০২. পিতৃদেবের বেনামা উপন্যাসে পরিবারের গোপনকথা

পিতৃদেবের বেনামা উপন্যাসে পরিবারের গোপনকথা

অবশ্বাস্য বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে তার ভিটেবাড়ির আত্মীয়স্বজনদেরও যে বোঝা দরকার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

স্বামীজির প্রাক্সন্ন্যাসজীবনের বিভিন্ন খুঁটিনাটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহও বেড়ে চলেছে। শৈশবে, কৈশোরে, বাল্যে ও যৌবনে কেমন দেখতে ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত? কোথায় গেল আদিপর্বের আলোকচিত্রমালা? তার মা, বাবা, ভাইবোন সম্পর্কে আমরা কেন আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না, ইত্যাদি নানা প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছেন বিশিষ্ট বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানীরা।

কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা পর্বের আগে নরেন্দ্রনাথের কোনো ফটো তোলা হয়নি তা মানতে মন চায় না। যেমন বিশ্বাস হতে চায় না যে সফল আইনজীবী ও দেশে দেশে পরিভ্রমণকারী, অভিজাতরুচি পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত মহাশয়ের কোনো ফটোগ্রাফ তোলা হয়নি। এ বিষয়ে দত্তপরিবারের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য : সবই ছিল, কিন্তু সবই হারিয়ে গিয়েছে পারিবারিক বিরোধে ও বারংবার পুলিসি খানাতল্লাশিতে।

পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের নিতান্ত আপনজনদের ভিটেবাড়ি থেকে আচমকা উৎখাতের প্রসঙ্গে যথাসময়ে আসা যাবে। বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দর মহাসমাধির পরবর্তী দশকে ইংরেজ পুলিসের বিষদৃষ্টিতে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তভিটেতে বহুবার তল্লাশি চলে এবং শাসকরা প্রতিবারই দেওয়ালের ছবি থেকে ট্রাঙ্কের কাগজপত্র, কাপড়চোপড় সব বাজেয়াপ্ত করে সঙ্গে নিয়ে যান।

এই অত্যাচারের ফলে ঐতিহ্যমণ্ডিত দত্ত পরিবারের অনেক নিদর্শন নষ্ট হয়েছে, বিবেকানন্দ ভিটেতে কাঠের দরজা জানলা, ইটের দেওয়াল, সিমেন্টের মেঝে এবং ছাদ ছাড়া আর কিছুই অতীতের ধারাবাহিকতা বহন করছে না। এবাড়ির যা কিছু খবরাখবর তা সংগ্রহ হয়েছে মানুষের স্মৃতিকথা থেকে এবং মূল্যবান আদালতি রেকর্ড থেকে।

দত্তপরিবারের শরিকি লড়াই প্রায় মহাপ্রয়াণের দিন পর্যন্ত স্বামীজিকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। কখনও প্রায় দেউলিয়া, কখনও সর্বস্বান্ত হয়েছেন দত্ত নামধারী পুরুষ ও মহিলারা। কিন্তু সব অমঙ্গলেরই একটা মঙ্গলময় দিক থাকে। স্বামীজির আপনজনদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন আদালতি সূত্র থেকেই অনুরাগীরা উদ্ধার করতে পেরেছেন।

তবু যতটুকু জানা গিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য এখনও অজানা থেকে গিয়েছে স্বামীজির গর্ভধারিণী জননী, পিতৃদেব এবং আত্মঘাতিনী বোনদের সম্পর্কে। ভাইদের সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু জানি আবার অনেককিছু জানি নাও বটে। জননী ভূবনেশ্বরী সম্পর্কে আজও কৌতূহলের বিরাম নেই বহুযুগ আগের দুই ভুবনবিদিতা জননী শঙ্করাচার্যমাতা ও চৈতন্যজননী সম্পর্কেও ভক্তজনের একই ধরনের ব্যাকুলতা।

সুদূর প্রবাসেও স্বামীজি তার গর্ভধারিণী জননী সম্পর্কে মাঝে মাঝে কিছু হৃদয়গ্রাহী মন্তব্য করেছেন। স্বামীজির বিদেশিনী অনুরাগিনীরাও তাদের গুরুদেবের জননীকে মার্কিনদেশ থেকে অভিনন্দন পাঠিয়েছেন।

ভূবনেশ্বরী সস্পর্কে প্রাচীনতম নিদর্শনটি হল কলকাতা হাইকোর্টের কাগজপত্রে একটি বাংলা সই, যা দেখে বোঝা যায় তার হস্তলিপি খুবই সুন্দর ছিল। আমরা জানি তিনি মেমদের কাছ থেকে ইংরিজি পাঠ নিয়েছিলেন এবং বড় ছেলেকে ইংরিজি শিখিয়েছেন। পরবর্তীকালে সাগরপারের কয়েকজন ভক্ত ও ভক্তিমতীর সঙ্গেও তিনি ইংরিজিতে কথা কইতেন, কিন্তু তার ইংরিজি লেখার কোনো নিদর্শন আজও উদ্ধার হয়নি। এতোদিন বিবেকানন্দ-জননীর একটিমাত্র আলোকচিত্রই ছিল ভরসা। স্বামীজির দেহাবসানের পর বিদেশিনীদের অর্থে সিস্টার নিবেদিতা এই ছবি তোলবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভূবনেশ্বরী দেবী ও নিতান্ত আদরের একমাত্র সন্তানের ভাগ্যবিপর্যয়ে সর্বদাকাতর বিবেকানন্দমাতামহী রঘুমণি দেবীর আলোকচিত্র মনে হয় একই সময়ে তোলা হয়েছিল।

অতিসম্প্রতি বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী ভূবনেশ্বরী দাসীর দ্বিতীয় একটি ছবি অধ্যাপক শ্রীসুজিত বসুর সৌজন্যে আমাদের নজরে এসেছে। নির্মম : দারিদ্র্য, বিচ্ছেদ, আত্মীয়দের অপমান ও অকালমৃত্যুতে জর্জরিত বিবেকানন্দজননীর এই হৃদয়বিদারক ছবিটি ব্রহ্মানন্দ উপাধ্যায় সম্পাদিত স্বরাজ পত্রিকায় বৈশাখ ১৩১৪ প্রকাশিত হয়েছিল।

স্বরাজ পত্রিকায় লেখা হয়, “আমরা নরেন্দ্রের মাতার চিত্র দিলাম। নরেন্দ্রের মাতা রত্নগর্ভা। মা–অমন রত্ন হারাইয়াছেন। হারাইয়াছেন কি ব্যবহারতঃ হারাইয়াছেন–পরমার্থতঃ হারান নাই। তাঁহার জ্যেষ্ঠ সুতের চরিত্রসৌরভে ভারত আমোদিত। আহা–মায়ের ছবিখানি দেখ– দেখিলে বুঝিতে পারিবে যে নরেন্দ্র মায়ের ছেলে বটে–আর মাতা ছেলের মা বটে।”

দুঃখের বিষয় ভূবনেশ্বরী দেবীকে লেখা অথবা তার নিজের হাতে পুত্রকে লেখা কোনো চিঠি এখনও সংগৃহীত হয়নি। আমরা জানি, মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ ভাগ্যসন্ধানে বিদেশে গমন করে অজ্ঞাত কারণে বহু বছর অদৃশ্য হয়েছিলেন এবং দীর্ঘসময় ধরে পদব্রজে বহুদেশ ভ্রমণ করে স্বামীজির দেহাবসানের কয়েকদিন পরে কলকাতায় ফিরে আসেন। চার পাঁচবছর মাকে একখানাও চিঠি না লিখে মহেন্দ্রনাথ তাঁর মা ও নরেন্দ্রনাথের উদ্বেগ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেন।

কিন্তু স্বামীজির মাতৃঅনুরাগের কথা তো আমাদের অজ্ঞাত নয়। দীর্ঘকাল স্বদেশ ও বিদেশের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে নিজের মাকে তিনি কখনও কোনো চিঠি লেখেননি তা ভাবতে ইচ্ছে করে না। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, মহেন্দ্রনাথ বা তার ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ কোথাও দাদার লেখা কোনো চিঠির উল্লেখ করেননি। যতদূর জানা যায়, স্বামীজির দিদি স্বর্ণময়ীও এবিষয়ে কোনো মন্তব্য রেখে যাননি, স্বামীজির দেহাবসানের তিনদশক পরেও (১৯৩২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) তিনি কিন্তু বেঁচে ছিলেন। স্বামীজির দিদির ক্ষেত্রে একটু নাম বিভ্রাটও আছে, মৃত্যু রেজিস্টারে তিনি স্বর্ণবালা, আবার কোথাও স্বর্ণলতা।

স্বামীজিরা ছিলেন দশ ভাইবোন (নরেন্দ্রনাথ ষষ্ঠ সন্তান), এঁদের সম্বন্ধেও আজও অনেক কিছু অজানা। আমরা বিশ্বনাথ দত্তের প্রথমপুত্র ও দুই কন্যার নাম জানি না। সন্ধানকারীদের মন্তব্য : নিতান্ত অল্প বয়সে মৃত্যু হওয়ায় এদের নামকরণ হয়নি, অথবা নামকরণ হলেও নামগুলি আমরা এখনও সংগ্রহ করতে সমর্থ হইনি। তার থেকেও যা দুঃখের, অন্য ভগ্নীদের প্রায় কোনো খবর হাতের গোড়ায় নেই। পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তর আকস্মিক প্রয়াণের সময় কন্যারা বিবাহিতা কি না তাও আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিষ্কার নয়।

প্রথম যুগের ইংরিজি বিবেকানন্দ-জীবনীতে বিশ্বনাথের পারলৌকিক কাজ শেষ করে নরেনের বাড়ি ফেরার বর্ণনা আছে। এই বিবরণ থেকে আন্দাজ হয়, কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ তখন যেমন নিতান্তই শিশু তেমনই ভগ্নীদের কেউ কেউ অবিবাহিতা।

পরবর্তীসময়ে এদের বিবাহে কে কী ভূমিকা গ্রহণ করলেন, কোথা থেকে বিবাহের অর্থ এলো তাও অস্পষ্ট। আরও যা আলো-আঁধারিতে ভরা, তা হলো একজন নয়, দুই বোনের নিতান্ত অল্পবয়সে স্বামীগৃহে দুঃখজনক অকালমৃত্যু। এঁদের একজন যে ছোটবোন যোগীন্দ্ৰবালা তা জানা যায়, তিনি যে কলকাতা সিমলা অঞ্চল থেকে সুদূর সিমলা পাহাড়ের পতিগৃহে আত্মঘাতিনী হন তাও স্পষ্ট, কিন্তু দ্বিতীয় আত্মঘাতিনী ভগ্নীর প্রকৃত বিবরণ এখনও রহস্যময়।

এক নজরে বিশ্বনাথ-ভূবনেশ্বরীর পরিবারের ছবি আঁকার সময় আমরা আরও কিছু বিবরণ উপস্থাপন করব। সংসারত্যাগের পরে এবং বিদেশ থেকে প্রত্যাগমনের আগে গৈরিক বেশধারী নরেন্দ্রনাথকে যে কখনও ভিটেবাড়িতে দেখা যায়নি এমন ইঙ্গিত রয়েছে, তবে দিদিমা রঘুমণি বসুর ৭ রামতনু বসু লেনের বাড়িতে যে বেশ কয়েকবার গুরুভাই ও শিষ্যদের নিয়ে স্বামীজি এসেছে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।

চরম অর্থনৈতিক ও পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ভূবনেশ্বরীর আশ্রয়স্থল এই রামতনু বসু লেনের পিত্রালয়। অল্পবয়সে বিধবা হওয়া অসহায় মেয়ের পাশে সারাজীবন দাঁড়াতে গিয়ে দিদিমা রঘুমণি বসু বড়ই কষ্ট পেয়েছে। অসহায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে স্বামীর ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ভূবনেশ্বরী তার শেষ আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়েছেন স্নেহময়ী মায়ের কাছে। আদরিনী কন্যার মৃত্যু তারিখ ডেথ রেজিস্টার অনুযায়ী ২৫ জুলাই ১৯১১। অভাগিনী কন্যাকে আগে সব যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে পাঠিয়ে দিয়ে, তার ঠিক দুদিন পরে ২৭ জুলাই ১৯১১ স্বামীজির দিদিমা রঘুমণি বসু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

*

উত্তর কলকাতায় ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে স্বামী বিবেকানন্দর ভিটেবাড়ির শেষ উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা, কনিষ্ঠভ্রাতা ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত জীবনসায়াহ্নে তাঁর বাংলা বইতে একটি ছোটখাট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গিয়েছেন।

স্বামীজির জীবন ও কীর্তি সম্পর্কে ভূপেন্দ্রনাথের ইংরিজি বই ‘স্বামী বিবেকানন্দ পেট্রিয়ট-প্রফেট’ বইতে জলঘোলা নেই, কিন্তু বাংলা রচনা ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বইতে দরিয়াটোনার দত্ত বংশের পরিচয় দিতে দিতে এবং পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত সম্পর্কে বলতে বলতে তিনি যে গোপন পারিবারিক তথ্য ফাঁস করেছে, তার মর্মার্থ হল, স্বামী বিবেকানন্দের পরমপ্রতিভাবান পিতা অকালমৃত বিশ্বনাথ দত্ত সুলোচনা’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন যা সেকালের পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। বহুদর্শী নরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার কিছুটা গর্ভধারিণী জননী ভূবনেশ্বরীর কাছ থেকে জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন তার জননী যে কবিতা রচনা করতেন তা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই জানি, কিন্তু পিতৃদের বিশ্বনাথ দত্তের সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কে তেমন কোনো ইঙ্গিত অনুরাগী মহলে ছিল না, যদিও নানা ভাষায় বিশ্বনাথের ব্যুৎপত্তি ও গ্রন্থপ্রেম কারুর অজানা ছিল না।

‘স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ১০১ পাতায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তার পিতৃদেব সম্বন্ধে লিখেছেন : সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অপরিসীম। সুলোচনা’ নামে একটি বাংলা উপন্যাস তিনি রচনা। করেছিলেন।

এর পরেই বিস্ফোরণ। তার নিজের আর্থিক অবস্থা তখন সচ্ছল ছিল না বলে জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী গোপালচন্দ্র দত্তের নামে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।

‘সুলোচনা’ সম্পর্কে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পরে কয়েকদশক অতিবাহিত হলেও স্বামীজি সম্পর্কে গবেষকরা কেন এই বইটি সম্বন্ধে তেমন অনুসন্ধান করলেন না তাও বিবেচনার দাবি রাখে।

প্রকাশিত হওয়ার পরে “পাঠক সাধারণ কর্তৃক বিশেষভাবে সমাদৃত” ‘সুলোচনা’ পরবর্তীকালে দুষ্প্রাপ্য হলেও দুর্লভ নয়। স্বদেশে ও বিদেশে যেখানেই উনিশ শতকে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের সংগ্রহ আছে সেখানকার গ্রন্থতালিকায় এই উপন্যাসের নাম রয়েছে।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন “১৮৮০ খৃষ্টাব্দে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।” কিন্তু কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে দেশবিদেশে খোঁজখবর করতে গিয়ে বিলেতে যে বাংলা বইয়ের হদিশ পাওয়া গেল তার প্রকাশ কলকাতায়, সময় ১৮৮২, বাংলা সন ১২৮৯।

তখনকার কলকাতায় প্রকাশিত বাংলা গল্প-উপন্যাসে একটা ইংরিজি ও একটা বাংলা ফ্লাই-লিফ থাকতো। ইংরিজি টাইটেল-পেজ অনুযায়ী বইটির প্রথম প্রকাশ ১৮৮২। প্রকাশক ২৫ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বি ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং। বাংলা ফ্লাইলিফে বি ব্যানার্জি অ্যান্ড কোং হয়েছেন বি. বানুর্জি কোম্পানি। ব্যানার্জি পদবীটির উচ্চারণ ও বানান নিয়ে বাংলা ও ইংরিজিতে যে দীর্ঘকাল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে তার অকাট্য প্রমাণ।

‘সুলোচনা’ উপন্যাসের শেষপ্রান্তে উল্লেখ : “কলিকাতা বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে ৬৯ বাটীতে হিতৈষী যন্ত্রে শ্রী ব্রজনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক মুদ্রিত।”

সুলোচনা’ উপন্যাসের টাইটেল পেজে আরও কিছু খবরাখবর আছে। সেকালের বইতে মূল নামের সমর্থনে ও ব্যাখ্যায় দ্বিতীয় একটি নাম দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। এক্ষেত্রে লেখা হয়েছে: সুলোচনা অথবা আদর্শ ভাৰ্য্যা। ইংরিজিতে : ‘সুলোচনা দ্য এগজেমপ্লরি ওয়াইফ।’

ইংরিজি পরিচয়পত্রে আরও ব্যাখ্যা আছে : ‘এ স্টোরি অফ বেঙ্গলি ফ্যামিলি লাইফ’ বাংলা করলে দাঁড়ায় : বাঙালির পারিবারিক জীবন নিয়ে একটি কাহিনী। কিন্তু দ্বিতীয় বাংলা টাইটেলে উপন্যাসের লেখক সাহস করে আরও একটু এগিয়ে গিয়েছেন : ‘বঙ্গবাসীদিগের সংসারিক ব্যবহারাবলম্বিত উপন্যাস।১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে আড়াই শ পাতার উপন্যাসের মূল্য এক টাকা, সেই সঙ্গে সেকালের ডাক খরচ সম্বন্ধেও একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে : ‘ডাকমাশুল আনা। পোস্টেজ 2 annas।

পরবর্তী প্রশ্ন স্বভাবতই ‘শ্রী গোপালচন্দ্র দত্ত প্রণীত’ ব্যক্তিটি কে? মুলপরিচয়ে পৌঁছবার আগে ভূপেন্দ্রনাথের বইতে দরিয়াটোনার দত্ত পরিবারের যে বংশলতিকা দেওয়া হয়েছে তার দিকে নজর দিলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে দাঁড়ায়।

গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়ি প্রসঙ্গে আমরা জানি নরেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ দক্ষিণরাঢ়ী কাশ্যপ গোত্র রামনিধি দত্ত তার পুত্র রামজীবন ও পৌত্র রামসুন্দরকে নিয়ে বর্ধমান জেলার দরিয়াটোনা থেকে কলকাতায় চলে আসেন।

এই রামসুন্দর দত্তের পাঁচপুত্র রামমোহন, রাধামোহন, মদনমোহন, গৌরমোহন ও কৃষ্টমোহন। জ্যেষ্ঠ রামমোহন দত্তই ভুবনবিদিত স্বামী বিবেকানন্দর প্রপিতামহ। কনিষ্ঠ কৃষ্টমোহূনের সেজ ছেলে গোপালচন্দ্র; অতএব শরিকী সম্পর্কে গোপালচন্দ্র হলেন নরেন্দ্রনাথের পিতৃদেব বিশ্বনাথের খুড়ো বা কাকা।

এই প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের রচনা থেকে বেশ কিছু তথ্য আমরা জানতে পারি। বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে গ্রন্থরচনার উপাদান সংগ্রহের জন্য ভূপেন্দ্রনাথ একসময় সিমুলিয়া দত্তদের আদি কুলগুরু আন্দুল-মৌরীর শ্ৰীতারাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য (বন্দ্যোপাধ্যায়)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারাপ্রসন্নবাবু তখন ভূপেন্দ্রনাথকে জানান যে তার মাতৃদেবী গোপালচন্দ্র দত্তকে দেখেছিলেন। আরও জানান, তাদের শিষ্যবংশের খাতায় রামনিধির প্রপৌত্র মদনমোহনের নাম পাওয়া যায়, সন ১২৬৩ (১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ)। ভূপেন্দ্রনাথের মন্তব্য, এই তারিখটি একটু গোলমেলে, কারণ ভিটেবাড়ির পার্টিশন মামলার কাগজপত্রে মদনমোহনের মৃত্যু তারিখ ১৮৪৩ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের বর্তমান অনুসন্ধানে অবশ্য এই মতপার্থক্যের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

আমরা এখন জানতে চাই উপন্যাসের টাইটেল পেজে উল্লিখিত গোপালচন্দ্র সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য। স্বামীজির ছোটভাই আমাদের হতাশ করেননি। তিনি একই বইতে জানিয়েছেন, “গোপালচন্দ্র দত্ত একজন বিদ্বান ও যশস্বী জননায়ক হয়েছিলেন।”

আরও খবর, গোপালচন্দ্র ডাকবিভাগে বড় পদে চাকরি করতেন এবং চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি কৃষ্ণদাস পালের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর হন। গোপালচন্দ্র বেথুন সোসাইটির শুরু থেকে আজীবন সভ্য ছিলেন এবং ১০ নভেম্বর ১৮৫৯ থেকে ২০ এপ্রিল ১৮৬৯ প্রায় দশ বছর সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।

ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, গোপালচন্দ্র ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯ বেথুন সোসাইটীতে বাংলার শিক্ষিত শ্রেণী–তাদের অবস্থা ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পাঠ করেন।

গোপালচন্দ্রের বড় জ্যাঠামশাই রামমোহনের দুই পুত্র ও সাতকন্যা। পুত্রদের নাম দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ। এই দুর্গাপ্রসাদই বিশ্বনাথের পিতা এবং পরবর্তীকালে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। পরবর্তীকালে বারাণসীতে তিনি নাকি কোনো মঠের অধ্যক্ষ হন।

আরও একজন সন্ন্যাসীর নাম দেখা যায় দত্তদের বংশলতিকায়, তিনি গোপালচন্দ্রের দাদা নবীনের বড় ছেলে–আদালতি বংশলতিকায় এঁর নামোল্লেখ নেই। বলা হয়েছে, এঁর ছোটভাই নীলমণি।

সন্ন্যাসের প্রতি দত্তপরিবারের আসক্তি সম্পর্কে উল্লেখ প্রয়োজন এই কারণে যে ‘সুলোচনা’ উপন্যাসেও ঘুরে ফিরে এক সন্ন্যাসীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অঙ্কিত হয়েছে। কাহিনীতে এঁর নাম স্পষ্ট নয়। “সন্ন্যাসী কহিলেন–আমার নাম জানিবার আর আবশ্যক কি, আমার সাংসারিক নাম আমি ত্যাগ করিয়াছি। এখন আমার সম্প্রদায়ী উদাসীনেরা আমাকে অঘোরস্বামী বলিয়া ডাকে।”

‘সুলোচনা’ উপন্যাসে অঘোরস্বামীর ভূমিকা এতোই নাটকীয় ও অপ্রত্যাশিত যে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে উপন্যাসের সাসপেন্স নষ্ট করতে চাই না। তবে এই চরিত্রটির পিছনে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের পুত্র, বিবেকানন্দের পিতা ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথের যে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সমর্থন রয়েছে সেবিষয়ে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। তাৎক্ষণিক কৌতূহল নিবারণের জন্য বিশ্বনাথের রচনা থেকে সামান্য একটু নমুনা দেওয়া যেতে পারে।

“কর্ম ভিন্ন কেবল চক্ষু মুদিয়া ভাবনায় কোন ফল নাই। কর্মের অর্থ অনেক। কেবল আপন শরীরকে যাতনা দেওয়া কর্ম নহে। সংসারের সুখখান্নতি, পরের ইষ্টসাধন ও অন্যায়, অনিষ্টসাধন হইতে বর্জিত থাকা, নিজের শরীর পালন ও শরীর পবিত্র রাখা, ক্ষুৎপীড়িতের ক্ষুধানিবৃত্তি, তৃষ্ণাতুরকে স্নিগ্ধবারি দান, শীতপীড়িতকে বস্ত্র দান, নগ্নভিক্ষুকের লজ্জা নিবারণ, রোগীর রোগের সেবা, আশ্রয়হীনকে আশ্রয়দান–এই সকল কর্ম।

“যাঁহারা এই রূপ কর্মসাধন করিতে যত্ন পান না তাহাদের ঈশ্বরধ্যানের অধিকার নাই। তাহাদিগের ঈশ্বর আরাধনা লৌকিক আড়ম্বর মাত্র। অনেকে ধর্মের জন্য এক কপর্দক ক্ষতি স্বীকার করেন না–কোন অংশে এক তিল বিলাস ভোগ হইতে বঞ্চিত থাকেন না–কোনো আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিতে পারেন না ও ত্যাগ করিবার চেষ্টাও পান না–তাহাদিগের ধর্মের ভেক ধারণ করা শঠতার রূপান্তর মাত্র।

“আবার আর এক শ্রেণীর প্রবঞ্চক আছেন তাঁহাদিগের মুখে দিবানিশি ধর্মসম্বন্ধীয় কাহিনী শুনিতে পাইবে। ইহাদিগের ধর্মালোচনা কেবল নিজের পাণ্ডিত্য প্রকাশ ও নিজের স্বরূপ প্রচ্ছন্ন রাখিবার উপায়ন্তর মাত্র। ইহাদিগের ধর্মকথনের এই পর্যন্ত উপকার দৃশ্য হয় যে ইহারদ্বারা প্রকাশ পায় যে কত প্রকার সুললিত ভাষায় কত প্রকার সুযুক্তি দেখাইতে পারা যায় ও এক এক লোকের কি পর্যাপ্ত বচননিপুণতা আছে ও তাহারা কত প্রকার বাক্যপ্রণালী প্রয়োগ করিতে পারে।”

উপন্যাসের আরও একটি বক্তব্যের ওপর আলোকপাত প্রয়োজন হতো যদি না স্বামী বিবেকানন্দের সন্ন্যাসী পিতামহের বৈরাগ্যময় জীবন সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই অবহিত হতাম।

উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সুরথনাথ প্রশ্ন করিলেন, “দিবানিশী ভজন সাধন করিলেই কি মনুষ্যের মুক্তি সম্ভাবনা, না তাহার সহিত আর কোন কর্তব্যকর্ম আছে?”

সন্ন্যাসী উত্তর করিলেন–”বাপু এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেওয়া অসাধ্য। মনুষ্যের যে প্রণালীতে জন্ম তাহাতে তাহার জন্মদাতার ও গর্ভিণীর শারীরিক ও মানসিক ও ধর্ম নৈসর্গিক গুণসমুদয় তাহাতে বর্তায়। সত্যপরায়ণ, নির্লোভী নিরাকাঙ্ক্ষী হিংসাদ্বেষ কাম ক্রোধ শূন্য হইয়া কেহ জন্মগ্রহণ করেন না। এই রিপুগুলির বীজ তাহার শোণিতে মিশ্রিত আছে এবং সংসারে থাকিয়া তাহা অন্যের সংসর্গে এবং পৃথিবীর ব্যবহার দেখিয়া দিন দিন উন্নতি প্রাপ্ত হয়।

“কি সংসারী কি ব্রহ্মচারী সকলেরই এক অনাদি পবিত্র আত্মার চিন্তা কর্তব্য যেহেতুক তদ্বারা কেবল নিজের প্রত্যক্ষ মঙ্গল সাধন হইবে তাহা নহে, মনুষ্যের আত্মা অত্যুৎকৃষ্ট সুনির্মল পবিত্র আত্মার আদর্শ দেখিয়া সেই উচ্চতা কালে প্রাপ্ত হইতে পারিবে। কিন্তু মনকে পবিত্র করা, রিপু সমুদয়কে কোমল করিয়া নিয়মাধীনে রাখা, এক জন্মের কর্ম, এটী এক দিনের কর্ম নহে, এক বৎসরের কর্ম নহে কিছু কাল অধ্যবসায়ের সহিত অভ্যাস করিলে হয় ত সিদ্ধ হওয়া যায়, হয় ত হওয়া যায় না।

“যেমন রোগীকে ঔষধ প্রয়োগ করিবার পূর্বে তাহার শরীর অন্তর্গত মলমূত্রাদি নিষ্কৃতি করিতে হয়–যেমন দেবদেবীর অর্চনার পূর্বে একটি পবিত্র বেদি নির্মাণ করিতে হয় তেমনি ঈশ্বর আরাধনার পূর্বে মনকে পরিশুদ্ধ করা সত্যপরায়ণ হওয়া কপটতা ত্যাগ করা সাংসারিক কৌশল বর্জিত হওয়া আবশ্যক। সাংসারিক সুখে কিছুমাত্র বঞ্চিত হইব না অথচ সময়ে এক এক বার চক্ষু মুদিত করিব–সে উপাসনা নহে–এবং যে সেই রূপ উপাসক সে ঈশ্বরের নামে আপন সৃষ্ট কোন দেবতার আরাধনা করে।

“অপবিত্র মনে অপবিত্র চিত্তে কি প্রকারে পবিত্র নির্মল আত্মার আরাধনা করা সাধ্য। কি উপায়ে অর্জিত অর্থের আগমন হইবে কাহার স্থাপ্য হরণ করিব কাহাকে প্রলোভন দর্শাইয়া নিজাধীনে আনিয়া তাহার সর্বস্ব হস্তগত করিব–যাঁহার অহর্নিশ এই চিন্তা–যিনি নিজ বিলাস ভোগে অধীর হইয়া অন্যকে স্ত্রী কন্যা লইয়া সংসার করিতে দেন না–যিনি ঐহিক পদমর্যাদা, প্রভুত্ব আকাঙ্ক্ষায় মুগ্ধ হইয়া কোন প্রবঞ্চনা প্রতারণা মিথ্যা কল্পনা করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হন না, তিনি কি ঈশ্বরোপাসনা করিতে পারেন? সংসারে থাকিলেই কুক্রিয়াতে রত হইতে হইবে এটি সাংসারিক লোকের ছল মাত্র।”

*

সুলোচনা নিয়ে বিশেষ কৌতূহলের কারণ, এই উপন্যাসে বিবেকানন্দ পিতৃদেব বিশ্বনাথ কিছু ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিশ্বনাথ দত্তের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমরা অন্যান্য সূত্র থেকে তেমন কিছু জানতে না পারায় সুলোচনা উপন্যাসটিই আমাদের প্রধান ভরসা।

এই উপন্যাসের অন্দরমহলে প্রবেশের আগে একটা কথা স্মরণ রাখা ভাল যে লেখকের ব্যক্তিজীবন ও অভিজ্ঞতা প্রায়ই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। কখনও কখনও মনে হয়, প্রত্যেক উপন্যাসই একধরনের আত্মজীবনী, কখনও লেখকের জ্ঞানত এবং প্রায়ই অজ্ঞানত। ইদানিং তাই ব্যক্তিজীবনের চাবিকাঠি খুলে উপন্যাসের অনালোকিত গর্ভগৃহে প্রবেশের চেষ্টা শুরু হয়েছে। ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ঘটনাবলী যে উপন্যাস লেখক সরলভাবে নকল করে যান তা নয়, কখনও কখনও অতিসাবধানে লেখক তার আত্মজীবনকে লুকিয়ে রাখতেও সচেষ্ট হন। কিন্তু তার সৃষ্টিটি যেন তার ছায়া। কখনও সামনের, কখনও পিছনের, কখনও পাশের। নিষ্ঠুর সত্যটি হল কেউ কখনও তার নিজের ছায়াকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হন না।

এইভাবে চিন্তা করে সুলোচনা উপন্যাসের পাঠোদ্ধার করলে কি স্বামীজির পিতামহ (দুর্গাপ্রসাদ), পিতামহী শ্যামাসুন্দরী, পিতা বিশ্বনাথ, মাতা ভুবনেশ্বরী, পিতামহের ভাই কালীপ্রসাদ, পত্নী বিশ্বেশ্বরী, তাঁদের পুত্র তারকনাথ ও পুত্রবধূকে ছায়াচিত্রর মতন খুঁজে পাওয়া যায়? এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, বহু উপন্যাস সত্যঘটনার কার্বন কপি না হয়েও, প্রকৃত ঘটনাস্রোতের গতিরেখা নিশ্চিতভাবে এঁকে যায়।

বহুক্ষেত্রে এই ধরনের অনুমানের কোনো মানে হয় না। কিন্তু যেখানে উপন্যাসের লেখক স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দর পিতৃদেব এবং দত্তদের শরিকি মামলার নথিপত্রের বাইরেও ভিটেবাড়িতে এক অদ্ভুত জীবনযাত্রা চলমান ছিল এবং যেখানে এক যুগনায়ক ভূমিষ্ঠ হয়ে শৈশব, বাল্য ও যৌবন অতিবাহিত করেছিলেন সেখানে ভক্তদের, অনুরাগীদের ও দুনিয়ার সংখ্যাহীন মানুষের সীমাহীন কৌতূহল নিতান্ত স্বাভাবিক। এই কারণেই বিবেকানন্দ-অনুরাগীরা ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পটভূমি, চরিতাবলী ও ঘটনাবলী বারবার খুঁটিয়ে দেখবেন।

নিবেদিতার এক চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, স্বামী বিবেকানন্দ বিদেশে তার পারিবারিক স্মৃতি অবগাহন করতে করতে একবার বলেন, তাঁর পিতামহ দুর্গাপ্রসাদের বিবাহ হয়েছিল তিন বছর বয়সে শ্যামাসুন্দরীর সঙ্গে। এঁদের জ্যেষ্ঠা সন্তান একটি কন্যা, তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। পরবর্তী সন্তান বিশ্বনাথের জন্ম ১৮৩৫। বিশ্বনাথের বিবাহ যে যোলো বছর বয়সে হয়েছিল একথাও নিবেদিতার এই পত্রে উল্লিখিত হয়েছে। স্ত্রীর বয়স তখন দশ।

গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তরা বংশানুক্রমে আইনব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্বামীজি কথায় কথায় বলতেন, আমাদের সাতপুরুষ উকিল। পিতামহ রামমোহন ছিলেন তখনকার সুপ্রিমকোর্টের ফার্সী আইনজীবী। এই পেশায় তিনি যে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন তার প্রমাণ তার বিশাল সম্পত্তিসালকিয়ায় দুটো বাগানবাড়ি, খিদিরপুরে প্রচুর জমিজমা। বিধির খেয়ালে এই সালকিয়ার লাগোয়া বেলুড়েই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে কলেরায় রামমোহনের অকাল মৃত্যু হয়। সেকালের কলকাতায় দারুণ গ্রীষ্মে অশোধিত জল খেয়ে কলেরায় অকালমৃত্যু কোনো নতুন ঘটনা নয়।

রামমোহনের বড় ছেলে দুর্গাপ্রসাদও প্রথম জীবনে এটর্নি অফিসে কাজ করতেন এবং পরবর্তীকালে কোনো এক দুর্ঘটনায় তার জীবনের গতি পরিবর্তিত হয়। ভিটেবাড়িতে তখনই শরিকী টেনশন যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।

ভূপেন্দ্রনাথের কথায় : “দুর্গাপ্রসাদ ফার্সী ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তিনি উত্তর কলকাতানিবাসী দেওয়ান রাজীবলোচন ঘোষের কনিষ্ঠা কন্যা শ্যামাসুন্দরীকে বিবাহ করেন। শ্যামাসুন্দরী বাংলাভাষায় বিদুষী ছিলেন। তার হস্তাক্ষর ছিল খুব চমৎকার। তিনি ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিণী’নামে একটি সুবৃহৎ বাংলা কাব্যও রচনা করেছিলেন।” রূপবতী শ্যামাসুন্দরীর প্রথমা কন্যাটি সাত বছর বয়সে মারা যায়।

এই গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনীর পাণ্ডুলিপি বিশ্বনাথ অনেকদিন সযত্নে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু রায়পুরে সংসার নিয়ে যাওয়ার সময় এই মূল্যবান সংরক্ষণটি নষ্ট হয়ে যায়। এইভাবে দত্তপরিবারের আরও কত সংগ্রহ অদৃশ্য হয়েছে তার হিসেব নেই।

তখনকার দত্তভিটের একটা অন্তরঙ্গ ছবি ভূপেন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছেন। “মনে হয় বিধবা বোন যিনি স্বামীর উইলের অধিকারিণী ছিলেন, তিনিই ছিলেন সংসারের কী। যে কারণেই হোক তিনি আমার পিতামহীকে ভাল চক্ষে দেখতেন না।”

শ্যামাসুন্দরী একবার বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি এলে রায়বাঘিনী ননদিনী হুকুম দিলেন, পাল্কি হটাও। বিশ্বনাথ জননীকে তখনই বাপের বাড়ি ফিরতে হয়। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “স্ত্রীর এই অপমান দেখে দুর্গাপ্রসাদ বসতবাড়ি ত্যাগ করে চলে গেলেন। পরে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন।”

কালের ব্যবধান অমান্য করে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের স্মৃতি আজও স্বামীজির ভিটেবাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের আগন্তুক তীর্থযাত্রীরা এখন জানতে চান, বাড়ির কোন ঘরে একসময় সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদকে শেষবারের মতন বন্দি করে রাখা হয়?

কাহিনীটা এই রকম : উত্তর ভারত থেকে সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে টাটু ঘোড়ায় চড়ে কলকাতায় আসতেন। থাকতেন তার ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে, এই বাড়িটি একসময় তিনিই ভিক্ষাপুত্রকে দান করেছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়, মতের পরিবর্তন হতে পারে এই আশায় ভ্রাতা কালীপ্রসাদ একবার তার সন্ন্যাসী ভাইকে ভিটেবাড়িতে এনে ঘরে তালা বন্ধ করে রেখেছিলেন।

ফল ভাল হয়নি, বন্দি দুর্গাপ্রসাদ তিন দিন ক্রমাগত চিৎকার করতে লাগলেন দরজা খুলে দেবার জন্য। এক সময় তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা শঙ্কিত হয়ে তাকে মুক্ত করে দিতে বললেন।

বিশ্বনাথ দত্তের বাবা সেই যে গৃহত্যাগ করলেন, আর কখনও দত্ত বাড়িতে ফেরেননি। শোনা যায়, গৈরিক গ্রহণের পর বিদেশেযাত্রার আগে পর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দকেও ভিটেবাড়িতে পদার্পণ করতে দেখা যায়নি। মা ও দিদিমাকে দেখতে তিনি যেতেন ৭ রামতনু বোস লেনের বাড়িতে, এই রামতনু বসু ছিলেন দিদিমা রঘুমণি দাসীর পিতামহ।

*

সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদ কলকাতায় এলে বালক বিশ্বনাথ তার সঙ্গে দেখা করতে পিতার ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে যেতেন।বলাবাহুল্য দুর্গাপ্রসাদ আর কখনও স্বগৃহে আসেননি।

দুর্গাপ্রসাদের কোষ্ঠিতে একটি ইঙ্গিত পরিবারের মধ্যে বিশেষ আশা জাগিয়েছিল, জাতক ৩৬ বছর বয়সে গৃহে ফিরে আসবেন। অত্যন্ত বিস্ময়ের কথা, ঠিক ঐ বয়সেই দুর্গাপ্রসাদ পরিবারের জনৈক সভ্যের হাত দিয়ে তার ভিক্ষাপাত্র ও জপমালা বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এই লক্ষণ দেখে প্রতিবেশীরা শ্যামাসুন্দরীকে পরামর্শ দিলেন, দুর্গাপ্রসাদের মধ্যাহ্নিক শয়নের সময়ে গিয়ে তাঁর পদসেবা করতে।

‘সুলোচনা’ উপন্যাসেও নায়কের বিদেশযাত্রার পূর্বে স্ত্রীর পদসেবার একটি মনোগ্রাহী ছবি এঁকেছেন বিশ্বনাথ। শ্যামাসুন্দরীর ক্ষেত্রে অবশ্য স্বামীর সেবা প্রচেষ্টার ফল মোটেই ভাল হয়নি। পারিবারিক বর্ণনাটা এইরকম : “শ্যামাসুন্দরী স্বামীর ঘরে গিয়ে তাঁর মশারি তুলে পদসেবা করবার চেষ্টা করতেই দুর্গাপ্রসাদ চীৎকার করে বলে উঠলেন, চণ্ডালী আমাকে স্পর্শ করেছে। একথা বলেই তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর আর তিনি দেশে আসেন নি।”

যে রায়বাঘিনী ননদিনীর হাতে দুর্গাপ্রসাদের পত্নী শ্যামাসুন্দরী প্রায়ই নিগৃহীতা হতেন তার সূত্র ধরেই দত্তদের ভিটেবাড়িতে নানারকম মামলার অনুপ্রবেশ ঘটে।

রামমোহনের এই কন্যাটির বিয়ে হয়েছিল খুবই বড়লোকের বাড়িতে। একদিন পুকুরে স্নান করতে যাবার সময় জামায়ের সঙ্গে এক গণকের দেখা হলো। এই গণকটি ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন, সর্পদংশনে শীঘ্রই তার মৃত্যু হবে। সময় নষ্ট না করে নিরুপায় জামাতা সামনের এক কুমোরের দোকানে গিয়ে তৎক্ষণাৎ একটা মাটির হাঁড়ি কিনলেন এবং আর কিছু না পেয়ে সেই হাঁড়ির ওপরে উইল লিখলেন যে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি পাবেন তার বালবিধবা।

বিধির বিধানে জামাতা সত্যিই হঠাৎ মারা গেলেন। শোকাহত রামমোহন তখন সদ্যবিধবা কন্যা, মাটির হাঁড়িতে লেখা উইলটি ও কন্যার শ্বশুরবাড়ির শালগ্রামশিলাটি নিয়ে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটেবাড়িতে ফিরে এলেন। কিছুদিনের মধ্যে বারুইপুরের চৌধুরীরা প্রয়াত জামায়ের সম্পত্তির ভাগ নিয়ে আদালতে মামলা করলেন।

এই মামলা চলেছিল তিন প্রজন্ম ধরে এবং শেষপর্যন্ত রামমোহনকন্যারই জয় হয়েছিল। কিন্তু মামলার খরচ সামলাতে গিয়ে লাখ টাকার সম্পদ কমতে কমতে যোলো হাজার টাকায় দাঁড়ায়।

উইল বা পারিবারিক সম্পত্তির পার্টিশন মামলায় সেকালের কলকাতায় এরকম আর্থিক সর্বনাশই হতো। উইল করা সম্পর্কে বিশ্বনাথ দত্তের ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে সুন্দর একটি দৃশ্য আছে। সেখানে উইলের চমৎকার বাংলা করা হয়েছে ‘মানসপত্র’–এই শব্দটির বদলে এখন সাধারণত আমরা ব্যবহার করে থাকি ইচ্ছাপত্র।

দুর্গাপ্রসাদ সংসার ত্যাগ করার পরে সংসারের প্রধান হলেন তার ছোটভাই কালীপ্রসাদ দত্ত। এঁর পত্নীর নাম বিশ্বেশ্বরী, ইনি জয়নগর ২৪ পরগনার মেয়ে। কালীপ্রসাদের নিজস্ব উপার্জন ছিল না, রোজগারের একমাত্র সূত্র দত্ত পরিবারের সম্পত্তির থেকে আয়। খাজনা এবং ভাড়া থেকে চলতো দুর্গাপ্রসাদহীন সংসার।

যথাসময়ে দত্ত ভিটেতে আরও একটি আইনি সমস্যার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সেকালের হিন্দু আইন অনুযায়ী সন্ন্যাসীদের পারিবারিক সম্পত্তির কী অবস্থা হবে? হিন্দু আইন মতে কেউ বারো বছর নিরুদ্দিষ্ট থাকলে প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আদালতের আদেশে তাকে মৃত ঘোষণা করা যায়। স্বামীজির পিতামহ দুর্গাপ্রসাদের ক্ষেত্রেও এই পথ অনুসরণ করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এই মামলাটির কাগজপত্র এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

সিমলে দত্ত পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের স্পষ্ট অভিযোগ, কালীপ্রসাদ তার সন্ন্যাসী দাদার ছেলেকে তেমনভাবে দেখাশোনা করেননি, ফলে অত্যন্ত অযত্ন ও অবহেলায় বিশ্বনাথের ছোটবেলা কেটেছিল।

ভূপেন্দ্রনাথ অবশ্য তার বাবার ধনবান মামার বাড়ির কিছু খবরাখবর আমাদের দিয়েছেন। শ্যামাসুন্দরীর পিতৃদেব সেকালের ডাকসাইটে ব্যক্তিত্ব রাজীবলোচন ঘোষ ছিলেন ভারত সরকারের তোষাখানার দেওয়ান। এঁর আর্থিক সমৃদ্ধি সম্বন্ধে ছড়া ও গান নাকি একসময় প্রাচীন কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় লোকের মুখে মুখে ফিরত।

ছ’বছর বয়সে দুর্গাপূজার সময় মামার বাড়িতে গিয়ে বিশ্বনাথ নাকি চরম অপমানের পাত্র হন। তাঁর জামাকাপড় ভাল না থাকায়, বালকটি যে এবাড়ির ভাগ্নে তা কয়েকজন অভ্যাগতর কাছে মামার বাড়ির লোকরা চেপে গিয়েছিলেন। নিদারুণ মনোকষ্ট পেয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বালক বিশ্বনাথ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসেছিলেন এবং শোনা যায় এরপর তিনি আর কোনোদিন মামার বাড়িতে পা দেননি।

*

কাকা কালীপ্রসাদ ও বিশ্বনাথ জননী সম্পর্ক সম্বন্ধে এত কিছু বলার কারণ, ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে সেকালের যৌথপরিবারের নিজস্ব উপার্জনহীন কর্তা ও তাঁর ভ্রাতৃবধুর বেশ কিছু বিস্ময়কর ছবি আছে। তফাত এই, সুলোচনার স্বামী সংসারত্যাগী নন, ভাগ্যসন্ধানে ও কর্মসূত্রে তিনি বাংলা থেকে বেশ দূরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। উপন্যাসের নায়ক সেকালের প্রথা অনুযায়ী নিজের স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেননি। যাঁরা দত্তভিটের তখনকার সাংসারিক ছবিটি মাথায় রাখবেন, তাদের মনে হতে পারে, উপন্যাস লেখক বিশ্বনাথ দত্ত কি তার কাকা কালীপ্রসাদ ও জননী শ্যামাসুন্দরীর বিচিত্র ঘটনাগুলি পরবর্তীকালেও বিস্মৃত হননি?

সংসারত্যাগী দাদার নিঃসহায় স্ত্রী-পুত্রর সঙ্গে ভাই কালীপ্রসাদ কী ধরনের ব্যবহার করেছিলেন তার আরও কিছু বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। কালীপ্রসাদ একবার মামলার খরচ চালানোর জন্যে ভ্রাতৃবধূ শ্যামাসুন্দরীর বেশ কিছু গহনা নিয়ে গিয়ে দোকানে বন্ধক রেখে নগদ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন।

বিবেকানন্দ-পিতার উপন্যাসে এমন একটি দৃশ্য আছে যেখানে উপার্জনহীন গৃহকর্তা তাঁর ভ্রাতৃবধুর গহনা চাইছে। দত্ত ভিটেবাড়িতে গহনা বার করে দেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য অত সহজ হয়নি। শ্যামাসুন্দরী যখন গহনা ফেরত দেবার জন্যে চাপ দিতে লাগলেন তখন অনন্যোপায় কালীপ্রসাদ বালক বিশ্বনাথের নামে কয়েকটি তালুক লিখে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, চোদ্দ বছরের বালক বিশ্বনাথকে লাঠিয়াল সহ তালুকের দখল নিতে যেতে হয়েছিল। পরে দেখা গেল তালুকসংক্রান্ত দলিলে বহু গোলমাল আছে।

কালীপ্রসাদের লোভ ও বোকামির শেষ ছিল না। এই বাড়িতে ভূবনেশ্বরীর বিয়ের আগে কালীপ্রসাদ এক ভণ্ড তান্ত্রিকের খপ্পরে পড়েছিলেন। তিনি নাকি কয়লাকে হিরেয় রূপান্তরিত করতে পারেন কিছু পয়সা পেলে। কালীপ্রসাদ দত্ত সরল মনে এই অষ্টসিদ্ধ যোগীর পিছনে তখনকার দিনে আঠারো হাজার টাকা খরচ করেন।

.

বিশ্বনাথের বয়স যখন সতেরো তখন মাতামহ রাজীবলোচন ঘোষের দেহাবসান ঘটে। পিতৃসান্নিধ্যে বঞ্চিত নাতিকে তিনি একটি বাগানবাড়ি লিখে দিয়ে যান, কিন্তু কিছুদিন পরেই বিশ্বনাথের বড়মামা বাড়িতে এসে ভাগ্নের কানে কানে কী বললেন, বিশ্বনাথ সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পত্তি মামাকে লিখে দিলেন।

পরবর্তী সময়ে স্বামীজির মা অল্পবয়সী স্বামীর এই কাজকে সমর্থন করতেন। তার ধারণা ছিল, মামাকে লিখে না দিলে, দত্তবাড়ির শরিকরা এই সম্পত্তি বিশ্বনাথের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতেন।

মধু রায় লেনে সিমুলিয়ায় দত্তপরিবারের একটা যৌথ সম্পত্তি ছিল। কালীপ্রসাদের অনুরোধে বিশ্বনাথ এই সম্পত্তিতে তার ভাগটা কাকাকে লিখে দিয়েছিলেন। স্বভাবতই ভূবনেশ্বরী প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, এইভাবে সব সম্পত্তি লিখে দিলে নিজের ছেলে, মেয়ে, বউয়ের জন্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

কিন্তু সংসারবিরাগী বাবার অনুপস্থিতিতে যে কাকা তাকে ছোটবেলায় মানুষ করেছেন তার প্রতি বিশ্বনাথের আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন। ছোট বয়সে যিনি আমাকে দেখেছেন তিনি চাইলে দেহের মাংস পর্যন্ত কেটে দিতে পারি, এই হল কৃতজ্ঞ বিশ্বনাথের মনোভাব।

কাকার দেহাবসান পর্যন্ত বিশ্বনাথের এই মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকে তিনি বড়ছেলে নরেনের কাছে নিজের মনের কথা লুকিয়ে রাখেননি, গভীর দুঃখের সঙ্গে তিনি বর্ণনা করতেন, কাকা এবং তার পরিবারের কাছে তিনি কীভাবে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পাঠক বসুপরিবারের তিন পুত্রের জ্যেষ্ঠ ভজহরির মধ্যে সিমুলিয়ার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের কালীপ্রসাদকে খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।

*

বিশ্বনাথ দত্তের উপন্যাসটি একটি কায়স্থ পরিবারকে কেন্দ্র করে। এই উপন্যাসের প্রথম পুরুষ কেনারামও অনেকটা দত্ত পরিবারের রামমোহনের মতন। ইনিও ছিলেন আধা-উকিল। উপন্যাসের কেনারাম আইনের ব্যাপারে কখনও কাউকে কুপরামর্শ দিতেন না, কেউ এমন কথা বলতে পারত না যে কেনারামের পরামর্শে তার ক্ষতি হয়েছে। এই কেনারামও রামমোহনের মতন বুদ্ধি ও কৌশলে নিজের পৈতৃক ভদ্রাসনের সুবিস্তার ঘটিয়েছিলেন।

আরও এক আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য। দত্তপরিবারের প্রথম চারপুরুষ সকলেই রাম রামনিধি, রামজীবন, রামসুন্দর, রামমোহন। আর বিশ্বনাথের লেখা উপন্যাসের আদিচরিত্র কেনারাম ও প্রধান চরিত্র রামহরি।

পিতৃদেব কেনারাম বসুর আশি বছর বয়সে মৃত্যুর সময় জমিজমা বাগবাগিচা ও তালুক ছাড়াও নগদ নিতান্ত কম ছিল না। তাছাড়া সম্পত্তির বাৎসরিক আয় পঞ্চাশ হাজার টাকা এমন এক সময়ে যখন বাৎসরিক চার হাজার টাকা আয়ের লোকরা নিজেদের বড়মানুষ বলে গণ্য করতেন।

‘সুলোচনা’ উপন্যাসের কোন চরিত্রের মধ্যে লেখক বিশ্বনাথ দত্ত লুকিয়ে আছেন? উপন্যাস শেষ করে পাঠক-পাঠিকারা অবশ্যই তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন। আপাতত বলা যেতে পারে, একটি নয়, দুটি চরিত্রে তার ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলি বারবার উঁকি মারছে। একটি অবশ্যই নায়ক রামহরি–সেই চরিত্রে আছে তার জীবনসংগ্রাম ও নানা সংঘাত। গল্প একটু এগোলেই কিন্তু মনে হয়, রামহরির একমাত্র সন্তান সুরথনাথের মধ্যেও লেখক বিশ্বনাথ উঁকি মারছেন। বিশ্বনাথের বাল্য, যৌবন ও জীবনসায়াহ্নের ঘটনাবলি একটু বিস্তারিত জানা থাকলে চরিত্ৰবিচার সহজতর হতে পারে।

*

বাল্যে বিশ্বনাথের লেখাপড়া নিয়ে দত্ত পরিবারের কেউ তেমন মাথা ঘামাননি। পাড়াপড়শিদের প্রশ্নে ধৈর্যহীন হয়ে নিজের মুখরক্ষার জন্য অনাথ ভ্রাতুস্পুত্রকে অবশেষে কালীপ্রসাদ পাঠিয়েছিলেন আজকের ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে, সেকালে যার নাম ছিল গৌরমোহন আঢ্যর স্কুল। বালকটির জুতো ছিল না, খালিপায়ে প্রতিদিন সিমলা থেকে আহিরিটোলায় যাতায়াত করতে হত। এক মাস্টারমশায় জিজ্ঞেস করলেন, জুতো নেই কেন?

সরলমনে গরিব ছেলেটি উত্তর করল, “আমার বাবা বারাণসীতে থাকেন। তিনি আমার জন্যে জুতো পাঠাবেন। এখনও জুতো আসেনি, এলেই পরবো।” আমরা জানি পিতা দুর্গাপ্রসাদ তখন বারাণসীতে মঠাধীশ। গৌরমোহন আঢ্যের ইস্কুলেই বিশ্বনাথের শিক্ষক ছিলেন রসিকচন্দ্র চন্দ্র। বিধির বিধানে পরবর্তীকালে এঁরই পুত্র কালীপ্রসাদ চন্দ্র স্বামী অভেদানন্দ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কালীবেদান্তি ছিলেন স্বামীজির প্রিয়বন্ধু ও গুরুভাই। স্বামীজি তাঁর এই গুরুভাইকে আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের জন্য আহ্বান করেছিলেন।

‘জুনিয়র’ ও ‘সিনিয়র’ পরীক্ষা পেরিয়ে কোনো এক সময়ে বিশ্বনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি কিছুটা ধোঁয়াশায় ঢাকা। কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, অর্থোপার্জনের জন্য বিশ্বনাথ কিছুদিন ব্যবসায়ে হাত পাকিয়েছিলেন, কিন্তু তেমন সুবিধে করতে পারেননি।

পরবর্তী পর্যায়ে তার ওকালতিজীবনও আমাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যেত। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তী উচ্চ আদালতের রেকর্ড ঘেঁটে কিছু আলোকপাত করে গিয়েছেন। আর আছে কলকাতা হাইকোর্টে বিশ্বনাথের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর আবেদনপত্র যেখানে মায়ের সঙ্গে সই করেছেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই আবেদনের তারিখ কলকাতায় সুলোচনা প্রকাশের প্রায় সাড়ে চার বছর পরে।

মামলা মোকদ্দমার ছায়া থেকে সিমুলিয়ার দত্তরা কখনও নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। সন্ন্যাসী দুর্গাপ্রসাদের বিষয়-সম্পত্তি অধিকারের জন্য হাইকোর্টের মামলায় দীর্ঘ বারো বছর তার কোনো সংবাদ বা সন্ধান না পাওয়ার অভিযোগে তাঁকে আইনমতে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল।

কলকাতা হাইকোর্টের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্তের সম্পর্ক সম্বন্ধে খোঁজখবরের জন্য ব্যারিস্টার সুধীরচন্দ্র মিত্র একসময় মাননীয় প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণ চক্রবর্তীর শরণাপন্ন হন। ফণীভূষণের ৪ ডিসেম্বর ১৯৫২ তারিখের লিখিত বিবরণ সব সন্দেহের অবসান ঘটায়। ব্যাপারটা এই রকম :

আদালতের কাগজপত্রে বিশ্বনাথের ইংরিজি বানান Bisso Nath Dutt: ১৪ মার্চ ১৮৬৬ প্রধান বিচারপতি বার্নের্স পিককের কাছে এটর্নি ও প্রক্টর হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার জন্য তিনি আবেদন করেন। প্রক্টর শব্দটির আভিধানিক অর্থ মকদ্দমার তদ্বিরকারি আম-মোক্তার হিসেব অনুযায়ী পুত্র নরেন্দ্রনাথের বয়স তখন তিন বছর।

আদালতের আবেদনপত্রের বাঁদিকে লেখা হয়েছে “তাই হোক” (বি ইট সো)–যে বিচারক বিশ্বনাথের আবেদনপত্র মঞ্জুর করেন তার নাম মিস্টার জাস্টিস ওয়ালটার মরগ্যান। তখন কলকাতা হাইকোর্টের লেটারস্ পেটেন্ট ১৮৬২ অনুযায়ী বিচারকের সংখ্যা তেরো জন। মরগ্যান পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চীফ জাস্টিস হন।

পিটিশনের সঙ্গে জমা দেওয়া পরীক্ষকদের সার্টিফিকেট (১২ মার্চ ১৮৬৬) থেকে দেখা যায় এটর্নি মিস্টার হেনরি জর্জ টেম্পল-এর কাছে বিশ্বনাথ আর্টিকেল্ড ছিলেন। এঁর নামানুসারেই সম্ভবত ৬ ওল্ড পোস্টপিস স্ট্রিটের বিখ্যাত টেম্পল চেম্বার্স ভবনের নামকরণ হয় যেখানে প্রায় এক শতাব্দী পরে আমি ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল মহোদয়ের বাবু বা ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিই।

দেখা যাচ্ছে, মিস্টার চার্লস এফ পিটারের কাছে বিশ্বনাথ দত্তের আর্টিকেল্ড ক্লার্কশিপের শুরু ১১ এপ্রিল ১৮৫৯–শেষ ৩১ জুলাই ১৮৬০। প্রায় ছ’মাসের ব্যবধানে (২৯ জানুয়ারি ১৮৬১) তিনি আর্টিকেল হন মিস্টার হেনরি জর্জ টেম্পলের কাছে। এই বিখ্যাত এটর্নির অধীনে তিনি থাকেন ১০ অক্টোবর ১৮৬৪ পর্যন্ত। এটর্নি হিসেবে নথীভুক্ত হবার আবেদনের সঙ্গে দুটি চরিত্র সার্টিফিকেট (দুটিরই তারিখ ৭ জানুয়ারি ১৮৬৫) দেন শ্রী গ্ৰীশ (গিরিশ) চুন্দার (চন্দ্র) বনার্জি ও শ্রী দিগম্বর মিটার। এই গিরিশই পরবর্তীকালে বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বনার্জির পিতৃদেব। দিগম্বর মিটার পরে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন।

প্রধান বিচারপতি ফণীভূষণের রিপোর্টে পরলোকগত বিশ্বনাথের বিধবা ভূবনেশ্বরী দাসীর (Bhubannessary Dassee) ১১আগস্ট ১৮৮৬র লেটারস অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের আবেদনের বিবরণ আছে। এই আবেদনপত্রে সম্মতি জানিয়ে সই করেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত।

পরের দিনই (১২ আগস্ট ১৮৮৬) এই আবেদন গৃহীত হয়। আবেদনপত্রের তিন নম্বর প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে বিশ্বনাথের বিধবা ছাড়া তিন পুত্রসন্তান রয়েছে, এদের নাম নরেন্দ্রনাথ (২২ বছর) ও নাবালক মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথ। প্রথম প্যারাগ্রাফ থেকে স্পষ্ট যে বিশ্বনাথ দত্ত কোনো উইল রেখে যাননি–তাঁর দেহাবসান হাইকোর্ট রেকর্ড অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।

কলকাতা কর্পোরেশনের ডেথ রেজিস্টারে বিশ্বনাথের মৃত্যুদিন শনিবার ২৩ ফেব্রুয়ারি, বয়স ৫২, মৃত্যুর কারণ বহুমূত্র রোগ, মৃত্যুকালীন বাসস্থান ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট। (পীড়ার পূর্বে নিবাস : একই।) সংবাদদাতা হিসেবে ইংরিজিতে সই করেছেন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত। কর্পোরেশন রেকর্ড অনুযায়ী মৃত্যু রেজিসট্রির তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।

*

আইনজ্ঞ হিসেবে বিশ্বনাথের কর্মজীবন সম্পর্কে নানারকম কাহিনী আজও বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে আছে। অ্যাটর্নি হওয়ার পরেই তিনি আশুতোষ ধরের সঙ্গে ধর অ্যান্ড দত্তর অংশীদার হয়েছিলেন। পরে তিনি এই যৌথ ব্যবসায়ে উদ্বিগ্ন হয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

অনুসন্ধানী লেখক চিত্রগুপ্ত দত্তবাড়ির আদালতি কাগজপত্র অনেক খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পান। বিশ্বনাথ সম্পর্কে তার মন্তব্য : “আয় আশানুরূপ হলেও বেহিসেবী এবং অপরিণামদর্শী হওয়ায় তিনি দেনার জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর সেন্ট্রাল প্রভিন্সেসে, যার পরবর্তী নাম মধ্যপ্রদেশ। প্রবাসে থাকাকালীন তিনি কিছুদিন পাঞ্জাবেও ওকালতি করেছিলেন।”

১৮৭৯ সালে বিশ্বনাথ কলকাতায় ফিরে এসে আবার আইন প্র্যাকটিশ শুরু করেন। পরবর্তীকালে স্বামীজির কাকা তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী যে মামলা করেন সেই আবেদনে অভিযোগ, বিশ্বনাথ দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ১৮৭১ সালের মাঝামাঝি কলকাতা ছেড়ে চলে যান। তাঁর বিরুদ্ধে পাওনাদারদের কয়েকটি ডিক্রি জারির আশঙ্কায় তিনি সাত বছর প্রবাসে কাটান।

জ্ঞানদাসুন্দরীর অভিযোগের জবাবে ভূবনেশ্বরী আদালতে যে বক্তব্য দাখিল করেন তার মর্মার্থ : “আমার স্বামী বিশ্বনাথ দত্ত, এই মামলার বাদী জ্ঞানদাসুন্দরীর স্বামী তারকনাথ দত্ত এবং তারকের সহোদর ভাই কেদারনাথ দত্ত ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে থেকে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতেন। আমার স্বামী বিশ্বনাথ শেষজীবনে কলকাতা ছেড়ে উত্তর পশ্চিম প্রদেশে চলে গিয়ে কয়েক বছর সেখানে আইনজীবীর পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। সে সময়ে আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসতবাড়িতেই ছিলাম। আমার এবং আমার পোষ্যদের ভরণপোষণের যাবতীয় খরচ আমার স্বামী পাঠানে। একথা অত্যন্ত অসত্য ও অমূলক যে তারকের আনুকূল্যে আমার ও আমার ছেলেমেয়েদের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হত, বিশেষ করে যখন আমার স্বামী প্রবাসে ছিলেন। তবে, একথা সত্যি যে আমার স্বামীর অনুপস্থিতে তারকনাথ সংসারের কর্তা হিসেবে আমাদের দেখাশোনা করতেন।”

বিবেকানন্দজননীর আদালতে এইসব নিবেদন বিশ্বনাথের দেহান্তের কয়েকবছর পরে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সুলোচনা’ উপন্যাসে বিশ্বনাথ এই ধরনের ছবিই এঁকেছেন। ভাই কাজের সূত্রে বিদেশ গিয়েছে, সেখানে বেশ ভাল উপার্জন করেন এবং সেই টাকা অভিভাবক দাদার কাছে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু তিনি ও তার পরিবার তা হজম করে ফেলেন। ভ্রাতৃবধূর দৈনন্দিন জীবনে কষ্টের অভাব নেই।

ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথ কি মানসচক্ষে অনাগত ভবিষ্যৎকে দেখে ফেলেছিলেন? দত্ত পরিবারের বৃহৎ পারিবারিক বিরোধের বিবরণ দেওয়ার পূর্বে জ্ঞাতিদের সম্বন্ধে আরও কিছু বিবরণ সংগ্রহ করা মন্দ হবে না। দুর্গাপ্রসাদ ও কালীপ্রসাদ সম্বন্ধে আমরা ইতিমধ্যেই কিছুটা জেনেছি। কালীপ্রসাদের দুই পুত্ৰকেদারনাথ ও তারকনাথ। কেদারনাথের এক কন্যা ও চার পুত্রের মধ্যে দুই পুত্র (হাবুবাবু ও তমুবাবু) সঙ্গীতজগতের নামকরা ব্যক্তিত্ব। জেনে রাখা ভাল জগদ্বিখ্যাত আলাউদ্দীন খাঁ সায়েব এ বাড়িরই শিষ্য। রামকৃষ্ণভক্ত হাবুবাবু, ঠাকুরের দেহাবসানের পরে তাঁর অস্থি দিয়ে একটি জপমালা তৈরি করেছিলেন। এঁদের ছোটভাই শরৎচন্দ্র ১৬ বছরে মারা যান।

কেদারনাথের ভ্রাতা তারকনাথের স্ত্রীই পরবর্তীকালে স্বামীজির মায়ের নামে মামলা আনেন। এঁদের একপুত্র ও ছয় কন্যা। তারকনাথ একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বসত সেখানে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন। পরে বি এল পাশ করে তিনি হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তারকনাথ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির হয়ে ওকালতি করতেন, সেই সূত্রে তার মেয়ের বিয়েতে দেবেন্দ্রনাথ ও বিখ্যাত ঠাকুররা দত্তবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে আসলে। হয়তো বাংলার যৌথপরিবারে, এমন ব্যাপার সেযুগে প্রায়ই ঘটতো।

ভুক্তভোগী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত দুঃখ করেছেন, “পারিবারিক কাহিনীর গোপন তথ্য এখানে প্রকাশ করবার উদ্দেশ্য, হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের অভিশাপ যে কত নিষ্করুণ তা ব্যক্ত করা। যাঁরা এই একান্নবর্তী পরিবার প্রথার পবিত্রতা সম্পর্কে গলাবাজি করে থাকেন তারা হয় এর বাস্তব অবস্থার অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত নন, নতুবা পারিবারিক কলহ বিবাদ ও বিয়োগান্ত ঘটনাবলী উপেক্ষা করে থাকেন। ব্যবসায়িক ও শিল্পনীতিক সমাজে এই প্রথা এখন অচল। বর্তমান সমাজে এই প্রথা চালুরাখার সপক্ষে কোন কারণই থাকতে পারে না।”

সিমুলিয়ার দত্তবাড়ির অবস্থান কলকাতার ছয়ের পল্লীতে, যাকে বাংলার এথেন্স বলা হতো। কারণ যথেষ্ট। এই এথেন্সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, রমেশচন্দ্র দত্ত, তরু দত্ত, অরু দত্তর জন্ম। পুরো উত্তর কলকাতা ধরলে এক সহস্র নামেও বিশিষ্টদের তালিকা শেষ হবে না। দত্তদের বংশে বৈচিত্র্য প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের মন্তব্য : নরেন্দ্রনাথের পিতৃপুরুষের বংশে প্রভূত বিত্তশালী, সন্ন্যাসী, সরকারি চাকুরে, জনকল্যাণমূলক কার্যে ও দেশ সেবায় আত্মনিয়োগকারী মহান ব্যক্তিরা জন্মেছেন। আবার সাধারণ গৃহীর বেশে কেউ কেউ গুপ্তযোগীরূপে জীবনযাপন করেছেন।”

কলকাতা হাইকোর্টে জ্ঞানদাসুন্দরী বনাম ভূবনেশ্বরীর মামলার শুনানি শুরু হয় বিশ্বনাথের দেহাবসানের কয়েক বছর পরে ১৮৮৭ সালের গোড়ায়।

এই মামলায় সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্রনাথ বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টারের জেরার সম্মুখীন হন ৮ মার্চ ১৮৮৭।

এই মামলার বীজবপন ও ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ কীভাবে হলো তার কিছু বিবরণ রয়েছে আমার ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ বইয়ের প্রথম অংশে। সেই বিবরণের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।

শুধু এইটুকু বলা যায় বিচারপতি ম্যাকফারসন তার রায়ে বলেন, বিশ্বনাথ, যিনি পাওনাদারদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে কলকাতা ছেড়ে চলে যান, তিনি ১৮৭৯ সালে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসে যৌথপরিবারেই আশ্রয় নেন। মধ্যবর্তী সময়ে তিনি পাঞ্জাব ও মধ্যপ্রদেশে ওকালতি করেন। তবে প্রমাণিত হয়েছে, প্রবাসে উপার্জনকালে বিশ্বনাথ দত্ত তাঁর স্ত্রীকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। এই মামলায় বিতর্কিত বিষয় সম্পত্তি জ্ঞানদার স্বামী তারকনাথ কি তাঁর ভ্রাতৃবধূ ভূবনেশ্বরীর বেনামীতে কিনেছিলেন অথবা তা বিবেকানন্দ জননী ভূবনেশ্বরী নিজেই কিনেছিলেন তার স্বামী বিশ্বনাথের পাঠানো টাকায়? শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের রায়, জ্ঞানদাসুন্দরী তার অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

যাঁরা এই মামলা সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চান তারা জেনে রাখুন, তারকনাথের একটি চিঠি তাঁর স্ত্রীর মামলাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এই চিঠিতে তারকনাথ নিজেই পরিবারের একজনকে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, “শরিকী সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভূবনেশ্বরী।”

আরও প্রমাণ হয়, ১৮৭৯ সালে কেনা সম্পত্তি কালেকটরেট অফিসে নথিভুক্ত করার সময় তারকনাথ সানন্দে ভূবনেশ্বরীর হয়ে আদালতে উকিলের কাজ করেছিলেন। পরের বছর অবশ্য ভূবনেশ্বরী তার স্বামীকেই অ্যাটর্নি নিযুক্ত করেছিলেন।

এই পরবর্তী সময়টি ‘সুলোচনা’ উপন্যাসের পক্ষে খুবই মূল্যবান। সম্ভবত এই সময়েই ‘সুলোচনা’ রচিত হয়। ভূপেন্দ্রনাথ ভুল করে বলেছেন, বইয়ের প্রকাশকাল ১৮৮০। আসলে উপন্যাসের প্রকাশের বছর ১৮৮২।

১৪ মার্চ ১৮৮৭ আদালতের রায়ে পরাজিত হয়ে জ্ঞানদাসুন্দরী কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। ১০ নভেম্বর ১৮৮৭ আপীল আদালতে প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আর্থার উইলসন ও বিচারপতি রিচার্ড টটেনহ্যাম পূর্বতন রায় বহাল রেখে দিলেন।

এই মামলা চলার সময় টানা একবছর নরেন্দ্রনাথকে নিয়মিত কলকাতা হাইকোর্টে ছুটতে হয়েছিল। শোনা যায় তিনি পায়ে হেঁটে হাইকোর্টে যেতেন এবং পরে মায়ের কাছে সবিস্তারে সব ঘটনার বিবরণ দিতেন। আমাদের এই দেশে মহামানবরা সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত হয়েও পার্থিব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেন না। এই ১৮৮৭ সাল সন্ন্যাসী ও সাধক বিবেকানন্দর জীবনে স্মরণীয় সময়। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বিরজাহোম করে নরেন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম সন্ন্যাস নাম বিবিদিষানন্দ গ্রহণ করেন এবং ঐ বছরের কোনোসময় চিরতরে গৃহত্যাগ করেন।

*

বিশ্বনাথের উপন্যাসে বড় ভাই অনেকটা দত্তবাড়ির উপার্জনহীন কর্তা কালীপ্রসাদের মতন।

যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে স্বামী গম্ভীরানন্দের বর্ণনা : “কালীপ্রসাদ একদিকে ছিলেন অমিতব্যয়ী, অপরদিকে তেমনি ভ্রাতুস্পুত্র বিশ্বনাথের আয়ের উপর রাখিতেন পূর্ণ দাবি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি তিনি তো নষ্ট করিতেনই, অধিকন্তু বিশ্বনাথের অর্থেও ভাগ বসাইনে। শেষদিকে বিশ্বনাথবাবু তাঁহার কলিকাতার এটর্নি অফিসের উপর নজর রাখিতে পারিতেন না। জনৈক বন্ধুর উপর উহার ভার অর্পণ করিতে বাধ্য হন। বন্ধু এই সুযোগে বিশ্বনাথবাবুর নামে ঋণ করিয়া সেইসব অর্থ আত্মসাৎ করিতে থাকেন। …বিশ্বনাথের জীবনসন্ধ্যায় যৌথপরিবারে মনোমালিন্য বর্ধিত হওয়ায় তাহাকে বাস্তুভিটা ছাড়িয়া স্ত্রীপুত্রসহ পৃথক অম্নের ব্যবস্থা করিতে হয় এবং তজ্জন্য অস্থায়ীভাবে ৭ নং ভৈরব বিশ্বাস লেনের এক ভাড়াবাড়িতে চলিয়া যাইতে হয়। নরেন্দ্র তখন (১৮৮৩) বি. এ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। …ইহারই কোন এক সময়ে তিনি পিতার আদেশে পিতৃবন্ধু নিমাইচন্দ্র বসু মহাশয়ের অফিসে এটর্নির কাজ শিখিবার জন্য শিক্ষানবিশরূপে ভর্তি হইয়া প্রতিদিন পিতা ও খুল্লতাতের সহিত অফিসে বাহির হইতে থাকেন।”

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মন্তব্য আরও স্পষ্ট। “কাকা ও কাকীমার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে” একান্নবর্তী পরিবার থেকে ছিন্ন হওয়ার কোন ইচ্ছা বিশ্বনাথের ছিল না। তাই ভূবনেশ্বরীর প্রতি অন্যায় ও অসম ব্যবহার চলল দীর্ঘদিন।

বিশ্বনাথের মৃত্যুর কয়েক বৎসর পূর্বে কাকার পরিবার সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করবার জন্যে তাঁকে পৃথক করে দেন। পৃথক হবার পর আমাদের পরিবার সাময়িকভাবে ৭নং ভৈরব বিশ্বাস লেনে বাড়ি ভাড়া করে বসবাস করেন। সেখানে থেকেই নরেন্দ্রনাথ বি এ পরীক্ষার জন্য পড়া তৈরি করেছিলেন।

‘সুলোচনা’ উপন্যাসের কাহিনীতে যে অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা আছে তা এখানে ফাস করে সাসপেন্স নষ্ট করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। তবু মূল গল্পের পটভূমির আরও একটু ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

কিন্তু তার আগে বিশ্বনাথের জীবনের অন্তিমপর্ব ও তার থেকে তার স্ত্রীপুত্রদের দুঃখজনক শিক্ষা সম্বন্ধে দু একটা কথা বলে নেওয়া যেতে পারে।

অভিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন বিশ্বনাথ, তার খ্যাতি এতোই ছিল যে দেহাবসানের কিছু আগে হায়দ্রাবাদের নিজামের এজেন্টরা একটা মামলায় বিশ্বনাথকে হায়দ্রাবাদে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেছিলেন। “স্থির হয়েছিল যে, তিনি মাঘমাসের শেষে হায়দ্রাবাদে রওনা হবেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।”

বাংলার বাইরে থাকাকালে বিশ্বনাথ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হন–পরবর্তীকালে স্বামীজিও এই ব্যাধির শিকার হন।

আমাদের ধারণা স্বামীজির এই রোগ আমেরিকায় ধরা পড়েনি, তার ডায়াবিটিস ধরা পড়ে প্রথমবার দেশে ফেরার পথে কলঘোয়। কিন্তু রোমা নোলাঁর মতে স্বামীজির ডায়াবিটিসের লক্ষণ দেখা যায় সতেরো-আঠারো বছর বয়সে। তবে স্বামী গম্ভীরানন্দর সিদ্ধান্ত, প্রেসিডেন্সি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষ ক্লাশে পড়ার সময় তার প্রায়ই ম্যালেরিয়া হতো। প্রমাদাস মিত্রকে নরেন বাবাজী সম্পর্কে লেখা একখানি চিঠিতে ‘পুরনো রোগের উল্লেখ থেকে গবেষক শৈলেন্দ্র নাথ ধরের আশঙ্কা ইঙ্গিতটা ডায়াবিটিসের দিকে।

যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইতে বিশ্বনাথের অন্তিমপর্বের বর্ণনা এই রকম : “মৃত্যুর একমাস পূর্বে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া চিকিৎসকের পরামর্শানুযায়ী শয্যাগ্রহণ করেন। ইহার পরেই একটি কার্যস্থলে যাইতে হয়। সেখান হইতে ফিরিয়া পত্নীকে বলেন যে, মক্কেল তাঁহাকে বহুদূরে আলিপুরে দলিলপত্র দেখাইতে লইয়া গিয়াছিল, তিনি হৃদয়ে বেদনা অনুভব করিতেছেন। অতঃপর রাত্রে আহারের পর বুকে ঔষধ মালিশ করাইয়া তামাক সেবন করিতে করিতে তিনি কিছু লেখাপড়ার কাজে মন দেন; নয়টায় উঠিয়া বমি করেন এবং তারপরেই রাত্রি দশটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়।”

স্বামীজির ইংরিজি জীবনী গ্রন্থ ‘দ্য লাইফ’-এ বলা হয়, বি এ পরীক্ষার ফল বেরুবার আগে পিতা বিশ্বনাথের মৃত্যু হয়। শৈলেন্দ্রনাথ ধর অনুসন্ধান করে জানিয়েছেন বিশ্বনাথের মৃত্যুর অন্তত তিন সপ্তাহ আগে বি এ পরীক্ষার ফল বের হয়। ঐ বছর বি এ পরীক্ষা শুরু ৩১ ডিসেম্বর ১৮৮৩, গেজেটে ফল প্রকাশ ৩০ জানুয়ারি ১৮৮৪। বিশ্বনাথের দেহাবসান ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪।

অভিজ্ঞ আইনজীবী হয়েও বিশ্বনাথ কোনো উইল করেননি। ফলে মক্কেলদের কাছ থেকে পাওনাগণ্ডা আদায়ের জন্যও ভূবনেশ্বরী ও নরেন্দ্রনাথকে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সময় ও অর্থব্যয় হলেও এর একটা সুবিধা আমরা পেয়েছি, হাইকোর্টে ভূবনেশ্বরীর আবেদনপত্রে ভূবনেশ্বরী দাসীর বাংলা স্বাক্ষর এবং তার তলায় ইংরিজিতে পুত্র নরেন্দ্রনাথের স্বাক্ষরের অমূল্য দলিলটি, যা আজও কলকাতা হাইকোর্টে সংরক্ষিত আছে।

১১ আগস্ট ১৮৮৬তে লেটার্স অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের এই আবেদনে ভূবনেশ্বরী বলেন, মৃত্যুর আগে তাঁর স্বামী কোনো উইল করেননি। এইরকম কোনো দলিল তার অফিসে বা বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই আবেদনের সময় নরেন্দ্রনাথের বয়স বাইশ, অন্য দুই ভাই নাবালক। বিশ্বনাথের কয়েকজন মক্কেল যাঁদের কাছে টাকা পাওনা আছে তাদের নাম ঠিকানার বিবরণ এই আবেদনে আছে। তাদের নিয়ে কোনো অনুসন্ধান আজও হয়নি।

আবেদনপত্রে মায়ের বাংলা স্বাক্ষর সনাক্ত করে পুরো নাম সই করেন নরেন্দ্রনাথ। জানান, মায়ের দরখাস্ত তিনি পূর্ণ সমর্থন করছেন। এই মামলায় ভূবনেশ্বরীর অ্যাটর্নি ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দাস, ভুবনেশ্বরীকে সনাক্ত করেন কালীচন্দ্র দত্ত এবং ইংরিজি অনুবাদের বাংলা ব্যাখ্যা করে শোনান অবিনাশচন্দ্র ঘোষ, ইনটারপ্রেটার।

*

ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথ সুলোচনার উপাদান কতখানি নিজের পরিবার থেকে সংগ্রহ করেছেন? নায়কের আদিপুরুষদের কথা বলতে গিয়ে মূলগায়িন’ বলে একটি শব্দ বিশ্বনাথ ব্যবহার করেছেন।

দত্তরা এসেছিলেন বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে, চলতি ভাষায় কোথাও দেরেটোন, কোথাও দাড়িয়াটোন। দরিয়াটোনার দত্তরা মুঘল আমল থেকেই বিখ্যাত, দক্ষিণ-রাঢ়ী কায়স্থদের যে ত্রিশটি সমাজ ছিল দরিয়াটোনার দত্তরা তাদের অন্যতম। কোনো নবাব বাহাদুর প্রীত হয়ে গ্রামের নাম দত্ত-দরিয়াটোনা বলে ঘোষণা করেন। স্বামীজির পূর্বপুরুষ রামনিধি এই দত্ত-দরিয়াটোনা থেকে কলকাতায় এসে গড়-গোবিন্দপুরে বসবাস শুরু করেন।

বিশ্বনাথের উপন্যাসের নায়ক রামহরির ঠিকানা : শৰ্ষা গ্রাম, জয়পুর পরগণা, জেলা নবদ্বীপ। আদিপুরুষ কেনারাম বসু, যাঁর সম্বন্ধে পাঠক পাঠিকারা ইতিমধ্যেই কিছুটা জানতে পেরেছেন। কেনারামের একটি উক্তি থেকে লেখকের মনোভাব কিছুটা আন্দাজ করা যায় : “বাপের নাম জানিনে। পিতামহের নাম জানিনে কিন্তু চিনের বাদশার চোদ্দপুরুষের পরিচয় জানবার জন্য ব্যগ্র!”

কেনারাম বসুর জ্যেষ্ঠপুত্ৰ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ভজহরি তেরোটি পুত্রকন্যার পিতা। নায়ক রামহরি দ্বিতীয়পুত্র, তার একটি মাত্র সন্তান সুরথনাথ। অসামান্যা স্ত্রী সুলোচনার নামেই উপন্যাসের নামকরণ। সুলোচনার পিছনে কি বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী উঁকি মারছেন? না বিশ্বনাথ জননী শ্যামাসুন্দরী? ব্যক্তিজীবনে শ্যামাসুন্দরীর একটি মাত্র পুত্র; ভূবনেশ্বরী চারপুত্র ও ছয়কন্যার জননী।

‘সুলোচনা’ উপন্যাসে নায়ক রামহরি ও সুলোচনার একমাত্র পুত্র সুরথনাথ। চরিত্রটির ওপর লেখক সব ভালবাসা ঢেলে দিয়েছেন। একমাত্র সন্তানকে পৈত্রিক বাড়িতে স্ত্রীর কাছে রেখে রামহরি বসু একদা কর্মসন্ধানে দিল্লি পাড়ি দিয়েছিলেন।

বাড়ির কর্তা ভজহরি বসু সবসময়েই এত ব্যস্ত যে “মাথা চুলকাইবার” অবকাশ হতো না। এইপ্রসঙ্গে লেখকের ব্যঙ্গোক্তি : “শয্যা হইতে গাত্রোত্থান, নিত্যক্রিয়া সমাপন, মুহুর্মুহু তাম্রকুট ধূমপান, দণ্ডে দণ্ডে তীব্র মুখব্যাদান করিয়া হায়ি তোলা ইত্যাদি কর্মসমূহ একজন পুরুষের পক্ষে সাধ্য নহে।”

বসুদের যৌথ পরিবারে দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মীনশীরাম গুরুমহাশয় ও ভোলো খানসামা। মুহুরি নশীরাম কেনারামের রেখে যাওয়া সম্পত্তির দেখভাল করতেন ও পাওনা টাকা আদায় করতেন। রেগে গেলে তিনি ভজহরিকে বলতেন, “আমি না থাকলে তোমার প্রত্যহ চারকাটা মুড়ি, দুরেক চালের ভাত কোথা থেকে হবে?”

রামহরি যেমন লেখাপড়ায় পটু তেমনি নম্র ও সুশীল। সাহেবী কোম্পানিতে একটা সামান্য কাজ নিয়ে প্রবাস যাত্রার উদ্যোগ করেছিলেন।

বিদায়কালে দাদা ভজহরিকে প্রণাম করে রামহরি অন্তঃপুরে গেলেন এবং দেখলেন প্রিয়তমা ভার্যা ধুলোয় পড়ে অশ্রুনয়নে ক্রন্দন করছেন, আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করছেন। সেকালের বাঙালি পরিবারের যেসব পুরুষ কর্ম উপলক্ষে বিদেশ যেতেন তাদের মানসিক অবস্থার একটা চমৎকার ছবি এই উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে। রামহরি তার স্ত্রীকে প্রিয়পুত্র সুরথনাথের লেখাপড়ায় নজর রাখতে বললেন, সেই সঙ্গে বললেন, “আমি দাদার কাছে টাকা পাঠাবো। আর তোমার জন্যে লুকিয়ে প্রহ্লাদ সেনের (বন্ধু) কাছেও টাকা পাঠাব।”…বন্ধুর বিধবাভগ্নী “ক্ষমাদিদি এসে তোমার হাতে টাকা দিয়ে যাবে।”…পত্নী সুলোচনা আবার ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

প্রবাসে রামহরি যে কাজ করতেন তার মাইনে তেমন বেশি নয়। নায়ক ভাবছেন, এতো কম অর্থের জন্যে কেন বিদেশে আসা? বিশ্বনাথ যে তার নিজস্ব প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা এইখানে বেশ ভালভাবে কাজে লাগিয়েছেন তা স্পষ্ট।

এই সময় একদিন দিল্লির প্রসিদ্ধ বণিক রঘুরামজী কুঠিওয়ালার সঙ্গে রামহরির যোগাযোগ।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এদেশে মাড়ওয়ারি বণিকদের বাণিজ্যপদ্ধতি সম্বন্ধে অতি চমৎকার একটা ছবি বিশ্বনাথের এই উপন্যাস থেকে আমাদের বাড়তি প্রাপ্তি। সমস্ত ভারতবর্ষে রঘুরামজীর কুঠি ও কারবার, তখনকার দিনে তার অর্থের পরিমাণ চার পাঁচ কোটি, যা একুশ শতকের গোড়ায় প্রায় হাজার কোটি টাকার মতন।

ব্যবসা ছাড়াও রঘুরামজীর ছিল “সুবিস্তারিত রোকড়ের ও বেণেতি কার্য।” ধনপতি কুঠিয়ালরা সেযুগে নিজের দেশের লোক ছাড়া কাউকে দায়িত্বপূর্ণ চাকরি দিতেন না বলেই আমার ধারণা ছিল, কিন্তু বিশ্বনাথের উপন্যাস থেকে স্পষ্ট হচ্ছে এঁদের দু’একজন কৃতী বাঙালি কর্মীও থাকতেন।

চাকরির ইন্টারভিউতে রঘুরামজীর কাছে রামহরির সরল স্বীকারোক্তি, যে উদ্দেশ্যে দেশত্যাগী হয়েছিলেন তা সিদ্ধ হবার কোনো পথ দেখছেন না

। রঘুরামজীর স্মরণীয় মন্তব্য : “বাঙালি লোক ঝাঁকে ঝাঁকে এ অঞ্চলে আসছে। এরা শুনেছি লেখাপড়া জানে, কিন্তু এদের কর্মকাণ্ড দেখলে লেখাপড়ার কোনো ফল হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশ পঁচিশ টাকার একটা চাকরি পেলেই এরা কৃতার্থ হয়। কিন্তু দেখো আমাদের দেশের লোক এমন নয়বাঁধা মাইনের চাকরি পাবার জন্যে এরা মরে গেলেও চেষ্টা করে না। এরা সকলেই কারবার করে খায়।”

দেখা যাচ্ছে, বিশ্বনাথ বর্ণিত বাঙালির বাণিজ্যমানসিকতা দেড়শ বছর আগের ভারতবর্ষে যা ছিল একুশ শতকেও তাই রয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, সঙ্গতিহীন মাড়ওয়ারিরা কুঠি থেকে চটা সুদে কুড়ি পঁচিশ টাকা কর্জ করে বাংলায় যাচ্ছেন এবং দু’বছর পরে ধারের টাকা মিটিয়ে দিচ্ছেন। তারপর উত্তর ভারতের ভাগ্যসন্ধানী বণিকদের নির্ভরযোগ্য জীবনযাত্রা বর্ণনা, কলকাতার রাস্তায় এঁরা কাপড়ের গাঁট পিঠে করে বেড়ান। এঁরাই ক্রমশ হাউসের দালাল হন, কেউ কেউ নিজে কুঠিয়াল হন।

রঘুরামজীর প্রশ্ন : “তোমরা বল কাপড় বিক্রি ও দালালি ইতর কাজ–তবে কি মনে করো সাহেবের মুনসিগিরি সম্মানের কাজ?”

যে রঘুরামজীর ব্যবসায় রামহরি অবশেষে কাজ নিলেন তা আকারে বৃহৎ। হিন্দুস্থানের এমন জায়গা নেই যেখানে তার কুঠি বা কারবার নেই। দিল্লির সদর কুঠিতে প্রায় পাঁচশত কর্মচারী।

রঘুরামজীর ব্যবসার অতি আকর্ষণীয় বিবরণ রয়েছে এই উপন্যাসে, যা কেবল পাঠক-পাঠিকার ভাল লাগবে তা নয়, একালের বিজনেস ঐতিহাসিকদেরও কাজে লাগবে। মাড়ওয়ারি অফিসে তথাকথিত দেশওয়ালী কর্মীরা কিরকমভাবে তাদের মনিবের পয়সা আত্মসাৎ করত তার ছবিও রয়েছে। আর আছে শেয়ানে-শেয়ানে কোলাকুলি!

একটি চমৎকার চরিত্র হুকুমাদ সুখদয়াল, মীরাটে কুঠিয়াল। এই মীরাটেই অনেকদিন পরে লেখকের প্রিয় সন্তান যে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ হিসেবে নানা ইতিহাস রচনা করবেন তা কে জানত?

সেকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভাল ছিল না। আমরা দেখেছি নাগপুর থেকে রায়পুর যেতে ভূবনেশ্বরী ও সন্তানদের একমাস লেগেছিল। দিল্লি থেকে কলকাতা আসতে পঁচিশ দিন লেগে যেতো সেইসময়। ফলে গল্পের রামহরি যে সাত আট বছর বাড়ি এলেন না, কেবল চিঠি লিখলেন এবং টাকা পাঠালেন সেটা তেমন কিছু আশ্চর্যজনক নয়।

কিন্তু যৌথপরিবারে স্ত্রীপুত্রের প্রকৃত অবস্থা রামহরি জানতে পারতেন না। স্ত্রী সুলোচনার কাছ থেকে যেসব চিঠি পেতেন তা অস্পষ্ট এবং কিছু কিছু মুছে দেওয়া।

সুলোচনা ভাল বাংলা লিখতেন, অথচ চিঠিগুলো বোধ হয় অন্য কারুর হাতে পড়তে এবং তিনি লেখার ওপর চিত্রবিচিত্র কেটে দিতেন। বিশ্বনাথের উপন্যাসের এই অংশ পাঠ করলে স্পষ্ট হয়, যৌথ পরিবারে প্রোষিতভর্তৃকা ভূবনেশ্বরী কিভাবে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন এবং সন্তানদের নিয়ে মাঝে মাঝে তার কেমন অসহায় অবস্থা হতো। আজকের যুগের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে যৌথপরিবারের এই ব্যাপারটা নিতান্ত অসম্ভব এবং অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু যাঁরা যৌথপরিবারের ঘটনাবলি সে যুগের লেখকদের রচনা থেকে পুনরুদ্ধার করছেন তারা জানেন কোনো কিছুই সে যুগে অসম্ভব ছিল না।

সুলোচনার শুভানুধ্যায়িনী, স্বামীর বন্ধুর অগ্রজা, গ্রামের বিধবা ক্ষমা দিদির মন্তব্য : “ওমা শুনছি দশ পনেরো দিন অন্তর আঁজলা-আঁজলা টাকা পাঠায়, কিন্তু মেজো খুঁড়ির হাল দেখে কান্না পায়রুক্ষ্ম মাথা, ময়লা কাপড়–আর দিন দিন যেন পোড়া কাঠখানা হয়ে যাচ্ছে।”

একই সঙ্গে নজর দেওয়া যাক, বিদেশে কর্মরত বিশ্বনাথের যৌথ পরিবারে-ফেলে-আসা স্ত্রীর ছবি। পরবর্তীকালে পুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর স্বামী বিবেকানন্দ বইতে বলেছেন, তিনি মায়ের মুখ থেকে শুনেছেন, এমন সময়ও গেছে যখন ভূবনেশ্বরীকে একটিমাত্র শাড়ি পরে কাটাতে হয়েছে অথচ জায়েদের পরনে যথেষ্ট কাপড় থাকতো।

ভূপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, সেকালের অনেক অ্যাটর্নির মতন বিশ্বনাথ আদালতের নীলাম থেকে কলকাতায় সম্পত্তি ক্রয় করে তা আবার বিক্রি করতেন। কিন্তু প্রত্যেক সম্পত্তিই তিনি ভূবনেশ্বরীর নামে ক্রয় করতেন।

মহেন্দ্রনাথ তাঁর ছোটভাইকে বলেছিলেন, আপার সার্কুলার রোডে মানিকপীরের দরগা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পিতৃদেব কিনেছিলেন ভূবনেশ্বরীর নামে। জননী স্বয়ং তার কনিষ্ঠ পুত্রকে বলেছিলেন, কারবালা ট্যাঙ্ক রোডের দরগা থেকে প্রত্যহ তিনি পাঁচ টাকা থেকে আট টাকা প্রণামী পেতেন।

বিশ্বনাথ একসময় স্ত্রীর নামে সুন্দরবনে এগারো হাজার বিঘার বিস্তৃত তালুক কেনেন। কিন্তু খুড়শ্বশুর কালীপ্রসাদ তার ভ্রাতুষ্পত্রের বধূকে বলেন ‘তোমার কি বাবার তালুক’। ভূবনেশ্বরী বেশী কথা বলতেন না। এই গালি শুনে নরেন্দ্ৰজননী সম্পত্তির পাট্টাটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেন। আমরা জানি, বিশ্বনাথ পরে বুঝতে পারেন তার স্ত্রীর দুঃখ, পীড়া ও বেদনা। তিনি ক্ষুব্ধচিত্তে একদিন প্রকাশ করলেন অভিযোগ, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেটভরে খেতে পায় না।”

এসব বলা সত্ত্বেও বিশ্বনাথ যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, ফলে ভূবনেশ্বরীর কষ্ট শেষ হয়নি। কিন্তু যা ঘটবার তা ঘটল যথাসময়ে। পারিবারিক সম্পত্তির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করার জন্য কাকার পরিবার বিশ্বনাথকে পৃথক করে দিলেন। এই সময়ে তিনি সাময়িকভাবে সপরিবারে ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনের ভাড়াবাড়িতে উঠে যান।

প্রায় একই পরিস্থিতিতে সুলোচনা উপন্যাসের যৌথপরিবারে কী হল এবং কীভাবে জটীল সমস্যার অপ্রত্যাশিত সমাধান হল তা এখানে ফাঁস করতে চাই না, তাতে উপন্যাসপাঠের আনন্দ ও আকর্ষণ কমে যেতে পারে। শুধু এইটুকু বলতে চাই যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে বসে একজন কথাসাহিত্যিক যে কাল্পনিক উপন্যাস লিখছেন তার প্রায় সমস্ত উপাদান সংগৃহীত হচ্ছে একই বাড়ির বাস্তবতা থেকে।

শুভার্থিনী ক্ষমা দিদি সুলোচনাকে চুপি চুপি বলছেন, “তুই বলে এই ঘর করিস, আমরা হলে এতোদিনে কাপড় ফেলে পালাতুম।”

এরপরে ক্ষমাদি খবর দিচ্ছেন, “রাম বলেছে বেশি টাকা না পাঠিয়ে তোমার নামে একখানা তালুক কিনবে।”

সুলোচনার উত্তর : “তালুকের নাম শুনে তো আমার পেট ভরবে না।…বাপের এক মেয়ে বটে কিন্তু রোজ রোজ কে আব্দার শুনবে গা! লোক বলে, তুই বড় মানুষের মেয়ে, বড় মানুষের বউ, তোর দশা এমন কেন? তোর ভাবনা কিসের? লোকে তো ঘরের কথা জানে না তা বলবো কি বলল। রোজ রোজ বাবাকে কত বলে পাঠাবো বলো–আবার তিনি মনে করেন তাঁর মেয়ে কত সুখে ভাসছে।”

বিশ্বনাথ এই ডায়ালগে রামতনু বসু লেনে নিজের শ্বশুরবাড়ির কথা বলেছেন কিনা তা পাঠক-পাঠিকারা বিবেচনা করে দেখবেন। কুঞ্জবিহারী দত্তর জ্যেষ্ঠা কন্যা রাইমণি, তার স্বামী গোপালচন্দ্র ঘোষ। গোপালচন্দ্রের একমাত্র সন্তান রঘুমণি। এঁর স্বামী নন্দলাল বসুই বিশ্বনাথের শ্বশুর। ‘সুলোচনা’ উপন্যাসে রামহরির শ্বশুরের নাম নিধিরাম সরকার। তিনি সম্মৌলিক কায়স্থ।

ক্ষমাদিদি মারফৎ দুঃখিনী সুলোচনা তার প্রবাসী স্বামীর কাছে যে খবর পাঠিয়েছিলেন তা আমাদের এই তুলনামূলক আলোচনার পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ।”যদি তিনি আমাদের জ্যাস্ত দেখতে চান একবার যেন ফিরে আসেন–তার যক্ষের ধন নিয়ে কি স্বর্গে যাবো?”

সুরসিকা মাদিদির প্রতিশ্রুতি তিনি রামহরিকে খবর পাঠাচ্ছেন– “জনকনন্দিনী ধুলোয় পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছেন– এইবার বুঝি সীতা ঠাকরুণ প্রাণত্যাগ করেন।”

উপন্যাসকে অবলম্বন করে বাস্তবের ছবি আঁকা অপরাধ না হলে, বিশ্বনাথ তাঁর উপন্যাসে রামহরির তরুণ পুত্র সুরথনাথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা কৌতূহলের উদ্রেক করে। সুদীর্ঘকায় কিন্তু কৃষ অথচ বাহুদ্বয়ের ও উরুদেশের অস্থি স্থূল ও সবল। গৌরাঙ্গ, মস্তকটি সুগঠিত ও সুগোল। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ কোমল কেশাবৃত ললাট প্রশস্ত ও সুবিস্তারিত। যুগল সুব ধনুকের ন্যায় ঘন কেশরঞ্জিত, নেত্রদ্বয় সুদীর্ঘ ও ভাসমান।…গ্রীবা সমুন্নত ও স্কন্ধদ্বয় সুবিস্তারিত, দুই বাহু লম্বমান করিলে প্রায় দুই জানু স্পর্শ করিত। সুরথনাথের বয়স বোড়শ বর্ষ। ঠিক যে বয়সে স্বয়ং বিশ্বনাথ বিবাহ করেছিলেন উত্তর কলকাতার রামতনু বসু লেনের ভূবনেশ্বরীকে।

.

উপন্যাসে বসু পরিবারের ছেলেপুলেদের নামগুলি মজার–’ছেঁড়া’, ‘ভাঙ্গা’, ‘গোঁড়া, ‘খেঁদি’, ‘ভূতী’, ‘পদী’, ইত্যাদি।

পরবর্তী পর্বে রামহরি দেশে ফিরেছেন, সুলোচনা ফোঁস ফোঁস করে কেঁদে নিজের দুঃখের কথা বলতে লাগলেন।”ছেলেটির হাত ধরে পথের ভিখারিনী হয়ে বেড়াব?”

রামহরি তখনও যৌথপরিবারে বিশ্বাস হারাননি। “দেখো মেজো বউ, লোকে তোমার কথা শুনলে বলবে তুমি ঘর ভাঙতে চাও, আর তুমি দাদার ছেলেমেয়ের হিংসা করো। না হলে তোমার কান্নাকাটির কোনো কারণই তো দেখতে পাইনে।”

বিবেকানন্দপিতার উপন্যাসের সুবিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পুত্র সুরথনাথের বিবাহবর্ণনা।

উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বিবাহ উপলক্ষে যে বেহিসেবী কাণ্ডকারখানা চলত তার হৃদয়গ্রাহী কিন্তু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এই বিবাহবাসরের সঙ্গে স্বয়ং বিশ্বনাথের বসুপরিবারে বিবাহের তুলনীয় কিছু আছে কি না তা এতদিন পরে কারও পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়; তবে পাঠকপাঠিকারা মানসচক্ষে একটা ধারণা করে নেবার স্বাধীনতা অবশ্যই দাবি করতে পারেন।

যাঁরা কল্পনার সঙ্গে ঘটনাকে মিলিয়ে দেখবার জন্য সব সময় তেমন ব্যস্ত নন তারা বুঝতে পারবেন, নানা পারিবারিক উৎসবের ঘূর্ণিপাকে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ে অষ্টাদশ, উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি কেন অর্থসঞ্চয় করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে স্বামীজি বলেছিলেন, যারা কখনও লাখ টাকার ওপর বসলো না তারা কেমন করে বৈরাগ্যে আগ্রহী হবে?

‘সুলোচনা’ উপন্যাসে যৌথ পরিবারের নানা সমস্যা ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। লেখক নিপুণভাবে নানা ঘটনার মাধ্যমে যে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন তা একমাত্র ভুক্তভোগীর পক্ষেই বর্ণনা করা সম্ভব।

মূল উপন্যাসে যেমন সমস্যা আছে তেমন সমাধানসূত্রও রয়েছে। যথাসময়ে আসরে উপস্থিত হয়েছে এক সন্ন্যাসী। বাল্যকালে গৌরমোহন মুখার্জির ভিটে থেকে বেরিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসগ্রহণকারী পিতৃদেব দুর্গাপ্রসাদের কথাই কি অজান্তে বিশ্বনাথের কল্পনায় উপস্থিত হয়েছে? বড়ই কঠিন প্রশ্ন। তবে গল্প-উপন্যাসে আজও ‘উইশফুল থিংকিং’-এর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়নি। নিপুণ পাইলটের মতন আকাশচারী বিমানকে নিরাপদে মাটিতে নামিয়ে আনার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন সন্ন্যাসীর পুত্র এবং সন্ন্যাসীর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত।

আড়াইশ পৃষ্ঠার সুলোচনা’ উপন্যাস পড়া শেষ করে কোনো সন্দেহই। থাকে না ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সুলোচনা সম্বন্ধে যা লিখে গিয়েছেন তা সত্য, এই উপন্যাস স্বামী বিবেকানন্দের পিতৃদেবেরই রচনা।

ভূপেন্দ্রনাথ পারিবারিক সূত্র থেকে বলেছেন, আর্থিক অনটনেই এই উপন্যাস ছাপানো হয় জ্ঞাতি কাকা গোপালচন্দ্রের নামে। কিন্তু উপন্যাস প্রকাশকাল [১৮৮২] বিবেচনা করলে আন্দাজ করা যায়, এই সময় স্বামীজির ভিটেবাড়িতে যে গৃহবিবাদ পাকিয়ে উঠছে, মামলা মোকদ্দমার মাধ্যমে তা পরিবারের আর্থিক সর্বনাশ অবধারিত করবে এবং তার রেশ চলবে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের শেষ শনিবার পর্যন্ত।

পটভূমি হিসেবে এইটুকু বলা যায়, হাইকোর্টের আপীলে জিতেও সমস্যার সমাধান হয়নি।

মামলায় হেরে গিয়েও জ্ঞানদাসুন্দরী বাড়ির অংশ অধিকার করে বসে আছেন। পরবর্তীকালে সর্বস্ব হারিয়ে তিনি স্বামীজির কাছে অর্থভিক্ষা করছেন। স্বামীজি তাঁকে অর্থ না দিয়ে থাকতে পারলেন না।

৬ আগস্ট ১৮৯৯ স্বামীজি তার বিদেশিনী অনুরাগিনী মিসেস সারা বুলকে লিখছেন : “দুশ্চিন্তা? সম্প্রতি তা যথেষ্ট। আমার খুড়িকে আপনি দেখেছেন তিনি আমাকে ঠকাবার জন্যে তলে-তলে চক্রান্ত করেন। তিনি ও তার পক্ষের লোকজন আমাকে বলেন, ৬০০০ টাকায় বাড়ির অংশ বিক্রয় করবেন, আর তা আমি সরল বিশ্বাসে ৬০০০ টাকায় কিনি। তাদের আসল মতলব, তারা বাড়ির অধিকার দেবেন না, এই বিশ্বাসে যে, আমি সন্ন্যাসী হয়ে জোর করে বাড়ির দখল নেবার জন্য কোর্টে যাব না।”

স্বামীজি অবশ্য হাল ছাড়েন নি। শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন, মায়ের অপমান যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। মামলার জন্যে মঠের তহবিল থেকে তিনি ৫০০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন, সেজন্যে কিছু সমালোচনাও হয়, তবে স্বামীজি সেই দেনা শোধও করেন।

সংখ্যাহীন মামলায় জর্জরিত স্বামীজির বিধবা জননী ভূবনেশ্বরী। ১৯০২ জুন মাসে মর্ত্যলীলার শেষ শনিবার স্বামীজি বেলুড়মঠে বাগবাজারে নিবেদিতার বাড়িতে গিয়েছিলেন। বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষাও করেছিলেন, তারপর উদগ্রীব হয়ে পারিবারিক কুরুক্ষেত্রের সমাধানসূত্র খুঁজতে বসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন ভিটেবাড়ির শরিক হাবু দত্ত। স্বেচ্ছায় বিবাদ মিটিয়ে নেবার কথা বললেন হাবু দত্ত।

স্বামীজি সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। বললেন, যদি মীমাংসা হয় তা হলে আরও হাজার টাকা দেবেন। হাবু দত্ত ও তমু দত্ত রাজি। প্রিয় বন্ধু ও গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন হাবুর সঙ্গে অ্যাটর্নি পন্টুবাবুর কলকাতা অফিসে গেলেন।

দুই পক্ষের অ্যাটর্নিদের মধ্যে বারবার আলোচনা চললো। ২রা জুলাই (স্বামীজির মহাসমাধির মাত্র দুদিন আগে) শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে পন্টুকে হাবু দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী চারশ টাকা দেওয়া হল। অর্থাৎ আপাতত শেষ হল দীর্ঘদিনের সংঘাত। নিবেদিতার এক চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, শেষ দেখার সময়ে স্বামীজি তাকে বলেন, মামলারও নিষ্পত্তি হয়েছে আপসে–এবিষয়ে তাঁর কোনো খেদ নেই। অর্থাৎ অভাগিনী মায়ের সব সমস্যা অবিশ্বাস্যভাবেই সমাধান করে গেলেন আমাদের চিরপ্রণম্য স্বামী বিবেকানন্দ।

.

অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে বুঝতে গেলে সুলোচনা অবশ্যই পঠনীয়।

স্বামীজির বিচিত্র জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দীর দূরত্ব পেরিয়ে পিতৃদেব রচিত উপন্যাসের সামাজিক গুরুত্ব অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। যাঁরা স্বামী বিবেকানন্দর বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সম্বন্ধে আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন তাঁদের কাছে অধুনা-দুষ্প্রাপ্য সুলোচনা উপন্যাসটি নিতান্ত ছোট প্রাপ্তি নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *