১০. ফসিল

১০. ফসিল

আমাদের ঘুম ভাঙল খালেদের চিৎকারে। প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে সে, গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম, বেশ খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায়। হঠাৎ করে সব মনে পড়ে গেল, তখন লাফিয়ে দাঁড়ালাম আমি, খালেদের কাছে ছুটে গেলাম, সে হাত দিয়ে কি যেন দেখাচ্ছে। আমার পিছু পিছু অন্য সবাই ছুটে এসেছে। আমরা পাহাড়ের এক কিনারায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকালাম, আর হঠাৎ মনে হল হৃৎস্পন্দন বুঝি থেমে গেল!

সে কী অপরূপ, সে কী বিস্ময়কর দৃশ্য! চারপাশে খাড়া পাহাড়ে মরি আর তার ঠিক মাঝখানে ছবির মত একটা হ্রদ। নীল টলটলে পানি, মনে হচ্ছে কেউ যেন আকাশের এক টুকরা ভেঙ্গে এখানে গেঁথে দিয়েছে। খাড়া পাথরের দেয়াল আর সেই পাথর থেকে একটা প্রাণীর মাথা বের হয়ে আসছে। একটা প্রাণীর কঙ্কাল, বিশাল মুখ হাঁ করে আছে, ভয়ঙ্কর দাঁত, দেখে মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সেটি ঝাঁপিয়ে পড়ল না, পাথরে আটকা পড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

খালেদ সেটার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, টি-রেক্স। টি রেক্স! টি-রেক্স। আমরা টি-রেক্সকে পেয়েছি।

রাজু দুহাতে মুখ চেপে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, কী সুন্দর। ইশ! কী সুন্দর!

সেই অপুর্ব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সাড়ে ছ’ কোটি বছর আগে কী প্রতাপে এই প্রাণীটি রাজত্ব করে বেড়িয়েছে। কী ভয়ানক ছিল তার ক্ষমতা, কী ভয়ঙ্কর ছিল তার চেহারা, কী অচিন্ত্যনীয় ছিল তার ক্ষমতা। আজ সেই ভয়ঙ্কর টি-রেক্স পাথরে ফসিল হয়ে বন্দী হয়ে আছে? আমার বিশ্বাস হতে চায় না।

থোয়াংসা চাই চুপ করে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে, মনে হয় সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।

[এখানে একটি পেজ মিসিং আছে]

কঙ্কালের একটু বের হয়ে আছে। আমি একটা টেনে বের করার চেষ্টা করছিলাম, খালেদ একেবারে হা হা করে উঠল। ফসিলকে নাকি খুব যত্ন করে ধরতে হয়। হাত দিয়ে স্পর্শ করে অবশ্যি বোঝা যায় এগুলো পাথর হয়ে গেছে। আমার মত দুর্বল মানুষ সেটা টেনে বের করা দূরে থাকুক একটা দাগ পর্যন্ত দিতে পারবে না।

আমরা পুরো এলাকাটা ঘুরে ঘুরে একটা রত্নভাণ্ডার আবিষ্কার করলাম। এত অল্প জায়গার মাঝে এত ডাইনোসোরের ফসিল কেমন করে এল, সেটা একটা রহস্য। হয়তো এখানে কোন চোরাবালি ছিল বা বিশাল কোন লুকানো খাদ ছিল, কে বলতে পারবে। সাড়ে দু’ কোটি বছর তো ছেলে খেলা নয়।

সব দেখেশুনে ছোট চাচা গম্ভীর গলায় বললেন, এটা হচ্ছে আমাদের দেশের সম্পদ। বিদেশের ডাকাতেরা এসে এটা লুটেপুটে নেবে, আমি সেটা হতে দেব না। জান থাকতে হতে দেব না।

আমি মাটিতে পা দাপিয়ে বললাম, কখনো না।

রাজু বলল, কখনো না।

খালেদ বলল, নেভার! নেভার এগেন।

কি নিয়ে কথা হচ্ছে থোয়াংসা চাই ঠিক বুঝতে পারল না। কিন্তু তার রাম দাতা। মাথার ওপর দিয়ে শাঁই শাঁই করে ঘুরিয়ে একটা রণ হুঙ্কার ছাড়ল।

রাজু বলল, বদমাইসগুলি মনে হয় সকালের আগে রওনা দেবে না।

হ্যাঁ।

 এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে।

হ্যাঁ।

রাত্রি বেলা তো জায়গাটা দেখতে পাবে না, কাজেই কিছু করতে পারবে না। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

কাজেই আমরা যা করতে চাই ভোর হওয়ার আগেই করতে হবে। খালেদ জিজ্ঞেস করল, কি করবে ছোট চাচা?

ছোট চাচা মাথা চুলকালেন। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ভয় দেখিয়ে সবগুলিকে ভাগিয়ে দিতে হবে।

কিভাবে ভয় দেখাবে?

ছোট চাচা আবার তার মাথা চুলকাতে লাগলেন।

ঠিক এই সময় আমরা থোয়াংসা চাইয়র উল্লাস ধ্বনি শুনতে পেলাম, তাকিয়ে দেখি সে হ্রদে বসে থাকা একটা পাখিকে তীর দিয়ে গেঁথে ফেলেছে। সাদা ধবধবে পাখিটা রক্তে লাল হয়ে ছটফট করছে। থোয়াংসা চাই পানিতে ছুটে গিয়ে পাখিটা তুলে আনে। ছোট চাচা এগিয়ে গিয়ে বললেন, আহা, পাখিটাকে কেন মারল।

থোয়াংসা চাই এসে হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল এই পাখিটি খেতে খুব মজা।

পাখিটা তখনো ছটফট করছে, দেখে আমাদের কারো খাওয়ার কথা মাথায় এল না। ছোট চাচা হাত বাড়িয়ে পাখিটা নিলেন আর ঠিক তখন পাখিটা ডানা ঝাঁপটে উঠল আর এক ঝলক রক্ত ছিটকে এসে ছোট চাচার হাতমুখ আর কাপড় লাল হয়ে উঠল। ছোট চাচা নিজের রক্তমাখা কাপড়টার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মুখ

তুলে বললেন, আমার মাখায় একটা আইডিয়া এসেছে।

কি আইডিয়া?

দাঁড়া বলছি। ছোট চাচা নিজের রক্তমাখা শার্টটা খুলে নিচে বিছিয়ে বললেন, এই শার্টটা আরো ভাল করে রক্ত দিয়ে ভেজাতে হবে।

পাখিটা কষ্ট পাচ্ছিল, তাকে এমনিতেই জবাই করে নেয়া দরকার। ছোট চাচা তার শার্টের ওপর জুবাই করলেন। তার এত সুন্দর শার্টটা পাখির রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। ছোট চাচা তখন শার্টটা পাথরে ঘষে ঘষে এখানে সেখানে ছিঁড়ে ফেললেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি করছ ছোট চাচা?

পাহাড়ি দানো একটা মানুষকে ধরে খেয়ে ফেলেছে। এটা তার শার্ট।

পাহাড়ি দানো?

হ্যাঁ।

আমরা এখানে পাহাড়ি দানোর জন্ম দেব।

কেমন করে?

বলছি শোন।

ছোট চাচা তখন তার পরিকল্পনাটা খুলে বললেন, শুনে আমরা আনন্দে লাফাতে থাকি! এরকম চমৎকার বুদ্ধি শুধু ছোট চাচার মাথা থেকেই বের হতে পারে। হাতে সময় বেশি নেই, ছোট চাচার সাথে আমরা কাজে লেগে গেলাম।

প্রথমে হ্রদের কাছের নরম মাটিতে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে পাহাড়ি দানো নামের সেই রহস্যময় প্রাণীর পায়ের ছাপ তৈরি করলাম। চার হাত দূরে দূরে একেকটা পায়ের ছাপ, সামনে তিনটা বড় নখ, পছনে একটা ছোট, দেখে মনে হয়, হ্রদের ভেতর থেকে অতিকায় একটা প্রাণী উঠে এসে হ্রদের পাশ দিয়ে পাহাড়ের দিকে হেঁটে গেছে। কাছাকাছি রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন শার্টটা রাখা হল। গাছের ডাল ভেঙে সেটা মাটিতে ঘষে ঘষে একটু হুটোপুটির মত চিহ্ন রাখা হল। দেখে কোন সন্দেহ থাকে না, হ্রদ থেকে একটা বিশাল দানব আকৃতির প্রাণী হেঁটে হেঁটে বের হয়ে এসে একটা মানুষকে ধরে খেয়ে ফেলে পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে। পায়ের ছাপের আশে পাশে আমাদের পায়ের ছাপও রয়ে গিয়েছিল, এবারে খুব সাবধানে সেগুলি গাছের ডাল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে দেয়া হল। ছোট চাচা আমাদের বারবার বলে দিলেন, এখন থেকে খুব সাবধান, হ্রদের কাছাকাছি গেলে পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে, যেন পায়ের ছাপ না পড়ে।

পাহাড়ি দানোর পায়ের ছাপ তৈরি করে ছোট চাচা আমাদের নিয়ে হ্রদের পাশে খাড়া পাহাড়টায় ওঠার চেষ্টা করতে লাগলেন। সোজাসুজি ওঠা গেল না, পেছন দিয়ে ঘুরে ঘুরে অনেক সময় নিয়ে উঠতে হল। ছোট চাচা আন্দাজ করছেন, সাহেব তার দলের লোকগুলি নিয়ে হ্রদের কাছাকাছি কোথাও রাত কাটাবে। তিনি এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করতে চান যেটা হবে অনেক ওপরে, সহজে কেউ আসতে না পারবে না, কিন্তু সে জায়গাটা নিচে থেকে খুব সহজে দেখা যাবে। শেষ পর্যন্ত এ রকম একটা জায়গা পাওয়া গেল। একপাশে উঁচু পাথরের দেয়াল, মাঝখানে খানিকটা জায়গা মোটামুটি সমতল। ছোট চাচার কথা মত, আমরা সেখানে কিছু পাথরের স্কুপ দাঁড়া করলাম। বিছানার একটা চাদর ছিল, সেটাতে বড় একটা চোখ আর দাঁত আঁকা হল কাদা মাটি দিয়ে। রাতের অন্ধকারে এটা নাড়াচাড়া করলে আবছা অন্ধকারে দূর থেকে মনে হবে ভয়বাহ একটা প্রাণীর মাথা নাড়াচাড়া করছে।

পাহাড়ি দানোর গর্জন কেমন করে তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা হল। দুই হাতে মুখ ঢেকে থোয়াংসা চাই নানা ধরনের বিচিত্র শব্দ করতে পারে, সেখান থেকে বেছে বেছে একটা শব্দ ঠিক করা হল। হ্রদের পাশে এই এলাকার একটা বিশেষত্ব রয়েছে। ছোট একটা শব্দ করলেও সেটা খুব চমৎকারভাবে অনেকদূর পর্যন্ত শোনা যায়। মনে হয় চারপাশে পাথরের দেয়ালগুলি থেকে শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে আসে। খুঁজে খুঁজে কিছু ফাঁপা ডালপালা বের করা হল, একটার সাথে আরেকটা টোকা দিলে বিচিত্র এক ধরনের শব্দ হয়, পাহাড়ি দানো ছুটে বেড়াচ্ছে বোঝানোর জন্যে এটা দিয়ে শব্দ করা হবে।

আমরা ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট পাথর সাবধানে এমনভাবে স্তূপ করে রাখলাম যেন আস্তে টোকা দিলেই সেটা হুড়মুড় করে পড়ে যায়। পাহাড়ি দানোটা যখন ছোটাছুটি করবে তখন এগুলি ধাক্কা দিয়ে ফেলে মোটামুটি একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি করা হবে।

বিকেল হবার আগেই আমাদের সব প্রস্তুতি হয়ে গেল। এখন শুধু অপেক্ষা করা।

অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে আমরা আবার এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। পাথরের আড়ালে আরো নানা ধরনের ফসিল খুঁজে বের করলাম আমার। হ্রদের পাশে এক জায়গায় হঠাৎ কি একটা প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখে থোয়াংসা চাই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। প্রাণীটা কি সে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু আমরা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। থোয়াংসা চাই জায়গাটা ভাল করে দেখে হঠাৎ তার জিনিসপত্র নামিয়ে তার সেই ফাঁদ তৈরি করতে শুরু করল। প্রাণীটি কি আমরা জানি না কিন্তু মনে হচ্ছে সে এটা না ধরে ফিরে যাবে না। আমরা থোয়াংসা চাইকে সাহায্য করলাম, মোটা একটা গাছের ডালকে খুব কায়দা করে বাকা করে আনা হল, একটা বড় পাখরও এবারে কোথায় জানি বেঁধে দিল, ফাঁদটা গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেয়া হল যেন দেখা না যায়। আমরা হোয়াংসা চাইয়ের ফাঁদ তৈরি করায় এত ব্যস্ত ছিলাম যে, লক্ষ্যই করি নি বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। ছোট চাচা ওপর থেকে ডাক দিলেন, সবাই ওপরে চলে আস। সময় হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন জানি করে ওঠে, কি হবে আজ রাতে?

.

১১. পাহাড়ি দানো

অন্ধকার হবার আগেই সাহেব আর তার দলবল এসে হাজির হল। সবার সামনে সাহেব, তার মাথায় হ্যাট, বুকে একটা কালো চশমা ঝুলছে, হাফ প্যান্ট, ভারী বুট। তার সাথে সাথে কাচু মিয়া। ঘেমে একেবারে চুপসে আছে। তাদের বেশ পছনে অন্য লোকজন। তাদের মাথায় কাঠের খালি বাক্স, নিশ্চয়ই এগুলিতে করে ফসিলগুলি নেবে।

লোকগুলি তাদের মাথার জিনিসগুলি নামিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়। আমরা ভোরে যখন পাহাড়ে টি-রেক্সের ফসিলটি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এই লোকগুলিও সেরকম হতবাক হয়ে আছে। আমরা ভয় পাই নি, কিন্তু মনে হল এই লোকগুলি বেশ ভয় পেয়েছে। পাহাড়ে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি কখন তারা হ্রদের আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে পাহাড়ি দানোর পায়ের ছাপটা দেখবে।

কিছুক্ষণের মাঝেই একজন হ্রদের কাছাকাছি হেঁটে গেল। হঠাৎ সে পাহাড়ি দানোর পায়ের ছাপটা দেখে, সাথে সাথে সে পাথরের মত জমে গেল। একরার সামনে তাকাল, আরেকবার পেছনে তাকাল তারপর হঠাৎ আর্ত চিৎকার করে ছুটতে শুরু করল। তার গলার স্বর শুনে মনে হতে থাকে পাহাড়ি দানো বুঝি তাকে তাড়া করেছে, আরেকটু হলেই তাকে খপ করে খেয়ে ফেলবে।

লোকটার চিৎকার শুনে সবাই তার কাছে ছুটে গেল, লোকটা এক নিঃশ্বাসে কিছু একটা বলল এবং আরো কয়েকজন তার পিছু পিছু পাহাড়ি দানোর পায়ের ছাপ দেখতে গেল। আমরা ওপরে থেকেই বুঝতে পারি, নিচে একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

ফ্রেডারিক সাহেবকে গিয়ে কেউ একজন কিছু একটা বলল তখন দেখলাম সেও ছুটে গেল। পাহাড়ি দানোর পায়ের চিহ্নের পিছু পিছু কয়েকজন সাহসী মানুষ হাঁটতে থাকে আর হঠাৎ করে তারা ছোট চাচার রক্তমাখা শার্টটা আবিষ্কার করে ফেলল। মানুষগুলি তখন গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকে এবং অন্য সবাই সেখানে ছুটে যায়। সবাই রক্তমাখা শার্টটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে, উত্তেজিত কথাবার্তা হতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই মানুষগুলি জটলা করতে শুরু করে।

আমরা ওপর থেকে বুঝতে পারি মানুষগুলি এখানে রাত কাটাতে সাহস পাচ্ছে না। তারা বলছে তাদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হোক, তারা এই মুহূর্তে চলে যেতে চায়। সাহেব কাচু মিয়াকে দিয়ে তাদের জানিয়ে দিল যে সব মালপত্র আবার ফিরিয়ে নিতে হবে। যদি না নেয় তাদের একটি পয়সাও দেয়া হবে না।

লোকগুলি হত দরিদ্র মানুষ। অল্প কিছু পয়সার জন্যে এখানে এসেছে, এখন এখানে থাকার সাহস নেই কিন্তু চলেও যেতে পারছে না। দেখলাম সবাই মিলে কাছাকাছি জটলা করতে থাকে। আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে গেলে লোকগুলি আগুন জ্বালিয়ে রান্নাবান্না শুরু করে। আমরা ওপর থেকে শুনতে পাই পাহাড়ি দানা ছাড়া আর কিছু নিয়ে কেউ কথা বলছে না।

আমরা পাথরের আড়ালে বসে সবাইকে লক্ষ্য করতে থাকি। খাবার দাবার যা ছিল দুপুরেই শেষ হয়ে গেছে। অ্যাডভেঞ্চারে বের হলে মনে হয় খিদে বেশি পায়। থোয়াংসা চাইয়ের পাখিটা রান্নার কোন উপায় নেই বলে খাওয়া গেল না। এখন মনে হচ্ছে পুড়িয়েই বেশ খাওয়া যেত আমাদের সাথে শুকনো চিড়ে ছাড়া আর কিছু নেই! বসে বসে সেটাই চিবিয়ে যাচ্ছি সবাই। চিড়ের একটা ভাল গুণ রয়েছে, অল্প একটু খেলেই খানিকক্ষণ পরে বেশ পেট ভরে যায়।

যখন রাত বেশ গম্ভীর হয়েছে ছোট চাচা আমাদের কাজ শুরু করার ইঙ্গিত দিলেন। আমি আর রাজু মিলে চাদরটা ধরে দাঁড়ালাম। মাঝামাঝি একটা চোখ আঁকা আছে, একপাশে কিছু সঁত, আঁকা হয়েছে কাদা মাটি দিয়ে, এমন কিছু স্পষ্ট ছবি নয়। কিন্তু আবছা অন্ধকারে অনেক দূর থেকে দেখলে এটাকে নিশ্চয়ই পাহাড়ি দানোর মাথা বলে মনে হবে। আগে থেকে ঠিক করে রাখা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আমি আর রাজু চাদরটা নাড়তে থাকি, দূর থেকে যেন মনে হয় মাথাটা নড়ছে।

এবারে নিচের লোকগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। কাজটি খুব কঠিন হবার কথা নয়। প্রথমে থোয়াংসা চাই দু’হাত মুখের উপর চেপে বিকটু একটা আওয়াজ করল, প্রথমে ছোট ছোট কয়েকটা ডাক তারপর লম্বা একটা ডাক। ভয়ঙ্কর সেই গর্জন পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। এতটুকু ছেলের গলায় এরকম জোর কেমন করে হল কে জানে। নিচে যারা শুয়ে ছিল তারা সেই বিকট গুঞ্জন শুনে লাফিয়ে জেগে ওঠে। ছোট চাচা সেই সময় স্তূপ করে রাখা পাখরগুলি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, ভয়ঙ্কর শব্দ করে সেগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়তে থাকে। শব্দ শুনে মনে হতে পারে, পুরো পাহাড় বুঝি মাথার ওপর ভেঙে পড়ছে।

নিচে ভয়াবহ আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়, লোকজন চিৎকার করে খোদাকে ডাকতে থাকে। আমি আর রাজু চাদরটা নাড়তে থাকি এবং হঠাৎ একজন সেটা দেখতে পায়। লোকটা “পাহাড়ি দানো” “পাহাড়ি দানো” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে।

খালেদ ফাঁপা গাছের ডালগুলি ঠুকে ঠুকে এক ধরনের শব্দ করতে থাকে, আমরা পাহাড়ি দানোর মাথা নাড়তে থাকি। থোয়াংসা চাই বিকট শব্দ করতে থাকে আর ছোট চাচা তখন আরেকটা পাথরের স্তূপ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। ভয়ঙ্কর শব্দ করে পাথর নিচে গড়িয়ে পড়তে থাকে, নিচের মানুষগুলি এবারে আতঙ্কে একেবারে দিশেহারা হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি কেউ কেউ এবারে ছুটতে শুরু করেছে।

আমরা এবার পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে থাকি, বিকট একটা শব্দ করে থায়াংসা চাই আর সাথে সাথে ছোট চাচা আগে থেকে দাঁড় করানো পাথরের স্তূপগুলো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। আমরা দুপ দুপ করে তখন আরেকটু নিচে নেমে আসি, তারপর আরো নিচে–

নিচের মানুষগুলির কাছে মনে হতে থাকে ভয়ঙ্কর সেই পাহাড়ি দানে বুঝি নিচে নেমে আসছে। তার চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে থাকে। হৈ চৈ করে মানুষগুলি নিজের জিনিসগুলি তুলে নেয় তারপর প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। কয়েক মিনিটের মাঝে দেখতে পেলাম সব মানুষ জায়গাটা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

আমরা আনন্দে আর হাসি চাপতে পারি না। ভয় একটা বিচিত্র জিনিস, যখন সেটা হঠাৎ করে শুরু হয় সেটা কোন যুক্তিতর্ক মানে না। অমানুষিক একটা ভয় দ্রুত একজনের কাছ থেকে আরেকজনের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে, কিছু বুঝার আগেই সবাই আতঙ্কে অধীর হয়ে সম্পূর্ণ অবাস্তব কাজকর্ম করে ফেলে।

আমরা খুব ভাল করে দেখার চেষ্টা করলাম কেউ কি তখনো রয়ে গেছে কি না, মনে হল নেই। সাহেব কাচু মিয়া সবাই প্রাণের ভয়ে ছুটে পালিয়ে গেছে! ছোট চাচার ভয় দেখানোটা এত ভাল কাজ করবে কখনো চিন্তা করি নি। আমরা তখন পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসতে থাকি। গত রাতে ভাল ঘুম হয় নি, সাহেব তার সুন্দর তাঁবুটা ফেলে গেছে, তার ভেতরে শুয়ে খুব আরামে একটা ঘুম দেব। কাল ভোরের মাঝে নিশ্চয় পুলিশ এসে যাবে।

আমরা নিচু গলায় কথা বলতে বলতে নেমে আসছি, বড় একটা পাথর থেকে সাবধানে নিচে নেমে আসলাম তখন হঠাৎ শুনলাম ‘ক্লিক’ করে একটা শব্দ হল।

কিসের শব্দ শোনার জন্যে মাথা ঘুরিয়েছি, আর সাথে সাথে তীব্র টর্চ লাইটের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আমি শুনতে পেলাম সাহেবটা ভারি গলায় বলছে, দুই হাত মাথার ওপরে তুলে দাঁড়াও। একটু নড়লে গুলি করে মাথার খুলি ছাতু করে দেব।

ফ্রেডারিক সাহেব কথা বলেছে ইংরেজিতে কিন্তু তবু আমাদের বুঝতে কোন অসুবিধে হল না, প্রচণ্ড আতঙ্কে আমরা পাথরের মত জমে গেলাম।

.

১২. কাল রাত্রি

কি হচ্ছে বুঝতে আমাদের কিছুক্ষণ লাগল। আমরা ধরা পড়ে গেছি। চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ফ্রেডারিক সাহেব তার বন্দুকটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে কাচু মিয়া। ভয়ে আতঙ্কে হঠাৎ মনে হতে থাকে, আমি বুঝি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না, হাঁটু ভেঙে পড়ে যাব। অনেক কষ্ট করে তবু দাঁড়িয়ে রইলাম। আড় চোখে দেখলাম আমার সামনে রাজু, এক পাশে খালেদ, পিছনে ছোট চাচা। থোয়াংসা চাইকে দেখতে পেলাম না।

ফ্রেডারিক সাহেব আবার চিৎকার করে বলল, হ্যান্ডস আপ!

আমরা যন্ত্রের মত হাত উপরে তুললাম।

সাহেব এক হাতে বন্দুকটা ধরে রেখে অন্য হাতে সশব্দে কাচু মিয়ার গালে একটা চড় মেরে ইংরেজিতে বলল, দেখছ তোমার পাহাড়ি দানো? দেখছ? স্টুপিড গাধা কোথাকার।

ফ্রেডারিক সাহেবের এরকম চড় খেয়েও কাচু মিয়া অপ্রতিভের মত হেসে বলল, বুঝতে পারি নাই সার! একেবারে বুঝতে পারি নাই।

আমাকে বুঝালে এরা ফিরে চলে গেছে। এখন তাহলে আসল কোথা থেকে? হ্যাঁ, কোথা থেকে এল? আকাশ থেকে?

কাচু মিয়া গালে হাত বুলাতে বুলাতে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বল, আমাকে মাঝিরা বলেছে, ওরা দেখেছে ওদের চলে যেতে। একজন বড় মানুষ আর তিনজন বাচ্চা। মিছা কথা বলেছিল।

এই হচ্ছে তোমার একজন বড় মানুষ আর তিনজন ছোট বাচ্চা। ভাল করে দেখে নাও, আর কিছুক্ষণ পরে থাকবে একটা বড় মানুষের ডেডবডি আর তিনটা বাচ্চ ছেলের ডেডবডি!

সাহেবের কথা শুনে আমরা ভয়ানক চমকে উঠি। রাজু ভীতু মুখে একবার আমার দিকে তাকাল দেখলাম, তার সমস্ত মুখ ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

কাচু মিয়া দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আমার হাতে ছেড়ে দেন আমি এক কোপে যদি এদের গলা না নামিয়ে দেই।

সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি যাও সব কুলীদের গিয়ে ডেকে আন।

এখন কেমন করে ডেকে আনব? এতক্ষণে সবাই তো দেশ ছেড়ে চলে গেছে।

ফ্রেডারিক সাহেব মুখ লাল করে বলল, আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি যদি গিয়ে কুলী যোগাড় করে না আন, তিনটা ডেডবডির জায়গায় চারটা ডেডবডি পড়ে থাকবে।

সাহেব এবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, দুই হাত ওপরে তুলে সামনের দিকে হাঁট।

আমরা দুই হাত ওপরে তুলে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। প্রথমে রাজু, তারপর আমি, আমার পর খালেদ, খালেদের পরে ছোট চাচা। থোয়াংসা চাই নেই, সাহেব কিংবা কাচু মিয়া তাকে খুঁজছেও না। তারা জানেও না যে, আমাদের সাথে থোয়াংসা চাই ছিল। সে কি একা কিছু একটা করতে পারবে?

কচু মিয়া আমাদের পিছনে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, কত বড় বদমাইসের দল। বিলের নিচে যখন মাছে এসে লাশকে ঠুকরে ঠুকরে খাবে, তখন বুঝবে মজা। আমার সাথে মামদোবাজি।

ফ্রেডারিক সাহেব ভারি গলায় বলল, কি বলছ?

জে না। কিছু না।

.

তাঁবুর সামনে এসে ফ্রেডারিক সাহেব আমাদের মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসতে বলল। আমরা কোন কথা না বলে হাঁটু গেড়ে বসলাম।

সাহেব তার হাঁটুতে বন্দুকটা রেখে রাগে ফায়ার করতে করতে বলল, এই বদমায়েসী কেন করেছ?

ছোট চাচা এই প্রথম একটা কথা বললেন, বদমায়েসী কে করেছে? আমরা, না তোমরা?

কাচু মিয়া হুঙ্কার দিয়ে বলল, চোপ!

ছোট চাচা বললেন, এটা আমাদের দেশের সম্পদ, তুমি বিদেশী মানুষ, এই সম্পদ চুরি করে নিতে চাও? ডাকাতি করে নিতে চাও?

কাচু মিয়া আবার হুঙ্কার দিয়ে বলল, খবরদার।

ছোট চাচা বললেন, তুমি ভেবেছ তুমি পার পেয়ে যাবে? কক্ষনো না। আমি পুলিশকে খবর পাঠিয়েছি। তারা আসছে। কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাবে।

ফ্রেডারিক সাহেব হঠাৎ একটু হকচকিয়ে গেল। প্রশ্ন দৃষ্টিতে কাচু মিয়ার দিকে তাকাল। কাচু মিয়া মাথা নেড়ে বলল, আরে না, স্যার। পরিষ্কার মিছা কথা, ভয় দেখাচ্ছে।

আমরা চুপ করে বসেছিলাম, কেউ একটা কথাও বলছি না, হঠাৎ শুনলাম খালেদ পরিষ্কার গলায় একেবারে আমেরিকান ইংরেজিতে বলল, না ফ্রেড, এই মানুষটি মিথ্যে কথা বলছে না।

খালেদের ইংরেজি উচ্চারণ শুনে সাহেব একেবারে চমকে উঠল, বলল, তুমি এরকম ইংরেজি কোথায় শিখেছ?

আমি একজন আমেরিকান। আমার জন্ম আমেরিকায়, বড় হয়েছি আমেরিকায়, কথা বলি আমেরিকানদের মত, চিন্তা করি আমেরিকানদের মত। এই পোড়া দেশে তোমার যেরকম যন্ত্রণা হচ্ছে, আমারো সেই রকম হচ্ছে।

আমরা অবাক হয়ে খালেদের দিকে তাকালাম আর সাথে সাথে বুঝে গেলাম সে কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছে। ফ্রেডারিক সাহেব খানিকক্ষণ খালেদের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বলার চেষ্টা করছ?

আমি গত তিনদিন থেকে এই মানুষটার শক্ত খুলির ভেতরে একটা জিনিস ঢোকানোর চেষ্টা করছি। খালেদ বুড়ো আঙুল দিয়ে ছোট চাচাকে দেখিয়ে বলল, মানুষটার মাথা নিরেট পাথর।

ছোট চাচাও বুঝে গেলেন কিছু একটা ব্যাপার হচ্ছে। রেগে যাবার ভান করে বললেন, খালেদ, তুমি চুপ করবে?

খালেদ ছোট চাচাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, এই মানুষটা এই দেশের অন্য সব মানুষের মত মাথা খারাপ। বিষয়বুদ্ধি বলে কিছু নেই। আমি তাকে কম করে হলেও একশবার বলেছি, এটা জানাজানি করিয়ে লাভ নেই। ফসিলগুলি লুকিয়ে তুলে নিয়ে যাই, মোটা দামে বিক্রি করা যাবে, লোকটা রাজি হয় নাই।

ছোট চাচা আবার চিৎকার করে বললেন, এটা আমার দেশের সম্পদ। আমি কাউকে নিতে দেব না।

খালেদ গলা নিচু করে বলল, ফ্রেড, এই মানুষটার বিচারবুদ্ধি বলে কিছু নেই, মাথাও খুব গরম। আমার মনে হয় তাকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তুমি বিশ্বাস করবে না, এই লোকটা গতকাল আমার গায়ে হাত তুলেছে। আমেরিকা হলে শিশু নির্যাতনের জন্যে ছ’বছর জেল হয়ে যেতো।

ফ্রেডারিক সাহেব খালেদকে ঠিক তখনো বিশ্বাস করে নি কিন্তু ছোট চাচাকে বেঁধে ফেলার বুদ্ধিটা লুফে নিল। কাচু মিয়াকে বলল, তার তাঁবুর ভেতর থেকে নাইলনের দড়ি বের করে ছোট চাচাকে বেঁধে ফেলতে।

ছোট চাচা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খালেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। খালেদ তার দৃষ্টি এড়িয়ে সাহেবকে বলল, আমি তোমার সাথে একটা ডিল করতে পারি?

কি ডিল?

আমরা আজকে সকালে এখানে এসেছি, পুরো জায়গাটা ভাল করে দেখেছি। এখানে নানা রকম ফসিল রয়েছে, সবচেয়ে চমকপ্রদ ফসিল হচ্ছে ডাইনোসরের ডিম, একটা ভেঙে তার ভেতর থেকে বাচ্চা বের হচ্ছে। কমপ্লিট ফসিল। তুমি যদি রাজি থাক আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব, তুমি তুলে নিয়ে যেতে পারবে, মিলিওন ডলারে বিক্রি হবে।

তার বদলে তুমি কি চাও?

আমাকে কয়েকটা ফসিল নিয়ে যেতে দেবে। পুলিশের কথাটা সত্যি–আজ রাতে পালাতে না পারলে আর কখনো এই ফসিল নেয়া যাব না।

ফ্রেডারিক সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে খালেদের দিকে তাকিয়ে রইল, তখনো ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।

খালেদ বলল, আমাদের হাতে সময় বেশি নাই! এই একমাত্র সুযোগ।

কচু মিয়া তখন ছোট চাচাকে মাটিতে ফেলে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে। ছোট চাচা যন্ত্রণার একটা শব্দ করলেন। আমার খুব মায়া লাগল, কিন্তু কিছু করার নেই।

খালেদ আবার বলল, তোমারা দুজন বড় মানুষ, তোমাদের কাছে বন্দুক, আর আমরা মাত্র তিনজন বাচ্চা তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে না চাইলে নাই কিন্তু ডাইনোসরের ডিমটা দেখে আসতে তো কোন ক্ষতি নেই। আমি চোখ বুজে বলতে পারি, কার্নেগি মিউজিয়ামে সেটা এক মিলিওন ডলারে বিক্রি হবে।

সাহেব শেষ পর্যন্ত একটু নরম হল। বলল, ঠিক আছে আমাকে নিয়ে যাও। আমি না দেখে কোন কথা দিচ্ছি না।

ঠিক আছে। কিন্তু যদি তোমার পছন্দ হয় তাহলে আমাকে আমার পছন্দ মত কয়েকটা ফসিল নিয়ে আজ রাতের মাঝে পালিয়ে যেতে দেবে?

সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, দেব।

চল, তাহলে যাই।

সাহেব আমাকে আর রাজুকে দেখিয়ে বলল, এরা দুজন?

এরা আমাদের সাথে যাবে, জায়গাটা দিনের বেলা দেখেছি, রাতের বেলা খুঁজে পতে একটু ঝামেলা হতে পারে। এরা থাকলে সাহাষ্য করতে পারবে।

বেশ, তাহলে চল।

আমরা উঠে দাঁড়ালাম। প্রথমে খালেদ তার পিছনে রাজু তারপর আমি। আমার পিছনে সাহেব, তার হাতে বন্দুক, সাহেবের পিছনে কাচু মিয়া। দু’জনের হাতে বড় দুটো টর্চ লাইট।

খালেদের পিছু পিছু আমরা হাঁটতে থাকি আর ঠিক তখন আমি বুঝে গেলাম খালেদ কি করতে যাচ্ছে। সে সাহেবকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে থোয়াংসা চাইয়ের ফাঁদের দিকে। কোথায় আছে থোয়াংসা চাই? নিশ্চয় আশেপাশে কোন পাথরের আড়াল থেকে লুকিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ঠিক প্রয়োজনের সময় নিশ্চয়ই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার রাম দা নিয়ে। আমার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে উত্তেজনায়। সবকিছু হবে তো ভালভাবে? একজন ফাঁদে আটকা পড়ে গেলেও আরেকজন রয়ে যাবে, তাকে আমাদেরই সামলে নিতে হবে। পারব তো সামলে নিতে? কিছু একটা হয়ে যাবে না তো? আমি চোখ বন্ধ করে খোদাকে ডাকতে থাকি।

খালেদ গলার স্বর খুব স্বাভাবিক করে সাহেবের সাথে একটা আলোচনা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। বাস্কেটবল খেলায় কারা এসেছে, কাদের আসা উচিত ছিল, এ ধরনের কথাবার্তা। সাহেবের কথাবার্তায় খুব একটা উৎসাহ নেই। হুঁ হুঁ করে কথা শেষ করে দিচ্ছে।

আমরা থোয়াংসা চাইয়ের ফাঁদের কাছে এসে গেছি। আর কয়েক পা গেলেই মাটিতে লুকানো দড়ির ফাঁদ। খুব সাবধানে সেটা পার হয়ে যেতে হবে। আমার বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে, দেখলাম খালেদ একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে ফাঁসটা পার হল। রাজুও পার হল লাফ দিয়ে। এক জায়গায় তিনজনই লাফ দিলে সাহেব যদি কিছু সন্দেহ করে? আমি তাই না লাফিয়ে পাশ কাটিয়ে গেলাম। আড়চোখে সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছি, প্রাণপণে খোদাকে ডাকছি, আর ঠিক জাদুমন্ত্রের মত ঘটল ব্যাপারটি। সাহেব পা দিল দড়ির ফাঁসে আর একেবারে বিদ্যুতের গতিতে উল্টে গেল সে। এক পা ওপরে দিয়ে ঝুলে গেল সাথে সাথে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটেছে যে, সাহেব কিছু বুঝতেই পারল না। কাচু মিয়া ভয় পেয়ে একটা চিৎকার দিল, সাথে সাথে আমরা তিনজন এক সাথে কাচু মিয়ার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মাটিতে ফেলে গায়ের জোরে তাকে কিল ঘুষি মারছি, চেপে রেখেছি মাটিতে, উঠতে দিচ্ছি না কিছুতেই।

সাহেব উল্টো অবস্থায় ঝুলতে থাকে, তখনো সে এক হাতে টর্চ লাইট, অন্য হাতে বন্দুকটা ধরে রেখেছে। ঝুলে থেকে ঘুরছে সে, তাই বন্দুকটা আমাদের দিকে ধরতে পারছে না। সেই অবস্থায় চিৎকার করে বলল, ছেড়ে দাও ওকে। খুন করে ফেলব না হয়।

আমরা ছাড়লাম না কাচু মিয়াকে। আরো জোরে ঠেসে ধরে রাখলাম মাটিতে।

ছেড়ে দাও। সাহের তখনো বন্দুকটা আমাদের দিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে, পারছে না। ঠিক তখন আমরা দেখতে পেলাম, থোয়াংসা চাই তার রাম দা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। তার ভাষায় কি যেন বলল সে হিংস্র গলায়।

সাহেব আমাদের ছেড়ে এবার বন্দুকটা হোয়াংসা চাইয়ের দিকে ধরল। চিৎকার করে বলল, থামো, না হয় গুলি করে দেব।

হোয়াংসা চাই খামার কোন লক্ষণ দেখাল না। রাম দা’টা মাথার ওপর ঘুরিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে এগিয়ে আসতে থাকে।

সাহেব কেমন জানি ভয় পেয়ে যায় হঠাৎ, ঝুলে থেকে ভয় পাওয়া গলায় বলল, এটা কে?

আমাদের বন্ধু থোয়াংসা চাই।

তাকে বল থামতে, না হলে আমি গুলি করব।

তুমি বল, আমরা তার ভাষা জানি না।

ভাষা জান না?

না।

সাহেব অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বন্দুকটা থোয়াংসা চাইয়ের দিকে ধরে। চিৎকার করে বলে, গুলি করে দেব। গুলি করে দেব কিন্তু, থামছে না কেন?

খালেদ মাথা নেড়ে বলল, থোয়াংসা চাই কখনো বন্দুক দেখে নি, সে জানে না এটা কি?

গুলি করব আমি।

খালেদ চিৎকার করে বলল, তুমি উল্টো হয়ে ঝুলছে ফ্রেড। তুমি ঠিক করে গুলি করতে পারবে না। চেষ্টা করতে যেও না, থোয়াংসা চাই এক কোপে তোমার মাথা ফেলে দেবে। খোদার কসম।

আই ডোন্ট কেয়ার। সাহেব বন্দুকটা তুলে ধরে। থোয়াংসা চাই ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে আসে। এক পা। তারপর আরেক পা। অরপর আরেক পা। আমরা অমানুষিক আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলি।

সমস্ত অরণ্যে যেন একটা ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে আসে। সমস্ত পৃথিবী, গাছপালা, আকাশ বাতাস যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে। আমাদের সমস্ত শরীর, সমস্ত অনুভূতি যেন অপেক্ষা করতে থাকে গুলির ভয়ঙ্কর শব্দের জন্যে, ভয়ংকর আর্তনাদের জন্যে, ভয়াবহ চরম একটা পরিণতির জন্যে।

কতক্ষণ সময় কেটেছে আমরা জানি না, মনে হতে থাকে যেন কয়েক যুগ। ভয়ে ভয়ে আমরা চোখ খুলে তাকাই। থোয়াংসা চাই তার রাম দা তখন তুলে ধরে রেখেছে কোপ দেয়ার ভঙ্গিতে আর ঠিক তার বুকের মাঝে ফ্রেড বন্দুকটা ধরে রেখেছে। ট্রিগারে আঙুল। একজন আরেক জনের চোখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী ভয়ঙ্কর, কী অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য!

খালেদ ফিসফিস করে বলল, আমার কথা শোন ফ্রেন্ড। বন্দুকটা ফেলে দাও।

ফ্রেড তার কথা শুনল বলে মনে হল না। খেয়াংসা চাই স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছে না। সমস্ত শরীর ধনুকের ছিলার মত টান টান হয়ে আছে।

খালেদ আবার বলল, বন্দুকটা ফেলে দাও ফ্রেড।

আমরা দেখতে পেলাম খুব ধীরে ধীরে ফ্রেড তার বন্দুকটা নামিয়ে আনে তারপর হাত থেকে নিচে ফেলে দেয়। হেরে গেছে সে। হেরে গেছে একটা পাহাড়ি শিশুর সাহসের কাছে।

আমাদের বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে।

.

ছোট চাচার হাত পিছন দিকে শক্ত করে বেঁধে কাচু মিয়া তাকে উপুড় করে ফেলে রেখেছিল। ছোট চাচা অনেক কষ্ট করে সোজা হয়ে বসেছেন। সেই অবস্থায় যখন আমাদেরকে আসতে দেখলেন এত অবাক হলেন বলার মত নয়, তাকে অবাক করে দেয়ার জন্যে আমরা ব্যাপারটা করেছিও অনেক চমকপ্রদ। কাচু মিয়া এবং ফ্রেড দুজনের হাত পিছনে বাধা, দড়ি ধরে কাচু মিয়ার পিছনে রাজু, ফ্রেডের পিছনে খালেদ, সামনে থোয়াংসা চাই, তার ঘাড়ে বিশাল রাম দা। আমি সবার পেছনে, আমার হাতে বন্দুক। থোয়াংসা চাইয়ের হাতে একটা টর্চ লাইট, আমার হাতে আরেকটা। আমরা গান গাইতে গাইতে আসছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি গানটা তৈরি হয়েছে তাই খুব উঁচু দরের শিল্পকর্ম হয় নি। কিন্তু গভীর রাতে এই জঙ্গলের মাঝে সেটি চমৎকার শোনাচ্ছিল। গানটা এরকমের–

প্রথমে আমি বলি : কাচু মিয়া ফ্রেডি মিয়া দুই শয়তান –

তখন অন্য সবাই বলে : দুই শয়তান।

আমি আবার বলি : ধরে আনি পিছ মোড়া ডান বাম ডান।

অন্য সবাই তখন মাটিতে পা দাপিয়ে বলে : ডান বাম ডান ডান বাম ডান।

তখন থোয়াংসা চাই তার রাম দা ঘুরিয়ে এক পাক নেচে মুখে হাত দিয়ে বলে : হুয়া হুয়া হুয়া হুয়া।

আমরা সবাই বলি : ঘ্যাং ঘ্যাং ঘ্যাং।

তারপর আমরা সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে বিকট স্বরে ঘ্যাং ঘ্যাং করতে থাকি।

যদি আমরা এমনি এমনি চলে আসতাম, তাহলে বেশি দেরি হত না কিন্তু এই গানটার কারণে আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরি হল। আমাদের দেখে ছোট চাচার মুখের যা একটা অবস্থা হল সেটা দেখার মত। দুই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে একেবারে গোল আলুর মত, চোয়াল স্কুলে পড়েছে, মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। শুধু বলছেন, তো- তা তো তোরা- তোরা- তোরা

আমি বললাম, হ্যাঁ, চাচা, আমরা।

থোয়াংসা চাই ছুটে গিয়ে রাম দা দিয়ে ঘ্যাচ করে ছোট চাচার বাঁধন কেটে দিল। তারপর মুখে হাত দিয়ে বলল, হুয়া হুয়া হুয়া।

আমরা সবাই বললাম, ঘ্যাং ঘ্যাং ঘ্যাং!

.

১৩. শেষ কথা

মুসলিম ভাই পুলিশকে নিয়ে হাজির হল পরের দিন দুপুর বেলা। আমরা ততক্ষণে ফিরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। রাতে খুব ভাল ঘু্য হয় নি, হওয়ার কথাও নয়। এত উত্তেজনার মাঝে ঘুম আসতে চায় না। ফ্রেড আর কাচু মিয়াকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সারা রাত একজন না হয় আরেকজন পাহারা দিয়েছে। ছোট চাচা পর্যন্ত জেগেছিলেন যখন তার পাহারা দেবার কথা। কাচু মিয়া আর ফ্রেড অবশ্যি কোন রকম ঝামেলা করেনি। ফ্রেড প্রথম দিকে আমাদের সাথে কথা বলছিল, তাকে ছেড়ে দিলে সে কত টাকা দিবে, এ ধরনের কথা। ছোট চাচা তখন গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি পুঁজিবাদী দেশের মানুষ, মনে কর টাকা দিয়ে সব হয়। তোমার দেশে হয়তো হয় কিন্তু এখানে হয় না।

ফ্রেড বলল, তোমার টাকার দরকার নেই?

আছে, কিন্তু টাকার লোভ নেই।

ফ্রেড আর কোন কথা বলল না। ছোট চাচা না হয়ে যদি বড় চাচা হতো তাহলেই সর্বনাশ হত!

পুলিশ অফিসার কাচু মিয়াকে এভাবে বেঁধে রেখেছি দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন, এইবার পেয়েছি ব্যাটাকে। জন্মের মত সিধে করে দেব।

অনেক খুনখারাপি করেছে, প্রমাণের অভাবে নাকি সবসময় ছাড়া পেয়ে যায়। এবারে আর ছাড়াছাড়ি নেই। ফ্রেডকে নিয়ে অবিশ্যি পুলিশ অফিসার খুব আশাবাদী নন। যাথা নেড়ে বললেন, খবর পৌঁছানো মাত্ৰ ওপর থেকে টেলিফোন আসবে, তখন ছেড়ে দিতে হবে।

ছোট চাচা বললেন, কোন সমস্যা নেই। ঢাকায় গিয়ে সব খবরের কাগজে এমনভাবে খবরটা ছাপানো হবে যে, কারো বাবার সাধ্যি হবে না তাকে ছাড়িয়ে নেয়। পুলিশ ভদ্রলোক অবশ্যি তবু মাথা নেড়ে বললেন, এই সাদা চামড়ার লোকের কিছু হয় না। দেশের পর দেশ জ্বালিয়ে দেয় তবু কিছু হয় না!

ছোট চাচা বললেন, এই ফসিল গুলির কিছু হবে না তো?

পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন, দেশের সম্পদ। আমরা জান দিয়ে রক্ষা করব। ফিরে গিয়েই আমি রিপোর্ট পাঠাচ্ছি হেড অফিসে।

.

আমাদের ফিরে আসতে আসতে আরো দু’দিন কেটে গেল। সাঙ্গু নদীতে নৌকা ভাসিয়ে মুসলিম ভাই আমাদের ফিরিয়ে আনল। থোয়াংকা চাইকে নামিয়ে দেয়া হল তার পাহাড়ে। আমাদের বিশ্বাসই হতে চাইছিল না তাকে ছেড়ে আমরা চলে যাব। নৌকা থেকে নেমে থোয়াংসা চাই আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে কিছু একটা বলল। আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না। খালেদ তার হাত ধরে বলল, থোয়াংসা চাই, আবার দেখা হবে।

আমি বললাম, তুমি আমাদের প্রাণের বন্ধু।

রাজুর মনটা খুব নরম। সে থোয়াংসা চাইকে জড়িয়ে ধরে একেবারে হু হু করে কেঁদে ফেলল। আর তাকে কাঁদতে দেখে আমরাও কেঁদে ফেললাম। আর আমাদের কাঁদতে দেখে থোয়াংসা চাইও ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে শুরু করল।

ছোট চাচা বললেন, ছিঃ কাঁদে না। আবার আমাদের দেখা হবে। আমরা আবার আসব।

মুসলিম ভাই বলল, এসে আমাকে খোঁজ করবেন। আমি এই পাহাড়ে এসে থোয়াংসা চাইকে বের করব।

খালেদ বলল, হ্যাঁ, আবার আসব। বাবা বলেছে, আমরা আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসব। এই পাহাড়েই থাকব আমরা!!

থোয়াংসা চাই কিছু বলল না। এগিয়ে এসে প্রথমে আমাকে, তারপর খালেদকে, তারপর রাজুকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরে মুখ ঘুরিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটে গেল। যতক্ষণ না সে ঘন অরণ্যে অদৃশ্য না হয়ে গেল আমরা তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পানিতে তখন বনজঙ্গল পাহাড় সব অস্পষ্ট হয়ে গেছে, থোয়াংসা চাই থাকলেও তাকে দেখতে পেতাম না।

.

ফসিলের ব্যাপারটা নিয়ে অনেক হৈ চৈ হয়েছিল। খালেদের তোলা ছবিগুলো দিয়ে খবরের কাগজে কাগজে বড় বড় লেখা বের হয়েছিল। প্রথম প্রথম সাংবাদিকেরা এসে আমাদের সাথে কথা বলেছে, আমাদের ছবিও কোথায় কোথায় ছাপা হয়েছে। খালেদ আমেরিকা গিয়ে নাকি কংগ্রেসম্যানদের কাছে ফ্রেডের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছে। সেখানেও নাকি সেটা নিয়ে খানিকটা হৈ চৈ হয়েছে। হীরা চাচা চিঠি লিখে জানিয়েছেন, অনেকদিন দেশের বাইরে থাকা হল। এখন দেশে ফিরে আসতে চান। খালেদকে নিয়েই তার একটু ভয় ছিল, এখন তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। আমরা খুব আশা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি। কে জানে হীরা চাচাকে দেখে হয়তো বড় চাচা, জয়নাল চাচা আর সুন্দর চাচা একটু মানুষ হবেন! আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনে তারা যা একটা কাণ্ড করলেন সেটা আর বলার নয়।

.

সেই রহস্যময় পাহাড় থেকে ফসিল তুলে আনা শুরু হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম টি-রেক্সের ফসিল, কিন্তু এটার ঠিক নাম হচ্ছে টার্বোসোরাস। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, টি-রেক্সের কাছাকাছি এক ধরনের ডাইনোসোর। ফসিলগুলি রাখার জন্যে যাদুঘরে একটা আলাদা বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে। এখনো পুরোপুরি শেষ হয় নি। আমরা একদিন দেখতে গিয়েছিলাম, কোন মানুষজন নেই দেখে দরজার ফাঁক দিয়ে আমি আর রাজু ঢুকে গেলাম। শক্ত কংক্রিটের একটা টেবিলে একটা ডাইনোসোরের মাথা রাখা আছে। কী ভয়ঙ্কর তার মুখ। আমি একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছি, হঠাৎ পিছন থেকে একজন খপ করে আমাদের ঘাড় ধরে ফেলল। আমরা তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্ক মানুষ, চোখ পাকিয়ে চিৎকার করে বলল, কি করছ এখানে, হ্যাঁ?

দেখছি।

এটা কি রঙ তামাশার জিনিস? জান এটা কি? জান?

আমি কিছু বলার আগেই লোকটা গর্জন করে বলল, জান এটা কোথা থেকে এসেছে? জান? দেশের কত বড় সম্পদ তুমি জান? জান?

আমি আবার কিছু বলার আগেই লোকটা আমাদের ঘাড় ধরে ঠেলে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে থাকে, বাইরে ঠেলে দিয়ে বলে, আর কখনো যেন তোমাদের না দেখি এখানে। দুষ্টু ছেলে।

আমরা খুব অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আর এমন রাগ উঠল বলার মত নয়। লোকটা দরজা বন্ধ করতে করতে থেমে গিয়ে বলল, এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলার আছে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আছে।

কি?

আমি দুই হাত মুখে ধরে বললাম, হুয়া হুয়া হুয়া হুয়া!

রাজুর এক সেকেন্ড সময় লাগল বুঝতে, যেই বুঝতে পারল তখন দুই হাত ওপরে তুলে লাফাতে লাফাতে বলল, ঘ্যাং ঘ্যাং ঘ্যাং!

কি হচ্ছে? কী হচ্ছে এটা?

আমি বললাম, টি-রেক্সকে জিজ্ঞেস করে দেখেন। সে জানে।

.

লোকটা খুব অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

লেখকের কথা

আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমরা বান্দরবন থাকতাম। বান্দরবন খুব সুন্দর জায়গা। ছোট বেলায় সেটিকে যে কী রহস্যময় মনে হত, কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আমার বাবা সেখানে পুলিশে চাকুরি করতেন। আরাকান থেকে সেখানে ডাকাতের আসত আর আমার বাবাকে নৌকা করে পাহাড়ে যেতে হত তাদের সাথে মুখোমুখি হবার জন্যে। বাবা এসে আমাদের সেই রহস্যময় পাহাড়ের গল্প করতেন, আমরা অবাক হয়ে শুনতাম। বান্দরবন স্কুলে আমার অনেক উপজাতীয় বন্ধু ছিল, একটি মগ বাচ্চা ছিল আমার প্রাণের বন্ধু, তার নাম ছিল থোয়াংসা চাই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবাকে পাকিস্তান মিলেটারিরা মেরে ফেলেছিল। বান্দরবনের সেই রহস্যময় এলাকা নিয়ে আমার বাবার যত লেখালেখি ছিল সব তখন হারিয়ে গেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে সব সময় আমি ভাবতাম, আমার বাবা যেখানে গিয়েছিলেন সেই পাহাড়ে একদিন আমি বেড়াতে যাব। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন দুজন বন্ধুকে নিয়ে সত্যি একবার সেই রহস্যময় এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। একজন মাঝি নৌকা করে আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। নৌকায় থাকা, নৌকায় খাওয়া, অন্ধকার নেমে এলে নৌকাতে ঘুম। কী চমৎকার ছিল সেই রহস্যময় পাহাড়, সেই বন, সেই নদী, সেই উপজাতীয় মানুষ। আর কী চমৎকার রান্না করত সেই হাসিখুশি মাঝি। সেই মাঝির নাম ছিল মুসলিম, আমরা তাকে ডাকতাম মুসলিম ভাই।

এই বইয়ের সমস্ত চরিত্র, সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক। শুধু শুধু দুটি নাম, ‘থোয়াংসা চাই’ আর ‘মুসলিম ভাই’ কাল্পনিক নয়। নাম দুটি সত্যি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *