০৯-১০. মিটিং ছিল অফিসে

০৯.

আজকে একটা মিটিং ছিল অফিসেই। জিষ্ণুর কাছে সাতটাতে ক্লায়েন্ট এসেছিল। রিজিয়োনাল ম্যানেজার ফ্রি হতে আরও দশ মিনিট লাগালেন। তার পর বললেন, ওল অফ আস আর টায়ার্ড টু আওয়ার বোনস। চলো, স্যাটারডে ক্লাব-এ যাই।

ক্লাবে গিয়ে এককোনায় বসে মিটিং হল। বলতে গেলে খালি পেটেই অনেকগুলোহুইস্কি খেতে হল। কাজের সঙ্গে মদ খাওয়াটা আজকাল ফ্যাশন। কে কত বেশি মদ খেতে পারে তা নিয়েও একটা বাহাদুরির ব্যাপার থাকে। এই চাকরির সবই ভালো কিন্তু মালটিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোরবিভিন্ন খাতের অপচয় চোখে দেখা যায় না। হরির লুট চলে এখানে।

স্যাটারডে ক্লাব থেকে যখন বেরোল তখন প্রায় সাড়ে নটা। আর এম এবং চানচানি রয়ে গেলেন। আর এম-এর মেজাজ খুব ভালো। এম ডি এসেছিলেন এবং জিষ্ণুদের ব্রাঞ্চের খুবই প্রশংসা করে গেছেন। বলে গেছেন, কিপ ইট আপ ইয়াং বয়েজ, অ্যাণ্ড ডোন্ট ওয়ারি, ইউ উইল বি ওয়েল লুকড়-আফটার।

ইয়াং বয়েজ বলে গেলেন বটে। তাঁর নিজের বয়েসই চল্লিশের বেশি হবে না। আজকাল এই ট্রেণ্ড। আম্বানি, পারেখ, গোয়েঙ্কা, কল, কানোড়িয়া এমনি অগণ্য মানুষ, চল্লিশের কম যাদের বয়েস; তারাই বিরাট বিরাট মালটিন্যাশনাল কোম্পানির কর্ণধার। অনেকেই অবশ্য পৈতৃক সাম্রাজ্য পেয়েছেন কিন্তু আজকের দিনের প্রেক্ষিতে ব্যাবসা চালাবার যোগ্যতা না থাকলে তাঁরা ওই আসন পেতেন না পরিবার থেকেও। আর কিছু আছে মেধাবী, পুরোপুরি প্রফেশনাল ম্যানেজারস। তারাই আস্তে আস্তে টেক-ওভার করে নেবে এই ম্যানেজারিয়াল পোস্টগুলো। যাদের ব্লক শেয়ার হোল্ডিং তারা গলফ খেলবে, হুইস্কি খাবে, মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করবে। তাদেরই হয়ে, দুধে-ভাতে-রাখা প্রফেশনালসরা তাঁদের সাম্রাজ্য চালাবেন।

 ক্লাব থেকে বাড়িতে এল গাড়িতেই। পরিও অবশ্য অফিস থেকে ট্রান্সপোর্ট পায়, যাতায়াতের। কিন্তু গাড়ি দিলেও নিতে পারেনি ওই একই কারণে। শ্যামবাজারের এই গলিতে আর থাকা সম্ভব নয় ওদের পক্ষে। সাউথে যেতে হবে। এখানে প্রত্যেকটি মানুষের জন্ম, তারিখ, ঠিকুজি, বাবার নাম, ঠাকুরদার নাম, পারিবারিক পটভূমি অন্যেরা জানে। কিন্তু নতুন বড়োলোক হওয়াদের, অতীতকে গুলি-মারা মানুষদের ভিড় যেখানে, সেই প্রায়শঃই অতীত লুকোনো বুদ্ধিজীবী দুর্বুদ্ধিজীবী নির্বুদ্ধিজীবীদের সাউথ-এ একবার গিয়ে ভিড়ে গেলে নিজেই, কিছুদিন পর নিজেকে আর চিনতে পারা যায় না। নিজেকে মনে হয় স্বয়ম্ভু। আত্মীয় পরিজন জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কথা তো বেমালুম ভুলে যাওয়া বা অস্বীকার করাও যায়। খোঁজ চলছে। পরিও খোঁজ করছে। ও-ও ফ্ল্যাট কিনবে। কোম্পানি থেকে মোটা অ্যাডভান্স দেবে! জিষ্ণুকেও দেবে। ফ্ল্যাট হাতে এলেই গাড়িটাও নিতে পারবে। তবে পরির মাইনে জিষ্ণুর চেয়ে অনেকই বেশি। প্রায় হাজার আষ্টেক পায় পরি। ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেনস-এ পরির ফ্ল্যাটের ব্যাপারটা প্রায় পাকা হয়ে এসেছে।

কিন্তু পুষি?

পুষির চলে যাওয়াটা জিষ্ণুর ভবিষ্যৎ-এর সব পরিকল্পনাই গোলমাল করে দিয়ে গেছে। বড়োই নিশ্চেষ্ট লাগে। কাজ করতে হয়, করে। খেতে হয় খায়। পড়াশুনো-টড়াশুনো সব মাথায় উঠেছে। লেখালেখিও তাই। রাতে ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম হয় না। বুকের ভেতরে যে ইঞ্জিনটা ফুলস্পিডে টপ-গিয়ারে চলতে আরম্ভ করেছিল সে যেন কোনো রাক্ষসের হাতের ছোঁওয়ায় হঠাৎ-ই ফ্রিজ করে গেছে। মাঝপথে। আর কোনো দিন ওতে গুঞ্জরন উঠবে বলে মনে হয় না।

পুষির মৃত্যুর পর পরি একেবারেই বদলে গেছে। পুষির সঙ্গে জিষ্ণুর আলাপ হওয়ার পর তিনটে বছর যেমন মনমরা হয়েছিল পরি তেমনই উৎসাহিত হয়ে উঠেছে আবার ফুলে

ফেঁপে, বর্ষার নদীর মতো। ওর ভাবভঙ্গি, আচার-ব্যবহার বড়ো অবাক করে জিষ্ণুকে। কী যে বলতে চায় ও, বোঝে না। যা বলতে চায়, তা বোঝার কাছাকাছি এলেও অস্বস্তি বোধ করে ও। কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে। ওর নিজের খুড়তুতো বোন। শিশুকাল থেকেই একসঙ্গে বড়ো হয়েছে। প্রথম যৌবনে এরকম অনেক দুর্ঘটনা ঘটে যায় বলে শুনেছে, দেখেছে; পড়ে তো ছেই। কিন্তু এই পরিণত যৌবনে?

 জিষ্ণু শুয়ে পড়েছিল খেয়ে দেয়ে সেদিনের রাতে। পরি চান করে সুগন্ধি মেখে নাইটি পরে এসেছিল ওর ঘরে। দুটি গ্লাস এবং একটি রাম-এর বোতল নিয়ে।

বলেছিল, তুমি ভালোবাসো, তাই।

নাইটির ভেতর দিয়ে এক অন্য পরিকে দেখেছিল জিষ্ণু। অচেনা, অভাবনীয়, অনাঘ্রাত, রোমহর্ষক। অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে জিষ্ণু উঠে বসেছিল বিছানাতে। পেছন থেকে আলো পড়ায় পরির হালকা সবুজ সিল্কের নাইটিটাকে স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল। মেয়েদের শরীরে অসীম রহস্য থাকে, যা হয়তো কোনোদিনও পুরোনো হয় না। প্রচন্ড লোভ জেগেছিল একমুহূর্তের জন্যে। তার পরই হুঁশ ফিরে এসেছিল ওর। বুঝেছিল যে, সে-অনুভূতির নাম লোভ নয়, কাম। প্রথম রিপু।

 রাম-এর গ্লাসে নিট রাম ঢেলে দিয়ে পরি উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার পরই ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বলেছিল, বাইরে অনেক চাঁদ। কলকাতা কর্পোরেশনের উচিত দশমী থেকে পূর্ণিমা অবধি শুক্লপক্ষে পথের সব আলো নিভিয়ে রাখা।

জিষ্ণু বলেছিল, হ্যাঁ। তাহলে চোর-ডাকাত-রেপিস্ট-মার্ডারারদের তো পোয়াবারো।

ভালো দেখাত কত্ব। কত্ব ঠাণ্ডা, স্নিগ্ধ হত শহরটা।

বলেই, বাইরের বারান্দার দরজাটা পুরো খুলে দিয়েছিল। সত্যিই গানুবাবুদের বাড়ির গাছপালা চোঁয়ানো সবুজ জ্যোৎস্না এসে ভরে দিয়েছিল মার্বেলের বারান্দাটা। তার পরই চুঁইয়ে এসেছিল ঘরে।

পুষি একদিন এই চাঁদের আলো ভরা বারান্দাতে বসে জিষ্ণুকে বলেছিল, বিয়ের পর সারারাত এই বারান্দাতে বসে থাকব।

 পরি এসে বিছানাতে বসল জিষ্ণুর পাশে। বাঁ-হাতে রাম-এর গ্লাসে বড়ো একটা চুমুক দিয়েই ডান হাতটা জিষ্ণুর স্লিপিং স্যুটের বুকখোলা জামার মধ্যে গলিয়ে ওর বুকে হাত বোলাতে লাগল।

ভেঙে পড়ছে ইমারত। ভেঙে পড়ছে ওর শৈশব-পালিত মূল্যবোধ, কলকাতার সব পুরোনো বাড়ি ধসে যাচ্ছে। চারিধারে খসে-যাওয়া পলেস্তারা, খুলে-নেওয়া সেগুন কাঠের কড়ি-বরগা, জানালা-দরজা। ধুলো উড়ছে চারদিকে, বালি। পুরোনো সবদিকে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। ধুলোবালিতে ভরে যাচ্ছে শহরটা, এ-শহরের মানুষেরা। নতুন হয়ে যাচ্ছে জিষ্ণু আর পরিরা। নতুন হচ্ছে কলকাতা। কিন্তু ভালো হচ্ছে কি?

এক সময়ে জিষ্ণু ঘুমিয়ে পড়েছিল। আরামে, বাধা দেওয়ার অপারগতার গ্লানিতে এবং শ্রান্তিতেও। এমন ঘুম-এর আগে কখনো ঘুমোয়নি জিষ্ণু।

কখন পরি চলে গেছিল স্বপ্নে-আসা পরিরই মতো, তা জানেনি জিষ্ণু।

হঠাৎ-ই ওর ঘুম ভেঙে গেল এক তীব্র তীক্ষ্ণ অপরাধবোধে বিদ্ধ হয়ে। ছিঃ ছিঃ। ও কী মানুষ!

পরি বিড় বিড় করে কী একটা কথা বলছিল বার বার। আমি তোমার বন্ধু। আমি তোমাকে বিয়ে করব। অ্যাণ্ড উই উইল লিভ মেরিলি, হিয়ারআফটার।

কী বলছ! তুমি আমার বোন।

জিষ্ণু ঘোরের মধ্যে বলেছিল গরম প্রশ্বাস ফেলে।

বাজে কথা। তুমি জানো না।ড্য ডুন্নো।

 কাকিমা?

শ শ শ। ডোন্ট আটার দ্যাট নেম। শি ইজ আ বিচ।

 নিজের জন্মদাত্রী মাকে কুকুরি বলে গালাগালি দেয় এ কেমন শিক্ষার রকম? কী হল? এত ভালো ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনো করে?

কী যে ঘটে যাচ্ছে কিছুদিন হল এ-বাড়িতে, কলকাতায়; কিছুই বুঝতে পারছে না জিষ্ণু। তারিণীবাবুর এই পৈতৃক বাড়ি অভিশপ্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র এই কারণেই এ-বাড়ি জিষ্ণুর ছেড়ে যাওয়া দরকার। জ্বর জ্বর লাগছে জিষ্ণুর। যদি কাকিমা এসে ঢোকেন ঘরে? যদি শুধোন, তোরা কী করছিলি?

মাথার কাছে হাত বাড়িয়ে আর একটা ঘুমের ওষুধ টেনে নিল জিষ্ণু। ট্রাপেক্স টু মিলিগ্রাম খায় ও, পুষিকে ইলেকট্রিক ফার্নেসে ঢুকিয়ে আসার রাতের পর থেকেই। একটা শোয়ার আগেই খেয়েছিল। পরি এসে ঘুম ভাঙাল। আর একটা খেতে হবে। কাল নটায় পৌঁছোতে হবে অফিসে।

 একটা ভিসাস-সার্কল হয়ে গেছে যেন পুরো জীবনটা। কোনো বৈচিত্র্য নেই, বন্ধু নেই; নির্মল আনন্দ নেই। অফিস-বাড়ি-স্লিপিং-ট্যাবলেট-ঘুম-অফিস-বাড়ি-পরি-অপরাধবোধ-তীব্র ছুরিকাঘাতের মতো তীক্ষ্ণ শারীরিক আনন্দ-অবসাদ-অপরাধবোধ ঘুম-জেগে ওঠা-অফিস।

 বন্ধু যে নেই তার, সে-দোষ তার একার নয়। বন্ধুদের দেওয়ার মতো সময় জিষ্ণুর কোনো দিনও বেশি ছিল না। আর শুধুই প্রত্যয়হীন এবং গন্তব্যহীন রাজনীতি, খেলা, সাহিত্য অথবা অশেষ পরচর্চায় দিন কাটাতে তার ভালো লাগত না। ওইসব আড্ডা নিছকই বাঙালি-আড্ডা। তা থেকে শেখার কিছুই নেই। নিজেকে উন্নত করার কিছু নেই। বাড়ি বসে লিখেছে, পড়েছে, গান গেয়েছে, ছবি এঁকেছে এবং তাতেই চিরদিন ও আনন্দ পেয়েছে। ও একা চিরদিনের। একাকিত্বতে ও ছেলেবেলা থেকেই অভ্যস্ত আছে।

কাছের বন্ধু বলতে একমাত্র ছিল পিকলুই। একটা সময়ে পিকলু আর জিষ্ণু অভিন্নহৃদয় ছিল। পিকলুকে ও, ওর হৃদয়ের সব উষ্ণতাই নিংড়ে দিয়েছিল। বড়োই চোট পেয়েছে হৃদয়ের সবচেয়ে নরম জায়গাটাতে জিষ্ণু। গুলি লেগেছে হৃদয়ে। কিন্তু ওই চোটের পর জায়গাটা পাথর হয়ে গেছে। আর সেখানে কোনো ঘাসও জন্মাবে না। বন্ধুত্ব কথাটাতেই ওর বিশ্বাস সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দিয়েছে পিকলু। সেই তারাশঙ্করের দুই পুরুষ নাটকে মাতাল সুশোভনের ডায়ালগ ছিল না? আই হ্যাড মাই মানি অ্যাণ্ড মাই ফ্রেণ্ড : আই লেন্ট মাই মানি টু মাই ফ্রেণ্ড। আই লস্ট মাই মানি অ্যাণ্ড মাই ফ্রেণ্ড।

এটা অনেকই আণ্ডার-স্টেটমেন্ট! বন্ধু যখন তঞ্চক হয়ে ওঠে, তখন টাকার শোকটা শোকই নয়, তিলতিল করে গড়ে তোলা একটি জীবনের সমস্ত বিশ্বাস তখন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। বিশ্বাস নিজের বুকে একটুও না থাকলে কি কারো পক্ষেই এই অবিশ্বাসী পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সম্ভব? না। জিষ্ণুর পক্ষে অন্তত সম্ভব নয়।

পুষিটা যদি থাকত! পরির মধ্যে বড় জ্বালা, দহন, তীব্র ধার তার স্পর্শে, ধারালো ছুরির উষ্ণ স্পর্শে, সে কেটে ফালা ফালা করে জিষ্ণুর শরীর, চেতনা, সব। পরিকে ও যদি না মারতে পারে, তবে পরিই ওকে মেরে ফেলবে। শিগগির। ও রোগগ্রস্ত হয়েছে। বাড়ি ফিরে আসতে ভয় করে ওর। পরির গলার স্বর শুনলে ভয় করে।

 পরি যখন ছোটো ছিল, জিষ্ণুও ছোটোই, কাকিমা ও হীরুকাকার সঙ্গে দেওঘরে বেড়াতে গেছিল একবার পুজোর সময়ে। নন্দন পাহাড়ের কাছে ছোট্ট একটা বাড়িতে উঠেছিল। কে জানে কাদের বাড়ি? আজ মনে নেই আর।

সকালের মিষ্টি মিষ্টি রোদে ওরা দু-ভাই-বোন নতুন জামা জুতো পরে লাল ধুলো কাঁকড়ের কাঁচাপথে হাঁটতে যেত গুটি গুটি পাহাড়ের দিকে। একদিন পরি একটা লাল আর হলুদ আর কালো গরম স্কার্ট পরেছিল। আর লাল ফ্ল্যানেলের ব্লাউজ। পায়ে হলুদ মোজা আর কালো জুতো। কাকিমা খুবই শৌখিন ছিলেন। ওঁর শখের লকলকে গাছটি ফুলফলন্ত হত পরি আর জিষ্ণুর মাধ্যমে। দুজনে হাতে হাত ধরে ওরা হাঁটছিল।

পরি বলেছিল, জিষ্ণু, তোমাকে খুব ভালো লাগে আমার।

 জিষ্ণু বলেছিল, আমারও খুব ভালো লাগে তোমাকে।

বড়ো হলে আমি তোমাকে বিয়ে করব।

 দুর পাগলি। তুমি তো আমার বোন।

তাতে কী হয়? আমি তো মেয়ে। হবে না বিয়ে?

পাগলি। তুমি একটা পাগলি পরি।

 পাগলিই হই আর যাই-ই হই। আমি তোমাকে বিয়ে করবই। দেখো তুমি।

কলকাতার বাইরে কাজে না গেলে পরি আজকাল রোজই আসে। স্বপ্নের পরিরই মতো। প্রথম রাত কেটে যায় স্বপ্নেরই মতো। আশ্চর্য হয়ে যায় একথা ভেবে জিষ্ণু যে, কাকিমা কেন আসেন না এদিকে? উনি কি জানেন?

একজন সাইকিয়াট্রিস্ট খুবই দরকার জিষ্ণুর। কালই অফিস থেকে ডা. কিশলয় কুমার অথবা ডা. নন্দীকে ফোন করতে হবে। এক গভীর অপরাধবোধে সবসময়েই ক্লিষ্ট থাকে জিষ্ণু। মুষড়ে থাকে মানসিকভাবে, শারীরিক আনন্দর মধ্যেও। পুষির মৃত্যুতেও ও এতখানি মুষড়ে পড়েনি।

 এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুম ঘুম পেতে লাগল জিষ্ণুর। ঘুমোনো সহজ ছিল না। জীবনে ও কখনো সম্পূর্ণ নগ্না কোনো নারীকে আগে দেখেনি। না। পরির মতো কারোওকে তো নয়ই। তার বোন। কিন্তু এত সুন্দরী ও জ্বালাময়ী হয় কি প্রত্যেক নগ্ন নারীই? কোনো ধারণাই ছিল না। পুষিকেও কি এরকমই দেখাত? যদি দেখার সুযোগ পেত?

 বারান্দা থেকে চুঁইয়ে-আসা চাঁদের আলোয় পরির মসৃণ উষ্ণ শরীরের স্পর্শনে, ঘর্ষণে, স্পন্দনে জিষ্ণুর এ ক-দিনই মনে হয়েছে নিবিড় সহানুভূতি, পরমনির্ভরতা এবং অনভ্যস্ত উত্তেজনার মধ্যে যেন ঝুঁদ্যার দুটি মূর্তি প্রাণ পেয়েছে হঠাৎ। জীবনের প্রথম নারী সংসর্গর বিবশতা কামানের গোলার আঘাতের চেয়েও বেশি মারাত্মক। পরির সঙ্গে ওর কঁদ্যার প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া একটুও উচিত হয়নি। প্রায়ই ভাবে জিষ্ণু।

.

১০.

 জিষ্ণুদের অফিস শনিবার বন্ধ থাকে। ফাইভ-ডেইজ উইক। কিন্তু মাঝে মাঝেই শনিবারে শনিবারে ম্যানেজারিয়াল লেভেলের অফিসারদের মিটিং থাকে। যেতে হয়। লাঞ্চ অবধি মিটিং চলে। সেইসব দিনে, দুপুরে বাড়ি এসেই লাঞ্চ খায়।

আজ মিটিং-এর পর আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছিল না। কাকিমার ও পরির খাওয়া হয়ে যায় এতক্ষণে। পরির অফিস শনিবারে পুরোই বন্ধ থাকে। মোক্ষদাদি ও শ্ৰীমন্তদা বসে থাকে ওর জন্যে। তবু বলাই আছে যে, শনিবারে একটা বেজে গেলে ও বাড়িতে খাবে না। ওয়ালডর্ফ-এ গিয়েই খেয়ে নিল আজকে। তার পর পৌনে তিনটে নাগাদ ট্যাক্সি নিয়ে বেরোল। আজ ও তারিণীবাবুর বাড়ি যাবেই। বৃদ্ধর চিঠিটি ওর মধ্যে এক আলোড়ন এনেছিল। বৃদ্ধর প্রতি এক ধরনের সমবেদনা আর কাকিমার প্রতি এক ধরনের অসূয়ার জন্ম দিয়েছিল সেই চিঠিটি।

বাড়িটা আর বাড়ি নেই। পরির ব্যবহার এবং চালচলনও দিনে দিনে বড়োই অদ্ভুত হয়ে উঠছে। তা ছাড়া, ইদানীং না-বলে-কয়ে অসময়ে বাড়ি ফিরলে প্রায়ই দেখে হীরুকাকু আর কাকিমা, কাকিমার ঘরে বসে গুজগুজ ফুসফুস করছেন।

হীরুকাকু অনেকই করেছেন এক সময়ে। তাঁর অথবা কাকিমার কোনোরকম সমালোচনা করা জিষ্ণুর ইচ্ছা নয়। তাতে অধিকারও নেই। তবে এমন এমন সব ঘটনা ঘটত না আগে। বদলে যাচ্ছে পুরোনো যা-কিছু ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস। যা দেখেনি, তাই দেখছে। ধাক্কা তাই লাগে বই কী।

হীরুকাকু আর কাকিমা না থাকলে পিতৃমাতৃহীন জিষ্ণু হয়তো ভেসেই যেত। কিন্তু বড়ো হয়ে ওঠার পর ও যেন, ক্রমশই বুঝতে পারছে ওর তেমন আপনজন একজনও নেই। পুষির মধ্যে ও ওর হারানো এবং পুরোপুরিই ভুলে-যাওয়া মা এবং প্রেমিকাকে পেয়েছিল। পুষির মা-বাবার কাছ থেকেও যে-স্নেহ পেয়েছিল তা বলার নয়। যার দাবিতে ওর সব জোর ছিল ও-বাড়িতে সেই মানুষটিই চলে যাওয়াতে এখন সেখানে যেতে বড়োই লজ্জা করে! মনে হয়, ধোঁকা দিয়ে ও ওঁদের ভালোবাসা এখনও চাইছে। যা চিরদিনের নয়, তা পেয়ে লাভই বা কী? তা ছাড়া, তা পেতে ওর আত্মসম্মানেও লাগে। পুষির ছোটোবোন হাসি। মাঝে মাঝেই ফোন করে যেতে বলে। জিষ্ণুই যায় না। নতুন করে কোনো বাঁধনে পড়তে চায় না আর ও।

পকেট থেকে চিঠিটা বের করে ঠিকানাটা আর একবার দেখে নিল। বহুদিন আগে একবার হীরুকাকুর সঙ্গেই এসেছিল। চিঠিটি তো পেয়েছে বেশ ক-দিনই হল। তারিণীবাবুর এস ও এস। তারিণীবাবুর কাছে ও অনেক আগেই আসত। কিন্তু অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে চিঠিটি ওর লেখা-পড়ার টেবিলের ডান দিকের ড্রয়ার থেকে হারিয়ে গেছিল।

 কোনো ড্রয়ারেই, এমনকী আলমারিতেও চাবি দেওয়া অভ্যেস নেই ওর। চাবি দিলে মনে হয় শ্ৰীমন্তদা আর মোক্ষদাদিকে অপমান করা হচ্ছে। না দিয়ে দিয়ে, চাবি দেওয়ার অভ্যেসই চলে গেছে। চিঠিটা আবার হঠাৎ খুঁজে পেয়েছিল গত বুধবার। হয়তো ভুলোমনের কারণে ও নিজেই অসাবধানে রেখেছিল বা অন্য কাগজপত্রর সঙ্গে মিশে গেছিল।

ট্যাক্সিটা মোড়েই ছাড়ল। কারণ, যাদের অবস্থা ভালো নয় তাদের বাড়ির সামনে গাড়ি বা ট্যাক্সিতে গিয়ে পৌঁছোতে বাধো বাধো ঠেকে, লজ্জা করে। মনে হয়, বড়োলোকি দেখানো হচ্ছে।

 মোড়টা ঘুরতেই চোখে পড়ল একটি বড়ো স্টেশনারি দোকান। ভাবল, ওই দোকানে ঠিকানাটা বলে একবার ডিরেকশানটা জিজ্ঞেস করে নেবে। পথের উলটোদিক থেকে একটি মেয়ে হেঁটে আসছিল। অতিসাধারণ একটি তাঁতের শাড়ি পরা। মুখে-চোখে স্বাচ্ছল্যর অভাব ফুটে রয়েছে কিন্তু তার চলা, চোখ-চাওয়া, শাড়ি পড়ার সভ্যভঙ্গিটির মধ্যে থেকে এমন একটি শালীন সম্ভ্রান্ততা উপছে পড়ছে যে, যার চোখ আছে তার ভুল হওয়ার কথা নয় যে, সে-মেয়ে অসাধারণ। অসাধারণত্ব থাকতে পারে বংশ-পরিচয়ে, কৌলীন্যে এবং স্বাচ্ছল্যে। এবং দারিদ্রেও। অসাধারণত্বর কারণটা ঘনিষ্ঠ হলে তবেই জানা যায় কিন্তু অসাধারণত্ব এমনই এক জিনিস যা লুকিয়ে রাখা যায় না। পাঁচ-শো মানুষের মধ্যে থাকলেও তা প্রকাশিত হয়ে পড়েই।

মেয়েটি একবার জিষ্ণুর দিকে চাইল। ছাই-রঙা একটি বিজনেস-স্যুট পরেছিল জিষ্ণু। সঙ্গে লাল-কালো টাই। লাঞ্চ খাওয়ার সময়ে টাইয়ের নটটা খুলে গলার বোতামটাও খুলে দিয়েছিল। এখন মনে হল, না খুললেও পারত। মনে হতেই নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই হেসে ফেলল মনে মনে।

মেয়েটিও ওই দোকানেই ঢুকেছে। সে ঢোকার তিরিশ সেকেণ্ড পর গিয়ে ঢুকল জিষ্ণু।

 কী দেব?

দোকানি বললেন।

 কিছু না। তারিণীবাবু, মানে তারিণী চক্রবর্তী কোথায় থাকেন বলতে পারেন? এই ঠিকানা।

বলেই, চিঠিটা বের করল কোটের বাঁ-দিকের পকেট থেকে।

দোকানি হাসলেন। বললেন, ভালো সময়েই শুধোলেন। এই যে এঁদের বাড়িতেই থাকেন তারিণীবাবু। ওঁর জ্যাঠামশাই হন সম্পর্কে।

 মেয়েটি মিষ্টি প্রতিবাদ করে উঠল। বলল, এ কী অন্যায় কথা। জ্যাঠামণি আমাদের বাড়িতে থাকতে যাবেন কোন দুঃখে? উনি নিজের বাড়িতেই থাকেন। আমরা থাকি সে বাড়িরই এক অংশে।

তার পরই জিষ্ণুকে বলল, আপনার খুব তাড়া নেই তো? একটি জিনিস নিয়েই আমি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে চলুন। একেবারে জ্যাঠামণির হাতেই সমর্পণ করে দেব আপনাকে।

 বৃদ্ধ দোকানি খুব রসিক। হেসে বললেন, দয়া করে তাই কোরো মামণি। ভদ্রলোকের যা চেহারা-মাঝপথেই না ছেনতাই করে নেয় অন্যে।

মেয়েটি লজ্জা পেয়ে মুখ নীচু করল। তার পরই মুখ তুলে হাসল। জিষ্ণু দেখল, হাসলে গালে টোল পড়ে তার।

মেয়েটি বৃদ্ধ দোকানিকে বলল, রবিকাকা অচেনা ভালোমানুষের পেছনে লাগার স্বভাব কবে যাবে তোমার এল তো?

স্বভাব কি যায় মামণি? স্বভাব যায় না মলে। তুমি এত তাড়াতাড়ি মানুষকে ভালো বলে ঠাহর করে ফেলো নাকি? বাঃ। তবে কথাটা তো শুধু অচেনা ওকেই বলিনি মা, চেনা তোমাকেও বলা। তা ছাড়া অচেনা, চেনা হতে কতক্ষণ লাগে এল তো? চিনতে যদি কাউকে চায়ই কেউ?

জানি না।

 মেয়েটি বলল। লজ্জা পেয়ে অপ্রতিভ মুখ নামিয়ে।

তার পর বলল, কই? দিয়েছ?

এই নাও। বলেই ঠোঙাটা এগিয়ে দিলেন।

ঠোঙায় কী ছিল তা বোঝা গেল না।

দোকানি রবিবাবু বললেন, তাহলে লিখেই রাখছি। দাদাকে…

বলেই, জিষ্ণুর দিকে তাকিয়েই থেমে গেলেন।

 মেয়েটির মুখ মুহূর্তের জন্যে লাল হয়ে গিয়েই আবার স্বাভাবিক চাঁপা-রঙা হয়ে গেল।

 কৃতজ্ঞতা-মাখা গলায় বলল, যাচ্ছি তবে রবিকাকা।

এসো মামণি। যাওয়া নেই।

পথে বেরিয়ে মেয়েটি বলল, আপনি আমার জ্যাঠামণিকে চেনেন?

হুঁ।

কীভাবে? ধার আদায় করতে এসেছেন বুঝি? কালকে এক কাবুলিওয়ালা এসেছিল।

তাই? হেসে বলল, জিষ্ণু।

আমার কথার উত্তর দিলেন না যে?

কোন কথার?

 ধার আদায় করতে এসেছেন কি না?

 ও। ওই। একরকমের তাই বলতে পারেন।

কালো হয়ে গেল মুখ।

কষ্ট হল জিষ্ণুর, রসিকতাটি করেছে বলে।

মেয়েটি বলল, আমার জ্যাঠামণি ভারি ভালো মানুষ, ভারি সরল। আপনি কতটুকু জানেন ওঁর সম্বন্ধে?

অনেকখানিই। তবে সব নিশ্চয়ই নয়। সব জানলে আপনার কথাও জানতাম।

 মেয়েটি কথা না বলে হাঁটতে লাগল। জিষ্ণু দেখল, তার চটির একটি পাটির, যেখানে বুড়ো আঙুল ঢোকে সেখানটা ছিঁড়ে গেছে। একটি রাবার-ব্যাণ্ড দিয়ে বাঁধা রয়েছে জায়গাটি।

আপনার জেঠুমণির ধার আমার কাছে নয়। আমি অধমর্ণ। ধার শোধ করতে এসেছি।

মেয়েটি পূর্ণদৃষ্টিতে জিষ্ণুর মুখে চাইল মুখ ঘুরিয়ে। গলির ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বিকেল বেলার আলো এসে তার মুখে পড়েছিল। ভারি ভালো লেগে গেল জিষ্ণুর, সেই মুখখানিকে। পুষিকেও ভালো লেগেছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে। একে ভালো লেগে গেল প্রথম দেখাতেই। ঠিক এমন অনুভূতি ওর আগে হয়নি কখনো। নিজের অপ্রাপ্তবয়স্ক, হঠকারী অপরিণামদর্শী মনকে খুব করে বকে দিল মনে মনে জিষ্ণু।

ঠাট্টা করছেন আপনি?

 অবিশ্বাসী গলায় সে বলল।

না। চলুন তারিণীবাবুর কাছে। তখনই জানবেন।

 এই মোড়ে বাঁ-দিকে গেলেই আমাদের পোড়ো-বাড়ি। আমি জ্যাঠামণির অংশটুকু দেখিয়ে চলে যাব। আপনারা কাজের কথা বলুন। আজ আমার মায়ের জন্মদিন। আমার মামা আসবেন। দাদা আসবেন অফিস থেকে। সামান্য একটু ব্যস্ত থাকতে হবে রান্নাঘরে।

আপনি নেমন্তন্ন করবেন না।

আপনি বড় ছেলেমানুষ। হয়তো ভালোমানুষও। বয়েস কত আপনার?

আপনার চেয়ে মনে হয়, ন-দশ বছরের বড়োই হব। মনে হয় না তো কথা শুনে? আর একটা হতে পারে। আপনি সরল। আমার জ্যাঠামণিরই মতো। নইলে জ্যাঠামণির কাছে অধমর্ণ হন! হাসিরই ব্যাপার।

মেয়েটি চলে গেল তারিণীবাবুর অংশতে ঢোকার জায়গাটি দেখিয়ে দিয়ে। জিষ্ণু গিয়ে বেল দিতেই ভেতর থেকে একটি কুকুর সিংহবিক্রমে, তেড়ে এল তার পর বন্ধ দরজায় দু-পা দিয়ে খচর-মচর শব্দ করতে লাগল। তারিণীবাবু এসে দরজা খুললেন। একটি খাকি ফুলপ্যান্ট, ইস্তিরিবিহীন এবং অন্য কারো ব্যবহার করে দিয়ে দেওয়া সাদা রঙের একটি বেঢপ সাইজের টেনিস খেলার গেঞ্জি এবং ডান পায়ে, কড়ে আঙুলের কাছে ছেঁড়া একটি লালচে কেডস পরে দরজা খুললেন। বাঁ-পাটা খালি ছিল।

কালো শীর্ণ কুকুরটা লাফাতে লাফাতে ডাকতে লাগল।

কে? আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না। একটু দাঁড়ান। চশমাটা। এই ভুলো! চশমা!

মুহূর্তের মধ্যে ‘ভুলো’ নামক কুকুরটি ডাঁটি কামড়ে চশমাটা নিয়ে এল ভেতর থেকে।

চশমাটা পরে, ভালো করে দেখে তারিণীবাবু বিপদগ্রস্ত মুখে বললেন, অ্যাই খেয়েছে! চশমা পরেও যে, চিনতে পারলুম না। আপনি কে স্যার?

জিষ্ণু বলল, আমি জিষ্ণু। আপনার ভাড়াটে।

 ওঃ। জিষ্ণু। এসো এসো বাবা। কী চমৎকার চেহারা করেছ। আমি যখন রিটায়ার করি তখন আমাদের ডেপুটি ডিভিশনাল ম্যানেজার ছিলেন চ্যাটার্জি সাহেব। ঠিক তাঁর মতো চেহারা। উনি একদিন রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বার হবেন। আমাকে বলে গেছিলেন গুহ সাহেব। এস আর গুহ। দিল্লির ডিরেক্টর অফ ওয়াগন এক্সচেঞ্জ আর রেলওয়ে কনফারেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ছিলেন গুহ সাহেব। তুমিও খুব উন্নতি করবে। তোমার চেহারাই বলছে। দেখে নিয়ে আমার কথা ফলে কি না!

বসব?

আরে দেখো বসবে বই কী নিশ্চয়ই বসবে। কিন্তু এ-ঘরে তো পাখা নেই বাবা। তুমি তো এমনিতেই ঘেমে গেছ। তা চলো ভেতরের ঘরেই গিয়ে বসি। তক্তপোশে বসতে পারবে তো?

কেন পারব না?

তোমার স্যুটটা আমার ঘামেভেজা শতরঞ্চিতে নষ্ট হয়ে যবে। ঘেমে তেলচিটে হয়ে রয়েছে। তবু চলো, চলো ভেতরেই চলো বাবা।

 জিষ্ণু গিয়ে বসল। তারিণীবাবু পাশে বসলেন। ভুলো মেঝেতে শুয়ে পড়ল ওদের দিকে মুখটা করে নিজের সামনের দু-থাবার মধ্যে রেখে।

জিষ্ণু বলল, জুতোটা পরে ফেলুন বাঁ-পায়ে।

ও হ্যাঁ। পরবখন। কিছু তো করার নেই। বিকেলে একটু বেরিয়ে আসি। ফেরার সময়ে হাফ-পাউণ্ড একটা রুটি কিনে নিয়ে আসি। আমার আর ভুলোর রাতের খাওয়া। তবে আজ আমাদের দুজনেরই নেমন্তন্ন আছে।

তাই? কোথায়?

এই এ-বাড়িতেই।

ও।

তুমি জীবনে খুব উন্নতি করবে তা কী করে বললাম এল তো?

কী করে?

তোমার ঠোঁট দুটি দেখে। দৃঢ় প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাস ফুটে আছে তোমার ঠোঁটে, চোয়ালে। আমাকে একজন খুব বড়ো জ্যোতিষী চিনিয়ে দিয়েছিলেন। অনিল চাটুজ্যে মশায়। তিনি বেঁচে থাকলে তোমার ঠিকুজিটা নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতাম তাঁর কাছে।

এইটুকু বলেই বৃদ্ধ ক্লান্ত হয়ে বাঁ-পাটি কষ্ট করে ডান পায়ের ওপরে তুলে মোজা পরতে লাগলেন। মোজা পরতে পরতেই বললেন, দাঁড়াও! জুতোটা পরে তোমার জন্যে একটু চা নিয়ে আসি। আমিও খাইনি। ওই একেবারে বিকেলে বেরিয়ে ঘণ্টের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই খেয়ে নিই এককাপ।

জিষ্ণু না করল না। কেন যে করল না, তা ও বুঝল না। জিষ্ণু ভাবছিল যে-মানুষ অমন করে চিঠি লেখেন তিনি এতক্ষণ পরেও নিজের প্রয়োজনের কথা একবারও উচ্চারণ করলেন না।

তারিণীবাবু ভাঁড়ে করে চা আর দুটো লেড়ো বিস্কুট এনে দিলেন জিষ্ণুকে।

 জিষ্ণু যখন চা খাচ্ছে তখন উনি বললেন, তুমি কেন এসেছ বাবা তা তো বললে না!

জিষ্ণু অবাক হয়ে গেল। বৃদ্ধর স্মৃতিশক্তির গোলমাল হয়েছে বিলক্ষণ।

বাঃ। আপনি চিঠি লেখেননি?

হ্যাঁ। কিন্তু তোমার মা তো এসেছিলেন; থুরি তোমার কাকিমা, তোমাকে লেখা চিঠিখানি নিয়ে। বলে গেলেন, সাত দিন পর আবার আসবেন। আমিও দলিলটা ইতিমধ্যে নিয়ে আসব। তবে বাড়ির দাম আমি বলতে পারিনি। আমার মামণির বিয়ের খরচটা এই বাড়ি বিক্রির টাকা থেকেই আমায় জোগাড় করতে হবে। এটা নতুন ডেভেলাপমেন্ট। বিশ্বাস করো, আমি মিথ্যে বলছি না।

বলেই বললেন, অ্যাই যা। তোমার কাকিমা যে তাঁর আসার কথা তোমাকে বলতে মানা করেছিলেন। আমি যে বলে ফেললাম।

জিষ্ণুর বুকের মধ্যে কাকিমার কারণে বড়ো রাগ ও দুঃখও হচ্ছিল। এই বৃদ্ধকে সামান্য ক-টি টাকার জন্যে এতদিন উপবাসে রেখেছেন তিনি। তার ওপর জিষ্ণুকে লেখা চিঠি নিয়ে ওঁকে ঠকিয়ে বাড়িটি পর্যন্ত কিনে নিতে চান কাকিমা! সম্ভবত পরিকেও না জানিয়ে। ওঁর কীসের এত লোভ? নিরাপত্তার অভাববোধ কেন এত? কাকিমাকে তো ছেলেবেলা থেকেই সে মায়ের মতোই দেখে এসেছে। তবু কেন?

জিষ্ণু বলল, মনে করুন আপনি আমাকে বলেননি। আমিও ওঁকে জানাব না।

তাই? তুমি আমাকে মিথ্যেবাদী হওয়া থেকে বাঁচাবে তো? মুখ রেখো বাবা। তোমাকে বলা আমার উচিত হয়নি। বুড়ো হয়েছি। কথা সব মনে থাকে না।

তার পর বললেন, তোমার কাকিমার কথা তো আমি শুনেছিই। তুমি কি নতুন কিছু বলবে?

হ্যাঁ। কিন্তু আমি যা, বলব এবং করব তা কিন্তু সত্যি সত্যি কাকিমার কাছে গোপন রাখতে হবে। না রাখতে পারলে, আপনার নয়, আমার অসম্ভব ক্ষতি হয়ে যাবে।

না, বাবা না। তুমি ছেলেমানুষ। চমৎকার মানুষ। তোমার ক্ষতি হবে এমন কিছু আমি করতে পারব না। আমার ক্ষতি হলে তোক।

জিষ্ণু কোটের বুক-পকেট থেকে পার্স বের করে একহাজার টাকা দিল তারিণীবাবুকে। দশটি এক-শো টাকার নোট।

এ কী! এ কী বাবা! এত টাকা? কেন?

বলেই বললেন, ওই দেখো, ওই ব্যাটা ভুলোর চোখও লোভে চকচক করছে। টাকা বড়ো স্বস্তির বাবা, কিন্তু বেশি টাকা আচমকা এলে স্বস্তির বদলে আক্রমণ হয়ে ওঠে। –আবুল বাশার, তরুণ সাহিত্যিক বলেছিলেন। কাগজে পড়েছিলাম। বড়ো ভালো বলেছিলেন হে কথাটা। লাখ কথার এককথা।

 এই টাকা জানুয়ারি মাস থেকে মে মাস অবধি পাঁচ মাসের বাড়ি ভাড়া। দু-শো টাকা করে মাসে। আপনি এক-শো টাকা করে চেয়েছিলেন। মানে, বাড়তি ভাড়া। আপাতত জানুয়ারি থেকে দু-শো করে বাড়ালাম। জুন থেকে তিন-শো করে বাড়াব।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি তো মোটে এক-শোর কথাই বলেছিলাম তোমার কাকিমাকে।

সে তো কাকিমার সঙ্গে আপনার কথা। এও তো ন্যায্য নয়! তবে পরে আরও অনেক বাড়াব। যাতে ন্যায্য হয়।

 কেন বাড়াবে বাবা? এখন কলকাতার সব ভাড়াবাড়িই তো ভাড়াটেদের হয়ে গেছে। ভাড়াটেরাই তো আসল মালিক। আমি তো তবু পুরুষমানুষ। ভাড়াটে হলেই যে গরিব হবে তেমন কোনো কথা নেই। ভাড়াটেদের যেমন অসুবিধে থাকে, বাড়িওয়ালাদেরও থাকে বাবা। কত বিধবার সংসার চলে না, মেয়ের বিয়ে হয় না আর ভাড়াটেরা ভাড়া-বাড়িতে থেকেই ফ্ল্যাট কিনে, সে-ফ্ল্যাট চার হাজার পাঁচ হাজারে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। পাঁচ-ছ-টি কেস তো আমি নিজেই জানি। যেখানে অবস্থা নেই, সত্যিই অন্যত্র থাকার জায়গা নেই সেখানে অন্য কথা। কিন্তু তা তো নয়। তারা রেন্ট-কন্ট্রোলে ভাড়া জমা দিয়ে দেয়। নিঃসহায় মানুষকে বলে মামলা করতে। একবছর দু-বছরের ভাড়ার টাকায় পুরোবাড়ি কিনে নিতে চায়।

কাকাবাবু!

জিষ্ণু বলল।

হ্যাঁ বাবা? তুমি আমাকে কাকাবাবু বলে ডাকলে? আমি তো তাগাদা দেওয়া বাড়িওয়ালাই শুধু। আমাকে অনেক সম্মান দিলে বাবা।

বলছিলাম, আইনের কথা আমি বলছি না। ন্যায়-অন্যায়, বিবেকের কথা বলছিলাম।

দাঁড়াও দাঁড়াও। রসিদ বইটা আবার কোথায় ফেললাম।

রসিদ লাগবে না কাকাবাবু।

সে কী? এর মানে আইনে আবার অন্য কিছু বলবে না তো?

 আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আইনের নয়।

তবে? সম্পর্কটা বে-আইনি বলছ?

জিষ্ণু হেসে ফেলল। বলল, ধরুন তাই।

একটু চুপ করে থেকে জিষ্ণু বলল, আর একটা কথা।

 কী তারিণীবাবু বললেন।

 কাকিমা বাড়ি কিনতে এলে আপনি বলে দেবেন যে, বাড়ি বিক্রি করবেন না বলেই আপনি মনস্থ করেছেন।

তা হলে আমার মামণির বিয়ে আমি দেব কী করে?

অনেক বেশি দাম দেবে এমন ক্রেতা আমিই ঠিক করে দেব। টাকাটা কি খুব শিগগিরই দরকার? বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে?

আরে, না না বাবা। চেষ্টা-চরিত্তির চলছে। গরিবের মেয়েকে আর কে এই পোড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার করতে আসবে এল! টাকা যার নেই তার তো কিছুই নেই।

কেমন ছেলে খুঁজছেন আপনারা?

আরে আমাদের আবার চাওয়া-চাওয়ি। আজকাল লোকে হয় বড়োলোকের মেয়ে চায়, নয় চাকুরে মেয়ে চায়। সোজা কথা। আরে আমি তো আর তার জন্যে তোমার মতো রূপে-গুণে রাজপুত্র খুঁজছি না। মোটামুটি ছেলে। তবে হ্যাঁ। অনেস্ট। যে যাই বলুক, ইন দ্য লং রান অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি। তোমার কাকিমাকে বলে এয়েছিলাম সেদিন। ডিসঅনেস্টি করেই ছেলেদের কেউকেটা করেছিলাম আমি। আর দেখো, আজকে সেই তারাই বুড়ো বাপের সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে। বড়োটা শেষ যেবার এসেছিল, আমাকে বলে গেল। বুড়ো, একটা ম্যাটাডর ভ্যান কিনে দিচ্ছি, চালিয়ে খাও; খেটে খাও। বিদেশে কোনো বাপই ছেলের দয়ায় বাঁচে না।

 কথাটা শুনে জিষ্ণুর দুঃখও হল আবার হাসিও পেল। কোনো ছেলে নিজের বাবাকে এমন করে বলতে পারে যে, একথা ভেবেই।

আরে বাবা, বিদেশে কোনো ছেলেও কি বুড়োবয়েস অবধি বাপের হোটেলে খায়? না কোনো ছেলের কেরিয়ার বাবারা চুরি-ডাকাতি করে, কি পেটে না খেয়ে গড়ে দেয় বলো? অনেক ভেবে-টেবেই ডিসাইড করেছি, আমার মামণির জন্যে আমি ডিস-অনেস্ট ছেলে চাই না।

 দেখব আমি। আপনার মনোমতো ছেলেই দেখব। এই যে রইল আমার কার্ড। অফিসের ঠিকানাতেই একটু যোগাযোগ করবেন।

আমার আজকাল হাত কেঁপে যায়। আমি শিবুকেই বলব। মানে মামণির দাদা। তুমি যদি সাক্ষাৎ দেখতে চাও তো মামণিকে এখুনি ডেকে আনছি একবার।

না, না কাকাবাবু। আমি তো আর পাত্র নই। মিছিমিছি বেচারিকে এম্বুরাস করে লাভ নেই।

যা ভালো বোঝো বাবা।

আমি তবে উঠি আজকে। প্রতিমাসের সাত তারিখের মধ্যে আমি টাকাটা পাঠিয়ে দেব। আর মাসে যে-টাকা, কাকিমা শ্ৰীমন্তদা-কে দিয়ে পাঠান তা তো উনি পাঠাবেনই।

তারিণীবাবু গলির মোড় অবধি পৌঁছে দিলেন জিষ্ণুকে। সঙ্গে ভুললো। জিষ্ণু, ভুলোর জন্যে এক প্যাকেট বিস্কিট কিনে দিল। ভুলো ল্যাজ নাড়িয়ে বিদায় দিল ওকে।

 গলির মোড়ে যখন এসে একটা ট্যাক্সি খোঁজার জন্যে দাঁড়াল তখন একাধিক কারণে ওর মনটা বড়ো খুশি খুশি লাগতে লাগল। বড়ো অনাবিল খুশি। অনেক অনেক দিন এত খুশি হয়নি ও পুষির মৃত্যুর পর।

বাড়ি পৌঁছে স্নান করে তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল। পরি ট্যুরে গেছে ব্যাঙ্গালোরে আজ। কাল রাতে ওকে চুমোয় চুমোয় ভরে দিয়ে বলেছিল ভালো ছেলে হয়ে থাকবে। এবারে ফিরে এসে রেজিস্ট্রেশান করব আমরা তার পর চলে যাব ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেনস-এর ফ্ল্যাটে।

কাকিমা?

স্টপ ইট। ও নাম তুমি মুখে আনবে না।

 আজকে খাওয়ার একটু আগেই ট্রাপেক্স টু মিলিগ্রামের দুটি ট্যাবলেট খেয়ে নিয়েছিল। রোজই রাত একটা দুটো অবধি জেগে থাকার কারণে আর অপরাধ-বোধে ঘুম হয় না ক দিন। চোখের কোণে কালি পড়েছে। অথচ দেরি করে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে সকাল নটা দশটা অবধি একটা ঘোর থাকে। রিফ্লেক্স ঢিলে হয়ে থাকে। কলকাতার সব মানুষই কি ঘুমের ওষুধ খায়? অনেককেই কেমন ঘোরাচ্ছন্ন, নেশাগ্রস্ত দেখে লাঞ্চ অবধি। কে জানে! এরা সবাই বোধ হয় ঘোরের মধ্যে হাঁটে, ঘোরের মধ্যে মিছিল করে, স্লোগান দেয়, বেঁচে থাকে।

দেখতে দেখতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল জিষ্ণু। মামণির মুখটা ভেসে উঠল একবার চোখের সামনে। তার পর পুষির মুখ। পুষি হাসছিল, মুখটা একপাশে ঘুরিয়ে।

পুষি……

.

গভীর ঘুম এখন জিষ্ণুর। গভীর ঘুম। নাসিরুদ্দিন বলল, আপনাকে বলেছিলাম স্যার থ্রি-টু বোর না নিয়ে থ্রি-এইট নিন।

থ্রি-এইট বোরের পিস্তলগুলো প্রহিবিটেড বোর। গুলি পাব কোত্থেকে।

জিষ্ণু বলেছিল।

নাসিরুদ্দিন হাসল।

 বলল, নকশালরা কোত্থেকে পাচ্ছিল স্যার? পাঞ্জাবে কী করে পাচ্ছে? দার্জিলিং-এ? পাওয়ার ইচ্ছে থাকলেই পাওয়া যায়। গুলি, কুড়ি রাউণ্ড দিয়ে দিচ্ছি সঙ্গে। যথেষ্ট। ভাড়া নেবেন? না কিনবেন? যদি আমার নাম বলে দেন, তাহলে আপনার ফ্যামিলির কেউ আর আস্ত থাকবে না স্যার।

ভাড়া কত?

জিষ্ণু বলল।

প্রাইভেট ট্যাক্সির চেয়ে একটু বেশি। দিনে পাঁচ-শ।

গুলি?

গুলি পঁচিশ টাকা করে রাউণ্ড।

গুলিও কি ভাড়া?

হ্যাঁ। ফেরত দিলে টাকা ফেরত দেব। খরচা হলে ওই গচ্চা।

দাও।

.

খালপাড়ের মিনিবাসের টার্মিনালে তখন ভিড় কমে এসেছে। কোমরের সঙ্গে বাঁধা আছে বেল্টে জিনিসটা। মোড়ের কাছে চা আর ওমলেট আর মাটন রোল-এর দোকানের সামনের বেঞ্চেতে বসে আছে জিষ্ণু জিনিসটা পাওয়ার পর থেকেই। যাকে খুঁজছে তাকে কিন্তু পাচ্ছে না। গল্প করেছে ও নানা ড্রাইভার, কণ্ডাক্টর ও ক্লিনারদের সঙ্গে। এ একটা অন্য জগৎ, অন্য পরিবেশ।

ভোঁতকা কোন গাড়ি চালাচ্ছে রে এখন? মদনা? মিনিই চালাচ্ছে তো?

একজন কণ্ডাক্টর শুধোল অন্যকে।

আর কী চালাবে?

ওর মালিকের তো পাঁচখানা গাড়ি। তবে সবই মিনি। ট্যাক্সি একটাও নেই। তারই মধ্যে চালাচ্ছে কোনো একটা। তবে এসে পড়বে এক্ষুনি। ওর সাঁটুলি এসে একবার খোঁজ করে গেছে ইতিমধ্যেই। গরজ জোর।

তুই জানিস যে, ও জামিন পেয়েছে?

 কবে? কোন ড্রাইভারের কী হবে র‍্যা? সব কেস ফিট করা আছে সব জায়গাতে।

ফুলরেণু গুহকে যে চাপা দিয়েছে সে ঠিক শ্বশুরবাড়ি যাবে।

ওই। শ-য়ে একজনের কপাল খারাপ থাকে। যারা চাপা পড়ে তারা সকলেই তো আর ফুলরেণু গুহ নয় যে কংগ্রেস, সি পি এম দুজনেরই দরদ উথলে উঠবে? হেঁজি-পেঁচিদের জন্যে কোন শালা কী করে র‍্যা?

সেই মেয়েটা, যেটা স্কুটারের পেছনে বসেছিল, তারও বোধ হয় সোর্স আছে ভালো।

 কী করে বুঝলি?

একটা টিকটিকি মাইরি রোজই একসময়ে আসছিল। বোধ হয় ডি-ডির লোক হবে। হারামিকে দিন কয় দেখছি না।

চিনতে পারলে বলিস তো বাঞ্চোতের টেংরি খুলে নেব। লাশ ফেলে দেব খালে।

কেসটার কী হবে?

আরে কী আর হবে? তারিখ পড়বে। যা হয়।

তার পর?

তার পর আবার তারিখ পড়বে।

তার পর?

তাপ্পর আবারও তারিখ পড়বে।

তাপ্পর অ্যাবার। মেয়ের জন্যে, বউয়ের জন্যে ভালোবাসা কার কদ্দিন থাকে রে শালা বাঙালি জাতের? সোডার বোতলের জাত শালারা। বারো ঘণ্টা যদি মরার পর তোকে মনে রাখে কেউ, তবে জানলি বাঞ্চোৎ এ কি সর্দারজি পেয়েছিস? কিছু করলি লাইফে।

উরি: শালা। চার হাজার পঁয়ত্রিশ কীরকম ঝিং-চ্যাক লাইট লাগিয়েছে দেখ। ওই যে আসছে গুরু।

জিষ্ণুর চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। গায়ে জ্বর। মিনিটা এসে দাঁড়িয়ে বলল, বেসি দুধ, বেসি চিনি দিয়ে চা দে তো নেপো ভালো করে একগ্লাস। আর শোন একটা মোগলাইও। জলদি দিবি রে শ্লা।

বলেই, ড্রাইভিং সিট থেকে নামল। গাড়িটা লাগানোর সময়েই একজন লাঠি-হাতে বৃদ্ধ চাপা পড়ছিলেন প্রায় মিনির তলাতে। অকথ্য খিস্তি করল তাকে ড্রাইভার। বলল, এই যে ঘাটের মড়া! এখুনি তো ইলেকট্রিক ফার্নেসে যেতে হত।

মিনির ড্রাইভারটাকে দেখতে যে-কোনো অন্য মানুষেরই মতো। রোগা-পটকা। বাজারের ফলওয়ালা কি মাছওয়ালা কি চানাচুরের দোকানি বা তাদের সামনে পায়জামা-শার্ট পরে থলে হাতে দাঁড়ানো যেকোনো স্বল্পবিত্ত খদ্দেরেরই মতো। তফাত-এর মধ্যে তার ডান হাতে সর্দারজির মতো একটি স্টেইনলেস স্টিলের বালা, লোকটার চোখ দুটো দেখে মনে হয় লোকটা প্রচন্ড ধূর্ত। পৃথিবীকে ডোন্ট কেয়ার ভাব তার মুখে-চোখে।

ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে পিঠের ঘাম শুকোল সে, জামাটা তুলে হাওয়া খেয়ে।

তার পর বলল, কী রে নেপো? কেউ আমার খোঁজ করেছিল?

পাশের ড্রাইভারটি বলল, তোমার সাঁটুলি দু-দুবার ঘুরে গেছে গুরু।

এ কী মাইরি। ছোকরাদের সামনে একটু রেসপেক্ট দিয়ে কথা কইতে পারিস না? তোরা মাইরি! তা, কখন আসবে বলেছে আবার?

বলেছে আসবে না। নাগ করেছে নাগুনী। উলটোদিকে বসে থাকবে। তুমি চা খেয়ে লিয়েই সাঁকো পেরিয়ে চলে যাও। হাতে-গরম পেরেম পাবে।

লেহশালা। তা আগে বলবি তো মাইরি! তালে অত জম্পেস করে চা-ফা খেতাম না।

 চা-টা খেয়ে মোগলাইটা নিয়ে যাও। দুজনে পেরেমের সঙ্গে ভাগ করে নিয়ো।

তোমার কেসের কী হল গুরু? ওই স্কুটারের মেয়েটার!

সে তো সয়ে চলে গেছে ক্লিন। ভোঁতকা লাইফে কাউকে কখনো ভোগলা দেয়নি।

তা নয় হল কিন্তু পুলিশ কেস তো করেছে। সে কেসের কী হবে?

সে থানার মক্কেল, আর মোটর ভেহিকেলস আর ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি বুঝবে। আমার গায়ে হাত দেয় কোন শালা? গায়ে হাত দেওয়ার জন্যে বুঝি মালিক মাস-মাইনে করে এত লোক রেখেছে?

তোমার মালিককে তো দেখিই না আজকাল। মেলা রেলা হয়েছে না? শুনছি, দশখানা প্রাইভেট খাটাচ্ছে?

আমিও শুনেছি। আজ তত তার আসবার কথা। শ্বশুরবাড়িতে বিয়ে তাই তিনটে বাস উইথড্র করতে হবে। এখানে এসেই বলে যাবে। এল বলে। এও শুনছি যে, আগামীবার এম এল-এর জন্যে দাঁড়াবে ইলিকশানে।

তালে তো মাল প্রচুর জমেছে র‍্যা?

মাল তো জমেছেই। তা ছাড়া ইলিকশানে দাঁড়ালে গাড়ি ধরতে পারবে না ইলিকশান ডিউটির জন্যে। ওই সময়ে গাড়ি কম থাকায় ভাড়াও বেড়ে যায় অনেক। এক ঢিলে দুই পাখি।

 জিষ্ণুর সব অঙ্ক গুলিয়ে গেল। মালিক? না কর্মচারী। কাকে দেবে দাওয়াই? তার পরই ঠিক করল, না, এখানে ব্যতিক্রম। মালিক নয়, কর্মচারী। যে পুষির মাথাটা থেঁতলে দিয়েছে তাকেই দেবে দাওয়াই। লেট দেয়ার বি অ্যান এগজাম্পল।

 ভোঁতকা চা আর মোগলাই খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে, গুনগুন করে হিন্দি গান গাইতে গাইতে হঠাৎ পেছন ফিরে বলল, আরে নেপো। কাল গাড়ির চাকা ভালো করে পোয়াবি।  হেস্টিংস-এর কাঁচা রাস্তায় এক শালা ট্যালা মাল নিয়ে চলে এল। চাকায় রক্ত লেগেছে। প্যাসেঞ্জাররা বুঝতেই পারেনি।

একজন বলেছিল, কী দাদা?

বলে দিলুম কুকুর। পথও অন্ধকার ছেলে। গড ইজ গুড বুয়েছিস শালা। আমরা এই বাঙালিরা সেন্টিমেন্টেই মল্লুম।

 ভোঁতকা এবারে এগোচ্ছে তার সাঁটুলির দিকে। জিষ্ণুও উঠে পড়ে এগোচ্ছে। এখন খালের সাঁকো পেরোচ্ছে ভোঁতকা। বড়ো বড়ো গাছ এখানে, জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন, নির্জন, শুধুই প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড়। ধারে কাছে কেউ নেই। জায়গাটা খুবই নির্জন। কলকাতা বলে মনে হয় না। জিষ্ণু গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, দাদা, আগুন হবে?

 ভোঁতকা ঘুরে দাঁড়াল জিষ্ণুর এক হাতের মধ্যে। দেশলাইটা বাড়িয়ে দিতে গেল আর জিষ্ণু কক-করা পিস্তলটা কোমর থেকে খুলে নিয়েই গুড়ম গুডুম করে পর পর তিন বার গুলি করল।

ওরে বাবা!

বলেই, ভোঁতকা মাটিতে পড়ে গেল।

জিষ্ণুর রাগটা তখন মরেনি বরং ঝড়ের পাখির ডানা সাপটানোর মতো প্রবলতর হয়ে ফিরে এসেছে। পুষির মুখ। ইলেকট্রিক ফার্নেসের লালিমা। আঁচ। সব ফিরে এসেছে জিষ্ণুর মস্তিষ্কে।

আরও দুটো গুলি করল জিষ্ণু।

পালিয়ে যাবে বলে ও আসেনি। ধরা পড়ার ভয়ে ও ভীত ছিল না। ওকে কাঠগড়ায় যখন দাঁড় করানো হবে তখন মাননীয় বিচারপতিরা ভোঁতকাকে না তাকে, কাকে বড়ো খুনি বলে রায় দেন, তা দেখার ইচ্ছে আছে ওর। জজ সাহেবদেরও বিবেকের পরীক্ষা হবে। আইনের কেতাব জিতবে? না জজ সাহেবদের মানসিকতা? জানতে চায় জিষ্ণু।

দাদাবাবু। দাদাবাবু। কী হয়েছে আপনার? জল খান। জল।

শ্ৰীমন্তদা জিষ্ণুকে খাটের ওপর উঠিয়ে বসাল। বলল, বোবায় ধরেছে তোমাকে। বুকে হাত দিয়ে শুতে মানা করি এতবার।

জিষ্ণুর মনে হল, ওকে নয়। বোবায় ধরেছে কলকাতার সব মানুষদের। বুকে হাত দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সকলে।

জল খাও। বাথরুমে গিয়ে মাথায় জল দাও।

জিষ্ণু বাথরুমে গিয়ে মাথায় থেবড়ে থেবড়ে জল দিতে দিতে ভাবছিল, এই স্বপ্নটা যদি সত্য হত ওর জীবনে হয়তো মাথা উঁচু করে বাঁচার অন্তত কিছু সার্থকতা থাকত। কুকুরের মতো লাথি খেয়ে বেঁচে থাকাকে বাঁচা বলে না।

কাকিমা কোথায়?

ঘরে।

হীরুকাকা এসেছিলেন। খেয়ে গেছেন?

 খেয়েছেন। তবে যেতে পারেননি। শরীরটা খারাপ। রয়ে গেছেন মায়ের ঘরে। কম্পাউণ্ডারবাবু এসেছিলেন।

কে? গোদা কম্পাউণ্ডার?

হ্যাঁ।

পরি?

সে তো ব্যাঙ্গালোরে গেছে?

 ও। তাইতো! মনে ছিল না।

এখন কটা বাজে?

আড়াইটে।

নাও, এবারে শুয়ে পড়ো তো দেখি।

স্বপ্নটাও ভেঙে গেল। এখন দুঃস্বপ্ন; জেগে থেকে।

হাত বাড়িয়ে আর একটা স্লিপিং পিল খেল জিষ্ণু।

কাকিমার ঘরে হীরুকাকা রাত কাটাচ্ছেন? নাঃ। তারিণীবাবুর কাছে আবার কালই যাবে জিষ্ণু। বাড়িটা সত্যিই অভিশপ্ত হয়ে গেছে। কী যেন নাম মেয়েটির? আশীর্বাদী ফুলের মতো মেয়েটির? মামণি?

হ্যাঁ। মামণি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *