০৮. আলো আঁধারের খেলা

এই পৃথিবীতে যেমন আলো আঁধারের খেলা চলে, আমার জীবনেও ঠিক তেমনি ভালোমন্দের খেলা চলছে। কাকুর আশ্রয় ছেড়ে আসার সময় মনে হয়েছিল, এ অন্ধকার আমার জীবন থেকে কোনো দিন কাটবে না, কিন্তু এমনই আশ্চর্য ব্যাপার যে তার পরই আনন্দে খুশিতে আমার জীবন আবার ঝলমল করে উঠল।

পাঁচ সাত দিন কেটে যাবার পর একদিন ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে অমিয় বলল, যত দিন তুমি এ দেশে থাকবে ততদিন তুমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তার মানে? এ দেশে ছাড়া আর কোন দেশে থাকব?

না তুমি এ দেশে থাকবে না।

বাজে বকো না। আমি আবার কোথায় যাব আমি হেসে বললাম, তোমাদের দুজনের ঘাড় ভেঙে যখন এমন মৌজ করে দিন কাটাচ্ছি তখন আর…।

অমিয় অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, সে কী? তুমি খরচাপত্র দিচ্ছ না?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি খরচ না দিলে কি তোমার একার দ্বারা এ সংসার এভাবে চলত?

যাই হক অমিয় বলল, পাসপোর্টের অ্যাপলিকেশন এলেই তুমি পাসপোর্টের জন্য অ্যাপ্লাই করবে।

কেন? পাসপোর্ট দিয়ে আমি কি করব?

এ দেশে থাকলে তোমার মতো মেয়ের কপালে অনেক দুঃখ আছে। তোমাকে এখানে থাকতে হবে না।

কিন্তু বিদেশ গিয়ে আমি কি করব?

হোয়েন ইউ উইল কাম টু দ্য ব্রিজ, ইউ ইউল ক্রস দ্য ব্রিজ। এখন সেসব কথা ভাবতে হবে না।

সেদিন আর কোনো কথা হল না। ও অফিস চলে গেল।

দুএকদিন পর অফিস থেকে ফিরেই অমিয় আমাকে পাসপোর্টের ফর্ম দিয়ে বলল, এটা ফিল আপ করে রেখ। তারপর সুপর্ণার সঙ্গে গিয়ে প্যারাডাইস স্টুডিও থেকে ছবি…

কিন্তু…

সুপর্ণা বলল, অত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন? তোর মতো মেয়ে বিদেশে গেলে কত সুযোগ পাবি…

হঠাৎ তোরা দুজনে আমাকে তাড়াবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছিস কেন?

অমিয় গম্ভীর হয়ে বলল, যদি অবিলম্বে বিয়ে করে নার্সিংহোমে ভর্তি হতে রাজি থাকিস, তাহলে অবশ্য বিদেশে না গেলেও চলবে।

আজে-বাজে কথা বললে, একটা থাপ্পড় খাবে।

মোটেও আজেবাজে কথা বলছি না; ঠিক কথাই বলছি। তোমার মতো মেয়ের পক্ষে এদেশে একলা থাকা অসম্ভব।

কেন?

চারদিক থেকে এত শুভাকাক্ষীর সমাগম হবে যে আত্মরক্ষার জন্য কোনো পথ পাবে না।

তারপর একদিন আমি সত্যি সতিই পাসপোর্ট পেলাম।

অমিয় জিজ্ঞাসা করল, জাহাজে যাবে, নাকি প্লেনে যাবে?

কোথায়?

আপাতত লন্ডনে।

তারপর?

তারপর যেখানে তোমার অদৃষ্ট টেনে নেবে, সেখানেই যাবে।

লন্ডনে গিয়ে কি করব?

বাপ-ঠাকুর্দার দেওয়া টাকা যখন আছে, তখন আরো দু এক বছর লেখাপড়া করে জীবন সংগ্রাম শুরু করে দাও।

আমি মুখ নীচু করে একটু গম্ভীর হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, সত্যি সত্যি তুমি আমাকে যেতে বলছ?

হ্যাঁ কবিতা। এই সতী-সাবিত্রীর দেশে তোমার মতো নিঃসঙ্গ যুবতীর শান্তিতে থাকা সত্যি অসম্ভব। তুমি বাইরেই চলে যাও।

বিদেশে কি সবাই সাধু?

না, তা নয়; তবে সেখানে ছুঁচোর মতো রাতের অন্ধকারে কেউ তোমাকে বিব্রত করবে না। যারা তোমাকে চাইবে, তারা সোজাসুজি তোমাকে সে কথা বলতে দ্বিধা করবে না।

আমি মুখ নীচু করেই চুপ করে বসে থাকি।

কোনো কথা বলি না। ভাবি। নানা কথা। আকাশ-পাতাল। অতীত-ভবিষ্যৎ।

অমিয় আবার বলে, ও দেশে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলতে পারেন আমি বেজন্মা, বাস্টার্ড! আর এ দেশে? ছত্রিশ কোটি দেবতার দেশে আমরা মহাবদমাইস হয়েও ভদ্রলোকের খোলস পরে বেশ দিন কাটাচ্ছি।

আমি আর সুপর্ণা দুজনেই হাসি।

অমিয় রেগে ওঠে, না, না, হাসির কথা নয়। আমরা কত বিধবা আর কত ঝিয়ের সর্বনাশ করেও ভদ্দরলোকের ভূমিকায় অভিনয় করে সবাইকে বোকা বানিয়ে দিচ্ছি।

সুপর্ণা প্রশ্ন করে, তাই বলে বিলেতে কি কেউ কোনো মেয়ের সর্বনাশ করে না?

হাইকোর্টের পাকা ব্যারিস্টারের মতো অমিয় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, করে, কিন্তু তারা নবজাত শিশুকে ডাস্টবিনে ফেলে আসে না।

রাত্তিরে খেতে খেতে অমিয় বলল, আমার এক অধ্যাপক ডক্টর সরকার এখন লণ্ডনে আছেন। আমি তাকে লিখে দেব। তিনি তোমার সব ব্যবস্থা করে দেবেন। তারপর তুমিই তোমার ব্যবস্থা করে নিতে পারবে।

যদি না পারি?

ফিরে এসো। এ বাড়ির দরজা তো তোমার কাছে সব সময়ই ভোলা থাকবে।

সুপর্ণা বলল, একবার গেলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবি না। তারপর একটু হেসে বলল, তুই ওখানে থাকলে একবার হয়তো আমরাও ঘুরে আসব।

অমিয় বলল, হয়তো মানে? ডেফিনিটলি যাব।

.

ভাই রিপোর্টার, যখনকার কথা বলছি, তখন পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন ছিল কিন্তু বিদেশ যাওয়া সহজ ছিল। জাহাজ প্লেনের ভাড়াও অনেক কম ছিল। তবু কলকাতা ছেড়ে বিদেশ যাবার কথা মনে হতেই খারাপ লাগল। এই এত বড় পৃথিবীতে আমার কোনো আপনজন না থাকলেও নিজের দেশ, সমাজ সংসার ছেড়ে বিদেশ যেতে মনে মনে বিশেষ উৎসাহবোধ করলাম না। আবার মনে হল, না, না, চলেই যাই। কি হবে এদেশে থেকে? কে আছে আমার? এখানে একলা থাকলেই অসংখ্য পরিচিত অপরিচিত মানুষের সমালোচনার শিকার হতে হবে। শৈশবে মা-বাবা, কৈশোরে ভাইবোন, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে সন্তান ছাড়া এ দেশে কোনো মেয়ের পক্ষে একা থাকা স্বাভাবিকও নয়, সম্ভবও নয়। এই যে অমিয় আর আমি! নিছকই ভাইবোন কিন্তু পারব কি আমরা দুজনে একসঙ্গে হাসতে, খেলতে, গল্প করতে? না। প্রত্যেকটি দর্শক এক একটি আরব্য উপন্যাস সৃষ্টি করবে। যে দেশে ভাইবোন একসঙ্গে তীর্থ ভ্রমণে যেতে পারে। না, সে দেশে না থাকাই ভালো।

আবার মনে মনে ভাবি, যে সমালোচনা করবে করুক, তবু তো এটা আমার দেশ। এখানে আমার ইচ্ছামতো হাসতে ও কাঁদতে পারি কিন্তু বিদেশে? সেখানে কে আমার আনন্দে হাসবে? দুঃখের দিনে কে আমার জন্য চোখের জল ফেলবে? তাছাড়া একবার বিদেশ গেলে তো চট করে আর আসতে পারব না।

অমিয়, ভাই একটা কথা বলব।

বল।

তুমি এখানেই আমার একটা চাকরি জোগাড় করে দাও। আমি একলা একলা বেশ থাকতে পারব।

ও হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি ভাইফোঁটা দিয়ে সব পুরুষ মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্য দূর করতে পারবে?

আমি কি হেলেন অফ ট্রয়?

ঈষৎ তির্যক দৃষ্টিতে অমিয় একবার আমাকে দেখে নিয়ে সুপর্ণাকে বলল, তোমার বান্ধবীকে বলে দাও, এই পৃথিবীর সব পুরুষ আমার মতো সন্ন্যাসী নয়।

সুপর্ণা হাসতে হাসতে বলল, তুমি সন্ন্যাসী!

অব কোর্স!

তোমার মতো কামুক এ পৃথিবীতে আর কেউ আছে?

কজন পুরুষ সম্পর্কে তোমার অভিজ্ঞতা আছে সুন্দরী?

একজনকে দেখে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে আর দেখার দরকার নেই।

অমিয় গম্ভীর হয়ে বলল, শাস্ত্র বলেছে, ধর্ম রক্ষার জন্য বংশরক্ষা করা পুরুষের অবশ্য কত।

এতক্ষণ আমি মুখ টিপে হাসছিলাম। এবার বললাম, তাই বুঝি এক দিনের জন্যও বৌকে ছেড়ে থাকতে পারো না?

মিস চৌধুরী, ইউ আর মিসটেক। আমার স্নেহালিঙ্গন ছাড়া আমার স্ত্রীর ঘুম আসে না।

সুপর্ণা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, হা ভগবান! কি মিথ্যেবাদী! আমাকে রাগালে আমি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব।

আমি সঙ্গে সঙ্গে সুপর্ণার হাত ধরে বললাম, প্লিজ, এখনি ভাঙতে শুরু কর!

আস্তে আস্তে দিনগুলো এগিয়ে চলে আর অমিয়ও আমার বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে উদ্যোগ আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ করে আনে। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফিরে এসেই আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলল, হিয়ার ইজ এ লেটার ফ্রম ডক্টর সরকার। পড়ে দেখ। বেশ এনকারেজিং চিঠি।

চিঠিখানা পড়ে দেখি ডক্টর সরকার লিখেছেন, তোমার বোন ডক্টরেট হলে এখানে নিশ্চয়ই ভালো সুযোগ পাবে এবং আমি আমার যথাসাধ্য সাহায্য করব। মনে হয় তোমার বোনের কোনো অসুবিধা হবে না।

ডক্টর সরকারের এই চিঠিখানা পড়ার পর বিদেশ যাওয়া সম্পর্কে আমিও উৎসাহ বোধ করলাম। অমিয় আর সপুর্ণাকে বললাম, সামনের মাসের সাত তারিখে আমার ভাইবা। তারপর কয়েক দিনের মধ্যেই রেজাল্ট জানতে পারব। যদি সত্যি সত্যি ডক্টরেটটা পেয়ে যাই তাহলে ভাবছি চলেই যাব।

অমিয় বলল, ভাবছি মানে? তোমাকে বিদায় না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।

আমি সুপর্ণাকে বললাম, দ্যাখ, তোর স্বামীর নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। তা নয়তো ও আমাকে তাড়াবার জন্য এমন পাগল হয়ে উঠেছে কেন?

সুপর্ণা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

অমিয় বলল, খুব স্বাভাবিক। বিদ্যাসাগর মশাইকে পর্যন্ত কত অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে। সুতরাং আমার মতো মহাপুরুষকেও যে তোমরা বদনাম দেবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

সুপর্ণা ঠোঁট উল্টে বলল, তুমি মহাপুরুষ!

এ গ্রেট ইজ নোন বাই দ্য নাম্বার অফ হিজ এনিমিজ—

আমরা তিনজনেই একসঙ্গে হেসে উঠি।

.

ভাই রিপোর্টার, আশু মুখুজ্যে মারা যাবার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বারোটা বেজেছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ আমিও ডক্টরেট পেলাম। আমার রেজাল্ট বেরুবার পর অমিয় প্রায় আহার নিদ্রা ত্যাগ করে আমাকে বিলেত পাঠাবার ব্যাপারে যে কি পরিশ্রম করেছিল, তা তুমি ভাবতে পারবে না।

আমার বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে এত কিছু লেখার প্রয়োজন ছিল না কিন্তু তবু আমি না লিখে পারলাম না। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ বিশেষ কাজের জন্য আসে সে কাজ শেষ হইলেই তারা চলে যায়। আমার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার জন্যই বোধহয় ও এসেছিল। তা না হলে আমি চলে আসার এক বছরের মধ্যে অমিয় ক্যান্সারে কেন মারা গেল? আমার স্থির বিশ্বাস, ও থাকলে আমার জীবনটা এমন হতাশায় ভরে যেত না।

অমিয়কে হারাবার পর আমি নতুন করে উপলব্ধি করলাম, এ পৃথিবীতে শুধু দুঃখ ভোগের জন্যই আমি এসেছি। আমার মুখের হাসি ভগবান কিছুতেই সহ্য করবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *