চিকিৎসকের চেম্বারে চল্লিশ টাকা
বিদেশে বসবাসকালে স্বামীজি যে কয়েকশো চিঠি লিখেছিলেন তার কোথাও-কোথাও আমরা কয়েকজন সহৃদয় ডাক্তারের খবর পাচ্ছি যারা শুধু বিনামূল্যে সহায়সম্বলহীন সন্ন্যাসীর চিকিৎসা করেছিলেন তা নয়, প্রয়োজনে তারা স্বামীজিকে স্বগৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই সুযোগে আমরা তাদের গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই এবং লজ্জা প্রকাশ করি এই কারণে যে পাশ্চাত্যবাসীর কাঞ্চনপ্রীতি প্রাচ্যদেশ অপেক্ষা অনেক বেশি–এই গুজবটি আজও যথেষ্ট পরিমাণে ছড়ানো হয়ে থাকে।
অপরিচিত দেশে অপরিচিত চিকিৎসক বিনা পারিশ্রমিকে বিদেশির চিকিৎসা করতে উৎসাহী নাও হতে পারেন, কিন্তু নিজের জন্মনগরী খোদ কলকাতায় বিশ্ববন্দিত বিবেকানন্দ খ্যাতনামাদের কাছে কী আচরণ পেয়েছিলেন তার এক অস্বস্তিকর ইঙ্গিত এতদিন লুকিয়েছিল স্বামীজির গুরুভাই, রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের প্রথম সভাপতি স্বামী ব্রহ্মানন্দের নোটবুকে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ মঠ মিশনের খরচাপাতির নানা বিবরণ তার এই বইতে নিয়মিত টুকে রাখতেন। বহুযুগ পরে সেই দিনলিপির ছোট্ট একটি উদ্ধৃতি টীকাকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তা হয়তো তার কল্পনার বাইরে ছিল।
সময় অক্টোবর ১৮৯৮। ইংরিজি ভাষায় দিনলিপিতে উল্লেখ : “October 28, 1898. (1) Gone to Calcutta to settle Dr. R. L. Dutt to see Swamiji. October 29, 1898 : Paid to Dr. R. L Dutt Rs. 40/-. Paid for medicines and other expenses Rs. 10/-.”
উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে নগর কলকাতার উকিল, ব্যারিস্টার ও ডাক্তারদের অনেকের ভারতজোড়া খ্যাতি। দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে মক্কেল ও রোগীরা তাদের কাছে ছুটে আসতেন। কিন্তু তাদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ যে হিমালয় সদৃশ হতে পারে তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
অসুস্থ স্বামীজির জন্য ডাক্তারের এই ফি কি মঠে গিয়ে রোগী দেখার জন্য? না চেম্বারেই এই ৪০ টাকা দেয়? আজকের হিসেবে এই চল্লিশ টাকাটা কত? একশো না, দুশো নয়, তিনশ দিয়ে গুণ করলে কি কাছাকাছি একটা অঙ্কে পৌঁছনো যাবে?
স্বামীজির জীবনকালের শেষপর্বে চিকিৎসাখরচ যে কোথায় উঠতে পারে এবং আমাদের এই বাংলার একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে কেউ কেউ কেমন আর্থিক ব্যবহার করেছিলেন তার খোঁজখবর করাটা বোধহয় তেমন অন্যায় হবে না।
ডাক্তার আর এল দত্ত সম্পর্কেও কিছু বৃত্তান্ত হাতে পাওয়া গেল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগ্য কিছুটা ভালো, তার এক সায়েব চিকিৎসক রোগী দেখার পরে হাতে নগদ টাকা পাওয়া সত্ত্বেও তা সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পথ্য কেনবার জন্য। আর একজন ডাক্তার অর্থ তো নেনইনি, বরং তাঁর দেহাবসানের পরে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে, পকেট থেকে দশ টাকা বার করে দিয়ে ভক্তদের পরামর্শ দিয়েছিলেন বেঙ্গল ফটোগ্রাফারসকে ডেকে গ্রুপ ফটো তোলাতে। আরেকজন বিখ্যাত ডাক্তার খালি হাতে রোগীর কাছে যেতেন না, এক সময়ে নরেনের চিকিৎসা করতে এসেও রোগীকে তিনি একটি বেল উপহার দিয়েছিলেন। এই ডাক্তারের কাছ থেকেই শ্রীরামকৃষ্ণ সানন্দে একজোড়া চটি উপহার নিয়েছিলেন। যদিও উকিল ও ডাক্তারদের সম্বন্ধে তার মতামত তেমন ভালো ছিল না।
পরবর্তী পর্যায়ে ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানদের একজন প্রিয় চিকিৎসক ছিলেন শশী ডাক্তার। পুরো নাম ডাক্তার শশীভূষণ ঘোষ। রোগী বিবেকানন্দ এঁকে কয়েকটি অন্তরঙ্গ চিঠি লিখেছিলেন। তার একটিতে বিশ্বজয়ী সন্ন্যাসী আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যাকুল! কারণ ডাক্তারের কাছে এক গুরুভাই তার সম্বন্ধে রিপোর্ট দিয়েছেন–ডায়াবিটিক বিবেকানন্দ মিষ্টি খাচ্ছেন নিষেধ সত্ত্বেও।
২৯ মে ১৮৯৭ আলমোড়া থেকে শশী ডাক্তারকে স্বামী বিবেকানন্দের করুণ চিঠি : “যোগেন কি লিখছে তা হৃক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোলভাগের একভাগ খেয়েছিলাম, আর যোগেনের মতে ওই হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ।”
ডায়াবিটিস যে দত্তদের পারিবারিক ব্যাধি তার ইঙ্গিত রয়েছে কলকাতা কর্পোরেশন ডেথ রেজিস্টারে পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তের অকালমৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটি মন্তব্যে। রোগটি বহুমূত্র।
মার্কিন মুলুকে বড় বড় ডাক্তারদের সান্নিধ্যে এলেও সেখানে স্বামীজির ডায়াবিটিস ধরা পড়েনি। প্রথম প্রবাস সম্পন্ন করে প্রিন্স রিজেন্ট লিওপোল্ট জাহাজে নেপক্স থেকে স্বামীজি কলম্বোতে এলেন ১৫ জানুয়ারি ১৮৯৭। এই সময় (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭) তিনি লিখছেন, “আমি এখন মৃতপ্রায়…আমি ক্লান্ত–এতই ক্লান্ত যে যদি বিশ্রাম না পাই, তবে আর ছ’মাসও বাঁচব কিনা সন্দেহ।”
স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য কৃষ্ণলাল মহারাজের স্মৃতিচিত্র থেকে জানা যাচ্ছে, কলম্বোর ডাক্তাররাই স্বামীজির ডায়াবিটিস ধরেন এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসার পরামর্শ দেন। বলাবাহুল্য সেই সময়ে ডায়াবিটিস চিকিৎসা পদ্ধতির তেমন উন্নতি হয়নি এবং প্রাণদায়িনী ইনসুলিন তখনও অধরা।
ভগ্নস্বাস্থ্য স্বামীজির শরীর সম্পর্কে নানা বর্ণনা রয়েছে তার নিজের চিঠিতেই। তার মধ্যে মৃত্যুচিন্তাও এসে গিয়েছে। কলকাতার আলমবাজার মঠ থেকে আমেরিকায় মাতৃসমা মিসেস সারা বুলকে তিনি লিখছেন (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭), “যদি টাকা তোলবার আগেই আমার মৃত্যু হয়, তবে আপনি ওই টাকার সবটা তুলে আমার অভিপ্রায় অনুসারে খরচ করতে পারবেন। তা হলে আমার মৃত্যুর পর আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ আর ওই টাকা নিয়ে গোলমাল করতে পারবে না।”
এরপরে স্বাস্থ্যসন্ধানে স্বামীজির দার্জিলিং যাত্রা-২৬শে মার্চ ১৮৯৭। সেখান থেকে আর এক পত্রে মিসেস বুলকে তিনি তাঁর শরীর সম্পর্কে কিছু পারিবারিক খবরাখবর দিয়েছেন : “পশ্চিমে একটানা খাটুনি ও ভারতে একমাস প্রচণ্ড পরিশ্রমের পরিণাম বাঙালির ধাতে–বহুমূত্র রোগ। এ একটি বংশগত শত্রু এবং বড়জোর কয়েক বছরের মধ্যে এই রোগে আমার দেহাবসান পূর্বনির্দিষ্ট। শুধু মাংস খাওয়া, জল একেবারে না খাওয়া এবং সর্বোপরি, মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ বিশ্রামই বোধ হয়, জীবনের মেয়াদ বাড়াবার একমাত্র উপায়।”
আর এক চিঠির তারিখ ২৬ মার্চ ১৮৯৭। অর্থ-প্রসঙ্গে কলকাতাবাসীদের বিচিত্র ব্যবহার এই সময়ে স্বামীজির মানসিক দুঃখের কারণ হয়েছিল। তার ইঙ্গিত রয়েছে, ভারতী সম্পাদিকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়া সরলা ঘোষালকে দার্জিলিং থেকে লেখা আর একটা চিঠিতে–তারিখ ৬ এপ্রিল ১৮৯৭। ব্যাপারটা বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু স্বয়ং বিবেকানন্দ মনের দুঃখে নিজের কথা লিখে গিয়েছেন। কলকাতায় তাঁকে যে বিশেষ অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল, যথাসময়ে তার খরচের একটি বিল সংগঠকরা তাঁকেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে অভ্যর্থনা করিবার ব্যয়নির্বাহের জন্য কলকাতাবাসীরা টিকিট বিক্রয় করিয়া লেকচার দেওয়াইলেন এবং তাহাতেও সঙ্কুলান না হওয়ায় ৩০০ টাকার এক বিল আমার নিকট প্রেরণ করেন!!!” উদারহৃদয় সন্ন্যাসী অবশ্যই বিস্মিত, কিন্তু লিখছেন, “ইহাতে কাহারও দোষ দিতেছি না বা কুসমালোচনাও করিতেছি না; কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থবল ও লোকবল না হইলে যে আমাদের কল্যাণ অসম্ভব, ইহাই পোষণ করিতেছি।”
দার্জিলিং থেকে লেখা আরও কয়েকটি চিঠি থেকে স্বামীজির স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও ডায়াবিটিসের উল্লেখ, কোথাও ডাক্তারদের পরামর্শে খেতড়ির রাজা অজিত সিং-এর সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার খবর, আবার কোথাও দেহ বর্ণনা যা দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। মিস মেরী হেলকে (২৮ এপ্রিল ১৮৯৭) দার্জিলিং থেকে স্বামীজি লিখছেন, “আমার চুল গোছগোছ পাকতে আরম্ভ করেছে এবং আমার মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে–দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়স যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে–রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমনকী আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!! …আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ করেছে…হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিসই না ঢেকে রাখতে পারো! তোমারই জয় জয়কার।”
এই চিঠি লেখার তিন সপ্তাহ পরে স্বামীজির ঠিকানা আলমোড়া। ২০ মে ১৮৯৭ অভিন্নহৃদয় স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তিনি স্বাস্থ্যের রিপোর্ট দিচ্ছেন : “আরও ঠান্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারের গোল দাঁড়ায়। এখানে হাওয়া এত শুষ্ক যে দিনরাত নাক জ্বালা করছে এবং জিব যেন কাঠের চোকলা।…তুমিও-সব মুখ-ফুর্খদের কথা কি শোন? যেমন তুমি আমাকে কলায়ের দাল খেতে দিতে না–স্টার্চ বলে!! আবার কি খবর-না, ভাত আর রুটি ভেজে খেলে আর স্টার্চ থাকে না!!! অদ্ভুত বিদ্যে বাবা!! আসল কথা আমার পুরোনো ধাত আসছেন। …রাত্রির খাওয়াটা মনে করেছি খুব ‘লাইট’ করব; সকালে আর দুপুরবেলা খুব খাব, রাত্রে দুধ, ফল ইত্যাদি। তাই তো ওৎ করে ফলের বাগানে পড়ে আছি, হে কর্তা!!”
দু সপ্তাহ পরে (৩ জুন ১৮৯৭) যা স্বাস্থ্যের খবর পাওয়া যাচ্ছে তা তেমন ভালো নয়। “আমার দেহ নানাপ্রকার রোগে বারবার আক্রান্ত হচ্ছে এবং ‘ফিনিক্স পাখির মতন আমি আবার বারবার আরোগ্য লাভও করছি। …সব বিষয়েই আমি চরমপন্থী–এমনকী আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কেও তাই; হয় আমি লৌহদৃঢ় বৃষের মতো অদম্য বলশালী, নতুবা একেবারে ভগ্নদেহ.. যদি শেষ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তা হলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে–কেমন পারবে তো?”
আরও সতেরো দিন পরে স্বামীজির অদম্য উৎসাহ। প্রিয় ব্রহ্মানন্দকে আলমোড়া থেকে লিখছেন (২০ জুন ১৮৯৭) : “আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই, আর রাত্রে উঠিয়া প্রস্রাব বন্ধ, …কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই, লিভারও ভালো।”
পরবর্তী রিপোর্টের তারিখ ১৩ জুলাই ১৮৯৭। দেউলধার আলমোড়া থেকে প্রেমাস্পদ স্বামী ব্রহ্মানন্দকে চিঠি : “পেটটা বিষম ফুলিতেছে; উঠতে বসতে হাঁপ ধরে,…পূর্বে আমার দুইবার ‘সান-স্ট্রোক হয়। সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই-তিন-দিন শরীর খারাপ যায়।” এই সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য খবর : “ স্যাকারিন ও ‘লাইম’ এসেছে।”
আশা-নিরাশার দোলায় নিরন্তর দুলে চলেছেন আমাদের অনন্তবিস্ময় স্বামী বিবেকানন্দ। বেলুড় মঠ থেকে ১৯ আগস্ট ১৮৯৭ মিসেস ওলি বুলকে তিনি নিজের হাতে লিখছেন, “আমার শরীর বিশেষ ভালো যাচ্ছে না…আগামী শীতের আগে পূর্বশক্তি ফিরে পাবো বলে বোধ হয় না।”
পরের মাসে (৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৭) শ্রীনগর কাশ্মীর থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে বিস্ময়কর সংবাদ :”সাধারণ স্বাস্থ্য খুব ভালো ও ডায়াবেটিস অনেকদিন ভাগলওয়া হয়েছেন–আর কোনও ভয় করব না।” ডায়াবিটিস যে দুরারোগ্য, একবার হলে সারাজীবন যে কেবলমাত্র তাকে আয়ত্তে রাখবার চেষ্টা চলতে পারে সেখবর তখনও বোধহয় সাধারণের কাছে অজ্ঞাত।
এই রোগ সম্বন্ধে আরও আলোকপাত করছেন স্বামীজি নিজেই বেলুড়মঠ হাওড়া থেকে ২ মার্চ ১৮৯৮। লিখছেন মার্কিন মুলুকে স্নেহের মিস মেরী হেলকে : “লন্ডন থেকে ফিরে এসে যখন আমি দক্ষিণ ভারতে এবং যখন লোকেরা আমাকে উৎসবে ভোজে আপ্যায়িত করছে এবং আমার কাছ থেকে ষোল আনা কাজ আদায় করে নিচ্ছে, এমন সময় একটি বংশগত পুরোনো রোগ এসে দেখা দিল। রোগের প্রবণতা (সম্ভাবনা) সব সময়ই ছিল, এখন অত্যধিক মানসিক পরিশ্রমে তা আত্মপ্রকাশ করল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে এল সম্পূর্ণ ভাঙন ও চূড়ান্ত অবসাদ।”
কিন্তু নিরাশ হতে প্রস্তুত নন আমাদের রোগজর্জরিত নায়ক। “তুমি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ো না, কারণ রোগটা আরও দুই তিন বছর আমাকে টেনে নিয়ে যাবে। বড়জোর নির্দোষ সঙ্গীর মতো থেকে যেতে পারে। আমার কোন খেদ নেই।…বহুদিন আগে যেদিন জীবনকে বিসর্জন দিয়েছি, সেইদিনই আমি মৃত্যুকে জয় করেছি।”
ডায়াবিটিস ছাড়াও অন্য কয়েকটি রোগের নিগ্রহ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। ২৮ আগস্ট ১৮৯৮ শ্রীনগর, কাশ্মীর থেকে আমেরিকায় স্নেহের মেরী হেলকে স্বামীজি খবর দিচ্ছেন, “আমি খুশি যে, দিন-দিন আমার চুল পাকছে। তোমার সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাতের পূর্বেই আমার মাথাটি পূর্ণ-বিকশিত একটি শ্বেতপদ্মের মতো হবে।”
রসিকতা করে স্বামীজি পরিস্থিতি যতই হালকা করুন, কাশ্মীরে তিনি যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তা কারও অজানা নয়। যা তেমন জানা নয়, চিকিৎসার খরচে বিব্রত কপর্দকশূন্য সন্ন্যাসীর মনোবেদনা। বিব্রত সন্ন্যাসী এই অবস্থায় দুখানি চিঠি লিখেছিলেন দুঃখদিনের দুই বন্ধুকে। দুটি চিঠিরই তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮।
স্নেহের হরিপদ মিত্রকে লিখছেন : “মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরি হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যেই পাঞ্জাবে যাইবার কল্পনা ছিল। …আমার সঙ্গে এবার কেহ নাই। দু’জন আমেরিকান লেডি ফ্রেন্ড মাত্র আছেন। ..আমার এখানকার সমস্ত খরচপত্র উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাহাদের নিকট হইতেই লইব। তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর–এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।”
অবস্থা কতটা সঙ্গীন হলে সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে স্বামীজির মতন মানুষ এমন চিঠি লিখতে পারেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
অর্থের এমনই প্রয়োজন যে একই দিনে (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮) তার আর্থিক পরিত্রাতা খেতড়ির মহারাজা অজিৎ সিংকে আর একটি চিঠি লেখেন। “এখানে আমি দু-সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। এখন সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমার কিছু টাকার টান পড়েছে। যদিও আমেরিকান বন্ধুরা আমাকে সাহায্যের জন্য তাদের সাধ্যমতো সবকিছুই করছেন, কিন্তু সবসময়ই তাদের কাছে হাত পাততে সঙ্কোচ হয়, বিশেষত অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না, এবং তিনি হলেন আপনি। আপনি দিলেন কি না দিলেন–আমার কাছে দুই সমান। যদি সম্ভব হয়, অনুগ্রহ করে কিছু টাকা পাঠাবেন।”
বোঝা যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে মহারাজের সঙ্গে টেলিগ্রামে কিছু সংবাদ চালাচালি হয়েছিল, মনে হয় তারে’ (টেলিগ্রাফিক মানি অর্ডার) কিছু অর্থ খেতড়ি থেকে শ্রীনগর পাঠানো হয়েছিল। ১৬ অক্টোবর ১৮৯৮ স্বামীজির চিঠি : “মহামান্য মহারাজ, আমার ‘তারের পরে যে চিঠিখানা গিয়েছে, তাতে আপনার অভিপ্রেত সংবাদ ছিল; সেজন্য আপনার তারের উত্তরে আমার স্বাস্থ্যের সংবাদ দিয়ে আর কোনও তার করিনি।”
একই দিনে লাহোর থেকে হরিপদ মিত্রকে লেখা চিঠিতে আবার অর্থের উল্লেখ। “কাশ্মীরে স্বাস্থ্য একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে এবং ৯ বৎসর যাবৎ দুর্গাপূজা দেখি নাই–এ বিধায় কলিকাতা চলিলাম। …৫০ টাকা আমার গুরুভ্রাতা সারদানন্দ লাহোর হইতে করাচি পাঠাইবেন।”
‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের মন্তব্য : “স্বামীজি তখন কপর্দকশূন্য ছিলেন–আমেরিকান মহিলাদের অর্থে তাহার ব্যয় নির্বাহ হইত, ভারত হইতে তিনি কিছুই পাইতেন না।”
লাহোর থেকে ১৬ অক্টোবর (১৮৯৮) স্বামী সদানন্দের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় চললেন, বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে পৌঁছলেন ১৮ অক্টোবর। তাঁর শরীরের অবস্থা দেখে মঠের মানুষদের চিন্তার অবধি নেই। :
এবার শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর বিখ্যাত বই ‘স্বামী শিষ্য সংবাদে’ আসা যাক। স্থান-বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠ-বাটী। “কাল-নভেম্বর ১৮৯৮”, মনে হয় সময়টি ভুল, অক্টোবর হবে, কারণ পরিচ্ছেদের শুরু : “আজ দুই-তিনদিন হইল স্বামীজি কাশ্মীর হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন।”
স্বামীজির শরীর তেমন ভালো নেই। “শিষ্য মঠে আসিতেই স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলিলেন, কাশ্মীর থেকে ফিরে আসা অবধি স্বামীজি কারও সঙ্গে কোনও কথাবার্তা কন না, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। তুই স্বামীজির কাছে গল্পসল্প করে স্বামীজির মনটা নীচে আনতে চেষ্টা করিস।…শিষ্য স্বামীজির ঘরে গিয়া দেখিল, স্বামীজি মুক্ত-পদ্মাসনে পূর্বাস্য হইয়া বসিয়া আছেন…মুখে হাসি নাই। …স্বামীজির বামনেত্রের ভিতরটা রক্তবর্ণ দেখিয়া শিষ্য জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার চোখের ভিতরটা লাল হয়েছে। কেন?’ ‘ও কিছু না বলিয়া স্বামীজি পুনরায় স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন।”
শিষ্য তামাক সাজিয়ে দিল। আস্তে আস্তে ধূমপান করতে করতে স্বামীজি বললেন, অমরনাথ যাবার কালে পাহাড়ের একটা খাড়া চড়াই ভেঙে উঠেছিলুম। যে রাস্তায় যাত্রীরা কেউ যায় না…আমার কেমন রোক হ’ল, ওই পথেই যাব। যাব তো যাবই। সেই পরিশ্রমে শরীর একটু দমে গেছে।
শিষ্য। শুনেছি, উলঙ্গ হয়ে অমরনাথকে দর্শন করতে হয়। কথাটা কি সত্য?
স্বামীজি। হাঁ, আমিও কৌপীনমাত্র পরে ভস্ম মেখে গুহায় প্রবেশ করেছিলাম।”
বেলুড়ে ফেরার পরে স্বামীজির চিকিৎসার জন্য কলকাতার সেরা ডাক্তারের খোঁজখবর পড়ে যায়। সবারই ধারণা বিশ্ববন্দিত বিবেকানন্দকে কোন্ ডাক্তারই না, বিশেষ করে বাঙালি ডাক্তার চিকিৎসা করতে আগ্রহী হবেন?
ডাক্তার-সন্ধানে প্রধান ভূমিকায় স্বামী ব্রহ্মানন্দ। তার দিনলিপিতে ছোট্ট একটি নোটিং : ২৮ অক্টোবর ১৮৯৮ তিনি কলকাতায় যান ডাক্তার আর এল দত্তর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করতে।
এই ডাক্তার দত্ত সম্বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনেকের কৌতূহল। এঁর সম্বন্ধে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি তার প্রধান সূত্র মহানগরীর– সুবৰ্ণবণিক সমাজ। উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ডাঃ দত্তর খ্যাতি ভারতজোড়া। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথায় তার কাছে চিকিৎসা করানোর বিবরণও নজরে এসেছে। আরও যা আকর্ষণীয়, তার পারিবারিক বাড়ি পঞ্চাননতলা হাওড়ায় যেখানকার চৌধুরীবাগানে এই প্রতিবেদকের বহুবছর কেটেছে।
ইদানীং এই খ্যাতনামা চিকিৎসক সম্বন্ধে যা জানতে পেরেছি তার কিছুটা অংশ কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবেদন করতে চাই। আমাদের এই খবরের প্রধান উৎস সুবর্ণবণিক কথা ও কীর্তি।
রসিকলাল দত্ত কলকাতায় লেফটেনান্ট কর্নেল আর এল দত্ত নামে পরিচিত ছিলেন। গুরুচরণ দত্ত ও দিগম্বরী দত্তর তিনি চতুর্থ পুত্র, জন্ম ২০ আগস্ট ১৮৪৫। তার যখন একবছর বয়স তখন পিতৃদেব হাওড়ায় চলে আসেন। দত্তদের আদিবাড়ি স্বামী প্রেমানন্দের পৈতৃক বাড়ি আটপুরে, যেখানে স্বামীজির অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে।
রসিকলাল দত্তের ব্যক্তিজীবন এমনই নাটকীয় যে তার সামান্য ইতিবৃত্ত এখানে লিপিবদ্ধ করার অপরাধ মার্জনীয়। প্রথমে পাঠশালা, পরে এগারো বছর বয়স পর্যন্ত রেভারেন্ড গোপাল মিত্রর অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুলে অধ্যয়ন। তারপর হাওড়া জেলা ইস্কুল।
প্রতিবছর ডবল প্রমোশন পেয়ে ১৪ বছর বয়সে রসিকলাল সেকেন্ড ক্লাসে উঠলেন। “সেই বৎসর প্রবেশিকা পরীক্ষার মাত্র তিন মাস বাকি। প্রবেশিকা-ক্লাসে পরীক্ষা পাশ করার উপযুক্ত কোনও ছাত্র ছিল না। সেইজন্য হেডমাস্টার রসিকলালকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই তিন মাসে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উপস্থিত হবার মতো পড়া তৈরি করতে পারবে কিনা।” রসিকলাল রাজী হলেন এবং ১৮৫৯ সালে ১৪ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।
তখনকার দিনকাল অন্যরকম। একইসঙ্গে ভুবনবিদিত প্রেসিডেন্সি কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব ছিল। তখনও গঙ্গার ওপর ভাসমান সেতু তৈরি হয়নি, রসিকাল প্রত্যেকদিন নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে কলেজ করতেন। কিছুদিন পরে ডাক্তারির দিকে ঝুঁকে পড়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে দেন।
১৮৬২-৬৩ সালে রসিকলাল মেডিক্যাল কলেজের ডিপ্লোমা পাশ করেন এবং একই বছরে খিদিরপুরের গোলাপমোহিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহিত হন।
মেডিক্যাল কলেজে পড়তে পড়তেই রসিকলাল ডাক্তারি প্র্যাকটিশ শুরু করেন। শোনা যায় ফিফথ ইয়ারে পড়বার সময়েই তার বিশাল পসার, মাসিক উপার্জন ৬০০ টাকা! “রোগী দেখিবার জন্য তিনি ১৬ জন পাল্কি-বেয়ারা নিযুক্ত করেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিশে তিনি এমনই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে ডাক্তারির ফাঁইনাল পরীক্ষায় তিনি উপস্থিত হতে পারলেন না, “এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ তাঁহার অদৃষ্টে ঘটে নাই।”
১৮৭০ সালে রসিকলালের জীবনে প্রবল আঘাত এল। হাওড়া শালকিয়ায় এক মহিলার জটিল চিকিৎসার ব্যাপারে হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তাররা এসে ব্যর্থ হন। তখন রসিকলালকে ডাকা হয়। তাঁকে আসতে দেখে হাসপাতালের সার্জন বিরক্ত হন এবং মাতাল ও হাতুড়ে ডাক্তার বলে বিদ্রূপ করেন।
রোগিণীকে নিরাপদে প্রসব করিয়ে বাড়ি ফিরে অপমানিত রসিকলাল দত্ত শয্যাগ্রহণ করলেন। সার্জেনের বিদ্রুপের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন, তিনি বিলেত গিয়ে ডাক্তার হতে চান। দাদা বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত যতক্ষণ না অনুমতি দিচ্ছেন ততক্ষণ তিনি বিছানা ছেড়ে উঠবেন না। চতুর্থদিনে মায়ের অনুরোধে দাদা অনুমতি দিলেন, তবে জানিয়ে দিলেন বিলেতে যাবার এবং পড়াশোনার খরচপত্র তিনি বহন করতে পারবেন না।
ফ্লাইং ফোম নামে পালবাহী জাহাজে ডাক্তারের কাজ নিয়ে ১৮৭০ সালের মার্চ মাসে রসিকাল এদেশ থেকে ত্রিনিদাদ যাত্রা করলেন। এই জাহাজে ভারতবর্ষ থেকে পাঁচশো কুলি পাঠানো হয়েছিল।
সিংহল, বিষুবরেখা, মাদাগাস্কার অতিক্রম করে পালতোলা জাহাজ যখন আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে চলল, তখন প্রবল ঝড় জাহাজকে ঠেলে ৪০০ মাইল দক্ষিণে নিয়ে গেল এবং ভীষণ বেগে একটা ভাসমান বরফ স্কুপের উপর নিক্ষেপ করল। ফ্লাইং ফোম সেই স্কুপে আটকে গেল।
“ওজন কমিয়ে জাহাজ রক্ষার জন্য কাপ্তেন ২০০ মণ চাল ও ডাল সমুদ্রে ফেলে দেবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু অনাহারের আশঙ্কায় কুলিরা গোলযোগ আরম্ভ করলো।”
জাহাজের ডাক্তার রসিকলাল অনেক চেষ্টায় অবস্থা সামাল দিয়ে, বিদ্রোহীদের “প্রিজন সেলে নিয়ে যান এবং তথায় আবদ্ধ করেন।”
দশদিন এই অবস্থায় থাকার পরে, একাদশ দিনে দূরে একটা বাষ্পীয় পোত দেখা গেল এবং এই জাহাজটি বিপন্ন পালতোলা জাহাজকে বরফ-স্কুপ থেকে মুক্ত করে, টানতে টানতে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে পৌঁছে দিল। দুস্তর পারাবার পেরিয়ে যাত্রার চার মাস পরে ফ্লাইং ফোম জাহাজ ত্রিনিদাদ পৌঁছলো।
ফ্লাইং ফোম জাহাজের চাকরি ইস্তফা দিয়ে রসিকলাল যে ডাক জাহাজে এবার ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করলেন সেটিও পাল ও দাঁড়বাহী। লন্ডনে এসেও নবাগত রসিকলাল নানা বিপদে পড়েন। নিরুপায় হয়ে শহরের ডিরেক্টরি দেখে লন্ডনের এক বাঙালি ডাক্তারকে (ক্ষেত্রমোহন দত্ত) তিনি তার করেন এবং ক্ষেত্রমোহন দয়াপরবশ হয়ে তাকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। পরবর্তী পর্যায়ে লন্ডনে যাঁদের সঙ্গে রসিকলাল একটা বাসা ভাড়া করেন তাদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত তারকনাথ পালিত, কিশোরীমোহন চট্টোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও গিরিশচন্দ্র মিত্র।
লন্ডন থেকে যথাসময়ে রসিকলাল যেসব ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করেন তাদের মধ্যে রয়েছে এম বি, এম আর সি এস ও এম ডি। এই সময়ে আই এম এস পরীক্ষায় বসবার জন্যে চেষ্টা করেন। সঙ্গে গোপাল রায় ও ডাক্তার কে ডি ঘোষ। শেষের মানুষটি ঋষি রাজনারায়ণ …বসুর জামাই এবং শ্রীঅরবিন্দের বাবা খ্যাতনামা সিভিল সার্জেন কৃষ্ণধন
ঘোষ। এঁদের আবেদন, যতদিন না আই এম এস পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হচ্ছে ততদিন, নেটুলে মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলে তাদের সুযোগ দেওয়া হোক। কিন্তু ইন্ডিয়া অফিস এই দরখাস্ত না-মঞ্জুর করেন। হতাশ হয়ে রসিকলাল দেশে ফিরে আসেন ১৮৭১ সালে এবং ডিব্রুগড়ে মেডিকেল অফিসার নিযুক্ত হন। কাজে যোগ দেবার জন্যে রসিকলাল যখন প্রস্তুত হচ্ছেন সেই সময় লন্ডন থেকে নতুন খবর এল ফেব্রুয়ারি ১৮৭২ সালে। ৪০ জন বিদেশিকে আই এম এস পরীক্ষায় বসবার অনুমতি দেওয়া হবে।
পরীক্ষার মাত্র আটদিন আগে রসিকলাল আবার লন্ডনে হাজির হতে পারলেন। আই এম এস-এ সফল হয়ে, নেটুলে মিলিটারি ট্রেনিং স্কুলে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং নিয়ে রসিকলাল লেফটেনান্ট পদ লাভ করলেন এবং ৫১ আইরিশ রেজিমেন্টে কাজ নিয়ে ১৮৭২ নভেম্বর মাসে বম্বেতে হাজির হলেন।
১৮৯৩ সালে রসিকলাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অফিসিয়েটিং প্রফেসর। পরবর্তী পদ বর্ধমান এবং যথাসময়ে হুগলির সিভিল সার্জন।
কোনও এক সময়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ খালি হল। “উক্ত পদে তার দাবি সমধিক ছিল। কিন্তু তিনি বাঙালি বলে তাকে নিযুক্ত করা হল না; একজন জুনিয়র ইংরেজ কর্মচারীকে প্রিন্সিপ্যাল নিযুক্ত করায় তেজস্বী রসিকলাল দু’বছরের ফার্লো আবেদন করে চাকরি থেকে অকাল অবসর গ্রহণ করেন।”
স্বামীজি যে-বছর নানা অসুখে জর্জরিত (১৮৯৮) সেই বছরই রসিকলাল কলকাতায় স্বাধীনভাবে চেম্বার খুলে প্র্যাকটিশ আরম্ভ করে বিপুল সাফল্য অর্জন করেন।
এখন প্রশ্ন, স্বামীজিকে ডাক্তারের কোন চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন পরম বিশ্বস্ত স্বামী ব্রহ্মানন্দ? এই ব্যবস্থা পাকা করতেই তো স্বামী ব্রহ্মানন্দ ২৮ অক্টোবর ১৮৯৮ বেলুড় মঠ থেকে কলকাতায় গিয়েছিলেন। এর উত্তর কঠিন নয়–২ নম্বর সদর স্ট্রিট, ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের উত্তরদিকের পথ। এই রাস্তায় একসময় ভাড়াটে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই বাড়িতে বসেই একদিন ভোরে কবি রবীন্দ্রনাথ ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি লিখেছিলেন। সদর স্ট্রিটের ২ নম্বর বাড়িতে রসিকলাল যে বিশাল পসার জমিয়ে বসেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তবে স্বামীজির চেম্বারে আসার তারিখটা নিয়ে একটু গোলমাল রয়েছে। যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইটির তৃতীয় খণ্ডের ১৫০ পাতায় স্বামী গম্ভীরানন্দ ২৭ অক্টোবর ১৮৯৮ উল্লেখ করছেন, অথচ একই পাতার ফুটনোটে স্বামী ব্রহ্মানন্দের নোট বইতে উল্লেখ, ২৮ অক্টোবর তিনি সব ব্যবস্থা পাকা করতে কলকাতায় ডাক্তার আর এল দত্তের কাছে গিয়েছিলেন।
স্বামী গম্ভীরানন্দ নোট বইকেই নির্ভর করা আমাদের পক্ষে যুক্তিযুক্ত হবে, এবং সেক্ষেত্রে রোগী দেখার তারিখ ২৯ অক্টোবর ১৮৯৮।
এখন বিবেকানন্দ-অনুরাগীদের কৌতূহল, সদর স্ট্রিটে স্বামীজির কী চিকিৎসা হয়েছিল? স্বামীজির চিকিৎসার কোনও প্রেসক্রিপশন কারও সংগ্রহে আছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রেসক্রিপশন তো দূরের কথা তার ডেথ সার্টিফিকেটও আমাদের আয়ত্তের বাইরে।
ডাক্তার আর এল দত্তের সদর স্ট্রিটের চেম্বার সম্বন্ধে আমাদের খবরাখবর সীমাবদ্ধ। স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে আমরা জানি স্বামীজির ওষুধের খরচ লেগেছিল দশ টাকা। এবং স্বামী গম্ভীরানন্দ লিখেছেন, “তদানীন্তন সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার আর এল দত্তের নিকট তাহার বুক পরীক্ষা করানো হয়, কবিরাজদেরও সাহায্য লওয়া হয়। উক্ত ডাক্তারবাবু ও কবিরাজগণ সকলেই বলিয়া দেন, সাবধানে থাকা উচিত, নতুবা রোগ প্রবলাকার ধারণ করিতে পারে।”
ডাক্তার রসিকলাল দত্তর চিকিৎসা-বিশেষত্ব সম্বন্ধে আমরা যা জানতে পেরেছি তা এইরকম : “প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য চিকিৎসা-কৌশলের সমন্বয়ই তাকে চিকিৎসক-শিরোমণিরূপে পরিণত করেছিল এবং ওইটাই ছিল তার চিকিৎসার বিশেষত্ব। তিনি ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র প্রথমবার বিলাত যাওয়ার পূর্ব থেকে কিছু কিছু অধ্যয়ন করতেন।…ভারতবর্ষে ফিরে আসবার পর তিনি চরক, সুশ্রুত, বাদ্ভট প্রভৃতি চিকিৎসা গ্রন্থ পুনরায় অধ্যয়ন করে উভয় বিদ্যায় পারদর্শী হয়েছিলেন। বিশেষত ভারতীয় দ্রব্যগুণ তিনি বিশেষভাবে আয়ত্ত করেন। এইভাবে তিনি ক্রমে আয়ুর্বেদীয় পথ্যের অনুরাগী হন এবং রোগ-নির্ণয়েও ভারতীয় প্রথা অনেকাংশে অবলম্বন করেন।”
ডায়াবিটিস, হৃদরোগ ও নিদ্রাহীনতা রোগে জর্জরিত সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ যে শেষপর্যন্ত বড় ডাক্তারের কড়ি জুগিয়েও তেমন কিছু শারীরিক সুফল পাননি তার ইঙ্গিত জীবনীকারদের রচনায় রয়েছে। স্বামীজির স্বাস্থ্যের আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না দেখে শুভানুধ্যায়ীরা স্থির করলেন অন্যত্র বায়ুপরিবর্তন প্রয়োজন। সেইমতো ব্রহ্মচারী হরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ স্বামীজি বৈদ্যনাথধাম যাত্রা করলেন। সেখানে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে ২২ জানুয়ারি ১৮৯৯ তিনি কলকাতায় ফিরলেন। দেওঘরে তার শরীর এত খারাপ হয় যে টেলিগ্রাম পেয়ে স্বামী সারদানন্দ ও স্বামী সদানন্দ বেলুড় থেকে সেখানে ছুটে যান।
দেওঘরে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে সময় সময় স্বামীজির এত শ্বাসকষ্ট হত যে মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠত, সর্বাঙ্গে আক্ষেপ হতে এবং উপস্থিত সকলে মনে করতেন, বুঝিবা প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যাবে। স্বামীজি বলেছেন, এই সময় একটা উঁচু তাকিয়ার ওপর ভর দিয়ে বসে তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতেন, ভিতর থেকে যেন নাদ উখিত হত–”সোহহং সোহহং”।
এই সময়ে শ্রীমতী ম্যাকলাউডকে স্বামীজির চিঠি (২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯) : “বৈদ্যনাথে বায়ুপরিবর্তনে কোনও ফল হয়নি। সেখানে আট দিন আট রাত শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি। ডাক্তার সরকার এখন আমার চিকিৎসা করছেন।”
আমরা ২ সদর স্ট্রিটের প্রসঙ্গ এখনও শেষ করিনি। স্বামী ব্রহ্মানন্দের fraria on oma Giaco hooo : Paid to Dr. R. L. Dutt Rs 40/-… তারিখ ২৯ অক্টোবর ১৮৯৮। দরিদ্র সন্ন্যাসী চেম্বারে ডাক্তারের নগদ কড়ি দিচ্ছেন চল্লিশ টাকা উনিশ শতকের কলকাতায়! বিশ্বাস হতে চায় না! আজকের মূল্য মানে সেই চল্লিশ টাকা কত? চার হাজার, না আট হাজার, না বারো হাজার তা হিসেব করে লাভ কী? চিকিৎসার খরচের বোঝায় আমাদের প্রিয় মহামানব বিব্রত ও বিধ্বস্ত হয়েছিলেন সেকথা ভেবে এতদিন পর লাভ কি?
ডাক্তার রসিকলাল দত্ত সম্পর্কে আরও যা জানতে পেরেছি–একমাত্র পুত্র জহরলালকে তিনি রানিগঞ্জের কাছে ভসকাজুলী নামে কয়লাখনি কিনে দেন। ১৮৯৪ সালে ৪ জানুয়ারি দুটি কন্যা ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে পুত্র জহরলাল পরলোকগমন করেন। ১৮৯৪ সালের ১৭ এপ্রিল রসিকলালের পৌত্র রঙ্গলাল দত্তের জন্ম। প্রথম পৌত্রী আশালতা চ্যাটার্জি পরবর্তীকালে বিখ্যাত ডাক্তার কর্নেল কে কে চ্যাটার্জির পত্নী। দ্বিতীয় পৌত্রী অনারেবল মিসেস শান্তিলতা সিংহ লর্ড সিংহের পুত্র অনারেবল শিশিরকুমার সিংহের সহধর্মিণী। ১৯০৮ সালে রসিকলাল-পত্নী গোলাপমোহিনীর দেহত্যাগ। তার মৃত্যুর দু’মাস পরে রসিকলাল ৪ নম্বর ময়রা স্ট্রিটে বাড়ি কেনেন।
জীবনের শেষদিকে পুত্রশোকাতুর ডাক্তার রসিকলাল দত্ত দৃষ্টিহীন হয়ে যান। এই অবস্থায় জীবন-ধারণ করা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হয়েছিল, তিনি নাকি প্রায়ই বলতেন—”ভগবান আমাকে শীঘ্র নাও, আমার কাজ শেষ হয়েছে।”