১০. সংবাদপত্র ও তৎসংক্রান্ত আইন

দশম অধ্যায় – সংবাদপত্র ও তৎসংক্রান্ত আইন

১. সংবাদপত্র (১৭৮০-১৮৫৭)

(ক) ইংরেজী পত্রিকা

ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ছিল একটি ব্যবসায়ী দল। ভারতের সাধারণ ইংরেজ অধিবাসীরা তাহাদের গভর্নমেন্ট বা কর্মচারীবৃন্দকে খুব শ্রদ্ধা ও প্রীতির চক্ষে দেখিত না। সংবাদপত্রেও এই মনোভাব প্রতিফলিত হইত। সুতরাং ইংরেজ সরকার ও ইংরেজী সংবাদপত্র, এই দুইয়ের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের ভাব ছিল। বাংলা দেশের প্রথম সংবাদপত্র, ইংরেজীভাষায় লেখা, হিকি সাহেব (James Augustus Hicky) সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা বেঙ্গল গেজেট (Bengal Gazette)। ইহা ১৭৮০ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইহার আর এক নাম ছিল Calcutta General Advertiser। দুই পাতার এই ক্ষুদ্র পত্রিকার অধিকাংশই বিজ্ঞাপনে ভরা থাকিত, বাকী অংশে উচ্চপদস্থ রাজপুরুষদের সম্বন্ধে বহু কুৎসা প্রচার করা হইত বড়লাট, তাঁর পত্নী, চীফ জাষ্টিস্, পাদ্রী, রাজকর্মচারীকেহই হিকির কুৎসা হইতে অব্যাহতি পাইতেন না। গভর্নমেন্ট হিকিকে জব্দ করার জন্য সাধারণ ডাকের মারফৎ তাঁহার সংবাদপত্র পাঠানো বন্ধ করিলেন। প্রত্যুত্তরে হিকি মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা যে ইংরেজ জাতির জন্মগত অধিকার এবং সুশাসনের একটি প্রধান অঙ্গ’, এই উচ্চ আদর্শ প্রচারপূর্বক এক তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশ করিয়া বলিলেন যে, এই স্বাধীনতা হরণ করা স্বৈরতন্ত্রের পরিচায়ক। চল্লিশ বৎসর পরে রামমোহন রায়ও বাঙ্গালীর পক্ষ হইতে এই স্বাধীনতার দাবি করেন। হিকির কাগজ বেশীদিন চলে নাই। ১৭৮১ সনে একজন পাদরী ও বড়লাট স্বয়ং হিকির বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ করেন। হিকির কারাদণ্ড হয় ও তাহার কাগজ বন্ধ হইয়া যায়।

১৭৮০ হইতে ১৭৯৩ সনের মধ্যে কলিকাতায় আরও ছয়টি কাগজ বাহির হয়। ইহাদের মধ্যে ইণ্ডিয়া গেজেট (India Gazette) (১৭৮০), কলিকাতা গেজেট (Calcutta Gazette) (১৭৮৪), এবং হরকরা (Hurkaru বা Hircarrah) (১৭৯৩) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকাগুলিতে বিদেশের ও ভারতের রাজনীতির সংবাদ থাকিলেও ইহাতে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গী ছিল না এবং এগুলি প্রধানত ইংরেজদের জন্য লিখিত হইত। তবে কয়েকটি পত্রিকায় ইংরেজশাসনের কঠোর সমালোচনা করা হইত এবং ইহার জন্য সম্পাদকদের কষ্ট ও লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইত। Bengal Journal (১৭৮৫) ও Indian World পত্রিকার সম্পাদক আমেরিকাবাসী আইরিস Wiliam Duane বহু দুর্গতি ও লাঞ্ছনা সহ্য করিয়া অবশেষে ভারতবর্ষ হইতে নির্বাসিত হইলেন। পূর্বোক্ত Bengal Hurkaru (হরকরা) নামে যে পত্রিকা ১৭৯৩ সনে প্রচারিত হয় তাহা নীলকরদের সমর্থন করিত। ১৭৯৮ সনে ঐ (অথবা ঐ নামে নূতন এক) পত্রিকা বাহির হয়। ১৮১৯ সনে ইহা দৈনিকে পরিণত হয়। ভারতবর্ষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য Bangal Hurkaru পত্রিকার সম্পাদক Charles Maclear-কে গ্রেপ্তার করিয়া অনেক কষ্ট ও লাঞ্ছনা দেওয়ার পর নির্বাসিত করা হয়। ১৮১৮ সনে প্রতিষ্ঠিত Calcutta Journal পত্রিকার সম্পাদক James Silk Buckingham শাসন-নীতির বিরুদ্ধে মন্তব্য করায় তাঁহাকেও নির্বাসিত করা হয়। এই পত্রিকাটি ভারতীয় ইংরেজ শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা দ্বারা খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল এবং ইহার সম্পাদক বাকিংহামও সম্পাদক হিসাবে খুবই সুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। পত্রিকাটি প্রথমে সপ্তাহে দুইবার প্রকাশিত হইত, কিন্তু এক বৎসরের মধ্যেই দৈনিকে পরিণত হয় (মে, ১৮১৯)। সম্ভবত ইহাই ভারতের প্রথম দৈনিক পত্রিকা। বাকিংহাম একজন উচ্চপদস্থ ধর্মযাজকের কার্যের নিন্দা ও তীব্র বিরুদ্ধ সমালোচনা করায় তাঁহার কাগজ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয় এবং তাঁহাকে ও তাঁহার সহকারী সম্পাদককে ভারত হইতে বিলাতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। বিলাতে তিনি Oriental Herald নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন–ইহাতে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে অনেক সংবাদ প্রচার হইত।

১৮৩০ সনে অর্থনীতিক জগতে বিষম দুর্বিপাক ঘটে এবং বহু ইংরেজ ব্যবসায়ীর গুরুতর লোকসান হয়। সংবাদপত্র-জগতেও ইহার প্রভাব লক্ষিত হয়। John Bull নামক পত্রিকা বিক্রয় হইয়া যায় এবং তাহা Englishman নামে প্রকাশিত হইতে থাকে। দ্বারকানাথ ঠাকুর India Gazette ক্রয় করিয়া Bengal Hurkaru-র সঙ্গে সংযুক্ত করেন। Calcutta Courier-এর প্রকাশ বন্ধ হয়।

১৮৩১ সনে ডিরোজিও (De’rozio) East India ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় Inquirer পত্রিকা প্রকাশিত করেন।

১৮৩১ সনে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের সম্পাদনায় Indian Reformer প্রকাশিত হয়। ইহা নব্য বাংলার প্রগতিশীল সম্প্রদায়ের মুখপত্র বলিয়া গৃহীত হইত। এই শ্ৰেণীর আর-একটি পত্রিকা ছিল রামগোপাল ঘোষ সম্পাদিত Bengal Recorder (১৮৪২)। ইহা প্রথমে মাসিক, পরে পাক্ষিক ও সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। সে-যুগে ইহা খুব প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। আর একখানি উচ্চশ্রেণীর পত্রিকা ছিল কাশীপ্রসাদ ঘোষের সম্পাদিত Hindu Intelligencer (১৮৪৬)। ইহাতে তাহার দেশাত্মবোধক কবিতাগুলি প্রকাশিত হইত। সে-যুগে নব্যবঙ্গ সমাজের আর একজন প্রধান নেতা তারাচাঁদ চক্রবর্তী Quill নামে এক পত্রিকা প্রকাশিত করেন (১৮৪২)। হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা, Parthenon (১৮৩০), Gyananneshun (জ্ঞানান্বেষণ) (১৮৩১-৪৪), Hindu Pioneer ও Bengal Spectator (১৮৪২) পত্রিকার মাধ্যমে রাজনীতিক ও সামাজিক বিষয়ে নূতন প্রগতিশীল মত প্রচার করেন। ১৮৩৯ সনে কলিকাতায় ২৬টি ইউরোপীয় সম্পাদিত পত্রিকা ছিল। ইহার মধ্যে ৬টি ছিল দৈনিক। ১৮৫১ সনের পূর্বে আরও কয়েকটি প্রকাশিত হয়, ইহার মধ্যে Englishman এবং Friend of India বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু, দুই একটি ব্যতীত প্রায় সকল পত্রিকাই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গী হইতে লিখিত।

১৮৫৩ সনে প্রকাশিত Hindoo Patriot নামক সাপ্তাহিক পত্রিকাতে বাংলার নবজাগ্রত রাজনীতিক চেতনার উন্মেষের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথমে (১৮৪৯) কলিকাতার সম্ভ্রান্ত একটি ঘোষ-পরিবারের তিন ভ্রাতা Bengal Recorder নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিন-চারি বৎসর পরে স্বনামধন্য হরিশ্চন্দ্র মুখার্জী ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন ও ইহার নাম হয় Hindoo Patriot। সম্পাদক ও রাজনীতিক নেতা হিসাবে উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাসে হরিশ্চন্দ্র মুখার্জীর নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে।

এই পত্রিকার প্রচারের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, দেশের স্বার্থ এবং যে সকল রাজনীতিক ও সামাজিক কু-ব্যবস্থা দেশের বর্তমান দুর্দশার কারণ, নিরপেক্ষভাবে তাহার বিচার ও প্রচার করা। আরও বলা হইয়াছে যে, ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতশাসনে নূতন সনদ দেওয়া উপলক্ষে যে আলোচনা ও তর্কবিতর্কের সূত্রপাত হইয়াছে তাহার ফলে যাহাতে ভারতের শাসনব্যবস্থার সংস্কার হয় সেজন্য ভারতবাসীর পক্ষ হইতে তদুপযোগী যুক্তি উপস্থাপিত করিয়া তাহা সমর্থন করা এবং এ সম্বন্ধে যতটুকু সাধ্য চেষ্টা করা প্রত্যেক ভারতবাসীরই কর্তব্য।

এই পত্রিকাখানি দেশের শাসন-সংস্কার ও নানাবিধ দুঃখদুর্দশা দূর করার কার্যে কী পরিমাণ সাহায্য করিয়াছিল এই গ্রন্থের নানা স্থানে তাহার উল্লেখ করা হইয়াছে।

(খ) বাংলা পত্রিকা (১)

১৮১৮ সনের পূর্বে বাংলাভাষায় কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় নাই। ঐ বৎসর ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ (Weekly Bangal Gazette) নামে একখানি সাপ্তাহিক কলিকাতায় প্রকাশিত হয়। কেহ কেহ বলেন, ইহার সম্পাদক ছিলেন রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা’র সম্পাদক হরচন্দ্র রায়-আবার কাহারও মতে ইহার সম্পাদকের নাম গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। এই দুইজনই এই পত্রিকার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইহার বার্ষিক মূল্য ছিল সডাক দুই টাকা।

ঐ বৎসরই (১৮১৮) শ্রীরামপুর হইতে পাদরী মার্শম্যানের (J. C. Marshman) সম্পাদনার এপ্রিল মাসে ‘দিগদর্শন’ নামে একখানি মাসিক ও মে মাসে ‘সমাচার দর্পণ’ নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্র বাহির হয়। দিগদর্শন খুব অল্পদিন পরেই বন্ধ হয় কিন্তু ইহাই বাংলায় লিখিত প্রথম সাময়িকপত্র। সমাচার দর্পণ দীর্ঘকাল স্থায়ী হইয়াছিল। ১৮১৮ সনের ২৩শে মে ইহার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। মার্শম্যান সাহেব নামে সম্পাদক হইলেও প্রকৃতপক্ষে এদেশীয় পণ্ডিতেরাই ইহার সম্পাদনা করিতেন।

‘বাঙ্গাল গেজেটি’র কোন সংখ্যাই এযাবৎ পাওয়া যায় নাই–সুতরাং ইহার প্রথম সংখ্যা সমাচার দর্পণের প্রথম সংখ্যার পূর্বে কি পরে প্রকাশিত হইয়াছিল এ সম্বন্ধে কেবল বর্তমানকালে নহে, উক্ত পত্রিকা দুইটি প্রকাশিত হইবার পর দুই বৎসরের মধ্যেই মতভেদ দেখা যায়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তপ্রণীত বাংলা সাময়িক-পত্র’ গ্রন্থে এই প্রশ্নটি আলোচনা করিয়াছেন। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি দুইটি বিরোধী মতেরই উল্লেখ করিয়াছেন। শ্রীরামপুর হইতে ১৮২০ সনের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘ফ্রেণ্ড-অব ইণ্ডিয়া’ পত্রের প্রথম সংখ্যায় লিখিত মন্তব্য হইতে জানা যায় যে, সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হইবার পর একপক্ষকালের মধ্যেই বাঙ্গাল গেজেটি প্রকাশিত হয়। অপরপক্ষ সমাচার চন্দ্রিকা’র সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সংবাদ প্রভাকর’-সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, এই দুইজন বিখ্যাত সাংবাদিকের-এবং আরও অনেকের মতে “বাঙ্গাল গেজেটি” সমাচার দর্পণের অগ্রজ। এই সকল উল্লেখ করিয়া ব্রজেন্দ্রবাবু মন্তব্য করেন : “তবে ‘ফ্রেণ্ড-অব-ইণ্ডিয়ার উক্তি সর্বাপেক্ষা পুরাতন” এবং অনুমান করেন যে সমাচার দর্পণ’ই প্রথম প্রকাশিত হয়।

ব্রজেন্দ্রবাবু তাঁহার গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে (১৩৫৪) এ-বিষয়ে একটি নূতন প্রমাণের উল্লেখ করেন। এশিয়াটিক জার্নালের ১৮১৯ সনের জানুয়ারি সংখ্যায় ১৬ মে, ১৮১৮ তারিখের ‘ওরিয়েন্টাল ষ্টার’ হইতে এই মর্মে একটি সংবাদ উদ্ধৃত হয় যে একখানি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হইয়াছে (the publication of a Bengalee newspaper has been commenced)। এই পত্র যে বাঙ্গাল গেজেটি তাহাতে কোন সন্দেহ নাই এবং ব্রজেন্দ্রবাবুও ইহা স্বীকার করেন। কিন্তু যে কয়েকটি কারণে তিনি উদ্ধৃত পংক্তির স্বাভাবিক অর্থ গ্রহণ না করিয়া বলেন যে ইহার অর্থ “বাঙ্গাল গেজেটি”র প্রকাশের আয়োজন আরম্ভ হইয়াছে–তাহা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয় না। ১৮১৮ সনের ১৪ই মে তারিখের “গভর্ণমেন্ট গেজেটে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় যে বাঙ্গাল গেজেটি শীঘ্রই বাহির হইবে। প্রতি শুক্রবারে ইহা বাহির হইত। সুতরাং ১৫ মে শুক্রবার যে বাঙ্গাল গেজেটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় এবং ইহাই প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এই সিদ্ধান্তই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। ১৮২৯ সনে সমাচার দর্পণ দ্বিভাষিক হইল, অর্থাৎ ইহাতে বাংলা ও ইংরাজী উভয় ভাষার রচনা থাকিত। ১৮৩২ সনে সপ্তাহে দুইবার ইহা প্রকাশিত হইত। দুই বৎসর পরেই ইহা পুনরায় সাপ্তাহিকে পরিণত হইল। ১৮৪০ সনের ১লা জুলাই হইতে মার্শম্যান একখানি নূতন বাংলা সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করিলেন এবং ইহার ফলে ১৮৪১ সনের ২৫শে ডিসেম্বরের সংখ্যা বাহির হওয়ার পর সমাচার দর্পণ বন্ধ হইল। ১৮৪২ সনের প্রথম ভাগে বাঙ্গালীদের চেষ্টায় সমাচার দর্পণের দ্বিতীয় পর্যায় প্রকাশিত হয়। ইহাতে ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষাই ব্যবহৃত হইত। ইহার সম্পাদক ছিলেন ভগবতীচরণ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ইহা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই। বহুদিন বন্ধ থাকার পর শ্রীরামপুরের মিশনারীরা ১৮৫১ সনের ৩রা মে আবার সমাচার দর্পণ প্রকাশ করিলেন। এই তৃতীয় পর্যায়ের সমাচার দর্পণ দেড়বৎসর স্থায়ী হইয়াছিল এবং তাহার পরেই ইহা চিরদিনের মত লুপ্ত হয়।

সমাচার দর্পণে রাজনীতিক আলোচনা বেশী না থাকিলেও ইহাতে এদেশের ও ইউরোপের নানা সংবাদ প্রকাশিত ও নানা বিষয় আলোচিত হওয়ার ফলে আধুনিক যুগের জ্ঞান ও চিন্তাধারার সহিত বাঙ্গালীর পরিচয় লাভের যথেষ্ট সুযোগ ঘটিয়াছিল। ইউরোপের নূতন নূতন আবিষ্কারের সংবাদ প্রদান, নূতন নূতন ইংরেজীগ্রন্থ হইতে নূতন শিল্পকলা প্রভৃতির বিবরণ, এবং ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস, শিক্ষা, বিদগ্ধ ব্যক্তি ও গ্রন্থাদির বিবরণ প্রকাশ যে এই পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য, প্রথম সংখ্যার বিজ্ঞপ্তিতেই সম্পাদক তাহার উল্লেখ করিয়াছিলেন। মোটের উপর মধ্যযুগে বহির্জগতের সহিত সর্বপ্রকার সম্পর্কহীন বাংলা দেশে সমাচার দর্পণ যে নূতন জাতীয় চেতনা জাগরণে বিশেষভাবে সাহায্য করিয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

১৮২১ সনে রামমোহন রায় ব্রাহ্মণ সেবক ও মিশনারী সংবাদ’ নামে পত্রিকা প্রকাশিত করেন। ঐ বৎসরই ৪ঠা ডিসেম্বর কলুটোলা-নিবাসী তারাচাঁদ দত্ত এবং ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বাদ কৌমুদী’ নামে একখানি বাংলা সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করেন। রামমোহন রায় এই পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রবন্ধ লিখিতেন। কিন্তু ইহা সহমরণ-প্রথার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করায় ভবানীচরণ ইহার সহিত সংশ্রব পরিত্যাগ করেন। ইহার পর রামমোহন রায়ই কার্যতঃ ইহার সম্পাদক হইলেন। কিন্তু ভবানীচরণ সনাতনধর্মের স্বপক্ষে সমাচার চন্দ্রিকা’ নামে নূতন একখানি বাংলা সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশিত করায় সম্বাদ কৌমুদীর প্রচার বন্ধ হইয়া যায় (১৮২২ সন)। পর বৎসর ইহা পুনরুজ্জীবিত হয় এবং বিভিন্ন পরিচালক ও সম্পাদকের অধীনে আরও দশ বৎসর জীবিত ছিল।

১৮২২ সনের ৫ই মার্চ সমাচার চন্দ্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বলা বাহুল্য, ‘সম্বাদ কৌমুদী’র সহিত ইহার ‘মসীযুদ্ধ’ কিছুদিন চলিয়াছিল। ইহাদের সম্বন্ধে সমাচার দর্পণে মন্তব্য করা হইয়াছে : “উভয়ে পরস্পর বিবাদজনক অসাধু ভাষাতে পরস্পর নিন্দা স্ব স্ব কাগজে ছাপাইতেছেন”।

“চন্দ্রিকা-কার ধর্মসভার, কৌমুদী-কার ব্রহ্মসভার সাহায্যকারক। সতীবিষয়ক ব্যাপার সম্প্রতি ঐ উভয় সমাচার পত্রে লিখিত বাদানুবাদমাত্রের আশ্রয় হইয়াছে।”8 গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মুখপত্র হওয়ায় সমাচার চন্দ্রিকা’র প্রাধান্য ও গ্রাহকসংখ্যার বৃদ্ধি হয়। ১৮৪৮ সনে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ইহার প্রসার-প্রতিপত্তি কমিয়া যায়। নানা অবস্থা-বিপর্যয়ের ভিতর দিয়া ইহা ১৮৫৩ সন পর্যন্ত টিকিয়া ছিল।

১৮৩১ সনে অনেকগুলি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যথা–

দুর্লভচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত দৈনিক ‘নিত্য প্রকাশ’, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সম্বাদ সৌদামিনী’, মধুসূদন দাস সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সম্বাদ রত্নাকর’, ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সম্বাদ ময়ূখ। যথাক্রমে ভোলানাথ, সেন, প্রেমচাঁদ রায় এবং রামচন্দ্র মিত্র ও কৃষ্ণধন মিত্র সম্পাদিত ‘অনুবাদিকা’, ‘সম্বাদ সুধাকর’ ও ‘জ্ঞানোদয়’ নামে তিনখানি মাসিক পত্রিকা ছাড়া ‘সম্বাদসার সংগ্রহ’ নামে একখানি সাপ্তাহিক এবং শেষ আলিমুল্লা সম্পাদিত বাংলা ও ফার্সী মাসিক ‘সমাচার সভা রাজেন্দ্র প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে।

১৮৩১ সনের ২৮শে জানুয়ারি কবির ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় প্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক পত্র সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হয়। ইহাই সাহিত্যিক মর্যাদাসম্পন্ন প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র। বঙ্কিমচন্দ্র ইহা কবির অদ্বিতীয় কীর্তি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। দেড় বৎসর চলিবার পর ইহা বন্ধ হইয়া যায়। চারি বৎসর পরে ১৮৩৬ সনের ১০ই আগষ্ট ইহা পুনরায় সপ্তাহে তিনবার করিয়া প্রকাশিত হইত। তিন বৎসর সগৌরবে চলিবার পর ১৮৩৯ সনের ১৪ জুন হইতে সংবাদ প্রভাকর’ দৈনিক সংবাদপত্রে পরিণত হয়। ইহাই বোধ হয় ভারতীয় পরিচালিত দ্বিতীয় দৈনিক সংবাদপত্র।৫

সংবাদ প্রভাকর সে-যুগে খুব প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য, প্রভৃতি নানা বিষয়ে সেকালের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি এই পত্রিকায় লিখিতেন এবং সম্পাদক নিজেও বহু মূল্যবান মন্তব্য লিখিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম বয়সের অনেক রচনা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার অনেক অংশ এই গ্রন্থে নানা প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা হইয়াছে।

১৮৫৩ সন হইতে সংবাদ প্রভাকরের একটি মাসিক সংস্করণ বাহির হয়। ইহাতে “নীতি কাব্য ও বিখ্যাত মহাত্মাদিগের জীবনবৃত্তান্ত প্রভৃতি গদ্য পদ্য পরিপূরিত উত্তম উত্তম প্রবন্ধ এবং সৰ্বশেষে-মাসের সমুদয় ঘটনা অর্থাৎ মাসিক সংবাদের সারমর্ম প্রকটিত” হইত। ইহাতে ঈশ্বরচন্দ্র আরও একটি জিনিস প্রকাশ করিয়াছিলেন, যাহার উল্লেখ করা একান্ত কর্তব্য। দীর্ঘকাল পরিশ্রম ও নানা স্থান পর্যটন করিয়া ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচীন কবিদিগের বহু অপ্রকাশিত রচনা ও জীবনচরিত সংগ্রহ করিয়া সেগুলি তিনি প্রধানতঃ ১৮৫৪-৫৫ সনের মাস পয়লার কাগজগুলিতে মাঝে মাঝে প্রকাশ করিয়াছিলেন। এই কার্যে তিনি অগ্রসর না হইলে বোধ হয় এতদিন কবিদিগের এই সকল রচনার কোন অস্তিত্বই থাকিত না। এই সমূদয় কবিদের নাম : রামপ্রসাদ সেন, রামনিধি গুপ্ত, রাম [মোহন বসু, নিত্যানন্দ দাস বৈরাগী, কেষ্টা মুচী, লালু নন্দলাল, গোঁজলা গুঁই, হরু ঠাকুর, রাসু, নৃসিংহ, লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস।৬

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৮৫৯ সনের ২৩ জানুয়ারি তাঁহার মৃত্যু হইলে তাহার অনুজ রামচন্দ্র গুপ্ত ইহার সম্পাদক হন।

১৮৩১ সনের ১৮ই জুন ‘জ্ঞানান্বেষণ’ নামে সুপ্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইহাকে ইংরেজীশিক্ষিত উদারমতাবলম্বী যুবকদের মুখপত্র বলা যাইতে পারে। প্রথমে দক্ষিণানন্দন (পরে দক্ষিণারঞ্জন) মুখোপাধ্যায় এবং তাঁহার পর রসিককৃষ্ণ মল্লিক এবং মাধবচন্দ্র মল্লিক ইহার পরিচালনা করেন। ইহারা সকলেই হিন্দু কলেজের কৃতী ছাত্র। দুই বৎসর পরে এই পত্রিকায় ইংরেজী ও বাংলা, উভয় ভাষারই ব্যবহার হয়। গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ কিছুদিন এই পত্রিকার বাংলা বিভাগের সম্পাদক ছিলেন এবং সাধারণভাবে সমগ্র পত্রিকার সম্পাদনা কার্যে বিশেষ সহায়তা করিতেন। পরে ১৮৩৯ সনে তিনি ইহা ছাড়িয়া সম্বাদ ভাস্কর’ নামে পৃথক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। রামগোপাল ঘোষ ও আরও কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি জ্ঞানান্বেষণের সহিত সংসৃষ্ট ছিলেন। ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে উদার মত জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিয়া এই পত্রিকা খুবই প্রসিদ্ধি অর্জন করিয়াছিল। ১৮৪০ সনের নভেম্বর মাসে ইহা বন্ধ হয়।

১৮৩১ সনের পরে প্রকাশিত নূতন সংবাদপত্রের সংখ্যা ক্রমশই বাড়িতে থাকে। তাহার মধ্যে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করিতেছি।

১৮৩৫ সনের ৮ই জুন সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রতি পূর্ণিমায় প্রকাশিত হইত বলিয়া ইহার এইরূপ নামকরণ হইয়াছিল। ১৮৩৬ সনের ৯ই এপ্রিল ইহা সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হয় এবং প্রধানত সাহিত্য ও রাজনীতির আলোচনাই ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য বরিয়া পরিগণিত হয়। ১৮৪৪ সনে ইহা দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়। এই দৈনিক পত্রিকাখানি ১৯০৮ সনের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। খুব কমসংখ্যক বাংলা পত্রিকাই এরূপ দীর্ঘকাল স্থায়ী হইয়াছিল। এই পত্রিকার ১২৫৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় (১৪ এপ্রিল, ১৮৫১) তকালে প্রচলিত প্রাত্যহিক, দিনান্তরিক, অর্ধসাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, অর্ধমাসিক ও মাসিক’ সংবাদপত্রের এক তালিকা প্রকাশিত হয়।

১৮৩৯ সনের মার্চ মাসে ‘সম্বাদ ভাস্কর’ নামে সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশিত হয়। নামে শ্রীনাথ রায় সম্পাদক হইলেও প্রকৃতপক্ষে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশই যে ইহার পরিচালক ছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। আন্দুলের রাজার কোন কার্য সম্বন্ধে ইহা অনুচিত এই মন্তব্য করায় আন্দুলরাজের কুড়ি-পঁচিশজন সশস্ত্র প্রহরী সম্পাদক শ্রীনাথ রায়কে দিবাভাগে কলিকাতার রাস্তা হইতে ধরিয়া নিয়া আটক করিয়া রাখে এবং তাহার উপর অনেক অত্যাচার করে। আদালতে অভিযুক্ত হইলে রাজা কিছুদিন আত্মগোপন করিয়া রহিলেন ও শ্রীনাথ রায়কেও নানাস্থানে লুকাইয়া রাখিলেন। অবশেষে রাজাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কিছুদিন হাজতে রাখিয়া সুপ্রীম কোর্ট তাঁহাকে মাত্র এক হাজার টাকা জরিমানা করেন। সমস্ত ব্যাপারটিই খুব বিস্ময়কর বলিয়া মনে হয়। ‘সম্বাদ ভাস্কর’ প্রথমে সাপ্তাহিক ছিল। ১৮৪০ সনে শ্রীনাথ রায়ের মৃত্যু হইলে গৌরীশঙ্করই সম্বাদ ভাস্করের একমাত্র সম্পাদক হন। ১৮৪৮ সনে ইহা সপ্তাহে দুইবার এবং পরের বৎসর তিনবার করিয়া প্রকাশিত হয়। ১৮৫৯ সনে গৌরীশঙ্করের মৃত্যুর পরেও বহুকাল ইহা প্রচলিত ছিল। ইহা সে-যুগের একখানি উৎকৃষ্ট পত্রিকা বলিয়া পরিগণিত হইত।

১৮৩৯ সনে ‘সম্বাদ ভাস্করের সম্পাদক গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের পরিচালনায় সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অন্য কয়েকজন ব্যক্তি পর পর নামেমাত্র ইহার সম্পাদক বলিয়া পরিচিত ছিলেন। ইহা প্রথমে সাপ্তাহিক, পরে অর্ধসাপ্তাহিক হইয়াছিল। পরের কুৎসা ও অশ্লীল গালিগালাজ এই পত্রিকার বৈশিষ্ট্য ছিল। সম্ভবতঃ এই কারণেই “ইহার গ্রাহকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাইয়াছিল; সে যুগের কোন ভাল সংবাদপত্রেরও এত গ্রাহক ছিল না।”

কাশিমবাজারের রাজা কৃষ্ণনাথ ও তাঁহার পত্নী রাণী স্বর্ণময়ী সম্বন্ধে কুৎসা প্রচার করায় ১৮৪৩ সনে গৌরীশঙ্করের নামে রাজা মানহানির মকদ্দমা করেন। ১৭৫৫ সনে লালা ঈশ্বরীপ্রসাদও ঐরূপ মামলা করেন। উভয় মামলার বিচারেই গৌরীশঙ্করের ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড ও ছয়মাসের জন্য কারাবাসের আদেশ হইয়াছিল। অবশেষে শোভাবাজার রাজপরিবারের বিরুদ্ধে অকথ্য অসত্য প্রকাশ করাতে মহারাজ কমলকৃষ্ণ বাহাদুর সুপ্রীম কোর্টে অভিযোগের উদ্যোগ করাতেই ১৮৫৭ সনে সম্বাদ রসরাজ বন্ধ হইয়া গেল। ১৮৫৯ সনে গৌরীশঙ্করের মৃত্যুর পর ইহা পুনঃপ্রকাশিত হইয়াছিল (১৮৬১)। কিন্তু পুনরায় ‘অযথা গালাগালি ও নিন্দাবাদের ফলে’ নূতন সম্পাদকের ৫০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাস মেয়াদ হয়। ইহার পরেও কিছুদিন এই পত্রিকা প্রচারিত হইয়াছিল, তবে ইহাতে আর কোন অশ্লীল বিষয় থাকিত না।

১৮৪২ সনের এপ্রিল মাসে প্যারীচাঁদ মিত্র, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির সহযোগিতায় রামগোপাল ঘোষ ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ (The Bengal Spectator) নামে এক ইংরেজী-বাংলা দ্বিভাষিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। প্রথম পাঁচ মাস মাসিক, পরের ছয় মাস পাক্ষিক, এবং ১৮৪৩ সনের মার্চ মাস হইতে ইহা সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। বহু আর্থিক ক্ষতি হওয়ার ফলে ১৮৪৩ সনের নভেম্বর মাসে ইহা বন্ধ হইয়া যায়। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ইহার প্রচারের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যাহা বলা হইয়াছে তাহাতে সে-যুগের সাময়িকপত্রের লক্ষ্য, কর্তব্য ও সার্থকতা সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা জন্মে। এইজন্য ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

“যে প্রকার সময় উপস্থিত হইয়াছে তাহাতে আমারদিগের উদ্যোগের আনুকূল্যের সম্ভাবনা, যেহেতু রাজ্যশাসনকারিরা প্রজার মঙ্গল বিষয়ে পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক সচেষ্ট হইতেছেন এবং ভারতবর্ষস্থ ও ইংলণ্ডদেশস্থ ইংরাজের মধ্যে অনেকের অন্তঃকরণে আমারদিগের হিতেচ্ছা প্রবল হইতেছে। অপর এতদ্দেশীয় সুশিক্ষিত ব্যক্তিদিগেরও স্বদেশের হিতাকাঙ্ক্ষা জন্মিয়াছে এবং তাঁহারা বিশেষ যত্নবান হইলে তাহাদিগের দ্বারা অনেক উপকার দর্শিতে পারে। আর তদ্ভিন্ন অন্যান্য ব্যক্তিদিগের স্ব স্ব মতের বিরুদ্ধে কথা শ্রবণে যে দ্বেষ তাহার হ্রাস হইতেছে। অতএব এতদ্রূপ অবস্থায় গভর্নমেন্টের সমীপে দুঃখসমূহ নিবেদনপূর্বক যাহাতে ঐ ক্লেশ নিবারণ এবং দেশের অবস্থার উৎকৃষ্টতা হয় তাহার প্রার্থনা এবং আমারদিগের প্রার্থিত বিষয়ে সাহায্যকরণার্থে ইংরাজদিগের অনুরোধ করা, আর সুশিক্ষিত ব্যক্তিদিগকে স্বদেশের মঙ্গলার্থে সম্যক প্রকারে যত্ন করিতে প্রবৃত্তি প্রদান, এবং অস্মদ্দেশীয় সাধারণ জনগণকে স্ব স্ব হিতাহিত উত্তমরূপে বিবেচনা দ্বারা উৎসাহাবলম্বন পূৰ্ব্বক আপনারদিগের মঙ্গলার্থে সচেষ্টিত হইতে প্রার্থনা করা আমারদিগের যথাসাধ্য অবশ্য কর্তব্য হইয়াছে।

“পূর্বোক্ত অভিপ্রায়ানুসারে আমরা এতৎপত্রে ঐ সকল বিষয়ের বিশেষ আলোচনা করিব যদ্বারা রীতি ব্যবহারাদির উত্তমতা এবং বিদ্যা, কৃষিকৰ্ম্ম ও বাণিজ্যাদির বৃদ্ধি আর রাজ্যশাসন কার্য্যের সুনিয়ম হইয়া প্রজাদিগের সৰ্ব্বপ্রকারে উন্নতি হয়।”৭।

১৮৪৩ সনের ১৬ আগষ্ট ‘তত্ত্ববোধিনী সভার’ মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ষষ্ঠ অধ্যায়ে ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসপ্রসঙ্গে এই সভা ও পত্রিকার উল্লেখ করা হইয়াছে। এ-পর্যন্ত যত সাময়িক পত্রিকার বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। তাহার মধ্যে এই পত্রিকাখানিই সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবী। বাংলা দেশের আধুনিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসে এই পত্রিকাখানির অবদান অমূল্য।

ধর্ম ও ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানপ্রচার ইহার প্রধান উদ্দেশ্য থাকিলেও ইহাতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, পুরাতত্ত্বাদি বহু বিষয় আলোচিত হইত। বাংলা দেশের বহু মনস্বী এই পত্রিকাখানির সহিত সংযুক্ত ছিলেন। ইহার প্রবর্তক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়াটিক সোসাইটির অনুকরণে একটি প্রবন্ধ-নির্বাচনী সভা গঠন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ প্রভৃতি ইহার সভ্য ছিলেন। নিয়ম ছিল যে এই সভার সভ্যগণের অধিকাংশ কর্তৃক মনোনীত না হইলে কোন প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবে না এবং প্রয়োজন হইলে উক্ত সভা তাহা পরিবর্তিত ও সংশোধিত করিতে পারিবে।

অক্ষয়কুমার দত্ত প্রথম বারো বৎসর (১৮৪৩-৫৫) এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং প্রধানতঃ তাঁহার যত্ন ও পরিশ্রমেই ইহার শ্রীবৃদ্ধি হয়। তিনি মাসিক ৩০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন, পরে ইহা বাড়িয়া ৬০ টাকা পর্যন্ত হইয়াছিল। তাহার পর ক্রমান্বয়ে সম্পাদক হন নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৫-৫৯), সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৫৯-৬২, ১৯০৯-১০), অমোধ্যানাথ পাকড়াশী (১৮৬৫-৬৭, ১৮৬৯ ৭২), সীতানাথ ঘোষ (১৮৭২-৭৭?), হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৮৬৭-৬৯, ১৮৭৭ ৮৪), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৪-১৯০৮), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১০-১৫), সত্যেন্দ্রনাথ ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সহযোগে-১৯১৫-২৩) এবং ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২৩-১৯৩২)। ক্ষিতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ইহা বন্ধ হইয়া যায়।

১৮৪৬ সনে “বিদ্যাকল্পদ্রুম অর্থাৎ বিবিধ বিদ্যাবিষয়ক রচনা শ্রীকৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা সংগৃহীত” হইয়া প্রকাশিত হয়। এই ত্রৈমাসিক পত্রিকাখানির ইংরেজী নাম ছিল “Encyclopaedia Bengalensis”। ইহার এক-একটি খণ্ড সাধারণতঃ তিন মাসের ব্যবধানে প্রকাশিত হইত। মোট ১৩ খণ্ড প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহার আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে, রোম ও ঈজিপ্ত দেশের পুরাবৃত্ত, ক্ষেত্ৰতত্ত্ব, ভূগোলবৃত্তান্ত, নীতিবোধক ইতিহাস এবং ‘চিত্তোকর্ষবিধান’ প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে।

১৮৪৯ সনে ‘সংবাদ রসসাগর’ নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশিত হয়। কয়েক মাস পরে ইহা সপ্তাহে তিন দিন বাহির হয়। প্রথমে ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং তাঁহার মৃত্যুর পর (১৮৫০) কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ইহার সম্পাদনা করেন। রঙ্গলাল ইহার নাম রাখেন সংবাদ সাগর। ১৮৫৩ সনে এই পত্রিকা বন্ধ হইয়া যায়।

১৮৪৯ সনে জয়কালী বসু ‘মহাজন দর্পণ” নামে একখানি দৈনিক পত্র প্রকাশ করেন। ইহা বেশীদিন স্থায়ী হয় নাই, কিন্তু ইহাই বাংলাভাষায় দৈনিক পত্রিকারূপে প্রকাশিত তৃতীয় সাময়িকপত্র। বাণিজ্যসংক্রান্ত সাময়িকপত্র বোধ হয় ইহাই প্রথম।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, শ্রীরামপুরের মিশনারীদের দ্বারা ১৮১৮ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘সমাচার দর্পণ’ কিছুকালের জন্য বন্ধ হইয়াছিল। এই সময় ১৮৫০ সনে ৪ঠা মে মেরিডিথ টেনিসে নামক এক সাহেব ‘সত্য প্রদীপ’ নামে একখানি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। পর বৎসর ‘সমাচার দর্পণ’ পুনরায় প্রকাশিত হইলে সত্যপ্রদীপের প্রচার বন্ধ হয়। সত্যপ্রদীপের প্রথম সংখ্যায় ইহার প্রচারের যে উদ্দেশ্য ব্যক্ত হইয়াছে তাহা পাঠ করিলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সাময়িকপত্র সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা যায়। এইজন্য ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

“সত্যপ্রদীপ প্রকাশ…এইক্ষণে অন্যূন সপ্তদশ পত্র বঙ্গ ভাষায় প্রকাশিত হইতেছে ইহার মধ্যে কএক পত্রের তিন চারি শত পৰ্য্যন্ত গ্রাহক সত্তাই সম্বাদ পত্র পাঠ করেন এতদ্দেশীয় লোকেরদের অভ্যন্ত লালসার প্রমাণ। ইদানীং বঙ্গদেশীয় বিজ্ঞজনগণ স্বদেশীয় লোকেরদের উপকারার্থ স্বীয় ভাষায় সপ্তদশ পত্র প্রকাশ করিতেছেন অতএব বিদেশীয় লোকেরদের এতঙ্কর্মে হস্তক্ষেপ করণের কি প্রয়োজন কেহ যদি অসন্তুষ্ট হইয়া এইমত আপত্তি করেন তবে উত্তর এই। কোন দেশীয় লোক কিঞ্চিৎ সভ্যতাবিশিষ্ট হইলে তাঁহারা অবশ্য সম্বাদপত্র প্রকাশ করেন ক্রমে সভ্যতার বর্ধনানুসারে পত্রের উত্তমতা বৃদ্ধি হয়। এদেশীয় লোকেরদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে সভ্যতা বৃদ্ধি পাইতেছে বটে তথাপি যে যে পত্র প্রকাশ হইতেছে তাহার তিন চারি পত্র ভিন্ন অন্যান্য পত্রবিষয়ে সভ্যজনগণ নানা দোষাৰ্পণ করেন। প্রথম এই। কোন কোন সম্পাদক মহাশয় কোন স্থানে কোন সম্বাদ শ্রুত হইলে তাহার সত্যাসত্যতা নির্ণয়ার্থে উপযুক্ত অনুসন্ধান না করিয়া অথবা তদ্রপ অনুসন্ধান করণক্ষম হইয়া সহসা তাহা প্রকাশ করেন। ফলতঃ কোন কোন সময়ে সদাচারি সভ্য বিশিষ্ট লোকেরদের নামে অনুপযুক্তরূপে দোষাৰ্পণ ও নানাপ্রকার গ্লানি হয়। দ্বিতীয় এই। কএক সম্বাদপত্রে অত্যন্ত অনুপযুক্ত শব্দাদি ব্যবহার প্রযুক্ত সভ্যলোকেরা প্রায় প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করিতে পারেন না। ফলতঃ এতদ্বিষয়ে নিশ্চিন্ত মহাশয়েরদের ঐ সকল পত্র পাঠ করাতে তাহারদের নীতিবৃদ্ধি না হইয়া অসভ্যতা বর্ধন হইতেছে। এইক্ষণে আমরা দেশবিদেশীয় সত্য সম্বাদ অনুসন্ধানপূর্বক প্রকাশ করিয়া যাহা অসত্য তাহা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পাঠক মহাশয়দের মনঃসন্তোষ করণাভিপ্রায়ে সত্যপ্রদীপ নামক এই সম্বাদপত্র প্রকাশ করিতেছি। কোন অন্যায়চরণের বিশ্বাস্য সংবাদ প্রাপ্ত হইলে তদাচারের দোষ প্রকাশ করণে কোনক্রমে শৈথিল্য করিব না পরন্তু ব্যক্তিবিশেষের গ্লানিও করিব না। ফলতঃ এতদ্দেশীয় লোকদের সজ্ঞান ও গুণ যাহাতে বৃদ্ধি হয় এমত উপায় করা সত্যপ্রদীপের প্রধান অভিপ্রায়।”৮

১৮৪৯ সনে কলিকাতায় সামাজিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সৰ্ব্বশুভকরী সভা’ পরবৎসর ‘সৰ্ব্বশুভকরী পত্রিকা’ নামে একখানি মাসিক পত্র বাহির করেন। বহুঁকালাবধি প্রচলিত কতকগুলি সামাজিক কুপ্রথা-কৌলীন্য ব্যবস্থা, বিধবা বিবাহ প্রতিষেধ, অল্পবয়সে বিবাহ প্রভৃতি–যে সমাজের কতদূর অনিষ্টকারী তাহা জনসমাজে প্রচার করাই ছিল এই পত্রিকার উদ্দেশ্য। ইহার প্রথম সংখ্যায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’, দ্বিতীয় সংখ্যায় স্ত্রী শিক্ষা, ও তৃতীয় সংখ্যায় মাংসাহারের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিত হইয়াছিল। রাজনারায়ণ বসু তাঁহার আত্মচরিতে এই পত্রিকা সম্বন্ধে লিখিয়াছেন :

“ইনি (মদনমোহন তর্কালঙ্কার) ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘সৰ্ব্বশুভকরী’ নামে পত্রিকা বাহির করেন। এই পত্রিকাতে স্ত্রীশিক্ষার আবশ্যকতা বিষয়ে একটি প্রস্তাব তর্কালঙ্কার মহাশয় লিখিয়াছিলেন। স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক ঐরূপ উৎকৃষ্ট প্রস্তাব অদ্যাপি বঙ্গভাষায় প্রকাশিত হয় নাই।”৯

এই পত্রিকার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, ইহার কোন নির্ধারিত মূল্য ছিল না। চারি আনা বা তাহার অধিক যাহা কেহ স্বেচ্ছায় দান করিতেন তাহাই গৃহীত হইত। ১৮৫১ সনে কাগজের প্রচার কিছুদিন বন্ধ থাকে, কিন্তু সম্ভবতঃ কয়েক বৎসর পর ইহা পুনঃ প্রকাশিত হয়।

১৮৫১ সনে জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞানবিস্তারের জন্য বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ (Vernacular Literature Committee) স্থাপিত হয়। বাংলার কয়েকজন মনস্বী-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাধাকান্ত দেব, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, পাদরি লং সাহেব ও আর কয়েকজন ইংরেজ ইহার সহিত যুক্ত ছিলেন। এই সমাজের পক্ষ হইতে এবং ইহার অর্থসাহায্যে ১৮৫১ সনে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ নামক একখানি সচিত্র মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। ইহাই সম্ভবতঃ বাংলাভাষায় প্রথম সচিত্র পত্রিকা। নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনে এই কাগজের উদ্দেশ্য বিবৃত হইয়াছে :

“পুরাবৃত্তেতিহাস প্রাণিবিদ্যা, শিল্পসাহিত্যাদিদ্যোতক মাসিক পত্র।-যাহাতে বঙ্গদেশস্থ জনগণের জ্ঞান বৃদ্ধি হয় এমৎ সৎ ও আনন্দজনক প্রস্তাব সকল প্রচার করা উক্ত সমাজের মুখ্য কল্প, এবং ইংরাজী ভাষায় “পেনি মেগজিন” নামক পত্রের অনুবর্তিত এতৎপত্রে তদভিপ্রায় সিদ্ধ্যর্থে অবিরত সম্যক্ চেষ্টা করা যাইবেক। আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলের পাঠযোগ্য করণার্থে উক্ত পত্র অতি কোমল ভাষায় লিখিত হইবেক, এবং তত্ৰত্য প্রস্তাবিত বস্তু সকলের বিশেষ পরিজ্ঞানার্থে তাহাতে নানাবিধ ছবি থাকিবেক।”১০ ইহার প্রথম সম্পাদক ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। ১৮৬১ সনে কালীপ্রসন্ন সিংহ ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। এই পত্রিকাখানি গভর্নমেন্টের অর্থসাহায্য পাইত। কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘নীলদর্পণের’ বিস্ত রিত সমালোচনা এবং নীলকরদিগের অত্যাচার প্রকাশ করায় গভর্নমেন্ট অসন্তুষ্ট ও রুষ্ট হন এবং ইহার ফলে পত্রিকাখানি উঠিয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘জীবনস্মৃতি’তে এই পত্রিকার খুব প্রশংসা করিয়া লিখিয়াছেন: “চীৎ হইয়া (শুইয়া) পড়িয়া নীল তিমি মৎস্যের বিবরণ কাজির বিচারের কৌতুক-জনক গল্প, কৃষ্ণকুমারীর উপন্যাস পড়িতে কত ছুটির দিনের মধ্যাহ্ন কাটিয়াছে। এই ধরণের কাগজ একখানিও এখন নাই কেন? সৰ্বসাধারণের দিব্য আরামে পড়িবার একটি মাঝারি শ্রেণীর কাগজ দেখিতে পাই না।”১১

বিবিধার্থ সংগ্রহের অভাব দূর করিবার জন্য কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটির ও ভার্ণাকিউলার লিটারেচার সোসাইটির আনুকূল্যে ১৮৬৩ সনে ‘রহস্য-সন্দর্ভ’ নামে একখানি সচিত্র মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। ইহার উদ্দেশ্য নিম্নলিখিতরূপে বর্ণিত হইয়াছে

“পূৰ্ব্বে বিবিধার্থ সংগ্রহ যে উদ্দেশে বহুল পাঠকবৃন্দের মনোরঞ্জন করিত ইহাও সেই অভিপ্রায়ে প্রতিষ্ঠিত।…এইরূপ পত্র সম্প্রতি আর প্রচলিত নাই।

“পুরাবৃত্তের আলোচনা, প্রসিদ্ধ মহাত্মাদিগের উপাখ্যান, প্রাচীন তীর্থাদির বৃত্তান্ত, স্বভাবসিদ্ধ রহস্য-ব্যাপার ও জীবসংস্থার বিবরণ, খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন, বাণিজ্যদ্রব্যের উৎপাদন, নীতি-গর্ভ উপন্যাস, রহস্যব্যঞ্জক আখ্যান, নূতন গ্রন্থের সমালোচন, প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের আলোচনায় উক্ত পত্র অতি অল্পকালে সঙ্খ্যাতিরিক্ত ব্যক্তির প্রেমাস্পদ হইয়াছিল; এই মাসিক পত্র তদনুকরণ দ্বারা তাহার পুরস্কার প্রার্থনা করে।”১২

১৮৫৪ সনে সমাচার সুধাবর্ষণ’ নামে একখানি দৈনিক পত্র প্রকাশিত হয়। ইহাতে বাংলা ও হিন্দী এই দুই ভাষা এবং বাংলা ও নাগরী এই দুই অক্ষর ব্যবহৃত হইত। ইহার সম্পাদক ছিলেন শ্ৰীযুত শ্যামসুন্দর সেন এবং ইহাতে প্রধানতঃ জাহাজের সংবাদ, জিনিসপত্রের দর প্রভূতি থাকিত। ইহাই বাংলাভাষায় লিখিত চতুর্থ ও বাংলা দেশে হিন্দীভাষায় লিখিত প্রথম দৈনিক পত্র।

১৮৫৬ সনে শিক্ষাবিভাগের তৎকালীন ইন্সপেক্টর হজসন প্র্যাট সাহেবের প্রতিপোষকতায় এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্তাবহ’ প্রকাশিত হয়। এই বাংলা সাপ্তাহিকের সম্পাদক ছিলেন রেভারেণ্ড ও’ব্রায়েন স্থিথ (Rev. O’Brien Smith)। মফঃস্বলের লোকদের নিকট সংবাদ সরবরাহের জন্য সরকার এই সংবাদপত্র ও তৎসংক্রান্ত আইন পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং মাসিক দুইশত টাকা সাহায্য দান করেন। “ইহার বার্ষিক অগ্রিম মূল্য ৩ টাকা ও মাসিক অগ্রিম মূল্য সাড়ে চারি আনা মাত্র।”

প্রসিদ্ধ কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন ইহার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। স্মিথ সাহেব বিলাত যাইবার কিছুকাল পরে ১৮৬৬ সনের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্সী কলেজের ইংরেজীসাহিত্যের সহকারী অধ্যাপক খ্যাতনামা প্যারীচরণ সরকার ইহার সম্পাদক হন। তাঁহার সম্পাদনায় পত্রিকাখানির উন্নতি হইয়াছিল এবং গ্রাহকসংখ্যাও বাড়িয়াছিল। কিন্তু আড়াই বৎসর পরে যে-কারণে তিনি পদত্যাগ করেন তাহা নানাদিক হইতে বাংলা দেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এইজন্য ইহার একটু বিস্তৃত বিবরণ দিতেছি।

১৮৬৮ সনের মে মাসে একটি রেলওয়ে দুর্ঘটনায় বহু লোক হতাহত হইয়াছিল। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করিয়া গভর্নমেন্ট যে বিবরণী প্রকাশিত করেন জনসাধারণ তাহা বিশ্বাস করে নাই এবং বহু পত্রিকায় ইহার অতি ভয়াবহ বিবরণ প্রকাশিত হয়। এডুকেশন গেজেটে যে সুদীর্ঘ বিবরণ প্রকাশিত হয় তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“বিগত ২৬শে বৈশাখ ঈষ্টারণ বেঙ্গল রেলওয়ের শ্যামনগর ষ্টেশনে যে দুর্ঘটনা হইয়াছিল, তাহার অত্যন্ত ভয়ানক বিবরণ ক্রমে ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িতেছে। যাহারা তৎকালে ঐ স্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই প্রকাশ্যরূপেই বলিতেছেন যে, প্রায় তিন শত লোক মারা পড়িয়াছে। আবার উহা অপেক্ষা আরও ভয়ঙ্কর কয়েকটি বৃত্তান্ত শুনিতে পাওয়া যাইতেছে। অনেকেই এরূপ অনুভব করিতেছেন যে রেলওয়ে কর্মচারীরা যখন তাড়াতাড়ি ভগ্ন গাড়ী হইতে হত আহত ব্যক্তিগণকে বাহির করিতে আরম্ভ করেন, তখন তাঁহাদের কেহ কেহ অত্যন্ত নৃশংস ব্যবহার করিয়াছিলেন।…..

“হত আহত ব্যক্তিরা যে স্থানে ছিল, তথা হইতে ৬৭ হাত দূরে তাহাদিগকে স্থানান্তরিত করিবার গাড়ী আনিয়া রাখা হয়, এবং এই ৬৭ হাত ভূমির উপর দিয়া মৃত ও মৃতপ্রায় ব্যক্তিগণকে যে প্রকার ভয়ানকরূপে নিক্ষেপ করা কিম্বা টানিয়া লইয়া যাওয়া হয়, তাহাতে যাহারা মৃতপ্রায় ছিল, তাহাদের জীবিত থাকিবার অধিক সম্ভাবনা ছিল না।…

“হত ব্যক্তিকেও যেমন বলপূৰ্ব্বক টানিয়া অথবা ঊর্ধে নিক্ষেপ করিয়া স্থানান্ত রিত করিবার গাড়ীতে রাখে, যে সকল আহত ব্যক্তিরা মৃতপ্রায় হইয়াছিল, অথবা কথা কহিতে অসমর্থ ছিল, তাহাদের প্রতিও তদ্রপ ব্যবহার করে।….

“তাড়াতাড়ি হত ব্যক্তিসমূহকে রাত্রিকালে গোপনে নূতন ট্রেন আনাইয়া স্থানান্তরিত করা, এবং কোথায় নিক্ষেপ করা হইল তাহা কাহাকেও না জানান, অত্যন্ত সন্দেহের কারণ, অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে।….

“যখন রাত্রি মধ্যেই চুপে চুপে সমস্ত মৃতদেহ স্থানান্তরিত করিয়া কুষ্টিয়ার নীচে পদ্মাতে বা অপর স্থানে নিক্ষেপ করা হইয়াছে, তখন প্রকাশ্য রিপোর্টের লিখিত সংখ্যা অপেক্ষা অধিক সংখ্যক মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল বলিয়া অনায়াসেই লোকের মনে সন্দেহ জন্মিতে পারে।…

“সকলেই বলিতেছে যে তাড়াতাড়িতে কতকগুলি মৃতপ্রায় ব্যক্তিকেও মৃতব্যক্তির সহিত এক গাড়ীতে নিক্ষেপ করিয়া পদ্মায় বিসর্জন দেওয়া হইয়াছে।…

“যে সকল ব্যক্তি হত বা আহত হইয়াছিল তাহাদের ঘড়ী, অলঙ্কার, টাকা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি কোথায় গেল, কে লইল তাহারও কিছুই অনুসন্ধান হয় নাই। শুনা গেল জনৈক আহত ব্যক্তি বলিয়াছিলেন যে, তিনি যখন অচেতন হইয়া পড়িয়াছিলেন, তখন রেলওয়ে কর্মচারীর দুই একজন তাহার পকেটে হাত দেওয়াতে তিনি যেমন সচেতন হইয়া চাহিয়া দেখেন তৎক্ষণাৎ দস্যুবৎ কর্মচারীরা অন্যদিকে যায়। এই সকল কর্মচারী লুট করিতে গিয়াছিল, সাহায্য দিতে যায় নাই।

“যাহাতে এই দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান হয়, এবং তৎসম্পকীয় সমস্ত সত্য প্রকাশ পায়, তজ্জন্য গভর্নমেন্ট একটি কমিশন নিযুক্ত করুন।”১৩

সরকারী অর্থসাহায্যে প্রতিপালিত পত্রিকায় এইরূপ বিবরণ বাহির হওয়ায় গর্ভনমেন্ট সম্পাদককে লিখিলেন : “যাহাতে সত্য ঘটনা জানিয়া জনসাধারণ মতামত গঠন করিতে পারে তাহাই ছিল এডুকেশন গেজেটকে গভর্নমেন্টের অর্থ সাহায্যের প্রধান শর্ত বা উদ্দেশ্য। রেলওয়ে দুর্ঘটনা সম্বন্ধে সত্যাসত্য নির্ধারণের চেষ্টা না করিয়া যে মিথ্যা বিবরণ প্রকাশিত হইয়াছে তাহা এই উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ প্রতিকূল এবং ইহা দ্বারা এ দেশীয় জনসাধারণ বিভ্রান্ত এবং সন্ত্রস্ত হইবে।”

ইহার উত্তরে প্যারীচরণ লিখিলেন : “Hindoo Patriot, National Paper, Indian Mirror, ‘সোম প্রকাশ’, ‘প্রভাকর’, এবং চন্দ্রিকা’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ এবং আমি নিজে অনুসন্ধান করিয়া যে সমুদয় নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাইয়াছি তাহাতে আমার লিখিত বিবরণ সত্য বলিয়াই আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে। সুতরাং গভর্নমেন্ট যে শর্তের বা উদ্দেশ্যের কথা লিখিয়াছেন তাহা যে কোন রকম ভঙ্গ বা ব্যর্থ হইয়াছে আমি তাহা মনে করি না।”

এই উত্তরে গভর্নমেন্ট সন্তুষ্ট না হওয়ায় প্যারীচরণ পদত্যাগ করেন। প্যারীচরণ নিজে একজন সরকারী কর্মচারী ছিলেন, কিন্তু এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ ভিন্ন গভর্নমেন্ট তাঁহার বিরুদ্ধে আর কিছু করেন নাই। পরবর্তীকালের তুলনায় সম্পাদক প্যারীচরণের চিত্ত-স্বাধীনতা যেমন প্রশংসনীয়, সরকারের অপেক্ষাকৃত অকঠোর ভাবও তেমনি উল্লেখযোগ্য। স্বাধীন ভারতে এরূপ সরকার বা সরকারী কর্মচারী সুলভ নহে।

পূর্বোক্ত দুর্ঘটনার বিবরণ যে অনেকাংশে সত্য তাহাতে সন্দেহ নাই। কারণ পরবর্তীকালেও রেলওয়ে দুর্ঘটনায় সত্যগোপনের জন্য কর্মচারীদের অনুরূপ নৃশংস ব্যবহারের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। শতাধিক বর্ষ পূর্বে এইরূপ একটি ঘটনার সমসাময়িক বিস্তৃত বিবরণ বিশেষ মূল্যবান।

প্যারীচরণের পরে তৎকালে স্কুল ইন্সপেক্টর ও পরবর্তীকালে প্রসিদ্ধ লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হইলে গভর্নমেন্ট তাঁহাকে এডুকেশন গেজেট পত্রিকাখানির সর্বস্বত্ব দান করিয়াছিলেন। হুগলী হইতে প্রকাশিত এই পত্রিকাখানি প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল ও দীর্ঘজীবী হইয়াছিল।

১৮১৮ হইতে ১৮৫৭ সন–এই ৪০ বৎসরের মধ্যে বহুসংখ্যক নূতন বাংলা সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাহার মধ্যে মাত্র কয়েকটির নাম ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল।১৪ শ্ৰীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যে তালিকা দিয়াছেন

তদনুসারে সময়ানুক্রমে ইহাদের সংখ্যা এইরূপ–

১৮১৮-২২ সন — ৯

১৮২৩-৩৫ সন — ২০

১৮৩৬-৩৯ সন — ৮

১৮৪০-৪৬ সন — ২২

১৮৪৭-৪৮ সন — ২০

১৮৪৯-৫০ সন — ১৯

১৮৫১-৫৫ সন —  ২৬

১৮৫৬-৫৭ সন —  ১২

মোট ১৩৬

ইহার মধ্যে কলিকাতার বাহিরে মফঃস্বল হইতেও কতকগুলি পত্রিকা প্রকাশিত হইয়াছিল, যথা–সাপ্তাহিক ‘মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী (১৮৪০), সাপ্তাহিক ‘সংবাদ বর্ধমান’ (১৮৫০) ও বর্ধমান চন্দ্রোদয়’, দ্বিভাষিক (ইংরেজী ও বাংলা) মাসিক ‘মেদিনীপুর ও হিজিলি অঞ্চলের অধ্যক্ষ’ (১৮৫১), সাপ্তাহিক ‘রংপুর বার্তাবহ’ (১৮৪৭)। বিশেষ কোন বিষয় অবলম্বনেও কয়েকখানি পত্রিকা প্রকাশিত হইয়াছিল। যেমন ‘আয়ুর্বেদ দর্পণ’ (মাসিক, ১৮৪০), কায়স্থ কৌস্তুভ’ (১৮৪৪), ‘পশ্বাবলী’ (১৮২২), ‘পক্ষির বিবরণ (১৮৪৪), এবং ধর্মানুষ্ঠান সম্বন্ধে কয়েকখানি পত্রিকা। জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ নামে মুসলমান-পরিচালিত একখানি সাপ্তাহিক পত্র ১৮৪৬ সনে প্রকাশিত হয়। ইহা বাংলা ছাড়া আরও চারিটি ভাষায়–ইংরেজী, হিন্দী, ফার্সী এবং উর্দু বা হিন্দুস্থানীতে প্রকাশিত হইত।

রামমোহন রায় ইংরেজীতে অনভিজ্ঞ ফার্সী পণ্ডিতদের জন্য ‘মীরাৎ-উল আখবার’ নামে সাপ্তাহিক পত্রখানি ১৮২২ সনে প্রকাশ করেন। জাম-ই-জুহান নুমা’ নামে প্রথম উর্দু সাপ্তাহিকও ঐ বৎসরই প্রকাশিত হয়। ইহা ছাড়া আরও কতকগুলি ফার্সী ও উর্দু সাময়িকপত্র কলিকাতা হইতে প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞানবিষয়ে আলোচনার জন্য কয়েকখানি পত্রিকা প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে Society for Translating European Sciences কর্তৃক ১৮৩২ সনে প্রকাশিত মাসিক বিজ্ঞান সেবধি’ ও ১৮৩৩ সনে প্রকাশিত পাক্ষিক বিজ্ঞান সার সংগ্রহ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রেভারেণ্ড লং সাহেব ১৮৫০ সনে বাংলা সাময়িকপত্র সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং ১৮৫৫ ও ১৮৫৭ সনে এ-বিষয়ে দুইটি রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করেন। তাঁহার মতে “বাংলা সাময়িক পত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য হাজার হাজার শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও প্রতিপ্ৰত্তিশালী হিন্দুর মতামত গঠিত করিতেছে। যদি ধরা যায় যে গড়পরতা দশজন লোক একটি পত্রিকা পাঠ করে তাহা হইলে সরকারী ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে সাময়িক পত্রের মতামত মফঃস্বলের অন্ত তঃ ত্রিশ হাজার লোকের নিকট পৌঁছে। ভাস্করের ন্যায় বাংলার কয়েকটি পত্রিকা সুদূর পঞ্জাবে পর্যন্ত গঠিত হয় এবং ইংলণ্ডেও ইহার গ্রাহক আছে।”

নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষীদের আলোলন উপলক্ষে যে সরকারী কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় তাহার নিকট সাক্ষ্যদানের সময় রেভারেণ্ড লং সাহেব বলেন, “নীলচাষীরা এই আন্দোলনে যে প্রকার ঐক্য ও দৃঢ়তা দেখাইয়াছে, তাহার অন্যান্য কারণের মধ্যে বাংলা সাময়িক পত্রিকার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারতীয় জনসাধারণের মুখপাত্র হিসাবে বাংলা সাময়িক পত্রিকার এখন একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। রাজনীতিক এবং ভারতীয়দের সম্বন্ধে আলোচনা যে বইতে থাকে তাহা লোকে খুব আগ্রহের সহিত কেনে এবং পড়ে। বিক্রয়ের জন্য মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যা হইতেই ইহা বেশ বোঝা যায়। কারণ ১৮২৬, ১৮৫৩ ও ১৮৫৭ সনে কলিকাতায় মুদ্রিত পুস্তকের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে আট হাজার, তিন লক্ষ, ও ছয় লক্ষ। ভাস্কর’ ও ‘প্রভাকরের ন্যায় বাংলা পত্রিকা সুদূর পঞ্জাব পর্যন্ত বহুলোকে পাঠ করে। বাংলা পত্রিকার মফঃস্বলস্থ সংবাদদাতারা সমগ্র জিলার সংবাদ সরবরাহ করে এবং প্রত্যেক পত্রিকায়ই ইংরেজী সংবাদ অনুবাদের জন্য লোক আছে। সুতরাং ভারত ও ইউরোপের নানা রাজনীতিক ঘটনার যথেষ্ট জ্ঞান তাহাদের আছে…কাছারীর আমলা, পুলিশের কার্যাবলী, ম্যাজিষ্ট্রেটগণের চরিত্র–প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রায়ই বাংলা সংবাদপত্রে সমালোচনা করা হয়। আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা হইতে আমি বলিতে পারি যে গত ১৬ বৎসর যাবৎ নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই সমস্ত সংবাদপত্রে প্রায়ই কঠোর সমালোচনা থাকিত এবং এই সব পত্রিকার মতামত অশিক্ষিত জনসাধারণের নিকটও পৌঁছিয়াছে।”

১৮৭৩ সনে ছোটলাট ক্যাম্বেলের নির্দেশে বঙ্গদেশে প্রচলিত পত্রিকার এক তালিকা প্রস্তুত হয়। ইহাতে ৩৫টি পত্রিকার নাম আছে। ইহার মধ্যে ৩৩টি বাংলা, একটি ফার্সী ও একটি উর্দু ভাষায় প্রকাশিত। উনিশটি কলিকাতা এবং মোলটি মফঃস্বল হইতে বাহির হইত।১৫

২. সংবাদপত্র বা মুদ্রাযন্ত্রবিষয়ক আইন (১৮৫৭ সন পর্যন্ত)

ঈষ্ট ইণ্ডিয়ান কোম্পানীর গভর্নমেন্ট যে ইংরেজী সাময়িকপত্রগুলির প্রতি প্রসন্ন ছিল এবং কয়েকজন সম্পাদক তাহাদের হস্তে লাঞ্ছনা ভোগ করেন অথবা নির্বাসিত হন এবং তাঁহাদের কাগজ বন্ধ হইয়া যায়, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। অতঃপর বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (গভর্নমেন্টের মতে স্বেচ্ছাচারিতা) খর্ব করা হয়। ১৭৯৯ সনে বড়লাট ওয়েলেসলীর আমলে এক নিয়ম হয় যে, প্রকাশের পূর্বে প্রত্যেক সংবাদপত্র গভর্নমেন্টের নিকট পাঠাইতে হইবে এবং সেক্রেটারী ইহা পরীক্ষা ও অনুমোদন না করিলে প্রকাশ করা যাইবে না। এই নিয়ম ভঙ্গ করিলে সম্পাদককে ইউরোপে পাঠাইয়া দেওয়া হইবে, অর্থাৎ ভারত হইতে নির্বাসন করা হইবে। ফলে সম্পাদকীয় মন্তব্যের যে যে অংশ সরকারী পরীক্ষক বাদ দিতেন, তাহা তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করিতে না পারিয়া, অথবা এই নিয়মের প্রতি বিক্ষোভ প্রকাশের চিহ্নস্বরূপ, সম্পাদকেরা সেই সেই অংশ শূন্য রাখিয়া তারকাচিহ্ন দ্বারা নির্দেশ করিতেন।

সতের বৎসর এইভাবে চলিবার পর বড়লাট লর্ড হেষ্টিংস ১৮১৮ সনে এইরূপ পূর্বাহ্বে পরীক্ষার প্রথা রহিত করিয়া সম্পাদকদের পরিচালনার জন্য কতকগুলি সাধারণ নিয়ম নির্দেশ করিলেন। বড়লাটের কৌন্সিল বা সভার সদস্য অ্যাডাম (John Adams), চীফ সেক্রেটারী বেইলী (W. B. Bayley) ও অন্যান্য ইংরেজ কর্মচারীরা হেষ্টিংসের কার্যের বিরোধী ছিলেন এবং বড়লাটের পূর্বোক্ত কৌন্সিল Calcutta Journal পত্রের সম্পাদক বাকিংহামকে ভারত হইতে নির্বাসিত করিবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু হেষ্টিংস “মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা” নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাস করিতেন বলিয়া এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। বাকিংহামের দুর্ভাগ্যবশতঃ লর্ড হেষ্টিংস পদত্যাগ করিলে অ্যাডামস্ অস্থায়ী বড়লাট হইলেন। অতঃপর বাকিংহামের যে দুরবস্থা হইল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

লর্ড হেষ্টিংসের সহযোগীদের ন্যায় বিলাতের কোর্ট অব ডিরেকটর্সও মনে করিতেন যে, গণতন্ত্রশাসিত রাজ্যে মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা বাঞ্ছনীয় হইলেও ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষের ন্যায় পরাধীন দেশে তাহা চলিতে পারে না। ১৮১৮ সনের নূতন বিধি তাহারা মঞ্জুর করেন নাই, কিন্তু বোর্ড অব কনট্রোল (Board of Control) তাহাদের মত অনুমোদন না করায় লর্ড হেষ্টিংসের বিধান বাংলা দেশে কার্যকর হইয়াছিল। অ্যাডাম বড়লাট হইয়াই ১৮২৩ সনের ১৪ই মার্চ সংবাদপত্র সম্বন্ধে এক কড়া আইন (Press Ordinance) জারি করিলেন।

যে সকল মুদ্রিত পুস্তক, পুস্তিকা বা সাময়িকপত্রে সংবাদ এবং সরকারী আইন ও বিচারপদ্ধতির বা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের সমালোচনা থাকিত, কেবল সেইগুলির জন্য নূতন আইনের সৃষ্টি হইল। এই আইন-অনুসারে কোনো সাময়িকপত্র বাহির করিবার পূর্বে স্বত্বাধিকারী, মুদ্রাকর ও প্রকাশককে সরকারের নিকট হইতে লাইসেন্স বা অনুমতি লইতে হইবে, এইরূপ নির্দেশ ছিল। কোন ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট হলফ করিয়া, সেই হলফনামা গভর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারীর নিকট পাঠাইলে তবে লাইসেন্স বা অনুমতি পাওয়া যাইত, কিন্তু সেজন্য কোনও ফি দিতে বা খরচ করিতে হইত না। কী কী বিষয়ের আলোচনা সংবাদপত্রে নিষিদ্ধ ছিল, তাহার মুদ্রিত বিবরণ পূর্ব হইতেই প্রত্যেক সম্পাদককে দেওয়া থাকিত। তাহা সত্ত্বেও আইনবিরুদ্ধ কোন বিষয়ের আলোচনা করিলে কাগজের লাইসেন্স বাতিল করিয়া দেওয়া হইত এবং বেআইনিভাবে কাগজ চালাইলে চারিশত টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল।১৬

এই কুখ্যাত আইনের বিরুদ্ধে রামমোহন রায় যে তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন করিয়াছিলেন বাংলার–তথা ভারতের ইতিহাসে তাহা চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। সেকালের আইন অনুসারে প্রত্যেকটি নূতন আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের নিকট আবেদন করা যাইত। রামমোহন ও কলিকাতার পাঁচজন বিশিষ্ট নেতা এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে একটি আবেদনপত্র (Memorial) দাখিল করিলেন। এই আবেদনে যেরূপ যুক্তিপূর্ণ ও ওজস্বিনী ভাষায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদ করা হইয়াছিল তাহার তুলনা নাই। একজন ইংরেজ মহিলা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য ইংরেজ মহাকবি মিলটন (Milton) রচিত জগদ্বিখ্যাত Areopagitica নামক পুস্তিকার সহিত ইহার তুলনা করিয়াছেন।১৭ কিন্তু সুগ্রীম কোর্টের বিচারপতি আবেদনের যুক্তিতর্কে কিছুমাত্র কর্ণপাত করিলেন না। উপরন্তু জানাইলেন, এই আবেদন পাইবার পূর্বেই গভর্নমেন্টকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন তিনি তাহা অনুমোদন করিবেন। কিন্তু রামমোহন ইহাতে নিবৃত্ত না হইয়া বিলাতে সপারিষদ রাজার (King in Council) নিকট আপীল করিলেন। এই আপীলের রচনাও এদেশে ও বিলাতে বিশেষ প্রশংসা লাভ করিয়াছিল। বলা বাহুল্য, আবেদন ও আপীল উভয়ই রামমোহন নিজে রচনা করিয়াছিলেন। কিন্তু এ আপীলেও কোন ফল হইল না। ১৮২৩ সনের সংবাদপত্র আইন বলবৎ রহিল।

নূতন আইন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রামমোহন প্রতিবাদস্বরূপ তাঁহার সম্পাদিত ‘মীরাৎ-উল-আখবার’ নামক ফার্সী ও উর্দু ভাষায় লিখিত সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ করিয়া দিলেন। ইহার শেষ সংখ্যায় তিনি জানাইলেন যে নূতন আইনের অপমানজনক শর্তে রাজী হইয়া তিনি ঐ কাগজ প্রকাশ করিতে অনিচ্ছুক।

সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইলেও, এই নূতন আইনের বিরুদ্ধে রামমোহন ও তাঁহার পাঁচজন সহযোগীর আন্দোলন ভারতের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে। একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজকর্মচারী এই প্রসঙ্গে যাহা লিখিয়াছেন তাহা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। নিম্নে তাহার সারমর্ম দিতেছি :

“রামমোহন ও তাঁহার যে পাঁচজন সহযোগী-চন্দ্রকুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, হরচন্দ্র ঘোষ, গৌরীচরণ ব্যানাজী ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর–এই আইনের বিরুদ্ধে আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন, তাঁহারা সমগ্র দেশবাসীর নিকট নির্ভীক দেশপ্রেমিক বলিয়া চিরস্মরণীয় হইয়াছেন–কারণ তাঁহারা যে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও রাজার আদালতের বিরুদ্ধে সগর্ধ্বে ও সৎসাহসের সহিত মাথা

তুলিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন তাহা কেবল ভারতীয়দের স্বার্থের জন্য নহে, স্বাধীনভাবে জ্ঞান অর্জন করিবার যে মানুষের জন্মগত অধিকার আছে তাহার প্রতিষ্ঠার জন্য। আবেদনপত্র হইতে বেশ বোঝা যায় যে ইংরেজজাতির রাজনৈতিক চিন্তা ও আদর্শ দ্বারাই তাঁহারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। তাঁহারা ঘোষণা করিলেন যে ইংলণ্ডে প্রজাদের যে অধিকার আছে ভারতীয় প্রজারাও তাহা তুল্যভাবে দাবি করিতে পারে, কিন্তু এই নূতন আইন এইরূপ একটি প্রধান অধিকার হইতে তাহাদিগকে বঞ্চিত করিয়াছে, অথচ কোনরকমেই তাঁহারা এই অধিকারের অপব্যবহার করেন নাই। এই আইনের ফলে ইংলণ্ডের রাজা পার্লিয়ামেন্টের নিকট, ভারতীয় প্রজারা দেশের প্রকৃত অবস্থা ও সরকারী কর্মচারীদের প্রকৃত আচরণ জানাইতে সক্ষম হইবে না। আর ইহাতে সর্বপ্রকারে দেশবিদেশের গ্রন্থাদি হইতে জ্ঞান আহরণের পক্ষে বিষম বাধার সৃষ্টি করিবে।”১৮

এই আন্দোলনের আর-একটি ফল, দেশবাসীর মনে রাজনীতিক চেতনার সঞ্চার। সংবাদ লইয়া সেকালের খুব কম লোকই মাথা ঘামাইত, খুব কম লোকই সংবাদপত্র পড়িত। কিন্তু কারাবাস, নির্বাসন বা অন্য কোন দণ্ডের ভয়ে ভীত না হইয়া রামমোহন ও তাঁহার সহযোগীগণ যেভাবে রাজশক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান। হইলেন তাহাতে বহু দেশবাসীর চিত্ত আকৃষ্ট হইল এবং রাজনীতিক অধিকারের সমস্যা তাহাদের মনে দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হইল।

বস্তুতঃ রামমোহন রাজনীতিক আন্দোলনের যে পন্থা দেখাইলেন, শতাধিক বর্ষ পর্যন্ত ভারতে তাহাই আইনসম্মত আন্দোলন (constitutional agitation) নামে পরিচিত হইয়া ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম প্রস্তুতিরূপে স্বীকৃত ও অনুসৃত হইয়াছিল। ১৯৩০ সনে ভারতের মুক্তিসংগ্রাম যখন প্রায় শেষ অঙ্কে পৌঁছিয়াছিল তখন একজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারী লিখিয়াছিলেন, “লণ্ডনে এক গোলটেবিল বৈঠকে (Round Table Conference) ভারতীয় ও ইংরেজ নেতৃবৃন্দ সমবেত হইয়া ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করিবেন, ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে কোন ইংরেজ ইহা কল্পনাও করিতে পারিত না। আর ইহা কখনও সম্ভব হইত না, যদি রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে তিনজন ঠাকুর, একজন ঘোষ, ও একজন ব্যানার্জী তাঁহাদের আন্দোলনের দ্বারা ইহার পথ প্রস্তুত না করিতেন।”১৯

১৮২৩ সনের কুখ্যাত আইনটি বারো বৎসর ভারতীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করিয়া রাখিয়াছিল এবং এই সময়ের মধ্যে যত সংবাদপত্র বাহির হইয়াছিল, সকলকেই লাইসেন্স গ্রহণ করিতে হইত। লর্ড আমহার্স্ট যখন ১৮২৩ সনে স্থায়ী বড়লাট নিযুক্ত হন তখন কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে ভারতীয় সংবাদপত্র কঠোরহস্তে দমন করিতে নির্দেশ দেন এবং তিনিও সাধ্যমত এই নির্দেশ পালন করেন। ১৮২৭ সনে তিনি সরকারী কর্মচারীদিগকে সংবাদপত্রের সহিত কোনপ্রকার সম্বন্ধ রাখিতে নিষেধাজ্ঞা প্রচার করিয়াছিলেন। ১৮৪১ সনে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়, কিন্তু লর্ড লিটন ১৮৭৫ সনে ইহা পুনঃপ্রচার করেন। ১৮২৭ সনে লর্ড আমহার্স্ট Calcutta Chronicle নামক সংবাদপত্রের প্রচার বন্ধ করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-৩৫) নানাভাবে উদার নীতির পরিচয় দিলেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন। তবে তাঁহার আমলে কোন খবরের কাগজের প্রচার বন্ধ হয় নাই। লর্ড বেন্টিঙ্কের পর মেটকাফ (Sir Charles Metcalfe) অস্থায়ীভাবে বড়লাট নিযুক্ত হন। তিনি ১৮২৩ সনের আইন রহিত করিয়া ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করেন (সেপ্টেম্বর ১৮৩৫)। তাঁহার স্বল্পকালস্থায়ী শাসন ইহার জন্য ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়াছে। ভারতবাসীরা খুবই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইলেও ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ইহাতে বিরক্ত হইলেন। বোধহয় এই কারণেই মেটকাফকে পাকাপাকিভাবে বড়লাটের পদে নিযুক্ত করিলেন না।

ইহার পর ১৮৫৭ সন পর্যন্ত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ছিল এবং কোন অভিযোগের কারণও ঘটে নাই। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজী ও দেশীয় কাগজের নানারকম মিথ্যা সংবাদে ও উত্তেজনামূলক উক্তিতে সিপাহীরা বিচলিত হইয়া বিদ্রোহ করিয়াছে এই ধারণার বশবর্তী হইয়া বড়লাট ক্যানিং ১৮৫৭ সনে আইন করিয়া এক বৎসরের জন্য ইংরেজী ও দেশীয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অনেক পরিমাণে খর্ব করেন। এই আইনের ফলে বাংলা দেশের ‘সুলতান-উল আখবর’ ও ‘দূরবীন’ নামক দুইটি ফার্সী পত্রিকা, ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ নামে হিন্দী ও বাঙ্গলা ভাষায় লিখিত পত্রিকা, এবং দুইটি ইংরেজী পত্রিকা Friend of India’ ও Bengal Hurkaru’ অভিযুক্ত হয়।

৩. সংবাদপত্র (১৮৫৭-১৯০৫)

(ক) ইংরেজী পত্রিকা

সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতীয় পরিচালিত পত্রিকার সংখ্যা অনেক বাড়িয়া গেল। ইহার মধ্যে ইংরেজী পত্রিকার সংখ্যা খুব অল্পই ছিল বরং বিভিন্ন দেশীয় ভাষায় লিখিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। এইগুলির মধ্যদিয়া ভারতীয়দের মনে রাজনীতিক চেতনা জাগ্রত হইল এবং দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি ও অনুপ্রেরণা বাড়িয়া চলিল। অপরপক্ষে ইংরেজ পরিচালিত পত্রিকাগুলিতে ভারতীয়দের প্রতি একটা আক্রোশের ভাব দেখা দিল, উপরন্তু তাহাদের রাজনীতিক অধিকার ও দাবির বিরোধিতা প্রকট হইয়া উঠিল। ইহার প্রধান কারণ এতদিন ভারতবর্ষ ছিল একটি কোম্পানীর অধিকারে, এখন হইতে ইহা প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজরাজের ও ইংরেজ জাতির অধীন হইল, সুতরাং প্রত্যেক ইংরেজই নিজেকে ভারতের প্রভু বলিয়া মনে করিতে লাগিল।

বাংলা দেশে বহুদিন পর্যন্ত ‘Hindoo Patriot’-ই সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ পত্রিকা ছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সময় এই পত্রিকা স্বাধীন মতামত প্রকাশ করিয়া খুব সুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিল। নীলকরদের অত্যাচার ও চাষীদের দুর্দশা বর্ণনা করিয়া এই পত্রিকা তীব্র ভাষায় ইংরেজিশাসনের নিন্দা ও ইহার বিরুদ্ধে দেশীয় লোকদের সক্রিয় প্রতিরোধ সমর্থনপূর্বক এক নূতন জাতীয় মনোবৃত্তি গঠনের অনুপ্রেরণা জোগাইয়াছিল। ১৮৬১ সনে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ইহার প্রভাব কিছু কমিয়াছিল। কিন্তু কৃষ্ণদাস পাল ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করায় আবার ইহার পূর্বগৌরব ফিরিয়া আসিল। তেইশ বৎসর কাল কৃষ্ণদাস পাল ইহার সম্পাদক ছিলেন এবং এই সময় ইহার প্রভাব ও প্রতিপত্তি যেরূপ বৃদ্ধি পাইয়াছিল খুব কম সংবাদপত্রের ভাগ্যেই তাহা ঘটিয়াছে। গভর্নমেন্টও ইহার মতামতকে মূল্যবান জ্ঞান করিতেন।

এই সময় আর কয়েকটি পত্রিকাও বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিল। ১৮৬১ সনে Indian Mirror প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পরে কেশবচন্দ্র সেন ইহার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, পরে ইহার সুযোগ্য সম্পাদক ছিলেন নরেন্দ্রনাথ সেন। অন্যান্য পত্রিকাগুলির মধ্যে কিশোরীচাঁদ মিত্র সম্পাদিত সাপ্তাহিক Indian Field (১৮৫১), শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত Mukherji’s Magazine (১৮৬১) এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত Bengalee (১৮৬২) প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ১৮৬৫ সনে নবগোপাল মিত্র বিশেষভাবে জাতীয়তার উদ্দীপক National Paper প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ বৎসরই Indian Field পত্রিকা Hindoo Patriot-এর সঙ্গে যুক্ত হয়।

ইংরেজ পরিচালিত কাগজের মধ্যে ‘Statesman’ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। ইহার সম্পাদক রবার্ট নাইট (Robert Knight) ইংরেজ সম্পাদকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রসিদ্ধি অর্জন করিয়াছিলেন। ইনি প্রথমে বম্বে নগরী হইতে প্রকাশিত The times of of India পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৮৭৫ সনে তিনি ইহার সংস্রব ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসেন এবং শ্রীরামপুরের কেরী, মার্শম্যান, ওয়ার্ড প্রভৃতি মিশনারীগণ কর্তৃক ১৮১৮ সনে প্রতিষ্ঠিত Friend of India পত্রিকার স্বত্ব ক্রয় করেন। ইহা প্রথমে ছিল মাসিক, পরে সাপ্তাহিক হয়। সিপাহী বিদ্রোহের প্রারম্ভে ১৮৫৭ সনের ২৫শে জুন তারিখে এই পত্রিকায় “পলাশীর শতবার্ষিকী নামে একটি প্রসিদ্ধ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গর্ভনমেন্ট ইহাতে বিচলিত হইয়া ইহাকে সতর্ক করিয়া দেন। ১৮৭৫ সনে নাইট সাহেব Statesman পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরিণামে এই দুইটি কাগজ যুক্ত হইয়া The Statesman and the Friend of India এই নামে প্রকাশিত হয়। এই কাগজটি The Statesman নামে এখনও প্রচারিত হইতেছে। ইংরেজ পরিচালিত সাময়িকপত্রের মধ্যে Statesman পত্রিকার সম্পাদক নাইট সাহেব ভারতের প্রগতির প্রতি সর্বাপেক্ষা অধিকতর সহানুভূতি প্রদর্শন করিতেন। আর-একখানি প্রসিদ্ধ ইংরেজী দৈনিকপত্র Englishman; ইহা ১৮৩২ সনে প্রতিষ্ঠিত John Bull পত্রিকার পরিবর্তিত নূতন নাম। ইহা ছিল সাম্রাজ্যবাদী ও কনসার্ভেটিভ (Conservative বা Tory) দলের মুখপত্র, সুতরাং ভারতীয়বিদ্বেষী এবং প্রতিক্রিয়াশীল। এই দুইখানি পত্রিকার মধ্যপন্থী ছিল Indian Daily News। এই পত্রিকা ও Englishman, এই দুই দৈনিকের মূল্য ছিল চারি আনা। Statesman এক আনায় বিক্রয় হইত। সুতরাং ঐ দুই পত্রিকা Statesmanকে পছন্দ করিত না। কিন্তু ভারতীয় জনসাধারণের কাছে Statesman খুবই প্রিয় ছিল। দামে সস্তা এবং মতামতের উদারতাই ইহার কারণ।

বাংলা ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ কিরূপে প্রথমে শিশিরকুমার ও পরে মতিলাল ঘোষের সম্পাদনায় ইংরেজী দৈনিক কাগজে পরিবর্তিত হয় তাহা পরে বিবৃত হইবে। ইংরেজী Bangalee ও Amrita Bazar Patrika উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের প্রথমে সর্বশ্রেষ্ঠ সংবাদপত্র বলিয়া পরিগণিত হইত। Bengalee পত্রিকার প্রতিষ্ঠার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ১৮৭৯ সনের ১লা জানুয়ারি তারিখে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ইহার সম্পাদক ও অধ্যক্ষ হন। এই সময় হইতে Bengalee খুব প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে স্বদেশী আন্দোলনের যুগে ইহা Amrita Bazar অপেক্ষাও অধিকতর জনপ্রিয় হইয়াছিল। মোটের উপর এই দুই পত্রিকা যে বাংলার–তথা ভারতের জাতীয়তা-চেতনা উদ্বোধনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, তাহতে কোন সন্দেহ নাই।

দুঃখের বিষয়, এই দুই পত্রিকার সম্পাদকের মধ্যে বহুদিন যাবৎ একটি রেষারেষির ভাব গড়িয়া উঠিয়াছিল। “হিতবাদী’ পত্রিকা সে-যুগের একজন সুপরিচিত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির পারিবারিক কুৎসা প্রচারের জন্য মানহানির অপরাধে অভিযুক্ত হয়। এই উপলক্ষে এই বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। রাজনীতিক মতভেদও ইহার অন্যতম কারণ ছিল, কারণ সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন নরমপন্থী আর মতিলাল ছিলেন কতকটা চরমপন্থী। ১৯০০ সনে ভাগলপুরে অনুষ্ঠিত বাংলা প্রাদেশিক সভা (Bengal Provincial Conference) সম্বন্ধে মতিলাল মন্তব্য করেন যে ইহা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় নাই, কয়েকজন বক্তা ও সম্পাদকের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছিল। ইহাতে ইংরেজী Bengalee ও বাংলা বসুমতী পত্রিকা মতিলালের বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য করিয়াছিল। বহুদিন পর্যন্ত সুরেন্দ্রনাথ ও মতিলালের ন্যায় দুইজন প্রবীণ সাংবাদিক পরস্পরের প্রতি যে সমুদয় ব্যক্তিগত উক্তি ও নিন্দা করিতেন, তাহা সর্বসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত অপ্রীতিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছিল। একসময়ে এমন সম্ভাবনাও দেখা দিয়াছিল যে এই কলহ আদালত পর্যন্ত গড়াইবে। সৌভাগ্যের বিষয় তাহা হয় নাই। দুইজনের মধ্যে মাঝে মাঝে সদ্ভাবের লক্ষণ দেখা গেলেও ইহা স্থায়ী হয় নাই, প্রীতির বন্ধন গড়িয়া ওঠা ত দূরের কথা।

(খ) বাংলা পত্রিকা

আলোচ্য যুগের প্রারম্ভেই, ১৮৫৮ সনের ১৫ই নভেম্বর (১অগ্রহায়ণ, ১২৬৫), বিখ্যাত ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ। ইহা প্রথমে কলিকাতা হইতে প্রকাশিত হইত। তারপর রেললাইন দ্বারা কলিকাতার সহিত সম্পাদকের জন্মস্থান চাংড়িপোতার সংযোগ হইলে ঐ গ্রাম হইতেই সোমপ্রকাশ প্রকাশিত হইত।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই এই পত্রিকার পরিকল্পনা করেন। তাঁহার ন্যায় দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণও খুব স্বাধীনচেতা ও উদারমতাবলম্বী ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা পত্রিকায় রাজনীতিবিষয়ক আলোচনার প্রবর্তন করেন। এই গ্রন্থে সোমপ্রকাশের নানা সংখ্যা হইতে যে-অংশসমূহ উদ্ধৃত হইয়াছে তাহা হইতেই বাংলার জাতীয় জাগরণে এই পত্রিকার অবদান সম্বন্ধে অনেকটা ধারণা করা যাইবে। Hindoo Patriot পত্রিকার ন্যায় সোমপ্রকাশও চাষীদের প্রতি নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল।

১৮৭৮ সনে দেশীয় সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইন হয় তদনুসারে লাহোরস্থ সংবাদদাতার এক পত্র প্রকাশ হওয়াতে গভর্নমেন্ট ঐ পত্রিকার নিকট হাজার টাকা আমানত (ডিপোজিট) ও মুচলেকা চান। তাহা না-দেওয়ায় সোমপ্রকাশ বন্ধ হইয়া যায়। পরে কৃষ্ণদাস পাল, লালমোহন ঘোষ প্রভৃতির চেষ্টায় আমানত ও মুচলেকা ছাড়াই গভর্নমেন্ট ঐ পত্রিকা পুনঃপ্রচারের অনুমতি দেন এবং নির্দেশ দেন যে ‘সোমপ্রকাশে’ যেন কোন অসঙ্গত বিষয় প্রকাশ না হয় এবং সম্পাদক স্বচক্ষে না দেখিয়া যেন কোন বিষয় মুদ্রিত হইতে না দেন। ১৮৮০ সনে সোমপ্রকাশ পুনঃপ্রকাশিত হয়। শেষবয়সে দ্বারকানাথ অসুস্থ হওয়ায় পত্রিকাসম্পাদনে পূর্বের ন্যায় সময় দিতে পারিতেন না; ফলে ইহার প্রভাব কমিয়া যায়। ১৮৮৬ সনে দ্বারকানাথের মৃত্যু হয়।

১৮৬১ সনে ‘সোমপ্রকাশের অনুকরণে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘ঢাকাপ্রকাশ’ বাহির হয়। পত্রিকার পরিচালকগণের মধ্যে অনেকেই ব্রাহ্মধর্মের সমর্থক ছিলেন, সুতরাং পত্রিকাখানিতে ঐ ধর্মের প্রভাব ছিল। চারি বৎসর পর প্রথম দীননাথ সেন (পরবর্তীকালে ইন্সপেক্টর অব স্কুলস্) ও পরে আরও কয়েকজন ইহার সম্পাদক হন। এই পত্রিকাখানি ৭০ বৎসরেরও অধিককাল প্রচলিত ছিল।

১৮৬১ সনে পরিদর্শক’ নামে একখানি দৈনিক পত্র প্রকাশিত হয়। প্রথমে জগন্মোহন তর্কালঙ্কার ও মদনমোহন গোস্বামী, পরে ১৮৬২ সনের ১৪ই নভেম্বর হইতে কালীপ্রসন্ন সিংহ এই পত্রিকার সম্পাদক হন এবং ইহার কলেবর বৃদ্ধি করেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই ইহার প্রচার বন্ধ হইয়া যায়।

পরিদর্শকের প্রথম সংখ্যায় প্রস্তাবনায় যাহা বলা হইয়াছে তাহা হইতে সে সময়কার বাংলা সংবাদপত্রের সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা যায়। এই নিমিত্ত ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“অস্মদেশীয় অধিকাংশ লোক সংবাদপত্রের তাদৃশ সমাদর করেন না, অনেকে ইহার ফলোপধায়তার বিষয়ও অবগত নহেন। যাহারা ইংরাজী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে যদিও সংবাদপত্র পাঠে আগ্রহাতিশয় প্রকাশ করিতে দেখা যায় বটে, কিন্তু ইংরাজী পত্র পাটেই তাঁহাদিগের সম্পূর্ণ ঔৎসুক্য নিবৃত্তি হয়। ইংরাজী পত্র না পাইলেও তাঁহাদিগের বাঙ্গলা পত্র পাঠ করিতে ভক্তি জন্মে না। তাহার কারণ এই যে, বাংলা সংবাদপত্রের অধিকাংশই অসার ও অকর্মণ্য, কেহ কেহ ইংরাজী পত্র হইতে একমাসের পুরাতন সংবাদ অনুবাদ করিয়া কাগজ পূর্ণ করিয়া থাকেন, কোন কোন বাঙ্গলা সংবাদপত্র কোন একখানি ইংরাজী পত্রের কিয়দংশের অনুবাদ মাত্র বলিলেও অসঙ্গত হয় না…

“যে সকল কারণে বাঙ্গালা পত্রে সাধারণের অনাস্থা জন্মিয়াছে, যাহাতে সেই সকল কারণ সম্পূর্ণরূপে অপনীত হয়, তদ্বিষয়ে সবিশেষ যত্নবান হইব। আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যে জ্ঞান পূৰ্ব্বক সত্য পথ হইতে বিচলিত হইব না, যাহাতে কোন বিষয়ের অতিবর্ণন না হয়, তদ্বিষয়ে সবিশেষ যত্নবান হইব, যদিও পৃথিবীর কোন মনুষ্যই পক্ষপাতের হাত এড়াইতে পারেন না তথাপি আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, জ্ঞান পূৰ্ব্বক কখন পক্ষপাত দোষে লিপ্ত হইব না। যাহাতে দেশের কুসংস্কাররাশি নিরাকৃত হয় তদ্বিষয়ে নিয়ত নিযুক্ত থাকিব, দেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধন, অজ্ঞানান্ধ ভ্রাতৃগণকে জ্ঞাননেত্র প্রদান করা, পরোপকারি ও প্রজাপীড়ক দুরাত্মাদিগের দৌরাত্ম নিবারণ এই সমস্ত কাৰ্যই আমাদিগের প্রধান উদ্দেশ্য।”২০

১৮৬৩ সনে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইহার সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত। এই পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হইয়াছে :

“এই পত্রিকাতে স্ত্রীলোকদিগের আবশ্যক সমুদয় বিষয় লিখিত হইবে। তন্মধ্যে যাহাতে তাহাদের ভ্রম ও কুসংস্কার সকল দূর হইয়া প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হয়, যাহাতে তাহাদের উৎকৃষ্ট মনোবৃত্তি সকল উপযুক্ত বিষয়ে পরিচালিত হয়, এবং যাহাতে তাহাদের নিতান্ত প্রয়োজনীয় জ্ঞান সকল লাভ হইতে পারে, তপ্রতি বিশেষ দৃষ্টি থাকিবে। ইহাতে যে সকল বিষয় অবলম্বন করিয়া লেখা হইবে, পত্রিকার শিরোভাগে তাহার উল্লেখ করা গিয়াছে।”২১

প্রথম সংখ্যার শিরোভাগে নিম্নলিখিত বিষয়-তালিকা ছিল।

লেখ্য বিষয়

১। ভাষাজ্ঞান ২। ভূগোল ৩। খগোল ৪। ইতিহাস ৫। জীবনচরিত ৬। বিজ্ঞান ৭। স্বাস্থ্যরক্ষা  ৮। নীতি ও ধর্ম ৯। দেশাচার ১০। পদ্য ১১। গৃহচিকিৎসা ১২। শিশুপালন ১৩। শিল্পকর্ম ১৪। গৃহকাৰ্য্য ১৫। অদ্ভুত বিবরণ [২২]

স্ত্রীশিক্ষা প্রচারে এই পত্রিকা যে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল তাহা ঐ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হইয়াছে। স্ত্রীলোকদের লেখায় উৎসাহিত করা এবং যোগ্য বোধ করিলে তাহা পত্রিকায় প্রকাশ করা ইহার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল।

বামাবোধিনী পত্রিকা ১৯২৩ সন (১৩২৯ বঙ্গাব্দের চৈত্র) পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ষাট বৎসর প্রচলিত ছিল।

উনিশ শতকের ষষ্ঠ দশকে মফঃস্বলের শহর হইতে কয়েকখানি পত্রিকা বাহির হইত। ইহাদের মধ্যে সাপ্তাহিক ‘রঙ্গপুর দিপ্রকাশ’ (১৮৬০), মাসিক ‘ত্রিপুরা জ্ঞানপ্রসারিণী’ (১৮৬০), পূর্বোক্ত সাপ্তাহিক ‘ঢাকাপ্রকাশ’ (১৮৬১), পাক্ষিক ‘ফরিদপুর দর্পণ’ (১৮৬১), সাপ্তাহিক ‘ঢাকাবার্তা প্রকাশিকা’ (১৮৬২), সাপ্তাহিক ‘ঢাকাদর্পণ’ (১৮৬৩), মাসিক ‘পাবনাদর্পণ’ (১৮৬৪), ‘ঢাকার হিন্দু হিতৈষিণী’ (১৮৬৫), ‘বধৰ্মান মাসিক পত্রিকা’ (১৮৬৬), পাক্ষিক ‘মুর্শিদাবাদ সংবাদসার’ (১৮৬৬), খুলনার ‘সমাজ দর্পণ’ (১৮৭১) ও মৈমনসিংহের ‘ভারতমিহির’ প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে।

১৮৬৩ সনে (১২৭০ সাল) প্রকাশিত কুমারখালির প্রসিদ্ধ কাঙ্গাল হরিনাথ সম্পাদিত গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ একখানি উল্লেখযোগ্য সাময়িকপত্র। গ্রাম ও গ্রামবাসীর দুরবস্থার কথা প্রচার করাই ছিল ইহার বিশেষ উদ্দেশ্য। ১৯ বৎসর কাল এই পত্রিকা মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক প্রভৃতি নানা আকারে প্রচলিত ছিল। পরে ১২৮৯ সালের বৈশাখ মাসে জলধর সেন ও অক্ষয়কুমার মৈত্রের পরিচালনায় সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্তা’ পুনঃ প্রকাশিত হয়। ১২৯১ সালের আশ্বিন মাসে ইহা বন্ধ হইয়া যায়।

১৮৬৫ সনে ঢাকা হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভার মুখপত্র ‘হিন্দু হিতৈষিণী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইহার সম্পাদক ছিলেন হরিশ্চন্দ্র মিত্র। ইহা ব্রাহ্মধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করিত।

রাজসাহী জিলার বোয়ালিয়া হইতে ১৮৬৬ সনে শ্রীনাথ সিংহ রায়ের সম্পাদনায় ‘হিন্দুরঞ্জিকা’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ব্রাহ্মধর্মের প্রতিবাদ ও হিন্দুধর্মের প্রচার করাই ছিল ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য। দুই বৎসর পরে ইহা সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। ইহা ৬৫ বৎসর পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

১৮৬৭ সনে ঢাকা হইতে ‘পল্লী-বিজ্ঞান’ নামে মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। গ্রামে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারই ছিল ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য।

১৮৬৯ সনে স্ত্রীলোকের উন্নতিসাধনের জন্য ঢাকা হইতে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সম্পাদনায় ‘অবলাবান্ধব’ নামে পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরে ইহা কলিকাতা হইতে প্রচারিত হয় এবং মাসিকে পরিণত হয়।

১৮৭০ সনে ঢাকা হইতে বঙ্গচন্দ্র রায় ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ইহা ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ছিল এবং ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি সম্বন্ধে আলোচনা করিত। ইহা ১৯০৭ সনে বন্ধ হয়।

১৮৭৭ সনে কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ‘ধর্মপ্রচারক’ নামে সনাতনপন্থী হিন্দুদের একখানি মুখপত্র প্রথমে মুঙ্গের ও পরে কাশী হইতে প্রকাশিত করেন। ইহা ২৫ বৎসর কাল প্রচলিত ছিল।

বাঁকুড়া হইতে ১৮৯২ সনে পাক্ষিক বাঁকুড়া দর্পণ’ প্রকাশিত হয়। দুই বৎসর পরে ইহা সাপ্তাহিক হয় এবং মফঃস্বলের পত্রিকাগুলির মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। রামনাথ মুখোপাধ্যায় ১৮৯২ হইতে ১৯০৭ সন পর্যন্ত ইহার সম্পাদনা করেন।

১৮৯৭ সনে রাজসাহী জিলার বোয়ালিয়া হইতে ‘উৎসাহ’ নামক মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। ইহার সম্পাদক ছিলেন সুরেশচন্দ্র সাহা। রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার মৈত্র, জলধর সেন প্রভৃতি অনেক খ্যাতনামা লেখকের রচনা ইহাতে প্রকাশিত হইত।

‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ যথাসময়ে ইহার শতবার্ষিকী উৎসব অনুষ্ঠান করিয়াছে। যশোহর জিলার একটি ক্ষুদ্র গ্রাম ‘চরমাগুরা’ হইতে শিশিরকুমার ঘোষ তাঁহার এক ভ্রাতা হেমন্তকুমারের সহযোগে ১৮৬৮ সনের ২০ ফেব্রুআরি এই বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বাহির করেন। ছোট একটি কাঠের মুদ্রাযন্ত্র কিনিয়া নিজেদের গ্রামে তাহা প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেরাই, প্রেসের কম্পোজিটর ও মুদ্রাকর এবং পত্রিকার সম্পাদক প্রভৃতির কার্য নির্বাহ করিতেন। ইহার প্রথম সংখ্যায় লিখিত হইয়াছিল : “যে স্থান হইতে এই পত্রিকা বাহির হইতেছে তাহার পশ্চিমে ও উত্তরে ৩ দিনের পথ, পূৰ্বে দেড় বৎসরের ও দক্ষিণে ৩ বৎসরের পথ পৰ্য্যন্ত একটিও মুদ্রাযন্ত্র নাই, সুতরাং সম্বাদপত্র থাকাও অসম্ভব।” এই অসমসাহসিক কার্যে ব্রতী হইয়া ঘোষ-ভ্রাতারা এই পত্রিকার মাধ্যমে সাধারণের যে কল্যাণ সাধন করিয়াছেন, তাহার তুলনা বিরল। সে-যুগে নির্ভীকভাবে গভর্নমেন্টের দোষত্রুটির আলোচনা এবং জনসাধারণের অভাব-অভিযোগ ও দুর্দশার কথা প্রচার করিয়া এই পত্রিকার সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ অনন্যসাধারণ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। এই পত্রিকাকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারক ও বাহক’ করাই ছিল শিশিরকুমারের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য এবং এ-বিষয়ে যে তিনি বহু পরিমাণে সফলতা অর্জন করিয়াছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। এই পত্রিকার শিরোভূষণস্বরূপ (motto) পৃষ্ঠান্তরে দুইটি লাইন মুদ্রিত হইত :

“অধীনতা কালকূটে মরি হায় হায়।
করেছে কি আর্যসুতে চেনা নাহি যায় ॥”

অমৃতবাজার পত্রিকাই সর্বপ্রথম অতি জোরের সহিত পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করিলেন –”শাসক ইংরেজ ও শাসিত ভারতবর্ষের স্বার্থ কখনও এক হইতে পারে না, প্রত্যুত উহা পরস্পরের পরিপন্থী। সুতরাং ভারতবাসীকে ইংরেজের মুখাপেক্ষী না হইয়া নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে, এবং তখনই শাসকের দৃষ্টিতেও তাহার মর্যাদা বাড়িবে।”২৩

১৮৬৮ সনের ৭ মে সংখ্যায় মন্তব্য করা হইয়াছে : “জাতি-ঐক্যতার সংস্থাপন করিতে গেলে একটি এমন উদ্দেশ্য আবশ্যক করে যেখানে সকলের স্বার্থ সমানরূপে সম্মিলিত হয়। সেটি ভারত ভূমিকে দাসত্ব শৃঙ্খল হইতে উন্মোচন করা।”২৪ নবগোপাল মিত্রের প্রচারিত জাতীয়তা অপেক্ষা এই জাতীয়তার আদর্শ উচ্চতর।

ইহার তিন সপ্তাহ পরে “ভারতবর্ষীয়েরা ক্রমে স্বাধীনতা পাইবার উপযুক্ত হইবে” এইরূপ উক্তির উত্তরে সম্পাদক লিখিয়াছেন, “ইহা কি কখনও হইয়া থাকে? স্বাধীনতা শিখিবার পুস্তক ইতিহাসও নয়, রাজনৈতিক বিজ্ঞানও নয়। স্বাধীনতা শিখিবার পুস্তক স্বাধীনতা।”২৫ এইগুলি ও ইহার অনুরূপ উক্তি ৪০ বৎসর পরে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের মূলমন্ত্ররূপে ব্যবহৃত হইত।

মফঃস্বলে নীলকর ও অন্যান্য সাহেবদের অত্যাচারের কথা অমৃতবাজার পত্রিকায় নির্ভীকভাবে প্রকাশ করা হইত, তাহার জন্য সম্পাদক আদালতে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হইয়াছেন। বস্তুতঃ সে-যুগের ইংরেজী বা বাংলা কোন পত্রিকাতেই অমৃতবাজারের ন্যায় স্বাধীনচিত্ততা এবং সরকারী কার্যাকার্যের কঠোর সমালোচনা দেখা যায় না।

পত্রিকার দ্বিতীয় বৎসরে (২৫ ফেব্রুআরি ১৮৬৯) বাংলার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু ইংরেজী অংশও থাকিত। ১৮৭২ সন হইতে প্রতি সপ্তাহেই ইংরেজী অংশ বেশী পরিমাণে ও রীতিমত বাহির হইত। সুতরাং বাংলার বাহিরেও ইহা লোকে পাঠ করিয়া স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা পাইত। ১৯১৭ সনে লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক লিখিয়াছেন : “৪০ বৎসর পূর্বে অমৃতবাজার পত্রিকার জন্য প্রতি সপ্তাহে মহারাষ্ট্রের লোকেরা উদ্গ্রীব হইয়া থাকিত। ইহার বিদ্রূপ ও শ্লেষাত্মক রচনা এবং কঠোর সমালোচনা সকলেই খুব উপভোগ করিত। মহারাষ্ট্রের লোকেরা বলাবলি করিত যে শিশিরবাবু এক পা জেলের দিকে বাড়াইয়াই লিখিতে বসিতেন, আর তাঁহার ভাই মতিবাবু অপেক্ষা করিয়া থাকিতেন কখন তিনি জেলে যাইবেন।”২৬ বাংলার বাহিরে এমনকি সুদূর মহারাষ্ট্রেও অমৃতবাজার পত্রিকা কিরূপ জনপ্রিয় ছিল, ইহা হইতে তাহা জানা যাইবে। অনেকে মনে করেন, প্রধানতঃ অমৃতবাজার পত্রিকার মুখ বন্ধ করার জন্যই ১৮৭৮ সনের ‘দেশীয় সম্বাদ-পত্র আইন বিধিবদ্ধ হয়। কিন্তু ইহার কবল এড়াইবার জন্য ১৮৭৮ সনে ২১শে মার্চ রাতারাতি অমৃতবাজার ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়। ১৮৯১ সনের ১৯ ফেব্রুআরি ইহা দৈনিক কাগজে পরিণত হয়।

১৮৬০ সনে মাসিক ‘বিজ্ঞান কৌমুদী’ ও ১৮৬৩ সনে সাপ্তাহিক ‘আয়ুর্বেদ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ সনে ‘অবোধ বন্ধু’ নামে একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী ও আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের বহু রচনা ইহাতে প্রকাশিত হয়। ১৮৭০ সনে কেশবচন্দ্র সেন ‘সুলভ সমাচার’ নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন। ইহার মূল্য ছিল এক পয়সা মাত্র আর ইহার গ্রাহকসংখ্যা তিন হইতে চারি হাজার। সেকালে ইহার অপেক্ষা বেশী গ্রাহক কোন কাগজেরই ছিল না, এরূপ সস্তা সংবাদপত্রেরও ইহাই প্রথম দৃষ্ঠান্ত। জনশিক্ষায় এই পত্রিকা বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল। বাংলা ১৩১৮ সালে ইহা দৈনিকে পরিণত হয়, কিন্তু পর বৎসরই ইহা বন্ধ হইয়া যায়।

১৮১৭ সনে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় মদ না গরল’ নামে মাসিক ও ১৮৭৩ সনে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সম্পাদনায় চূড়া হইতে সাপ্তাহিক ‘সাধারণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সাধারণী’ বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার জীবনচরিতে ইহাকে ‘শিক্ষিত সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ মুখপত্র’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ইহার একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। ১৮৭৩ সনে প্রকাশিত ‘সহচর’ নামে আর একখানি পত্রিকাও এককালে একখানি উৎকৃষ্ট পত্রিকা বলিয়া গণ্য হইত।

১৮৭৯ সনে নববিভাকর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় ও কয়েক বৎসর পরে ইহা সাধারণী’র সহিত যুক্ত হইয়া ‘নববিভাকর-সাধারণী’ নামে পরিচিত হয়। অক্ষয়চন্দ্র সরকার নবজীবন’ নামে একখানি মাসিক-পত্রও সম্পাদনা করিতেন। বঙ্কিমচন্দ্র ব্যতীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি প্রসিদ্ধ লেখকগণ অক্ষয়চন্দ্রের পত্রিকায় লিখিতেন। কিন্তু ১৮৯০ সনে নববিভাকর-সাধারণী’ বন্ধ হইয়া যায়।

১৮৮১ সনে ‘বঙ্গবাসী’ ও ১৮৮৩ সনে সঞ্জীবন’ এই দুইটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। উভয় পত্রিকাই বহুদিন স্থায়ী হইয়াছিল ও খুব প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। বঙ্গবাসীর স্বত্বাধিকারী ছিলেন যোগেন্দ্রচন্দ্র বসু। তিনি নামতঃ সম্পাদক হইলেও ১৮৮৩ হইতে ১৮৯৫ সন পর্যন্ত কার্যতঃ কৃষ্ণচন্দ্র ব্যানার্জীই ইহার সম্পাদনা করিতেন। ১৮৯১ সনে সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ প্রকাশিত হয়। এই তিনটি সাপ্তাহিকই বাংলার জনসাধারণের বিধি বিষয়ে জ্ঞানলাভ ও জাতীয়তা বিকাশের বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল। ১৮৯৬ সনে সাপ্তাহিক বসুমতী’ প্রকাশিত হয়। ইহার প্রথম সম্পাদক ছিলেন ব্যোমকেশ মুস্তফী। আলোচ্য যুগের পরে ইহা দৈনিকে পরিণত হয় (১৯১৪), পরে ইহার মাসিক সংস্করণও প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে। বিংশ শতকে উল্লিখিত তিনখানি পত্রিকার ন্যায় দৈনিক ও মাসিক বসুমতী বিশেষ জনপ্রিয় হয়। বঙ্গবাসীর মূল্য ছিল এক পয়সা এবং ইহার বহুল প্রচার ছিল। বঙ্গবাসী কাগজটি আমাদের বাল্যকালে মফঃস্বলে এত জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল যে গ্রামের লোকেরা সকল বাংলা সংবাদপত্রকেই ‘বঙ্গবাসী’ বলিয়া অভিহিত করিত। ইংরেজীশিক্ষার ফলে হিন্দুদের যে এক সম্প্রদায় নিজেদের সংস্কৃতি তুচ্ছ করিয়া পাশ্চাত্ত্যের অনুকরণে ব্যর্থ ছিল, বঙ্গবাসী তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও তীব্র কটাক্ষে তাহাদের জর্জরিত করিত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় চেতনা উদ্বোধনের জন্য আবেগপূর্ণ ভাষায় আবেদন করিত এবং গভর্নমেন্টের অনেক কার্যের কঠোর সমালোচনা করিত। ইহার ফলে ১৮৯১ সনে প্রকাশিত কয়েকটি মন্তব্যের জন্য বঙ্গবাসীর স্বত্বাধিকারী, সম্পাদক, পরিচালক ও মুদ্রাকর ফৌজদারী আইনের ১২৪-এ ও ৫০০ ধারা অনুযায়ী বিদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হন। এদেশের সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে এরূপ সরকারী মামলা এই প্রথম। এই বিষয় পরে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হইবে। মোটের উপর রাজনীতিক এবং সামাজিক বিষয়ে প্রাচীনপন্থী হইলেও বঙ্গবাসী বাঙ্গালীর উপর খুবই প্রভাব বিস্তার করে। ইহার গ্রাহকসংখ্যা ছিল বিশ হইতে ত্রিশ হাজারের মধ্যে। ইহার একটি হিন্দী সংস্করণও ছিল।

‘সঞ্জীবনী’ ছিল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র এবং ধর্ম ও সামাজিক বিষয়ে বঙ্গবাসীর প্রতিদ্বন্দ্বী। ইহার সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র। হিতবাদীর প্রথম সম্পাদক ছিলেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ইহার এক অংশ (magazine) সম্পাদনা করিতেন এবং তাঁহার কয়েকটি ছোটগল্প ইহাতে প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৮৯৪ সনে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ ইহার সম্পাদক হন। তাঁহার সম্পাদনায় ক্রমে ইহা সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা সাপ্তাহিক বলিয়া পরিগণিত হয়। কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের মৃত্যুর পর (১৯০৭) সখারাম গণেশ দেউস্কর ও জলধর সেন ইহার সম্পাদক হন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় এই তিনখানি পত্রিকা জনমত গঠনে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল।

‘বামাবোধিনী পত্রিকার উল্লেখ পূর্বেই করা হইয়াছে। বিশেষভাবে স্ত্রীলোকের শিক্ষা ও সাধারণ উন্নতির জন্য আরও কয়েকখানি পত্রিকা প্রচারিত হইয়াছিল। ইহার মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক ১৮৭৮ সনে প্রকাশিত ‘পরিচারিকা’ নামে মাসিক পত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহার প্রথম সম্পাদক ছিলেন প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। ইহা ২৮ বৎসর চলিয়াছিল।

ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী একজন সুলেখক ছিলেন। তিনি সুপাঠ্য সামাজিক উপন্যাস রচনা করেন এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ‘তত্ত্বকৌমুদী’ ও শিশুপাঠ্য মাসিক-পত্ৰ মুকুল’ (১৮৯৫) সম্পাদনা করিতেন। মুকুল’ এককালে খুব জনপ্রিয় ছিল।

জাতীয়তা ভাবের উদ্বোধন ও প্রচারক হিসাবে আলোচ্য যুগের শেষভাগে প্রকাশিত কয়েকখানি পত্রিকা বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ইহাদের মধ্যে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক Dawn (১৮৯৭) ও বিপিনচন্দ্র পাল সম্পাদিত সাপ্তাহিক New India (১৯০২) এই দুইখানি ইংরেজী পত্রিকা ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় সম্পাদিত দৈনিক এক পয়সা মূল্যের সন্ধ্যা’ (১৯০৪) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম দুইখানি শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়ের উপর চলতি ভাষায় লিখিত ও গালগল্প-শ্লেষসমন্বিত সন্ধ্যা সর্বসাধারণের, বিশেষতঃ অর্ধশিক্ষিত নিম্নশ্রেণীর উপর খুবই প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।

ধর্মসম্বন্ধীয় কয়েকখানি পত্রিকা সম্বন্ধে পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। ১৮৯৯ সনে প্রকাশিত রামকৃষ্ণ মিশনের মুখপত্র উদ্বোধন’ এই শ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য। ইহা প্রথমে পাক্ষিক ছিল, দশ বৎসর পরে মাসিকে পরিণত হয়। স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও সারদানন্দ এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতির অনেক রচনা ইহাতে প্রকাশিত হইয়াছে। এই মাসিক পত্রিকাখানি এখনও সগৌরবে সুপ্রতিষ্ঠিত। পূর্বের ন্যায় ধর্ম, দর্শন, প্রভৃতি বিষয়ে এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ এবং তাঁহাদের শিষ্য ও অনুবর্তীদের মতবাদ, কাহিনী ও উক্তি অবলম্বনে বহু মূল্যবান রচনা ছাড়াও জগদ্ব্যাপী রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন কেন্দ্রের বিবরণ ইহাতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

বাংলা-সাহিত্যের নানাবিধ বিভাগের আলোচনা ও উন্নতির জন্য ১৮৯৩ সনে “The Bengal Academy of Literature” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইহার মুখপত্র ছিল মাসিক “The Bengal Academy of Literature”। ১৮৯৪ সনে এই প্রতিষ্ঠান ও মুখপত্র যথাক্রমে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’ নামে পরিবর্তিত হইল। এই ত্রৈমাসিক পত্রিকা এখনও প্রচলিত আছে এবং বাংলা সাহিত্যের অশেষবিধ উন্নতি সাধন করিতেছে।

আলোচ্য যুগে একখানি মাত্র ঐতিহাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হইয়াছিল– ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্র সম্পাদিত ‘ঐতিহাসিক চিত্র। ইহাতে অনেক সারবান ঐতিহাসিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, কিন্তু ইহা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই।

উনিশ শতকের শেষভাগে সাপ্তাহিক পত্রিকাই জনপ্রিয় ছিল। কারণ, লোকে টাটকা সংবাদ অপেক্ষা মন্তব্য ও আলোচনাই বেশি পছন্দ করিত। তবে দৈনিক পত্রিকাও ছিল। ১৮৯০ সনে ইহার সংখ্যা ছিল পাঁচ। ইহাদের মধ্যে ‘দৈনিক’ নামক পত্রিকাই সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল।

এই সময়ে পাঁচখানি পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন মুসলমান। ইহার মধ্যে ১৮৯০ সনে সাপ্তাহিক ‘সুধাকরে’র গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। ইহার সম্পাদক ছিলেন রেয়াজউদ্দিন আহমদ। বঙ্গবাসীর হিন্দু-গোঁড়ামির ন্যায় মুসলমান-গোঁড়ামিই ইহার বৈশিষ্ট্য ছিল। সুতরাং ইহাতে হিন্দুবিরোধী মনোভাবই প্রায় দেখা যাইত।

১৮৮৬ সনে ময়মনসিংহ জিলার টাঙ্গাইল হইতে ‘আহমদি’ নামক পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইহার সম্পাদক ছিলেন মৌলবি আব্দুল হামিদ খান ইউসুফজাৎ। এই পত্রিকার কোন সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি ছিল না বরং হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রীতস্থাপন করাই ছিল ইহার উদ্দেশ্য।

অপর তিনখানি মুসলমান পত্রিকার নাম ‘গওহর’, ‘দার-উস্-সলতৎ’ ও ‘Urdu Guide’।

বাংলাভাষায় পত্রিকার সংখ্যা মোটের উপর ক্রমশই বাড়িতেছিল। ১৮৮০ হইতে ১৮৯২-এই ১৩ বৎসরে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৭, ৩৮, ৫৬, ৬৩, ৬৪, ৬৩, ৬২, ৬৩, ৬৭, ৭১, ৬২, ৭১, ৭৪। ১৮৮০ সনে সমস্ত দেশীয় সংবাদপত্রের গ্রাহকসংখ্যা সমগ্র ইংরেজশাসিত ভারতে ছিল ৬৫,১৭৯। ১৮৯০ সনে কেবল বাংলা দেশে এই সংখ্যা ৬৬,০০০ ছাড়াইয়া গিয়াছিল। স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সাধারণতঃ বিশেষ করিয়া মফঃস্বলে, প্রতিটি সংবাদপত্র বহু শ্রোতার সম্মুখে পড়া হইত। অনেক সময় গ্রামে একখানি মাত্র কাগজ যাইত, সারা গ্রামের লোক তাহা পড়িত ও শুনিত। জনমতের উপর যে ইহার খুব বেশী প্রভাব ছিল, অনেক ইংরেজ কর্মচারীরাও তাহা স্বীকার করিয়াছেন।

প্রধানতঃ সুকুমার সাহিত্যের আলোচনা ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য বাংলায় কয়েকখানি মাসিক-পত্র বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ইহাদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ (১৮৭২) কেবল সর্বপ্রথম নহে, সর্বশ্রেষ্ঠ ও এই জাতীয় পত্রিকার পথপ্রদর্শক ও আদর্শ বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হইবে না। বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত কয়েকখানি উপন্যাস, জাতীয়তার উদ্দীপক প্রবন্ধগুলি, বিবিধ জ্ঞানভাণ্ডার হইতে আহৃত রচনাবলী ও অমর রম্যরচনা ‘কমলাকান্তের দপ্তর ইহাতেই প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনেই সর্বপ্রথম গ্রন্থসমালোচনার সম্পূর্ণ অভিনব এক উচ্চ আদর্শ স্থাপন করেন। সে-যুগের বহু জ্ঞানী ও চিন্তাশীল লেখকের উৎকৃষ্ট রচনা বঙ্গদর্শনকে অলঙ্কৃত করিত। ইহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া অনাবশ্যক। প্রধানতঃ ধর্মসম্বন্ধীয় আধুনিক যুগের উপযোগী প্রচার’ নামে একখানি মাসিক-পত্রও বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় চারি বৎসর প্রকাশিত হইয়াছিল।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-বাড়ী হইতে ‘ভারতী’ ও ‘সাধনা’ এই দুইখানি প্রসিদ্ধ মাসিক-পত্র প্রকাশিত হয়। ১৮৭৭ সনে প্রথম-প্রকাশিত ‘ভারতীর’ সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে ইহার সম্পাদিকা হন তাঁহার ভগ্নী স্বর্ণকুমারী ও স্বর্ণকুমারীর দুই কন্যা সরলা ও হিরন্ময়ী দেবী। রবীন্দ্রনাথও কিছুদিন ইহার সম্পাদক ছিলেন।

১৮৯১ সনে প্রকাশিত ‘সাধনা’র সম্পাদক ছিলেন প্রথমে সুধীন্দ্রনাথ ও পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শন’ও খুব প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল ইহার সম্পাদক ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ-সম্পাদিত ‘আর্যদর্শন’, কালীপ্রসন্ন ঘোষ-সম্পাদিত ঢাকা হইতে প্রকাশিত বান্ধব’ (১৮৭৪), দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সম্পাদিত নব্যভারত’ (১৮৮৩), সুরেশচন্দ্র সমাজপতি-সম্পাদিত সাহিত্য (১৮৯০) ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত ‘মুকুল’ (১৮৯৭) বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। নব্যভারত’ ৪০ বৎসরেরও অধিককাল প্রচলিত ছিল। সাহিত্য বহুকাল উচ্চাঙ্গের সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকারূপে প্রসিদ্ধ ছিল। কঠোর সমালোচনা ইহার একটি বৈশিষ্ট্য বলিয়া পরিগণিত হইত। অনেক খ্যাতনামা লেখকের বিরুদ্ধ সমালোচনা ইহাতে স্থান পাইত।

উপরোক্ত মাসিক-পত্রগুলিতে বহু খ্যাতনামা লেখকের উপন্যাস ও ছোটগল্প এবং সাহিত্য, সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি সম্বন্ধে সুচিন্তিত ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হইত। বস্তুতঃ বাংলা-সাহিত্যের ইতিহাসে এই সকল মাসিক-পত্র এখনও একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে।

বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষসাধন ব্যতীত বাংলার সংবাদপত্র ও সাময়িক-পত্রগুলি উনিশ শতকে বাংলা দেশে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ (Renaissance) বিশেষতঃ সামাজিক সংস্কার ও রাজনীতিক চেতনার উদ্বোধনে, এবং বিশ্বের নবযুগের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয় স্থাপনে যে বিশেষ কার্যকরী হইয়াছিল ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। বিধবা-বিবাহ প্রচলন, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, বহুবিবাহ নিবারণ, ধর্মের নামে প্রচলিত বহু সামাজিক কুসংস্কার উচ্ছেদ, এবং সমসাময়িক বিশেষ বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে জনমত গঠনে বাংলা সংবাদপত্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। সংবাদপত্রের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ, ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে সাহেবদের আন্দোলন, সুরেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে মামলা ও তাহার কারাদণ্ড (১৮৮৩), ভারতের জাতীয় কনফারেন্স ও কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা (১৮৮৫), সহবাস-সম্মতি আইন (১৮৯১), ১৮৯২ সনের ‘Indian Councils Act’, ১৮৯৬ সনে প্লেগ মহামারী, ১৮৯৭ সনে তিলকের কারাদণ্ড ও দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি ঘটনা উপলক্ষে বাংলার সংবাদপত্রে সুচিন্তিত ও সুদীর্ঘ সমালোচনা মুদ্রিত হয়। বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙ্গালী পরিচালিত ইংরেজী পত্রিকা জাতীয় ভাবের প্রসারে খুব সাহায্য করিয়াছে। অধিকাংশ ইংরেজ-সম্পাদিত পত্রিকা ছিল ইহার বিরোধী। সহবাস-সম্মতি আইনের আন্দোলনে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ও ‘বঙ্গবাসী’ ছিল ইহার ঘোরতর বিরোধী এবং ‘Indian Mirror ও সঞ্জীবনী’ ছিল ইহার প্রবল সমর্থক।

ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে দেশীয় রাজন্যবর্গের পক্ষ সমর্থনের জন্য অমৃতবাজার পত্রিকা বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ভূপাল রাজ্যের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবহারের তীব্র সমালোচনা করায় গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট Sir Lepel Griffin এই পত্রিকার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করার প্রস্তাব করেন, কিন্তু লর্ড ডাফরিণ ইহা অনুমোদন করেন নাই। এইরূপ আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

৪. সংবাদপত্র-বিষয়ক আইন (১৮৫৮-১৯০৫)

১৮৫৮ সনের পরে দেশে যে নূতন জাতীয়তা ভাবের স্রোত বহিতে থাকে সংবাদপত্রে তাহা প্রতিফলিত হয় বলিয়াই তাহার অনুপ্রেরণা বৃদ্ধি পায়। বিশেষতঃ দেশীয় ভাষায় লিখিত সংবাদপত্রগুলি এই ভাবধারা জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের প্রধান বাহক ও ধারক হইয়া ওঠে। সুতরাং ইংরেজ গভর্নমেন্ট ভীত হইয়া ইহার দমনে কৃতসংকল্প হন। ১৮৭০ সনে বিদ্রোহমূলক লেখা বন্ধ করিবার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনে নূতন এক ধারা (Section 124A) যোগ করা হয়। কিন্তু বাংলার ছোটলাট সার জর্জ ক্যাম্বেল ইহা পর্যাপ্ত মনে না করিয়া ১৮৭৩ সনে ‘হালিসহর পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি মন্তব্যের প্রতি বড়লাট লর্ড নর্থব্রুকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বাংলা পত্রিকায় ক্যাম্বেলের বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য করা হইত। তাঁহার শিক্ষানীতির নিন্দা করিয়া অমৃতবাজার পত্রিকা তাঁহাকে সংহারের দেবতা ‘মহেশ্বর’ এবং শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরকে ‘বুড়া বৃষ’ বলিয়া উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছেন, এই বুড়া বৃষের উপর চড়িয়া শিব বাংলা দেশের শিক্ষা ধ্বংস করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ক্যাম্বেলের বিশ্বাস ছিল যে, বিদ্রোহমূলক লেখার বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ মামলা করিলে ইহার প্রচার বৃদ্ধি হয়, সুতরাং সংক্ষেপে সরাসরি বিচার করিয়া লেখকদের শাস্তি দিবার ব্যবস্থা করাই সঙ্গত। নর্থব্রুক এই প্রস্তাবে সম্মত হন। নাই। ১৮৭৫ সনে বরোদার মহারাজা যখন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট (Resident) কর্ণেল ফেয়ারকে (Phayre) বিষপ্রয়োগে হত্যা করার অপরাধে অভিযুক্ত হন, তখন অমৃতবাজার পত্রিকায় ইহার বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্যসহ দুইটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইহার একটির শেষাংশ এইরূপ : “ইংরেজরাজ নির্বিঘ্নে রাজত্ব করিবার জন্য একটি সমগ্র জাতিকে পৌরুষত্বহীন করিয়া রাখিয়াছেন (emasculate)। একজন কর্ণেলকে বিষ দান করা ইহার অপেক্ষা অনেক লঘুতর অপরাধ।”

বিলাতী সংবাদপত্রে (Pall Mall Gazette) এই দুইটি প্রবন্ধ উদ্ধৃত হয় এবং সেক্রেটারি অব ষ্টেট ও ভারতের বড়লাট, উভয়েই সংবাদপত্রের এইরূপ উক্তি কিরূপে বন্ধ করা যায় তাহার আলোচনা করেন। কিন্তু বড়লাট নর্থব্রুক (১৮৭২ ৭৬) কোন নির্দিষ্ট পন্থা নির্ধারণ করার পূর্বেই পদত্যাগ করেন। তবে তাঁহার আমলে (১৮৭৫) এই মর্মে একটি সরকারী ইস্তাহার জারী হয় যে, সরকারের অনুমতি ব্যতীত কোন সরকারী কর্মচারী কোন সংবাদপত্রের সম্পাদক বা স্বত্বাধিকারী হইতে পারিবে না; তাহারা সংবাদপত্রে লিখিতে পারিবে, কিন্তু তাহাদের মতামত যেন যুক্তিসঙ্গত আলোচনার সীমা অতিক্রম না করে। উপরন্তু পদানুরোধে বা সরকারী কার্যব্যপদেশে যেসব কাগজ বা দলিলপত্র তাহাদের হস্ত গত হইবে সরকারের অনুমতি ব্যতীত তাহারা তাহা প্রকাশ করিতে পারিবে না। পরবর্তী বড়লাট লর্ড লিটন (১৮৭৬-৮০) কঠোর দমননীতি অবলম্বন করেন। বাংলার ছোটলাট অ্যালি ইডেন প্রকাশ্য এক বক্তৃতায় বাংলা সংবাদপত্রে বিদ্রোহসূচক লেখার বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করেন এবং ভারত সরকারকে এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে অনুরোধ করেন। তাঁহার উক্তির সমর্থনে ১৮৭৬-৭৭ সনে অমৃতবাজার পত্রিকা, ভারত মিহির, সাধারণী, সমাজদর্পণ, সোমপ্রকাশ প্রভৃতি পত্রিকাতে প্রকাশিত প্রবন্ধের আপত্তিজনক অংশগুলি অনুবাদ করিয়া পাঠান। লর্ড লিটন বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নমেন্টকে এই বিষয়ে লিখিলেন এবং মাদ্রাজ ব্যতীত অন্যান্য সকল গভর্নমেন্টই ইডেনের সঙ্গে একমত হইলে নূতন এক আইন প্রস্তাব করিলেন। ইহাই ১৮৭৮ সনের কুখ্যাত Vernacular Press Act। ১৪ই মার্চ কাউন্সিলের এক অধিবেশনেই ইহা পাশ হইল। ইহাতে কোন মামলা-মোকদ্দমা না করিয়া গভর্নমেন্ট বিদ্রোহাত্মক লেখার জন্য দেশীয় ভাষায় লিখিত পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক প্রভৃতিকে শাস্তি দিবার সরাসরি ক্ষমতা পাইলেন। ক্যাম্বেলের প্রস্তাব কার্যে পরিণত হইল।

বাংলা পত্রিকায়, বিশেষতঃ ‘অমৃতবাজারে’, যে-সকল জাতীয় উদ্দীপনামূলক মন্তব্য প্রকাশিত হইত তাহাতে ভয় পাইয়াই যে গভর্নমেন্ট এই আইন করিতে তৎপর হইয়াছিলেন তাহাতে বিশেষ কোন সন্দেহ নাই। এই প্রসঙ্গে মতিলাল ঘোষ লিখিয়াছেন: “এই সময় শিশিরকুমার খুবই গরীব ছিলেন, কলিকাতাতেও তাঁহার বিশেষ কোন প্রতিপত্তি ছিল না। তাঁহাকে হাতে রাখিবার জন্য ছোটলাট নিজে তাঁহাকে ডাকিয়া নিয়া অর্থের লোভ দেখাইলেন। বহু লোক এই লোভ সম্বরণ করিতে পারিত না। কিন্তু শিশিরকুমার ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি ধীরভাবে বলিলেন, দেশে অন্ততঃ একজন সৎ সাংবাদিক থাকা উচিত। ছোটলাট অ্যালি ইডেন ইহাতে বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, আপনি বোধহয় ভুলিয়া গিয়াছেন কাহার সঙ্গে কথা বলিতেছেন। আমি যে-কোন দিন ইচ্ছা বিদ্রোহাত্মক লেখার জন্য আপনাকে জেলে পাঠাইতে পারি এবং ছয় মাসের মধ্যেই আপনাকে জিনিষপত্রসহ যশোহরে ফেরৎ পাঠাইয়া দিব। শিশিরকুমারের দাম্ভিক উক্তির প্রতিশোধ লইবার জন্যই ইডেন বড়লাটকে অনুরোধ করায় একদিনেই ভারতীয় মুদ্রাযন্ত্র আইন পাশ হইল (১৮৭৮)।”২৭

কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই নূতন আইন করা হইয়াছিল তাহা সিদ্ধ হয় নাই। বড় বড় সরকারী কর্মচারীরা এবং অন্যান্য ইংরেজও স্বীকার করিয়াছেন যে বাংলা পত্রিকার সুর কিছু নরম হইলেও গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ভাব বিশেষ হ্রাস পায় নাই। খোলাখুলি বিদ্রোহ প্রচার বন্ধ হইয়াছে–কিন্তু রাজভক্তি কিছুমাত্র বাড়ে নাই। বাংলা পত্রিকার মনোভাব পূর্ববই আছে।

যেসব বিদ্রোহাত্মক রচনার ভিত্তিতে এই নূতন আইনের ব্যবস্থা হইল এবং যাহার নমুনা সকল প্রাদেশিক গভর্নমেন্টকে পাঠান হইয়াছিল তাহার সবগুলিই বাংলা পত্রিকা হইতে গৃহীত। এই সময় বাংলা সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল ৩৫, ইহার মধ্যে ১৫টি হইতে ৩৬টি দৃষ্টান্ত নির্বাচিত করা হয়। এই আইনের বলে বাংলার ছোটলাট ‘ভারত মিহির’, ‘ঢাকা প্রকাশ’, ‘ঢাকা হিতৈষিণী’, ‘সুলভ সমাচার’ এবং সহচর’ পত্রিকার উপর মুচলিকা (Bond) দিবার আদেশ জারী করেন, কিন্তু ভারত-সরকারের নির্দেশ অনুসারে ইহা প্রত্যাহার করেন। কেবলমাত্র ‘সোমপ্রকাশের নিকট এইরূপ দাবি ভারত-সরকার সমর্থন করেন, ইহা পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

এই নূতন আইনের বিরুদ্ধে কলিকাতায় এবং সমগ্র ভারতে কিরূপ তীব্র আন্দোলন হইয়াছিল এবং ইহা-যে জাতীয় মুক্তিআন্দোলনের সূচনা করিয়াছিল তাহা অন্যত্র বিবৃত করা হইয়াছে। এই সময় বিলাতে মন্ত্রীসভার পরিবর্তনের ফলে লর্ড লিটনের স্থানে লর্ড রিপণ বড়লাট হইয়া আসিলে ১৮৮২ সনে এই আইন রদ করা হয়।

১৮৮৯ সনে কাশ্মীরের রাজাকে পদচ্যুত করার প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকা ভারত-সরকারের একটি গোপনীয় রিপোর্ট (Foreign Office Document) প্রকাশ করিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করে যে, ঐ রাজার বিরুদ্ধে প্রজার প্রতি অত্যাচার। প্রভৃতি তাঁহার পদচ্যুতির অজুহাত মাত্র, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পার্বত্য গিলগিট অঞ্চলে ইংরেজের প্রভুত্ব স্থাপন করার উদ্দেশ্যই ইহার প্রকৃত কারণ। বড়লাট ইহার বিরুদ্ধে তীব্র মন্তব্য করিলেও পত্রিকার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনিলেন না, কিন্তু ১৮৮৯ সনে একটি নূতন আইন প্রণয়ন করিলেন (Official Secrets Act)। ইহাতে কোন গোপনীয় সরকারী তথ্য বা দলিল প্রকাশ করা দণ্ডনীয় বলিয়া ঘোষিত হইল। বাংলার ছোটলাট সার চার্লস এলিয়ট (১৮৯০-৯৫) এই আইনের বলে তাঁহার দপ্তরের সমস্ত নথিপত্র ক্রিয়াকলাপই গোপনীয় তথ্য বা দলিল বলিয়া ধরিয়া লইলেন এবং তদনুযায়ী ‘Reis and Rayyet’ ও ‘ Indian Mirror পত্রিকার দুই সম্পাদককে এই আইনভঙ্গের জন্য সাবধান করিয়া দিলেন।

অন্যান্য আইনের সাহায্যেও সংবাদপত্রের শাস্তি বিধান করা হইল। চন্দননগর হইতে প্রকাশিত প্রজাবন্ধু’ নামে বাংলা পত্রিকায় ১৮৮৯ সনে অশ্লীল ও বিদ্রোহাত্মক প্রবন্ধ রচনার জন্য ১৮৭৮ সনের Sea Customs Act-এর ১৯ ধারা এবং ১৮৬৬ সনের Indian Post Office Act-এর ৬০-এ ধারা অনুসারে ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে এই পত্রিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হইল এবং ইহার স্বত্বাধিকারী ও পরিচালক শিক্ষা-বিভাগের জনৈক কেরানীবাবু তিনকড়ি ব্যানার্জীকে বরখাস্ত করা হইল।

অতঃপর সাধারণ ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারেই সংবাদপত্রের বিদ্রোহাত্মক উক্তির বিচার করা হয়। ইহার প্রথম দৃষ্টান্তস্বরূপ বঙ্গবাসী পত্রিকার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ১৮৯১ সনে বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২৪-এ এবং ৫০০ ধারা অনুসারে অভিযোগ আনা হয়। ২০শে মার্চ, ১৬ই মে এবং ৬ই জুন তারিখে প্রকাশিত যে তিনটি আপত্তিজনক প্রবন্ধের জন্য এই অভিযোগ করা হয় তাহার কয়েকটি অংশের সারমর্ম এই :– “আমরা সম্পূর্ণরূপে ইংরেজের অধীন। ইংরেজরাজ ইচ্ছা করিলে আমাদের সম্পত্তি কাড়িয়া নিতে পারে, আমাদের পরিবারবর্গকে নানারূপ কষ্ট ও লাঞ্ছনা করিতে পারে, এবং আমাদের ধর্ম ও সামাজিক আচার ব্যবহার পালন করিতে বাধা দিতে পারে। ইংরেজ বড়লাট ল্যান্সডাউন সাহেব বাহাদুর বিধানসভায় জোরগলায়, স্পষ্ট ভাষায় এবং বুক টান করিয়া ইহা ঘোষণা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে ইংরেজ যাহা ভাল মনে করে হিন্দুদের তাহাই করিতে হইবে, এবং ইংরেজ যাহা মন্দ মনে করে তাহা বর্জন করিতে হইবে। ইহার জন্য যদি তোমার ধর্ম নষ্ট হয় তাহাতেও ক্ষতি নাই। যদি তাই হয় তবে হে প্রভু একেবারে সরাসরি আমাদের ধর্ম, সমাজ সকলই নষ্ট করিয়া ফেল। যদি হিন্দুদের ধ্বংস করাই তোমার সংকল্প তবে বল আমরা তোমার পায়ে আজীবনের জন্য দাসখত লিখিয়া দেই।”২৮

‘সহবাস সম্মতি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সমর্থনেই এই সকল প্রবন্ধ লিখিত হয়। এই আইন প্রসঙ্গে লেখা হইয়াছে : “এই আইন পাশ করায় ইংরেজ সাধুতার মুখোস খুলিয়া ভয়ঙ্কর মূর্তিতে প্রকট হইয়াছে। সীতা যেমন সাধুবেশী রাবণের স্বরূপ দেখিয়া ভীত হইয়াছিল আজ আমাদের অবস্থাও সেইরূপ–হে মধুসূদন–এই কি আমাদের ইংরেজ রাজ! ইংরেজের কামান হিন্দুদিগের বহু অনিষ্ট করিতে পারে কিন্তু হিন্দুধর্মকে ধ্বংস করিতে পারিবে না।”২৯।

‘বঙ্গবাসী’র বিরুদ্ধে মোকদ্দমার ফলে সমগ্র দেশে খুব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বড় বড় উকীল ব্যারিষ্টার আইনের কূটতর্ক করেন। বিচারের ফলে জুরীদের অধিকাংশের মতে অভিযুক্ত স্বত্বাধিকারী, সম্পাদক, পরিচালক, মুদ্রাকর সকলেই দোষী সাব্যস্ত হন। কিন্তু জুরীগণ একমত না হওয়ায় চীফ জাষ্টিস্ আপাততঃ চূড়ান্ত আদেশ স্থগিত রাখেন। ইতিমধ্যে নেটিভ প্রেস অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি বঙ্গবাসী’র সপক্ষে ছোটলাটের নিকট আবেদন করে। অভিযুক্ত ব্যক্তিগণও পুনরায় এইরূপ রাজদ্রোহাত্মক কিছু লিখিবেন না এইরূপ প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় সরকার এই মামলা তুলিয়া লন।৩০

‘বঙ্গবাসী’র বিরুদ্ধে সরকারী মোকদ্দমার ফলেই দেশীয় সংবাদপত্রের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সর্ববিধ ন্যায়সঙ্গত উপায়ে ইহার উন্নতিসাধন, উপরন্তু যাহাতে ইহা লোকমতের ধারক ও বাহকরূপে সর্বপ্রকার অতিভাষণ পরিহার করিয়া গর্ভনমেন্ট ও জনসাধারণের মতামত উভয়ের নিকট সুষ্ঠুভাবে উপস্থিত করিতে পারে এই উদ্দেশ্যে নেটিভ প্রেস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক ও ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারী রাজকুমার সর্বাধিকারী নেটিভ প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি হন। Indian Mirror, Indian Nation’ এবং ‘Reis and Rayyet’–এই তিনটি পত্রিকা ছাড়া বাংলা দেশের আর সকল ইংরেজী ও বাংলা পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী ইহাতে যোগদান করেন।

পাদটীকা

১. বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাস ও বিস্তৃত বিরণের জন্য ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাংলা সাময়িকপত্র গ্রন্থ দ্রষ্টব্য (অতঃপর এই গ্রন্থকে সাময়িকপত্র’ বলিয়া উল্লেখ করা হইবে)।

২. Calcutta Review (December, 1969, pp. 213-16) পত্রিকায় এই প্রসঙ্গটি বিস্ত তভাবে আলোচিত হইয়াছে। আমার এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখিলাম যে ১৩৪৭ সালে প্রবাসী পত্রিকায় (ফাল্গুন সংখ্যা, পৃ. ৬৫৪) এই প্রসঙ্গটি আলোচিত হইয়াছে।

৩. সতীদাহ প্রথার নিবারণের বিরুদ্ধে ইংলণ্ডে আপীল করা ও সাধারণভাবে সনাতন হিন্দু ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রাচীনপন্থী হিন্দুরা মিলিয়া ১৮৩০ সনের ১৭ই জানুয়ারি ‘ধর্মসভা’র প্রতিষ্ঠা করেন। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই সভার সম্পাদক ছিলেন।

৪. ‘সাময়িকপত্র’, ৩১-৩২ পৃ.

৫. ‘সংবাদ অরুণোদয়’ নামে একখানি দৈনিক পত্র ১৮৩৯ সনের শেষাশেষি জগন্নারায়ণ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ইহা কয়েক মাস পরেই বন্ধ হইয়া যায়। ইহাতে ১৮৩৯ সন পর্যন্ত জীবিত ও মৃত বাংলা সাময়িকপত্রের একটি তালিকা প্রকাশিত হয় (সাময়িকপত্র, ১০২-৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

৬. সাময়িকপত্র’ ৫০ পৃ.

৭. ঐ, ৭৬ পৃ.

৮. ঐ, ১৭২ পৃ.

৯. ঐ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ৩৩ পৃ.

১০. সাময়িকপত্র’, ১৯২ পৃ.

১১. জীবন স্মৃতি’ (১৩৪০) ১১৯ পৃ.

১২. ‘সাময়িকপত্র’, ২৮৩ পৃ.

১৩. সাময়িকপত্র ২২৩-২৫ পৃ.

১৪. এই বিবরণ প্রধানতঃ সাময়িকপত্র’ অবলম্বনে লিখিত

১৫. Margarita Barns, প্রণীত Indian Press, ২৭২ পৃ.

১৬. সাময়িকপত্র’ ৩৯ পৃ.।

১৭. S.D. Collet. The Life and Letters of Raja Rammohun Roy (Ed. by D.K. Biswas, p. 177)

১৮. O’Malley, L S.S. (Ed), Modern India and the West, pp. 198-99.

১৯. ঐ, ১৯৮ পৃ.

২০. ‘সাময়িকপত্র’, ২৬৮-৬৯ পৃ.

২১. ঐ, ২৯৭ পৃ.

২২. ঐ, ২৯৬ পৃ.

২৩. যোগেশচন্দ্র বাগল-ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ২০ পৃ.

২৪. ঐ, ৯ পৃ.

২৫. ঐ, ১২ পৃ.

২৬. ঐ, ১৮ পৃ..

২৭. Paramananda Datta, Memoirs of Motilal Gose, p. 48

২৮. C.E. Buckland, Bengal under the Lieutenant Governors, p. 917.

২৯. ঐ, ৯১৯ পৃ.।

৩০. জাতীয়তার বিকাশে বঙ্গবাসী’ পত্রিকার অবদান ও ইহার বিরুদ্ধে মামলার বিবরণ “National Awakening and the Bangabasi” by Shyamananda Banerjee (Culcutta, 1968) গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *