০৯. সাহিত্য

নবম অধ্যায় – সাহিত্য

১. গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব

এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় ১৭৬৫ হইতে ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের বাংলার ইতিহাস। এই ১৪০০ বৎসরের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুতর বিবর্তন বাংলা গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব। সুতরাং এই বিষয়টিই প্রথমে আলোচনা করিব।

(ক) অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা গদ্য

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলা গদ্যভাষার নমুনা ও বিবরণ এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে দেওয়া হইয়াছে। এই শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা গদ্যভাষার কিরূপ পরিবর্তন হইয়াছিল নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি হইতে তাহা বুঝা যাইবে।

১। ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে পুত্রের নিকট লিখিত মহারাজা নন্দকুমারের পত্র।

“তোমার মঙ্গল সৰ্ব্বদা বাসনা করণক অত্র কুশল পরন্তু ২৫ তারিখের পত্র ২৭ রোজ রাত্রে পাইয়া সমাচার জানিলাম শ্রীযুক্ত ফেতরৎ আখি খাঁ-এর এখানে আইসনের সম্বাদ যে লিখিয়াছিলে এতক্ষণতক পঁহুছেন নাই পঁহুছিলেই জানা যাইবেক। শ্ৰীযুত রায় জগচ্চন্দ্র বিষ রোজের পর বাটি হইতে আসিয়াছেন যেমত ২ কুচেষ্টা পাইতেছেন তাহা জানাই গেল। তিনি যথা ২ যাউন ফলত কার্যের দ্বারাতেই বুঝিবেন স্পষ্ট হইয়া আপনারি মন্দ করিতেছেন সে সকল লোকও অবশ্য বুঝিবেক।”১

২। ১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে লিখিত লর্ড কর্ণওয়ালিসের নিকট কোচবিহার সরকারের পত্র

“ধজেন্দ্র নারায়ণ রাজা আপন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে খানখা কাটিয়াছিল এ কারণ ভুটিয়ার স্থানে কএদ রহিল আমার ছাওাল শ্রীমান নাজির দেও খগেন্দ্র নারায়ণ রাজেন্দ্র নারায়ণকে রাজা করিল। তাহার পর রাজেন্দ্র নারায়ণ রাজার পরলোক হইলে পর কএদি রাজার পুত্র রাজার উপযুক্ত নহে তুমি রাজা হও অথবা অন্য কাহাকো রাজা করহ তাহা আমার ছাওাল মনজুর করিল না একারণ সন ১১৭৯ সালে ভুটিয়ার সহিত কাজিয়া (হইল)”।

৩। শ্রীহরিমোহনবাবু কর্তৃক ওলন্দাজ কোম্পানির ডিরেক্টারের নিকট ১৭৮৬ খ্রষ্টাব্দের ১২ই অগস্ট তারিখে লিখিত পত্র

“মে ওয়াল সাহেব জবরদস্তী করিয়া তাতি লোককে কাপড় বুনিতে দেয় না মুচলকা লইয়াছেক সেওয়ায় ইঙ্গরেজের কোম্পানি আর কোন মহাজনের কাপড় বুনিতে পারিবে না ইহাত তাতীলোক আমাদের কাপড় বুনিতে রাজ জদি ছাপীয়া আমাদের কাপড় কেহ বোনে তাহা ছেনাইয়া লন এবং মারপিট করেন ইহাতে আমাদিগের কর্মবন্ধ হইয়াছে–জাহাতে কাজ চলে এমন তদারক করিতে হুকুম হয়।”

৪। বহুলোকের স্বাক্ষরিত বীরভূম জিলার জজ সাহেবের নিকট দেওঘর বৈদ্যনাথ মন্দিরের জন্য ওঝা নিযুক্তি-সম্পর্কে ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুআরি মাসের একখানি আর্জিপত্র :

“আগে শ্রীশ্রী ঠাকুরের ওঝাগিরি কার্য্যের রামদত্ত ঝা ছিলেন তাহার তপ্রাপ্তি হইলে হযুরের হুকুম মত ঝামত ওঝার (?) পুত্ৰ শ্ৰীযুত আনন্দ দত্ত ওঝা সকুল কাৰ্যে খবর গিরি সুন্দর মত করিতেছেন কিন্তু ওঝা গিরি কার্যে নিযুক্ত না হওয়াতে শ্রীশ্রী ঠাকুরের সেবার অনেক কাৰ্য্য আটক হইতেছেক তাহাতে যাত্রিক লোকের মনের খেদ হয়ে সংপ্রতিক ফালগুন মাসের সিবরাত্রির ব্রত নিকট হইতেছে নানাদেশের লোক দরসনে আসিবেক ইহার মৈদ্ধে ওঝাগিরি কার্যে নিযুক্ত হইলে বড় ভালো হয়ে।”২

শ্রীপঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত এবং বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত চিঠিপত্রে সমাজ চিত্র’ নামক গ্রন্থে বহু চিঠি প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা হইতে তিনখানি চিঠির কিয়ৎ অংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

১। বাংলা ১১৯৬ সনে (১৭৮৯ খ্রী.) লিখিত নিমন্ত্রণপত্র–

“আমার দ্বিতিয় কন্যার মুভ বিবাহ ২৯ ওনত্রিষ্যা অগ্রহায়ন রবিবার হইবেক অতয়েব অনুগ্রহপূর্বক মহাশয় এবাটীকে আশীয়া সুভকৰ্ম্ম সম্পন্ন করিতে আজ্ঞা হইবেক শ্রীচরণে নিবেদন করিলাম।”

২। বাংলা ১২০১ সালে (১৭৯৪ খ্রী.) লিখিত চিঠি–

“১০ পৌষ রবিবার দিবষ আমার পীতা ঠাকুরের শার্ধ আমার পুরহিত শ্ৰীযুত মধ্যম ভট্টাচাৰ্য মহাশয় তাহাকে আশীতে পত্র লিখিতেছী তিহো বাড়িতে থাকেন তাহাকে অদ্যই আশীতে কহিবেন বাড়িতে না থাকেন তাঁহার তরফ জনেক ব্রাহ্মণকে পাঠাইবেন এখানের ক্রীয়া করাইয়া জায় ইহা নিবেদন করিলাম ইতি।”

৩। ১১৯৮ সনে (১৭৯১ খ্রী.) লিখিত ব্যবসায়ীর পত্র–

“শ্ৰীযুত কালীপ্রসাদ ঘোষজা খুড়া এখান হইতে দিবস আষ্টেক হইল মোকামে গিয়াছেন সকল কথা তাঁহার সাক্ষ্যাতে কহিয়াছি তাহাতেই জ্ঞাত হইয়া থাকিবা। অদ্যাপি কাপড় পাঠাইলা না এখানে ইঙ্গেরের সহিত কাপড় সওদা করিয়াছি অতয়েব রাতি বিরতে জে সুরতে কাপড় আসিয়া পহুছে তাহা করিবা জল এইক্ষনে হইল না মোকাম কাটঙায় নৌকাজোগে জে প্রকারে রাহি হয় তাহা করিবা কদাচ গৌন করিবা না গৌন হইলে সওদা চটিবেক আর আমাকে খেসারত দিতে হবেক ইহা বুঝিয়া কাৰ্য্য করিবা আর কাপড় জত তৈয়ার থাকে তাহাই এ চালানে পাঠাইবা এখন জে কাপড় আসিবেক তাহাই বিক্রী হবেক ইহার পর গৌনে জে কাপড় আসিবেক তাহা বিক্রী হওয়া ভার হবে।”

উপরে নানা শ্রেণীর লোকের রচিত বাংলা গদ্যের যে সমুদয় নমুনা উদ্ধৃত হইয়াছে তাহা হইতে সহজেই বুঝা যাইবে যে, ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে বাংলা গদ্যভাষা সাহিত্যসৃষ্টির উপযোগী হইয়া উঠে নাই, তবে ইহার সম্ভাবনা অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছে। কিন্তু ইহার অল্পকালের মধ্যেই বাংলা গদ্য একটি শক্তিশালী সাহিত্যের বাহন হইয়া উঠিল।

(খ) বাংলা গদ্যসাহিত্যে ইংরেজের অবদান

বাংলা গদ্যের এই সমৃদ্ধিসাধনে ইংরেজ কর্মচারীদের ও মিশনারীদের অবদান নিতান্ত সামান্য নহে। ঈষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার দেওয়ানি ও পরে ক্রমে ক্রমে ইহার শাসনভার গ্রহণ করার পর হইতে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য কর্মচারীদের বাংলাভাষা শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে। ইহার ফলে কোম্পানির অন্যতম প্রধান কর্মচারী ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হালহেড ইংরেজীভাষায় বাংলাভাষার একটি ব্যাকরণ রচনা ও প্রকাশ করেন (১৭৭৮ খ্রী.)। এই গ্রন্থের মধ্যেই সর্বপ্রথম বাংলা ছাপার হরফ ব্যবহৃত হয়। ইহার পরে জোনাথান ডানকান, এন. বি. এডমনষ্টোন, হেনরি ফরস্টার প্রভৃতি ইংরেজ লেখকগণ একাধিক আইনগ্রন্থ ইংরেজী হইতে বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করেন। জোনাথান ডানকানের অনূদিত আইন-গ্রন্থটি ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং এইটিই প্রথম বাংলা অক্ষরে মূদ্রিত পূর্ণাঙ্গ বাংলা গ্রন্থ। এডমনষ্টোন ও ফরস্টারের অনূদিত গ্রন্থদ্বয় যথাক্রমে ১৭৯১ ও ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ইহার পর ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে এ. আপজন রচিত ‘ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকেবিলারি’ (ইংরেজী ও বাংলা শব্দকোষ) এবং জন মিলারের ‘The Tutor’ বা ‘শিক্ষ্যা (sic) গুরু’- এই দুইটি শব্দশিক্ষা-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই বইগুলি রচনারীতির দিক দিয়া তেমন উল্লেখযোগ্য হইলেও আরবী ও ফারসী শব্দ যথাসাধ্য বর্জন করিয়া বাংলাভাষাকে একটি নির্দিষ্ট রূপ দেয়।

ইহার অব্যবহিত পরে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনের পাদরীরা এদেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় বাইবেল অনুবাদ ও খ্রীষ্টচরিত সম্বন্ধীয় নিবদ্ধ রচনা করিতে আরম্ভ করেন। ইহাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন জন টমাস ও উইলিয়াম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪ খ্রী.)। তাহাদের সহযোগী ছিলেন জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ড। রামরাম বসুর সাহায্যে টমাস ম্যাথু মার্ক, জন প্রভৃতির গসপেল বাংলায় অনুবাদ করিয়াছিলেন, মার্শম্যান এবং ওয়ার্ডও বাইবেলের কিছু অংশের বঙ্গানুবাদ করিয়াছিলেন। এইগুলি কেরীর অনুবাদের অঙ্গীভূত হইয়াছে। কেরীর বাইবেলের অনুবাদ (যাহা অংশত টমাস, মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের লেখনীপ্রসূত) ‘ধর্মপুস্তক’ নামে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ইহা ২৬টি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হইয়াছিল। বর্তমান কালের বিচারে কেরীর ‘ধর্মপুস্তক’-এর ভাষা অপূর্ণাঙ্গ ও অমার্জিত হইলেও বাংলা গদ্যের প্রথমযুগে একজন বিদেশীর রচনা-প্রচেষ্টা হিসাবে ইহাকে প্রশংসা না করিয়া পারা যায় না। ইহার ভাষার কিছু নিদর্শন নিম্নে দেওয়া হইল।

“দুই বৎসর পূর্ণ হইলে এত মত হইলে ফারোঙা স্বপ্ন দেখিলেন। দেখ সে ডাণ্ডাইয়াছে নদীর কিনারায়; দেখ নদী হইতে উঠিল সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট সাতটা গাভী ও চরিতে লাগিল ধারের উপর; তাহার পরে আর সাতটা গাভী উঠিল নদী হইতে বড় কুচ্ছিত আর কৃশা, পরে নদিতীরে ডাণ্ডাইল আর সকল গাভীর কাছে; অতঃপর কুচ্ছিত কৃশা গাভীরা খাইয়া ফেলাইল সেই সাতটা সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট গাভীদিগকে। তখন ফারোঙার চৈতন্য হইল।”৩

কেরীর বাইবেল-অনুবাদ প্রকাশের কয়েক মাস পূর্বে শ্রীরামপুর হইতে বাইবেলের The Gospel According to St. Mathew অংশ মূল গ্রীক হইতে অনূদিত হইয়া ‘মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত’ নামে প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহা কাহার রচনা তাহা জানা যায় না, তবে ইহার ভাষা সরল ও তদ্ভব-শব্দ-বহুল। কেরী ইংরেজী ভাষায় A Grammar of the Bengali Language নামে একটি বাংলাভাষার ব্যাকরণ (১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত) এবং A Dictionary of the Bengali Language নামে একটি বাংলা-ইংরেজী অভিধানও (প্রথম খণ্ড ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দে ও দ্বিতীয় খণ্ড ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত) প্রণয়ন করিয়াছিলেন। ভারতবর্ষে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষার মধ্যে কেরী বাংলাভাষাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করিতেন।

কেরী-কৃত বাইবেলের বঙ্গানুবাদ অল্পকালের মধ্যেই সবিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করে এবং কেরী ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন।

বাংলা গদ্যের উন্নতি সাধনে শ্রীরামপুর মিশনও দীর্ঘকাল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল। জোশুয়া মার্শম্যান সম্পাদিত বাংলা সাময়িকপত্র ‘সমাচার দর্পণ সম্বন্ধে পরে বিস্তৃত আলোচনা করা হইবে। তাঁহার পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান অনেকগুলি বাংলা গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন; ইহাদের নাম ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৩১), ক্ষেত্ৰবাগান বিবরণ (প্রথম খণ্ড ১৮৩১, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৩৬), পুরাবৃত্তের সংক্ষেপ বিবরণ (১৮৩৩), দেওয়ানি আইনের সংগ্রহ’ (১৮৪৩), বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৮) এবং ‘দারোগারদের কর্ম প্রদর্শক গ্রন্থ (১৮৫১)। মার্শম্যানের ভাষা অত্যন্ত সহজ ও অনাড়ম্বর। নানা দুরূহ বিষয় ও মৌলিক চিন্তাকে বাংলা গদ্যে সরলভাবে প্রকাশ করিয়া তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন। মার্শম্যান কেরীর বাংলা-ইংরেজী অভিধানের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেন এবং নিজে একটি ইংরেজী-বাংলা অভিধান প্রণয়ন করেন।

উইলিয়াম কেরীর পুত্র ফেলিক্স কেরীও উৎকৃষ্ট বাংলা গাদ্য লিখিতে পারিতেন। তিনি ব্যবচ্ছেদবিদ্যা’ (১৮২০), ‘ব্রিটি দেশীয় বিবরণ সঞ্চয় (১৮২০), যাত্রীদের অগ্রেসর-বিবরণ’ (১৮২১) প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন; ইহাদের মধ্যে ব্যবচ্ছেদবিদ্যা’তে (ইহা একটি অসম্পূর্ণ কোষগ্রন্থের প্রথম খণ্ড) তিনি দুইজন বাঙালী পণ্ডিতের এবং পিতা উইলিয়ম কেরীর সাহায্য অবলম্বনে বাংলাভাষার সর্বপ্রথম শারীরতত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন। ফেলিক্স কেরীই বাংলা গদ্যে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানচর্চা করিয়াছেন। ফেলিক্স কেরী ও জন ক্লার্ক মার্শম্যান নিতান্ত শৈশবকাল হইতেই বাংলা দেশে মানুষ হইয়াছিলেন এবং সেই বয়স হইতেই পিতাদের উৎসাহে খুব ভালভাবে বাংলা শিখিয়াছিলেন। ফলে ইঁহারা বাঙালীর মতই বাংলা লিখিতে ও বলিতে পারিতেন। সুতরাং ইহাদের বাংলা রচনা বাঙালীর রচনা হিসাবেই বিচার করা উচিত।

ইঁহাদের সমসাময়িক ও সহযোগী–শ্রীরামপুর মিশনের আর একজন কর্মী স্কচ লেখক জন ম্যাক সরল বাংলা গদ্যে ‘কিমিয়া বিদ্যার সার’ (১৮৩৪) নামে একটি রসায়নবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন।

ইহাদের সমসাময়িক–শ্রীরামপুর মিশনের আর একজন পাদ্রী-উইলিয়ম ইয়েটস সরল বাংলা গদ্যে ‘পদার্থবিদ্যাসার’ (১৮২৫), জ্যোতির্বিদ্যা’ (১৮৩০), ‘সত্য ইতিহাস সার’ (১৮৩০), প্রাচীন ইতিহাস সমুচ্চয়’ (১৮৩০) ও সারসংগ্রহ (১৮৪৪) নামে কয়েকটি গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন। সম্ভবত শ্রীরামপুর মিশনের পাদ্রীদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইয়া বর্ধমানস্থিত প্রভিনসিয়াল ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুটান্ট ক্যাপ্টেন জেমস স্টুয়ার্টও বাংলা গদ্য রচনায় ব্রতী হইয়াছিলেন এবং ইতিহাস কথা’ (১৮১৬) ও তমোনাশক’ (১৮১৮) নামে দুইটি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। বাংলাভাষার প্রথম বর্ণমালা’ (১৮১৮) ইনিই রচনা করেন।

(গ) ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ

১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলি কলিকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপন করেন। বর্তমান মহাকরণ বা Writers, Building-এ এই কলেজ অবস্থিত ছিল। ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের (ইহাদিগকে তখন Writer বলা হইত) বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা এবং এদেশের ইতিহাস ও সমাজসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যেই ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময়ে ভারতীয় ভাষাগুলিতে উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তকের অভাব ছিল বলিয়া এই কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক ও কোন কোন কর্মচারী বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তক রচনা করিয়াছিলেন। সেগুলি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ হইতেই প্রকাশিত হইয়াছিল। বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীদের বাংলা গদ্যে রচিত পাঠ্যপুস্তকগুলির একটি বিশিষ্ট স্থান আছে।

উইলিয়ম কেরী ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সংস্কৃত, বাংলা ও মারাঠি ভাষার অধ্যাপক এবং বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে। নিযুক্ত হইবার পরে কেরী তাঁহার কয়েকজন সহকর্মীর উপর বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার ভার দেন। ইহার ফলে রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ইহাই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ হইতে প্রকাশিত প্রথম বাংলা গ্রন্থ, গদ্যে রচিত বাংলা জীবনীগ্রন্থ, এবং বাঙালীর লেখা প্রথম মুদ্রিত গদ্যগ্রন্থ। ইহার কিছু অংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“এক দিবস রাজার বাহির গড়ের সেনাপতি কমল খোঁজা নামে একজন মহা পরাক্রান্ত এবং রাজার কাছে বড়ই প্রতিপন্ন হাত জোড় করিয়া নিবেদন করিল রাজার গোচরে। মহারাজা আমি দুই তিন দিবস হইতে দেখিতেছি রাত্রি দুই প্রহরের পরে ঐ জঙ্গলটাতে অকস্মাত অগ্নি আকার প্রজ্বলিত হয় বড়ই দীপ্তিকর প্রচণ্ড অনলের ন্যায় তাহাতে প্রথম ঠাওরাইলাম বুঝি কোন রাখাল ইত্যাদি লোক এ বনে অগ্নি দিয়া থাকিবেক তাহাতে রাত্রে প্রজ্বলিত হইয়াছে। প্রাতে ঘোড় শোয়ারিতে যাইয়া দেখিলাম বন পূৰ্ব্ব মতই আছে বরং অধিক তেজস্ব। দুই তিন দিবস হইতে আমি এই মত দেখিতেছি। মহারাজা আমাকে ভ্রান্ত জ্ঞান করিবেন এ পরাভয় প্রযুক্ত নিবেদন করি নাই।”৪

অনেকে এই গ্রন্থের ভাষাকে অপরিণত ও বিশৃঙ্খল বলিয়া নিন্দা করিয়াছেন। কিছু কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও যে ইহা সাধু বাংলাভাষাই তাহাতে কোন সন্দেহ নাই তবে ইহার মধ্যে আরবী ও ফারসী শব্দের আধিক্য দেখা যায়।

রামরাম বসুর আর-একটি গ্রন্থ লিপিমালা’ ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ পত্রাকারে রচিত কতকগুলি প্রস্তাবের সমষ্টি। এই গ্রন্থে লেখক সংস্কৃত ব্যাকরণ ও অন্বয়ের দোষ পরিহার করিয়া এবং ফারসী শব্দের মোহ কাটাইয়া সরল সুখপাঠ্য বাংলা গদ্য রচনা করিতে সমর্থ হইয়াছেন।

‘লিপিমালা’র অব্যবহিত পরে গোলোকনাথ শর্মা নামক একজন পণ্ডিত-কৃত ‘হিতোপদেশ’-এর বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। ইহার ভাষা অনেকটা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালী পণ্ডিতদের গদ্য-রচনার মত। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অপর দুইজন পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এবং রামকিশোর তর্কচূড়ামণিও ‘হিতোপদেশ’ এর বঙ্গানুবাদ করিয়াছিলেন। কিন্তু রামকিশোরের ১৮০৮-এ প্রকাশিত অনুবাদটি বর্তমানে আর পাওয়া যায় না।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট লেখকদের অন্যতম। তাঁহার রচিত গদ্য যে তখনকার মান অনুসারে অতি উৎকৃষ্ট গদ্য কেবল তাহাই নহে–তাহার মধ্যে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের সহিত সূক্ষ্ম রসজ্ঞানের সংযোগ সাধিত হইয়াছে। বাংলা গদ্যের প্রায় সমস্ত রীতির পরীক্ষাই সেই সুদূর অতীতকালে তিনি করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার প্রথম গ্রন্থ ‘বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২) সংস্কৃতগ্রন্থ দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা’র ছায়ানুবাদ। ইহার মধ্যে স্থানে স্থানে সংস্কৃতের আক্ষরিক অনুবাদ রচনার সৌন্দর্যহানি করিয়াছে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের সতেজ প্রকাশভঙ্গী ও সরল শব্দবিন্যাসের পরিচয় তাঁহার এই প্রথম গ্রন্থেই পরিস্ফুট। ইহার ভাষার নিদর্শন :

“অবন্তী নাম নগরেতে ভর্তৃহরি নামে রাজা ছিলেন তাঁহার অভিষেককালে শ্রীবিক্রমাদিত্য নামে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা কোন অপমান পাইয়া স্বদেশ ত্যাগ করিয়া বিদেশে গেলেন। শ্রীভর্তৃহরি অভিষিক্ত হইয়া পুত্ৰতুল্য প্রজাপালন দুষ্টের দমন এইরূপে পৃথিবী পালন করেন…সেই নগরে এক ব্রাহ্মণ ভুবনেশ্বরী দেবীর আরাধনা করেন আরাধনাতে সন্তুষ্ট হইয়া দেবী প্রত্যক্ষ হইলেন ও কহিলেন। হে ব্রাহ্মণ বর প্রার্থনা কর। ব্রাহ্মণ অনেক স্তব বিনয় করিয়া কহিল হে দেবী আমার প্রতি যদি প্রসন্ন হইয়াছেন তবে আমাকে অজরামর করুন।”

মৃত্যুঞ্জয়ের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘হিতোপদেশ’ (১৮০৮) সংস্কৃতগ্রন্থের মূল্যানুবাদ হওয়ার ফলে অপেক্ষাকৃত কঠিন, কিন্তু গোলকনাথের ‘হিতোপদেশে’র সহিত তুলনা করিলেই বুঝা যাইবে, মৃত্যুঞ্জয়ের সাহিত্যিক চেতনা তাঁহার অনুবাদকে কতখানি সরস করিয়া তুলিয়াছে। মৃত্যুঞ্জয়ের তৃতীয় গ্রন্থ ‘রাজাবলি’ (১৮০৮)। এই গ্রন্থে কলিযুগের আরম্ভ হইতে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি পৰ্য্যন্ত ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এই গ্রন্থে মৃত্যুঞ্জয় একাধিক রচনারীতি অনুসরণ করিয়াছেন, স্থানে স্থানে আরবী ফারসী শব্দের ব্যবহার করিতেও দ্বিধা করেন নাই। তাঁহার পূর্বের দুইখানি গ্রন্থের তুলনায় এই গ্রন্থের ভাষা অধিকতর সার্থক হইয়াছে। ‘রাজাবলী’র ভাষার নমুনা নিম্নে দেওয়া হইল।

“কান্যকুজ দেশের রাজা জয়চন্দ্র রাঠোর মহাবলপরাক্রম ছিলেন এবং বড় ধনী ছিলেন কাহাকে বলেতে কাহাকে প্রীতিতে এইরূপে প্রায় কুমারিকাখণ্ডস্থ সকল রাজাকে আপন বশীভূত করিয়াছিলেন তাঁহার অনঙ্গমঞ্জরী নামে অপূর্ব সুন্দরী এক কন্যা ছিলেন তাঁহার বিবাহের নিমিত্তে যে যে বর উপস্থিত হয় তাহারদের মধ্যে কেহ তাহার মনোনীত হইল না। পরে রাজা এক দিবস উদ্বিগ্ন হইয়া কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিলেন।…রাজকন্যা কহিলেন আমি এই মনে করিয়াছি আপনি এক রাজসূয় যজ্ঞ আরম্ভ করুন তাহাতে সকল রাজারদের নিমন্ত্রণ করুন তবে সকল রাজারা অবশ্য আসিবেন সেই রাজারদের মধ্যে আপন মনোনীত যে রাজাকে দেখিব তাহাকে স্বয়ং বরণ করিব।”৫

‘রাজাবলি’র চারি-পাঁচ বৎসর পরে মৃত্যুঞ্জয় ‘প্রবোধ-চন্দ্রিকা’ রচনা করেন। ইহার মধ্যে সংস্কৃত ব্যাকরণ, অলঙ্কার, স্মৃতি, ব্যবহার, নীতিবিদ্যা প্রভৃতি বহু শাস্ত্রের মর্ম সংক্ষেপে প্রকাশ করা হইয়াছে এবং অনেক উপাখ্যান আছে। বইটি মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুর (১৮১৯) চৌদ্দ বৎসর পর প্রকাশিত হয় (১৮৩৩)।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের আর-একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাহিরে প্রকাশিত ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’। বেদান্তদর্শন সম্বন্ধে রামমোহন রায়ের মত খণ্ডনের উদ্দেশ্যে মৃত্যুঞ্জয় এই গ্রন্থ রচনা করেন। স্থানে স্থানে ইহার ভাষা আক্রমণাত্মক হইলেও ইহাতে মৃত্যুঞ্জয় শিশু বাংলা গদ্যকে বিতর্কের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করিয়া শক্তির পরিচয় দিয়াছেন।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের আদি পর্বের অন্যান্য লেখকদের রচনাবলীর মধ্যে তারিণীচরণ মিত্রের ‘ঈশপের গল্পাবলী’ (ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট’ নামক বহুভাষিক গ্রন্থের বাংলা অংশ-১৮০৩), চণ্ডীচরণ মুন্‌শীর ‘তোতা ইতিহাস’ (১৮০৫), রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম্ (১৮০৫) এবং হরপ্রসাদ রায়ের ‘পুরুষপরীক্ষা’র (১৮১৫) নাম উল্লেখযোগ্য। তারিণীচরণ স্থানে স্থানে ইংরাজী ও ফারসী বাক্যগঠনরীতি অনুসরণ করিলেও তাঁহার ভাষা মার্জিত ও প্রাঞ্জল। তোতা ইতিহাস’ ‘তুতি নামা’ নামে একটি ফারসী গ্রন্থের হিন্দুস্থানী অনুবাদের অনুবাদ। ইহাতে ফরাসী শব্দের কিছু আধিক্য থাকিলেও বইটি সুখপাঠ্য। ইহার ভাষা অত্যন্ত সরল এবং কাহিনীকথনের উপযোগী, তাহাতে অনুবাদের আড়ষ্টতা নাই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’র আদর্শে রচিত। অস্ত্যর্থক ক্রিয়ার কর্তৃপদের অপ্রয়োগ এবং ফারসী “তক” শব্দের অতিপ্রয়োগ প্রভৃতি ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ইহার ভাষা বেশ সরল ও মার্জিত, বাক্যের হ্রস্বতা ইহার বিশেষত্ব। এই গ্রন্থের ভাষার নিদর্শন নিম্নে দেওয়া হইল।

“এক দিবস জগৎসেটের বাটীতে রাজা মহেন্দ্র প্রভৃতি সকলে বসিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে আহ্বান করিলেন দূত আসিয়া রাজাকে লইয়া গেলে যথাযযাগ্য স্থানে সকলেই বসিলেন। ক্ষণেক পরে রাজা রামনারায়ণ প্রশ্ন করিলেন আপনারা সকলেই বিবেচনা করুন দেশাধিকারী অতিশয় দুবৃত্ত উত্তর ২ দৌরাত্মের বৃদ্ধি হইতেছে অতএব কি করা যায়।…

“পশ্চাৎ কৃষ্ণচন্দ্র রায় নিবেদন করিলেন এ দেশের উপর বুঝি ঈশ্বরের নিগ্রহ হইয়াছে নতুবা এককালীন এত হয় না প্রথম যিনি দেশাধিকারী ইহার সৰ্ব্বদা পরানিষ্ট চিন্তা এবং যেখানে শুনেন সুন্দরী স্ত্রী আছে তাহা বলক্রমে গ্রহণ করেন এবং কিঞ্চিৎ অপরাধে জাতি প্রাণ নষ্ট করেন দ্বিতীয় বরগী আসিয়া দেশ লুট করে তাহাতে মনোযোগ নাই তৃতীয় সন্ন্যাসী আসিয়া যাহার উত্তম ঘর দেখে তাহাই ভাঙ্গিয়া কাষ্ঠ করে তাহা কেহ নিবারণ করে না।”

উইলিয়ম কেরীর নিজের নামেও ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ হইতে দুইটি বই প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহাদের একটির নাম ‘কথোপকথন’ (১৮০১), অপরটির নাম ইতিহাস মালা’ (১৮১২)। কথোপকথন’ দ্বিভাষিক গ্রন্থ, তাহার প্রতি পাতার এক পৃষ্ঠা বাংলায় রচিত, অপর পৃষ্ঠা ইংরেজীতে। এই বইয়ে বিদেশীদের শিক্ষাদানের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর বাঙালীর কথ্যভাষার নমুনা সংগৃহীত হইয়াছে; অবশ্য অবিমিশ্র সাধুভাষার রচনাও কয়েকটি আছে। কথোপকথন হইতে বাংলা কথ্যভাষার খাঁটি উদাহরণ এবং বাঙালী সমাজের বাস্তব ও অন্তরঙ্গ যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা সে-যুগের অন্য কোন বইয়ে মিলে না। ইতিহাস মালা’ প্রচলিত দেশী গল্প, সংস্কৃত কাহিনী ও ঐতিহাসিক কিংবদন্তীর একখানি সংকলন-গ্রন্থ। ইহার ভাষা–কয়েকটি গল্পের সংস্কৃতানুগত ভাষা বাদ দিলে-উন্নত স্তরের প্রাঞ্জল সাধুভাষা। বইটি মোটের উপর সুখপাঠ্য। প্রথম বাংলা গল্প-সংকলন হিসাবে ‘ইতিহাস মালা’র একটি ঐতিহাসিক মূল্য আছে। কেরী প্রকৃতপক্ষে এই বই দুইখানির রচয়িতা কিনা, সে-সম্বন্ধে বিতর্ক আছে। কেরীর নিজস্ব রচনা ‘ধর্মপুস্ত ক’-এর (কেরীর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ সংস্করণ ১৮৩২-৩৩) ভাষা এই দুইটি বইয়ের ভাষার তুলনায় অনেক পঙ্গু ও আড়ষ্ট। কথোপকথন’-এর অন্তত কতকাংশ যে কেরীর লেখনীনিঃসৃত নহে, তাহাতে কোন সন্দেহই নাই; কারণ কেরী এই বইয়ের ভূমিকায় লিখিয়াছেন যে ইহার গার্হস্থ্য বিষয় সংক্রান্ত সংলাপগুলি তিনি বিজ্ঞ বাঙালীদের (“sensible natives”) দিয়া লিখাইয়াছিলেন। কেরী সম্ভবত এই দুটি গ্রন্থের সংকলন ও সম্পাদনা মাত্র করিয়াছিলেন; অবশ্য তাহা করিয়া থাকিলেও তাঁহার কৃতিত্ব কম নহে। এই দুইটি বইয়ের ভাষার নিদর্শন নীচে উদ্ধৃত হইল।

(১) গ্রাম্য অশিক্ষিত নারী মজুরের কথাবার্তার নমুনা–

“ফলনা কায়েতের বাড়ী মুই কায করিতে গিয়াছি তার বাড়ী অনেক কায আছে। তুই যাবি।

না ভাই। মুই সে বাড়ীতে কায করিতে যাব না তারা বড় ঠেটা। মুই আর বছর তার বাড়ী কায করিয়াছিলাম মোর দুদিনের কড়ি হারামজাদগি করিয়া দিলে মুই সে বেটার বাড়ী আর যাব না।”৭ (কথোপকথন)

(২) “সাধু স্বভাব এক ব্যক্তি পথে যাইতেছিলেন তথাতে এক সরোবরে কথগুলি লোক বড়িশীতে মাংসাদি অৰ্পণ করিয়া মৎস্য ধরিতেছে মৎস্য সকল আহারার্থ আসিয়া আপন ২ প্রাণ দিতেছে ঐ সাধু এইরূপ দেখিয়া নিকটস্থিত এক রাজসভাতে গিয়া কহিলেন অদ্য পুষ্করিণীর তটে আশ্চর্য দেখিলাম সভাস্থির ব্যক্তিরা কহিল কি তিনি কহিলেন দাতা ব্যক্তি নরকে যাইতেছে এবং গ্রহীতাও প্রাণত্যাগ করিতেছে…”৮ (ইতিহাস মালা)

হেনরি সারজ্যাণ্ট নামে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের একজন ছাত্র শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের বিষয়বস্তু অবলম্বনে বাংলা গদ্যে শ্রীমদ্ভাগবত’ নামে একটি ছোট বই লিখিয়াছিলেন। বইটি মুদ্রিত হয় নাই, ইহার পাণ্ডুলিপি বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত আছে। ইহার ভাষা অনেক স্থানে বেশ সরল, কিন্তু স্থানে স্থানে বিদেশীয়ানা উল্কটভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। দৃষ্টান্ত :

“ঈশ্বরের অত্যন্তাবির্ভাব দ্বারা তেজম্পুঞ্জা এবং উজ্জ্বলকারীরা”, “ঈশ্বরীয়াষ্টহস্ত–প্রকাশিত আশ্চর্য্য সন্তান।”

বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ হইতে প্রকাশিত প্রথমযুগের পূর্বোক্ত গ্রন্থগুলির একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। এই গ্রন্থগুলির মধ্যদিয়া অল্প কয়েক বৎসরের মধ্যেই বাংলা গদ্যের অনেকখানি অগ্রগতি সাধিক হইয়াছিল। কালক্রমে বহু লেখকের বহু আয়াসে ও সাধনায় বাংলা গদ্যের যে রমণীয় মূর্তি গড়িয়া উঠিয়াছিল, এই গ্রন্থগুলিকে তাহার কাঠামো বলা যাইতে পারে।

বাংলা গদ্যের সহিত ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের আরও একটু সম্পর্ক আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪১-৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সেরেস্তাদার বা প্রথম পণ্ডিত এবং ১৮৪৭-৫০ খ্রীষ্টাব্দে ঐ কলেজের প্রধান কেরানী ও খাজাঞ্চির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিদ্যাসাগরের প্রথম দুইটি গ্রন্থ বাসুদেব চরিত’ ও ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যপুস্তক হিসাবেই রচিত হইয়াছিল। প্রথমটি মুদ্রিত না হইলেও দ্বিতীয়টি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ হইতে প্রকাশিত হইয়া (১৮৪৭ খ্র.) বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে যুগান্তর আনয়ন করে। বিদ্যাসাগরের ‘বেতাল-পঞ্চবিংশতি’ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ হইতেই প্রকাশিত হিন্দী গ্রন্থ ‘বেতাল-পচিসী’ (১৮০৫ খ্রী.) অবলম্বনে রচিত।

(ঘ) রামমোহন রায়

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতগণ কর্তৃক বাংলা গদ্যসাহিত্যের সৃষ্টি হওয়ার কয়েক বৎসর পরেই মনস্বী রামমোহন রায় (১৭৭২ (?)-১৮৩৩) বাংলা গদ্যসাহিত্যে গুরুগম্ভীর বিষয় আলোচনা দ্বারা ইহার মর্যাদা ও পরিসর বৃদ্ধি করেন। তাঁহার প্রথম দুই পুস্তক বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘বেদান্তসার’ ১৮১৫, তলবকার উপনিষৎ (কেনোপনিষৎ) ও ঈশোপনিষৎ ১৮১৬, মুণ্ডকোপনিষৎ ১৮১৯, উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার ১৮১৬-১৭, ভট্টাচার্যের সহিত বিচার ১৮১৭, সহমরণ বিষয়ে তিনখানি গ্রন্থ ১৮১৮, ১৮১৯, ১৮২৯, পথ্যপ্রদান ১৮২৩, বজ্ৰসূচী ১৮২৭ ও গৌড়ীয় ব্যাকরণ ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ইহা ছাড়াও তিনি আরও অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেন। রামমোহনের ভাষার দুইটি নমুনা দিতেছি।

(১) “এস্থানে এক আশ্চর্য এই যে অতি অল্প দিনের নিমিত্ত আর অতি অল্প উপকারে যে সামগ্রী আইসে তাহার গ্রহণ অথবা ক্রয় করিবার সময় যথেষ্ট বিবেচনা সকলে করিয়া থাকেন আর পরমার্থবিষয় যাহা সকল হইতে অত্যন্ত উপকারি আর অতি মূল্য হয় তাহার গ্রহণ করিবার সময় কি শাস্ত্রের দ্বারা কি যুক্তির দ্বারা বিবেচনা করেন না আপনার বংশের পরম্পরা মতে আর কেহ ২ আপনার চিত্তের যেমন প্রশস্ত্য হয় সেইরূপ গ্রহণ করেন এবং প্রায় কহিয়া থাকেন। যে বিশ্বাস থাকিলে অবশ্য উত্তম ফল পাইব।”৯

(২) “দেখ কি পর্যন্ত দুঃখ, অপমান, তিরস্কার, যাতনা, তাহারা কেবল ধৰ্ম্মর্ভয়ে সহিষ্ণুতা করে, অনেক কুলীন ব্রাহ্মণ যাহারা দশ পোনর বিবাহ অর্থের নিমিত্ত করেন, তাহারদের প্রায় বিবাহের পর অনেকের সহিত সাক্ষাৎ হয় না, অথবা যাবজ্জীবনের মধ্যে কাহারো সহিত দুই চারিবার সাক্ষাৎ করেন….।”১০।

বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে রামমোহনের স্থান যে অতি উচ্চে সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তিনি যে বাংলা গদ্যসাহিত্যের স্রষ্টা, বহুকাল অবধি এই মত প্রচলিত থাকিলেও ইহা যুক্তিযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করা কঠিন। কারণ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতগণ তাঁহার প্রথম রচনা প্রকাশিত হইবার পূর্বেই যে সমুদয় গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন তাহার সাবলীল ও সহজ রচনারীতি সাহিত্যের বাহন হিসাবে রামমোহনের রচনারীতি অপেক্ষা নিকৃষ্ট বলিয়া মনে করিবার কোন কারণ নাই। শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন লিখিয়াছেন, এখনকার দিনে ছেদচিহ্ন বিরল রামমোহনের বাক্যাবলী উদ্ভট ঠেকিতে পারে, কিন্তু সে সময়ের কলেজি রচনার সঙ্গে মিশাইয়া দেখিলে বুঝা যাইবে কেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মত প্রাচীনতার ভক্তও বলিয়াছিলেন, “দেওয়ানজী জলের মত বাংলা লিখিতেন”।১১

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতগণের রচনার যে নমুনা উপরে উদ্ধৃত হইয়াছে তাহার সহিত রামমোহনের ভাষার তুলনা করিলে এই উক্তি কোন মতেই সমর্থন করা যায় না।

সুকুমারবাবু আরও বলিয়াছেন যে “বিচার-বিশ্লেষণে উচ্চতর চিন্তার বাহন হিসাবে প্রথম ব্যবহারে লাগইয়া (রামমোহন) বাংলা গদ্যকে জাতে তুলিলেন।” কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারও ‘বেদান্ত চন্দ্রিকা’, ও ‘প্রবোধ চন্দ্রিকা’ নামক দুই গ্রন্থে বিচার-বিশ্লেষণে উচ্চতর চিন্তার বাহন হিসাবে বাংলাভাষারই ব্যবহার করিয়াছেন। বেদান্ত চন্দ্রিকা’ ১৮১৭ ও ‘প্রবোধ চন্দ্রিকা ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত। অবশ্য এই দুই গ্রন্থের ভাষা ১৬ বৎসর পূর্বে রচিত গ্রন্থের মত সরল নহে, সংস্কৃতবহুল; কিন্তু রামমোহনের শাস্ত্ৰবিচারের ভাষা হইতে খুব নিকৃষ্ট মনে হয় না। দুয়ের ভাষার তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যাইবে।

১। রামমোহনের ভাষা

“কেহ কেহ কহেন ব্রহ্মপ্রাপ্তি যেমন রাজ প্রাপ্তি হয়। সেই রাজ প্রাপ্তি তাহার দ্বারীর উপাসনা ব্যতিরেকে হইতে পারে না সেইরূপ রূপগুণ বিশিষ্টের উপাসনা বিনা ব্ৰহ্মপ্রাপ্তি হইবেক না।…ব্রহ্ম সৰ্ব্বব্যাপী আর যাঁহাকে তাহার দ্বারী কহ তেহো মনের অথবা হস্তের কৃত্রিম হয়েন কখন তাহার স্থিতি হয় কখন স্থিতি না হয় কখন নিকষ্টস্থ কখন দূরস্থ অতএব কিরূপে এমত বস্তুকে অন্তর্যামী সৰ্ব্বব্যাপী পরমাত্মা হইতে নিকটস্থ স্বীকার করিয়া ব্ৰহ্মপ্রাপ্তির সাধন কহা যায়।” (বেদান্ত গ্রন্থ-বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, পৃ. ১৭৫৪-৫৫)।

২। মৃত্যুঞ্জয়ের ভাষা

“আর যদি মন্দির মসজিদ গীর্জা প্রভৃতি যে কোন স্থানে যে কোন বিহিত ক্রিয়া দ্বারা শূন্য স্থানে ঈশ্বর উপাস্য হন তবে কি সুঘটিত স্বর্ণমৃত্তিকা পাষাণ কাষ্ঠাদিতে ঐ ঈশ্বরের উপাসনা করাতে ঈশ্বরের অসম্মান করা হয় কিম্বা দৃষ্টি কৌরূপ্য হয়…কিংবা সৰ্ব্বত্রগ সৰ্ব্বজ্ঞ পরমেশ্বর অন্যত্র প্রতিমাদিতে পূজাস্তবাদি যাহা যাহা হয় তাহা দেখিতে পান না ও শুনিতে পান না।” (বেদান্ত চন্দ্রিকা, ২০৭ পৃ.)।

শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন রামমোহনের দাবির স্বপক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মন্তব্য উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু গুপ্ত কবির সমসাময়িক দেওয়ান রামকমল সেন মহাশয় ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত A Dictionary in English and Bengalee গ্রন্থে স্পষ্ট স্বীকার করিয়াছেন যে বাংলা গদ্যসাহিত্য সৃষ্টির কৃতিত্ব কেরী সাহেব ও তাঁহার সহযোগীদেরই প্রাপ্য।১২ বর্তমান যুগে ডক্টর সুশীলকুমার দে ঠিক ঐ কথাই বলিয়াছেন।১৩

‘রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের জনক’, এই মত যখন প্রচলিত হয়, তখন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতদের গ্রন্থগুলি খুব সুপরিচিত ছিল না। এই সমুদয়ের উল্লেখ করিয়া ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়াছেন : “বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপনে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতবৃন্দের দান অপরিসীম। তাঁহারা সকলেই রামমোহনের পূর্ধ্বগামী।”১৪

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হইতে প্রকাশিত প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ রামমোহন সংশোধন করিয়াছিলেন–এই কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করিয়া ডক্টর মনোমোহন ঘোষ বাংলা গদ্যের জনকত্বের গৌরব রামমোহনকে দিতে চাহেন।১৫ কিন্তু ঐ কিংবদন্তী অলীক বলিয়া মনে হয়। তাহা ছাড়া অন্যের রচনা সংশোধন করাকে যদি বাংলা গদ্যের জনক-পদবাচ্য হইবার যোগ্যতা বলিয়া গণ্য করা যায়, তাহা হইলে রামরাম বসুই বাংলা গদ্যের জনক, কারণ ইহার পূর্বেই তিনি টমাসের বাংলা গদ্য-রচনার ভাষা সংশোধন করিয়াছিলেন।

নিরপেক্ষভাবে বিচার করিলে একথা স্বীকার করা কঠিন যে, রামমোহন রায়ই বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক। তিনি বাংলা দেশে ইংরেজীশিক্ষার প্রবর্তন করেন বা হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলেন, ইত্যাদি দাবি বহুল প্রচারসত্ত্বেও ভ্রান্ত বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনকত্বও অনুরূপ ভ্রান্ত ধারণা। যে-কোন মহৎ ব্যক্তির মুগ্ধ ভক্তগণের স্বভাব এই, যাহা কিছু ভাল নূতন সেগুলির সব কৃতিত্বই ঐ একজনকে দিবার আগ্রহ হয়। বর্তমান ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়াছে।

কিন্তু রামমোহন রায় বাংলা গদ্যসাহিত্যের স্রষ্টা নহেন ইহাও যে-পরিমাণ সত্য, ইহার উন্নতিসাধনে তাহার দান যে অপরিসীম তাহাও তেমনি সত্য। তিনি প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্র-গ্রন্থ এবং তর্ক ও বিচারমূলক গ্রন্থ বহুসংখ্যায় রচনা করিয়া বাংলা-সাহিত্যে ভাবের গভীরতা ও ভাষার শব্দসম্পদ অনেক বৃদ্ধি করিয়াছেন। বাক্যবিন্যাস রীতিসম্বন্ধেও যথেষ্ট নৈপুণ্য দেখাইয়া বাংলাভাষাকে সতেজ ও পুষ্ট করিয়াছেন।

রামমোহন কবিও ছিলেন। তাঁহার লেখা অনেকগুলি পরমার্থবিষয়ক গান ব্রহ্মসঙ্গীত (১৮২৮) নামক গ্রন্থে সঙ্কলিত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে। বাংলা পদ্যে শ্রীমদ্ভগবদগীতার অনুবাদও তিনি করিয়াছিলেন। এই অনুবাদ এখন আর পাওয়া যায় না।

পূর্বোক্ত গ্রন্থগুলি ছাড়া এই সময় হইতে বাংলা সাময়িকপত্রও গদ্যসাহিত্যের পুষ্টির যথেষ্ট বিশেষ সহায়তা করে। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে মাসিক ‘দিগদর্শন’ এবং ‘সাপ্তাহিক বাঙ্গাল গেজেটি’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়। ইহার মধ্যে একমাত্র সমাচার দর্পণ’ দীর্ঘকাল স্থায়ী হইয়াছিল। ১৮২১ সনে ব্রাহ্মণ সেবধি’ ও ‘সস্বাদ কৌমুদী’ প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায় এই দুইটি পত্রিকার সহিতই বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বাদ কৌমুদীর অন্যতম প্রকাশক হইলেও ইহাতে সহমরণ-প্রথার সমর্থন থাকায় ইহার সংশ্রব ত্যাগ করিয়া ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ নামে সনাতনপন্থী নূতন একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করেন (১৮২২ খ্রী.)। ইহার পর বাংলাভাষায় লিখিত বহু সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাগুলি গদ্যসাহিত্যের প্রসারে ও উন্নতিতে যে কতদূর সাহায্য করিয়াছিল এবং ইহাদের প্রচারের ফলে বাংলা গদ্যভাষা ও সাহিত্য যে কিরূপ দ্রুত উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছিল, তাহার সবিস্তার পরিচয় দেওয়া এখানে সম্ভব নহে। এই গ্রন্থের অন্যত্র বাংলা সাময়িক-পত্ৰসম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি এবং এই গ্রন্থে সাময়িক-পত্রগুলি হইতে যে বহুসংখ্যক উদ্ধৃতি আছে তাহা হইতেই ইহাদের গদ্যভাষার রীতি-সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যাইবে। নিছক সাহিত্যের দিক দিয়া বিবেচনা করিলে ১২৫০ বাংলা সনে প্রকাশিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র অবদান খুবই মূল্যবান। ইহার সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত এবং ইহার নিয়মিত লেখকবৃন্দের মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকগণ। ইঁহারা ছাড়াও অন্যান্য আরও কয়েকজন সংবাদপত্রের লেখকগণের রচনায় পরিপুষ্ট হইয়া বাংলা সাহিত্যের, বিশেষতঃ বাংলাভাষার যে অপরূপ শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

(ঙ) রামমোহনের পরবর্তী কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক

পূর্বোক্ত বাংলা গদ্যগ্রন্থগুলির পরে আরও কয়েকখানি গ্রন্থ নূতন গদ্যরীতিতে লিখিত হয়। ইহাদের মধ্যে পূর্বোক্ত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনখানি গ্রন্থ-নববাবু বিলাস’ (১৮২৩ খ্রী.), কলিকাতা কমলালয়’ (১৮২৩ খ্রী.) ও ‘নববিবিবিলাস’ (১৮৩১ খ্রী.)১৬ গদ্যসাহিত্যে তাহার লিপিকুশলতার পরিচয় দেয়। যে কথ্যভাষার প্রবর্তক হিসাবে “আলালের ঘরের দুলাল” প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে, এই তিনখানি গ্রন্থেই তাহার পূর্বপরিচয় পাওয়া যায়।

‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক ও প্রধান লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০ ১৮৮৬) বহু গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। তাহাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘ভূগোল’ (১৮৪১), বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ দুই খণ্ডে (১৮৫২, ১৮৫৩), চারুপাঠ’- তিন খণ্ড (১৮৫২, ১৮৫৪, ১৮৫৯), ‘ধর্মনীতি’ (১৮৫৬), পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৬) এবং ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, দুই খণ্ড (১৮৭০, ১৮৮৩)। অক্ষয়কুমারের গদ্যরীতি সহজ, পরিমিত এবং প্রকাশক্ষম, তবে তাহার মধ্যে স্বচ্ছন্দতা ও সাবলীলতার কিছু অভাব দেখা যায়। তাঁহার সমস্ত রচনাই জ্ঞানপ্রচারের উদ্দেশ্যে লিখিত; ইহাদের অধিকাংশই ইংরেজ লেখকদের গ্রন্থ বা প্রবন্ধ অবলম্বনে রচিত। চারুপাঠ’-এর কয়েকটি প্রবন্ধে বিশেষভাবে ‘স্বপ্নদর্শন’-শীর্ষক তিনটি রূপক রচনার মধ্যে, সাহিত্যরসের কিছু আস্বাদ পাওয়া যায়।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫ খ্রী.) ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যা করিয়া অনেকগুলি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন ও বক্তৃতা দিয়াছিলেন। সেগুলি প্রথমে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ও পরে ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান’ (১৮৬১) প্রভৃতি গ্রন্থে সংকলিত হয়। দেবেন্দ্রনাথের ভাষা অত্যন্ত সরল, উপরন্তু তাহাতে সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ ও গভীর অধ্যাত্ম-অনুভূতির পরিচয় প্রস্ফুটিত হইয়াছে। দেবেন্দ্রনাথের বৃদ্ধবয়সে রচিত ‘আত্মজীবনী’ (১৮৯৮) অত্যন্ত উপাদেয় সৃষ্টি–একাধারে তথ্যপূর্ণ ও সাহিত্য রসাপুত রচনা।

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫ খ্রী.) প্রধানত খ্রীষ্টধর্মপ্রচারক হিসাবে বিখ্যাত হইলেও বাংলা গদ্যের রচয়িতা হিসাবে তাঁহার দান অল্প নহে। ‘ষড়দর্শন-সংবাদ’ (১৮৬৭ খ্র.) এবং তের খণ্ডে বিভক্ত প্রথম বাংলা এনসাইক্লোপিডিয়া বিদ্যাকল্পদ্রুম’ (১৮৪৬-১৮৫১ খ্রী.) তাঁহার পাণ্ডিত্য ও রচনাশৈলীর নিদর্শন বহন করিতেছে। কৃষ্ণমোহনের গদ্যরীতি সহজ, তবে তাহার মধ্যে প্রসাদগুণের অভাব আছে।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮ খ্রী.) ‘শিশুশিক্ষা’ নামে তিন খণ্ডে যে ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে প্রাঞ্জল ও উৎকৃষ্ট গদ্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। মদনমোহন রসতরঙ্গিণী’ (১৮৩৪) ও বাসদত্তা’ (১৮৩৬) নামে দুইটি কবিতাপুস্তকও রচনা করিয়াছিলেন।

পূর্বোক্ত লেখকদের গ্রন্থরচনার ফলে সহজ বাংলা গদ্যের প্রচলন হয়। কিন্তু এইসঙ্গে সংস্কৃতশব্দবহুল পণ্ডিতী ভাষাও বাংলাসাহিত্যে প্রাধান্য লাভ করে। এই শ্রেণির লেখক তারাশঙ্কর তর্করত্নের রচনার নমুনা দিতেছি :

“পয়ঃপান দ্বারা পিপাসা শান্তি হইলে যে প্রকার আনন্দ হয় চির বিযুক্ত মিলন দ্বারা যেরূপ হৃদয়ে সুখ ধারা বর্ষণ করে নিবিড় ঘনঘটায় ঘোরতর অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনীতে রাজমার্গে আলোক অবলোকন করিয়া যেরূপ চিত্ত হর্ষে পুলকিত হয় তদ্রূপ বিদ্যামৃত অজ্ঞান তৃষ্ণা নষ্ট করিয়া হৃদয়কে হৃষ্ট ও প্রফুল্ল করে।”১৬ক

তারাশঙ্কর তিনটি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন-’ভারতবর্ষীয় স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষা’, কাদম্বরী’ ও ‘রাসেলাস’। ইহাদের মধ্যে শেষোক্ত দুইটি বই অনুবাদ-গ্রন্থ। তারাশঙ্করের ভাষায় সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য থাকিলেও তাহাতে প্রসাদ-গুণের অভাব নাই, বরং শিল্পগুণেরও নিদর্শন পাওয়া যায়।

(চ) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)

ইহাদের পরে আসিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁহার ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭ খ্রী.), শকুন্তলা (১৮৫৪ খ্রী.), কথামালা’ ও ‘চরিতাবলী’ (১৮৫৬ খ্র.) এবং সীতার বনবাস’ (১৮৬০ খ্রী.) পর পর প্রকাশিত হয়। এই কয়খানি ছাড়াও তাঁহার রচিত অন্যান্য বহু গ্রন্থ বাংলা গদ্যসাহিত্যে যুগান্তর আনয়ন করিল। এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করিলেই যথেষ্ট হইবে : “বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূৰ্ব্বে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সৰ্ব্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন। ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধার মাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন তেন প্রকারেণ কতকগুলা বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্য সমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্তদ্বারা বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্য সমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্তদ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে।”১৭।

বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য-একদিকে প্রচুর সংস্কৃত শব্দের সুষ্ঠু ব্যবহারের মধ্য দিয়া ধ্বনিগাম্ভীর্য সৃষ্টি, অপরদিকে বহুল-পরিমাণে ছেদচিহ্নের ব্যবহারের দ্বারা বাক্যের অংশগুলিকে শ্বাসপর্ব ও সার্থপর্ব অনুসারে সাজাইয়া ভাষাকে ছন্দোময় করিয়া ভোঁসলা। তাঁহার ভাষায় গাম্ভীর্য ও মাধুর্যের সমন্বয় সাধিত হইয়াছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলাভাষার কী পরিবর্তন ঘটিয়াছিল পূর্বোদ্ধৃত বাংলারচনার নমুনাগুলির সহিত বিদ্যাসাগর-কৃত নিম্নলিখিত কয়েক পংক্তির তুলনা করিলে তাহা সম্যক বুঝিতে পারা যাইবে।

“তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এক কালে নির্মূল হইয়া যায়।…হায় কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধৰ্ম্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদৃসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধৰ্ম্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে।”১৮

বিদ্যাসাগরের যে-সমস্ত গ্রন্থের উল্লেখ পূর্বে করিয়াছি, সেগুলির মূল-হিন্দী সংস্কৃত ও ইংরেজীতে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ। বিদ্যাসাগরের মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৩), দুই খণ্ড ‘বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫), দুই খণ্ড বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ (১৮৭১, ১৮৭৩) প্রভৃতি। প্রথমোক্ত গ্রন্থটিতে বিদ্যাসাগরের সাহিত্য-রসজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং ইহাই বাংলাভাষায় রচিত প্রথম সাহিত্য-ইতিহাস। বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহ সংক্রান্ত গ্রন্থগুলির ভাষা সরল ও স্বচ্ছন্দ, ইহাদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের প্রগাঢ় শাস্ত্রজ্ঞান ও নিপুণ বিচারশক্তির পরিচয় আছে। বিদ্যাসাগরের কয়েকটি বেনামী ব্যঙ্গ রচনায় এবং তাঁহার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত প্রভাবতীসম্ভাষণ’ নামক ক্ষুদ্র শোক-নিবন্ধে ও তাঁহার অসম্পূর্ণ আত্মচরিতে উপভোগ্য সাহিত্য-রসের নিদর্শন পাওয়া যায়।

(ছ) প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহ

বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক দুইজন লেখক সংস্কৃতমূলক সাধুভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত-শব্দবিরল লৌকিক ভাষায় সাহিত্য রচনা করিয়াছিলেন। “টেকচাঁদ ঠাকুর” ছদ্মনামধারী প্যারীচাঁদ মিত্রের (১৮১৪-১৮৮৩ খ্রী.) উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮ খ্র.) এবং “হুতোম” ছদ্মনামধারী কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০ ১৮৭০ খ্রী.) প্রণীত কলিকাতা সমাজের ব্যঙ্গচিত্র ‘হুতোম প্যাচার নকশা” (১৮৬২ খ্র.) এই ভাষায় রচিত। শেষোক্ত গ্রন্থটি সম্পূর্ণভাবে কথ্যভাষায় লেখা। হুতোম পাচার নক্শা হইতে ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে বিদ্রুপাত্মক একটি অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি–

“পাঠকগণ! এই যে উর্দি ও তকমা-ওয়ালা বিদ্যালঙ্কার, ন্যায়ালঙ্কার, বিদ্যাভূষণ ও বিদ্যাবাচস্পতিদের দেখছেন, এরা বড় ফ্যালা যান না, এঁরা পয়সা পেলে না করেন হেন কৰ্ম্মই নাই। পয়সা দিলে বানরওয়ালা নিজ বানরকে নাচায়, পোষাক পরায়, ছাগলের উপর দাঁড় করায়; কিন্তু এঁরা পয়সা পেলে নিজে বানর পৰ্য্যন্ত সেজে নাচেন। যত ভয়ানক দুষ্কৰ্ম্ম এই দলের ভেতর থেকে বেরোবে, দায়মালী জেল তন্ন কল্লেও তত পাবেন না।”১৯

কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহ ব্রাহ্মণপণ্ডিতদের দ্বারা মহাভারতের অনুবাদ সাধুভাষায় করান এবং বিনামূল্যে বিতরণ করেন। ইহাতে প্রায় লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। তাঁহার মৃত্যুর পর ‘সোমপ্রকাশ’ মত প্রকাশ করে যে তাঁহার “হুতোম প্যাচা” ও “মহাভারত” তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিবে।”১৯ক

প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাষার নমুনা :

“রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে-কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে, বলদেরা গরু লইয়া চলিয়াছে–ধোবার গাধা ধপাস ধপাস করিয়া যাইতেছে–মাছের ও তরকারির বাজরা হুহু করিয়া আসিতেছে–ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন–মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্তা কহিতেছে। কেহ বলিতেছে পাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল–কেহ বলে আমার শাশুড়ী মাগি বড় বৌকাটকি-কেহ বলে দিদি আমার আর বাঁচতে সাধ নাই–বৌছুঁড়ি আমাকে দু পা দিয়ে থেতলায়-বেটা কিছুই বলে না; ছোঁড়াকে গুণ করে ভেড়া বানিয়েছে–কেহ বলে আহা এমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম দিবারাত্রি আমার বুকে বসে ভাত রাঁধে, কেহ বলে আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল–কবে মরি কবে বাঁচি এইবেলা তার বিএটি দিয়েনি।”২০

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্যারীচাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। তাঁহার সুদীর্ঘ উক্তি হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :

“বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান অতি উচ্চ। তিনি বাঙ্গালা সাহিত্যে এবং বাঙ্গালা গদ্যের একজন প্রধান সংস্কারক।”

পূর্বোক্ত পণ্ডিতী ভাষার উল্লেখ করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করেন : “এই সংস্কৃতানুসারিণী ভাষা প্রথম মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের হাতে কিছু সংস্কার প্রাপ্ত হইল। ইহাদিগের ভাষা সংস্কৃতানুসারিণী হইলেও তত দুৰ্ব্বোধ্যা নহে। বিশেষতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূৰ্ব্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারে নাই, এবং তাহার পরেও কেহ পারে নাই। কিন্তু প্রাচীন প্রথায় আবদ্ধ এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষার মনোহারিতায় বিমুগ্ধ হইয়া কেহই আর কোন প্রকার ভাষায় রচনা করিতে ইচ্ছুক বা সাহসী হইত না। কাজেই বাঙ্গালা সাহিত্য পূৰ্ব্বমত সঙ্কীর্ণ পথেই চলিল।

“ইহা অপেক্ষা বাঙ্গালা ভাষায় আরও একটি গুরুতর বিপদ ঘটিয়াছিল। সাহিত্যের ভাষাও যেমন সঙ্কীর্ণ পথে চলিতেছিল–সাহিত্যের বিষয়ও ততোধিক সঙ্কীর্ণ পথে চলিতেছিল। যেমন ভাষাও সংস্কৃতের ছায়া মাত্র ছিল, সাহিত্যের বিষয়ও তেমনই সংস্কৃতের এবং কদাচিৎ ইংরাজির ছায়ামাত্র ছিল। সংস্কৃত বা ইংরাজিগ্রন্থের সার সঙ্কলন বা অনুবাদ ভিন্ন বাঙ্গালা সাহিত্য আর কিছুই প্রসব করিত না। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রতিভাশালী লেখক ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাঁহারও শকুন্তলা ও সীতার বনবাস সংস্কৃত হইতে, ভ্রান্তিবিলাস ইংরাজি হইতে এবং বেতালপঞ্চবিংশতি হিন্দি হইতে সংগৃহীত। অক্ষয়কুমার দত্তের ইংরাজি একমাত্র অবলম্বন ছিল। আর সকলে তাঁহাদের অনুকারী এবং অনুবৰ্ত্তী। বাঙ্গালী লেখকেরা গতানুগতিকের বাহিরে হস্ত প্রসারণ করিতেন না। জগতের অনন্ত ভাণ্ডার আপনাদের অধিকারে আনিবার চেষ্টা না করিয়া সকলেই ইংরাজি ও সংস্কৃতের ভাণ্ডারে চুরির সন্ধানে বেড়াইতেন। সাহিত্যের পক্ষে ইহার অপেক্ষা গুরুতর বিপদ আর কিছুই নাই।…

“এই দুইটি গুরুতর বিপদ হইতে প্যারীচাঁদ মিত্রই বাঙ্গালা সাহিত্যকে উদ্ধৃত করেন। যে ভাষা সকল বাঙ্গালীর বোধগম্য এবং সকল বাঙ্গালী কর্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থে প্রণয়নে ব্যবহার করিলেন। এবং তিনিই প্রথম ইংরাজি ও সংস্কৃতের ভাণ্ডারে পূর্ধ্বগামী লেখকদিগের উচ্ছিষ্টাবশেষের অনুসন্ধান না করিয়া, স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার হইতে আপনার রচনার উপাদান সংগ্রহ করিলেন। এক “আলালের ঘরের দুলাল” নামক গ্রন্থে এই উভয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল…”আলালের ঘরের দুলালের” দ্বারা বাঙ্গালা সাহিত্যের যে উপকার হইয়াছে আর কোন বাঙ্গালা গ্রন্থের দ্বারা সেরূপ হয় নাই এবং ভবিষ্যতে হইবে কিনা সন্দেহ।”২১

২. গদ্যসাহিত্যের দ্বিতীয় পর্ব

(ক) উপন্যাসের আরম্ভ উনিশ শতকে বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রধান ঘটনা ইংরেজি রোমান্টিক নভেলের প্রভাবে উপন্যাস-রচনা।

বাংলা গদ্যে লিখিত এই শ্রেণীর উপন্যাস রচনার প্রথম ক্ষীণ প্রচেষ্টার ফল ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীমতী হানা ক্যাথেরীণ মলেন্স্ রচিত “ফুলমণি ও করুণার বিবরণ”।২২ খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষিত কয়েকটি বাঙ্গালীর জীবনকাহিনী ইহার বিষয়বস্তু। কিন্তু সাহিত্য হিসাবে ইহার মূল্য খুব বেশী নহে।

ইহার পরবর্তী উপন্যাস ১৮৫৮ সনে রচিত আলালের ঘরের দুলাল’। গ্রন্থকর্তা প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-৮৩) “টেকচাঁদ ঠাকুর” এই ছদ্মনামে ইহা প্রকাশিত করেন। ইহা প্রায় কথ্যভাষাতেই লিখিত, তবে ইহার ক্রিয়াপদগুলি সাধুভাষার। শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন যথার্থই বলিয়াছেন, “মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন নবীন কবিতার জন্মদাতা প্যারীচাঁদ মিত্র তেমনি গল্প উপন্যাসের পথকর্তা”। ঠাকুরমার ঝুলি’তে সংগৃহীত বালক-বালিকার শ্রবণপ্রিয় উপকথা, এবং বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘আরব্য উপন্যাস প্রভৃতির বাহিরেও যে উচ্চশ্রেণীর চিত্তাকর্ষক গল্প থাকিতে পারে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখিয়া প্যারীচাঁদ তাহাই প্রমাণিত করিলেন। এই গ্রন্থে সেকালের কলিকাতা শহরের মধ্যবিত্তশ্রেণীর একটি বাস্তব ছবি পাওয়া যায়। কাহিনীর দিক দিয়া নববাবুবিলাস’-এর সহিত ইহার মিল আছে। সার্থকনামা ঠকচাচা চরিত্রটিই এই উপন্যাসের প্রাণস্বরূপ। এই গ্রন্থখানিকে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস বলা চলে না।২৩ কিন্তু ইহার মূল্য ও বিশেষত্ব কী, পূর্বোক্তৃত বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তি হইতেই তাহা বুঝা যাইবে। প্যারীচাঁদ ‘অভেদী’ (১৮৭১) নামে একখানি আধ্যাত্মিক উপন্যাস এবং নারীকল্যাণের জন্য ‘আধ্যত্মিকা’ (১৮৮০) নামে আর একটি উপন্যাস লেখেন। প্যারীচাঁদের অন্যান্য গ্রন্থ : মদ খাওয়া বড় দায় জাত রাখার কি উপায়’ (১৮৫৯), ‘রামারঞ্জিকা’ (১৮৬০) ও যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫)।

এই সময়ে আরও কয়েকখানি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তন্মধ্যে ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৫-১৮৯৪) প্রণীত ‘সফল স্বপ্ন’ ও ‘অঙ্গুরীয়-বিনিময়’ নামক কাহিনীদ্বয়-সংবলিত ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস গ্রন্থ (১৮৬২) এবং কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের রূপক-আখ্যায়িকা ‘বিচিত্রবীর্য’ (১৮৬২) ও ‘দুরাকাক্ষের বৃথা ভ্রমণ (১৮৫৭), গোপীমোহন ঘোষের ‘বিজয়-বল্লভ’ (১৮৬৩) প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। কয়েকখানি ইংরেজী উপন্যাসের অনুবাদও এই সময়ের প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী’, উপন্যাসের যে নূতন ধারা প্রবর্তন করে, উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত তাহা অব্যাহত ছিল। আজিও তাহার গৌরব ম্লান হয় নাই।

(খ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তিনি কলিকাতার নিকটবর্তী (নৈহাটির সংলগ্ন) কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং নবপ্রতিষ্ঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে বি. এ. পরীক্ষা পাস করিয়া ঐ বৎসরই ডেপুটি-ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম গ্রন্থ ললিতা। পুরাতাত্ত্বিক গল্প। তথা মানস।’–১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি কবিতার গ্রন্থ। ইহার অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলি অপরিণত। বঙ্গসাহিত্য-লেখকগণকে উৎসাহ দিবার জন্য কলিকাতার এক সভা প্রতিবৎসর বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য একটি পুরস্কার দিতেন। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়িবার সময় বঙ্কিমচন্দ্র ঐ পুরস্কার লাভের জন্য একখানি উপন্যাস রচনা করেন, কিন্তু উপন্যাসটি পুরস্কারের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয় নাই।২৪ কিশোরচাঁদ মিত্র সম্পাদিত Indian Field নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় Rajmohan’s Wife নামে বঙ্কিমচন্দ্রের একখানি ইংরেজী উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটিতে বিশেষ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না। বঙ্কিমচন্দ্র পরে উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষ করিতে পারেন নাই।

১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র রচনা আরম্ভ হয়। উপন্যাসটি লিখিয়া বঙ্কিমচন্দ্র তাহার দুই জ্যেষ্ঠভ্রাতা শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্রকে ইহা পড়িতে দেন। তাঁহারা এই গ্রন্থ প্রকাশের অযোগ্য বিবেচনা করেন। কিন্তু গ্রন্থখানি প্রকাশিত হইবামাত্র (১৮৬৫) ইহা বাঙ্গালী পাঠকের চিত্ত আকর্ষণ করিল এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের মর্যাদা দিল। প্রসিদ্ধ লেখক রমেশচন্দ্র দত্ত যথার্থই লিখিয়াছেন, “যখন দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশিত হইল, তখন যেন বঙ্গীয় সাহিত্যাকাশে একটি নূতন যুগের আলোকের বিকাশ হইল।….বঙ্গবাসিগণ বুঝিল সাহিত্যে একটি নূতন যুগের আরম্ভ হইয়াছে। একটি নূতন ভাবের সৃষ্টি হইয়াছেনূতন চিন্তা ও নূতন কল্পনা বঙ্কিমচন্দ্রকে আশ্রয় করিয়া আবির্ভূত হইয়াছে।”২৫

বর্তমানকালের বিচারে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ অপরিণত উপন্যাস; ইহার মধ্যে বহু অস্বাভাবিক ঘটনার সমাবেশ ও সুলভ চমক সৃষ্টির নিদর্শন দেখা যায়, চরিত্রগুলিও সম্পূর্ণ জীবন্ত হয় নাই। কিন্তু ইহার পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলির সঙ্গে তুলনা করিলে ইহার বর্ণনার সরসতা ও রচনার শক্তিমত্তা উপলব্ধি করিয়া বিস্মিত হইতে হয়। বাংলা দেশে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দশকে মুঘল-পাঠান সংঘর্ষের পটভূমিকায় উপন্যাসটি রচিত। ইহার কাহিনীর অধিকাংশ এবং দুই-একটি ব্যতীত সমস্ত চরিত্রই কাল্পনিক।

পরবর্তী উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’য় (১৮৬৬) অপরিণত উপন্যাসের কোন চিহ্নই দেখা যায় না। ইহা বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ইহার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র অরণ্য-পালিতা কপালকুণ্ডলার জটিল রহস্যময় চরিত্র যেভাবে অঙ্কন করিয়াছেন, তাহা অপরিসীম নৈপুণ্যের পরিচায়ক। উপন্যাসটির রহস্যমণ্ডিত পরিবেশও খুব জীবন্তভাবে চিত্রিত হইয়াছে। কপালকুণ্ডলা’ আকবরের মৃত্যুর (১৬০৫) অব্যবহিত পরবর্তী কালের পটভূমিকায় রচিত হইয়াছে। ইহার ঐতিহাসিক অংশ খুবই নগণ্য।

বঙ্কিমচন্দ্রের তৃতীয় উপন্যাস ‘মৃণালিনী (১৮৬৯) কপালকুণ্ডলা’র মত উচ্চাঙ্গের রচনা নহে। ইহাতে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা যায়। এই উপন্যাসের কাহিনীর পটভূমি ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বখতিয়ার খিলজীর নবদ্বীপ-জয়। মৃণালিনী’র প্রধান অংশ–হেমচন্দ্র ও মৃণালিনীর প্রণয়কাহিনী নিতান্তই কৃত্রিম ও প্রাণহীন। তবে এই উপন্যাসে মনোরমার চরিত্রসৃষ্টিতে এবং পশুপতির বিশ্বাসঘাতকতার বর্ণনায় বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন।

ইহার পর বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সামাজিক উপন্যাস ‘বিষবৃক্ষ প্রকাশিত হয় (১৮৭৩)। ইহাও একখানি উৎকৃষ্ট উপন্যাস। ইহার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র যেমন চরিত্রসৃষ্টিতে দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন, তেমনি একাধিক কাহিনীকে একসূত্রে গ্রথিত করার ব্যাপারেও নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়াছেন। মানুষের আদিম রিপু বশীভূত

হইলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে যে অনর্থ সৃষ্ট হয়, তাহাই বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসে দেখাইয়াছেন। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নগেন্দ্র, সূর্যমুখী, কুন্দনন্দিনী ও হীরার করুণ ট্রাজেডি যেভাবে রূপায়িত হইয়াছে, তাহা এই উপন্যাসখানিকে উচ্চস্তরের শিল্পসৃষ্টির পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী উপন্যাস ‘ইন্দিরা’-তে একটি নারীর সাময়িক ভাগ্য বিপর্যয় ও তাহা হইতে উদ্ধারলাভের কাহিনী খুব লঘু এবং সরস ভঙ্গীতে বর্ণিত হইয়াছে। ইহার নারীচরিত্রগুলি, বিশেষত নায়িকা ইন্দিরার চরিত্র, খুবই জীবন্ত। ‘ইন্দিরা’ ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে সংক্ষিপ্ত আকারে এবং ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়।

‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫) বঙ্কিমচন্দ্রের আর-একখানি উৎকৃষ্ট উপন্যাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর সপ্তম দশকে বাংলার নবাব মীরকাশিমের সহিত ইংরেজদের সংঘর্ষের পটভূমিকায় এই উপন্যাসটি রচিত। ইহার প্রধান কাহিনী কাল্পনিক বলিয়া ইহাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যায় না। কিন্তু ইহার ঐতিহাসিক পরিবেশ খুবই জীবন্ত। নবাব মীরকাশিমের চরিত্র ইতিহাসসম্মত ও সজীব। এই উপন্যাসের ইংরেজ চরিত্রগুলির মধ্যেও বঙ্কিমচন্দ্র যুগোচিত বৈশিষ্ট্য ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। উপন্যাসের নায়িকা–বিবাহিতা কিন্তু বাল্যপ্রণয়ীর প্রতি আসক্তা শৈবলিনীর জটিল চরিত্র অত্যন্ত জীবন্ত হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। চন্দ্রশেখরে’র পরিবেশের রূপায়ণও খুব সুন্দর। তবে কেহ কেহ মনে করেন যে ইহার মধ্যে শৈবলিনী-চন্দ্রশেখর-প্রতাপের কাহিনীর সহিত মীরকাশিম-দলনীর কাহিনীর একত্র গ্রন্থন উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যিক শিল্পের আদর্শকে কিঞ্চিৎ পরিমাণে ক্ষুণ্ণ করিয়াছে।

রজনী’ (১৮৭৭) উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র এক অন্ধ পুস্পনারীর কাহিনী বর্ণনা করিয়াছেন। ইহাতে কাহিনীর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন চরিত্রের জবানীতে বর্ণিত হইয়াছে। ইহাকে প্রথম শ্রেণীর উপন্যাস বলা যায় না; কারণ ইহার কাহিনীতে অনেকাংশে অবাস্তবতা দেখা যায় এবং স্থানে স্থানে অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনার নিদর্শনও পাওয়া যায়। লবঙ্গলতা ও অমরনাথ ভিন্ন রজনী’র আর কোন চরিত্র জীবন্ত নহে। বঙ্কিমচন্দ্র রজনী’র কাহিনীর ক্ষেত্রে লর্ড লিটনের The Last days of Pompeii উপন্যাসের এবং আঙ্গিকের ক্ষেত্রে উইকি কলিন্‌সের The Woman in White-কে আর্দশস্বরূপ গ্রহণ করিয়াছেন।

পরবর্তী উপন্যাস ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ (১৮৭৮) বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিষবৃক্ষেরই মত অসংযত রিপুর বিষময় পরিণামের চিত্র অঙ্কন করিয়াছেন। রচনারীতি এবং কাহিনী-বর্ণনার অনায়াস, স্বচ্ছন্দ ও ক্ষিপ্রগতির দিক দিয়া উপন্যাসটি অতি উচ্চস্ত রের বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। তবে বর্তমান যুগের কোন কোন সাহিত্যিক ও সমালোচক মত প্রকাশ করিয়াছেন যে এই উপন্যাসে বর্ণিত রোহিণীর আকস্মিক হত্যাকাণ্ড শিল্পের দিক দিয়া সম্পূর্ণ সুষ্ঠু হয় নাই।

ইহার পর ‘রাজসিংহ’ উপন্যাস সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হয় (১৮৮২)। কয়েক বৎসর পরে বঙ্কিমচন্দ্র ইহাকে পরিবর্ধিত আকরে পুনঃপ্রকাশ করেন (১৮৯৩)। বঙ্কিমচন্দ্রের অনেক উপন্যাসে ঐতিহাসিক পটভূমিকা থাকিলেও একমাত্র রাজসিংহ’কেই তিনি “ঐতিহাসিক উপন্যাস” বলিয়াছেন। প্রধানত টডের রাজস্থান হইতে এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক উপকরণ সংগৃহীত হইয়াছে। অবশ্য আধুনিক ঐতিহাসিকদের বিচারে ঐসব উপকরণের অনেকগুলি অনৈতিহাসিক বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। রাজসিংহ ও চঞ্চলকুমারীর (ইতিহাসের ‘চারুমতী’) চরিত্র বঙ্কিমচন্দ্র তাহাদের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রখিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিয়াছেন। তবে এই উপন্যাসের ঔরঙ্গজেব ও জেবউন্নেসার চরিত্রে ইতিহাসের সহিত সম্পূর্ণ সঙ্গতি রক্ষিত হয় নাই। এই উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ অংশ জেবউন্নেসা ও মবারকের প্রেমকাহিনী। বাদশাহজাদী জেবউন্নেসার বিচিত্র প্রণয় ও তাহার করুণ পরিসমাপ্তি অপরূপ শিল্প-সুষমায় মণ্ডিত হইয়া রূপায়িত হইয়াছে। রাজসিংহ উপন্যাসের শেষে বঙ্কিমচন্দ্র রাজসিংহের নিকট ঔরঙ্গজেবের শোচনীয় পরাজয়ের যে বর্ণনা দিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণভাবে ইতিহাসসম্মত নহে।

বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ তিনখানি উপন্যাস–’আনন্দমঠ’ (১৮৮২), ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪) ও সীতারাম’ (১৮৮৭)-এ তাঁহার ঔপন্যাসিক জীবনের এক দিক্‌-পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই তিনটি উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র কেবল গল্পের খাতিরে গল্প লেখার নীতিকে ত্যাগ করিয়া গল্পের মধ্যদিয়া জনসাধারণকে নিষ্কাম কর্মযোগের আদের্শ উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। আনন্দমঠ’ ঐতিহাসিক সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত, কিন্তু ইহার অধিকাংশ ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। ইহার মধ্যে দেশোদ্ধারব্ৰতী সত্যানন্দ, ভবানন্দ, জীবানন্দ প্রভৃতি সন্তানদের কাহিনী বর্ণনার মধ্যদিয়া নিষ্কাম কর্মযোগের সার্থকতা ও ব্যর্থতা দুইই দেখানো হইয়াছে; এইসব চরিত্র আদর্শবাদের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত; মহেন্দ্র, কল্যাণী ও শান্তি অপেক্ষাকৃত বাস্তব। ‘আনন্দমঠ’ পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের বিপুল অনুপ্রেরণা যোগাইয়াছিল। বিখ্যাত “বন্দেমাতরম” আজ জাতীয় সঙ্গীত এবং ইহা এই উপন্যাসেরই অন্তর্ভুক্ত। দেবী চৌধুরাণী’তেও ঐতিহাসিক পটভূমিকা আছে, কিন্তু ইহার প্রায় সব চরিত্র ও ঘটনাই কাল্পনিক। এই উপন্যাসের নায়িকা প্রফুল্লকে লেখক নিষ্কাম কর্মযোগের আদর্শ সাধিকা হিসাবে উপস্থাপিত করিয়াছেন। কিন্তু প্রফুল্ল-চরিত্র বাস্তব ও জীবন্ত না-হওয়ার জন্য এই ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র সাফল্য অর্জন করিতে পারেন নাই। এই উপন্যাসের হরবল্লভ চরিত্রটি অত্যন্ত সজীব ও উজ্জ্বল। সীতারাম’-এ বঙ্কিমচন্দ্র নায়ক সীতারামের মধ্যদিয়া নিষ্কাম কর্মযোগ জীবনে গ্রহণ না-করার শোচনীয় পরিণাম দেখাইয়াছেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে পরিপূর্ণ সাফল্যলাভ সম্ভব হয় নাই, কারণ সীতারাম ও শ্রী-কাহারও চরিত্রই সম্পূর্ণ জীবন্ত হয় নাই। বরং এই উপন্যাসের ক্ষুদ্রতর চরিত্রগুলিরমা, নন্দা ও গঙ্গারাম বাস্তব ও প্রাণবন্ত। সীতারামের ঐতিহাসিক কাহিনীর খুব সামান্যই বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসে গ্রহণ করিয়াছেন, কল্পনার পরিমাণই ইহাতে বেশি!

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে যে-সকল নরনারী চিত্রিত হইয়াছে, কাহিনীর সৌন্দর্য নষ্ট না করিয়াও তাহাদের মধ্যদিয়া তিনি গার্হস্থ্যজীবনের, বিশেষতঃ নরনারীর প্রণয়ের ও মানসিক দ্বন্দ্বের যে ছবি আমাদের মনে গভীরভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন তাহা একাধারে সৌন্দর্যসৃষ্টির রস এবং উচ্চ ভাব ও আদর্শের প্রেরণা যোগায়। প্রায় সব উপন্যাসেই একনিষ্ঠ প্রেমের মর্যাদা ও সতীত্বের মহিমা এবং অপরদিকে মনুষ্যচরিত্রের দুর্বলতা, প্রলোভন ও নৈতিক অধঃপতনের বিচিত্র দ্বন্দ্বে মানুষের জয়-পরাজয়ের মর্মন্তুদ কাহিনী পাঠকের মনে রোমান্টিক উপন্যাসের বিশেষত্ব ও সৌন্দর্য সর্বদা স্মরণ করায়। ঊনবিংশ শতকে নীতিবোধের যে উচ্চ আদর্শ ছিল বঙ্কিমচন্দ্র দৃঢ়হস্তে তাহা সর্বদা আমাদের সম্মুখে ধরিয়া রাখিয়াছেন; তাঁহর মুষ্টি কখনও শিথিল হয় নাই। রোহিণীর মৃত্যু, শৈবলিনীর প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি বর্তমান যুগের আদর্শ ও নীতিজ্ঞানের অনুযায়ী নহে বলিয়া অনেকে তাহার বিরুদ্ধ সমালোচনা করেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের বিচার করিতে হইলে উনিশ শতকের মাপকাঠিই ব্যবহার করিতে হইবে–বিশ শতকের নহে। একাধারে ভাষার লালিত্য, অনবদ্য সৌন্দর্য-সৃষ্টি, রসের অবতারণা ও মহান আদর্শের অপূর্ব সমন্বয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলি উনিশ শতকের বাঙ্গালী-জীবনের প্রতীকরূপে চিরদিনই গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকিবে।

বঙ্কিমচন্দ্র দুইটি ক্ষুদ্র আখ্যায়িকা রচনা করিয়াছিলেন-”যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪) ও রাধারাণী’ (১৮৭৫)। এই দুইটি রচনা উপন্যাস নহে, আবার ছোটগল্পের শ্রেণীতেও ইহাদিগকে ফেলা যায় না। নিছক কাহিনী হিসাবে আখ্যায়িকা দুইটি কিছু সার্থকতা লাভ করিয়াছে, কিন্তু উচ্চাঙ্গের সাহিত্য হয় নাই।

বঙ্কিমচন্দ্র কয়েকটি লঘুরসাত্মক গ্রন্থও রচনা করিয়াছেন–যথা, কমলাকান্ত’ (১৮৮৫), ‘লোকরহস্য (১৮৭৪) ও ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত (১৮৮৪)। হাস্যরস সৃষ্টিতে তাহার অসামান্য দক্ষতার পরিচয় এই তিনটি গ্রন্থ হইতে পাওয়া যায়। কমলাকান্ত’ তিন খণ্ডে বিভক্ত-কমলাকান্তের দপ্তর (ইতিপূর্বে ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দে ইহা স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়াছিল), কমলাকান্তের পত্র ও কমলাকান্তের জোবানবন্দী। প্রথম খণ্ডে কয়েকটি উচ্চাঙ্গের ব্যক্তিগত প্রবন্ধে লেখকের মনের চিন্তা ও অনুভূতি অত্যন্ত সরস ভঙ্গীতে উপস্থাপিত হইয়াছে; অপর কয়েকটি প্রবন্ধ হইতে বঙ্কিমচন্দ্রের সূক্ষ্ম রাজনীতিজ্ঞান ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার চিন্তা ও অনুভূতিকে পত্রের আঙ্গিকে রূপায়িত করিয়াছেন। তৃতীয় খণ্ডটি একটি অত্যন্ত উপভোগ্য হাস্যরসাত্মক নকশা। ইহাতে আদালতের বিচারপদ্ধতিকে ব্যঙ্গ করা হইয়াছে। এই গ্রন্থটির মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র হাসি ও ব্যঙ্গের আবরণে বাঙ্গালী জাতির অনেক মর্মবেদনা প্রকাশ করিয়াছেন। লোকরহস্য’ গ্রন্থে কয়েকটি উপভোগ্য হাস্যরসাত্মক নকশা ও প্রবন্ধ পাওয়া যায়। মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’-এ অযোগ্য লোকের ভাগ্যের প্রসাদে কিভাবে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে, তাহাই বঙ্কিমচন্দ্র লঘু হাস্যরসের মধ্যদিয়া রূপায়িত করিয়াছেন। এই তিনখানি গ্রন্থে তিনি যে সুনির্মল কৌতুকধারা প্রবাহিত করিয়াছেন, তাহার তুলনা হয় না।

শুধু উপন্যাস রচনায় নহে, ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও বিবিধ প্রবন্ধ রচনাতেও বঙ্কিমচন্দ্র অবিসংবাদিত নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৮৬)। এই গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র মহাভারতে এবং পুরাণগুলিতে বর্ণিত কাহিনী বিশ্লেষণ করিয়া কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিক সত্য উদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছেন। তাঁহার প্রচেষ্টা হয়ত সম্পূর্ণ সার্থক হয় নাই, কিন্তু যুক্তিমূলক রচনা হিসাবে ইহার বৈশিষ্ট্য ও মৌলিকত্ব খুব উচ্চশ্রেণীর। ইহার রচনাভঙ্গীও অত্যন্ত চমৎকার। তাহার ফলে ইহা শুষ্ক গবেষণাগ্রন্থে পরিণত হয় নাই, অত্যন্ত সরস ও সুখপাঠ্য রচনা হইয়া উঠিয়াছে। বিবিধ প্রবন্ধ (প্রথম ভাগ ১৮৮৭ ও দ্বিতীয় ভাগ ১৮৯২-এ প্রথম প্রকাশিত) গ্রন্থে নানা বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের অনেকগুলি প্রবন্ধ সঙ্কলিত হইয়াছে। এই গ্রন্থ হইতে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের পাণ্ডিত্য এবং তাঁহার চিন্তার মৌলিকতা ও যুক্তিশৃঙ্খলার পারিপাট্যের পরিচয় পাইয়া মুগ্ধ হই। সাহিত্যসমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলি ‘বিবিধ প্রবন্ধ’র শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ভারতবর্ষ ও বাংলা দেশের ইতিহাসসম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলি বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেম ও ইতিহাস-নিষ্ঠার পরিচয় বহন করিতেছে। সাম্য’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র মিলের মত অনুসরণ করিয়া সাম্যতত্ত্ব বিশ্লেষণ করিয়াছেন। শেষজীবনে তিনি এই গ্রন্থ প্রত্যাহার করিয়াছিলেন। ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে তিনি ধর্মের মূলতত্ত্ব লইয়া আলোচনা করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলাভাষায় ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতার অনুবাদ ও ভাষ্য রচনা আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষ করিতে পারেন নাই। বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫) গ্রন্থে তিনি কয়েকটি বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গ লইয়া আলোচনা করিয়াছেন, অবশ্য পরে এইসব বিষয় সম্বন্ধে নূতন নূতন তথ্য আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে তাঁহার আলোচনা বর্তমানে অনেকাংশে মূল্যহীন হইয়া পড়িয়াছে। গদ্যপদ্য বা কবিতাপুস্তক (১৮৯১) নামে আর-একটি গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকটি কবিতা ও তিনটি সুন্দর কাব্যধর্মী গদ্য-রচনা সঙ্কলিত হইয়াছে।

বাংলাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের আর-একটি অবিস্মরণীয় দান-বাংলা গদ্যের একটি আদর্শ রীতির প্রতিষ্ঠা। পূর্বেই বলা হইয়াছে, বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থরচনার পূর্বে বাংলা গদ্যের দুইটি স্বতন্ত্র রীতি প্রচলিত ছিল–তারাশঙ্কর তর্করত্নের কাদম্বরী’ প্রভৃতি গ্রন্থে ব্যবহৃত সংস্কৃত-শব্দবহুল রীতি এবং প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রভৃতি গ্রন্থে ব্যবহৃত কথ্যভাষার রীতি। এই দুইটি রীতি পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং কেহই আদর্শ বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। বঙ্কিমচন্দ্র এই দুইটি রীতির সমন্বয় সাধন করিয়া এবং সংস্কৃত ও লৌকিক শব্দরাজির সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাস করিয়া যে এক অভিনব রীতির প্রবর্তন করিলেন তাহাই বাংলা গদ্যের আদর্শ রীতি হিসাবে গৃহীত হইল। বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং তাঁহার বাংলা ভাষা প্রবন্ধে এই রীতির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন।

সম্প্রতি একশ্রেণীর লেখক বঙ্কিমের সাহিত্যিক কৃতিত্ব সম্বন্ধে বিরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজী উপন্যাসের নিকট কী পরিমাণ ঋণী, ইহা লইয়াও অনেক তর্কবিতর্ক হইয়াছে। বঙ্কিমের উপন্যাসে সৃষ্ট চরিত্রের বাস্তবতা নাই, এই অভিযোগ করিয়া কেহ কেহ তাহাকে মাঝারি নভেল-লেখক বলিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। এইসব ও অন্যান্য বিরুদ্ধ-আলোচনা বর্তমান প্রসঙ্গে আলোচনা করা সম্ভব নহে।২৬ আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসসম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের রচিত বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ আছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক সেগুলি পাঠ করিতে পারেন।

এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার জীবনের অভিজ্ঞতা ও আদর্শ হইতে সার সংগ্রহ করিয়া বাংলার নব্য লেখকদের প্রতি যে নিবেদন করিয়াছিলেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দৰ্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।…

“যাহা অসত্য, ধৰ্ম্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধৰ্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনীধারণ মহাপাপ।”২৭

বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং যে এই নীতিগুলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন, তাঁহার রচনাবলী তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। ‘বঙ্গদর্শন’ নামে সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদন বঙ্কিমচন্দ্রের একটি প্রধান কীর্তি। ১২৭৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (১৮৭২ এপ্রিল) বঙ্গদর্শনের প্রথম সংখ্যা কলিকাতা হইতে প্রকাশিত। এই শ্রেণীর সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা বাংলা দেশে ইহার পূর্বে ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র তখন চাকুরি উপলক্ষে বহরমপুরে ছিলেন এবং সেখানে ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামদাস সেন, লালবিহারী দে, রামগতি ন্যায়রত্ন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রভৃতিকে লইয়া তিনি এক ক্ষুদ্র সাহিত্য সংঘ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। এই সংঘের সহায়তায় এবং বঙ্কিমের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত হইয়া বাঙ্গালীর চিত্ত উদ্বুদ্ধ করিল। বঙ্কিমচন্দ্র নিজের লেখা উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গ্রন্থ-সমালোচনা

এবং তাঁহার নির্দেশ অনুযায়ী অপর লেখকের সামাজিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক ও অন্যান্য বিষয়ক প্রবন্ধ ও গল্প প্রভৃতিতে বঙ্গদর্শন সুসমৃদ্ধ হইয়া উঠিল। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিয়াছেন :

“বঙ্কিমচন্দ্র যদি সেদিন সুকৌশলী সেনাপতির মত বঙ্গবাণীর বিচ্ছিন্ন সেবকদের ‘বঙ্গদর্শনের ব্যুহমধ্যে সংস্থাপিত করিতে না পারিতেন, তাহা হইলে অত্যল্পকাল মধ্যে বঙ্গসাহিত্যের এতখানি প্রসার সম্ভব হইত না।”২৮ ইহা একটুও অত্যুক্তি নহে। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা হইতেই বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সঙ্গীত, সাহিত্য, সমালোচনা, ব্যঙ্গকৌতুক প্রভৃতি বিষয়ে স্বয়ং লিখিতেন। তাঁহার কয়েকখানি উৎকৃষ্ট উপন্যাস, বিখ্যাত ‘কমলাকান্তের দপ্তর’২৯ ও নানা মূল্যবান প্রবন্ধ এই বঙ্গদর্শনে প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যসাধনা সম্বন্ধে কয়েকটি উক্তি উদ্ধৃত করিয়াই এই প্রসঙ্গের উপসংহার করিব।

ব্রজেন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন :

বঙ্কিমচন্দ্র “একদিকে প্রাচ্য জড়তা ও অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর মোহজাত পাশ্চাত্ত্যের অনুকরণবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া বাঙ্গালী-জাতি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে স্বমৰ্য্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।”৩০

মোহিতলাল মজুমদার লিখিয়াছেন :

বঙ্কিমচন্দ্র “শুধু সাহিত্যস্রষ্টা শিল্পী নহেন-নব্য বঙ্গসাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা।…. সাহিত্য রচনায় আত্মবিস্মৃত শিল্পী যে আনন্দমুক্তির আস্বাদ পায়, বঙ্কিমের তাহাতে লোভ ছিল না।…যে মনুষ্যত্বের বিকাশ হইলে, জাতির জীবনে উৎকৃষ্ট সাহিত্য আপনি সম্ভব হয়; বঙ্কিম সেই আদর্শের প্রতিষ্ঠায় তাঁহার সকল শক্তি নিয়োগ করিয়াছিলেন।”৩১

সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার অননুকরণীয় ভাষায় লিখিত এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি যে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করিয়াছেন তাহার কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করিতেছি :

“সব্যসাচী বঙ্কিম এক হস্ত গঠনকার্যে এক হস্ত নিবারণকার্যে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন। একদিকে অগ্নি জ্বালাইয়া রাখিতেছিলেন আর একদিকে ধূম এবং ভস্মরাশি দূর করিবার ভার নিজেই লইয়াছিলেন।

“রচনা এবং সমালোচনা এই উভয় কার্য্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।

“সাহিত্যের যেখানে যাহা কিছু অভাব ছিল সর্বত্রই তিনি আপনার বিপুল বল এবং আনন্দ লইয়া ধাবমান হইতেন।….বিপন্ন বঙ্গভাষা আর্তস্বরে যেখানেই তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছে সেইখানেই তিনি প্রসন্ন চতুর্ভুজমূৰ্ত্তিতে দর্শন দিয়াছেন।”৩২

(গ) বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী উপন্যাস

বঙ্কিমচন্দ্র নূতন শ্রেণীর উপন্যাসের যে ধারা প্রবাহিত করিলেন ক্রমে তাহা বিশাল নদীর স্রোতের ন্যায় বঙ্গসাহিত্যকে প্লাবিত করিল। উনিশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত বহু ঔপন্যাসিক এই ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন এবং বহুসংখ্যক উপন্যাস প্রকাশিত হইয়াছিল–ইহা সবিস্তারে বর্ণনা করা সম্ভব নহে, কয়েকখানির মাত্র উল্লেখ করিব।

তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৪৩-৯১) প্রণীত ‘স্বর্ণলতার’ বৈশিষ্ট্য এই যে ইহা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী গৃহস্থের প্রাত্যহিক জীবন অবলম্বনে লিখিত। এই শ্রেণীর বাঙ্গালীর চিত্রকে প্রাধান্য দিয়া ইহার পূর্বে কোন উপন্যাস রচিত হয় নাই। ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে ইহা প্রকাশিত হয় এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ইহা বিশেষ লোকপ্রিয় ছিল। ইহার কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘সরলা’ নাটক বাংলার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইত।

সিভিলিয়ান রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) ইংরেজী ও সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের প্রেরণায় বাংলায় চারিখানি উপন্যাস রচনা করিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন-’বঙ্গবিজেতা’, ‘মাধবী কঙ্কন’ (১৮৭৭), মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত’ (১৮৭৮) ও রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’ (১৮৭৯)। এই চারিখানি উপন্যাসই ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে লিখিত এবং ইহাদের মধ্যে বর্ণিত ঘটনাগুলি মুঘল যুগের একশত বৎসরের মধ্যেই ঘটিয়াছিল–এইজন্য এই চারিখানি একত্রে শতবর্ষ’ নামে অভিহিত হয়। ঐতিহাসিক পটভূমিকা ও কাহিনীর সরস বর্ণনার গুণে ইহারা জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিল। মধ্যবিত্ত গৃহস্থের জীবনযাত্রা লইয়া রমেশচন্দ্র ‘সংসার’ (১৮৮৬) ও সমাজ (১৮৯৩) নামে আরও দুইখানি উপন্যাস লিখিয়াছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের ভগিনী স্বর্ণকুমারী দেবী কয়েকটি উপন্যাস রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ (১৮৭৬) এবং শেষ উপন্যাস “মিলনরাত্রি’ (১৯২৫)। তাঁহার রোমান্টিক প্রণয়কাহিনী-মূলক ও ঐতিহাসিক উপন্যাস এককালে জনপ্রিয় ছিল। কাহাকে?’ (১৮৯৮) তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

দামোদর মুখোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা’ ও ‘দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের উপসংহার-অর্থাৎ কপালকুণ্ডলা ও আয়েষার কাহিনী বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে শেষ করিয়াছেন তাহার পরে, তাহাদের জীবনের ঘটনা অবলম্বনে ‘মৃন্ময়ী’ ও নবাবনন্দিনী’ নামে দুইখানি উপন্যাস লেখেন। কপালকুণ্ডলার জলে ঝাঁপ দিয়া অন্তর্ধান ও আয়েষার ব্যর্থ প্রণয়কাহিনীতে পাঠকের মনে যে একটা অতৃপ্তির ভাব হইত তাহা কতক পরিমাণে দূর করার জন্যই এই উপন্যাস দুইখানি খুব জনপ্রিয় হইয়াছিল। দামোদরবাবুর অন্যান্য উপন্যাসগুলির তেমন আদর হয় নাই।

নব্যভারত’ পত্রিকার সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী (১৮৫৪-১৯২০) ও ব্রাহ্মসমাজের আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) কয়েকখানি উপন্যাস লিখিয়াছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর মেজবৌ’ (১৮৮০) ও ‘যুগান্তর (১৮৯৫) এক সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল।

চণ্ডীচরণ সেন (১৮৪৫-১৯০৬) বিখ্যাত Uncle Tom’s Cabin-এর বঙ্গানুবাদ–‘টমকাকার কুটীর’ লিখিয়া যশস্বী হন। পরে তিনি মহারাজা নন্দকুমার’ (১৮৮৫), দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ’ (১৮৮৬), অযোধ্যার বেগম’ (১৮৮৬) ও ঝন্সীর রাণী’ (১৮৮৮) প্রভৃতি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিয়া খ্যাতিলাভ করেন। কিন্তু এগুলিতে প্রকৃত ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষিত হয় নাই।

শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পল্লীগ্রামের চিত্রমূলক কয়েকখানি উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের প্রশংসালাভ করিয়াছিল। ইহার মধ্যে ফুলজানি’ (১৮৯৪) সমধিক প্রসিদ্ধ।

সাধারণ উপন্যাস ছাড়া কয়েকটি বিভিন্ন শ্রেণীর উপন্যাসও উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ ব্যঙ্গরচনা। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৪৯-১৯১১) কল্পতরু’ (১২৮১ সাল) বাংলার প্রথম ব্যঙ্গ-উপন্যাস। যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর মডেল ভগিনী’ (১৮৮৬) এককালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই দুইখানি বই-ই ব্রাহ্মসমাজকে বিদ্রূপ করিয়া লিখিত। যোগেন্দ্রচন্দ্রের আরও কয়েকখানি ব্যঙ্গ-উপন্যাস সমসাময়িক কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া রচিত হইয়াছিল।৩৩।

যোগেন্দ্রচন্দ্র শ্রীশ্রীরাজলক্ষ্মী’ নামে যে বিশুদ্ধ রোমান্টিক উপন্যাস লেখেন (১৯০২-০৬) তাহা বাংলাভাষায় বৃহত্তম উপন্যাস বলিয়া পরিগণিত হয়।

সামাজিক চিত্র অবলম্বনে ব্যঙ্গ ও কৌতুকমিশ্রিত সুরলোকে বঙ্গের পরিচয়, ‘দেবগণের মর্ত্যে আগমন’ প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। স্বর্গ হইতে দেবগণ বঙ্গদেশে আসিয়া যাহা যাহা দেখিলেন এগুলি তাহার সরস শ্লেষাত্মক বর্ণনা। সমাজ, ভাষা ও সাহিত্য এবং প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিদ্রূপই এই শ্রেণীর গ্রন্থের উপজীব্য।

রূপকথার ছাঁচে ঢালিয়া সম্ভব অসম্ভব নানারূপ কল্পনাসৃষ্টির সাহায্যে ব্যঙ্গমিশ্রিত রসরচনায় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭-১৯১৯) বিশেষ দক্ষতা দেখাইয়াছেন। তাঁহার কঙ্কাবতী’ (১২৯৯ সাল), ‘ফোকলা দিগম্বর’ (১৩০৭ সাল) ও ডমরু-চরিত’ সম্পূর্ণ অভিনব সৃষ্টি। অনেকে এই সকল রচনার খুব উচচপ্রশংসা করিয়াছেন। ত্রৈলোক্যনাথ একজন প্রথমশ্রেণীর ব্যঙ্গশিল্পী।

কয়েকখানি ডিটেকটিভ উপন্যাসও এককালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিল। ইহাদের মধ্যে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’ (১৮৯৩ ৯৯) এবং প্রায় সমসাময়িক শরচ্চন্দ্র সরকারের গোয়েন্দাকাহিনী-শীর্ষক গ্রন্থমালা খুবই জনপ্রিয় হইয়াছিল। পরে পাঁচকড়ি দে ও দীনেন্দ্রকুমার রায় এই শ্রেণীর গ্রন্থ লিখিয়া বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।

(ঘ) বিবিধ রচনা

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের বিশেষ উন্নতি ঘটিয়াছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের দুইজন সহপাঠী-ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৫-১৮৯৪) ও রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) প্রথমশ্রেণীর প্রবন্ধলেখক ছিলেন। ভূদেবের প্রবন্ধগুলি প্রধানতঃ সদাচার ও গৃহধর্মবিষয়ক। সেগুলি পারিবারিক প্রবন্ধ (১৮৮১), সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯৩), ‘আচার প্রবন্ধ’ (১৮৯৪) প্রভৃতি গ্রন্থে। সংকলিত হইয়াছে। এগুলি হইতে ভূদেবের রক্ষণশীল অথচ উদার মনের পরিচয়। মিলে। মারাঠারা পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হইলে কিরূপ হইত, তাহার একটি কাল্পনিক চিত্র ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’ গ্রন্থে ভূদেব সুন্দরভাবে অঙ্কন করিয়াছেন। রাজনারায়ণ বসুর রচনারীতি ঋজু ও সরস, সাধুভাষা হইয়াও কথ্যভাষার কাছাকাছি। সেকাল আর একাল’ (১৮৭৪), গ্রাম্য উপাখ্যান (১৮৮৩) ও ‘আত্মচরিত (১৯০১) তাঁহার শ্রেষ্ঠ তিনটি গ্রন্থ। ইহা ভিন্ন তাহার অন্য কয়েকখানি গ্রন্থও-ব্রাহ্ম সমাজের বক্তৃতা’ (১৮৬১), বক্তৃতা’ (দুই খণ্ড, ১৮৫৫, ১৮৭০), হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ (১৮৭৩), বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৭৮), বিবিধ প্রবন্ধ (১৮৮২) এবং বৃদ্ধ হিন্দুর আশা (১৮৮৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে বহু মূল্যবান প্রবন্ধ এই যুগে রচিত হইয়াছিল। কয়েকজন ব্রাহ্ম লেখক-শিবনাথ শাস্ত্রী, গিরিশচন্দ্র সেন, কৃষ্ণবিহারী সেন, প্রভৃতি জীবনী ও প্রবন্ধ রচনায় খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৮৯৭) ও ‘আত্মচরিত (১৯১৮) তথ্যের দিক দিয়া অত্যন্ত মূল্যবান। শশধর তর্কচূড়ামণির প্রবন্ধ গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রিয় ছিল। রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮৪৯-১৯০০) ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থের রচয়িতা হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন।

গুরুগম্ভীর চিন্তামূলক প্রবন্ধের জন্য ঢাকা হইতে প্রকাশিত বান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন ঘোষ (১৮৪৩-১৯১০) বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। তাঁহার ‘প্রভাত চিন্তা (১৮৭৭), ‘নিভূত চিন্তা’ (১৮৮৩), নিশীথ চিন্তা’ (১৮৯৬) প্রভৃতি উচ্চাঙ্গের রচনা। কলিকাতার বাহিরে মফঃস্বলবাসী কোন সাহিত্যিকই এরূপ খ্যাতিলাভ করেন নাই। তিনি পূর্ববঙ্গের বিদ্যাসাগর বলিয়া পরিচিত ছিলেন।

মীর মশারফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২) এই যুগের একজন বিশিষ্ট গদ্য লেখক। কারবালার করুণ কাহিনী অবলম্বনে রচিত ইহার ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (তিন খণ্ড, ১৮০৪-১৮৯০) বাংলাসাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও (১৮৪০-১৯২৬) সাহিত্যিক প্রতিভা ছিল। আলোচ্য যুগে তিনি দার্শনিক প্রবন্ধরচনায় বাংলাসাহিত্যের অগ্রদূত ছিলেন এবং চারি খণ্ড ‘তত্ত্ববিদ্যা’ (১৮৬৬-৬৯) এবং বহু দর্শনবিষয়ক গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার মধ্যমভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৪২ ১৯২৩) ভাল বাংলা লিখিতেন। তিনি বৌদ্ধধর্ম’ (১৯০১), বোম্বাই চিত্র (১৮৮৮) এবং আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস’ (১৯১৫) প্রভৃতি বিশিষ্ট গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক বঙ্গদর্শন’-গোষ্ঠীর কয়েকজন প্রবন্ধলেখকের নাম পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন অক্ষয়চন্দ্র সরকার (১৮৪৬-১৯১৭) ও রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৫-১৮৮৬)। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর-গ্রন্থে ইঁহাদের লেখা দুইটি প্রবন্ধ আছে। রাজকৃষ্ণের নানা প্রবন্ধ’ গ্রন্থে (১৮৮৫) অনেকগুলি জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সংকলিত হইয়াছে, সেগুলি হইতে ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি নানা বিষয়ে লেখকের গভীর পাণ্ডিত্যের এবং সহজ সর্বজনবোধ্য ভাষায় তাহাকে প্রকাশ করার শক্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের রচনারীতি ছিল অত্যন্ত লঘু ও সরস। তাঁহার প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে সমাজ-সমালোচনা (১৮৭৪), ‘আলোচনী’ (১৮৮২), সনাতনী’ (১৯১১), মোতিকুমারী’ (১৯১৭) এবং রূপক ও রহস্য’ (১৯২৩) উল্লেখযোগ্য। এগুলির মধ্যে জ্ঞানগাম্ভীর ও কল্পনাবিলাস উভয়েরই নিদর্শন আছে। আত্মজীবনীমূলক নিবন্ধ পিতাপুত্র’ এবং হেমচন্দ্রের জীবনী ও কাব্যসমালোচনা অবলম্বনে লিখিত কবি হেমচন্দ্র’ অক্ষয়চন্দ্রের দুইটি বিশিষ্ট রচনা।

বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও (১৮৩৪-১৮৮৯) সুলেখক ছিলেন। তাঁহার লেখা ‘পালামৌ’ (১৮৮০) একটি সরস ভ্রমণকাহিনী। জাল প্রতাপচাঁদ’ (১৮৮৩) গ্রন্থে তিনি একটি মামলার বর্ণনাকেও রসমণ্ডিত করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। সঞ্জীবচন্দ্র কণ্ঠমালা’ (১৮৭৭) ও মাধবীলতা’ (১৮৮৪) নামে দুইটি উপন্যাস ও কয়েকটি গল্পও লিখিয়াছিলেন।

চন্দ্রনাথ বসুও (১৮৪৪-১৯১০) বঙ্কিমচন্দ্রের গোষ্ঠীভুক্ত লেখক। তাঁহার শকুন্তলাতত্ত্ব (১৮৮১), ত্রিধারা (১৮৯১), ‘সাবিত্রীতত্ত্ব’ (১৯০০) প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থে যুক্তি ও বিশ্লেষণক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁহার অতিরক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য প্রবন্ধগুলি বর্তমান যুগে জনপ্রিয় নহে।

বীরেশ্বর পাড়ে এ-যুগের আর-একজন রক্ষণশীল লেখক। প্রাচীন হিন্দু আদর্শ ‘ক্ষুণ্ণ করার জন্য তিনি নবীনচন্দ্র সেনকে আক্রমণ করিয়া উনবিংশ শতাব্দীর মহাভারত’ (১৮৯৭) নামে গ্রন্থ লিখিয়াছেন। তাঁহার অপর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘মানবতত্ত্ব’ (১৮৮৩), ‘অদ্ভুত স্বপ্ন বা স্ত্রীপুরুষের দ্বন্দ্ব’ (১৮৮৮), ও ধর্মবিজ্ঞান (১৮৯০)।

ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় (১৮৫১-১৯০৩) বীরশ্বের পাঁড়েরই মত প্রধানত সাহিত্য-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন, তবে তাহার প্রবন্ধাবলীতে উদার মতবাদ ও সূক্ষ্ম রসাস্বাদন শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। সাহিত্যমঙ্গল’ (১৮৮৮) গ্রন্থে তাঁহার কিছু প্রবন্ধ সঙ্কলিত হইয়াছে।

চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (১৮৪৯-১৯২২) তাহার স্ত্রীবিয়োগের পর ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেম’ (১৮৭৬) নামে যে শোকাচ্ছ্বাসপূর্ণ প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন, এককালে তাহা খুব খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। তাঁহার অপর তিনটি গ্রন্থ ‘সারস্বতকুঞ্জ’ (১৮৯০), ‘স্ত্রীচরিত্র’ (১৮৯০) এবং কুলতার মনের কথা।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক ও গবেষক। তাঁহার প্রবন্ধগুলির অধিকাংশই প্রত্নতত্ত্ব এবং প্রাচীন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধীয়। তাঁহার ভাষা অতিশয় সরল ও সরস, এবং নিতান্ত দুরূহ বিষয়ের আলোচনাও তিনি সর্বজনবোধ্য ও চিত্তাকর্ষক করিয়া তুলিতে পারিতেন। তিনি অত্যন্ত লঘু ও চিত্তাকর্ষক ভঙ্গীতে কালিদাসের মেঘদূত’-এর সুন্দর একটি ব্যাখ্যা রচনা করিয়াছিলেন। তিনি কাঞ্চনমালা’ (১৯১৪) ও ‘বেণের মেয়ে (১৯১৯) নামক দুইখানি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করিয়াছিলেন। শেষোক্ত গ্রন্থে একাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকের বাংলা দেশের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। তাঁহার ‘বাল্মীকির জয়’ (১৮৮১) উপন্যাসধর্মী পুরাণাশ্রিত আখ্যায়িকা। ভারতমহিলা (১৮৮০) তাঁহার একটি বিশিষ্ট প্রবন্ধগ্রন্থ।

ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪) লেখা উপদেশগ্রন্থগুলি এবং আত্মজীবনীগ্রন্থ ‘জীবন বেদ’ (১৮৮৪) ও সাহিত্যিক প্রবন্ধের নিদর্শনস্বরূপ গণ্য হইতে পারে। কেশবচন্দ্রের সরল ও স্পষ্ট ভাষা, প্রগাঢ় মনস্বিতা এবং ভগবৎ স্বরূপ উপলব্ধির জন্য প্রগাঢ় আবেগ এই গ্রন্থগুলির প্রধান সম্পদ।

স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২) পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, বর্তমান ভারত’ ও ‘ভাববার কথা বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের মধ্যে অতি উচ্চস্থান অধিকার করিয়া আছে। অবশ্য তাহার বাংলা রচনার মধ্যে পত্রের সংখ্যাই অধিক। দেশের মাটি ও সাধারণ মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার পরিচয় বিবেকানন্দের রচনাবলীর অসংখ্য স্থানে ছড়াইয়া আছে। তাঁহার লিপিভঙ্গী অত্যন্ত সরস। তাঁহার অনেক বাংলা রচনা চলিত ভাষাতেই লিখিত। ভাববার কথা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রবন্ধে তিনি চলিত ভাষাকেই সাহিত্যের বাহন করিয়া তোলার সপক্ষে সুদৃঢ় যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন। এ-বিষয়ে তিনি প্রমথ চৌধুরীর অগ্রগামী।

বাংলা গদ্যের উন্নতিসাধনে সাময়িকপত্রগুলির ভূমিকাও অল্প নহে। এ-সম্বন্ধে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হইয়াছে।

আলোচ্য যুগের ঐতিহাসিক রচনার মধ্যে রামদাস সেনের (১৮৪৫-৮৭) ‘ঐতিহাসিক রহস্য’ ও ‘ভারত রহস্য’ এবং কার্তিকেয়চন্দ্র রায় সঙ্কলিত ক্ষিতীশ বংশাবলি-চরিত’ (নবদ্বীপের রাজবংশের বিবরণ) বিশেষ মূল্যবান। আর্যদর্শন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ (১৮৪৫-১৯০৪) ম্যাটসিনি, গ্যারিবলডী প্রভৃতি বিদেশীয় দেশপ্রেমিকের জীবনবৃত্তান্ত লিখিয়া বঙ্গসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ও জাতীয়তা আন্দোলনের সহায়তা করেন। সত্যচরণ শাস্ত্রীর ‘শিবাজী ও ‘প্রতাপাদিত্যের জীবনচরিত’ এই শ্রেণীর রচনা।

আধুনিক যুগের বাঙ্গালী মনীষীদের কয়েকটি জীবনবৃত্তান্ত এই সময়ে রচিত হয়। ইহার মধ্যে নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত’ (১৮৮১), যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত (১৮৯৩) এবং চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিহারীলাল সরকারের বিদ্যাসাগর’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আলোচ্য যুগে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসবিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়। তথ্যগত ভ্রম ও অপূর্ণতাসত্ত্বেও তখনকার মান অনুযায়ী এগুলি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় রচনা। এই জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে হরিমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কবিচরিত’ (১৮৬৯), মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গভাষার ইতিহাস’ (১৮৭১) এবং রামগতি ন্যায়রত্নের ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৭২-৭৩) উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত গ্রন্থটি বৃহদায়তন ও সুলিখিত এবং ইহার আদর্শ বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব।

৩. কাব্য

ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য ১৬৭৪ শকাব্দে (১৭৫২-৫৩ খ্র.) সম্পূর্ণ হয়। তাঁহার পর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পূর্বে আর কেহ বাংলাসাহিত্যে কবিরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেন নাই। এ-দুইয়ের অন্তর্বর্তীকাল বাংলায় রাজনীতিক, সামাজিক ও অর্থনীতিক বিপ্লবের যুগ-উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যের বিকাশের পক্ষে হয়ত ইহাই একটি প্রধান অন্তরায় হইয়াছিল। কারণ যাহাই হউক, কার্যতঃ কীর্তন ও অন্যান্য ধর্মসঙ্গীত এবং কবিগান, পাঁচালি, তর্জা, টপ্পা, আখড়াই, সারি, ঝুমুর প্রভৃতি লোকসঙ্গীতই এ-যুগে কবিতার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল। এইগুলির সম্বন্ধে দ্বাদশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হইবে।

এই যুগের সাহিত্য-রসজ্ঞানের সম্বন্ধে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে তখন পাঁচালি-রচয়িতা সুপ্রসিদ্ধ দাশরথি রায় সম্বন্ধে বলা হইত, “কালিদাসের উপমা গুণ নৈষধের পদলালিত্য গুণ ও ভারবির অর্থগৌরব গুণ–এই সকল কবিগণের গুণের ইয়ত্তা আছে কিন্তু দাশরথি রায়ের গুণের সীমা নির্ধারণ করা যায় না।”৩৪ বর্তমান কালের পাঠক অবশ্য ইহা শুনিয়া হাস্য করিবেন এবং সে-যুগের কবিত্বরসের উপলব্ধি সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করিবেন। দাশরথি রায়ের শব্দ-চাতুর্যেই প্রধানতঃ লোক মুগ্ধ হইত। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি :

“পণ্ডিতের ভূষণ ধর্মজ্ঞানী, মেঘের ভূষণ সৌদামিনী, সতীর ভূষণ পতি। যোগীর ভূষণ ভস্ম, মৃত্তিকার ভূষণ শস্য, রত্নের ভূষণ জ্যোতি ॥”

এই প্রকার উপমার রাশি জলস্রোতের ন্যায় প্রবাহিত হইয়া সেকালের শ্রোতা ও পাঠকগণকে মধুর রসে প্লাবিত করিত।

(ক) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১১-১৮৫৯) প্রসিদ্ধ সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক এবং সে-যুগের একজন উচ্চশ্রেণীর কবি বলিয়া বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক কবিতা-রচনায় ঈশ্বর গুপ্তের শিষ্য ছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত ধর্ম, সমাজ ও প্রেমবিষয়ক বহু কবিতা এবং অনেক কবি-গানও রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার বিশেষ ঝোঁক ছিল লোকসঙ্গীতের উপর।

ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার মধ্যে খাঁটি বাংলা ও সমসাময়িক বাঙ্গালী-জীবনের প্রতিচিত্র পাওয়া যায়। তাঁহার পরেই বাংলা কাব্যে মার্জিত সাধুভাষা ও পাশ্চাত্ত্য প্রভাব সুপরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।

ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় রচনা-চাতুর্য আছে কিন্তু ভাবের গভীরতা নাই। সুতরাং ইহা উচ্চাঙ্গের কবিতা বলিয়া গণ্য করা যায় না। দুইটি বিষয়ে ইহাদের মধ্যে আধুনিকতার আভাস পাওয়া যায়-দেশপ্রেম ও ইতিহাস-চেতনা। বিদেশী ঠাকুর’ ফেলিয়া তিনি দেশের কুকুর’-এর আদর করিতেন।

ঈশ্বর গুপ্তের গদ্য-রচনাগুলির অধিকাংশেরই ভাষা অনুপ্রাসবহুল ও কৃত্রিম। প্রাচীন কবিদের সম্বন্ধে লেখা তাঁহার প্রবন্ধগুলির ভাষা সরল ও স্বচ্ছন্দ। তিনি রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি প্রাচীন কবি ও কবিওয়ালাদের জীবনী রচনার জন্য গবেষণায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ইহা তাঁহার পূর্বে বাংলা-সাহিত্যক্ষেত্রে অপরিচিত ছিল। অনেক লুপ্ত রচনার পুনরুদ্ধার তাঁহার একটি বিশেষ কীর্তি। ঈশ্বর গুপ্তের অনেক কবিতা ব্যঙ্গাত্মক। ইহাদের মধ্যে উপভোগ্য হাস্যরসের নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে তাঁহার অনেক কবিতা অশ্লীলতা-দোষে দুষ্ট। বিলিতী ফ্যাসানের ও নব্য ইংরেজীশিক্ষিত সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে তাহার ব্যঙ্গোক্তিমূলক কবিতাগুলি এককালে খুব জনপ্রিয় ছিল। দৃষ্টান্ত :

“যা থাকে কপালে ভাই টেবিলেতে খাব
ডুবিয়া জবর টবে চ্যাপেলেতে যাব।
কাঁটা ছুরি কাজ নাই কেটে যাবে বাবা
দুই হাতে পেট ভরে খাব থাবা থাবা।”

অন্যত্র

“ইচ্ছা করে ধন্না পাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে।
কুক হয়ে মুখখানি লুক করি সুখে ॥”

ঈশ্বর গুপ্তের শ্লেষ ও শব্দ-চাতুর্যের একটি প্রধান দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তাহার নিজের সম্বন্ধে উক্তিতে :

“কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচরে।
যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকরে ॥”

(‘প্রভাকর’ পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন।)

(খ) রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

ঈশ্বর গুপ্তের দেশপ্রেম তাঁহার শিষ্য রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-১৮৮৬) কবিতায় অনেক বেশী পরিস্ফুট হইয়াছে। তাহার ‘পদ্মিনী-উপাখ্যান’ (১৮৫৮) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাব্য বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছে।

টডের ‘রাজস্থানে’ বর্ণিত পদ্মিনীর রূপে মুগ্ধ আলাউদ্দীনের চিতোর অভিযান ও চিতোরের পতনের কাহিনী এই ঐতিহাসিক কাব্যখানির বিষয়বস্তু। ইহার একটি উক্তি

“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়।
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়।”

–বাংলাসাহিত্যে রঙ্গলালের নাম চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবে। বাংলা দেশ রঙ্গলাল এবং তাঁহার কাব্য ভুলিয়া গিয়াছে কিন্তু তাহার এই উক্তি এখনও লোকের মুখে মুখে ফিরিতেছে।

রঙ্গলালের দ্বিতীয় কাব্য ‘কর্মদেবী’ও ১৮৬২ সনে রাজপুতকাহিনী অবলম্বনে রচিত। কিন্তু ইহার পূর্বেই মধুসূদন দত্ত বাংলা পদ্যসাহিত্যে এক নূতন যুগ আনয়ন করেন। রঙ্গলালের তৃতীয় কাব্য ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮) রাজপুত-ইতিহাসের একটি কাহিনী অবলম্বনে এবং চতুর্থ কাব্য কাঞ্চীকাবেরী’ (১৮৭৯) উড়িয়া কবি পুরুষোত্তম দাসের লেখা ঐ নামের একটি প্রাচীন উড়িয়া কাব্যের কাহিনী অবলম্বনে রচিত।

(গ) মাইকেল মধুসূদন দত্ত

আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র ও পদ্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্ত (১৮২৪ ১৮৭৪) যুগান্তর আনয়ন করেন। উভয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্যও লক্ষ্য করা যায়। উভয়েই ইংরেজীসাহিত্যে কৃতবিদ্য; উভয়েই প্রথমে ইংরেজীভাষায় গ্রন্থ লিখিয়া সাহিত্যিক জীবন আরম্ভ করেন কিন্তু শীঘই বাংলাভাষার দিকে আকৃষ্ট হন, এবং উভয়েরই রচনা পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের দ্বারা বিশেষ প্রভাবান্বিত। একজন উপন্যাসে, আর একজন কাব্যে, বিষয়বস্তু ও ভাষার রীতিতে যে সম্পূর্ণ এক নূতন পন্থা প্রদর্শন করেন তাহা উনিশ শতকের শেষার্ধে রবীন্দ্রনাথের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত উপন্যাস ও কাব্যরচনার আদর্শ ভাষা ও বিষয়বস্তু বলিয়া পরিগণিত হইত। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন উপন্যাস ব্যতীত ধর্মতত্ত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ, এবং গ্রন্থ-সমালোচনা প্রভৃতি বিভিন্ন বিভাগের পথপ্রদর্শক, মধুসূদনও তেমনি মহাকাব্য ব্যতীত ‘খণ্ডকাব্য’, ব্রজাঙ্গনা’ ও ‘বীরাঙ্গনা’, সনেট (চতুর্দশপদী কবিতাবলী) এবং নাটক ও প্রহসন লিখিয়া বঙ্গসাহিত্যের নূতন নূতন দ্বার খুলিয়া দিলেন।

মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় সংস্কৃতের অনুকরণে ত্রিপদী, পয়ার প্রভৃতি ছন্দেরই ব্যবহার হইত এবং তাহাতে যমক, অনুপ্রাস প্রভৃতির বাহুল্য ছিল। মধুসূদন এইগুলি বর্জন করিয়া পয়ারের বাঁধ ভাঙ্গিয়া, দুই চরণের অন্ত্য অক্ষরের মিল উপেক্ষা করিয়া যে একপ্রকার নূতন ছন্দের প্রবর্তন করেন তাহা সাধারণতঃ অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলিয়া পরিচিত। ইহার প্রকৃতি সম্বন্ধে সুকুমার সেন বলেন :

“অমিত্রাক্ষর বিদেশি প্রভাবজাত কিন্তু বিদেশি বস্তু নয়, আসলে ইহা পয়ারই। তফাতের মধ্যে এই যে পুরাণো পয়ারে যেমন দুই চরণে (অর্থাৎ আটাশ অক্ষরে) শেষ যতি পড়ে, অমিত্রাক্ষর পয়ারে তেমন নয়, এখানে শম যত-খুসি চরণের পর যে-কোন পূর্ণ যতিতে (অর্থাৎ প্রথম আট বা শেষ ছয় অক্ষরের পরে) অথবা অর্ধ যতিতে (অর্থাৎ প্রথম অর্ধে চার ও শেষ অর্ধে তিন অক্ষরের পরে হইতে পারে।) পয়ারের মিলের বন্ধনীতে দুই চরণের মধ্যে বাক্য শেষ করিতেই হয়। পয়ারের এই দুই-চরণের নিগড় ভাঙ্গিয়া মধুসূদন ছন্দের ওসার বাড়াইয়া বাক্য-প্রসারের অবকাশ দিলেন,–ইহাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল রহস্য। বস্তুত মিল না থাকাটাই বড় কথা নয়, যতি সংখ্যার উপচয় অর্থাৎ ছন্দের প্রবহমাণতাই অমিত্রাক্ষরের বৈশিষ্ট্য।”৩৫

অমিত্রাক্ষর ছন্দে মধুসূদনের প্রথম রচনা তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৫৯ ৬০) বিশেষ সমাদর লাভ করে নাই। কিন্তু সাহিত্যরসিকগণ ইহাতেই বাংলাকাব্যের ইতিহাসে এক নূতন যুগের সম্ভাবনা দেখিতে পান। রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁহার ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ নামক পত্রিকায় ইহার প্রথম সর্গ মুদ্রিত করেন (১৮৫৯) এবং ভূমিকায় লেখেন–”ইহার রচনা প্রণালী অপর সকল বাঙ্গালী কাব্য। হইতে স্বতন্ত্র। ইহাতে ছন্দ ও ভাবের অনুশীলন ও অন্ত্যযমকের পরিত্যাগ করা হইয়াছে।” ইহার বাইশ বৎসর পরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন : “আমরা মাইকেলের তিলোত্তমাসম্ভব প্রকাশ হইতে নূতন সাহিত্যের উৎপত্তি ধরিয়া লইব। যদি ইহার পূর্বে এরূপ নূতন সাহিত্যের কিছু থাকে, কেহ আমাদিগের সেই অন্ধকার দূর করিয়া দিলে একান্ত বাধিত হইব।”৩৬।

মহাভারতে বর্ণিত সুন্দ, উপসুন্দ ও তিলোত্তমার কাহিনী অবলম্বনে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য রচিত হইয়াছে। কাব্যটির স্থানে স্থানে কবিত্বশক্তির পরিচয় পাওয়া গেলেও সমগ্রভাবে কাব্যটি আকর্ষণীয় হইতে পরে নাই। ইহার কোন চরিত্রও জীবন্ত হয় নাই। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত প্রথম বাংলাকাব্য বলিয়া ইহার বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। কিন্তু এই কাব্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দ সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন নহে, ইহার মধ্যে ধ্বনিপ্রবাহ খণ্ডিত হওয়ার যথেষ্ট নিদর্শন আছে।

১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে পুরাপুরি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মধুসূদনের অমর কাব্য ‘মেঘনাদবধ প্রকাশিত হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য এই যে, ঐ বৎসরেই রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। মেঘনাদবধ’কে সমালোচকেরা মহাকাব্য’ আখ্যা দিয়াছেন। রামায়ণ-মহাভারত যে-অর্থে মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ সেই অর্থে মহাকাব্য নয়। কিন্তু দান্তের Divina Comedia এবং মিল্টনের Paradise Lost-এর মত ‘মেঘনাদবধ’কে Literary Epic বা সাহিত্যিক মহাকাব্য বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে। এই শ্রেণীর মহাকাব্যের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসমূহ- প্রাচীনকালের পটভূমি, ভাষার সারল্য ও স্পষ্টতা, ভাবের গভীরতা ও বলিষ্ঠতা- ‘মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যায়। উপরন্তু মধুসূদন বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্যদর্পণে নির্দেশিত মহাকাব্যের লক্ষণসমূহের মধ্যে অনেকগুলি ‘মেঘনাদবধে’ রূপায়িত করিয়াছেন। এই শ্রেণীর মহাকাব্যে সমসাময়িক যুগচেতনার প্রতিচ্ছায়া পড়িয়া থাকে, ‘মেঘনাদবধেও পড়িয়াছে। প্রচলিত মূল্যবোধ সনাতন ভারতীয় আদর্শের বিরুদ্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী-শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙ্গালী তরুণদের বিদ্রোহ ও তাহাদের স্বাধীন চিন্তার প্রতিচ্ছায়া এই কাব্যে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। ‘মেঘনাদবধে’ মধুসূদন রাম-লক্ষ্মণ অপেক্ষা রাবণ-মেঘনাদকে বড় করিয়া প্রচলিত আদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছেন; এই কাব্যের রাবণ ও মেঘনাথ অসভ্য রাক্ষস নয়, তাহারা সুসভ্য রাজা রাজপুত্র– মহত্ত্ব, বীরত্ব, দেশপ্রেম প্রভৃতি সদ্‌গুণে ভূষিত। মেঘনাদবধ কাব্যের প্রত্যেকটি মুখ্য চরিত্রই জীবন্ত। বিশেষত রাবণ-চরিত্রটি কবির এক আশ্চর্য সৃষ্টি। একদিকে বিরাট ঐশ্বর্য, বিরাট গৌরব, অপরদিকে নিয়তির বিরূপতা, উপর্যুপরি পুত্রশোক- এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়াইয়া মহাতেজস্বী রাজেন্দ্র রাবণ ট্রাজেডির মূর্ত প্রতীকরূপে প্রতীয়মান হইয়াছে। ইন্দ্রজিতের স্ত্রী প্রমীলাও তাঁহার এক অভিনব সৃষ্টি। রামায়ণের কাহিনী তিনি এই কাব্যে সম্পূর্ণ এক নূতন ছাঁচে ঢালিয়াছেন। ইহার একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত সরমার নিকট সীতার বিলাপ—

ছিনু মোরা সুলোচনে গোদাবরী তীরে
কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ চূড়ে
বান্ধি নীড় থাকে সুখে।

আর একটি দৃষ্টান্ত এই মহাকাব্যের শেষাংশে প্রমীলা ও রাবণের বিলাপ। মধ্যযুগের কবিতায় ইহা দুর্লভ। উনিশ শতকে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার সংস্পর্শে আসিবার পূর্বে কোন বাঙ্গালী কবি এই শ্রেণীর কবিতা লেখেন নাই।

বাংলা অমিত্রাক্ষর ছন্দ এই কাব্যে পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছে। এই কাব্যের ভাষা অপূর্ব ওজোগুণে মণ্ডিত; প্রচুর পরিমাণে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিয়া এবং বহুলমাত্রায় নামধাতু প্রয়োগ করিয়া মধুসূদন এই ওজোগুণ সৃষ্টি করিয়াছেন। মধুসূদনের ভাষায় কোথাও কোথাও দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, যেমন- ‘যাদঃপতিরোধঃ যথা চলোর্মি আঘাতে। এইরূপ অভিধানিক সংস্কৃত শব্দের বিন্যাসের বিরুদ্ধে অনেকেই তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলেন–কিন্তু মধূসূদনের কঠোর সমালোচক কিশোর রবীন্দ্রনাথের মতে এই ছত্রটিতে “ভাবের অনুযায়ী কথা বসিয়াছে, ঠিক বোধ হইতেছে যেন তরঙ্গ বার বার আসিয়া তটভাগে আঘাত করিতেছে”।৩৭ ইহাও একেবারে অমূলক বলা যায় না।

‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ বহু ভারতীয় ও পাশ্চাত্ত্য কবির প্রভাব দেখা যায়। ভারতীয় কবির মধ্যে প্রধান বাল্মীকি ও কৃত্তিবাস; ইহাদের রচিত সংস্কৃত ও বাংলা রামায়ণ হইতে মধুসূদন তাঁহার কাব্যের উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছেন এবং সেজন্য তিনি হঁহাদের কাছে ঋণ স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু এই কাব্যের কাহিনী, বর্ণনা এবং চরিত্র-চিত্রণে মধুসূদন অনেকাংশে হোমার, ভার্জিল, দান্তে, ট্যাসো, মিল্টন প্রভৃতি পাশ্চাত্ত্য কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছে। মিল্টন কর্তৃক ব্যবহৃত Blank Verse-এর আদর্শেই মধুসূদন অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু পাশ্চাত্ত্য কবিদের নিকট হইতে সংগৃহীত উপকরণগুলি মধুসূদন সম্পূর্ণ নিজস্ব করিয়া লইতে পারিয়াছেন বলিয়া তাহার কাব্যে বৈদেশিক গন্ধ পাওয়া যায় না।

মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যও ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই কারণে অনেকেই ইহাকে ‘মেঘনাদবধের সমকালীন রচনা বলিয়া মনে করিয়াছেন, কিন্তু মধুসূদনের চিঠিপত্র হইতে জানা যায় যে, ব্রজাঙ্গনা’র রচনা ইহার প্রকাশের বত্সরাধিককাল পূর্বে সমাপ্ত হইয়াছিল। ব্রজাঙ্গনা’ মিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। ইহাতে রাধার বিরহ বর্ণিত হইয়াছে।

১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশিত হয়। ইহা যীশুখ্রীষ্টের সমসাময়িক রোমান কবি ওভিদের Heroides নামক ল্যাটিন কাব্যের আদর্শে রচিত। ওভিদের কাব্যে যেমন গ্রীক পুরাণ ও কাব্যের নায়িকারা পত্রের মধ্যদিয়া তাহাদের স্বামী বা প্রণয়ীর কাছে প্রেম নিবেদন করিয়াছে, তেমনই ‘বীরাঙ্গনা কাব্যেও সংস্কৃত পুরাণ ও কাব্যের নায়িকারা পত্রের ভিতর দিয়া তাহাদের স্বামী বা প্রণয়ীর কাছে অন্তরের কথা ব্যক্ত করিয়াছে। বীরাঙ্গনার’ পত্রগুলিতে বিভিন্ন ধরণের ভাব অভিব্যক্ত হইয়াছে। সূর্পণখা, ঊর্বশী, শকুন্তলা প্রভৃতি নায়িকাদের পত্রে প্রেম, দুঃশলা ও ভানুমতীর পত্রে ভয়, জাহ্নবীর পত্রে ঔদাসীন্য এবং কেকয়ী ও জনার পত্রে ক্রোধের অভিব্যক্তি দেখিতে পাওয়া যায়। অমিত্রাক্ষর ছন্দ যে শুধু ওজোগুণ-সমন্বিত বিষয়বস্তু নহে, নারীহৃদয়ের সুকুমার অনুভূতিও রূপায়ণে সক্ষম, ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে মধুসূদন তাহাই প্রমাণ করিয়াছেন; আবার নারীর উক্তির মধ্যেও যে ওজোগুণ স্ফুর্ত হইতে পারে, দশরথের প্রতি কেকয়ী’ ও ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রিকায় তাহার নিদর্শন পাওয়া যায়।

ইহার পর মধুসূদন অনেকগুলি কাব্য এবং ‘হেক্টর বধ’ নামে একটি গদ্যগ্রন্থও রচনা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন; কিন্তু কোনটিই শেষ করিতে পারেন নাই। হেক্টর বধ অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই তিনি প্রকাশ করেন (১৮৭১)। ইহাতে ইলিয়াড কাব্যের কাহিনীর একাংশ বর্ণিত হইয়াছে।

১৮৫৮ হইতে ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মধুসূদনের প্রায় সব বিশিষ্ট গ্রন্থই প্রকাশিত হয়। তাঁহার দুইটি বিখ্যাত কবিতা-’আত্মবিলাপ’ ও ‘বঙ্গভূমির প্রতিও এই সময়েই রচিত ও প্রকাশিত হয়। এই সময়ের মধ্যেই তিনি প্রথম একটি বাংলা সনেট রচনা করেন; তাহার নাম কবি-মাতৃভাষা’। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে মধুসূদন ইংলণ্ডে যান। ইংলণ্ড ও ফ্রান্সে কয়েক বৎসর কাটাইবার পর তিনি ব্যারিস্টার হইয়া দেশে ফিরেন। বিদেশে অবস্থানের সময়ে মধুসূদন অনেকগুলি বাংলা সনেট রচনা করেন। তাঁহার ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ গ্রন্থে (১৮৬৬) সেগুলি সংকলিত হইয়া প্রকাশিত হয়। এই সনেটগুলি মধুসূদনের বিশিষ্ট সৃষ্টিসমূহের অন্যতম। ইহাদের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যও অপরিসীম। ইহাদের কতকগুলি পেত্রার্ক ও দান্তে প্রভৃতি বিদেশী কবিদের ও কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি স্বদেশী কবিদের প্রতি মধুসূদনের শ্রদ্ধা নিবেদন। সুদূর প্রবাসে বসিয়া দেশের জন্য তাহার মন উদ্বেলিত হইয়া উঠিত; তাহারই ছাপ রহিয়া গিয়াছে নদীতীরে দ্বাদশ শিবমন্দির’, ‘কপোতাক্ষ নদ’, ‘বৌ কথা কও’ প্রভৃতি সনেটের মধ্যে। আবার কোন কোন সনেটে তাহার সাময়িক অনুভূতি অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে; যেমন–কোন পুস্তকের ভূমিকা পড়িয়া’। মধুসূদনের সনেটগুলি চৌদ্দ অক্ষরের পয়ার ছন্দে রচিত। আঙ্গিকের দিক দিয়া বা রসের দিক দিয়া তাঁহার সব সনেট নিখুঁত নহে। কিন্তু দুইটি কারণে ইহাদের গুরুত্ব অপরিসীম; প্রথমত, বাংলা সাহিত্যে এই সর্বপ্রথম কবির আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস এরকম সংহতরূপে অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে; দ্বিতীয়ত, এই সনেটগুলিতে মধুসূদনের মনোরাজ্যের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়।

মধুসূদন ছোটদের জন্য অনেকগুলি সুন্দর নীতি-কবিতা রচনা করিয়াছিলেন; যেমন রসাল ও স্বর্ণলতিকা’, ‘গদা ও সদা’, ‘দেবদৃষ্টি’ প্রভৃতি। ইহাদের কোনটি মৌলিক, আবার কোনটিতে Aesop’s Fables ও ‘হিতোপদেশ’-এর প্রভাব দেখা যায়। বাংলা শিশুসাহিত্যেরও মধুসূদন পথিকৃৎ।

যতদূর জানা যায়, মধুসূদনের বিখ্যাত সমাধিলিপিটিই তাঁহার শেষ কবিতা।

মধুসূদনের অনুকরণে বহু কাব্য ও কবিতা রচিত হইয়াছে। ব্রজনাথ মিত্রের কাদম্বরী কাব্য’ মধুসূদনের প্রায় আক্ষরিক অনুকরণ। দীননাথ ধরের কংশবিনাশ কাব্য (১৮৬১), রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘দানবদলন কাব্য’ প্রভৃতি ‘মেঘনাদবধ’ এর অক্ষম অনুকরণের নিদর্শন। বীরাঙ্গনা ও ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যের এবং ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’রও অনেক অনুকরণ হইয়াছিল। মেঘনাদবধের ‘প্যারডি’ হিসাবে জগদ্বন্ধু ভদ্র ‘ছুছুন্দরীবধ কাব্য রচনা করেন। মুসলমান কবি মুহম্মদ কাজেম ওরফে কায়কোবাদ’ (১৮৫৪-১৯৫১) রচিত ‘মহাশ্মশান’ (১৯০৪) ‘মেঘনাদবধ কাব্যের অনুসরণে-পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ও মারাঠা শক্তির পতনকাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘মহাকাব্য।

(ঘ) মধুসূদনের পরবর্তী কবিগণ

মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যবর্তী সময়ে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরীনচন্দ্র সেন এই দুই কবিই বিশেষ প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন এবং কবিতার এই যুগ সাধারণত হেম-নবীনের যুগ বলিয়াই অভিহিত। কিন্তু হঁহাদের সমসাময়িক বিহারীলাল চক্রবর্তী ও সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার খুব খ্যাতনামা না হইলেও কবিপ্রতিভার বিশিষ্ট ছাপ রাখিয়া গিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে কবি বিহারীলালের প্রসঙ্গ থাকায় তিনি বর্তমান যুগে খানিকটা পরিচিত, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ বর্তমান যুগে বিস্মৃতপ্রায়।

বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-৯৪) শ্রেষ্ঠ কাব্য সারদামঙ্গল’ (১২৮৬ সাল)। তাঁহার অন্যান্য রচনার মধ্যে সাধের আসন’, ‘প্রেমপ্রবাহিনী’, ‘বন্ধুবিয়োগ, ‘নিসর্গসন্দর্শন’, ও ‘বঙ্গসুন্দরী’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই কাব্যগুলিতে যে ‘আত্মগত অন্তরঙ্গ ভাব ফুটিয়াছে তাহা তখনকার বাংলা সাহিত্যে অভিনব বস্তু ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, “বিহারীলালের মনের চারিদিক ঘেরিয়া কবিত্বের একটি রশ্মিমণ্ডল তাঁহার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিত, তাঁহার মধ্যে পরিপূর্ণ একটি কবির আনন্দ ছিল।”৩৮ বর্তমান একজন সমালোচক যথার্থই মন্তব্য করিয়াছেন, “হৃদয়াবেগের প্রবলতা ফেনোচ্ছ্বসিত হওয়ায় বিহারীলালের কাব্যের বিষয় তলাইয়া গিয়া প্রায়ই স্পষ্ট ও সুসংহত হইতে পারে নাই…তবুও স্বীকার করিতে হইবে যে বিহারীলালের কাব্যে কল্পনা যেমন মৌলিক ভাষাও মোটামুটি তেমনি প্রকাশক্ষম।”৩৯

সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের (১৮৩৮-৭৮) শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘মহিলা তাঁহার মৃত্যুর পর ১৮৮০ সনে প্রকাশিত হয়, কিন্তু ইহা প্রায় দশবৎসর পূর্বে রচিত। কেহ কেহ মনে করেন, এই কাব্যের পরিকল্পনা বিহারীলালের বঙ্গসুন্দরী’ পাঠের ফল। বিহারীলালের মত সুরেন্দ্রনাথও প্রেমের কবি। নারীর মহিমা সম্বন্ধে কবির খুব উচ্চধারণা ছিল। মহিলা কাব্যে তিনি নারীপ্রকৃতি যে নরপ্রকৃতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এই ধারণা নারীর মাতা’ ও ‘জায়া’ রূপের মধ্যদিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ভগ্নী-রূপের বর্ণনাও তিনি লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই।

সুরেন্দ্রনাথের আরও অনেক খণ্ডকবিতা ও কাব্য আছে। সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার সুরেন্দ্রনাথের কাব্যের উৎকর্ষ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিয়া বাংলার এই উপেক্ষিত কবিকে স্বমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন। কিন্তু এই চেষ্টা বিশেষ সফল হয় নাই।

গদ্যসাহিত্য প্রসঙ্গে উল্লিখিত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাংলার একজন উপেক্ষিত কবি। তাঁহার স্বপ্ন প্রয়াণ’ (১৮৭৫) মনোজগতের রূপক এবং এই হিসাবে স্পেন্সরের ‘ফেয়ারী কুইন’ এবং বানিয়ানের ‘পিলগ্রিমস্ প্রোগ্রেস’, এই দুইখানি প্রসিদ্ধ ইংরেজী গ্রন্থের সঙ্গে তুলনীয়। ইহা আধ্যাত্মিক কাব্য নয়, পুরাপুরি রসাত্মক কাব্য।৪০ ইহার মধ্যে কবি স্বপ্নদর্শনের রূপকের মধ্যদিয়া নিজের অন্ত জীবনের সাধনা ও সংগ্রামের আলেখ্য অঙ্কন করিয়াছেন।

ইঁহাদের তুলনায় উনিশ শতকের আর দুইজন কবি হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র, অনেক বেশী পরিমাণে খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন, এবং তাঁহাদের কবিতার সমাদর হ্রাস পাইলেও এখনও বিলুপ্ত হয় নাই।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩) প্রধানতঃ দেশপ্রেমমূলক কবিতার জন্যই আজও স্মরণীয় হইয়া আছেন। তাঁহার ‘ভারত বিলাপ’, ‘ভারত ভিক্ষা’, ‘ভারত সঙ্গীত’,৪১ ‘রিপন উৎসব–ভারতের নিদ্রাভঙ্গ’ প্রভৃতি কবিতাগুলি এই শতকের প্রথমে লোকের মুখে-মুখে ফিরিত ও অপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি করিত। ইলবার্ট বিল উপলক্ষে সাহেবদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে নেভার-নেভার এবং কলিকাতার একটি ব্রাহ্মণ-পরিবারে ব্রিটিশ যুবরাজের অভ্যর্থনা ও সমাদর উপলক্ষে রচিত ‘বাজিমাৎ-হেমচন্দ্রের এই দুইটি ব্যঙ্গ কবিতাও এককালে বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। হেমচন্দ্রের প্রথম ক্ষুদ্রকাব্য ‘চিন্তা তরঙ্গিণী’ ১৮৬১ ও দ্বিতীয় কাব্য ‘বীরবাহু’ ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁহার শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বৃত্রসংহার কাব্য (১৮৭৫-৭৭) পৌরাণিক আখ্যান অবলম্বনে লিখিত হইলেও ইহাতে তাঁহার নিজস্ব অবদান ও ইংরেজী কাব্যের অনুকরণ আছে। একশ্রেণীর লেখক, এবং কিশোরবয়সে রবীন্দ্রনাথও, ‘মেঘনাদবধের তুলনায় ‘বৃত্রসংহার’কে উচ্চতর আসন দিয়াছেন। কিন্তু ইহা স্বীকার করা কঠিন। “সাধারণ পাঠকের কাছে বৃত্রসংহারকে ছন্দের সহজ লালিত্য, রচনার প্রাঞ্জলতা এবং ভাবের সরলতা সবিশেষ সহজবোধ্য করিয়াছিল”৪২-বর্তমান একজন সমালোচকের এই উক্তি আংশিক সত্য হইলেও মধুসূদনের ভাষার ওজস্বিতার তুলনায় হেমচন্দ্রের ভাষার মৃদুমন্থর গতি সকলেই অনুভব করে এবং অনেককেই পীড়িত করে। মধুসূদনের সম্মুখ সমরে পড়ি বীরচূড়ামণি”…. অথবা নবীনচন্দ্রের “দ্বিতীয় প্রহর নিশি নীরব অবনী”– ইত্যাদি “মেঘনাদ বধ” ও “পলাশির যুদ্ধ” কাব্যের গ্রন্থারম্ভের প্রথম কয়েক পংক্তির সহিত ‘বৃত্রসংহারের’ আরম্ভ–”বসিয়া পাতালপুরে ক্ষুব্ধ দেবগণ ও পরবর্তী কয়েক পংক্তির তুলনা করিলে হেমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব মানিয়া লওয়া যায় না। বিষয়বস্তুর বিন্যাস, চরিত্রগঠন ও কবিতৃময় সৌন্দর্যবর্ণনা বিচার করিয়াও অনেকে ঐ একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। বর্তমান শতকের গোড়ায় বৃত্রসংহার’ ব্যতীত হেমচন্দ্রের পূর্বোক্ত দুইখানি ও পরবর্তী অন্য দুইখানি কাব্য ‘আশা কানন (১৮৭৬) ও ছায়াময়ী’ (১৮৮০) প্রভৃতির বিশেষ কোন সমাদর ছিল না। তাহার কবিখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত ছিল কবিতাবলী’র (দুই খণ্ড ১৮৭০, ১৮৮০) উপর। কবিতাবলী’র অন্তর্গত দেশাত্মবোধক ও অন্যান্য কবিতাই (বৃত্রসংহার নহে) এখনও তাঁহার কবিপ্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয় বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। হেমচন্দ্রের ব্যঙ্গকবিতা ‘হুতোম প্যাচার গান’ আর-একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। তিনি নাকে খৎ’ নামে একটি হাস্যরসাত্মক কাব্যও লিখিয়াছিলেন। ব্যঙ্গকবিতা রচনায় তাঁহার সহজাত দক্ষতা ছিল। হেমচন্দ্রের অন্যান্য রচনার মধ্যে ‘দশমহাবিদ্যা’ (১৮৮২) আধ্যাত্মিক ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত। অনেকে ইহার আধ্যাত্মিক দৃষ্টির উচ্চপ্রশংসা করিয়াছিলেন, কিন্তু প্রাচীন ও প্রবীণ সমালোচক অক্ষয়চন্দ্র সরকার মন্তব্য করিয়াছিলেন “দুর্ভাগ্যক্রমে দশমহাবিদ্যার দর্শন-ভাগ আমরা কিছুই বুঝিতে পারি নাই।” হেমচন্দ্র শেক্সপীয়রের দুইখানি নাটকের ছায়া অবলম্বনে ‘নলিনী বসন্ত’ (১৮৬৮)৪৩ ও রোমিও জুলিয়েত (১৮৯৫) রচনা করেন।

নবীনচন্দ্র সেনের (১৮৪৭-১৯০৯) প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অবকাশ রঞ্জিনী’ প্রথম খণ্ড (১৮৭১) বিভিন্নকালে রচিত কতকগুলি কবিতার সমষ্টি। ইহার মধ্যদিয়াই প্রকৃত ‘লিরিক’ বা পাশ্চাত্ত্য গীতিকবিতার প্রথম গুঞ্জন শোনা যায়। ইহার প্রথম কবিতা ‘পিতৃহীন যুবক, এবং বিধবা কামিনী’ ও অন্যান্য কয়েকটি কবিতা কবির ছাত্রাবস্থায় রচিত হইলেও, প্রবীণ সাহিত্যিক প্যারীচরণ সরকার ও কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য এগুলির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এডুকেশন গেজেটে’ ইহা ছাপা হয়। নবীনচন্দ্রের কয়েকটি দেশপ্রেমমূলক কবিতা ‘অবকাশ রঞ্জিনী’র দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ইহার মধ্যে যুবরাজ এডওয়ার্ডের ভারত-আগমন উপলক্ষে রচিত ভারত-উচ্ছ্বাস’ (১৮৭৫) একটি প্রথমশ্রেণীর কবিতা বলিয়া আদৃত হয় এবং ইহার জন্য ভারত-সরকার কবিকে পঞ্চাশ গিনি পুরস্কার দেন। হিন্দুর অতীত গৌরবের স্মৃতি এই কবিতার মাধ্যমে যেরূপ মর্মস্পর্শী ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছে তাহা প্রায় অতুলনীয় বলা যায়। ইহাকে হেমচন্দ্রের অনুকরণ মাত্র মনে করিলে৪৪ কবির প্রতি অবিচার করা হইবে। ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘পলাশির যুদ্ধ প্রকাশিত হইলে নবীনচন্দ্রের কবিখ্যাতি সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়। এই কাব্যে রূপায়িত সিরাজউদ্দৌলার চরিত্র ও ঘটনার পরিবেশ অনেক স্থলে ঐতিহাসিক সত্যের বিরোধী, বর্তমান যুগের গবেষণায় তাহা প্রতিপন্ন হইয়াছে। কিন্তু সে-যুগে প্রচলিত ধারণার উপর কিছু কল্পনা মিশ্রিত করিয়া কবি যে-কাব্য রচনা করিয়াছেন, ভাষা ও ভাবের দিক দিয়া তাহা খুব উচ্চশ্রেণীর কাব্য বলিয়া পরিগণিত হয়। কালীপ্রসন্ন ঘোষ তাঁহার ‘বান্ধব’ পত্রিকায় ইহার অসাধারণ কবিত্বের” উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া বলেন, “যতদিন বঙ্গভাষা জীবিত থাকিবে ততদিনই ইহার প্রফুল্লকান্তি বঙ্গবাসীর হৃদয়-দর্পণে প্রতিফলিত হইবে।”

‘পলাশির যুদ্ধের পর নবীনচন্দ্রের ‘ক্লিওপেট্রা’ (১৮৭৭) ও রঙ্গমতী’ (১৮৮০) প্রকাশিত হয়। নবীনচন্দ্র চট্টগ্রামের অধিবাসী। রঙ্গমতী বা রাঙ্গামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা তাঁহার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল ও বিশেষ হৃদয়গ্রাহী।

ইহার ছয় বৎসর পরে ক্রমান্বয়ে ‘রৈবতক’ (১৮৮৬) কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) এবং প্রভাস’ (১৮৯৬) প্রকাশিত হয়। এই তিনখানি কাব্যের কেন্দ্রীয় ঘটনা যথাক্রমে সুভদ্রাহরণ, অভিমন্যুবধ এবং যদুবংশ-ধ্বংস।

বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্রের দ্বিতীয় সংস্করণে (১৮৯২) ঐতিহাসিক বিচার দ্বারা কৃষ্ণচরিত্রের যে অপরূপ ও অভিনব ব্যাখ্যা করেন, নবীনচন্দ্রও উক্ত কাব্যত্রয়ীর’ মাধ্যমে সেইরূপ শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করিয়া মহাভারতের কাহিনীর মধ্যে এক নূতন আদর্শের প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হন। তাঁহার কল্পনায় শ্রীকৃষ্ণ যে মহান উদ্দেশ্য সাধন করিতে ধরাধামে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন তাহা মূলতঃ নিষ্কাম কর্ম ও নিষ্কাম প্রেমের আদর্শস্থাপন ও তাহার ফলস্বরূপ আর্য ও অনার্যের মধ্যে প্রীতির বন্ধন স্থাপন করিয়া হিন্দুসংস্কৃতির উন্নতিসাধন। অনেক সমালোচকের মতে কবিত্বের রস ও মাধুর্য, চরিত্রের (বিশেষতঃ নারীচরিত্রের) সৃষ্টি এবং কল্পনার বিশালতা এই সকলের অপূর্ব সংমিশ্রণে নবীনচন্দ্রের এই কাব্যত্রয়ী “বাংলা ভাষার কণ্ঠে একটি কমনীয় হার স্বরূপ বিরাজ করিবে।

নবীনচন্দ্র প্রথমে যীশুখ্রীষ্ট, এবং পরে বুদ্ধ ও চৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে সুললিত ও সহজ ভাষায় তিনখানি ক্ষুদ্রকাব্য রচনা করেন। ইহাদের নাম যথাক্রমে ‘খ্রষ্ট’ (১২৯৭ সাল), অমিতাভ’ (১৩০২ সাল), ও ‘অমৃতাভ’ (১৩১৬ সাল)। নবীনচন্দ্র ভগবদ্গীতার এবং মার্কেগুয় চণ্ডীর পদ্যানুবাদ করেন (১৮৮৯, ১৮৯৪)। নবীনচন্দ্রের প্রবাসের পত্র’ (১৮৯২), ভানুমতী” (আখ্যায়িকা, ১৩০৭) ও আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ (১৩১৪-২০) গদ্যরচনার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক আরও কয়েকজন কবির রচনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। কেহ কেহ বলেন, “উদাসিনী’ (১৮৭৪) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫০-১৮৯৮) “বাঙ্গালা সাহিত্যে রোমান্টিক আখ্যায়িকা-কাব্য ও গাথা-কবিতার প্রবর্তন করিয়াছিলেন।”৪৫ এই শ্রেণীর একজন ছন্দজ্ঞ কবি বলদেব পালিত (১৮৩৫-১৯০০)। ইহার কাব্যমঞ্জরী (১৮৬৮), ভর্তৃহরি কাব্য (১৮৭২) ও কর্ণার্জুন কাব্য (১৮৭৫) কবিতাগ্রন্থে ছন্দোনৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

হেমচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও (১৮৫৬-১৮৯৭) কবি ছিলেন। তিনি কয়েকখানি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৪৯-৯৪) গদ্যে ও পদ্যে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। বস্তুতঃ মধুসূদনের পর বাংলায় কবিযশঃপ্রার্থীর সংখ্যা ছিল বহু, কিন্তু তাঁহাদের অনেকেরই নাম ও রচনা বিস্মৃতির গহ্বরে বিলীন হইয়াছে।

বিহারীলাল ও রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হইলেও দেবেন্দ্রনাথ সেনের (১৮৫৫-১৯২০) একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তিনি কয়েকখানি কাব্য ও অনেকগুলি সরস কবিতা লিখিয়াছেন। নারীপ্রেমের বিচিত্র প্রকাশ তাঁহার কাব্যে মুখ্যস্থান অধিকার করিয়াছে, পরিণত বয়সের কবিতায় বাৎসল্যরসও আছে। সনেট রচনাতেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থ ফুলবালা’ (১৮৮০) ও ‘অশোকগুচ্ছ’ (১৯০০)।

সমসাময়িক কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৫-১৯১৮) হতাশ প্রেমের কবি। তাঁহার জন্ম পূর্ববঙ্গে এবং এই অঞ্চলের কতকগুলি বিশেষত্ব গোবিন্দচন্দ্রের কবিতায়ই প্রথম পরিস্ফুট হইয়াছে। যৌবনের একাধিক সঙ্গিনী ও সহধর্মিণীর প্রতি ভালবাসা এবং তাঁহাদের অকালমৃত্যুই গোবিন্দচন্দ্রের কবিতার উৎস। ইহার মধ্যদিয়া যে দেহসর্বস্ব প্রেমের উচ্ছ্বাস প্রবাহিত হইয়াছে তাহা গোবিন্দচন্দ্রের কবিতার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। গোবিন্দচন্দ্র ইংরেজীসাহিত্যের সহিত পরিচিত ছিলেন না এবং তাঁহার কবিতায় অমার্জিত সরল সহজ গ্রাম্য ভাব যেরূপ পরিস্ফুট হইয়াছে তাহা সে-যুগে অপরিচিত ছিল। ভাওয়ালের রাজপরিবারের অত্যাচারে উৎপীড়িত, হৃতসর্বস্ব পূর্ববঙ্গের এই জনপ্রিয় কবি শেষজীবনে দারিদ্র্যের ও অভাবের তাড়নায় কয়েকটি মর্মন্তুদ কবিতা লিখিয়াছিলেন। তাঁহার এইশ্রেণীর ব্যঙ্গকাব্য ‘মগের মুলুক’ (১২৯৯ সাল) ও অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ- ‘প্রেম ও ফুল’ (১২৯৪), কুঙ্কুম’ (১২৯৮), কস্তুরী (১৩০২), চন্দন’ (১৩০৩), ফুলরেণু (১৩০৩), প্রভৃতি কবিতা পূর্ববঙ্গে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।

অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৮) পাঁচখানি কাব্যগ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন—‘প্রদীপ’ (১৮৮৪), ‘কনকাঞ্জলি’ (১৮৮৫), ‘ভুল’ (১৮৮৭), ‘শঙ্খ’ (১৯১০) এবং ‘এ’ (১৯১২)। তাহার কাব্যে বিহারীলাল চক্রবর্তীর হৃদয়োচ্ছ্বাস এবং সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের সংযম ও যুক্তিনিষ্ঠ ভাবাবেগের সমন্বয় সাধিত হইয়াছে। ‘এ’ কাব্যে তাঁহার পত্নীবিয়োগজনিত শোক অভিব্যক্ত হইয়াছে; সমালোচকদের মতে এটিই তাঁহার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) রচিত ‘আর্যগাথা’ (১৮৮২-১৮৯৩), ‘আষাঢ়ে’ (১৮৯৯), ‘হাসির গান’ (১৯০০), মন্দ্র (১৯০২), ‘আলেখ্য’ (১৯০৭) এবং ‘ত্রিবেণী’ (১৯১২) কবি হিসাবে তাঁহার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। দ্বিজেন্দ্রলালের কবিতার দুইটি প্রধান গুণ-গীতিমাধুর্য এবং ব্যঙ্গরস; তাঁহার অনেক কবিতায় এই দুইটি পরস্পরবিরোধী গুণের বিস্ময়কর সমন্বয় দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহার কবিতার ভাষা গদ্যের ভাষার কাছাকাছি, কিন্তু ছন্দোমণ্ডিত ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। দ্বিজেন্দ্রলালের অননুকরণীয় হাসির গানগুলি অনাবিল কৌতুকরসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ও অত্যন্ত উপভোগ্য। তিনি অনেকগুলি স্বদেশী গানও রচনা করিয়াছিলেন উচ্ছ্বসিত দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি হিসাবে এগুলির জনপ্রিয়তা আজিও অম্লান। দ্বিজেন্দ্রলালের গানগুলি সুরের দিক দিয়াও অনবদ্য সৃষ্টি।

রজনীকান্ত সেন (১৮৮৫-১৯১০) প্রধানতঃ সঙ্গীত-রচয়িতা। তাঁহার জীবিতকালে বাণী (১৯০২), ‘কল্যাণী’ (১৯০৫) এবং ‘অমৃত’ (১৯১০)- এই তিনটি, এবং মৃত্যুর পরে ‘আনন্দময়ী’ (১৯১০), ‘বিশ্রাম’ (১৯১০), ‘অভয়া’ (১৯১০), ‘সদ্ভাব-কুসুম’ (১৯১৩) এবং ‘শেষ দান’ (১৯২৭)– এই পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। রজনীকান্ত ভক্তিমূলক গান, হাসির গান, স্বদেশী গান ও নীতিকবিতা রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন, কিন্তু ভক্তিমূলক গানগুলিই তাঁহার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, এবং ইহার মধ্যদিয়াই কবির গভীর ভক্তিভাবের অভিব্যক্তি হইয়াছে।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক স্বর্ণকুমারী দেবী, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু এবং প্রিয়ম্বদা দেবী প্রভৃতি কয়েকজন মহিলা কবির নামও উল্লেখযোগ্য।

৪. নাটক

(ক) প্রস্তুতি-পর্ব

উনিশ শতকের মধ্যভাগে আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যের আবির্ভাব হয়। তাহার পূর্বে প্রধানত রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের জন্য যে সমুদয় গ্রন্থ রচিত হইত তাহাদিগকে প্রকৃত নাটক সংজ্ঞা দেওয়া যায় না, তবে বাংলা নাটকের প্রস্তুতি-পর্বের নাটকরূপে। তাহাদের কিছু মূল্য আছে। এই সমুদয় নাটকের অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত হইয়াছে। কোন্‌গুলি সত্য সত্যই অভিনীত হইয়াছিল তাহাও সঠিক বলা যায় না। ‘সাজবদল বা কাল্পনিক সংবদল’ নামে যে বাংলা নাটকটি বাংলার রঙ্গমঞ্চে সর্বপ্রথম অভিনীত হয় (১৭৯৫ খ্রী., ২৭ নভেম্বর) তাহা একখানি ইংরেজী নাটকের৪৫ক অনুবাদ।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রস্তুতি-পর্বের আরও কয়েকখানি নাটক রচিত হইয়াছিল। সংস্কৃত ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকের যে কয়েকখানি বাংলা অনুবাদ রচিত হইয়াছিল তাহার মধ্যে বিশ্বনাথ ন্যায়রত্নের অনুবাদ ১২৪৬ সালে লেখা হইলেও তাহা ৩১ বৎসর পর ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘আত্মতত্ত্ব কৌমুদী’ নামক ঐ গ্রন্থের অপর একটি অনুবাদ সম্ভবত প্রথম মুদ্রিত বাংলা নাটক। ঐ বৎসরই ‘হাস্যর্ণব’, ‘ধূর্ত নাটক’ ও ‘ধূর্ত সমাগম’ নামে সংস্কৃত হইতে অনূদিত তিনখানি প্রহসন প্রকাশিত হয়। অশ্লীলতার অপবাদে সমসাময়িক পত্রিকায় এগুলির বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হয়। ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে সংস্কৃত ‘কৌতুক-সর্বস্ব’ নাটকের, ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা এবং ১৭৭১ শকাব্দে (১৮৪৯-৫০) রত্নাবলী’ নাটকের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। মৌলিক রচনার মধ্যে দ্বারকানাথ রায়ের বিশ্বমঙ্গল’ (১৮৪৫ খ্রী.) এবং পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রমণী নাটক’ (১৮৪৮ খ্রী.) ও ‘প্রেমনাটক’ (১৮৫৪)–এই তিনখানি নক্শা বা প্রহসনজাতীয় নাটকের উল্লেখ করা যায়- ইহাতেও আদিরসের প্রাচুর্য আছে। শেষের দুইখানি ও পূর্বোক্ত ‘কৌতুক-সর্বস্ব’ নাটকে গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণ দেখিতে পাওয়া যায়।

পূর্বোক্ত গ্রন্থগুলি নাটক নামে অভিহিত হইলেও প্রকৃত নাটকের মর্যাদালাভের অধিকারী নহে। নাটক বলিতে আমরা যাহা বুঝি বা যাহা বুঝা উচিত, উপন্যাসের ন্যায় ইংরেজীসাহিত্যের অনুকরণেই তাহার সৃষ্টি হয়। ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত জি. সি. গুপ্তের কীর্তিবিলাস’ ও তারাচরণ শীকদারের ‘ভদ্রার্জুন বাংলার মৌলিক নাট্যরচনার প্রথম নিদর্শন। প্রথম নাটকখানি ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’র বিপত্তি দেখাইবার উদ্দেশ্যে রচিত এবং ইহার বিষয়বস্তু বাংলার প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন ‘বিজয়বসন্ত’ নামক কাহিনী। নাটকটি বিয়োগান্ত। ভদ্রার্জুন’ মিলনান্ত পৌরাণিক নাটক–ইহা যাত্রাগানের ঈষৎ পরিমার্জিত সংস্করণ। এই নাটকের সংলাপের অধিকাংশই পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। নাটকখানি অনেকাংশে সংস্কৃত নাটকের আদর্শ অনুসরণ করিলেও ইহাতে নান্দী, প্রস্তাবনা এবং বিদূষক-ভূমিকা নাই। ইংরেজী নাটকের ন্যায় ইহার অঙ্কগুলি সংযোগস্থল’ অর্থাৎ দৃশ্যে বিভক্ত, এবং ইংরেজী নাটকের Prologue-এর মত এই নাটকের আরম্ভে মূল কাহিনীর পূর্বকথা উপরে বর্ণিত হইয়াছে।৪৬ এইগুলি এবং ইহাদের অব্যবহিত পরবর্তীকালে রচিত কয়েকখানি নাটক সাহিত্যিক মর্যাদা লাভের উপযুক্ত ছিল না; কিন্তু ইহাদের কোন কোনটি একাধিকার কলিকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইয়াছিল। এইসব নাটকের মধ্যে হরচন্দ্র ঘোষের ভানুমতী-চিত্তবিলাস’ (Merchant of Venice অবলম্বনে রচিত), চারুমুখ-চিত্তহরা’ (Romeo and Juliet অবলম্বনে রচিত), ‘কৌরব বিয়োগ’ (কাশীরাম দাসের মহাভারত অবলম্বনে রচিত) এবং রজতগিরি’ (ব্রহ্মদেশীয় কাব্য অবলম্বনে রচিত) উল্লেখযোগ্য।

বাংলার প্রথম প্রসিদ্ধ নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-৮৬)। তাঁহার ‘কুলীন-কুল-সর্বস্ব’ (১৮৫৪) নামক প্রহসন খুবই খ্যাতি ও অর্থ অর্জন করিয়াছিল। ইহা ছাড়া তিনি আরও কয়েকখানি সামাজিক প্রহসন, তিনখানি পৌরাণিক নাটক ও একখানি প্রচলিত আখ্যায়িকাঘটিত নাটক রচনা করিয়াছিলেন এবং চারিখানি সংস্কৃত নাটকও তদ্বারা অনূদিত হয়। কৌলীন্যজনিত বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, পুরুষের লাম্পট্য প্রভৃতি সামাজিক দোষপ্রদর্শনই তাঁহার সামাজিক প্রহসনগুলির উদ্দেশ্য। রামনারায়ণের সমসাময়িক কয়েকজন নাট্যকার তাঁহার প্রহসনগুলির অনুকরণে প্রহসন রচনা করিয়াছিলেন।

(খ) মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩)

রামনারায়ণের রত্নাবলী’ (১৮৫৮) নাটকের অভিনয় দেখিয়া মধুসূদন দত্ত বাংলা নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত হন। এই অনুপ্রেরণার ফলে মধুসূদনের প্রথম বাংলা নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে (মতান্তরে ১৮৫৯-এর জানুআরি মাসে) প্রথম প্রকাশিত হয়। শমিষ্ঠাই “বাংলা ভাষায় প্রথম দস্তুরমত নাটক”।৪৭ এই নাটকের প্রস্তাবনায় মধুসূদন দুঃখ করিয়া লিখিয়াছেন

“অলীক কুনাট্য রঙ্গে   মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।”

এই দুঃখ দূর করিবার জন্যই তিনি “শর্মিষ্ঠা নাটক লেখেন। মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত যযাতির উপাখ্যান হইতে এই নাটকের কাহিনী সংগৃহীত এবং কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকের আদর্শে ইহা গঠিত। ইহা গদ্যে লেখা, কিন্তু ইহাতে পয়ার ছন্দে আট ছত্র কবিতা ও ছয়টি গান আছে। ইহা নাট্যমঞ্চে অভিনীত হইয়া যথেষ্ট প্রশংসা লাভ করিয়াছিল।

মধুসূদনের অন্যান্য নাটকের মধ্যে ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০) ও কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘পদ্মাবতী’তে গ্রীক পুরাণের একটি প্রসিদ্ধ কাহিনী সোনার আপেল লইয়া তিন দেবীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও তাহার আনুষঙ্গিক ঘটনাবলী-নাট্যে রূপায়িত হইয়াছে; তবে এই নাটকে মধুসূদন গ্রীক দেবদেবীদের নাম পরিবর্তিত করিয়া হিন্দু দেবদেবীদের নাম দিয়াছেন। নাটকটিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের ভিন্নমুখী দুইটি ধারা একত্রে মিলিয়াছে। ইহার সংলাপের কয়েকটি ছত্রে মধুসূদন সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে টডের ‘রাজস্থানে বর্ণিত রাজপুত ইতিহাসের একটি আখ্যান রূপায়িত হইয়াছে। রাজকন্যা কৃষ্ণকুমারীকে লইয়া দুইজন রাজার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিবাদ এবং তাহার ফলস্বরূপ কৃষ্ণকুমারীর আত্মবিসর্জনের করুণ কাহিনী এই নাটকে বর্ণিত হইয়াছে। নাটকটি ট্র্যাজেডির পর্যায়ভুক্ত। মৃত্যুর পূর্বে এক রঙ্গালয়ের কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে অগ্রিম অর্থ লইয়া মধুসূদন মায়াকানন ও ‘বিষ না ধনুগুণ’ নামে দুইটি নাটক রচনা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন; প্রথমটি তিনি শেষ করিয়াছিলেন, কিন্তু মুখ্যত অভিনয়ের প্রয়োজনে রঙ্গালয়-কর্তৃপক্ষ ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে দিয়া ইহার কিছু কিছু পরিবর্তন সাধন করান। সেই পরিবর্তিত রূপটিই প্রকাশিত হইয়াছে (১৮৭৫)। “বিষ না ধনুগুণ’ মধুসূদন সম্পূর্ণ করিতে পারেন নাই।

মধুসূদন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ (১৮৬০) ও বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) নামে দুইখানি উৎকৃষ্ট প্রহসনও রচনা করিয়াছিলেন। প্রথম প্রহসনটিতে তিনি উন্মার্গগামী নব্য বাঙ্গালীদের দুর্নীতি ও গ্লানি উদঘাটিত করিয়াছেন। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে তিনি একজন চরিত্রহীন ধর্মধ্বজী বৃদ্ধের চিত্র অঙ্কন করিয়া প্রাচীনপন্থীদের পাপ ও ভণ্ডামির দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। দুইটি প্রহসনেরই ব্যঙ্গ অত্যন্ত ক্ষুরধার ও উপভোগ্য। এই দুইটি প্রহসনের প্রভাব দীনবন্ধু মিত্রের নাটকগুলিতে বিশেষভাবে দেখা যায়।

মধুসূদন তাঁহার নাটকের সংলাপ রচনায় বিশেষ দক্ষতা দেখাইয়াছেন। তাঁহার প্রহসন দুইটির সংলাপ আশ্চর্যরকমের জীবন্ত। শুধু প্রহসনগুলির নয়, গুরুগম্ভীর নাটকগুলির সংলাপও মধুসূদন চলিত বাংলায় রচনা করিয়াছিলেন; তাঁহার সমসাময়িক বাঙ্গালী নাট্যকারদিগের মধ্যে প্রায় কেহই তাহা করেন নাই।

মধুসূদন তিনটি বাংলা নাটক ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়াছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’, নিজের ‘শর্মিষ্ঠা এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ।

(গ) মধুসূদনের পরবর্তী নাট্যকারগণ

এই যুগের নাটক রচনায় মধুসূদনের পরেই দীনবন্ধু মিত্রের (১৮২৯-৭৩) স্থান। তাঁহার প্রথম রচনা ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০)-এ নীলকরদের অত্যাচারের চিত্র সে-যুগে যে তুমুল আন্দোলনের সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। নাট্যপ্রতিভার বিশেষ স্ফুরণ না হইলেও ইহাতে উৎপীড়িত অসহায় একশ্রেণীর বাঙ্গালীদের প্রতি যে মর্মবেদনা ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা এই নাটকটিকে অমরত্ব দান করিয়াছে। নীলদর্পণ’-এর দ্ৰ চরিত্রগুলির তুলনায় নিম্নশ্রেণীর চরিত্রগুলি খুব জীবন্ত; তাহাদের সংলাপে যশোহর অঞ্চলের কথ্যভাষা ব্যবহৃত হইয়াছে। নীলদর্পণ’-এর পরে দীনবন্ধু আরও তিনখানি নাটক লিখিয়াছিলেন- নবীন তপস্বিনী’ (১৮৬৩), ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭) এবং কমলে কামিনী’ (১৮৭৩)। এগুলি খুব উচ্চশ্রেণীর রচনা নহে। কিন্তু প্রহসন রচনায় তিনি বিশেষ দক্ষতা দেখাইয়াছেন- এ-বিষয়ে তিনি মধুসূদনের সহিত তুলনীয়। সধবার একাদশী’ (১৮৬৬) তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রহসন এবং ইহার নায়ক মদ্যপ চরিত্রহীন নিমচাঁদ একটি বাস্তব চরিত্র ও অনবদ্য সৃষ্টি। বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬) একটি গ্রাম্য বৃদ্ধের শেষবয়সে বিবাহের উদ্যোগ ও তজ্জনিত লাঞ্ছনার চিত্র- কাহারও কাহারও মতে ইহা একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত। জামাই বারিক’ (১৮৭২) প্রহসনে কলিকাতার কোন ধনী পরিবারের ঘরজামাই’-রাখার প্রথা লইয়া ব্যঙ্গ করা হইয়াছে। ইহার মধ্যে দুই সতীনের ঝগড়ার কাহিনীটি একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। দীনবন্ধুর নাটকগুলিতে অনেক পরিমাণে বিশুদ্ধ কৌতুকরস থাকায় তৎকালে ইহাদের অভিনয় খুব জনপ্রিয় হইয়াছিল। তবে রুচি পরিবর্তিত হওয়ায় বর্তমানে তাহার প্রহসনগুলি আর তেমন উপভোগ্য নহে।

মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২) অনেকগুলি পৌরাণিক নাটক রচনা করেন। ইহার মধ্যে সতী’ নাটকই (১৮৭৩) সর্বশ্রেষ্ঠ। এই নাটকগুলি পুরাতন যাত্রা পাঁচালী-কথকতার সহিত নবীন নাট্যরীতির যোগাযোগ ঘটাইয়া “পুরাতন-নূতনের সন্ধি-বন্ধন” এবং “বাঙ্গালা নাটকের ইতিহাসের আদি ও মধ্য যুগের মধ্যে সেতু সংযোগ করিয়াছে।”৪৮ ইহা ছাড়াও তাঁহার নাটকগুলির জনপ্রিয়তার আর-একটি কারণ এই যে, ইহাদের মধ্যদিয়া সে-যুগের নবজাগ্রত জাতীয়তার সুর ফুটিয়া উঠিয়াছে। ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে রচিত “দিনের দিন, সবে দীন, হয়ে পরাধীন! অন্নাভাবে শীর্ণ, চিন্তাজ্বরে জীর্ণ, অপমানে তনু ক্ষীণ!” এই বিখ্যাত গানটি এবং করভার-প্রপীড়িত দেশের দুঃখের বর্ণনামূলক আর-একটি গান মনোমোহনের ‘হরিশ্চন্দ্র’ নাটকের অন্তর্ভুক্ত।

সে-যুগের রঙ্গশালা প্রতিষ্ঠার ফলে বহু নাটক লিখিত হয়। সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ, সংস্কৃত ও ইংরেজী সাহিত্যের আখ্যাত এবং আধুনিক ও পুরাতন কাব্যের বিষয় অবলম্বনে বহু নাটক রচিত হইয়াছিল। মেঘনাদবধ কাব্য অবলম্বনে অন্ততঃ ছয়খানি নাটক রচিত হয়। সামাজিক সমস্যা, সমসাময়িক ঘটনা, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কুৎসা প্রভৃতি লইয়া বহু নাটক রচিত হইয়াছিল। নাট্যাকারে অনেক যাত্রার পালাও রচিত হয়। নাট্যকারদের মধ্যে মীর মশারফ হোসেন (১৮৪৮ ১৯১২) ও অন্য দুইজন মুসলমান ও কয়েকজন মহিলা ছিলেন।

ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাজকৃষ্ণ রায়, অমৃতলাল বসু, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রভৃতি নাট্যকার হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪৮-১৯২৫) মৌলিক রচনার মধ্যে কিঞ্চিৎ জলযোগ’ নামক একাঙ্ক প্রহসন (১৮৭২) (কেশবচন্দ্র সেনের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কটাক্ষ), অলীকবাবু’ নামে আর-একটি প্রহসন, দেশপ্রেমমূলক ‘পুরু বিক্রম’ (১৮৭৪) ও ‘সরোজিনী’ বা ‘চিতোর আক্রমণ’ (১৮৭৫) নাটক এবং ‘অশ্রুমতী’ (১৮৭৯) নাটক বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বহু সংস্কৃত ও ইংরেজী নাটকের অনুবাদ এবং মারাঠি ভাষার কয়েকখানি গ্রন্থের অনুবাদই বঙ্গসাহিত্যে তাহার বিশিষ্ট কীর্তি।

রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৪৯-৯৪) বহুসংখ্যক পৌরাণিক নাটক ও নাট্যগীতি রচনা করেন। তাহাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ‘অনলে বিজলী’ (১৮৭৮) ও ‘হরধনুর্ভঙ্গ’ (১৮৮১)। শেষোক্ত নাটকের সংলাপে ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। এই ছন্দ বাংলা নাটকে রাজকৃষ্ণ প্রথম ব্যবহার করেন।

এই যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২) একাধারে সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, সুদক্ষ অভিনেতা ও বহুসংখ্যক নাটকের রচয়িতা ছিলেন। তিনি বহু প্রসিদ্ধ কাব্য ও উপন্যাসের নাট্যরূপ, অনেক অপেরা বা নাট্যগীতি, এবং বহু মৌলিক নাটক রচনা করিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। মৌলিক নাটকগুলি পৌরাণিক কাহিনী, বুদ্ধ, চৈতন্য প্রভৃতি ধর্মগুরু ও সাধুসন্তের জীবনী, গার্হস্থ্য ও সামাজিক চিত্র এবং ঐতিহাসিক কাহিনী প্রভৃতি অবলম্বনে লিখিত। ইহাদের মধ্যে জনা’, ‘চৈতন্যলীলা’ ও ‘বুদ্ধদেবচরিত’ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিল। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে তাঁহার ‘সিরাজদ্দৌলা (১৩১২ সালে), মীরকাশিম’ (১৩১৩) ও ছত্রপতি শিবাজী’ (১৩১৪)এই তিনখানি নাটক অপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি করিয়াছিল। ইহার পর তিনি আবার পুরাতন যুগের ন্যায় ‘শঙ্করাচার্য’, ‘অশোক’, ‘তপোবল’ প্রভৃতি পৌরাণিক বা প্রাচীন যুগাশ্রিত নাটক রচনা করেন।

গিরিশচন্দ্রের সামাজিক নাটকগুলির মধ্যে করুণরসাত্মক নাটক ‘প্রফুল্ল’ বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিল। তাঁহার অন্যান্য সামাজিক নাটকের মধ্যে ‘হারানিধি’, ‘শাস্তি কি শান্তি’ ও ‘বলিদান উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত নাটকে পণপ্রথার বিষময় ফল প্রদর্শিত হইয়াছে।

নাট্যরচনার সংখ্যায় গিরিশচন্দ্র আর সকলকে ছাড়াইয়া গিয়াছেন। কেহ কেহ তাঁহার নাট্যপ্রতিভার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন, কিন্তু এ-বিষয়ে সমালোচকেরা একমত নহেন। ডা. সুকুমার সেন লিখিয়াছেন, “গীতিনাট্যের কথা বাদ দিলে তাঁহার প্রায় পঁয়তাল্লিশখানি নাটকের বদলে চার-পাঁচখানি মাত্র লিখিলে তাঁহার যশের হানি হইত না।”৪৯….”গিরিশের নাটকে উঁচুদরের সাহিত্যশিল্পের পরিচয় নাই।”৫০।

পৌরাণিক নাটকগুলিই গিরিশচন্দ্রের সর্বাপেক্ষা বিশিষ্ট সৃষ্টি। ইহাদের বহিরাঙ্গিক পাশ্চাত্ত্য নাটকের মত হইলেও মূলতঃ এইগুলি যাত্রারই অনুরূপ। সুতরাং পাশ্চাত্ত্য নাটকের আদর্শে বিচার করিলে ইহাদের মধ্যে অনেক পরিমাণে নাট্যগুণের অভাব দেখা যাইবে। কিন্তু স্মরণ রাখা আবশ্যক, এইগুলি আমাদের দেশের ঐতিহ্য অনেক পরিমাণে রক্ষা করিয়াছে।

অমৃতলাল বসু (১৮৫৩-১৯২৯) গিরিশচন্দ্রের ন্যায় সুদক্ষ অভিনেতা ছিলেন এবং সমসাময়িক সামাজিক চিত্র অবলম্বনে অনেক অভিনয়োপযোগী প্রহসন ও বিদ্রুপাত্মক নকশা রচনা করিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে চাটুয্যে-বড় য্যে’, ‘কৃপণের ধন’, ‘বিবাহ-বিভ্রাট’, ‘তাজ্জব ব্যাপার’, ‘রাজা বাহাদুর’, ‘অবতার’, ‘বাবু’ (ইহার ‘দেশহিতৈষী বাবু’-চরিত্র সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি কটাক্ষমূলক), তিলতর্পণ, ‘খাসদখল’, ‘দ্বন্দ্বে মাতন (“বন্দেমাতরম্‌”-এর ব্যঙ্গ) প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাধারণ নাটকও তিনি কয়েকখানি রচনা করিয়াছিলেন। অমৃতলালের নাটকে তাঁহার রক্ষণশীল ও প্রগতি-বিরোধী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে এগুলির মধ্যে, বিশেষভাবে তাঁহার প্রহসনগুলিতে, হাস্যরস-সৃষ্টিতে তাহার দক্ষতার নিদর্শন আছে।

ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭) বহুসংখ্যক নাটক লিখিয়াছিলেন এবং ইহার অনেকগুলি রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইত। তাঁহার প্রথমযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ‘আলিবাবা’ (১৩০৪ সাল) ক্লাসিক থিয়েটারে বহুদিন যাবৎ অভিনীত হইয়া যেরূপ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিল খুব কম বাংলা নাটকের ভাগ্যে তাহা ঘটিয়াছে। কিন্তু এই যশের প্রধান কারণ সুদক্ষ অভিনেতা ও অভিনেত্রীর গীত ও নৃত্যকৌশল। ইহা আরব্য উপন্যাসের একটি সুপরিচিত কাহিনী অবলম্বনে লঘুভঙ্গীতে লিখিত। এই শ্ৰেণীর আরও অনেকগুলি নাটক তিনি রচনা করিয়াছিলেন, কিন্তু সেগুলি বিশেষ জনপ্রিয় হয় নাই। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে ও পরে তিনি কয়েকখানি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করিয়া জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিলেন। পদ্মিনী’, ‘চাঁদবিবি’, ‘প্রতাপ আদিত্য, নন্দকুমার’, ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’, ‘বাঙ্গালার মসনদ’ প্রভৃতি এই জাতীয় রচনা। ইহা ছাড়াও তিনি অনেক ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও রোমান্টিক নাটক রচনা করেন। তাঁহার পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে ভীষ্ম’, নরনারায়ণ’ ও ‘উলুপী’ এবং ঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে আলমগীর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।

ক্ষীরোদপ্রসাদের সমসাময়িক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) এ-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। তিনি প্রথমে কয়েকখানি প্রহসন রচনা করেন। সমাজ বিভ্রাট ও কল্কি অবতার’ (১৮৯৫) প্রহসনে তিনি প্রাচীন ও নবীন উভয়পন্থী হিন্দুদিগের উপর বিদ্রূপ বর্ষণ করিয়াছেন। বিরহ’ (১৮৯৭), ‘ত্র্যহস্পর্শ’ (১৯০০), ‘প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০১) প্রভৃতি প্রহসনগুলি প্রধানতঃ হাস্যরসাত্মক গানগুলির জন্য বিশেষ উপভোগ্য। অবশ্য ইহাদের মধ্যে অনাবিল কৌতুকরসেরও প্রাচুর্য দেখা যায়। পুনর্জন্ম (১৯১১) দ্বিজেন্দ্রলালের সর্বশেষ প্রহসন। দ্বিজেন্দ্রলালের দুইখানি সামাজিক নাটক ‘পরপারে’ (১৯১১) ও বঙ্গনারী’ (১৯১৫) প্রথমশ্রেণীর না হইলেও উৎকৃষ্ট রচনা।

দ্বিজেন্দ্রলাল তিনটি পৌরাণিক নাটক রচনা করিয়াছিলেন–’পাষাণী (১৯০২), ‘সীতা’ (১৯০২), ভীষ্ম (১৯১২)। গিরিশচন্দ্র ও ক্ষীরোদপ্রসাদের পৌরাণিক নাটকের মত ভক্তিরসাশ্রিত নাটক না হইলেও এগুলিতে নাট্যকারের মননশীলতা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে সীতা’ই শ্রেষ্ঠ।

দ্বিজেন্দ্রলালের যে ঐতিহাসিক নাটকগুলি নাট্যকার হিসাবে তাঁহাকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবে তাহারা তারাবাই’ (১৩১০ সাল), ‘প্রতাপসিংহ (১৩১২), ‘দুর্গাদাস’ (১৩১৩), নূরজাহান’ (১৩১৪), মেবারপতন’ (১৩১৫), ‘সাজাহান’ (১৩১৭), চন্দ্রগুপ্ত (১৩১৮?) ও ‘সিংহলবিজয়’ (১৩২২)। প্রথম ছয়খানি নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল যথাসম্ভব ঐতিহাসিক সত্য বজায় রাখিতে চেষ্টা করিয়াছেন। শেষোক্ত দুইখানি অনেকাংশে কাল্পনিক। এই নাটকগুলিতে পাত্রপাত্রীর সংলাপে নাট্যকারের অনন্যসাধারণ দীপ্তি, গরিমা ও আভিজাত্য দেখা যায়। অধিকাংশ নাটকেই দ্বিজেন্দ্রলাল জটিল ও জীবন্ত চরিত্র এবং নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টিতে বিশেষ নৈপুণ্য দেখাইয়াছেন। পাশ্চাত্ত্য নাটকের সংজ্ঞানুসারে নাট্য-রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁহার পূর্ববর্তী নাট্যকারদের অপেক্ষা অধিকতর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, এ-বিষয়ে সন্দেহ নাই। দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে শুধু তাঁহার নাট্যপ্রতিভার নহে, দেশপ্রেমেরও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি কটাক্ষ করিয়া দ্বিজেন্দ্রলাল ‘আনন্দবিদায়’ (১৯১২) নামে একটি প্রহসন রচনা করিয়াছিলেন। ইহা তাঁহার ন্যায় সাহিত্যিকের পক্ষে নিন্দার কারণ হইয়াছে।

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্র যেমন বাংলা সাহিত্যের দুই বিভাগে যুগান্তর আনিয়াছিলেন, উনিশ শতকের শেষভাগে রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যের প্রায় সব বিভাগেই তদনুরূপ আর এক নূতন যুগের প্রবর্তন করেন। ইহার প্রভাব অদ্যাবধি চলিতেছে। কিন্তু বর্তমান গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁহার প্রবর্তিত নবযুগের আলোচনায় একটি গুরুতর বাধা আছে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ ও মৃত্যু ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে। এই গ্রন্থের সমাপ্তিকাল ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক জীবনের বেশীর ভাগ পরবর্তী খণ্ডের বিষয়বস্তু। কিন্তু তিনি গীতিকবিতা ও ছোটগল্পে যে নূতন রীতি প্রবর্তিত করেন, ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই তাহা সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। অপরপক্ষে উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, সঙ্গীত প্রভৃতি সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগে তাঁহার অবদান ঐ সময়ের পরেই বাংলাসাহিত্যে নূতন ধারার প্রবর্তন করে। রবীন্দ্রনাথের ন্যায় প্রতিভাবান সাহিত্যস্রষ্টার সমগ্র রচনার মধ্যে যে একটি নিবিড় যোগসূত্রের বন্ধন থাকে তাহা এইরূপ দুই খণ্ডে বিভক্ত করা যায় না। সুতরাং সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের এবং তাহার প্রবর্তিত সাহিত্যযুগ ও তাঁহার অনুবর্তী সাহিত্যকদিগের আলোচনা পরবর্তী খণ্ডেই বিশদভাবে করা হইবে। কিন্তু সাহিত্যের এই যুগসন্ধির উপক্রমণিকাস্বরূপ এই গ্রন্থেও সংক্ষেপে কয়েকটি মন্তব্যের প্রয়োজন বোধ করি।

রচনার বৈচিত্র্যসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ প্রধানতঃ ও মূলতঃ কবি। সন্ধ্যা সঙ্গীত (১৮৮২), ‘প্রভাত সঙ্গীত’ (১৮৮৩), ‘ছবি ও গান’ (১৮৮৪) এবং ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬)-এই কয়খানি গ্রন্থে কবিমানসের যে অস্ফুট ও কতকটা বিস্ময়কর চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছিল তাহা যে এক অপূর্ব কবিপ্রতিভার সূচনা, আজিকার দিনে তাহা যেরূপ স্পষ্ট বুঝা যায় তখনকার দিনে তাহা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী” (১৮৯৩), ‘চিত্রা’ ও ‘চৈতালি’ (১৮৯৬), ও কল্পনা (১৯০০) প্রকাশের পর কবির স্বাতন্ত্র ও তপ্রবর্তিত গীতিকবিতার অভিনব ধারা ও আদর্শ স্বীয় মহিমায় ও মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইল। অবশ্য তখনও রবীন্দ্রনথের কবিত্ব সর্বত্র স্বীকৃত হয় নাই এবং ইহার অসারত্ব প্রতিপন্ন করার চেষ্টাও হইয়াছিল। কিন্তু সে-যুগের কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক বাংলার সাহিত্যগগনে নবযুগ-প্রবর্তক নবরবির আবির্ভাব সাদরে অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র এই কিশোর কবিকে নিজের হস্তে জয়মাল্য পরাইয়া স্বীয় সাহিত্যসম্রাটের সিংহাসন ছাড়িয়া দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেন নাই। কবি নবীনচন্দ্র সেনও রবীন্দ্রনাথকে তাঁহার অপেক্ষা উচ্চস্তরের কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।

উনিশ শতক শেষ হইবার পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ ‘ছোটগল্প রচনার নূতন যুগ প্রবর্তন করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলিয়াছেন, “আমার ছোটগল্প রচনার পূর্বে বাংলা সাহিত্যে ইহার অস্তিত্ব ছিল না”। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলিতে বাংলা দেশের বিশেষত ইহার গ্রামের–পটভূমিকায় বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন শ্রেণীর বাঙ্গালীর ছবি যেপ্রকার ফুটিয়া উঠিয়াছে ইহার পূর্বে কোন সাহিত্যিক তাহা কল্পনাও করেন নাই। রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব এই যে, রোমান্টিক উপন্যাস বাঙ্গালীর মনে যখন প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করিয়াছে, তখন সাধারণ বাঙ্গালীর গার্হস্থ্যজীবনের ছোটখাট সুখ, দুঃখ, আশা-নিরাশা, অভাব, অভিযোগ প্রভৃতি নিজের কবিহৃদয়ের অনুভূতির সাহায্যে ছোটগল্পের আকারে উপস্থিত করিয়া তিনি বাঙ্গালীর হৃদয়কে এমনভাবে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করিয়াছিলেন যে, তাহার প্রভাবে পরবর্তী বঙ্গসাহিত্যে ছোটগল্প সর্বপ্রধান আসন গ্রহণ করিয়াছে, ইহা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না। তাঁহার ছোটগল্পে নানা শ্রেণীর, নানা বয়সের নরনারীর যে কত বিচিত্র চরিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। অথচ ইহার প্রত্যেকটিকে তিনি কবিত্বময় ভাষা ও ভাবের সাহায্যে অপূর্ব সুষমামণ্ডিত করিয়া দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছতা হইতে অনেক ঊর্ধ্বে তুলিয়া আমাদের নিকট বাঙ্গালী জীবনের এক অভূতপূর্ব রসের ভাণ্ডার খুলিয়া দিয়াছেন।

১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয়- ‘ঘাটের কথা ও ‘রাজপথের কথা। ইহার সাত বৎসর পরে রচিত গল্পগুলি তাঁহার স্বকীয় রীতির পরিচায়ক। এই সময় হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত অর্ধশতাব্দীকাল তিনি বাংলার পল্লী ও নাগরিক জীবনের বিচিত্র রূপ অঙ্কিত করিয়া ছোটগল্পের মাধ্যমে সৌন্দর্যের যে বিশাল চিত্রশালা রচনা করিয়াছেন, তাহা চিরকাল সাহিত্যিক সৃজনীপ্রতিভার অপূর্ব নিদর্শনরূপে বিরাজ করিবে।

বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ অবদান-প্রধানতঃ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের পরবর্তী রচনা পরবর্তী খণ্ডে আলোচিত হইবে।

৬. উপসংহার

শ্রীযুক্তা কামিনী রায়ের (১৮৬৪-১৯৩০) আলো ও ছায়া’ ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হইয়া মহিলা কবিদের মধ্যে তাঁহাকে শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁহার এ সম্মান আজিও অক্ষুণ্ণ আছে।

উনিশ শতকের শেষভাগে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ইহাদের কেহ কেহ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে সাহিত্যিক-জীবন আরম্ভ করিলেও পরবর্তীকালেই সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সুতরাং এখন শুধু তাঁহাদের নাম উল্লেখ করিব, বিস্তৃত বিবরণ পরবর্তী খণ্ডে দেওয়া হইবে।

কবিদের মধ্যে যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৭-১৯৪৮), করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৫৫), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) এবং কুমুদরঞ্জন মল্লিকের (১৮৮২-১৯৭০) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উপন্যাস ও গল্প-লেখকদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬ ১৯৩৮)–এই তিনজন লেখকই সর্বপ্রধান।

প্রবন্ধলেখকদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৮৫৯-১৯৫৬) ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪ ১৯১৯)। ইঁহারা উভয়েই বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ের প্ৰবন্ধলেখক। জগদানন্দ রায় (১৮৬৯-১৯৩৩) বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ ও গ্রন্থরচয়িতা।

কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬০-১৯২৯) ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬২ ১৯৩০) ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধলেখক এবং বিজয়চন্দ্র মজুমদার (১৮৬১ ১৯৪২) বৌদ্ধ থেরগাথা, থেরীগাথা ও গীতগোবিন্দের অনুবাদক এবং গল্প ও কবিতার রচয়িতা। সখারাম গণেশ দেউস্কর (১৮৬৯-১৯১২) জাতিতে মারাঠী হইয়াও কয়েকখানি ঐতিহাসিক গ্রন্থ বাংলায় রচনা করেন। তাঁহার ‘দেশের কথা’ (১৩১১ সাল) স্বদেশী আন্দোলনের যুগে বিশেষ সমাদর লাভ করিয়াছিল।

দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯-১৯৪২) প্রধানতঃ ডিটেকটিভ কাহিনী রচনার জন্য খ্যাত। কেবলমাত্র পল্লীসমাজ সম্বন্ধে কয়েকখানি বই ইহার ব্যতিক্রম। তাঁহার ‘পল্লীচিত্র’ (১৩১১ সাল) উৎকৃষ্ট রচনা।

.

পাদটীকা

এই পাদটীকায় নিম্নলিখিত সাংকেতিক চিহ্নগুলি ব্যবহৃত হইয়াছে—

সং = সংস্করণ

সা-সা-চ = সাহিত্য সাধক চরিতমালা

সা-প= সাহিত্য পরিষৎ

বা-সা=শ্রীসুকুমার সেন প্রণীত বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, ৩য় সং (১৩৬২) দ্র = দ্রষ্টব্য।

১. “ভারতবর্ষ”, ১৩৭১, পৌষ, ৯৬ পৃ.

২. ২, ৩ ও ৪নং উদ্ধৃতি সুরেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত প্রাচীন বাংলা পত্র সঙ্কলন’ পৃ. ৬৩ ও ৭০ হইতে যথাক্রমে গৃহীত।

৩. শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, ১৯৫৯, পৃ. ১২৪

৪. রঞ্জন পাবলিশিং হাউস হইতে প্রকাশিত সং. ৪৮ পৃ.

৫. রঞ্জন পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত বত্রিশ সিংহাসন’, পৃ. ৪ এবং রাজাবলী’ পৃ. ১৪১।

৬. ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিত-সা-সা-চ, পৃ. ৩৪-৩৫

৭. “উইলিয়ম কেরী”-সা-সা-চ, ৩৭ পৃ.

৮. ঐ, ৪৬পৃ.।

৯. রামমোহন রায়”, সা-সা-চ, ৭৩ পৃ.

১০. ঐ, ৭৪ পৃ.।

১১. বা-সা, ৬ পৃ.।

১২. “উইলিয়ম কেরী”–সা-সা-চ, ২৪ পৃ.

১৩. S.K. De, Bengali Literature in the Nineteenth Century, P. 156; উইলিয়ম কেরী, ৫৬ পৃ.।

১৪. রামমোহন রায়, সা-সা-চ, ৭০ পৃ.

১৫. “বাংলা গদ্যের চার যুগ”২য় সংস্করণ (১৯৪৯), ২৬ পৃ.।

১৬. এই তিনখানি গ্রন্থ রঞ্জন পাবলিশিং হাউস হইতে পুনর্মুদ্রিত হইয়াছে। প্রথম ও তৃতীয় গ্রন্থের সঠিক তারিখ জানা নাই–”ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায়” গ্রন্থের (সা-সা চ) ১৭, ২৬ পৃ. দ্রষ্টব্য।

১৬ (ক), সা-সা-চ (১১) ৯ পৃ.

১৭. চারিত্র পূজা (রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ৪৭৭-৪৭৮)। “ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর” (সা-সা-চ), ৯৯ পৃ.। ইহা একটি পঠিত প্রবন্ধের অংশ (সাধনা, ভাদ্র, ১৩০২), কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে ও রবীন্দ্র-রচনাবলীতে শেষের প্যারা বর্জন করা হইয়াছে।

১৮. বিধবা বিবাহ ২য় পুস্তক। বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী-সমাজ (রঞ্জন পাবলিশিং হাউস) ১৮৭ পৃ.

১৯. হুতোম প্যাচার নকশা, (রঞ্জন পাবলিশিং হাউস) ৯৮ পৃ.

১৯(ক). বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, চতুর্থ খণ্ড, ৭১২-১৩ পৃ.।

২০. “প্যারীচাঁদ মিত্র” (সা-সা-চ), ২৭-২৮ পৃ.

২১. ঐ, ২৪-২৬ পৃ.।

২২. ১৮৪১ সনে রচিত অপ্রকাশিত ‘মধুমল্লিকা বিলাস’ নামে পদ্যে লিখিত একটি আখ্যায়িকার বিবরণ দিয়া শ্রীসুকুমার সেন লিখিয়াছেন যে ইহা ইংরেজী সাহিত্যের দ্বারা কোনো রকমে প্রভাবান্বিত নহে, অথচ ইহাতে গার্হস্থ্য উপন্যাসের লক্ষণ বিদ্যমান (বাসা, ১৬০ পৃ.)।

২৩. বা-সা, ১৬৭ পৃষ্ঠায় ইহার কারণ আলোচিত হইয়াছে।

২৪. বা-সা, ১৮৩ পৃ.

২৫. সা-প পত্রিকা, শ্রাবণ, ১৩০১, ৪ পৃ.

২৬. বঙ্কিমের বিরুদ্ধ সমালোচনা, নিন্দা ও ব্যঙ্গকৌতুক প্রভৃতির জন্য, বা-সা, ১৮৮, ২০২, ২০৩ পৃ. দ্র।

২৭. “বিবিধ প্রবন্ধ” ২য় ভাগ (সা-প-সং) ২০৬ পৃ.

২৮. “বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সা-সা-চ, ৫১ পৃ.

২৯. “কমলাকান্তের দপ্তর” ১২৮০-৮২ সনের “বঙ্গদর্শনে” প্রকাশিত হয় এবং ১৮৭৫ সনে স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১২৯২ সালে ইহার সহিত “কমলাকান্তের পত্র” ও “কমলাকান্তের জোবানবন্দী” এই দুইখানি নূতন গ্রন্থ যোগ করিয়া “কমলাকান্ত” নামে পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ঐ, ৭৫ পৃ.।

৩০. সা-সা-চ, বঙ্কিম ৫১ পৃ.।

৩১. “আধুনিক বাংলা সাহিত্য”, ৪৭-৪৮ পৃ.।

৩২. “আধুনিক সাহিত্য” ৪-৯ পৃ.।

৩৩. S.K. De, Bengali Literature in the Nineteenth Century, 2nd Ed., P. 336

৩৪. দীনেশচন্দ্র সেন, “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” (ষষ্ঠ সং), ৫৪৫ পৃ.।

৩৫. বা-সা, ১২১-২২ পৃ.।

৩৬. সা-প-সং ভূমিকা।

৩৭. বা-সা, ১৩৪-৩৫ পৃ.।

৩৮. ঐ, ৩৯৭ পৃ.।

৩৯. ঐ ৪০. ঐ, ৪১৯ পৃ.।

৪১. শ্রীসুকুমার সেন লিখিয়াছেন : “ভারত সঙ্গীত লিখিয়া হেমচন্দ্র দেশের রাজশক্তির কাছে যে অপরাধ করিয়াছিলেন তাহা ভারত ভিক্ষা’ (১৮৭৫) লিখিয়া ক্ষালন করিতে হইল” (বাসা, ৩৪৪পৃ.)। ইহার স্পষ্ট ইঙ্গিত এই যে ভারত ভিক্ষা দেশপ্রেমমূলক কবিতা নহে, রাজভক্তিসূচক। কিন্তু ভারত ভিক্ষা’য় তকালে প্রচলিত মহারাণীর নিকট আবেদন নিবেদন থাকিলেও ভারতের প্রাচীন গৌরবসূচক ও দেশপ্রেমউদ্দীক অনেক আবেগপূর্ণ উক্তি আছে।

৪২. বা-সা, ৩৫০

৪৩. সেক্সপীয়ারর “Tempest” নাটক অবলম্বনে লিখিত।

৪৪. ‘হেমচন্দ্রের উদ্দীপনা নবীনচন্দ্রকেও স্পর্শ করিয়াছে’ (বাসা, ৪৫৮ পৃ.)।

৪৫. শ্রীসুকুমার সেনের এই উক্তি (বা-সা, ৩৭০ পৃ.) এবং বিশেষত এই প্রসঙ্গে অন্য একটি উক্তি, “উদাসিনী কাব্যে এককালে রবীন্দ্রনাথ, নবীনচন্দ্র ও ঈশানচন্দ্র প্রমুখ কবিদিগকে নূতন প্রেরণা দিয়াছিল”, সমর্থনযোগ্য বলিয়া মনে হয় না। এগুলি অত্যুক্তির পর্যায়ে পড়ে। 86. (F). M. Goddrell TIDO “The Disguise”

৪৬. বা-সা, ৩১ পৃ.।

৪৭. ঐ, ৪৮-৪৯ পৃ.।

৪৮. ঐ, ৭৭ পৃ.।

৪৯. ঐ, ৩১৫ পৃ.। এই মত গ্রহণ করা কঠিন। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রণীত “গিরিশ প্রতিভা” দ্র।

৫০. বা-সা, ৩২০ পৃ.।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *