১০
কী হচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। গ্রিগান আমাকে কিনে নিয়েছে এবং তার নির্দেশমত আমাকে একটা পাহাড়ি এলাকায় পাঠানো হয়েছে। সেখানে ছিমছাম একটা কটেজ রয়েছে, আশেপাশে কিছু নেই, গাছপালা পাহাড় এগুলো দিয়ে ঢাকা। কটেজে আমি একা, কুলিং চেম্বারে প্রচুর খাবার আমি সেগুলো বের করে খাই। এলাকাটা ঘুরে দেখে আবার কটেজে ফিরে আসি। পাহাড়ে দূর থেকে একদিন একটা বাদামী ভালুক দেখেছি, আমি সেটাকে বিরক্ত করিনি, সেটাও আমাকে বিরক্ত করেনি। কটেজে কিছু ভিডিও ক্লিপ আছে সময় কাটানোর জন্য সেগুলো দেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু ভালো লাগেনি। আমার জানার কিংবা বোঝার কোনো উপায় নেই কিন্তু আমি অনুভব করতে পারছি আমাকে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ্য করা হচ্ছে।
এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর হঠাৎ করে মানুষ আসতে শুরু করল। খুবই সাধারণ মানুষ, আমি তাদের মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে দেখেছি তারা জানে না আমি একজন পরামানব। তাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম তাদেরকে এই কটেজটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পাঠানো হয়েছে।
মানুষগুলোর মাঝে নারীপুরুষ আছে, কম বয়সী মাঝবয়সী এমন কী এক দুইজন রীতিমত বৃদ্ধ মানুষও আছে। তাদের কেউ কেউ হাসিখুশী, কেউ কেউ গোমড়ামুখী, কেউ কেউ মোটামুটি দার্শনিক ধরনের। এই মানুষগুলোর সাথে কথা বলে আমার দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু গ্রিগান এতো ইউনিট খরচ করে আমাকে শুধুমাত্র কিছু মানুষের সাথে কথা বলিয়ে যাচ্ছে কেন আমি এখনও বুঝতে পারছি না।
এর কিছুদিন পর হঠাৎ করে যে মানুষগুলো আসতে শুরু করেছে তারা জানে আমি পরামানব। তাদের অনেকের আমাকে নিয়ে আতংক, অনেকের কৌতূহল আবার কয়েকজনের রীতিমত অবিশ্বাস। আগের সহজসরল মানুষগুলোর তুলনায় এই মানুষগুলো রীতিমত জটিল, তাদের সাথে কথা বলতেই আমি এক ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করি। এদের মাঝে এক দুইজন আমার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে শুরু করেছে। দিন শেষে মানুষগুলো চলে যাবার পর আমি এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করি।
এরপর একই সাথে নানা ধরনের মানুষ আসতে শুরু করেছে। একেবারে সহজ সরল কম বয়সী শিশু আছে, তাদের স্নেহময়ী মা আছে আবার এক রোখা নিষ্ঠুর মানুষও আছে। আমার সবচেয়ে সমস্যা হয় যখন গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন কেউ চলে আসে। প্রায় অপ্রকৃতস্থ মানুষ এসে আমার কাছে সাহায্য চায়। তবে সত্যিকারের বিপদের মাঝে পড়েছিলাম যখন একজন সম্পূর্ণ বিনা কারণে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে। আমি তার মস্তিষ্কে ঢুকে সময়মত অচল করে না দিলে আমি বেঁচে থাকতাম কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহ আছে।
এরকম ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটতে থাকল, তারপর হঠাৎ করে পুরো বিষয়টা অন্যদিকে ঘুরে গেল। গভীর রাতে সুন্দরী মেয়েরা আসতে শুরু করল, তাদের লাস্যময়ী ভাবভঙ্গী আমি সহজভাবে নিতে পারলাম না–নিজেকে সংযত রাখলাম। আমি এতোদিনে মোটামুটি অনুমান করতে পারছি এখানে কী হচ্ছে। পরামানব কেন্দ্রে প্রতিবুদ্ধিমত্তা মেয়েটি আমাকে বলেছিল সে যদি আমাকে আরও একটুখানি পর্যবেক্ষণ করতে পারত তাহলে আমি কি করতে চাইছি বুঝে ফেলতে পারতো। একজন মানুষকে যথেষ্ট সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারলে একটি প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম মানুষটিকে বুঝে ফেলতে পারে।
একদিন দুইজন টেকনিশিয়ান এসে আমার শরীরে একটা ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে গেল। কীসের ট্রাকিওশান আমি জানতে চাইছিলাম, তারা মুখ খুলল না।
গ্রিগান আমাকে একটা প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়ে নিচ্ছে। আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে। যেহেতু প্রায় সব রকম পরিবেশে সব
ধরনের মানুষের সাথে আমার সময় কাটাতে হয়েছে সিস্টেমটি আমাকে খুব ভালোভাবে বুঝে নিয়েছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি আমার নিজেকে যেটুকু বুঝতে পারি গ্রিগান একটা প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম আমাকে তার চাইতে অনেক নিখুঁতভাবে বুঝতে পারছে।
আমার সন্দেহ যে মিথ্যা নয় আমি কয়েকদিন পরেই সেটা টের পেলাম।
***
বিশাল একটা হলঘরে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। এতো বড় একটা হলঘর কেমন করে তৈরি করে কে জানে! হলঘরের ছাদটাও কতো উঁচু! আমি সারাজীবন ঘিঞ্জি ঘরে থেকে এসেছি, জায়গা বাঁচানোর জন্য নিচু ছাদ। মানুষের যখন অর্থ সম্পদ হয় তখন মনে হয় সবার প্রথম থাকার জন্য এতো বড় বড় ঘর বাড়ি তৈরি করে। বেশি অর্থ সম্পদ মানেই বেশি অপচয়।
ঘরের মেঝেটা স্বচ্ছ নাকি অস্বচ্ছ বোঝা যায় না। এটি কি দিয়ে তৈরি কে জানে। দেখে এক ধরনের পাথর মনে হয়, কিন্তু কোথাও জোড়া দেওয়া হয়েছে মনে হয় না। দেওয়ালগুলো ধবধবে সাদা কিন্তু মোটেও চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে না। ছাদটাও অর্ধস্বচ্ছ। ঘরে এক ধরনের কোমল আলো, কিন্তু আলোটা কোথা থেকে আসছে আমি জানি না। ঘরের মাঝামাঝি একটা কুচকুচে কালো টেবিল, সেই টেবিল ঘিরে অনেকগুলো আরামদায়ক চেয়ার। টেবিলের উপর একটা স্ফটিকের বাটিতে অনেকগুলো ফল। ফলগুলোর রং বিস্ময়কর।
আমি চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। গ্রিগান আমার সাথে এখানে দেখা করবে।
আমি এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছি। গ্রিগানের একক সম্পদ পৃথিবীর বাকি সব মানুষের সম্পদ থেকে বেশি। পৃথিবীর প্রযুক্তির বড় বিষয়গুলো সে নিয়ন্ত্রণ করতো, এখন বিজ্ঞান গবেষণাও সে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ, পৃথিবীর যেকোনো দেশকে ইচ্ছে করলে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। শুনেছি মানুষটি নিজেকে ঈশ্বরের কাছাকাছি বলে ভাবতে পছন্দ করে। এই মানুষটি আমার সাথে দেখা করতে চাইছে বিষয়টি আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। আমি তার সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।
আমি স্ফটিকের বাটি থেকে হালকা গোলাপী রংয়ের একটা ফল তুলে নিলাম। হাতে নিয়ে হঠাৎ সেটিকে আমার দূরের দেওয়ালের দিকে ছুঁড়ে দেওয়ার ইচ্ছা করল, কেন এই বিচিত্র ইচ্ছা করছে আমি জানি না।
আমি হঠাৎ করে পিছনে পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে দেখি আমার পিছনে গ্রিগান দাঁড়িয়ে আছে। ভিডিও স্ক্রিনে তাকে যেরকম দেখেছি তার চেহারা ঠিক সেরকম। লম্বা মুখ, মাথায় চুল নেই। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। তার নীল চোখ দুটি ঝকঝক করছে, বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না।
গ্রিগান বলল, “তুমি ইচ্ছা করলে এই ফলটি ছুঁড়ে মারতে পার।”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, আমার ধারণা সঠিক। গ্রিগানের প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম নিখুঁতভাবে আমার সব চিন্তা বিশ্লেষণ করতে পারে, আমি কী ভাবছি অনুমান করতে পারে।
আমি হাতের গোলাপী ফলটি দূরের দেওয়ালের দিকে সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে দিলাম, সেটি খুব কাছাকাছি কোনো একটা অদৃশ্য দেওয়ালে আঘাত খেয়ে থেতলে নিচে পড়ে গেল।
গ্রিগান বলল, “তোমার অনুমান সঠিক। এই ঘরটি ছোট একটা ঘর। দৃষ্টি বিভ্রম করিয়ে অনেক বড় একটা ঘরের অনুভূতি দেওয়া হয়েছে।” গ্রিগান হাসার ভঙ্গী করে বলল, “তোমার আগে আর কেউ এটা ধরতে পারেনি। তুমি শুধু পরামানব নও। তুমি বুদ্ধিমান পরামানব।”
আমি এই প্রথম কথা বললাম, “কয়েক সপ্তাহ আগেও আমি জানতাম না যে আমি একজন পরামানব, কিংবা আমি বুদ্ধিমান।”
“হতে পারে তুমি পরামানব হিসেবে আমার মস্তিষ্ক থেকে এই তথ্যাটি নিয়েছ।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না। আমি একান্ত প্রয়োজন না হলে অন্যের মস্তিষ্কে ঢুকি না।”
গ্রিগানের মুখে এক ধরনের বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল, গলায় শ্লেষ মিশিয়ে বলল, “তুমি শুধু পরামানব নও, তুমি একজন মহৎ ন্যায়নিষ্ঠ পরামানব!” একটু থেমে যোগ করল, “তবে তোমার চেহারায় বুদ্ধি কিংবা মহত্ত্বের কোনো ছাপ নেই। তোমার চেহারা নির্বোধের মতন। “
গ্রিগান হেঁটে একটা চেয়ারে বসল, আমি দেখতে পেলাম চেয়ারটি একটি জীবন্ত প্রাণীর মত তার আকার পরিবর্তন করে গ্রিগানের বসার ভঙ্গীর সাথে সমন্বয় করে নিল। গ্রিগান টেবিল থেকে উজ্জ্বল লাল একটি ফল হাতে নিয়ে সেটাকে লুফোলুফি করতে করতে বলল, “আমি কেন তোমার সাথে রূঢ় এবং অশালীন ভাষায় কথা বলছি জান? তার কারণ তোমাকে দেখে আমার কী মনে হয়েছে সেটা যেহেতু আমি মুখে উচ্চারণ না করলেও আমার মস্তিষ্ক থেকে তুমি জেনেই যাবে, আমি তাহলে নিজ থেকে তোমাকে জানিয়ে দেই না কেন?”
আমি একটা চেয়ার টেনে সেখানে বসে বললাম, “আমি তোমাকে বলেছি আমি বিনা কারণে কারো মস্তিষ্কে প্রবেশ করি না।”
আমার চেয়ারটাও জীবন্ত প্রাণীর মত তার আকার পরিবর্তন করে আমার বসার ভঙ্গীর সাথে মিলিয়ে নিল। গ্রিগান বলল, “তুমি সত্যি কথা বলছ। বিষয়টা তোমার জন্য খুব বিপজ্জনক, তোমাকে জানিয়ে রাখা ভালো। তুমি যেহেতু অন্যের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে সেটাকে বিকল করে দিতে পার সে কারণে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিটম্যান থেকেও বড় হিটম্যান। আমার মত একজন মানুষের তোমার কাছে থাকা খুবই বিপজ্জনক। আমার নিরাপত্তার জন্য তোমার শরীরে একটি ট্রাকিওশান ঢোকানো হয়েছে।“
আমি বললাম, “আমি জানি।”
“আমার সম্পর্কে তোমার মনে বিন্দুমাত্র ভায়োেলন্সের মনোভাব হলেই সেই ট্রাকিওশানটি বিস্ফোরিত হবে।”
এই অংশটুকু আমি জানতাম না। ঠিক কী কারণ জানা নেই আমি নিজের ভেতর আতংকের বদলে এক ধরনের দুঃখবোধ অনুভব করলাম।
গ্রিগান হাতের ফলটিকে একটি কামড় দিয়ে মুখ বিকৃত করে ফলটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজেই তুমি ভুলেও আমার কোনো ক্ষতি করার কথা চিন্তা করো না, আমার প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম ফ্রিজিলা সেটি বুঝতে পারবে।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”
গ্রিগান তার নিষ্ঠুর নীল দুটি চোখ নাচিয়ে বলল, “এবারে আমি দেখতে চাই তুমি আসলেই পরামানব কিনা। বল আমি কী চিন্তা করছি?”
আমি গ্রিগানের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে শিউরে উঠলাম, মাথা নেড়ে বললাম, “না! না!”
গ্রিগান কঠিন মুখে বলল, “বল।”
“তুমি এই মুহূর্তে চিন্তা করছ, যে মানুষটি টেবিলের এই ফলগুলো এনেছে তাকে একটা ফলের ট্রাকের নিচে চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। ফলটা বিস্বাদ–”
গ্রিগান উঠে দাঁড়াল। তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে বলল, “তুমি আসলেই একজন পরামানব। তোমাকে আমার প্রয়োজন।“
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, কী বলব বুঝতে পারলাম না। গ্রিগান বলল, “তুমি কী আমার সম্পর্কে আরও কিছু বলতে পারবে?”
আমি আবার গ্রিগানের মস্তিষ্কে প্রবেশ করলাম, আরও একটু গভীরে গেলাম তারপরে বের হয়ে এসে বললাম, “আশ্চর্য!”
“কী আশ্চর্য?”
“তোমার শরীরে হৃৎপিণ্ড দুইটি। অস্ত্রোপাচার করে একজন সুস্থ সবল কিশোরের হৃৎপিণ্ড বসানো হয়েছে। তোমার মস্তিষ্কে নিউরণের সংখ্যা বেশি, নবজাতক সন্তানের মস্তিষ্ক থেকে আনা হয়েছে। তোমার মস্তিষ্কে একটি ইমপ্লান্ট তোমার প্রতিবুদ্ধিমত্তা সিস্টেম ফ্রিজিলার সাথে যুক্ত। তুমি নিজের বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি ফ্রিজিলার বুদ্ধিমত্তার সাথেও যুক্ত। সেটি একইসাথে তোমার সব ধরনের জৈবিক আনন্দ দিতে পারে।“
“চমৎকার ৷” গ্রিগান চলে যেতে শুরু করে থেমে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি পৃথিবীর একমাত্র মানুষ, যে এখন আমার সবচেয়ে গোপনীয় কথাগুলো জানে। তার অর্থ কী বলতে পারবে?”
“অনুমান করতে পারি।”
“কর।”
“আমি কখনোই এই চার দেওয়ালের বাইরে যেতে পারব না। এবং আমাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখবে না।”
গ্রিগান মুখের হাসিকে বিস্তৃত করে বলল, “অসাধারণ!”
তারপর সরাসরি দেওয়ালের দিকে হেঁটে গেল। দেখতে পেলাম সে আবছা হয়ে কেমন করে জানি মিলিয়ে গেল।
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। বাটি থেকে একটা ফল তুলে কী খেয়ে দেখব–যে ফলের স্বাদ যথাযথ না হওয়ার জন্য একজন মানুষকে মারা যেতে হবে সেই ফলটি খেতে কী রকম?
কিন্তু আমার সাহস হল না।
১১
আমি আমার ঘরে একাকী বসে আছি। অনেক বড় একটা ঘর কিন্তু এখন আমি জানি আসলে ঘরটা ছোট, এক ধরনের দৃষ্টি বিভ্রম করিয়ে আমাকে বড় ঘরের অনুভূতি দেওয়া হয়েছে। ঘরের একদিকে বড় জানালা, সেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে একটা বনভূমি দেখা যায়। দূরে পাহাড়, পাহাড়ের চূড়া সাদা তুষারে ঢাকা। মাঝে মাঝে উত্তরের শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। দূরে পাখি কিচির মিচির করে ডাকছে, একটা বন্য হরিণ তার শিশু ছানাটিকে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আমি জানি এই সবগুলো আসলে কৃত্রিম। বাইরে কোনো বনভূমি নেই, দূরে পাহাড় নেই, পাহাড়ে তুষার নেই, পাখি নেই, হরিণ নেই। মাঝে মাঝে আমার জানার ইচ্ছা করে বাইরে আসলে কী? কুৎসিত ভাগাড়? আবর্জনা? জঞ্জাল?
আমি কৃত্রিম একটা জগতে আটকা থেকে হাঁপিয়ে উঠছি। আমি আশেপাশে কারা আছে বোঝার চেষ্টা করি। অপ্রকৃতস্থ মানুষের কোলাহলের জন্য কিছু শুনতে পাই না। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে যদি অপ্রকৃতস্থ মানুষের কোলাহল একটু কমে আসে তখন আমি কয়েকজন মানুষের উপস্থিতি টের পাই। একজন গণিতবিদ অথবা বিজ্ঞানী, একজন সম্ভবত সন্ন্যাসী, একজন শিশু, একজন সম্ভবত দানব–আমি এই বিচিত্র মানুষগুলো কেন আছে বুঝতে পারি না। গ্রিগান আমাকে যেভাবে ধরে এনেছে, এদেরকেও কী সেভাবে ধরে এনেছ? আমাকে না হয় পণ্য হিসেবে কিনতে পেরেছে কিন্তু অন্যদেরকেও কী সেভাবে কিনে আনতে পেরেছে?
অপ্রকৃতস্থ মানুষের কোলাহলের কারণে আমি অবশ্যি এই বিচিত্র মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে পারি না। পরামানব যেন কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে সেজন্য যে পদ্ধতিটি বের করেছে সেটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অমানবিক কিন্তু যথেষ্ট কার্যকর।
দুইদিন পর হঠাৎ আমার ঘরে গ্রিগান নিজে হাজির হল। আমি তাকে দেখে যথেষ্ট অবাক হলাম। সে বলল, “চল ৷”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”
গ্রিগান কঠিন মুখে বলল, “তোমার সেটা জানার প্রয়োজন নেই।”
কাজেই আমি আপত্তি না করে উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, “আমি প্রস্তুত।”
ঘরের বাইরে ছোট একটা গাড়ি। পাশাপাশি দুইজন বসতে পারে। গ্রিগান আমাকে নিয়ে সেখানে বসল। সামনের স্ক্রিনে কিছু একটা স্পর্শ করতেই গাড়িটি চলতে শুরু করে। এই জায়গার দেওয়ালগুলো বিচিত্র, দেখে মনে হয় শক্ত পাথরের কিন্তু আমরা দেওয়ালের কাছে আসতেই সেগুলো ধোঁয়ার মত হয়ে যাচ্ছে আমরা ভেতর দিয়ে বেশ সহজে চলে যেতে পারছি।
গ্রিগান বলল, “আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছ?”
আমি বললাম, “না। আমি এখনো জানি না। আমি তোমাকে বলেছি প্রয়োজন না হলে আমি কারো মস্তিষ্কে প্রবেশ করি না।”
গ্রিগানের মুখে তার শ্লেষের হাসিটি ফুটে উঠল, বলল, “ও, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি ন্যায়নিষ্ঠ পরামানব! তোমার মস্তিষ্কে বসানো ইম্প্লান্টটি না থাকলে আমি এটা বিশ্বাস করতাম না!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
“আমার অফিসে।”
“কেন?”
“আমি একজনের সাথে কথা বলব। তুমি তখন সেই মানুষটির মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে দেখবে সে কী সত্যি কথা বলছে নাকি মিথ্যা কথা বলছে। সে আমার সাথে মুখে কথা বলার সময় তার মস্তিষ্কে কী ঘটছে আমি সেটা জানতে চাই। তুমি আমাকে সেটা জানাতে থাকবে।”
আমি চুপ করে রইলাম। গ্রিগান বলল, “কোনো সমস্যা?”
“ঠিক সমস্যা নয়, তবে কাজটি সম্ভবত অনৈতিক।”
গ্রিগান হা হা করে হাসল, তারপর বলল, “তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব না আজ বিকেলেই শেষ করে দেব সেটা এই অনৈতিক কাজের উপর নির্ভর করছে। বুঝেছ?”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “বুঝেছি।”
গ্রিগানের অফিসটি অনেক বড়। এটি দৃষ্টি বিভ্রম দিয়ে বড় করানো নয়, আসলেই বড়। তার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে যে পর্বতমালা এবং অরণ্য দেখা যায় সেগুলো কৃত্রিম নয়। বনের পাখিগুলোও সত্যিকারের জীবন্ত পাখি। সেগুলো দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পৃথিবীর এরকম কতো অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য রয়েছে কিন্তু সেগুলো আমাদের মত মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
গ্রিগান তার বড় ডেস্কের পাশে একটা বড় কেবিনেট খুলে আমাকে বলল, “ঢুকো।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ঢুকব? আমি? এখানে?”
“হ্যাঁ। তোমাকে আমি কাছাকাছি রাখতে চাই যেন মস্তিষ্ক ঠিক করে পড়তে পার।”
আপত্তি করা অর্থহীন, তাই আমি কেবিনেটের ভিতরে ঢুকে নিচে হেলান দিয়ে বসে গেলাম। ব্যাপারটা যতটুকু অস্বস্তিকর হবে ভেবেছিলাম ততটুকু হল না, মোটামুটি স্বচ্ছন্দে বসা গেল ৷
কিছুক্ষণের ভেতরেই গ্রিগানের মানুষটি চলে এল, সে গ্রিগানকে সম্ভাষণ জানিয়ে গ্রিগানের সামনে বসেছে। শুনলাম মানুষটি বলছে, “গ্রিগান, তুমি সত্যি সত্যি আমার সাথে দেখা করতে রাজী হবে আমি সেটা কল্পনাও করিনি। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।” আমি শুনলাম তার মস্তিষ্কে এক ধরনের অবিশ্বাস্য ঘৃণা, মানুষটি মনে মনে বলছে “এর চাইতে আমার নরকবাসী হওয়া ভালো ছিল। আমার মৃত্যু হওয়া ভালো ছিল।”
আমি একটু ইতস্তত করে মানুষটির সত্যিকারের ভাবনাটুকু গ্রিগানকে জানিয়ে দিলাম। গ্রিগান বলল, “তুমি এতো কম বয়সে এরকম অসাধারণ একটা উদ্ভাবনী কাজ করতে শুরু করেছ, আমার তো তোমাকে নিয়ে কৌতূহল হতেই পারে।” মনে মনে বলল, “তা ছাড়া যে মানুষটিকে আমার শেষ করে দিতে হবে তার চেহারাটি তো একবার দেখা দরকার।
তারপর দুইজন ব্যবসায়িক কথা বলতে লাগল। আমি তার খুঁটিনাটি বুঝতে পারলাম না কিন্তু মানুষটির মনের কথাগুলো নিখুঁতভাবে গ্রিগানকে জানিয়ে দিতে লাগলাম। খুঁটিনাটি বুঝতে না পারলেও আমার বুঝতে সমস্যা হল না যে মানুষটি মুখে এক ধরনের কথা বললেও তার ভেতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিকল্পনা। সে গ্রিগানের বিশাল সাম্রাজ্যে হাত দিতে চায়।
একসময়ে দুজনের কথা শেষ হল তারপর তারা একটু উত্তেজক পানীয় খেলো এবং শেষ পর্যন্ত মানুষটি বের হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই গ্রিগান কেবিনেটের দরজা খুলে আমাকে বের করে আনে। আমার দিকে তাকিয়ে আনন্দের হাসি হেসে বলল, “আমাদের ন্যায়নিষ্ঠ পরামানব, তুমি তোমার প্রথম পরীক্ষা পাস করেছ। তোমার আয়ু আজকে বিকাল থেকে বেশি।”
আমি কিছু বললাম না, চুপচাপ বসে রইলাম। গ্রিগান বলল, “তুমি খুব চমৎকারভাবে তোমার দায়িত্ব পালন করেছ–এই নর্দমার কীটটিকে শেষ করতে এখন আমার কোনো অপরাধবোধ হবে না!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গ্রিগানের কখনও কী কোনো অপরাধ বোধ হয়? আমি কী সত্যিই এই মানুষটির মৃত্যুর কারণ হতে যাচ্ছি?
গ্রিগান বলল, “তোমাকে একটা পুরস্কার দেওয়ার ইচ্ছা করছে। তুমি কী পুরস্কার চাও?
আমি এবারে কথা বললাম, “একা একা আমার সময় কাটাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সাথে আরো যারা আছে আমি কী তাদের সাথে একটু সময় কাটাতে পারি?”
গ্রিগানের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল, “তুমি চিড়িয়াখানার অন্যদের সাথে কথা বলতে চাও?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “চিড়িয়াখানা?”
“হ্যাঁ। সারা পৃথিবী থেকে বেছে বেছে আজব মানুষ একত্র করেছি! তাদের মাঝে তুমিও একজন। তোমরা সবাই আমার চিড়িয়াখানার প্রদর্শনি!”
“আমি কী নিজের চোখে তাদের দেখতে পারি? কথা বলবে পারি?”
গ্রিগান কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। আমি তোমার পাশে থাকব যেন তুমি বাড়াবাড়ি কিছু করতে না পার। গোপনে কিছু করতে না পার।”
আমি একটু অবাক হয়ে গ্রিগানের দিকে তাকালাম, বললাম, “ আমি যতটুকু জানি আমি বাড়াবাড়ি কিছু করতে পারব না। চেষ্টা করলেই আমার ট্রাকিওশান আমাকে বিস্ফোরিত করে দেবে।”
হ্যাঁ। গ্রিগান গম্ভীর মুখে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমি গ্রিগান হয়েছি কারণ আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। মানুষকে না, পরামানবকে না, যন্ত্রকেও না।”
আমি কিছু না বলে গ্রিগানের দিকে তাকিয়ে রইলাম, যে মানুষ কাউকে বিশ্বাস করে না তার জীবনটা না জানি কতো নিরানন্দের!
***
গ্রিগানের হাতে একটি চাবুক। চাবুকটি শুধু যে চামড়ার উপর বসে যায় তা নয়, সেটি এক ধরনের ইলেকট্রিক শক দেয়। সে কেন হাতে এই চাবুকটি নিয়ে এসেছে প্রথমে বুঝতে পারিনি। একটু পরেই অবশ্য আমি বুঝতে পারলাম। তিন জন অপ্রকৃতস্থ মানুষকে গলায় শিকল দিয়ে বেঁধে গ্রিগানের হাতে দেওয়া হল। এই অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সে এই চাবুকটি রেখেছে।
আমি মানুষগুলোর মস্তিষ্কে উঁকি দিতে চাইনি কিন্তু তারা মুখে পুরোপুরি নীরব হলেও তাদের মস্তিষ্কে এতো ভয়ংকর হাহাকার আর আর্তচিৎকার যে আমার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। একজন মানুষ এতো অসহায়ভাবে এতো যন্ত্রণায় থাকতে পারে যে সেটি বিশ্বাস করা কঠিন।
গ্রিগান পা দিয়ে একজন আলুথালু পোষাকের নারীকে ধাক্কা দিয়ে আমাকে বলল, “এই মেয়েটি ছিল সাংবাদিক। আমার সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল। আমি তাকে ধরে নিয়ে এসেছি। তার মস্তিষ্ক ওলটপালট করে দিয়েছি।”
নারীটি কিছু বুঝতে পারল বলে মনে হল না, এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। গ্রিগান হা হা করে হেসে বলল, “একজন মানুষ কতো বড় নির্বোধ হলে আমার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়?”
আমি কিছু না বলে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলাম। গ্রিগান তখন তার পা দিয়ে উদভ্রান্তের মত একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই মানুষটি আরো বড় গর্দভ। সে আইন শৃঙ্খলার মানুষ ছিল, আমাকে আইনের গরম দেখানোর চেষ্টা করেছিল। এখন তার কী অবস্থা দেখেছ?”
আমি চুপ করে রইলাম। গ্রিগান তৃতীয় মানুষটিকে দেখিয়ে বলল, “এই নির্বোধ মানুষটা আমার ব্যবসাতে হাত দিতে চেয়েছিল! ভেবেছিল আমি বুঝতে পারব না। আমাকে সে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করেনি। এই পৃথিবীতে তার সুস্থ মানুষের মত বেঁচে থাকার অধিকার নেই।”
গ্রিগান আমার দিকে তাকিয়ে ভালো মানুষের মত হেসে বলল, “এই তিনটি আজব চিড়িয়ার গলায় চেন দিয়ে বেঁধে কেন সাথে নিয়েছি তুমি জান?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “অনুমান করতে পারি। এদের কোলাহলের কারণে আমি যেন গোপনে অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারি!”
“তোমার চেহারা যত নির্বোধের মত, তুমি মানুষটা আসলে তত নির্বোধ নও। তুমি ঠিকই অনুমান করেছ। তোমার আগে আমি সত্যিকার পরামানব নিয়ে কোনো খেলা খেলিনি। তাই একটু সাবধানে থাকছি।”
গ্রিগান আমার কথার কোনো উত্তর আশা করেনি তাই আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। গ্রিগান তার হাতের চাবুকটা দিয়ে অপ্রকৃতস্থ তিনজন মানুষকে আঘাত করে আমাকে বলল, “চল ৷”
আমি যদি জানতাম এরকম নিষ্ঠুর একটা ব্যাপার ঘটবে তাহলে আমি নিশ্চয়ই গ্রিগানকে অন্য মানুষদের সাথে দেখা করিয়ে দিতে বলতাম না। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। আমাকে এখন গ্রিগানের সাথে হেঁটে যেতেই হবে। তার আশ্চর্য ভয়াবহ জগৎটি দেখতেই হবে।
আমি নিজের ভেতর এক ধরনের আতংক অনুভব করি।
১২
একটা বড় করিডোর ধরে আমি গ্রিগানের সাথে হেঁটে যাচ্ছি। গ্রিগানের হাতে শেকলে বাধা তিনজন অপকৃতস্থ মানুষ–তারা মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে বিড়বিড় করে কথা বলছে, গ্রিগান তখন শেকলে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাদের সামনে নিয়ে আসছে।
গ্রিগান হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমার সংগ্রহে অনেক বিচিত্র মানুষ, সবগুলো দেখতে হলে দিন পার হয়ে যাবে। আমি তোমাকে আমার পছন্দের সংগ্রহগুলো দেখাই।”
গ্রিগান একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দরজার পাশে একটা বোতাম স্পর্শ করতেই ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা একপাশে সরে যায়, সামনে লোহার গারদ, ভেতরে একটা পাথরের উপর একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটির মাথায় বড় বড় চুল, মুখে দাড়ি গোঁফ। তার মুখের উপর একটা দীর্ঘ কাটা দাগ। দরজা খোলার শব্দ শুনে সে মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়েছে। আমাদের দেখেও তার মুখের নির্লিপ্ত ভাবের কোনো পরিবর্তন হল না।
গ্রিগান আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভায়োলেন্ট মানুষ নিয়ে আমার এক ধরনের কৌতূহল আছে। সারা পৃথিবী থেকে আমি ভায়োলেন্ট মানুষদের সংগ্রহ করি। এ হচ্ছে সেরকম একজন মানুষ।”
আমি বললাম, “কেন তুমি এদের সংগ্রহ কর?”
“যখন আমার জীবন পানসে হয়ে যায় তখন আমি দুজন ভায়োলেন্ট মানুষকে মারামারি করতে দেই। তারা তখন একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুনোখুনি শুরু করে দেয়। আমার দেখতে ভালো লাগে। স্নায়ু শীতল হয়। তুমি চাইলে পরের বার তোমাকে দেখাতে পারি।”
আমি বললাম, “না। আমি দেখতে চাই না।”
“কেন? তোমার ভায়োলেন্স ভালো লাগে না?”
“না।”
গ্রিগান দার্শনিকের মত বলল, “সবই অভ্যাসের ব্যাপার। একটু চেষ্টা করেই এই ধরনের খেলা উপভোগ করায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া যায়।”
আমি কোনো কথা বললাম না। গ্রিগান দরজাটি বন্ধ করে করিডোরের অন্য পাশের একটি দরজা খুলে ফেলল। এখানেও লোহার গারদ এবং ভেতরে একজন স্বল্পবসনা নারী। নারীটি এক টুকরা মাংস অনেকটা পশুর মত চিবিয়ে খাচ্ছে। তার অবিন্যস্ত সোনালী চুল এবং নিষ্ঠুর নীল চোখ। আমাদের দেখে সে দরজার দিকে এগিয়ে আসে। আমাদের এক নজর দেখে একটা অশালীন ভঙ্গী করে ময়লা হলুদ দাঁত বের করে একটা হিংস্ৰ শব্দ করল।
গ্রিগান হাসি হাসি মুখ করে বলল, “এই মেয়েটিও ভায়োলেন্ট ৷ সে কী করেছে শুনলে তুমি অবাক না হয়ে পারবে না–”
আমি গ্রিগানকে বাধা দিয়ে বললাম, “না, না। আমি শুনতে চাই না। “ মেয়েটি লোহার গারদ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আমাদের শরীরে থুতু দেওয়ার চেষ্টা করল।
গ্রিগান একটু সরে গিয়ে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ এরা এখানে খুবই সুখী!”
“সুখী?”
“হ্যাঁ। তারা যে যে ধরনের ভায়োলেন্স করতে চায় আমি তাদের সেরকম ভায়োলেন্স করার সুযোগ করে দিই। বাইরে থাকলে তারা সেগুলো করতে পারতো না।
আমি কেমন জানি শিউরে উঠলাম। গ্রিগান দরজা বন্ধ করে আরো একটু এগিয়ে যায়। কয়েকটা ঘর পার হয়ে সে আবার একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বোতাম স্পর্শ করে দরজাটা খুলে ফেললে দেখলাম এখানে কোনো লোহার গারদ নেই। ঘরের ভেতর এক ধরনের শান্ত সৌম্য পরিবেশ এবং সেখানে সাদা আলখাল্লা পরা একজন মানুষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় দীর্ঘ চুল এবং মুখে লম্বা দাড়ি। মানুষটির কপালে একটা টেপ লাগানো।
গ্রিগান বলল, “এ আমাদের সন্ন্যাসী। পৃথিবীর অন্য পাশের একটা আশ্রম থেকে ধরে এনেছি। এর তিনটি চোখ।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তিনটি চোখ?”
“হ্যাঁ। তিন নম্বর চোখটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে।”
“কৃত্রিমভাবে?”
“হ্যাঁ। ড্রিল দিয়ে কপালের হাড় ফুটো করে মস্তিষ্ক পর্যন্ত একটা গর্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেটাই নাকি চোখ। সেটা দিয়ে নাকি মানুষের জ্যোতি
দেখা যায়।”
“কী ভয়ানক!”
“এটি এমন কিছু ভয়ানক নয়। আমার এখানে আরো ভয়ানক মানুষ আছে। তোমাকে দেখাব।”
“আমি দেখতে চাই না।”
আমার কথা শুনে গ্রিগান মনে হয় কৌতুক অনুভব করল সে ভালো মানুষের মতন হাসল। একজন দানব কেমন করে ভালো মানুষের মত হাসতে পারে দেখে আমি এক ধরনের বিস্ময় অনুভব করি।
গ্রিগান হাতের শেকলে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে সামনে টেনে এনে আবার হাঁটতে থাকে। এবারে বেশ কয়েকটা ঘর পার হয়ে সে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। বোতাম স্পর্শ করে দরজা খোলার পর আমি চোখ বাধা একটি মেয়ে দেখতে পেলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এর চোখ বাঁধা কেন?”
“আমরা শুধু দৃশ্যমান আলো দেখতে পাই। এই মেয়েটি ইনফ্রায়েড থেকে আলট্রাভায়োলেট পর্যন্ত দেখতে পায়। চোখ বাধা থাকলেও সে দেখতে পাচ্ছে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী আশ্চর্য।”
গ্রিগান দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, “এমন কিছু আশ্চর্য নয় ৷ গবেষণা করে যদি তোমার মত বিচিত্র পরামানব তৈরি সম্ভব হয় তাহলে অন্য আরো অনেক কিছু সম্ভব হতে পারে।”
কথাটি নিশ্চয়ই সত্যি। আমি নিজে পরামানব বলে এটি কতো বিচিত্ৰ একটি বিষয় সেটি অনুভব করতে পারি না।
গ্রিগান আরো কয়েকটি ঘর পার হয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে যে আছে তাকে দেখে তুমি নিশ্চয়ই খুশি হবে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভেতরে কে আছে?”
আমার কথার উত্তর না দিয়ে গ্রিগান দরজা খুলে দিল। ভেতরে একটি বিশাল ল্যাবরেটরি, সেখানে একটা টেবিলে ঝুঁকে পড়ে আট দশ বছরের একটি ছেলে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে।
গ্রিগান বলল, “প্রডিজি।”
“প্রডিজি?”
“হ্যাঁ। এখনই অনেক বড় বিজ্ঞানী। তার দরিদ্রও বাবা মায়ের পক্ষে এই ছেলেটির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই আমি নিয়ে এসেছি।”
“সে তার বাবা মায়ের কাছে যেতে চায় না?”
“চায়। কিন্তু আমার এই চিড়িয়াখানায় যারা একবার আসে তারা কখনোই এখান থেকে বের হতে পারে না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “এইটুকুন বাচ্চা–একা থাকে?”
“হ্যাঁ।” গ্রিগান মাথা নাড়ল, “প্রতি রাতে বাবা মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। খুবই অস্থির হয়ে যায়। কোনো একদিন কিছু একটা করেও ফেলতে পারে।”
কিছু একটা করে ফেলতে বলে কী বোঝাচ্ছে আমার সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস হল না।
গ্রিগান দরজা বন্ধ করে আরো খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সময় কাটানোর জন্য এই মানুষটা মনে হয় সবচেয়ে ভালো।”
কেন এই মানুষটা সময় কাটানোর জন্য সবচেয়ে ভালো সেটা দরজা খুলতেই আমি বুঝতে পারলাম। ঠিক দরজার সামনেই এলোমেলো চুলের একজন বৃদ্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল সে যেন জানতো দরজাটা খোলা হবে।
আমাদেরকে একনজর দেখে, গ্রিগানের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ মানুষটি পরিচিত মানুষের মত বলল, “চারজনের গলায় শেকল দিয়ে বেঁধে বেড়াতে বের হয়েছ?”
গ্রিগান বলল, “জিনিৎস্কী, তুমি বুড়ো হয়ে গুনতে ভুলে গেছ! এখানে চারজনের গলায় শেকল নেই–তিনজনের!”
আমি চমকে উঠলাম, এই কী সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী জিনিৎস্কী? যার তৈরি ভিডিও দেখে আমি পরামানবে রূপান্তরিত হয়েছিলাম?
জিনিৎস্কী বলল, “না গ্রিগান আমি গুনতে ভুল করিনি। তিনজনের গলার শিকল দেখা যাচ্ছে। অন্যজনের শিকলটা অদৃশ্য। নিশ্চয়ই একটা ট্রাকিওশান দিয়ে বেঁধে রেখেছ। তোমার কথায় ওঠে এবং বসে। এটা শিকল থেকে ভালো কিছু নয়।“
গ্রিগান শব্দ করে হাসল, বলল, “সেভাবে দেখলে আমাদের সবারই গলা শিকল দিয়ে বাঁধা।”
জিনিৎস্কী ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “এর ট্রাকিওশান কী রকম? ম্যাগনেটিক? মানে বিস্ফোরক বোঝাই? নাকি শুধু ই এম সিগন্যাল?”
গ্রিগান কঠিন মুখে বলল, “এতো খুটিনাটি তথ্য দিয়ে তুমি কী করবে?”
“আমাকে এখনও এতো ভয়? আমাকে একটা ঘরে আটকে রেখেছে, আমি এখানে কী করতে পারব?”
গ্রিগান বলল, “না তোমাকে নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। আমি সতর্ক মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে কোনো তথ্য দেই না।”
জিনিৎস্কী আমার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে এখানে কেন এনেছে?”
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই গ্রিগান বলল, “এ পরামানব।”
“পরামানব!” জিনিৎস্কী প্রায় চিৎকার করে উঠল। আমার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল, বলল, “সত্যিকারের পরামানব?”
আমি মাথা নাড়লাম। জিনিৎস্কী জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারবে? আমার চিন্তা পড়তে পারবে?”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে শেকলে বাধা তিনজন অপ্রকৃতস্থ মানুষকে দেখিয়ে বললাম, “এই তিনজনের মস্তিষ্কে এতো যন্ত্রণার হাহাকার যে সেই কোলাহল ছাপিয়ে এখন আমি অন্য কিছু শুনতে পারি না।”
জিনিৎস্কী মাথা নেড়ে বলল, “এখন আমি বুঝতে পারছি কেন এদেরকে সাথে রেখেছে।”
গ্রিগান জিনিৎস্কীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাকে বলেছি জিনিৎস্কী, আমি সতৰ্ক মানুষ।”
জিনিৎস্কী আবার আমার দিকে তাকালো, তারপর বলল, “তুমি কি আমার তৈরি ভিডিওটা দেখেছিলে?”
“হ্যাঁ।” আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ। সেটা দেখার পরই আমি জানতে পেরেছিলাম যে আমি পরামানাব।”
জিনিৎস্কী কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মাঝে মাঝে আমার মনে হয় পরামানব বের করার সেই ভিডিওটি তৈরি করে হয়তো বড় ভুল করেছি।”
“কেন?”
“সেটি না থাকলে একজন মানুষ পরামানব হয়েও কখনো জানতো না সে পরামানব, তার জীবনে এতো ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে আসততা না। রাষ্ট্র এভাবে তাদের খুঁজে বের করে শেষ করতে পারতো না।”
আমি বললাম, “জিনিৎস্কী এটি তোমার দোষ নয়। রাষ্ট্রের দোষ!”
গ্রিগান কঠিন মুখে বলল, “অনেক হয়েছে। এখন এই আলোচনা থামাও। আমরা যাই। আর জিনিৎস্কী এই বড় বড় আলোচনা না করে তোমাকে আমি যে দায়িত্ব দিয়েছি, সেটা করো। এমন আরেকটা ভিডিও তৈরি করো যেটা দেখে সুস্থ মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়
জিনিৎস্কী মাথা নেড়ে বলল, “এর চাইতে তুমি আমাকে মেরে ফেল। কিংবা একটা লম্বা দড়ি দাও যেন আমি নিজেই ভিতরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে যেতে পারি।“
গ্রিগান কথার উত্তর না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বোতাম টিপে দিল যখন দরজাটি বন্ধ হতে শুরু করেছে আমি তখন জিনিৎস্কীর দিকে
তাকিয়ে রইলাম, তার চোখের দিকে তার মস্তিষ্কে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তিনজন অপ্রকৃতস্থ মানুষের জন্য প্রচণ্ড কোলাহল, কোনো কিছু শোনা যায় না। আমি তবু চেষ্টা করলাম, মনে হল সে বারবার বলছে, “ট্রাকিওশান চুম্বক ট্রাকিওশান চুম্বক…”
আমি অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলাম। নারীটির মস্তিষ্কে মাঝে মাঝেই একটা শিশুর চেহারা ভেসে ওঠে, আমি সেই শিশুটিকে দেখিয়ে একটু শান্ত করতে পারলাম তখন শুনলাম জিনিৎস্কী বলছে, “চুম্বক দিয়ে ট্রাকিওশান খুঁজে বের করো–শরীর থেকে বের করো–বাঁচাও নিজেকে বাঁচাও–”
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখলাম প্রতিবুদ্ধিমত্তা সিস্টেম ফ্রিজিলা আমাকে লক্ষ করছে, আমার কোনোভাবেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না। ফ্রিজিলাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না–যে আমি জিনিৎস্কীর কথা শুনতে পেয়েছি। কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না।
আমি গ্রিগানের দিকে তাকালাম, বললাম, “গ্রিগান, আমরা কী আজকের মত এখানেই শেষ করতে পারি?”
“কেন? তোমার সখ মিটে গেছে?”
“না। আমি জিনিৎস্কীকে দেখে খুব অবাক হয়েছি। সে এখানে? তোমার কাছে?”
গ্রিগান হাসল, বলল, “তুমি অবাক হওয়ার কিছুই এখনো দেখনি!”
১৩
জিনিৎস্কীর কাছ থেকে আমি খুবই বিচলিত হয়ে ফিরে এসেছি। প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম ফ্রিজিলা আমাকে সবসময় লক্ষ করে, নিশ্চয়ই বুঝে গেছে আমি বিচলিত। গ্রিগান আমাকে যে মানুষগুলো দেখিয়েছে তাদের দেখে বিচলিত হওয়া খুব বিচিত্র কিছু নয় কিন্তু আমি যে আসলে জিনিৎস্কীর মস্তিষ্কে ঢুকে তার এক দুইটা শব্দ শুনে বিচলিত হয়েছি সেটা কী ফ্ৰিজিলা বুঝতে পেরেছে? আমাকে যে জিনিৎস্কী চুম্বক দিয়ে ট্রাকিওশান বের করে ফেলতে বলেছে সেটা কী ফ্রিজিলা জেনে গেছে? একটা মানুষের শরীরে একেবারে বালুকণার মত ছোট একটা ট্রাকিওশান ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কোথায় আছে আমি কেমন করে জানব? চুম্বক দিয়ে সেটা কেমন করে আমি বের করে আনব? বের করার মত একটা চুম্বক আমি পাবই বা কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে শুধু জিনিৎস্কী। আমি কী পারব তার সাথে যোগাযোগ করতে? সে কী আমাকে বলতে পারবে আমাকে কী করতে হবে?
আমি জিনিৎস্কীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। অপ্রকৃতস্থ মানুষের কোলাহলের কারণে আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না। এই মানুষগুলোর জীবন থেকে ভয়ংকর জীবন কী আর কারো হতে পারে? একজন মানুষকে এর চাইতে বেশি কষ্ট কী দেওয়া সম্ভব? নরকে কী এভাবেই পাপী তাপী মানুষকে শাস্তি দেওয়া হবে?
আমি অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। প্রথমে সেই মেয়েটির সাথে কথা বললাম, নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কী মেয়ে?”
মেয়েটা হাহাকার করে উঠল, “নাম? নাম? আমার নাম?”
“হ্যাঁ। তোমার নাম? “
“নাম? নাম? আমার নাম? নাম? নাম?”
মনে হল মেয়েটি বুঝতেই পারছে না নাম মানে কী। আমি ধৈৰ্য্য হারালাম না। শান্ত গলায় বললাম, “হ্যাঁ, মেয়ে। তোমার নাম। একটুখানি চিন্তা করো–এই একটুখানি–”
“একটুখানি?”
“হ্যাঁ, চিন্তা করো। বল আমাকে, তোমার নাম কী। বল।”
“আমার নাম–আমার নাম–ইরিনা–মনে হয় ইরিনা–”
“ইরিনা!” আমি আরও নরম গলায় বললাম, “ইরিনা, তুমি একটু শান্ত হও! একটু শান্ত হও।”
“শান্ত? আমি শান্ত হব? কিন্তু কষ্ট–অনেক কষ্ট–অনেক বেশি কষ্ট–” ইরিনা আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল।
আমি তাকে কাঁদতে দিলাম। একজন মানুষের দুঃখ কষ্ট সুখ আনন্দ সবই তার মস্তিষ্কে। আমি কী এই মেয়েটির মস্তিষ্কের সব মুছে দিয়ে সেখানে একটুখানি শান্তি এনে দিতে পারি না? নিশ্চয়ই পারব। যদি না পারি তাহলে আমি কিসের পরামানব?
আমি আবার ইরিনার সাথে কথা বলতে লাগলাম। নরম গলায় আদর করে বললাম, “ইরিনা, তুমি কেঁদো না। আমি তোমার সব দুঃখ মুছে দেব। তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব। আমি পারি। আমি সবার দুঃখ কষ্ট দূর করে দিতে পারি।”
ইরিনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি–তুমি কে?”
“আমাকে তুমি চিনবে না ইরিনা। কিন্তু তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর। আমি তোমার কষ্ট দূর করার জন্য এসেছি। এই দেখ তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাচ্ছে। তোমার সব যন্ত্রণা দূর হয়ে যাচ্ছে। তোমার বুকের ভেতর একটা গভীর প্রশান্তি নেমে আসছে ইরিনা। তুমি ঘুমিয়ে যাও ইরিনা, তুমি ঘুমিয়ে যাও তোমার কোনো ভয় নেই কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না- আমি আছি–আমি আছি তোমার পাশে–”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি ইরিনা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। আমি নিজের ভেতর এক ধরনের গভীর আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে থাকি। আমি পারি। যেহেতু মানুষের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা সুখ আনন্দ সব অনুভূতি থাকে তাদের মস্তিষ্কে, আর আমি যেহেতু সেই মস্তিষ্ককেই নিয়ন্ত্ৰণ করতে পারি কাজেই আমার ভেতরে এখন অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। আমি আমার সেই অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ব্যবহার করব। ফ্রিজিলা আমাকে হয়তো বেঁচে থাকতে দেবে না, কিন্তু আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।
আমি তখন একজন একজন করে সব অপ্রকৃতস্থ মানুষের দুঃসহ কষ্ট, অবিশ্বাস্য আতংক আর অবর্ণনীয় যন্ত্রণা কমিয়ে দিয়ে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিই। কে জানে, না জানি কতোদিন পর তারা এভাবে শান্তিতে ঘুমোচ্ছে।
তারপর আমি জিনিৎস্কীর মস্তিষ্কে প্রবেশ করলাম। তাকে ডাকলাম, “জিনিৎস্কী– জিনিৎস্কী– তুমি কোথায়?”
জিনিৎস্কী চমকে উঠল। বলল, “কে? কে কথা বলে?”
“আমি নীল। পরামানব।”
“তুমি? তুমি না করো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলে না? অপ্রকৃতস্থ মানুষদের দিয়ে তোমাকে ঘিরে রেখেছিল?”
“হ্যাঁ। তারা আমাকে ঘিরে ছিল। তাদের কোলাহলে আমি অন্য কিছু শুনতে পেতাম না। কিন্তু আমি তাদের সবাইকে শান্ত করেছি। তাদের আতংক, কষ্ট যন্ত্রণা দূর করে দিয়েছি। তারা সবাই এখন গভীর প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“কী আশ্চর্য! কী অসাধারণ! কী চমৎকার!”
আমি বললাম, “জিনিৎস্কী আমি তোমার সাথে একটা জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই। সেজন্য আমি তোমার কাছে এসেছি। প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম ফ্রিজিলা প্রতি মুহূর্তে আমাকে লক্ষ করছে। সে নিশ্চয়ই সবকিছু টের পেয়ে গেছে। কিছু একটা করে ফেলার আগে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই জিনিৎস্কী।”
“বল। বল, তুমি কী বলতে চাও।”
আমি তার মস্তিষ্কে বললাম, “তুমি আমাকে বলেছিলে চুম্বক দিয়ে আমার ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলতে। কিন্তু—”
“বুঝেছি। তুমি জানতে চাইছ কেমন করে ট্রাকিওশান বের করবে?”
“হ্যাঁ। তাছাড়া আমি চুম্বক পাব কোথায়? কতো বড়, কতো শক্তিশালী চুম্বক লাগবে আমি তো সেটাও জানি না জিনিৎস্কী। আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি লেখাপড়া শিখিনি, কিছু জানি না–”
জিনিৎস্কী হাসির মত শব্দ করল। বলল, “তুমি যা জান সেটা লেখাপড়া থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! যাই হোক আমি বলে দিই ৷ তুমি মন দিয়ে শোনো–”
আমি বললাম, “শুনছি। বল।”
“তোমার ঘরে নিশ্চয়ই একটা কুলিং চেম্বার আছে?”
“হ্যাঁ আছে।”
“গ্রিগানের কোম্পানির সবচেয়ে সস্তা মডেল।”
“সম্ভবত।”
“সেটার দরজা স্পর্শ করলে নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায়?”
“হ্যাঁ।”
“দরজা বন্ধ রাখার জন্য ভেতরে উপরে ডান দিকে দেখবে একটা গোলাকার চাকতির মত শক্তিশালী চুম্বক আছে।”
আমি জিনিৎস্কীর মস্তিষ্কে কথা বলতে বলতে রান্নাঘরে গিয়ে কুলিং চেম্বার খুলে ভেতরে ডান দিকে উপরের দিকে তাকালাম। সত্যিই সেখানে গোলাকার চাকতির মত চুম্বক লাগানো। আমি বললাম, “হ্যাঁ দেখেছি।”
“সেটা খুলে নিতে হবে। একটা চামুচ দিয়ে চাড় দিলেই খুলে যাবে।“
“ঠিক আছে। আমি খুলে নেব। ফ্রিজিলা নিশ্চয়ই আমাকে লক্ষ করছে তাই এই মুহূর্তে খুলব না। একটু পরে খুলব।”
“ঠিক আছে। তোমার ট্রাকিওশানটি আছে তোমার হৃৎপিণ্ডে। তারা তোমার মস্তিষ্কটি রক্ষা করতে চায় তাই সেটি মস্তিষ্কে বসায়নি। যদি মস্তিষ্কে বসাতো তাহলে বের করা যেতো না। যাই হোক চুম্বকটি আলাদা করার পর সেটি তোমার বুকের বাম দিকে চেপে ধরবে। তারপর হৃৎস্পন্দনের সাথে মিলিয়ে এটাকে একটুখানি উপরে তুলবে আবার বুকে চেপে ধরবে। মনে রেখো এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি হৃৎস্পন্দনের তালে তালে করতে না পার তাহলে কিন্তু হবে না। বুঝেছ?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। বুঝেছি।”
“কতোবারে এটা করতে পারবে আমি জানি না। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য কমপক্ষে দশবার করবে। তারপর ধরে নিতে পারবে যে তুমি সেটাকে মুক্ত করতে পেরেছ। তখন চুম্বকটিকে হৃৎস্পন্দনের তালে তালে শরীরে লাগিয়ে লাগিয়ে এটাকে ধমনীর ভেতর দিয়ে টেনে টেনে একেবারে আঙুলের ডগায় নিয়ে আসতে হবে।” জিনিৎস্কী একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “আমি মনে হয় তোমাকে ঠিক করে বোঝাতে পারলাম না।”
আমি বললাম, “না জিনিৎস্কী, আমি বুঝতে পেরেছি। আমি শুধু যে তোমার চিন্তা শুনতে পাই তা নয়। আমি তোমার কল্পনাটুকু দেখতেও পাই। আমি তোমার বর্ণনাটুকু দেখেছি!”
জিনিৎস্কী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চুপ করে রইল। তারপর বলল, “কী অসাধারণ! তুমি বুঝতে পারছ নীল, যদি তোমার মত দশজন পরামানব একসাথে বসতে পারে, একজন আরেকজনের মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে, তারপর একসাথে তাদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারে তাহলে কী ঘটবে? নিউরণগুলো যখন — “
আমি জিনিৎস্কীকে থামালাম। বললাম, “জিনিৎস্কী, তোমার বিজ্ঞান আর গবেষণার কথাগুলো বুঝতে হলে আমাকে তোমার মস্তিষ্ক থেকে বিজ্ঞানের তথ্যগুলো আমার মাথায় আনতে হবে– এখন সেটা করার সময় নেই। আমি দেখি আগে ট্রাকিওশান বের করতে পারি কিনা। এখন বলে দাও ট্রাকিওশানটি আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে আসার পর আমাকে কী করতে হবে।”
জিনিৎস্কী বলল, “তখন আঙ্গুলের ডগায় একটা ফুটো করে এক ফোঁটা রক্ত বের করে আনবে তারপর চুম্বকটা সেই রক্তে চেপে ধরে রাখবে। যদি সবকিছু ঠিকভাবে হয়ে থাকে তাহলে ট্রাকিওশানটা চুম্বকের গায়ে লেগে থাকবে। চুম্বকটা তখন দূরে সরিয়ে রাখবে।”
আমি বললাম, “বুঝেছি।”
“শরীরের ভিতরে বসে হৃৎপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করতে বেশি বিস্ফোরক দরকার নেই, ছোট একটি বিস্ফোরণ দিয়েই সেটা করা যায়। কাজেই বিস্ফোরকের পরিমাণ মোটেও বেশি নেই। চুম্বকটা যদি তোমার কুলিং চেম্বারে রেখে দাও সেটাই যথেষ্ট।”
“বুঝেছি।”
“ঠিক আছে। তুমি তাহলে কাজ শুরু করে দাও। শুভ কামনা নীল।”
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ জিনিৎস্কী।”
.
আমি জিনিৎস্কীর কথামত শীতল চেম্বার থেকে চুম্বকটি খুলে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। কয়েক মিনিটের ভেতর আমি ট্রাকিওশানটি আঙুলের ডগায় এনে সেটি একফোঁটা রক্তের সাথে বের করে নিলাম। ট্রাকিওশানটি বালুকণার মত ছোট কিন্তু চেষ্টা করলে খালি চোখে দেখা যায়। চুম্বকের উপর সেটি লেগে আছে ৷
আমি চুম্বকটা কুলিং চেম্বারের ভেতর রেখে তার দরজাটি শক্ত করে বন্ধ করে যখন বসার ঘরে ফিরে এসেছি ঠিক তখন সাদা অস্বচ্ছ দেওয়াল ভেদ করে একজন মানুষ ঘরে ঢুকল। আমি মানুষটিকে চিনতে পারলাম, গ্রিগান নিজেই। আমি ভেবেছিলাম কোনো একজন প্রহরী আসবে অস্ত্র হাতে কিন্তু গ্রিগান নিজেই এসেছে। তার হাতে অস্ত্র। আমি যেমনটি ভেবেছিলাম।
সে অস্ত্রটি আমার মাথার দিকে তাক করল, তারপর গুলি করল, দুম দুম দুম দুম…
***
আমি গ্রিগানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম গ্রিগান!”
গ্রিগান অস্ত্রটি আমার মাথার দিকে তাক করে ধরে রেখে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “না গ্রিগান, এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা না যে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র দিয়ে এতো কাছে দাঁড়িয়েও তুমি একটি গুলিও আমার শরীরে লাগাতে পারনি। তুমি ভুলে গেছ যে আমি পরামানব। আমি অন্যের মস্তিষ্কে সাধারণত ঢুকি না, কিন্তু যদি ঢুকতে হয় আমি ঢুকে যাই। তার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিই। তুমি জানো না তোমার মস্তিষ্ক এখন আমার নিয়ন্ত্রণে। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুমি একটি কাজও করতে পারবে না।“
গ্রিগান ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “তুমি দেখতে চাও গ্রিগান? আমি তোমাকে দেখাই। তুমি এখন আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে। তারপর দুই হাত জোড় করে মাথা নিচু করে থাকবে। প্রাচীনকালে ক্রীতদাসেরা যেভাবে তাদের প্রভুর সামনে থাকতো অনেকটা সেরকম।“
গ্রিগান খুব ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসল। তারপর দুই হাত জোড় করে মাথা নিচু করে রাখল।
আমি একটা চেয়ার টেনে এনে তার সামনে বসলাম। বললাম, “গ্রিগান, প্রাচীনকালে ক্রীতদাসেরা তাদের প্রভুর চোখের দিকে তাকাতে পারত না। তবে আমি তোমাকে আমার মুখের দিকে তাকানোর অনুমতি দিচ্ছি। তাকাও, তুমি আমার দিকে তাকাও, আমি কারো চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলতে পারি না।”
গ্রিগান হাঁটু গেড়ে বসে থেকে আমার মুখের দিকে তাকাল। তার চোখে অবর্ণনীয় আতংক। একজন মানুষ একটা ভয়ংকর অস্ত্র হাতে জোড় হাতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে, দৃশ্যটি কেমন জানি বিসদৃশ।
আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম, “আমি জানি তুমি একটু অবাক হয়ে ভাবছ আমার শরীরের ট্রকিওশানটি কেন বিস্ফোরিত হচ্ছে না? ফ্রিজিলা নিশ্চয়ই তোমাকে জানিয়েছে ট্রাকিওশানটি আমার শরীরে নেই তাই বিস্ফোরিত হলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু আমি যেহেতু তোমার কোনো ক্ষতি করছি না, শুধু তোমার সাথে কথা বলছি সম্ভবত সেজন্য এখনও বিস্ফোরিত হচ্ছে না! আমি তোমাকে নিয়ে কী করতে চাই সেটা বললে নিশ্চয়ই বিস্ফোরিত হবে। চেষ্টা করব?”
গ্রিগান কোনো কথা বলল না, সে কিছু বলবে আমি আশাও করিনি।
আমি বললাম, “তোমাকে দেখতে যদিও মানুষের মত দেখায় গ্রিগান, কিন্তু তুমি তো আসলে দানব ছাড়া কিছু নও। যে মানুষগুলো তোমার দানব পরিচয়টি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিল তুমি যে তাদেরকে অপ্রকৃতস্থ করে এখানে রেখেছ, তাদের গলায় শেকল বেঁধে তুমি পশুর মত টানা হ্যাঁচড়া করেছ, যাদেরকে আমার চারপাশে রেখেছ, আমি তোমাকে এখন সেরকম করে দেব। তুমিও অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাবে। আমি তখন তোমার গলায় শেকল বেঁধে তোমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হব! কাজটি কী বেআইনী হবে? আইন তো মানুষের জন্য, আমি তো মানুষ নই, আমি তো পরামানব!”
গ্রিগান কিছু বলল না কিন্তু রান্নাঘরে কুলিং চেম্বারে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। আমি বললাম, “শুনেছ? আমার ট্রাকিওশনটি বিস্ফোরিত হয়েছে? এটা বিস্ফোরিত হয়ে আমার হৃৎপিণ্ডকে ছিন্ন ভিন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে কুলিং চেম্বারে আমার স্ট্রবেরি চকলেট আইসক্রিমকে ছিন্ন ভিন্ন করেছে। আমার খুব প্রিয় আইসক্রিম।” আমি সুর পাল্টে বললাম, “তোমার প্রিয় আইসক্রিম কী গ্রিগান? মানুষের রক্ত দিয়ে কী আইসক্রিম তৈরি হয়?”
গ্রিগান কোনো কথা বলল না, আমার দিকে নির্বোধ একটি পশুর মত তাকিয়ে রইল।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “তুমি ভেবেছিলে অপ্রকৃতস্থ মানুষকে দিয়ে ঘিরে রেখে তুমি আমাকে অচল করে রেখেছ। আমি কারো মস্তিষ্কে ঢুকতে পারব না, কিছু করতে পারব না। সেইজন্য কিছু সশস্ত্র প্রহরী না পাঠিয়ে তুমি নিজেই আমাকে খুন করতে এসেছ। মানুষ খুন করার কী আনন্দ, তাই না? কেন সেটা অন্যকে দেবে?”
আমি জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললাম, “কিন্তু নির্বোধ তুমি জানতে না, আমি সব অপ্রকৃতস্থ মানুষদের শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। তোমার সাধের ফ্রিজিলাও সেটা বুঝেনি! কেমন করে বুঝবে? মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা যন্ত্র কেমন করে জানবে? জানা কী সম্ভব?”
আমি এবারে গ্রিগানের দিকে তাকিয়ে বললাম, “গ্রিগান তোমাকে নিয়ে এখনো আমার শেষ কাজটা বাকি আছে। তোমার বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তুমি যে সি-কিউব তৈরি করেছ সেটা আমার দরকার। আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি, লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। আমি অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ। পৃথিবীর নিয়ম-কানুন জানি না! তোমাকে অচল করে দেওয়ার পর এখানকার বন্দি মানুষদের মুক্ত করার জন্য আমাকে কী করতে হবে আমি জানি না। তোমার সব সম্পদ পৃথিবীর দরিদ্র মানুষদের কাছে কীভাবে ফিরিয়ে দিতে হবে সেটাও আমি জানি না। সবচেয়ে বড় কথা তোমার বিশাল প্রহরী বাহিনী যেন আমাকে ভস্মীভূত করে না ফেলে সেটাও আমাকে নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য আমার সি-কিউবটা দরকার।” আমি আমার হাত বাড়িয়ে বললাম, “সেটা আমাকে দাও।”
গ্রিগান এই প্রথমবার মাথা নাড়ল, সে আমাকে এটা দিতে চায় না ৷
আমি শব্দ করে হাসলাম, বললাম, “আমি জানি এটা তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস! তুমি যে গ্রিগান, একজন হতদরিদ্র অভুক্ত শ্রমিক নও তার গ্যারান্টি হচ্ছে এই সি-কিউব। আমাকে এটা দিতে হবে। দাও।”
সে আবার অসহায়ের মত মাথা নাড়ল, শুধু তাই নয় মুখ দিয়ে অব্যক্ত শব্দ করল, বলল, “না-না–”
“আমি জানি তোমার মুখের শেষ দাঁতটি কৃত্রিম, সেটা আসলে একটা সকেট যেটা স্ক্রুয়ের মত করে তোমার চোয়ালে লাগানো আছে! তার ভেতরে আছে সি-কিউব। এটা খুলে আমাকে দাও গ্রিগান, আমার হাতে সময় নেই। তোমার নিজস্ব ইচ্ছা বলে কিছু নেই গ্রিগান। শুধু শুধু চেষ্টা করে সময় নষ্ট করো না।”
গ্রিনান তখন মাথা নিচু করে তার মুখে হাত ঢুকিয়ে তার কৃত্রিম দাঁতটা প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে খুলতে থাকে।
***
জিনিৎস্কী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, কয়েকবার চেষ্টা করে, বলল, “তুমি?”
“হ্যাঁ আমি। তোমার পদ্ধতি ব্যবহার করে ট্রাকিওশান সরিয়ে বের হয়ে এসেছি।”
জিনিৎস্কী এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। কাঁপা গলায় বলল, “আর গ্রিগান?”
“আমার ঘরে মেঝেতে অথর্ব অচল অপ্রকৃতস্থ হয়ে শুয়ে আছে। তার হাতে একটা ভয়ংকর অস্ত্র। মাথায় একটা ইমপ্লান্ট। কাজেই সে যদি অস্ত্রটা দিয়ে নিজের কিছু একটা করে ফেলে অবাক হবার কিছু নেই।”
“প্রতিবুদ্ধিমত্তা সিস্টেম ফ্রিজিলা তোমাকে করতে দিয়েছে?”
“তাইতো দেখছি।” আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “জিনিৎস্কী, এখন কী করতে হবে আমি জানি না। তাই তোমার কাছে এসেছি। আমার কাছে তার সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মডিউলটা আছে, এটার নাম সি-কিউব। তার মানে এখন সে নয়–আমরাই তার সম্পদ শক্তি প্রতিপত্তি সবকিছুর অধিকারী। কিন্তু আমি কী করতে হবে জানি না। তুমি আমাকে সাহায্য কর।”
জিনিৎস্কীর মুখে খুব ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, “নীল, তুমি জানো না তুমি কী করে ফেলেছ! এটি স্বপ্নেও কোনোদিন আমি কল্পনা করতে পারতাম না!”
“কিন্তু তুমি সাহায্য করবে তো?”
“করব। করব। অবশ্যই করব। এর আগে শুধু ঈশ্বর পুরো পৃথিবী ডিজাইন করেছে! এখন আমরা করব। আমরা–তুমি, আমি আর আমাদের মত সাধারণ মানুষ! দরিদ্র মানুষ!”
১৪
যখন সবকিছু মিটে গেল, পৃথিবীটা একটা নূতন জায়গায় পৌঁছে গেল তখন একদিন আমি আমার ফ্যাক্টরিতে এসেছি। বহুদিন কাজে আসিনি বলে আমার চাকরি নেই। আমি তাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, যখন ফ্যাক্টরির কাজ শেষ হয়েছে সব শ্রমিকেরা বের হয়ে আসছে আমি তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতিনাকে খুঁজতে থাকি। কেউ আলাদা করে আমাকে লক্ষ করছে না, করলে একজন দুইজন আমাকে নিশ্চয়ই চিনে ফেলতো।
আগে শ্রমিকেরা বের হতো ক্লান্ত হয়ে, তাদের চোখে মুখে থাকতো হতাশার ছাপ, তাদের জীবনে আনন্দের কোনো চিহ্ন ছিল না ৷ এখন সব ফ্যাক্টরির মালিকানা শ্রমিকদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের উপার্জন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, তাদের জীবনটাও আনন্দময় হয়েছে। এখন তাদের চোখে মুখে যতটুকু ক্লান্তি তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ, অনেক বেশি উত্তেজনা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি হঠাৎ রাতিনাকে দেখতে পেলাম। সে তার পুতুলের মত মুখ নিয়ে অন্যমনস্কভাবে বের হয়ে আসছে। আমি গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, “রাতিনা!”
রাতিনা মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো তারপর দ্রুতপায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। অবাক হয়ে বলল, “তুমি বেঁচে আছ?”
আমি হাসলাম, বললাম, “হ্যাঁ রাতিনা আমি বেঁচে আছি।”
“তুমি নিশ্চয়ই জান একজন রহস্যময় পরামানব গ্রিগানকে অপরাধী হিসেবে ধরিয়ে দিয়েছে?”
আমি একটু হাসলাম। “হ্যাঁ জানি।”
“সেই পরামানব পৃথিবীটা ঠিক করে দিয়েছে, এখন পরামানব হওয়া আর অপরাধ নয়?”
আমি মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ, আমি জানি!”
“তখন সব পরামানব ছাড়া পেয়ে বের হয়ে আসছে। শুধু তুমি আসনি! তাই আমি ভেবেছিলাম তোমাকে বুঝি মেরে ফেলেছে!”
আমি বললাম, “না আমাকে মারেনি। আমাকে মারতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।”
“তুমি অনেক সৌভাগ্যবান।”
“হ্যাঁ। আমি অনেক সৌভাগ্যবান।”
রাতিনা আমাকে স্পর্শ করে বলল, “তুমি আমাকে বাঁচানোর জন্য নিজের পরিচয় দিয়েছিলে, আমি বেঁচে গিয়েছি কিন্তু তারা তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল! আমার কী যে মন খারাপ হয়েছিল।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মনে আছে!”
“অজ্ঞান হওয়ার আগে তুমি বলেছিলে, “আবার দেখা হবে রাতিনা।”
“হ্যাঁ সেজন্য আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি রাতিনা। আমি আমার কথা রাখতে এসেছি।”
“নীল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সেজন্য।” একটু থেমে বলল, ‘একসময় সবাই পরামানবকে ভয় পেতো। এখন আর কেউ পরামানবদের ভয় পায় না। সবাই জানে তারা আমাদের মত সাধারণ মানুষ।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিকই বলেছ।”
রাতিনা হঠাৎ মুখ তুলে বলল, “কিন্তু আমি শুনেছি সেই রহস্যময় পরামানব নাকি ছিল সত্যিকারের ক্ষমতাশালী। সে নাকি চোখের পলকে দুঃখী মানুষের মন ভালো করে দিতে পারতো। ভয়ংকর অপরাধীদের অচল করে দিতে পারতো, যেকোনো মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। তার চোখগুলো নাকি ছিল ঝকঝকে, দুর্বল মানুষেরা নাকি তার চোখের দিকে তাকালে অচেতন হয়ে যেতো।”
আমি কিছু না বলে রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাতিনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার না সেই রহস্যময় পরামানবের কথা খুব জানতে ইচ্ছা করে। কোথাও তার কোনো ভিডিও নেই, ছবি পর্যন্ত নেই। কী আশ্চর্য!”
আমি বললাম, “তুমি তাকে দেখতে চাও রাতিনা?”
“হ্যাঁ দেখতে চাই। অবশ্যই তাকে দেখতে চাই। সবাই তাকে দেখতে চায়।”
“কিন্তু তাকে দেখে তো তোমার খুব মন খারাপ হবে। তার মাঝে কোনো রহস্য নেই, সে খুবই সাধারণ–এতো সাধারণ যে তুমি তার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও তাকে আলাদাভাবে দেখবে না–”
রাতিনা হঠাৎ ঝট করে ঘুরে খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল, বলল, “তু-তু-তুমি সেই রহস্যময় পরামানব?”
রাতিনা কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, ফিস ফিস করে বলল, “তুমি– তুমি- তুমি?”
আমি ফিস ফিস করে বললাম, “আমি তোমার কাছে আমার কোনো কথা গোপন করতে পারব না রাতিনা। হ্যাঁ, আমি সেই রহস্যময় পরামানব।”
“তুমি?”
“হ্যাঁ আমি।”
“তুমি? তুমি?”
“হ্যাঁ রাতিনা। আমি।”
রাতিনা হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। কেন কে জানে?
***
এলা একটা অনাথ আশ্রমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এইটা সেই অনাথ আশ্ৰম।”
এলার চুল এখন আগের মত ছোট নয়; একটু বড় হয়েছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই সে আজকে একটু সেজেও এসেছে।
আমি নিজের ভেতর একটা কাঁপুনি অনুভব করলাম। রাতিনা আমার হাত ধরেছিল, সে আমার কাঁপুনিটি অনুভব করল, আমাকে বলল, “তোমার ভয় করছে নীল?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ রাতিনা। আমার ভয় করছে।”
রাতিনা আমার পিঠে হাত রাখল, বড় মানুষেরা ছোট শিশুদের পিঠে যেভাবে হাত রেখে অনেকটা সেভাবে। তারপর বলল, “নিজের মায়ের কাছে আসতে সন্তানের কোনো ভয় নেই নীল।”
“কিন্তু আমি তো কখনো তাকে দেখিনি। কেমন দেখব তো জানি না?”
“তাতে কিছু আসে যায় না নীল। মা’কে চিনতে হলে তাকে দেখতে হয় না।”
এলা অনাথ আশ্রমের দরজায় শব্দ করল, এবং সাথে সাথে খুট করে দরজটা খুলে গেল। দরজার সামনে একজন মধ্যবয়সী মহিলা, তার চুলে পাক ধরেছে। চোখ দুটো বিষণ্ণ।
এলা বলল, “আমরা অনাথ আশ্রমের ডিরেক্টরের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“এসো। ভেতরে এসো। আমি এই অনাথ আশ্রমের ডিরেকটর।”
আমি মহিলার চোখের দিকে তাকালাম। মহিলাও আমার চোখের দিকে তাকাল। মহিলার চোখে হঠাৎ কেমন জানি বিস্ময় উঁকি দেয়। ফিসফিস করে আমাকে বলল, “আমি কী তোমাকে আগে দেখেছি? তোমাকে কী আমি চিনি?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ মা। তুমি আমাকে আগে দেখেছ। আমাকে তুমি চিনো। আমি তোমার ছেলে নীল।”
আমার মা আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি দেখলাম তার চোখ দুটো খুব ধীরে ধীরে পানিতে ভরে গেল। আমার মা কাঁপা গলায় বলল, “বাবা নীল। তুমি কী আমার কাছে আসবে?”
রাতিনা আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে আমাকে সামনে ঠেলে দিল। আমি মায়ের কাছে এগিয়ে গেলাম, আমার মা আমাকে গভীর ভালোবাসায় আলিঙ্গন করে ফিস ফিস করে বলল, “আমি জানতাম তুমি একদিন আসবে। আমি তাই অপেক্ষা করেছিলাম। কতোকাল থেকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি! কতোকাল থেকে…”
আমার মা গভীর ভালোবাসায় আমাকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে রাখল এবং আমি–পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী একজন পরামানব ধীরে ধীরে একটা শিশুতে পরিণত হতে থাকলাম ৷
ছোট একটি শিশু। যার ভেতরে কোনো দুঃখ নেই কষ্ট নেই, ভয় নেই, দুর্ভাবনা নেই। যে জানে তার মায়ের বুকের চাইতে নিরাপদ কোনো জায়গা নেই। সে পরম শান্তিতে সেই নিরাপদ জায়গায় থাকবে অনন্তকাল!
অনন্তকাল।
চারটা বই নাই –
১। গ্লিনা
২। বনবালিকা
৩। প্রজেক্ট আকাশলীন
৪। নিয়ান
অনুগ্রহ করে পোস্ট করবেন।