ষষ্ঠ অধ্যায় – ধর্ম
উপক্রমণিকা
একশত বৎসর পূর্বে (১২৭৭ সনে) শ্রীঅক্ষয়কুমার দত্ত তাঁহার সময়কার ধর্মসম্প্রদায়ের যে বিবরণ দিয়াছেন তাহাতে দেখা যায় যে, যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব, সৌর ও গাণপত্য–এই পাঁচটি ধর্মসম্প্রদায় প্রধান বলিয়া পরিগণিত হইত তথাপি ইহার প্রতিটির মধ্যেই দুই দল ছিল। এক দলে ছিলেন “ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও তদীয় মতানুগত গৃহী ব্যক্তিরা।” হঁহারা “বৈদিক ও তান্ত্রিক উভয়বিধ ক্রিয়ারই অনুষ্ঠান করিতেন।” অপর দল বিষ্ণু, শক্তি, শিব, সূর্য ও গণেশকে ইষ্টদেবতাস্বরূপ গ্রহণ করিয়া তাহাদের আরাধনা করিতেন, কিন্তু “বেদের শাসন ও ব্রাহ্মণ-বর্ণের আধিপত্য অস্বীকার করিতেন।” তাঁহারা “স্ব সম্প্রদায় মধ্যে বর্ণবিচার পরিত্যাগ করেন, সকল বর্ণ হইতেই গুরু ও শিষ্য গ্রহণ করেন এবং দেশভাষায় লিখিত সমধিক গ্রন্থের অনুবর্তী হইয়া চলেন।” “এই বৈশিষ্ট্য অন্যান্য সম্প্রদায় অপেক্ষা বৈষ্ণবদিগের মধ্যেই অধিক দেখিতে পাওয়া যায়। ইঁহাদের মধ্যে রামানুজ, বিষ্ণুস্বামী, মধ্বাচার্য এবং নিম্বাদিত্য প্রবর্তিত চারিটি সম্প্রদায়ই প্রধান। কিন্তু বাংলা দেশে চৈতন্য সম্প্রদায়ই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। ইহা গৌড়-বৈষ্ণব বলিয়া অভিহিত হয়।”
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনেক শাখা আছে। তাহা এই অধ্যায়ের শেষে বর্ণিত হইবে। তৎপূর্বে উনিশ শতকে যে সমুদয় নূতন ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত হইয়া বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে তাহাদের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হইল।
১. ব্রাহ্মধর্ম
(ক) রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালীর জীবনে ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য ও রাজনীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সমুদয় গুরুতর পরিবর্তন হয়, তাহাদের সকলের মূলে না থাকিলেও প্রায় সবগুলির সহিতই রামমোহন রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। তাঁহাকে এই নবযুগ বা নবজাগরণের (Renaissance) সৃষ্টিকর্তা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি করা হয় না। সুতরাং এই মহাপুরুষের জীবনী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।
হুগলী জেলার অন্তঃপাতী রাধানগর গ্রামে রামমোহনের জন্ম হয়। তাঁহার পিতা রামকান্ত রায় একজন অবস্থাপন্ন ভূম্যধিকারী ছিলেন। তাঁহার জন্মতারিখ সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কেহ বলেন ১৭৭২, আবার কাহারও মতে ১৭৭৪।১ রামমোহনের বাল্যকাল সম্বন্ধে সঠিক বিবরণ বিশেষ কিছু জানা যায় না। কথিত আছে যে, তিনি বাড়ীতে ফার্সী, পাটনায় আরবী এবং কাশীতে সংস্কৃত শিক্ষা করেন। ইহা কতদূর সত্য বলা যায় না, তবে তিনি যে এই তিনটি ভাষাই ভাল জানিতেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। রামমোহন সম্বন্ধে আরও দুইটি কাহিনী প্রচলিত আছে : (১) ষোল বৎসর বয়সে তিনি হিন্দুদের প্রতিমাপূজার বিরুদ্ধে একখানি গ্রন্থ লেখায় তাঁহার পিতার সহিত মনোমালিন্য হয় এবং তিনি পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া চারি বৎসর দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করার পরে পিতার সহিত তাহার পুনর্মিলন হয়। (২) হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে পিতার সহিত নানা আলোচনাসত্ত্বেও তিনি সন্তোষজনক উত্তর না-পাওয়ায় ১৫ বৎসর বয়সে পিতৃগৃহ ত্যাগ করেন এবং ভিন্ন কোন ধর্মের সহিত পরিচিত হইবার জন্য তিব্বতে গমন করেন।
রামমোহনের জীবনী সম্বন্ধে এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনীর সামঞ্জস্য করা কঠিন। প্রথমটিতে তাঁহার পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে গ্রন্থ লেখা ও পিতার সহিত মনোমালিন্যের কথা আছে, কিন্তু তিব্বত যাওয়ার কথা নাই। দ্বিতীয়টিতে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কোন গ্রন্থ লেখার কথা নাই এবং সম্পূর্ণ ভিন্নকারণে পিতৃগৃহ ত্যাগের কথা আছে। অপর পক্ষে তিব্বত-ভ্রমণের কথা আছে।
প্রথম কাহিনী পাওয়া যায় কোন বন্ধুর নিকট লিখিত চিঠিতে রামমোহনের আত্মজীবনের বিবরণীতে। কিন্তু, এই চিঠি তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশিত হয় নাই। দ্বিতীয় কাহিনীটি মেরী কার্পেটার রামমোহনের মুখে দুইবার শুনিয়াছেন–এরূপ লিখিয়াছেন :
পরস্পরবিরোধী হওয়ায় মোটামুটি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হওয়া সত্ত্বেও রামমোহনের তিব্বত-ভ্রমণ এবং ষোল বৎসর বয়সে পৌত্তলিকতার বিরোধী মত প্রচার–ইহার কোনটিই নিঃসংশয়ে সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।
পূর্বোক্ত আত্মজীবনীতে রামমোহন লিখিয়াছেন, তিনি বিশ বৎসর বয়স হইতেই ইউরোপীয়দের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মেশামেশি করিতেন এবং তাহাদের আইন-কানুন ও শাসনপ্রণালী সম্বন্ধে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করেন। রামমোহন কিছুদিন ঢাকা জালালপুরের (বাংলা দেশের অন্তর্গত ফরিদপুর) কালেক্টর উড়ফোর্ড সাহেবের দেওয়ান ছিলেন। মুর্শিদাবাদে অন্য একজন সিবিলিয়ান র্যামজে সাহেবের সহিতও তাঁহার পরিচয় ছিল। অতঃপর ১৮০৫ হইতে ১৮১৪ সন পর্যন্ত রামমোহন মফঃস্বলের নানা স্থানে জন ডিগবীর অধীনে চাকরি করেন এবং তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। কিন্তু ডিগবীর সহিত রামমোহনের কেবলমাত্র মনিব কর্মচারীর সম্বন্ধই ছিল না। রামমোহন ডিগবীর নিকট হইতে গভীরভাবে ইংরেজী শিক্ষা করেন। ডিগবীও রামমোহনকে অতিশয় শ্রদ্ধা করিতেন।”২ ডিগবী নিজেই লিখিয়াছেন যে, “যদিও রামমোহন ২২ বৎসর বয়সে ইংরেজী শিখিতে আরম্ভ করেন, তাহার অধীনে কর্মচারী থাকাকালীন তিনি উত্তমরূপে ইংরেজী বলিতে ও লিখিতে পারিতেন; ইংরেজী সংবাদপত্র পড়িতেন, ইউরোপের রাজনৈতিক ঘটনা জানার তাহার বিশেষ আগ্রহ ছিল এবং তিনি সম্রাট নেপোলিয়ানের একজন ভক্ত ছিলেন।” সুতরাং ডিগবী ছুটি নিয়া বিলাত যাওয়ার পরে ১৮১৪ সনে রামমোহন যখন স্থায়ীভাবে কলিকাতায় বাস করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন তিনি ইংরেজীভাষায় অভিজ্ঞ এবং পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতি ও ভাবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন, ইহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। রামমোহন কলিকাতার একজন সম্ভ্রান্ত গণ্যমান্য ব্যক্তি বলিয়া পরিগণিত হইলেন এবং ইউরোপীয় ভারতভ্রমণকারীর অনেকেই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন। সুতরাং পাশ্চাত্ত্য জগতের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হইয়াছিল। এই প্রসঙ্গে ইহাও উল্লেখ করা আবশ্যক যে, তিনি যখন ডিগবীর অধীনে রংপুরে চাকরী করিতেন তখন তান্ত্রিক যোগী হরিহরানন্দনাথ তীর্থস্বামীর নিকট কয়েক বৎসর হিন্দুশাস্ত্র ও দর্শনের রীতিমত চর্চা করিয়াছিলেন।
এমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নাই যাহাতে বলা যায় যে, পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর বয়সের পূর্বে রামমোহনের ধর্মমতের পরিবর্তন হইয়াছিল। প্রায় ত্রিশ বৎসর বয়সে (১৮০৩-০৪ সন) লিখিত তুহফাৎ-উল মুহাহিদীন নামক আরবী ও ফার্সী ভাষায় লিখিত একখানি গ্রন্থে ইহার প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে তিনি হিন্দুগণের প্রতিমাপূজার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। ভাল করিয়া ইংরেজী শেখার এবং কলিকাতায় আসার পর তিনি সর্বপ্রথম ধর্মসংস্কার আন্দোলন আরম্ভ করেন। এই আন্দোলনের মূলসূত্র ছিল যে, প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে, সুতরাং বহু দেবদেবীতে বিশ্বাস ও তাঁহাদের প্রতিমা পূজা করা প্রকৃত হিন্দুধর্মের বিরোধী। এই উদ্দেশ্যে তিনি বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেন এবং ‘ঈশ’, ‘কেন’, ‘কঠ’ প্রভৃতি উপনিষদ্ প্রকাশ করেন। গ্রন্থরচনা ছাড়া ব্রহ্মসম্বন্ধে আলোচনার জন্য ১৮১৫ সনে তিনি আত্মীয় সভা’ স্থাপন করেন। এই সভায় বেদপাঠ ও ব্যাখ্যা, শাস্ত্র আলোচনা ও ব্রহ্মসঙ্গীত হইত।
রামমোহনের ধর্মমতে আকৃষ্ট হইয়া অনেক শিক্ষিত গণ্যমান্য ব্যক্তি প্রথম প্রথম এই সভায় যোগ দিতেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে রক্ষণশীল হিন্দুসপ্রদায় তাহার বিরোধিতা করিয়া পুস্তক লেখা এবং তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করার ফলে যখন তুমুল দলাদলি আরম্ভ হইল, তখন অনেকেই আর এই সভায় যোগ দিতে সাহস করিতেন না। ১৮২১ সনে রামমোহন ‘ইউনিট্যারিয়ান কমিটি’ নামে আর-একটি সভা স্থাপন করিলেন। “এই সভার ধর্মমত খ্রীষ্টান ধর্মমত হইতে গৃহীত হইয়াছিল ও উহাতে ইউনিট্যারিয়ান খ্রীষ্টান মতেই উপাসনা প্রভৃতি হইত।”৩ কিন্তু এই সভাও বেশী জনপ্রিয় হয় নাই। অবশেষে তিনি আর-একটি নূতন সভা স্থাপন করলেন। ইহার নাম হইল ‘ব্রাহ্ম সমাজ’–কিন্তু সাধারণত লোকে ইহাকে ব্রহ্মসভা বলিত। ১৮২৮ সনের ২০ অগষ্ট তারিখে ইহার প্রথম অধিবেশনে হয়। প্রতি শনিবার সন্ধ্যাকালে এই সভার অধিবেশনে বেদ ও উপনিষদ্ পাঠ, বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা এবং সঙ্গীত হইত। কিছুদিন পরে ইহার জন্য একটি নূতন বাড়ী নির্মাণ করা হইল। ১৮৩০ সনের ২৩ জানুআরি এই নূতন গৃহের উদ্বোধন উপলক্ষে প্রায় পাঁচশত হিন্দু সমবেত হন, তাঁহাদের মধ্যে অনেক ব্রাহ্মণও ছিলেন। বস্তুতঃ রামমোহন কোনদিনই একটি বিশিষ্ট স্বতন্ত্র ধর্মসম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করিবার কল্পনা করেন নাই–হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, ইহুদী সকলেই এই উপাসনায় যোগ দিতেন। রামমোহন তাঁহার লিখিত দলিলেও এইরূপ নির্দেশ দিয়া যান যে, যে-কোন ব্যক্তি শ্রদ্ধার সহিত সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরের উপাসনা করিতে আসিবেন তাঁহারই জন্য জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়, সামাজিক পদ নির্বিশেষে এই মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত থাকিবে। তবে এখানে কোন সাম্প্রদায়িক নামে ভগবানের উপাসনা হইতে পারিবে না, কোনপ্রকার চিত্র বা প্রতিমূর্তি ব্যবহৃত হইবে না, প্রাণিহিংসা হইবে না, পানভোজন হইবে না এবং কোন সম্প্রদায়ের উপাস্যকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হইবে না। যাহাতে পরমেশ্বরের ধ্যানধারণার প্রসার হয় এবং প্রেম, নীতি, ভক্তি, দয়া প্রভৃতি সদ্গুণের বিকাশ হয়, সেই আদর্শের অনুযায়ী উপদেশ, বক্তৃতা, প্রার্থনা ও সঙ্গীত হইবে। এই আদর্শের পরিপন্থী কোন অনুষ্ঠান এই মন্দিরে হইতে পারিবে না।
নূতন মন্দিরের উদ্বোধনের দশমাস পরেই রামমোহন বিলাত যাত্রা করেন। (১৮৩০ সন, ১৯ নভেম্বর) এবং প্রায় তিন বৎসর পর ১৮৩৩ সনের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে বিলাতেই ব্রিষ্টল নগরে তাঁহার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্মণোচিত যজ্ঞোপবীত ধারণ করিতেন।
রামমোহন নূতন ধর্মসম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা না করিলেও প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও সংস্কারের প্রতি কঠোর আঘাত করিয়াছিলেন। পৌত্তলিকতা বর্জন ও একেশ্বরবাদ যে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত তিনি ইহাই প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন এবং যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিমাত্রেরই চিন্তার স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়া সামাজিক অনুশাসন ও প্রচলিত শাস্ত্রবিধি ইহার বিরোধী হইলে তাহা অমান্য করার নির্দেশ দিয়াছিলেন। ইহার প্রতিক্রিয়া হিন্দুসমাজে যেমন, তাহার নবপ্রতিষ্ঠিত সমাজেও তেমনি প্রবল আকারে দেখা দিল। ইহার ফলে একদিকে যেমন হিন্দুধর্মের বিশিষ্ট পরিবর্তন হইল, তেমনি তাহার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ সার্বজনীন উদার ধর্মমতের আদর্শ পরিত্যাগ করিয়া একটি স্বতন্ত্র ধর্মসম্প্রদায়ে পরিণত হইল। অতঃপর কিরূপে ক্রমে ক্রমে এই গুরুতর পরিবর্তন সাধিত হইল তাহার আলোচনা আমরা করিব।
(খ) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) ও আদি ব্রাহ্মসমাজ
রামমোহনের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজ ক্রমেই দুর্বল হইয়া পড়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের অর্থসাহায্যে ইহা কোনমতে টিকিয়া ছিল। সাপ্তাহিক সভায় খুব অল্পই লোক হইত এবং রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ইহার আচার্যের কাজ করিতেন।
দ্বারকানাথের পুত্র ও হিন্দু কলেজের ছাত্র দেবেন্দ্রনাথ এই সমাজকে পুনরায় উজ্জীবিত করেন। রামমোহনের সংস্পর্শেই দেবেন্দ্রনাথের মনে প্রথম ধর্মভাবের উন্মেষ হয়। পরে কয়েকখানি উপনিষদ্ পাঠ করিয়া এই ধর্মভাব বাড়িয়া যায় এবং ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার করিবার জন্য তিনি তত্ত্বরঞ্জিনী ল’ স্থাপন করেন। দ্বিতীয় অধিবেশনে ইহার নূতন নামকরণ হয় তত্ত্ববোধিনী সভা’ (১৮৩৯ খ্রী.)। “সমুদয় (হিন্দু) শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব এবং বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার” ইহার উদ্দেশ্য বলিয়া গৃহীত হয়। এই সভার তৃতীয় বৎসরে (১৮৪২ সনে) দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন এবং এই দুইটি সভা দেবেন্দ্রনাথের পরিচালনাধীনে যুক্ত হয়। তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজ পরিচালনার ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের ভার গ্রহণ করে। এই সময় ব্রাহ্মসমাজের অনেক সভ্য সভায় নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করিলেও নিজ নিজ বাটিতে প্রতিমাপূজা করিতেন, এবং পূর্বের ন্যায় রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ বেদপাঠ করিবার পর তাঁহার সহযোগী ঈশ্বরচন্দ্র ন্যায়রত্ন বেদী হইতে শ্রীরামচন্দ্রের অবতারত্ব সমর্থন করিয়া বক্তৃতা দিতেন। তখন সমাজের কোন বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন ছিল না, যে-কেহ ইচ্ছা করিত আসিত যাইত, কিন্তু তাহাদের মধ্যে কোন ঐক্যের বন্ধন ছিল না। দেবেন্দ্রনাথ স্থির করিলেন যে, অতঃপর যাহারা পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ করিয়া মাত্র এক-ঈশ্বরের উপাসনা করিবেন এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিবেন কেবল তাঁহারাই সমাজের সভ্য বলিয়া গৃহীত হইবেন। এই উদ্দেশ্যে আরও কয়েকটি দৈনিক কৃত্যাদি সংযোগ করিয়া একটি প্রতিজ্ঞাপত্র রচিত হইল এবং ১৮৪৩ সনের ২১ ডিসেম্বর তারিখে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ ২১ জন এবং দুই বৎসরের মধ্যে আরও ৫০০ জন উক্ত প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করিয়া ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইলেন। প্রতিজ্ঞাপত্রে লেখা হইল “প্রতিদিবস শ্রদ্ধা ও প্রীতিপূৰ্ব্বক পরব্রহ্মে আত্মা সমাধান করিব” এবং উপাসনার জন্য উপনিষদ্ হইতে “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম” এবং “আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি” এই দুইটি বাক্য উদ্ধৃত হইল। পরে “শান্তং শিবমদ্বৈতং” এই বাক্যটিও যোগ করা হয়। দেবেন্দ্রনাথ উপাসনার প্রণালী নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন এবং ইহার শেষে একটি প্রার্থনা যোগ করিলেন।
এইরূপে রামমোহনের প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজ একটি স্বতন্ত্র ধর্মসম্প্রদায়ে পরিণত হইল। কিন্তু তখনও ইহা হিন্দুসমাজ হইতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয় নাই। দেবেন্দ্রনাথ পৌত্তলিকতা বর্জন করিলেও প্রথম প্রথম ‘বেদ অপৌরুষেয়’ ইহা বিশ্বাস করিতেন। খ্রীষ্টীয় মিশনারীগণের সঙ্গে বাদানুবাদ প্রসঙ্গে তিনি একটি প্রবন্ধে লিখিলেন, “আমরা একমাত্র বেদকেই হিন্দুসমাজের মূল উৎস বলিয়া মনে করি-স্মৃতি ও অন্য সকল শাস্ত্র যে পরিমাণে বেদের অনুগামী সেই পরিমাণেই গ্রহণীয়। কারণ বেদ শ্রুতি’ অর্থাৎ ঋষিদের মুখে উচ্চারিত ভগবানের বাণী (uttered by inspiration-what we consider as revelation is contained in the Vedas alone), স্মৃতি প্রভৃতি বেদের ভাষ্য মাত্র (only an exposition of their percepts)”।৪
এই প্রবন্ধ ১৮৪৫ সনে প্রকাশিত হয়। ঐ সময়ে বঙ্গদেশে বেদের চর্চা বিশেষ ছিল না। এদেশে যাহাতে বেদের পঠন-পাঠন হয় সেজন্য তিনি ১৭৬৬ শকে আনন্দচন্দ্র ভট্টাচার্য, এবং পর বৎসর আরও তিনজনকে বেদ অধ্যয়ন করিবার জন্য কাশীধামে পাঠান। এই চারিজন যথাক্রমে চারি বেদ অধ্যয়ন করেন। কিন্তু ইহার ফল হইল বিপরীত। বেদের বিষয়বস্তু সম্যক উপলব্ধির ফলে ইহার অপৌরুষেয়ত্ব সম্বন্ধে দেবেন্দ্রনাথের মনে সংশয় উপস্থিত হইল। কাশীধামে প্রেরিত পণ্ডিতগণের মধ্যে একজন ১৮৪৭ এবং আর তিনজন ১৮৪৮ সনে ফিরিয়া আসেন। রাজনারায়ণ বসু তাঁহার ‘আত্মচরিতে’ দেবেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন :
“ইংরাজী ১৮৪৫-৫০ এই তিন বৎসর, বেদ ঈশ্বর প্রত্যাদিষ্ট কিনা, ইহা সৰ্ব্বদা আমাদিগের মধ্যে বিচারিত হইত। আমরা তখন ঈশ্বর প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করিতাম বটে, কিন্তু বেদ কেবল যুক্তিযুক্ত বাক্যপূর্ণ ছিল বলিয়া তাহা ঈশ্বর প্রত্যাদিষ্ট বলিয়া বিশ্বাস করিতাম।”
কিন্তু এ বিশ্বাস শিথিল হইয়া গেল, তবে ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি বা পত্তনভূমি বেদে বা উপনিষদে না পাইয়া তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন যে, “আত্মপ্রত্যয়-সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হৃদয়ই তাহার পত্তনভূমি” এবং তাঁহার “ব্রাহ্ম ধর্ম” গ্রন্থ প্রথম খণ্ডে (১৮৪৯ খ্র.) “বেদ ও উপনিষদ্ হইতেই তিনি আত্মপ্রত্যয়-সিদ্ধ তত্ত্বসমূহ মাত্র সংকলন করিলেন। তিনি লিখিলেন : “ইহা কেহ মনে করিবেন না যে, আমাদের বেদ ও উপনিষদকে আমি একেবারে পরিত্যাগ করিলাম, ইহার সঙ্গে আমাদের আর কোন সংস্রব রহিল না। এই বেদ ও উপনিষদের যে সকল সার সত্য, তাহা লইয়াই ব্রাহ্মধৰ্ম্ম সংগঠিত হইল….আমি সমগ্র বেদ এবং সমস্ত উপনিষদকে ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা করিতে যত্ন পাইয়াছিলাম; কিন্তু তাহা করিতে পারিলাম না, ইহাতেই আমার দুঃখ। কিন্তু এ দুঃখ কোন কার্যের নহে, যেহেতুক সমস্ত খনি কিছু স্বর্ণ হয় না। খনির অসার প্রস্তরখণ্ড সকল চূর্ণ করিয়াই তাহা হইতে স্বর্ণ নির্গত করিয়া লইতে হয়।”৫
এই উক্তিটি বিশেষ মূল্যবান, কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের যে দুইটি মূলকথা–অন্ধবিশ্বাস ও প্রচলিত সংস্কারের উপর যুক্তির প্রাধান্য, এবং শাস্ত্রের বা গুরুর নির্দেশ অপেক্ষা আত্মপ্রত্যয় অধিকতর সিদ্ধ–ইহাতে তাহাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। আর দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসমাজ ভাঙ্গিয়া ক্রমে যে আরও দুইটি অধিকতর প্রগতিশীল সমাজের সৃষ্টি হয় তাহার মূলেও আছে এই দুইটিরই প্রভাব।
দেবেন্দ্রনাথ কর্তৃক দুই খণ্ড গ্রন্থে ব্রাহ্মধর্মের সার সংকলিত হইলে সমাজে নূতন প্রেরণার সঞ্চার হইল। কিন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ও তত্ত্ববোধিনী সভা এই নূতন ধর্মমতের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখাইল না, বরং ইহার বিঘ্নস্বরূপ হইল। বিরক্ত হইয়া দেবেন্দ্রনাথ ঐ সভা তুলিয়া দিলেন এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ব্রাহ্মসমাজের সম্পত্তি হইয়া প্রকাশিত হইল (১৮৫৯ খ্রী.)। দেবেন্দ্রনাথ স্থির করিলেন যে, “ব্রাহ্ম সমাজের সাহায্যের নিমিত্ত আর তত্ত্ববোধিনী সভা রাখিয়া লোকদিগের মতামত লইয়া বিবাদ করিবার প্রয়োজন নাই। এখন যে কাৰ্য্যতৎপর উন্নত ব্রাহ্মগণকে পাওয়া যাইতেছে ইহাদিগকে লইয়া ব্রাহ্ম সমাজের সকল কার্য্য নিৰ্বাহ করিতে পারিবেন। তাহা হইলে ব্রাহ্মদিগের মতামতের জন্য বিবাদের চিন্তা হইতে নিষ্কৃতি লাভ হয়।” কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের এই আশা ফলবতী হয় নাই। কারণ তিনি পূর্বোক্ত যে “কাৰ্য্যতৎপর উন্নত ব্রাহ্মগণের সাহায্যের আশা করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কেশবচন্দ্র সেনই দেবেন্দ্রনাথের সমাজ পরিত্যাগ করিয়া নূতন সমাজ গঠন করিলেন।
(গ) কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪)
১৮৩৮ সনে কলুটোলার সেন পরিবারে কেশবচন্দ্রের জন্ম হয়। তাঁহার পিতামহ রামকমল সেন কলিকাতার একজন প্রসিদ্ধ ধনী ও খ্যাতিমান পুরুষ ছিলেন এবং নানা জনহিতকর প্রগতিশীল কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। কেশব হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং ছাত্রাবস্থাতেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত পরিচিত হন। তত্ত্ববোধিনী সভার সহিত ব্রাহ্মসমাজের সম্বন্ধ ছিন্ন হওয়ার অল্পদিন পূর্বেই কেশবচন্দ্র দেবেন্দ্রনাথের সহিত যোগ দেন এবং শীঘ্রই তাঁহার বিশেষ স্নেহভাজন ও একজন কর্মঠ সহযোগী বলিয়া পরিগণিত হইলেন। অল্পকালের মধ্যেই তত্ত্ববোধিনী সভার পরিবর্তে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজ পরিচালনার জন্য নূতন ‘অধ্যক্ষ সভা গঠন করেন (১৮৫৯, ২৫ ডিসেম্বর)। ইহার সভাপতি হইলেন রামমোহন রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র রামপ্রসাদ রায় এবং যুগ্ম সম্পাদক হইলেন দেবেন্দ্রনাথ এবং কেশবচন্দ্র। কেশবচন্দ্র ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলে চাকুরী করিতেন, তাহা ছাড়িয়া দিয়া সম্পূর্ণরূপে সমাজের কার্যে আত্মনিয়োগ করিলেন (১লা জুলাই, ১৮৬১ খ্রী.)। ইহার পূর্বেই ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল (৮ মে, ১৮৫৯ খ্রী.) এবং এখানে প্রতি সপ্তাহে দেবেন্দ্রনাথ বাংলায় ও কেশবচন্দ্র ইংরেজীতে বক্তৃতা করিতেন। কেশব শীঘ্রই বাগ্মী বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিলেন এবং উভয়ের উদ্দীপনাময় বক্তৃতা ও প্রবন্ধ ক্রমে ক্রমে বহু যুবককে নূতন ধর্মমতে আকৃষ্ট করিল। ইহাদের মধ্যে উমেশচন্দ্র দত্ত, বিজয়কৃষ্ণ গোম্বামী, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, অঘোরনাথ গুপ্ত, পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, গৌরগোবিন্দ উপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল, আনন্দমোহন বসু ও গিরিশচন্দ্র সেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেশবচন্দ্রের উৎসাহ ও চেষ্টায় ধর্মালোচনার জন্য ‘সঙ্গত সভা’ (১৮৬১ খ্রী.) এবং সামাজিক উন্নতি সম্বন্ধে আলোচনার জন্য ব্রাহ্মবন্ধুসভা’ (১৮৬৩ খ্রী.) স্থাপিত হইল। ইহার ফলে সমাজের কর্মসূচীও প্রসার লাভ করিল এবং সমাজ নানাভাবে কর্মমুখর হইয়া উঠিল। ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবা ও সমাজের উন্নতিমূলক নানাবিধ সংস্কারকার্যের সূচনা হইল। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হইলে সমাজ একটি সাহায্য-সমিতি গঠন করে। ভাগীরথীর তীরে ম্যালেরিয়ার প্রকোপে বহু নরনারীর মৃত্যু হয়–ইহার প্রতিকার ও প্রশমনের জন্য কেশবচন্দ্র সদলবলে ঐসব অঞ্চলে গমন করেন। সাধারণের মধ্যে এবং অন্তঃপুরে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারের প্রতিও সমাজের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। শিক্ষাপ্রণালীর উৎকর্ষ সাধনের জন্য কেশবচন্দ্র প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা করেন। নীতিধর্মবিহীন শিক্ষার পরিবর্তে নীতিধর্মমূলক শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার প্রভৃতি বিষয়ে কেশবচন্দ্র মর্মস্পর্শী ভাষায় যে বক্তৃতা দেন তাহার ফলে বিলাত হইতে অর্থসংগ্রহ করিয়া “কলিকাতা কলেজ” প্রতিষ্ঠিত হইল এবং কেশবচন্দ্র ইহার পরিচালনার ভার গ্রহণ করিলেন। ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ নামে ইংরাজী একখানি পাক্ষিক পত্র ও ‘ধর্মতত্ত্ব’ নামে বাংলা মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। কেশবচন্দ্রই এই উভয়ের ভার গ্রহণ করেন।
কেশবচন্দ্ৰ কলিকাতার বাহিরেও ধর্মপ্রচার করেন। ১৮৬১ সনে কৃষ্ণনগরে তিনি ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে যে বক্তৃতা করেন তাহাতে রক্ষণশীল হিন্দুসম্প্রদায়ও মুগ্ধ হইয়া কেশবকে বহু সাধুবাদ করেন। এই অঞ্চলে খ্রীষ্টান পাদ্রীগণের খুব প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল; কেশবচন্দ্রের প্রচারের ফলে তাহা অনেকটা কমিয়া যায়। কেশবচন্দ্র পাদ্রীদিগের সঙ্গে যে তর্ক-বিতর্ক করেন তাহাতে তাঁহারা বিস্মিত হন এবং প্রসিদ্ধ পাদ্রী আলকজাণ্ডার ডাফ পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব ও প্রতিপত্তি স্বীকার করিতে বাধ্য হন।
কেশবচন্দ্রের কার্যাবলীতে প্রীত হইয়া দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্রকে ব্রহ্মানন্দ এই উপাধি দেন এবং সমাজের আচার্যপদে প্রতিষ্ঠিত করেন (১৮৬২ খ্রী.)। অতঃপর তিনি নিজে প্রধান আচার্য এই আখ্যা গ্রহণ করেন। কেশবচন্দ্রের কৃতিত্বের কথা বাংলা দেশের বাহিরেও বিস্তৃত হইয়াছিল। আচার্যপদে বৃত হইবার পর তিনি দক্ষিণভারতে ধর্মপ্রচার করেন (১৮৬৪ খ্রী.)। তিনি প্রথমে মাদ্রাজ ও পরে পুণা, বোম্বাই, কালিকট প্রভৃতি স্থানে গমন করেন এবং এই সমুদয় নগরীতে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে ধর্মসমাজ স্থাপিত হয়। বোম্বাই-এর সমাজ “প্রার্থনা সমাজ” নামে খ্যাত হয় এবং মহাদেব গোবিন্দ রাণাডের পরিচালনায় ইহা বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে।
কেশবচন্দ্রের ভারতভ্রমণ একটি বিশেষ স্মরণীয় ঘটনা। ইহার পূর্বে বর্তমান যুগে সমগ্র ভারতের ঐক্যসাধনের আদর্শ ও প্রচেষ্টার এরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালের রাজনীতিক ভিত্তিতে জাতীয় কংগ্রেস যে ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, বহুদিন পূর্বে কেশবচন্দ্র ধর্মের ভিত্তিতে তাহার সূচনা করেন।
তত্ত্ববোধিনী সভা বিলোপ করিয়া নূতনভাবে পরিচালনার পর প্রথম পাঁচ-ছয় বৎসর কাল ব্রাহ্মসমাজের সুবর্ণযুগ বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য। কার্যসূচীর প্রসার, জনপ্রিয়তা অর্জন এবং শাখা সমাজ-প্রতিষ্ঠানের ও সভ্যসংখ্যার বৃদ্ধি সকলই এ বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করে। ব্রাহ্মসমাজের সভ্যসংখ্যা ১৮২৯ সনে ছিল ৬, এবং দশ বৎসরে বৃদ্ধি পাইয়া ১০০ হয়। ১৮৪৯ সনে এই সংখ্যা ছিল ৫০০, কিন্তু ১৮৬৪ সনে ইহা বাড়িয়া দুই সহস্র হইয়াছিল। বাংলা দেশের নানাস্থানে এই সভার শাখা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং বাংলার বাহিরেও বোম্বাই ও মাদ্রাজ পর্যন্ত ইহার প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল। ১৮৫৮ সনে এই শাখা-সমাজের সংখ্যা ছিল ১০/১২টি, কিন্তু ১৮৭৮ সনের মে মাসে ইহার সংখ্যা ছিল ১২৪-বঙ্গদেশে ৮০, আসামে ৮, বিহারে ৬, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ১১, অযোধ্যায় ৫, বম্বে প্রদেশে ৭, সিন্ধু প্রদেশে ২ এবং দক্ষিণ ভারতে ৫। ইংরেজী ও অন্যান্য ভাষায় ২১টি পত্রিকা প্রকাশিত হইত। এই দ্রুত উন্নতি যে প্রধানত কেশবচন্দ্রের কৃতিত্বের ফল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। অবশ্য দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব ব্যতীত ইহা সম্ভব হইত কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যাইতে পারে।
কিন্তু সমুদ্রের তরঙ্গরাশির মত উন্নতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছিবার অব্যবহিত পরেই ব্রাহ্মসমাজের অবনতি আরম্ভ হইল। ইহার মূল কারণ হইল, দেবেন্দ্রনাথের সহিত কেশবচন্দ্রের মতবিরোধ। বিপ্লব মাত্রেরই একটি সাধারণ লক্ষণ এই যে, একবার আরম্ভ হইলে ক্রমশই ইহার গতিবেগ বর্ধিত হইতে থাকে। প্রথম বিপ্লবকারীরা যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য লইয়া যাত্রা করেন, পরবর্তীকালে তাঁহাদের অনুচরগণ সে সীমা লঙ্ঘন করিয়া এতদূর অগ্রসর হন যে, পূর্ববর্তিগণ অনুমোদনের পরিবর্তে ইহার বিরোধিতা করেন। বিংশ শতাব্দীতে ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে ইহার যে সুষ্ঠু পরিচয় পাওয়া যায়, উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রাহ্মসমাজের বিবর্তনেও তাহাই ঘটিয়াছিল। রামমোহন যেখানে থামিয়াছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ তাহা হইতে অনেকদূর অগ্রসর হইলেন। তিনি ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুধর্ম হইতে একটি স্বাতন্ত্র্য দান করিলেন এবং বেদকে অপৌরুষেয় বলিয়া স্বীকার করিতে অসমর্থ হইলেন। কিন্তু তিনি উপনিষদ্, স্মৃতি প্রভৃতি একেবারে অগ্রাহ্য করেন নাই। সমাজ সম্বন্ধেও তিনি পৌত্তলিকতা বর্জনপূর্বক হিন্দুর নানাবিধ সংস্কার-উপনয়ন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতির অনুষ্ঠান করিতেন। জাতিভেদ না মানিলেও ব্রাহ্মণ ব্যতীত আর কেহ (কেশবচন্দ্র ব্যতীত) বেদী হইতে উপাসনা করিবার অধিকারী ছিলেন না।
কেশবচন্দ্র আর এক ধাপ অগ্রসর হইলেন। তিনি সর্বপ্রকার শাস্ত্রের উপর কেবলমাত্র যুক্তি ও বিবেকের অনুশাসন মানিতেন। যে-কোন সামাজিক প্রথা যুক্তি বিরোধী-যতই প্রাচীন ও শাস্ত্ৰনুমোদিত হউক না কেন, তাহা অবিলম্বে বর্জন করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন। কেশবচন্দ্র ও তাঁহার অনুগত যুবকদল সর্ববিধ সামাজিক সংস্কারের জন্য অতিশয় ব্যগ্র লইয়া উঠিলেন। জাতিভেদ প্রথার উচ্ছেদ, বিধবা-বিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ, স্ত্রীলোকের পর্দা বিলোপ প্রভৃতি সংস্কারের কার্য তাঁহারা সক্রিয়ভাবে আরম্ভ করিলেন। ব্রাহ্মসমাজের উপাচার্যদিগের উপবীত ত্যাগ ও জাতি নির্বিশেষে সকলেরই বেদী হইতে উপাসনা পরিচালনা করিবার অধিকারও তাঁহারা দাবি করিলেন। দেবেন্দ্রনাথ প্রথম উপবীতধারী উপাচার্যদিগকে বর্জন করিলেন কিন্তু পরে আবার তাঁহাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। দেবেন্দ্রনাথ এ-বিষয়ে একটি আপসরফার চেষ্টা করিলেন ও “উপবীতধারী ব্রাহ্মণ উপাসনাকারীর পার্শ্বে জাতিভেদ বিরোধী প্রগতিশীল ব্যক্তিদেরও স্থান করিয়া দিলেন।”৭ এই সমুদয়ের ফলে বৃদ্ধের দল অসন্তুষ্ট ও শঙ্কিত হইয়া উঠিল কিন্তু প্রগতিশীল দলও সন্তুষ্ট হইল না। তাহরা দাবি করিল যে, “সাধারণ উপাসনার দিন ব্যতিরেকে তাহাদের উপাসনার জন্য একই ব্রাহ্মসমাজ-মন্দিরে অন্য একদিন নির্দিষ্ট করিয়া দিতে হইবে।” দেবেন্দ্রনাথ এই প্রস্তাবে সম্মত না-হওয়ায় কেশবচন্দ্র ও তাঁহার প্রগতিশীল দল ব্রাহ্মসমাজ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিয়া (১৮৬৫ খ্রী.) কিছুদিন পর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করিলেন। দেবেন্দ্রনাথ পরিচালিত সমাজ ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ নামে পরিচিত হইল।
দেবেন্দ্রনাথ যে সমাজসংস্কারের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন এরূপ মনে করিবার কারণ নাই। কিন্তু তাঁহার মতে ধর্ম ও সমাজসংস্কার একসঙ্গে একভাবে গ্রহণ করিলে অনর্থের সৃষ্টি হইবে। এ-বিষয়ে তিনি লিখিয়াছেন : “সমাজসংস্কার ও সভ্যতাবর্ধন যদি ব্রাহ্মধর্মের অঙ্গমধ্যে প্রবিষ্ট করা হয়, তাহা হইলে ব্রাহ্মধর্ম কেবল সংস্কৃত ও সভ্য সমাজেরই ধৰ্ম্ম হইয়া থাকিবে। বিশ্বজনীন আধ্যাত্মিক ও উদারতর বলিয়া ব্রাহ্মধর্মের যে মহিমা কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে, তাহার যথেষ্ট হানি করা যাইবে।”৮
সামাজিক সংস্কার ভিন্ন আরও কোন কোন বিষয়ে কেশবচন্দ্র ও দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে মতদ্বৈধ প্রকট হইয়া উঠিয়াছিল। কেশবের ইচ্ছা ছিল যে, ব্রাহ্মসমাজ কতকগুলি নিয়ম-প্রণালীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সর্বসাধারণের মত দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ইহার বিরোধী ছিলেন। কারণ, এ-সকল বিষয়ে জনমতের প্রতি তাঁহার মোটেই আস্থা ছিল না।
কেহ কেহ উভয়ের মধ্যে মতভেদ ও বিরোধের আর-একটি কারণও নির্দেশ করিয়াছেন। শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র বাগল বাংলা ১৩৬৫ সনে প্রকাশিত কেশবচন্দ্র সেনের জীবনীতে লিখিয়াছেন :
“তিনি (কেশবচন্দ্র) দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের পর একটি প্রতিনিধিস্থানীয় মণ্ডলী স্থাপন করিতে অভিলাষী হন, যাহা শুধু বাংলার নহে, বোম্বাই ও মাদ্রাজের ধর্মসমাজগুলির মধ্যেও যোগাযোগ স্থাপন করিয়া পরস্পর উন্নতি সাধনে যত্নবান হইবে। বঙ্গদেশে প্রতিনিধি-সভা গঠিত হইল, নিয়মাবলীও রচিত ও গৃহীত হইল। এইরূপ প্রতিনিধি-সভার কয়েকটি অধিবেশন এই ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দেই হইয়াছিল। কিন্তু এইরূপ প্রতিনিধি-সভা গঠনের প্রস্তাবেই দেবেন্দ্রনাথ শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। পাছে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের কর্তৃত্বভার প্রতিনিধি সভার হাতে চলিয়া যায় এই আশঙ্কায় তিনি ট্রাস্টীর ক্ষমতাবলে উহার কর্তৃত্বভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন পরিচালক পদে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বসান। কেশবচন্দ্রের পক্ষ হইতে ইহার প্রতিবাদ হইল; কেশবচন্দ্র প্রকাশ্য সভায় এরূপ কার্যের সমালোচনা করিতে ছাড়িলেন না। এইভাবে বিরোধ ক্রমে বিচ্ছেদে পরিণত হইল। কেশবচন্দ্র সদলে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ হইতে সরিয়া দাঁড়াইলেন।”৮ক
যোগেশবাবুর মতে পূর্বে উল্লিখিত সমাজ-সংস্কার ও উপাচার্যদের উপবীত ত্যাগ ও গ্রহণাদি প্রভৃতি কারণগুলি গৌণ, অর্থাৎ এইটিই বিচ্ছেদের আসল কারণ। অথচ ১৫ বৎসর পূর্বে প্রকাশিত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনীতে তিনি ইহার কোন উল্লেখ করেন নাই।
১৮৬৬ সনের ১১ নভেম্বর ব্রাহ্ম প্রতিনিধি-সভার একটি সাধারণ সম্মেলনে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইল। প্রথমে একখানি খোলার ঘর প্রস্তুত করিয়া তাহাতে উপাসনার স্থান হয়। পরে সভ্যগণ নিজেরা চাঁদা দিয়া কিছু অর্থ সংগ্রহ করেন। কেশবচন্দ্রও নিজের দায়িত্বে মেছুয়াবাজার স্ত্রীটে (বর্তমান কেশব সেন স্ট্রীট) জমি খরিদ করেন। ১৭৮৯ শক, ১১ মাঘ (১৮৬৮, ২৪ জানুআরি) ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম মন্দিরের’ ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই নামটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেকালে সমগ্র ভারত যে একটি অখও দেশ এ-ধারণা লোকের মনে স্থান পাইত না। রাজনীতিক্ষেত্রে এই বাংলা দেশের নেতারাই ১৮৫১ সনে ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ স্থাপন করিয়া বৃটিশশাসিত ভারতবর্ষে ঐক্যসাধনের সূত্রপাত করেন। কিন্তু কেশবচন্দ্র আর-একটু অগ্রসর হইয়া ধর্মক্ষেত্রে সমগ্র ভারতের ঐক্যসাধনের প্রতীকস্বরূপ ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ এই নামটি ব্যবহার করিলেন। দক্ষিণভারতে ধর্মপ্রচার করিবার পর হইতেই সম্ভবত তিনি এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। ১৮৬৯ সনের ২১শে অগষ্ট বহু আড়ম্বর, উপাসনা ও বক্তৃতার সহিত ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম মন্দিরের দ্বারোঘাটন করা হয়।
নূতন সমাজ প্রতিষ্ঠার পর পূর্বের ন্যায় কেশবচন্দ্র ধর্মপ্রচার, শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজ-সংস্কার প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপূর্ব কর্মশক্তির পরিচয় দিলেন। ১৮৬৭ সনে উত্তরভারত ভ্রমণে বাহির হইয়া তিনি পাটনা, এলাহাবাদ, কানপুর, লাহোর, অমৃতসর, দিল্লী, মুঙ্গের প্রভৃতি স্থানে ধর্মপ্রচার করেন। ফিরিয়া আসিয়া তিনি একটি বক্তৃতায় সমগ্র ভারতের শিক্ষিত জনসাধারণের একটি মিলনক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার আকাক্ষা ব্যক্ত করেন। দশ বৎসর পরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এইরূপে সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করিয়া রাজনীতিক্ষেত্রে শিক্ষিত ভারতবাসীদের মিলনক্ষেত্র রচনার পথ সুগম করেন। এ-বিষয় যথাস্থানে আলোচিত হইবে।
কেশবচন্দ্রের দৃষ্টান্তে ও উৎসাহে অনুপ্রাণিত হইয়া একদল ব্রাহ্মযুবক সমাজের প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করিলেন। হিন্দু আত্মীয় ও প্রতিবেশীর হস্তে তাঁহাদের অনেককেই যথেষ্ট লাঞ্ছনা, অপমান ও কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছিল। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নিজের জন্মস্থান শান্তিপুরে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করায় তাঁহার গায়ে চিটাগুড় মাখাইয়া বোলতা ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল। উমেশচন্দ্র দত্ত হরিনাভিতে ব্রাহ্মমন্দিরে চক্ষু বুজিয়া ধ্যান বা উপাসনা করিতেছিলেন–এই অবস্থায় তাহাকে তুলিয়া পাশের এক কাঁটাবনে ফেলিয়া দেওয়া হয়। কোন কোন স্থানে ব্রাহ্মমন্দিরে আগুন লাগান হয়। কোন কোন যুবা প্রচারককে পিতা ত্যাজ্যপুত্র করিয়া বাড়ী হইতে তাড়াইয়া দেন। কিন্তু এই সমুদয় বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ব্রাহ্মধর্মের প্রচার পুরাদমে চলিতে লাগিল এবং বাংলা দেশে ইহার প্রভাব ও প্রতিপত্তি অনেক বাড়িয়া গেল। কেশবচন্দ্রের বহুমুখী কর্মশক্তি ও তাহার কর্মসম্প্রদায়ের বিস্তৃত বর্ণনা করা বর্তমান গ্রন্থে সম্ভব নহে। কেবল কয়েকটি বিশিষ্ট প্রসঙ্গের উল্লেখ করিব।
কেশবচন্দ্রের দৃষ্টি কেবল ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৮৬০ সন হইতেই তিনি জগতের বিভিন্ন স্থানের একেশ্বরবাদীদের সহিত চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করিয়াছিলেন। ভারতে খ্ৰীষ্টীয় পাদ্রীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক এবং কয়েকটি বক্তৃতায় তিনি খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে অসাধারণ জ্ঞান ও যীশুখ্রীষ্টের প্রতি অসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়াছিলেন। ১৮৬৬ সনে মার্চ মাসে তিনি “খ্রীষ্ট, ইউরোপ ও এশিয়া” নামক যে বক্তৃতা দিয়াছিলেন, তাহাতে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড লরেন্স হইতে আরম্ভ করিয়া বহু উচ্চপদস্থ ইংরেজ মুগ্ধ হইয়া তাহাকে অভিনন্দন করিয়াছিলেন। এইরূপ আরও কয়েকটি বক্তৃতার ফলে অনেকে, বিশেষতঃ পাদ্রীরা, বিশ্বাস করিতেন যে, কেশব অবিলম্বে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করিবেন। সুতরাং কেশবচন্দ্র যখন বিলাতযাত্রার অভিলাষ প্রকাশ করিলেন, তখন সেখানে হইতে লর্ড লরেন্স প্রমুখ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সাদর আমন্ত্রণ জানাইলেন। ১৮৭০ সনে ২১শে মার্চ তিনি লণ্ডনে পৌঁছিলেন এবং প্রায় সাত মাস সেখানে থাকিয়া ২০শে অক্টোবর কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন। বিলাতে ম্যাক্সমুলার, জন স্টুয়ার্ট মিল, গ্ল্যাডষ্টোন প্রভৃতির সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে অনেক কথাবার্তা হয়। মহারাণী ভিক্টোরিয়াও তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। বিলাতে কেশবচন্দ্রের জনপ্রিয়তার বোধ হয় রাজনীতিক কারণও ছিল। ইংরেজ সরকারের আনুগত্য তিনি অবশ্যপালনীয় নীতি হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং সর্বপ্রকার রাজনীতিক আন্দোলন বর্জন করিয়া চলিতেন। সুতরাং যখন সুরেন্দ্রনাথের উদ্দীপনাময় বক্তৃতা ও জাতীয় ভাব জাগরণের প্রভাবে বাংলার যুবকদল ইংরেজশাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হইয়া উঠিল তখন কেশবচন্দ্রের ইংরেজরাজের প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য ক্রমশই যুবকদলকে তাঁহার ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারের প্রতি বিমুখ ও রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট করিল।
বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া কেশবচন্দ্র নানাবিধ সমাজ-সংস্কারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছিলেন–স্ত্রীজাতির শিক্ষা ও সর্ববিধ উন্নতি, শ্রমিকদলের শিক্ষা ও মানসিক উন্নতি, সর্বসাধারণের জন্য অল্পমূল্যে গ্রন্থ ও সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ, সুরাপান নিবারণ, প্রভৃতি অনেক কার্যে ব্রতী হইয়াছিলেন। ইহার ফলে এক পয়সা মূল্যের ‘সুলভ সমাচার করে’, শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় ও বিধবাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। কালীপদ ব্যানার্জি ১৮৭৪ সনে শ্রমিকদের জন্য ভারত শ্রমজীবী পত্রিকা প্রকাশিত করেন।
রাজনীতিক কারণ ছাড়া কেশবচন্দ্রের জনপ্রিয়তা হ্রাসের অন্য কারও ছিল। তিনি ক্রমশঃ খ্ৰীষ্টীয় ধর্ম ও ধর্মশাস্ত্রের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হইয়া উঠিলেন। পূর্বোল্লিখিত খ্রীষ্টসম্বন্ধে বক্তৃতায় তিনি বলিয়াছিলেন : ‘যখন আমি চিন্তা করি খ্রীষ্ট, তাঁহার শিষ্য ও ধর্মপ্রচারকগণ সকলেই এশিয়াবাসী ছিলেন, তখন খ্রীষ্টের প্রতি আমার প্রীতি ও শ্রদ্ধা শতগুণে বাড়িয়া যায়। তিনি মানবত্বের উৎকৃষ্ট আদর্শ…এশিয়া ও ইউরোপ তাঁহার ভিতর দিয়াই একতা ও সমন্বয়ের শিক্ষা লাভ করিতে পারে। ১৮৬৮ সনের একটি বক্তৃতায়ও তিনি খ্রীষ্টধর্মের উৎকর্ষ উচ্ছ্বসিত ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। রামমোহন ও দেবেন্দ্রনাথ হিন্দুধর্মশাস্ত্র, বিশেষতঃ উপনিষদের ভিত্তিতেই ধর্মমত গঠন করিয়াছিলেন, কিন্তু কেশবচন্দ্র তাঁহার ধর্ম সার্বজনীন উদার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়া, ইহা যে হিন্দুধর্মের সংস্কারমাত্র তাহা অস্বীকার করিলেন। শালগ্রাম শিলা সম্মুখে না-রাখিয়া বিবাহ করায় ব্রাহ্মদের বিবাহ আইনের চক্ষে অসিদ্ধ ছিল, সুতরাং কেশবচন্দ্রের চেষ্টায় গভর্নমেন্ট ১৮৭২ সনে নূতন এক আইন করিলেন। এই নূতন আইনে বিভিন্ন জাতির মধ্যে, এবং কোনপ্রকার পৌত্তলিকতার (শালগ্রাম শিলা প্রভৃতির) অনুষ্ঠান ব্যতীতও বিবাহ আইনসঙ্গত হইতে পারিত। কিন্তু যাহারা এই আইন অনুসারে বিবাহ করিত তাহাদিগকে ঘোষণা করিতে হইত যে, “আমি হিন্দু, মুসলমান বা খ্রীষ্টান নহি।” এই আইনের খসড়ায় ইহার নাম ছিল “ব্রাহ্মবিবাহ বিল”। কিন্তু আদি ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা আপত্তি করিল যে, তাহারা ব্রাহ্ম ধর্মমত গ্রহণ করিলেও নিজদিগকে হিন্দু বলিয়া মনে করেন। তখন ঐ আইনের নাম হইল “সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট” (Civil Marriage Act)। এইরূপে কেশবের ধর্মসম্প্রদায় হিন্দুধর্মের গণ্ডীর বাহিরে চলিয়া গেল। কিন্তু এই নূতন আইন একদিক দিয়া তাঁহার বিজয় সূচিত করিলেও পরিণামে ইহাই তাহার সম্প্রদায়ের ধ্বংস সাধন করিল।
ইহা বর্ণনা করার পূর্বে কেশবচন্দ্রের শেষজীবনের আরও কয়েকটি গুরুতর পরিবর্তন সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক।
একদিকে তিনি যেমন খ্রীষ্টধর্মোক্ত “ঈশ্বরের পিতৃত্ব ও মানবের ভ্রাতৃত্ব”, “মানুষ মাত্রেই পাপী-অনুতাপ ও হৃদয় পরিবর্তন ও ঈশ্বরের করুণা ব্যতীত তাহার উদ্ধারের উপায় নাই”, প্রভৃতি বিশিষ্ট ভাবের উপর অতিরিক্ত জোর দিতেন ও খ্রীষ্টের দেবত্বে বিশ্বাস করিতেন, অন্যদিকে তেমনি তাঁহার আচরণে বৈষ্ণববাচিত ভক্তি ও ধর্মের আতিশয্য নানাভাবে প্রকাশ পাইত। ইহার ফলে তাঁহার সহচর ও অনুচরের দলে “অনুতাপ ও ব্যাকুল প্রার্থনা” অদ্ভুতরূপে ফুটিয়া উঠিল। ব্রাহ্ম উপাসকগণের ক্রন্দন, চীৎকার ও আর্তনাদে, বাহিরের লোকের পক্ষে তাহাদের উপাসনার স্থানে বসা দুষ্কর হইত। কোন কোন ব্রাহ্ম সঙ্গীত ও সংকীর্তনাদির সময় অচেতন-প্রায় হইয়া গড়াগড়ি দিতেন। কেহ বা অপরের পা ধরিয়া কাঁদিতেন এবং অনেকে আচার্য কেশবচন্দ্রের চরণে পড়িয়া প্রার্থনা করিতেন।৯
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সংস্পর্শে আসিয়া তিনি শক্তিরূপে কালীর উপাসনাও করিতেন–কেহ কেহ এরূপও বলিয়াছেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের কোন কোন ভক্ত ইহা স্বীকার করেন না। আমার পিতৃদেব কৈশোরে কেশবচন্দ্রের ভক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তাঁহার মুখে শুনিয়াছি যে, কেশব যখন ঘণ্টা বাজাইয়া কালীপূজা আরম্ভ করিলেন তখন তাঁহারা বীতশ্রদ্ধ হইয়া তাঁহার সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করেন।১০
আর একটি নূতনত্ব–কেশবচন্দ্রের অন্তরে ভগবানের ‘প্রত্যাদেশ’ এবং যুক্তির পরিবর্তে এইপ্রকার প্রত্যাদেশের অনুসরণ। সম্ভবত ইহারই ফলে তাঁহার কোন কোন ভক্ত তাঁহাকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করিতেন এরূপ কাহিনী প্রচলিত হইয়াছিল। এই বিষয়টি লইয়া তখন ঘোরতর আন্দোলন হইয়াছিল। কিন্তু ইহা যে। অনেকটা সত্য তাহা মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে।১০ক
এই সমুদয় কারণে কেশবের সহকর্মিগণ ক্রমশঃ তাহার প্রতি বিরূপ হইয়া উঠেন। কেশবচন্দ্রের কন্যার বিবাহ উপলক্ষে এই বিরূপতা তীব্র আকার ধারণ করে।
১৮৭৭ সনের শেষদিকে বাংলা গভর্নমেন্ট কুচবিহারের মহারাজার সহিত কেশবচন্দ্রের কন্যা সুনীতি দেবীর বিবাহ-সম্বন্ধ উপস্থিত করেন। কেশবের ব্রাহ্মবন্ধুগণ ইহার বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত কারণে আপত্তি করেন।
(১) ১৮৭২ সনে কেশবের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মদের বিবাহ আইনানুমোদিত করিবার জন্য যে নূতন আইনের প্রবর্তন হয় তাহা পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে। এই আইন অনুসারে বিবাহ দিতে হইলে বর ও কনের বয়স যথাক্রমে অন্যূন ১৮ ও ১৪ বৎসর হওয়া আবশ্যক। কিন্তু এক্ষেত্রে বর ও কনে দুজনেরই বয়স ইহার অপেক্ষা কম ছিল।
(২) বিবাহে ব্রাহ্মধর্মের প্রতিকূল পৌত্তলিকতার অনুষ্ঠান হইবে। কারণ কুচবিহারের রাজপরিবার ছিল গোঁড়া হিন্দু।
(৩) মহারাজা স্বয়ং ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ছিলেন না।
কিন্তু এই সমুদয় আপত্তিসত্ত্বেও কেশবচন্দ্র এই বিবাহে অনুমতি দিলেন। যাহাতে ব্রাহ্মধর্মের প্রতিকূল কোন অনুষ্ঠান না হয় এ-সম্বন্ধে বরপক্ষ প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও কার্যকালে নারায়ণ শিলার সম্মুখেই হিন্দু-অনুষ্ঠানের সহিত বিবাহকার্য সম্পন্ন হয় (৬ই মার্চ, ১৮৭৮ খ্রী.)। অবশ্য কেশবচন্দ্র ইহার বিরুদ্ধে চেষ্টা ও সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন, কিন্তু সফল হন নাই। তবে একথা স্বীকার করিলেও এরূপ হওয়ার যে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, একথা পূর্বেই তাঁহার বুঝা উচিত ছিল। কিন্তু কেশবচন্দ্র ভগবানের প্রত্যাদেশ হিসাবেই এই বিবাহে সম্মতি দিয়াছিলেন। বিবাহের অল্পকাল পরেই কেশবচন্দ্র একখানি চিঠিতে লিখিয়াছিলেন : “আমি অনুভব করিলাম স্বয়ং ভগবান তাঁহারই অদ্ভুত বিধানে আমার তনয়ার পরিণয়ের জন্য কুচবিহারের যুবক মহারাজাকে আমার সম্মুখে আনিয়াছিলেন। আমি কি আর না বলিতে পারি? আমার বিবেক আদেশ পালন করিতে বলিল। …অপরাপর চিন্তা এই পবিত্র আহ্বান–এই ঐশ্বরিক অনুজ্ঞার নিম্নে পড়িয়াছিল।”১১
যাঁহারা বিবাহের বিরুদ্ধে বিশেষ আপত্তি করেন নাই, তাঁহারাও সাংসারিক ব্যাপারে ভগবানের প্রত্যাদেশ’-এইরূপ দোহাই দেওয়া খুবই আপত্তিজনক বলিয়া মনে করিতেন। এইপ্রকার রাজপরিবারের সহিত সম্বন্ধস্থাপনের ফলে যে ব্রাহ্মসমাজের বিশেষ উপকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ইহা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু পূর্বোক্ত নানা কারণে কেশবের অনুচরগণের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি হওয়ায় এই উপলক্ষে এক প্রবল আন্দোলন উপস্থিত হইল এবং আপত্তিকারী ব্রাহ্মগণ কেশবচন্দ্রকে সমাজের সম্পাদক ও আচার্যের পদ হইতে সরাইবার চেষ্টায় বিফল হইয়া ১৮৭৮ সনের ১৫ই মে তারিখে টাউন হলে এক সভা আহ্বান করিলেন। এই সভাতে এক স্বতন্ত্র সমাজ স্থাপনের প্রস্তাব গৃহীত হইল। ইহারই ফলে কলিকাতা সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইল।
দ্বিতীয়বার বিচ্ছেদের পরে কেশবচন্দ্রের ধর্মমতের অনেক পরিবর্তন হইল। এই পরিবর্তনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রাহ্মধর্মকে সকল দেশের এবং সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের উপযোগী এক বিশ্বজনীন ধর্মে পরিণত করা। সনাতন হিন্দুধর্মের ভক্তি, বিশ্বাস ও ভাবধারাগুলিকেও তিনি ইহার অন্তর্ভুক্ত করিলেন। একটি বক্তৃতায় তিনি যীশুখ্রীষ্টে দেবত্ব আরোপিত করিলেন। হিন্দুধর্মের চিরপ্রচলিত ধর্মসাধনা–সৃষ্টিকর্তাকে মাত বা শক্তিরূপে উপলব্ধি করা–তিনি গ্রহণ করিলেন। আরও একটু অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “ব্রহ্মের ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপ মূর্তিরূপে পূজিত হইতেছে। হিন্দুর পৌত্তলিকতা অগ্রাহ্য করিবার বস্তু নয়। মূর্তি ভগবানের অসংখ্য অংশের প্রতীক, সকল একত্র কর, অখণ্ড ব্রহ্মকে পাইবে। প্রত্যেকটি মূর্তি ভগবানের এক একটি গুণবাচক প্রতীক।” বৈষ্ণবদের মত তিনি দল বাঁধিয়া রাস্তায় ভগবানের নাম-সংকীর্তন করিতেন। তিনি আর-একটি অনুষ্ঠান প্রবর্তন করিলেন–Pilgrimage to Saints and Prophets (সাধুসন্তদের নিকট তীর্থযাত্রা)। ইহার উদ্দেশ্য হইল, জগতের সকল সাধু ও মহাপুরুষদের জীবনী ও বাণী সম্বন্ধে গভীর আলোচনা ও ধ্যান, তাঁহাদের শিক্ষাদীক্ষা ধর্মে ও জীবনে গ্রহণ করা, এবং তাঁহাদের সঙ্গে আত্মিক যোগ স্থাপনা করা। তিনি বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, যীশুখ্রীষ্ট, মহম্মদ, সক্রেটিস, কার্লাইল, এমারসন, ফ্যারাডে প্রভৃতি সকলকে এই সাধু ও মহাপুরুষদের অন্তর্ভুক্ত করিলেন। মোটের উপর কেশবচন্দ্র তাঁহার ধর্মে হিন্দুধর্মের মূল তত্ত্বগুলি, এমনকি পৌত্তলিকতার নিগূঢ় রহস্যপূর্ণ ভাব, বৈষ্ণবের ভক্তিবাদ, শৈবের শক্তিপূজা প্রভৃতির সহিত ইসলাম ও খ্রীষ্টধর্মের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সত্যগুলির সমন্বয় সাধন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই সমন্বয়মূলক নবীন ধর্মমতকে তিনি নববিধান’ নামে অভিহিত করিলেন অর্থাৎ সমাজের নাম পূর্ববৎ ব্রাহ্মসমাজ থাকিল, কিন্তু ধর্মের নাম হইল নববিধান। ১৮৮১ সনে মাঘোৎসবের সময় মন্দিরের বেদী হইতে এবং টাউন হলে তাঁহার বার্ষিক ইংরেজী ভাষণে তিনি এই নবধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিয়া বলিলেন, “এই নববিধান সকল ধর্মপ্রবর্তক, সকল ধর্মশাস্ত্র ও সকল বিধানের এক অপূর্ব সঙ্গতি। এই নববিধান সকল দেশের ও সকল কালের সঞ্চয়িত মণিমুক্তাদ্বারা নির্মিত একটি বহুমূল্য কণ্ঠহার। জগতে যাহা কিছু সত্য, শিব ও সুন্দর সে-সমস্তই এই ধর্মে গৃহীত হয়। হে জগতের জাতিসমূহ, তোমরা এই ধর্মের পতাকার সম্মুখে মস্তক অবনত কর আর ঈশ্বরের পিতৃত্ব ও মানবের ভ্রাতৃত্ব ঘোষণা কর।”১২
নববিধান ঘোষণার পরেই ‘পতাকা বরণ’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। নববিধানের প্রতীক এই পতাকায় চিত্রদ্বারা ধর্মসমন্বয়ের কল্পনা ও আদর্শ পরিস্ফুট করা হইয়াছে। ইহার বর্ণনা প্রসঙ্গে কেশবচন্দ্র বলেন : “উধ্বদিকে দৃষ্টিপাত কর, সেখানে দেখিবে জগতের সকল ধর্মপ্রবর্তক সাধু মহাজনদের আত্মা সম্মিলিত হইয়াছে…এই পূত পতাকার পাদদেশে রহিয়াছে হিন্দু, খ্রীষ্টান, মোসলেম ও বৌদ্ধধর্মের শাস্ত্রসমূহ।”১৩
ঊনবিংশ শতাব্দীতে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কেবলমাত্র বাণী দ্বারা নহে, নিজের সাধনা দ্বারা সর্বধর্মসমন্বয়ের যে অপূর্ব আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, জগতে তাহার তুলনা নাই। ইহা পরে বিবৃত হইবে। কেশবচন্দ্র রামকৃষ্ণের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন–অনেকে এই মত পোষণ করেন, কিন্তু নববিধানের নেতাগণ অনেকেই ইহা বিশ্বাস করেন না। তবে প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও আরও কেহ কেহ ইহা স্পষ্টতঃ স্বীকার করিয়াছেন।১৪
কেশবচন্দ্র নববিধানের বিশেষত্বসূচক কতকগুলি অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন। খ্রীষ্টধর্মের অনুকরণে দীক্ষাগ্রহণ (Baptism) ও অন্তিম ভোজ (Lords Supper), এবং সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুমতে হোমেরও ব্যবস্থা হয়। প্রচারক দলকে অভিষিক্ত করা, ভক্তদের ভিতর দারিদ্র্য, আত্মসমর্পণ, দান প্রভৃতি বিষয়ে ব্রত গ্রহণের প্রবর্তন ও এই উদ্দেশ্যে ভগিনী সম্প্রদায় ও যুবকসম্প্রদায় গঠন–ইহাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ফরাসী পণ্ডিত রোমা রোলা ও পাশ্চাত্তের আরও অনেক মনীষিবৃন্দ ‘নববিধানের’ উদার সার্বজনীন ভাবে মুগ্ধ হইয়া কেশবচন্দ্রের ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন। যে-সকল ব্রাহ্ম তাঁহার দল ছাড়িয়া গিয়াছিলেন তাঁহাদের অন্যতম প্রসিদ্ধ নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী ইহাকে “ব্রাহ্ম সমাজের ইতিবৃত্তে কেশবচন্দ্রের একটি প্রধান কার্য” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতিও ইহার সম্বন্ধে অনেক সাধুবাদ করিয়াছেন।১৫ কিন্তু তথাপি একথা অস্বীকার করা যায় না যে, নববিধান কোনদিনই খুব জনপ্রিয় হইয়া ওঠে নাই এবং ১৮৮৪ সনে কেশবচন্দ্রের মৃত্যুর পর ইহা প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছে বলিলেও বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না। ইহার প্রধান কারণ মনে হয়, হিন্দু অথবা ব্রাহ্ম কোন সম্প্রদায়ই কেশবচন্দ্রের অনেক কার্যকলাপ সমর্থন করিতেন না। এ-সম্বন্ধে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজনারায়ণ বসুকে একখানি পত্রে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা উদ্ধৃত করিলেই যথেষ্ট হইবে।
“শ্রীযুক্ত কেশববাবুর প্রতি এখনো যে আমার স্নেহ আছে তাহা ম্লান হয় নাই তাহাই আমি প্রতাপবাবুর পত্রে লিখিয়াছিলাম।…আমার সহিত কেশববাবুর যাহাতে পূর্ববৎ সম্মিলন হয়, প্রতাপবাবু তাঁহার পত্রের শেষে এই ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন।…এই কথার সহজ উত্তর এই যে, ধর্মসম্বন্ধে তাঁহার সঙ্গে আর মিল হইতে পারে না। মিলের সম্ভাবনাই বা কোথায়? যখন তিনি স্বীয় অভিমানে এত উচ্চ হইয়া উঠিয়াছেন যে আমরা তাঁহার আর নাঙ্গাল পাই না, তখন আর তাহার সঙ্গে কি প্রকারে মিল হইবে? যখন তিনি কখনো গঙ্গার স্তব করিতেছেন, কখনো রাধাকৃষ্ণের প্রেমগান করিতে করিতে রাস্তায় মাতিয়া বেড়াইতেছেন, কখনো আবার হোম করিতেছেন, কখনো সশিষ্যে বাড়ির পুষ্করিণীতে স্নান করিয়া বলিতেছেন, জোর্ডান নদীতে জান-দি-বেপটাইসটের দ্বার বেপটাইট হইতেছে, মধ্যে মধ্যে মুশা যীশা, সক্রেটিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে সশরীরে পরলোকে তীর্থযাত্রা করিতেছেন-তখন এই সকল প্রহেলিকা ভেদ করিয়া তাহার সঙ্গে কি প্রকারেই বা মিল হইবে? আমরা কেবল এক জন্মভূমির অনুরাগে ঋষিদিগের বাক্যেই জ্ঞানতৃপ্ত হইয়াছি, তিনি অসাধারণ উদার প্রেমে উদ্দীপ্ত হইয়া ভারতবর্ষের ব্রহ্মবাদিদিগের সঙ্গে পালেস্তাইন ও আরববাসী ব্ৰহ্মবাদিদিগের সমন্বয় করিতে উদ্যত হইয়াছেন। এই তাহার অসাধারণ উদার প্রেমই সমস্ত কলহের মূল, ইহা লইয়া ব্রাহ্মদিগের মধ্যে এত বিবাদ। ইহা লইয়া যে বাদানুবাদ উপস্থিত হইয়াছে তাহার অন্ত নাই–ইহার কোলাহল ক্রমাগতই বৃদ্ধি হইতেছে।”১৬
কেশবচন্দ্রের নববিধান’ যে আদি ও সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ, উভয়েরই বিরাগভাজন হইয়াছিল এই পত্র হইতে তাহা জানা যায়। কিন্তু শিবনাথ শাস্ত্রী যাহা লিখিয়াছেন তাহাও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন :
“ব্রাহ্মধর্মের এই উদারতা ও সার্বজনীনতা তাঁহার একটি প্রধান কার্য। এ কার্যের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব প্রতীতি করিবার সময় এখনও উপস্থিত হয় নাই। এখনও জগতের ধর্মসকল প্রাচীন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ লইয়া বাস করিতেছে, ব্রাহ্মধর্ম যে মহৎ কার্যে প্রবৃত্ত, তাহা দেখিতে পাইতেছে না, কিন্তু দিন আসিতেছে, যখন তাহা দেখিতে পাইবে। তখন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় দীপ্তি পাইবে।”১৭
ইহা ব্যতীত কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজকে অন্য যাহা যাহা দিয়া গিয়াছেন ১৯১০ সনে মাঘোৎসব উপলক্ষে শিবনাথ শাস্ত্রী তাহার উল্লেখ করিয়াছেন। কেশবচন্দ্র হইতে বিচ্ছিন্ন ও তাঁহার বিরোধীদলের অন্যতম নেতা ত্রিশ বৎসর পরে তাঁহার সম্বন্ধে যে উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন, তাহার ঐতিহাসিক মূল্য খুব বেশী–কারণ ইহা স্তাবকের অত্যুক্তি নহে বা পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট বলিয়া মনে করিবার কোন কারণ নাই। সমসাময়িক ঘটনায় যে চিত্তবিক্ষোভ হইয়াছিল, তাহার উপশম হইবার বহু বৎসর পরে বাদ-বিসম্বাদের অবসানে, শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁহার বিরোধীপক্ষের নেতার অবদান যেভাবে বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহা তাঁহার ন্যায় উদার-হৃদয় চিন্তাশীল ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব এবং সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত বলিয়াই মনে হয়। সুতরাং সংক্ষেপে ইহার উল্লেখ করিতেছি :
১। কেশবচন্দ্রের প্রথম মহোপদেশ এই যে, ঈশ্বরের মৌখিক বা ক্রিয়াময় পূজাই সর্বশ্রেষ্ঠ নহে, কিন্তু বাক্যে কার্যে ও জীবনে অসত্যকে বর্জন করা ও সত্যকে গ্রহণ করা, অন্যায়কে নিবারণ করা ও ন্যায়কে স্থাপনা করা, অপবিত্রতাকে পরিহার করা ও পবিত্রতাকে অবলম্বন করা, এ-সকলও তাঁহার পূজা। ব্রাহ্ম যে কেবল মূর্তিপূজা বর্জন করিয়া তৎস্থানে অনন্তের পূজা প্রতিষ্ঠা করিয়া সন্তুষ্ট হইবেন তাহা নহে। কিন্তু তাহার ধর্মবুদ্ধিতে ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠিত জানিয়া সর্বস্থানে সর্বকালে ও সর্বাবস্থাতে তাঁহার আদেশের অনুগত হইয়া চলিবেন। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের উপদেশ ও দৃষ্টান্তে এই ভাব যুবক-ব্রাহ্মগণের মনে একসময় এমন প্রবল হইয়াছিল যে, ইহা অনেক জীবনে মহাপরিবর্তন আনয়ন করিয়াছিল।
২। দেবেন্দ্রনাথ মানবের সামাজিক জীবনকে ধর্মসাধনের অঙ্গীভূত করেন নাই; কিন্তু কেশবচন্দ্র আধ্যাত্মিক অর্চনার ন্যায় মানবের সামাজিক জীবনকে ধর্মসাধনের অঙ্গীভূত করিলেন। জাতিভেদ বর্জন, নারীগণের শিক্ষা ও সর্ববিধ উন্নতি, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিবারণ, পানদোষ বর্জন প্রভৃতির দিকে যুবক ব্রাহ্মদিগের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল।
৩। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুভাবেই ব্যক্ত করিয়াছিলেন এবং উপনিষদাদি প্রাচীন গ্রন্থসকলের সমালোচনাই প্রধানরূপে অবলম্বন করিয়াছিলেন। কেশবচন্দ্র খ্রষ্টীয় শাস্ত্রের আলোচনা করিয়া ব্রাহ্মধর্মকে এক উদার আধ্যাত্মিক ও সর্বজনীন মহাধর্মরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।
৪। রামমোহন ও দেবেন্দ্রনাথের ধর্ম বহুলপরিমাণে জ্ঞানের ধর্ম ছিল। রামমোহনের জ্ঞান-প্রধান বেদান্তবাদ এবং দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মজ্ঞান, ব্রহ্মধ্যান ও ব্রহ্মানন্দ রসপান’ ব্রাহ্মসমাজের প্রধান উপজীব্য ছিল। কেশবচন্দ্র বৈষ্ণবীয় কীর্তন প্রথার প্রবর্তন ও চৈতন্য প্রভৃতি ভক্তগণের জীবন আলোচনা করিয়া এক নবযুগের প্রবর্তন করেন এবং ব্রাহ্মসমাজে ভক্তিস্রোতের প্রবাহ বহিতে থাকে। ইহা দ্বারা ব্রাহ্মধর্মকে জ্ঞান-প্রধান বেদান্তবাদে পরিণত হওয়ার বিপদ হইতে রক্ষা এবং ব্রাহ্মধর্মের সাধনে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের সামঞ্জস্য বিধান করিয়া কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজের চিরকৃতজ্ঞতার পাত্র হইয়াছেন।
৫। ঈশ্বরের করুণাতে বিশ্বাসস্থাপনপূর্বক, তাঁহার হস্তে আত্মসমর্পণ করিয়া ব্রাহ্মধর্ম প্রচার ও ব্রাহ্মসমাজের সেবাতে দেহ মন প্রাণ নিয়োগ করিতে পারেন, এরূপ এক প্রচারকদল সৃষ্টি করা কেশবচন্দ্রের একটি প্রধান কার্য।১৮
(ঘ) সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ
কেশবচন্দ্রের দল হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাহারা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করিলেন (১৫ই মে, ১৮৭৮ খ্রী.) তাঁহাদের মধ্যে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, দুর্গামোহন দাস প্রভৃতি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ধর্মের দিক দিয়া এই সমাজের নূতন অবদান বিশেষ কিছুই নাই। আচার্য বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ব্রাহ্মসমাজে আধ্যাত্মিকতার ভাব অনেকটা বজায় রাখিয়াছিলেন। কিন্তু তিনিও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাবে “তাঁহার সাকার বিশ্বাস লুকাইয়া রাখিতে না পারিয়া” ব্রাহ্মসমাজ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। উক্ত সমাজের মধ্যে তাহার উপর যাঁহাদের একান্ত বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা ছিল তাঁহারাও সমাজ ছাড়িয়া তাহার সহিত চলিয়া আসিলেন। পরবর্তী আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী একজন উপযুক্ত নেতা ছিলেন এবং সমাজের আদর্শ অক্ষুণ্ণ রাখিতে যত্নশীল ছিলেন। কিন্তু বিজয়কৃষ্ণ ও তাহার অনুচরগণের সমাজত্যাগের পরই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে আধ্যাত্মিক ধর্মভাবের অনুশীলন ক্রমশঃই ক্ষীণ হইতে লাগিল এবং আধ্যাত্মিকতা হারাইয়া প্রধানতঃ সমাজ-সংস্কার এবং নানাবিধ দেশহিতকর কার্যেই সমাজের সদস্যগণ আত্মনিয়োগ করিলেন। অবশ্য সমাজে ধর্মপিপাসু ব্যক্তির একেবারে অভাব কখনও হয় নাই। কিন্তু সমষ্টিগতভাবে কেশবচন্দ্র ও বিজয়কৃষ্ণের পর আধ্যাত্মিকতার প্রভাব ও প্রচার নববিধান’ ও ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের বৈশিষ্ট্য বলিয়া গ্রহণ করা কঠিন। শ্রীশিবনাথ শাস্ত্রী প্রণীত ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস’ পড়িলে এবং বিগত অর্ধশতাব্দী কালের যে কার্যক্রম বর্তমান লেখকের প্রত্যক্ষ গোচরে আসিয়াছে তাহা বিবেচনা করিলে মনে হয় যে, কেশবচন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গেই ব্রাহ্মধর্মের নূতন নূতন উদ্ভাবনী শক্তি ও সক্রিয় গতিবেগ তিরোহিত হইয়াছে। গত নব্বই বৎসরে সাধারণ সমাজের সঙ্গে আদি ব্রাহ্মসমাজ ও কেশবচন্দ্রের নববিধান বা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ পাশাপাশি অবস্থান করিয়া মোটামুটি নির্বিবাদে নিজ নিজ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে। ঠাকুর-পরিবার, বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথ ও তাহার ভ্রাতৃবৃন্দ এবং অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ-আদি ব্রাহ্মসমাজের স্মৃতি উজ্জ্বল রাখিয়াছেন, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অনেক সভ্যও সাহিত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞানচর্চা ও সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কীর্তিলাভ করিয়াছেন কিন্তু ধর্মের ইতিহাসে তাঁহাদের বিশেষ কোন স্থান নাই। তিনটি শাখার ব্রাহ্মদের সংখ্যা বহুদিন ধরিয়াই কমিতেছে। বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় তাহাদের মোটসংখ্যা ২৮৫ এবং সমগ্র ভারতে ২,১৯২। সুতরাং ব্রাহ্মধর্মের আন্দোলন এখন অতীতের ইতিহাসে পর্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু বর্তমান হিন্দুসমাজের গঠন ও আদর্শ যে ব্রাহ্মসমাজের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুসমাজ হইতে স্বাতন্ত্রের দাবি বেশ জোরের সহিত প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এক পৌত্তলিকতা বর্জন ব্যতীত ব্রাহ্মধর্ম ও সমাজের যাহা কিছু বৈশিষ্ট্য, তাহা বর্তমান হিন্দুসমাজে গৃহীত হইয়াছে এবং কোন কোন বিষয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্মসমাজ অপেক্ষা অনেক বেশি অগ্রসর হইয়াছে। নিষিদ্ধ দ্রব্যের ভোজন, বিলাত যাত্রা, জাতিভেদের নিয়ম লঙ্ন, প্রাপ্তবয়স্কা অনূঢ়া ও শিক্ষিতা কন্যার অভাব, প্রভৃতি যে সমুদয় কারণে বহুসংখ্যক হিন্দু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করিত, সেসকল কারণের অভাবই যে। প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের জনপ্রিয়তা ও সভ্যসংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সুতরাং ব্রাহ্মধর্ম ও সমাজ ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হইতেছে ইহাও যেমন সত্য, অপ্রত্যক্ষভাবে ইহা যে হিন্দুধর্মের অঙ্গরূপে পরিণত হইয়া ইহাকে নূতন রূপ ও শক্তি দান করিয়াছে, ইহাও তেমনি সত্য। ভারতে বৌদ্ধধর্ম যেরূপে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া নিজের স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়াছে, ব্রাহ্মধর্মও তেমনি বিরাট হিন্দুধর্ম ও সমাজের মধ্যে মিশিয়া যাইবে, ইহার সম্ভাবনা খুব বেশী।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের শ্রেষ্ঠ অবদান-গণতন্ত্রমূলক ভিত্তির উপর ইহার প্রতিষ্ঠা। ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রথম হইতেই এবং ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ কিছুদিনের মধ্যেই কার্যত একজন নায়কের অধীনে পরিচালিত হইত। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রথম হইতেই গণতন্ত্র-প্রণালীতে পরিচালিত হইতেছে। রাজনীতির ভাষায়, প্রথম দুই সমাজে ছিল স্বৈরতন্ত্র (dictatorship) এবং তৃতীয়টিতে ছিল গণতন্ত্র (democracy)। ধর্মজগতে শাসনপ্রণালীর এই পরিবর্তন, বঙ্গদেশের রাজনীতিক চেতনাকেও অনুরূপভাবে পরিবর্তনের সহায়তা করিয়াছিল, এরূপ অনুমান করা খুব অসঙ্গত হইবে না। বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে বাংলায় যাঁহারা রাজনীতিক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে ব্রাহ্মদের সংখ্যা খুব কম নহে। ইহা একেবারে আকস্মিক ঘটনা নাও হইতে পারে। ধর্মমতের স্বাধীনতার জন্য ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন রামমোহন ও দেবেন্দ্রনাথ, সামাজিক জগতে সাম্যপ্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হন কেশবচন্দ্র এবং সাধারণ লোকের সর্ববিষয়ে তুল্য অধিকারের দাবির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। এই দাবি যে রাজনীতিক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার আন্দোলন হইবে ইহা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। সুতরাং ধর্মজগতে নূতন অবদান বিশেষ কিছু না থাকিলেও জাতীয় জাগরণে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অবদান স্বীকার করিতেই হইবে।
২. খ্রীষ্টধর্ম
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজগণ বাংলায় ব্যবসায় বাণিজ্য উপলক্ষে বসবাস করিতে আরম্ভ করিলে বাংলা দেশে রোমান ক্যাথলিক খ্রীষ্টধর্মের প্রচার আরম্ভ হয়। সপ্তগ্রাম, চট্টগ্রাম, ব্যাণ্ডেল ও হুগলীতে পর্তুগীজেরা বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করে এবং ক্রমে এই সমুদয় স্থানে, বিশেষতঃ হুগলীতে, বহু পর্তুগীজ ও ইউরেশীয়ান স্থায়ীভাবে বাস করে। পর্তুগীজেরা জোর করিয়া হিন্দু মুসলমানদের খ্রীষ্টান করিত, এবং গর্ব করিত যে, সমস্ত প্রাচ্য ভূখণ্ডে পাদ্রীরা দশবৎসরে যত ভারতীয়কে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করে, হুগলীতে এক বৎসরে তাহার চেয়ে বেশী লোক খ্রীষ্টান হয়। কিন্তু মুঘলসম্রাট শাহজাহানের বেগমের দুইজন বাদীকে অপহরণ করায় তাঁহার আদেশে হুগলী হইতে পর্তুগীজেরা বিতাড়িত হয় (১৬৩২ খ্রী.)।
পর্তুগীজ মিশনারীরা যে ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলা শিখিয়া ঐ ভাষায় গ্রন্থ রচনা করিত, এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে তাহা বিবৃত হইয়াছে। পর্তুগীজদের মধ্যে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে যে, ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’ গ্রন্থের রচয়িতা ডোম অ্যান্টোনিও রোজারিও নামক খ্রীষ্টধর্মান্তরিত একজন বাঙ্গালী হিন্দু ঢাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে ২০,০০০ নিম্নশ্রেণীর হিন্দুকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করে, কিন্তু দুইদল পাদ্রীর মধ্যে ইহাদের তত্ত্বাবধান করিবার ভার লইয়া বিবাদ হয় এবং তাহার ফলে ইহারা সকলেই পুনরায় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে। পূর্ববঙ্গে নিম্নশ্রেণীর অনেক লোক পর্তুগীজদের প্ররোচনায় খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু তাহাদের মোট সংখ্যা খুব বেশী নহে। ইংরেজরাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাঙ্গালীদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্মের প্রভাব খুব সামান্যই ছিল। তবে বহু পর্তুগীজ এদেশীয় স্ত্রীলোকদের বিবাহ করায় বৃহৎ একটি বাঙ্গালী খ্রীষ্ট সম্প্রদায় গড়িয়া উঠিয়াছিল।
পর্তুগীজদের পরে ইউরোপ হইতে ওলন্দাজ ও ইংরেজ কোম্পানি এদেশে আসিয়া বাণিজ্যে প্রাধান্য লাভ করে। কিন্তু তাহারা ধর্মপ্রচারের সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিল। যে রাজকীয় সনদের বলে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বাণিজ্য করিবার অধিকার পাইয়াছিল তাহাতে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে তাহারা ভারতে মিশনারী পাঠাইতে পারিবে না। এই বাধাসত্ত্বেও উইলিয়ম কেরী নামে একজন ইংরেজ ডেনদেশীয় জাহাজে ১৭৯৩ সনে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে কলিকাতায় আসেন। তিনি এক দরিদ্র মুচির পুত্র ছিলেন এবং যথেষ্ট উৎসাহ ও অধ্যবসায়সত্ত্বেও খ্রীষ্টধর্মপ্রচারে সম্পূর্ণ বিফল হইলেন। কিছুদিন পরে তাঁহার আহ্বানে আরও চারিজন ইংরেজ এক আমেরিকান জাহাজে কলিকাতায় পৌঁছিলেন। কিন্তু ইংরেজ গভর্নমেন্ট তাঁহাদিগকে কলিকাতায় নামিতে না-দেওয়ায় তাঁহারা ডেন জাতি অধিকৃত শ্রীরামপুরে চলিয়া গেলেন এবং কেরীও সেখানে তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। এইরূপে কলিকাতার নিকটবর্তী শ্রীরামপুরে প্রটেষ্ট্যান্ট খ্রীষ্টান মিশনারীদের একটি কেন্দ্র স্থাপিত হইল। বাংলা দেশে গদ্যভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা ও মুদ্রাযন্ত্রের উন্নতিকল্পে তাঁহাদের অমূল্য অবদান যথাস্থানে বিবৃত হইবে। ১৮০০ সনে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামে একজন ছুতার মিস্ত্রীর হাত ভাঙ্গিয়া গেলে টমাস নামে এক মিশনারী ডাক্তারের চিকিৎসায় সে আরোগ্যলাভ করে। সে-ই সর্বপ্রথম খ্রীষ্টানধর্ম গ্রহণ করে। ইহার পূর্বে সাত বৎসরের মধ্যে কেরী একটি বাঙ্গালীকেও খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষিত করিতে পারেন নাই। সুতরাং এই ঘটনায় সমস্ত মিশনারীরা আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল–ডাক্তার টমাস উন্মাদের ন্যায় আচরণ করায় তাহাকে আটক করিয়া রাখা হইল।
বিলাতে একদল লোকের চেষ্টায় ভারতে ইংরেজ মিশনারীদের ধর্মপ্রচারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, ১৮১৪ সনে তাহা রহিত করা হয়। সুতরাং শ্রীরামপুরের মিশনারীদের কর্মক্ষেত্র সমস্ত বাংলায় এবং বাংলার বাহিরেও বিস্তৃত হইল। ১৮১৮ সনে মিশনের অধীনে ১২৬টি দেশীয় ভাষা শিক্ষার বিদ্যালয়ে প্রায় দশ হাজার ছাত্র পড়িত। তাহারা সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে খ্রীষ্টধর্মেও শিক্ষালাভ করিত। ১৮২১ সনে শ্রীরামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। এই কলেজটি এখনও আছে।
১৮১৪ সনের পর বহু মিশনারী দলে দলে বঙ্গদেশে আসিতে লাগিল। কলিকাতায় একজন বিশপ নিযুক্ত হইলেন। ইহার ফলে এবং প্রধানত বিদ্যালয়, হাসপাতাল প্রভৃতির দ্বারা দরিদ্র নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা প্রলুব্ধ হইয়া খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করিতে লাগিল। কিন্তু তাহাদের সংখ্যা খুব বেশী হয় নাই।
১৮১৭ সনে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৩৫ সনের সরকারী নূতন ব্যবস্থায় ইংরেজীশিক্ষার প্রসারের ফলে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যেও খ্রীষ্টধর্মের প্রতি আসক্তি বাড়িয়া ওঠে। মধুসূদন দত্ত ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ ইহার দৃষ্টান্তস্থল।
পূর্বে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এদেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের বিরোধী ছিলেন। ক্রমে ক্রমে তাহাদের মত সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইল। ১৮১৩ সনে কোম্পানিকে যে নূতন সনদ দেওয়া হইল, তাহাতে মিশনারীদের এদেশে বসবাস ও ধর্মপ্রচারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হইল। দলে দলে মিশনারীরা এদেশে আসিতে লাগিল ও ইংরেজ কর্মচারিগণ এযাবৎ পরোক্ষভাবে হিন্দুধর্মের যে সমর্থন করিয়া আসিতেছিলেন তাহার বিরুদ্ধে তাহারা প্রতিবাদ আরম্ভ করিল। তাহাদের প্রধান কয়টি অভিযোগের সারমর্ম এই :
(১) সরকারপক্ষ হইতে হিন্দু মন্দিরের ভার গ্রহণ করা।
(২) অনাবৃষ্টি হইলে তাহা নিবারণের জন্য ব্রাহ্মণদের দ্বারা পূজা করান।
(৩) সরকারী দলিলে ‘শ্রী’ লেখা এবং গণেশ প্রভৃতি নাম উল্লেখ করা।
(৪) হিন্দু ও মুসলমান ধর্মোৎসবে সরকারী কর্মচারীদের যোগদান ও এই উপলক্ষে শোভাযাত্রায় সামরিক বাদ্য বাজান।
(৫) হিন্দু-উৎসব উপলক্ষে দুর্গ, ও জাহাজ হইতে কামান দাগা।১৯
এই আন্দোলনের ফলে বিলাতের কর্তৃপক্ষ আদেশ দিলেন যে সরকারী কর্মচারীরা হিন্দুধর্মের সহিত কোন সম্বন্ধ রাখিতে পারিবে না। সরকারের নির্দেশ ছিল যে, সরকারী কর্মচারীরা ধর্মবিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকিবে, কিন্তু কার্যত তাহারা খ্রীষ্টানধর্ম প্রচারের জন্য নানাভাবে মিশনারীদের সাহায্য করিত। এ-বিষয়ে উদারমতাবলম্বী রামমোহন রায় যাহা লিখিয়াছেন তাহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :
“গত বিশ বৎসর যাবৎ একদল ইংরেজ মিশনারী প্রকাশ্যে নানাভাবে হিন্দু ও মুসলমানদিগকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করিতে চেষ্টা করিতেছে। প্রথমত ছোট বড় নানা গ্রন্থে এই উভয় ধর্মের নিন্দা ও কুৎসা এবং হিন্দুদের দেবতা ও মহাপুরুষদের প্রতি গালাগালি ও ব্যঙ্গোক্তি করিয়া তাহা সাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা; দ্বিতীয়তঃ এদেশীয় লোকের গৃহের সম্মুখে এবং রাস্তায় দাঁড়াইয়া স্বীয় ধর্মের শ্ৰেষ্ঠতা ও অন্য ধর্মের হীনতা প্রচার করা; তৃতীয়তঃ নিম্নশ্রেণীর কোন লোক অর্থলোভে বা অন্য কোন স্বার্থের আশায় খ্রীষ্টান হইলে তাহাদের ভরণপোষণ ও চাকুরীর ব্যবস্থা করিয়া অপরকে খ্রীষ্টানধর্ম গ্রহণে উৎসাহ দান।
“সত্য বটে যে যীশু খ্রীষ্টের শিষ্যেরা নানা দেশে ধর্মপ্রচার করিত। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে তাহারা ঐ সমুদয় দেশে রাজত্ব করিত না। যদি ইংরেজ মিশনারীরা তুরস্ক, পারশ্য প্রভৃতি অধিকতর নিকটবর্তী যে সমুদয় দেশ ইংরেজের অধীন নহে সেই সমুদয় দেশে ধর্মপ্রচার করিত, তাহা হইলে বুঝিতাম যে যীশুর অনুচরগণের ন্যায় ধর্মসাধনই তাহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য; কিন্তু যে বাংলা দেশে ইংরেজ রাজা এবং ইংরেজের নামেই লোকে ভয়ে কম্পমান, সেই দেশের দরিদ্র ভীরু অধিবাসীদের ধর্মবিষয়ে স্বাধীন অধিকারে কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ ভগবান বা মানুষের কাছে ন্যায়সঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হইবে না। কারণ জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা তাহাদের অপেক্ষা কম শক্তিশালী কাহারও মনে আঘাত দেওয়া অন্যায় মনে করেন, বিশেষতঃ এই সকল দুর্বল লোকেরা যদি তাঁহাদের অধীনস্থ হয় তবে তাঁহারা ইহাদের কোনরূপ কষ্ট দেওয়ার কথা কল্পনাও করিতে পারেন না।”২০
মিশনারীরা হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কিরূপ মনোভাব পোষণ করিতেন বাংলার সুপ্রসিদ্ধ মনীষী রেভারেণ্ড আলেকজাণ্ডার ডাফ প্রণীত একখানি গ্রন্থে নিম্নলিখিত উক্তি হইতে তাহা বুঝা যাইবে : “অধঃপতিত মানবের কুবুদ্ধি হইতে যে সকল অসত্য ধর্মমতের উদ্ভব হইয়াছে তাহার মধ্যে হিন্দুধৰ্ম্মই সর্বাপেক্ষা বিশাল। জগতে যত মিথ্যা ধৰ্ম্ম আছে তাহাদের মধ্যে হিন্দুধর্মেই সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে এবং অধিক প্রকারে ভগবানের প্রচারিত সত্যের বিরোধী মত ও উক্তি স্থান পাইয়াছে।”২৫
মিশনারীদের বিদ্যালয়গুলি যে প্রধানত খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কেন্দ্ররূপে কল্পিত হইয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ১৮২২ সনে এক ইংরাজী পত্রিকায় লেখা হইয়াছে : “যে সকল ছাত্রেরা এখন পুতুল পূজার ন্যায় অপবিত্র গর্হিত আচরণে অভ্যস্ত তাহারা এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রভাবে ভগবান ও তাঁহার প্রেরিত যীশু সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করিবে।”
মিশনারী বালিকা বিদ্যালয়গুলিতেও প্রকাশ্যে খ্রীষ্টধর্ম শিক্ষা দেওয়া হইত। হিন্দু ছাত্রীদের অন্নপূর্ণা, বিষ্ণুপ্রিয়া প্রভৃতি নামের উল্লেখ করিয়া একজন মন্তব্য করিয়াছেন, “ব্যভিচারিণী, ইন্দ্রিয়পরায়ণা যেসব কাল্পনিক দেবীর ক্রুরতা ও কামুকতার কুৎসিত কাহিনী হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থেই লিপিবদ্ধ আছে তাহাদের নামে পিতামাতা যে সন্তানদের নাম রাখিয়াছেন তাহাদের সৎ আচরণ কিরূপে প্রত্যাশা করা যায়।”২২
মিশনারীরা যে ছলে বলে তরুণ বালকদিগকে খ্রীষ্টান করিতেন এরূপ অভিযোগ সে-সময়কার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইত। ১২৪০ সালের ২৪শে আষাঢ় (১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ৬ জুলাই) তারিখের ‘সমাচার চন্দ্রিকায় এক পত্রপ্রেরক লিখিয়াছেন যে তাঁহার পুত্র তাঁহাকে না-জানাইয়া মিশনারী স্কুলে পড়িতেছে এই সংবাদ পাইয়া তিনি পুত্রকে বাড়ীতে আটকাইয়া রাখিয়াছিলেন। পরবর্তী ঘটনা সম্বন্ধে তাঁহার উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি :
“কিঞ্চিকাল পরে জাতিভ্রষ্ট অপকৃষ্ট কৃষ্টা বান্দা নামক পাতিফিরিঙ্গি একজন গত স্নানযাত্রার দিবসে আমার বনহুগলীর বাটীতে যাইয়া ঐ চৌদ্দ বৎসর বয়স্ক বালককে ছল করিয়া আনিয়া বগীগাড়ীতে আরোহণ করাইল। বালক শিক্ষকের বশীভূত হইয়া তৎসমভিব্যাহারে গেল তকালে আমার গৃহে পুরুষমাত্র ছিল না। কিন্তু যখন কলিকাতাভিমুখে বগী চালাইতে লাগিল তখন বালক চীৎকার ধ্বনি করিয়া গ্রামের লোককে কহিল তোমরা আমার পিতাকে সংবাদ দিবা আমাকে কেষ্টা বান্দা ধরিয়া লইয়া যায়। তৎপরে কএক দিবস আমি তত্ত্বকরত ঐ পাঠশালায় আছে জানিতে পারিয়া বাটীমধ্যে প্রবিষ্ট হওনের চেষ্টা করিলাম। কোনমতে প্রবিষ্ট হইতে পারিলাম না। পরে পোলীসে নালিস করিলাম ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহাতে মনোযোগ করিলেন না। ফলতঃ আমার বালককে ছাড়িয়া দিতে হুকুম দিলেন না।”
পত্রপ্রেরক ইহার পরে লিখিয়াছেন যে মিশনারীরা এইপ্রকার দৌরাত্ম করিতেছে–এবং এইরূপ আরও যে চারিটি বালককে অপহরণ করিয়া খ্রীষ্টান করিয়াছে তাহাদের নাম ও পরিচয় দিয়া হিন্দুদিগকে মিশনারী দমনের চেষ্টা করিতে উপদেশ দিয়াছেন।২৩
মিশনারী ডাফ সাহেব তাঁহার যে-গ্রন্থে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে পূর্বোল্লিখিত নিন্দাবাদ করিয়াছিলেন, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তাহার তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়। ডাফ স্কুলের একজন ছাত্র ও তাহার স্ত্রী খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করায় কলিকাতার তুমুল আন্দোলন হয় এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে হিন্দুগণ এইপ্রকার বলপূর্বক খ্রীষ্টান করার বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হয়। তাঁহাদের চেষ্টা অনেকটা সফল হয় এবং বলপূর্বক খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা দিবার দৃষ্টান্ত অনেক কমিয়া যায়। মিশনারীদের বিদ্যালয়গুলিই এইরূপ ধর্মান্তর গ্রহণের প্রধান কেন্দ্রস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল। এইজন্য হিন্দুরা ইংরাজীশিক্ষার জন্য সচেষ্ট হইল। ইহার ফলে ১৮৪৫ সনে একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হইল। সহস্রাধিক হিন্দু ছাত্র এখানে বিনাবেতনে পড়িতে পারিত।
কিন্তু এই সমুদয় অপচেষ্টাসত্ত্বেও উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের উপর খ্রীষ্টধর্ম বিশেষ কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। সাধারণত আদিবাসী ও অস্পৃশ্য জাতির লোকেরাই দলে দলে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করিত। ইহার কারণ সহজেই অনুমান করা যাইতে পালে। হিন্দুসমাজে যাহাদের ঘৃণিত জীবন যাপন করিতে হইত, খ্রীষ্টান হইলে তাহাদের যে কেবল সামাজিক উন্নতি হইত তাহা নহে; তাহারা বিনাবেতনে বিদ্যালয়ে পড়িত, অনেকে বিনামূল্যে খাদ্য বস্ত্র প্রভৃতি পাইত। হাসপাতালে ও প্রসূতি সদনে বিনাখরচায় চিকিৎসা এবং অন্যান্য নানারকমের যথেষ্ট সুবিধা ভোগ করিত। ইউরোপ ও আমেরিকা হইতে প্রচুর অর্থ আসিত। মিশনারীদের মধ্যে অনেক যোগ্য লোকের নিঃস্বার্থ চেষ্টায় ফলে মিশনারী প্রতিষ্ঠানগুলি এদেশের আদর্শস্থানীয় হইয়া উঠিয়াছিল। যীশুখ্রীষ্টের প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাস অপেক্ষা এই সমুদয় ঐহিক সুবিধাই সাধারণ লোককে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের প্রতি বেশী আকর্ষণ করিত।
খ্রীষ্টধর্মের দীক্ষিত উচ্চবর্ণের বাঙ্গালীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় হইলেও খ্রীষ্টধর্মের প্রধান প্রধান নীতি ও আদর্শ যে বাঙ্গালী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ইংরাজীশিক্ষা প্রবর্তনের অব্যবহিত পরেই পাশ্চাত্ত্য খ্রীষ্টীয় সমাজের অনেক রীতিনীতি যে বাঙ্গালী যুবকেরা গ্রহণ করিয়াছিল তাহা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিবৃত হইয়াছে। ইহার মধ্যে দূষণীয় অনেক কিছু থাকিলেও স্থায়ী শুভ ফলও উপেক্ষণীয় নহে। ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমত–একেশ্বরবাদ, পৌত্তলিক পূজার বিরোধিতা, সামাজিক উদার নীতি-স্ত্রীশক্ষা, জাতিভেদ লোপ, বহুবিবাহে বিমুখতা, ধর্মের সহিত সামাজিক সংস্কারের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ, শাস্ত্রসম্মত হইলেও কুসংস্কার ও যুক্তিহীন আচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রভৃতি নানা বিষয়ে খ্রীষ্টধর্ম ও সমাজের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। পরবর্তীকালে সাধারণ হিন্দুদের মধ্যেও ইহার প্রসারে ব্রাহ্মধর্মের ও সমাজের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং খ্রীষ্টধর্মের ও সমাজের অপ্রত্যক্ষ প্রভাব তুল্যরূপেই বিদ্যামান। কেশবচন্দ্র সেন যে খ্রীষ্টধর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।
খ্রীষ্টীয় মিশনারী অপেক্ষা ইংরাজীসাহিত্য বাংলায় খ্রীষ্টধর্মের প্রভাব বিস্তারে বেশী সহায়তা করিয়াছে। ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অপেক্ষা শেক্সপীয়র (Shakespeare), মিলটন, পোপ, টেনিসন, অ্যাডিসন প্রভৃতি ইংরেজী সাহিত্যিকগণের রচনার মধ্যদিয়া বাঙ্গালীরা খ্রীষ্টীয় ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কারের সহিত অধিকতর ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইয়াছে। সাধারণভাবে মিশনারীরা হিন্দুধর্মের সম্বন্ধে যে নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করিত, পূর্বে তাহা বলা হইয়াছে। কিন্তু পাদ্রীদের মধ্যেও অনেক সদাশয় মহানুভব লোক ছিলেন। ঊনবিংশ শতকের প্রথমভাগে কেরী, মধ্যভাগে লং সাহেব এবং বিংশশতকে অ্যাস ও আরও অনেকের নাম করা যাইতে পারে। ইঁহাদের জীবনী ও চরিত্র খ্রীষ্টধর্মকে মহিমান্বিত করিয়াছে।
৩. হিন্দুধর্ম
(ক) ব্রাহ্ম ও খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
একদিকে খ্রীষ্টীয় ধর্মপ্রচারকগণ, আর একদিকে ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের সম্বন্ধে যে সমুদয় তীব্র নিন্দাসূচক মন্তব্য সমালোচনা করেন তাহার বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে তীব্র আন্দোলন উপস্থিত হয়। এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য, যাহাতে লোকে এইসকল নিন্দাবাদে বিভ্রান্ত হইয়া হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ এবং ব্রাহ্ম বা খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ না করে, তাহার জন্য নিন্দুকের সমালোচনার অসার প্রতিপাদন করিয়া হিন্দুধর্মের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হইয়া একদল লোক প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন যে, হিন্দুধর্ম ব্রাহ্ম বা খ্রীষ্টান ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং ইহার মধ্যে দূষণীয় কিছুই নাই। ইহাদের মধ্যে কাহারও কাহারও যুক্তি ও উক্তি অতিশয় হেয় ও অসার। কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন শ্রোতাদিগকে বলিতেন যে-দেখ, খ্রষ্টানদের ঈশ্বর প্রতিবাচক শব্দ God, উল্টাদিক হইতে পড়িলে হয় dog অর্থাৎ কুকুর; কিন্তু হিন্দুর দেবতা নন্দনন্দন ডাহিন বা বাম হইতে পড়-উভয়ই এক। ইহাদের অপেক্ষা কিছু উন্নতস্তরের প্রতিবাদকারীদের মধ্যে শশধর তর্কচূড়ামণির নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। তিনি হিন্দুদের মূর্তিপূজা, জাতিভেদ ও অন্যান্য যে সমুদয় ধর্ম ও সামাজিক অনুষ্ঠান ব্রাহ্ম ও খ্রীষ্টানদের প্রধান আক্রমণের লক্ষ্য, সে সমুদয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতেন। এই শ্রেণীর সমালোচকদের উদ্দেশ্যেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ব্যঙ্গ করিয়া লিখিয়াছিলেন : “টিকিতে electricity নাই, if you think তাহলে you are an awful goose.” অর্থাৎ তুমি যদি একথা না মান যে (ব্রাহ্মণের মাথার) টিকির মধ্যদিয়া বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তাহলে তুমি একটি বোকচন্দ্র।
এইরূপ যুক্তিতর্ক বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও গোলদীঘিতে আমি ছাত্রাবস্থায় নিজে শুনিয়াছি। যথা, “বেদে যে ত্রিতারং শব্দ আছে তাহার প্রকৃত অর্থ তিনটি তারের মধ্যদিয়া বিদ্যুৎশক্তির তিন রূপের প্রকাশpositive, negative, neutral”। যুক্তি হিসাবে এইসকল উক্তি মূল্যহীন হইলেও সাধারণ লোকের মনে ইহার ফলে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে খুব উচ্চধারণা জন্মিত।
কিন্তু, সে-যুগের অনেক চিন্তাশীল ও পণ্ডিত ব্যক্তিরাও হিন্দুধর্মের সম্বন্ধে প্রচলিত বহু নিন্দাবাদ অযৌক্তিক ও অজ্ঞানতাপ্রসূত বলিয়াই মনে করিতেন। তাহারা প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থাদি হইতে হিন্দুধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা দ্বারা ইহার নিরসন করিতে যত্নবান হইতেন। ইহাদের মধ্যে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শিক্ষাবিদ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলার সাহিত্যজগতে নূতন শ্রেণীর উপন্যাস এবং বাংলাভাষায় এক অভিনব সুললিত রচনারীতির প্রবর্তন করিয়া অমর কীর্তি অর্জন করিয়াছিলেন। এ-বিষয় নবম অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইবে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে তিনি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মতভাবেও ঐতিহাসিক প্রণালীতে হিন্দুধর্মশাস্ত্র আলোচনায় প্রবৃত্ত হন। ইহার ফলে তিনি ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থ ও ভগবদ্গীতার ব্যাখ্যা রচনা করিয়া হিন্দুধর্মের উপর নূতন আলোকপাত করেন। কিন্তু এইদিক দিয়া দেখিতে গেলে তাঁহার ‘কৃষ্ণ চরিত্র সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। হিন্দুগণের বিশ্বাস, শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের পূর্ণ অবতার এবং তাহার জীবনকাহিনী ও ধর্মমত সাধারণ হিন্দুর ধর্ম, বিশ্বাস ও সংস্কারের এক বিরাট অংশকে প্রভাবান্বিত করিয়াছে। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কাহিনী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের এবং বৈষ্ণব ধর্মমতের প্রধান উপজীব্য। রাধা ও অন্যান্য গোপবধূর সহিত কৃষ্ণের কামকেলির বহু আদিরসাশ্রিত কাহিনী খ্রীষ্টান ও ব্রাহ্ম ধর্মপ্রচারকগণের হস্তে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে অমোঘ অস্ত্ররূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। এই সমুদয় অপবাদ ও কৃষ্ণের সম্বন্ধে অন্যান্য অলৌকিক কাহিনীর-যে কোন প্রকৃত ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই–ইহা প্রমাণিত করিবার জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র ‘কৃষ্ণ চরিত্র রচনা করেন। এই গ্রন্থ রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র যে পাণ্ডিত্য, অধ্যবসায় ও সূক্ষ্ম ঐতিহাসিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়াছেন, সে-যুগের পক্ষে তাহা সত্যসত্যই বিস্ময়কর। তাঁহার এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য তিনি নিম্নলিখিত ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন :
“কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং।….কিন্তু ইহারা ভগবানকে কি রকম ভাবেন? ভাবেন, ইনি বাল্যে চোর-ননী মাখন চুরি করিয়া খাইতেন; কৈশোরে পারদারিক-অসংখ্য গোপনারীকে পাব্ৰিত্য ধর্ম হইতে ভ্রষ্ট করিয়াছিলেন; পরিণত বয়সে বঞ্চক শঠ-বঞ্চনার দ্বারা দ্রোণাদির প্রাণহরণ করিয়াছিলেন; ভগবচ্চরিত্র কি এইরূপ? যিনি কেবল শুদ্ধসত্ত্ব, যাহা হইতে সর্বপ্রকার শুদ্ধি, যাহার নামে অশুদ্ধি, অপুণ্য দূর হয়, মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়া সমস্ত পাপাঁচরণ কি সেই ভগবচ্চরিত্র-সঙ্গত?….
“ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যথার্থ কিরূপ চরিত্র পুরাণেতিহাসে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা জানিবার জন্য আমার যতদূর সাধ্য আমি পুরাণ ইতিহাসের আলোচনা করিয়াছি। তাহার ফল এই পাইয়াছি যে, কৃষ্ণসম্বন্ধীয় যে সকল পাপোপাখ্যান জনসমাজে প্রচলিত আছে, তাহা সকলই অমূলক বলিয়া জানিতে পারিয়াছি এবং উপন্যাসকারকৃত কৃষ্ণসম্বন্ধীয় উপন্যাসসকল বাদ দিলে যাহা বাকি থাকে, তাহা অতি বিশুদ্ধ, পরম পবিত্র, অতিশয় মহৎ, ইহা জানিতে পারিয়াছি। জানিয়াছি ঈদৃশ সৰ্ব্বগুণান্বিত সৰ্ব্বপাপসংস্পর্শ-শূন্য, আদর্শ চরিত্র আর কোথাও নাই। কোন দেশীয় ইতিহাসেও না, কোন দেশীয় কাব্যেও না।”
বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ইংরেজীশিক্ষায় শিক্ষিত প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের এই উক্তি এবং একখানি বৃহদাকার গ্রন্থে যুক্তিতর্কদ্বারা তাহা প্রতিপন্ন করা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে যে কতদূর সহায়ক হইয়াছিল তাহা আজ আমাদের পক্ষে ধারণা করা দুরূহ। শিক্ষিত হিন্দুমাত্রেই ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টান প্রভৃতির অপপ্রচারে ও কুৎসায় নিজেদের ধর্ম প্রকাশ্যে সমর্থন করিতে কুণ্ঠাবোধ করিতেন। কারণ, সাধারণ অশিক্ষিত লোকের ন্যায় যুক্তিতর্কের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র সংস্কার ও বিশ্বাসকে আঁকড়াইয়া ধরা, তাঁহাদের মার্জিত বুদ্ধিবৃত্তি অনুমোদন করিত না। সুতরাং যেরূপ যুক্তিতর্কের উপর নির্ভর করিয়া হিন্দুবিদ্বেষিগণ হিন্দুধর্মের কুৎসা ও নিন্দা করিত, সেইরূপ যুক্তিতর্কের সাহায্যেই এই সমুদয় অপবাদ নিরাকৃত করিয়া, হিন্দুর উপাস্য দেবতা কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনপূর্বক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাদিগকে স্বীয় ধর্মের গৌরব প্রত্যক্ষ করাইয়া, স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে সাহায্য করিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র যদিও কেবলমাত্র কৃষ্ণচরিত্রের আলোচনা করিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহারই প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করিয়া এ পর্যন্ত যাহা কিছু হিন্দুধর্মের গ্লানি বলিয়া বিবেচিত ও প্রচারিত হইত, তাহা খণ্ডন করিবার জন্য প্রতিবাদ আরম্ভ হইল। বস্তুত একটু অনুধাবন করিলে সহজেই প্রতীতি হইবে যে, রামমোহন রায়ের ও বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মান্দোলনের মধ্যে প্রণালীর কোন বিশেষ প্রভেদ ছিল না। উভয়েই প্রচলিত ধর্ম, বিশ্বাস ও সংস্কারকে অন্ধভাবে মানিয়া না লইয়া যুক্তিতর্কের সাহায্যে তাহার সত্যতা নিরূপণ করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন। কিন্তু দুইজনের সিদ্ধান্ত ছিল একেবারে বিপরীত। রামমোহন একমাত্র বেদ-বেদান্তকেই প্রামাণিক বলিয়া গ্রহণ করিলেন এবং পরবর্তীকালে যে পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভব হইয়াছিল তাহা অসার বলিয়া অগ্রাহ্য করিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র প্রতিপন্ন করিলেন যে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম বর্জনীয় নহে, তাহার মধ্যেও হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতার লক্ষণ আছে। দুইজনেই বহু কুসংস্কার ও কদাচার বিসর্জন করিয়া বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম কী, তাহার নিরূপণে যত্নবান হইয়াছিলেন। কিন্তু এই কলুষতাবর্জিত সত্য হিন্দুধর্ম কী সে-সম্বন্ধে তাঁহারা বিপরীত মত প্রচার করিলেন। পরবর্তীকালে-যে হিন্দুসমাজ রামমোহনের পরিবর্তে বঙ্কিমচন্দ্রকেই অনুসরণ করিয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহা হইতে এই সিদ্ধান্ত করিলে ভুল হইবে যে, বঙ্কিমচন্দ্রের যুক্তি অবিসংবাদিতরূপে রামমোহনের যুক্তি অপেক্ষা অধিকতর সঙ্গত ও গ্রহণীয়। প্রকৃত কারণ এই যে, বঙ্কিমচন্দ্রের সিদ্ধান্ত ছিল হিন্দুর বিশ্বাস ও সংস্কারের অনুকূল এবং রামমোহনের সিদ্ধান্ত ছিল তাহার প্রতিকূল। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মানুসারেই হিন্দুসম্প্রদায় বঙ্কিমচন্দ্রের মত গ্রহণ করিল এবং ব্রাহ্ম ও খ্রীষ্টধর্ম বাংলা দেশে প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিল না। হিন্দুধর্ম জয়লাভ করিলেও এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের অবান্তর ফল অর্থাৎ সংস্কার ও বিশ্বাসের উপর যুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার প্রভাব-শিক্ষিত হিন্দুর মনে ও হৃদয়ে যে গভীর রেখাপাত করিয়াছিল তাহা হিন্দুর ধর্ম ও বিশ্বাসে ক্রমশই গুরুতর পরিবর্তন আনয়ন করিল। বিংশ শতাব্দীর হিন্দুধর্ম ও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের হিন্দুধর্ম–উভয়ের মধ্যে গুরুতর ব্যবধান সহজেই পরিলক্ষিত হইবে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচার ব্যতীত আরও কয়েকটি কারণে ইহা ঘটিয়াছিল। ইহার মধ্যে দুইটি প্রধান। প্রথমত, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের অভ্যুদয়; দ্বিতীয়ত, ভারতে থিওসফি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা।
এই দুইটি সম্প্রদায়ের আলোচনার পূর্বে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, বর্তমানকালের বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহাসিকত্ব প্রমাণের চেষ্টা করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুধর্মে কৃষ্ণ ও ভগবদ্গীতার স্থান বহু উচ্চে প্রতিষ্ঠিত করেন। খ্রীষ্টান মিশনারীরা বলিত যে, এই নব-কৃষ্ণ আন্দোলনের ফলে বাঙ্গালীরা কৃষ্ণকে খ্রীষ্টের এবং গীতাকে বাইবেলের আসন দিয়াছে। ১৯০২ সনে প্রেমানন্দ ভারতী নামে একজন বাঙ্গালী আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের নানা স্থানে কৃষ্ণসম্বন্ধে বক্তৃতা করেন এবং লজ এঞ্জেলসে (Los Angeles) একটি হিন্দু মন্দির স্থাপিত করেন।
(খ) শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস
পরবর্তীকালে যিনি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস নামে বিশ্ববিখ্যাত হইয়াছিলেন বাল্যকালে তাহার নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। ১৮৩৬ সনে হুগলী জিলার অন্ত গত কামারপুকুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণগৃহে তাঁহার জন্ম হয়। বাল্যকালে তাঁহার লেখাপড়ায় বিশেষ মন ছিল না, সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষার পরে আর বেশীদূর অগ্রসর হন নাই। তাঁহার অগ্রজ রামকুমার এ-বিষয়ে তাঁহাকে ভর্ৎসনা ও অনুযোগ করিলে তিনি বলিয়াছিলেন : “চালকলা-বাঁধা বিদ্যা আমি শিখিতে চাহি না; আমি এমন বিদ্যা শিখিতে চাহি যাহাতে জ্ঞানের উদয় হইয়া মানুষ বাস্তবিক কৃতার্থ হয়।” অগ্রজ রামকুমার ১৭ বৎসর বয়সে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে কলিকাতায় আনিয়া নিজের টোলে শিক্ষা দিতেন এবং কয়েকটি গৃহে দেবসেবা করিয়া কিছু আয়ের জন্য ঐ কার্যে নিযুক্ত করেন। ইহার কিছুকাল পরে কলিকাতার প্রসিদ্ধ জমিদার রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে একটি কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন (১২৬২ সাল, ১৮ই জ্যৈষ্ঠ; ১৮৫৫ সন ১৯শে মে)। কথিত আছে, এই উপলক্ষে রাণী নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন এবং ২,২৬,০০০ টাকায় একটি পরগণা কিনিয়া দেবসেবার জন্য দান করিয়াছিলেন। রামকুমার এই মন্দিরের প্রথম পূজক নিযুক্ত হইলেন। তাঁহার পরে গদাধর ঐ কার্যে নিযুক্ত হন।
লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ না থাকিলেও বাল্যকাল হইতেই গদাধর সাধু সন্ন্যাসীর প্রতি আসক্ত ছিলেন। কামারপুকুর গ্রামের পাশ দিয়াই পুরীধাম যাইবার পথ। সুতরাং বহু সাধু, ফকির, বৈরাগী প্রভৃতির সহিত তাঁহার মিশিবার সুযোগ হইত। গদাধর তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করিয়া তাহাদের আচার-ব্যবহার লক্ষ করিতেন। কথিত আছে, বাল্যকাল হইতেই তাহার ভাবাবেশ হইত। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই বর্ণনা করিয়াছেন যে, ছয়-সাত বছর বয়সে একদিন মুড়ি খাইতে খাইতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের গায়ে একঝাঁক সাদা বক দেখিয়া “অপূৰ্ব্বভাবে তন্ময় হয়ে এমন একটা অবস্থা হলো যে, আর হুঁশ রইলো না। কতক্ষণ এভাবে পড়ে ছিলাম বলতে পারি না, লোকে ধরাধরি করে বাড়ী নিয়ে এসেছিল। সেই প্রথম ভাবে বেহুশ হয়ে যাই।”২৪
আট বৎসর বয়সের সময় অনেক স্ত্রীলোকের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির দেখিতে যাওয়ার পথে গদাধর উক্ত দেবীর মহিমা কীর্তন “করিতে করিতে সহসা থামিয়া গেল, তাঁহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গাদি অবশ আড়ষ্ট হইয়া গেল, চক্ষে অবিরল জলধারা বহিতে লাগিল।” ব্যজন, মস্তকে জলসেক প্রভৃতি বহুরকমের চেষ্টায়ও যখন বালকের জ্ঞানসঞ্চার হইল না, তখন স্ত্রীলোকেরা আকুল হইয়া বিশালাক্ষী দেবীর আশীর্বাদের জন্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন এবং বালকের সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল, কিন্তু শরীরে কোনরূপ অবসাদ বা দুর্বলতা দেখা গেল না।
দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পূজক নিযুক্ত হইবার পর গদাধরের হৃদয়ে অপূর্ব ভগবদ্ভক্তির উচ্ছ্বাস প্রবাহিত হইল। স্বামী সারদানন্দ লিখিয়াছেন :
“তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছি, এই সময়ে যথারীতি পূজা সমাপনান্তে দেবীকে নিত্য রামপ্রসাদ প্রমুখ ভক্তদিগের রচিত সঙ্গীতসমূহ শ্রবণ করান তিনি পূজার অঙ্গবিশেষ বলিয়া গণ্য করিতেন। হৃদয়ের গভীর উচ্ছ্বাসপূর্ণ ঐ সকল গীত গাহিতে গাহিতে তাঁহার চিত্ত উৎসাহপূর্ণ হইয়া উঠিত। ভাবিতেন–রামপ্রসাদ প্রমুখ ভক্তেরা মা’র দর্শন পাইয়াছিলেন; জগজ্জননীর দর্শন তবে নিশ্চয়ই পাওয়া যায়, আমি কেন তবে তাঁহার দর্শন পাইব না? ব্যাকুল হৃদয়ে বলিতেন-”মা তুই রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, আমায় তবে কেন দেখা দিবি না? আমি ধন জন ভোগ সুখ কিছুই চাহি না, আমায় দেখা দে।’ ঐরূপ প্রার্থনা করিতে করিতে নয়নধারায় তাঁহার বক্ষ ভাসিয়া যাইত….দেবীর পূজা ও সেবা সম্পন্ন করিবার নির্দিষ্ট কালও এই সময় হইতে তাঁহার দিন দিন বাড়িয়া যাইতে লাগিল।…দিনের পর যত দিন যাইতে লাগিল ঠাকুরের মনে অনুরাগ, ব্যাকুলতাও তত বৃদ্ধি পাইতে লাগিল…।২৫
“তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছি, এই সময় একদিন তিনি জগদম্বাকে গান শুনাইতেছিলেন এবং তাহার দর্শনলাভের জন্য নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া প্রার্থনা ও ক্রন্দন করিতেছিলেন। বলিতেছিলেন, “মা, এত যে ডাচি তার কিছুই কি তুই শুনচি না? রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েচিস, আমাকে কি দেখা দিবি না?
“তিনি বলিতেন–মার দেখা পাইলাম না বলিয়া তখন হৃদয়ে অসহ্য যন্ত্রণা। …যন্ত্রণায় ছটফট করিতে লাগিলাম। অস্থির হইয়া ভাবিলাম তবে আর এ জীবনে আবশ্যক নাই। মার ঘরে যে অসি ছিল দৃষ্টি সহসা তাহার উপর পড়িল। এই দণ্ডেই জীবনের অবসান করিব ভাবিয়া উন্মত্তপ্রায় ছুটিয়া উহা ধরিতেছি এমন সময়ে সহসা মা’র অদ্ভুত দর্শন পাইলাম ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া গেলাম। তাহার পর বাহিরে কি যে হইয়াছে, কোন্দিক দিয়া সেদিন ও তৎপরদিন যে গিয়াছে তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই! অন্তরে কিন্তু একটা অননুভূতপূর্ব জমাট বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছিলাম।২৬
“ইহার পরেও তিনি শ্রীশ্রীজগদম্বার চিন্ময়ী মূর্তির অবাধ অবিরাম দর্শনের জন্য ব্যাকুল হইয়া ক্রন্দন করিতেন। সময় সময় অসহ্য যন্ত্রণায় বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িতেন এবং তার পরেই দেখিতেন, ‘মার বরাভয়করা চিন্ময়ী মূৰ্ত্তি। তিনি বলিতেন, ‘দেখিতাম ঐ মূৰ্ত্তি হাসিতেছে, কথা কহিতেছে, অশেষ প্রকারে সান্ত্বনা ও শিক্ষা দিতেছে।
“ইহার পর জগদম্বার ধ্যানে ঠাকুর এত বিভোর হইয়া থাকিতেন যে, নিয়মিত পূজার কার্যও তাঁহার দ্বারা সম্ভবপর হইল না। পূজা করিতে বসিয়া অদ্ভুত আচরণ করিতেন। জবাবিলের অর্ঘ্য প্রথমে নিজের মাথা, বুক, এমনকি পায়ে পর্যন্ত ছোঁয়াইয়া পরে কালীমূর্তির চরণে দিতেন–পুজার আসন ত্যাগ করিয়া সিংহাসনের উপর উঠিয়া সস্নেহে দেবীমূর্তির চিবুক ধরিয়া আদর, গান, পরিহাস বা কথোপকথন করিতেন, অথবা শ্রীমূর্তির হাত ধরিয়া নৃত্য করিতেন। ভোগ নিবেদনের সময় অন্নব্যঞ্জনের কিয়দংশ নিজে গ্রহণ করিয়া অবশিষ্ট অংশ মার মুখে দিতেন।”
তাঁহার বাহ্যিক আচরণও মাঝে মাঝে অদ্ভুত বলিয়া মনে হইত। অবশেষে ইহা চরমে পৌঁছিল। একদিন রাণী রাসমণি মন্দিরে পূজা দিবার সময় ঠাকুরসঙ্গীত করিতেছিলেন, কিন্তু রাণী বিষয়-সংক্রান্ত একটি গুরুতর মামলার বিষয় ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনস্কা হইয়া পড়েন, পূজা বা সঙ্গীত কোনদিকেই তাঁহার মত ছিল না। ভাবাবিষ্ট ঠাকুর ইহা বুঝিতে পারিয়া তাহার গণ্ডদেশে চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন, “এখানেও ঐ চিন্তা”। কর্মচারিগণ ভীত ও বিহ্বল হইয়া ভাবিল, ভট্টাচার্যের মন্দিরে পূজারীগিরি আজই শেষ হইল। রাণী কুদ্ধা না হইয়া নিজের ত্রুটির জন্য অনুতপ্তা হইলেন এবং ঠাকুরের প্রতি তাঁহার ভক্তি বৃদ্ধি পাইল।২৭ কিন্তু তাঁহার জামাতার সন্দেহ হইল যে ঠাকুরের মস্তিষ্ক কিছু বিকৃত হইয়াছে। তিনি চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে কলিকাতার প্রসিদ্ধ কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেনের নিকট পাঠাইলেন। কবিরাজ বলিলেন, “ইনি উন্মাদ বটে–তবে দিব্যোন্মাদ। এ রোগ আমাদের চিকিৎসার বাহিরে।” এই ঘটনার কাল ১৮৫৮ সন। ইহার পরে ঠাকুর দেবীপূজার কার্য ছাড়িয়া দিয়া পরবর্তী আট বৎসরকাল নানারকম সাধনকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। এক ভৈরবীর নিকট শিক্ষালাভ করিয়া প্রথম চারি বৎসর তন্ত্র-নির্দিষ্ট সাধনসকল যথাবিধি অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। পরবর্তী চারি বৎসরে তিনি জটাধারী নামে এক রামাইত সাধুর নিকট হইতে রাম-মন্ত্রে উপদিষ্ট ও বাৎসল্যভাব সাধনে সিদ্ধ হন, বৈষ্ণব তন্ত্রোক্ত মধুর ভাবে সিদ্ধিলাভের জন্য ছয়মাসকাল স্ত্রীবেশ ধারণ করিয়া থাকেন; আচার্য শ্রীতোতাপুরীর নিকট হইতে সন্ন্যাস গ্রহণপূর্বক বেদান্ত সাধনদ্বারা এক দিনে সমাধির নির্বিকল্প ভূমিতে আরোহণ করেন। বেদান্তোক্ত জ্ঞানমার্গের চরম ফল নির্বিকল্প সমাধি। ঠাকুরের এই সমাধি। অবস্থা দেখিয়া তোতাপুরী “স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন–চল্লিশ বৎসরব্যাপী কঠোর সাধনায় যাহা জীবনে উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইয়াছি, তাহা কি এই মহাপুরুষ সত্যসত্যই এক দিবসে আয়ত্ত করিলেন!”২৮ অদ্বৈত ভাবভূমিতে আরূঢ় হইয়া ঠাকুর উপলব্ধি করিলেন যে, ইহাই ভারতের প্রচলিত প্রধান প্রধান সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের সাধন-ভজনের চরম উদ্দেশ্য। উহারা প্রত্যেকেই সাধককে উক্ত ভূমির দিকে অগ্রসর করে। তিনি ভক্তগণকে বারংবার বলিতেন : “জানিবি সকল মতেরই উহা শেষ কথা এবং যত মত তত পথ”। এইরূপ ধর্মবিষয়ে উদারতার ফলে তিনি ইসলামধর্মে দীক্ষিত গোবিন্দ রায়ের নিকট যথাবিধি ইসলামধর্মসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। ঠাকুর বলিতেন, “ঐ সময়ে ‘আল্লা’ মন্ত্র জপ করিতাম, ত্রিসন্ধ্যা নামাজ পড়িতাম এবং হিন্দু দেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না। ঐভাবে তিন দিবস অতিবাহিত হইবার পরে ঐ মতের সাধনফল সম্যক হস্তগত হইয়াছিল।”২৯ ইহা ছাড়াও তিনি বৈষ্ণবতন্ত্রোক্ত সখ্যভাবের এবং কর্তাভজা, নবরসিক প্রভৃতি বৈষ্ণব মতের অবান্তর সম্প্রদায় সকলের সাধনমার্গের সহিতও পরিচিত হইয়াছিলেন।
ইহার কিছুকাল পরে শম্ভুচরণ মল্লিকের নিকট যীশুখ্রীষ্টের (ঈশার) জীবনী ও ধর্মমত শুনিয়া এবং মাতৃকোলে শিশু যীশুর মূর্তি দেখিয়া তাহার সম্বন্ধে ধ্যান করিতে লাগিলেন। তিনদিন পর্যন্ত তিনি এইভাবে এরূপ বিভোর ছিলেন যে মন্দিরেও যান নাই। তৃতীয় দিনের শেষে তিনি পঞ্চবটীতলে বেড়াইতে বেড়াইতে অনুভব করিলেন, সৌম্যমূর্তি এক দেবমানব তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া তাঁহার শরীরে লীন হইলেন। “ঐরূপে শ্রীশ্রীঈশার দর্শন লাভ করিয়া ঠাকুর তাঁহার অবতারত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দিগ্ধ হইয়াছিলেন।”৩০
শ্রীবুদ্ধদেবকে ঠাকুর ঈশ্বরের অবতার বলিয়া শ্রদ্ধা ও পূজা করিতেন এবং বলিতেন, তৎপ্রবর্তিত মতে এবং বৈদিক জ্ঞানমার্গে কোন প্রভেদ নাই। জৈনধর্ম প্রবর্তক তীর্থঙ্করদের এবং গুরু নানক হইতে আরম্ভ করিয়া গুরু গোবিন্দ পর্যন্ত দশজন শিখগুরুর অনেক কথা পরজীবনে জৈন ও শিখদের নিকট হইতে শুনিয়া ঐ দুই সম্প্রদায়ের প্রতি ঠাকুরের বিশেষ ভক্তি-শ্রদ্ধার উদয় হইয়াছিল। অন্যান্য দেবদেবীর চিত্রের সঙ্গে তাঁহার ঘরে মহাবীর তীর্থঙ্করের একটি প্রস্তরমূর্তি এবং যীশুখ্রীষ্টের একখানি ছবি ছিল। প্রত্যহ প্রাতে ও সন্ধ্যায় এই সকল ছবি ও মূর্তির সম্মুখে ধূপ-ধুনা দিতেন।৩১
এইরূপে বিভিন্ন ধর্মমতের সাধনে সিদ্ধি ও বহু ধর্মমতের পরিচয় লাভ করিয়া ঠাকুরের দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল “সর্ব ধর্ম সত্য-যত মত তত পথ মাত্র।”৩২ তাঁহার ধর্মমতের ইহা একটি প্রধান ও শ্রেষ্ঠ উক্তি এবং বর্তমান যুগে এটি একটি মহান আদর্শ। তাঁহার একজন ভক্ত এই প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন :
“সকল প্রকার ধর্মমতের সাধনায় অগ্রসর হইয়া তিনি উহাদিগের প্রত্যেকের যথার্থ ফল জীবনে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। যুগাবতার ঠাকুরের উহা প্রচারপূর্বক পৃথিবীর ধর্মবিরোধ ও ধৰ্ম্মগ্লানি নিবারণের জন্যই যে বর্তমান কালে আগমন, এ কথা বুঝিতে বিলম্ব হয় না। কারণ, কোন ঈশ্বরাবরই ইতঃপূৰ্ব্বে সাধনসহায়ে ঐকথা নিজজীবনে পূর্ণ উপলব্ধিপূৰ্ব্বক জগৎকে ঐ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করেন নাই। আধ্যাত্মিক মতের উদারতা লইয়া অবতারসকলের স্থান নির্দেশ করিতে হইলে, ঐ বিষয় প্রচারের জন্য ঠাকুরকে নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চাসন প্রদান করিতে হয়।”৩৩
কিন্তু গীতায় শ্রীকৃষ্ণের উক্তি–”যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্”–যে ইহার বীজস্বরূপ সেকথা অস্বীকার করা যায় না। সমস্ত ধর্মমতের সত্যতা স্বীকার করিলেও বেদান্তের অদ্বৈতভাবই তাঁহার উপর সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। অদ্বৈতভাব–অর্থাৎ সমস্ত জড়জগৎ ও ব্রহ্মের অভিন্নতা এবং তাহার ফলে জীবজন্তু, উদ্ভিদ প্রভৃতি সকলের সহিত একাত্মভাব ঠাকুরের কতদূর অন্তরের পদার্থ ছিল, বহু ঘটনায় তাহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। দুইটি উল্লেখ করিতেছি :
(১) ঘাটে বসিয়া দেখিলেন, দুই নৌকার মাঝিদের মধ্যে কলহের ফলে সবল ব্যক্তি দুর্বলের পৃষ্ঠদেশে বিষম চপেটাঘাত করিল। ঠাকুর চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। তাঁহার ভাগিনেয় আসিয়া দেখিল, তাঁহার পৃষ্ঠদেশ লাল হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে।
(২) নবীন দূর্বাদলে ঢাকা উদ্যানের শোভা ঠাকুর তন্ময় হইয়া দেখিতে দেখিতে উহাকে নিজের অঙ্গ বলিয়া অনুভব করিতেছিলেন এমন সময় এক ব্যক্তি উহার উপর হাঁটিতে লাগিল। ঠাকুর বলেন, “বুকের উপর দিয়া কেহ চলিয়া গেলে যেরূপ যন্ত্রণার অনুভব হয়, ঐ কালে ঠিক সেইরূপ যন্ত্রণা অনুভব করিয়াছিলাম।”৩৪
কিন্তু এই জ্ঞানমূলক বেদান্তের সহিত ভক্তি ও মূর্তিপূজার সমন্বয় ঠাকুরের জীবন ও ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
এই প্রসঙ্গে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি–যাহা গৃহীদিগের পক্ষে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান উপদেশ বলিয়া গৃহীত হইবার যোগ্য। স্বামী সারদানন্দ ইহার যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহাই সংক্ষিপ্ত আকারে উদ্ধৃত করিতেছি :
“১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের কোন সময়ে আমাদিগের জনৈক বন্ধু দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ঠাকুর গৃহমধ্যে ভক্তগণ-পরিবৃত হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রও (ভবিষ্যৎ স্বামী বিবেকানন্দ) সেখানে উপস্থিত। বৈষ্ণব ধর্মের প্রসঙ্গে ঠাকুর বলিলেন যে এই মতের সারমর্ম “নামে রুচি, জীবে দয়া, বৈষ্ণব পূজন।” ইহার ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া বলিলেন, ‘কৃষ্ণেরই জগৎ সংসার একথা হৃদয়ে ধারণা করিয়া সৰ্ব্বজীবে দয়া’-এই পর্যন্ত বলিয়াই তিনি সহসা সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন। কতক্ষণ পরে অর্ধবাহ্যদশায় উপস্থিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, “জীবে দয়া–জীবে দয়া? দূর শালা! কীটাণুকীট-তুই জীবকে দয়া করবি? দয়া কর্বার তুই কে? না না-জীবে দয়া নয়–শিবজ্ঞানে জীবের সেবা।…’
নরেন্দ্রনাথ বাহিরে আসিয়া বলিলেন : কি অদ্ভুত আলোকই আজ ঠাকুরের কথায় দেখিতে পাইলাম। শুষ্ক, কঠোর ও নির্মম বলিয়া প্রসিদ্ধ বেদান্ত-জ্ঞানকে ভক্তির সহিত সম্মিলিত করিয়া কি সহজ সরস ও মধুর আলোকই প্রদর্শন করিলেন? অদ্বৈত জ্ঞান লাভ করিতে হইলে সংসার ও লোকসঙ্গ সর্বতোভাবে বর্জন করিয়া বনে যাইতে হইবে এবং ভক্তি ভালবাসা প্রভৃতি কোমলভাবসমূহকে হৃদয় হইতে সবলে উৎপাটিত করিয়া চিরকালের মত দূরে নিক্ষেপ করিতে হইবে–এই কথাই এতকাল শুনিয়া আসিয়াছি।..কিন্তু ঠাকুর আজ ভাবাবেশে যাহা বলিলেন, তাহাতে বুঝা গেল-বনের বেদান্তকে ঘরে আনা যায়, সংসারের সকল কাজে উহাকে অবলম্বন করিতে পারা যায়। মানব যাহা করিতেছে, সে সকলই করুক তাহাতে ক্ষতি নাই, কেবল প্রাণের সহিত এই কথা সর্বাগ্রে বিশ্বাস ও ধারণা করিলেই হইল-ঈশ্বরই জীব ও জগঞ্জপে তাহার সম্মুখে প্রকাশিত রহিয়াছে। …সংসারের সকল ব্যক্তিকে যদি সে ঐরূপে শিবজ্ঞান করিতে পারে, তাহা হইলে আপনাকে বড় ভাবিয়া তাহাদিগকে প্রতি রাগ, দ্বেষ, দম্ভ, অথবা দয়া করিবার তাহার অবসর কোথায়? ঐরূপে ‘শিবজ্ঞানে জীবের সেবা করিতে করিতে চিত্তশুদ্ধ হইয়া সে স্বল্পকালের মধ্যে আপনাকে চিদানন্দময় ঈশ্বরের অংশ, শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব বলিয়া ধারণা করিতে পারিবে।….
“শিব বা নারায়াণ জ্ঞানে জীবে সেবা করিলে ঈশ্বরকে সকলের ভিতর দর্শনপূর্বক যথার্থ ভক্তিলাভে ভক্ত সাধক স্বল্পকালেই কৃতকৃতার্থ হইবে, একথা বলা বাহুল্য।
“কর্ম না করিয়া দেহী যখন এক দণ্ডও থাকিতে পারে না, তখন ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’-রূপ কর্মানুষ্ঠানই যে কর্তব্য এবং উহা করিলেই তাহারা লক্ষ্যে আশু পৌঁছাইবে, একথা বলিতে হইবে না। যাহা হউক ভগবান যদি কখন দিন দেন ত আজি যাহা শুনিলাম এই অদ্ভুত সত্য সংসারে সর্বত্র প্রচার করিব,পণ্ডিত, মূর্খ, ধনী, দরিদ্র, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, সকলকে শুনাইয়া মোহিত করিব।”৫৩
ভগবান দিন দিয়াছিলেন এবং নরেন্দ্রনাথ এই ভিত্তির উপরই শাখাপ্রশাখা সমন্বিত বিশাল বটবৃক্ষের ন্যায় ভারতের সর্বত্র প্রসারিত রামকৃষ্ণ মিশনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া ঠাকুরের উক্তি ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা এবং তাঁহার প্রবর্তিত এই উক্তিসূচক ‘দরিদ্র-নারায়ণ’ এই শব্দটি ভারতের নব্য হিন্দুধর্মের ইতিহাসে অমর। অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন।
অতি বাল্যকালেই ঠাকুরের বিবাহ হইয়াছিল। বিবাহের পরে চতুর্দশ বৎসর বয়সের সময় শ্রীশ্রীমাতার প্রথম স্বামী সন্দর্শন হয়। তার পরে বহুকাল তাঁহারা কামারপুকুরে ও দক্ষিণেশ্বরে স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় বাস করেন। কিন্তু ঠাকুর তাঁহাকে মাতৃজ্ঞান করিতেন। ঠাকুর বলিতেন, “আমি স্ত্রীলোক মাত্রকেই মা বলে জ্ঞান করি, কারণ স্ত্রীলোক মাত্রেই ভগবতীর অংশ।” ঠাকুরকে বিবাহিত জানিয়া তোতাপুরী তাঁহাকে বলিয়াছিলেন : “তাহাতে আসে যায় কি? স্ত্রী নিকটে থাকিলেও যাঁহার ত্যাগ, বৈরাগ্য, বিবেক, বিজ্ঞান সর্বতোভাবে অক্ষুণ্ণ থাকে সেই ব্যক্তিই ব্রহ্মে যথার্থ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে; স্ত্রী ও পুরুষ উভয়কেই যিনি সমভাবে আত্মা বলিয়া সর্বক্ষণ দৃষ্টি ও তদনুরূপ ব্যবহার করিতে পারেন, তাহারই যথার্থ ব্ৰহ্মবিজ্ঞান লাভ হইয়াছে।” ঠাকুর আজীবন স্ত্রীর সাহচর্য করিয়াও এইরূপ ব্ৰহ্মনিষ্ঠের জীবন যাপন করিয়াছেন। তাহার জীবনে ইন্দ্রিয়জয়ের এরূপ পরিচয় ও পরীক্ষা আরও আছে। ভৈরবীর নিকট ঠাকুর যখন তন্ত্রসাধনায় দীক্ষিত হইতে ছিলেন তখন তিনি একদিন এক পূর্ণযৌবনা সুন্দরী রমণীকে বিবস্ত্রা করিয়া ঠাকুরের সম্মুখে রাখিয়া বলিলেন ইহাকে দেবীবুদ্ধিতে পূজা কর। পূজা শেষ হইলে বলিলেন, ইহাকে সাক্ষাৎ জগজ্জননী জ্ঞানে ইহার কোলে বস এবং তন্ময় চিত্তে জপ কর। এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া ঠাকুর বলিয়াছেন : “আতঙ্কে ক্রন্দন করিয়া মাকে বলিলাম, “মা, তোর শরণাগতকে এ কি আদেশ করিতেছিস? দুর্বল সন্তানের এরূপ দুঃসাহসের সামর্থ্য কোথায়? ঐরূপ বলামাত্র দিব্যবলে হৃদয় পূর্ণ হইল…এবং রমণীর ক্রোড়ে উপবিষ্ট হইবামাত্র সমাধিস্থ হইয়া পড়িলাম।”৩৬
শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী ঠাকুরের পদসেবা করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করেন, “আমাকে তোমার কী বলিয়া বোধ হয়?” ঠাকুর উত্তর দিয়াছিলেন, “ যে মা মন্দিরে আছেন তিনিই এখন আমার পদসেবা করিতেছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ বলিয়া তোমাকে সৰ্ব্বদা সত্য সত্য দেখিতে পাই।” ঠাকুরের প্রার্থনায় শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীও ঠাকুরকে এইরূপ দেখিতেন। উভয়ের মধ্যে কোন ‘কাম-গন্ধ’ ছিল না।৩৭
অর্থের প্রতি সম্পূর্ণ অনাসক্তি তাঁহার সাধনার আর-একটি বিশেষত্ব। সাধনকালের প্রথমে তিনি টাকা মাটি-মাটি টাকা’ বলিতে বলিতে মাটির সহিত কয়েকটি মুদ্রা গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিতেন। পরিণত বয়সেও অজ্ঞাতসারে মুদ্রার স্পর্শ হইলে তিনি অসুস্থ বোধ করিতেন। একবার ইহা পরীক্ষা করিবার জন্য কেহ তাঁহার বিছানার তলে টাকা লুকাইয়া রাখিয়াছিল। ঠাকুর শয়ন করিবামাত্র অসুস্থ বোধ করিয়া উঠিয়া বসিলেন। কামিনী ও কাঞ্চনের মোহ ত্যাগের এরূপ দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।
ঠাকুর কোনদিন ধর্মপ্রচার করেন নাই। দক্ষিণেশ্বরেই নির্জনে বাস করিতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁহার খ্যাতি চারিদিকে বিস্তৃত হওয়ায় বহুলোক তাঁহাকে ‘দর্শন’ করিতে আসিত। ঠাকুর কথোপকথনচ্ছলে তাহাদিগকে নানা উপদেশ দিতেন এবং তাঁহাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সংক্ষিপ্ত দুই-চারিটি কথায় এবং ছোট ছোট গল্প ও দৃষ্টান্তের সাহায্যে তিনি যে অমূল্য ধর্ম-উপদেশ দিতেন, শ্রীমহেন্দ্র গুপ্ত (মাষ্টার মশায়) নামে তাঁহার এক ভক্ত প্রত্যহ তাহা লিখিয়া রাখিতেন এবং পরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ নামে পুস্তকাকারে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত করেন। এই অমূল্য গ্রন্থখানি ঠাকুরের আধ্যাত্মিক জীবন ও তাঁহার ধর্মমতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান বলিয়া জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। ইহার মধ্যদিয়া যে সমুদয় যুগোচিত ধর্মানুষ্ঠানের ও ধর্মমতের পরিচয় পাওয়া যায়, ঠাকুর নিজের জীবনে তাহা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। “আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখায়”–এই মহান উক্তি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সম্বন্ধে সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। ইহা স্মরণ করিয়াই প্রসিদ্ধ ফরাসী পণ্ডিত রোমা রোল্যা বলিয়াছেন, এই মহাপুরুষ “ভারতবর্ষের তিনসহস্র বৎসরের আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতীক স্বরূপ।” ঠাকুরের জীবিতকালেও সুরেশচন্দ্র দত্ত ১৮৮৪ সনে তাঁহার অনেকগুলি উক্তি বা উপদেশ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত করিয়াছিলেন।
তাঁহার ধর্মমতকে নব্য হিন্দুধর্ম বলিয়া অভিহিত করা যায়, কারণ হিন্দুধর্ম শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ও তাহার প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাবে ও উপদেশে যে রূপ পরিগ্রহণ করিয়াছে তাহাই বর্তমান যুগে বিশেষভাবে প্রচলিত। বেদান্ত ও উপনিষদের আত্মা, পরমাত্মা ও ভগবৎ-জ্ঞান লাভ, ভগবানে ঐকান্তিক ভক্তি ও আত্মসমর্পণ, সংসারবদ্ধ জীবের কর্মশক্তি ভগবানের সৃষ্ট জীবের কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করা, এবং এই সমুদয়ের সাহায্যে ভগবানকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করার জন্য চিত্তের সতত আগ্রহ ও ব্যাকুলতাএই সকল ভিত্তির উপরই ঠাকুরের ধর্মমতের প্রতিষ্ঠা।
রামমোহন রায় বেদ-বেদান্ত উপনিষদ্ মানিতেন, কিন্তু পরবর্তী পৌরাণিক যুগে হিন্দুধর্মের যে রূপান্তর ঘটিয়াছিল তাহা প্রকৃত হিন্দুধর্ম বলিয়া স্বীকার করিতেন না। তাঁহার ধর্মমতের দুইটি দৃঢ় স্তম্ভ ছিল; প্রথম, একমাত্র নিরাকার ঈশ্বরে অবিচলিত নিষ্ঠা; দ্বিতীয়, প্রতিমাদি রূপে তাঁহার ধারণা, পূজা উপাসনা প্রভৃতির সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান। এই দুইটি বিষয়েই ঠাকুর তাঁহার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি দ্বারা রামমোহনের মতের বিরুদ্ধে প্রচলিত হিন্দুধর্মের (অর্থাৎ সাকার ভগবানে বিশ্বাস ও তাহার প্রতিমাপূজার সার্থকতার) প্রতি সর্বসাধারণের, বিশেষতঃ পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের, বিশ্বাস ও নিষ্ঠা ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন। হিন্দুরা মনে-মনে এইরূপ যুক্তি করিতেন যে, ঠাকুর কালীমাতার পূজা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন–ইহা অপেক্ষা রামমোহনের উল্লিখিত দুইটি মতের বিরুদ্ধে বলবত্তর প্রমাণ আর কী হইতে পারে? মূর্তিপূজা যে ধর্মের একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি ও বেদান্তে বর্ণিত মোক্ষলাভের অন্যতম উপায়, ঠাকুরের জীবনী আলোচনা করিয়া কে তাহা অস্বীকার করিতে পারে? আর ঠাকুরের ন্যায় কালী, দুর্গা, শিব, কৃষ্ণ প্রভৃতি দেবদেবী বিশ্বাস করিয়াও যদি আধ্যাত্মিকতার চরমে পৌঁছান যায় তবে সাকার ভগবানে বিশ্বাস সমূলে বর্জন করিবার প্রয়োজন কোথায়? এইপ্রকার সহজ যুক্তির বলেই ঠাকুরের প্রভাবে খ্রীষ্টান ও ব্রাহ্ম সম্প্রদায় কর্তৃক বহুনিন্দিত পৌরাণিক ধর্মে হিন্দুর বিশ্বাস দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।
প্রচলিত ভাষায় যাহাকে উচ্চশিক্ষা বলে, ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ তাহার অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু এই অশিক্ষিত ও প্রায়-নিরক্ষর ব্রাহ্মণ যে উচ্চ আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক জ্ঞানের পরিচয় দিতেন তাহাতে লোকে মুগ্ধ ও বিস্মিত হইত। তিনি বক্তৃতা দিতেন না–কিন্তু সাধারণভাবে কথাবার্তার মধ্যদিয়া অতি দুরূহ দার্শনিক তত্ত্বের সমাধান ও উচ্চ ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা করিতেন।৩৮
ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছিলেন : “রাত্রে আকাশে কত তারা দেখ, সূর্য উঠলে দেখতে পাও না বলে কি বলবে দিনের বেলায় আকাশে তারা নেই? সেইরকম অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পাও না বলে কি বলবে ঈশ্বর নাই?”
সাকার, নিরাকার ও প্রতিমাপূজা সম্বন্ধে ঠাকুরের কয়েকটি উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি :
“দেখ, ভগবান আসলে নিরাকার, কিন্তু ভক্তের আকুলতায় তাকে রূপ ধরতে হয়। যেমন মহাসমুদ্র-কেবল জল- কিন্তু তারই মাঝে মাঝে ঠাণ্ডায় হিমে জল জমে বরফ হয়ে গেছে। এও ঠিক তাই। ভগবান জলের মতই নিরাকার। কিন্তু ভক্তদের ভক্তিরূপ হিমে জমে তাঁকে মাঝে মাঝে আকার ধারণ করতে হয়।”
মাষ্টার প্রশ্ন করলেন :
“ভগবান সাকার একথা ধরে নিলেও তিনি যে মাটির প্রতিমার ভেতরও আছেন, একথা কেমন করে বিশ্বাস কর?”
ঠাকুর–”তুমি মাটির প্রতিমা কেন বলছ গো? মায়ের চিন্ময়ী প্রতিমা।”
মাষ্টার-”তবে যারা মাটির প্রতিমা পূজা করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত ওটা ঈশ্বর নয়। তারা ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে প্রতিমার পূজা করে মাত্র।”
ঠাকুর–”আচ্ছা ঈশ্বর সব জানেন আর এইটে জানেন না যে এইভাবে তাঁকেই ডাকা হচ্ছে?” “প্রতিমাদি সাকার মূর্তিতে ঈশ্বরভাব থাকলে ঈশ্বরলাভ হইয়া থাকে। আর কাঠ, খড়, মাটি বোধ থাকলে কিছুই হয় না।” “যেমন সোলার আতা, মাটির হাতী দেখে আসল আতা ও হাতী মনে পড়ে, সেইরকম প্রতিমা দেখে ঈশ্বরকে মনে পড়ে।”
কেশবচন্দ্রকে তিনি বলিয়াছিলেন, “প্রতিমা দেখলে মাটি খড় তোমার মনে আসে কেন? সচ্চিদানন্দময়ী মা মনে আসে না কেন?” “আগে গোটা লেখা অভ্যাস হলে পরে ছোট হরফ সহজে লিখতে পারা যায়; সেইরূপ আগে সাকারে মন বসলে সহজেই নিরাকারকে ধরতে পারা যায়।”
আর এক সময় ঠাকুর বলেছিলেন :
“গাছের উপর একটা গিরগিটী দেখে একজন এসে বললে, সেটা লাল, আর একজন বললে সেটা সবুজ, তৃতীয় ব্যক্তি বললে হলদে। তিনজন ঝগড়া কর্তে কর্তে গাছতলায় একজন লোককে দেখে জিজ্ঞেস কর্ল। সে বলল, ভাই তোমরা সবাই ঠিক দেখেছ। আমি সব সময় এই গাছতলায় থাকি, আমি জানি জানোয়ারটি বহুরূপী। সে কখনও লাল, কখনও সবুজ, কখনও হলদে। ঈশ্বর হলেন বহুরূপী। যে ভক্ত তাঁর যে রূপ ভালবাসে তাকে সেইরূপেই তিনি দেখা দেন। তিনি সাকার, তিনি নিরাকার, এবং তার আরো কত আকার আছে তা আমরা জানি না।”
একজন প্রশ্ন করিয়াছিলেন : “যদি সকল ধর্মের ভিতরে এক ঈশ্বরের কথাই লেখা আছে তবে প্রত্যেক ধর্মে ঈশ্বরকে ভিন্ন ভিন্ন দেখায় কেন?”
ঠাকুরের উত্তর : “ঈশ্বর এক, কিন্তু তাঁর ভাব বিভিন্ন। যেমন বাটীর কর্তা এক ব্যক্তি, কিন্তু তিনি কাহারও পিতা, কাহারও ভ্রাতা এবং কাহারও পতি। ভাব ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু ব্যক্তি এক। ঈশ্বর সেই রকম। যেমন কুমোরের দোকানে হাঁড়ি গামলা, জালা, প্রদীপ প্রভৃতি বিভিন্ন দ্রব্য থাকে, কিন্তু সকলকার ভিতরে সেই এক মাটি। ঈশ্বরও সেইরকম এক হয়েও দেশভেদে ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছেন। ঈশ্বরও এক, কিন্তু ভাবে বহু। মাছ এক, কিন্তু ঝালে, ঝোলে, অম্বলে প্রভৃতি নানারকমে যেমন তাকে আস্বাদ করা যায়, সেইরকম ভগবান এক হলেও সাধকগণ তাকে বিভিন্নরকমে উপভোগ করে থাকেন।”
“যেমন কালীঘাটে মায়ের বাড়ী যাবার অনেক পথ আছে, সেইরকম ভগবানের ঘরেও নানা পথ দিয়ে যেতে পারা যায়। প্রত্যেক ধৰ্ম্মই এক এক পথ দেখিয়ে দিচ্ছে।”
একজন ব্রাহ্ম সাধু তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “ব্রাহ্মধর্মে ও হিন্দুধর্মে প্রভেদ কী?” তিনি বলিলেন, পোঁ বাজান ও সুর বাহির করা। ব্রাহ্মধর্ম এক ব্রহ্মের পোঁ ধরিয়া আছে, হিন্দুধর্ম তাহার উপর নানারকম সুর তাল লয় বাহির করিতেছে।
এই প্রসঙ্গে ঠাকুর প্রাচীন হস্তী-ন্যায়ের কথাও বলতেন-”চারজন অন্ধ হাতী দেখতে গিয়ে তার বিভিন্ন অঙ্গ-পা, ড়, পেট ও কানে হাত বুলিয়ে পরখ করল। ফলে তখন তাদের যথাক্রমে ধারণা হল, হাতীটা স্তম্ভ, মুগুর, জালা ও কুলোর মত। যারা গোড়া তারা এই অন্ধের মত ভগবানের একটা দিক দেখেই ঠিক করে নেয় যে ভগবান এই রকম। আজ যে সাকার রূপের পূজা কচ্ছে, সেই আবার নিরাকার রূপের পূজা করবে। ছোট ছোট মেয়েরা পুতুল নিয়ে খেলা করে, কিন্তু যেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়, অমনি পুতুলখেলা বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো হল ধাপ বা সিঁড়ি। ভগবানই এ ব্যবস্থা করেছেন। মা যেমন যে ছেলের পেটে যা সয় তাই ভেবে কারো জন্যে ডাল ভাত এবং কারো জন্যে সাগু ব্যবস্থা করেন–অথবা যার যেরকম মাছ সয় তাকে সেইরকম করে মাছ বেঁধে দেন-কাকেও ভাজা কাকেও ঝোল, কাকেও ঝাল-ভগবানও সেইরূপ প্রত্যেক মানুষের উপযোগী সাধনার ব্যবস্থা করে থাকেন।”
বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে ঠাকুরের উক্তি :
“ভগবান তো আলাদা নন। তিনি এক, কেবলমাত্র নামের তফাৎ এই যা। তাকে কেউ বলছে আল্লা, কেউ হরি, কেউ God, কেউ কালী, কেউ ব্রহ্ম, আবার কেউবা বলছে-যীশু, দুর্গা ইত্যাদি। যেমন একটা পুকুরের তিন-চারটা ঘাট আছে। একটায় হিন্দুরা জল খায়, তারা বলছে জল, একটাতে মুসলমানেরা খায়, তারা বলছে পানি, আর একটায় খ্রীষ্টানেরা খায় তারা বলছে water। এ নিয়ে মানুষে মানুষে ঝগড়া কেন?”
“ভগবানকে পাওয়া মানবজীবনের চরম ও পরম আদর্শ ও লক্ষ্য, এবং সকল ধর্মেরই সেইটিই মূল কথা। কিন্তু ইহার জন্য যে সংসার ত্যাগ করিয়া বনে পর্বতে সাধন ভজন করিতেই হইবে তাহা নয়।
“অসতী স্ত্রীলোক বাপ মা ও সমস্ত পরিবারের ভিতর থেকে সংসারের কাজকর্ম করে, কিন্তু তার মন থাকে সেই উপপতির প্রতি। হে সংসারী জীব! মন ঈশ্বরে রেখে, তুমিও বাপ মা ও পরিবারের কাজ করিও।”
“জাহাজের কম্পাসের কাঁটা উত্তরদিকে থাকে, তাই জাহাজের দিভুল হয় না। মানুষের মন যদি ঈশ্বরের দিকে থাকে, তা হলে কোন ভয় থাকে না।”
“জলে নৌকা থাকে ক্ষতি নাই, কিন্তু নৌকায় যেন জল না থাকে। সাধক সংসারে থাকে ক্ষতি নাই, কিন্তু সাধকের ভেতর যেন সংসার না থাকে।”
ঠাকুর বলিতেন, “ভগবানে মন দিতে গেলে সংসার ছাড়তে হবে কেন? সংসারও যে তাঁরই রাজত্বে। এই জগৎ সংসার সবই যে তাঁর, কোথায় ছেড়ে কোথায় যাবে?”
একজন জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “যারা সংসারে থাকেন তাঁদের ভগবানলাভের উপায় কী?” ঠাকুর উত্তর দিলেন, “তাদের উপায় সবসময় তার নাম ও গুণগান করা, মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ করা, আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা, যেন তিনি তাঁদের বিশ্বাস ভক্তি দেন। বিশ্বাস হলেই হয়ে গেল, ওর ওপরে আর জিনিস নেই।”
“বাপ-মা আপনার লোক, এদের সকলকে নিয়ে থাকবে, তাদের ভক্তি কবে, সেবা কর্বে, কিন্তু মন রাখবে ঈশ্বরে। যেমন বড়লোকের বাড়ীর ঝি মনিবের বাড়ীতে কাজ করে, ছেলেপুলে মানুষ করে। মুখে বলে আমার হরি, আমার যদু, কিন্তু মনে জানে এরা কেউ তার নয়–সব সময় মন পড়ে থাকে আপনার বাড়ীতে। সেই রকম তুমিও নিজের ছেলেদের যত্ন করো, কিন্তু মন রেখো ঈশ্বরের দিকে।”
“যদি কেউ ভগবানের ইচ্ছার ওপর সব ফেলে দিয়ে সংসার করে তাতে দোষ কী? সংসার ছাড়তে হবে না। সংসারই তোমাকে ছাড়ক। সংসারে বাঁধা না পড়লেই হল। লুকোচুরি খেলায় যে বুড়ি ছোয়, সে আর চোর হয় না। তেমনি ঈশ্বররূপ বুড়িকে ছুঁয়ে থাকলে, সে আর বাঁধা পড়ে না।”
মাষ্টার জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঈশ্বরকে দেখা যায় কি না এবং কেমন হলে দেখা যায়?” ঠাকুর জবাব দিলেন : “হ্যাঁ, নিশ্চয় দেখা যায়, খুব আকুলভাবে তাঁকে ডাকলে, তাঁর নাম করে কাঁদলে, তাঁর দেখা মেলে। লোকে ছেলের জন্যে, স্ত্রীর জন্যে, টাকার জন্যে ঘটি ঘটি কাঁদে, কিন্তু ঈশ্বরের দেখা পেলাম না বলে কজন কাঁদছে? ডাকার মত ডাকলে তিনি দেখা না দিয়ে পারেন না–অবশ্য দেখা দেন। সতীর স্বামীর প্রতি টান, বিষয়ীর বিষয়ের প্রতি টান, আর মায়ের ছেলের প্রতি টান মিলে যদি এক টান হয়, আর সেই টান যদি কেউ ঈশ্বরের উপর দেয়, তার ঈশ্বরলাভ হবেই হবে। মোট কথা ঈশ্বরকে ভালবাসতে হবে। বেড়ালের ছানা যেমন মা ছাড়া কিছুই জানে না, মা যখন যেখানে তাকে রাখে সেইখানেই থাকে আর মিউ মিউ করে, তেমনি যদি কেউ তাঁর উপর পুরোপুরি ভরসা করে বসে থাকে, তবে কি তিনি দেখা না দিয়ে পারেন?”
অন্যত্র ঠাকুর বলিয়াছেন : “ভগবানের নামে এমন জোর বিশ্বাস হওয়া চাই যে জোর করে বলতে পারা চাই, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার আবার পাপ কোথায়?”
একজন ঠাকুরের সঙ্গে ভগবানের সম্বন্ধে তর্ক করিতেছিল। ঠাকুর বলিলেন, “তর্ক করে যদি বুঝতে চাও কেশবের কাছে যাও। আর যদি সহজ করে এককথায় বুঝতে চাও ত আমার কাছে এস।” কেশবচন্দ্র সেনের সম্বন্ধে ঠাকুরের খুব উচ্চ ধারণা ছিল। কিন্তু দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ কী, এই উক্তিটি হইতে তাহা বেশ পরিষ্কার বুঝা যায়।
ঠাকুরের আর-একটি কথাও এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। “একটা খালি কলসীতে জল ভরতে যাও-ভক্ ভন্ শব্দ করে। যেই সেটা ভরে গেছে আর শব্দ নেই। সেইরকম যে ভগবান পায়নি, সে বই থেকে নানা কথা আওড়ায়। কিন্তু যে ভগবানের দেখা পেয়েছে, সে চুপ করে আনন্দ ভোগ করে।”
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সমসাময়িক ভারতের দুইজন প্রসিদ্ধ ধর্মাচার্য ও নবধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা তাঁহার সম্বন্ধে খুব উচ্চধারণা পোষণ করিতেন। ঠাকুরের প্রায়ই ভাবসমাধি হইত–তাহা দেখিয়া কেশবচন্দ্র সেন বলিয়াছিলেন : “এই রকমের সমাধি দেখা যায় না। এ কেবল কয়েকজনের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। এই ভাবের সমাধি শ্রীচৈতন্যের হত, যীশুখ্রীষ্টের হত, মহম্মদের হত।”
অতি সরল সহজ ভাষায় সুপরিচিত সাধারণ দৃষ্টান্তের সাহায্যে ঠাকুরের উচ্চ দার্শনিক তথ্যের ব্যাখ্যা শুনিয়া কেশবচন্দ্র বলিয়াছিলেন : “এ যে একেবারে যীশুখ্রীষ্টের মত কথা। সকলের বোঝার মত করে সেইরকম গল্প করে বোঝন। যীশু পিতা পিতা’ করে পাগল, আর ইনি ‘মা মা’ করে পাগল, এই যা তফাৎ।” শ্রীদয়ানন্দ সরস্বতীও এইরকম মত ব্যক্ত করিয়াছেন। বিলাতে ম্যাক্সমূলার ও ফরাসি দেশে রোমা রোলাও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের উচ্চস্তরের সাধনায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন।
ভগবানের কথার সঙ্গে ঠাকুর অনেক সময় নীতির উপদেশ দিতেন। তিনি বলিতেন : “সত্য একালের তপস্যা। যদি কেউ জীবনে সত্যকথা বলে যায় ও সেইমত কাজ করে যায়, সে তাতেই ভগবানকে লাভ করতে পারে।” ঠাকুর নিজের জীবনে কী অবিচলিত নিষ্ঠার সহিত এই নীতি পালন করিতেন সে-সম্বন্ধে অনেক কাহিনী আছে। একবার তিনি নিজেই নিজের কথা বলিয়াছিলেন : “যদি একবার বলতুম, অমুক জায়গায় যাব বা এই কাজ কর্ব বা এই জিনিষ খাব, তা হলে সেটা করা চাই। একবার রামের বাড়ী গিয়ে বলে ফেলেছিলুম, লুচি খাব না। যখন খেতে দিলে, ভারি ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু লুচি খাব না বলেছি, কাজেই মিঠাই খেয়েই পেট ভরালুম।”
ঠাকুর সকলকেই মাতাপিতার প্রতি ভক্তির উপদেশ দিতেন। একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করিলেন : “বাপ মা যদি কোন গুরুতর অপরাধ করেন, কিংবা ভয়ানক পাপ কাজ করেন, তাহলেও কি তাদের মানতে হবে?” ঠাকুর উত্তর দিলেন : “তা হলেই বা–কথায় আছে, যদিও আমার গুরু শুড়িবাড়ী যায়, তবুও আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়। মা-বাপ এরা কি কম? তারা রাগ করলে ধর্ম-টর্ম হয় না। মানুষের কতকগুলি ঋণ আছে, দেবঋণ, ঋষিঋণ, পিতৃঋণ, মাতৃঋণ। মা-বাপের ঋণ শোধ না কর্লে কিছুই হবে না জেনো। তবে ভগবানের নামে পাগল হলে কে কার? তখন বাপই বা কেন আর মা-ই বা কে? সে তখন যা-কিছু করার মত সবটুকুর বাইরে চলে যায়। তার আর ঋণ বলতে কিছু থাকে না।”
“কেবলমাত্র ভগবানকে পারার জন্য মা-বাপের অবাধ্য হতে পারা যায়। যেমন প্রহ্লাদকে তার বাপ কৃষ্ণনাম নিতে বারণ করেছিল, কিন্তু প্রহ্লাদ তা শোনেনি। ধ্রুবকে তার মা তপস্যা কর্তে নিষেধ করেছিল, কিন্তু ধ্রুব না-শুনে বনে গিয়েছিল।”
জাতিভেদ সম্বন্ধে ঠাকুর বলিয়াছিলেন : “জাতিভেদ একটা উপায়ে উঠে যেতে পারে। সেই উপায়টা হচ্ছে, ভক্তি। ভক্তের জাত নেই। চণ্ডালও যদি ভক্তিলাভ করে, সে আর চণ্ডাল থাকে না। আর একটি উপায় হচ্ছে, নিজেকে বোঝার জ্ঞান লাভ।” “কাশীতে শঙ্করাচার্য একবার গঙ্গাস্নান করে উঠে আসছেন। এই সময় একজন চণ্ডালের গায়ে গা লেগে গেল। তিনি বল্লেন : ‘তুই আমায় ছুঁয়ে দিলি?’ চণ্ডাল বল্লে, ঠাকুর তুমি আমায় ছোওনি, আমিও তোমায় ছুঁইনি। তোমাতে আমাতে তফাৎ কী? তুমিও যা আমিও তাই। যিনি শুদ্ধ আত্মা তিনি শরীর নন, পঞ্চভূত নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন।” তখন শঙ্করের জ্ঞান হইল।
ঠাকুর অবতারত্ব বিশ্বাস করিতেন। বলিতেন : “অবতার ঈশ্বরের কর্মচারী–যেমন জমিদার ও তাহার নায়েব। আপন অধিকারের যে প্রদেশে গোলমাল হয়, জমিদার সেই প্রদেশেই তাঁর নায়েবকে প্রেরণ করেন; সেইরূপ জগতে যে-কোন স্থানে ধর্মহানি হয় সেই স্থানেই অবতারকে আসতে হয়।” “সেই একই অবতার যেন ডুব দিয়ে এখানে উঠে কৃষ্ণ হলেন, ওখানে উঠে যীশু হলেন।”
ঠাকুরের ভক্তেরা তাহাকে অবতার মনে করিতেন। এই বিষয় আলোচনার জন্য দক্ষিণেশ্বরে বহু পণ্ডিত এক সভায় সমবেত হন এবং তাঁহাকে অবতার বলিয়া স্বীকার করেন। ঠাকুর নাকি নিজেই বলিয়াছিলেন–পূর্বযুগে রাম ও কৃষ্ণের অবতার এ-যুগে রামকৃষ্ণ হইয়া জন্মিয়াছিল। স্বামী সারদানন্দ লিখিয়াছেন : “তাঁহাকে বারবার বলিতে শুনিয়াছি “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সেই ইদানীং রামকৃষ্ণ।”৩৯
ঠাকুরের মৃত্যুর দুইদিন পূর্বে তাহার রোগশয্যার পাশে দাঁড়াইয়া নরেন্দ্রের মনে হইয়াছিল, “উনি তো অনেক সময় নিজেকে ভগবানের অবতার বলে পরিচয় দিয়েছেন। এখন এই সময়ে যদি বলতে পারেন ‘আমি ভগবান’ তবেই বিশ্বাস করি।” ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন, “এখনও তোর জ্ঞান হোলো না? সত্যি সত্যি বলছি, যে রাম যে কৃষ্ণ-সে-ই ইদানীং এ শরীরে রামকৃষ্ণ-তবে তোর বেদান্তে র দিক দিয়ে নয়।”৪০
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কোনদিনই কোন বিশেষ ধর্মমত প্রচার করেন নাই। তিনি দক্ষিণেশ্বরের নির্জন পরিস্থিতিতেই সাধন-ভজন করিতেন এবং জনসাধারণও বহুদিন পর্যন্ত তাহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানিত না। ব্রাহ্মসমাজের আচার্য কেশবচন্দ্রের খ্যাতি শুনিয়া ঠাকুর বেলঘরিয়ায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। ঈশ্বরের প্রসঙ্গ আলোচনা করিতে করিতে ঠাকুরের সমাধি হয়। তৎপর গভীর আধ্যাত্মিক বিষয়গুলি তিনি এমন সরল ভাষায় সামান্য সামান্য দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যক্ত করেন যে শুনিয়া সকলেই মুগ্ধ হয়। ঠাকুর কেশবকে অনুচরবর্গের সাক্ষাতেই বলিয়াছিলেন : “তোমার ল্যাজ খসিয়াছে।” সকলের অপ্রস্তুত ভাব দেখিয়া ঠাকুর বলিলেন : “দেখ ব্যাঙ্গাচির যতদিন ল্যাজ থাকে, ততদিন সে জলেই থাকে, স্থলে উঠিতে পারে না, কিন্তু ল্যাজ যখন খসিয়া পড়ে তখন জলেও থাকিতে পারে, ড্যাঙ্গাতেও বিচরণ করিতে পারে–সেইরূপ মানুষের যতদিন অবিদ্যারূপ ল্যাজ থাকে, ততদিন সে সংসার-জলেই কেবল থাকিতে পারে; ঐ ল্যাজ খসিয়া পড়িলে, সংসার এবং সচ্চিদানন্দ উভয় বিষয়েই ইচ্ছামত বিচরণ করিতে পারে। কেশব, তোমার মন এখন ঐরূপ হইয়াছে, উহা সংসারেও থাকিতে পারে এবং সচ্চিদানন্দেও যাইতে পারে।”৪১
কেশবচন্দ্র তাঁহার প্রতি এতদূর আকৃষ্ট হইয়াছিলেন যে অতঃপর তিনি মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে যাইতেন। ঠাকুরও মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় কেশবচন্দ্রের বাটীতে গমন করিতেন। এইরূপে উভয়ে উভয়ের সাহচর্যে বহুদিন ধর্মের তথ্য আলোচনা করিয়াছেন। ঠাকুরের সম্বন্ধে কেশবচন্দ্রের অভিমত পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। কেশবচন্দ্রের সম্বন্ধেও ঠাকুর খুব উচ্চধারণা পোষণ করিতেন।
ব্রাহ্মসমাজের উৎসবের সময় কেশবচন্দ্র ঠাকুরের নিকট আগমন করিয়া অথবা ঠাকুরকে লইয়া যাইয়া ঈশ্বরপ্রসঙ্গে বহুক্ষণ অতিবাহিত করিতেন। “অনেকবার তিনি জাহাজে করিয়া কীর্তন করিতে করিতে সদলবলে দক্ষিণেশ্বরে আগমনপূর্বক ঠাকুরকে উহাতে উঠাইয়া লইয়া তাঁহার অমৃতময় উপদেশ শুনিতে গঙ্গাবক্ষে বিচরণ করিতেন।” কেশবচন্দ্রের মৃত্যুর পরে ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “মনে হয়, যেন আমার একটা অঙ্গ (পক্ষাঘাতে) পড়িয়া গিয়াছে।”
প্রসঙ্গক্রমে এইখানে বলা আবশ্যক যে, কেশবচন্দ্র সেনের একজন ভক্ত শ্রীসুরেশচন্দ্র দত্ত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবিতাবস্থায় (১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে) তাঁহার সরল সংক্ষিপ্ত উপদেশগুলি সংগ্রহ করিয়া “পরমহংস রামকৃষ্ণের উক্তি” এই নামে প্রকাশিত করেন। ১৯০৭ সনে ইহার পরিবর্ধিত চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে কেশবচন্দ্র মুক্তকণ্ঠে জনসাধারণের নিকট তাঁহার অপূর্ব জ্ঞান, ভক্তি, বৈরাগ্য প্রভৃতি ঐশ্বরিক সম্পদের কথা প্রচার করেন। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের ইংরেজী ও বাংলা পত্রিকা-সুলভ সমাচার, Sunday Mirror, Theistic Quarterly Review-প্রভৃতি ঠাকুরের পূত চরিত্র, সারগর্ভ বাণী ও ধর্মবিষয়ক মতামতের আলোচনায় পূর্ণ থাকিত। বক্তৃতা এবং একত্র উপাসনার পরে বেদী হইতে ব্রাহ্মসঙ্কে সম্বোধনপূর্বক উপদেশ প্রদানকালেও কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মনেতাগণ অনেক সময় ঠাকুরের বাণীসকল আবৃত্তি করিতেন।৪২।
এই সমুদয়ের ফলে ক্রমশঃ কলিকাতা ও অন্যান্য স্থান হইতে বহু লোক ঠাকুরকে দর্শন করিতে ও তাহার উপদেশ শুনিতে আসিত। ঠাকুরও কথোপকথন প্রসঙ্গে তাঁহাদিগকে নানারূপে ধর্মোপদেশ দিতেন। এইগুলির একটি মনোরম বিবরণ শ্ৰীম (মহেন্দ্র গুপ্ত) রচিত “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃত”তে (পাঁচখণ্ডে সম্পূর্ণ) পাওয়া যায়। ইনি মাঝে মাঝে ঠাকুরদর্শনে যাইতেন এবং ফিরিয়া আসিয়া উপস্থিত ভক্ত ও দর্শকবৃন্দের সঙ্গে ঠাকুরের কথোপকথনের সারাংশ লিখিয়া রাখিতেন। এই দৈনিক বিবরণী অবলম্বন করিয়াই তিনি “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃত” লিখিয়া অমর হইয়াছেন। বস্তুতঃ ধর্মজগতে কোন মহাপুরুষের উক্তি ও দৈনন্দিন জীবনের চিত্র কোন প্রত্যক্ষদর্শী এইরূপভাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন ইহার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর নাই। ঠাকুরের জীবনী সম্বন্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রামাণিক গ্রন্থ হিসাবে ইহা এখনও খুব জনপ্রিয় এবং নানা ভাষায় ইহার অনুবাদ হইয়াছে। এই গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে ঠাকুরের ভক্তদলের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়াই চলিয়াছিল এবং প্রতিদিনই দক্ষিণেশ্বরে ভক্তবৃন্দের সমাগত হইত।
আচার্য কেশবচন্দ্র সেনের ন্যায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আচার্য শ্ৰীযুত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ঠাকুরের একজন ভক্ত ছিলেন এবং ঠাকুরের প্রভাবে তাঁহার ধর্মমত এতদূর পরিবর্তিত হইয়াছিল যে তিনি সাকার ভগবানে বিশ্বাসপূর্বক সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সহিত সংস্রব ত্যাগ করিয়াছিলেন। “কীর্তন-কালে ভাবাবিষ্ট হইয়া তাহার উদ্দাম নৃত্য ও ঘন ঘন সমাধি দেখিয়া লোকে মোহিত হইত। আধ্যাত্মিক গভীরতা লাভের পর তিনি অনেক ব্যক্তিকে মন্ত্রশিষ্য করিয়াছিলেন।”৪৩
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর ন্যায় শিবনাথ শাস্ত্রীও ঠাকুরের নিকট আসিতেন এবং তাঁহাকে বিশেষ ভক্তি শ্রদ্ধা করিতেন। কিন্তু বিজয়কৃষ্ণের উপর ঠাকুরের প্রভাবের পরিণাম-ফল দেখিয়া তিনি আর ঠাকুরের নিট যাইতেন না এবং অন্যান্য ব্রাহ্মকেও সম্ভবতঃ যাইতে নিষেধ করিয়াছিলেন। এ-সম্বন্ধে তৎকালীন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের একজন সদস্য নরেন্দ্রনাথ দত্তকে–ভবিষ্যৎ স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছিলেন, “তিনি (শিবনাথ শাস্ত্রী) দক্ষিণেশ্বরে ঘন ঘন গমন করিলে তাহার দেখাদেখি ব্রাহ্মসংঘের অন্য সকলেও ঐরূপ করিবে এবং পরিণামে উক্ত দল ভাঙ্গিয়া যাইবে।” শিবনাথ শাস্ত্রী নরেন্দ্রনাথকেও দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরদর্শনে গমন হইতে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়াছিলেন।
শিবনাথ শাস্ত্রীর আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক ছিল না, বিজয়কৃষ্ণ ও নরেন্দ্রনাথের জীবনীই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বিজয়কৃষ্ণের ন্যায় নরেন্দ্রনাথও ঠাকুরের প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করিয়া শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান ভক্ত ও শিষ্য হন এবং গুরুর ধর্মমত দেশেবিদেশে প্রচার করিয়া নব্য হিন্দুধর্মকে ধর্মজগতে এক বিশিষ্ট উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর তাঁহার জীবনী আলোচনা করিব।
(গ) স্বামী বিবেকানন্দ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যে-সকল ভক্তবৃন্দ আসিতেন, তাঁহারা সকলেই ছিলেন সংসারী-অবসরমত ঠাকুরের উপদেশ শুনিবার জন্য দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন। ইহাদের মধ্যে কয়েকজন ঠাকুরের বিশেষ অনুগ্রহভাজন ছিলেন। কথিত আছে যে ঠাকুর নাকি বহু পূর্বেই এই কয়জন ভক্তের আগমনের কথা জানিতেন। ১৮৮৫ সনের আরম্ভে পূর্ণ নামক জনৈক ভক্ত আসার পর তিনি বলিয়াছিলেন : “এখানে আসিবে বলিয়া যাহাদিগকে দেখিয়াছিলাম, পূর্ণের আগমনে সেই শ্রেণীর ভক্ত সকলের আসা সম্পূর্ণ হইল। অতঃপর ঐ শ্রেণীর আর কেহ এখানে আসিবে না।” “ঐ সকল ভক্তের আগমন মাত্র, অথবা আসিবার স্বল্পকাল পরে, ঠাকুর তাহাদের প্রত্যেককে একান্তে আহ্বানপূর্বক ধ্যান করিতে বসাইয়া তাহাদিগের বক্ষ, জিহ্বা, প্রভৃতি শরীরের কোন কোন স্থান দিব্যাবেশে স্পর্শ করিতেন। ঐ শক্তিপূর্ণ স্পর্শ…ঈশ্বরের দর্শনলাভের জন্য তাহাদিগকে বিশেষভাবে নিযুক্ত করিত। ফলে উহার প্রভাবে…কাহারও গভীর ধ্যান ও অভূতপূৰ্ব আনন্দ, কাহারও ঈশ্বর লাভের জন্য প্রবল ব্যাকুলতা, কাহারও ভাবাবেশ ও সমাধি হইত।” ভক্তদিগের মধ্যে। কোন কোন ব্যক্তিকে স্পর্শ করা ছাড়াও ঠাকুর মন্ত্রদীক্ষা প্রদান করিতেন।
এই সকল ভক্তদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামে কলিকাতাবাসী একজন ইংরেজীশিক্ষিত সম্ভ্রান্ত বংশজাত যুবক ঠাকুরের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি কয়েকজন ভক্তকে নির্দেশ করিয়া বলিতেন, “ইহারা ঈশ্বরকোটী অথবা শ্রীভগবানের কার্যবিশেষ সাধন করিবার নিমিত্ত সংসারে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছে।” ঐ কয়েক ব্যক্তির সহিত নরেন্দ্রের তুলনা করিয়া তিনি এক দিবস বলিয়াছিলেন, “নরেন্দ্র যেন সহস্রদল কমল; এই কয়েকজনকে ঐ জাতীয় পুষ্প বলা যাইলেও, ইহাদের কেহ দশ, কেহ পনর, কেহ বা বড়জোর বিশ দল বিশিষ্ট।”8৪
১৮৬৩ সনের ১২ই জানুআরি নরেন্দ্রনাথের জন্ম। ১৮৮১ সনের শেষভাগে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। একদিন ঠাকুরের ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্র ঠাকুরকে কলিকাতায় নিজ ভবনে আমন্ত্রণ করেন এবং প্রতিবেশী নরেন্দ্রনাথকে ঠাকুরের নিকট ভজন গাহিবার জন্য আহ্বান করেন। নরেন্দ্রনাথ তখন এফ. এ. ক্লাসে পড়িতেন, সঙ্গীতবিদ্যাও আয়ত্ত করিয়াছিলেন। নরেন্দ্রের ভজন শুনিয়া ঠাকুর তাঁহার প্রতি খুব আকৃষ্ট হইলেন এবং তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বরে যাইবার জন্য আমন্ত্রণ করিলেন।৪৫
নরেন্দ্রনাথ যে এই সময়ে ব্রাহ্মধর্মে অনুরক্ত ছিলেন তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। এই ঘটনার পরে নরেন্দ্রনাথের বিবাহের প্রস্তাব আসিল-বরপণ দশ হাজার টাকা। কিন্তু পিতার অনুরোধসত্ত্বেও নরেন্দ্র ধর্মভাবের প্রেরণায় বিবাহ করিতে রাজী হইলেন না। তখন তাহার আত্মীয় ও ঠাকুরের পরমভক্ত রামচন্দ্র দত্ত নরেন্দ্রের মনোভাব বুঝিতে পারিয়া একদিন তাঁহাকে বলিলেন : “যদি ধৰ্মলাভ করিতেই তোমার যথার্থ বাসনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে ব্রাহ্মসমাজ প্রভৃতি স্থলে না বেড়াইয়া দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকট চল।” সুরেন্দ্রনাথ মিত্রও ঐরূপ নিমন্ত্রণ করাতে নরেন্দ্র তাঁহার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে আসিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে গান গাহিতে বলায় নরেন্দ্র ব্রাহ্মসমাজের “মন চল নিজ নিকেতন, সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে” এই গানটি গাহিলেন। তাহার পরে যাহা ঘটিল নরেন্দ্রনাথের নিজের কথাতেই তাহা সংক্ষেপে বিবৃত করিতেছিঃ “গান ত গাহিলাম, তাহার পরেই ঠাকুর সহসা উঠিয়া আমার হাত ধরিয়া উত্তরের বারাণ্ডায় নিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিলেন। বারাণ্ডায় ঝাঁপ থাকায় বাহিরের লোককে দেখা যাইত না। সহসা আমার হাত ধরিয়া বলিলেন, ‘এতদিন পরে আসিতে হয়? আমি তোমার জন্য কিরূপে প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছি তাহা একবার ভাবিতে নাই?…’ ইত্যাদি কত কথা বলেন ও রোদন করেন। পরক্ষণেই করযোড়ে বলিতে লাগিলেন, “জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীর ধারণ করিয়াছ ইত্যাদি; “আমি ত একেবারে নির্বাক স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবিলাম এ ত একেবারে উন্মাদ ….তারপরে গৃহমধ্যে পুনঃপ্রবেশ করিয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া ও তাহার কথাবার্তা শুনিয়া মনে হইল ঈশ্বরের জন্য ঐরূপ ত্যাগ জগতে বিরল–উন্মাদ হইলেও এ ব্যক্তি মহাপবিত্র, মহাত্যাগী এবং এইজন্য মানবহৃদয়ের শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মান পাইবার যথার্থ অধিকারী।”
ইহার পূর্বেই নরেন্দ্রনাথ ধর্মভাবের তীব্র প্রেরণায় অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনে ও কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করিয়া নিরাকার সগুণ ব্রহ্মের ধ্যান করিতেন। কিন্তু ক্রমেই তিনি ভগবানের দর্শন লাভ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন। নরেন্দ্রনাথকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিলেন : “তুমি ধ্যানাভ্যাস করিলে যোগশাস্ত্রনির্দিষ্ট ফল সকল শীঘই প্রত্যক্ষ করিবে।”৪৬ নরেন্দ্র তাঁহার উপদেশমত ধ্যান করিতে লাগিলেন কিন্তু যাহা খুঁজিতে ছিলেন তাহা পাইলেন না–শান্তি মিলিল না। একদিন তিনি মহর্ষিকে প্রশ্ন করিলেন, “মহাশয়, আপনি কি স্বয়ং ঈশ্বর দর্শন করিয়াছেন?” মহর্ষি তদুত্তরে “ক্ষণকাল নরেন্দ্রের নেত্ৰমধ্যে দৃষ্টি সন্নিবেশ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, বৎস! তোমার চক্ষুদ্বয় ঠিক যোগীদিগের চক্ষের ন্যায়।”৪৭ কিন্তু নরেন্দ্র এই উত্তরে বিশেষ সন্তুষ্ট হইতে পারিলেন না।
ইতিমধ্যে নরেন্দ্রনাথের সহিত ঠাকুরের দুইবার সাক্ষাতের কথা পূর্বে বলিয়াছি। তাহার পর আরও দুইবার তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের দর্শন পাইয়াছিলেন এবং পূর্ববৎ তাহার প্রতি ঠাকুরের অদ্ভুত আচরণ ও অলৌকিক ব্যাপার লক্ষ্য করিয়া কখনও ভাবিতেন ইনি উন্মাদ, আবার কখনও ভাবিতেন, না, ইনি সত্যই মহাপুরুষ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শেষোক্ত সাক্ষাতের পর তিনি দক্ষিণেশ্বরে গিয়া ঠাকুরকে প্রশ্ন করিলেন, আপনি কি ঈশ্বর দেখিয়াছেন?” “পরমহংসদেব তৎক্ষণাৎ উত্তর করিলেন, ‘হ গো, এই যেমন তোমায় দেখছি’, এবং তোমাকেও ঈশ্বর দেখাইতে পারি।”৪৮
অতঃপর নরেন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে ঠাকুরের প্রেম, ভক্তি, বৈরাগ্য ও অমৃতময় উপদেশের প্রতি আকৃষ্ট হইলেন, এবং অনেক অন্তঃসংগ্রাম ও তর্কবিরোধের পর অবশেষে তিনি পরমহংসদেবের সকল কথা সত্য বলিয়া মানিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু ইহা দুই-একদিনে হয় নাই,তিনি দীর্ঘ পাঁচবৎসর কাল ধরিয়া প্রতিপদে ঠাকুরকে পরীক্ষা করিয়াছিলেন ও সম্পূর্ণ প্রমাণসহায়ে নিজের দৃঢ়বিশ্বাস উৎপন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কখনও তাহার প্রতি সন্দেহ ত্যাগ করেন নাই। ইহার বিস্তারিত কাহিনী বলিবার প্রয়োজন নাই, কারণ ইহা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের জীবনীতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এই সময়ের মধ্যে নরেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক উন্নতি কোন পথে কীভাবে অগ্রসর হইয়াছিল, তাহার ইঙ্গিত দিবার জন্য মাত্র দুই-একটি ঘটনার উল্লেখ করিব।
১৮৮৪ সনে নরেন্দ্রনাথের পিতৃবিয়োগ হয় এবং সংসারে খুব অভাব-অনটন দেখা দেয়। তখন নরেন্দ্রের বয়স কুড়ি বৎসর এবং নরেন্দ্রনাথ বি. এ. পরীক্ষা দিয়াছেন। বি. এ. পরীক্ষায় পাশ হইবার পর তিনি বহু চেষ্টা করিয়াও জীবিকার্জনের কোন সুবিধা করিতে পারিলেন না। অর্থাভাবে মাতা ও ভ্রাতাগণের দুর্দশা সহ্য করিতে না পারিয়া দক্ষিণেশ্বরে গিয়া ঠাকুরকে বলিলেন, “আপনি মা কালীকে বলিয়া কহিয়া আমাদের সাংসারিক দুঃখ নিবারণের একটা উপায় করিয়া দিন।” ঠাকুর তাঁহাকে স্বয়ং মার কাছে গিয়া প্রার্থনা করিতে উপদেশ দিলেন। “নরেন্দ্র প্রথমে সম্মত হইলেন না কিন্তু ঠাকুরের পুনঃপুনঃ আদেশে ভবতারিণীর মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু দেবীর পাদপদ্মে প্রণত হইয়া বিবেক, বৈরাগ্য, জ্ঞান, ভক্তি প্রার্থনা করিলেন, টাকাপয়সার কথা মনে রহিল না।” ফিরিবার পর যখন ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি রে, মাকে বলিয়াছিস ত?” তখন নরেন্দ্রের চমক ভাঙ্গিল। বলিলেন, না, সেকথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি’। ঠাকুর তাঁহাকে আরও দুইবার মায়ের মন্দিরে পাঠাইলেন, কিন্তু ফল একই হইল–প্রতিবারই ধনরত্নের পরিবর্তে বিবেক, বৈরাগ্য, জ্ঞান ও ভক্তি প্রার্থনা করিলেন।৪৯,
ঠাকুরের সহিত দীর্ঘকাল মিলনের সৌভাগ্য নরেন্দ্রনাথের আদৃষ্টে ছিল না। প্রথম সাক্ষাতের পর চারি বৎসর অতীত হইবার কিছু পরেই ঠাকুরের গলায় ক্যান্সার রোগ হয়, এবং চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে কাশীপুরে এক বাগানবাড়ীতে আনা হয়। নরেন্দ্র ও অন্যান্য কয়েকজন ঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত সর্বদা তাঁহার সেবা শুশ্রূষায় নিযুক্ত থাকিতেন। এই সময় তিনি একদিন এই কয়েকজন যুবক ভক্তকে গেরুয়া প্রদান করিয়া সন্ন্যাব্রতে দীক্ষিত করেন।৫০
দেহত্যাগের তিন-চারি দিবস পূর্বে একদিন ঠাকুর নরেন্দ্রকে কাছে ডাকিলেন ও সম্মুখে বসাইয়া একদৃষ্টে তাহার দিকে চাহিয়া সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন। স্বামীজি বলিতেন, তখন তাহার অনুভব হইতে লাগিল যেন ঠাকুরের শরীর হইতে তড়িৎ কম্পনের মত একটা সূক্ষ্ম তেজঃরশ্মি তাঁহার শরীরমধ্যে প্রবেশ করিতেছে। ক্রমে তিনিও বাহ্যজ্ঞান হারাইলেন।…বাহ্য চেতনা হইলে দেখিলেন, ঠাকুর অত্যাগ করিতেছেন। তিনি অতিশয় চমৎকৃত হইয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলে ঠাকুর সস্নেহে বলিলেন, আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকীর হলুম! তুই এই শক্তিতে জগতের অনেক কাজ করবি। কাজ শেষ হলে পর ফিরে যাবি ৫১।
ঠাকুরের মহাপ্রস্থানের দুইদিন পূর্বে শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে ডাকিয়া বলিলেন, দেখ নরেন, তোর হাতে এদের সকলকে দিয়ে যাচ্ছি। কারণ তুই সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী। এদের খুব ভালবেসে, যাতে আর ঘরে ফিরে না গিয়ে একস্থানে থেকে খুব সাধন-ভজনে মন দেয় তার ব্যবস্থা করবি।
১৮৮৬ সনের ১৬ আগষ্ট ঠাকুর মহাপ্রয়াণ করিলেন। তাঁহার ভক্ত ও শিষ্যগণ আরও কয়েকদিন কাশীপুরের বাগানবাড়ীতে ছিলেন। কয়েকজন অভিভাবকদের অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া আসন্ন বি. এ. পরীক্ষায় প্রস্তুত হইবার জন্য গৃহে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু কয়েকজন গৃহত্যাগ করিয়াই আসিয়াছিলেন। একজন গৃহী ভক্ত সাহায্য করায় তাঁহারা বরাহনগরে একটি জীর্ণ শীর্ণ বাড়ী সস্তায় ভাড়া পাইয়া সেখানেই বাস করিতে লাগিলেন। যাহারা গৃহে ফিরিয়াছিল তাহারাও পরীক্ষান্তে আসিয়া জুটিল। এইভাবেই ধীরে ধীরে বরাহনগরের মঠ গড়িয়া উঠিল। ১৮৮৬ সনে ডিসেম্বর মাসে সমবেত ভক্তগণ সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হইলেন এবং গৃহস্থজীবনের নাম পরিবর্তন করিয়া নূতন নাম গ্রহণ করিলেন। সকল নামের শেষেই ছিল ‘আনন্দ’-এই শব্দ। নরেন্দ্রনাথ প্রথমে বিবিদিষানন্দ, সচ্চিদানন্দ প্রভৃতি নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। পরে বিবেকানন্দ নামেই তিনি পরিচিত ও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। অতঃপর এই নামেই তাহাকে অভিহিত করিব। ১৮৮৬ হইতে ১৮৯২ সন পর্যন্ত মঠ বরাহনগরে, ও তারপর ১৮৯৭ পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের নিকটে আলমবাজারে ছিল। সেখান হইতে কিছুদিনের জন্য বরাহনগরের অপরপারে গঙ্গাতীরে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বাগানে উঠিয়া যায়। কিরূপে পরিশেষে স্থায়ীভাবে বেলুড়ে মঠ প্রতিষ্ঠিত হয় তাহা পরে বলা হইবে। বলা বাহুল্য, সকল ভক্তগণই প্রথম হইতে নরেন্দ্রকে মঠের অধিনায়ক বলিয়া স্বেচ্ছায় ও আনন্দে স্বীকার করিয়া লইল।
বরাহনগরে মঠের কঠোর ও কষ্টকর জীবনযাত্রা সম্বন্ধে বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে বলিতেন : “বরাহনগরে এমন কতদিন গিয়েছে যে খাবার কিছুই নাই, ভাত জোটে ত নুন জোটে না। দিনকতক হয়ত শুধু নুন-ভাত চললো, কিন্তু কাহারও গ্রাহ্য নাই। কখন কখন শুধু তেলাকুচো পাতা-সিদ্ধ ও নুন-ভাত-এই মাসাবধি চলছে। আহা সেসব কি দিনই গেছে! সে কঠোরতা দেখলে ভূত পালিয়ে যেত, মানুষের কথা কি? কিন্তু এই দুঃখকষ্টের মধ্যেও জপ-ধ্যানের প্রবল তোড়ে আমরা ভাসছি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবিরাম সংকীর্তন হচ্ছে, কারও ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ক্লান্তিবোধ বা বিশ্রামের আকাক্ষা নাই। ব্যাকুল ঈশ্বরদর্শন-লালসা দাবাগ্নির ন্যায় প্রত্যেকের হৃদয়ের প্রজ্বলিত।”৫২
মঠ স্থাপিত হইলেও একস্থানে গৃহীর ন্যায় জীবনযাপন করা অনেক ভক্তেরই মনঃপূত হইল না। অনেকেরই মনে নির্জনবাসের ইচ্ছা জাগিয়া উঠিল। তীর্থভ্রমণ ও পরে নির্জনে বসিয়া একাকী ঈশ্বরচিন্তায় নিযুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে অনেকে মঠ ছাড়িয়া ভ্রমণে বাহির হইলেন। স্বামী বিবেকানন্দও এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া মাঝে মাঝে দুই-একজনকে সঙ্গে লইয়া তীর্থভ্রমণে বাহির হইতেন। কিন্তু আবার মঠে ফিরিয়া আসিতেন। ১৮৯১ সনের প্রথমভাগে দিল্লী হইতে তিনি একাকী ভারত পর্যটনে বাহির হইলেন এবং সাধারণ সাধু-সন্ন্যাসীর ন্যায় পদব্রজে ভ্রমণ করিয়া আলোয়ার, জয়পুর, খেতড়ি, গুজরাত, বম্বে, মহীশূর, মালাবার, মাদুরা, রামেশ্বর হইয়া কুমারিকা অন্তরীপে পৌঁছিলেন। পথে অনেক রাজা, মহারাজা, পণ্ডিত ও সাধুর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হইয়াছিল–তাহার বিস্তৃত বিবরণ তাহার জীবনীতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এখানে মাত্র কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করিতে চাই।
বিবেকানন্দের খ্যাতি শুনিয়া আলোয়ারের মহারাজা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রথমেই বলিলেন, স্বামীজি মহারাজ, শুনছি আপনি অদ্বিতীয় পণ্ডিত। তা আপনি ত সহজেই অনেক টাকা উপার্জন করিতে পারেন। তাহা না করিয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়ান কেন? স্বামীজি উত্তর করিলেন, মহারাজ, আপনি রাজকার্য অবহেলা করিয়া দিনরাত্রি সাহেবদের সঙ্গে খানা খাইয়া শিকার করিয়া বেড়ান কেন? মহারাজ বলিলেন, ঐরূপ করিতে ভাল লাগে। স্বামীজি বলিলেন, আমারও ফকিরী করে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। কথাপ্রসঙ্গে মহারাজা বলিলেন, আমি অন্য লোকের মত কাঠ, মাটি, পাথর, ধাতুর মূর্তিপূজা করিতে পারি না। সম্মুখেই দেওয়ালে মহারাজের একখানি ছবি ছিল, তাহা নামাইয়া আনিয়া স্বামীজি দেওয়ানজীকে বলিলেন, এই চিত্রের উপর নিষ্ঠীবন ত্যাগ কর। দেওয়ানজী হতভম্ব হইয়া বলিলেন, এ কি আদেশ করিতেছেন, ইহা আমাদের মহারাজের প্রতিকৃতি! ইহার প্রতি আমরা কিরূপে অসম্মান প্রদর্শন করিতে পারি? স্বামীজি তখন মহারাজার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, মহারাজ, দেখুন–যদিও এই চিত্রটি আপনি নহেন, এক টুকরা কাগজমাত্র, তথাপি হঁহারা উহাকে ঠিক আপনার মতই ভাবেন…। ভগবদ্ভক্তও প্রস্তর বা ধাতু নির্মিত দেবদেবী মূর্তিকে এইভাবে দেখেন–ঐসকল দেখিলে চিন্ময় ইষ্টদেব পরমব্রহ্মকেই মনে পড়ে, তাই ভক্ত ঐ মূর্তির এত সম্মান করেন। কেহ বলে না, হে প্রস্তর, আমি তোমার উপাসনা করি। হে ধাতু, আমার প্রতি সদয় হও। স্বামীজির কথা শেষ হইলে মহারাজা করযোড়ে নিবেদন করিলেন, প্রভো! আপনি যাহা বলিলেন, তাহার প্রতি বর্ণ সত্য। আমি এতদিন অন্ধ ছিলাম, কিছুই বুঝিতে পারি নাই। আজি আমার চক্ষু খুলিল।৫৩
জয়পুরে খেতড়ির মহারাজের সঙ্গে কিঞ্চিৎ ধর্মপ্রসঙ্গের পর মহারাজ একজন নর্তকীকে একটি গীত গাহিতে আদেশ করিলেন। সঙ্গীতব্যবসায়ী স্ত্রীলোক সম্ভবতঃ অসচ্চরিত্রা-এই আশঙ্কায় স্বামীজি স্থান ত্যাগ করিতে উদ্যত হইলে মহারাজার বিশেষ অনুরোধে একটি গান শুনিতে রাজী হইলেন। রমণী ভক্ত সুরদাসের পদ গাহিতে লাগিল। হিন্দী গানটির প্রথম ছয় লাইনের ভাবার্থ এই :
প্রভু আমার অসৎ প্রবৃত্তি দেখিও না,
কারণ তোমার নাম সমদর্শী,
একখণ্ড লৌহ মন্দিরে মূর্তির মধ্যে থাকে,
আর এক খণ্ড থাকে ব্যাধের (কসাইয়ের) ঘরে,
কিন্তু পরশমণি যদি স্পর্শ করে;
তবে দুইই স্বর্ণে পরিণত হয়।
স্থিরভাবে অপূর্ব তাল লয় সহকারে মধুরকণ্ঠে গীত এই বৈষ্ণব পদাবলী শুনিয়া স্বামীজি ভাবিলেন আজ ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ এই সারসত্যটি গায়িকা সুপরিস্ফুটভাবে আমার মর্মে বিদ্ধ করিয়া দিয়াছে। আমি সন্ন্যাসী আর এই স্ত্রীলোক পতিতা নারী, এ ভেদজ্ঞান তো আজিও যায় নাই। সর্বভূতে ব্রহ্মানুভূতি কি কঠিন। গায়িকা রমণীকে বলিলেন, মা, আমি অপরাধ করিয়াছি, আপনাকে ঘৃণা করিয়া উঠিয়া যাইতেছিলাম। আপনার গানে আমার চৈতন্য হইল।৫৪
এইরূপে ভ্রমণকালে স্বামীজি রাজা, মহারাজা, সাধু, পণ্ডিত প্রভৃতি সর্বশ্রেণীর লোকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। তিনি বহু দরিদ্র লোকেরও আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছেন এবং অনেক অস্পৃশ্য নীচজাতির বাটিতে খাদ্য গ্রহণ করিয়াছেন।
আগ্রা হইতে পদব্রজে বৃন্দাবন যাইবার পথে দেখিলেন, এক ব্যক্তি মহাআরামে ধূমপান করিতেছে। ক্ষুৎপিপাসাকাতর স্বামীজি তাহার নিকট হইতে কলিকাটি চাহিবামাত্র লোকটি নিতান্ত ত্রস্তভাবে বলিল, “মহারাজ, হাম ভঙ্গী (মেথর) হ্যায়’। স্বামীজি নিরাশচিত্তে অগ্রসর হইলেন, কিন্তু কিছুদূর গিয়াই তাহার মনে হইল, কি! সারাজীবন আত্মার অভেদ বিচার করিয়া শেষে জাতিভেদের পাকে পড়িলাম! ছি, ছি, এখনও সংস্কার! পুনরায় সেইস্থানে ফিরিয়া গিয়া তিনি ঐ মেথরের কলিকায় তামাক সেবন করিলেন।৫৫
এই দেশভ্রমণের ফলে স্বামীজি ঘনিষ্ঠভাবে দেশের সকল শ্রেণীর লোকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিবার সুযোগ পাইলেন। উৎপীড়িত, অসহায় ভারতবাসী জনসাধারণের দুঃখ, দুর্দশা, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতাজনিত কুসংস্কার এবং ধনীর ধর্মজ্ঞানহীনতা বিলাস ব্যসন প্রভৃতি ছায়াচিত্রের মতন তাঁহার সম্মুখে প্রসারিত হইল। তিনি দেখিলেন, রাজা মহারাজা এবং উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় পাশ্চাত্যের প্রভাবে নিজেদের অতীত সংস্কৃতি ও গৌরব বিস্মৃত হইয়াছে এবং শারীরিক ও মানসিক শক্তি উভয়ই বিসর্জন দিয়াছে। ইহার ফলে স্বামীজির জীবনের গতি পরিবর্তিত হইল।
ভারতবর্ষের সর্বদক্ষিণপ্রান্তে তিনটি সমুদ্রের সঙ্গমস্থল কুমারিকা অন্তরীপে পৌঁছিয়া স্বামীজি কন্যাকুমারীর পূজা করিলেন। তারপর সমুদ্রে নামিয়া অনতিদূরবর্তী এক প্রস্তরখরে উপর উত্তরাস্য হইয়া বসিলেন। কল্পনায় দেখিলেন, সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁহার সম্মুখে প্রসারিত এবং ধ্যানযোগে তাঁহার চিত্তে ভারতের অতীত ও বর্তমানের চিত্র ভাসিয়া উঠিল। তিনি মানসনেত্রে ভারতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করিয়া তাহার কর্তব্যপথ স্থির করিলেন। গুরুদেব শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের বাণী ‘খালিপেটে ধর্ম হয় না তাহার স্মরণপথে উদিত হইল। তিনি লিখিয়াছেন : “ভারতবর্ষের শেষ পাথর টুকরার উপর বসে ভাবতে লাগলাম, এই যে আমরা সন্ন্যাসীরা লোককে দর্শন শিক্ষা দিচ্ছি এসব পাগলামি-এই যে গরীবগুলো পশুর মত জীবন যাপন করছে তার কারণ মূর্খতা; আমরা আজ চার যুগ ওদের রক্ত চুষে খেয়েছি আর দু’পা দিয়ে দলেছি।”৫৬ তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন, আর নিজের মুক্তি বা নির্বিকল্প সমাধির চেষ্টা না করিয়া মুখ দরিদ্র ভারতবাসীর শিক্ষা ও অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করিবার জন্য জীবন উৎসর্গ করিবেন।
১৮৯২ সনের শেষভাগে স্বামীজি কন্যাকুমারী হইতে মাদ্রাজ ও হায়দ্রাবাদে গমন করেন। মাদ্রাজে তাঁহার বিপুল সম্বর্ধনা হয় ও এখানেই তিনি সর্বপ্রথম জনসমাজের নিকট বিস্তৃতভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। কিছুকাল পূর্ব হইতে ভারত-ভ্রমণকালে পাশ্চাত্ত্য দেশে যাইবার ইচ্ছা স্বামীজির মনে উদিত হইয়াছিল। কুমারিকা অন্তরীপে এই ইচ্ছা বর্ধিত হয় এবং আমেরিকায় বিশ্বের সকল ধর্মের প্রতিনিধিদের মহাসম্মেলনে যোগ দিবার ইচ্ছা তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। সর্বপ্রথমে মহীশূরে তিনি বেদান্ত প্রচারের উদ্দেশ্যেই পাশ্চাত্ত্যে যাইবেন এইরূপ মত ব্যক্ত করেন। কিন্তু মাদ্রাজের ভক্তদের নিকট তিনি বলেন যে, ভারতের দরিদ্র অধিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করাই তাহার লক্ষ্য। কুমারিকায় তাঁহার যে ধারণা হইয়াছিল যে ক্ষুধার্ত লোকের নিকট ধর্মপ্রচার করার কোন অর্থ নাই–এবং দরিদ্রের অন্নসংস্থানের জন্যই তিনি আমেরিকায় যাইতেছেন, পাশ্চাত্ত্যে যাত্রার অব্যবহিত পূর্বে তিনি তাঁহার দুই গুরুভাইকে এইরূপ বলিয়াছিলেন।৫৭ মহীশূরের মহারাজা ও হায়দ্রাবাদের নিজাম তাঁহার আমেরিকা যাত্রার খরচ বহন করিতে প্রস্তুত ছিলেন। মাদ্রাজের ভক্তগণও এই উদ্দেশ্যে চাঁদা তুলিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার ভক্ত ও শিষ্য খেতড়ির মহারাজাই তাহার যাত্রার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করেন।
১৮৯৩ সনের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ধর্মমহাসভার (Parliament of Religions) প্রথম অধিবেশন হয়। এই মহাসভায় স্বামীজি যে-কয়েকটি বক্তৃতা করেন তাহা হইতে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে তাঁহার মতামত ব্যক্ত হয় এবং মহাসভায় উপস্থিত অন্যধর্মাবলম্বী পাশ্চাত্ত্যদেশীয় শ্রোতাদের মনে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম জাগরূক করে।
প্রথম দিবসের অধিবেশনে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিগণ স্বীয় ধর্ম সম্বন্ধে খুব সাধারণভাবে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতে আহূত হন। বিবেকানন্দ মামুলীভাবে শ্রোতৃগণকে “ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ”–এইরূপ সম্বোধন না করিয়া “আমেরিকাবাসী ভগ্নী ও ভ্রাতৃমণ্ডলী”–এই সম্বোধন করায় কয়েক মিনিট পর্যন্ত তুমুল সাধুবাদ ও হর্ষধ্বনি উত্থিত হইল। তারপর স্বামীজি যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন তাহার সারমর্ম এই :৫৮
“যে ধর্ম চিরদিন সকল ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করিতে শিখাইয়াছে আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত বলিয়া মনে করি। আমরা যে অন্য ধর্মকে কেবল সমদৃষ্টিতে দেখি তাহা নহে, আমরা সকল ধর্মকেই সত্য বলিয়া মনে করি। যে ধর্মের অভিধানে ‘বর্জন’ বা পরিত্যাজ্য শব্দ (অর্থাৎ ইংরেজী exclusion-এর প্রতিশব্দ) নাই আমি সেই ধর্মভুক্ত। কোটি কোটি হিন্দু নরনারী যে স্তোত্রটি এখনও প্রতিদিন পাঠ করে তাহা এই : ‘যেমন ভিন্ন ভিন্ন নদীর উৎপত্তিস্থান বিভিন্ন হইলেও সকলেই সমুদ্রে পতিত হয়, তেমনি হে প্রভো! ভিন্ন ভিন্ন রুচি হেতু সরল ও কুটিল প্রভৃতি নানা ধর্ম পথ অবলম্বন করিলেও সকল যাত্রীর তুমিই একমাত্র গম্যস্থান।…
“আমাদের ধর্মগ্রন্থ গীতায় ভগবানের মুখে উক্ত হইয়াছে, যে যেরূপ ধর্মমত আশ্রয় করিয়া আসুক না কেন, আমি তাহাকে সেইভাবেই অনুগ্রহ করিয়া থাকি–মনুষ্যগণ সকল পথ দিয়াই আমার নিকটই পৌঁছে।
“সাম্প্রদায়িকতা, সঙ্কীর্ণতা ও উহাদের ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা, এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল ধরিয়া পীড়িত করিয়াছে ও বহুবার নরশোণিতে প্লাবিত করিয়াছে। কিন্তু আমি আশা করি যে আজ যে-ঘণ্টাধ্বনি এই মহাসভার আহ্বান জানাইয়াছে তাহাই ঐ সমুদয়ের নিধনবার্তা ঘোষণা করিবে।”
এই বক্তৃতায় স্বামীজি তাঁহার গুরুর মহান উদার বাণী “যত মত তত পথ”– বিশ্বের সকল ধর্মের অনুগামীদের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। ১৫ই সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা স্বীয় ধর্মমতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করিতে যত্নবান হইলে স্বামীজি গুরুর আর-একটি উক্তি বা উপদেশমূলক আখ্যান উদ্ধৃত করিয়া ইহার উত্তর দেন।
“কোন একটি ক্ষুদ্র কূপে এক ভেক বাস করিত। দৈবক্রমে সমুদ্রতীরবাসী একটি ভেক আসিয়া সেই কূপে পতিত হইল। প্রথম ভেকটি যখন শুনিল যে দ্বিতীয়টি সমুদ্র হইতে আসিয়াছে, তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, সমুদ্র? সে কত বড়? তাহা কি আমার কূপের মত বড়? সে যত বলে যে ক্ষুদ্র কূপের সহিত সমুদ্রের তুলনাই হইতে পারে না–ততই কূপমণ্ডুক তাহার প্রতিবাদ করিল এবং অবশেষে বলিল, আমার কূপের ন্যায় কিছুই বড় হইতে পারে না, ইহা অপেক্ষা কিছুই বড় থাকিতে পারে না; এটা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী, অতএব ইহাকে তাড়াইয়া দাও।”
এই আখ্যানটির উল্লেখ করিয়া স্বামীজি বলিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ, এইরূপ সঙ্কীর্ণ ভাবই আমাদের মতভেদের কারণ। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান–আমরা সকলেই নিজের নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসিয়া আছি ও ইহাকেই সমগ্র জগৎ মনে করিতেছি। আশা করি এই ধর্মমহাসভার ফলে এই ক্ষুদ্র জগৎগুলির অবরোধ ভাঙ্গিয়া যাইবে।”
১৯শে সেপ্টেম্বর একটি লিখিত ভাষণে স্বামীজি হিন্দুধর্মের বিশেষতৃগুলি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন। শ্রীশ্রীপরমহংসদেব যে সকল সংক্ষিপ্ত উপদেশ দিতেন ইহা তাহারই ভাষ্যমাত্র। হিন্দুধর্মের ব্যাপকতা ও উদারতার পরিচয়স্বরূপ তিনি বলেন :
“আধুনিক বিজ্ঞানের নূতনতম আবিস্ক্রিয়াসমূহ বেদান্তের প্রতিধ্বনিমাত্র। সেই সর্বোৎকৃষ্ট বেদান্তজ্ঞান হইতে সামান্য মূর্তিপূজা ও তদানুসঙ্গিক নানাবিধ পৌরাণিক গল্প পর্যন্ত, এমনকি, বৌদ্ধদের অজ্ঞেয়বাদ এবং জৈনদের নিরীশ্বরবাদ-এই প্রত্যেকটিরই হিন্দুধর্মে স্থান আছে।” ইহার প্রয়োজনীয়তা ও অন্য ধর্মের সহিত এ-বিষয়ে হিন্দুধর্মের প্রভেদ স্বামীজি নিম্নলিখিত যুক্তিদ্বারা নির্দেশ করিয়াছেন :
“অন্যান্য ধর্ম কতকগুলি নির্দিষ্ট মতবাদ বিধিবদ্ধ করিয়া সমাজের সকলকে তাহাই বলপূর্বক মানিয়া লইতে বাধ্য করেন। সকলের সম্মুখে এক মাপের একটিমাত্র জামা রাখিয়া জ্যাক, জন, হেনরী সকলকেই উহা পরিতে হুকুম করেন। যাহার গায়ে এ জামা লাগে না সে বরং খালিগায়ে থাকিবে তবু অন্যরকম বা অন্য অন্য মাপের জামা পরিতে পারিবে না–অর্থাৎ খালিগায়ে থাকিবে তাহাও ভাল কিন্তু জামার বদল হইবে না। হিন্দুগণ বুঝিয়াছেন যে কেবল সাপেক্ষকে আশ্রয় করিয়াই নিরপেক্ষ তত্ত্বের ধারণা উপলব্ধি বা প্রকাশ সম্ভব। অতএব তাঁহাদের মতে হিন্দুদের দেববিগ্রহ, খ্রীষ্টানদের ক্রস (Cross) ও মুসলমানদের চন্দ্রকলা প্রভৃতি অধ্যাত্মিক উন্নতির সহায়স্বরূপ। সকলের পক্ষে ইহা আবশ্যক না হইতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ লোকই যে ইহাতে পরম উপকার লাভ করেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।…ভারতবর্ষে মূর্তিপূজা একটা ভয়ানক ব্যাপার নয়। ইহা দুষ্কর্মের অনুষ্ঠানের প্রশ্রয় দেয় না; বরং ইহা দুর্বল অধিকারীদিগকে ধর্মের উচ্চভাব ধারণা করিতে সক্ষম করে।…হিন্দু পক্ষে সমস্ত ধর্মজগত্তা নানা রুচিবিশিষ্ট নরনারীর নানা অবস্থার মধ্য দিয়া সেই একমাত্র ঈশ্বরোপলব্ধির পথে অগ্রসর হওয়ার উপায় ভিন্ন আর কিছুই নহে।”
হিন্দুধর্মের এই সকল ভিন্ন ভিন্ন ও আপাতদৃষ্টিতে বিরোধীভাব সমুদয়ের সাধারণ ভিত্তিমূল কোথায়? কোন্ সাধারণ কেন্দ্রকে আশ্রয় করিয়া ইহারা অবস্থা করিতেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি জীবদেহ এবং আত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করিয়াছেন : “আমি এখানে দাঁড়াইয়া আছি। যদি চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আমার সত্তা সম্বন্ধে চিন্তা করি-’আমি’, ‘আমি’, ‘আমি’, তাহা হইলে আমার কী ভাবের উদয় হয়? এই দেহই আমি-এই ভাবই মনে আসে। বেদ বলিতেছে, না, আমি দেহমধ্যস্থ আত্মা’-আমি দেহ নহি। দেহ নষ্ট হইবে, কিন্তু আমি নষ্ট হইব না। আমি এই দেহের মধ্যে আছি–কিন্তু যখন এই দেহ পঞ্চত্ব লাভ করিবে তখনও আমি বিদ্যমান থাকিব এবং দেহগ্রহণের পূর্বেও আমি ছিলাম। আত্মা কোন পদার্থ হইতে সৃষ্ট হন নাই।
“হিন্দু আপনাকে আত্মা বলিয়া বিশ্বাস করেন। সেই আত্মাকে তরবারি ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল আর্দ্র করিতে পারে না ও বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না। সেই আত্মা এমন একটি বৃত্তস্বরূপ, যাহার পরিধি নির্ণয় করা যায় না, কিন্তু যাহার কেন্দ্র কোন একটি দেহমধ্যে অবস্থিত, এবং সেই কেন্দ্রের দেহ হইতে দেহান্তরে গমনের নামই মৃত্যু। আর আত্মা জড় নিয়মের বশীভূত নহেন, ইনি নিত্য-শুদ্ধ-বৃদ্ধ-মুক্তস্বভাব; অনাদি, অমর ও পূর্ণ। মনুষ্যের বর্তমান অবস্থা পূর্বজন্মে অনুষ্ঠিত কর্মের ফল; এবং ভবিষ্যৎ বর্তমান কর্মের ফলস্বরূপ।
“আত্মা ব্রহ্মস্বরূপ, কেবলমাত্র পঞ্চভূতে বদ্ধ হইয়া আছেন। যখন তিনি এই বন্ধন হইতে মুক্ত হন, তখনই পূর্ববৎ পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। এই অবস্থার নাম মুক্তি অর্থাৎ অপূর্ণতা, জন্ম-মৃত্যু-আধিব্যাধি প্রভৃতি হইতে নিষ্কৃতি। ঈশ্বরের কৃপা হইলেই কেবল আত্মার এই বন্ধন মোচন হইতে পারে। আর পবিত্র স্বভাব লোকের উপরেই তাহার কৃপা হয়। যখন তাহার কৃপা হয়, তখন শুদ্ধ বা পবিত্র হৃদয়ে তিনি প্রকাশিত হন। নির্মল বিশুদ্ধ মানব ইহজীবনেই তাঁহার দর্শন লাভ করেন। আমি আত্মাকে দর্শন করিয়াছি, ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাইয়াছি’ এই অনুভূতি না হইলে কোন মনুষ্য পূর্ণ হইতে পারে না। অতএব ক্রমাগত অধ্যবসায় ও যত্নদ্বারা পূর্ণতা লাভ করা-দেবতা হওয়া, ঈশ্বরের সান্নিধ্য ও তাহার দর্শন লাভ করাই হিন্দুদের সমুদয় সাধন-প্রণালীর লক্ষ্য। আর এইরূপে ঈশ্বর-সান্নিধ্য লাভ করিয়া, তাঁহাকে দর্শন করিয়া, তাঁহার ন্যায় পূর্ণ হওয়াই হিন্দুর ধর্ম। পূর্ণ হইলে মনুষ্য নিত্য আনন্দ ভোগ করেন, যিনি সমুদয় লাভের অপেক্ষা পরম ও চরম লাভস্বরূপ সেই পরমানন্দধাম ঈশ্বরকে পাইয়া পরমানন্দের অধিকারী হন।”।
এইরূপে হিন্দুধর্মের অন্তর্নিহিত সারসত্য ব্যাখ্যা করিয়া স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিপন্ন করেন যে হিন্দুর অদ্বৈতবাদই ধর্ম-বিজ্ঞানের চরম সিদ্ধান্ত। মূল শক্তি অর্থাৎ যে শক্তি হইতে অন্যান্য শক্তি উদ্ভূত হইয়াছে তাহার আবিষ্কার করাই বিজ্ঞানের চরম উন্নতি। অদ্বৈতবাদও পরিবর্তনশীল জগতের মূল কারণ যিনি একমাত্র পরমাত্মা, অন্যান্য আত্মা, যাহার প্রতিবিম্বস্বরূপ আবিষ্কার করিয়াছে। এইরূপে বহু-ঈশ্বরবাদ, দ্বৈতবাদ প্রভৃতির ভিতর দিয়া অদ্বৈতবাদে উপনীত হইলে ধর্মবিজ্ঞান আর অগ্রসর হইতে পারে না।
বেদান্ত ব্যাখ্যার পর হিন্দুদের যে-সকল ধর্মমত ও বিশ্বাস প্রভৃতি কুসংস্কার বলিয়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা নিন্দা করে, বিবেকানন্দ তাহার প্রতিবাদ করিয়াছেন। তিনি দেখাইয়াছেন, প্রতিমা পূজা-তথাকথিত পৌত্তলিকতা–প্রথমাবস্থায় প্রয়োজনীয় পরে কিঞ্চিৎ উন্নতি লাভ করিলে ইহা ত্যাগ করাও চলে। সুতরাং ইহা ভ্রমাত্মক নহে। হিন্দুদের মতে, ক্ষুদ্র অজ্ঞানীদের ধর্ম হইতে বেদান্তের অদ্বৈতবাদ পর্যন্ত যাবতীয় ধর্মই অনাদি পরব্রহ্ম উপলব্ধির সাধন বা সোপানস্বরূপ, জন্ম ও অবস্থাভেদ যাহার পক্ষে যাহা উপযোগী, তিনি সেইটিকে আশ্রয় করিয়া অপরটিকে উত্থিত হইবেন। অর্থাৎ মানব ভ্রম হইতে সত্যে গমন করিতেছে না, কিন্তু নিম্নতর হইতে উচ্চতর সত্যে গমন করিতেছে।
হিন্দুদের অনেক কুসংস্কার আছে ইহাদিগকে দোষ বলিয়া স্বীকার করিয়াও তিনি মন্তব্য করিয়াছেন—’মনে রাখা উচিত যে ইহার ফলে তাহারা নিজের দেহ পীড়ন করে, কিন্তু অন্যধর্মাবলম্বীর শিরশ্চেদ করে না। হিন্দু নরনারী অগ্নিকুণ্ডে স্বীয় দেহপাত করে, কিন্তু বিধর্মীদের, অথবা ডাকিনী বলিয়া শত শত স্ত্রীলোককে পোড়াইয়া মারিবার জন্য আগুন জ্বালায় না।’
শিকাগোর ধর্মমহাসভার প্রধান উদ্দেশ্য ও আদর্শ–ধর্মসমন্বয়ের সাধারণ ভিত্তিভূমি সম্বন্ধে ইহার শেষ অধিবেশনে তিনি বলেন : যদি এখানে কেহ এরূপ আশা করেন যে, উক্ত সমন্বয় বিভিন্ন ধর্মসমূহের মধ্যে একটির অভ্যুদয় ও অপরগুলির বিনাশ দ্বারা সাধিত হইবে, তবে তাহাকে আমি বলি, ভ্রাতঃ, তোমার আশা ফলবতী হওয়া অসম্ভব। আমি ইচ্ছা করি না যে খ্রীষ্টান হিন্দু হউন অথবা হিন্দু বা বৌদ্ধ খ্রীষ্টান হউন। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মই অন্যান্য ধর্মগুলির সারভাগগুলিকে ভিতরে গ্রহণ ও তদ্বারা পুষ্টিলাভ করিয়া আপনার বিশেষত্ব রক্ষাপূর্বক নিজের প্রকৃতি অনুসারে পরিবর্ধিত হইবে।…পবিত্রতা, উদারতা, চিত্তশুদ্ধি প্রভৃতি সদ্গুণসমূহ কোন ধর্মেরই নিজস্ব নহে এবং প্রত্যেক ধর্মেই উন্নতচরিত্র নরনারীর আবির্ভাব হইয়াছে। শীঘ্রই দেখিবেন…সকল ধর্মের পতাকাশীর্ষে লিখিত হইবে, ‘সমর নহে–সহায়তা!’ ‘বিনাশ নহে–বরণ! দ্বন্দ্ব নহে–মিলন ও শান্তি।’
শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজির বক্তৃতাগুলি চারিসহস্র শ্রোতবর্গের হৃদয় জয় করিয়া তাহাদের মনে এক অপূর্ব গভীর ভাবের সঞ্চার করিয়াছিল। বিভিন্ন সংবাদপত্রে উচ্ছ্বসিত ভাষায় তাঁহার প্রশংসা হইত। একটি কাগজ (New York Herald) লিখিল, “ধর্মমহাসভায় ইনিই নিঃসন্দেহে সর্বপ্রধান ব্যক্তি। ইহার বক্তৃতা শ্রবণ করিয়া আমরা বুঝিতে পারিয়াছি যে, সুশিক্ষিত ভারতবাসীর নিকট খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য মিশনারী পাঠান কতদূর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।” বোষ্টনের কাগজে লিখিল, “তাঁহার পাণ্ডিত্য এত বেশী যে, আমাদের দেশের খুব কম পণ্ডিতই তাঁহার সহিত তুলনায় দাঁড়াইবার যোগ্য।” আরও কয়েকটি কাগজের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি : “সভায় বহু খ্রীষ্টান বিশপ এবং প্রায় সকল সম্প্রদায়ের ধর্মোপদেষ্টাগণ উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই তৎপ্রভাবে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়াছেন।” “ইনিই সেই ব্যক্তি যাহার প্রশংসা-ধ্বনিতে মহাসভায় সর্বাপেক্ষা অধিক কোলাহল উত্থিত হইয়াছিল এবং স্রোতৃবৃন্দের আগ্রহাতিশয়ে যাঁহাকে পুনঃপুনঃ সভামধ্যে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছিল।” “ধর্মসভার অধ্যক্ষেরা লোককে আকৃষ্ট করিবার জন্য শেষপর্যন্ত বিবেকানন্দকে রাখিয়া দিতেন। শত শত শ্রোতা চলিয়া যাইতেছে দেখিলে সভাপতি অমনি উঠিয়া বলিলেন সভার কার্য শেষ হইবার অব্যবহিত পূর্বে স্বামী বিবেকানন্দ একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা দিবেন। আর কথা নাই, অমনি সেই শত শত ব্যক্তি দাঁড়াইয়া পড়িতেন। এইরূপে কলম্বস হলের চারিসহস্র শ্রোতা শেষকালে বিবেকানন্দের পনর মিনিট বক্তৃতা শুনিবার জন্য সহাস্য বদনে দুই ঘণ্টা হাঁ করিয়া বসিয়া থাকিত।”
ধর্মমহাসভার জেনারেল কমিটির সভাপতিও বলিয়াছেন : “স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার শ্রোতৃবর্গের উপর আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন।” মাননীয় মি. মারউইন-মেরী সেল (Hon’ble Mr. Merwin-Marie Snell) লিখিয়াছেন : “আর কোন ধর্মই ধর্ম-মহাসভায় হিন্দুধর্মের ন্যায় প্রতিপত্তি বিস্তার করিতে পারে নাই এবং এই ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ। মহাসভায় ইহার প্রভাব ও আদর যে সর্বাপেক্ষা অধিক হইয়াছে সে-বিষয়ে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। …খ্রষ্টান অখ্রীষ্টান সকল বক্তা অপেক্ষা লোকে তাঁহাকেই অধিকতর উৎসাহ সহকারে সম্বর্ধনা করিত। তিনি যেদিকে যাইতেন সেইদিকেই লোকের ভীড় হইত এবং তাঁহার মুখের প্রত্যেক কথাটি শুনিবার জন্য তোক উদ্গ্রীব হইয়া থাকিত।”৫৯
এইরূপে শিকাগো ধর্মমহাসভা অনুষ্ঠানের ফলে বিবেকানন্দ বিশ্ববরেণ্য মহাপুরুষ বলিয়া পরিগণিত হইলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে অপরিচিত, অবহেলিত হিন্দুধর্ম গৌরবের শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত হইল। ভারতের নব জাতীয় জাগরণের উপরে ইহার প্রভাব অন্যত্র আলোচিত হইবে।
কিন্তু বিবেকানন্দ যে হিন্দুধর্মের গৌরব প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তাহা ঊনবিংশ শতাব্দীতে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত হিন্দুধর্ম হইতে অনেক পৃথক। মোটের উপর একথা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না, উনবিংশ শতাব্দীতে একদিকে ব্রাহ্মধর্ম ও অপরদিকে গোঁড়া হিন্দুধর্মের মধ্যে যে বিরোধ জাগিয়া উঠিয়াছিল, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ তাঁহার সমন্বয় সাধন করেন। তাঁহারা হিন্দুধর্মকে যে রূপ দিয়া গিয়াছেন বর্তমান যুগে তাহাই হিন্দুধর্মের স্বরূপ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
যাহারা পাশ্চাত্ত্য সভ্যতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করিবার পক্ষপাতী ছিল এবং যাহারা পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার উজ্জ্বল আলোকে অন্ধ হইয়া প্রাচীন হিন্দুধর্মকে একেবারে অসার বলিয়া ত্যাগ করিতে প্রস্তুত ছিল–স্বামীজি এই উভয়কেই ভ্রান্ত বলিয়াছেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বলিয়াছেন যে, পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা করা হিন্দুদের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়, কারণ এই শিক্ষার অভাবই হিন্দুদের পতনের একটি প্রধান কারণ আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক শক্তি না থাকিলে কেবল আধ্যাত্মিক শক্তি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। অন্যদিকে তিনি জোরের সহিত বলিয়াছেন যে, হিন্দুধর্ম এখন অন্তঃসারশূন্য হইয়া কতকগুলি কুসংস্কার ও লোকাঁচারে পরিণত হইয়াছে –সুতরাং ঐগুলি দূরীভূত করিতে হইবে। তিনি একখানি পত্রে লিখিয়াছিলেন : “ঘণ্টা ডাইনে বাজবে না বাঁয়ে, চন্দনের টিপ মাথায় কি কোথায় পরা যায়, পিদ্দীম দুবার ঘুরবে বা চারবার-ঐ নিয়ে যাদের মাথা দিনরাত ঘামাতে চায়, তাদেরই নাম হতভাগা। যদি ভাল চাও ত ঘণ্টা ফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান, নারায়ণের মানবদেহধারী হরেক মানুষের পূজা করগে….এর নাম কর্মঘণ্টার উপর চামর চড়ান নয়–আর, ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট বস্ব কি আধঘণ্টা বস্-এ বিচারের নাম কর্ম নয়, ওর নাম পাগলা গারদ। ক্রোড় টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলচে আর পড়ছে! এই ঠাকুর কাপড় ছাড়চেন, ত এই ঠাকুর ভাত খাচ্চেন, ত এই ঠাকুর আঠকুড়ির বেটাদের গুষ্টির পিণ্ড করছেন–এ দিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা মরে যাচ্ছে। বোম্বায়ের বেনেগুলো ছারপোকার হাসপাতাল বানাচ্চে-মানুষগুলো মরে যাক।”৬০
“পুঁথি পড়ে বি–অবগত হয়েছেন যে এ দুনিয়াতে যত লোক আছে তারা সকলে অপবিত্র এবং তাদের প্রকৃতিতে আসল ধর্ম হবার যো-টি নেই, কেবল ভারতবর্ষের এক মুষ্টি ব্রাহ্মণ যারা আছেন তাঁদেরই ধর্ম হতে পারবে।…ভোগের সময় ব্রাহ্মণের জাতের স্পর্শে দোষ নাই–ভোগ সাঙ্গ হলেই স্নান, কেননা ব্রাহ্মণেতর অপবিত্র জাতি অন্য সময় তাদের স্পর্শ করাও নাই। সাধু-সন্ন্যাসী, আর ব্রাহ্মণ বাস দেশটা উৎসন্ন দিয়েছে। দেহি-দেহি, চুরি-বদমাসি–এরা আবার ধর্মের প্রচারক! পয়সা নেবে, সর্বনাশ করবে, আবার বলে ছুঁয়ো না ছুঁয়ে–আর কার্য তো ভারি-’আলুতে বেগুনেতে যদি ঠেকাঠেকি হয়, তাহলে কতক্ষণে ব্রহ্মাণ্ড রসাতলে যাবে?’ ‘চৌদ্দবার হাতে মাটি না করলে চৌদ্দ পুরুষ নরকে যায় কি চব্বিশ পুরুষ?’-এই সকল দুরূহ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছেন আজ দুই হাজার বৎসর ধরে। এদিকে সিকি ভাগ লোক না খেতে পেয়ে মরছে। আট বৎসরের মেয়ের সঙ্গে তিরিশ বৎসরের পুরুষের বিয়ে দিয়ে মেয়ের মা আহ্লাদে আটখানা। ছয় বৎসরের মেয়ের গর্ভাধানের যাঁরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেন, তাঁদের কোন্ দেশী ধর্ম?”৬১
“হিন্দুর (এখনকার) ধর্ম বেদে নাই, পুরাণে নাই, ভক্তিতে নাই, মুক্তিতে নাই–ধর্ম ঢুকেছেন ভাতের হাঁড়িতে। (এখনকার) হিন্দুর ধর্ম বিচারমার্গেও নয়, জ্ঞানমার্গেও নয়, ছুত্সর্গ, আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না, বস্। এই ঘোর বামাচার ছুত্সর্গে পড়ে প্রাণ খুইও না। আত্মবৎ সর্বভূতেষু’ কি কেবল পুঁথিতে থাকিবে না কি? যারা এক টুকরা রুটী গরীবের মুখে দিতে পারে না তারা আবার মুক্তি কি দিবে! যারা অপরের নিঃশ্বাসে অপবিত্র হয়ে যায়, তারা আবার অপরকে কি পবিত্র করবে? চুত্যার্গ একপ্রকার মানসিক ব্যাধি, সাবধান। সর্বপ্রকার বিস্তারই জীবন, সর্বপ্রকার সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু। যেখানে প্রেম সেখানেই বিস্তার; যেখানে স্বার্থপরতা সেখানেই সঙ্কোচ, অতএব প্রেমই জীবনের একমাত্র বিধি।…সকল অবতারের মধ্যে চৈতন্য প্রভু বড়, কিন্তু তাহাতে (প্রেমের সমান) জ্ঞানের অভাব ছিল-রামকৃষ্ণ অবতারে জ্ঞান, ভক্তি ও প্রেম। অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রেম, অনন্ত কর্ম, অনন্ত জীবে দয়া।…”
“সমগ্র হিন্দু জাতি সহস্র সহস্র যুগ ধরিয়া যে চিন্তা করিয়া আসিয়াছেন; তিনি এক জীবনেই সেই সমুদয় ভাব উপলব্ধি করিয়াছেন। তাহার জীবন সকল জাতির শাস্ত্রসমূহের জীবন্ত টীকাস্বরূপ।”৬২।
স্বামী বিবেকানন্দের প্রচাতির হিন্দুধর্মের ভিত্তি কী, ১৮৯৭ সনে লিখিত তাঁহার একখানি ইংরাজী পত্রের নিম্নলিখিত অংশ হইতে তাহা বুঝা যাইবে।
“তুমি বেদ সম্বন্ধে যে আপত্তিগুলি প্রদর্শন করিয়াছ, সেগুলি যথার্থ বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যাইত, যদি ‘বেদ’ শব্দ কেবল সংহিতা বুঝাইত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের সর্বদিসম্মত মতানুসারে সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ্ এই তিনটির সমষ্টিই বেদ। ইহাদের মধ্যে প্রথম দুইটি কর্মকাণ্ড বলিয়া এখন একরূপ অন্তর্হিত হইয়াছে। কেবল উপনিষদকেই আমাদের সকল দার্শনিক ও বিভিন্ন মতের সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতৃগণ গ্রহণ করিয়াছেন। কেবল সংহিতা অংশটিই বেদ, এ মত অতি আধুনিক এবং স্বর্গীয় স্বামী দয়ানন্দই এই মতের প্রথম প্রবর্তক। প্রাচীন হিন্দুসমাজের ভিতর এই মতের প্রভাব কিছুমাত্র বিস্তৃত হয় নাই।…গীতা নিঃসন্দেহই এতদিনে হিন্দুধর্মের বাইবেল স্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।”৬৩
গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের যে রূপ দেশের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলেন, উল্লিখিত উক্তিগুলি হইতে তাহার সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যায়। একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, ইহাই বর্তমান যুগে হিন্দুধর্মের স্বরূপ বলিয়া ভারতের শিক্ষিত সমাজে গৃহীত হইয়াছে–এবং হয়ত ইহার আদর্শেই হিন্দুধর্ম ভবিষ্যতে নূতন আকার ধারণ করিবে। সমাজ ও ধর্মের দিক দিয়া দেখিলে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ বাংলা দেশে যে এক নবযুগের সূচনা করিয়াছেন এবং কালে ইহার প্রভাব যে সুদূরস্পর্শী হইবে সে-বিষয় কোন সন্দেহ নাই। এইজন্যই ইহাদের কাহিনী বিস্তৃতভাবে লিখিত হইয়াছে।
আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশে ঘুরিয়া ১৮৯৭ সনের ১৫ জানুআরি স্বামী বিবেকানন্দ কলম্বোতে উপনীত হইলেন, এবং দক্ষিণভারতে রামনদ, মাদ্রাজ প্রভৃতি নানাস্থানে কিছুদিন কাটাইয়া ২০ ফেব্রুআরি কলিকাতা পৌঁছিলেন। সকল স্থানেই স্বামীজির অভ্যর্থনার যে বিপুল আয়োজন হইয়াছিল তাহার তুলনা নাই। বামনদের রাজা নিজে অন্যান্য দর্শকগণসহ স্বামীজির গাড়ী টানিয়া নিয়াছিলেন। কলিকাতায়ও এই দৃশ্যের পুনরভিনয় হইয়াছিল। ইহার পর স্বামীজি উত্তরভারতেও বহু স্থান ভ্রমণ করেন–সকল জায়গাতেই স্বামীজি স্বাগত-সম্ভাষণের প্রত্যুত্তর ও কোন কোন স্থানে সাধারণভাবে বক্তৃতা করিয়াছিলেন। ইহার অনেকগুলি মুদ্রিত হইয়াছে।৬৪ কলম্বো হইতে হিমালয় পর্যন্ত এই অভিযানের ফলে ভারতে হিন্দুধর্মের নূতন কলেবরে নবজন্ম লাভ হইয়াছিল।
এই সমুদয় অভ্যর্থনা ও নানা শ্রেণীর দর্শকের সাক্ষাৎকারে ব্যস্ত থাকিলেও স্বামীজি পুরাতন মঠের কথা বিস্মৃত হন নাই। ১৮৯২ সনে মঠটি বরাহনগর হইতে আলমবাজারে উঠিয়া গিয়াছিল। স্বামীজি সারাদিন নানা কার্যে ব্যস্ত থাকিলেও প্রতিরাত্রে মঠে যাইয়া গুরুভাইদের সঙ্গে ভবিষ্যতের কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন। তিনি যে নূতন কর্মপদ্ধতির আদর্শ তাঁহাদের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন, তাহার মূল লক্ষ্য ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ এই মহামন্ত্রকে কার্যে রূপায়িত করা। ঠাকুরের ভক্তেরা যাহাতে জনসাধারণের শিক্ষাবিস্তার, দারিদ্র্য ও ব্যাধির হাত হইতে পরিত্রাণ, এবং সামাজিক বৈষম্য ও কলুষতার দূরীকরণ দ্বারা তাহাদের সর্ববিধ নৈতিক, শারীরিক ও মানসিক উন্নতি বিধানে আত্মোৎসর্গ করেন, ইহাই ছিল স্বামীজির মূল কথা– অর্থাৎ, যাহাতে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী-সংঘ ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জাগরণ ও সামাজিক সংস্কারকেও ইহার এক প্রধান অঙ্গস্বরূপ মনে করিয়া এক নূতন আদর্শে অনুপ্রাণিত হন তাহার ব্যবস্থা করা। একদল ভক্ত প্রথমে ইহা অনুমোদন করেন নাই। তাঁহাদের মতে ঈশ্বরের সাধন ভজন দ্বারা মুক্তিলাভ করাই সন্ন্যাস-গ্রহণের উদ্দেশ্য-কোন কারণেই সাংসারিক ব্যাপারে লিপ্ত হওয়া কর্তব্য নহে–ইহাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ। কিন্তু বহু তর্কবিতর্কের পর স্বামীজির মতই গৃহীত হইল।৬৫
এই মহান আদর্শ কর্যে পরিণত করিবার উদ্দেশ্যে ১৮৯৭ সনের মে মাসে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হইল। দেশে ও বিদেশে বেদান্ত ধর্ম প্রচার, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে প্রীতির বন্ধন স্থাপন, এবং ভারতীয় জনসাধারণের ঐহিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নানাস্থানে মঠ ও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করিয়া একদল সন্ন্যাসী ও গৃহীকে শিক্ষাদান–এই সমুদয় মিশনের কার্যসূচী বলিয়া নিরূপিত হইল।
অতঃপর আলমবাজার হইতে বেলুড়ে মঠটি স্থানান্তরিত করিয়া ১৮৯৮ সনের ৯ ডিসেম্বর যথারীতি শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী বর্তমান বেলুড় মঠের প্রতিষ্ঠাকার্য সম্পন্ন হইল। মঠের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা ও কার্যসূচী নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য অনেক নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ করা হইল। ইহার মধ্যে নিম্নলিখিত দুইটি নিয়ম বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
১। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের প্রদর্শিত পথে প্রত্যেকে যাহাতে নিজের মুক্তি ও জগতের সর্বপ্রকার কল্যাণসাধন করিতে সক্ষম হন তাহাই এই মঠ স্থাপনের উদ্দেশ্য। স্ত্রীলোকদিগের জন্য এইরূপ পৃথক মঠ প্রতিষ্ঠিত হইবে।
২। উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণীর মধ্যে গুরুতর ব্যবধানই ভারতের সর্ববিধ দুর্দশার মূল কারণ। এই ব্যবধান দূর না হইলে দেশের মঙ্গল নাই। অতএব জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা ও ধর্মবিস্তারের জন্য সর্বত্র প্রচারক পাঠাইতে হইবে।
ইহাও স্থির হইল যে, বেলুড় মঠই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান মঠ অর্থাৎ কেন্দ্র হইবে এবং রামকৃষ্ণসম্প্রদায়ের সকল সন্ন্যাসীকেই ইহার নিয়মপ্রণালী অনুসারে চলিতে হইবে। প্রথমে রামকৃষ্ণ মিশনকে মঠের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল, কিন্তু শিক্ষা, আত্রাণ প্রভৃতি দেশহিতকর কার্যের প্রসার হওয়ায় ১৯০৯ সনে রামকৃষ্ণ মিশন পুনরুজ্জীবিত হইল। ফলে বেলুড় মঠের কর্তৃপক্ষের অধীন হইলেও ইহা
একটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পাইল এবং সন্ন্যাসী ব্যতীত গৃহী ভক্তরাও ইহার সদস্যপদের অধিকারী হইল।
বর্তমানে ভারতের সর্বত্র রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের শাখা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহার সংখ্যা ৮৩। ভারতের বাহিরেও অনেক মিশন আছে। ইহাদের সংখ্যা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ১১। সমগ্র পৃথিবীতে ৪১টি মঠ, ৫০টি মিশন ও ২১টি যুক্ত মঠ ও মিশন আছে।
৪. থিওসফিক্যাল সম্প্রদায়
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৭৫ সনে ম্যাডাম ব্লাভাস্কি (Madame H. P. Blavatsky), কর্ণেল অলকট (H. S. Olcott) প্রভৃতি কয়েকজন মিলিয়া থিওসফিক্যাল সম্প্রদায় (Theosophical Society) প্রতিষ্ঠা করেন। ইহার উদ্দেশ্য : (১) জগতের নরনারীর মধ্যে সৌভ্রাত্র স্থাপন; (২) প্রাচীন ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের তুলনামূলক চর্চায় উৎসাহ প্রদান; এবং (৩) প্রকৃতির রাজ্যে যে সমুদয় ঘটনা ঘটে অথচ যাহার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ এখনও পাওয়া যায় নাই, তাহার গূঢ় কারণ নির্ণয় ও মানুষের মধ্যে যে অন্তনিহিত ঐশীশক্তি আছে তাহার মূল উৎস অনুসন্ধান এবং বৃদ্ধিকরণ।
প্রকট, অপ্রকট সমগ্র চরাচর বিশ্বের পশ্চাতে যে একটি সত্তা (বা আত্মা) বিদ্যমান ভারতীয় বেদান্ত মতের অনুযায়ী এই বিশ্বাসই প্রথম উদ্দেশ্যের ভিত্তি।
থিওসফিষ্টরা বিশ্বাস করেন যে, জগতে যত বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় আছে তাহার সবগুলিই একটি মৌলতত্ত্ব হইতে উদ্ভূত এবং কেবল একশ্রেণীর সাধুরা তাহা অবগত আছেন। ইঁহাদিগকে ‘মহাত্মা’ বলা হয়। ইহারা এখনও হিমালয় পর্বতে বাস করেন। ম্যাডাম ব্লাভাস্কি হঁহাদের সহিত সংযোগ স্থাপন করিয়া অনেক গূঢ়তত্ত্ব জানিতে পারিয়াছিলেন, যাহার ফলে তিনি অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হইয়াছিলেন। এই মতবাদই দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের ভিত্তি।
তৃতীয় উদ্দেশ্য, ভারতের অতীন্দ্রিয়বাদ বা অলৌকিকবাদের অনুরূপ এবং ইহার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। হিন্দুধর্মের সহিত এইরূপ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধবশত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমে থিওসফি মতবাদ শিক্ষিত হিন্দুদিগকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করিয়াছিল। ইহার আর-একটি কারণ এই, হিন্দুধর্মের ও সমাজের যে সমুদয় অঙ্গ-প্রতিমাপূজা, জাতিভেদ প্রভৃতি–খ্রীষ্টান ও অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের লোক বিশেষভাবে নিন্দা করিত, থিওসফিষ্টগণ নানা যুক্তি ও তর্কের সাহায্যে তাহার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাইত।
ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ অ্যানি বেসান্ট (Annie Besant) ১৯০৭ সনে থিওসফিক্যাল সম্প্রদায়ের সভাপতি হন। তিনি আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে স্বীয় অভিজ্ঞতার প্রমাণ দিয়াছেন। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মোক্ত কর্মফল’, ‘নির্বাণ’ প্রভৃতি তত্ত্বও থিওসফিষ্টরা প্রচার করিতেন। ফলে যে সমুদয় নব্যশিক্ষিত হিন্দুরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক আচরণের বিরুদ্ধে অন্য সম্প্রদায়ের নিন্দা ও কটুক্তির যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদ না করিতে পারিয়া অশান্তি ও অস্বস্তি ভোগ করিতেছিল, তাহারা থিওসফিষ্টদের ন্যায় একদল ইউরোপীয়ের সমর্থন পাইয়া একদিকে থিওসফি সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরক্ত হইল, অপরদিকে নব্য-হিন্দুধর্মেরও পক্ষপাতী হইয়া উঠিল।
ভারতে থিওসফি সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল মাদ্রাজ শহরের নিকটবর্তী অ্যাডিয়ার নামক শহরতলীতে। বাংলা দেশেও ইহার কিছু কিছু প্রভাব ছিল। পণ্ডিতপ্রবর দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইহার একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
৫. ইসলামধর্ম
খাঁটি ইসলামের অতিরিক্ত এবং অননুমোদিত কতকগুলি ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক প্রথা যে মুসলমান সমাজে প্রচলিত হইয়াছিল, তাহা এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বিবৃত হইয়াছে। হিন্দুর দৃষ্টান্তে যে অনেক নূতন সামাজিক প্রথা মুসলমান সমাজে প্রচলিত হইয়াছিল তাহাও এই গ্রন্থে অন্যত্র আলোচিত হইবে। এই সমুদয় দূর করিয়া পুনরায় যাহাতে ইসলামধর্মের আদিম বিশুদ্ধ অবস্থা ফিরাইয়া আনা যায় সেজন্য আরব দেশে যে আন্দোলন হয় তাহা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে প্রসিদ্ধ। ঊনবিংশ শতাব্দীর আরম্ভে বাংলা দেশেও যে ইহার অনুরূপ আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছিল এবং কিরূপে তাহা ধর্মসংস্কারের পরিবর্তে রাজনীতিক আন্দোলনে পরিণত হইয়াছিল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ধর্মের দিক দিয়া এই দুই আন্দোলন অথবা পরবর্তী উত্তরভারতব্যাপী ওয়াহাবি আন্দোলনের ফলে বাংলা দেশে ইসলামধর্মের বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটে নাই।
পঞ্জাবে মির্জা গুলাম আহমদ খ্রীষ্টান ও আর্যসমাজ সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ইসলামের কিছু কিছু সংস্কার করেন। ১৮৮০ সনে প্রকাশিত ‘বরাহীনি অহ্মদিয়’ নামক তাঁহার গ্রন্থ সমগ্র মুসলমান সমাজে আদৃত হয়। কিন্তু ১৮৯১ সনে যখন তিনি নিজেকে ধর্মপ্রবর্তক (মাহদি ও মেসায়া) ও কৃষ্ণের অবতার বলিয়া ঘোষণা করিলেন তখন অনেকেই তাঁহার বিরোধী হইলেও তাঁহার শিষ্যদল লইয়া এক নূতন মুসলমান সম্প্রদায় গঠিত হইল। এই সম্প্রদায় তাঁহার নামানুসারে আহমদিয়া এবং তাহার জন্মস্থান কাদিয়ান শহরের নামানুসারে কাদিয়ানী নামে পরিচিত। বাংলা দেশেও এই সম্প্রদায় আছে কিন্তু ইহার সংখ্যা বা প্রভাব খুব বেশী নহে।
আলিগড় আন্দোলনের নেতা সার সৈয়দ আহমদও ইসলামধর্মে আধুনিক যুগোচিত কিছু সংস্কার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহার প্রভাবও বাংলা দেশে খুব বেশী দেখা যায় না।
৬. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মসম্প্রদায়
(ক) তন্ত্রমত
বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই তান্ত্রিক প্রভাব বিস্তৃত হয়। তান্ত্রিক ধর্মমতের অনুষ্ঠানে নানারূপ ব্যভিচারের প্রাদুর্ভাব সম্বন্ধে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে কিছু বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। ইহার ফলে শিক্ষিত সম্প্রদায় ইহার প্রতি অনেকটা বীতশ্রদ্ধ হইয়াছিলেন। হাইকোর্টের জজ উডরফ সাহেব ও বাঙ্গালী মন্মথনাথ দত্ত তন্ত্রের মূলতত্ত্ব আলোচনা করিয়া ইহার অন্তর্নিহিত ধর্মের সারসত্য নির্ণয় করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহাও নব্য হিন্দুধর্মের অনুরূপ প্রাচীন মতের সমর্থন করার চেষ্টা বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
(খ) শিবনারায়ণ পরমহংস ও অন্যান্য সাধু-সন্ত
পরিব্রাজক সাধু শিবনারায়ণ পরমহংস ১৮৪০ সনে কাশীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা দেশে এক নূতন ধর্মমত প্রচার করেন। তিনি এক-ঈশ্বরে বিশ্বাস করিতেন ও প্রতিমাপূজার বিরোধী ছিলেন। এই দুইটি বিষয়ে তিনি স্বামী দয়ানন্দের সহিত একমত ছিলেন, কিন্তু তিনি বেদ অপৌরুষেয় সুতরাং প্রামাণিক এই মত এবং কর্মফল ও জন্মান্তরবাদ প্রভৃতিতে বিশ্বাস করিতেন না। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ন্যায় ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবার উপর খুব জোর দিতেন। তিনি কয়েকটি অদ্ভুত মত প্রচার করিতেন, যথা–সমস্ত মানুষের একটিমাত্র ভাষা থাকিবে এবং সমুদয় ধর্মসম্প্রদায়ের সারসত্য সংগ্রহ ও ঐ ভাষায় প্রকাশ করিয়া অপর সমুদয় ধর্মশাস্ত্র পোড়াইয়া ফেলিবে।
শিবনারায়ণ ধর্মসম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু কলিকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে তাঁহার বহু ভক্ত ও শিষ্যেরা একটি ক্ষুদ্র ধর্মসম্প্রদায় গড়িয়া তোলে। আসামের মেচ জাতির মধ্যে শিবনারায়ণের অনেক শিষ্য ছিল। কালীচরণ নামে তাহাদের একজন এই ক্ষুদ্র ধর্মসম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন।
এইরূপে অনেক সাধুসন্তের শিষ্যেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মসম্প্রদায়ের সৃষ্টি করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে ভোঁসলাগিরি, তৈলঙ্গ স্বামী, পাহাড়ী, বাঘা, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, কাঠিয়া বাবা এবং সন্তদাস বাবাজী বাংলা দেশে সমধিক প্রসিদ্ধ।
(গ) কর্তাভজা সম্প্রদায়
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে কর্তাভজা সম্প্রদায় বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ইহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে দেওয়া হইয়াছে। আউলাদ নামক একজন সাধক এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সম্প্রদায়ের মতে শ্রীচৈতন্যই আউলচাঁদরূপে পুনরায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ‘গুরু সত্য’ এই মন্ত্র প্রচার করেন। ইহা বৈষ্ণবধর্মেরই একটি শাখা বা প্রশাখা ও নিজেদের মধ্যে সহজধর্ম বা সত্যধর্ম বলিয়া পরিচিত। এই ধর্মমতে শুরুই পৃথিবীতে ভগবানের একমাত্র প্রতিনিধি, অবিচলিত নিষ্ঠা ও ভক্তিসহকারে ঈশ্বরজ্ঞানে গুরুসেবাই এই ধর্মসম্প্রদায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গুরুসেবাই ‘কর্তাসেবা বা কর্তাভজা’, এবং ইহা হইতেই এই সম্প্রদায় কর্তাভজা নামে পরিচিত। বাউলদের মত ইহাদের মধ্যে কতকগুলি গোপনীয় রহস্য বা তত্ত্ব আছে। দলের বাহিরে কাহারও তাহা জানিবার উপায় নাই। এই দলের মধ্যে জাতিভেদ ছিল না। হিন্দু মুসলমান সকলেই সকলের অন্ন ভোজন করিতেন।৬৭।
কাঁচড়াপাড়ার উত্তর-পশ্চিমে পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত ঘোষপাড়া গ্রাম এই সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র। ইহার প্রতিষ্ঠাতা আউলচাঁদের ২২ জন শিষ্যের মধ্যে সদৃগোপ, কলু, মুচি প্রভৃতি হিন্দু ও কয়েকজন মুসলমান ছিলেন। আউলচাঁদের মৃত্যুর (আ. ১৬৯১ শক = ১৭৬৯ খ্রী.) পর তাঁহার ২২ জন শিষ্যের অন্যতম এই গ্রামবাসী সদ্গোপ[৬৭ক] বংশের রামশরণ পাল তাঁহার স্থানে গুরুর পদে অভিষিক্ত হন। রামশরণের মৃত্যুর পর (আ. ১৭৮৩ খ্রী.) তাঁহার পুত্র রামদুলাল, এবং তাঁহার মৃত্যু হইলে (১৮৩৩ খ্র.) তাঁহার পুত্র ঈশ্বর পাল গুরু হন।৬৭খ সমসাময়িক পত্রিকায় এই সম্প্রদায় সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। ১৮৬৩ সনের সোমপ্রকাশে একজন লিখিয়াছেন :
“রামশরণের বাটীতেই আউলেচাঁদের মৃত্যু হয়। চাকদহের নিকট পড়াবি গ্রামে ইহার সমাধি হইয়াছে। ঘোষপাড়ায় একটি সমাজবাটী আছে। কেহ কেহ বলে, ঐটি রামশরণের স্ত্রী সতীমার সমাধিস্থান। কর্তাভজা স্ত্রী ও পুরুষেরা ঐ বাটীস্থ এক স্তম্ভে আবির ও পুস্পমালা প্রভৃতি প্রদান করিয়া ভক্তি প্রকাশ করিয়া থাকে। ধর্মাবলম্বীরা রামশরণের স্ত্রীর প্রতি অতিশয় ভক্তি করিয়া থাকে। রামশরণের পুত্র রামদুলাল, রামদুলালের দুই পুত্র, ঈশ্বরচন্দ্র ও ইন্দ্রনারায়ণ। এই ঈশ্বরচন্দ্র বর্তমান কর্তা, ইঁহাদিগের পৌত্র হইয়াছে। এই ১০০ বৎসরের মধ্যে পালদিগের ৫ পুরুষ ও বঙ্গদেশের ভিতরে ভিতরে প্রায় একলক্ষ লোক কর্তাভজা হইয়াছে। ইহাদিগের উপাসনা প্রকার বড় বাহুল্য নয়, একখানি গীতগর্ভ পুস্তক আছে, আহারের পর ১০ জন একত্র উপবেশন করিয়া আউলেচাঁদ, রামশরণ ও তাঁহার স্ত্রীর মূর্তি ভাবনা, ক্রন্দন ও গান করিয়া থাকে।….
“কর্তাভজা ধর্মাবলম্বীরা পুত্রকে পুত্র ও পিতাকে পিতা বলিয়া সম্বোধন করে। ইহারা বলে, সকলেই একজনের পুত্র, একমাত্র গুরুই সকলের পিতা। মফঃস্বলের গুরুদিগকে (কৰ্ত্তা) মহাশয়’ বলে। এক একজন মহাশয়ের অধীনে কয়েকজন করিয়া শিষ্য আছে, শিষ্যদিগের নিকট হইতে যে প্রণামী আদায় হয়, ঈশ্বরবাবু তাহার অংশ পান, মফঃস্বলের মহাশয়েরা তাহার কিছু কিছু পাইয়া থাকেন।
***
“ইতর লোকের মধ্যে এই ধর্মের সবিশেষ প্রাদুর্ভাব। ভদ্রলোকেরা ইহার আদর করা দূরে থাকুক, যাহারা এই ধৰ্ম্ম অবলম্বন করে তাহাদিগকে ঘৃণা করিয়া থাকেন, তবে যে ২৪ জন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থকে এই ভ্রমে পতিত দেখিতে পাওয়া যায় তাহারাও মূর্খতায় ইতর লোকের তুল্য। এ ধর্মের এরূপ প্রাদুর্ভাব হইবার এই কারণ অনুমান হয়, ইহার ভক্তদিগের নানাপ্রকার যথেচ্ছাচারিতার বিলক্ষণ সুবিধা আছে। হিন্দুদিগের শাস্ত্র ও ব্যবহারানুসারে স্ত্রীজাতির স্বাতন্ত্র নাই। তাহাদিগকে সকল সময়ে ও সকল অবস্থাতেই পিতা, মাতা, পতি ও পুত্রাদির পরতন্ত্র হইয়া থাকিতে হয়, কিন্তু কর্তাভজা ধর্মে বিলক্ষণ স্বাতন্ত্রলাভ আছে। আমাদিগের সম্বাদদাতা বলিলেন, মেলাস্থলে কর্তাদিগের অতিশয় কড়াকড়ি আছে, কেহ কোন কুকৰ্ম্ম করিলে তৎক্ষণাৎ তাহার দণ্ডবিধান হয়। এরূপ হওয়া অসম্ভাবিত হয়। কৰ্ত্তা পৰ্য্যন্ত উচ্ছঙ্খল হইলে ধৰ্মলোপ ও স্বার্থহানি হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়, যে স্থানে মূর্খতা ও স্বাতন্ত্র উভয়ের যোগ, সেখানে কুক্রিয়ার বিলক্ষণ আধিপত্য হয়, ধৰ্ম্মের নাম তাহার সহিত সংযোজিত হইলে তাহার ত আর কথাই নাই। আমাদিগের সম্বাদদাতা এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত দর্শন করিয়া আসিয়াছেন। তিনি দেখিয়া আসিয়াছেন, বর্তমান কর্তা ঈশ্বরবাবু একটি শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, অনেকগুলি স্ত্রীলোক তাঁহার চতুর্দিকে বসিয়া কেহ পদসেবা করিতেছে, কেহবা অঙ্গে চন্দন লেপন করিতেছে এবং কেহ কেহ বা গলদেশে পুষ্পমাল্য পরাইয়া দিতেছে। আমরাও অনেক লোকের মুখে শুনিয়াছি এই ধর্মাবলম্বিদিগের মধ্যে শ্রীবৃন্দাবনের প্রকৃত কৃষ্ণলীলাটাই অনুষ্ঠিত হয়। কোন কোন কৰ্ত্তা কুলবালাদিগের বস্ত্র হরণ করিয়া বৃক্ষে আরোহণ করেন, রমণীরা করযোড় করিয়া বৃক্ষতল হইতে উহা প্রার্থনা লয়। এতদ্বতিরিক্ত ভূতছাড়ান, ডাইন ঝাড়ান প্রভৃতি বিস্তর রহস্য আছে। অতএব অনুমান হইতেছে অনেকে দুপ্রবৃত্তির চরিতার্থতা ও স্বার্থসিদ্ধির আশ্রয়ে ঐ দলের পুষ্টিসাধন করিয়া থাকে।
“কর্তাভজাদলে জাতিভেদ নাই, স্ত্রী পুরুষ একত্র বসিয়া উপাসনাদি করা হইয়া থাকে, ঐ ধৰ্ম্মের উপদেশগুলিও সৎপথ প্রদর্শন। এই সকল দেখিয়া স্পষ্ট বোধ হইতেছে, যিনি এই ধৰ্ম্ম প্রবর্তিত করিয়াছেন, তিনি বিলক্ষণ বুদ্ধিমান, চতুর ও ঔদাৰ্য্যশালী। এই ধর্মের সৃষ্টি করিয়া তাহার নিজ নামকে চির প্রসিদ্ধ করিবার অভিলাষ ব্যতিরিক্ত অন্য কোন অভিসন্ধি ছিল কিনা, এখন নির্ণয় করিয়া উঠা কঠিন। আশ্চর্যের বিষয় এই, কৰ্ত্তারা আপনাদিগকে ঈশ্বরস্থানীয় বলিয়া জ্ঞান করেন, উপাসকদিগের নিকটেও পূজা পাইয়া থাকেন, কিন্তু তাঁহারা আবার নিজ গৃহে দুর্গোৎসবাদি ও ব্রাহ্মণের পদধূলি পৰ্য্যন্ত গ্রহণ করেন। অথচ তাঁহাদিগের উপাসকেরা তাঁহাদিগের প্রতি দৃঢ়ভক্তি প্রকাশ করে।
“আমাদিগের অধিকতর চমৎকার বোধ হইতেছে, খৃষ্ট, মহম্মদ, গৌরাঙ্গ ও আউলেদ, ইঁহাদিগের প্রবর্তিত ধৰ্ম্মের ও সেই ধর্ম প্রবর্তন প্রকারের অনেক সৌসাদৃশ্য আছে।”৬৮
রথযাত্রা ও দোলের সময় ঘোষপাড়ায় বিশেষ সমারোহ হইত ও মেলা বসিত। দোলের মেলাতেই লোকসমাগম ও জাঁকজমক বেশি হইত। ১৮৪৮ সনের ৩০শে মার্চ তারিখের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রকাশিত একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ এইরূপ :
“গত দোলযাত্রার পর দিবস সোমবার অপরাহে কতিপয় বন্ধুর সহিত আনন্দধাম ও পবিত্র স্থান ঘোষপাড়া নামক প্রসিদ্ধ গ্রামে রাসযাত্রা দর্শন করিতে গমন করিয়া তথায় স্ত্রীপুরুষ অন্যূন দশসহস্র ভাবের মনুষ্য অর্থাৎ কৰ্ত্তা-উপাসককে উপস্থিত দেখিলাম, এতদ্ভিন্ন সে স্থলে ক্রেতা, বিক্রেতা, রঙ্গদর্শি ও নিমন্ত্রিত প্রভৃতি অনেক লোকের সমাগম হইয়াছিল।
“ঐ বহুসংখ্যক কর্নামতাবলম্বিরা কেবল যে ইতর জাতি ও শাস্ত্রবিজ্ঞান বর্জিত মনুষ্য তাহা নহে তাহাদের মধ্যে সকুলোদ্ভব মান্য, বিদ্বান এবং সূক্ষ্মদর্শি জন দৃষ্ট হইল, এই ভাবকেরা ভিন্ন ভিন্ন দলবদ্ধ পূৰ্ব্বক বৃক্ষমূলে বা রম্যস্থলে বা পুষ্করিণীর ঘাটে বা মাঠে বা গৃহস্থের উঠানে অথবা রাজপথে স্ব স্ব মহাশয় অর্থাৎ উপগুরু বেষ্টন করিয়া বসিয়া একান্তঃকরণে কর্নাগুণ সংকীৰ্ত্তন করিতেছে, কি আশ্চৰ্য্য, কি কুহক, যুবতী ও কুলের কুলবধূ প্রভৃতি কামিনীগণ যাহারা পিঞ্জরের পক্ষির ন্যায় নিয়তঃ অন্তঃপুরে বদ্ধা থাকেন তাহারা এককালীন লজ্জা ও কুলভয় এবং মনের বিকারকে জলাঞ্জলি দিয়া পরপুরুষের সহিত একাসনোপবিষ্টা হইয়া আনন্দলহরী ও গোপীযন্ত্রে গীত ও বাদ্য করিতেছে, ক্ষণেক ঠাকুর ঠাকুর বলিয়া চীৎকার, ক্ষণেক বা গুরুনামে করতালি ও জয়ধ্বনি প্রদান এবং ক্ষণেক বা আউল নাম উচ্চারণ করিতেছে, আরবার নিস্তব্ধ হইয়া ভক্তিতে মগ্নানন্তর অশ্রুপাত করিতেছে, এবপ্রকার দর্শন ও শ্রবণানন্তর কর্তার ভবনে প্রবেশ করিয়া তাহার মধ্যে বহু জনতা দেখিলাম, তিলার্ধ স্থান শূন্য নাই, যে কিঞ্চিৎকাল দণ্ডায়মান হইয়া কাহার সহিত কথোপকথন বা পুরীর শোভা সন্দর্শন করি, পরে বাটিস্থিত এক দাড়িম্ব তরুতলে অনেক লোককে পতিতাবস্থায় দৃষ্টি করিয়া তদৃক্ষের নিকটস্থ হইয়া ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিবাতে অবগতি হইল যে, এ স্থলে কৰ্ত্তা পাতকী তরাইয়াছিলেন, বিধেয়ে ইহার বিশেষ মাহাত্ম আছে, এজন্য সঙ্কটাপন্ন জীবেরা ইহার আশ্রয় লইয়াছে, অনন্তর তথায় অর্ধদণ্ডকাল অবস্থিতি করিয়া দেখিলাম, যে যাহারা ভূমি সার করিয়াছে ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ উৎকট পীড়াতে পীড়িত, কেহ বা সমূহ বিপদ্গ্রস্ত, কেহ বা মনের তাপে তাপিত ও কেহ বা সন্তান সন্ততি বিরহে দুঃখিত হইয়া স্ব স্ব দায় হইতে উদ্ধার হওনের ভরসায় ও মনোরথ সিদ্ধকরণের প্রত্যাশায়, এরূপ হত্যে দিয়াছে, মধ্যে মধ্যে কর্তার উদ্দেশ্যে ঐ পবিত্র বৃক্ষকে অষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করত দোহাই ঠাকুর দোহাই সতী মা, আমরা নরাধম অতি পাপি, আমাদের অপরাধ মার্জনা কর ইত্যাদি কাতরুক্তি প্রয়োগ করিতেছে। তদনন্তর পূর্বোক্ত বাটীর কিয়দূরে হিমসাগর নামক পুষ্করিণীর নিকট চরণ চালন করিয়া দেখিলাম যে ইহার ঘাটের অধঃসোপানে পাপি লোকসকল এক পদ স্থলে দিয়া অন্য পদ জলে মগ্ন করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া কৰ্ত্তাপ্রেরিত দূতগণের সমক্ষ্যে স্ব স্ব কৃত কলুষ রাশি অম্লান বদনে স্বীকার করত ত্রাণ পাইতেছে, কিন্তু যাহারা স্বীয় স্বীয় অপরাধ ব্যক্ত করিতে বিলম্ব বা সন্দেহ করিতেছে দূতেরা তাহাদের প্রতি প্রকৃত যমদূতের ন্যায় ভীষণ মূর্তি ধারণ পূৰ্ব্বক তর্জন গর্জন শব্দে তাহাদের কেশাকর্ষণ করত মুষ্ট্যাঘাত দ্বারা তাহাদের পাপপুঞ্জ স্বীকার করাইয়া লইতেছে, পরে পাতকিদিগকে কথিত পুষ্করিণীতে অবগাহন করাইয়া তাহাদের দেহ নিষ্পাপ করিয়া দিতেছে, পরিশেষে কৰ্ত্তার নিকেতনের উত্তরাংশে এক স্থানে দৃষ্ট হইল যে, একজন ফকির চামর লইয়া রোদন বদনে প্রভু আউলের আবির্ভাব ও তাহার সহিত বর্তমান কর্তা ঈশ্বরচন্দ্র পালের পিতামহ রামশরণ পালের মিলন বিষয়ের আদ্যন্ত। বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছে শ্রোতারা তক্ষুবণে ভাবে গদ গদ ও আর্দ্র হইতেছে। এদিগে কৰ্ত্তার অন্তঃপুরে রাশি রাশি অন্ন ব্যঞ্জন প্রস্তুত হইয়া সেবকবর্গের সেবায় লাগিতেছে, বাহির মহলে গান বাদ্য ও নৃত্যের ধুমধাম হইতেছে, অপর রাত্রি দশ ঘটিকার সময় নাট মন্দিরে কবি আরম্ভ হইলে, আমরা তথা হইতে প্রস্থান করিতে বাধ্য হইলাম, আমরা এই সকল ব্যাপার দর্শন করিয়া চমৎকৃত হইয়াছি। যেহেতু ব্রাহ্মণ, শূদ্র, যবন প্রভৃতি জাতি নীচেদের অন্ন বিচার না করিয়া এরূপ ক্ষেত্রে ভোজন ও পান করে ইহা কুত্রাপি কোন স্থানে দেখি নাই ও শুনি নাই, বিশেষ আশ্চর্যের বিষয় এই যে যদবধি আমরা উক্ত পল্লীতে উপস্থিত ছিলাম তদবধি ক্ষণমাত্র কাহাকেও অসুখি দেখি নাই, সকলেই হাস্যাস্যে সময়ক্ষেপ করিতেছিল, বোধহয় রাসের তিন দিবস তথায় আনন্দ বিরাজমান থাকে।”৬৯
১৮৬৩ সনের ‘সোম প্রকাশে একজন প্রত্যক্ষদর্শী এই মেলার যে বিবরণ দিয়াছেন তাহার কিয়ংদশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“এবৎসর দোলে প্রায় ৬৫ হাজার লোকের সমাগম হইয়াছিল। যাত্রীদিগের মধ্যে চৌদ্দ আনা স্ত্রীলোক। কুলকামিনী অপেক্ষা বেশ্যাই অধিক, পুরুষদিগের সকলেই প্রায় মূর্খ। এখানে জাতিভেদ নাই। সকল জাতিই সকলের মুখে অন্ন। তুলিয়া দিয়া থাকে। এ বিষয়ে ঘোষপাড়া জগন্নাথ ক্ষেত্রকেও পরাজয় করিয়াছে। সেখানে মুসলমানদিগের প্রবেশাধিকার নাই, এখানে মুসলমানেরা স্বচ্ছন্দে ব্রাহ্মণের মুখে অন্ন প্রদান করিতেছে! রামশরণ বাবুর পূজার বাটীতে একটি দাড়িম্ব বৃক্ষ আছে, কেহ কেহ বলে, এই দাড়িম্ব তলায় আউলচাঁদের গোধূড়ী প্রোথিত আছে, কেহ বলে, রামশরণ ঐ স্থানে বসিতেন এই নিমিত্ত উহার অধিক মাহাত্ম হইয়াছে। দেখিলাম ২০ রোগী আরোগ্যলাভ করিবার আশায় দাড়িম্ব তলায় হত্যা দিয়া পড়িয়া রহিয়াছে। অন্য অন্য ধর্মাবলম্বিদিগের ন্যায় ইহাদিগের বুজরুকীও অল্প নয়। কোন পরিচিত ব্যক্তিকে বোবা সাজাইয়া “বোবার কথা হউক” প্রভৃতি বলিয়া রোগ আরাম করিতেছে! ঈশ্বরবাবুর বাটীতে দুর্গোৎসব, রাস, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিদায় পৰ্য্যন্ত সমুদায় অনুষ্ঠান হইয়া থাকে। তিনি নিজেও ব্রাহ্মণের পদধূলি গ্রহণ করিয়া থাকেন। সকল কর্তাভজারই প্রায় ঐরূপ ব্যবহার দেখা যায়। আমাকে কল্য জুতা পায়ে দিতে দেয় নাই, কিন্তু অদ্য আমি দাড়িম্বতলা পর্যন্ত জুতা পায়ে দিয়া বেড়াইয়াছি।
“এই রাধাকৃষ্ণের দোল উপলক্ষে প্রতি বৎসর অনেক চুরি ও হত্যা হইয়া থাকে। এ বৎসর তিন ব্যক্তির ওলাওঠায় মৃত্যু হইয়াছে, দেখিয়া আসিয়াছি। ইহার পর আর কত হয় বলিতে পারি না। পুলিষের কনষ্টবলেরাও অত্যাচার করিয়া পয়সা গ্রহণ করে।
“উপসংহার স্থলে সমাজের বিষয়ে কিঞ্চিৎ বলা আবশ্যক। বাঙ্গালা দেশের প্রায় সমুদায় জেলা হইতেই কর্তাভজা আসিয়াছে, তাহার মধ্যে মুরশিদাবাদের লোকই অধিক। যে সমাজের স্ত্রীলোকেরা লজ্জা ও কুলভয়ে গৃহের বাহির হইতে সাহসী হয় না, সেই সমাজের সেই স্ত্রীলোকেরা এক “কর্তা”র অনুরোধে বহুসংখ্য অপরিচিত পুরুষের সহিত একত্রে বসিয়া আমোদ করিতে লজ্জিত হইতেছে না! এক একট পুরুষের নিকটে গড়ে ৪৫টী করিয়া যুবতী বসিয়া আছে!”৭০
অক্ষয়কুমার দত্ত এই সম্প্রদায়ের বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, “ব্যভিচার দোষ তাঁহাদের সকল গুণ গ্রাস করিয়াছে। সম্প্রদায়ভুক্ত স্ত্রীপুরুষ ভ্ৰাতৃভগিনী সম্বন্ধ স্থাপিত করিলেও পরস্পর একত্র বাসই তাহাদের সর্বনাশের হেতু হইয়া উঠিয়াছে।”৭১
(ঘ) রামবল্লভী সম্প্রদায়
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হুগলীর নিকটবর্তী বাঁশবেড়িয়া গ্রামে সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া একটি নূতন ধর্মসম্প্রদায় গঠিত হয়। ১৮৮১ সনে ৩১শে মে তারিখে শ্রীরাজনারায়ণ বসু রামমোহন রায়ের জীবনীলেখিকা মিস্ কলেটের নিকট একখানি চিঠিতে ইহার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়াছিলেন নিম্নে তাহার বঙ্গানুবাদ দিতেছি।
“শ্ৰীযুত কেশবচন্দ্র সেন নানা প্রচলিত ধৰ্ম্মমত ও অনুষ্ঠানের জগাখিচুড়ী (jumbling up) করিয়া যে নববিধান প্রবর্তন করিয়াছেন তাহা এদেশে নূতন নহে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূৰ্ব্বে হুগলীর নিকটস্থ বাঁশবেড়িয়া গ্রামে রাধাবল্লভ নামে একটি অদ্ভুত প্রকৃতির (eccentric) লোক অনুরূপ একটি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। ইহার বাৎসরিক সভায় হিন্দু প্রণালীতে দেবতার নিকট ভোজ্য নিবেদন প্রথার অনুকরণে কৃষ্ণ, খৃষ্ট ও মহম্মদ এই তিনজনের উদ্দেশ্যেই ভোগ দেওয়া হইত। কৃষ্ণকে ননী, মাখন, মিষ্টান্নাদি দেওয়া হইত, কিন্তু মাংস দেওয়া হইত না। মুহম্মদকে গো-মাংস দেওয়া হইত কিন্তু শূকর-মাংস নহে। খ্রীষ্টকে উক্ত উভয় প্রকারের মাংসই ভোগ দেওয়া হইত। এই উৎসবে যে স্তোত্র পাঠ করা হইত তাহার মর্মার্থ এই যে কালী, কৃষ্ণ, খোদা এ সকলই ভগবান, হঁহাদের মধ্যে কোন ভেদ বুদ্ধি মনে ঠাই দিও না।”৭২
শ্রীরাজনারায়ণ বসু লিখিয়াছেন যে অক্ষয়কুমার দত্তের ‘Hindu Sects’ নমে প্রসিদ্ধ বাংলাগ্রন্থে ইহার বিস্তৃত বিবরণ আছে। কিন্তু ঐ গ্রন্থে ইহা রামবল্লভী’ নামে অভিহিত হইয়াছে। অক্ষয়কুমার কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিবরণের পরই ইহার বিবরণ দিয়াছেন এবং লিখিয়াছেন : “কিছুদিন হইল পালদিগকে (অর্থাৎ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের গুরু রামশরণ পালের বংশধরদিগকে) কৰ্ত্তা স্বরূপ স্বীকার না করিয়া বংশবাটির কয়েক ব্যক্তি রামবল্লভী নামে একটি শাখা সংস্থাপন করেন। কৃষ্ণকিঙ্কর গুণসাগর ও শ্রীনাথ মুখ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ের প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। এ সম্প্রদায়ীরা রামবল্লভ নামে এক ব্যক্তিকে আপনাদের প্রবর্তক ও শিবস্বরূপ বলিয়া স্বীকার করেন।…হঁহারা সৰ্ব্বশাস্ত্রকে সমান জ্ঞান ও সৰ্ব্বশাস্ত্রোক্ত দেবতাদিগকে অভিন্নবোধ করেন। অতএব ঐ উৎসব কালে ভগবদ্গীতা, কোরাণ, বাইবেল এই তিনই পঠিত হয়।…শ্রুত হওয়া গিয়াছে ইঁহারা খেচরান্ন ও গোমাংসাদি সকল দ্রব্যেরই ভোগ দিয়া থাকেন-ইশুখ্রীষ্ট, মহম্মদ ও নানকের এক এক ভোগ হয় এবং এক একজন তত্তৎ মহাজন স্বরূপ হইয়া তদীয় ভোগের সামগ্রী ভক্ষণ করিয়া থাকে।…হঁহাদের মত-প্রতিপাদক গান : “কালী কৃষ্ণ গাড় খোদা, কোন নামে নাহি বাধা, বাদীর বিবাদ দ্বিধা, তাতে নাহি টলোরে। মন কালী কালী গাড় খোদা বলরে।”
রাজনারায়ণ বসু ও অক্ষয়কুমার দত্ত, দুই ভিন্ন নামে যে একই সম্প্রদায়ের বিবরণ দিয়াছেন সে-সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। রাধাবল্লভী নামে একটি বৈষ্ণবসম্প্রদায়ও ছিল। অক্ষয়কুমার তাহার বর্ণনা করিয়াছেন কিন্তু তাহা সম্পূর্ণ ভিন্নমতাবলম্বী এবং বাংলায় তাহার বিশেষ প্রাধান্য ছিল না। রাজনারায়ণবাবু বোধ হয় ভ্রমবশত রামবল্লভী ও রাধাবল্লভী এই দুই সম্প্রদায়কে অভিন্ন মনে করিয়াছেন। রামবল্লভী নামই ঠিক বলিয়া মনে হয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ ও কেশবচন্দ্রের নববিধান’ এই দুই ধর্মসমন্বয়ের পরিকল্পনার সহিত রামবল্লভী সম্প্রদায়ের ধর্মমতও উল্লেখযোগ্য।
(ঙ) সাহেবধনী
প্রবাদ এই যে নদীয়া জেলার অন্তর্গত শালিগ্রাম, দোগাছিয়া প্রভৃতি কয়েক গ্রামের বনে সাহেবধনী নামে এক উদাসীন এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন। ইহা সম্ভবতঃ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের শাখাবিশেষ এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ইহার শিষ্য হইত। ইহাদের মূল-গুরু দুঃখীরাম পালের পুত্র চরণ পাল শতাধিক বৎসর পূর্বে ইহার মূল-গুরু ছিলেন এবং বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলেন। এই সম্প্রদায় কোন বিগ্রহের উপাসনা করে না, বরং বিগ্রহ ও মন্ত্রদাতা গুরুর প্রতি বিশেষ বিদ্বেষই প্রকাশ করে। প্রতি বৃহস্পতিবার এই সম্প্রদায়ের অনেক লোক একত্রিত হইয়া উপাসনা ও পরমার্থ সাধন করে, অর্থাৎ যবনাদি নানা জাতি প্রদত্ত তাহাদের প্রস্তুত করা পরমান্ন ও অন্যান্য ভোগের সামগ্রী উপাসনা স্থানের (একখানি চৌকী) নিকট নিবেদন করিয়া দিয়া নিবেদিত দ্রব্য পরস্পরের মুখে অর্পণ করে।”৭৩ চরণ পালের পরে তাহার পুত্র এই সম্প্রদায়ের শুরু হন।
(চ) বৈষ্ণব সম্প্রদায়
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কয়েকটি শাখার প্রাধান্য ছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ স্পষ্টদায়ক, সখীভাবক, আউল, বাউল, সহজী, সাঁই, নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র প্রবর্তিত ন্যাড়া, সনাতন গোস্বামী প্রবর্তিত দরবেশ, প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইহাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে সাদৃশ্য আছে। প্রকৃতিসাধন (অর্থাৎ নারীর সহিত সাধন), জাতিধর্ম নির্বিশেষে শিষ্যগ্রহণ, ও তাহাদের পরস্পরের অনুগ্রহণ প্রভৃতি ইহাদের বৈশিষ্ট্য। ইহাদের সম্বন্ধে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে আলোচনা করা হইয়াছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় পদে সখীভাবক সম্প্রদায় কলিকাতায় খুব প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল এবং “ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, সুবর্ণবণিক ও অপরাপর জাতীয় ধনাঢ্য ও মধ্যবিত্ত লোকেরা এই সম্প্রদায়ের ধর্ম অনুষ্ঠান করিতেন।”৭৪ আউল সম্প্রদায় সম্বন্ধে অক্ষয়কুমার দত্ত লিখিয়াছেন : “ইহাদের আর একটি নাম সহজ কর্তাভজা। কোন সম্প্রদায় প্রকৃতি সাধন বিষয়ে ইহাদের ন্যায় উদার ভাব অবলম্বন করিতে পারে নাই। ইহাদের পরমার্থ সাধন কেবল দুই একটি নিজ প্রকৃতি সহবাসে পর্যাপ্ত হয় না, কি প্রকাশ্য কি অপ্রকাশ্য, ইচ্ছানুরূপ বহুতর বারাঙ্গনা ও গৃহাঙ্গনা ইহাদিগের সাধন সম্পাদনে নিয়োজিত হইয়া থাকে।…শুনিয়াছি, আপনার প্রকৃতিকে অন্যদীয় সংসর্গে অনুরক্ত দেখিলেও কিছুমাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করে না। বাউ ও ন্যাড়ারা যেরূপ শত্রু ও ওষ্ঠ লোমাদি সমুদয় কেশ রাখিয়া দেয়, ইহারা সেরূপ করে না; ঐ উভয়ই ক্ষৌরী হইয়া থাকে। ৪০ ৪৫ বৎসর অতীত হইল (অর্থাৎ ১৮৩০-৩৫ সনে) কলিকাতার শ্যামবাজারে রঘুনাথ নামে একটি আউল ও তাহার কতকগুলি শিষ্য ছিল। এক্ষণে (১৮৭০ সনে) এ সম্প্রদায়ী লোক এ প্রদেশে আর সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না।”৭৫
পূর্বোক্ত সম্প্রদায়গুলি ছাড়া আরও কয়েকটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উল্লেখ করা যাইতে পারে।
(১) খুশি-বিশ্বাসী-নদীয়া জেলার অন্তর্গত দেবগ্রামের নিকটবর্তী ভাগা গ্রামনিবাসী খুশি বিশ্বাস নামক একজন মুসলমান এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। এই সম্প্রদায়ীরা খুশি বিশ্বাসকে চৈতন্যের অবতারস্বরূপ জ্ঞান করে, বর্ণভেদ মানে না, সকল জাতি একত্র হইয়া পরস্পরের মুখে অন্নাদি অর্পণ করে।৭৬
(২) গৌরবাদী–ইহারা গৌরাঙ্গকে শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ মনে করে, কারণ রাধা-কৃষ্ণ একত্র মিলিয়া গৌরাঙ্গরূপে ভূতলে অবতীর্ণ হন। দেবালয়ে একমাত্র গৌরাঙ্গের বিগ্রহ স্থাপন করে ও সর্বদা গৌর নাম উচ্চারণ করে।
(৩) নদীয়া জেলার অন্তর্গত মেহেরপুর গ্রামের অধিবাসী বলরাম হাড়ি একটি সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। শিষ্যেরা বলরামকে শ্রীরামচন্দ্র বলিয়া বিশ্বাস করে। “দোলের সময় বলরাম স্বয়ং দোলমঞ্চে আরোহণ করিয়া বসিত এবং শিষ্যেরা আবির ও পুষ্পদি দিয়া তাহার অর্চনা করিত।” এই সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিভেদ নাই। অনেকেই গৃহস্থ, কেহ কেহ উদাসীন। “উদাসীনেরা বিবাহ করে না অথচ ইন্দ্রিয় দোষেও লিপ্ত নহে।” ইহাদের মধ্যে বিগ্রহসেবা প্রচলিত নাই। ১২৫৭ সালে (১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দে) বলরামের মৃত্যুর পর ব্রহ্মমালোনী নামে একটি স্ত্রীলোক গুরুর কার্য করিত।৭৭।
(৪–৮) হজরৎ, গোবরা ও পাগলনাথ, এই তিনজন মুসলমান কর্তৃক কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অনুরূপ তিনটি সম্প্রদায় স্থাপিত হয়। তিলক দাস নামে একজন সদৃগোপ কর্তাভজা সম্প্রদায় ত্যাগ করিয়া নিজ নাম অনুসারে তিলকদাসী নামে স্বতন্ত্র সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করে। তিনি নিজেকে বিষ্ণু শিবাদির অবতার বলিয়া প্রচার করিতেন। শান্তিপুর নিবাসী দর্পনারায়ণ মুচি একটি সম্প্রদায়ের প্রবর্তক।
(ছ) পাগলপন্থী
ময়মনসিংহ জিলায় সেরপুরের মুসলমানদিগের মধ্যে পাগলপন্থী নামক এক সম্প্রদায় ছিল। “সুসঙ্গ পরগণার অন্তর্গত লেটিয়াকান্দা গ্রামবাসী টিপু পাগল এই মতের প্রবর্তয়িতা। টিপু প্রথমে সামান্য কৃষাণ ছিল, সময়ে সে কেবল ধর্মপ্রচারক নহে, বহু সংখ্য অনুচর প্রাপ্ত হইয়া একজন ঘোরতর সমাজবিপ্লাবক হইয়া উঠে। তদীয় ধর্মের অন্যতম মূলসূত্র এই, সকল মানুষই ঈশ্বর সৃষ্ট, কেহ কাহারও অধীন নহে; সুতরাং কেহ উচ্চ, কেহ নীচ, এরূপ প্রভেদ করা অসঙ্গত। ১২৩১ সনে তন্মতাবলম্বী এ পরগণাস্থ অনেক প্রজা দলবদ্ধ ও বিদ্রোহী হইয়া জমীদার প্রভৃতিকে খাজানা দেওয়া বন্ধ করে। পরিশেষে উহারা গবর্ণমেন্টের সুশাসনে নিরস্ত হয়। পাগল গুরুরা অন্যান্য মুসলমানদিগের ন্যায় শ্মশ্রুধারণ, কুক্কুটাদি জন্তু পালন করেন না। লোকে ইহাদিগের অতিমানুষিক ক্ষমতা বিশ্বাস করিয়া তদুদ্দেশে অনেক প্রকার মানসিক করিয়া থাকে। এই নিমিত্ত সৰ্ব্বদা তাহাদের বাসভবনে অনেক লোকের সমাগম হয়। টিপু পাগলকে পূর্ব বাঙ্গলার এক প্রকার লুই ব্লেঙ্ক (Louis Blanc) বলিলে হয়।”৭৮
৭. ধর্মের নামে নিষ্ঠুরতা
আঠার ও উনিশ শতকে ধর্মের নামে অনেক নিষ্ঠুর অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। সতীর সহমরণ ও গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন ইহার মধ্যে প্রধান। সতীপ্রথা সমাজ’ শীর্ষক অধ্যায়ে আলোচিত হইবে। কোন স্ত্রীলোকের সন্তান না হইলে মানৎ করিত, দুইটি সন্তান জন্মিলে একটি গঙ্গামাতাকে উপহার দিবে, অর্থাৎ মাতা স্বহস্তে নিজের শিশুসন্তানকে গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিবেন। কতদূর ধর্মান্ধ ও সদসৎ বিবেচনাশূন্য হইলে কেহ এইরূপ অমানুষিক কার্য অথবা তাহার অনুমোদন করিতে পারে তাহা আজ সকলেই বুঝিতে পারে। অথচ উনিশ শতকে বাংলা দেশের বহু জননী গঙ্গাসাগর-সঙ্গমে এইরূপে নিজের সন্তান নিজে হত্যা করিয়াছে এবং হিন্দুসমাজ তাহার সম্পূর্ণ সমর্থন করিয়াছে; অন্ততঃ প্রতিবাদ করিয়াছে, এমন কোন প্রমাণ নাই। “দেবতার গ্রাস” নামক প্রসিদ্ধ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মনুষ্যত্বের এই চরম কলঙ্ককে সাহিত্যে শাশ্বত রূপ দিয়াছেন।
চৈত্রসংক্রান্তিতে চড়কপূজার উৎসবে বহুপ্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত। চড়ক গাছে, অর্থাৎ একটি উচ্চ খুঁটিতে ‘ভক্ত বা ‘সন্ন্যাসী’কে লোহার হুক দিয়া চাকার সহিত বাঁধিয়া ঐ চাকা দ্রুতবেগে ঘুরান হইত। অনেক সময় হুক ছিঁড়িয়া যাইত আর ঐসব পুণ্যপিপাসী ভক্তের দেহ মাংসপিণ্ডাকৃতি হইয়া ২৫/৩০ গজ দূরে যাইয়া পড়িত। এইরূপ ভক্তের সংখ্যা কখনও কখনও শতাধিক হইত। তাহাদের পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায়, এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে “বাণফেঁড়া” অর্থাৎ লোহার শলাকা বিদ্ধ করা হইত, জ্বলন্ত লোহার শলাকা তাদের গায়ের মধ্যে যুঁড়িয়া দেওয়া হইত।৭৯ ইচ্ছা থাকিলেও গভর্নমেন্ট বহুদিন পর্যন্ত লোকমত উপেক্ষা করিয়া এই নিষ্ঠুর প্রথা রহিত করিতে সাহস করেন নাই। অবশেষে প্রায় দশ বৎসর নানা আলোচনা ও আন্দোলনের পর ১৮৬৫ সনে আইন করিয়া ইহা বন্ধ করা হয়। কিন্তু, এখনও এই গাজন (গা অর্থাৎ গ্রামের জনসাধারণের উৎসব) পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। শ্রীবিনয় ঘোষ লিখিয়াছেন :
“চৈত্রসংক্রান্তির সময় মহাসমারোহে শিবের গাজন হয় বাহুলাড়ায়, এবং উৎসব উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী মেলা হয়। আগেকার তুলনায় সমারোহ এখন কমে গেলেও, আজও মেলায় চার-পাঁচ হাজার লোকের সমাগম হয়। গাজনে আগে কয়েক শত ‘ভক্ত’ বা সন্ন্যাসী হত এবং পিঠ ফোঁড়া বাণ হত। চড়কগাছে পিঠে বাণ ছুঁড়ে ভক্তরা দে-পাক, দে-পাক করে পাক খেতেন। এখন ভক্তের সংখ্যা একশ-দেড়শ জন হয় এবং পিঠবাণ হয় না। তা না হলেও অন্যান্য বাণ ফোঁড়া এখনও হয় সিদ্ধেশ্বরের গাজনে। যেমন জিব-বাণ কপাল-বাণ ইত্যাদি। এখনও চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন পাটভক্তা বা প্রধান ভক্তা স্নান করে, লোহার কাঁটা-বেঁধা পাটাতনের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে, বুকের উপর ব্রাহ্মণ পূজারীকে বসিয়ে, ঘাট থেকে গাজনতলায় আসেন। অন্যান্য ভক্তেরা বেতের ছড়ি ঠুকতে ঠুকতে –”ব্যোম ব্যোম্ শিব শঙ্কর”-ধ্বনি দিতে দিতে তাঁর অনুগমন করেন। বাহুলাড়ায় চাষী, তিলি, সদৃগোপ, কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, নায়েক, খয়রা, বাউরী, ধীবর প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির লোকের বাস থাকলেও, প্রধানত ভক্ত হন নায়েক, খয়রা, বাউরী, ধীবর প্রভৃতি জাতির লোকেরাই বেশি। উৎসবটাও প্রধানত তাঁদেরই। কাছাকাছি ধর্মঠাকুরও আছেন এবং তাঁরও গাজন-উৎসব হয়।”৮১
৮. ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুধর্মের অবস্থা
শ্রীরামপুরের মিশনারী W. Ward হিন্দুদের ধর্ম, সমাজ, আচার-ব্যবহার, শিক্ষা, সাহিত্য প্রভৃতি সম্বন্ধে একখানি বৃহৎ গ্রন্থ লেখেন।৮২ ওয়ার্ড তাঁহার ব্যক্তিগত অনুসন্ধান ও অভিজ্ঞতার ফলে যে সমুদয় তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন তাহাই এই গ্রন্থের প্রধান উপাদান। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাঙ্গালীর জীবনযাত্রার এরূপ বিস্তৃত সমসাময়িক বিবরণ আর কোথাও পাওয়া যায় না। অবশ্য তিনি বিদেশী ও বিধর্মী বলিয়া অজ্ঞতা ও ভ্রান্তি স্বাভাবিক এবং মিশনারীদের মজ্জাগত হিন্দুবিদ্বেষ যে তাঁহার ধারণা ও বর্ণনার উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তথাপি সমসাময়িক বর্ণনা এবং তখনকার বাঙ্গালী হিন্দুসমাজ সম্বন্ধে একজন বিদেশীর কিরূপ ধারণা ছিল তাহার নিখুঁত পূর্ণাবয়ব ছবি হিসাবে ইহার ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। অনেক বিষয়ে তাঁহার বর্ণনা যে সত্যকে লঙ্ন করে নাই বরং সূক্ষ্মদৃষ্টির পরিচয় দিয়াছে তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। শতবর্ষ পরে আমার নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনেক বিষয়ে তাঁহার বর্ণনা সমর্থন করে। গুরুর নিকট দীক্ষা ও গুরুর প্রতি শিষ্যের আচরণ সম্বন্ধে তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা রক্ষণশীল পরিবারে এখনও, অন্ততঃ কিছুদিন পূর্বেও, প্রচলিত ছিল। গুরু শিষ্যের বাড়ীতে আসিলে পরিবারের প্রত্যেক ব্যক্তি সাষ্টাঙ্গে তাঁহাকে প্রণাম করিত এবং তিনি তাঁহার দক্ষিণ চরণ তাঁহাদের মস্তকে স্থাপন করিতেন। একজন তাঁহার পদদ্বয় জলে ধুয়াইয়া দিত, পরে এই জল সকলেই একটু একটু মুখে দিত, বাকী জল সযত্নে রক্ষিত হইত। কয়েকজন তাঁহার অঙ্গে তৈল মাখাইত এবং মস্তকে জল ঢালিয়া স্নান করাইয়া দিত। গুরুর ভোজন হইলে পাত্রে ভুক্তাবশেষ যাহা থাকিত তাহার কিছু কিছু সকলেই খাইত। তারপর শিষ্যের দীক্ষাগ্রহণের পর গুরু তাঁহার কানে বীজমন্ত্র দিতেন। অতঃপর শিষ্য নিজের সঙ্গতিঅনুসারে যথাসাধ্য প্রণামী টাকা, বস্ত্র প্রভৃতি দিলে গুরু বিদায় লইতেন। এই দীক্ষাগ্রহণ হিন্দুধর্মের একটি প্রধান অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত। এই প্রসঙ্গে মি, ওয়ার্ড নিম্নলিখিত কাহিনীটি লিখিয়াছেন :
১৮০৪ সনে হরি তর্কভূষণ নামে ৬০ বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধ এক ব্রাহ্মণকে মৃত্যুকালে কলিকাতায় গঙ্গাতীরে নেওয়া হয়। তাঁহার শিষ্য উভয়চরণ মিত্র নামে একজন কায়স্থ গুরুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে, তিনি কিছু চাহেন কিনা। মুমূর্ষ গুরু বলিলেন, আমাকে এক লক্ষ টাকা দেও। কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করিয়া শিষ্য বলিল, তাহার এত টাকা দিবার সাধ্য নাই। গুরু প্রশ্ন করিলেন, তাহার কত আছে। শিষ্য বলিল, তাহার প্রায় লাখ টাকার সঙ্গতি আছে কিন্তু নগদ টাকা অত নাই। গুরু বলিলেন, ইহার অর্ধেক টাকা আমার পুত্রগণকে দাও। শিষ্য স্বীকৃত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, গুরু আর কিছু চাহেন কিনা। গুরু বলিলেন, তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র একজোড়া সোনার বালা (মণিবন্ধে পরিবার জন্য) চাহিয়াছিল কিন্তু তিনি তাহা দিতে পারেন নাই। শিষ্যের এক পুত্র পাশে দাঁড়াইয়াছিল, শিষ্য তৎক্ষণাৎ তাহার মণিবন্ধ হইতে সোনার বলয়জোড়া খুলিয়া গুরুপুত্রকে দিল। এইরূপে শিষ্যের পুনঃপুনঃ প্রার্থনায় গুরু তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্য কলিকাতায় বিশ হাজার টাকা মূল্যের একখণ্ড জমি এবং নিজের শ্রাদ্ধের জন্য পাঁচ হাজার টাকা চাহিলেন। শিষ্য উভয় দাবিই পূরণ করিলেন। পর দিনই গুরুর মৃত্যু হইল এবং স্ত্রী সহমৃতা হইলেন। তাঁহার শ্রাদ্ধের খরচ বাবদ শিষ্য আরও পাঁচ হাজার টাকা দিল।
এই বিবরণের উপসংহারে মি. ওয়ার্ড (Ward) লিখিয়াছেন, হিন্দুরা সকলেই এই গুরুকে গালমন্দ করিয়া বলিল যে, স্ত্রী সহমরণে না গেলে গুরুর নরকবাস হইত। ইহার কিছুদিন পরে উক্ত শিষ্য উভয়চরণ মথুরায় মারা যান। তাঁহার ব্যবহৃত লাঠি ও খড়ম (clog) সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় তাঁহার স্ত্রী চিতায় আরোহণ করিয়া সতীধর্ম পালন করেন।
ওয়ার্ড আরও লিখিয়াছেন : “আমি শুনিয়াছি যে শিষ্যের অন্ধভক্তির সুযোগ লইয়া কোন কোন গুরু শিষ্যের পরিবারস্থ স্ত্রীলোকের সহিত ব্যভিচারে লিপ্ত হন। কোন কোন গুরুর ফৌজদারী অপরাধে প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হইয়াছে।”৮৩
গুরুর উত্তরাধিকারীরাই বংশানুক্রমে গুরুর পদ অধিকার করিত। গুরুর একাধিক পুত্ৰ থাকিলে অন্যান্য স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ন্যায় গুরু শিষ্যবর্গ নিজেদের মধ্যে বিভাগ করিয়া নিতেন। এইরূপে গুরুগিরি একটি পৈতৃক ব্যবসায়ে পরিণত হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, অধিকাংশ গুরুরই এই পদে উপযুক্ত যোগ্যতা ছিল না।
গুরুবাদ বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের মধ্যেও খুব প্রচলিত ছিল। মি. ওয়ার্ড লিখিয়াছেন তাহার সময়ে (১৮১১ সনে) বাংলা দেশের হিন্দুদের এক-পঞ্চমাংশ চৈতন্যদেবের প্রবর্তিত বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। অদ্বৈত, নিত্যানন্দ এবং ছয় গোস্বামীর বংশধরগণ তাঁহাদের গুরু ছিলেন। মি. ওয়ার্ড লিখিয়াছেন, অদ্বৈত ও নিত্যানন্দের বংশধরেরা শান্তিপুর, বাগনাপাড়া ও খড়দহে বাস করেন। গুরুদের মধ্যে তাঁহাদের প্রাধান্য সকলেই স্বীকার করেন এবং বর্তমানে তাঁহারা অতুল বৈভবের অধিকারী। অসংখ্য যাত্রী তাঁহাদের ভবনে তীর্থযাত্রা করে ও প্রণামী দেয়। প্রত্যেক বৈষ্ণবের বিবাহের সময় তাঁহারা বর কনে উভয়পক্ষের নিকট হইতে মোট তিন টাকা দক্ষিণা পান এবং উভয়ের সম্মতিক্রমে তাঁহারা বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিলেও তুল্য পরিমাণ দক্ষিণা পান। ইহা আদায় করিবার জন্য নানাস্থানে তাহাদের নিযুক্ত লোক থাকে।৮৪ বৈষ্ণব গুরু ও অন্য কয়েকটি বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায় সম্বন্ধে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে যাহা উক্ত হইয়াছে উনবিংশ শতাব্দীতেও তাহার প্রচলন ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে লৌকিক ধর্মের বিবরণে ওয়ার্ড সাহেব নিম্নলিখিত দেবদেবীর মূর্তিপূজার উল্লেখ করিয়াছেন।
১। রাধা-কৃষ্ণের মূর্তির পাশে ইহার মূর্তি থাকে।
২। পঞ্চানন–শিবের মূর্তিবিশেষ, পঞ্চ মুখ। প্রত্যেক মুখে তিনটি চক্ষু। মাটির মূর্তি গড়িয়া অথবা একটি প্রস্তরখণ্ডে তৈল মাখাইয়া রং করিয়া প্রায় প্রতি গ্রামে বট, অশ্বথ প্রভৃতি গাছের নীচে ইহার পূজা হয়। কোন শিশুর মৃগীরোগ হইলে এই দেবতার পূজা দিলে আরোগ্য হয় এই প্রকার সংস্কার ছিল।
৩। ধর্মঠাকুর (দ্বিতীয় ভাগ দ্রষ্টব্য)।
৪-৫। কালুরায় ও দক্ষিণ রায় (দ্বিতীয় ভাগ দ্রষ্টব্য)।
৬। কালভৈরব–কুকুরের পৃষ্ঠে নগ্ন, ভস্মাচ্ছাদিত ত্রিনেত্র শিবমূর্তি। এক হস্তে শিঙ্গা, অন্য হস্তে ঢাক। বাংলা দেশের অনেক স্থানে এই মূর্তি প্রত্যহ পূজিত হইত। ইনি কাশীধামের বিশ্বেশ্বরের প্রতিনিধি বলিয়া পরিগণিত হইতেন। ইহা ব্যতীত বর্তমানকালে প্রচলিত শীতলা, মনসা প্রভৃতি বহু পূজাও প্রচলিত ছিল। বৃক্ষ (বট, তুলসী, অশ্বথ, বকুল, হরীতকী, আমলকী), পশু-পক্ষী (গরু, হনুমান, শৃগাল এবং বিভিন্ন দেবতার বাহন পশু বা পক্ষী), গঙ্গা, আত্রেয়ী, করতোয়া প্রভৃতি নদী, শালগ্রাম শিলা এবং ঢেঁকিপূজা প্রচলিত ছিল।৮৫
তান্ত্রিক উপাসনার কয়েকটি বীভৎস চিত্র ওয়ার্ড সাহেবের গ্রন্থে আছে। রুদ্রযামল, যোনিতন্ত্র, নীলতন্ত্রগুলিতে যে সমুদয় বিধান আছে, তদনুসারে এগুলির অনুষ্ঠান হইত–প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট হইতে শুনিয়া ওয়ার্ড ইহার বিবরণ দিয়াছেন। এই অনুষ্ঠানগুলি সাধারণতঃ চক্র নামে অভিহিত হইত। ওয়ার্ড সাহেবের বিবরণ সংক্ষেপে এই :
“এই অনুষ্ঠান করিতে হইলে প্রথমে পূজার জন্য একটি স্ত্রীলোক নির্বাচন করিতে হইবে। দক্ষিণাচারীরা নিজের স্ত্রীকে এবং বামাচারীরা নর্তক, কপালী, ধোবা, নাপিত, চণ্ডাল বা মুসলমান জাতীয় নারী অথবা গণিকাকে আনিয়া একটি আসনে বা মাদুরের উপর বসাইবে। অতঃপর মৎস্য, মাংস, কড়াইশুটি, ভাত, মদ্য, মিঠাই ও অন্যান্য দ্রব্য আনিবে। প্রথমে মন্ত্র পড়িয়া এই সমুদয় দ্রব্য ও স্ত্রীলোকটিকে শোধন করিবে এবং ইষ্ট দেবতার পূজা করিবে।
যে নারীর পূজা হইল, পূজান্তে সে মৎস্য, মাংস, মদ্য প্রভৃতি ভোগের দ্রব্য প্রথমে আহার করিত, পরে তাহার ভুক্তাবশিষ্ট অন্য সকলে একে অন্যের মুখে পুরিয়া দিত–ইহার মধ্যে কোন জাতিবিচার ছিল না।
“অতঃপর স্ত্রীলোকটিকে নগ্ন করিয়া প্রথমে পুরোহিত ও পরে অন্যান্য সকলে প্রকাশ্যে উল্লিখিত শাস্ত্রসমূহের বিধান অনুযায়ী যাহা যাহা করিত তাহা এতই অশ্লীল যে লিপিবদ্ধ করা যায় না। যে সমুদয় ব্রাহ্মণপণ্ডিত আমাকে এই বিবরণ দিয়াছেন তাহারা বলিতে বলিতে পুনঃ পুনঃ থামিয়া ঢোক গিলিয়া কোন মতে এই বীভৎস কাহিনীর বর্ণনা শেষ করেন।”৮৬
ওয়ার্ড অবধূত ব্রহ্মচারীদের পূর্ণাভিষেকের’ এইরূপ বীভৎস অনুষ্ঠানও বর্ণনা করিয়াছেন।৮৭
উপসংহারে ওয়ার্ড সাহেব লিখিয়াছেন যে, এইরূপ অনুষ্ঠানের সংখ্যা ও বীভৎসতা ক্রমশঃ বাড়িয়াই চলিয়াছে। এগুলি গোপনে ইহলেও, ইহা যে ব্রাহ্মণ ও অন্য জাতির মধ্যে ক্রমশঃ বাড়িতেছে ইহা সকলেই জানে। শাস্ত্রের মন্ত্র ও বিধান যথাযথভাবে কম লোকেই অনুসরণ করে। অধিকাংশই এই সমুদয় অনুষ্ঠান মৎস্য, মাংস, মদ্য ও মৈথুন প্রভৃতি সম্ভোগের উপলক্ষ্য বলিয়াই মনে করে।
তান্ত্রিক পূজার আর-একটি অঙ্গ নরবলিও যে প্রচলিত ছিল কয়েকটী দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া ওয়ার্ড সাহেব তাহাও প্রতিপন্ন করিয়াছে।৮৮।
ওয়ার্ড সাহেব কয়েক প্রকার স্বেচ্ছামৃত্যুর বিবরণ দিয়াছেন। কুষ্ঠ প্রভৃতি দুরারোগ্য ব্যাধি, দুর্দশা, সামাজিক ঘৃণা প্রভৃতির হাত হইতে এড়াইবার জন্য কেহ কেহ আগুনে পুড়িয়া বা জলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিত। নদীয়ার নিকটে ক্ষীরগ্রামে একপ্রকার অর্ধচন্দ্রাকৃতি খড়গর সাহায্যে নিজের গলা কাটিয়া মৃত্যুবরণের কাহিনী ওয়ার্ড লিখিয়াছেন। গঙ্গায় শিশুসন্তান বিসর্জন ছাড়াও পূর্ববঙ্গে অসুস্থ শিশুকে ‘ভূতে পাইয়াছে’ মনে করিয়া ঝুড়িতে ভরিয়া তিনদিন গাছের ডালে ঝুলাইয়া রাখা হইত। ইহার ফলে প্রায়ই শিশুর মৃত্যু হইত।৮৯
ওয়ার্ড সাহেব বাংলায় বৈরাগী ও সন্ন্যাসীর সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়াছেন তাহা সংক্ষেপে উল্লেখ করিতেছি : [৯০]
বৈরাগী : অধিকাংশ বৈরাগীই চৈতন্য-সম্প্রদায়ভুক্ত। তাহাদের অধিকাংশের সঙ্গেই একজন করিয়া বৈষ্ণবী থাকে। গোসাইরা মালাবদল করিয়া ইহাদের বিবাহ দেন। অনেক বৈষ্ণবীই অসচ্চরিত্রা। ইহারা গান গাহিয়া বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।
এই বর্ণনার সমর্থনে আমার বাল্যকালের একটি কাহিনী মনে পড়ে। আমাদের বাড়ীতে একজন নমঃশূদ্র চাকর ছিল। এক নাপিতের বিধবাকন্যাকে লইয়া সে পলাইয়া যায়। ২৩ বছর পরে এই দুইজন তিলক কাটিয়া বৈরাগী বোষ্টমরূপে আমাদের গ্রামে আসিয়া খঞ্জনী বাজাইয়া গান গাহিয়া বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করিত। কোন ভদ্র গৃহস্থ যে তাহাদের অতীত জীবনের কথা মনে করিয়া তাহাদের ঘৃণা করিতেন বা তাহাদের প্রতি বিরূপ ছিলেন এরূপ মনে হয় না।
শৈব সন্ন্যাসী : ইহারা গায়ে ভস্ম মাখিয়া কৌপীন পরে এবং গায়ের উপর একখানি রঙীন কাপড় জড়াইয়া রাখে। ইহাদের ময়লা চুল জটা পাকাইয়া অনেক সময় প্রায় পায়ের গোড়ালিতে পৌঁছে, তবে এগুলি অনেক সময়ই কৃত্রিম পরচুলা মাত্র। কেহ কেহ হাতে শূকরের দাঁত বাঁধে। কেহ কেহ উলঙ্গ হইয়াই ঘোরে। ইহাদের মধ্যে এক শ্রেণী বিবাহ করে না; মৎস্য, মাংস আহার করে না এবং তৈল মাখে না। বাংলা দেশে শৈব সন্ন্যাসীর সংখ্যা অনেক বেশী, কিন্তু বৈরাগীদের অপেক্ষা তাহাদের আদর বা সম্মান অনেক কম।
ইহা ছাড়া আরও কয়েক শ্রেণীর সন্ন্যাসী ছিল, কিন্তু তাহাদের সংখ্যা খুব বেশী নহে। ইহাদের মধ্যে দণ্ডী ও পরমহংস বিশেষ সম্মানের পাত্র ছিল। ইহা ছাড়া মৌনী ও ঊর্ধ্ববাহু সন্ন্যাসীও বাংলায় কিছু কিছু দেখা যাইত। দণ্ডীদের হাতে লাঠি থাকিত, তাহারা কেশ ও শত্রু রাখিত না, কৌপীন ও রক্তবস্ত্রের উত্তরীয় পরিত; মৎস্য, মাংস, তৈল ও সিদ্ধ চাউল বর্জন করিত এবং গঙ্গামাটি গায়ে মাখিয়া স্নান করিত। তাহারা ভিক্ষা বা রন্ধন করিত না-ব্রাহ্মণের গৃহে সম্মানিত অতিথি হইয়া ভোজন করিত। বিষ্ণুর ধ্যান ও জপে তাহারা সর্বদাই নিযুক্ত থাকিত। পরমহংসগণ সিদ্ধপুরুষ বলিয়া পরিচয় দিতেন, কোন বস্ত্র পরিধান করিতেন না এবং মৌনী হইয়া তীর্থস্থানে বাস করিতেন। কালীঘাটে কয়েকজন পরমহংসের কথা ওয়ার্ড লিখিয়াছেন। ইঁহারা ভিক্ষা চাহিতেন না, স্বেচ্ছায় যে যাহা দিত তাই খাইয়াই জীবন ধারণ করিতেন। ইহা ছাড়াও একদল মৌনী সাধু ছিলেন। তাঁহারা কৌপীন পরিতেন, গায়ে ছাই মাখিতেন এবং গঙ্গাতীরে দুগ্ধ, ফল, মূল প্রভৃতি আহার করিতেন। লোকে এসকল স্বেচ্ছায় দান করিত, প্রয়োজন হইলে শিষ্যগণ ভিক্ষা করিত। কিন্তু মৌনীবাবা কখনও কথা বলিতেন না। ঊর্ধ্ববাহুগণ সর্বদাই দক্ষিণহস্ত উঁচু করিয়া রাখিতেন। কেহ চিরকালের জন্য, কেহবা নির্দিষ্টকালের জন্য এইরূপ থাকিবেন, এইরূপ ব্রত গ্রহণ করিতেন। ব্ৰতকাল শেষ হইলে বিষ্ণুপূজা করিয়া সন্ন্যাসীদের প্রধানকে দক্ষিণা দিতেন। ওয়ার্ড বলেন যে, হিন্দু বাঙ্গালীর আট ভাগের এক ভাগ লোক এইপ্রকার সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে।
বর্তমানকালের ন্যায় গঙ্গাসাগরে এবং নানা যোগে অর্থাৎ পুণ্য তিথিতে কলিকাতায় ও অন্যান্য স্থানে দূরদূরান্তর হইতে যাত্রীরা গঙ্গাস্নান করিতে আসিত।
ওয়ার্ড সাহেব বহু ধর্মোৎসব ও ব্রতের এবং উপবাস, দান ও পুণ্যকার্যের উল্লেখ করিয়াছেন। রামায়ণ, মহাভারত, গীতা ও পুরাণ পাঠের ব্যবস্থা করা, অতিথিসেবা, পথের ধারে পুকুর কাটা ও গাছ লাগান, জলসত্র, ব্রাহ্মণকে দান। প্রভৃতি পুণ্যকার্য বলিয়া বিবেচিত হইত। শ্রীরামপুরের গোলকচন্দ্র রায় প্রত্যহ ২৫০ জন পথিক ও সন্ন্যাসীকে ভোজন করাইতেন। কথিত আছে, ইহার জন্য প্রতি বৎসরে তিনি ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করিতেন।
পূবেই বলিয়াছি, খ্রীষ্টান মিশনারী (মি. ওয়ার্ড ও অন্যান্য ইংরেজ লেখকগণ) হিন্দুধর্মের সম্বন্ধে যে-সকল কুৎসা প্রচার করিয়াছেন, তাহার মধ্যে অনেক ভুল, ভ্রান্তি ও অতিরঞ্জন থাকিলেও প্রকৃত তথ্যও অনেক আছে। ইহার প্রমাণস্বরূপ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে প্রকাশিত একখানি ক্ষুদ্র পুস্তিকার উল্লেখ করা যায়। গ্রন্থকারের নাম ব্রজমোহন, কিন্তু অনেকে মনে করেন, রামমোহন রায় নিজেই ছদ্মনামে এই গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ইহাতে পূজাপার্বণ উপলক্ষে স্ত্রীলোকদের সাক্ষাতে অতিশয় অশ্লীল ভঙ্গীতে নৃত্যসহ অশ্রাব্য ভাষায় সঙ্গীত, হোলি ঝুলনযাত্রা জন্মাষ্টমী উপলক্ষে মুসলমান বাইজীর গীত ও নৃত্য, গঙ্গার ঘাটে পুরুষদের দৃষ্টিগোচরে যুবতীদের স্নান, এবং প্রধানতঃ নিম্নজাতীয়দের মধ্যে প্রচলিত কালু রায়, দক্ষিণ রায়, ওলাবিবি প্রভৃতির পূজার উল্লেখ করা হইয়াছে।৯১
এই প্রসঙ্গে বামাচারী শাক্ত, অঘোরপন্থী শৈব ও এই শ্রেণীর অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের বীভৎস অনুষ্ঠানসম্বন্ধে প্রত্যক্ষদর্শী অথবা সমসাময়িক বিশ্বস্ত হিন্দুর বিবরণ উল্লেখ করা যাইতে পারে। বর্তমান শতাব্দীর প্রথমভাগেও যে এই জাতীয় অনুষ্ঠান একেবারে রহিত হয় নাই তাহারও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আছে।
বাংলা দেশে উনিশ শতকে ধর্মে যে বিষম গ্লানি উপস্থিত হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এ-সম্বন্ধে ঐতিহাসিক কোন স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পূর্বে কয়েকটি বিষয় স্মরণ রাখা অবশ্যক।
প্রথমত, ধর্মের নামে এইপ্রকার বীভৎসতা বহু বৎসর পূর্ব হইতেই, কেবল বাংলা দেশে নহে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও প্রচলিত ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ পশ্চিমভারতের বল্লভাচার্য সম্প্রদায়ের উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই সম্প্রদায়ের গুরু, মহারাজ অথবা গোকুলস্থ গোঁসাই নামে অভিহিত হইতেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে একখানি সংস্কৃত নাটকে এইসব গুরুদের সহিত তাহাদের শিষ্যাদের যে সম্ভোগচিত্র অঙ্কিত হইয়াছে তাহা অবিশ্বাস্য বলিয়াই বোধ হয়। কিন্তু স্বামী নারায়ণ নামে একজন সংস্কারক (১৭৮১-১৮৩০) এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে যে তুমুল আন্দোলন করেন তাহাতে ইহার সত্যতা সম্বন্ধে বিশেষ কোন সন্দেহ থাকে না। কচ্ছদেশে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ম্যাকমার্ডো (McMurdo) ১৮২০ সনে লিখিয়াছেন, ভাটিয়া সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত লোকেরাও তাহাদের স্ত্রী ও কন্যারা গুরু মহারাজের সঙ্গে সহবাস করিলে নিজদিগকে সম্মানিত মনে করেন। হয়ত এই সমুদয় কেহই পুরাপুরি বিশ্বাস করিত না। কিন্তু এই গুরু মহারাজেরা এক মানহানির মোকদ্দমা আনিলে ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে বোম্বে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সার জোসেফ আর্নল্ড (Sir Joseph Arnold) যে রায় দেন তাহাতে শিষ্যাদের সহিত গুরুদের ব্যভিচার কাহিনী সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া মন্তব্য করেন। একজন গণ্যমান্য সাক্ষী বলেন, তিনি এই ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, কারণ চিরাচরিত প্রথা অনুসারে কিছু টাকা দক্ষিণা দিলেই ভক্তকে ইহা দেখিবার সুযোগ দেওয়া হয়। মোকর্দমার এই রায় বাহির হইলে কোন সংবাদপত্রে লেখা হইয়াছিল, ইহার ফলে বল্লভাচার্য সম্প্রদায় লোপ পাইবে এবং কৃষ্ণ-গোপীমূলক বৈষ্ণবধর্মের প্রতিপত্তিও খুব হ্রাস পাইবে। কিন্তু কার্যত ইহার কিছুই হয় নাই।৯২
দ্বিতীয়ত, উনিশ শতকের প্রথমভাগে সুরাপান, স্ত্রীসংসর্গ, প্রভৃতি বিষয়ে বর্তমান কালের নীতি ও আদর্শ বিশিষ্ট হিন্দুদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল না। রামমোহন রায় সে-যুগের একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নাই। তিনিও ‘কুলার্ণব’ ও ‘মহানির্বাণ’-তন্ত্রের বচন উদ্ধৃত করিয়া ‘সংস্কৃত মদ্যপানে’ দোষ নাই এবং যে ইহা দোষ মনে করিয়া নিন্দা করে তাহার মহাপাতক হয়–ইহা সপ্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। তিনি ইহাও সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, “তন্ত্রোক্ত শৈব বিবাহের দ্বারা বিবাহিতা যে স্ত্রী সে বৈদিক বিবাহের স্ত্রীর ন্যায় অবশ্যগম্যা হয়। শৈব বিবাহের বয়স ও জাতি ইহার বিচার নাই কেবল সপিণ্ডা না হয় এবং সভর্তৃকা হয় তাহাকে শিবের আজ্ঞাবলে শক্তিরূপে গ্রহণ করিবেক।” ইহার যুক্তিস্বরূপ তিনি বলেন, “বৈদিক বিবাহের স্ত্রী….যদি ব্রহ্মার কথিত মন্ত্রবলে শরীরের অর্ধাঙ্গভাগিনী হয় তবে মহাদেবের প্রোক্ত মন্ত্রের দ্বারা গৃহীতা যে স্ত্রী সে পত্নীরূপে গ্রাহ্য কেন না হয়?”৯৩
অনুরূপ যুক্তিবলে অনেক কদাচারকেই সমর্থন করা যায়। অনেক তান্ত্রিক গ্রন্থে মদ্যপান ও পরস্ত্রীগমন সম্বন্ধে এমন সব বচন আছে যে তাহার উল্লেখ করা বর্তমান কালে রুচিসঙ্গত হইবে না। সুতরাং সে-যুগের সাধারণ লোকে যে বেদের বহু পরবর্তীকালের তন্ত্র ও বৈষ্ণবশাস্ত্রের দোহাই দিয়া মদ্য, মাংস, মৈথুনের বিষয়ে যথেচ্ছাচার করিবে ইহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই। ‘শিব প্রোক্ত’ বাণী যদি গ্রাহ্য হয় তবে বৈষ্ণবগ্রন্থে অনুমোদিত কার্যাবলীই বা দোষের হইবে কেন? অথচ রামমোহন ইহার তীব্র নিন্দা করিয়াছেন।৯৪
তৃতীয়ত, যদিও কর্তাভজা, বল্লভাচার্য প্রভৃতি বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের বিবরণ হইতে সেকালের ধর্মানুষ্ঠান সম্বন্ধে গভীর অশ্রদ্ধার উদয় হওয়া অস্বাভাবিক নহে, তথাপি এই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অনেক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিও ছিলেন তাহারও প্রমাণ পাওয়া যায়। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।৯৫ নিত্যানন্দের দশম অধস্তন বংশধর রঘুনন্দন গোস্বামী ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাম-সীতার কাহিনীমূলক রামরসায়ণ’ নামে মহাকাব্য, শ্রীচৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে ‘গৌরাঙ্গচ’, ‘গীতমালা’ নামে কৃষ্ণের বাল্যলীলা সম্বন্ধে ৪৩৯টি গীতিকবিতা এবং রাধার প্রণয় অবলম্বনে ৩৪ সর্গে বিভক্ত আর-একখানি মহাকাব্য রচনা করেন। ইহাতে কবিত্বশক্তি ও মৌলিক উদ্ভাবনী শক্তির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
অদ্বৈতের বংশধর রাধামোহন বিদ্যাবাচস্পতি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বলিয়া দেশীয় ও ইংরেজ পণ্ডিতদের সম্মান লাভ করিয়াছিলেন। স্মৃতি, ন্যায় ও দর্শনে তাহার অপূর্ব পাণ্ডিত্য ছিল এবং ১৮০২ খ্রষ্টাব্দে তিনি তত্ত্ব-সংগ্রহ’ নামে প্রসিদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বৈষ্ণবধর্ম সম্বন্ধে তিনি কৃষ্ণতত্ত্বামৃত’, ‘কৃষ্ণভক্তি-রসোদয়’, ‘কৃষ্ণভজনক্রম-সংগ্রহ’ এবং ‘কৃষ্ণার্চনদীপিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থ লিখিয়া খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করেন।
হেষ্টিংসের দেওয়ান সুপ্রসিদ্ধ গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের পৌত্র কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ ইংরেজ কোম্পানির অধীনে উচ্চ চাকুরী করিতেন। কিন্তু বিষয়বাসনা ত্যাগ করিয়া ৩০ বৎসর বয়সে বৃন্দাবনে যান। সেখানে ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া কৃষ্ণের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিদিন তিনি বৈষ্ণব ভোজন করাইতেন, ইহাতে বার্ষিক ২২ হাজার টাকা ব্যয় হইত। ৪০ বৎসর বয়সে সংসার ত্যাগ করিয়া গোবর্ধনের সিদ্ধ কৃষ্ণদাস বাবাজীর শিষ্য হন এবং সাধুন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেন। লালাবাবু নামে তিনি এখনও বাংলা দেশে সুপরিচিত। ৪২ বৎসর বয়সে তাহার মৃত্যু হয়। এই সময়ে বহু বাঙ্গালী বৈষ্ণব মথুরা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আদর্শ বৈষ্ণব সাধুর ন্যায় জীবন যাপন করিয়া তিনশত বৎসর পূর্বে শ্রীচৈতন্যের প্রতিষ্ঠিত এই বৈষ্ণবকেন্দ্রের খ্যাতি ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ইহা বাংলার বৈষ্ণব ধর্মের গৌরব সূচিত করে।
***
পাদটীকা
১. বিভিন্ন মতের সপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলির জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি দ্রষ্টব্য : (১) শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-রামমোহন রায়, পৃ. ১২। (২) The Life and Letters of Raja Rammohan Roy, by S. D. Collet, Edited by Dilip Kumar Biswas and Prabhat Chandra Ganguli P. 1.
২. ব্রজেন্দ্র-২৪ পৃ.
৩. ব্রজেন্দ্র- ৫৪ পৃ.
৪. শ্রীযোগেশচন্দ্র বাগল-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-২৭ পৃ.
৫. ঐ-২৮।২৯ পৃ.
৬. ঐ-৩১ পৃ.।
৭. ঐ-৬৬ পৃ.
৮. ঐ-৬৯ পৃ. ৮(ক). শ্রীযোগেশচন্দ্র বাগল-কেশবচন্দ্র সেন-৩৭-৩৮ পৃ.
৯. ১৯১০ সনে মাঘোৎসব উপলক্ষে শিবনাথ শাস্ত্রীর বক্তৃতা। G. C. Banerjee প্রণীত Keshub as seen by his Opponents গ্রন্থের ১১৪ পৃ. দ্রষ্টব্য।
১০. প্রতাপচন্দ্র মজুমদার “The Life and Teachings of Keshub Chander Sen” গ্রন্থে কেশবচন্দ্রের উপর রামকৃষ্ণের প্রভাব স্বীকার করিয়াছেন। “ And now the sympathy, friendship and example of the Paramhansa converted the Motherhood of God into a subject of special culture with him.” (২২৮-২৯ পৃ.)। প্রতাপচন্দ্র আরও বলেন, “ইহার ফলে হিন্দুসমাজে কেশবের ধর্মমত জনপ্রিয় হইয়া ওঠে এবং ‘আর্যনারী সমাজ’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়–এখানে কেশবের ও প্রতিবেশী পরিবারের নারীগণ ধর্মসাধনা করেন।”
১০ক. G. S. Leonard প্রণীত A History of the Brahmo Samaj নামক সমসাময়িক গ্রন্থে এই বিষয়ের বিস্তৃত আলোচনা দ্রষ্টব্য (pp. 284-93)।
১১. শ্রীগিরিশচন্দ্র নাগ-ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁহার মহত্ত্ব, ১৩৯ পৃ.
১২. ঐ ১৪২-৪৮ পৃ.
১৩. ঐ ১৪৯ পৃ.
১৪. ১০নং পাদটীকায় উল্লিখিত গ্রন্থের ২৪১-৪২ পৃ. দ্রষ্টব্য। রামকৃষ্ণের ধর্মসমন্বয়ের উল্লেখ করিয়া প্রতাপচন্দ্র বলিয়াছেন : “This strange eclecticism suggested to Keshub’s appreciative mind the thought of broadening the spiritual structure of his own movement.”
১৫. গিরিশ, ১৬১-৬৭ পৃ.
১৬. বাগল–দেবেন্দ্রনাথ, ৭২-৩ পৃ.
১৭. ৯নং পাদটীকায় উল্লিখিত গ্রন্থ, ১১৫-১৬ পৃ.
১৮. ঐ, ১১১-২১ পৃ.।
১৯. P. Thomas, Christians and Christianity in India and Pakistan (George Allen and Unwin, 1954) p. 182.
২০. Rammohan Roy’s Works (Panini Office Edition) pp. 145-46.
২১. Reverend Alexander Duff, India and Indian Missions (Quoted in History & Culture of the Indian People, Vol. X, p. 155).
২২. The Calcutta Journal, 11 March, 1822.
২৩. শ্ৰীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-সংবাদপত্রে সেকালের কথা ২য় ভাগ- ১৭৩-৭৪ পৃ.
২৪. স্বামী সারদানন্দ-শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ-২য় খণ্ড, ৪২ পৃ. (এই গ্রন্থ পরবর্তী পাদটীকাগুলিতে “লীলা প্রসঙ্গ” নামে অভিহিত হইবে।)
২৫. ঐ, ১০৭-৮ পৃ.
২৬. ঐ, ১১০ পৃ.
২৭. ঐ, ১২৬ পৃ.
২৮. ঐ, ২৮৮ পৃ.
২৯. ঐ, ৩০০ পৃ.
৩০. ঐ, ৩৬১ পৃ.
৩১. ঐ, ৩৬২-৬৩ পৃ.
৩২. ঐ, ৩৬৬ পৃ.
৩৩. ঐ, ৩৬৬-৬৭ পৃ.
৩৪. ঐ, ৩০৩ পৃ.
৩৫. ঐ, পঞ্চম খণ্ড, ২২৩-২৫ পৃ.
৩৬. ঐ, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৯ পৃ.
৩৭. ঐ, ৩৫১ পৃ.
৩৮. অতঃপর দৃষ্টান্তস্বরূপ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের যে কয়টি উক্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, সেইগুলি এবং অনুরূপ আরও বহু উক্তি নিম্নলিখিত দুইটি গ্রন্থে আছে : (১) শ্রীসুরেশ চন্দ্র দত্ত- পরমহংস রামকৃষ্ণের উক্তি (ইহার প্রথম ভাগ ১৮৮৪ অব্দে ও দ্বিতীয় ভাগ ১৮৮৬ অব্দে পরমহংসের জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত হয়। পরে ইহার পরিবর্ধিত বহু সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে)। (২) শ্ৰীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) কথিত- শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃত (৫ খণ্ড)।
৩৯. লীলাপ্রসঙ্গ- তৃতীয় খণ্ড, ১৪৫ পৃ।
৪০. শ্রীপ্রমথনাথ বসু-স্বামী বিবেকানন্দ (প্রথম খণ্ড), ১৪৭ পৃ. (এই গ্রন্থ অতঃপর ‘বিবেকানন্দ’ নামে অভিহিত হইবে।
৪১. লীলাপ্রসঙ্গ, দ্বিতীয় খণ্ড, ৩৯০ পৃ.
৪২. ঐ, পঞ্চম খণ্ড, ৮ পৃ.
৪৩. ঐ, ১৮ পৃ.
৪৪. ঐ, ২২২ পৃ.
৪৫. নরেন্দ্রনাথের জীবনের ঘটনা- ‘বিবেকানন্দ’ গ্রন্থ হইতে গৃহীত।
৪৬। লীলাপ্রসঙ্গ, পঞ্চম খণ্ড, ৬৫ পৃ.
৪৭. বিবেকানন্দ–প্রথম খণ্ড, ১০৩ পৃ.
৪৮. ঐ, ১০৯ পৃ.
৪৯. ঐ, ১১৮-১৯ পৃ.
৫০. ঐ, ১৩৭ পৃ.
৫১. ঐ, ১৪৫ পৃ.
৫২. ঐ, ১৬০ পৃ.
৫৩. ঐ, ২৩৮ পৃ.
৫৪. ঐ, ২৫৮ পৃ.
৫৫. ঐ, ১৮৭ পৃ. ৫৬. ঐ, ৩৪০ পৃ.
৫৭. স্বামীজির আমেরিকা যাইবার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল, এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা “Swami Vivekananda–A Historical Review” by Dr., R. C. Majumdar, গ্রন্থে আছে।
৫৮. ধর্মমহাসভার অধিবেশনে স্বামীজি যে সমুদয় বক্তৃতা করেন তাহার বঙ্গানুবাদ উদ্বোধন কার্যালয় হইতে “স্বামী বিবেকানন্দের চিকাগো বক্তৃতা” নামে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হইয়াছে।
৫৯. ধর্মমহাসভায় স্বামীজির বক্তৃতাগুলির মর্ম এবং এ-সম্বন্ধে আমেরিকায় যে সমুদয় মতামত প্রকাশিত হইয়াছিল তাহার বিস্তৃত বিবরণ নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলিতে আছে : (3) R. C. Majumdar, Swami Vivekananda-A Historical Revie– pp. 38-50, Calcutta, 1965. (3) Burke, Marie Louise, Swamil Vivekananda in America : New Discoveries, Calcutta, 1954. (3) Nikhilananda Swami, Vivekananda : a Biography, New York, 1953.
৬০. পত্রাবলী (উদ্বোধন কার্যালয় হইতে প্রকাশিত-১৩৪১ বাংলা সন) দ্বিতীয় ভাগ, ১০১-২ পৃ.
৬১. ঐ, ১১০-১২ পৃ.
৬২. ঐ, ১১৫-১৭ পৃ. (মূল চিঠির কোন কোন অংশ ইংরেজীতে লেখা–তাহার বঙ্গানুবাদ দেওয়া হইল।)।
৬৩. ঐ, ১৫৭ পৃ.
৬৪. Lectures from Colombo to Almora.
৬৫. বিবেকানন্দ, চতুর্থ খণ্ড, ৭২২-২৫ পৃ.
৬৬. ইহার বিস্তৃত বিবরণীর জন্য নিম্নলিখিত গ্রন্থ দ্রষ্টব্য : Swami Gambhirananda, History of the Ramakrishna Math and Mission, Advaita Ashrama, Calcutta, 1957..
৬৭. বিস্তৃত বিবরণের জন্য অক্ষয়কুমার দত্ত প্রণীত “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” -প্রথম ভাগ, ১৫২-৬৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য (পরবর্তী পাদটীকাগুলিতে এই গ্রন্থ ‘উপাসক’ নামে উল্লেখ করা হইবে।)
৬৭ (ক), কাহারও মতে ‘কৈবর্ত (JAS 1966, p. 244).
৬৭ (খ), ঐ।
৬৮. বিনয় ঘোষ প্রণীত “সাময়িক পত্রে সমাজচিত্র”, চতুর্থ খণ্ড, ৬৯৮-৭০০ পৃ. দ্র.। পরবর্তী পাদটীকাগুলিতে এই গ্রন্থ ‘বিনয়’ ও খণ্ডসূচক অঙ্ক দ্বারা উল্লেখ করা হইবে।
৬৯. বিনয়, ১। ১১৫-১৭ পৃ.
৭০. ঐ, ৪। ৬৯৯ পৃ.।
৭১. ‘উপাসক’, ১৫৭ পৃ.
৭২. বিনয়, ২। ৩৪৩ পৃ.
৭৩. ‘উপাসক’, ১৬৫ পৃ.
৭৪. ঐ, ১৮৬-৮৯ পৃ.
৭৫. ঐ, ১৭৫ পৃ.
৭৬. ঐ, ১৭৭ পৃ.
৭৭. ঐ, ১৮০ পৃ.
৭৮. বিনয়, ২। ৫৭৫ পৃ.
৭৯. Journal of the Asiatic Soicety, 1833, Vol. 2.
৮০. Buckland, C. F., Bengal under the Lieutenant Governors, pp. 32. 177. R. C. Majumdar, Glimpses of Bengal in the Nineteenth Century, pp. 69-70.
৮১. বিনয় ঘোষ, পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি, ১০৭ পৃ.
৮২. Ward, W., A View of the History, Literature and Mythology of the Hindoos. Serampore, 1818.
৮৩. ঐ, ২। ২৫৪ পৃ.
৮৪. ঐ, ২। ১৭৫ পৃ.; Wilson, H. H., An Account of the Religious Sects of Hindus (1832), p. 107.
৮৫. Ward ২। ১৯৫-২২৪ পৃ.
৮৬. ঐ, ২। ১৯৩ পৃ.।
৮৭. ঐ, ২। ২৯৫-৯৬ পৃ.
৮৮. ঐ, ২। ২৬১ পৃ.
৮৯, ঐ, ২। ৩১৩ পৃ.
৯০. ঐ, ২। ৩৭১ পৃ.
৯১. J. A. S. Vol. VIII, 1966, No. 4, p. 245.
৯২. ঐ, ২৪১-৪২ পৃ.। বিস্তৃত বিবরণের জন্য History of the Sect of Maharajas of Vallabhacharyas in Western India 1851
৯৩. “চারি প্রশ্নের উত্তর” (সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ), ১৮-১৯ পৃ.। “পথ্যপ্রদান”, ১৩১।
৯৪. “গোস্বামীর সহিত বিচার”, ৫১ পৃ.; “পথ্যপ্রদান” ১৩১-৪০ পৃ.
৯৫. বিস্তৃত বিবরণের জন্য JAS, 1966, pp. 242-43 দ্রষ্টব্য।