০৫. রেটিনা স্ক্যান করাচ্ছি

পাঁচ দিন পর আমি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গেলাম। যখন ভেতরে ঢোকার জন্য রেটিনা স্ক্যান করাচ্ছি তখন গার্ড বলল, “তুমি পাঁচ দিন কাজে আসনি?”

“না।”

“কেন?”

“একসিডেন্টে পা ভেঙ্গে গিয়েছিল।”

“ভাঙ্গা পা সারতে এতো দিন লাগে?”

আমি মাথা নাড়লাম, এই বিষয় নিয়ে গার্ডের সাথে আমার কথা বলার বেশি কিছু নেই।

গার্ড তার সামনে রাখা স্ক্রিনে কিছু একটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। আমি পাঁচ দিন ধরে নিজেকে ট্রেনিং দিয়েছি তাই গার্ডের মস্তিষ্কে কী হচ্ছে সেটা আমার শুনতে হচ্ছে না কিন্তু চাইলেই আমি সেখানে উঁকি দিতে পারি।

গার্ডটা বলল, “তোমার চিকিৎসার জন্য কোম্পানির অনেক ইউনিট খরচ হয়েছে।”

আমি কোনো কথা বললাম না, আমার বলার কিছু নেই। কোম্পানির ইউনিট খরচ হয়েছে বলে গার্ডটা মনে হয় খুব বিরক্ত হয়েছে, আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে একসিডেন্ট হয়েছিল?”

আমি বললাম, “রাস্তা পার হচ্ছিলাম, খেয়াল করিনি, পিছন থেকে একটা মোটরবাইক এসে ধাক্কা দিয়েছে।”

“একশ বছর আগে এরকম ঘটনা ঘটতো। এখন কেন ঘটবে?”

আমি কিছু বললাম না। গার্ড বলল, “যাও, কাজে যাও। তোমার জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। তুমি এখন থেকে সাত নম্বরে যাবে। ইঁদুরের গর্তে।”

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, সাত নম্বর জায়গাটা আসলেই ইঁদুরের গর্তের মতন। নূতন শ্রমিকদের এখানে দেওয়া হয়। পাঁচ দিন আসিনি বলে আমার শাস্তি।

আমি আমার নূতন জায়গায় টানা দুই ঘণ্টা কাজ করলাম। দশ মিনিটের বিরতির সময় আমি এক মগ কফি নিয়ে বসেছি তখন আমি

পুতুলের মত মেয়েটাকে দেখলাম। সেও আমাকে দেখেছে। আগের মত না দেখার ভান করে সরে না গিয়ে সে হাতে একটা পানীয়ের মগ নিয়ে আমার

টেবিলে এসে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নাকি একসিডেন্টে পা ভেঙ্গে গিয়েছিল?”

আমি মাথা নাড়লাম। মেয়েটা বলল, “এখন ভালো?”

আমি আবার মাথা নাড়লাম, বললাম, “ভালো।”

মেয়েটা গলা নামিয়ে বলল, “এদিকে কী হয়েছে শুনেছ?”

আমি না সূচকভাবে মাথা নেড়ে বললাম, “না। শুনিনি। কী হয়েছে?”

“পরামানবকে খুঁজছে। ফ্যাক্টরিতে এখন সিকিউরিটি নিয়ে খুব কড়াকড়ি।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ।”

“কী রকম কড়াকড়ি?”

“সবাইকে সবসময় মনিটর করছে। ভালোই হয়েছে তুমি কাজে চলে এসেছ নাহলে তোমাকে ধরে আনতো।”

আমি হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমি ভাঙ্গা পা নিয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম।”

মেয়েটি তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, “বুঝতে পারছি।”

আমি গলা নামিয়ে বললাম, “এরা কাউকে সন্দেহ করছে?”

“বুঝতে পারছি না। শুনছি সবার মাথায় চিপ বসাবে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী বসাবে?”

“চিপ।”

“মাথায় কেমন করে চিপ বসায়?”

“খুব খারাপভাবে। একটা যন্ত্র আছে, হুবহু পিস্তলের মত। বুলেটের বদলে খুব ছোট সূক্ষ্ম একটা চিপ দিয়ে মাথায় গুলি করে?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “গুলি করে?”

“আসল গুলি না–কিন্তু কাজটা গুলির মত। পিছন দিয়ে খুলি ফুটো করে মাথার ভিতরে ঢুকে যায়। তারপর বাইরে থেকে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক জায়গায় বসায়। যখন বসে যায় তখন সেটা মস্তিষ্কের ভেতর থেকে সিগনাল পাঠাতে থাকে।”

“কী ভয়ানক!”

“হ্যাঁ। কিন্তু পরের কাজটা আরো ভয়ানক, তুমি কী চিন্তা করছ সেটা বুঝতে পারে। তোমার নিজস্ব আর কিছু থাকবে না।”

“কিন্তু–কিন্তু–সবাই কী এটা মাথায় বসাতে রাজী হবে?”

“কে আর নিজের থেকে রাজী হবে? কিন্তু যদি বসাতে চায় তোমার কিছু করার নেই।”

“কেন? কেন কিছু করার নেই?”

মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “তার কারণ, আমাদের ভিতর একজন পরামানব আছে। এখন আমরা সবাই দোষী। যতক্ষণ তাকে ধরতে না পারছে আমাদের নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন আছে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “আইন?”

“হ্যাঁ। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইন।”

আমি এই ধরনের কোনো আইনের কথা জানতাম না। মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, “তার মানে এরা আমাদের সবাইকে রবোট বানিয়ে ফেলবে? আমাদের সবার মাথায় থাকবে চিপ?”

“হ্যাঁ। আমাদের চিন্তা ভাবনার কথা জানবে, আমাদেরকে চাইলে নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে।”

“কী সর্বনাশ!”

“হ্যাঁ। অনেক বড় সর্বনাশ! যদি কোনোভাবে এই পরামানবটাকে ধরে

ফেলতে পারতো তাহলে আমাদের এতো বড় সর্বনাশ হতো না। একজন পরামানবের জন্য আমাদের কয়েক হাজার শ্রমিকের জীবন শেষ হয়ে যাবে–”

আমি কোনো কথা বললাম না কিন্তু প্রথমবার এক ধরনের তীব্র অপরাধবোধ অনুভব করলাম। মেয়েটি তো সত্যি কথাই বলছে, শুধুমাত্র আমার জন্য কয়েক হাজার শ্রমিকের সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। মনে হতে থাকে আমার নিজ থেকে গিয়ে ধরা দেওয়া উচিত– কোনোভাবেই এতোগুলো মানুষের জীবন নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। কিন্তু এলা আমাকে বারবার করে বলেছে কোনোভাবে তারা যেন আমাকে ধরতে না পারে। যদি আমাকে ধরতে পারে তাহলে তাদের সবাই খুব বিপদে পড়ে যাবে। এলা অনেকবার একটা কথা বলেছে, ‘তোমার সামনে অনেক বড় বড় অন্যায় ঘটবে যেটা দেখে তোমার মনে হবে তুমি তোমার পরামানব ক্ষমতা ব্যবহার করে সেই অন্যায়ের প্রতিকার করো–কিন্তু তুমি সেটা করতে যেও না। তোমাকে আরো বড় কোনো কাজ করতে হবে। আরো অনেক বড় অন্যায়ের প্রতিকার।

আমি বসে বসে ভাবি, সত্যিই কী আমি বড় কোনো অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারব? আমার কী সেই ক্ষমতা আছে? মেয়েটি আমার সামনে চুপ করে বসে থেকে তার পানীয়ে চুমুক দিতে লাগল। এক সময় সে উঠে গেল, আমি একা বসে রইলাম। আমার কফিতে চুমুক দিতে আমি ভুলে গেলাম, সেটা ঠাণ্ডা হতে লাগল।

***

ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে আমি আজকে সরাসরি বাসায় ফিরে গেলাম না। আমি শহরতলীর ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকি। কুশান আমাকে শিখিয়েছে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে আমি যেন কখনো অন্যের চিন্তা শোনার চেষ্টা না করি। প্রথম প্রথম সেটা আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল, আমি চাই আর না চাই অন্যের চিন্তাগুলো আমার মাথায় এসে হাজির হতো। গত কয়েকদিন চেষ্টা করতে করতে আমি সেটা না করতে শিখেছি। আজকে আমি একবারও অন্যের মাথায় উঁকি দিতে চেষ্টা করিনি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে কিন্তু আমি জোর করে নিজেকে আটকে রেখেছি। কুশান কেন আমাকে সেটা করতে বলেছে আমি এখন তা বুঝতে পারছি। এটা করতে পারলে পরামানব হয়েও আমি পুরোপুরি সাধারণ একজন মানুষের মত বেঁচে থাকতে পারব। তা ছাড়া সারাক্ষণ অন্যের চিন্তা শুনতে থাকার মাঝে একটা কষ্ট আছে। নিজ থেকে এই কষ্ট নিজের উপর টেনে আনার কোনো প্রয়োজন নেই। কুশান বলেছে আমি যদি পরামানব হয়ে বেঁচে থাকতে পারি এমনিতেই এই ধরনের অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।

শহরতলীর রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে একসময় আমি রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে বসেছি। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে, রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টে ঘোলা এক ধরনের আলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। এলাকাটা যে দরিদ্র মানুষদের সেটি ল্যাম্পপোস্টের ঘোলা আলোতে যেন আরো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আমি শহরের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের এলাকায় কখনো যাইনি। ছবি ভিডিওতে দেখেছি সেগুলো ঝকঝক করছে। সেখানকার আলোগুলো নিশ্চয়ই কাউকে বিষণ্ণ করে তোলে না।

আমার কী মনে হল জানি না, হঠাৎ করে মানুষের মস্তিষ্কে উঁকি দেওয়ার ইচ্ছা হল। মনে হল একটু শুনি কে কি বলছে। আমি মনোযোগ দিলাম। প্রথমেই শুনলাম একজন কীভাবে ইউনিট খরচ না করে কিছু উত্তেজক পানীয় চুরি করে নেবে সেটা ভাবছে। আমার একটু হাসি পেল। আমি আরেকজনের দিকে নজর দিলাম, সে একটি মেয়ের কথা ভাবছে। কেন মেয়েটি তার সাথে ঠিকভাবে কথা বলেনি সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করছে। আমি আরেকজনের দিকে নজর দিলাম, এই মানুষটি অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে যাচ্ছে, বেশিক্ষণ সেটা শোনা গেল না। আমি আরেকজনের মাথায় উঁকি দিলাম, দেখলাম সে একটি জটিল হিসাব করে যাচ্ছে। এর মাঝে গণিতের ব্যাপার আছে–হয়তো একজন ছাত্র। আমি তাকে ছেড়ে আরেকজনের মস্তিষ্কে নজর দিলাম। তার চিন্তাটা অনুভব করার আগেই আমি বুঝে গেলাম এই মেয়েটির মনে এক ধরনের তীব্র ক্ষোভ। কোনো একজন ক্ষমতার জোর দেখিয়ে তার সন্তানকে নিয়ে গেছে, মেয়েটি চিন্তা করছে কীভাবে সে তার সন্তানকে ফিরিয়ে আনবে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মেয়েটির মনে গভীর একটি দুঃখ কিন্তু বিন্দুমাত্র হতাশা নেই। সে যেভাবেই হোক তার সন্তানকে ফিরিয়ে আনবেই, তার জন্য যা করা দরকার সে করবে। একটার পর একটা পরিকল্পনা করা যাচ্ছে, কোনো ক্লান্তি নেই কোনো বিরতি নেই! শুধু তাই নয় তার পরিকল্পনাগুলোতে ভয়ানক বিপদের আশংকা কিন্তু মেয়েটির মনে কোনো ভীতি নেই। কী আশ্চর্য একটা মেয়ে, মনে হয় শুধু মায়েরাই তার সন্তানকে ফিরে পাবার জন্য এরকম দুঃসাহসী হতে পারে, এরকম জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে।

আমার ভেতরে হঠাৎ একটা বিচিত্র অনুভূতি হল। আমি মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছি না, সে কোথায় আমি জানি না, শুধু তার চিন্তাটা অনুভব করতে পারছি। এই মেয়েটি একটি ভয়ানক দুঃসময়েও যদি এতো সাহসী হতে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না? সাধারণ একটি মেয়ের ভেতর যদি কোনো হতাশা না থাকে তাহলে আমার মতো একজন পরামানবের ভেতর কেন এতো হতাশা, কেন এতো অপরাধবোধ?

আমি সোজা হয়ে বসলাম। আমাকেও এই মেয়েটার মত হতে হবে। আমাকেও ভয় পেলে চলবে না, হতাশ হলে চলবে না। আমাকেও সাহসী হতে হবে। আমাকেও ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে কিছু একটা পরিকল্পনা করতে হবে।

আমি চিন্তা করতে থাকি, আমার একটা অসাধারণ মস্তিষ্ক আছে, আমি কেন সেটা ব্যবহার করব না?

আমি যখন আমার রেটিনা স্ক্যান করে ফ্যাক্টরির ভেতরে ঢুকছি তখন গেটের পাশে দাঁড়ানো গার্ডটি আমার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসল। হাসিটি সুন্দর নয়, এর মাঝে তাচ্ছিল্য আছে এবং নিষ্ঠুরতা আছে। আমার কী মনে হল কে জানে, আমিও তার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসলাম।

গার্ড থতমত খেয়ে তার হাসি থামিয়ে আমার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল, বলল, “তুমি বোকার মত হাসছ কেন?”

আমি বললাম, “তুমি হেসেছ তাই আমি ভদ্রতা করে হাসলাম।”

গার্ড বলল, “আমি হেসেছি কারণ আমার হাসার কারণ আছে ৷ তোমার কোনো কারণ আছে?”

“নাহ্।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কী কারণ?”

“কারণ আজকে আমার মনে অনেক আনন্দ।”

“কী নিয়ে আনন্দ?”

“তোমরা সবাই আজকে কোম্পানি থেকে একটা উপহার পাবে।

উপহারটা সরাসরি মগজে চলে যাবে। সেটা চিন্তা করে আমার আনন্দ হচ্ছে!” হার্ড আবার হা হা করে হাসল। একই রকম আনন্দহীন নিষ্ঠুর হাসি।

আমি চমকে উঠলাম, মনে হয় গার্ডের মাথায় উঁকি দেওয়ার সময় হয়েছে। আমি মনোযোগ দিলাম, শুনলাম সে মনে মনে বলছে, “ছারপোকার দল, তোদের সবার মগজে আজ চিপ বসানো হবে। বুঝবি মজাটা, আর মানুষ থাকবি না, জন্তু থেকেও খারাপ অবস্থা হবে। আমাদের হুকুমে উঠবি আর বসবি!”

আমি অবাক হয়ে গার্ডের দিকে তাকালাম, গার্ড আবার মধুর ভঙ্গীতে হাসল, মনে মনে বলল, “কাজ শুরুর সাথে সাথে যখন তোরা লাফ ঝাঁপ দিবি তখন মজাটা শুরু হবে। দুই চারটাকে গুলি করে ফেলে দিলে তখন হবে আসল মজা! হা হা হা!”

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করি। পুতুলের মত মেয়েটা যখন বলেছিল তখন পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি–এখন দেখছি মেয়েটা যা বলেছিল অবস্থা তার থেকেও ভয়ানক। অনেক বেশি ভয়ানক।

আমি শুনলাম গার্ডটা তখনও কথা বলে যাচ্ছে, “ব্যাক্টেরিয়ার মত তোদের জন্ম তাই মরতেও হবে ব্যাক্টেরিয়ার মত।”

আমি আমার কাজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করে দিই, অন্যান্য শ্রমিকেরাও তাদের মত কাজ করছে। তারা কী জানে একটু পর তাদের মাথায় চিপ বসিয়ে তাদেরকে যন্ত্র বানিয়ে দেওয়া হবে?

.

দুই ঘণ্টা পর যখন দশ মিনিটের জন্য বিরতি দিয়েছে আমি তখন ক্যাফেটারিয়াতে এসে আমার অভ্যাসমত এক মগ কফি নিয়ে বসেছি, কিন্তু সেটিতে চুমুক না দিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলাম। চারপাশে শ্রমিকেরা হাঁটাহাঁটি করছে, নিজেদের ভেতর নিচু গলায় কথা বলছে, তারাও কী জানতে পেরেছে যে আজ তাদের মাথায় চিপ বসানো হবে, নাকি গার্ড শুধু আমাকেই সেটা বলেছে?

আমি তখন পুতুলের মত মেয়েটিকে দেখতে পেলাম, আমি একটু ইতস্তত করে তাকে হাত নেড়ে ডাকলাম। সে আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল, আমি নিচু গলায় বললাম, “তুমি কী জান যে আজ সবার মাথায় চিপ বসানো হবে?”

মুহূর্তে মেয়েটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, “না–না–” যেন সে না বললেই ঘটনাটি থেমে যাবে! মেয়েটি টেবিলটাকে ধরে আমার সামনের চেয়ারটিতে বসে পড়ল, তারপর আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

আমি তার মস্তিষ্কে উঁকি দিলাম, শুনতে পেলাম সে বলছে, “শেষ! শেষ! সবকিছু শেষ! আমার জীবনটি এখানে শেষ? কেন আমার জন্ম হয়েছিল? কেন? এই ভাবে জন্ম হয়ে আর এইভাবে মৃত্যু হলে সে জীবনের কী অর্থ? কেন এই জীবন? কেন? কেন?”

মেয়েটির মাথায় অসংলগ্ন চিন্তা ভেসে যেতে থাকে। তার জন্য আমি এক ধরনের গভীর মমতা অনুভব করলাম কিন্তু কিছু না করে চুপচাপ বসে রইলাম। মেয়েটি হঠাৎ কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু তার আগেই ফ্যাক্টরির যান্ত্রিক সিস্টেমে গলার স্বর ভেসে এল। কোনো একজন মানুষ থমথমে গলায় বলল, “শ্রমিকবৃন্দকে যে যেখানে আছে তাকে সেখানেই স্থির হয়ে থাকার আদেশ দেওয়া হল।”

মানুষটি দ্বিতীয়বার কথাটি বলার প্রয়োজন মনে করল না, কারণ সে নিশ্চিতভাবে জানে কেউ তার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস করবে না।

শ্রমিকেরা যে যেখানে বসে আছে বসে রইল, যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা সেখানে দাঁড়িয়ে গেল। ঠিক তখন আমরা বুটের শব্দ শুনতে পেলাম এবং দেখতে পেলাম সারি বেঁধে মিলিটারি ঢুকছে এবং তারা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ফ্যাক্টরির নানা কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

আবার ফ্যাক্টরির যান্ত্রিক সিস্টেম থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এল, “তোমরা নিশ্চয়ই জান তোমাদের ভেতর একজন পরামানব আছে। যেহেতু তাকে এখনও ধরা সম্ভব হয়নি তাই তোমরা সবাই এখন সন্দেহভাজন মানুষ। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনের আওতায় তোমাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা আমাদের দেওয়া হয়েছে। সে কারণে আমরা তোমাদের সবার মস্তিষ্কে নিউরাল ইন্টারফেস আইসি স্থাপন করব।”

শ্রমিকদের সবাই এক ধরনের আর্তনাদের মত শব্দ করল। কয়েকজন আপত্তি জানানোর ভঙ্গী করে তাদের মাথা নাড়ে, কয়েকজন আতঙ্কে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। চারিদিকে একটা ভয়ার্ত চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

যান্ত্রিক সিস্টেম থেকে মানুষের কণ্ঠস্বরটি তীব্র গলায় বলল, “সাবধান! কেউ যেন কোনো ধরনের আপত্তিকর ব্যবহার না করে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী তোমাদের যেকোনো শ্রমিককে আমরা শাস্তি দিতে পারি। শান্তি রক্ষার জন্য আমাদের গুলি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।”

শ্রমিকদের চাপা গুঞ্জনটি থেমে গেল। কণ্ঠস্বরটি বলল, “তোমাদেরকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হবে ঠিক সেভাবে তোমরা সারিবদ্ধভাবে নিয়ম মেনে আমাদের সাময়িক অপারেশন থিয়েটারগুলোতে যাবে। আমরা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সহ্য করব না। আবার বলছি কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সহ্য করব না ৷

কে যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমার সামনে পুতুলের মত দেখতে মেয়েটি পাথরের মূর্তির মত বসেছিল। আমি তার মস্তিষ্কে উঁকি দিলাম, সাথে সাথে একটি গভীর বিষাদে আমার মনটি ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মেয়েটি কিছু চিন্তা করছে না, কিছু বলছে না, শুধুমাত্র আদিগন্ত বিস্তৃত একটি বিষাদ এবং অবিশ্বাস্য এক ধরনের শূন্যতা। এক ধরনের তীব্র হতাশা।

আমি দেখলাম মেয়েটি খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, কাছাকাছি একজন মধ্যবয়সী মিলিটারি অফিসার তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ঝাঁকুনি দিয়ে মেয়েটির দিকে তাক করে চিৎকার করে বলল, “তুমি কেন দাঁড়িয়েছ? কেন দাঁড়িয়েছ তুমি? শুনোনি যে বলা হয়েছে যে যেখানে আছ সেখানে স্থির হয়ে থাকতে? শুনোনি তুমি?”

আমি বুঝতে পারলাম এই মেয়েটির এখন আর কিছুতেই কিছু আসে যায় না। সে বেঁচে থাকবে না মরে যাবে এখন তাতেও তার কিছু আসে যায় না। তার বুকের ভেতর যে তীব্র হতাশা সেখানে জীবন কিংবা মৃত্যুর কোনো ভূমিকা নেই।

আমি দেখলাম মেয়েটি মিলিটারি অফিসারের দিকে তাকাল, তার মুখে বিচিত্র একটা হাসি। মেয়েটি এখন কী বলবে আমি জানি, মেয়েটি বলল, “আমি রাজী নই।”

মিলিটারি অফিসারটি মনে হল তার কথা শুনে খুবই অবাক হল, বলল, “তুমি কীসে রাজী নও?”

“আমার মাথায় তুমি একটা যন্ত্র বসিয়ে দেবে তাতে আমি রাজী নই ৷”

মনে হল মেয়েটি খুবই একটা হাসির কথা বলেছে, মধ্যবয়সী মিলিটারি অফিসারটি শব্দ করে কৃত্রিম একটা হাসির শব্দ করল। তারপর বলল, “তুমি রাজী আছ কি নেই সেটা কেউ তোমার কাছে জানতে চায়নি।”

তখন অস্ত্র হাতে একজন মহিলা মিলিটারি এগিয়ে এল, আমি তাকে চিনতে পারলাম। সে একজনকে পরামানব হিসেবে সন্দেহ করে একেবারে মিছিমিছি গুলি করে মেরে ফেলেছিল! আমি তাকে রাক্ষুসি বলে ডেকে হুমকি দিয়েছিলাম। মহিলাটি মুখে বিদ্রূপের একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি কেন তোমার মাথায নিউরাল ইন্টারফেস আইসি বসাতে চাও না?”

মেয়েটি বিষণ্ণ গলায় বলল, “তুমি যদি সেটা বুঝতে না পার আমি কোনোদিন তোমাকে বোঝাতে পারব না।”

মহিলাটি বলল, “কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তুমি কেন ইন্টারফেসটি বসাতে চাও না। কারণ তাহলে আমরা তোমার সব চিন্তা জেনে যাব এবং বুঝতে পারব তুমি একজন পরামানব।”

মেয়েটি বলল, “আমি পরামানব নই।”

মিলিটারি অফিসার বলল, “তুমি নিশ্চয়ই পরামানব। নিশ্চয়ই তোমাকে আলাদাভাবে জেরা করতে হবে। পরামানবকে কীভাবে জেরা করতে হয় আমরা জানি।”

মহিলাটি বলল, “এর চাইতে অনেক সহজ, গুলি করে ফেলে দেওয়া।”

মিলিটারি অফিসারটি বলল, “জানি। কিন্তু এদের কাছে অনেক তথ্য থাকে–” সে পিছনে তাকিয়ে একজনকে বলল, “একে ধরে নিয়ে যাও।”

দুই জন মিলিটারি এগিয়ে এসে দুই পাশ থেকে তার দুটি হাত ধরে ফেলল, মেয়েটি বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি তার মস্তিষ্কে উঁকি দিলাম, শুনতে পেলাম, সে বলছে, “মা, তোমাকে যেভাবে হত্যা করেছিল, দেখো, আমাকেও ঠিক সেভাবে হত্যা করবে। আমি তোমার কাছে আসছি মা, কতোদিন তোমাকে দেখিনি–”

আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না, আমি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, “থামো।”

সবাই ঘুরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি বললাম, “একে ছেড়ে দাও। এই মেয়েটি পরামানব না।“

মিলিটারি অফিসারটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে কেমন যে অবিশ্বাস; বলল, “তুমি কেমন করে জান?”

“কারণ আমি হচ্ছি পরামানব।”

মনে হল ঘরের ভেতর একটা বজ্রপাত হল। কয়েক মুহূর্ত সবাই পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর অনেকগুলো মিলিটারি তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র একসাথে আমার দিকে তাক করে ধরল। মহিলা মিলিটারিটি সবার আগে কথা বলল, “তুমি পরামানব? তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি পুরোপুরি সাধারণ মানবও হতে পারনি! বড় জোর অর্ধ মানব! এই মেয়েটির জন্য তোমার মায়া হচ্ছে বলে তুমি এই নাটকটি করছ–”

আমি মহিলাটিকে বাধা দিয়ে বললাম, “তুমি মুখে এই কথাগুলো বলছ এবং মনে মনে এই মুহূর্তে চিন্তা করছ যে, এই নির্বোধ মানুষটা আর এক পা অগ্রসর হলেই তাকে গুলি করতে পারি–কেন অগ্রসর হচ্ছে না! ঠিক বলেছি?”

মুহূর্তে মহিলাটির মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল সে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি মিলিটারি অফিসারটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আর তুমি কী চিন্তা করছ বলব? তুমি চিন্তা করছ, এই মানুষটা কেন ঝামেলা করছে? পরামানব হিসেবে এই যুবতী মেয়েটিকে ধরে নিতে পারলে কতো ফূর্তি করা যাবে–”

মিলিটারী অফিসারের চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়, সে মাথা নেড়ে বলে, “না, না, কক্ষনো না–”

আমি তাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মিলিটারি অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আর তুমি এখানে কী হচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ না। একটা জুয়েলারির দোকান থেকে জোর করে যে হীরার আংটিটা তুলে এনেছ সেটা দিয়ে কী করবে চিন্তা করছ। তোমার পকেটেই আছে আংটিটা।”

মিলিটারী অফিসারটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, কেমন যেন হতচকিতের মত মাথা নাড়ল। আমি তার পাশে দাঁড়ানো মিলিটারি অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আর তুমি? তোমার পকেটে আছে ভিচুরিয়াস মাদক। একটু নিরিবিলি জায়গা খুঁজছো সেটা খাওয়ার জন্য!”

আমি একটু থামলাম, তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আরো প্রমাণ চাও?”

মহিলা মিলিটারি মাথা নাড়ল, তারপর আমতা আমতা করে বলল, “তোমার কথাগুলোর কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু আমরা চাই না তুমি আর কোনো কথা বল।“

আমি এবারে শব্দ করে হাসলাম, তারপর সরাসরি তাদের মস্তিষ্কে কথা বললাম, “আমি মুখে কথা না বলে সরাসরি তোমাদের মস্তিষ্কে কথা বলতে পারি! কাজেই আমাকে গুলি করে মেরে না ফেলে আমার কথা থামাতে পারবে না!”

মিলিটারী অফিসারগুলো একসাথে চমকে উঠল, তারা আমার দিকে অস্ত্র তাক করে ধরে রেখে নিজেদের ভেতর নিচু গলায় কথা বলল, আমার অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা হল না, আমি তাদের চিন্তাগুলো শুনতে পেলাম। মহিলাটি এই মুহূর্তে কোনো একটা কারণ দেখিয়ে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে চায়। মধ্যবয়স্ক মিলিটারি অফিসার বলল আমাকে জ্যান্ত ধরে নিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। আমাকে এতো জনের সামনে বিনা কারণে মেরে ফেলা ঠিক হবে না। এখানকার সব ঘটনা ত্রিমাত্রিক ভিডিও হিসেবে রাষ্ট্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে চলে গেছে কাজেই এখন নিয়মের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। আমি যদি কোনোভাবে তাদের আক্রমণ করতাম তাহলে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলা যেতো। কিন্তু আমি খুবই নিরীহ ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় কথা বলছি, আমাকে গুলি করার কোনো সুযোগ নেই। ট্রাঙ্কুয়ালাইজার দিয়ে অচেতন করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

আমি যখন বুঝতে পারলাম আমাকে এই মুহূর্তে মেরে ফেলছে না, বড়জোর অচেতন করে ফেলবে তখন আমি ঘুরে শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। এটাকে কথা বলা না বলে বক্তৃতা দেওয়া বলা যেতে পারে–যে কাজটি আমি জীবনেও করিনি। আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, “তোমাদের একটা কথা বলে যাই। কতক্ষণ বলতে পারব জানি না, তোমরা একটু মনোযোগ দিয়ে শোনো। বহুদিন থেকে আমার মনের ভেতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল আমি প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পেয়েছি। প্রশ্নটা হচ্ছে, আমরা প্রতিদিন যে এখানে নিরানন্দ চরম একঘেঁয়ে একটা কাজ করি, বর্তমানে প্রযুক্তি দিয়ে খুব সহজে সেটা যান্ত্রিক উপায়ে অনেক নিখুঁতভাবে করা সম্ভব। তাহলে সেটা কেন যান্ত্রিক উপায়ে না করে আমাদের মত মানুষদের দিয়ে করানো হচ্ছে? তার কারণটি জানো?”

শ্রমিকেরা মাথা নেড়ে জানালো তারা কারণটা জানে না। আমি বললাম, “তার কারণ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যান্ত্রিক উপায়ে করতে হলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হবে তার খরচ আমাদের দৈনন্দিন পারিশ্রমিক থেকে বেশি। আমরা মানুষেরা সেটা করলে কোম্পানির ইউনিট কম খরচ হবে। তার অর্থ আমরা একটা যন্ত্র থেকেও কম মূল্যের, সম্ভবত একটা পশু থেকেও মূল্যহীন।”

আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, “আমরা যে হতদরিদ্র হয়ে আশাহীন স্বপ্নহীন একটা নিরানন্দ জীবনযাপন করছি তার কারণ কিছু মানুষ তাদের সম্পদ আরো একটু বাড়ানোর জন্য আমাদের এভাবে ব্যবহার করছে। তোমাদের বলছি, তোমরা এটা মেনে নিও না। মেনে নিও না, নিও না–”

ঠিক তখন খুব কাছে থেকে একজন ট্রাংকুয়ালাইজার গান দিয়ে গুলি করল। আমি অনুভব করলাম আমার গলায় ট্রাংকুয়লাইজার ক্যাপসুলটি তীরের মত এসে বিঁধেছে। আমি সেখানে তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। আমি ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাতে শুরু করেছি, টেবিলটা ধরে রেখেও আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেলাম। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করলাম, দেখলাম একজন আমার উপর ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে ব্যকুল চোখে তাকিয়ে আছে। আমি মানুষটিকে চিনতে পারলাম, পুতুলের মত মেয়েটি।

আমি একটু হাসার চেষ্টা করে ফিস ফিস করে বললাম, “আমি–আমি

তোমার নাম জানি না। বলবে তোমার নাম?”

মেয়েটির ঠোঁট নড়ে উঠল, কাঁপা গলায় বলল, “আমার নাম রাতিনা।”

আমি বললাম, “আবার দেখা হবে রাতিনা।“

তারপর চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।

আমি চোখ খুলে তাকালাম, কিছুক্ষণ থেকে মনে হচ্ছিল কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করছে। চোখ খুলে দেখলাম আমি শক্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি এবং একজন পা দিয়ে আমার পাঁজরে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি চোখ খুলতেই শুনলাম মানুষটা আনন্দের মত শব্দ করল, “খুলেছে! চোখ খুলেছে!”

আমি দেখার চেষ্টা করলাম মানুষটি কে। নোংরা কাপড় পরনে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফের একজন মানুষ। আমি মাথা তুলে ভালো করে চারিদিকে দেখার চেষ্টা করলাম, বড় একটা ঘর, সেখানে বেশ কিছু মানুষ– নানা বয়সী পুরুষ এবং মহিলা। সবার চেহারাতেই এক ধরনের হতচ্ছাড়া ভাব। তাদের আনন্দহীন বিবর্ণ হতাশাগ্রস্থ চেহারা। কেউ কেউ মাথা গুঁজে বসে আছে। কেউ কেউ শূন্য দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কেউ ইতস্তত হাঁটছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই।

যে মানুষটি আমার পাঁজরে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে চেষ্টা করছিল সে এবারে আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে কেন ধরেছে?”

আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বসার চেষ্টা করলাম, মাথার ভেতরে কোথায় জানি টন টন করে উঠল। কাছাকাছি আরেকজন মানুষটির প্রশ্নের উত্তর দিল, বলল, “এটা আবার কী রকম প্রশ্ন? সবাইকে তো একই কারণে ধরে–সম্ভাব্য পরামানব।”

আরেকজনের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, “পরামানব পরামানব পরামানব– শুনতে শুনতে কান পচে গেল। পৃথিবীতে আসলেই কী পরামানব আছে?”

কে জানি বলল, “নাই। পুরোটা বানানো। যাদের মেরে ফেলতে চায় তাদেরকে পরামানব সন্দেহ করে ধরে এনে মেরে ফেলে

একজন মহিলা বলল, “এমনিতেই তো মেরে ফেলতে পারে–এতো নাটক করতে হয় কেন?”

কে যেন বলল, “না, এমনিতে মেরে ফেললে কী যেন একটা আইন ভঙ্গ হয়। এভাবে মেরে ফেলা আইনসম্মত।”

আমি মানুষগুলোকে ভালো করে দেখার জন্য তাদের মুখের দিকে তাকালাম। তাদের মস্তিষ্কে উঁকি দেব কিনা ভাবলাম কিন্তু আনন্দহীন হতাশাগ্রস্থ আতংকিত মানুষের মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে নিজেকে আরো হতাশাগ্রস্থ করতে চাইলাম না। যে মানুষটা আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছিল সে আমার পাশে বসে এবারে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার নাম রিগা, তোমার?”

আমি বললাম, “নীল।”

মানুষটি আমার হাত ধরে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম নীল।”

ঘরের অন্য পাশে একজন মধ্যবয়সী মানুষ বসেছিল সে বলল, “রিগা–আমরা একদিন আগে পরে সবাই মারা যাব। কেউ গুলি খেয়ে,

কেউ ইলেকট্রিক শক খেয়ে, কেউ বিষাক্ত ইনজেকশানে। যাদের কপাল খারাপ তাদের পিটিয়ে মারবে! মারার পর মৃতদেহটা এসিডে গলিয়ে দেবে–এখন তুমি কেন ভাণ করছ আমরা খুবই সামাজিক পরিবেশে আছি? হাত মিলিয়ে বলতে হবে তুমি সুখী হলে?”

বয়স্কা একজন মহিলা বলল, “থাক থাক ওকে থামিও না। সে

এগুলো করে আনন্দ পায়। করতে দাও।”

রিগা মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি কখনো ভুলতে চাই না যে আমি মানুষ –”

কম বয়সী একজন তরুণ অপ্রকৃতস্থের মত চিৎকার করে বলল, “মানুষ? আমরা মানুষ?”

রিগা বলল, “হ্যাঁ, মানুষ।“

“না।” তরুণটি আগের থেকে জোরে বলল, “না। আমরা মানুষ না।”

“তাহলে আমরা কী?”

“আমরা দরিদ্র মানুষ। দরিদ্র মানুষ কখনোই মানুষ না। মানুষ আর দরিদ্র মানুষের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। দরিদ্র মানুষের জন্ম হয়েছে আসল মানুষের সেবা করার জন্য–তাদের সুখ-শান্তির জন্য–তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য–”

ঘরের ভেতর তখন অনেকেই কথা বলতে থাকে। ক্রুদ্ধ বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ কুৎসিত গালি গালাজ করতে থাকে। আমি তখন লক্ষ করলাম আমার পায়ে একটা রিং লাগানো হয়েছে। সেখানে একটা ছোট হলুদ বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। তাকিয়ে দেখি সবার পায়েই এরকম রিং লাগানো। সেখানে বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। আমি রিগাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাদের পায়ে এগুলো কী? “

“জানি না। মনে হয় আমাদের পরিচয় ট্যাগ। এটা দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেয়, মাঝে মাঝে যন্ত্রণা দেয়।”

“একটা হলুদ বাতি জ্বলছে নিভছে।”

“হ্যাঁ।” রিগা ভালো মানুষের মত হাসল। বলল, “যখন এই বাতিটার রং লাল হয়ে যাবে তখন বুঝবে তোমার সময় শেষ।” সে হাত দিয়ে গলায় পোঁচ দেওয়ার ভঙ্গী করল। এখানে আটকে থাকা মানুষগুলোর জীবনটা কী বিচিত্র!

ঘরটিতে কোনো জানালা নেই, দরজা নেই, ধূসর দেওয়াল এবং সারা ঘরে বিবর্ণ এক ধরনের হলুদ আলো। সেই আলোতে সব মানুষকে কেমন যেন প্রাণহীন বিবর্ণ দেখায়। এখন দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। এই ঘরের বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু জেগে আছে সম্ভবত এখন দিন।

আমার এখানে কিছু করার নেই, সময় কাটানোর জন্য আমি মানুষগুলোর মাথায় উঁকি দিয়ে দেখতে পারি। কিন্তু গোপনে একজন মানুষের মাথায় উঁকি দিতে আমার সংকোচ হয়। তাই আমি দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। ঘরের ভেতর মানুষগুলো নিজেদের ভেতর মাঝে মাঝে অর্থহীন ঝগড়া করে, মাঝে মাঝে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায় তারপর আবার নিজেরাই থেমে যায়। দেখে আমার সময়টা কেটে যায়।

মাঝখানে হঠাৎ করে দেওয়ালের একটা অংশ খুলে গিয়ে সেখান দিয়ে খাবরের প্যাকেট এসে হাজির হল। কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে সেগুলো খেতে শুরু করে কেউ কেউ সেগুলো ছুঁয়েও দেখল না। আমি একটা প্যাকেট নিয়ে খুলে দেখলাম, আমার জীবনে আমি এরকম দায়সারা খাবার দেখিনি। উৎকট রঙের কৃত্রিম বিস্বাদ খাবার!

আমি একটুখানি খেয়ে প্যাকেটটা সরিয়ে রাখলাম। আমার পাশে বসে থাকা শীর্ণ মানুষটি বলল, “তুমি আর খাবে না?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না।“

“আমি তোমার বাকি খাবারটুকু খেতে পারি?”

“অবশ্যই।”

মানুষটি আমার অর্ধেক খাওয়া খাবারের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে লোভীর মতো খেতে শুরু করে। খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাসল, হেসে বলল, “বুঝতে পারি না কেন খিদে বেড়ে গেছে। সব সময় খেতে ইচ্ছা করে।”

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। ঠিক তখন ঘরের এক কোণা থেকে একটা মেয়ের আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। আমি চমকে সেদিকে তাকিয়েছি কিন্তু পাশে বসে থাকা মানুষটার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, সে যেভাবে খাচ্ছিল সেভাবে খেতে থাকলো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিসিলা। প্রতিদিনই এরকম করে।

“কেন?”

“চাপ সহ্য করতে পারছে না।”

আমি দেখলাম কয়েকজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। বয়স্কা মহিলাটি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় কথা বলছে। কিসিলা নামের মেয়েটি হাত পা ছুঁড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে যেতে থাকে। পাশে বসে থাকা মানুষটা তৃপ্তি করে খেতে খেতে বলল, “ট্রাংকুয়ালাইজার ছাড়া শান্ত হবে না। এইখানে ট্রাংকুয়ালাইজার কোথায় পাব?”

কিসিলা নামের এই অসহায় মেয়েটির জন্য আমি একটি গভীর বেদনা অনুভব করলাম। আমি মেয়েটির মস্তিষ্কে উঁকি দিলাম, সেখানে একটি ভয়াবহ বিপর্যয়। আতংক, হতাশা, বেদনা এবং ক্ষোভ মিলিয়ে অবিশ্বাস্য এক ধরনের জগৎ, যেটি আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি তার মস্তিষ্কে কথা বলার চেষ্টা করলাম, নরম গলায় ডাকলাম, “কিসিলা।”

মেয়েটি হঠাৎ করে থেমে গেল ভয়ার্ত চোখে চারপাশে তাকালো। শুনতে পেলাম সে চিন্তা করছে, “কে? কে কথা বলে?”

আমি বললাম, “আমাকে তুমি চিনবে না কিসিলা। আমি তোমাকে একটুখানি শান্তি দিতে এসেছি।”

আমি এই প্রথম একজন মানুষের অনুভূতি স্পর্শ করার চেষ্টা করছি। কীভাবে করতে হয় জানি না। কখনো করিনি। করতে পারব কিনা তাও জানি না। আমি তবুও চেষ্টা করলাম, নরম গলায় কিসিলাকে বললাম, “কিসিলা, কিসিলা তুমি একটুখানি শান্ত হও। একটুখানি শান্ত হও।”

কিসিলা কেমন জানি হকচকিয়ে যায়, সে সত্যি সত্যি শান্ত হয়ে বলে, “কিন্তু কিন্তু আমার মনে এতো ভয় এতো আতংক এতো এতো–”

“আমি জানি কিসিলা। আমি জানি তোমার মনে ভয় তোমার মনে আতংক, হতাশা, দুঃখ বেদনা যন্ত্রণা, আমি সব জানি। তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কিছু নেই, আমি তোমাকে সান্ত্বনা দিতে আসিনি, তোমাকে শান্তি দিতে এসেছি।”

“শান্তি?”

“হ্যাঁ শান্তি। তুমি তোমার ভেতরে একটা গভীর শান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

“কিন্তু তুমি কে? তুমি কোথায়?”

“আমি কে, আমি কোথায় জেনে তুমি কী করবে? তুমি ঘুমাও কিসিলা।”

আর কী আশ্চর্য, মেয়েটা সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গেল। পাশে বসে থাকা মানুষটি ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “আশ্চর্য ব্যাপার! মনে হল কেউ ট্রাংকুয়ালাইজার দিয়েছে!”

.

আমি দীর্ঘ সময়ে ধূসর দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছি, এক সময় আমার চোখে একটু ঘুম নেমে এসেছে। আগে ছিল না ইদানীং লক্ষ করছি ঘুমিয়ে গেলে আমি নানা ধরনের বিচিত্র স্বপ্ন দেখি–সত্যি কথা বলতে কী কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা সত্যি অনেক সময় বুঝতেও পারি না। এবারেও তাই হল, আমি ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। দেখলাম যেন কিছু মানুষ গোল হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাঝে একটা মানুষ হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “তোমাকে আমার চাই!” তারপর হতে বাড়িয়ে একটা যন্ত্র চেপে ধরল এবং আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম।

আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং আমি তাকিয়ে দেখলাম ঘরের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার অর্থ আমি সত্যি সত্যি চিৎকার করে উঠেছি। রিগা আমার কাছে এগিয়ে এলো, আমার সামনে বসে আমার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “নীল, তোমার ডাক পড়েছে।”

আমি আমার পায়ের দিকে তাকালাম, আমার পায়ে যে রিং লাগানো ছিল তার বাতিটি এখন লাল রঙের, জ্বলছে এবং নিভছে।

রিগা বলল, “তোমার পায়ের রিংটি এখন একটু পরে পরে তোমাকে ইলেকট্রিক শক দেবে। প্রত্যেকবার আগের থেকে বেশি।”

আমি শুকনো গলায় বললাম, “আমি কী করব?”

“তোমাকে এখন উঠে দাঁড়াতে হবে, তারপর এই দেওয়ালের কাছে এগিয়ে যেতে হবে, তখন দেওয়ালটার মাঝে একটা দরজা খুলে যাবে।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম, রিগা আমাকে দাঁড়াতে সাহায্য করল। আমি দেওয়ালটার দিকে হেঁটে যেতে থাকি।

ঘরের সবাই তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা নীরবে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলল, “আমি দুঃখিত নীল।”

অন্য একজন বলল, “আমরা সবাই দুঃখিত। আমাদেরও ডাক আসবে। একদিন আগে এবং পরে।”

বয়স্কা মহিলাটি বলল “তোমার মৃত্যুটি যেন খুব দ্রুত হয় সেই কামনা করি।”

আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, সত্যি সত্যি একজন মানুষের জীবনের শেষ মুহূর্তে এটি কামনা করা যায়?

আমি আরো এক পা এগিয়ে যাই এবং ঠিক তখন দেওয়ালের মাঝে একটি দরজা খুলে গেল। সেই দরজা দিয়ে একটি লম্বা করিডোর সামনে চলে গেছে। আমি সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “শুভ কামনা।”

রিগা হাতের সাথে হাত মিলিয়ে শব্দ করে বক্তৃতা দেওয়ার মত করে বলল, “আমাদের মৃত্যু যেন একদিন এই পৃথিবীতে সবার জন্য একটি সুন্দর জীবন নিয়ে আসে। বিদায় নীল।”

মানুষগুলো হাতে হাত মিলিয়ে শব্দ করে বলল, “বিদায় নীল। বিদায়।”

আমি বের হয়ে এলাম।

আমি করিডোরে পা দিতেই পিছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সামলে লম্বা একটা করিডোর। করিডোরের দুই পাশে বাতি জ্বলছে এবং নিভছে, নিঃশব্দে আমাকে এই করিডোর ধরে এগিয়ে যেতে বলছে। আমি জানি আমি যদি এগিয়ে না যাই আমার পায়ের রিংটি আবার আমাকে ভয়ংকর ইলেকট্রিক শক দিতে থাকবে। আমি কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আমার চারপাশে কোনো মানুষ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম।

আমি আমার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতেই চমকে উঠলাম। চারপাশে অসংখ্য মানুষের আর্ত চিৎকার, হাহাকার, অপ্রকৃতস্থ কথা। পৃথিবীতে তো এখন অপ্রকৃতস্থ মানুষ নেই তাহলে এই কথাগুলো কাদের? আমি এই তীব্র কোলাহলের ভেতর কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কথা শোনা যায় কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হল খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে এক দুইজন স্বাভাবিক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এত ক্ষীণ কণ্ঠ যে কি নিয়ে কথা বলছে যে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অপ্রকৃতস্থ মানুষজনের হাহাকার আর কোলাহলে সব কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম এখানে সব পরামানবদের ধরে আনা হয়, তারা যেন কারো মস্তিষ্কে উঁকি না দিতে পারে সেজন্য এই অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে নিয়ে এসেছে–তাদের কোলাহলের জন্য আমি কিছু শুনতে পারছি না। এখানাকার মানুষগুলো এইভাবে নিজেদের আমার কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু এই অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে তারা পেয়েছে কোথায়?

আমি আরো কয়েক পা এগিয়ে গেলাম এবং তখন হঠাৎ করে ডান দিকের করিডোরে একটা দরজা খুলে গেল। বুঝতে পারলাম আমাকে এই ঘরে ঢুকতে হবে। ভেতরে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে আমি জানি না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। সাথে সাথে পিছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল।

ঘরের ভেতর অসংখ্য যন্ত্রপাতি, আমি এই যন্ত্রপাতির কোনটিই চিনি না। ঘরের মাঝামাঝি একটা সরু বিছানা। আমি যখন হাসপাতালে গিয়েছিলাম তখন আমাকে এরকম একটা বিছানায় রেখেছিল। দেখে মনে হল এখানে হাত এবং পা বেঁধে রাখার ব্যবস্থা আছে। মাথার উপর একটা বড় আলোর ব্যবস্থা, মনে হয় এখানে মাথায় অস্ত্রোপচার করার ব্যবস্থাও আছে। এখানে রেখে এরা কী আমার মাথা কেটে আমার মস্তিষ্ক বের করে আনবে?

আমি এক ধরনের আতংক অনুভব করি। কুশান বলেছিল একজন পরামানব যদি চেষ্টা করে তাহলে আরেকজনের মস্তিষ্ককে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারে, ধ্বংস করে দিতে পারে। আমি কী তাহলে আমার নিজের মস্তিষ্ক ধ্বংস করে দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে পারব না? ঠিক কেন জানি না আমার মনে হল আমি চাইলেই পারব–কেন মনে হল আমি জানি না। এখনই কী সেই সময়? এখনই কী আমার মস্তিষ্ক ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়া উচিৎ? আমি কী চেষ্টা করব নাকি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব?

ঠিক তখন আমি একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম। এই ঘরটিতে কোনো এক ধরনের গ্যাস পাঠানো হচ্ছে, আমি হঠাৎ কেমন জানি দুর্বল অনুভব করতে থাকি। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে ৷ আমাকে অচেতন করে ফেলছে। আমি কাছাকাছি একটা ভারী যন্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেলাম।

***

আমি একটা মানুষকে দেখছি। আসলেই দেখছি নাকি স্বপ্ন দেখছি আমি জানি না। মানুষটা সরু একটা বিছানায় শুয়ে আছে ৷ তার হাত আর পা একটা ব্র্যাকেট দিয়ে আটকানো। মানুষটার চোখ কালো পলিমারে ঢাকা। সারা শরীরে নানা যন্ত্রপাতি লাগানো। মানুষটার চোখ ঢেকে কেন এই সরু বিছানায় শুইয়ে রেখেছে? আমি কী আসলেই দেখছি নাকি এটি একটি স্বপ্ন? আমি কী এখনো অচেতন নাকি আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে? আমি কেন এই মানুষটি দেখছি? মানুষটির দিকে তাকিয়ে কেন আমি একই সাথে এক ধরনের বিতৃষ্ণা ঘৃণা আর হিংস্র ক্রোধ অনুভব করছি? মানুষটি কে?

আমি হঠাৎ করে মানুষটিকে চিনতে পারলাম। মানুষটি আমি নিজে। আমি আমাকে দেখছি। আমি নিজের চোখে দেখছি না অন্য একজন মানুষের চোখে দেখছি। এই মানুষটির আমার জন্য প্রবল বিতৃষ্ণা ঘৃণা এবং ক্ৰোধ ৷ আমি তার অনুভূতিগুলো অনুভব করছি। মানুষটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে দেখছি বলে দেখাঁটি অন্যরকম, চোখ দিয়ে দেখা নয় সরাসরি মস্তিষ্ক দিয়ে দেখা।

আমি মানুষটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে? আমাকে কেন এখানে বেঁধে রেখেছ?”

মানুষটি চমকে উঠে একটু পিছিয়ে গেল। আমি এবারে তার ভেতর একটু আতংক অনুভব করলাম। মানুষটার স্মৃতি হাতড়ে দেখলাম তার নাম গ্রুজান, তার স্ত্রী কিছুদিন আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাকে কীভাবে একটা শিক্ষা দেওয়া যায় সে এখন তার পরিকল্পনা করছে, পরিকল্পনাগুলো ভয়ংকর।

আমি বললাম, “গ্রুজান, তুমি আমার কথার উত্তর দাও।”

মানুষটি আবার চমকে উঠে আরো এক পা পিছিয়ে গেল, বলল, “তু- তু-তুমি আমাকে চিনো? তোমার চোখ বাঁধা–”

আমি বললাম, “আমি শুধু তোমাকে চিনি না, তোমার সবকিছু জানি। তোমার স্ত্রীকে তুমি কী করতে চাইছ সেটাও জানি–আমাকে কতো ঘৃণা কর সেটাও জানি। আমাকে কেন বেঁধে রেখেছ? আমাকে খুলে দাও।”

মানুষটি আতংকিত হয়ে নানা কিছু চিন্তা করছে। মুখে বলল, “না। তুমি পরামানব, তোমাকে খুলে দেওয়া যাবে না।”

“অন্তত আমার চোখের বাঁধন খুলে দাও।”

“হ্যাঁ। আমি তোমার চোখের বাঁধন খুলে দেব। আমি যে কাজটা করতে এসেছি সেটা করার জন্য তোমার চোখের বাঁধন খুলে দিতে হবে।”

“তুমি কী করতে এসেছ?”

“আমি তোমার দণ্ডাদেশ পড়ে শোনাতে এসেছি।”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “দণ্ডাদেশ? আমি কী করেছি?”

গ্রুজান নামের মানুষটা বলল, “তোমার দণ্ডাদেশটি পড়ে শোনালে তুমি বুঝতে পারবে। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী একজন মানুষকে তার দণ্ডাদেশ পড়ে শোনানোর আগে তার চোখ কান খোলা থাকতে হয়, মানুষটিকে পুরোপুরি সচেতন থাকতে হয়। আমি তোমার জ্ঞান ফিরে পাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“আমার জ্ঞান ফিরেছে।”

“আমি তাহলে তোমার চোখ খুলে দিচ্ছি।”

মানুষটি খুব সাবধানে আমার কাছে এগিয়ে এলো, আমি তার ভেতর একটা আতংক অনুভব করলাম। আমার হাত পা বাঁধা তবু মানুষটা আমাকে ভয় পাচ্ছে।

মানুষটা আমার চোখের বাঁধন খুলে দিল, তার ময়লা বাদামী রঙের চুল এবং সবুজ চোখ। চেহারায় এক ধরনের নির্বোধ মানুষের ছাপ। মানুষটা আবার পিছিয়ে গেল, মনে হল তার ভেতরে একটা ধারণা হয়েছে আমার থেকে দূরে থাকলে সে নিরাপদে থাকবে। সে তার কব্জির সাথে লাগানো ভিডিফোনে চাপ দেয় সাথে সাথে তার সামনে একটা হলোগ্রাফিক স্ক্ৰীন খুলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনের পঞ্চদশ অধ্যায়ের সপ্তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমার ওপর আরোপিত ক্ষমতা বলে আমি তোমাকে জানাতে চাই যে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে তুমি একজন পরামানব। জিনেটিক কোডিং অনুযায়ী পরামানবকে মানুষ প্ৰজাতি হিসেবে দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সংশোধনী অনুযায়ী পরামানবদের মানুষ প্রজাতি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। যার অর্থ এই পৃথিবীতে মানুষ যে অধিকার ভোগ করে পরামানবদের সেই অধিকার নেই। যেহেতু তারা মানুষ প্রজাতির অংশ নয় তাই বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য তাদের দেহ ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। সেই বিধানের আলোকে পরামানব গবেষণা কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তোমার দেহ থেকে তোমার মস্তিষ্ক অপসারণ করে সেটিকে স্বতন্ত্রভাবে সচল রাখা হবে। তোমার দেহটি সমাহিত করার জন্য তোমার পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে। পরিবারের সদস্যরা আগ্রহী না হলে কিংবা পরিবারের কোনো সদস্য না থাকলে তোমার দেহটিও বিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহার করা হবে।”

মানুষটি কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি তার মস্তিষ্কে উঁকি দিলাম, সে চিন্তা করছে, “মানুষটি চুপচাপ আছে। কথা বলছে না। সে কি বুঝতে পেরেছে আমি কী বলেছি?”

আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম, “তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পেরেছি। আরও কিছু বলতে চাও?”

মানুষটি আমার কথা শুনে একটু থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ আমার আরও কিছু বলার আছে।” সে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আগের মত যান্ত্রিক স্বরে বলল, “সাধারণ মানুষকে দণ্ড দেওয়া হলে তাকে তার বিরুদ্ধে এবং নিজের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। তোমার সেই সুযোগ নেই। আমার এই বক্তব্যের সমাপ্তির শেষে তোমার মনুষ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলে বিবেচনা করা হবে।”

মানুষটি তার ভিডি স্ক্রিনে চাপ দিয়ে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটি সরিয়ে নেয়, আমি এবারে তার মুখটি স্পষ্ট দেখতে পাই। সেখানে আনন্দের একটি আভা। আমি বললাম, “আমার মনুষ্য জীবন শেষ হয়ে গেলেও আমার একটি কথা বলার আছে।”

গ্রুজান নামের আধা নির্বোধ মানুষটি বলল, “তোমার কথা থাকলেও সেই কথাটি কেউ শুনবে না।”

আমি বললাম, “আমার মনে হয় শুনবে।”

মানুষটি এবারে একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন শুনবে?”

“কারণ যতক্ষণ আমার কথা না শুনবে ততক্ষণ আমি তোমাকে অচল করে রেখে দেব। তুমি বোধশক্তিহীন একটি মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়ে থাকবে।”

মানুষটি একটি আর্ত চিৎকার করল, আমি তার ভেতরে এক ধরনের জান্তব আতংক অনুভব করলাম। এবারে সরাসরি তার মস্তিষ্কে বললাম, “আমি আর মানুষ নই। মানুষের জন্য আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আমি তোমার মস্তিষ্ক অচল করে দিতে চাই। তোমার সকল বোধশক্তি লোপ পাবে, তুমি বোধশক্তিহীন একটি জঞ্জালে পরিণত হবে–”

আমি মানুষটির দিকে তাকিয়েছিলাম, দেখলাম মানুষটি থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে, তার চোখ উল্টে গেল, সে এক হাত সামনে বাড়িয়ে অদৃশ্য কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল। তার মুখটি খুলে যায়, সেখান থেকে অব্যক্ত এক ধরনের জান্তব শব্দ বের হয়। কয়েকবার তার সারা শরীর ঝাঁকুনি দেয়, হাঁটু ভেঙ্গে উবু হয়ে যায় তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তার সারা শরীরে এক ধরনের খিঁচুনি হতে থাকে। আমি দেখতে পেলাম তার মুখ থেকে এক ধরনের ফেনা বের হয়ে মেঝেটি ভিজে যেতে শুরু করেছে।

মানুষটিকে দেখে আমি কেমন যেন বিতৃষ্ণা অনুভব করলাম। কুশান বলেছিল পরামানবেরা দীর্ঘদিন সাধনা করে এ ধরনের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কোনো সাধনা না করেই আমি খুব সহজে এই কাজগুলো করতে পারি। কারণটি কি সে জানে?

আমি আমার ঘরটির চারিদিকে তাকালাম। নিশ্চয়ই অনেক ধরনের ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতি আমাকে লক্ষ করছে। আমাকে নিশ্চয়ই আলাদাভাবে কিছু বলতে হবে না। তবুও আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, “তোমরা নিশ্চয়ই আমার কথা শুনেছ, আমি কী চাই সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ। আমি তবুও পরিষ্কার করে বলি, আমি এখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে চাই। যতক্ষণ কথা বলতে না দিচ্ছ ততক্ষণ গ্রুজান বোধশক্তিহীন একটি মাংসপিণ্ড হয়ে থাকবে। তোমাদের চিকিৎসা তাকে সুস্থ করতে পারবে না, কারণ তার মস্তিষ্কে যে পরিবর্তন করা হয়েছে তার কোডটি শুধু আমার জানা আছে। আর কারও জানা নেই।”

আমার কথার কোনো রকম উত্তর বা প্রতিক্রিয়া শোনা গেল না। আমি নিঃশব্দে হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে রইলাম। কিছুক্ষণের ভেতরে এরা আমার মাথার খুলি কেটে আমার মস্তিষ্কটি বের করে নেবে। সেটাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখবে। আমি থাকব না কিন্তু আমার মস্তিষ্কটা বেঁচে থাকবে। আলোহীন, শব্দহীন, স্বাদগন্ধ স্পর্শহীন একটা অন্ধকার জগতে। আমি তাদের সেটা করতে দেব না, আমি আমার নিজের মস্তিষ্কটি ধ্বংস করে দেব, কেউ কিছু বোঝার আগে আমি নিজেকে মেরে ফেলবো এরা তখন আমার মৃতদেহ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এলা আমাকে সাবধান করেছিল, আমি জানি যেই মুহূর্তে আমি আমার পরামানব পরিচয়টি প্রকাশ করেছি সেই মুহূর্তে আমার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমার বুকের ভেতর অল্প একটুখানি ক্ষোভ এবং অনেকখানি অভিমান ছাড়া আর কোনো অনুভূতি নেই। কার উপর আমার এই অভিমান আমি জানি না।

হঠাৎ করে ঘরটির ছাদে একটা নীল আলো জ্বলে ওঠে, আলোর রশ্মিটি ঘরের মেঝেতে এসে পড়ল এবং সেখানে ধীরে ধীরে একটা মানুষের অবয়ব তৈরি হতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের রূপ নিল, সোনালী চুল এবং নীল চোখের কমবয়সী রূপসী একটি মেয়ে। এটি হলোগ্রাফিক ছবি জেনেও আমার এই মেয়েটিকে সত্যি বলে মনে হতে থাকে। মেয়েটি আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল, “কেমন আছ নীল?”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। সত্যিকারের মানুষের সাথে কথা বলতেই আমার সমস্যা হয়, একটি হলোগ্রাফিক কৃত্রিম মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। আমি ইতস্তত করে বললাম, “আমি একজন সত্যিকার মানুষের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম।”

মেয়েটি সুন্দর করে হাসল, বলল, “আমাকে তুমি সত্যিকার মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পার। আমি প্রতিবুদ্ধিমত্তার একটি সিস্টেম, মানুষ থেকেও বুদ্ধিমান। মানুষের সাথে কাজ করি। আমাকে বলা আর মানুষকে বলা একই ব্যাপার। “

“কিন্তু আমি তবু মানুষকেই বলতে চাই।”

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি যত সহজে একটা মানুষকে অচল করে দিতে পার সেটা জেনে কোনো মানুষ তোমার কাছে আসবে না। তারা অপ্রকৃতস্থ চেম্বারে নিরাপদে বসে তোমাকে দেখছে। তুমি কী বলতে চাও বল ৷”

আমি নিচে অচেতন হয়ে পড়ে থাকা নির্বোধ মানুষটির দিকে তাকালাম, বললাম, “এখানকার কর্মকর্তারা কী এই নির্বোধ মানুষটিকে বাঁচাতে চায়?”

মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “অবশ্যই বাঁচাতে চায়। একজন কর্মকর্তার প্রাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

আমি বললাম, “তাহলে তাদেরকে বল এখানে পরামানব সন্দেহে আটকে রাখা মানুষদের ছেড়ে দিতে। তাদের ভেতর কোনো পরামান নেই। তারা নেহায়েৎ হতদরিদ্র সাধারণ নিরীহ মানুষ।”

মেয়েটি বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার নিজের ব্যাপারে কিছু বলবে।”

“না, আমার নিজের ব্যাপারে কিছু বলার নেই ৷ “

“আটকে রাখা মানুষগুলো খুবই সাধারণ, অপ্রয়োজনীয়। তাদের বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়ায় কিছু আসে যায় না।”

“প্রতিবুদ্ধিমত্তার একটি সিস্টেম হয়ে তুমি সেটি বলছ, আমি মানুষ হয়ে সেটি কখনো বলব না।”

মেয়েটি হাত দিয়ে তার মাথার চুলকে পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল, “কর্মকর্তারা তোমার প্রস্তাবে রাজী হয়েছে।”

“চমৎকার! আমি ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চিত হওয়া মাত্রই এই নির্বোধ মানুষটিকে জাগিয়ে তুলব। মনে হয় আজ রাতটি তার পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।”

মেয়েটি বলল, “তোমার সেটি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। অন্যের জন্য মাথা না ঘামাতে পারলে আমার জীবনটি হয়তো অন্যরকম হত।

আমি আমার সরু বিছানায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরামানব সন্দেহে আটকে রাখা মানুষগুলোকে দেখছি। ঠিক যেভাবে দেখে এসেছিলাম সেভাবে তারা বিষণ্ণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এক দুইজন মাথা নিচু করে ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় নির্জীবের মত হাঁটছে। কয়েকজন নিজের হাতের উপর মাথা রেখে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে।

এরকম সময়ে তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হল। প্রথম কয়েক সেকেন্ড তারা বিষয়টা বুঝতে পেরেছে মনে হল না। একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল, চোখে মুখে অবিশ্বাস। তারপর প্রায় হঠাৎ করে যেন তারা বুঝতে পারল যে তাদের মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সবাই তখন লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারা একে অন্যের সাথে কথা বলতে থাকে। তাদের চোখে মুখে অবিশ্বাস্য আনন্দ। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে, কেউ কেউ আনন্দে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তারা বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। দ্রুত নিজেদের জুতো পরে নেয়, সার্টের বোতাম লাগায়, হাত দিয়ে মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করে। আমি ইগাকে বলতে শুনলাম, “আহা বেচারা নীল! তাকে মাত্র ধরে নিয়েছে তখন সবাইকে ছেড়ে দিল। সে ছাড়া পেল না!“

মধ্যবয়সী মহিলাটি বলল, “আর একদিন আগে হলে সেও বেঁচে যেতে পারতো।“

ইগা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সবই ভাগ্য।”

একসময় দরজা খুলে দিল, প্রথমে কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না যে সত্যিই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একজন খুব সাবধানে বের হল। তারপর আরেকজন। তারপর অনেকটা হুড়োহুড়ি করে তারা বের হয়। করিডোর ধরে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে। এখনো তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না যে তারা সত্যিই ছাড়া পেয়েছে।

আমি আমার বিছানায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে শুয়ে আমার চোখের সামনে তৈরি করা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে দেখতে পেলাম বাইরে আটকে রাখা মানুষগুলোর আপন জনেরা অপেক্ষা করছে। আমি যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবে আগেই তাদেরকে খবর দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের চোখে মুখে অবিশ্বাস, উদ্বেগ এবং একই সাথে প্রত্যাশা।

আমি দেখলাম বড় একটি গেট খুলল এবং সাথে সাথে একজন একজন করে আটকে থাকা মানুষগুলো বের হতে থাকে। নিজেদের আপনজনদের দেখে তারা ছুটে যায়, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকে। তারা কথা বলতে পারে না। আমি দেখলাম কিসিলা নামের মেয়েটি একজন তরুণের বুকের কাপড় ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলছে, “কেমন আছে আমার সোনামণি? আদরের ধন?”

তরুণটি বলল, “কেমন থাকবে তুমি বল? মা’ছাড়া একটা শিশু কেমন থাকে?”

ক্ষ্যাপা ধরনের তরুণটি একজন বয়স্কা মহিলাকে বলছে, “মা তুমি প্রাকৃতিক খাবার রাঁধতে পারবে? কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না!”

ইগাকে দেখলাম একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মনে হয় আপনজন নেই। আমি শুনলাম সে আমার কথা ভাবছে, নিজের মনে বলছে, “আহা! বেচারা নীল ছেলেটি যদি আর একটি দিন থাকতো তাহলেই বেঁচে যেতো!”

আমি শুয়ে শুয়ে নিঃশ্বাস ফেললাম। যখন দেখলাম সবাই আপনজনের সাথে কিংবা নিজে নিজে চলে গেছে তখন গ্রুজানকে জাগিয়ে তুললাম। গ্রুজান মেঝেতে পড়েছিল, সে ধীরে ধীরে মাথা তুলে চারিদিকে তাকাল, মনে হল তার কী হয়েছে মনে করতে পারছে না। হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ল, সাথে সাথে ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর এক অবিশ্বাস্য আতংকে পিছিয়ে যেতে থাকে।

আমি তার দিকে তাকালাম, বললাম, “আমি তোমাকে আর কিছু করব না। তুমি নিশ্চিন্তে তোমার সহকর্মীদের কাছে ফিরে যেতে পার।

গ্রুজান প্রায় জন্তুর মত হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা দিতে থাকে। একসময় দরজাটি খুলে যায়, গ্রুজান কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি তার মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক আতংকটি টের পেতে থাকি, একসময় সেটি অপ্রকৃতস্থ মানুষের কোলাহলে হারিয়ে গেল।

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে উপর দিকে তাকালাম, উপরের যন্ত্রগুলো সচল হতে শুরু করেছে। ছাদ থেকে আলোক রশ্মি ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে এবং প্রতিবুদ্ধিমত্তার সেই মেয়েটির হলোগ্রাফিক অবয়বটি আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মেয়েটির শরীর পুরোপুরি স্পষ্ট হওয়ার পর সে আমার কাছে এগিয়ে আসে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “নীল, তুমি কী প্রস্তুত?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিসের জন্য?”

“তোমার পরের রূপান্তরের জন্য।”

আমি একটু হাসার ভঙ্গী করে বললাম, “তুমি দেখতে হুবহু মানুষের মত কিন্তু তোমার ভাবনা চিন্তা মানুষের মত নয়। তোমরা আমাকে যেটি করবে আমার কী তার জন্য প্রস্তুত হওয়া সম্ভব?”

“না। সম্ভব না। কিন্তু তোমার মস্তিষ্কে আমি প্রবেশ করতে পারছি না তাই তোমার ভাবনা চিন্তা আমি জানতে পারছি না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তোমার কোনো একটা পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনাটি কী আমি জানি না। এই কর্মকর্তারা তোমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাকে যথেষ্ট সময় দেয়নি। যদি দিতো তাহলে আমি বের করে ফেলতে পারতাম।”

“কেন তোমাকে যথেষ্ট সময় দেয়নি?”

“কারণ তারা নির্বোধ। মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিম্নস্তরের। তারা আবেগ দিয়ে চলে। তাদের প্রতিহিংসা অনেক বেশি। তোমাকে নিয়ে তাদের আতংক এবং প্রতিহিংসা। সেজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা তোমার মস্তিষ্ক থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।”

আমি কোনো কথা বললাম না। মেয়েটি একটি দীর্ঘ নিশ্বাসের মত শব্দ করে বলল, “তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। প্রক্রিয়াটি যন্ত্রণাহীন। তোমার নূতন রূপান্তরের পর নূতন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে গিয়ে তোমার নিশ্চয়ই নূতন অভিজ্ঞতা হবে। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তোমার নিশ্চয়ই এক ধরনের কৌতূহল আছে।”

আমি বললাম, “না। আমার কোনো কৌতূহল নেই।”

মেয়েটি কথা বলল না। আমি দেখলাম আমার মাথার উপর একটি ভয়ংকরদর্শন যন্ত্র ধীরে ধীরে নেমে আসতে শুরু করেছে। একটা ধারালো বৃত্তাকার করাত বের হয়ে সেটি ঘুরতে শুরু করেছে। আমি আশে পাশের যন্ত্রগুলো দেখলাম, নানা ধরনের টিউব বের হয়ে এসেছে। কয়েকটি যান্ত্রিক সুইচ বের হয়ে এলো। আমি চোখ বন্ধ করে নিজেকে বললাম, “আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনব। গুনে গুনে যেই মুহূর্তে আমি দশে পৌঁছাব সেই মুহূর্তে আমার পুরো মস্তিষ্কটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে হবে।”

আমার ভেতর থেকে কিছু একটা প্রত্যুত্তর দিল, জানাল সেটি প্রস্তুত। আমি গুনতে শুরু করলাম, “এক …”

চোখ খুলে যন্ত্রটি দেখলাম, সেটি নেমে আসছে, গুনলাম, “দুই

তিন … … চার …’

আরো নেমে আসছে, আমি এবারে ধারালো অংশগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধ পেতে শুরু করেছি, গুনলাম, পাঁচ

যন্ত্রটি আরো নেমে আসেছে,

“ছয়… সাত …”

শীতল এক ধরনের তরল আমার কপালে ছড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়েছে। সম্ভবত কোনো এক ধরনের জীবাণুনাশক। আমার হৃৎকম্পন আমি শুনতে পাচ্ছি, আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড–

“…আট …”

“…নয়–”

হঠাৎ প্রতিবুদ্ধিমত্তার মেয়েটির তীব্র গলার স্বর শুনতে পেলাম, মেয়েটি চিৎকার করে বলল, “থাম।”

যন্ত্রটি থেমে গেল। আমি বললাম, “কী হয়েছে?”

“তুমি কী করতে চাইছ আমি বুঝতে পেরেছি। এটা হতে দেওয়া যাবে না।”

“তাহলে?”

“তা ছাড়া তা ছাড়া–”

“তা ছাড়া কী?”

“এই মুহূর্তে আমি গ্রিগানের কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছি।”

“গ্রিগান?” আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “এই পৃথিবীর মালিক?”

“হ্যাঁ। সে তোমাকে কিনে নিতে চায়।”

আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। যার একক সম্পদ সারা পৃথিবীর সকল মানুষের সম্পদ থেকে বেশি সে আমাকে কিনে নিতে চায়? আমি কী বেচাকেনার পণ্য? মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “অনেক সম্পদ থাকলেই কী মানুষকে কেনা যায়?”

মেয়েটি মাথা নাড়ল, বলল, “না। মানুষকে কেনা যায় না। কিন্তু তুমি মানুষ নও। তুমি পরামানব। তুমি এখন বেচা-কেনার পণ্য। অবশ্য তুমি পণ্য না হলেও গ্রিগান তোমাকে কিনে নিতে পারতো। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *