০১. একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে

আমি পরামানব – মুহম্মদ জাফর ইকবাল / বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা ২০২২ উপলক্ষে

উৎসর্গ

প্রিয় লেখক বাদল সৈয়দ
(যাকে দেখে আমি আবার নিশ্চিত হয়েছি যে
ভালো মানুষ না হলে ভালো লেখক হওয়া যায় না!)

কয়দিন থেকে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝেই এটা ঘটে, আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। কখনো কখনো নিজেই সেই প্রশ্নের উত্তর বের করে ফেলি তবে বেশিরভাগ সময় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। এবারেও প্রশ্নটা বেশ কয়েকদিন থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু উত্তরটা খুঁজে পাচ্ছি না।

প্রশ্নটা আমার কাজ নিয়ে। আমি একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, একেবারে খুবই সাধারণ শ্রমিকের কাজ। ভোরবেলা গিয়ে আমি আমার জায়গায় দাঁড়াই। আমার সামনে দিয়ে একটা কনভেয়ার বেল্ট যেতে থাকে। প্রতি তিন মিনিটে সেই কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে একটা বিদঘুঁটে যন্ত্র এসে আমার সামনে হাজির হয়। আমার তখন রেঞ্চ দিয়ে তার একটা বোল্ট টাইট করতে হয়। তারপর যন্ত্রটা উল্টে একটা স্ক্রু খুলতে হয়; খোলার পর একটা গর্ত বের হয়ে আসে, সেই গর্তে লাল রঙের একটা ছোট টিউব ঠেসে ঢুকাতে হয়। তারপর আবার স্ক্রুটা লাগিয়ে একটা হ্যাঁন্ডেল ঘুরিয়ে দিতে হয়। এর জন্য আমার বরাদ্দ সময় তিন মিনিট। তিন মিনিটে যদি পুরো কাজটুকু শেষ করতে না পারি তাহলে আমার পয়েন্ট কাটা যায়। পয়েন্ট কাটা গেলে সপ্তাহ শেষে আমার ইউনিট কমে যায়। অল্প কয়টা ইউনিট দিয়ে আমি অনেক কষ্টে দিন কাটাই তাই ইউনিট কমে গেলে আমার খুব অসুবিধা হয়। প্রথম প্রথম তিন মিনিটে পুরো কাজ শেষ করতে পারতাম না, আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে মাঝে মাঝে বিদঘুঁটে যন্ত্রটা উল্টো হয়ে আসে কিংবা বাঁকা হয়ে আসে বলে সেটাকে আগে সোজা করে নিতে হয়–তখন আমার মূল্যবান সময় নষ্ট হয় ৷

আমার প্রশ্নটা খুবই সহজ। আমি যে কাজটা করি এটা খুব সহজেই একটা যন্ত্র করে ফেলতে পারে। আজকাল যন্ত্র চিন্তা ভাবনা পর্যন্ত করতে পারে, তাদের নাকি বুদ্ধিমত্তাও আছে। শুনেছি তাদের বুদ্ধি নাকি অনেক সময়েই মানুষ থেকে বেশি। তাহলে এই কাজটা একটা যন্ত্রকে দিয়ে না করিয়ে আমার মত একজন মানুষকে দিয়ে কেন করাচ্ছে? শুধু আমি একা না আমার মত আরো অনেক হতভাগা শ্রমিক দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই বুদ্ধিহীন কাজ করে যাচ্ছে। আমার ফ্যাক্টরির মালিক কেন এই কাজটা আমাদের দিয়ে করাচ্ছে? আমি প্রশ্নটা নিয়ে কয়েকদিন থেকে ভাবছি, তার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না।

আমরা যখন কাজ করি তখন প্রতি দুই ঘণ্টা পর আমাদের দশ মিনিটের ছুটি দেওয়া হয়। আমরা সবাই এই ছুটিটার জন্য পাগলের মত অপেক্ষা করি। ক্যাফেটরিয়ায় গিয়ে আমি আমরা চা কফি না হয় জুস খাই। এগুলো ফ্রি। কোনো ইউনিট খরচ করতে হয় না তাই দরকার না থাকলেও বেশ কয়েক মগ খেয়ে ফেলি। সেখানে অন্য শ্রমিকদের সাথে তখন আমি একটু কথাবার্তা বলি। আমি এরকম একজন শ্রমিককে আমার প্রশ্নটা করেছিলাম, তাকে দেখে আমার বেশ চালাক চতুর মনে হয়েছিল। কিন্তু কথা বলে বুঝতে পারলাম মানুষটা আমার মতই বোকা। কে জানে হয়তো আমার থেকেও বোকা। প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “তুমি কি চাও এখানে যন্ত্র লাগিয়ে তোমাকে বেকার বানিয়ে ফেলুক? আর তুমি কাজকর্ম ছাড়া রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াও!”

আমি তাকে কী প্রশ্ন করেছি আর সে তার কী উত্তর দিয়েছে! তাকে এই প্রশ্নটা করে অবশ্য আমার একটা লাভ হয়েছে, আমি বুঝতে পেরেছি মানুষের চেহারা চালাক চতুর হলেই সে চালাক চতুর হয় না। আমার চেহারায় বুদ্ধির কোনো ছাপ নেই, আমি মানুষটাও খুবই সাধারণ। লেখাপড়া করার সুযোগ পাইনি, অনাথ আশ্রমে যারা বড় হয় তারা লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। আমার বাবা মায়ের সাথে কোনোদিন দেখা হবে না, দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম আমাকে যদি অনাথ আশ্রমেই দিয়ে দেবে তাহলে আমায় জন্ম দিল কেন? আমার জন্ম না হলে এই পৃথিবীর কী ক্ষতি হতো?

আমি ক্যাফেটরিয়ায় বসে বসে ফ্রি জুস খেতে খেতে পুতুলের মত দেখতে মেয়েটাকে লক্ষ্য করি। এই মেয়েটি এখানে একেবারে বেমানান, তার আরো কোনো ভালো জায়গায় থাকার কথা। দেখে মনে হয় মেয়েটার মনে কোনো এক ধরনের দুঃখ আছে। আমি মেয়েটার সাথে এক দুইদিন ভাব করার চেষ্টা করেছি, কোনো লাভ হয়নি। এখন আমাকে দেখলে না দেখার ভান করে সরে যায়। আমি অবশ্য মেয়েটাকে কোনো দোষ দেই না, কেন মেয়েটি আমার কাছে আসবে? আমি অশিক্ষিত শ্রমিক, আমার চেহারাও

ভালো না, চেহারার মাঝে বুদ্ধিমত্তার ছাপ নেই। অনাথ আশ্রমে অন্য অনাথ ছেলেমেয়েদের মার খেয়ে খেয়ে অপমান সহ্য করতে করতে বড় হয়েছি। কোনোদিন আমার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিল না, মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি জানি না। শুধু মেয়েদের সাথে কেন, অপরিচিত মানুষের সাথেও কথা বলতে পারি না। আমার নিজেরই অবাক লাগে, আমার জন্ম হয়েছে কেন আর আমি এত কষ্ট করে বেঁচে আছি কেন? মাঝে মাঝে আমি কল্পনা করি হঠাৎ কোনোদিন কোনোভাবে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ হয়ে যাব–কীভাবে সেটা হবে আমি জানি না। তবু আমি কল্পনা করি, কল্পনা করতে তো কোনো দোষ নেই।

আমি দ্বিতীয় মগ জুস খেতে খেতে শুনতে পেলাম কাজে ফিরে যাওয়ার বেল বেজেছে। আমি জুসটা গলায় ঢেলে আমার জায়গায় হাজির হলাম। একটা একটা করে যন্ত্র আসতে শুরু করল, আমিও যন্ত্রের মত কাজ করতে থাকি। কী করছি কিছুক্ষণ পরে নিজেরও খেয়াল থাকে না, নিজেই যেন একটা যন্ত্র হয়ে যাই। একটা যন্ত্র অন্য যন্ত্রকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কী অর্থহীন একটা জীবন!

***

আজকে সপ্তাহ শেষে আমার একাউন্টে ইউনিট জমা হয়েছে। এই সপ্তাহে কাজে কোনো ভুল হয়নি বলে পুরো ইউনিট জমা হয়েছে তাই সুপার মার্কেট থেকে একটা বড় সসেজ আর স্ট্রবেরি চকলেট আইসক্রিম কিনে ফেললাম। আমার এপার্টমেন্টের কুলিং চেম্বার ভালো কাজ করে না তাই ছোট একটা বাক্স আইসক্রিম কিনেছি। যখন রেটিনা স্ক্যান করে সসেজ আর আইসক্রিমের দাম দিচ্ছি তখন লাইনে দাঁড়ানো আমার পিছনের মেয়েটি বলল, “স্ট্রবেরি চকলেট আইসক্রিম! আমারও ফেবারিট।”

আমি মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটাকে দেখলাম, মাথায় কালো চুল ছোট করে কেটে রেখেছে। আমার দিকে তাকিয়ে ভালো মানুষের মত হাসল। অপরিচিত একজন মেয়ে যখন পরিচিত ভঙ্গিতে হাসে, কোনো একটা কথা বলে তখন উত্তরে কী বলতে হয় আমি জানি না। তাই আমি একটু হাসার চেষ্টা করে সুপারশপ থেকে বের হয়ে এলাম। আমি বহুদিন হাসি না, তাই আমার হাসার চেষ্টাটুকু কতটুকু কাজ করেছে আমি জানি না।

আমি আমার এপার্টমেন্টে ফিরে কিছুক্ষণ ভিডি টিউবে একটা অত্যন্ত বাজে অনুষ্ঠান দেখলাম, প্রতিদিনই দেখি। কেন দেখি নিজেও জানি না ৷ তারপর খাবার প্রক্রিয়া করার চেম্বারে সসেজটা ঢুকিয়ে সামনের বোতামগুলো টিপে দিলাম, সস্তা চেম্বারটি বিকট শব্দ করে আমার সসেজটা রান্না করতে শুরু করল। আমি আইসক্রিমের ছোট প্যাকেটটি কুলিং চেম্বারে রেখে দিলাম। রাতের খাওয়া শেষ করে আইসক্রিমটা খাব, বহুদিন আইসক্রিম খাই না ৷

আমি আমার বাইরের কাপড় খুলব নাকি খুলব না যখন সেটা ভাবছি তখন আমার দরজায় শব্দ হল।

আমি চমকে উঠলাম। আমার কাছে বহুদিন কেউ আসে না। কেউ যদি আসতেও চায় সে ভিডি-ফোনে যোগাযোগ করে। দরজায় শব্দ করা অত্যন্ত বিচিত্র ঘটনা। কে আমার দরজায় ধাক্কা দিতে পারে এবং কেন ধাক্কা দিতে পারে আমি যখন সেটা চিন্তা করার চেষ্টা করছি তখন আবার দরজায় ধাক্কার শব্দ হল, এবারে আগের থেকে জোরে এবং আগের থেকে ব্যস্ত ভাবে ৷

আমি কৌতূহলি হয়ে দরজা খুলে একটুখানি ফাঁক করেছি তখন একটা বিশাল মানুষ আমার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী চাও? তুমি কাকে চাও?”

বিশাল মানুষটা ভিতরে ঢুকে গমগমে গলায় বলল, “তোমাকে।”

ঠিক তখন বিশাল মানুষটার পিছনে পিছনে একটা মেয়ে এসে ঢুকল, মেয়েটার চুল ছোট করে কাটা, আজকে সুপার মার্কেটে যে আমার আইসক্রিমটা দেখে বলেছিল এটা তারও পছন্দের আইসক্রিম। সে কেন এখানে?

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসল, যেন আমি তার কত পরিচিত। তারপর বিশাল আকৃতির মানুষটাকে বলল, “ইগর, একে তুমি বেঁধে ফেল।”

“বেঁধে ফেলবে?” আমি চিৎকার করে বললাম, “বেঁধে ফেলবে কেন?”

মেয়েটা বলল, “আগে মুখটা বাঁধো। এ বড় বেশি চেঁচায়।”

আমি চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ইগর নামের বিশাল মানুষটা সত্যি সত্যি পকেট থেকে রুমালটা বের করে আমরা মুখটা বেঁধে ফেলল, আমি এখন কোনো কথা বলতে পারি না, শুধু গোঁ গোঁ করে শব্দ করতে পারি। সেই শব্দ করে কি লাভ হবে কে জানে তাই তার চেষ্টা করলাম না।

মানুষটা পাহাড়ের মত বিশাল হাত দিয়ে চাপ দিয়ে আমার মাথাটা পুট করে ফাটিয়ে ঘিলু বের করে ফেলতে পারে। সে খুবই দক্ষভাবে আমার দুই হাত বেঁধে ফেলল। তারপর চেয়ারে বসিয়ে দিল।

আমি পা দিয়ে এক দুইটা লাথি মারার চেষ্টা করলাম সেটা দেখে– মেয়েটা মাথা নেড়ে একটু হতাশার ভাব করল তারপর বলল, “পা দুটিও বেঁধে ফেল।”

মানুষটা তখন চেয়ারের সাথে আমার পা দুটি বেঁধে ফেলল।

আমি বলার চেষ্টা করলাম, “তোমরা কারা? কী চাও?” কথাগুলো শোনা গেল না, অস্পষ্ট একটা গোঙ্গানীর মত শব্দ হল।

মেয়েটা বলল, “তুমি মনে হয় জিজ্ঞেস করছ আমরা কী চাই। আমি তোমাকে বলতে পারি কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আমি যতদূর জানি তোমার বুদ্ধিমত্তা খুবই নিম্নস্তরের।”

মেয়েটা আবার আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, যেন আমার বুদ্ধিমত্তা নিম্নস্তরের হওয়া খুবই একটা আনন্দের ব্যাপার। তারপর তার পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা খুলে সেটা আমার টেবিলে রাখল। ব্যাগটা খুলে একটা ভিডিও স্ক্রিন বের করে টেবিলে আমার সামনে রাখল। তারপর আমার দিকে

তাকিয়ে বলল, “তোমাকে আমি একটা ভিডিও ক্লিপ দেখাব। পনেরো মিনিটের ক্লিপ। আমাদের তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে সেই ভিডিও ক্লিপ দেখে তুমি পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যাবে।”

আমি গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ করলাম। মেয়েটা সেটাকে কোনো গুরুত্ব দিল না, বলল, “তোমার সারা শরীরে খিঁচুনি হবে, হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করবে, রক্তচাপ বেড়ে যাবে, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবে, মনে হবে সারা শরীর কেউ ফালা ফালা করে কাটছে, তোমার ঠিকভাবে ভাবার কোনো ক্ষমতা থাকবে না, যদি থাকতো তাহলে তুমি ভাবতে কেন তুমি বেঁচে আছ, কেন তুমি মরে যাচ্ছ না–”

আমি আবার গোঁ গোঁ করে শব্দ করলাম, বলার চেষ্টা করলাম, “কি বলছ তুমি–”

মেয়েটা আমার অস্পষ্ট কথাকে এবারেও কোনো গুরুত্ব দিল না, বলল, “তুমি বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে নাকি মরে যেতে চেষ্টা করবে, তোমার ইচ্ছা–”

আমি তখনও বুঝতে পারছি না এটা কী একধরনের উৎকট রসিকতা নাকি মেয়েটা সত্যি কথা বলছে? যদি সত্যি কথা বলছে তাহলে কেন এই অবিশ্বাস্য কথাগুলো বলছে? আমি কী করেছি?

আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম ইগর খাবার প্রক্রিয়া করার চেম্বারটা খুলে আমার আধা রান্না করা সসেজটা বের করে খেতে শুরু করেছে। মেয়েটা বলল, “ইগরের খিদে বেশি। তা ছাড়া আজ রাতে তুমি আর কিছু খেতে পারবে না। সসেজটা নষ্ট করা ঠিক হবে না।” তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, “তোমার আইসক্রিমটা কী খেয়ে ফেলেছ?”

আমি মাথা নাড়লাম, বোঝানোর চেষ্টা করলাম, খাইনি। মেয়েটা কুলিং চেম্বার খুলে আইসক্রিমের প্যাকেটটা বের করে বলল, “তুমি রাতে এটাও খেতে পারবে না। এটা নষ্ট করা ঠিক হবে না। তোমার কুলিং চেম্বারের যে অবস্থা কাল ভোরে এটা গলে যাবে।”

তারপর প্যাকেটটা খুলে খানিকটা আইসক্রিম মুখে দিয়ে বলল, “অসাধারণ।”

আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই এগুলো কী ঘটছে?

মেয়েটা আমার দিকে তাকাল, এই প্রথম মেয়েটাকে একটু বিষণ্ন একটু দুঃখী দেখা গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে ভিডিওটা শুরু করি?”

আমি গোঁ গোঁ শব্দ করে আপত্তি জানালাম। কিন্তু মেয়েটা সেটা শুনল না, শুনলেও কোনো গুরুত্ব দিল না। মেয়েটা তার ভিডিও স্ক্রিনটা চালিয়ে দিল।

প্রথমে ভিডিও স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর ঠিক মাঝখানে একটা অস্পষ্ট বিন্দু দেখতে পেলাম। বিন্দুটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল তারপর বড় হতে শুরু করল। হালকা নীল রঙের বিন্দুটির রং আস্তে আস্তে গাঢ় লাল রং হয়ে যায় তারপর বৃত্তাকার বিন্দুগুলো থেকে একটার পর একটা বৃত্তাকার আলোর ছটা ভিডিও স্ক্রিনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং আমি খুব হালকা একটা শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটিতে কোনো সুর নেই কিন্তু তারপরেও বিচিত্র এক ধরনের তাল আছে। ভিডিও স্ক্রিনের বৃত্তগুলো এখন একটার সাথে আরেকটা যুক্ত হয়ে একটা ত্রিমাত্রিক রূপ নিতে থাকে এবং ভিডিও স্ক্রিন থেকে বের হয়ে সেই ত্রিমাত্রিক নকশা আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

আমি তখন আমার মাথার ভেতরে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলাম। ব্যথাটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং কিছু বোঝার আগেই মনে হয় মাথাটি ছিঁড়ে পড়ে যাবে, ভেতরে কী যেন দপ দপ করতে থাকে। আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম, পারলাম না, আমার ভেতরে কিছু একটা জোর করে আমার চোখ দুটো খুলে রাখল। আমাকে দেখতে হবে, সবকিছু দেখতে হবে। আমাকে শুনতে হবে, সব কিছু শুনতে হবে।

আমার অনুভূতি কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আসে। আমি বুঝতে পারছি না আমি কোথায়। মনে হতে থাকে আমি ভাসছি, ভাসতে ভাসতে আমি যেন ওপরে উঠে যাচ্ছি তারপর হঠাৎ নিচে পড়ে যেতে থাকি। আমি পড়ে যাচ্ছি–পড়ে যাচ্ছি–পড়ে যাচ্ছি–কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছি না–প্রাণপণ চেষ্টা করছি চিৎকার করার জন্য কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।

হঠাৎ করে আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠল, মনে হল কেউ ধারাল ছুরি দিয়ে আমার শরীরটা গেঁথে ফেলছে। আমার হাত-পাগুলো ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে, কুণ্ডুলি পাকিয়ে যাচ্ছে তারপর খুলে যাচ্ছে, ঢেউয়ের মত যন্ত্রণা আমার আঙুলের ডগা থেকে শুরু করে শরীরটাকে কুরে কুরে ভেতরের দিকে আসতে থাকে। মনে হতে থাকে জ্বলন্ত কয়লা ওপর থেকে আমার শরীরে ঝরে ঝরে পড়ছে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আমি আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাই সেটা ধ্বক ধ্বক করছে। মনে হয় তার তীব্র শব্দ আমার

কানের পর্দা ফাটিতে দিবে। আমি দুই হাতে আমার কান বন্ধ করে ফেলতে চাই কিন্তু পারি না। আমার হাত-পা পাথরের মতন ভারী সেগুলো নাড়ানোর ক্ষমতা আমার নাই।

আমি হঠাৎ একটা আর্তনাদ শুনতে পেলাম, কে আর্তনাদ করছে? একটা শিশু। শিশুটি কোথায়? আমি এই শিশুটিকে চিনি। এই শিশুর আর্তনাদ আমি অনেকবার শুনেছি। এই শিশুটি আমি-অনাথ আশ্রমে

আমাকে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে যখন বড় বড় ছেলেমেয়েরা আমাকে অত্যাচার করত আমি তখন এভাবে আর্তনাদ করতাম। আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি, আমি অন্ধকার ঘরে প্রচণ্ড আতংকে থর থর করে কাঁপছি। থর থর করে কাঁপছি। কষ্ট, আহা–কী কষ্ট। কী কষ্ট! আমি কোথায় যাব?

আমার মাথার ভেতর পুরো জীবনের স্মৃতিগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। নিষ্ঠুর স্মৃতি, ভয়ংকর স্মৃতি। আতংকের স্মৃতি। আমি পালিয়ে যেতে চাই কিন্তু আমি পালাতে পারছি না। আমি মরে যেতে চাই কিন্তু আমি মরতে পারছি না। মেরে ফেলো। কেউ একজন মেরে ফেলো। ঈশ্বরের দোহাই, কেউ মেরে ফেলো।

কিন্তু আমাকে কেউ মেরে ফেলল না। আমি পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে থর থর করে কাঁপছি। থর থর করে কাঁপছি।

ঘুম ভাঙার পর আমার অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায় আছি, কেন আছি। ধীরে ধীরে আমার সবকিছু মনে পড়ল এবং তখন আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

কাল যারা আমাকে বেঁধে রেখে একটা ভিডিও দেখিয়েছে তারা যাবার সময় আমাকে বিছানায় শুইয়ে গেছে। শেষের দিকে আমি নিশ্চয়ই অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম, আমার কিছু মনে নেই।

আমার মাথায় একটা ভোঁতা ব্যথা, সমস্ত শরীরে অবসাদ এবং পেটে ভয়ংকর খিদে। আমি বিছানা থেকে নেমে আসি, আমি জানি বাসায় কোনো খাবার নেই। যে খাবার কিনে এনেছিলাম বিশাল মানুষটা এবং ছোট করে চুল কাটা মেয়েটা সেগুলো খেয়ে ফেলেছে। আমি আমার মূল্যবান ইউনিট খরচ করে ভিডি ফোনে একটু খাবার অর্ডার দিতে পারি, গতকাল থেকে যা যা ঘটেছে তারপর একটু বেহিসাবি ইউনিট খরচ করলে ক্ষতি নেই।

আমি খাবার অর্ডার দিয়ে বাথরুমে গেলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটু অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখে নিজেকে ভিন্ন একটা মানুষের মত মনে হয়, কারণটা কী কে জানে।

বেশ কিছুক্ষণ থেকে মনে হচ্ছিল আমি মাথার ভেতরে অনেক মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি। স্পষ্ট কোনো কথা নয় কিন্তু এক ধরনের কথা তাতে সন্দেহ নেই। সবসময় যে শুনতে পাচ্ছি তা নয়, যদি খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি তাহলে আবছা আবছা শুনতে পাই। একটু অন্যমনস্ক হলেই আর সেগুলো শুনতে পাই না।

আমি গতরাতের পোষাক পাল্টে নিলাম, যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছি সেই তুলনায় আমি যে খুব খারাপ অবস্থায় আছি তা নয়। ভালো করে খেয়ে নেওয়ার পর আমি মনে হয় সময়মতো কাজেও যেতে পারব।

কিছুক্ষণের মাঝে আমার খাবার চলে এলো, আমি বুভুক্ষের মতো সেগুলো খেলাম, উত্তেজক পানীয়টা খাওয়ার পর আমার শরীরটা ঝরঝরে লাগতে থাকে। আমি তখন কাজে রওনা দিলাম। আমার নিজের ভিতর কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তনটা কী আমি ধরতে পারছি না। একটু পরে পরে মনে হচ্ছে আমি একজন ভিন্ন মানুষ।

.

একশ সাত তালা থেকে লিফট দিয়ে নামার সময় লিফটে আমার সাথে আরো একজন ছিল। এই এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে আমার মতো হতদরিদ্র মানুষেরা থাকে, তাদের জীবনে কোনো ছিরিছাদ নেই। লিফটের যাত্রী মানুষটাকে দেখেই বোঝা যায় তার জীবনটাও কঠিন, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে কেমন জানি যন্ত্রণার ছাপ। মানুষটা নিরাসক্ত ভাবে সামনে তাকিয়ে ছিল, আমাকে দেখেও তার কোনো ভাবান্তর হল না। লিফট থামতে থামতে যাচ্ছে এবং তখন হঠাৎ আমি একটা কুৎসিত গালি শুনতে পেলাম। কান দিয়ে শুনিনি সরাসরি মস্তিষ্কে শুনেছি, কে এই কুৎসিত গালিটি দিয়েছে? আমার হঠাৎ একটা বিচিত্র জিনিস মনে হল, এই মানুষটা কী মনে মনে এই গালিটি দিয়েছে? আমি কী সেটা কোনোভাবে বুঝে ফেলেছি? কিন্তু এটা কী সম্ভব?

আমি মানুষটার মুখের দিকে তাকালাম তখন দ্বিতীয়বার গালিটি শুনতে পেলাম। মানুষটি আমার দিকে তাকাল তারপর বলল, “মেজাজটা ভালো নেই।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন, কী হয়েছে?”

“আমার ইউনিটগুলো নিয়ে গার্লফ্রেন্ড পালিয়ে গেছে।” মানুষটা এবারে স্পষ্ট উচ্চারণে সেই কুৎসিত গালিটি দিল, তার গার্লফ্রেন্ডকে লক্ষ্য করে।

আমি মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, “আমাদের সবার জীবনেই এরকম খারাপ দিন আসে। যখন ভালো দিন আসে তখন এই খারাপ দিনগুলোর কথা মনে থাকে না।”

মানুষটা কেমন জানি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, তার কঠিন মুখের মাংসপেশী কেমন জানি শিথিল হয়ে আসে, সে একটুখানি হাসল বলল, “ধন্যবাদ বন্ধু! তুমি আমার মনটা ভালো করে দিয়েছ। আমি জানি তুমি আমাকে ভালো অনুভব করানোর জন্য বলেছ, কিন্তু বলেছ খুব সুন্দর করে। তোমাকে ধন্যবাদ।”

লিফট থামার পর অপরিচিত এই মানুষটা আমার সাথে হাত মিলিয়ে চলে গেল। তার শেষ কথাটা আমার মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে, মানুষটা বলেছে যে আমি কথাটি বলেছি খুব সুন্দর করে। কিন্তু আমি সারাজীবনে কখনো সুন্দর করে কিছু বলিনি, সুন্দর করে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি জানি না। মানুষের মন ভালো করতে হয় কীভাবে সেটা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই। তাহলে কেমন করে আমি এই হতভাগ্য মানুষটার মন ভালো করে দেওয়ার জন্য সুন্দর করে কথা বললাম? আমি কেমন করে পারলাম? আমার ভিতরে কী হয়েছে?

আমার ফ্যাক্টরি শহরের বাইরে, অনেক দূরে। কিন্তু ম্যাগলেভ ট্রেনে যেতে একেবারেই সময় লাগে না। বাসা থেকে ট্রেন স্টেশনে যেতে যেটুকু সময় লাগে সেটুকু সময় হাতে নিয়ে রওনা দিতে হয়। আমি শহরের দরিদ্র এলাকায় থাকি। চালচুলোহীন হতদরিদ্র মানুষেরা এখানে থাকে। আমি যখন কাজে যাই প্রতিদিন এই মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে যাই। আমি নিজেও তাদের মত একজন তাই তাদের দেখে আমার কখনো আলাদাভাবে কিছু মনে হয়নি কিন্তু আজ হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন হাজির হল। এই মানুষগুলো দরিদ্র কেন? পৃথিবীতে তো কোনো মানুষের দরিদ্র থাকার কথা না!

আমি যখন মানুষগুলোকে আলাদাভাবে লক্ষ্য করতে করতে হাঁটছি তখন হঠাৎ হঠাৎ আমি এক দুইটা শব্দ শুনতে থাকি। ঠিক কান দিয়ে শোনা নয়, সরাসরি মাথার ভেতরে শোনা, একটু আগে লিফটের ভেতর যেভাবে শুনেছিলাম। একটু মনোযোগ দিলে অনেক মানুষের কথা শোনা যায় একেবারে কোলাহলের মত, আমার প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, খুব তাড়াতাড়ি তখন অন্য কোথাও মনোযোগ দিতে হয়। একজন দুইজনের কথা শোনা যায় কিন্তু একসাথে অনেক মানুষের কথা শুনলে মাথায় কেমন যেন চাপ পড়ে। আমার ঠিক কি হয়েছে? ছোট করে চুল কাটা মেয়েটাকে পেলে জিজ্ঞেস করা যেত। তাকে কোথায় পাব?

ফ্যাক্টরিতে ঢুকে স্ক্যান করিয়ে আমার জায়গায় যাওয়ার সময় একজন গার্ড আমাকে থামাল। আমার হাতে একটা ছোট টোকেন ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আজকে কাজে যেতে হবে না। হলঘরে যাও।”

“হলঘরে? হলঘরে কেন?”

“গেলেই দেখবে।”

আমি আগে কখনও ফ্যাক্টরির হলঘরে যাইনি। টোকেনটি ছোট একটা আলো জ্বালিয়ে আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে লাগল। যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম অন্য সব শ্রমিকেরাও হলঘরে যাচ্ছে। সবার চেহারায় একটুখানি উদ্বেগের চিহ্ন। এমন কী হতে পারে যে হলঘরে নিয়ে বলে দেবে আজ থেকে আমাদের চাকরি নেই, কাল থেকে আর কাজে আসতে হবে না?

হলঘরে গিয়ে দেখলাম আমার সিটটি পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটির পাশে। এই মেয়েটিও উদ্বিগ্ন চেহারায় বসে আছে। আমাকে দেখে দুর্বলভাবে একটু হাসার চেষ্টা করল।

আমি জানি মেয়েটা আমার থেকে দূরে দূরে থাকতে চায় তাই নিজ থেকে কোনো কথা বললাম না। একটু অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটাই মাথা ঝুঁকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি জান আমাদেরকে কেন এখানে এনেছে?”

“না জানি না। তুমি জান?”

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “জানি।”

“কেন?”

“আমাদের ভিতর কোনো পরামানব আছে কিনা দেখবে।”

“পরামানব? সেটা কী?”

মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি পরামানবের কথা জান না?”

“না।”

“কী আশ্চর্য! সবাই জানে ৷”

জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী?”

“এরা বিশেষ ধরনের মানুষ। এরা অন্যের মাথায় ঢুকে তাদের চিন্তা শুনতে পারে।”

আমি হঠাৎ ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলাম না। আজ ভোর থেকে আমি হঠাৎ হঠাৎ মানুষের চিন্তা শুনতে পাচ্ছি। এমন কী এখন স্পষ্ট শুনলাম মেয়েটা বলল, “কী আজব মানুষ!” আমার সম্পর্কে বলছে! বলতেই পারে। আমি কী তাহলে পরামানব? আমার মত মানুষ খুঁজে বের করবে?

আমি আমার শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে বললাম, “পরামানব বের করে তাদের কী করবে?”

“মনে হয় মেরে ফেলবে।”

আমি প্রায় আর্তনাদ করে বললাম, “মেরে ফেলবে?”

“হ্যাঁ দেখছ না, মিলিটারির মানুষ হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”

আমি দেখলাম একটু পরে পরে মিলিটারির মত মানুষ হাতে ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি জানি উত্তরটা কী হবে, তারপরেও মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “পরামানবকে কেমন করে বের করবে?”

“একটা গোপন ভিডিও আছে। সেটা দেখাবে। যারা পরামানব তাদের ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে–পাগল হয়ে যায়–”

আমি জানি। আমাকে গতরাতে ভিডিওটা দেখিয়েছে। আমি পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন আবার একই ব্যাপার ঘটবে? তখন মিলিটারি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে? আমি কী এখন উঠে একটা দৌড় দেব? পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব?

মেয়েটা বলল, “একবার পরামানব হয়ে গেলে অবশ্য আর ধরতে পারে না।”

“কী বললে? কী বললে তুমি?” আমি তার কথা শুনে চমকে উঠলাম,

“পরামানব হয়ে গেলে ধরতে পারে না?”

“না। তখন এই ভিডিও দেখে তাদের কিছু হয় না।”

“কিছু হয় না? কেন কিছু হয় না?”

আমি শুনলাম মেয়েটা মনে মনে বলল, “ইস! এই মানুষটা দুনিয়ার

কোনো খবর রাখে না। একেবারে হাবাগোবা।”

আমি হাবাগোবা হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, “পরামানব হয়ে গেলে ভিডিও দেখে কিছু হয় না কেন?”

“যারা পরামানব হয়ে জন্ম নেয় তারা জানে না যে তারা পরামানব। এই ভিডিওটা পরামানবেরা তৈরি করেছে পরামানব ক্ষমতাটা মস্তিষ্ক থেকে বের করে আনার জন্য। একবার ক্ষমতাটা বের হয়ে গেলে তখন আর এটা দরকার হয় না।”

“কী আশ্চর্য!”

মেয়েটা আমার দিকে তাকাল। বলল, “আশ্চর্য কী জান?”

“কী?”

“যে তুমি এর কিছু জান না। পৃথিবীর সবাই জানে। একটা বাচ্চা ছেলেও জানে!”

আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম, বললাম, “আসলে আমি তো একজন স্বাভাবিক মানুষের মত বড় হইনি তাই এগুলো জানার সুযোগ হয়নি।”

“তুমি কোথায় বড় হয়েছ?”

“একটা অনাথ আশ্রমে।” আমি দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করলাম, বললাম, “আমি ছিলাম অনাথদের মাঝে অনাথ। আমি যে বেঁচে আছি সেটাই আশ্চর্য!”

মেয়েটা নরম গলায় বলল, “দুঃখিত। আমি খুবই দুঃখিত।”

ঠিক তখন সামনে মঞ্চে একজন মিলিটারি মহিলা উঠে দাঁড়াল, তার কাছ যে পরিমাণ অস্ত্র আছে সেটা দিয়ে সে ইচ্ছা করলে হলঘরের সবাইকে মেরে ফেলতে পারবে!

মহিলাটি বলল, “এখন আমরা তোমাদের জিনিৎস্কী ভিডিওটা দেখাব। তোমরা যারা এখনও জিনিৎস্কী ভিডিও কী জান না, তাদেরকে বলছি, এটি হচ্ছে পরামানব মস্তিষ্ককে মুক্ত করার ভিডিও। যদি তোমাদের ভেতর কোন পরামানব আছ কিন্তু এখনও তোমাদের পরামানব মস্তিষ্ক মুক্ত হয়নি তাদের মস্তিষ্ক এখন অবমুক্ত হবে। আমি তোমাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।”

মহিলাটি তার হাতের অস্ত্রটি নিয়ে একটি ঝাঁকুনি দিল, কী ভয়ংকর দৃশ্য।

একজন কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেন দুঃখ প্রকাশ করছ?”

মহিলাটির মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, সেটা গোপন করার কোনো চেষ্টা না করে সেই মিলিটারি মহিলা বলল, “কারণ সে পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যাবে, সে হিংস্র পশুর মত হয়ে যাবে এবং তখন তাকে গুলি করে থামাতে হবে।”

হলঘরের মানুষগুলো কেমন যেন শিউরে উঠল।

মিলিটারি মহিলা বলল, “কাজেই তুমি যদি দেখ তোমার পাশে বসা মানুষটি থরথর কাঁপতে শুরু করেছে, গোঙ্গাতে শুরু করেছে চিৎকার শুরু করেছে তাহলে তোমরা শক্ত হয়ে নিজের সিটে বসে থাকবে, নড়বে না, কথা বলবে না। আমাদের সিস্টেম প্রত্যেকটা মানুষকে আলাদাভাবে দেখছে কাজেই আমাদের যে কাজ করার কথা আমরা সেটা করব।”

মহিলাটি আবার তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি একবার ঝাঁকুনি দিল। তারপর বলল, “আমি সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছি, তোমরা কেউ চোখ বন্ধ করে থাকবে না। তাহলে আমাদের স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম কোনো একটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে যার জন্য আমরা কেউ দায়ী থাকব না ৷’

আমি মহিলাটির দিকে তাকিয়েছিলাম এবং মনে হল পরিষ্কার শুনতে পেলাম, মহিলাটি বলছে, “হেই ঈশ্বর, একটা পরামানব বের করে দাও, গুলি করে ঘিলু বের করে দেই। কতোদিন কাউকে গুলি করি নাই।”

কী ভয়ংকর একটা কথা! মহিলাটি কি সত্যিই এরকম ভাবছে নাকি আমি কল্পনা করছি?

আমার পাশে বসে থাকা পুতুলের মত মেয়েটা ফিস ফিস করে বলল, “ভয় লাগছে! আমার খুব ভয় লাগছে।”

“কেন? ভয় লাগছে কেন?”

“যদি এখানে একজন পরামানব বের হয়ে যায় তাহলে কী হবে?”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, মেয়েটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম বললাম, “বের হবে না। নিশ্চয়ই বের হবে না।”

আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম, তার চেহারায় এক ধরনের আতংক, সে যদি জানতো তার পাশে যে মানুষটি আছে সে একজন পরামানব তাহলে সে কী করতো?

হলঘরের আলো কমে এলো এবং প্রথমে বড় স্ক্রিনটাতে সতর্কবার্তা দেখানো হল। তারপর পরামানব থেকে সতর্ক থাকার কিছু নিয়মাবলী দেখানো হল। তারপর পরামানবকে কীভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে সে রকম কিছু তথ্য দেখানো হল। তারপর বিখ্যাত জিনিৎস্কী ভিডিওটা দেখানো শুরু হল। আমি গতরাতেই এটা দেখেছি।

আমি নিজের ভেতর এক ধরনের চাপা আতংক অনুভব করি, যদি পাশে বসে থাকা মেয়েটার কথা সত্যি না হয়, যদি আজকেও এই ভিডিওটা দেখে আমি উন্মাদ হয়ে যাই তাহলে কী হবে? আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি ৷

স্ক্রিনটি অন্ধকার, ঠিক মাঝখানে একটা আলোক বিন্দু। বিন্দুটা বড় হতে থাকে, হালকা নীল থেকে ধীরে ধীরে গাঢ় লাল রঙের একটি বৃত্ত স্ক্রিনের ভেতর দেখা গেল। তারপর সেখান থেকে আরো বৃত্ত বের হয়ে আসে, ধীরে ধীরে স্ক্রিনের মাঝে সেই বৃত্তগুলো ছোটাছুটি করতে থাকে। সেগুলো একটি ত্রিমাত্রিক রূপ নিয়ে সেটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে।

আমি বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি খুব সাবধানে বের করে দিলাম। না, আমি গতকালকের মতো উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি না। আমি ভিডিওটি দেখতে পারছি এবং আমার ভেতর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। মিলিটারি মহিলাটি গুলি করে আমার ঘিলু বের করে দিবে না। আমি বেঁচে গেছি।

ঠিক তখন হলঘরের এক কোণায় একটা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। মুহূর্তের মাঝে গুঞ্জনটি প্রথমে কোলাহল তারপর একজন মেয়ের আর্তচিৎকারে পাল্টে গেল। হলঘরের আবছা অন্ধকার তার মাঝে দেখতে পেলাম একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে যেতে চেষ্টা করছে। পর মুহূর্তে একটা গুলির শব্দ শুনতে পেলাম, হলঘরের ভেতর গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে থাকে। হঠাৎ করে পুরো হলঘরে একটি বিস্ময়কর নীরবতা নেমে আসে শুধু তার মাঝে একজনের কাতর মৃত্যু যন্ত্রণার শব্দ শোনা যেতে লাগল। হলঘরের আলো জ্বলে উঠল, তীব্র আলোতে সমস্ত হলঘরটিকে একটা অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুর রঙ্গমঞ্চ বলে মনে হয়। আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটি দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে, “না, না, না, এটা হতে পারে না-হতে পারে না।”

আমি দেখতে পেলাম মিলিটারি মহিলাটি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে মঞ্চে ফিরে এসেছে। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কারো কোনো ভয় নেই ৷ পরামানবটিকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে।”

অকার্যকর! আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না, একটা মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে তাকে অকার্যকর করা? আমি হতবাক হয়ে মিলিটারি মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। দাঁতে দাঁত ঘষে নিজের অজান্তেই মনে মনে বললাম, “রাক্ষুসী!”

আর কী আশ্চর্য! সাথে সাথে ঝট করে মিলিটারি মহিলাটি ঘুরে তাকালো। আমার স্পষ্ট মনে হল সে আমার কথাটি শুনতে পেয়েছে। হঠাৎ করে তার মুখে আতংকের একটা ছাপ পড়লো, সে তার অস্ত্রটি হলঘর বোঝাই মানুষের দিকে তাক করে ধরে, দেখে মনে হয় গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলবে।

আমার কী হল জানি না, মহিলাটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, “তুমি যেভাবে মেয়েটিকে গুলি করে মেরেছ, একদিন তোমাকে ঠিক এইভাবে গুলি করে মারা হবে। রাক্ষুসী ডাইনী তুমি ৷”

মহিলাটি আতংকে চিৎকার করে ওঠে, তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উপর দিকে তুলে সে গুলি করতে থাকে। আশেপাশে দাঁড়ানো অস্ত্র হাতে অন্য মানুষগুলো ছোটাছুটি করতে থাকে, মুহূর্তের মাঝে পুরো হলঘরটিতে হই চই চিৎকার কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়।

কয়েকজন মিলিটারি মহিলাটির দিকে ছুটে গেল। মহিলাটি তখনও তার হাতের অস্ত্রটি হলঘর ভরা মানুষের দিকে তাক করে রেখেছে। দেখে মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে গুলি করে দেবে। শুনলাম সে অন্যদের বলছে, “এখানে আরেকজন পরামানব আছে। আমি কণ্ঠ শুনেছি সে আমাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে!”

এতক্ষণে একজন বড় মিলিটারি অফিসার চলে এসেছে, সে আমাদের দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল, “যে যেখানে আছ বসে থাক। নড়বে না। আমরা জানতে পেরেছি এখানে আরেকজন পরামানব আছে। আমরা সেই পরামানবটাকে খুঁজে বের করব। যেকোনো মূল্যে।”

পুরো হলঘরের সব মানুষ একসাথে একটা আতংকের মত শব্দ করল।

***

মিলিটারি অফিসার যদিও দাবি করেছিল যেকোনো মূল্যে পরামানবটিকে খুঁজে বের করবে, কিন্তু তারা আমাকে ধরতে পারল না। কীভাবে ধরবে? আমার দৈনন্দিন জীবনের মত একঘেয়ে জীবন করো নেই। দিনের পর দিন মাসের পর মাস আমি ফ্যাক্টরিতে একই নিরানন্দ কাজ করে গেছি, কাজ শেষে নিজের ঘুপচির মত এপার্টমেন্টে ফিরে গেছি। এই জীবনে কোনো বৈচিত্র্য নেই, আমার কথাবার্তা চালচলনে কোনো বুদ্ধিমত্তার ছাপ নেই, আমার সম্পর্কে অন্য কোনো শ্রমিক বলার মত একটি কথাও খুঁজে পায়নি।

আমি কেমন করে পরামানব হব? বিকেলের দিকে আমি ছাড়া পেয়ে গেলাম।

ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে আমি মনে হয় একশ পাও যাইনি, তখন হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা মোটরবাইক ছুটে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমি প্রায় ছিটকে গিয়ে পড়েছি, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম পায়ের উপর দিয়ে মোটরবাইকটা ছুটে গেছে, পা নিশ্চয়ই গুড়ো হয়ে গেছে–ঘটনাটা বোঝার আগেই সবকিছু ঘটে গেছে। যখন পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছি তখন আমি রাস্তায় শুয়ে আছি, আমাকে বেশ কিছু মানুষ ঘিরে আছে, যার ভেতরে অনেকেই আমার ফ্যাক্টরির শ্রমিক।

যে মোটরবাইকটা আমাকে ধাক্কা দিয়েছে সেটা একটু সামনে গিয়ে থেমেছে এবং যে বিশাল মানুষটা মোটরবাইকটা চালাচ্ছিল সে ব্যস্ত পায়ে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মানুষটাকে চিনতে পারলাম, গতকাল সে এবং ছোট করে কাটা চুলের মেয়েটি আমাকে জোর করে জিনিৎস্কী ভিডিওটি দেখিয়ে আজকে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু এখন কেন

মোটরবাইক দিয়ে চাপা দিয়ে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে আমি বুঝতে পারলাম না।

বিশাল মানুষটা আমার পাশে উবু হয়ে বসে আমার হাত ধরে বলল, “বেঁচে আছ?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। এখনও।”

মানুষটা বলল, “তাহলে বেঁচে যাবে। আমি দুঃখিত–’

আমি, তার চেহারায় দুঃখের কোনো চিহ্ন দেখলাম না, বরং মনে হল সেখানে একটা সন্তুষ্টির ভাব। সে আমাকে ঘিরে থাকা পথচারি এবং শ্রমিকদের বলল, “তোমরা যেতে পার। আমি এর সাথে আছি। আমার দোষ– আরেকটু খেয়াল করা উচিৎ ছিল। ভুলেই গিয়েছি যে রাস্তায় হাবাগোবা মানুষ থাকে ৷“

একজন শ্রমিক মাথা নাড়ল, বলল, “আমি একে চিনি, আমাদের সাথে কাজ করে। ঠিকই বলেছ, একটু হাবাগোবা ধরনের।”

বিশাল মানুষটা বলল, “এক্ষুণি পুলিশ এম্বুলেন্স এসে যাবে– তোমরা চিন্তা করো না। আমি দেখছি।”

পুলিশের কথা শুনে ঘিরে থাকা মানুষেরা সরে যেতে শুরু করল। বিশাল মানুষটা আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকাল। এতক্ষণ কোনো ব্যথা ছিল না, ধীরে ধীরে পায়ে প্রথমে ভোঁতা এবং একটু পর তীক্ষ্ণ এক ধরনের ব্যথা অনুভব করতে থাকি। আমি বুঝতে পারছি আমার সারা মুখ যন্ত্রণায় ঘামে ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে গেছে, রক্তে প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে আমি তার মাঝেই মানুষটাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। ভুলও হতে পারে আমার মনে হল, মানুষটার মুখের কোণায় খুব সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি। পুরো ব্যাপারটিতে আনন্দের হাসি দেওয়ার মত কিছু কী ঘটেছে?

.

তিন ঘণ্টার ভিতরে হাসপাতালে আমাকে পুরোপুরি ঠিক করে দিল। আমি জীবনে কখনো হাসপাতালে যাইনি তাই হাসপাতাল সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। যখন অনাথ আশ্রমে ছিলাম তখন যখন অসুখ হয়েছে ভুগে ভুগে ঠিক হয়ে গেছি। হাসপাতালে গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম মানুষের চিকিৎসার বিষয়টি কতো সহজ আর আধুনিক হয়ে গেছে। হাসিখুশি একটা নার্স কিংবা টেকনিশিয়ান আমার কাছাকাছি ছিল কিন্তু অনেকগুলো যন্ত্র আমার পা’টি ঠিক করে দিল। বড় স্ক্রিনে আমি আমার ক্ষতবিক্ষত পা, থেতলে যাওয়া মাংসপেশি আর ভেতরে গুঁড়িয়ে যাওয়া পায়ের হাড় দেখতে পেলাম। সেগুলো ঠিক করে ভেতরেই জোড়া দিয়ে দিল, থ্যাতলে যাওয়া অংশ স্বাভাবিক করে দিল, পায়ের ভেতরের শিরা আর ধমনী জুড়ে দিল। হাসিখুশি নার্স মেয়েটি এক সময় বলল, “তোমাকে একটু রক্ত দিতে হবে। কী রঙের রক্ত চাও?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী রং?”

“হ্যাঁ। সব রক্ত তো কৃত্রিম তাই আজকাল নানা রঙের রক্ত তৈরি হয়। তুমি চাইলে তোমার শরীরে পুরো রক্তই অন্য রঙের হতে পারে! তোমার গায়ের রংও তাহলে পাল্টে যাবে! কম বয়সীদের এটা নূতন ফ্যাশন!”

আমি বললাম, “না, না। আমি ফ্যাশন করতে চাই না। আমি আসল লাল রঙের রক্ত চাই!”

মেয়েটা হাসল, বলল, “ঠিক আছে!”

আমি শুনলাম মনে মনে মেয়েটা বলছে, “বহুদিন পরে একজন পুরানা মডেলের মানুষ পেলাম!”

.

একশ সাত তলায় আমার এপার্টমেন্টে আসতে একটু ঝামেলা হতে পারতো কিন্তু সাথে বিশাল মানুষটি থাকায় কোনো ঝামেলা হল না। আমার এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আমি দরজা খোলার জন্য কোড প্রবেশ করানোর আগেই খুট করে দরজা খুলে গেল। অবাক হয়ে দেখলাম ছোট করে চুল কাটা মেয়েটি ভেতর থেকে দরজা খুলে দিয়েছে! এপার্টমেন্টে গতকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমি যত বিচিত্র ঘটনা ঘটতে দেখেছি সেই তুলনায় এটি এমন কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়।

মেয়েটি আমার প্লাস্টার করা পা’টা এক নজর দেখে বিশাল মানুষটাকে বলল, “চমৎকার কাজ হয়েছে ইগর! ঠিক যেরকম ঠিক করেছিলাম।”

আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম, এই পুরো ঘটনা আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটা ঘটনা?

মেয়েটা শেষ পর্যন্ত দরজা থেকে সরে আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিল। এপার্টমেন্টটি একটু পরিষ্কার করা হয়েছে মনে হল। টেবিলে সকালের অর্ধভুক্ত খাবারগুলো নেই। প্লেট চামচ ঠিক জায়গায়। বিছানায় একটা পরিষ্কার চাদর। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে।

মনে হল মেয়েটি শেষ পর্যন্ত আমার পা দেখা শেষ করে আমাকে দেখল, তারপর বলল, “পুরুষ মানুষ হলেই প্রতিযোগিতা করে নোংরা থাকতে হবে সেটা ঠিক নয়।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম তার আগেই মেয়েটা বলল, “তুমি মানুষটা বোকা সেটা অনুমান করেছিলাম। কিন্তু তুমি এত বেশি বোকা সেটা বুঝতে পারিনি

আমি বললাম, “আমার সম্পর্কে আর যা যা বলতে চাও বলে ফেল, আমি একটা চেয়ারে বসে শুনি।”

মেয়েটা এগিয়ে এসে আমাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি কী জান তুমি মৃত্যুর কত কাছে পৌঁছেছিলে? তুমি নিজের চোখে দেখেছ একটা মেয়েকে গুলি করে মেরেছে। সেই মেয়েটি আসলে পরামানব ছিল না, দুর্বল প্রকৃতির একটি মেয়ে ছিল। মিছিমিছি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তোমাকে যে ধরতে পারেনি সেটা তোমার কপাল। আমি জানতাম না তুমি এতো বড় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছ।”

আমি বললাম, “বোকা মানুষেরা একটু সৌভাগ্যবান হয়।”

মেয়েটি বলল, “প্রত্যেকটা মানুষকে হিসাব করে সৌভাগ্য দেওয়া হয়। সেটাকে আগেই খরচ করে শেষ করে ফেলো না। ভবিষ্যতে দরকার হবে।”

আমি কিছু বললাম না। আজকের ঘটনার পর অনুমান করতে পারি কেন ভবিষ্যতের জন্য সৌভাগ্য জমা করে রাখতে হবে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ে আমার জীবনটা কী রকম অস্বাভাবিক হয়ে গেল।

আমি কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর বললাম, “আমার নাম নীল। তোমার নামটি আমি এখনও জানি না।”

“তোমার নাম পরিচয় জিনেটিক কোডিং সব আমি জানি। আমার পরিচয় দেইনি কারণ আমি জানতাম না সেটা ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় তুমি বেঁচে থাকবে কিনা। এখন মনে হচ্ছে বেচেঁ থাকতেও পারে। তাই এখন পরিচয় দেওয়া যায়। আমার নাম এলা।” এলা পাহাড়ের মত বিশাল মানুষটিকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী এর নাম ইতোমধ্যে জেনেছ, এ হচ্ছে ইগর। “

ইগর গমগমে গলায় বলল, “নীল, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম। গতকাল তোমার সসেজটা খেয়ে ফেলার জন্য দুঃখিত।”

আমি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারলাম না, তারপর অনেক কষ্টে নিজের বিস্ময়টুকু গোপন করে বললাম, “তুমি একটা মোটরবাইক আমার পায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে দিয়ে পাটা গুড়ো করে ফেলেছ, সেজন্য দুঃখ প্রকাশ না করে সসেজটা খেয়ে ফেলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছ?”

ইগর ভালো মানুষের মত হাসল, বলল, “সসেজ খেয়েছি লোভে, তোমার পায়ের উপর দিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে নিয়েছি তোমার জীবন বাঁচানোর জন্য।”

“আমার জীবন বাঁচানোর জন্য আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে?”

এবারে এলা আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, “এ ছাড়া তোমাকে কয়েকদিনের জন্য ঘরে আটকানো যেতো না। তুমি তোমার নূতন ক্ষমতাটা যত বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করেছ সেটা অনেক বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারতো। হয়েও গিয়েছিল। তুমি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছ।”

আমি বললাম, “এলা, তুমি জান আমি হাবাগোবা মানুষ। আমাকে কী পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে? একেবারে গোড়া থেকে।”

এলা হাসল, বলল, “হাবাগোবার মত ভান করে থাকলেই একজন হাবাগোবা হয়ে যায় না। তুমি খুব ভালো করে জান তুমি কী রকম মানুষ! যেটা জানতে না সেটা এখন জেনেছ। তুমি একজন পরামানব।”

“আমাকে পরামানবের বিষয়টা বুঝিয়ে দেবে?”

“যেটুকু জানি বুঝিয়ে দেব। সেজন্য ইগরকে পাঠিয়েছি তোমার পা ভেঙ্গে নিয়ে আসার জন্য! কারো ভেতরে কোনো সন্দেহ না জাগিয়ে তোমাকে কয়েকদিন নিজের ঘরে আটকে রেখে পরামানব হিসেবে অভ্যস্ত হওয়ার কাজটি করার জন্য, আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই সবচেয়ে সহজ উপায়। হাসপাতাল থেকে তোমার ফ্যাক্টরিতে খবর চলে গেছে যে পা ভেঙ্গে তুমি ঘরে আটকা পড়েছো ৷

ইগর বলল, “এবং চিকিৎসার বিলটাও গিয়েছে।”

এলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, বিল পেয়ে ফ্যাক্টরি খুব খুশি হবে বলে মনে হয় না। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, পরামানব হিসেবে এখন তোমাকে অভ্যস্ত হতে হবে।”

আমি এলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী পরামানব? ইগর?”

“না। আমরা পরামানব না। আমরা পরামানবদের সাহায্য করি।”

“কেন?”

“তাদেরকে পাখির মত গুলি করে মেরে ফেলার বিষয়টা অমানবিক।

তারা পরা-মানব, পরা-দানব নয়। যদিও সবাইকে বোঝানো হয় তারা দানব থেকেও ভয়ংকর।”

ইগর বলল, “তারা ইচ্ছা করলে দানব হতে পারে। তাদের যে ক্ষমতা আছে সেটা ইচ্ছা করলেই খুব ভয়ংকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব।”

এলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। পরামানবকে কিন্তু ভয়ংকর কাজের জন্য তৈরি করা হয়নি। তাদের জন্মটা একটা দুর্ঘটনা বলতে পার।”

আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, “বুঝতে পারছি না, বুঝিয়ে বল।”

“বলছি।” এলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “পুরো ব্যাপারটা শুরু হয়েছে লোভ থেকে। তুমি নিশ্চয়ই জান মানুষের সবচেয়ে আদি এবং অকৃত্রিম প্রবৃত্তি হচ্ছে লোভ?”

আমি জানতাম না। আমি অবশ্য আরো অনেক কিছুই জানি না।

***

এলা শুরু করেছে এভাবে :

“যখন থেকে মানুষের সম্পদ হতে শুরু করেছে তখন থেকে মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছে। এক ভাগ যাদের সম্পদ আছে, আরেক ভাগ যাদের সম্পদ নেই। কখনো রাজা বাদশাহ আর গরিব প্রজা। কখনো জোতদার আর ক্রীতদাস। কখনো জমির মালিক আর চাষী। মানুষ যত সভ্য হয়েছে এই পার্থক্যটা তত বেড়েছে।”

আমি এলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমি কখনো এভাবে চিন্তা করিনি।”

এলা বলল, “তার কারণ, তুমি দরিদ্র গোষ্ঠীর। দরিদ্র মানুষদের চিন্তা করা হচ্ছে বিলাসিতা। তাদের চিন্তা করতে হয় না। তাদের এভাবে চিন্তা করতে শেখানো হয় না। যাই হোক, যেটা বলছিলাম–” এলা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “ধনী দরিদ্রের এই পার্থক্যটা সবচেয়ে বেশি বাড়তে শুরু করেছে গত একশ বছরে–যখন থেকে মানুষ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় বড় আবিষ্কারগুলো করেছে।”

আমি বললাম, “কিন্তু উল্টোটা হওয়ার কথা না? “

“কে বলেছে? সবকিছুর পিছনে হচ্ছে লোভ, বিজ্ঞান প্রযুক্তির পিছনে ও আছে লোভ। তুমি অনেক বড় আবিষ্কার কর কারণ সেটা বিক্রি করে না হয় সেটা নিয়ন্ত্রণ করে অনেক সম্পদশালী হবে। তুমি এতো সম্পদশালী হবে যে তোমার ইউনিট জমা করার মত সিস্টেম পর্যন্ত থাকবে না!”

আমি বললাম, “কী আশ্চর্য!”

এলা একটু রেগে উঠল, বলল, “মোটেও আশ্চর্য না! এটাই হওয়ার কথা। সম্পদশালী মানুষেরা তাদের সম্পদ পৃথিবীর সব মানুষদের মাঝে ভাগাভাগি করে দিলে কিন্তু সবাই ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু তারা সেটা কল্পনাও করতে পারে না। কেন এটা করা যাবে না তার উপর অনেক ভালো ভালো থিওরি আছে। সেগুলো স্কুল কলেজে পড়ায়, তার উপর ভালো ভালো গবেষণা হয়।”

এলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সম্পদশালী মানুষের সম্পদ এক সময় এতো বেড়ে গেল যে তারা কীভাবে সেটা ভোগ করবে সেটা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেল। নিজেদের শরীরের পিছনে খরচ করতে লাগল যেন তাদের কখনো রোগ শোক না হয়। তাদের বয়স যেন না হয়, সেজন্য শরীরের ভিতরে দুটো হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্কে বাড়তি নিউরণ এরকম সবকিছু করে ফেলল। মহাকাশে বেড়ানো শুরু করলো। চাঁদে নতুন নতুন কটেজ তৈরি হল, সেখানে ছুটি কাটাতে যেতে শুরু করল। মঙ্গল গ্রহ একটু বেশি দূরে, যেতে কয়েক মাস লেগে যায় তাই ভ্রমণটা আনন্দময় করার জন্য বিশাল বিশাল স্পেস শিপ তৈরি করতে লাগল!”

ইগর হঠাৎ করে এলাকে থামিয়ে বলল, “নূতন নূতন সম্পদ তৈরি করার জন্য তারা যে পুরো পৃথিবীটাকে ঝাঁজরা করে ফেলল সেটাও বল।“

এলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ পুরো পৃথিবীটাকে শেষ করে দিল। জলবায়ু কী ভয়ানক! লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার পানির নিচে ডুবে গেল। বন জঙ্গল পাহাড় পর্বত পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সম্পদশালী মানুষের অবশ্য তাতে

কোনো সমস্যা হলো না, কারণ তারা সেখানে থাকে সেখানকার জলবায়ু আবহাওয়া সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে।”

আমি আস্তে আস্তে বললাম, “তুমি যেভাবে বলছ, শুনে ভয় লাগছে।”

“আমি কম করে বলছি। আসল ছবি আরো ভয়ানক। যাইহোক পৃথিবীর সেই লাগামছাড়া সম্পদশালী মানুষেরা তখন ঠিক করল তারা আর মানুষের ভূমিকায় থাকবে না। ঈশ্বরের ভূমিকায় চলে যাবে–তাদের সন্তানদের তারা মানুষ হিসেবে জন্ম দেবে না, অতিমানব হিসেবে জন্ম দেবে।”

আমি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “অতিমানব?

“হ্যাঁ মানুষের পরের ধাপ হচ্ছে অতিমানব। তারা তাদের সমস্ত সম্পদ ঢেলে অতিমানবের গবেষণা শুরু করল। পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সেরা ল্যাবরেটরি তৈরি করে সেখানে অতিমানব জন্ম দেওয়ার গবেষণা শুরু করল।

ইগর হাসির মত শব্দ করে বলল, “এলা, নীলকে সত্যি কথাটা বল, গবেষণা না ছাই! তারা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধ করা শুরু করল। সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। সবচেয়ে নৃশংস অপরাধ।” ইগরের মুখটি ক্রোধে বিকৃত হয়ে যায় ৷

এলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ, সেটি আসলে গবেষণা ছিল না। পৃথিবীর মানুষ আসলে বহুদিন থেকে গবেষণা ভুলে গেছে। একশত বছর আগে ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেটা দিয়েই অনেক গবেষণা হয়েছে, সেখান থেকে এসেছে দ্বিতীয় বুদ্ধিমত্তা, যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাদের মত করে নূতন বুদ্ধিমত্তা তৈরি করেছে। তারপর এসেছে প্রতিবুদ্ধিমত্তা–যার হাতে এখন জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতা গবেষণা সবকিছু জিম্মি হয়ে আছে–”

আমি এলাকে থামালাম, “কিন্তু অপরাধটি কি সেটা তো বললে না –”

“হ্যাঁ বলছি।” এলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “মানুষকে যখন নূতন করে ডিজাইন করা হয় তার জন্য অনুমতি নিতে হয়। নৈতিকতা কাউন্সিল সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এইবারে তার কিছু হল না, দরিদ্র এলাকায় দরিদ্র মা’দের অল্প কিছু ইউনিট দিয়ে তাদের গর্ভে মানবভ্রূণ বসানো শুরু হল। সেই ভ্রূণকে যথেচ্ছ পরিবর্তন করা হয়েছে, কোনো নিয়মনীতি না মেনে। একাট দুটি নয়, লক্ষ লক্ষ। প্রতিবুদ্ধিমত্তার সিস্টেম ছাড়া আর কেউ সেটা কিছু জানে না। সেটা জানা সম্ভব না।

“সন্তানদের জন্ম শুরু হল। বিকলাঙ্গ সন্তান। বুদ্ধিহীন সন্তান। মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তান। সিজোফ্রেনিক সন্তান। দানবিক সন্তান। বিবেকহীন সন্তান, প্রতিবুদ্ধিমত্তা তার মাঝে একটি সন্তান খুঁজে বেড়াতে থাকে যার মস্তিষ্ক বিকশিত! যে সাধারণ মানুষ নয়, যে অতিমানব।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, “পেয়েছে সেরকম মানুষ?”

“লক্ষ লক্ষ সন্তান জন্ম দিলে এক দুটি পাওয়া বিচিত্র নয়। যাদের পেয়েছে তাদের যত্ন করে ক্লোন করা হতে লাগল। পৃথিবীর জন্য অতিমানব সৃষ্টি করা হল। যারা সাধারণ মানুষকে সরিয়ে পৃথিবীতে জায়গা নেবে –“

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”

এলা বিচিত্র ভঙ্গীতে হাসল, বলল, “প্রকৃতি প্রতিশোধ নিল।”

“প্রতিশোধ?”

“হ্যাঁ। দেখা গেল অতিমানবের মাঝেও আছে অন্য অতিমানব। যারা শুধু উন্নত মানুষের সংস্করণ নয়, তারা ভিন্ন ধরনের মানুষ। তারা মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে যেতে পারে। মানুষের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে–অতিমানবদের সেই অতিমানব হচ্ছে–”

এলা হঠাৎ থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি কাঁপা গলায় বললাম, “পরামানব?”

“হ্যাঁ। নীল, তুমি হচ্ছ ঠিক সেরকম একজন পরামানব। তুমি জান না তোমার কী ক্ষমতা

আমি কেমন যেন শিউরে উঠলাম।

ইগর বলল, “অতিমানব তৈরির সেই প্রজেক্ট বাতিল করে দেওয়া হল। পরামানবদের মস্তিষ্ককে বিকশিত হতে দেওয়া হল না, তারা স্বল্পবুদ্ধির মানুষ হিসেবে বড় হতে লাগল। প্রতিবুদ্ধিমত্তা খুঁজে খুঁজে সেই শিশুদের হত্যা করতে লাগল। তখন অনেক মা গোপনে তাদের সন্তানদের অনাথ আশ্রমে দিয়ে গেল। তার স্বল্প বুদ্ধির মানুষ হয়ে বড় হবে, কিন্তু বেঁচে তো থাকবে–”

আমি বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম, বললাম, “তার মানে– তার মানে –“

এলা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, তার মানে তোমার মা তোমাকে পরিত্যাগ করেনি। তোমার মা তোমাকে রক্ষা করেছে

আমি বুকের ভেতর এক ধরনের কাঁপুনি অনুভব করলাম। আমার মা কী বেঁচে আছে? কোথায় আছে আমার মা?

ইগর বলল, “সবকিছুই বলা হয়েছে, শুধু বাকি আছে জিনিৎস্কী ভিডিওর কথা। সেটা না বললে কাহিনী শেষ হবে না।”

এলা বলল, “হ্যাঁ। পরামানবদের মস্তিষ্ক বিকশিত হতে না দিয়েও ভয়ংকর মানুষগুলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বস্তি পায়নি। জিনিৎস্কী নামে একজন খ্যাপা বিজ্ঞানী–প্রতিবুদ্ধিমত্তা সিস্টেম নয়, একশত ভাগ রক্ত মাংসের একজন মানুষ গবেষণা করে একটা ভিডিও তৈরি করল যেটা দেখানো হলে পরামানবদের মস্তিষ্ক আবার বিকশিত হতে থাকে!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সেই বিজ্ঞানী কোথায়?”

“সম্ভবত মেরে ফেলেছে–যদি বেঁচেও থাকে কোথায় আছে কেউ জানে না।”

আমি মাথা নাড়লাম, “এখন আমি বুঝতে পারছি, তোমরা সেই জিনিৎস্কী ভিডিও জোগাড় করেছ। সেই ভিডিও দেখিয়ে পুলিশ মিলিটারি পরামানবদের মেরে শেষ করার আগে তোমরা তাদের সেই ভিডিও দেখিয়ে প্রাণে বাঁচিয়ে দিচ্ছ! যেভাবে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ?”

“হ্যাঁ।

“কেন? তোমরা পরামানবদের ভয় পাও না?”

এলা অদ্ভুত ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর নরম গলায় বলল, “বল নীল, আমি কী তোমাকে দেখে ভয় পাব?”

আমি হাত বাড়িয়ে এলার হাত স্পর্শ করে বললাম, “না, এলা না। তুমি কেন আমাকে ভয় পাবে?”

8

পরদিন ভোর থেকে আমার পরামানব ট্রেনিং শুরু হল। বেশ সকালেই একজন মাঝবয়সী মানুষ এসেছে। দরজা খুলে দেওয়ার পর ভেতরে ঢুকে আমাকে বলল, “আমার নাম কুশান। মনে আছে আমি আর তুমি একই অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছিলাম?”

আমি অবাক হয়ে কুশানের দিকে তাকালাম, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না অনাথ আশ্রমে কুশান নামে কে ছিল! তখন শুনতে পেলাম মানুষটি মনে মনে বলছে, “কুশান নামে তোমার অনাথ আশ্রমে কেউ ছিল না। আমি তোমার অনাথ আশ্রমে ছিলাম না, কিন্তু যদি কেউ তোমার কাছে আমার পরিচয় জানতে চায় তুমি এই পরিচয়টি দেবে!”

আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে।”

মানুষটি বলল, “তুমি বেশ ভালোই মনের কথা বুঝে ফেলা শিখে গেছ!”

আমি বললাম, “আমি নিজে এর জন্য কিছু করিনি।”

“এখন করতে হবে। আমি সময় নষ্ট না করে শুরু করে দিই ৷ ঠিক আছে?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিক আছে।”

মানুষটি আমার সামনে একটি চেয়ারে বসে বলল, “আমার দিকে তাকাও।”

আমি তাকালাম। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “কী দেখছ?”

“তোমাকে।”

“আমার কী দেখছ?”

“তোমার মাথা, নাক মুখ চোখ চুল– “

“যদি একটা ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে তাহলে সেই ছবিতে কী দেখতে?”

“তোমাকে।”

“এবং?”

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সে ঠিক কী জানতে চাইছে। একটু অবাক হয়ে বললাম, “সেই ছবিতে তুমিই থাকতে।”

কুশান মাথা নাড়ল, বলল, “না। শুধু আমি থাকতাম না। সেই ছবিতে পিছনে তোমার রান্নাঘর থাকতো, দরজা থাকতো, দরজায় ঝোলানো টাওয়েল থাকতো, জানালা থাকতো, দেওয়াল থাকতো, এক কথায় আমার আশে পাশের সবকিছু থাকতো। এই সবকিছু তোমার চোখের সামনেও আছে কিন্তু তুমি সেগুলো দেখছ না, কারণ দেখার প্রয়োজন নেই। বুঝেছ?”

আমি মাথা নাড়লাম, “বুঝেছি।”

“তোমার মস্তিষ্ক যা কিছু অপ্রয়োজনীয় সব ছেঁকে সরিয়ে দিতে পারে। শুধু তুমি যেটা চাও সেটা ছাড়া আর কিছু তুমি দেখো না। ঠিক বলেছি?”

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।”

“ঠিক একইভাবে এখন কান পেতে শুনো কতো রকম শব্দ, তোমার কুলিং চেম্বারের শব্দ, জানালায় বাতাসের শব্দ, নিচে রাস্তার শব্দ, পাশের এপার্টমেন্টে মানুষের শব্দ, কিন্তু তুমি তার কিছু শুনছ না, তুমি শুধু আমার কণ্ঠস্বর শুনছ। বুঝেছ?”

“বুঝেছি।”

“পরামানব হিসেবে তোমার প্রথম কাজ হবে ঠিক এই কাজটি করা। চারপাশের সব মানুষের চিন্তা তুমি শুনতে পাবে, তার ভেতর থেকে শুধু যার চিন্তা তুমি শুনতে চাও সেটা আলাদা করে শোনা। প্রথম প্রথম পারবে না, ধীরে ধীরে করা শিখে যাবে।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“ঠিক আছে, তাহলে পরীক্ষা হয়ে যাক। তুমি কার কার চিন্তা শুনতে পাচ্ছ?”

আমি মনোযোগ দিলাম। কুশানের চিন্তা শুনতে পাচ্ছি সে এই মুহূর্তে এক মগ কফি খাওয়ার কথা চিন্তা করছে। বাইরের এপার্টমেন্ট থেকে একজন মানুষের ছাড়া ছাড়া অসংলগ্ন চিন্তা শুনতে পাচ্ছি। একজন মায়ের তার সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা শুনতে পাচ্ছি। অন্য একজন ক্রমাগত কুৎসিত গালি দিয়ে যাচ্ছে। আরো দূর থেকে আরো কিছু মানুষের চিন্তা শুনতে পাচ্ছি। পরিষ্কার বুঝতে পারছি না কিন্তু মনে হচ্ছে কোলাহলের মত।

আমি কুশানকে সবগুলোর বর্ণনা দিলাম। কুশান বলল, যেকোনো একটা বেছে নিয়ে শুধু সেটাকে মনোযোগ দিতে। আমি সন্তান নিয়ে মায়ের চিন্তাটাতে মনোযোগ দিলাম। প্রথম প্রথম চিন্তাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য চিন্তা ঢুকে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে শুধু একটাতে মনোযোগ দিয়ে সেই একটাই শুনতে চেষ্টা করে গেলাম। মায়ের চিন্তাটি বুঝতে পারলাম, অবাধ্য সন্তান কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সন্তানটি সম্ভবত মাদক শুরু করেছে সেটি নিয়ে দুর্ভাবনা। পুরোটা জেনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল।

কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা করে আমি মোটামুটি শিখে গেলাম, যখন অনেকগুলো চিন্তা শুনতে পাই তার যেকোনো একটা বেছে নিয়ে সেটাতে মনোযোগ দেওয়া। কুশান বেশ খুশি হয়ে বলল, “তুমি যেভাবে শিখে গেছ তাতে বুঝতে পারছি তোমার সবকিছু শিখে নিতে বেশি সময় লাগবে না

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সবকিছু বলতে কী বোঝাচ্ছ?”

“যেমন আরেকজনের মস্তিষ্কে ঢুকে গিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা। শুনেছি তুমি এর মাঝে একবার সেটা করে ফেলেছ, তোমার ফ্যাক্টরিতে এক মিলিটারি মহিলার সাথে–”

আমি বললাম, “কিছু একটা করেছিলাম। মহিলাকে গালাগাল করেছি– মনে হল শুনতে পেরেছিল।”

কুশান হাসল, বলল, “কাজটা খুবই বিপজ্জনক হয়েছিল। তুমি যদি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া করো তাহলে মাঝে মাঝে পরিচয়টা প্ৰকাশ পেয়ে যায়। তুমি বেঁচে গেছ যে তোমাকে ধরতে পারেনি।”

“আমি জানতাম না। কিছু না ভেবে করে ফেলেছিলাম। যাইহোক এখন বল আমাকে আর কী কী শিখতে হবে।”

কুশান বলল, “অন্যদের সাথে বেছে বেছে যোগাযোগ করা। তারপর একজনকে বুঝতে না দিয়ে তার মস্তিষ্কে উঁকি দেওয়া। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে আসা। তারপর অন্যজনের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করা!”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ?”

“হ্যাঁ। একজনকে সান্ত্বনা দেওয়া, খুশি করে দেওয়া। বিষণ্ণ করে দেওয়া–”

“সত্যি? আমি সেটা করতে পারব?”

“এই মুহূর্তে হয়তো পারবে না কিন্তু যদি চেষ্টা করো তাহলে একসময় সেটাও করতে পারবে। তারপর মনে করো তুমি চাইলে একজনের চিন্তাকে প্রভাবিতও করতে পারবে।”

“মানে?”

“সে জানতেও পারবে না, কিন্তু তুমি তার চিন্তাটাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে নিতে পারবে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আর কিছু করা সম্ভব?”

“হ্যাঁ আরো কিছু করা সম্ভব, যদিও আমরা কখনো সেটা করতে চাই না।”

“সেটা কী?”

কুশান হাসলো, বলল, “জানতে চাও?”

“হ্যাঁ।”

“আরেকজনের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া। তাকে কলের পুতুলের মতো ব্যবহার করা!”

আমি বললাম, “সর্বনাশ!”

কুশান বলল, “সর্বনাশের এখানেই শেষ নয়। আরো আছে।”

“সেটা কী?”

“আরেকজনের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে সেটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়া। একজনের পুরো মস্তিষ্ককে ধ্বংস করে দেওয়া। তাকে বদ্ধ উন্মাদ করে ছেড়ে দেওয়া।”

আমি অবাক হয়ে কুশানের দিকে তাকিয়ে রইলাম, বললাম “সত্যিই একজন পরামানব সেটা করতে পারে?”

“সে যদি সত্যিই চায়, সেটা শেখার জন্য চেষ্টা করে, দিনের পর দিন পরিশ্রম করে, এর পিছনে সময় দেয় তাহলে করা সম্ভব। কিন্তু সেটি খুবই কঠিন, রীতিমত সাধনা করে শিখতে হয়। আমরা তোমাদের সেই পথে পাঠাতে চাই না।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কোন পথে পাঠাতে চাও?”

কুশান বলল, “আমাদের উদ্দেশ্য খুবই সহজ। আমরা তোমাদের মূল বিষয়গুলো শিখিয়ে দিতে চাই যেন তোমরা স্বাভাবিক একজন মানুষের মত বেঁচে থাকতে পার। একটুখানি প্রতিভাবান সাধারণ মানুষ।”

আমি মাথা নাড়লাম, “আমি কী সত্যিই স্বাভাবিক মানুষের মত বেঁচে থাকতে পারব?”

“পারবে। চাইলেই পারবে। মনে রেখো একজন পরামানব হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন মানুষ। তোমার বেঁচে থাকা নির্ভর করে তুমি কতোটুকু স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকো তার উপর।”

“বুঝেছি।”

কুশান বলল, “আমি আরো একটা জিনিস জানতে চাইছিলাম—”

কুশান তার কথা শেষ করার আগেই আমি হাসলাম, বললাম, “হ্যাঁ, আছে। আমার কাছে কফি আছে। পা’টা নিয়ে নড়তে পারছি না তাই তোমাকে কফি বানিয়ে দিতে পারছি না। তুমি যদি নিজে একটু বানিয়ে নাও।”

কুশানও হাসল, বলল, “ধন্যবাদ নীল।”

“আর যদি একটু বেশি করে বানাও তাহলে আমিও তোমার সাথে বসে খেতে পারি।”

কুশান উঠে দাঁড়াল, বলল, “হ্যাঁ, আমি তোমার জন্যেও বানাচ্ছি।”

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কুশান।”

আমরা দুজন তারপর বসে বসে কফি খেলাম, সম্পূর্ণ অবান্তর অর্থহীন বিষয় নিয়ে কথা বললাম।

.

পরের কয়েকদিন কুশান নিয়মিতভাবে এসেছে, আমাকে নূতন নূতন পদ্ধতি শিখিয়েছে। একদিন এলাও এলো তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ইগরকে নিয়ে। তাকে দেখে আমি খুশি হয়ে উঠলাম, বললাম, “আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আর আসবে না।”

এলা বলল, “মনে আছে, আমি যতবার এসেছি ততবার তোমার একটা সর্বনাশা অভিজ্ঞতা হয়েছে?”

“আজকেও কী তোমার কোনো পরিকল্পনা আছে?”

“এখনও নেই।”

“তুমি আমাকে কী শেখাবে?”

“আমি কিছু শেখাবো না, একটু ভয় দেখাব।”

আমি হাসার ভঙ্গী করে বললাম, “ভয় দেখাবে?”

“হ্যাঁ।”

“দেখাও।”

এনার মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “আমি কিন্তু ঠাট্টা করে বলিনি, খুব সিরিয়াসলি বলেছি। যেটা বলি সেটা শোনো।” এলা একটা নিঃশ্বাস নিল, নিজের আঙুলগুলোর দিকে তাকাল তারপর বলল, “মনে আছে, তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আমরা কেন পরামানবদের বাঁচানোর চেষ্টা করি?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মনে আছে।“

“আমি বলেছিলাম, এটা একটা মানবিক বিষয়। তোমরা পরা-দানব নও তোমরা পরা-মানব। কাজেই তোমাদের পাখির মত গুলি করে মারা গ্রহণযোগ্য নয়।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। আমার মনে আছে।”

এলা বলল, “অবশ্যই সেটা একটা কারণ, কিন্তু সেটা প্রধান কারণ নয়।”

“তাহলে প্রধান কারণ কী?”

“প্রধান কারণ হচ্ছে, আমরা এই সিস্টেমটাকে পাল্টাতে তোমাদের সাহায্য চাই।”

“কোন সিস্টেম?”

“যে সিস্টেমে পৃথিবীতে দুটি দল। এক দল গরিব অন্য দল সেই গরিবের রক্ত ঘাম আর শ্রমের বিনিময়ে বড়লোক।”

আমি কিছুক্ষণ এলার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর বললাম, “যে পদ্ধতিটা পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর থেকে টিকে আছে তোমরা কয়েকজন মিলে সেই পদ্ধতিটা পাল্টাতে চাও?”

“আমরা কয়েকজন? কে বলেছে আমরা মাত্র কয়েকজন? আমরাই তো বেশি তারা মাত্র অল্প কয়েকজন! গ্রিগান নামে একজন মানুষের কাছেই পৃথিবীর অন্য সবার কাছ থেকে বেশি সম্পদ।”

“কিন্তু কিন্তু–” আমি কী বলব বুঝতে পাপলাম না। এলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

এলা বলল, “নীল, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ। সেটা হচ্ছে, এই প্রথম তারা খুব একটা বিপজ্জনক কাজ করছে, যেটা আগে কখনো করেনি।”

“সেটা কী?”

“সেটা হচ্ছে প্রযুক্তির উপর এতো বেশি নির্ভর করা। প্রথমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তারপর দ্বিতীয় বুদ্ধিমত্তা এখন প্রতিবুদ্ধিমত্তা। তারা নিজের অজান্তে কবর খুঁড়ে রেখেছে। এই প্রতিবুদ্ধিমত্তা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমাদের শুধু তাদের পাল্টা একটা প্রযুক্তি প্রস্তুত করতে হবে যেটা প্রতিবুদ্ধিমত্তাকে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “সেটা কী প্রযুক্তি?”

“পরামানব! তারা হচ্ছে আমাদের প্রযুক্তি।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমরা? আ-আমরা?”

“হ্যাঁ। সেজন্য তোমাদের যেকোনো মূল্যে নিরাপদ থাকতে হবে। কেউ যেন তোমাদের পরিচয় না জানে। কোনোভাবে যেন বুঝতে না পারে যে তুমি একজন পরামানব।”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম, তারপর বললাম, “ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব।”

এলা মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না। চেষ্টা করলে হবে না ৷ তোমাকে এটা করতে হবে। যদি তুমি ধরা পড়ে যাও, শুধু তোমার নয় আমাদের পুরো সংগঠনের অস্তিত্ব নিয়ে বিপদে পড়ব। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদেরকে পাখির মত নয় ব্যাক্টেরিয়ার মত মেরে ফেলবে।”

ইগর এতোক্ষণ একটা কথাও বলেনি, এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি কোনোভাবে ওরা তোমার পরিচয় জেনে

যায় তাহলে আমার বাইকটাকে তোমার পায়ের উপর দিয়ে নয়, তোমার মূল্যবান পরামানব মস্তিষ্কের উপর দিয়ে চালিয়ে নিতে হবে!”

আমি ইগরের দিকে তাকালাম, তার মুখে কৌতুকের ছিটেফোঁটা নেই! আমি আবার এলার দিকে তাকালাম তারপর বললাম, “এলা, তুমি বলেছিলে আমাকে ভয় দেখাবে! সত্যিই তুমি আমাকে ভয় দেখাতে পেরেছ।

এলা হাসার চেষ্টা করে বলল, “নীল, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না! আমি এই কথাগুলো বলেছি তোমাকে সাবধানে থাকার জন্য। যে মানুষটি পরামানব হয়নি তাদেরকে পরামানব হওয়ার আগেই পাখির মত মেরে ফেলে। কিন্তু যে মানুষটি পরামানব হয়ে গেছে তাদেরকে এতো সহজে মারে না। তাকে যদি ধরতে পারে তাহলে নিজেদের কাজে ব্যবহার করে- কীভাবে ব্যবহার করে সেটা তুমি জানতে চেও না।”

“আমি জানতে চাইব না।”

এলা হাসার চেষ্টা করে বলল, “অনেকক্ষণ নিরানন্দ কথা হয়েছে। এবারে আমরা একটু স্ট্রবেরি চকলেট আইসক্রিম খাই?”

এলা নিয়ে এসেছিল, আমরা সেটা ভাগাভাগি করে খেলাম– ছোট বাচ্চাদের মত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *