টি-রেক্সের সন্ধানে – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১. আমাদের বাসা
মালিবাগের মোড়ে যে নতুন চায়ের দোকান খুলেছে, তার ডান পাশের রাস্তাটা ধরে গিয়ে প্রথম গলিটার সামনে যে ময়লা দোতলা দালানটি চোখে পড়ে সেটা আমাদের বাসা। আমাদের মানে ঠিক আমাদের না, আমার চাচাদের। আমার চাচারা ছয় ভাই। তার মাঝে চারজন এখানে থাকেন। যে দুজন থাকেন না তার একজন আমার বাবা। বাবার থাকার কোন উপায় নেই, কারণ বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। আমি যখন মায়ের পেটে, তখন বাবা একটা ক্রেনের ওপর থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। ব্রেনের মাঝে চোট লেগেছিল। দুই দিন হাসপাতালে থেকে মরে গেলেন। আমার জন্মের বছরে বাবা মারা গেছেন বলে আমাকে ধরা হয় অপয়া। শুনলে মনে দুঃখ পাব বলে কেউ সোজাসুজি বলে না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে। তবু দিনে কয়েকবার করে আমাকে শুনতে হয়। আমি অবশ্যি দুঃখ টুঃখ পাই না। বাবা মারা যাবার পর আমার মা একটু অন্য রকম হয়ে গেছেন। অন্যেরা বলে মাথা খারাপের মত, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। দিনরাত শুধু মোটা মোটা বই পড়েন। আমাকে সেজন্য বেশি দেখেন শুনেননি, আমি নিজে নিজেই বড় হয়েছি। নিজে নিজে বড় হলে মনে হয়, মানুষের বেশি দুঃখকষ্ট হয় না। সে জন্যে আমার বেশি দুঃখকষ্ট নেই।
আরেকজন যে চাচা এই বাসায় থাকেন না, তিনি হচ্ছেন হীরা চাচা। হীরা চাচা আমেরিকা থাকেন। সেখানে নাকি লস এঞ্জেলস বলে একটা শহর আছে। সেই শহরে নাকি একটা পাহাড় আছে। তার কাছে নাকি একটা সমুদ্র আছে। সেই সমুদ্রের কাছে একটা ছবির মত বাসায় থাকেন হীরা চাচা।
হীরা চাচাকে আমি অনেকদিন দেখি না। শেষবার যখন দেখেছি তখন আমি অনেক ছোট, পরিষ্কার করে মনে নেই। শুধু মনে আছে, তার ঠিক আমার সমান একটা ছেলে, সে দিনরাত শুধু ট্যাঁ ট্যাঁ করে চেঁচাচ্ছে, আর সবাই সেটা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। হীরা চাচা মাঝে মাঝে আমেরিকা থেকে ছবি পাঠান, ছবিতে তাকে দেখায় খুব সুন্দর, ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। তার মাঝে গোলাপী গাল।
আমার তিন ফুফু, তাদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ফুফুর বিয়ে আবার ভেঙেও গেছে। ছোট ফুফা মানুষটাকে আমার ভালই লাগত, একেবারে সিনেমার নায়কদের মত চেহারা কিন্তু মানুষটা নাকি ভীষণ বদমাইস। কেন বদমাইস সেটা বাচ্চা বলে আমাদের শুনানো হয় না কিন্তু আমরা ঠিকই জানি, শুধু বড়দের সামনে ভান করি যে কিছুই জানি না। বিয়ে ভাঙার পর থেকে ছোট ফুফু এখানে থাকেন। আমার মায়ের মত ছোট ফুফু অন্যরকম হয়ে যাননি; কিন্তু দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা সবার ওপর রেগেমেগে আগুন হয়ে থাকেন। কেউ তার ধারেকাছে যাবার সাহস পায় না। ছোট ফুফুর ছেলে রাজু আমার সাথে এক স্কুলে পড়ে। আমার থেকে সে এক ক্লাস উপরে কিন্তু তবু সে আমার এক নম্বর বন্ধু। এ বাসায় আমাদের বয়সী আর কোন বাচ্চা নেই। যারা আছে তারা হয় অনেক ছোট, দিনরাত আমাদের জ্বালাতন করে, না হয় অনেক বড়, যারা আমাদের মানুষ বলে বিবেচনা করে না।
যেমন ধরা যাক, বড় চাচার কথা। তার ধারণা, ছোট বাচ্চারা হচ্ছে সাক্ষাৎ ইবলিশ। হয় তাদের ধরে শক্ত পিটুনি দেয়া দরকার, না হয় ধমক দিয়ে ঠাণ্ডা করে রাখা দরকার। সেজন্যে আমি বড় চাচাকে দুই চোখে দেখতে পারি না। তা ছাড়া বড় চাচার মত কৃপণ মানুষ এই পৃথিবীতে মনে হয় আর একটাও নেই। যদি অলিম্পিকে কৃপণ মানুষদের প্রতিযোগিতা থাকত, তাহলে বড় চাচা বাংলাদেশের হয়ে একই সাথে স্বর্ণ পদক আর রৌপ্য পদক নিয়ে আসতে পারতেন। তাঁর হাত থেকে একবার একটা আধুলি গড়িয়ে নালায় পড়ে গিয়েছিল বলে তিনি আধ ঘণ্টা একটা কাঠি দিয়ে নালার ময়লা ঘাঁটাঘাটি করেছিলেন। পেনসিল যখন লিখে লিখে ছোট হয়ে যায়, আর যখন সেটা হাত দিয়ে ধরা যায় না, বড় চাচা তখন বাঁশের কঞ্চি কেঁদে সেটা লম্বা করে নেন। আমাদের স্কুলের লেখালেখি করতে হয় পেনসিল দিয়ে। একবার লেখার পর বড় চাচা রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে লেখাগুলো তুলে সেখানে আবার লিখেন। চিনির দাম বেশি বলে বড় চাচা লবণ দিয়ে চা খান। আমাদের বাসায় পয়সা দিয়ে কোন খবরের কাগজ কেনা হয় না, বড় চাচা রাস্তার মোড় থেকে পড়ে আসেন। সকালবেলা বড় চাচার মুখ দেখলে নাকি সমস্ত দিন বরবাদ হয়ে যায়। বড় চাচা রিটায়ার করে চব্বিশ ঘণ্টা বাসায় থাকেন, সারা দিনে একটু পরে পরে তার মুখ দেখতে হয় বলে মনে হয় আমার জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাচ্ছে।
বড় চাচার পরের জন হচ্ছেন জয়নাল চাচা। জয়নাল চাচা হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে নীরস মানুষ। সব সময় জয়নাল চাচা ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকাতে থাকেন। একটু পরে পরে কাঠিটা বের করে চোখ কুঁচকে দেখেন কান থেকে কিছু বের হল কি না। যদি কিছু বের হয়, তাহলে খুব যত্ন করে সেটা টেবিলের কোণায় মুছে ফেলেন। যখন তিনি ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকাচ্ছেন না, তখন তিনি ঝাঁটার কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে থাকেন। খানিকক্ষণ দাঁত খুঁচিয়ে তিনি কাঠিটা নাকের কাছে এনে শুঁকে দেখে মুখ বিকৃত করে ফেলেন। যদি নিজের মুখের দুর্গন্ধ নিজের কাছে এত খারাপ লাগে, তাহলে সেটা শুঁকতে যান কেন সেটা এক রহস্য। এই রকম নানা ধরনের নোংরা কাজ ছাড়া জয়নাল চাচার আর কোন কিছুতে উৎসাহ নেই। সেবার যখন সাইক্লোনে দুই লাখ লোক মরে গেল আমি জয়নাল চাচাকে খবরটা দিয়েছিলাম। শুনেও তিনি কান চুলকানো বন্ধ করলেন না। মুখে বললেন, অ। যেদিন আমেরিকা ইরাকে গিয়ে বোমা ফেলল, তিনি শুনেটুনে একটা হাই তুলে বললেন, অ। নীরা হত্যা মামলায় সাইফুদ্দিনের ফাঁসির খবর শুনেও সেই একই ব্যাপার। বললেন, অ। আমাদের এই জয়নাল চাচা অফিসে কি করেন আর অন্যেরা তাঁকে কিভাবে সহ্য করে আমার জানার খুব ইচ্ছে।
আমাদের চাচাদের আরেক ভাই হচ্ছেন সুন্দর চাচা। সুন্দর চাচার আসল নাম চান্দু, কিন্তু তাকে সেই নামে ডাকলে তিনি খুব রেগে যান। তাই তাকে সুন্দর চাচা বলে ডাকতে হয়। কেন তাকে সুন্দর চাচা ডাকতে হয় সেটা একটা রহস্য। তার মাঝে সুন্দরের কিছু নেই। তার মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। তিনি নানাভাবে চুলগুলোকে এদিক সেদিক পাঠিয়ে টাকটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। তার সামনের দুটো দাঁত একটু উঁচু। বেশ কষ্ট করে সেটা ঠোঁট দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। তবে তার গায়ের রঙ ফর্সা। মানুষের গায়ের রঙ ফর্সা হলেই কি তাকে সুন্দর বলা যায়? সুন্দর চাচার গোলমাল অবশ্যি অন্য জায়গায়, তার মত এতবড় গালগল্প আর কেউ করতে পারে না। কোন অফিসে কেরানীর চাকরি করেন, কিন্তু তার কথা শুনলে মনে হয় তিনি বুঝি পাটমন্ত্রী বা আর কিছু। তিনি এক লাখ দু’লাখ টাকা ছাড়া কথা বলেন না। জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং নিয়ে যেভাবে কথা বলেন, তাতে মনে হতে পারে সব তার নাকের ডগায়। দেশের সব বড় বড় মানুষ নিয়ে এমনভাবে আলোচনা করেন যেন সবাইকে তিনি চেনেন। তার পরামর্শ ছাড়া কেউ কোন কাজকর্ম করে না। সুন্দর চাচার কথা শুনলেই বোঝা যায় যে তিনি গুলপট্টি মারছেন। কিন্তু তিনি নিজে সেটা বুঝতে পারেন না। একজন বয়স্ক মানুষ গুলপট্টি মারছে শুনতে কেমন লাগে?
এই বাসার সবচেয়ে আজব মানুষ হচ্ছেন ছোট চাচা। তবে ছোট চাচা আজব হলেও মানুষটি খুব ভাল। বাসার বড়দের সবার ধারণা ছোট চাচা নিষ্কর্মা এবং অপদার্থ। কিন্তু ছোট চাচা মোটেও অপদার্থ না। ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, অনার্স পরীক্ষার আগে ঘোষণা করলেন এ বছর পরীক্ষা দেবেন না। পরীক্ষার প্রশ্ন নাকি আউট হয়ে গেছে। আউট হওয়া প্রশ্নের পরীক্ষা দেয়া আর গোবর খাওয়ার মাঝে নাকি কোন পার্থক্য নেই।
বাসার সবাই তখন খুব রাগ করল। সুন্দর চাচী বললেন, প্রশ্ন যদি আউট হয়ে থাকে, তাহলে এটাই তো সুযোগ, কিন্তু ছোট চাচা রাজি হলেন না। তার হাতখরচের টাকা আটকে দেয়া হবে বলে ভয় দেখানো হল কিন্তু ছোট চাচা গা করলেন না। প্রথম ক’দিন ঘরে বসে যোগ ব্যায়াম প্র্যাকটিস করলেন (পদ্মাসনে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতেন, তখন গোলমাল করা নিষেধ ছিল)। তারপর চুল দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিয়ে মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেন। শুধু আতপ চাল ধোয়া পানি খেতেন। ক’দিনের মাঝেই না খেয়ে খেয়ে তার চেহারা খারাপ হয়ে গেল। তখন আবার হঠাৎ করে খাওয়া শুরু করলেন, আর সে কী খাওয়া! চুল দাড়ি বড় হয়ে যখন তাকে চে গুয়েভারার মত দেখাতে লাগল, তখন তিনি হঠাৎ করে দাড়ি গোফ কমিয়ে ঘোষণা করলেন, তিনি বাসায় সাপের চাষ করবেন। সাপের বিষ নাকি সোনার দরে বিক্রি হয়। অনেক হৈ চৈ করে কোথা থেকে একটা ঢোরা সাপ ধরে আনা হল। একটা কাঁচের বয়ামে সেটা থাকত, খাবার দাবারে সেটার বেশি রুচি ছিল না। তাই অনেক খুঁজে একটা ইঁদুর ধরে আনা হল। সাপটা সত্যি যখন সেই ইঁদুরটাকে গিলে ফেলল, তখন বাসার সব বড় ‘হ্যাক থুঃ’ ‘হ্যাক থুঃ’ বলে ছোট চাচাকে প্রায় বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছিল। সাপের চাষ কতদূর এগুতো বলা যায় না কিন্তু তার মাঝে একদিন সাপটা বয়মে থেকে পালিয়ে গেল। এতদিন মানুষ দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে বলে মানুষকে ভয় পায় না। সোজা রান্নাঘরে গিয়ে বড় চাচীর পা পেঁচিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। সেটা দেখে বড় চাচী ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে ফিট! বাসার কাজের মেয়েটি কছে বসে রুটি বেলছিল। বেলুন দিয়ে এক ঘা বসিয়ে সাপের বারোটা বাজিয়ে দিল। সেই ঘটনার পর এই বাসায় সাপের চাষ এবং ছোট চাচার ভবিষ্যৎ দুটোই একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে।
তবু এই বাসায় ছোট চাচা আছে বলে আমরা কোনমতে টিকে আছি; তা না হলে সারা পৃথিবীতে এই বাসার মত নীরস আর আনন্দহীন বাস্য মনে হয় একটিও নেই। গালিগালাজ ধমক খেয়ে আমরা বড় হই। বাসায় খেলার জায়গা নেই। ছাদে কিংবা বাসার সামনে এক চিলতে জায়গায় কিছু ফেলার চেষ্টা করলেই সরব চিৎকার হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। ছোট ফুফুর বিয়ে ভেঙে এ বাসায় যখন এসে উঠছিল, তখন বাসায় একটু উত্তেজনা হয়েছিল, রাজু আসার পর আমার একটা বন্ধু হচ্ছে কিন্তু তারপর আর কিছু ঘটে নি। মনে হয় না কিছু ঘটবে। এই রকম করে বড় হয়ে হয়ে মনে হয় এক সময় আমরা কেউ বড় চাচা, কেউ জয়নাল চাচা আর কে সুন্দর চাচা হয়ে যাব। খুব কপাল ভাল থাকলে হয়ত ছোট চাচা হব। কিন্তু সে রকম কপাল আর ক’জনের হয়?
এরকম সময় আমাদের বাসায় হীরা চাচার একটা চিঠি এল আমেরিকা থেকে। সুদীর্ঘ চিঠি, বড় চাচার নামে এসেছে কিন্তু সবাইকে উদ্দেশ্য করে লেখা। চিঠির বক্তব্য হচ্ছে এরকম : তার বড় ছেলে খালেদের বয়স প্রায় তেরো হতে চলল; কিন্তু সে এখনো তার পূর্বপুরুষের দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বা ভাষা সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার জন্যে খালেদকে তিন মাসের জন্যে দেশে পাঠানো হবে, যেন সে দেশের পরিবেশে তিন মাস থেকে নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারে।
চিঠিটা পড়ে আমাদের মাঝে উত্তেজনার একটা ঢেউ বয়ে গেল। খালেদের বয়স তেরো অর্থাৎ একেবারে আমার আর রাজুর বয়স। আমেরিকা থেকে আসছে, মনে হয় একটা বাংলা শব্দও জানে না। কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার।
বাসার সব বড় মানুষেরা বসে খুব গম্ভীর গলায় আলোচনা শুরু করে দিল। বড় চাচা বললেন, খালেদ হীরার ছেলে মানলাম, কিন্তু একেবারে আমেরিকান বাচ্চা। এই বাচ্চাকে দেশে রাখার একটা খরচপাতি আছে না?
সুন্দর চাচা বললেন, হীরার মাথায় তো বুদ্ধিসুদ্ধি নিশ্চয়ই আছে। টাকাপয়সা নিশ্চয় দিয়েই পাঠাবে।
বড় চাচার চোখ সাথে সাথে লোভে চকচক করে ওঠে। মাথা নেড়ে বললেন, নিশ্চয়ই পাঠাবে। নিশ্চয়ই পাঠাবে।
ছোট ফুফু বললেন, কি খাবে এখানে?
বড় চাচী বললেন, ভাত মাছ কি খায়? পাওয়া যায় ঐ দেশে?
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। আমাদের বাসায় মেয়েদের কোন রকম মানসম্মান নেই। সময় সময় মনে হয় তাদের অবস্থা বাচ্চাদের থেকেও খারাপ। একটু পরে বড় চাচা বললেন, আজকাল খাবার দাবারের যা দাম!
সুন্দর চাচা বললেন, সোনার গাঁ হোটেলের ম্যানেজারের সাথে আমার জানাশোনা আছে। আমি বলে দেব, হামবার্গার আর হট ডগ পাঠিয়ে দেবে বাসায়।
ছোট চাচা বললেন, বিদেশ থেকে একটা ছেলে দেশে এসেছে কি শুধু হামবার্গার আর হট ডগ খাওয়ার জন্যে?
জয়নাল চাচা কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন, অ।
আমার মা টেবিলের এক মাথায় মাথা গুঁজে কি একটা ইংরেজি বই পড়ছিলেন। হঠাৎ একটু হেসে ফেললেন। ছোট চাচা বললেন, ভাবী, আপনার কি মনে হয়?
মা মাথা তুলে ছোট চাচার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ভেরি ইটারেস্টিং।
কি?
সাইক্লপ নামে এক চোখের দৈত্যের কথা লিখেছে। নাবিকেরা নাকি এক দ্বীপে কঙ্কাল দেখেছে সাইক্লপের। বিরাট মাথা।
মা কথা বন্ধ করে আবার বইয়ের মাঝে ডুবে গেলেন। এখানকার একটা কথাও শুনেছেন বলে মনে হল না। কেউ আর তাকে বিরক্ত করল না। কখনো করে না।
রাজু ভয়ে ভয়ে বলল, কোথায় ঘুমাবে খালেদ?
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। এই বাসায় ছোটদের প্রশ্নেরও কোন উত্তর দেয়া হয় না। খানিকক্ষণ পরে সুন্দর চাচা বললেন, উপরে একটা ঘর খালি করতে হবে। বিছানা বালিশ মশারি —
বড় চাচা মাথা চুলকে বললেন, যা দাম লেপ তোষকের।
জয়নাল চাচা নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে লুঙ্গি চেপে শব্দ করে নাক ঝাড়লেন।
সুন্দর চাচা বললেন, আমার বোজম ফ্রেন্ডের এয়ার কন্ডিশনারের বিজনেস। সিঙ্গাপুর থেকে একটা চালান এসেছে। বললেই বাসায় লাগিয়ে দেবে।
রাজু আবার ভয়ে ভয়ে বলল, আমার ঘরে ঘুমাতে পারে। টেবিলটা সরালে আরেকটা বিছানার জায়গা হয়ে যাবে।
ছোট চাচা মাথা নাড়লেন। অন্য সবাই রাজুর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। এই বাসায় ছোটদের সব কথা হয় বোকামি না হয় বেয়াদপি হিসেবে ধরা হয়। ভেবেছিলাম, রাজু একটা রাম ধমক খাবে, কিন্তু তার কপাল ভাল, খেল না। জয়নাল চাচা শুধু ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করলেন।
.
রাতে ঘুমানোর সময় আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তুমি জান হীরা চাচার ছেলে আসছে আমেরিকা থেকে?
মা অন্যমনস্কর মত বললেন, তাই নাকি! আসছে নাকি?
হ্যাঁ, মা।
মা চুপ করে আবার কি একটা ভাবতে লাগলেন। আমার কথা শুনেছেন বলে মনে হল না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এক চোখের দৈত্যের কথা বলেছিলে মা?
হ্যাঁ। সাইক্লপ নাম।
কোথায় ছিল?
একটা দ্বীপে। মানুষ তার কঙ্কাল পেয়েছিল। সিন্দাবাদের গল্প পড়িস নি?
সত্যি পেয়েছিল মা?
মা হেসে ফেললেন। আজকাল আর বেশি হাসেন না, কিন্তু হাসলে মাকে এখনো কী সুন্দর দেখায়। মায়ের মাথার সব চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মুখটা কী সুন্দর, বাচ্চা মেয়েদের মত!
কি হল মা? হাস কেন?
দৈত্য কি কখনো থাকে নাকি!
তাহলে কঙ্কাল পেল কেমন করে?
হাতির কঙ্কাল। যেখান থেকে শুঁড় বের হয় সেখানে গর্ত, মনে হয় বুঝি চোখ। তাই মানুষ ভেবেছিল, এক চোখের দৈত্য। দৈত্য কি আর আলাদা করে হয়? মানুষই দৈত্য হতে পারে। পারে না? একাত্তরে হয়েছিল না?
আমি কিছু না বুঝে মাথা নাড়লাম। মা অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, ছেলেটা কষ্ট পাবে।
কোন্ ছেলেটা?
হীরার ছেলে। খালেদ। এই বাসায় কি মানুষ থাকতে পারে? পারে না। এই বাসায় কোন আনন্দ নেই, কোন সুন্দর জিনিস নেই, কোন ভাল জিনিস নেই। এই বাসায় শুধু কুৎসিত জিনিস। তুই কেমন করে থাকিস টোপন? আমি হলে তো মরেই যেতাম।
আমি একটু অবাক হয়ে আমার মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মাথা খারাপ মা! আমার মাঝে মাঝে এত ইচ্ছে করে যে, মা আমাকে একবার একটু বুকে চেপে আদর করবেন, কিন্তু মা আমাকে কখনো হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখেন না। এই ঘরে আমাদের আলাদা আলাদা বিছানা। আমি যখন শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি আমার মা তখন মশারির ভিতরে বসে বসে বই পড়েন।
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর আমার চোখে পানি এসে যেতে লাগল।
.
২. খালেদ
খালেদকে এয়ারপোর্ট থেকে আনার জন্যে বাসার সবাই এয়ারপোর্টে হাজির হল। একটা গাড়ি অনেক কষ্ট করে যোগাড় হয়েছে। সেটাতে ঠেলাঠেলি করে প্রায় সবাই এসে গেছে। সুন্দর চাচা বলেছিলেন, তাঁর এক বন্ধুর অনেকগুলো গাড়ি, তাকে সবসময় ব্যবহার করার জন্যে সাধাসাধি করেন। তাকে বলে একটা মাইক্রোবাস যোগাড় করে আনবেন। শেষ মুহূর্তে তিনি খবর আনলেন, গাড়ি নিয়ে সমস্যা হয়েছে। ইঞ্জিনের গোলমাল, কারবুরেটর না কি যেন পুড়ে গিয়েছে। তখন ছোট চাচা অনেক ছোটাছুটি করে এই গাড়িটা যোগাড় করেছেন। সেই গাড়িতে করে আমরা সবাই এয়ারপোর্টে এসেছি।
প্লেন সময়মত এসে নেমেছে, আমরা কাঁচের জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছি, তখন শেষ পর্যন্ত খালেদকে দেখা গেল। এতটুক ছেলে একা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছে আমাদের বিশ্বাস হয় না। তাকে দেখে অবশ্যি আমাদের একটু আশাভঙ্গ হল। আমাদের সবার ধারণা ছিল, তার গায়ের রঙ হবে ফর্সা, গাল হবে গোলাপী। তার পরনে থাকবে কোট এবং টাই, হাতে থাকবে চামড়ার এ্যাটাচি কেস। কিন্তু দেখা গেল তার গায়ের রং আমাদের মত শ্যামলা। পরনে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা অত্যন্ত টিলা একটা রং ওঠা টি-শার্ট। দেখে মনে হয়, ভুল করে অন্য কারোটা পরে চলে এসেছে। টি-শার্টের বুকে লেখা ‘ইকো ফার্স্ট’। তার মানে কি খোদায় জানেন। তার প্যান্টটা ভুসভুসে নীল রঙের। শুধু তাই নয়, মনে হল হাঁটুর কাছে একটু ছেঁড়া। পিঠে কটকেটে সবুজ রঙের একটা ব্যাগ। মাথায় বারান্দাওয়ালা একটা টুপি, সেটা আবার পরেছে উল্টো করে!
বড় চাচা বললেন, কাস্টমসে অনেক দেরি হবে। আমেরিকা থেকে আসছে। স্যুটকেস ভর্তি জিনিসপত্র। ছোট ছেলে পেয়ে অনেক হয়রানি করবে।
কিন্তু কাস্টমসে কোনই হয়রানি হল না। কারণ খালেদের কোন সুটকেসই নেই। ঘাড়ের ক্যাটকেটে সবুজ ব্যাগটাই তার সব মালপত্র। আমেরিকা থেকে এই ছেলে একটা ছোট ঝোলা নিয়ে চলে এসেছে!
বড় চাচা ব্যাপারটা টের পেয়ে খুব ঘাবড়ে গেলেন। বারবার বলতে লাগলেন, কোন জিনিসপত্র আনে নাই? কী সর্বনাশ! হীরাটা এরকম গাধা হল কেমন করে? একটা ভি. সি. পি. কয়টা বিছানার চাদর আর টাওয়েল দিতে পারত না? হ্যাঁ, এই দেশে একটা খরচাপাতি আছে না?
জয়নাল চাচা কোন কথা না বলে খুব যত্ন করে তার নাকের একটা লোম ছেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। এই ব্যাপারটা তিনি নতুন আবিষ্কার করেছেন।
খালেদ গেট থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। আমরা জোরে জোরে হাত নাড়লাম, আমাদের দেখে সে তখন লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল। বড় চাচা এগিয়ে এসে তার পা বাড়িয়ে দিলেন পা ছুঁয়ে সালাম করবে আশায়, খালেদ তার ধারেকাছে গেল না। বড় চাচাকে পাশ কাটিয়ে আমার আর রাজুর কাছে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হায়।
মানুষজনের সর্বনাশ হয়ে গেলে মানুষ ‘হায় হায়’ করে, মহররমের মাসে শিয়াদের বুক চাপড়ে ‘হায় হাসান’ ‘হায় হোসেন’ বলে মাতম করতে দেখেছি, কিন্তু এখানে ‘হায়’ মানে নিশ্চয়ই কি খবর? আমরা কোন কথা না বলে দাঁত বের করে হেসে মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলাম। সে এক সাথে আমার আর রাজুর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ঠোপন?
আমি শুদ্ধ করে দিলাম, বললাম, টোপন।
সে আবার বলল, ঠোপন? তখন বুঝতে পারলাম যে, সে ‘ট’ বলতে পারে না। টিপু সুলতান নাটকে দেখেছিলাম ইংরেজ সাহেবরা এরকম করে কথা বলে। খালেদ তখন রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, ড়াজু?
আমি আর রাজু আনন্দে হেসে ফেললাম, কি সুন্দর রাজুকে ডাকল ‘ড়াজু’। ঠিক যেরকম আমরা ভেবেছিলাম। খালেদ নিজেকে দেখিয়ে ভাঙা বাংলায় বলল, আমি ক্যালেদ।
আমরা হেসে গড়িয়ে পড়লাম। রাজু খালেদের পেটে গুতো দিয়ে বলল, দূর ছাই! তুমি ক্যালেদ হবে কোন্ দুঃখে? তুমি খালেদ।
খালেদ লাজুক মুখে আবার চেষ্টা করল, কাহলেদ?
শুনে আমরা আবার হেসে গড়িয়ে পড়লাম। আর আমাদের দেখে খালেদও হাসতে শুরু করল। তখন আমি, রাজু আর খালেদ একজন আরেকজনকে ধরে হাসতে লাগলাম। আর হাসতে হাসতে বুঝতে পারলাম, এই ছেলেটা যদিও আমেরিকা থেকে বড় হয়েছে কিন্তু সে একেবারে আমাদের মত একজন।
আমাদের তিনজনকে এভাবে হাসাহাসি করতে দেখে বড়রা যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা খুব বিরক্ত হল। বড় চাচা নিচু গলায় বললেন, আদব কায়দা কিছু শিখে নি মনে হচ্ছে।
তিনি আবার এগিয়ে এসে কেশে গলা পরিষ্কার করে বইয়ের ভাষায় ইংরেজিতে বললেন, গুড ইভনিং খালেদ।
খালেদ তার দিকে তাকাতেই তিনি তাঁর পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে আবার বললেন, আমি তোমার বড় চাচা। গ্রেট আঙ্কেল।
খালেদ হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বলল, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম।
বড় চাচাকে খুব সুখী দেখা গেল না। মুখ কালো করে হাত মিলিয়ে দাতে দাঁত চেপে নিচু গলায় বললেন, আদব লেহাজ কিছু শেখায় নি। বেজন্মা ছেলে।
খালেদ আবার আমাদের দিকে এগিয়ে এল। ফিসফিস করে ইংরেজিতে বলল, এই বুড়ো মনে হচ্ছে মহা বদমেজাজি।
.
এয়ারপোর্টে খালেদকে যেমন হাসিখুশি এবং সবকিছুতে তার উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, বাসায় এসে সেটা উবে গেল। তাকে দোষ দেয়া যায় না। আমাদের বাসায় এলে যে কোন মানুষের মন খারাপ হয়ে যায়। অন্ধকার বাসা, ছোট ছোট রুম, ময়লা আসবাবপত্র, তেলতেলে রং ওঠা দেয়াল, মন ভাল হওয়ার কিছু নেই এই বাসায়। খালেদ খানিকক্ষণ বাইরের ঘরে বসে থেকে একবার বাথরুমে ঢুকে ফ্যাকাসে মুখে প্রায় ছিটকে বের হয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
খালেদ কোন উত্তর দিল না। কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে মাথা নাড়ল। আমারও সেরকম সন্দেহ ছিল, আমাদের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ময়লা বাথরুমে গিয়ে সে একটা বড় ধাক্কা খাবে। বাথরুমে একটা বিশাল মাদী মাকড়সা মাঝে মাঝে পেটে ডিম নিয়ে বসে থাকে। কে জানে আজকেও বসে ছিল কি না!
রাতে খালেদের আসা উপলক্ষে ভাল খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পোলাও, মুরগির কোরমা, কাবাব, ইলিশ মাছের ভাজা, সালাদ আর বোরহানি। আমরা খুব শখ করে খেলাম। খালেদ অবশ্যি কিছুই খেতে পারল না। প্লেটে খানিকটা পোলাও আর একটা মুরগির রান নিয়ে বসে রইল। আমেরিকায় নিশ্চয়ই কেউ কাউকে খাবার তুলে দেয় না। কারণ খালেদ খাচ্ছে না দেখে বড় চাচী এক সময় তার প্লেটে এক গাদা খাবার তুলে দিলেন। খালেদ তাই দেখে মনে হল আকাশ থেকে পড়ল। হাত উপরে তুলে অবাক হয়ে বলল, কিন্তু আমি তো চাই নি! কেন আমাকে দিচ্ছ? কেন?
খালেদ কথাটা বলল ইংরেজিতে, সেটা বড় চাচীকে অনুবাদ করে শোনাতে হল। আর সেটা শুনে বড় চাচী হঠাৎ কেমন জানি খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন।
খালেদ বলতে গেলে কিছুই খেল না। যেটাই মুখে দেয়, সেটাই তার ঝাল লাগে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে সে খেল একটু পোলাও, অল্প একটু মুরগির গোশত আর বেশ অনেকখানি আলু। পানি খাবার আগে সে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল তার পানিটা ফোঁটানো কি না। ওর ‘পিডিয়াট্রিশান’ নাকি বলে দিয়েছে পানিটা ফুটিয়ে খেতে। কঠিন শব্দটার মানেটা কি কে জানে। মনে হয় ডাক্তারই হবে।
রাত্রি বেলা ঘুমানোর আগে খালেদ আমাদের ঘরে এসে মাকে বলল, চাচী, আমার বাবা আমাকে কয়েকটা ব্যাঙ্ক ড্রাফট আর ট্রাভেলার্স চেক দিয়েছে, সেগুলো আপনাকে দিই?
আমাকে?
হ্যাঁ।
আমার মা খুব ভালো ইংরেজি জানেন। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, কেন বাবা?
ওগুলো মনে হয় ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে ভাঙাতে হবে।
আমি সেগুলো ভাঙিয়ে দেব?
হ্যাঁ।
খালেদ জানে না আমাদের বাসায় মেয়েমানুষদের বলতে গেলে মানুষ বলেই বিবেচনা করা হয় না। টাকা পয়সার ব্যাপারে, বিশেষ করে ব্যাঙ্ক ড্রাফট কিংবা ট্রাভেলার্স চেক তো কখনোই কোন মেয়ের হাতে দেয়া হবে না। তার ওপর আমার মা, যিনি গত দশ বছরে কোনদিন বাসা থেকে বের হননি, সবাই মনে করে যার একটু মাথা খারাপের লক্ষণ আছে–তাকে দেয়ার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি খালেদকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই মা বেশ শান্ত গলায় বললেন, ঠিক আছে বাবা, রেখে যাও কাল ভোরে তোমাকে নিয়ে যাব।
দরজার বাইরে কয়েকজন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। মুহূর্তে সারা বাসায় খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, খালেদ তার সমস্ত টাকাপয়সা আমার মার হাতে দিয়েছে, আর মা সেগুলো নিয়ে কাল ব্যাঙ্কে ভাঙাতে যাবেন। শুনে উত্তেজনায় জয়নাল চাচা দু’ দু’বার ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে এক টান দিয়ে নাকের কয়েকটা লোম ছিঁড়ে ফেললেন। বড় চাচার প্রায় হার্টফেল করার মত অবস্থা হল, নিজের বুক চেপে ধরে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, শাহানা ব্যাঙ্কে যাবে? ঢাকা ভাঙাতে? ডাক শাহানাকে।
শাহানা আমার মায়ের নাম। কেউ আমার মাকে ডাকার সাহস পেল না। মা কখনো রাগারাগি করেন না, তবু সবাই মাকে খুব ভয় পায়, ছোট ফুফু দিন রাত রেগেমেগে চিৎকার করেন তবু মনে হয় মাকে তার থেকে অনেক বেশি ভয় পায়।
বড় চাচী মিনমিন করে কি একটা বলার চেষ্টা করছিলেন বড় চাচা তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে বললেন, সাংসারিক কোন জ্ঞান নেই, কিচ্ছু জানে না, কাউকে চেনে না, কোথায় গিয়ে কি করবে শাহানা? গুণ্ডা বদমাইস গিজগিজ করছে চারদিক!
সুন্দর চাচা বললেন, আমাকে বললেই হত, গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আমার বোজম ফ্রেণ্ড। একটা ফোন করে দিলেই–
ছোট চাচাও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছেন তবু নিজেকে শান্ত রেখে বললেন, এই বাসায় সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ ভাবী। চিন্তার কোন ব্যাপার নেই, ভাবী ঠিক সবকিছু সামলে নেবেন।
খালেদ সব কথাবার্তা বুঝতে পারছিল বলে মনে হয় না তবু আন্দাজে ধরে নিল, মাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। হাতে একটা কিল দিয়ে বলল, সুপার লেডি। দিনরাত বই পড়েন। কী সাংঘাতিক!
সবাই অবাক হয়ে খালেদের দিকে তাকাল। বই পড়া জিনিসটাকে এই বাসায় সময় নষ্ট বলে ধরা হয়। পাঠ্যবই না হলে সেটাকে ‘আউট বই’ বলা হয়। কম বয়সীরা ‘আউট বই’ পড়লে নষ্ট হয়ে যায় বলে এই বাসায় ‘আউট বই’ পড়া নিষেধ। আমরা যদি পড়তে চাই লুকিয়ে পড়ি। ধরা পড়লে শক্ত মার খেতে হয়।
.
রাত্রে ঘুমানোর সময় আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তুমি ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা ভাঙাতে পারবে?
মা বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, কি টাকা?
খালেদ যে টাকা দিয়েছে।
মা অন্যমনস্ক গলায় বললেন, কোন খালেদ?
আমি বুঝতে পারলাম মা আমার কথা ঠিক শুনছেন না, তার বইয়ে ডুবে আছেন। আমি তাকে আর ঘাটালাম না।
.
পরদিন ভোরে সারা বাসায় একটা চাপা উত্তেজনা। আমার সন্দেহ ছিল যে, মা হয়তো ভুলে গেছেন কিন্তু দেখলাম মা ভোলেন নি। ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে আলমারি খুলে একটা ভাল শাড়ি বের করে পরলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করলেন, তার হাতঘড়িটা বের করে সেটা চাবি দিয়ে চালানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু যে ঘড়ি দশ বছর চালানো হয় নি, সেটা চলতে রাজি হল না। মা ছোট চাচাকে ডেকে বললেন, তোমার ঘড়িটা দাও দেখি।
ছোট চাচা তাড়াতাড়ি তার ঘড়িটা খুলে দিলেন। মায়ের সুন্দর হাতে ছোট চাচার গোব্দা ঘড়িটা খুব খারাপ দেখাতে লাগল কিন্তু মায়ের সেটা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা হল বলে মনে হল না।
ছোট চাচা জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু লাগবে ভাবী?
না।
খুচরা টাকা আছে?
আছে। মা খালেদকে বললেন, চল বাবা।
খালেদ আজকে কমলা রঙের একটা টি শার্ট পরেছে। বুকে লেখা ‘সেভ দা ট্রীজ’ –গাছকে বাঁচাও। গাছকে কেমন করে বাঁচায় কে জানে। তার ক্যাটিক্যাটে সবুজ রঙের ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে সে মায়ের সাথে রওনা দিল।
মা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন তখন পিছু পিছু বাসার সবাই হেঁটে হেঁটে নামতে লাগল। গেটের কাছে এসে বড় চাচা শেষবার মা’কে থামানোর ‘চষ্টা করলেন। বললেন, শাহানা–
মা চোখ তুলে তাকালেন আর সাথে সাথে বড় চাচা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ইয়ে মানে যা রোদ একটা ছাতা দেব? আমব্রেলা?
মা কিছু বলার আগেই খালেদ বলল, মাথা খারাপ হয়েছে? ছাতা? এই সুন্দর রোদে?
রোদ আবার সুন্দর হয় কেমন করে কে জানে।
মা খালেদকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমরা দেখলাম মোড়ে একটা কিকশা থামিয়ে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে সেটাতে উঠে বসলেন, তারপর দু’জন রিকশা করে চলে গেলেন।
.
বাসায় একটা থমথমে আবহাওয়া নেমে এল। বড় চাচা বাজারে যেতে দেরি করছে অজুহাতে খামোখা কাজের ছেলেটার গালে একটা চড় কসিয়ে দিলেন। জয়নাল চাচা আর সুন্দর চাচা খুব গম্ভীর মুখে অফিসে গেলেন, যাবার সময় এমনভাবে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন যেন সব দোষ আমার। আমি চুপচাপ ছাদে গিয়ে বসে রইলাম। শুনতে পেলাম নিচে থেকে ছোট ফুফু বলছেন আমার মাকে অনেক আগেই পাগল গারদে আটকে রাখা উচিত ছিল তাহলে এখন আর এরকম ঝামেলা হত না।
মা খালেদকে নিয়ে সকালে বের হয়েছেন, ঘণ্টা দুতিনের মাঝে ফিরে আসার কথা ছিল কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেল তবু তাদের দেখা নেই। আস্তে আস্তে সবাই মায়ের ওপর ক্ষেপে উঠতে লাগল। বড় চাচা বললেন, মেয়েমানুষের বুদ্ধি আর কত হবে? খামোখা কোরআন শরিফে লিখেছে যে, মেয়েদের ধরে মারপিট করা দুরস্ত আছে?
বড় চাচী আর মেজ চাচী মুখ ঢেকে কি একটা বললেন ঠিক বোঝা গেল না। শুধু ছোট চাচা বললেন, ব্যাঙ্ক ড্রাফট ভাঙানো কি পানিভাত নাকি? সময় লাগবে না একটু? কেউ ভাঙিয়েছে কখনো?
আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে গেল তবু মায়ের কোন দেখা নেই। অফিস থেকে সুন্দর চাচা আর জয়নাল চাচা ফিরে এসে খুব গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। রাগের বদলে তখন আস্তে আস্তে সবাই ভয় পেতে শুরু করল। সুন্দর চাচা বললেন, মোড়ের দোকান থেকে সিটি এস পি কে একটা ফোন করে আসব?
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। ছোট চাচা বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, একবার রাস্তা ধরে এগিয়ে যান তারপর ফিরে আসেন। ভয়ে আমার কান্না পেতে লাগল, কি করব বুঝতে না পেরে ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে রইলাম।
.
মা খালেদাকে নিয়ে যখন ফিরে এলেন তখন সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে। রিকশাভর্তি বিচিত্র সব জিনিস, এক কাঁদি কলা, একটা মাটির কলসি, বেশ কিছু কবুতর আর এক ঝাঁকা চিনেবাদাম। দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন চিনেবাদামওয়ালার কাছ থেকে ঝাঁকাসহ কিনে নেয়া হয়েছে। রিকশাওয়ালা খুব উৎসাহ নিয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে দিল, কথা শুনে বুঝতে পারলাম সকালে যে রিকশাওয়ালাকে নিয়ে বের হয়েছেন, সেই সারাদিন মা আর খালেদাকে নিয়ে ঘুরেছে।
বড় চাচা খুব রেগে আছেন, আমি জানি পারলে আমার মাকে একেবারে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতেন, কিন্তু মায়ের সাথে কারো রেগে কথা বলার সাহস নেই। শুধু ছোট চাচা বললেন, ভাবী, এতো দেরি হল, কোন অসুবিধে হয় নি তো?
না। আজকাল মানুষজন অনেক ভাল হয়ে গেছে। নিজে থেকে এসে সাহায্য করে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অনেক সাহায্য করলেন।
মায়ের কথা শুনে বড় চাচা চোখ কপালে তুললেন, তার ধারণা পৃথিবীতে সব মানুষ চোর আর বদমাইস, সবাই একে অন্যকে ঠকানোর চেষ্টা করে, তার মাঝে খুব সাবধানে থাকতে হয়। শুকনো গলায় মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ডলারে কত রেট পেয়ছ?
তা তো জানি না। ম্যানেজার যা দিল।
বড় চাচাকে দেখে মনে হল তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছে। খাবি খেয়ে বললেন, দে-দে-দেখি।
খালেদের কাছে পাসবই আছে। বাচ্চা ছেলে তাই আমার সাথে জয়েন্ট একাউন্ট করতে হল।
তো-তো-তোমার সাথে? বড় চাচা ভাঙা গলায় বললেন, আর কারো সাথে করলে ভাল ছিল না? কোন পুরুষ মানুষ, দরকার পড়লে যেন যেতে পারে। দায়িত্বশীল কেউ—
দরকার হবে না। আমি পুরো চেকবইয়ে সাইন করে খালেদকে দিয়ে দিয়েছি। এখন তার যখন দরকার, সাইন করে তুলে নেবে।
চে-চে-চেক সাইন করে দিয়েছ? স-স-সব চেক?
হ্যাঁ, মা গলা নামিয়ে বললেন, ব্যাঙ্কে অবশ্য কোন টাকা আছে কিনা জানি না। টাকা তুলে যা একটা কাণ্ড করল!
বড় চাচা সাবধানে একটা চেয়ারে বসে দুর্বল গলায় বললেন, কি কাণ্ড?
নিউমার্কেটে যে বাচ্চা ছেলেরা মিন্তির কাজ করে, সেরকম একজন ছিল সাথে। দুপুরে যখন খাওয়ার সময় হল খালেদ বলল, তাকে নিয়ে খাবে। সেই মিন্তির আবার অনেক সঙ্গী সাথী। সবাইকে নিয়ে এক চাইনিজ বেস্টুরেন্টে–
চা-চা-চাইনিজ রেস্টুরেন্টে?
হ্যাঁ, প্রথমে তো আমাদের ঢুকতেই দেবে না, গরিব ছেলেপুলে, খালি পা, খালি গা, হাতে ঝাঁকা, কেন ঢুকতে দেবে? তখন কয়েকটা কলেজের ছেলে ছিল তারা হৈ চৈ শুরু করে দিল। বলল, ঢুকতে না দিলে ওরা পুরো বেস্টুরেন্ট জ্বালিয়ে দেবে।
বড় চাচা আর কোন কথা বলতে পারছিলেন না। অনেক কষ্ট করে চিঁ চিঁ করে বললেন, তুমি করতে দিলে?
মা সুন্দর করে হাসলেন। বললেন, কেন দেব না? তার টাকা সে যেভাবে খরচ করতে চায়। মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বললেন, দৃশ্যটা যদি দেখতেন! বিশাল একটা টেবিলে প্রায় কুড়িজন বাচ্চা ছেলেমেয়ে হৈচৈ করে চাইনিজ খাচ্ছে। কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে গিয়ে হেসে গড়াগড়ি। সে যা একটা দৃশ্য!
এ রকম সময় রাজু ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এল। বলল, টোপন?
কি?
ছাদে চল।
কেন?
আকাশে কবুতর ওড়ানো হবে। খালেদ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
বড় চাচা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, পয়সা দিয়ে কবুতর কিনে আকাশে ওড়াবে মানে? পয়সা কি গাছে ধরে?
মা হেসে বললেন, কি আছে! ছোট বাচ্চারা যদি পাগলামি না করে তাহলে কি বুড়োরা করবে?
বড় চাচার চোখ দিয়ে আগুন বের হতে লাগল।
.
৩. পরিচয়
সপ্তাহখানেক পরের কথা। খালেদ আজকাল বাংলা বেশ ভালই বুঝতে পারে। বলতে এখনো অসুবিধা হয় কিন্তু সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের ইচ্ছে সে ইংরেজিতে কথা বলুক, তার ইংরেজি উচ্চারণ এত বিদেশী যে আমাদের তাক লেগে যায়। খালেদ কিস্তু চেষ্টা করে বাংলায় কথা বলতে। ভুল বাংলা, অশুদ্ধ বাংলা, হাস্যকর বাংলা, কিন্তু বাংলা তাতে কোন সন্দেহ নেই। সবাইকে চোখ বুজে সে তুমি করে ডাকে, কেউ কিছু মনে করে না, শুধু বড় চাচা খুব বেগে যান। বড় চাচা খুব চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাকে আদব কায়দা এবং ধর্ম শেখাতে কিন্তু খুব ভাল এগুচ্ছে বলে মনে হয় না। যেমন ধরা যাক, বাথরুমের সেই মাদি মাকড়সাটার কথা। হাদিসে নাকি আছে মাকড়সা মারা নিষেধ, তাই বড় চাচার কড়া হুকুম কেউ সেই মাকড়সা মারতে পারবে না। সেটা শুনেও খালেদ একদিন এক ঝাঁটার আঘাতে মাকড়সাটার বারটা বাজিয়ে দিল। বাথরুমে কেউ তার দিকে আট চোখে তাকিয়ে আছে সেটা নাকি সে সহ্য করতে পারবে না। বড় চাচা তাকে একটা বড় লেকচার দিলেন, খালেদ গা করল না।
তারপর ধরা যাক জয়নাল চাচার ব্যাপারটা। একদিন ঝাঁটার কাঠি দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে যাচ্ছেন, খালেদ হঠাৎ বলে বসল যে, সবার মাঝখানে বসে দাঁত খোঁচানো খুব বাজে অভ্যাস। খোঁচাতেই যদি হয় তাহলে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খোঁচানো উচিত। শুনে জয়নল চাচার চোখ গোল আলুর মত বড় হয়ে গেল। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করলেন কিন্তু কিছু বললেন না। বড় চাচা একদিন কাজের ছেলেটাকে একটা চড় দিলেন, দেখে খালেদ বলল, এটা আমেরিকা হলে সে পুলিশে ফোন করে দিত আর পুলিশ এসে বড় চাচাকে ধরে নিয়ে যেতো। বড় চাচা থমথমে মুখে জানতে চাইলেন কেন, খালেদ বলল, শিশু নির্যাতনের অপরাধে। শুনে বড় চাচা অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলেন না। সুন্দর চাচার গুলপট্টি মারাও মনে হয় আগের থেকে একটু কমেছে, কারণ প্রত্যেকবার সুন্দর চাচা একটা গুলপট্টি মারতেই খালেদ হা হা করে হেসে উঠে বলে যে সুন্দর চাচা নাকি সত্য আর মিথ্যার মাঝামাঝি একটা ফ্যান্টাসির জগতে বাস করেন। এর নাকি চিকিৎসা দরকার। ভাল রকম চিকিৎসা না হলে শেষ বয়সে সুন্দর চাচাকে নাকি পাগলা গারদে থাকতে হবে।
বড়দের মাঝে শুধু ছোট চাচার সাথে তার খানিকটা ভাব হল কিন্তু সেটাও খুব বেশি নয়। ছোট চাচা সিগারেট খান আর খালেদ দুই চোখে সিগারেট দেখতে পারে না। ছোট চাচাকে সিগারেট খেতে দেখলেই সে এমন হৈ চৈ শুরু করে যেন সিগারেট নয়, বিষ খাচ্ছেন। খালেদের অত্যাচারে বাসায় ছোট চাচার সিগারেট খাওয়া বলতে গেলে বন্ধ, সিগারেট খাওয়ার অপকারিতার উপরে লম্বা লম্বা লেকচার শুনে খালেদকে দেখলেই ছোট চাচার মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে যায়।
বাসার মহিলাদের সাথে অবশ্যি খালেদের কোন সমস্যা নেই, তারা মনে হয় খালেদকে পছন্দ করেন। বড় চাচী, মেজো চাচী সবসময়ই বলছেন, আহা, এইটুকু ছেলে কোথায় কোন দেশে বাবা মাকে ফেলে একা চলে এসেছে। তাকে ভালমন্দ খাওয়ানোর জন্যে সবার খুব আগ্রহ। কিন্তু খালেদ খাওয়া নিয়ে বেশি ব্যস্ত নয়। তার প্রিয় খাবার আলু ভাজা, আলু ভর্তা এবং আলু সেদ্ধ। ভাত খায় আলাদা। একই জিনিস বারবার খেতে দেখে সবাই মনে হয় একটু অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
খালেদের সাথে আমাদের অবশ্যি খুব ভাব হয়ে গেল। মনেই হয় না তাকে আগে কখনো দেখি নি। যখন আশে পাশে কেউ থাকে না, তখন সে মাঝেমাঝে আমেরিকার গল্প করে, নানা রকম নিষিদ্ধ গল্প, বড়রা জানতে পারলে মনে হয় খুনোখুনি হয়ে যাবে। খালেদের সাথে ইংরেজি বলার চেষ্টা করতে করতে আমাদের সবারই একটু একটু ইংরেজিতে কথা বলার অভ্যাস হয়ে গেল, হাস্যকর ইংরেজি কিন্তু তবু তো ইংরেজি।
.
এভাবে আরো সপ্তাহ খানেক কেটেছে। একদিন খাবার টেবিলে সবাই বসে খাচ্ছি তখন বড় চাচী খালেদকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, আমেরিকায় মেয়েরা নাকি খুব বেহায়ার মত কাপড় পরে?
বেহায়া কথাটার মানে কি খালেদকে বোঝাতে বেশ একটু সময় লাগল, বোঝার পর সে পুরো কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, সেটা সত্যি নয়।
বড় চাচা গম্ভীর হয়ে বললেন, কি বলছ তুমি, আমি নিজে দেখেছি।
খালেদ অবাক হয়ে বলল, আপনি কখন দেখেছেন? তার মুখে ‘আপনি’ কথাটা আসতে চায় না কিন্তু বড় চাচার সাথে জোর করে চেষ্টা করে।
তোমার স্কুলের ছেলেমেয়েদের ছবি। মেয়েদের ছোট ছোট কাপড়। আস্তাগফেরুল্লাহ। পা দেখা যাচ্ছে! ছিঃ!
খালেদ প্রথমে একটু অবাক হল তারপর কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, যেখানকার মানুষ সেরকম রীতিনীতি। যেরকম পোশাকে তারা অভ্যস্ত, সেটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক। বাইরের মানুষের কাছে সেটা অস্বাভাবিক লাগলে কিছু করার নেই।
বড় চাচা বললেন, কিন্তু পরকাল রয়েছে, খোদার কঠিন শাস্তি রয়েছে।
খালেদ বলল, খোদার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই
তখন বড় চাচা ভীষণ রেগে গেলেন, তিনি যত জোরে কথা বলেন খালেদ তার থেকে জোরে কথা বলে, যাকে বলে একটা ফাটাফাটি অবস্থা। তর্ক যখন খুব জমে উঠেছে, প্রায় হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় তখন মা হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে বললেন, আমার মনে হয় খালেদ আর বাচ্চারা মিলে কোন এক জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসুক।
বড় চাচা থতমত খেয়ে বললেন, কেন?
মা বললেন, ছোট বাচ্চাদের বেড়াতে ভাল লাগে। এই বাচ্চারা অনেকদিন কোথাও বেড়ায় নি। তা ছাড়া এই বাসার পরিবেশ বলতে গেলে দূষিত! আনন্দের কিছু নেই।
বড় চাচা মুখ হা করে তাকিয়ে রইলেন। মা আবার বললেন, এদেশে অনেক সুন্দর জায়গা আছে, ঘুরে আসুক।
খালেদ টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ইয়েস।
খালেদের সাথে থেকে থেকে আমাদেরও একটু একটু সাহস বেড়ে যাচ্ছে। আমরাও টেবিলে থাবা দিয়ে বললাম, ইয়েস!
সবাই চোখ পাকিয়ে আমাদের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। ছোট চাচা বললেন, কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসতে পারে। পর্যটনের চমৎকার হোটেল আছে। সুন্দর বীচ।
বড় চাচা কেশে বললেন, কত পয়সা লাগে হোটেলে জানিস?
খালেদ আবার টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, পয়সার কোন চিন্তা নেই। আমার ব্যাঙ্কে এখনো কত টাকা। সবাইকে নিয়ে খরচ করার জন্যে বাবা দিয়েছেন।
বড় চাচা চুপ মেরে গেলেন, একটু পরে বিড়বিড় করে বললেন, খরচ করতে দিয়েছে, নষ্ট করতে দেয় নি।
ছোট চাচা বললেন, মনে হয় ভাবী ঠিকই বলেছেন। বাজার ঘুরে আসুক। কক্সবাজার খুব সুন্দর জায়গা। এত সুন্দর সমুদ্র আর কোথায় পাবে?
জয়নাল চাচা নাকের একটা লোম ছিঁড়তে গিয়ে থেমে গেলেন, সুন্দর চাচা পর্যটনের বড় অফিসারকে চেনেন এই ধরনের একটা কথা বলতে গিয়ে মনে হয় খালেদের ভয়েই থেমে গেলেন।
বড় চাচী এমনিতে বেশি কথা বলেন না, আজ মৃদু স্বরে কিন্তু বেশ জোর দিয়েই বললেন, আমারও মনে হয় কোন সুন্দর জায়গা থেকে ঘুরে আসুক। এ বাসায় আর কি আছে অনিন্দ করার মত?
বড় চাচা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন, ঠিক আছে।
আমরা আরেকটু হলে আনন্দে চিৎকার করে উঠতাম কিন্তু তার শেষ কথাটা শুনে একেবারে চুপসে গেলাম। বললেন, সাথে বড় মানুষ কাউকে যেতে হবে, আমি নিয়ে যার!
বড় চাচার সাথে আমি বেহেশতেও যেতে রাজি না। যদি সত্যি সত্যি বড় চাচা বেহেশতে যান (আমার খুব সন্দেহ আছে) তাহলে মনে হয় মানুষজন খুন করে আমি দোজখেই যাবো। বড় চাচার সাথে কক্সবাজার যাওয়া হবে একটা বড় বিভীষিকা। পয়সা বাঁচানোর জন্যে তিনি এমন সব কাজ করবেন যে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে যাব। তার ভিতরে ভাল কোন গুণ নেই, তার সাথে ভাল কিছু নিয়ে কথা বলা যায় না। বাসায় থাকলে তবু তার সাথে থাকতে হয় না, আমরা নিজেরা নিজেরা থাকতে পারি। সপ্তাহ খানেকের জন্যে কক্সবাজার গেলে চব্বিশ ঘণ্টা তার সাথে থাকতে হবে, চিন্তা করেই আমার শরীর কাটা দিয়ে উঠে।
খুব মন খারাপ করে আমরা উঠে এলাম, ব্যাপারটা কিভাবে অগ্রসর হয় দেখতে হবে। যদি দেখা যায় সত্যি বড় চাচা আমাদের সাথে রওনা দিচ্ছেন তাহলে বগলে রসুন নিয়ে রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থেকে জ্বর বাধিয়ে ফেলতে হবে।
.
খোদা আছেন কি নেই সেটা নিয়ে মাঝে মাঝেই আমরা চিন্তাভাবনা করি। খালেদের ধারণা খোদা বলে কিছু নেই। আমার ধারণা খোদা আছেন কিন্তু আমাদের জন্যে নেই। রাজুর ধারণা আমরা ঠিকমত নামাজ রোজা করি না বলে খোদা আমাদের দিকে নেই, যদি নিয়মিত জুম্মার নামাজ পড়তে শুরু করি তাহলেই খোদা আমাদের কথা শোনা শুরু করবেন। আমার কখনই সেটা ঠিক বিশ্বাস হয় নাই।
কিন্তু সপ্তাহ শেষ হবার আগেই আমরা আবিষ্কার করলাম খোদা আছেন। শুধু যে আছেন তাই নয়, আমাদের দিকেই আছেন। খালেদ সেই মাদী মাকড়সাকে ঝাটা পেটা করার পরও খোদা মনে হয় তাকে এবং আমাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন।
আমাদের রওনা দেবার কথা শুক্রবার রাতে। বৃহস্পতিবার সকালে বড় চাচা দেখলেন মেঝেতে একটা আধুলি পড়ে আছে। বড় চাচা নিচু হয়ে সেই আধুলিটা তুলতে গিয়ে আর সোজা হতে পারলেন না। বাঁকা হয়ে থেকে চিৎকার করতে থাকেন, তার পিঠে কোথায় নাকি টান পড়ে গেছে। তাকে সেই অবস্থায় চ্যাংদোলা করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হল। পয়সা খরচ হবে বলে ডাক্তার ডাকা হল না। বড় চাচী সর্ষের তেলে রসুল দিয়ে গরম করে পিঠে মালিশ করতে লাগলেন, আর বড় চাচা গরুর মত চিৎকার করতে থাকলেন। সেই চিৎকার আমাদের কানে যে কি মধুর লাগল সেটা আর বলার মত নয়!
ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে, হোটেল রিজার্ভেশন হয়ে গেছে, এখন তো আর কিছু বাতিল করা যায় না। বড় চাচা যেতে পারছেন না তাই ঠিক হল ছোট চাচা আমাদের সাথে যাবেন। এতদিন আমরা কোন উৎসাহ পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ করে আম্মাদের মাঝে উৎসাহের বান ডাকল। আমরা আমাদের ব্যাগ বোঝাই করতে শুরু করলাম। ট্রেনে পড়ার জন্যে সায়েন্স ফিকশান, সমুদ্র দেখে অব এসে গেলে কবিতা লেখার জন্যে নোটবই এবং কলম, ভ্রমণে কাজে লাগতে পারে সেজন্যে পকেটে রাখার মত ছোট চাকু, টর্চ লাইট, ফাস্ট এইডের জন্যে ব্যান্ডেজ, এ্যান্টিসেপটিক, মাথা ধরার জন্যে এসপিরিন, পেটের গোলমালের ওষুধ। খালেদের একটা ছোট ক্যাসেট প্লেয়ার আছে সেটাতে শোনার জন্যে গানের ক্যাসেট। ছোট চাচা একটা ক্যামেরা যোগাড় করার চেষ্টা করছিলেন তখন দেখা গেল খালেদের নিজেরই একটা ক্যামেরা আছে, তবে ছবি তোলার তার কোন শখ নেই। আমি আর রাজু খোঁজাখুঁজি করে মাথায় পরার জন্যে বারান্দাওয়ালা টুপি বের করলাম, বাসায় পরলে সবাই হাসাহাসি করবে, একবার বের হলেই মাথায় দিয়ে দেব। উৎসাহে আমাদের শেষ কয়েকটি ঘণ্টা আর কিছুতেই কাটতে চায় না।
.
৪. টি-রেক্স
আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছালাম খুব ভোরে। ট্রেনে ঘুমনো খুব সোজা নয়। বড় চাচা যাবেন ঠিক ছিল বলে সস্তা টিকিট কিনেছেন, না হয় একেবারে ফাস্ট ক্লাসের টিকেট কেনা যেত আর আমরা একেবারে মন্ত্রীদের মত আরামে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারতাম। আমি কখনো ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে উঠি নাই, না জানি কত মজা ফাস্ট ক্লাসে অবশ্যি সেটা নিয়ে আমাদের মনে একেবারেই কোন দুঃখ নাই, যখনই মনে পড়ছে যে বড় চাচা বিছানায় বাকা হয়ে শুয়ে আছেন, আনন্দে আমাদের মন ভরে যাচ্ছে। খোদা সত্যিই আছেন এবং আমাদের ওপর তার নেক নজর আছে সেটা নিয়ে এখন আর আমাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কে জানে এবারে ফিরে গিয়ে হয়তো নিয়মিত জুম্মার নামাজ শুরু করে দেব।
আমরা বেশ খানিকক্ষণ ট্রেনে বসে থাকলাম। অন্ধকার কেটে যখন একটু আলো হল আমরা ট্রেন থেকে নেমে এলাম, সাথে বেশি মালপত্র নেই, যে যার নিজের ব্যাগ নিয়ে নেমেছি। খালেদের দেখাদেখি আমরাও টুপিটা পরেছি উল্টো করে, দেখতে নিশ্চয় একেবারে অভিযাত্রীদের মত লাগছে আমাদের। রাতে ভাল ঘুম হয়নি, চোখে এখনো ঘুম লেগে আছে। হাত মুখ ধুয়ে কিছু একটা খাওয়া দরকার। আমাদের জন্যে কোন অসুবিধে নেই, কিন্তু খালেদের খাওয়া নিয়ে অনেক যন্ত্রণা। ফোঁটানো পানি ছাড়া কিছু খাওয়া নিষেধ, ভাল করে রান্না না করে খাওয়া নিষেধ। খোঁজাখুঁজি করে স্টেশনের বাইরে একটা রেস্টুরেন্ট বের করা হল, বাহার তাওয়ায় পুরোটা ভাজা হচ্ছে, গনগনে আন, কোন জীবাণু থাকার কথা নয়। আমরা সেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম।
.
কক্সবাজারের বাসে যখন উঠেছি তখন বেলা দশটা বেজে গেছে। বাসটা ছাড়তে একটু দেরি হল। বাসের ছাদে বস্তায় করে নানা রকম জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে, বড় বড় টায়ার, কার্ডবোর্ডের বাক্স বোঝাই রঙচঙে জিনিস, তেলের টিন, কি নেই! বাস ছাড়ার কিছুক্ষণের মাঝেই শহর থেকে বের হয়ে এলাম, দু পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ, বেশ লাগে তখন দেখতে। আমি খালেদকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে খালেদ?
ভালই। তবে—
তবে কি?
মনে হচ্ছে শরীরের পার্টস সব খুলে আসবে।
কেন?
ঝাঁকুনি দেখছ না?
আমি বেশ অবাক হলাম। চমৎকার রাস্তা, ঝাঁকুনির এমন কিছু চিহ্ন নেই। আমেরিকার রাস্তা কি মাখন দিয়ে তৈরি?
ভেবেছিলাম অভ্যেস নেই বলে এই ঝাঁকুনিতেই খালেদের শরীর খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তার কিছু হল না, ঘন্টা দুয়েক পর কথা নেই বার্তা নেই রাজু হড় হড় করে তার সামনে বসে থাকা মানুষটার ঘাড়ে বমি করে দিল। বমিতে আধা হজম হওয়া পরোটা, সবজি সব আলাদা আলাদা করে চেনা যায়। সামনের মানুষটি খুব বিরক্ত হল সত্যি কিন্তু বাচ্চা একটা ছেলে যদি শরীর খারাপ করে বমি করে দেয় তাহলে তো তার ওপরে রাগ করা যায় না। বাসটা থামানো হল একটু পরেই। একটা ছোট বাজারের মতন জায়গা। কয়েকটা দোকান, কিছু ফেরিওয়ালা, মাইক লাগানো একটা মসজিদ। বাসের সব মানুষ নেমে গেল, হাত পা ছড়িয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করবে। রাজু যার ঘাড়ে বমি করে দিয়েছে সেই মানুষটিকে দেখলাম তার শার্ট খুলে খুব ভালো করে টিউবওয়েলে ধোয়ার চেষ্টা করছে।
বমি করার পর বোধ হয় রাজুর শরীর একটু ভাল লাগতে থাকে। দেখলাম সে কথাবার্তা বলা শুরু করেছে, বসে এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। বাসের ওপর থেকে কিছু জিনিসপত্র নামিয়ে আবার অন্য জিনিসপত্র তোলা শুরু করেছে, মনে হয় বাস ছাড়তে একটু দেরি হবে। ছোট চাচা একটা সিগারেট ধরালেন এবং খালেদ সাথে সাথে তার লেকচার শুরু করল, বলল, সিগারেট খাওয়া আর নিজের মাথায় গুলি করার মাঝে কোন পার্থক্য নাই।
ছোট চাচা বললেন, আমি তো নিজের মাথায় করছি, তোমার মাথায় তো করছি না।
একটা সিগারেট খেলে দশ মিনিট আয়ু কমে যায়।
আয়ু যতো কমে তত ভাল। বুড়ো মানুষদের কৃত যন্ত্রণা দেখেছ?
সিগারেট খেলে লাংস ক্যান্সার হয়। লাংস ক্যান্সারের মৃত্যু ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মৃত্যু।
ছোট চাচা এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কোন্ মৃত্যু আরামের?
খালেদ তর্কে বেশি সুবিধে করতে না পেরে হঠাৎ লাফিয়ে ছোট চাচার মুখ থেকে সিগারেটটা ছো মেরে কেড়ে নিল। ছোট চাচা কিছু বোঝার আগেই সে সিগারেটটা ছুঁড়ে দিয়েছে রাস্তার ওপারে। অন্য কেউ হলে ছোট চাচা বেগে মেগে একটা কাণ্ড করতেন, কিন্তু খালেদের ওপর রাগবেন কেমন করে? সে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে সিগারেট খাওয়া আর মানুষ খুন করার মাঝে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই।
ছোট চাচা আরেকটা সিগারেট ধরাবেন কি না বুঝতে পারলেন না। খালেদের দিকে একবার বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেলেন। ঠিক তখন দেখতে পেলাম এক কোণায় বেশ কিছু মানুষের জটলা, সেখান থেকেই রাজু আমাদের হাত তুলে ডাকছে। রাস্তার পাশে আশ্চর্য মলম, দাঁতের মাজন, সাপ কিংবা বানরের খেলায় খালেদের খুব উৎসাহ, রাজুকে দেখে সে প্রায় সাথে সাথে ছুটে গেল।
ভিড় ঠেলে ঢুকে দেখি মাটিতে একটা চাদর বিছিয়ে সেখানে ছোট ছোট কোটায়, ছোট ছোট বাক্সে নানাম গাছগাছড়া, ওষধপত্র সাজানো! পেছনে দড়ির মতে শুকনো একজন মানুষ চিৎকার করে হাত পা নেড়ে কথা বলছে। নানা রকম অসুখের বর্ণনা বেশির ভাগই অসভ্য অসুখ এবং কিভাবে তার আশ্চর্য ওষুধ দিয়ে সেই সব অসুখ নিরাময় হয় তার উপরে বক্তৃতা। এক পাশে নানা রকম হাড়গোড়, একটা মানুষের মাথার খুলি আর একটা বিশাল হাড়। এতো বড় হাড় কোন প্রাণীর কে জানে।
খালেদ বড় হাডটা দেখে খুব অবাক হয়ে গেল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ওটা কিসের হাড়?
আমি তো জানি না।
ছোট চাচা এই সময় বাস থেকে আমাদের নাম ধরে ডাকলেন। বাস নিশ্চয়ই ছেড়ে দিচ্ছে।
খালেদ তখনো অবাক হয়ে হাড়টার দিকে তাকিয়ে আছে, আমাকে আবার বলল, জিজ্ঞেস কর তো কিসের হাড়।
দড়ির মত শুকনো লোকটা তখন খুব উত্তেজিত হয়ে সপ্ত ধাতু দিয়ে তৈরি কি একটা মহৌষধের কথা বলছে, মাঝখানে তাকে বাধা দেয়া ঠিক না, কিন্তু আমাদের বাসও ছেড়ে দিচ্ছে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না লোকটাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করতেই হল, ওটা কিসের হাড়?
লোকটা থতমত খেয়ে থেমে গেল। বেশ বিরক্ত হল, ভেবেছিলাম আমার কথার উত্তরই দেবে না, কিন্তু উত্তর দিল। গম্ভীর হয়ে বলল, পাহাড়ি দানো।
পাহাড়ি দানো?
হ্যাঁ।
সেটা আবার কি?
পাহাড়ে থাকে। বটগাছের সমান উঁচু। একটা দাঁত হাত দুই লম্বা।
আমার মুখে নিশ্চয়ই অবিশ্বাসের হাসি ফুটে উঠেছিল, কারণ দেখলাম হঠাৎ লোকটা খুব গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, আমার কথা বিশ্বাস করলে না? মনে করছ দুই চার পাতা বই পড়েছ বলে আল্লাহর দুনিয়ায় যা যা আছে সব ভ্রান্ত, হ্যাঁ?
আমি কিছু বললাম না। লোকটা এবার মাথা এগিয়ে বলল, এই হাড্ডিটা এসে তুলো দেখি!
বাস একটা হর্ন দিল সাথে সাথে ছোট চাচার ক্রুদ্ধ গলার স্বর শুনতে পেলাম কিন্তু এত বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছেড়ে দিই কেমন করে? এগিয়ে গিয়ে হাড়টা তোলার চেষ্টা করে একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম, ভয়ংকর ভারী যেন হাড় নয়, পাথর। খালেদও এগিয়ে এসে তোলার চেষ্টা করল, পারল না। সে অবাক হয়ে একবার লোকটার দিকে তাকাল তারপর কেমন যেন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ফসিল।
কি?
ফসিল।
ফসিল?
হ্যাঁ, ডাইনোসোরের ফসিল।
বাসটা খুব খারাপ ধরনের লম্বা একটা হর্ন দিয়ে নড়তে শুরু করল, খালেদ তখনো হাড়টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, চল খালেদ।
খালেদ ফিসফিস করে বলল, আমি যাব না।
কি বললে?
আমি যাব না।
আমি অবাক হয়ে খালেদের দিকে তাকালাম, হঠাৎ বুঝতে পারলাম সে সত্যিই যাবে না।
.
ছোট চাচা বেশি রাগেন না বলে রাগলে কি করতে হয় ঠিক জানেন না। বারবার শুধু ডান হাতটা ওপরে তুলে নাচার মত একটা ভঙ্গি করে একটু একটু তোতলাতে থাকেন। রাগলে ছোট চাচা ইংরেজিতে কথা বলতে থাকেন, বেশি রাগলে আবার ইংরেজিটাও ঠিক বের হয় না, ঢাকাইয়া কথা বের হতে থাকে! রাগটা খালেদের উপরে, কিন্তু সে একেবারেই গা করল না, একটু পরে চোখ বড় বড় করে বলতে লাগল, ফসিল! সত্যিকারের ফসিল! ডাইনোসেরের ফসিল!
শেষ পর্যন্ত ছোট চাচার রাগ একটু কমল, বাস থেকে নামানো আমাদের লিপত্রের ওপর বসে পড়ে গজগজ করতে করতে একটা সিগারেট ধরালেন, খালেদ পর্যন্ত সেটা সহ্য করে গেল। বাসের টিকিটের ভাড়াটা এর মাঝে গেছে, সময় মত কক্সবাজারে না পৌঁছালে হোটেলের রিজার্ভেশনের টাকাটাও গচ্চা যাবে। বড় চাচা হলে এতক্ষণে খুনোখুনি হয়ে যেত, ছোট চাচা বলে রক্ষা।
ছোট চাচার মেজাজটা ঠাণ্ডা হওয়ার পর খালেদ হাত পা নেড়ে বলল, এটা ডাইনোসরের ফসিল।
তোমায় কে বলেছে এটা ডাইনোসরের ফসিল?
পৃথিবীতে আর কোন জন্তু নাই যার এতবড় হাড় আছে। আর এটা কতখানি ভারী দেখেছ? ঠিক ফসিল যে রকম হয়।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। গত বছর আমরা ডাইনোসেরের উপর একটা প্রজেক্ট করেছি। ডাইনোসোরের উপর পড়াশোনা করার জন্যে আমরা কয়েকজন পিটসবার্গ গিয়েছিলাম। আমি ফসিল চিনি।
হুঁম। ছোট চাচা গুম হয়ে বসে রইলেন।
একটা হাড় কত বড় সেটা দেখেই জন্তুর সাইজ বলা যায়। এটা বড় কোন ডাইনোসোর। ব্রাকিওসোরাস না হয় ডিপ্লেডোকাস। লোকটার কথা যদি সত্যি হয় যে, এর দু’হাত লম্বা দাঁত তাহলে এটা নিশ্চয়ই টি-রেক্স।
টি-রেক্স?
হ্যাঁ। টাইরানোসোরাস রেক্স। সংক্ষেপে টি-রেক্স। ভয়ঙ্কর ডাইনোসোর!
ছোট চাচা কোন কথা বললেন না, খালেদ আবার চোখ বড় বড় করে বলল, বিশ্বাস করতে পারেন যে আশপাশে কোথাও ডাইনোসোরের ফসিল রয়েছে। সত্যিকারের ফসিল! বিশ্বাস করেন?
খালেদের এরকম উত্তেজনা দেখে আমি আর রাজুও মোটামুটি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। শেষ পর্যন্ত দেখলাম, ছোট চাচাও মাথা নাড়লেন, বললেন, তা ঠিক, পৃথিবীতে ডাইনোসরের ফসিল আর কত জায়গায় পাওয়া যায়?
আমাদের খুঁজে বের করতে হবে জায়গাটা।
ছোট চাচা একটু অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়লেন।
রাজু জিজ্ঞেস করল, কেমন করে বের করবে?
খালেদ বলল, ঐ লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কোথায় পেয়েছে।
আমি বললাম, আমরা জিজ্ঞেস করলে আমাদের হয়তো পাত্তাই দেবে না, ছোট চাচা, আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
ছোট চাচা তার সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, চল চাই।
ওষুধ বিক্রি করার শুকনো মানুষটার কাছে তখন ভিড় একটু কম। সে লম্বা বক্তৃতা দিয়ে মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, বসে বসে তাই বিশ্রাম নিচ্ছে। আমাদের দেখে ভুরু কুঁচকে তাকাল। ছোট চাচা জিজ্ঞেস করলেন, কি চাচা মিয়া, ব্যবসাপাতি কেমন? নবযৌবন সালসা কেমন চলছে?
আর ব্যবসাপাতি! লোকজনের ভাত খাওয়ার পয়সা নেই, নবযৌবন সালসা কিনে কেমন করে?
লোক ঠকানোর বিজনেস, যত কম হয় ততই ভাল! কি বলেন?
ভাবলাম ছোট চাচার কথা শুনে লোকটা খুব রেগে যাবে, কিন্তু রাগল না। মুখ বাঁকা করে একটু হেসে বলল, কি চান বলেন?
ছোট চাচা ডাইনোসোরের ফসিলটা দেখিয়ে বললেন, এই হাড়টা কোথায় পেয়েছেন?
লোকটা ভুরু কুচকে বলল, কেন?
এমনি জানতে চাই।
এমনি?
হ্যাঁ, ছোট চাচা উদাস মুখে বললেন, এমনি। কোথায় পেয়েছেন?
লোকটা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে ছোট চাচার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, বলতে পারি কিন্তু পাঁচশ টাকা লাগবে।
ছোট চাচা হে হে করে খুব খারাপ ভঙ্গি করে হেসে উঠে বললেন, আপনার কি ধারণা গাছে টাকা ধরে?? লাঠি দিয়ে খোঁচা দিলে একশ টাকার নোট ঝুরঝুর করে নিচে পড়তে থাকে? নাকি আমাকে দেখে মনে হয় আমি আদম ব্যাপারী? মানুষের বিজনেস করে এত টাকা কামিয়েছি যে, আপনার মুখ দেখে পাঁচশ টাকা দিয়ে দেব?
লোকটা সরু চোখে ছোট চাচার দিকে তাকিয়ে রইল আর ছোট চাচা সিনেমার ভিলেনের মত মুখ করে উঠে আসতে শুরু করলেন। খালেদ ছোট চাচার হাত জাপটে ধরে বলল, কি করছেন আপনি? কি করছেন? রাজি হয়ে যান।
আরে দাঁড়াও তো! দ্যাখ, এখনি ডাকবে।
সত্যি সত্যি আমরা দশ পাও যাই নি, লোকটা আবার ডাকল, শুনেন।
কি হল?
কত দেবেন?
পয়সাকড়ি কোথা থেকে দেব? জিনিসটা যদি খাঁটি হয় খবরের কাগজে আপনার নাম ধাম লেখা হবে, ছবি ছাপা হবে।
শুনে লোকটার মুখ কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল, খবরের কাগজে নাম দিয়ে কি আর পেট ভরে? নাকি সংসার চলে? ওসব আপনাদের ব্যাপার। আমার কোন নামের দরকার নাই, নাম আপনারাই নেন। আমি একটা দরকারি খবর দেই আপনারা কিছু সাহায্য করেন। চুরিচামারি তো করি না। স্বাধীন ব্যবসা করি।
ছোট চাচা চুপ করে বসে রইলেন। লোকটা বলল, ঠিক আছে, তিনশ টাকা দেন।
দুইশ।
আড়াইশ, লোকটা মুখে একটু মিনতির ভাব করল, তখন ছোট চাচা রাজি হয়ে গেলেন, বললেন, ঠিক আছে আড়াইশ।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলেন একটু চা খাই, গলাটা শুকিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে কথা বলি।
আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। লোকটা একপাশে বসে থাকা একটা কালো মতন বাচ্চাকে ধমক দিয়ে বলল, হেই কাউলা, বস এখানে। খবরদার, পাঁচ টাকার কমে কোন নবযৌবন সালসা দিবি না।
কালো মতন ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, জে, দেব না।
কে জানে সত্যিই ছেলেটার নাম কাউলা নাকি গায়ের রঙ কালো বলে ওকে কাউলা ডাকছে।
.
রেস্টুরেন্টে চা খেতে লোকটা যা বলল, তার সারমর্ম এরকম : সে নিজে এই হাড়টা যোগাড় করে নি। তার বড় শালা তাকে দিয়েছে। বান্দরবনের ভেতর দিয়ে একটা নদী ভেতরে চলে গেছে, নদীর নাম শঙ্খ নদী, স্থানীয় লোকজন বলে সাঙ্গু। সেই নদী ধরে পুরো দিন পাহাড়ে উঠে গেলে একটা জায়গা আসে সেটার নাম ঝুমিয়া। জায়গাটা চেনার সহজ উপায় আছে, খুব সুন্দর একটা ঝরনা আছে সেখানে। সেই ঝুমিয়া থেকে দুই পাহাড়ের মাঝে দিয়ে ঝরনার স্রোতধারা বেয়ে প্রায় কুড়ি মাইল হেঁটে গেলে একটা হ্রদ পাওয়া যায়। সেই হ্রদের পানি নাকি আকাশের মত নীল। সেই হ্রদের তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঢাকা, পাহাড়গুলি পাথরের, পাথরগুলির রঙ নাকি আগুনের মত। সেই পাথরের মাঝে নাকি নানারকম জন্তু জানোয়ারের হাড় ছড়ানো ছিটানো আছে। লোকটার বড় শালা শঙ্খ নদীতে নৌকা চালায়, সে একসময় গিয়েছিল। সেই এই হাড়টা এনে দিয়েছে। তার কাছে শুনেছে দৈত্যের মত বড় নাকি তার মাথা, তার বড় বড় দাঁত হাত দুই হাত লম্বা।
খালেদ নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল, কথা শেষ হবার সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করল, আর কেউ কি জানে এটা সম্পর্কে? আর কেউ উৎসাহ দেখিয়েছে?
লোকটা বলল, মনে হয় খুব বেশি মানুষ জানে না। কেউ কোন উৎসাহও দেখায় নাই। কয়েকজন বিদেশী একবার একটু উৎসাহ দেখিয়েছিল কিন্তু আজকাল বিদেশীরাও খুব চালু হয়ে গেছে, হাত দিয়ে পয়সা গলতে চায় না।
খালেদ জানতে চাইল বান্দরবন কেমন করে যেতে হয়, থাকার জন্যে হোটেল আছে কি না। খাওয়ার ভাল ব্রেস্টুরেন্ট আছে কি না।
লোকটা ভাল উত্তর দিতে পারল না, তবে তার বড় শালার নাম ঠিকানা লিখে দিল। সে স্থানীয় মানুষ, ভাল খোঁজখবর দিতে পারবে। দরকার পড়লে এক দুরাত তার বাড়িতে থাকা কোন সমস্যা না। গরীব মানুষ কিন্তু আদর যত্ন ঠিকই করবে।
খালেদ তখনি তার নাম ঠিকানা লিখে নিল।
.
ছোট চাচা বাইরে এসে একটা গাছের নিচে বসে তখন একটা জরুরী মিটিং ডাকলেন। বললেন, কক্সবাজারে আমাদের হোটেলে রিজার্ভেশন করা আছে। আমাদের এখন সেখানে গিয়ে প্রথমে পুরো ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা দরকার। দু’একদিন থেকে খোঁজখবর নিয়ে কিছু একটা করা যাবে।
খালেদ বলল, আপনি যান কক্সবাজার। আমি যাচ্ছি না।
ছোট চাচা রাগ চেপে বললেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
বান্দরবন হয়ে ঝুমিয়া। সেখান থেকে টি-রেক্সের সন্ধানে।
তুমি একা?
আর কেউ যদি না যায় তাহলে একা।
ছোট চাচা খুঁটি বাংলায় খালেদকে একটা গালি দিয়ে বললেন, তুমি একা বান্দরবনের পাহাড়ি জঙ্গলে যেতে পারবে?
আমি আমেরিকা থেকে একা চলে এসেছি।
আমেরিকা আর বান্দরবন এক জায়গা হল?
যে আমেরিকায় থাকতে পারে সে পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছে সেখানে থাকতে পারে। সেখানে প্রত্যেক তিন মিনিটে একটা মানুষ খুন হয়। পাঁচ মিনিটে –খালেদ হঠাৎ থেমে গল।
পাঁচ মিনিটে কি?
নাহ। কিছু না।
তোমার বাবা যদি খবর পায়—
কিছু হবে না। খালেদ তার ঝোলাটা হাতে নিয়ে বলল, কে যাবে আমার সাথে?
আমার বুক ধুক ধুক করতে থাকে। দিনরাত বড়দের গালিগালাজ খেয়ে আমাদের মনটাই ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু এখন এই রকম সুযোগ তো আমি ছেড়ে দিতে পারি না। দাঁড়িয়ে বললাম, আমি যাব।
ছোট চাচা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, টোপন, তোর মাথা যদি আমি চিবিয়ে না খাই।
রাজুও ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমিও যাব।
ছোট চাচার মুখ রাগে থমথম করতে থাকে। কাঁপা হাতে তিনি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। খালেদ নিচু গলায় বলল, সিগারেট খাওয়া আর মাথায় গুলি করার মাঝে কোন পার্থক্য নাই।
ছোট চাচা এত জোরে চিৎকার করে বললেন ‘চুপ কর’ যে আশপাশের সব লোক ঘুরে তার দিকে তাকাল। গাছের ওপর দুইটা পাখি কিচমিচ করে ঝগড়া করছিল, ভয় পেয়ে সেগুলি উড়ে গেল হঠাৎ।