১১. এরোগ্রামের চিঠিটা পড়তে পড়তে

তোমার এরোগ্রামের চিঠিটা পড়তে পড়তে শুধু হেসেছি। তোমার ওই কালো সুন্দরী মেয়েটাকে আমি দেখিনি কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ওকে তত বেশি ভালো লাগছে। বিদ্যা বুদ্ধি অভিজ্ঞতা দিয়ে নয়, আমার মনের একান্ত শুদ্ধ ও নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে অনুভব করি, ও সত্যি কত গভীর ভাবে তোমাকে ভালোবাসে আর আমাকে শ্রদ্ধা করে। আমার শোবার ঘরে আর স্টাডিতে তোমাদের দুজনের দুটো বড় বড় ছবি আছে। আজ রবিবার। এই উইকএন্ডে কোথাও যাইনি। এই তিনখানা ঘরের অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যেই বন্দিনী আছি, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য নিঃসঙ্গ বোধ করিনি। রবিবার তোমাদের দুজনের পুরনো চিঠিগুলো পড়েছি আর তোমাদের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি। মাঝে মাঝে তোমাদের দুজনের ফটোটা বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছি।

যাই হোক, তোমার সুন্দরীকে বোলো, সে ঠিক কথাই বলেছে। এই পৃথিবীর সব মেয়ের মনেই স্বপ্ন থাকে, কোনো না কোনো পুরুষ আদর ভালোবাসায় তার মন প্রাণ ভরিয়ে দেবে। আমারও সে স্বপ্ন ছিল। বোধহয় সে স্বপ্ন এখনও মরে যায়নি। এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, মনের মানুষকে কাছে পেলে নিজেকে বিলিয়ে দিতাম, ভাসিয়ে দিতাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভয় হয় স্বপ্নভঙ্গের, বিশ্বাসঘাতকতার, পিছিয়ে আসি, নিজেকে গুটিয়ে নিই।

যে বয়সে অধিকাংশ মেয়ে স্বপ্ন দেখে, পৃথিবীকে রঙিন মনে করে, মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায়, আমি তখন সত্যি স্বপ্ন দেখিনি। অবকাশ ছিল না। মার অসুস্থতা, বাবার মৃত্যু আমাকে এমনই বিব্রত করে তুলেছিল যে সমাজ সংসার পৃথিবী, সবকিছুই বিরূপ লেগেছিল। তারপর তো হঠাৎ একটা স্রোতের টানে ভেসে গেলাম। তখনও স্বপ্ন দেখার অবকাশ হয়নি। তারপর কিছুকাল নিজেই নিজেকে এমন ধিক্কার দিয়েছি যে জীবনের সূক্ষ্ম সুন্দর দিকগুলো মাথা উঁচু করতে পারেনি। লন্ডনে ডক্টর সরকারের স্নেহ ভালোবাসায় আবার আমি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলাম। যে সবুজ শ্যামল পৃথিবী হারিয়ে গিয়েছিল, তাকে আবার ফিরে পেলাম।

লন্ডন আসার মাস খানেক পরের কথা। এই মাস খানেকের মধ্যে লন্ডনের প্রায় সব দ্রষ্টব্যই আমার দেখা হয়েছে। শহরটাকে মোটামুটি চিনে ফেলেছি। এখন আমি টটেনহাম কোর্ট রোড টিউব স্টেশনে এসে নর্দান লাইনের গাড়ি দেখলেই উঠি না; দেখে নিই এজঅয়ার যাবে কি না। হ্যামস্টেডে থাকি বলে হ্যামস্টেড স্টেশনেই নামি না, গোল্ডার্স গ্রীনে নামি।

সেদিন কি একটা কাজে যেন বেরিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে বাড়িতে ঢুকতেই বুঝলাম, ডক্টর সরকার ফিরে এসে কারুর সঙ্গে গল্প করছেন।

আমি আমার ঘরে স্কার্ফ কোট জুতো খুলে তোয়ালে দিয়ে মুখটা একটু মুছে নেবার পর ওঁর ঘরে যেতেই উনি বললেন, এসো মা, আমার এক ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

আমি দু-এক পা এগোতেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন ও বললেন, আমি সন্দীপন ব্যানার্জি।

আমি কবিতা চৌধুরী।

ভাই রিপোর্টার, তোমার সুন্দরীকে বলল, এই সন্দীপন ব্যানার্জিকে দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল, বড় আপনলোক। হঠাৎ মুহূর্তের জন্য মনের মধ্যে অনেকগুলো স্বপ্ন একসঙ্গে ভীড় করে আমাকে আনমনা করে দিয়েছিল।

সন্দীপন বলল, বসুন।

সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর সরকার বললেন, হ্যাঁ, মা, বস।

বুঝলাম, স্বপ্নের ঘোরে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তাই ওদের কথায় একটু লজ্জিতই হলাম। আমি ওদের দুজনের মুখোমুখি বড় ডিভানের এক পাশে বসতেই ডক্টর সরকার হাসতে হাসতে বললেন, জানো মা, সন্দীপনরা চার ভাই বোনই আমার স্টুডেন্ট।

তাই নাকি? কিন্তু আপনি তো শুধু এরই প্রশংসা করেছেন; অন্য ভাই বোনদের কথা তো কিছু বলেননি।

সন্দীপন হাসতে হাসতে বলল, প্রশংসা করার মতো ছাত্র তো আমি নই। স্যারের অনেক ছাত্রছাত্রীই আমার চাইতে অনেক ব্রিলিয়ান্ট।

আমিও হাসি। বলি, সেসব খবর আমি জানি না। তবে আমার এই বুড়ো ছেলে আমার কাছে দিনের পর দিন আপনার প্রশংসা করেছেন।

ডক্টর সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তোমরা দুজনেই প্রশংসার যোগ্য অ্যান্ড আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ টু।

দু-চার মিনিট আরো কথাবার্তা বলার পর আমি চা করতে গেলাম। হঠাৎ সন্দীপন প্যান্ট্রির সামনে এসে আমাকে বলল, শুধু চা খাওয়াবেন না; আমার কিন্তু বেশ খিদে লেগেছে।

কি খাবেন? স্যান্ডউইচ?

আপত্তি নেই।

আর একটা কথা, আমি চা স্যান্ডউইচ খেয়েই চলে যাব না। একটু কাজে লন্ডন এসেছি। কয়েক দিন এখানে থাকব।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কে আপত্তি করছে? এ বাড়িতে আমার চাইতে আপনার দাবি অনেক বেশি।

ছিল ঠিকই কিন্তু আপনি এসে তো সব শেয়ার কিনে নিয়েছেন।

চা স্যান্ডউইচ নিয়ে ঘরে যেতেই ডক্টর সরকার আমাকে বললেন, সন্দীপ যখনই ব্রিস্টল থেকে আসে তখনই আমার এখানে থাকে। এবারও কয়েক দিন থাকবে।

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, যিনি মায়ের বিরুদ্ধে ছেলের কাছে নালিশ করেন, তাকে থাকতে দেওয়াই…

না, মা না, ও নালিশ করেনি।

সন্দীপন বলল, আমি এত বোকা না যে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করব।

তিনজনেই হেসে উঠলাম। হাসি থামলে ডক্টর সরকার বললেন, সন্দীপ, অনেক কাল তোমার হাতের মাংস রান্না খাই না!…

স্যার, আজই খাওয়াব।

একটু ভালো ওয়াইনও তো খাওয়াবে?

নিশ্চয়ই খাওয়াবো স্যার। এবার সন্দীপন আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট উইল ইউ হ্যাভ, ডক্টর মিস্ চৌধুরী।

আমি আমার মনের ইচ্ছাটা ঠাট্টাচ্ছলে হাসতে হাসতে বললাম, আই উইল বি হ্যাপি উইথ ইওর কোম্প্যানি ওনলি!

সে-রাত্রে আমাদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। তিন চার রাউন্ড ড্রিঙ্ক করার পর বৃদ্ধ ডক্টর সরকার গাইলেন, আমার জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান–

ডক্টর সরকারের গান শেষ হতে না হতেই সন্দীপন শুরু করল, তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি-

আমি আর ডক্টর সরকার হো হো করে হেসে উঠি।

সে রাত্রে হাসি-ঠাট্টা গান থামতে থামতে একটা দেড়টা বেজে গেল। তারপর খেতে বসেও ঘণ্টা খানেক সময় কেটে গেল।

পরের দিন সকালে আমিই প্রথম উঠলাম। ওরা দুজনে তখনও ঘুমুচ্ছেন। আমি সন্দীপনের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ওকে দেখলাম। মনে হল, ওর পাশে বসে ওকে ডাকি, সন্দীপ, উঠবে না? নাকি বিভোর হয়ে স্বপ্ন দেখছ? মনে মনে আরো কত কি বলেছিলাম মনে নেই কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে সন্দীপন হঠাৎ চোখ মেলে আমার দিকে তাকাতেই আমি লজ্জায় ভয়ে সঙ্কোচে পা নাড়াতে পারলাম না। পাথরের মূর্তির মতো ওখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বোধহয় মিনিট খানেক এভাবেই কেটে গেল।

সন্দীপন বলল, গুডমর্নিং!

গুডমর্নিং।

অনেক বেলা হয়েছে বলে ডাকতে এসেছেন? আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। আপনাকে দেখছিলাম।

ও খুশির হাসি হেসে চোখ দুটো বড় করে বলল, আমি কি টাওয়ার অব লণ্ডন যে আমাকে দেখছিলেন?

দেখছিলাম, কাল রাত্রের আপনি আর এখনকার আপনার মধ্যে কত পার্থক্য।

তাই নাকি?

আমি শুধু মাথা নাড়লাম।

দেখলেন? এখন আপনাকে কত শান্ত, স্নিগ্ধ লাগছে।

আর কাল রাত্রে?

সে তো কালবৈশাখী!

সন্দীপন হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু ওই কালবৈশাখীর ঝড়েই সব ধুলো বালি মালিন্য উড়িয়ে নিয়ে যায়।

আর আমি কথা বাড়ালাম না। বললাম, উঠে পড়ুন। আমি চা করছি।

ডক্টর সরকার তখনও ঘুমুচ্ছিলেন। আমরা দুজনে চা খাচ্ছিলাম। চা খেতে খেতে আমি ওকে বললাম, এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। আমাকে একটা চাকরি-বাকরি জোগাড় করে দিন।

আপনি ইচ্ছে করলে তে আজই চাকরি পেতে পারেন।

ইচ্ছা তো করছে কিন্তু পাচ্ছি কই।

একটু চুপ করে থাকার পর সন্দীপন জিজ্ঞাসা করল, বাইরে যেতে আপত্তি আছে?

বাইরে মানে?

লন্ডনের বাইরে।

বিন্দুমাত্র না।

ডক্টর সরকার আপত্তি করবেন না তো?

উনি কেন আপত্তি করবেন? একটু থেমে আমি বললাম, তবে ওঁর পরামর্শ নেওয়া আমার কর্তব্য।

একশোবার।

পট থেকে আরো খানিকটা চা নিজের কাপে ঢালতে ঢালতে উনি বললেন-ঠিক আছে, আমিই স্যারের সঙ্গে কথা বলব।

সেদিন নয়, পরের দিন রাত্রে খাবার টেবিলে ডক্টর সরকার আমাকে বললেন, মা, সন্দীপন তোমার জন্য একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করেছে।

আমি একটু অবাক হবার ভান করে বললাম, তাই নাকি?

আমি দেখলাম, সন্দীপন আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। কিন্তু ডক্টর সরকার তা লক্ষ্য না করেই বললেন, হ্যাঁ; তবে এখানে নয়, ওদের বিস্টলে।

এবার আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার মতো আছে?

একশোবার। বুঝলে মা, জীবনে কোনো সুযোগই দুবার আসে না।

আপনার মতো থাকলে নিশ্চয়ই যাব।

তবে মাঝে মাঝে উইক-এন্ডে এসো। তা নয়তো এই বুড়ো ছেলেকেই মায়ের কাছে ছুটতে হবে।

নিশ্চয়ই আসব।

খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা তিনজনে তিন ঘরে শুতে গেলাম। আমি, আমার ঘরে গিয়ে শাড়ি-টাড়ি ছেড়ে নাইটি পরলাম। চুল ব্রাশ করছি, এমন সময় দেখি আমার ঘরের দরজার নীচে দিয়ে একটা খাম এগিয়ে আসছে। প্রথমে একটু অবাক হলেও পর মুহূর্তে বুঝলাম, নিশ্চয়ই সন্দীপন দিয়ে গেল। যা ভেবেছিলাম, তাই। খুলে দেখি ছোট্ট একটা কাগজে লেখা, কদিন ধরেই আপনাকে একটা কথা বলতে চেষ্টা করছি কিছুতেই বলতে পারছি না।

ছোট্ট কাগজখানা হাতে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম নানা কথা। তারপর ওই কাগজেরই উল্টো দিকে লিখলাম, সে কথা কী শুধু আমাকে বলতে হবে?

দরজার নীচে দিয়ে কাগজখানা ওপাশে দিয়ে দেবার এক মিনিটের মধ্যেই জবাব এলো, হ্যাঁ, শুধু আপনাকেই সে কথা বলব!

ঠিক আছে, কাল বলবেন।

পরের দিন সকালে সন্দীপন ব্রেকফাস্ট না খেয়েই বেরিয়ে গেল। খানিকটা পরে ব্রেকফাস্ট শেষ করেই ডক্টর সরকার বেরিয়ে গেলেন। তার ঘন্টা খানেক পরেই সন্দীপন ফিরে এলো।

জিজ্ঞাসা করলাম, প্রফেসর ব্রুকস-এর সঙ্গে দেখা হল?

হ্যাঁ। স্যার কখন ফিরবেন?

বিকেলের দিকে ফিরবেন।

কিন্তু…আমার কাজ হয়ে গেছে। তাই ভাবছিলাম, দুপুরেই চলে যাব।

ডক্টর সরকারের সঙ্গে দেখা না করে যাবেন কেমন করে?

যাব না?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, না।

কাল চলে যাব?

এখানকার কাজ যখন হয়ে গেছে তখন আর শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন কেন?

সন্দীপন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, না, সব কাজ হয়নি; একটা কাজ বাকি আছে।

সে কাজটা সেরে নিন।

আপনি অনুমতি দিচ্ছেন?

আমি অনুমতি দেব?

হ্যাঁ, সে কাজটা আপনার সঙ্গে।

বলুন, কী কাজ।

সন্দীপন কোনো কথা না বলে আমার দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিতেই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম। ও দুহাতে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল।

অনেক রাত হয়েছে। শুতে যাচ্ছি। পরের চিঠিতে বাকি ইতিহাস জানাব।

তুমি আর তোমার সুন্দরী আমার প্রাণভরা ভালবাসা নিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *