৫. ফ্রেডারিক সাহেব
বান্দরবনে যে বাসটা যায়, সেটি আসলে বাস নয়, একসময় সেটি ছিল একটা জীপ। এখন তার ওপরে নিচে মানুষের বসার জায়গা করায় সেটি একটি বিদ্ঘুটে জিনিসে পরিণত হয়েছে। আমরা বসেছি তার ছাদে। আমাদের এক পাশে একটা বস্তা বোঝাই তামাক, অন্য পাশে ঝাঁকা বোঝাই মুরগি। এক পাশ থেকে আলকাতরার দুটি টিন ঝুলছে। যে বস্তাটায় হেলান দিয়ে বসেছি, গন্ধ থেকে বোঝা যাচ্ছে সেটা আসলে শুঁটকির বস্তা। দেখে মনে হয়েছিল খুব বেশি হলে এখানে সাত আটজন মানুষ বসতে পারবে কিন্তু ওপরে নিচে মিলে প্রায় তিরিশজন মানুষ, তার মাঝে বেশ কয়েকজন চাকমা না হয় মগ। এতটুকু জায়গায় এতজন মানুষ কেমন করে বসেছে সেটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আমি, রাজু আর খালেদ এই গাড়িটার ছাদে। ছোট চাচা ভেতরে বসে রাগে ফুলছেন। প্রথমে বলেছিলেন তিনি কক্সবাজার যাচ্ছেন, আমাদের যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে পারি, জাহান্নামে গেলেও তার কোন আপত্তি নাই বরং তিনি সেটা পছন্দই করবেন। যখন দেখলেন আমরা সত্যি সত্যি বান্দরবনের দিকে রওনা দিচ্ছি তখন আমাদের সঙ্গে এসেছেন। যখন বাসায় ফিরে যাব তখন আমাদের কি অবস্থা হবে সেটা নিয়ে আমাদের খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই। বাসার বড় মানুষেরা ছোট চাচার কি অবস্থা করবে সেটা চিন্তা করে বরং ছোট চাচার জন্য একটু দঃখই লাগছে।
বান্দরবনের রাস্তাটা অপূর্ব সুন্দর। আমি এর আগে কখনো এত সুন্দর রাস্তা দেখিনি। দুই পাশে পাহাড়, গাছগাছালি ঢাকা, মনে হয় কোথাও কোন মানুষ নেই, হঠাৎ করে দেখা যায় কিছু পাহাড়ি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তা এঁকেবেঁকে একবার ওপরে উঠে যায় একবার নিচে নেমে যায়। মাঝেমাঝেই পাহাড় এতটা খাড়া হয়ে যায় যে তখন গাড়ি আর নড়তে চায় না। সবাইকে নেমে তখন গাড়িটা ঠেলতে হয়। খালেদের তখন কী উৎসাহ! মাঝখানে হঠাৎ এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে হেলপার একটা বালতি নিয়ে ছুটে গেল। তারপর হুড় খুলে রেডিয়েটরে পানি ঢেলে দেয়, টগবগ করে সেখানে পানি ফুটতে থাকে। খালেদের চোখেমুখে একটা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি। আমাকে ফিসফিস করে বলল, মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি!
স্বপ্ন?
হ্যাঁ। কোনদিন কল্পনাও করি নাই এরকম একটা নির্জন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে গাড়ির ছাদে বসে বসে যাব। এইরকম দৃশ্য, এইরকম অ্যাডভেঞ্চার! গল্পের বইয়েও তে এ রকম হয় না। হয়?
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম, খালে আবার বলল, কী আশ্চর্যআসলেই এটা হচ্ছে। আমার নিজের জীবনে! বিশ্বাস হয়?
রাজু ফিসফিস করে বলল, যখন বাসায় যাব যা একটা মারি দেবে–
আরে ধুর! ভুলে যা বাসার কথা!
.
বান্দরবনের রাস্তাটা অপূর্ব, কিন্তু শহরটা এমন কিছু আহামরি নয়। দেশের যে! কোন মফঃস্বলের বাজারের মত। ছোট ছোট দোকানপাট। রাস্তাঘাটে ভিড়। তবে তুলনামূলকভাবে চাকমা, মগ এরকম মানুষ বেশি। বিচিত্র ভাষায় কথা বলছে, পোশাকও একটু অন্যরকম। শুকনো দড়ির মত মানুষটি আমাদের বলে দিয়েছিল বাজারের কাছ থেকেই সাঙ্গু নদী কিন্তু কোন নদী আমরা খুঁজে পেলাম না। লোকটা কি ধোকা দিয়ে আমাদের এখানে পাঠিয়েছে? ছোট চাচা তাহলে মনে হয় লবণ ছিটিয়ে আমাদের কাঁচা ধরে খেয়ে ফেলবেন।
আমরা বাজারের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, সাঙ্গু নদী কোথায়? লোকটা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই তো পেছনে!
তাকিয়ে দেখি সত্যিই দোকানের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা নিচে নেমে গেছে। আমাদের বুকে বল ফিরে এল, হেঁটে নিচে নেমে আসতেই দেখি নদী। নদীর তীরে এক পাশে অনেক মানুষের জটলা। দূর থেকে দেখতে পেলাম পাশাপাশি অনেকগুলো নৌকা তার মাঝে বড় কড় কাঠের বাক্স তোলা হচ্ছে। এটা দেখার জন্যে এত ভিড় কেন বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ দেখি একজন সাদা চামড়ার বিদেশী মানুষ, তখন হঠাৎ করে ভিড়ের আসল কারণটা বুঝতে পারলাম। বিদেশী মানুষ দেখলে সবসময় ভিড় জমে যায়। আমি খালেদকে বললাম, মনে হয় তোমার দেশের মানুষ, যাও কথা বলে এসো!
খালেদ উত্তর না দিয়ে হাসল। বোঝাই যাচ্ছে তার কোন উৎসাহ নেই।
ছোট চাচা অবশ্যি খুব উৎসাহ নিয়ে হেঁটে গেলেন। বিদেশী দেখলেই ছোট চাচা এগিয়ে যান, তার ধারণা এদেশে বিদেশীদের খুব অসুবিধে হয়, ছোট চাচা লেখাপড়া জানা মানুষ তাই গিয়ে তাদের সাহায্য করবেন।
আমরা আমাদের সেই শুকনো মানুষের বড় শালার খাঁজ করতে শুরু করলাম, নাম বলেছিলা তার বাহাউদ্দিন। মাঝিদের জিজ্ঞেস করতেই তারা চিনে ফেলল, মনে হয় এখানে সবই সবাইকে চেনে। তারা বলল, বাহাউদ্দিন মাঝি গত রাতে নৌকা নিয়ে পাহাড়ে গেছে। শুনে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, এরকম একটা ব্যাপার ঘটতে পারে আমরা চিন্তা করিনি।
এতদূর এসে তো আর ফিরে যাওয়া যায় না, তাই ছোট চাচা এসে হৈ চৈ শুরু করার আগেই আমরা খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলাম, নৌকা করে একরাত একদিন ওপরে উঠে গেলে সত্যি সত্যি মিয়া নামে একটা জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে সত্যি পাহাড়ের ওপর থেকে ঝরনার পানি এসে পড়ছে। কথা বলে মনে হল যে কোন মাঝিই আমাদের নৌকা করে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে। কোথায় থাকব জানতে চাইলে একজন মাঝি হেসে বলল, নৌকায় থাকবেন।
কোথায় ঘুমুব?
নৌকায়!
খাওয়া দাওয়া?
খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে কি? আমরা রান্না করব সেটা খাবেন। সব নৌকায় চুলো আছে, ডেকচি পাতিল আছে।
বাথরুম?
মাঝি হো হো করে হেসে বলল, এত বড় পাহাড় জঙ্গল আছে কি জন্যে?
.
ছোট চাচা তখনো সাহেবের পেছনে ঘুরঘুর করছেন। সাহেব মনে হচ্ছে তাকে বেশি পাত্তা দিচ্ছে না, কিন্তু তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। আমরা আর ছোট চাচার জন্যে অপেক্ষা করলাম না, নিজেরাই একটা নৌকা ঠিক করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
আমরা বাচ্চা ছেলে বলে নৌকার মাঝিরা আমাদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল না। যখন জানতে পারল সাথে একজন বড় মানুষ আছে তখন কয়েকজন মাঝি বেশ উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এল। তারা নিজেরাই আলাপ আলোচনা করে একজন মাঝিকে ঠিক করে দিল। লম্বা ঢ্যাঙা হালকা পাতলা মানুষ, হাসিখুশি চেহারা, নাম মুসলিম। তার কথা বোঝা অবশ্যি খুব কঠিন, মনে হয় সেখানে চট্টগ্রাম নয়, একেবারে আরাকানের ভাষার টান।
মাঝির সাথে দরদাম করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু খালেদের যন্ত্রণায় বেশিদূর যাওয়া গেল না। মাঝি যত চাইল খালেদ ঝপ করে সেটাতেই রাজি হয়ে গেল। আমরা তখন আমাদের ঝোলাঝুলি নিয়ে নৌকায় উঠে পা ছড়িয়ে বসলাম। নৌকার মাঝিকে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়া হল, সে গেল বাজার করতে, আগামী কয়েকদিনের জন্যে চাল ডলি কিছু কিনে আনবে। আমরা বলে দিলাম বিস্কুট কলা এসবও যেন কিনে আনে।
আমাদের মাঝে তখন কেমন জানি এক ধরনের স্মৃতির ভাব এসে গেছে। নৌকায় বসে নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে হৈ হুল্লাড় করছি। আশপাশে অনেক নৌকা। নদীর অন্য পাশে খাড়া পাহাড়। সেখানে দেখি কিছু বানর লাফঝাঁফ দিচ্ছে। জায়গাটার নাম। বান্দরবন হওয়ার কারণ তাহলে সত্যি আছে। কিছু লোক দেখলাম নদীতে গোসল করছে, জামা কাপড় খুলে আমরা লাফিয়ে পড়ব কি না চিন্তা করছিলাম, তখন দেখলাম ছোট চাচা ফিরে আসছেন। মুখে বেশ বড় একটা হাসি।
আমরা নৌকা ঠিক করে নিয়েছি দেখে রাগ করবেন ভেবেছিলাম কিন্তু রাগ করলেন না, বরং মনে হল একটু খুশিই হলেন। নোকার গলুইয়ে পা ঝুলিয়ে বসে এক গাল হেসে বললেন, সাহেবের নাম ফ্রেডারিক মায়ার। বাড়ি নিউজার্নি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি করছে এখানে?
তেল কোম্পানিতে কাজ করে। এক্সল। ড্রিল করার জন্যে এসেছে।
ড্রিল?
হ্যাঁ। তেল খোঁজার জন্যে মাটি খুঁড়ে দেখতে হয় তো। তাই করবে পাহাড়ে।
ও।
খালেদ জিজ্ঞেল করল, পাথর ড্রিল করার যন্ত্রপাতি কই?
যন্ত্রপাতি? আছে নিশ্চয়ই। ঐ দেখ না কত বক্স।
রাজু মাথা নাড়াল, উঁহু। ঐগুলি খালি বাক্স। দেখ না এক নৌকায় কতগুলি বাক্স তুলেছে। যন্ত্রপাতি হলে অনেক ভারী হত।
ছোট চাচা একটা ধমক দিয়ে বললেন, আজকাল কত রকম হাই টেক যন্ত্রপাতি বের হয়েছে, তুই কি জানিস?
খালেদ মাথা নেড়ে বলল, বাজু ঠিকই বলেছে। হাই টেক যন্ত্র দিয়ে কি আর পাথর ড্রিল করা যায়? পাথর ড্রিল করতে লাগে ভারী যন্ত্র।
ছোট চাচা হাত নেড়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, তাহলে কি লোকটা মিথ্যে কথা বলুকে আমার সাখে?
আর কি বলেছে আপনাকে?
একেবারে গোমড়ামুখো মানুষ। প্রথমে তো কথাই বলতে চায় না। শেষে যখন বললাম আমরাও যাচ্ছি অ্যাডভেঞ্চারে, তখন হঠাৎ করে উৎসাহ দেখাল।
কি করল তখন?
যখন শুনল আমরা ডাইনোসোরের ফসিল খুঁজতে যাচ্ছি তখন একেবারে হকচকিয়ে গেল। মনে হয়, কল্পনাই করতে পারেনি যে আমরা এরকম একটা সাংঘাতিক মিশনে যাচ্ছি। বারবার জিজ্ঞেস করল, কতজন যাচ্ছি, কিভাবে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, আমরা কে, কোথায় থাকি, কি করি, আমরা যে এখানে এসেছি, সেটা কারা জানে, আমাদের সাথে বন্দুক আছে কি না — এই রকম হাজার হাজার প্রশ্ন। মনে হল পারলে সেও আমাদের সাথে যায়। সাহেবের জাত ত, মনে হয় রক্তের মাঝে তাদের অ্যাভেঞ্চারের নেশা।
ছোট চাচার কথাবার্তা শুনে মনে হল অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলে সাহেবকে ভড়কে দিয়ে খুব খুশি হয়ে ফিরে এসেছেন। শার্ট খুলে নৌকায় চিৎ হয়ে শুয়ে গুনগুন করে একটা গান গাইতে গাইতে বললেন, বাঙালি জাতটার সমস্যা একটাই। সেটা হচ্ছে পলিটিক্স। পলিটিক্সে সময় নষ্ট না করে যদি অন্য কোন কাজে মন দিত কোন দিন এই জাতি মাথা তুলে দাঁড়াত।
আমার খুব ইচ্ছে করল তাকে মনে করিয়ে দিই, দুমাসও হয়নি তার ইউনিভার্সিটিতে ইলেকশান হল। ছোট চাচা সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে দাঁড়িয়েছিলেন। ইলেকশালে হেরে মুখ চুন করে ফিরে এসে বলেছেন, পুরো ব্যাপারটা নাকি একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফল। এর মাঝে একই সাথে সি.আই.এ. এবং কে.জি.বি.-র হাত ছিল।
.
মাঝি কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে এল। ছোট চাচা গম্ভীর হয়ে তাকে কিছু প্রশ্ন করে বাজিয়ে নিয়ে বললেন, চল তাহলে রওনা দিই।
মাঝি নোকাটার বড়ি খুলে নিয়ে লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে কি একটা বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না। শুধুমাত্র আল্লাহর নামটা শুনতে পেলাম। নিশ্চয় বলছে আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করছি। বড় চাচার ঘটনাটার পর থেকে আমাদের আল্লাহর উপর বিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। ওজু নাই তবু মনে মনে তিনবার কুলহু আল্লাহ পড়ে নিলাম।
আমরা নৌকা থেকেই দেখলাম নদীতীরে ছোট চাচার সেই ফ্রেডারিক সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছেন। সাথে আরেকজন মানুষ, গায়ের রং কুচকুচে কালো, দাঁতের ফাঁকে একটা সিগারেট চেপে ধরে রেখেছে। মানুষটির পরনে লাল লুঙ্গি। লাল রঙের লুঙ্গি হয় আমি জানতাম না।
আমরা যতক্ষণ না চলে গেলাম সাহেব আর লাল রঙের লুঙ্গি পরা কালো মানুষটি দাঁড়িয়ে রইল। যখন আরো দূরে চলে গেলাম দেখলাম সাহেবটা বাইনোকুলার বের করে আমাদের দেখতে লাগল। নিজে দেখে বাইনোকুলারটি দিল তার সাথে কালো মানুষটিকে, সে মানুষটিও চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। নিশ্চয়ই আমাদের দেখছে, কিন্তু কেন দেখছে?
ঠিক জানি না কেন হঠাৎ করে আমার মনে হল আমরা একটা অশুভ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ছি। বুকের মাঝে হঠাৎ কেন জানি কাঁপুনি দিয়ে একটা ভয়ের শিহরণ বয়ে গোল।
.
৬. কাচু মিয়া
নৌকাটা একটা বাঁক ঘুরতেই আমরা একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। কী অপূর্ব দৃশ্য! কী সুন্দর একটা নদী এঁকেবেঁকে চলে গেছে, দুই পাশে উঁচু পাহাড়, সেই পাহাড়ে ঘন জঙ্গল। বিকেলের নরম আলোতে যেন এক ধরনের রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর পানির ওপর হালকা কুয়াশা, চারদিকে সুর্মসুমি নীরবতা। সমস্ত প্রকৃতি যেন চুপ করে তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে হয় সারাটা জীবন আমি একটা অন্ধকার দোতলা দালানের ছোট ছোট খুপরির মাঝে বড় চাচা, জয়নাল চাচা আর সুন্দর চাচার মত অস্বস্তিকর মানুষের কাছাকাছি থেকে কাটিয়ে দিয়েছি। অথচ বাইরের পৃথিবী কত সুন্দর মনে হয় আগের জীবন ছেড়ে এখানে চলে আসি, একড়া পাহাড়ে পাহাড়ি কিছু শিশুর সাথে জীবনটা কাটিয়ে দিই। কী না মজা হত তাহলে!
নৌকাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে। বাঁশের লগি দিয়ে ঠেলে ঠেলে মাঝি নৌকাটা নিয়ে যাচ্ছে। পানিতে শুধু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, আর কোন শব্দ নেই। আমরা কেউ কোন কথা বলছি না, কেন জানি মনে হতে থাকে, এখানে কোন কথা বলার কথা নয়। কথা বললেই এই অপূর্ব সৌন্দর্য, মায়াবী নীরবতা, আর কোমল রহস্যময় অনুভূতির কোন ক্ষতি হয়ে যাবে। আমরা চুপ করে বসে রইলাম, ছোটচাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বললেন, আহারে! কী সুন্দর! এখন মরে গেলেও কোন দুঃখ নাই।
নৌকার মাঝি ছোট চাচার কথা শুনে মাথা নাড়ল, বড়রা ছোটদের অর্থহীন কথা শুনে যে রকম সস্নেহে মাথা নাড়ে সেভাবে।
আমরা নৌকায় বসে বসে অন্ধকার নেমে আসতে দেখলাম। নৌকার মাঝি মুসলিম, যাকে আমরা মুসলিম ভাই বলে ডাকছি, আমাদের জিজ্ঞেস করল, খিদে লেগেছে নাকি ভাই?
ছোট চাচা উত্তর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ মাঝি, পেটের মাঝে তো চিকা বুক ডন মারছে, খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থা করলে?
মুসলিম ভাই বলল, এই তো সামনে থামিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করব। তার কথায় চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার টান খুব বেশি কিন্তু কয়েক ঘণ্টা তার সাথে কথা বলে আমরা এখন তার কথা মোটামুটি বুঝে ফেলি। খালেদ অবশ্যি একটা কথাও বুঝে না। বুঝবে সেরকম আশাও করি নি।
ছোট চাচা জিজ্ঞেস করলেন, সামনে কোথায় থামাবে?
নদীর পাশে একটা ছোট জায়গা আছে। সেখানে রাতে সব নৌকা জড়ো হয়ে রাত কাটায়। একটা ছোট ঘর আছে, মাঝিরা সেখানে গল্পগুজব করে, চা সিগারেট খায়। রাতে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করে। সবাই এক সাথে থাকে যেন বিপদ আপদ না হয়।
কী রকম বিপদ আপদ?
মুসলিম ভাই উত্তর না দিয়ে বলল, কত রকম বিপদ আপদ আছে! রাত্রে নৌকা চালানো ঠিক না, পাহাড়ি নদী, কিছু বলা যায় না।
ছোট চাচা কোন কথা বললেন না, মনে হল একটু ঘাবড়ে গেছেন হঠাৎ করে।
.
মুসলিম ভাইয়ের কথাই সত্যি। আরেকটা বাঁক ঘুরতেই দেখি নদীর তীরে ছোট একটা ঝুপড়ির মত ঘর। তীরে অনেকগুলি নৌকা বাঁধা। মাঝিরা বান্না চড়িয়েছে। নৌকায় নৌকায় ছোট ছোট বাতি জ্বলছে মিটমিট করে।
মুসলিম ভাই নৌকা থামাতেই আমরা নৌকা থেকে নেমে গেলাম। হাত পা ছাড়িয়ে হাঁটাহাঁটি করে আমরা ঝুপড়ির ভেতরে গেলাম দেখার জন্যে। ভিতরে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে, মাঝখানে একটা চুলোয় বড় কেতলিতে চা গরম হচ্ছে। মাঝিরা শব্দ করে চুমুক দিয়ে দিয়ে চা খাচ্ছে। ভিতরে সিগারেটের ধোয়া, তার মাঝে সবাই গল্পগুজব করছে।
ভিতরে সবাই আমদের জায়গা দিল। বসার কোন জায়গা নেই। মাটিতে পা ছড়িয়ে বসতে হল। আমরা কে কোথায় যাচ্ছি সেটা নিয়ে দেখলাম সবার খুব কৌতূহল। ছোট চাচা সুযোগ পেয়ে ডাইনোসোর, ডাইনোসোরের ফসিল এই সব নিয়ে একটা মস্ত গল্প ফেঁদে বসলেন।
উপস্থিত যারা আছে তার মাঝে বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল যাব। এই জায়গাটার কথা শুনেছে। ঝুমিয়া থেকে উত্তরে ছোট্ট একটা স্রোতধারার পাশ দিয়ে কয়েকটা পাহাড় ডিঙিয়ে গেলে একটা পাহাড়ি হ্রদ পাওয়া যায়। তার আশেপাশে সত্যিই নাকি ভয়ঙ্কর প্রাণীর দেহাবশেষ দেখা গেছে। স্থানীয় মানুষ সেখানে যায় না, অনেকে মনে করে সেখানে সে ভয়ঙ্কর প্রাণী এখনো বেঁচে আছে। সবাই সেটাকে বলে পাহাড়ি দানো।
গল্প শুনে আমাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। রাজু ফিসফিস করে বলল, সত্যি কি পাহাড়ি দানো আছে?
খালেদ মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় না। আমরা যে হাড়টা দেখেছি, সেটা ফসিল। ফসিল তৈরি হতে লক্ষ লক্ষ বছর লাগে। এই প্রাণী পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে শেষ হয়ে গেছে।
আমরা খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে একটু হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম নৌকোয়। মুসলিম ভাই রান্না চাপিয়েছে। কী চমৎকার ঘ্রাণ বের হচ্ছে, জিবে একেবারে পানি এসে গেল। ছইয়ের মাঝে হেলান দিয়ে ছোট চাচা আয়েস করে বললেন, এটাকে বলে বেঁচে থাকা! কি বলিস তোরা?
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম। রাজু মাথা নেড়ে বলল, আপনি তো আসতেই চাচ্ছিলেন না।
ছোট চাচা না শোনার ভান করে গম্ভীর হয়ে বললেন, প্রকৃতির কাছাকাছি যে জীবন, সে হচ্ছে সত্যিকার জীবন। তারপর গম্ভীর হয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলেন, আবার আসিব ফিরে…
ছোট চাচার ভাব এসে গেলে ভারি মুশকিল।
.
মুসলিম ভাই কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের ভাত বেড়ে দিল! ভাত এবং ভাল, এর আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই। না একটু সবজি, মাছ, ডিম, আলু– কিচ্ছু না। সেটা যে অস্বাভাবিক হতে পারে সেটও মুসলিম ভাইয়ের চোখে পড়ছে না। আমি বুঝতে পারলাম, অসম্ভব গরিব মানুষ এই নৌকোর মাঝি, তারা হয়তো জানেও না ডাল এবং ভাত ছাড়াও আরো কিছু খাওয়া যায়।
শুধু ডাল এবং ভাত, কিন্তু খেতে কী যে ভাল লাগেল তা আর বলার নয়। হাত দিয়ে মাখিয়ে গপাগপ করে গোগ্রাসে খেয়ে ফেললাম আমরা। ছোট চাচা খাওয়া শেষ করে একটা ঢেকুর তুলে বললেন, এই হচ্ছে সত্যিকার জীবন।
খাওয়ার পর নৌকার ছহঁয়ে হেলান দিয়ে ছোট চাচা খালেদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে সাবধানে একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, খুব ভাল রান্না করেছ মাঝি।
মুসলিম ভাই একটু হেসে কি একটা বলল। ছোট চাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন, এতো সুন্দর জায়গা, লোকজন বেড়াতে আসে?
জে না। মাঝেমধ্যে কেউ একজন আসে।
বিদেশী লোকজন আসে?
জে না। আগে কখনো দেখি নাই।
এই যে দেখলাম একজন।
এই প্রথম দেখলাম। মুসলিম ভাই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছে জানেন?
তেল খুঁজতে এসেছে। মাটির নিচে তেল থাকে। যন্ত্রপাতি দিয়ে সেই তেল খুঁজে বের করে।
মুসলিম ভাই অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, জে না। আমার বিশ্বাস হয় না। অন্য বদ মতলব আছে।
ছোট চাচা অবাক হয়ে বললেন, সে কী! বদ মতলব থাকবে কেন?
জে, আছে বদ মতলব।
কেমন করে জান তুমি?
সাহেবের সাথে লাল লুঙ্গি পরা একজন মানুষ দেখেছিলেন কালো মতন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ দেখেছি। সাহেবের সাথে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল।
তার নাম কাচু মিয়া।
কি হয়েছে কাচু মিয়ার?
কাচু মিয়া হচ্ছে এই এলাকার বদমানুষ। খুন খারাপির মানুষ। টাকা দিলে চলা নামিয়ে দেয়। এই মানুষকে যেখানে দেখবেন, বুঝবেন সেখানে গোলমাল আছে। খুন খারাপি আছে।
মুসলিম ভাইয়ের কথা শুনে আমি শিউরে উঠলাম। আমার মনে পড়ে গেলি নদী তীরে দাঁড়িয়ে সাহেব আর কাচু মিয়া বাইনোকুলার দিয়ে আমাদের দেখছিল। তাহলে কি আমাদের নিয়ে কোন বদমতলব আছে? আমি একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই ছোট চাচা বললেন, আরে ধুর! কি বলছ মাঝি!
জে, ঠিক বলছি। সাহেবের সাথে কাচু মিয়াকে দেখলাম। তার নিশানা ভাল না। অনেক বড় বদ মতলব এই সাহেবের।
ছোট চাচা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরে কি বলছ তুমি? এরা কত বড় জাতি! কত বড় এদের মন! কত বড় এদের ডেমোক্রেসি! আমি নিজে সাহেবের সাথে কথা বলেছি। কী মাইডিয়ার মানুষ!
সাহেবের কথা চিন্তা করেই ছোট চাচার মুখে একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু আমার পেটের ভেতরে হঠাৎ কেমন জানি পাক খেয়ে ওঠে।
.
রাতে ঘুমানো নিয়ে একটু সমস্যা হল, সবাইকে নিয়ে আরাম করে শোয়ার জন্যে লোকোটা যথেষ্ট বড় না। আমি আর খালেদ এক পাশে শুয়েছি, মাঝখানে ছোট চাচা আর রাজু, অন্য পাশে নৌকোর গলুইয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়েছে মুসলিম ভাই। ছোট চাচার পা আমাদের পেট পর্যন্ত চলে এসেছে আর সেই পায়ে সে কী বিদঘুঁটে গন্ধ!
রাত্রে নৌকায় শুয়ে নৌকোর অল্প অল্প দুলুনিতে ঘুমনোর চেষ্টা করতে লালাম আরো নৌকো এসে থামছে আশেপাশে, শুয়ে থেকেই আমরা টের পাচ্ছি। রেল গাড়ির যে রকম জংশন থাকে, এটাও নিশ্চয় সে রকম নৌকার জংশন।
শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকি কিন্তু এত সহজে চোখে ঘুম আসতে চায় না। মনে হচ্ছিল বুঝি কখনোই ঘুম আসবে না কিন্তু এক সময় সত্যি চোখে ঘুম নমে এল। ছাড়ছাড়া ভাবে ঘুমাচ্ছি হঠাৎ দেখি খালেদ উঠে বসেছে। আমি আধো ঘুমে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
বাথরুম পেয়েছে।
ছোট বাথরুম না বড় বাথরুম?
ছোট বাথরুম।
নৌকোর পাশে দাঁড়িয়ে করে ফেল।
ধুর! নিচে নেমে করে আসি। তুমি আসবে একটু ভয় ভয় করে।
চল। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে আমি আর খালেদ নৌকা থেমে নেমে এলাম। খালেদের লজ্জাশরম বা স্বাস্থ্যজ্ঞান মানে হয় অন্য দশজন মানুষ থেকে একটু বেশি। একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ সেরে ফেলতে অসুবিধে কি, কিন্তু সে একেবারে জঙ্গলের মাঝে ঢুকে গেল। আমি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মনে হল দুজন মানুষ একেবারে অন্ধকার কুঁড়ে বের হয়ে এল। আমি ভয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠছিলাম, কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে গাছের আড়ালে সরে গেলাম। মানুষ দু’জন আমাকে দেখেনি। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল আর আমি ম্যাচের আলোতে মানুষটাকে চিনতে পারি, কাচু মিয়া।
আমার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। নিজেকে লুকিয়ে রেখে নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। কচু মিয়া সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কোন নৌকা?
সাথের অন্য মানুষটা বলল, দক্ষিণের দুইটা ছেড়ে তিন নম্বরটা।
আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম, সেটা আমাদের নৌকা।
ঠিক জান?
জে। দেখে এসেছি। তিনজন ছেলে, একজন বড় মানুষ। সাথে মাঝি।
অ। শালার ফেউয়ের বাচ্চা। কচু মিয়া অসম্ভব মুখ খারাপ করে আমাদের গালি দিয়ে বলল, পাহাড়ি দানোর হাড্ডি নেবে আমাদের আগে, কত বড় সাহস!
কত বড় সাহস! অন্য লোকটা বিশ্বস্ত অনুচরের মত মাথা নাড়ে।
চল। ছেলে তিনটারে ছেড়ে দেব। বড়টার গলাটা নামিয়ে দিয়ে আসি।
এখনই কাচু ভাই?
তাহলে কখন?
আরেকটু রাত হোক। লোকজন এখন জাগা।
জাগাই তো ভাল। কাচু মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, কাচু মিয়ার হাতের কাজ তো লোকজন জেগেই দেখবে! কাচু মিয়া কি কাউকে ভয় পায়?
আমি আবছা অন্ধকারে দেখলাম, কাচু মিয়া তার বগল থেকে একটা দা বের করে তার উপরে আঙুল বুলিয়ে তার ধারটা পরীক্ষা করে মুখ দিয়ে একটা খুব সন্তুষ্টির মত শব্দ করল। অন্য লোকটি বলল, আগে এক কাপ চা খেয়ে আসি চলেন।
কাজের সময় কাজ। খাওয়ার সময় খাওয়া।
এক কাপ চা খেতে আর কতক্ষণ লাগবে। ফ্রেস পাত্তির গরম চা। সাদা চিনি।
কাচু মিয়া একটু নরম হল মনে হল। জিজ্ঞেস করল, এত রাতে চা কি আছে?
জে, আছে।
চল তাহলে।
কাচু মিয়া আর তার সঙ্গী দু’জন হেঁটে হেঁটে ঝুপড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ভয়ে আতঙ্কে আমার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে, কোনমতে চাপা গলায় ডাকলাম, খালেদ!
খালেদ জঙ্গল থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
আমি ফিসফিস করে বললাম, তাড়াতাড়ি চল নৌকায়। সর্বনাশ!
কী হয়েছে?
কাচু মিয়া এত বড় একটা দা নিয়ে এসেছে, ছোট চাচাকে মারবে।
সত্যি?
হ্যাঁ, নৌকায় চল। আমি আর খালেদ ছুটতে ছুটতে নৌকায় এসে ছোট চাচাকে তোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু ছোট চাচা গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছেন। দু একবার ধাক্কা দেয়ার পর ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করে বললেন, স্বৈরতাস্ট্রিক শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিপন্থী…
মুসলিম ভাই আর রাজু ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। মুসলিম ভাই জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
কাচু মিয়া আমাদের খুঁজছে। ছোট চাচাকে কেটে ফেলবে। হাতে এই বড় একটা দা।
কোথায়?
এখন চা খেতে গেছে।
মুসলিম ভাই লাফ দিয়ে উঠে বসে নৌকার দুই থেকে টেনে কি একটা জিনিস বের করল। আমরা দেখলাম একটা বর্শা। হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কোন ভয় নাই। আমি আছি।
মুসলিম ভাইয়ের শক্ত শরীর, কঠোর মুখ আর এরকম একটা বর্শা দেখে হঠাৎ আমরা বুঝতে পারি এই মানুষটা সত্যি আমাদের রক্ষা করবে। একটু আগে যে রকম আতঙ্কে হাত পা শীতল হয়ে যাচ্ছিল সেটা কমে গিয়ে এখন এক ধরনের উত্তেজনা হতে থাকে। মুসলিম ভাই দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে নৌকা থেকে নেমে গেল। একটু পরে দেখি মুসলিম ভাই নৌকা খুলে দিয়েছে। স্রোতের টানে নৌকা ভেসে যাচ্ছে নিঃশব্দে। বেশ খানিকক্ষণ পরে মুসলিম ভাই ভেজা কাপড়ে নৌকায় উঠে বসল, নৌকা নিঃশব্দে অন্ধকারে ভেসে যেতে থাকে।
আমি ফিসফিস করে বললাম, কোথায় যাও মুসলিম ভাই?
সরে যাই। কাছে একটা জায়গা আছে, গাছপালায় ঢাকা। কারো সাধ্যি নেই সেখানে আমাদের খুঁজে পাবে।
শুনলাম ছোট চাচা আবার বিড়বিড় করে শোষণহীন শাসন ব্যবস্থা আর গণতন্ত্র নিয়ে কি একটা কথা বলে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেলেন। আমরা তাকে আর ঘাটালাম না। মুসলিম ভাই প্রায় নিঃশব্দে নোকাটাকে নিয়ে গাছপালা ঢাকা একটা জায়গায় হাজির হল। সেখানে সাবধানে নৌকাটাকে লুকিয়ে ফেলে বলল, আর কোন ভয় নাই।
সত্যি?
হ্যাঁ, কারো বাবার সাধ্যি নাই আমাদের খুঁজে বের করে। আর আমি তো আছি। কাচু মিয়া যদি আসে, এই বর্শা দিয়ে তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেব। ইবলিশের বাচ্চা।
কাচু মিয়া গামছা দিয়ে তার ভেজা শরীর মুছে নিচ্ছিল। আমি বললাম, তোমার ভেজা কাপড় বদলাবে না?
মুসলিম ভাই হেসে বলল, এই তো, দেখতে দেখতে শুকিয়ে যাবে।
আমি বুঝতে পারলাম তার আর কোন কাপড় নেই।
আমি, খালেদ আর রাজু অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রাতজাগ নানারকম পাখি আর জন্তুর ডাক শুনতে শুনতে এক সময় সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গেলাম।
.
৭. থোয়াংসা চাই
খুব ভোরে ছোট চাচা আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। তার চোখে মুখে আতঙ্ক, ফিসফিস করে কঁপা গলায় বললেন, তাড়াতাড়ি ওঠ সবাই। মহাবিপদ।
আমি লাফিয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
সর্বনাশ হয়েছে।
কি সর্বনাশ?
বাইরে তাকিয়ে দ্যাখ নেকি কোথায় এনে রেখেছে। একটা জঙ্গলের ভেতরে। এই মাঝি আসলে ডাকাত, নৌকেটি জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে তার দলের অন্য লোককে ডেকে আনতে গেছে। এখন আমাদের সবাইকে কেটে ভাসিয়ে দেবে।
আমি ছোট চাচাকে থামালাম, বললাম, ভয় পাবেন না ছোট চাচা। কেটে আমাদের ভাসাত না, ভাসাত আপনাকে। আর সেটা কে করত জানেন? মুসলিম ভাই না, আপনার প্রাণের বন্ধু ফ্রেডারিক সাহেবের ডান হাত কাচু মিয়া। মুসলিম ভাই না থাকলে কাল রাতে আমরা গিয়েছিলাম।
কেন? কি হয়েছে?
আমরা তখন ছোট চাচাকে গত রাতের পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। শুনে ছোট চাচা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। বেশ খানিকক্ষণ লাগল তার শান্ত হতে। তখন তিনি তার ভয়টা ঢেকে ফেলার জন্যে খুব রেগে যাবার ভান করলেন। চোখ লাল করে বললেন, আমাকে ডাকলি না কেন?
ডেকেছি ছোট চাচা। অনেক ডেকেছি। আপনি উঠেন নাই।
খালেদ বলল, পলিটিক্স নিয়ে একটা লেকচার দিলে।
ছোট চাচা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোদের কথা শুনে এখানে আসাই ভুল হয়েছে। আরেকটু হলে জানটা যেত। এখুনি ফিরে যাব।
খালেদ বলল, এই বদমাইস সাহেব এসেছে ফসিলের খোঁজে। সব ভেঙে নিয়ে যাবে।
যাক। ব্যাটার কাছে কত রকম বন্দুক আছে, গুলি করে শেষ করে দেবে। এখনো সময় আছে, তাড়াতাড়ি ফিরে যাই।
আমরা কেউ কোন কথা বললাম না।
কোথায় মাঝি? ডেকে আন।
খালেদ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, কাচু মিয়া বলেছে তোমাকে কেটে ফেলবে। আমাদের কিছু করবে না।
তার মানে?
তোমার যদি ভয় করে তুমি চলে যাও। আমরা তিনজন জায়গাটা দেখে আসি।
ছোট চাচা চোখ পাকিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন, রাগে অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলেন না। শেষে যখন কিছু একটা বলতে গেলেন, তখন দেখলাম মুসলিম। ভাই হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছে। আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কি খবর মুসলিম ভাই? কোথায় গিয়েছিলে?
একটু দেখে এলাম।
কি দেখে এলে?
কাচু মিয়াকে।
কি করে কাচু মিয়া?
নদীর ঘাটে বসেছিল তার সাগরেদকে নিয়ে। সবগুলি নৌকায় আপনাদের খুঁজছে।
ছোট চাচা চোখ বড় বড় করে বললেন, শুনলি? শুনলি? এখন যখন আমাদের দেখবে, কপ করে গলাটা কেটে ফেলে দেবে।
মুসলিম ভাই বলল, আমি একটা কাজ করেছি।
কি কাজ?
পরিচিত একজন মাঝিকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি যে, কাল রাতে আপনাদের একজনের খুব শরীর খারাপ হয়েছে, দাস্ত আর বমি! তাই আপনারা তাড়াতাড়ি ফিরে গেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, দেখলাম খবরটা কাচু মিয়ার কানে গেছে। তখন সে খুব খুশি হয়ে তার নৌকায় শুয়ে একটা ঘুম দিচ্ছে। আর সে আপনাদের খুঁজবে না।
খালেদ হাতে কিল দিয়ে বলল, ভেরি গুড।
মুসলিম ভাই বলল, সাহেব তার অন্য লোকজন নিয়ে সকালে রওনা দেবে। যাবার সময় এখান থেকে কাচু মিয়াকে তুলে নেবে।
আমি বললাম, সাহেব পৌঁছানোর আগে আমাদের পৌঁছাতে হবে।
মুসলিম ভাই মাথা নাড়ল, বলল, এখন আমরা লুকিয়ে চলে যেতে পারি কিন্তু যদি কাচু মিয়া দেখে ফেলে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে।
আমি বললাম, আমরা নৌকার একেবারে ভেতরে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকব।
মুসলিম ভাই বলল, আপনারা আরেকটা কাজ করে
কি কাজ?
নদীটা এই পাহাড়কে ঘুরে গেছে। আপনারা এই পাহাড়টা হেঁটে হেঁটে পার হয়ে আসেন। আমি অন্য পাশে নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করব। আমি একা খালি নৌকা চালিয়ে যাব, কাচু মিয়া যদি দেখেও ফেলে কোন সন্দেহ করবে না।
ছোট চাচা খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না, না, না, সেটা কেমন করে হয়? মাথা খারাপ নাকি? এত বড় ঝুঁকি নেয়া ঠিক না
মুসলিম ভাই মাথা নেড়ে বলল, আপনি ভয় পাবেন না সাহেব। আমি আছি। এই খোদার নামে কীরা কেটে বলছি, আমি বেঁচে থাকতে কেউ আপনাদের কিছু করতে পারবে না। আল্লাহর কসম।
ছোট চাচা আপত্তি তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে আমরা এক লাফে নৌকা থেকে নেমে গেছি।
মুসলিম ভাই বলল, নৌকো থামিয়ে আমি রান্না শুরু করে দেব। কালকে শুধু ডাল দিয়ে খেতে আপনাদের খুব কষ্ট হয়েছে। আজকে মাছের ব্যবস্থা করব।
ছোট চাচা গম্ভীর মুখে বললেন, মাঝি, তুমি এখনো খাবার কথা ভাবছ?
মুসলিম ভাই হেসে বলল, সাহেব, বিপদ আপদ যতই আসুক খেতে তো হয়। সকালে নাশতার ব্যবস্থা করতে পারি নাই, এই যে নেন মুড়ি আর গুড়।
মুসলিম ভাই একটা ঠোঙা ধরিয়ে দিল।
আমি মুড়ির ঠোঙাটা নিয়ে জঙ্গল ভেঙে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছি। আমার পেছনে খালেদ আর রাজু। বার পেছনে ছোট চাচা। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি তাকে জোর করে খানিকটা আলকাতরা খাইয়ে দিয়েছে। তার মুখ খুব বিমর্ষ। চোখের কোণে কালি। শেভ করেননি বলে গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
মুড়ি খেতে খেতে আমরা হাঁটছি। জঙ্গলের মাঝে দিয়ে আমরা আগে কখনো হাঁটিনি। ব্যাপারটা এত সোজা না। তাছাড়া পাহাড়টা ওপরে উঠে গেছে। সমান জায়গায় খুব সহজে হাঁটা যায়, কিন্তু ওপরে উঠতে হলে খুব সহজেই দম ফুরিয়ে যায়। আমাদের একটু পরে পরেই থেমে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল। হাঁটার কোন পথ নেই, পা ফেলার কোন জায়গা নেই। ঘন জঙ্গল গাছ আর লতাপাতায় ঢাকা, সেই সব গাছের ডালপালা চোখে মুখে লেগে যায়। কে জানে সাপ খোপ আছে নাকি। বিছুটি গাছ যদি থাকে তাহলে কি হবে? কষ্ট হচ্ছিল খুব কিন্তু আবার কেমন জানি মজাও লাগছিল আমাদের। মনে হচ্ছিল, আমরা বুঝি যাচ্ছি সত্যিকার অ্যাডভেঞ্চারে। মনে হচ্ছিল, আমরা বুঝি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের মত, যাচ্ছি সত্যিকারের কোন অভিযানে।
একটু পর আমরা মোটামুটি সমতল জায়গায় এসে পৌঁছুলাম। ছোট চাচা পেছন থেকে বললেন, দেখি আমি সামনে দিয়ে যাই। তোরা শুধু শুধু দেরি করছিস।
আমরা তাকে সামনে যেতে দিলাম। ছোট চাচা একটা শুকনো ডাল হাতে তুলে নিয়ে সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেতে লাগলেন। এভাবে মিনিট দশেক গিয়েছি, ঠিক তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বিচিত্র জিনিসটি ঘটল, দেখলাম, হঠাৎ করে ছোট চাচা আঁ আঁ-আঁ শব্দ করে ভয়ঙ্কর চিৎকার করতে করতে দুই পা ওপরে তুলে শূন্যে উঠে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, তিনি উল্টো হয়ে একটা গাছ থেকে ঝুলছেন। ব্যাপারটি এত বিচিত্র, আমাদের বেশ খানিকক্ষণ লাগল ব্যাপারটি বুঝতে। আমরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। বোঝার চেষ্টা করছি কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে। হঠাৎ করে শুনলাম কে যেন হি হি করে হেসে উঠল। সে হাসি কিছুতেই থামে না। একেবারে বাচ্চার গলার হাসি, প্রায় মেয়েদের হাসির মত। আমরা ঘুরে ফিরে তাকালাম, হঠাৎ দেখি একটা গাছের আড়াল থেকে বারো তেরো বছরের একটা ছেলে বের হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে হাসতে হাসতে তার পেট ফেটে যাবে। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে সে একবার ছোট চাচাকে দেখায়, তারপর আবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। হাসি জিনিসটা সংক্রামক, ছেলেটাকে এভাবে হাসতে দেখে আমরা হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটার হাস্যকর দিকটা দেখতে পারলাম। একজন বয়স্ক মানুষ দুই পা ওপরে দিয়ে একটা গাছ থেকে ঝুলছে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে হাস্যকর। আমরাও হাসতে শুরু করেছি তখন ছোট চাচা বাঘের মত একটা গর্জন করলেন, জানে মেরে ফেলব সব কয়টাকে।
বাচ্চা ছেলেটা, যার খালি গা, খালি পা, পরনে ছোট একটা কাপড় এবং কোমর থেকে তার সমান একটা ধারালো রাম দা ঝুলছে! এবারে হাসি থামিয়ে তার সেই ভয়ংকর রাম দা বের করে কোথায় একটা কোপ দিল, সাথে সাথে একটা দড়ি ছিঁড়ে ছোট চাচা হুড়মুড় করে নিচে একটা ঝোঁপের মাঝে এসে পড়লেন। আমরা দেখলাম, তাঁর পুরো শরীর ঝোঁপের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেছে, শুধু তার পা দুটি দেখা যাচ্ছে।
ছেলেটা সেটা দেখে আবার হি হি করে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
আমাদেরও সাংঘাতিক হাসি পাচ্ছিল কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, এখন হয়তো হাসা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমরা ঝোঁপের কাছে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম, ছোট চাচা এর মাঝে সামলে সুমলে বের হয়ে এসেছেন। কপালের খানিকটা ছাল ওঠে গেছে, শার্টের পকেটটা ছিঁড়ে ঝুলছে, গা হাত পায়ে ইতস্তত কাটাকুটি। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ছোট চাচা, ব্যথা পেয়েছ নাকি?
না। ছোট চাচা মুখ খিঁচিয়ে বললেন, খুব আরাম লেগেছে, অসম্ভব আরাম লেগেছে। এখনও আরাম লাগছে!
এবারে তিনি খালি গায়ের ছেলেটার দিকে তাকালেন। তার হাতে যদি এত বড় রাম দাটা না থাকত, আমি নিঃসন্দেহ যে তিনি ছেলেটার কান মুচড়ে একটা ডাবল সাইজ চড় কসতেন।
খালেদ ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কি? কেমন করে হল এটা?
প্রথমে বাংলায়, ছেলেটা কিছু বুঝল না, তখন ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, তাতেও লাভ হল না। তারপর পৃথিবীর আদি ভাষায়, আকার ইঙ্গিত এবং চোখের দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটা এবারে চট করে প্রশ্নটা বুঝে যায়।
সে আমাদের একটা ঝোঁপের কাছে নিয়ে দেখাল, পুরো জিনিসটা শেয়াল, হরিণ বা বুনো শূকর ধরার একটা ফাঁদ। গাছের একটা ডাল নুইয়ে সেখানে দড়ি বেঁধে একটা ফাঁস তৈরি করা হয়, গাছের ছোট একটা ডাল দিয়ে সেটা আটকে রাখা হয়। দড়ির ফাঁসে পা দিতেই ছোট ডালটা সরে গিয়ে ফাসটা পায়ে আটকে যায়, নুয়ে থাকা গাছটি ছিঁটকে ওপরে উঠে যায় আর সাথে সাথে প্রাণিটি শূন্য থেকে ঝুলতে থাকে। এটা জন্তু জানোয়ার ধরার ফাঁদ। ছোট চাচা তার এই ফাঁদে পা দেবেন সেটা সে কখনো সন্দেহ করেনি।
ছেলেটা বাংলা বোঝে না জানার পর ছোট চাচা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, জংলী ভূত। বেয়াদব। এক চড় মেরে সবগুলি দাঁত ফেলে দেওয়া দরকার। শিক্ষা দীক্ষা নেই, মানসম্মান জ্ঞান নেই–
আমি বললাম, কেন, রাগ করছেন ছোট চাচা? সে কি আর আপনার জন্যে এটা পেতে রেখেছিল? আপনি ভুল করে পা দিয়েছিলেন বলেই তো–
তাই বলে এভাবে হাসবে? এটা হাসি তামাশার জিনিস হল?
ছোট চাচা, আপনি যদি দেখতেন, তাহলে আপনিও হাসতেন! একজন বয়স্ক মানুষ উল্টো হয়ে ঝুলছে–
আমি হাসি শুরু করে দিচ্ছিলাম, কিন্তু ছোট চাচার মুখ দেখে আর সাহস হল না। তিনি ঘাড়টা বাঁকা করে এক জায়গায় বেশ জোরে জোরে মালিশ করে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই খুব ব্যথা লেগেছে। কারো ব্যথা লাগলে সেটা নিয়ে তো আর হাসা যায় না!
এদিকে মনে হচ্ছে খালেদ আর রাজুর সাথে ছেলেটার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। হাত নেড়ে, চোখ বড় করে, শরীর ঝাঁকিয়ে অনেক রকম ভাবের আদান প্রদান হয়ে যাচ্ছে। আমিও গিয়ে যোগ দিলাম।
খালেদ হাত ঝাঁকিয়ে নিজেকে দেখিয়ে বলল, খালেদ।
ছেলেট, যার নাকটা একটু চাপা, ঘড়ি পর্যন্ত লম্বা চুল, একেবারে গোলাপী গায়ের রঙ এবং গ্রীক দেবতাদের মত সুঠাম শরীর, নিজেকে দেখিয়ে বলল, থোয়াংসা চাই।
থোয়াংসা চাই? তোমার নাম?
ছেলেটা মাথা নাড়ল। রাজুর দিকে আঙুল দেখিয়ে তার নাম জানতে চাইল। রাজু বলল, রাজু।
আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, আমি বললাম টোপন।
টোপন? ছেলেটা আবার পেটে হাত দিয়ে হি হি করে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে শুরু করে। টোপন নামটাতে এত হাসির কি থাকতে পারে, আমরা বুঝতে পারলাম না।
থোয়াংসা চাইয়ের সাথে আমাদের যত সহজে ভাব হল, আমার মনে হয়, এত তাড়াতাড়ি আমাদের এর আগে কারো সাথে বন্ধুত্ব হয়নি। একজন আরেকজনের কথা বুঝি না, কিন্তু তবুও আকারে ইঙ্গিতে চোখের ভাষায় তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম। আমরা যাচ্ছি একটা অ্যাডভেঞ্চারে, দূর পাহাড়ে টি-রেক্সের সন্ধানে। আমাদের পেছনে লেগেছে এক ভয়ঙ্কর বদমাশ সাহেব। তার সাথে যোগ দিয়েছে কাচু মিয়া নামের একজন খুনী। আমাদের নৌকা আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল। আমরা কোনমতে পালিয়ে এসেছি। তাই আমরা এখন পাহাড়ের মাঝে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। পাহাড়টা পার হয়ে অন্য পাশে গিয়ে নৌকা ধরব। সেখানে মুসলিম ভাই আমাদের জন্যে নৌকায় অপেক্ষা করছেন।
থোয়াংসা চাই কতটুকু বুঝল, কে জানে, কিন্তু দেখলাম সে খুব গম্ভীর হয়ে তার জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করল। দড়ির ফাঁসটা পেঁচিয়ে গলায় ঝুলিয়ে নিল, ঝোঁপের ভেতর থেকে বের করে আনল তীর ধনুক, বাঁশের তৈরি তামাক খাওয়ার একটা পাইপ, তারপর রাম দাটা হাতে নিয়ে সে বুঝিয়ে দিল সে প্রস্তুত।
আমরা কিসের জন্যে প্রস্তুত জানতে চাইলাম, সে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে, সে আমাদের সাথে যাবে। যদি সেই সাহেব বা কাচু মিয়া এসে হাজির হয়, সে এক কোপে তাদের মাথাটা নামিয়ে দেবে। শুনে আমাদের আনন্দ দেখে কে! বাচ্চা একটা ছেলে, বয়স নিশ্চয়ই আমাদের থেকে একদিনও বেশি হবে না, কিন্তু কী আশ্চর্য তার আত্মবিশ্বাস! কী তার সাহস। যদি সে আমাদের সাথে থাকে, তাহলে আমাদের ভয় কি?
রওনা দেয়ার আগে থোয়াংসা চাই খুব যত্ন করে তার বাঁশের পাইপে তামাক ভরে ফস করে ম্যাচ দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে নিল তারপর খুব শখ করে সেটা টানতে থাকে। এত ছোট ছেলেকে আমরা এর আগে এত শখ করে তামাক খেতে দেখিনি।
তামাকটা খুব ভাল করে জ্বলে ওঠার পর সে পাইপটা আমাদের দিকে এগিয়ে দেয়, আমি সভয়ে মাথা নাড়লাম। রাজু চোখ কপালে তুলল, কিন্তু খালেদ, যে মনে করে সিগারেট খাওয়া আর মাথায় গুলি করার মাঝে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই, থোয়াংসা চাইয়ের চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করে বাঁশের পাইপটা মুখে নিয়ে একটা টান দিয়ে বসল।
তারপর খালেদের যা একটা অবস্থা হল, সেটা সত্যি বলার মত না। লাফিয়ে কুদিয়ে কাশতে কাশতে একটা বিতিকিচ্ছি অবস্থা। খালেদের চোখে পানি এসে গেল, থোয়াংসা চাই সেটা দেখে খুব হতাশ ভঙ্গিতে খালেদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে থাকে। কে দেখে বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না যে আমাদের দেখে তার খুব আশা ভঙ্গ হয়েছে।
খালেদ একটু সামলে নেবার পর আমরা রওনা দিলাম। সবার সামনে থোয়াংসা চাই, তার হাতে বিশাল রামদা, সামনে কোন গাছপালা, লতাপাতা আসতেই সে তার রামদা ঘুরিয়ে সেটা কেটে ফেলতে ফেলতে যাচ্ছে। প্রথমে মনে হল, সে বুঝি একটু উল্টোপথে যাচ্ছে। একটু পরেই সে একটা হাঁটাপথে তুলে দিল। তখন হাঁটা আমাদের জন্যে খুব সহজ হয়ে গেছে।
ছোট চাচা গজগজ করতে করতে বললেন, এই জংলী কী এখন আমাদের সাথে যাবে নাকি?
হ্যাঁ ছোট চাচা, আমি বললাম, আর কোন ভয় নেই। আপনার কাচু মিয়া থোয়াংসা চাইকে দেখলে কাপড়ে পেশাব করে দেবে।
ছোট চাচাকে সেটা নিয়ে খুব আহ্লাদিত হতে দেখা গেল না।
.
থোয়াংসা চাই খুব তাড়াতাড়ি আমাদের নিয়ে কিভাবে কিভাবে জানি পাহাড়ের পাশে ছোট খালটার কাছে নিয়ে এল। সেখানে সত্যি সত্যি মুসলিম ভাই নৌকা নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মনে হয় রান্না হয়ে গেছে। কারণ কাছে আসতেই খাবারের ঘ্রাণে আমাদের জিবে পানি এসে গেল।
মুসলিম ভাই আমাদের দেখে অবাক হয়ে বলল, অনেক তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন দেখি!
রাজু বলল, হ্যাঁ। এই যে থোয়াংসা চাই। আমাদের নিয়ে শর্ট কাট মেরে চলে এসেছে।
ভালই হল। আপনাদের এরকম জায়গায় ঘুরে ফিরে অভ্যাস নেই, তাই একটু চিন্তায় ছিলাম।
ছোট চাচা শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কাচু মিয়ার কি খবর?
মুসলিম ভাই বলল, একটু আগে নৌকা করে গেল। সাথে সেই সাহেব। সব মিলিয়ে মোট চারটা নৌকা। নৌকোর মাঝে মালপত্র আর লোকজন দেখে মনে হয় যুদ্ধ করতে যাচ্ছে।
ছোট চাচা চিন্তিত মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ, অ্যাডভেঞ্চার অনেক হয়েছে। জীবনে মনে হয় এত অ্যাডভেঞ্চার হয়নি। লিখলে বই হয়ে যাবে। চল এখন ফিরে যাই।
খালেদের সাথে থেকে থেকে আস্তে আস্তে আমাদের সাহস বেড়ে গেছে। আমি বললাম, ছোট চাচা, তুমি ফিরে যাও। আমরা জায়গাটা গিয়ে দেখে আসি।
রাজু মনে হল আরো এক ডিগ্রি ওপরে। গম্ভীর গলায় বলল, শুধু জায়গাটা দেখে আসব না, সাহেবের বারটা বাজিয়ে দেব।
ছোট চাচা রাগ চেপে রেখে বললেন, সেটা কেমন করে হবে শুনি?
খালেদ বলল, প্ল্যান করছি। তুমি শুধু দেখ।
ঠিক কি নিয়ে কথা হচ্ছে থোয়াংসা চাইয়ের বোঝার কোন উপায় নেই কিন্তু দেখলাম সে গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে রামদাটা মাথার ওপরে তুলে একটা হুঙ্কার দিল।
ছোট চাচা তখন হাল ছেড়ে দিলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, কাগজ আছে কারো কাছে।
আছে, কেন?
একটা চিঠি লিখি।
কাকে?
বান্দরবন থানার ওসি কে। জানিয়ে রাখি ব্যাপারটা। মাঝি, চিঠিটা পৌঁছানো যাবে না?
কোন অসুবিধা নেই। ফিরে যাচ্ছে সে রকম কোন মাঝিকে দিয়ে দেব। পৌঁছে দেবে।
ছোট চাচা সময় নিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। ছোট চাচা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়েন কিন্তু লেখার হাত খুব ভাল। এমন একটা চিঠি লিখলেন যে, সে চিঠি পড়ে বান্দরবন থানার ও.সি. যদি সাথে সাথে শখানেক পুলিশ নিয়ে ছুটে না আসে, আমি কান কেটে ফেলব।
.
৮. আক্রমণ
আমাদের নৌকা আবার চলছে। সাহেব আর কাচু মিয়া তাদের নৌকা নিয়ে ঘণ্টা চারেক আগে গিয়েছে, আমরা তাদের পেছনে। ব্যাপারটা একদিক দিয়ে বেশ নিরাপদ। আমরা নদীতীরের লোকজন, উল্টোদিক থেকে আসা মাঝিদের জিজ্ঞেস করে তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারি, কিন্তু তারা কখনোই আমাদের খোঁজ নিতে পারবে না। ছোট চাচা ভেতরে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। আমরা চারজন বাইরে। থোয়াংসা চাইয়ের দেখাদেখি আমাদেরও এখন খালি গা, তবে আমাদের শরীর হাড় জিরজিরে, মোটেও তার মত এত সুন্দর নয়। কিন্তু পাহাড়ের মাঝে এই নির্জন নদীতে সেটা নিয়ে আমাদের তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই।
থোয়াংসা চাইয়ের সাথে কথা বলার জন্যে একটি দুটি আঞ্চলিক শব্দ শিখে নিয়েছি। মুসলিম ভাইও বেশ কিছু শব্দ জানে। সেগুলো ব্যবহার করে অনেক রকম কথা বলা হয়ে গেছে। থোয়াংসা চাইয়েরা ছ’ ভাইবোন। সে সবচেয়ে ছোট। এক দুইদিন বাসায় না গেলে তার বাবা মা কখনো চিন্তা করে না। তার স্কুলে যাবার কোন ইচ্ছে নেই। টেলিভিশন কি সে জানে না। গাড়ি বলে একটা জিনিসের কথা সে শুনেছে, তবে কখনো দেখেনি। মাঝে মাঝে আকাশে প্লেন উড়তে দেখেছে, তার ধারণা, ব্যাপারটায় কোন ধরনের যাদু আছে। তার কী ধর্ম সে জানে না। বড় হয়ে তার ঘর সংসার করার ইচ্ছে। অনেকগুলো ছেলেমেয়ে হবে। তাদের নিয়ে সন্ধ্যাবেলা ঘরের দাওয়ায় বসে গান গাইবে।
জীবনকে নিয়ে কি করবে, সেটা এত নিখুঁতভাবে ঠিক করে রাখতে আমি আগে কাউকে দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কি, শুনে আমাদের কেমন জানি একটু হিংসে হতে লাগল!
সারাদিন ধরে নৌকা চলল। আস্তে আস্তে জংগল আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে, আরো জনমানবহীন হয়ে উঠেছে। দুপাশে খাড়া পাহাড়, নদীর পানি কোথাও কোথাও গভীর, কালো পানি সেখানে ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে ঘুরছে। পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে বুনো পশুর ডাক শুনতে পাই, থোয়াংসা চাই সে ডাক শুনে আপন মনে মাথা নাড়ে। আমরা বসে বসে একটা পরিকল্পনা করার চেষ্টা করি, কিন্তু চারজন ছোট ছেলে তার মাঝে একজন আমাদের কথা বুঝে না, আর একজন ভীরু বড় মানুষ নিয়ে একটা বিদেশী সাহেব, কাচু মিয়ার মত খুনে আর চার নৌকা বোঝাই মানুষের সাথে কেমন করে লড়া যায়, চিন্তা করে পেলাম না। আমরা বসে বসে অনেক চিন্তা করে দুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম। সেগুলো হচ্ছে।
(এক) ফ্রেডারিক সাহেবের কাছে নানা রকম বাক্স প্যাটারা আছে, তার মাঝে নিশ্চয়ই নানারকম যন্ত্রপাতি, সেগুলি ব্যবহার করে সে নিশ্চয় ফসিলগুলি তোলার চেষ্টা করবে। যেভাবেই হোক তার বাক্স প্যাটরাগুলি আটকাতে হবে। চেষ্টা করতে হবে নদীতে নৌকাগুলি ডুবিয়ে দিতে, রাত্রে যখন বিশ্রাম নেবে তখন চুপিচুপি গিয়ে নৌকার তলায় ফুটো করে দিতে পারলে হয়। সেটা অবশ্য কেমন করে করা হবে, আমাদের জানা নেই।
(দুই) ফ্রেডারিক সাহেবর সাথে মানুষ অনেক বেশি কাজেই কোন রকম বুদ্ধি খাঁটিয়ে তাদের ভাগিয়ে দিতে হবে। সাহেব এবং কাচু মিয়া জানে না যে আমরা তাদের পিছু পিছু এসেছি, আমরা তাদের কোন রকম ভয় দেখাতে পারি। জায়গাটাতে পাহাড়ি দানো থাকে বলে একটা কথা প্রচলিত আছে, মনে হয় সেটা ব্যবহার করা যাবে। কেমন করে ভয় দেখানো হবে, সেটা এখনো আমাদের জানা নেই।
আমরা সারা দিন বসে বসে চিন্তা ভাবনা করলাম, খুব একটা লাভ হল না। ছোট চাচাকেও আমাদের আলাপ আলোচনায় টেনে আনতে চাইছিলাম কিন্তু আনা গেল না, নৌকার মাঝে গোমড়া মুখে শুইয়ে রইলেন।
.
আমরা ঝুমিয়া পৌঁছালাম সন্ধ্যেবেলা সূর্য ডুবে যাবার পর। ফ্রেডারিক সাহেবের দলবল তাদের নৌকা থামিয়েছে ঠিক ঝরনার মুখে। আমরা আমাদের নৌকা মালাম তার বেশ আগে, একটা ঝাঁপড়া গাছের আড়ালে। মুসলিম ভাই নৌকা থামিয়ে চুপিচুপি দেখে এসে খবর দিল, সাহেব আর তার লোকজন নৌকা থেকে সব জিনিসপত্র নামিয়ে রাখছে। রান্নার আয়োজন করছে, সাহেব একটা গাছের গোড়ায় বসে পেট মোটা একটা বোতল থেকে মদ খাচ্ছে। কাচু মিয়া সাহেবের আশ পাশে ঘোরাঘুরি করছে মদের ভাগ পাবার আশায় কিন্তু সাহেব তাকে কিছু দিচ্ছে না। ভাব দেখে মনে হয়, তারা রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল ভোরে রওনা দেবে।
মুসলিম ভাই যখন আমাদের জন্যে রান্না চাপাল তখন ছোট চাচা আমাদের আক্রমণের প্রথম পরিকল্পনাটা বললেন। আমরা ভেবেছিলাম, ছোট চাচা গোমড়া মুখে বসেছিলেন কিন্তু আসলে সারাক্ষণ চিন্তা করছিলেন কি করা যায়। ছোট চাচা যখন খুব গভীরভাবে চিন্তা করেন তখন তাকে কেমন জানি গোমড়ামুখী দেখায়! ছোট চাচার পরিকল্পনাটা খুব ভাল, শুনে আমরা আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম! শুধু যে পরিকল্পনাটা ভাল তাই নয় তার পরিকল্পনাটা শুনে আমরা জানতে পারলাম, ছোট চাচা শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন, আমাদের মনের জোর তখন বেড়ে গেল একশ গুণ।
ভাল পরিকল্পনা সহজ হতে হয়। ছোট চাচার পরিকল্পনাটা ভাল কারণ সেটা খুবই সহজ! ফ্রেডারিক সাহেবকে থামিয়ে দেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে তার জিনিসপত্র নষ্ট করে দেয়া। সেটা আগুন ধরিয়ে নষ্ট করে দেয়া হবে। আগুন ধরানো হবে খেয়াংসা চাইয়ের তীর ধনুক দিয়ে। তীরের মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে কেরোসিন তেলে ভিজিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে তারপর সেই জ্বলন্ত তীর ছুঁড়বে থোয়াংসা চাই। সেই তীর পড়বে সাহেবের জিনিসপত্রে। দাউ দাউ করে সবকিছু জ্বলে উঠবে! পুরো ব্যাপারটা করা হবে জঙ্গলে লুকিয়ে, কেউ জানতেও পারবে না কেমন করে হল।
উত্তেজনায় আমাদের তখন খিদে তৃষ্ণা চলে গেছে। মুসলিম ভাই খুব মজার খিচুড়ি রান্না করেছেন, সাথে ডিম ভাজা, তাড়াতাড়ি করে আমরা সেটা খেয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি রাত আরেকটু গভীর হওয়ার জন্যে। ছোট চাচা তার গেঞ্জি ছিঁড়ে তীরের মাথায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেশ কয়েকটা আগুন জ্বালানোর তীর তৈরি করলেন। থোয়াংসা চাই সেগুলি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেখল, গম্ভীর হয়ে পিছনে আরো কিছু পালক বেঁধে নিল। তাকে বোঝানো হয়েছে কি করতে হবে, শুনে তার মুখে এগাল ওগাল জোড়া হাসি।
রাত গম্ভীর হবার পর আমরা মুসলিম ভাইয়ের হ্যারিকেনটা নিয়ে রওনা দিলাম। হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দেয়া হয়েছে, নেয়া হয়েছে কেরোসিনের জন্যে। আমাদের কাছে টর্চলাইট আছে কিন্তু সেটা জ্বালানো হচ্ছে না, ফ্রেডরিক সাহেবের লোকজন দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, আমরা বলতে গেলে কিছুই দেখতে পাই না। কিন্তু থোয়াংসা চাইয়ের একেবারে বিড়ালের মত চোখ, এই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পায়। তার পিছু পিছু আমরা সাহেবের আস্তানার কাছাকাছি এলাম। একপাশে একটা তাঁবু, ভিতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে, সেই আলোতে তাঁবুটাকে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে, বলার মত নয়! এটা নিশ্চয়ই ফ্রেডারিক সাহেবের তাঁবু, এখনও নিশ্চয় ঘুমায় নি, তাহলে হয়ত আলো নিভিয়ে দিত। তাঁবুর সামনে বেশ খানিকটা দূরে একটা আগুন জ্বলছে, সেই আগুনের সামনে একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে একজন মানুষ। আমরা আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম, মানুষটার হাতে একটা বন্দুক।
তাঁবুর পাশে নানা রকম বাক্স, সেগুলির মাঝে নিশ্চয় রয়েছে নানারকম যন্ত্রপাতি। আমাদের সেগুলি আগুন ধরিয়ে নষ্ট করতে হবে।
ছোট চাচা বন্দুক হাতে মানুষটাকে দেখে খুব ঘাবড়ে গেলেন। আমাদের কাঁধ খামচে ধরে ফিসফিস করে বললেন, ভেবে দ্যাখ সত্যিই চেষ্টা করবি কি না। গুলি করে মেরে টেরে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এতদূর এসে আমরা তো পিছিয়ে যেতে পারি না। আমরা মাথা নেড়ে বললাম, ভয় পাবেন না ছোট চাচা, ঠিক জ্বালিয়ে দেব সবকিছু।
বন্দুক হাতে মানুষটাকে দেখে পরিকল্পনা একটু রদবদল করা হল। ঠিক করা হল, থোয়াংসা চাই তার আগুনের তীর ছুঁড়বে মানুষটার পেছন থেকে যেন সে দেখতে না পায়। থোয়াংসা চাইয়ের সাথে থাকবে শুধু একজন, অন্যেরা আগেই সরে যাবে। পালিয়ে যাবার রাস্তায় টর্চ লাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে দেখানোর জন্যে। সবাই থোয়াংসা চাইয়ের সাথে থাকতে চায়। গলা নামিয়ে খানিকক্ষণ তর্কাতর্কি করে শেষ পর্যন্ত আমাকে যেতে দেয়া হল।
আমি আর থোয়াংসা চাই দাঁড়িয়ে রইলাম তখন অন্যের ধীরে ধীরে সরে গেল। আমরা তখন আরেকটু এগিয়ে গেলাম। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি থোয়াংসা চাইয়ের একটা তীর নিয়ে কেরোসিন তেলে ভাল করে ভিজিয়ে নিয়ে ফস করে দেয়াশলাইটা দিয়ে জ্বালিয়ে দিলাম। সাথে সাথে তীরটা মশালের যত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
আমরা বন্দুক হাতে মানুষটার পেছন দিকে ছিলাম, কিন্তু আগুনের শিখায় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠতেই লোকটা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আমি সাথে সাথে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম।
থোয়াংসা চাই তীরটা ধনুকে লাগিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয়, সে বুঝি কি করবে ভুলে গেছে। কিন্তু আমি জানি, সে অপেক্ষা করছে আগুনটা ভাল করে ধরার জন্যে না হয় তীরটা ছুটে যাবার সময় নিভে যাবে। বন্দুক হাতে মানুষটা অবাক হয়ে থোয়াংসা চাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। ঘন অরণ্যে নিশি রাতে একটা পাহাড়ি ছেলে হাতে তীর ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তীরের মাথায় দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন, দৃশ্যটা নিশ্চয়ই প্রায় অশরীরি! লোকটা বন্দুক হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে থোয়াংসা চাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি চাপা গলায় বললাম, মার থোয়াংসা চাই! মার।
থোয়াংসা চাই খুব ধীরে ধীরে ধনুকটা প্রায় আকাশের দিকে মুখ করে ধরে, খুব ধীরে ধীরে তীরটা টেনে আনে তারপর ছেড়ে দেয়। জ্বলন্ত আগুনের ফুলকির মত তীরটা ওপরে উঠে যায় তারপর নিচে নামতে থাকে, সাহেবের তাঁবুর ওপর দিয়ে গিয়ে একটু নিচে এসে পড়ে, ঠিক যেখানে বাক্সবোঝাই জিনিসগুলি রেখেছে সেখানে। তীরটা নিভে গেল না, বরং আগুনটা ছড়িয়ে পড়ল বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে।
বন্দুক হাতে লোকটার মনে হল কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে ব্যাপারটা কি হচ্ছে। যখন বুঝতে পারল, তখন বিকট চিৎকার করতে করতে আগুন নেভানোর জন্যে ছুটে যায়। তার চিৎকার শুনে সাহেব তার তাঁবু খুলে বের হল, ছোট একটা লাল জাঙিয়া ছাড়া পরনে আর কিছু নেই। আগুনটা দেখে সে হঠাৎ বিচিত্র একটা কাজ করল, সেটা নেভানোর কোন চেষ্টা না করে উল্টোদিকে ছুটতে ছুটতে গিয়ে নদীর মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমন কিছু বেশি আগুন নয়, একটু চেষ্টা করলেই নিভিয়ে ফেলতে পারত কিন্তু কেন সেটা নেভানোর চেষ্টা করল না বুঝতে পারলাম না। বন্দুক হাতে মানুষটা দুই এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর দেখলাম, সেও ছুটে গেল সাহেবের পেছনে পেছনে। আমি আর থোয়াংসা চাই দেখলাম, আশে পাশে কেউ নেই। আগুনটা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে, অন্য তীরগুলি ব্যবহার করার কোন দরকার নেই।
থোয়াংসা চাই তখন উঠে দাঁড়িয়ে একটু এগিয়ে গেল। আশে পাশে কাউকে না দেখে সে আরেকটু এগিয়ে গেল, তারপর আরেকটু আর হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম সাহেব কেন আগুনটা নেভানোর কোন চেষ্টা না করে পালিয়ে গেছে। ঐগুলি ডিনামাইটের বাক্স! আমরা ডিনামাইটের বাক্সে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি, এক্ষুণি নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ করে পুরোটা ফাটবে। সর্বনাশ! সর্বনাশ!!
আমি বিস্ফোরিত চোখে দেখলাম, থোয়াংসা চাই ওদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে! কি করছি বুঝতে না পেরেই আমি তার দিকে ছুটে গেলাম, তাকে জাপটে ধরে আমি টেনে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম, তার গায়ে মোষের মত জোর, এতটুকু সরাতে পারলাম না। আমি বেপরোয়ার মত আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে করতে কয়েক পা পিছিয়েছি ঠিক তক্ষুণি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মনে হল পুরো পৃথিবী দুলে উঠল।
আমরা নিশ্চয়ই ঠিক সেই সময় মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি কাবণ আগুনের একটা হলকা আমাদের ওপর দিয়ে ছুটে গেল। আমি আর থোয়াংসা চাই গুঁড়ি মেরে সরে যেতে থাকি, দাউদাউ করে চারদিকে আগুন জ্বলছে, আগুনের গরম হলকা লাগছে আমাদের চোখমুখে।
বিস্ফোরনটা ঘটে যাবার সাথে সাথে সাহেব আর লোকজন ছুটে আসতে থাকে, ঘটিবাটি যা আছে সেটাতে করে পানি আনতে থাকে আগুন নেভানোর জন্যে। কিন্তু তখন সেটা বিশাল এক আগুন, নেভানো খুব সহজ ব্যাপার নয়।
আমরা জঙ্গলে গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে দেখলাম সাহেব বন্দুক হাতের মানুষটার শার্টের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছে, কেমন করে হল? কেমন করে হল?
লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল স্থানীয় মানুষ। ট্রাইবাল পিপল। বাচ্চা ছেলে। বাচ্চা ছেলে।
সাহেব গর্জন করে জিজ্ঞেস করল, কয়জন ছিল?
একজন। জাস্ট ওয়ান।
কেন করল?
পাহাড়ি দানো। চায় না আমরা যাই। ভেরি ডেঞ্জারাস।
সাহেব ইংরেজিতে বলল, আমি পাহাড়ি দানের মুখে পেচ্ছাব করে দিই।
ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ছোট চাচা, খালেদ আর রাজু ভেবেছিল, আমি আর থোয়াংসা চাই বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গেছি। যখন দেখল আমরা ভালয় ভালয় ফিরে এসেছি, তাদের কী যে আনন্দ হল বলার মত নয়। ছোট চাচা এক হাতে আমাকে, আর এক হাতে থোয়াংসা চাইকে বুকের মাঝে চেপে ধরে অনেকক্ষণ একটা গাছের নিচে বসে রইলেন। আমি ছোট চাচাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ছোট চাচা, আমরা ভাল আছি, কিচ্ছু হয় নি। সত্যি কিচ্ছু হয় নি।
ছোট চাচা কিছু না বলে আরো জোরে আমাদের বুকে চেপে ধরে রাখলেন। টর্চলাইটটা জ্বালানো নিষেধ কিন্তু আমি লিখে দিতে পারি, যদি সেটা জ্বলাতাম তাহলে দেখতাম ছোট চাচার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ছোট চাচা অনেক রাগারাগি করেন, কিন্তু তার মনটা একেবারে বাচ্চাদের মত নরম।
.
৯. রাতের যাত্রী
নৌকায় ফিরে এসে আমরা সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। হঠাৎ করে আমরা টের পেতে শুরু করেছি ব্যাপারটা ছেলেমানুষি ব্যাপার নয়। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে এখন, আমাদের কেউ মারা যেতে পারে, খুন হয়ে যেতে পারে কেউ।
ছোট চাচা বললেন, খুব সাবধানে এগুতে হবে।
খালেদ বলল, যখন কোথাও ফসিল পাওয়া যায় খুব সাবধানে সেটা আস্তে আস্তে তুলতে হয়। আর এই ব্যাটা বদমাইস ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে উড়িয়ে ফসিল বের করতে এসেছে।
রাজু বলল, আমাদের দেশের একটা সম্পদ, তার জন্যে কোন মায়া দয়া নাই।
ছোট চাচা বললেন, আগুনে অনেক ক্ষতি হয়েছে ওদের কিন্তু আমার মনে হয় তবু ওরা চেষ্টা করবে।
আমরা মাথা নাড়লাম।
সাহেবের লোকজন এখনো জানে না আমাদের কথা, ভেবেছে থায়াংসা চাই একা নিজে নিজে করেছে। খুব ভাল হয়েছে এটা। আমরা লুকিয়ে আরো কিছু করতে পারব।
কি করবে?
ব্যাটা বদমাইসদের আটকে রাখতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পুলিশ আসছে।
কেমন করে আটকে রাখবেন?
ছোট চাচা মাথা চুলকালেন তারপর বললেন, কিছু একটা বুদ্ধি বের করতে হবে।
ভয় দেখালে কেমন হয়?
কেমন করে দেখাবি? একজন দুজন মানুষকে ভয় দেখানো যায়। এতজন মানুষ যদি একসাথে থাকে, হাতে বন্দুক, ভয় দেখাতে গিয়ে খুন হয়ে যাবি।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ছোট চাচা বললেন, ব্যাটা বদমাইসগুলি কাল ভোরের আগে রওনা দিতে পারবে না, আমাদের তার আগেই সেখানে পৌঁছাতে হবে।
খুব ভোরে উঠে রওনা দিয়ে দেব।
উঁহু, ছোট চাচা মাথা নাড়লেন। ভোরের জন্যে অপেক্ষা করা যাবে না। আমাদের এখুনি রওনা দিতে হবে।
এখুনি? আমরা প্রথমে ভাবলাম ছোট চাচা ঠাট্টা করছেন কিন্তু দেখলাম ঠাট্রা নয় সত্যি সত্যি এখুনি রওনা দিতে চান। আমি বললাম, এই মাঝ রাতে?
হ্যাঁ, ছোট চাচা মাথা নাড়লেন, অ্যাডভেঞ্চারে যখন যাবি, ঠিক করেই যাওয়া যাক। এই যুদ্ধে অরি এপার ওপার নেই। আজ রাতেই আমরা ফসিলের কাছে পৌঁছে যাব, কাল সারা দিন থাকবে কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্যে। তার মাঝে নিশ্চয়ই পুলিশ এসে যাবে।
.
আমাদের একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল কিন্তু এখুনি রওনা দেব শুনে ঘুম চটে গেল। সবাই নিজেদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। ভোরে খাবার জন্য মুসলিম ভাই বেশ কয়টা রুটি তৈরি করেছিলেন, সেগুলো নিয়ে নিলাম। এমনিতে খাওয়ার জন্যে চিড়া আর গুড়। চিড়ার ওপরে নাকি খাবার নেই, যতদিন খুশি রাখা যায়, যেভাবে খুশি খাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানী মিলিটারির হাত থেকে বাঁচার জন্যে মানুষের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা দীর্ঘ পথ পার হওয়ার সময় সাথে নিত চিড়া। আমাদের নিজেদের তখন হঠাৎ মুক্তিবাহিনী মুক্তিবাহিনী মনে হতে থাকে।
আমরা রওনা দেওয়ার সময় মুসলিম ভাই বলল, আমি এখানে পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করব। তারা যদি সময়মত না আসে তাহলে আরো কিছু মাঝি নিয়ে আমি যাব আপনাদের খোঁজে।
ছোট চাচা বললেন, ঠিক আছে।
আমরা গভীর রাতে অন্ধকার পথে মোটামুটিভাবে একটা অজানা গন্তব্য পথে রওনা দিলাম। কেউ বলে দেয় নি কিন্তু আমরা সবাই জানি সেখানে নিশ্চিতভাবে অপেক্ষা করছে বিচিত্র বিস্ময়।
বেশ খানিকটা ঘুরে সাহেবদের তাঁবু এবং লোকজনকে পাশ কাটিয়ে আমরা ছোট স্রোতধারার পাশে হাজির হলাম। এখন এটার তীর ধরে হেঁটে যেতে হবে দীর্ঘ পথ। আমরা টর্চ জ্বালিয়ে যাচ্ছিলাম, থোয়াংসা চাইয়ের সেটা খুব পছন্দ হল না। জংগল থেকে কিছু শুকনো ডাল এনে আগুন জ্বালিয়ে মশাল তৈরি করে নিল, মনে হয় বুনো পশু আগুন দেখলে ধারে কাছে আসবে না। খেয়াংসা চাইয়ের হাতে একটা মশাল, সে সবার আগে আগে যাচ্ছে, আমরা পেছনে পেছনে। গভীর রাত, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, কোথাও কোন জনমানব নেই। এভীর অরণ্যের মাঝে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমাদের বুকে কেমন জানি শিহরণ হতে থাকে।
রাজু নিচু গলায় বলে, ছোট চাচা।
কি হল।
একটা গল্প বলেন, শুনি।
গল্প?
হ্যাঁ।
কিসের গল্প?
আমি বললাম, ভূতের। ছোট চাচা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ভয় পাবি না তো?
না, পাব না।
শোন তাহলে, ছোট চাচা শুরু করলেন, আমার এক বন্ধু আছে, তার নাম শওকত। তাদের বাসা মুহম্মদপুরে। আমাদের সাথে পড়ে। সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার আগে আমাদের পড়ার খুব চাপ। একদিন তার বাসায় গেছি, অঙ্ক করতে করতে রাত হয়ে গেল। কঠিন সব অঙ্ক। একটা শেষ করতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। চার চারটা পারশিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন শেষ করে দেখি রাত বারটা বেজে গেছে।
শওকত বলল, এত রাত হয়েছে বাসায় যেয়ে কি করবি? থেকে যা এখানে।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
শওকত বলল, বাসায় চিন্তা করবে না তো?
আমি বললাম, আমার বাসার কারো আমার জন্য কোন মাথাব্যথা নেই। দু’তিন দিন না গেলেও কেউ খোঁজ করবে না।
আমি ছোট চাচার গল্পে বাধা দিয়ে বললাম, না ছোট চাচা, সেটা মোটেও ঠিক নয়। আমি প্রত্যেকদিন তোমার খোঁজ করি।
ছোট চাচা বললেন, তোরা হয়তো করিস কিন্তু আর কেউ করে না। যাই হোক, শওকত বলল, চল ঘুমুবি।
শওকতদের তিনতলা বাসা। ছাদে একটা ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে, সেখানে শওকত থাকে। তার ঘরটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে সে নিচে চলে গেল।
আমার ঘুম খুব বেশি। যে কোন জায়গায় আমি যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু কেন জানি শওকতের ঘরে শুয়ে আমার ঘুম আসতে চাইল না। আমি শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম আর কেমন জানি আমার এক ধরনের অস্বস্তি হতে লাগল। অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে যখন এপাশ ওপাশ করছি তখন হঠাৎ শুনি ছাদে কে যেন হাঁটছে। অনেক রাত হয়েছে, এত রাতে কারো ছাদে হাঁটাহাটি করার কথা না, আমি বেশ অবাক হলাম। যাই হোক, ব্যাপারটাতে গুরুত্ব না দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি তখন মনে হল একজন নয়, বেশ কয়েকজন হাঁটছে। এত রাতে শওকতদের বাসার সবাই ছাদে চলে এসেছে? আমি বেশ অবাক হলাম।
বেশ খানিকক্ষণ হয়ে গেছে, তখন শুনলাম ছাদে লোকজন শুধু হাঁটছে না, নিচু গলায় কথা বলছে। বেশির ভাগ মনে হল মেয়েদের গলা, আর কথাগুলিও যেন কেমন, মনে হয় দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, মনে হল যেন একটু একটু কাঁদছে।
আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। বিছানা থেকে উঠে আমি দরজা খুললাম, আর—
ছোট চাচা থেমে গেলেন আর আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, আর?
ছোট চাচা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, দেখলাম আমার ঘরের সামনে অনেক মানুষ ছায়ার মত দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাল করে দেখার চেষ্টা করলাম, দেখি কিছু পুরুষ, কিছু মহিলা, তাদের শরীরে রক্ত, মুখে রক্ত, হাত পা ছিন্ন ভিন্ন, ভেতর থেকে হাড় বের হয়ে আছে। আমি মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে কোন মতে বললাম, কে?
সাথে সাথে মানুষগুলি নড়তে শুরু করে, দেখি একজন আরেকজনের ভিতর দিয়ে চলে যাচ্ছে, চিৎকার করতে শুরু করেছে, ছুটতে শুরু করেছে। তারপর কিছু বোঝার আগে দেখি ছাদে একটি মানুষও নাই। ধু ধু ফাঁকা। শুধু একটা কাক কা কা করে ডাকতে ডাকতে উড়ে যেতে থাকে।
আমি তখন নিশ্চয়ই বিকট চিৎকার করে উঠেছিলাম কারণ দেখলাম সাথে সাথে শওকত আর তার বাসার লোকজন ছুটে এসেছে ওপরে। আমি কিছু বলার আগেই সে আমাকে ধরে বলল, নিচে আয়, তুই নিচে আয়—
আমি বললাম, শওকত, আমি দেখলাম–
শওকত বলল, আমি জানি। আমি জানি। আসলে আমারই ভুল হয়েছে। তুই নতুন মানুষ, তোকে একা ঘুমাতে দেয়া ঠিক হয় নাই।
আমি থর থর করে কাঁপছিলাম, শওকত বলল, একাত্তর সালে মুহম্মদপুরের এই এলাকায় বাঙালিদের মেরে কেটে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল। ছাব্বিশে মার্চ ভোরে এই বাসাতে ছাব্বিশটা ডেডবড়ি পড়েছিল। সেই থেকে এই বাসায় এরকম, আমাদের কখনো কিছু হয় না, কিছু দেখি না। নতুন কেউ এলে ভয় পায়–
আমরা অনেকক্ষণ কোন কথা বললাম না। খালেদ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি বানিয়ে খুব সুন্দর গল্প বলতে পার। একেবারে সত্যি গল্পের মতন।
ছোট চাচা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি বানিয়ে বলি নাই খালেদ।
.
বলেছিলাম ভয় পাব না, কিন্তু গল্প শুনে ভয়ে হাত পা আমাদের শরীরের ভিতরে ঢুকে যেতে চাইছে। আমরা কোন কথা না বলে চুপচাপ হাঁটতে থাকি। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, একটা ছোট স্রোতধারার পাশে দিয়ে হাঁটছি। দুপাশে ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়। রাত জাগা পাখির ডাক শুনছি। মাঝে মধ্যে পাতার ওপর দিয়ে শরশর করে কিছু একটা চলে যাচ্ছে, কে জ্বানে সাপ নাকি অন্য কিছু। সবার সামনে দিয়ে থোয়াংসা চাই হাঁটছে, তার হাতে একটা মশাল। মশালের আলোতে সবকিছু কী আশ্চর্য, কী অবাস্তব মনে হচ্ছে।
আমরা ঘন্টার পর ঘণ্টা হেঁটে গেলাম। মনে হয়, এই হাটার বুঝি আর কোন শেষ নেই। প্রথম প্রথম পা ব্যথা করছিল, কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর সেই ব্যথাও কেমন জানি কমে গেল। আমাদের ঘাড়ের বোঝাগুলি আস্তে আস্তে ভারী হতে শুরু করল কিন্তু আমরা জানি আমাদের থামার কোন সময় নেই, তাই সেই ভারী ঝোলা ঘাড়ে নিয়েই আমরা হাঁটতে থাকি।
হাঁটতে হাঁটতে যখন মনে হল আর পারি না তখন রাজু বলল, ছোট চাচা, আর তো পারি না।
খালেদ বলল, হ্যাঁ ছোট চাচা, এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।
ছোট চাচা বললেন, ঠিক ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট। বেশি বিশ্রাম নিলে আর নড়তে পারবি না।
আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি। মনে হয় এক অন্তহীন পথ যার শুরু নেই, শেষ নেই। অন্ধকারের মাঝে এক অজানা জায়গায় যেন আমরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি।
.
মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে আর বাকী সময় হেঁটে হেঁটে হঠাৎ এক সময় লক্ষ্য করি, আকাশে কেমন জানি আলো দেখা যাচ্ছে! আমরা কি হেঁটে হেঁটে একটা রাত পার করে দিয়েছি?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছোট চাচা, কয়টা বাজে?
পাঁচটা।
রাজু বলল, ছোট চাচা আমি আর পারব না। আর এক পা হাঁটলেই আমি মরে যাব।
ছোট চাচা বললেন, আর একটু। যখন হ্রদের কাছে পৌঁছাব–
খালেদ বলল, অসম্ভব।
আমি বললাম, অসম্ভব।
থোয়াংসা চাই কি বলল বুঝতে পারলাম না কিন্তু হাত পা নেড়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে যে জিনিসটা বলল সেটা যাই হোক আরো কয়েকঘণ্টা হেঁটে যাওয়ার সমর্থন হতে পারে না।
ছোট চাচা বললেন, ঠিক আছে, এখন কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়া যাক। ভোরে আবার শুরু করব।
আমরা সাথে সাথে সেখানেই লম্বা হয়ে শুইয়ে পড়ছিলাম, থোয়াংসা চাই আপত্তি করল। মাটিতে ঘুরে ঘুরে কিছু একটা দেখে আমাদের বোঝাল, বনের পশু এখানে পানি খেতে আসে।
ছোট চাচা বললেন, সর্বনাশ! পানি খেতে এসে আমাদের খেয়ে নেবে না তো!
আমি বললাম, জল এবং খাবার, জলখাবার!
থোয়াংসা চাই আমাদের রসিকতা বোঝার কোন চেষ্টাই কবল না, আমাদের নিয়ে সে উপরে উঠে যেতে লাগল। বেশ খানিকটা ওপরে একটা পাথুরে সমতল জায়গা তার বেশ পছন্দ হল বলে মনে হল। সেখানে কিছু শুকনো ডালপালা জড়ো করে বড় একটা আগুন তৈরি করে সে সাথে সাথে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
আমরা আগুনটা ঘিরে বসলাম। ঝোলা খুলে একটা চাদর বের করে মাটিতে বিছিয়ে মাথার নিচে ঝোলাটা দিয়ে আমি শুয়ে পড়ে বললাম, হাতি দিয়ে টেনেও এখন কেউ আমার চোখ খোলা রাখতে পারবে না।
ছোট চাচা বললেন, সবাই একসাথে ঘুমালে চলবে না। একজন একজন করে পাহারা দিতে হবে।
রাজু বলল, রূপকথার সেই প্রথম প্রহর কোটালিপুত্র, দ্বিতীয় প্রহর মন্ত্রিপুত্র, তৃতীয় প্রহর রাজপুত্র?
হ্যাঁ। কে পাহারা দেবে প্রথম প্রহর? কে হবে কোটালপুত্ৰ?
আমরা কেউ রাজি হলাম না। ছোট চাচা বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আমিই হব কোটালপুত্র। ঠিক এক ঘণ্টা পর টোপনকে তুলে দেব। টোপন এক ঘণ্টা পর তুলবে খালেদকে। খালেদ তুলবে রাজুকে। রাজু তুলবে থোয়াংসা চাহকে।
আমরা বললাম, ঠিক আছে।
খুব ক্লান্ত হয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল মাটিতে শোওয়া মাত্রই বুঝি ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু সাথে সাথে দু এল না, বেশ খানিকক্ষণ জেগে রইলাম। শুনতে পেলাম একজন একজন করে সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘুমন্ত মানুষের নিঃশ্বাসের একটা আলাদা রকম শব্দ রয়েছে। থোয়াংসা চাই তার ঘুমের মাঝেই কিছু একটা বলে হেসে ফেলল, ছেলেটা কি হাসতেই না পারে! আমি মৃদু স্বরে ডাকলাম, ছোট চাচা–
ছোট চাচা কোন উত্তর দিলেন না।
আমি আবার ভাবলাম, ছোট চাচা।
এবারে ছোট চাচার নাক ডাকা শুনতে পেলাম। ছোট চাচা যখন ঘুমান, তখন হালকা বাঁশির মত নাক ডাকে।
আমাদের প্রথম প্রহর পাহারা দেয়ার কোটালপুত্র ঘুমিয়ে গেছে, ঠিক রূপকথায় যেরকম হয়। তাকে ডেকে দেব ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমিয়ে গেলাম।