০৩.
চৌমাথাতে মিনি থেকে নামতেই প্রায় গায়ের পাশ দিয়েই একটি স্কুটার চলে গেল।
পিনিয়নে বসে আছে যে-মেয়েটি, কালো চুড়িদার এবং সাদা কুর্তা পরে তার গায়ের পারফিউমের গন্ধ এসে নাকে লাগল।
ছেলেটি লম্বা চওড়া। সুগঠিত চেহারা। কালো গেঞ্জি আর সাদা ট্রাউজার পরা। মেয়েটি যেন কী বলল ছেলেটিকে। ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে ফুটপাথে দাঁড়ানো জিষ্ণুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল, জেব্রাক্রসিংটা পেরিয়ে জিষ্ণু রাস্তা পেরোবে কি না। জিষ্ণুর মুখের ওপরে চোখ রেখেই ছেলেটি হেসে উঠল মেয়েটির কথাতে। জিষ্ণুর কানে না পৌঁছোনো কথাতে।
পুরো হাসি নয়। ঠোঁট দুটি কাঁপল শুধু। মেয়েটিও মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। দেখতে ভালোই। কিন্তু জিষ্ণুর চোখে ভালো লাগল না। ভালো হলেই কি সকলকেই ভালো লাগে?
ওরা কি জিষ্ণুকে নিয়ে ঠাট্টা করছে? ও-ই কি ওদের হাসির খোরাক?
আজকাল জিষ্ণুর কেবলই এরকম মনে হয়। অফিসে, বাড়িতে, পাড়ায়, পথে-ঘাটে। মনে হয়, ওকে নিয়ে সকলেই ঠাট্টা করছে, মুখ টিপে হাসছে। প্রত্যেকটি পরিচিত, অর্ধপরিচিত মানুষ এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে ওর বিরুদ্ধে।
এরকম ছিল না জিষ্ণু। পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ছিল নিজের ওপরে। পুষি হঠাৎ চলে যাওয়ার পর রোজই ঘুমের ওষুধ খেতে হচ্ছে। আগে এক মিলিগ্রাম করে খেত। আজকাল দুই মিলিগ্রাম করে খেতে হয়। নইলে ঘুম আসে না কিছুতেই। সমস্ত সকালটা ঘোর ঘোর লাগে। গাড়ির দরজার হ্যাঁণ্ডেল পিছলে যায় হাত থেকে, যদি কখনো বাসে ওঠে। পিছলে যায় কলম। চান করার সময়ে হাত পিছলে সাবান পড়ে যায় বার বার। দাড়ি কামানোর সময় গাল কেটে যায়। কেউ যদি পেছন থেকে ডেকে ওঠে নাম ধরে পথে, কী বাসে, কী অফিসে, অনেকক্ষণ সময় লেগে যায় ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তর দিতে। তার পর তাকে অথবা তার গলার স্বরকে চিনতেও অনেক সময় লাগে। চেনা-অচেনা সব মানুষের গলাকেই ডাস্টবিনের ওপরে-বসা দাঁড়কাকের গলা বলে ভুল হয়।
জিষ্ণু আর সেই জিষ্ণু নেই। অন্য মানুষ হয়ে গেছে।
স্কুটারে-বসা ছেলেটি জিষ্ণুর চেয়ে দু-এক বছরের বড়ো হলেও হতে পারে। মেয়েটি একেবারে পুষিরই সমবয়েসি।
ট্র্যাফিকের লাল আলোটা হলুদ হল। জিষ্ণুর মনে হল চিরদিনই হলুদ হয়ে থাকলেই ভালো হত। ফর এভার অ্যাম্বার। অনেক দিনের পুরোনো প্রিন্টের একটি ইংরিজি ছবি দেখেছিল। কিন্তু ওর মনে হওয়া-হওয়িতে কিছুমাত্রই এসে যায় না সংসারের। হলুদ সবুজ হল। আবারও হলুদ হবে। তার পরে লাল।
ছেলেটি খুব জোরে স্কুটার ছুটিয়ে চলে গেল। ও নিজেও একদিন যেত। জিষ্ণু অনেকখানি পথ ফুটপাথের ভিড় ঠেলে দৌড়ে গেল ওদের পেছনে পেছনে। হাত তুলে চেঁচিয়ে বলতে গেল, না না। এই যে শুনছেন! এরকম করবেন না, প্লিজ।
কিন্তু স্কুটারের পেছনের লাল আলোটা যানবাহনের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল একমিনিটের মধ্যে। একটা ভয়মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল ও মোড়ে।
সাঙ্কুভ্যালিতে যখন ঢুকল তখন কেউই আসেনি। অনেকই বছর পরে এল। আজ শনিবার। জিষ্ণুর ছুটি। সকলের তো নয়! অফিস যাদের আছে, তারা বাড়ি ফিরে চান-টান করে কিছু খেয়ে-দেয়ে তবেই হয়তো আসবে।
বছর দশেকের পুরোনো দলটা আর নেই। এখন যা-আছে তা নিছকই ভগ্নাংশ। সুমিত মারা গেল হঠাৎ এনকেফেলাইটিস-এ। মাত্র উনত্রিশ বছর বয়েসে। এত ভালো চাকরিটা! বিয়ে করেছিল সুমিতাকে ভালোবেসে। ওদের ছেলেটার বয়েস তখন তিন মাস। দুজনের নামে নাম মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছিল স্মিত।
সুমিত, সুমিতা এবং স্মিতর কথা মনে পড়ায় কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ও সান্ত্বনা পেল। সুমিতা টেলিফোন অপারেটরের কাজ করে একটি কমার্শিয়াল ফার্ম-এ।
জিষ্ণুদের সাঙ্গুভ্যালির দলটা ভেঙে গেছে কিছু সুখের ও কিছু দুঃখেরও কারণে। নরেন, পিন্টে, চিনু, ঋতেন, যথাক্রমে প্যারিস, মিজৌরি, লানডান এবং অস্ট্রেলিয়াতে চলে গেছে। যারা গেছে তারা কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কেউ ডাক্তার অথবা আর্টিস্ট। যারা থেকে গেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ লেখালেখি করে। দু-একজন গদ্য। বেশিই কবিতা। চলে যাওয়ার দল ওয়েল-সেটলড ইন লাইফ। কালার্ড ছবি পাঠায় ওদের নতুন নতুন বাড়ি গাড়ির। কেউ কেউ বা তার বাড়ির বাথরুমের বাথটাব-এ পাইপ-মুখে শুয়ে আছে তার ছবি। বস্তিবাসীর হঠাৎই লানডানে পৌঁছোনো আদিখ্যেতার দলিল। গার্লফ্রেণ্ডদের ছবিও পাঠাত কেউ কেউ। যখন হা-ভাতেপনা ছিল। এখন গার্লফ্রেণ্ড, সাদা চামড়া মেয়েমানুষ, জল-ভাত হয়ে যাওয়াতে আর পাঠায় না। বাথটাব-এ পাইপ মুখে শুয়ে থাকার ছবিও নয়। এক-একজন মানুষ কী আশ্চর্যরকমভাবে পালটে যায়। আর তাদের পালটাবার রকমটাই বা কত বিভিন্ন জিষ্ণু ভেবে অবাক হয়।
জিষ্ণুও কিছু বড়োলোক নয়। তবে স্বচ্ছল। কিন্তু ওর রক্তের মধ্যে কোনো বদগন্ধ হীনম্মন্যতা থেকে জন্মানো কোনোরকম আদিখ্যেতাই ছিল না। ছিল না যে তা জেনে, ও গর্ব বোধ করে।
পিন্টে লিখেছিল :সাদা মেয়ে অনেকই হল। বিয়ে করতে হবে দিশি মেয়েকেই। দিশি বউ এর কোনো বিকল্প নেই। সাত দিনের জন্যে যাব দেশে। আর এবারে বিয়ে করেই ফিরব। মেয়ে দেখ। অন্য সবাইকে বল। শহরে ঢেঁড়া পেটা।
জিষ্ণু উত্তরে লিখেছিল যে, সাত দিনের নোটিশে ভালো তেলওয়ালা চিতল মাছের পেটি অথবা বড়ো কইও পাওয়া যায় না যে ধনেপাতা কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঝোল খাবি। বিয়ে করার মতো মেয়ে তো দূরের কথা।
উত্তরে পিন্টে লিখেছিল খুব রেগে গিয়ে :এইজন্যেই বাঙালিদের কিসসু হল না। বিয়ে করার মতো মেয়ে মানে কী? মেয়েমাত্রই তো এক। একই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। শুধু পিগমেনটেশান আর চুলের রঙেই যা তফাত। আর মন? মেয়েদের মন দেবতারা বোঝে না আর আমি কোন দুঃখে তা বোঝাবুঝির মধ্যে যেতে যাব?
পিন্টে আবারও লিখেছে : ওরে লেথার্জিক বঙ্গসন্তান! উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি করে আমার বউ দেখ, যেন ইংরিজিটা একটু জানে, কথা চালাবার মতো, বাকিটা আমি শিখিয়ে নেব। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ড-ট্যাকগ্রাউণ্ড নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এ যুগে কে বস্তি থেকে এসেছে আর কে পথের ফুটপাথে ফুটপাথে মানুষ হয়েছে তাতে যায় আসে না কিছুই। কার কাছে মাল আছে, ক্ষমতা, লোকের ভালো বা মন্দ করার ক্ষমতা, সেটাই বড়ো কথা। আমার সবই আছে। আমার বউ-এর কিছুমাত্র না থাকলেও চলে যাবে। তার মা-বাবা না থাকলেই ভালো। থাকলে তো শেষে তারা আমার ঘাড়েই চাপবে। মেয়ে এবং তার মা-বাবা তো এখানের এত স্বাচ্ছল্য দেখে ওভারহোয়েলমড় হয়ে যাবে।
চেহারাও চাই সাদামাটা। মামাবাড়ি, কাকার বাড়ি মানুষ হওয়া মেয়ে হলেই ভালো। অপ্রেসড থাকবে মোটামুটি। চাহিদা-ফাহিদাও কম থাকবে। দেখতে বেশি ভালো হলে বিদেশে বিপদ। ফাঁকা বাড়ি। নিজে সারাদিন বাইরে। বউ চরতে চরতে শেষে অন্য ভিটেয় গিয়ে উঠবে। মেয়েদের সঙ্গে ছাগলদের মানসিকতার খুব মিল আছে। যাহা পায় তাহাই খায়। অন্যর বউ ভাগাবার এলেম অনেকেরই আছে এদেশের দিশিদের। কারো বা তা হোলটাইম অকুপেশান। নিজের বউকে ঠেকিয়ে রাখার এলেমও খুব বেশি লোকের নেই। আমার জন্যে মেয়ে দেখছিস যে, একথা আমার মাকে কিছুই বলবার দরকার নেই। বাবাকেও নয়। আমার পেছনে স্কুল-কলেজে পড়াশুনো করার জন্যে যা-খরচ করেছে বুড়ো মানে আমার বাবা, তা অনেকদিন আগেই ফেরত দিয়ে দিয়েছি। আমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই। বিজয়াতে চিঠি-ফিঠি লিখি কিন্তু টাকা-পয়সা আর একটুও দিতে পারব না। তুই হয়তো জানিস না যে, কুঁচির বিয়ের সমস্ত খরচও আমিই দিয়েছিলাম। আমাদের মা-বাপেরা স্রেফ ছেলে-মেয়ে প্যয়দাই করেছিল। আর কোন কম্মোটা করেছে বল, ছেলে-মেয়ের জন্যে? সাত টাকা মাইনের স্কুলে পড়াশুনো শিখে গর্দভ হয়েছি। এ-দেশের টেলিগ্রাফের তারে নুন ছিটিয়ে বরফ গলিয়ে প্রথম জীবন আরম্ভ করেছি। আমাকে তখন কেউই দেখেনি, আমিও কাউকে দেখব না। অনেকই কষ্ট করেছি। অনেক। ব্যাপারটা অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট।
একা বসে থাকলেই জিষ্ণুর মাথার মধ্যে একটা নিঃশব্দ কম্পিউটার চলে। মানুষজন, চেনা-মুখ, আর ভালো লাগে না। অথচ বেশিক্ষণ একা থাকলে জিষ্ণুর মনে হয় যে, পাগল হয়ে যাবে। এক কাপ চা নিয়ে বসে রইল মিনিট পনেরো।
কেউই এল না। জুনিয়র ব্যাচ ও তস্য জুনিয়র ব্যাচের অনেকেই এল। হাসল। তার পর নিজেদের তুমুল হই-হল্লাতে ডুবে গেল। জিষ্ণুর মনে হয় প্রতিদিন যে-পরিমাণ জীবনীশক্তি কলকাতার রেস্তরাঁ ও কফি-হাউসগুলোতে নষ্ট হয়, তার এককণাও চ্যানেলাইজ করতে পারলে এবং তা দিয়ে থার্মাল বা হাইড্যাল স্টেশান চালাতে পারলে কলকাতায় কোনো দিনও লোডশেডিং হত না।
জিষ্ণুরাও অবশ্য সময় নষ্ট করেছে ওদের বয়েসে। অনেকই জীবনীশক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেও এখনও যেটুকু বাকি আছে তা দিয়েই বা কী করে? খরচ করার সুস্থ ও স্বাভাবিক পথ না থাকলে জীবনীশক্তি নিজেকেই খেয়ে ফেলে অনুক্ষণ কুরেকুরে। কখনো ড্রাগ, এই নিরুপায় যৌবনকে, জীবনীশক্তিকে চুষে চুষে খেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কখনো ক্যান্সারের মতো নিঃশব্দে খায়; কখনো বা আত্মরতির গোপন উৎসারে; আবার কখনো বোমার সশব্দ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিভিন্ন পথ আছে, প্রকৃতি আছে, রকম আছে। কেউ স্বেচ্ছায় সেই পথ বেছে নেয়; কেউ অনিচ্ছায়।
এখনও ওরা একজনও এল না। টিভিতে বোধ হয় ভালো কোনো ছবি আছে। আর বসে থেকে লাভ নেই। দোষ তো ওরই। যার দেওয়ার মতো সময় নেই তার কোনো বন্ধু থাকে না। নষ্ট করার মতো সময় না থাকলে আড্ডাও মারা যায় না। নিয়ত আড্ডাবাজরা ব্যস্ত মানুষদের পছন্দ যে করে না শুধু তাই নয়, এক ধরনের ঘৃণাও করে।
চায়ের দাম মিটিয়ে বাইরে এল জিষ্ণু।
জনস্রোত বয়ে চলেছে অবিরত। পানের দোকানে, সিগারেটের দোকানে ভিড়। ভিড় ম্যাগাজিন আর কাগজের দোকানেও। মুহূর্তে মুহূর্তে বাস যাচ্ছে, ট্রাম, মিনি, ট্যাক্সি, গাড়ি। কত স্ত্রী-পুরুষ, নদীর উজান-ভাটার মতো পথের উজান-ভাটা বেয়ে, কত জায়গায় চলে যাচ্ছে, কত জায়গা থেকে বাদুড়-ঝোলা হয়ে ফিরছে কত লোক! অথচ জিষ্ণুরই এই মুহূর্তে কোথাওই যাওয়ার নেই। সমস্ত পৃথিবীর ওপর এক তীব্র অসূয়া আর বিরক্তি এসে গেছে এবং সেই বিরক্তির স্বাদ সর্বক্ষণ জিভে লেগে থাকে।
জিষ্ণুর কোথাওই যাওয়ার নেই।
বহুবছর আসতে পারেনি এই আড্ডায়। ও কোনো দিনই আড্ডাবাজ নয় তবে এলে স্কুল কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হত বলে কখনো-সখনো আসত। আজ এল। অথচ আজ কেউই নেই। গত তিনটে বছর পুষির সঙ্গেই প্রত্যেকটি অবসরের মুহূর্ত কেটেছে। হয় পুষিদের বাড়িতে, নয় জিষ্ণুদের বাড়িতে, রবীন্দ্রসদনে, বইমেলাতে, নন্দনে। যেদিনই একা থাকতে ইচ্ছে করে না ঠিক সেদিনই পৃথিবী চারপাশ থেকে সরে গিয়ে তার একাকিত্বর গহ্বরকে গভীরতর করে।
প্রমোশনটা আটকে ছিল। তাও এসেছে দু-মাস আগে। খুবই বড়ো লিফট। এখন স্কাই ইজ দ্য লিমিট। জিষ্ণুর প্রমোশনের পর পুষির মা আর জিষ্ণুর কাকিমা দুজনে মিলেই এনগেজমেন্টের দিন ঠিক করেছিলেন আগামী বুধবার। দু-পক্ষেরই আত্মীয়স্বজন আসবেন বলে কথা ছিল জিষ্ণুদের বাড়িতে। সঙ্গে রেজিস্ট্রেশান হয়ে যাওয়ারও কথা ছিল। গজেন ক্যাটারারকেও বলে দিয়েছিল জিষ্ণু। পরিই মেনু ঠিক করেছিল সেদিন রাতের খাবারের।
অবশ্য পুষির ইচ্ছে ছিল শীতকালেই বিয়েটা হোক।
জিষ্ণু বলেছিল, ভালোই তো হত। বসন্তে হলে তোমার মা তো আর লেপ দিতেন না।
কী অসভ্য!
বলে, হেসেছিল পুষি।
সমস্তটুকু আমাকেই মা তোমাকে দিয়ে দিচ্ছেন আর একটা লেপের দামই বেশি হল তোমার কাছে?
লেপ কি শুধু লেপই? নতুন গন্ধ লেপের নীচে কিছু না-পরা নতুন-গন্ধ বউ নিয়ে শোয়ার মজাটাই আলাদা। ভাবলেই তো আমার গা শিরশির করে।
জিষ্ণু হেসে বলেছিল।
আনকোরা নতুন আর রাখলে কোথায়? লেবেল-টেবেল তো ছেঁড়া হয়েছেই। শুভদৃষ্টির সময়ে যারা নতুন বউ-এর মুখ দেখে প্রথম বারে তারাই যথার্থ নতুন-বউ পায়।
সাঙ্গুভ্যালির সামনে দিয়ে খুব জোরে আরও একটা স্কুটার গেল। পেছনে-বসা মেয়েটি হয়তো ছেলেটির বান্ধবীই হবে। জোরে জাপটে ধরে আছে চালককে। কিছুটা প্রয়োজনে, বেশিটা সান্নিধ্য এবং উষ্ণতার জন্যে। সাদার ওপর হালকা বেগুনি-রঙা ছাপার কাজ করা একটি শাড়ি পরেছে মেয়েটি। ছেলেটির মাথায় হেলমেট।
হেলমেট তো জিষ্ণুও পরেছিল। তাই বেঁচে গেছিল অবশ্য। পুষির মাথায় হেলমেট ছিল না। কিন্তু মিনিবাসটা অন্যায়ভাবে, জোরে, বেআইনি করে ওভারটেক না করতে গেলে…।
মিনিবাসের ড্রাইভারদের মুখগুলো দেখা যায় না। সবগুলো মুখকেই একরকম মনে হয়। ওদের মায়া-দয়া নেই। দায়িত্বজ্ঞানহীন, নিষ্ঠুর, অনভিজ্ঞ, অনিয়মানুবর্তী যুথবদ্ধ পুলিশ ও প্রশাসনের মদতপুষ্ট একদল খুনি ওরা। কত পরিবারকে যে অভুক্ত রেখেছে, কত মানুষকে যে জিষ্ণুরই মতো ঘর বাঁধতে দেয়নি নিজেদের হঠকারী সমাজবিরোধিতায় তা যদি ওরা জানত! ওদের বিবেক, টায়ারের কাদারই মতো ধুয়ে ফেলেছে ওরা। কত রক্তচাপের রোগীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে যে মেরেছে ওরা, পঙ্গু করেছে যে কতজনকে তার লেখাজোখা নেই। হয়তো জেনেশুনেই করে। জনগণের নাম করে সব কিছুই করা সম্ভব এখন। এই শহরে ট্র্যাফিক আইন বলে যদি কিছুমাত্রও থাকত! যদি রিভলবার পিস্তল চালাতে পারত জিষ্ণু তবে ওই ড্রাইভারকে খুঁজে বের করে নিজে হাতেই গুলি করে মারত।
জিষ্ণু শুনেছে যে-মিনিবাস চাপা দিয়েছিল পুষিকে সেই মিনিবাসের সেই ড্রাইভার জামিন পেয়ে গেছে অনেকদিন। একই মালিকের অন্য মিনিবাস চালাচ্ছে নাকি এখন। কনফার্মড খুনি। পোটেনশিয়াল খুনিও। আবারও স্টিয়ারিং হাতে অ্যাকসিলেটারে পা দিয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।
থুতু ফেলল রাস্তায় জিষ্ণু।
ও কোথাওই কখনো থুতু ফেলে না। ফেলল তবু, ঘৃণার সঙ্গে। ওর মতো কোটি কোটি অসহায় মানুষের প্রতিবাদের এ-ই রকম। কিন্তু ফেলেই লজ্জা পেল খুব।
পুষি তো আর ফিরবে না।
দারুণ একটি ময়ূরকন্ঠি কাঞ্চীপুরম শাড়িতে পুষিকে সাজানো হয়েছিল শ্মশানযাত্রার আগে। এনগেজমেন্টের দিন যে-শাড়ি পরার কথা ছিল সেই শাড়িটিতেই। কাজল, চন্দন দিয়ে সাজিয়েছিল ওর বন্ধুরা। নববধূরই মতো। মুখে একটুও বিকৃতি ছিল না। মনে হচ্ছিল, যে হাসছে। যেন জিষ্ণুকে এক্ষুনি বলে উঠবে, অ্যাই অসভ্যতা কোরো না।
সে-পর্যন্ত সবই সুন্দর ছিল। তার পর ইলেকট্রিক ফার্নেসের সামনে ওকে খাট থেকে নামিয়ে বাঁশের একটা ফ্রেমের ওপর শোয়ানো হল। ফার্নেসের লোহার দরজাটা যেন যমদুয়ারের দরজাই খুলছে এমন প্রচন্ড ঝনঝন শব্দ করে উঠে খুলে গেল। শ্মশানের কর্মচারীরা ভাবলেশহীন মুখে ঠেলে দিল পুষিকে সেই লাল উত্তপ্ত গুহাতে। তখন বৈদ্যুতিক আগুনের সেই লাল আভাতে পুষির বুদ্ধি-প্রসারিত মাজা মুখটি ক্ষণিকের জন্য এক অসামান্য সৌন্দর্য পেল যা ওকে ফুলশয্যার রাতে জিষ্ণুর আদরও হয়তো দিতে পারত না। তার পরই অদেখা আগ্নেয়গিরির জীবন্ত জ্বালামুখের মতো ফার্নেস তাকে সহসাই গ্রাস করে নিল। একেবারেই সহসা। পুষি ক্রমশ লাল হতে হতে লাল আভা মন্ডিত হয়ে হঠাৎ লাল আগুনের সঙ্গে মিলে গেল। দড়াম শব্দ করে যম-দুয়ারের লোহার দরজা পড়ল। আগুন মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষে কেড়ে নিল ওকে।
মিনিবাসের ড্রাইভারটাকে পেলে জিষ্ণু অমনি করেই একদিন ঠেসে দিত শালাকে খোলা ফার্নেসের মধ্যে একেবারেই জ্যান্ত অবস্থায়। তবুও কি কমত জ্বালা? ভাবছিল, জিষ্ণু।
কী করবে, কোথায় যাবে ভাবছে জিষ্ণু, এমন সময়ে পিকলুর সঙ্গে দেখা। পিকলু একটা লাল মারুতি গাড়ির সামনের বাঁ-দিকের সিট থেকে মোড়ে নামল।
কী রে! কেমন আছিস?
পিকলুকে দেখেই জিষ্ণু শুধোল।
এই!
নিরুত্তাপ গলায় বলল পিকলু।
কবে এলি? কৃষ্ণনগর থেকে? তোর না আজকাল ওখানেই ডিউটি?
প্রতিসপ্তাহেই তো আসি উইক-এণ্ডে।
খবরটা জিষ্ণু রাখে না বলে একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই যেন বলল পিকলু।
খুশি কেমন আছে? কন্যা?
জিষ্ণু, তোর সঙ্গে একটু দরকার ছিল। তোর বাড়িতেই হয়তো যেতাম কালকে সকালে। এখানে এসেছিলাম, ভাবলাম যদি ওদের কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দরকারটা জরুরি।
পিকলু বলল।
তার পরই বলল, কোথাও বসবি? যাচ্ছিলি কোথাও? তুই?
না:। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
কথাটার মধ্যে যে-শূন্যময় হাহাকার ছিল সেটা পিকলুর কানে গেল না। ও নিজের চিন্তাতেই ছিল মনে হল।
পিকলু ভাবলেশহীন চোখ জিষ্ণুর চোখে মেলে বলল, সন্নিসি-টন্নিসি হবি নাকি? কী এমন ঘটল তোর পানা-পড়া পুকুরের জীবনে?
কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। উদ্দেশ্যহীনভাবে জিষ্ণু পথের দিকে চেয়ে রইল।
তবে চল আমাদের বাড়িতেই যাই।
পিকলু হঠাৎ বলল। জিষ্ণু যে যাবে না তা জেনেই।
হ্যাঁ। গেলে অবশ্য মন্দ হত না। খুশির সঙ্গে দেখা হয়নি বহুদিন।
পিকলু মনে মনে বলল, বহুবছর।
আজ থাক। আজ এখান থেকে আমাকে অন্য একটা জায়গায় যেতে হবে। ভুলেই গেছিলাম।
জিষ্ণু বলল।
যাবি কোথায়? পরি কেমন আছে? সেদিন দেখলুম শ্যামবাজারের মোড়ে একটি সিঁড়িঙ্গে লোকের গাড়ি থেকে নামতে নামতে একেবারে তার গায়ে গড়িয়ে পড়ে হাসছে। কী রে?
হাসতেই পারে। জিষ্ণু বলল। হাসির ওপর ট্যাক্স তো বসেনি এখনও। তবে যেকোনো দিন বসিয়ে দেবে কলকাতা কর্পোরেশন। গলায় গামছা দিয়ে ট্যাক্স আদায় করার ব্যাপারে তাঁদের জুড়ি নেই। বদলে কিছুমাত্র করুন আর নাই করুন।
লোকটা কে? বিয়ে করবে নাকি? পরিকে?
পিকলু পুরোনো কথার জের টেনে বলল।
কী করে বলব। সেটা ওর, মানে ওদের পার্সোনাল ব্যাপার। তা ছাড়া বিয়ে ছাড়া আর কিছু ভাবা সম্ভব হল না নাকি তোর পক্ষে?
খুড়তুতো বোন কার সঙ্গে প্রেম করছে খবর পর্যন্ত রাখবি না তা বলে?
কারো গাড়ি থেকে হেসে নামলেই যদি প্রেম হয়ে যেত তবে তো …তা ছাড়া, পরি স্বাবলম্বী। নিজের যোগ্যতাতে স্বচ্ছল। বয়েসও হয়েছে প্রেমের, বিয়েরও; ওর যা-খুশি তাই। করতে পারে ও।
বাবা। তুই যে খুব মডার্ন হয়ে গেছিস আজকাল দেখতে পাচ্ছি।
চিরদিনই ছিলাম। তুই-ই খোঁজ রাখিসনি হয়তো। মানুষের মানসিকতাও গাছেদেরই মতো। আলোর হদিশ পেলেই ডানা ছড়ায় সেদিকে; পাতা ছাড়ে।
এই শুরু হল তোর ভ্যাদভ্যাদে কাব্যি।
তার পরই বলল, তোর তো প্রোমোশন হয়েছে শুনেছি। কী রে জিষ্ণু?
কার কাছে শুনলি?
মদনের কাছে।
কে মদন?
তোদের কোম্পানিতেই কাজ করে রে। তবে ভেরি স্মল-ফ্রাই। অন্য ডিপার্টমেন্টে। তোকে কে না চেনে তোর অফিসে?
চেনাই স্বাভাবিক।
ও।
বড়োরাস্তা ধরে ওরা হাঁটতে লাগল দুজনে। জিষ্ণু ভাবছিল যে, পিকলুও বদলে গেছে অনেকই পিন্টেরই মতো। জিষ্ণু নিজেও হয়তো বদলেছে অনেক। কে জানে!
পুষির কী খবর জিষ্ণু?
জবাব দেবে কি না ভাবল জিষ্ণু একবার। পিকলু ওর ছেলেবেলার বন্ধু। তাকে এই দুঃখের খবর বলে হালকা হতে পারবে একটু নিশ্চয়ই। সব কথা তো সকলকে বলাও যায় না। বলা উচিতও নয়। কিন্তু …
কী রে? কথা বলছিস না যে?
পুষি মারা গেছে গতমাসের প্রথম শনিবার। অনেক দিনই হল।
সে কী রে? কী করে?
আমার স্কুটারকে ধাক্কা মেরেছিল মিনিবাস। আমার হেলমেট ছিল বলে বেঁচে গেছি। ও…
ভেরি স্যাড।
পিকলু বলল, মেকানিক্যালি।
জিষ্ণু বুঝল যে, পুষির চলে যাওয়ার খবরটা ওর হৃদয়ের যতখানি গভীর থেকে উঠেছিল, কথাটা পিকলুর হৃদয়ের ততখানি গভীরে আদৌ গিয়ে পৌঁছোল না।
পিকলু সম্বন্ধে জিষ্ণু চিরদিনই অন্ধ ছিল। এবং পিকলু হয়তো অন্ধ ছিল জিষ্ণুর হৃদয়ে ওর প্রতি যে উষ্ণতা আছে সে-সম্বন্ধে। মানুষে বলে, বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। পিকলুদের অবস্থা জিষ্ণুদের তুলনায় চিরদিনই খারাপ ছিল। কিন্তু জিষ্ণু সকলকেই বলত, সমানে সমানে ছাড়া বন্ধুত্ব হয় না ওসব বাজে কথা। বলত, পিকলুর মতো উদার হৃদয়ের ছেলে ও দেখেনি। পিকলুর মনে কোনোই মালিন্য নেই। ওর কোনো হীনম্মন্যতাও নেই। বরং ওর ঔদার্যের পাশে জিষ্ণুই সবসময়ে হীনম্মন্যতা বোধ করে। মানসিকতার, রুচির, মতামতের সমতা কথাটাই বড়ো কথা। প্রত্যেককেই বলত জিষ্ণু। পিকলুর মতো বন্ধু ওর আর একজনও নেই।
পিন্টে কিন্তু বলত চিরদিনই যে, পিকলু শালা কিন্তু তোকে তেল দেয়। তোর মোসাহেবি করে। হি ইজ আ মেক ইন দ্য এ্যাস।
জিষ্ণু একথা শুনে খুব রেগে যেত। বলত, ওর আর আমার সম্পর্ক এতদিনের এবং এতই পুরোনো যে, তুই সেই বন্ধুত্বের সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিস না কোনো দিনও। পিকলুকে তুই কতটুকু জানিস?
জিষ্ণুর কথাতে পিন্টে চুপ করে যেত।
সম্পর্ক অনেকই পুরোনো হয়ে গেলে, সে দাম্পত্য সম্পর্কই হোক কি বন্ধুত্ব; সেই সম্পর্ক যে বালির ওপরেই গাঁথা হয়েছিল এই নির্মম সত্য স্বীকার করার সাহস এবং ইচ্ছা সম্পর্ক-সম্পৃক্ত কোনো মানুষেরই হল না। অবশ্য জিষ্ণু আর পিকলুর সম্পর্কটি অনেকদিন হয় সময়-এর পরীক্ষা পাস করে গেছে।
হেদোয় এসে ওরা ঘাসেই বসল। কোনো বেঞ্চ-ই খালি ছিল না।
পিকলু বলল, স্কুটার আনিসনি?
না:। স্কুটারটা বিক্রি করে দিচ্ছি। গ্যারেজে দিয়েছি মেরামতের জন্যে। ওরাই খদ্দের দেখে বিক্রি করে দেবে।
কত দাম ধরেছিস?
জানি না। সাত-আট পাব বোধ হয়।
আমাকে দিবি? আমি কিন্তু পাঁচের বেশি দিতে পারব না। তাও পাঁচটি ইনস্টলমেন্টে দেব। এবং পাঁচ বছরে। ভেবে দেখ, তোর লস হবে কি না?
নিতে পারিস, কিন্তু!
কিন্তু কী?
ওই স্কুটার তোর কাছে থাকলেও তো আমার চোখে পড়বেই। পুষির কথা মনে হবে। তা ছাড়া, আনলাকিও তো বটে। নিবি? অ্যাক্সিডেন্টের স্কুটার।
প্রেম থাকা ভালো। তবে এতখানি সেন্টিমেন্টাল হওয়াটা ঠিক নয়। আসলে তোর মানসিকতাটাও তোর লেখারই মতো। ভ্যাদভ্যাদে। মেদবহুল। মেইনস্ট্রিম-এ আয় জিষ্ণু। সবাই যা করে তাই কর। নদী হয়ে যা, দ্বীপ হয়ে থাকিস না।
একটু চুপ করে থেকে পিকলু বলল, তোর লেখা-টেখা কেমন চলছে?
এই।
প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেল জিষ্ণু।
জিষ্ণু একটু অবাক এবং আহত হয়েছিল। পুষির মৃত্যুর তেমন প্রতিক্রিয়া হল না বলে পিকলুর ওপর। আশ্চর্য!
পুজোয় কোথায় লিখছিস এবারে?
সুরজিৎ ঘোষ তাঁর প্রমা-তে একটি উপন্যাস লিখতে বলেছেন। আর সমরেন্দ্র সেনগুপ্তও বলেছেন ওঁর বিভাব-এর জন্যে। ধূর্জটি চন্দ বলেছেন এবং-এ লিখতে। জামশেদপুর থেকে কমল চক্রবর্তীও কৌরব-এ একটি প্রবন্ধর কথা বলেছেন। কিন্তু কোথাওই লেখা হবে কি না জানি না। এবারে হয়তো কোথাওই লিখব না। লেখালেখি আনন্দ-নির্ভর। সবসময়েই লিখতে হলে তা শাস্তি বলেই মনে হয়।
তোর লেখার মতো এত সেন্টিমেন্টাল লেখা আজকাল চলে না। আজকাল টানটান এবং বীর্যবান গদ্যর দিন। একটিও বাড়তি বা অপ্রয়োজনীয় শব্দ থাকে না। টেলেক্স মেসেজে আর সাহিত্যে কোনো তফাত নেই আর। বুয়েচিস। সেন্টিমেন্ট-ফেন্টিমেন্ট ছাড়। ফালতু।
জিষ্ণু একটুক্ষণ চুপ করে থাকল।
তার পর দুম করে বলল, সেন্টিমেন্ট ব্যাপারটা তো মানুষেরই একচেটিয়া। এই শব্দ তো জানোয়ারদের অভিধানে নেই। আমার তো মনে হয়, মানুষ যেদিন পুরোপুরি সেন্টিমেন্ট বর্জিত হবে সেদিন মানুষ আর মানুষই থাকবে না। তুই হয়তো বলতে পারিস যে, সেন্টিমেন্টের প্রকাশটাই আধুনিকতার পরিপন্থী। একথা আমিও জানি। যদিও আংশিকভাবে। কিন্তু আমি তো শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে লাউডস্পিকারে আমার দুঃখের বা সেন্টিমেন্টের কথা জানাচ্ছি না। সেন্টিমেন্টাল লেখামাত্রই খারাপ একথা বলা বোধ হয় যায় না।
তাহলে তো তুই শরৎ চাটুজ্যেকেও বড়ো লেখক বলবি।
আমি তো বলিই। সবসময়েই বলি। তবে আজ এসব প্রসঙ্গ থাক পিকলু। লেখা নিয়ে আলোচনা করার মতো মনের অবস্থাও আমার নেই এ-মুহূর্তে। সেইজন্যেই বলছিলাম, এবার পুজোয় কোথাওই নাও লিখতেও পারি।
পিকলু জিষ্ণুর উম্মা দেখতে পেল তার কথায়।
সান্ত্বনা দেওয়ার গলায় বলল, বয়েস তো আর পার হয়নি। তোর মতো ছেলের, মেয়ের অভাব নাকি রে জিষ্ণু? এক পুষি গেছে তো কত পুষি আসবে।
কথাটাতে হঠাৎ ধাক্কা খেল জিষ্ণু।
বলল, তুই বড়ো ক্রুড হয়ে গেছিস পিকলু।
জীবন। জীবনই করেছে রে!
দু-কাঁধ শ্রাগ করে পিকলু ফিলজফিক্যালি বলল।
সকলেই তো তোর মতো টু-পাইস কামাচ্ছে না? দুধে-ভাতে তো নেই। তুই কি বুঝবি আমাদের কথা। কত বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষ। তুই কেন ক্রুডনেসের কথা বললি বুঝলাম না। জীবনে অনেক কিছুকেই মেনে নিতে হয়। না মেনে উপায় নেই বলে।
মনে মনে বলল জিষ্ণু। কিন্তু জবাব দিল না কোনো। যাদের তর্ক করার যুক্তি থাকে না, তারাই এমন বলে। পিকলু সত্যিই বদলে গেছে অনেক। আজকাল দেখাও হয় ন-মাসে ছ মাসে। বিয়ের পর থেকেই ও অনেক বদলে গেছে। হয়তো জিষ্ণুও যাবে। যখন বিয়ে করবে।
একমুহূর্ত পরেই পিকলু বলল, আমি কথাটা উইথ ড্র করছি। তোকে আহত করে থাকলে আমি দুঃখিত। তবে যাই বলিস, ভগবান যা-করেন মঙ্গলেরই জন্যে। পুষি ওজ নো ম্যাচ ফর ইউ!
এ-প্রসঙ্গ থাক পিকলু। বরং তুই যে কাজের কথা বলার জন্যে এখানে নিয়ে এলি আমাকে সে-কথা বল।
জিষ্ণু বলল, আহত গলায়।
ওর মুখে রাগ ছিল।
হ্যাঁ। কন্যার মুখেভাত দিচ্ছি আগামী সপ্তাহের শনিবার। মানে আজ থেকে বারো দিন পরে।
এই রে।
জিষ্ণু বলল।
আমি যে থাকছি না। সেই শনিবার দিঘা যাব। সুধাংশু আর প্রণব হোটেল করেছে। খুব সুন্দর নাকি হোটেল। একেবারেই সমুদ্রের ওপরে। ওরা জোর করেই নিয়ে যাবে। আমারও মন ভালো নয়। তাই ভাবলাম।
কী নাম? হোটেলের?
হোটেল ব্লু-ভিউ।
সুধাংশুটি কে?
ও আমার ভাইয়ের মতো। দেজ পাবলিশিং-এর। আমার একটি উপন্যাস ছেপেছে। প্রথম বই।
আর প্রণব?
প্রণব কর। ওই অঞ্চলের বনেদি বড়োলোক। দিঘাতেই বাড়ি।
তাহলে ওদের একটু বলে আসিস-না, খুশিকে আর কন্যাকে নিয়ে দিঘাতে যাব একবার। তোর জানা যখন, ডিসকাউন্ট দেবে নিশ্চয়ই। বিনা পয়সাতে থাকতে পারলে তো আরও ভালো হয়। কী রে! মনে করে বলবি তো!
দেখব। জিষ্ণু বলল। এবার কাজের কথাটা বল।
বাবাকে তো জানিসই। ক্যান্টাঙ্কারাস কার্যাক্টার। মানুষ বুড়ো হলে যা হয় আর কী! তার পর বাজে মানুষ বুড়ো হলে হয় শঙ্খচূড় সাপ। এক্কেবারেই অবুঝ এবং মতলবি হয়ে গেছেন। কন্যার মুখেভাতে আমার শ্বশুরবাড়ির একগাদা লোককে নেমন্তন্ন করে দিয়েছেন। মানা করেছিলাম। কিন্তু কে শুনছে বল? এদিকে আমার কি পৈতৃক জমিদারি আছে? না আমি তোর মতো বড়ো চাকরি করি? তুই-ই বল।
তোর কথার মানে ঠিক বুঝলাম না।
জিষ্ণু বলল।
তার পর বলল, ভালোই তো। প্রথম নাতনির মুখেভাত। বলবেনই বা না কেন?
তা বলুন। কিন্তু তার আগে নিজের ছেলের রেস্ত সম্বন্ধে খোঁজখবর তো নেওয়া দরকার ছিল।
জিষ্ণু চুপ করে রইল।
এদিকে আমি পড়েছি মহাবিপদে। বুঝলি। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। লোনটা স্যাংশানও হয়েছে। কিন্তু পাওয়া যাবে সেই তোর গিয়ে মুখেভাতের পরের সপ্তাহে। এখন তুই আমার মুখ রক্ষা না করলে চলবে না।
কী করতে হবে?
পাঁচ হাজার টাকা কালই চাই।
কাল তো ব্যাঙ্ক বন্ধ।
ও। তাহলে পরশু সকালেই তোর বাড়ি যাব।
চেক-বই যে অফিসেই থাকে। অফিসেই আসিস।
তাই যাব। তাড়া করছি এইজন্যে যে, আমাকে আবার মঙ্গলবার একবার বর্ধমানে যেতে হবে খুশিকে নিয়ে। সেখানে আবার গিয়ে ছোটো শালাজের সাধ। তোক বলতে তো আমি একা। দাদার কথা তো জানিসই। আলাদা থাকে। সেজেগুজে নেমন্তন্ন খেতে আসবে। কোনো কাজই তাকে দিয়ে হওয়ার নয়। সাহায্য তো দূরের কথা।
আমি উঠি।
হঠাৎই জিষ্ণু বলল, উঠে পড়ে।
বুঝলি জিষ্ণু, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা পেলেই আমি তোকে এসে দিয়ে যাব। স্টপগ্যাপ হিসেবেই তোর সাহায্য চাইছি। ওঃ। আর একটা কথা। ওই পাঁচটা হাজার, সাড়ে-সাত যদি করিস তো খুবই ভালো হয়। এত লোককে বাবা বলে ফেলেছেন। একেবারে সেনাইল হয়ে গেছেন মানুষটা। আর যা বাজার! টাকার কি কোনো দাম আছে?
সাড়ে সাত হাজার দিতে হলে তো দু-ব্যাঙ্কে চেক কাটতে হয়। লিকুইড ফাণ্ডস তো বেশি থাকে না। আমার এক ব্যাঙ্ককে অত টাকা নেই। এফ ডি বা অন্য ইনভেস্টমেন্টেই থাকে। যতটুকু আছে।
তাই না হয় কাটবি। গরজ বড়ো বালাই। দরকার যখন আমার তখন দুই ব্যাঙ্কে আমাকেই ছুটতে হবে।
যা ভালো মনে করিস।
কাল, মানে পরশু তোর বাড়ি, সরি, অফিসে কখন যাব বল?
ন-টা নাগাদ আয়। সাড়ে নটায় আমার মিটিং আছে একটা। ব্যাঙ্গালোর থেকে কাস্টমার আসছেন।
পৌনে দশটায় গেলে হয় না? আমার মেজোসম্বন্ধী আবার আসবেন সোনারপুর থেকে। তার শালির বিয়ে সম্বন্ধে আলোচনা করতে। আমারই গিয়ে যত ঝামেলা। শ্বশুরবাড়ির সকলেরই আমি যেন লোকাল গার্জেন। তাকে বিদেয় করে তার পর তো আসতে হবে।
ঠিক সাড়ে নটায় কিন্তু আমাকে মিটিং-এ বসতেই হবে।
দেখি। তা হলে ন-টায় যাওয়ারই চেষ্টা করব। আমি তা হলে চলি। এইকথাই রইল কিন্তু। সাড়ে-সাত। সাত দিনের জন্যে। এবং স্কুটারটা।
বলেই, বড়োরাস্তায় পৌঁছে একটি মিনি ধরে পিকলু চলে গেল।
জিষ্ণু ভাবছিল যে পিকলুর শ্বশুরবাড়িতে পিকলু একজন কেউকেটা। এই বা কম কী! কার আদর-যত্নর ভাগ্য যে, কোন ঘরে ঠিক করা থাকে তা বিধাতাই জানেন। তবে জামাই যতই করুক শ্বশুরবাড়ির জন্যে, শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা তাকে কোনো দিনই মনে রাখে না। কৃতজ্ঞতাবোধটুকুও থাকে না তাদের। এই কথা বলেন জিষ্ণুদের অফিসের নগেনদা। বড়ো ভালোমানুষ। সত্যিই শ্বশুরবাড়ির জন্যে অনেকই করেছেন তিনি একসময়ে। ওঁর ভেতরে যে এক গভীর দুঃখ এবং অভিমান কাজ করে তা বোঝে জিষ্ণু। অন্যর দুঃখ কম মানুষেই বোঝে। টাকা-পয়সা দিয়ে করাটা বড় কথা নয়। হৃদয় নিংড়ে যা-দিয়েছিলেন তার সবই ফেলা গেল যে, দুঃখ এটাই।
পুষির কারণে আজ সন্ধেবেলায় জিষ্ণুর যে-বিষণ্ণতা ছিল তা আরও গম্ভীর হল পিকলুর জন্যে। পুষি কোনো দিনও জিষ্ণুর কাছে কিছুই চায়নি। কিছুমাত্র নয়। কফি খেলেও পয়সা পুষিই দিয়েছে জোর করে। ওরা খুব যে-অবস্থাপন্ন ছিল এমনও নয়। পুষির চাকরিটাও তেমন বড়ো কিছু ছিল না। ও ওর উচ্ছ্বাস আর জীবনীশক্তি দিয়েই সব অভাব পুষিয়ে নিত।
পুষি একদিন বলেছিল, আমি উইমেন্স লিব-এ বিশ্বাস করি না। বিয়ের পর চাকরি ঠিক ছেড়ে দেব। দেখো। তখন তো তোমার পয়সাতেই খাব-পরব কিন্তু তাতে আমার সম্মানে একটুও লাগবে না। তোমাকে এত ভালোবাসব, তোমার জন্যে এত কিছু করব যে, তুমিই ভাববে ইশ! কী লজ্জার কথা!
বলেছিল, আমাকে মাসে দু-শো টাকা করে পকেট-মানি দেবে কিন্তু।
বাস-স্টপেজে এসে দাঁড়াল জিষ্ণু নানা কথা ভাবতে ভাবতে। একটা মিনিবাস কর্কশ আওয়াজ করে এগিয়ে গেল। পুষির হাসিমুখটি ভেসে উঠল জিষ্ণুর সামনে। কনডাক্টর শূন্যে লাথি ছোঁড়ার মতো পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে লাগল। মাথায় রক্ত চড়ে গেল জিষ্ণুর। ভাবল, পা-টা ধরে ফেলে একটানে তাকে নীচে নামিয়ে তার কলার ধরে মাথাটা ঠুকে দেয় ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে।
হুড়মুড় করে যাত্রীরা নাতসি জার্মানির কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের বন্দিদের মতো মিনিতে গিয়ে উঠে, মাথা নীচু করে হাতল ধরে দাঁড়ালেন। কনডাক্টরকে মারার স্বপ্ন উবে গেল জিষ্ণুর। কলকাতার মানুষের মতো সহ্যশক্তিসম্পন্ন, আত্মসম্মানজ্ঞানহীন, নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনবহিত মানুষ বোধ হয় শুধু ভারতবর্ষের কেন পৃথিবীর কোনো বড়ো শহরেই নেই। যে-দেশের অধিকাংশ মানুষ একজন মহিলার হাওয়ায় চাবুক মারার শব্দেই ত্রস্ত হয়ে নতজানু হয়ে বসে তার পদলেহন করেন সেই দেশের মানুষদের এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার যোগ্যতাও অবশ্য নেই। দু-চোখ জলে ভরে আসে জিষ্ণুর এই ক্ষুন্নিবৃত্তির বৃত্তে ঘূর্ণায়মান নিরুপায়, সর্বংসহ, প্রতিবাদহীন, অগণ্য নারী-পুরুষের দিকে চেয়ে।
.
০৪.
পিকলু যেদিন আসবে বলেছিল আসেনি। ওর জন্যে মিটিং প্রায় আধ ঘণ্টা দেরি করে করেছিল।
জিষ্ণু অফিসে কাজ করছিল। আজকে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের আসার কথা বম্বে থেকে। বম্বে থেকে কলকাতার ফ্লাইট খুব ভোরেই ছাড়ে। কিন্তু মাড়োয়া টেলেক্স পাঠিয়েছে যে, টেকনিক্যাল ফল্ট-এর জন্যে ফ্লাইট চার ঘণ্টা ডিলেড। দশটাতে যদি বম্বে থেকে ছাড়ে তবে বারোটা দশ নাগাদ দমদম-এ নামবে প্লেন এবং সেখান থেকে অফিসে পৌঁছোতে আরও চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। রিজিয়োনাল ম্যানেজার এবং লোকাল পি আর ও এয়ারপোর্টে বসে আছেন সকাল পৌনে আটটা থেকে। ওঁদের সঙ্গেও কথা হয়েছে জিষ্ণুর। এখন বারোটা বাজে। এম ডি যেকোনো মুহূর্তে এসে পৌঁছোতে পারেন। কাজ-পাগলা মানুষ। খাওয়া টাওয়ার কথা মনে থাকে না। এসেই কাজে বসবেন। ওয়ার্কহলিক!
ঠিক সেই সময়েই বেয়ারা স্লিপ নিয়ে এল পিকলুর। খুবই বিরক্ত হল জিষ্ণু। যেদিন ওর আসার কথা, আগের দিন রাতে ঘুম না হওয়া সত্ত্বেও কোনোক্রমে কাঁটায় কাঁটায় ন-টার সময় পিকলুর জন্যেই এসে পৌঁছেছিল। অথচ সেদিন পিকলু আসেনি। এবং একটা ফোন পর্যন্ত করেনি আসতে পারছে না জানিয়ে। মধ্যে সাত দিন কেটে গেছে। ওর মেয়ের মুখেভাতও হয়ে যাওয়ার কথা। এরকম কুডন্ট কেয়ারলেস অ্যাটিচুডের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো দূরের কথা সম্পর্ক রাখাও মুশকিল কোনো ব্যস্ত মানুষের পক্ষে।
পিকলু ঢুকতেই জিষ্ণু বিরক্ত গলায় বলল, এক্ষুনি এম ডি আসছেন। বড়ো টেনশানে আছি। কী ব্যাপার হল তোর?
আর বলিস না। বর্ধমানের শালা। এমন ইরেসপনসিবল। দে দে চেকটা কেটে দে। মনে আছে তো। সাড়ে-সাত বলেছিলি? বলেছিলি দু-ব্যাঙ্কের চেক কাটবি।
তোর মেয়ের মুখেভাত তো হয়ে গেছে।
হ্যাঁ।
তবে?
তবে কী? কোনোক্রমে কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে ধার নিয়ে ম্যানেজ করলাম।
আমাকে নেমন্তন্ন করলি না? টাকাটা দিতে পারিনি বলে কি নেমন্তন্ন থেকেও বাদ দিলি?
আরে নেমন্তন্ন আর কী! গরিবের ব্যাপার! অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকেই বলেছিলাম। আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বাবার ইরেসপনসিবল কান্ড সব। জানিসই তো। দে টাকাটা দে।
আমি বুঝি ঘনিষ্ঠদের একজন নই? আমি শুধুই তোর ব্যাঙ্কার? জিষ্ণু বলল।
ঠিক এইভাবে জিষ্ণু কোনো দিনও কথা বলেনি পিকলুর সঙ্গে। পিকলু অপ্রতিভ গলায় বলল, মানে না, না। তুই ভুল বুঝছিস।
তোর প্রফিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাটা পাসনি? যার জন্যে অ্যাপ্লাই করেছিলি?
জিষ্ণু জানবার জন্যে স্টার্ন হয়ে বলল।
আরে গভর্নমেন্ট অফিসের কথা আর বলিস না। ইনএফিশিয়েন্সির চূড়ান্ত।
জিষ্ণুর এবারে পিকলুর ওপর একটু রাগ হল। বলল, নো ওয়াণ্ডার। তুই যদি সে-অফিসের একটি স্পেসিমেন হোস। কাজটা করিস কখন তোরা?
আরে আমার তো ঘুরে বেড়ানোই কাজ। কাজ না করলে সরকার কি এমনিতেই চলছে? চাকা বন্ধ হয়ে যেত তো! আমার জবটাই এইরকম। রোদে-বৃষ্টিতে ঘুরতে কার আর ভালো লাগে বল?
জিষ্ণু বলল, মনে মনে, কেমন যে চলছে সরকারি চাকা, তা বেসরকারি সকলে হাড়ে হাড়েই জানে।
বলল, আমার আজ সত্যি খুবই টেনশান।
বলেই ডান দিকের ড্রয়ারটা খুলে একটি খাম দিল পিকলুকে।
নেমন্তন্নই যখন করলি না, আমি যখন তোর ঘনিষ্ঠজনের মধ্যে পড়িই না তখন তোর বাড়িতে তোর মেয়ের মুখেভাত উপলক্ষে আর এখন যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এতে তিন-শো টাকা আছে। খুশিকে বলিস পছন্দমতো কিছু কিনে দেবে কন্যার জন্যে।
আর চেকটা?
আজ আমার সময় নেই পিকলু। সত্যিই বলছি। তুই রাতে একটা ফোন করিস বাড়িতে বরং।
রাতে? কোথায়?
বাড়িতে। বললাম-ই তো।
বাড়িতে তো চেকবই থাকে না।
তা থাকে না। আমার একটা কমিটমেন্ট আছে। সেটা ছিল না, তোর সঙ্গে যেদিন সাঙ্গুভ্যালির সামনে দেখা হয় তখন। গত বুধবারে সেটা অ্যারাইজ করেছে।
কী ব্যাপার?
সেটা তোকে জানাতে পারছি না। কিন্তু খুবই জরুরি।
এমন কথাও আছে যে, তুই আমাকেও জানাতে পারিস না?
থাকবে না কেন? আমি তো তোর ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে পড়ি না।
কথাটা বলে, বলতে পেরে খুশি হল জিষ্ণু।
এত বছরের অন্তরঙ্গতম বন্ধুর ব্যবহারটা ওর কাছে এই প্রথমবার যেন কেমন ঠেকল। যতখানি ব্যথিত হল, ততখানি ক্রুদ্ধ হতে পারল না। কিন্তু পিকলু সম্বন্ধে জিষ্ণু যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তা হলে এ পৃথিবীতে আর কারো সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে পারবে না ও। এত বড়ো দুর্বিপাক একজন পুরুষের জীবনে আর হতে পারে না।
তুই ব্যাপারটাকে বেশ সিরিয়াসলি নিচ্ছিস।
অ্যাপোলজিটাকালি বলল পিকলু।
বেশি, আদৌ নয়। ঠিক যতখানি সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত ততখানি সিরিয়াসলিই নিচ্ছি।
বাঃ বাঃ। খুব রেগেছিস দেখছি!
পিকলু বলল।
জিষ্ণু চুপ করে থাকল।
তা রাগ না-হয় হয়েছে কিন্তু চা তো খাওয়াবি এককাপ? না তাও নয়?
দেখ আজকের দিন এবং ঠিক এই সময়টা আমার আতিথেয়তা করার নয়। তোকে বলেছি যে, এম ডি যেকোনো মুহূর্তে ঢুকে পড়তে পারেন। এমন একদিনও কি হয়েছে যে, তুই আমার অফিসে এসেছিস আর চা খাওয়াইনি তোকে?
পিকলু এবার উঠে দাঁড়াল।
বলল, তুই একটা চাকর হয়ে গেছিস। আ রিয়্যালি চাকর। পাতি-বুর্জোয়া।
চাকর তো বটেই। চাকরি যখন করি। আর সব বুর্জোয়াই সমান। পাতি আর রাজ। চাকরি করি। খেটে খেতে হয়। মনিবকে ভয় করতে হয়। কী করব বল?
মৃদু হাসল পিকলু। টিভি সিরিয়ালের ভিলেনের মতো। তার পর গোল্ড-ফ্লেক সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁওয়াটা ওপরে ছুঁড়ে দিল। এয়ার কণ্ডিশনারের একজস্ট ধোঁওয়ার কুন্ডলীটাকে ঠেলে পিকলুর দিকেই ফিরিয়ে দিল।
দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পিকলু বলল, বুর্জোয়াদের কাছে কাজ করে তুইও একটা রিয়্যাল বুর্জোয়া হয়ে উঠেছিস। একটা শ্রেণি তোদের কখনোও মেনে নেবে না।
কোন শ্রেণি যে মানল তা তো আজও বুঝলাম না। ভূমিহীন কৃষকেরই মতো আমিও একজন শ্রেণিহীন মানুষ। নিজের জন্যেই কষ্ট হয় আমার নিজের। তোর তো হবেই! আশ্চর্য হই না।
পিকলু বলল, তবে ওই কথাই রইল। ফোন করব রাতে। আজ অবশ্য হবে না। কৃষ্ণনগরে চলে যাচ্ছি। ফিরেই করব।
ও চলে যেতেই চানচানি ঘরে ঢুকে বলল, চলো ইয়ার বাহারসে লাঞ্চ করকে আয়েগা।
এম ডি?
উৎকণ্ঠিত গলায় শুধোল জিষ্ণু।
মাড়োয়া হ্যাজ সেন্ট আ টেলেক্স জাস্ট নাউ। দ্য টেকনিক্যাল স্ন্যাগ। মাই ফুট! দ্য ফ্লাইট ইজ ক্যান্সেলড। ট্যুওর প্রোগ্রাম উইল বি ইন্টিমেটেড লেটার।
আজ ব্যাঙ্গালোরে চলে গ্যয়ে বড়াসাব। হুইয়েসে হায়দরাবাদ। মে বি, উইল কাম হিয়ার নেকস্ট উইক ফ্রম হায়দরাবাদ। নাউ দেয়ারস আ রেগুলার ফ্লাইট টু অ্যাণ্ড ফ্রম ক্যালকাটা। নাথিং টু ওয়ারিবাউট!
জিষ্ণুর মনটা এম ডি-র আসন্ন ভিজিট এবং পিকলুর আসার কারণে খুবই টেন্সড হয়েছিল।
বলল, খুশি হয়ে লেটস গো।
কাঁহা যায়ে গা?
কোয়ালিটিমে চালো। নজদিকমে পড়েগা।
চানচানি বলল, স্কাইরুমে খানা কব খিলায়গা? পিঙ্কি দো দফে ইয়াদ দিলায়।
যো রোজ তু ফিকস করোগে। মেরি খুশনসিবি!
জিষ্ণু বলল। এই মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করে ওর হিন্দি এবং ইংরিজি দুই-ই ইমপ্রুভ করেছে।
চালো।
বিয়ার অর্ডার করেছিল চানচানি। গত একসপ্তাহ হল সকাল সাড়ে আটটাতে অফিসে আসছে আর যাচ্ছে রাত ন-টাতে। শনি-রবিও বাদ যায়নি। নতুন এম ডির এই প্রথম ভিজিট। সক্কলেই টেন্সড হয়ে আছে।
মানুষটা নাকি ভালো কিন্তু সবসময়ে হাইপারটেন্সড হয়ে থাকেন এই দোষ। প্রাইভেট সেক্টরের এই দোষ। কেউ কুড়ি হাজার টাকা মাইনে পেলেও নো বডি নোজ হু উইল গেট দ্য স্যাক? অ্যাণ্ড হোয়েন?
বিয়ার যখন আনল বেয়ারা তখন চানচানির বন্ধু মাইক মিনেজিস তাকে ডাকল, সে অন্য কোনাতে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিল। আই টি সি-তে আছে। একাই ছিল।
চানচানি বলল, তুম অর্ডার কর দো ইয়ার ম্যায় আভভি আয়া। মেরি কলেজকি দোস্ত। তুমসে মিলায়গা বাদমে।
এমন সময়ে টেবিল থেকে উঠে এসে মাইক মিনেজিস জিষ্ণুকে উইশ করে গেলেন। ভদ্রলোক। চানচানি বলল মাইকও আমারই মতো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। চানচানি বলে গেল কলেজকি দোস্ত। বড়ো দুঃখের সঙ্গে ভাবল জিষ্ণু যে, স্কুল-কলেজের কোনো বন্ধুর সঙ্গেই মিলিত হওয়ার সাধ আর নেই ওর। কোনো বন্ধুর সঙ্গেই নয়। পিকলু আজ অফিস থেকে মেয়ের প্রেজেন্ট তিন-শো টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার পরই পুরো ব্যাপারটা এবং তার পর অনেকগুলো পুরোনো ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক হয়েছিল। মরমে মরেছিল জিষ্ণু।
পিকলুর এক বোন ছিল। একমাত্র বোন। ওরা এক বোন এক ভাই। পিকলু বোনের বিয়ের পাঁচ বছর আগে থেকেই চাকরি করছিল। যদিও পিকলুর অবস্থা জিষ্ণুর চেয়ে অনেকই খারাপ ছিল তবুও চিরদিনই পিকলু জিষ্ণুর চেয়ে ভালো জামাকাপড় পরেছে, ভালো সিগারেট খেয়েছে, নিজের খরচে কোনোদিনই কোনো কার্পণ্য করেনি।
বোন চম্পার বিয়ের সময়ে পিকলুকে জিষ্ণু জিজ্ঞেস করেছিল, কী দিচ্ছিস তুই চম্পাকে? টাকা-পয়সা জমিয়ে রেখেছিস তো কিছু?
পিকলু ননশালান্টলি বলেছিল, কী বলব তোকে জিষ্ণু, একপয়সাও সেভিং নেই আমার।
অবাক হয়ে গেছিল জিষ্ণু বন্ধুর অভাবনীয় দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখে।
একটু ভেবে বলেছিল, এই কথা কাউকে বলবি না।
তার পর পিকলুকে বউবাজারে নিয়ে গিয়ে তখনকার দিনে পাঁচ হাজার টাকার একটি গয়না কিনে দিয়েছিল চম্পার জন্যে। নিজে যা দেওয়ার তা তো দিয়েই ছিল। বার বার করে বলে দিয়েছিল পিকলুকে, দেখ পিকলু, কেউই যেন না জানে যে, আমি দিয়েছি ওটা। জানলে, তোকে সকলেই অমানুষ ভাববে।
অমানুষ কেউই ভাবেনি।
পিকলুর নিজের বিয়ের সময়ও পিকলু এসেছিল জিষ্ণুর কাছে। জিষ্ণু তখন একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে কাজ করে। এই কোম্পানিতে জয়েন করেনি তখনও। পিকলু তখনও বলেছিল, পাঁচ হাজার টাকা ধার দিবি, প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে অ্যাপ্লাই করেছি। বউভাতের খরচের জন্যে। বাবা ও মামাই সব করছেন। তবু আমারও তো কিছু দিতে হয়। টাকাটা পেয়ে নিশ্চয়ই যাব তবে দু-একদিন দেরি হবে। টাকাটা পেলেই তোকে আমি শোধ করে দেব।
জিষ্ণুকে ঈশ্বর পিকলুর চেয়ে বেশিই দিয়েছিল। শুধু অর্থই নয়, হৃদয়ও। অনেকই বেশি। অনেকই দিকে। তা ছাড়া পিকলু ছিল জিষ্ণুর অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু। ওর জন্যে ওর প্রয়োজনে এটুকু করতে পেরে ভালো লেগেছিল খুবই। খুশিমনেই দিয়ে দিয়েছিল টাকাটা।
কিন্তু পিকলুর বিয়ের পর সপ্তাহের পর সপ্তাহ মাসের পর মাস বছরের পর বছর কেটে গেছিল। জিষ্ণু পথ চেয়ে বসেছিল পিকলুর। টাকাটা নেবে বলে না, টাকাটা পিকলু দিতে এলে সে বলবে, মার খাবি তুই। টাকাটা রেখে দে। ফেরত দিতে যে চেয়েছিস, এতেই ফেরত দেওয়া হয়ে গেছে। ভেবেছিল জিষ্ণু, যে এইটুকু আনন্দ থেকে অন্তত বঞ্চিত হবে না ও। শ্রদ্ধা না করতে পারলে একে অপরকে; বন্ধুত্ব তো নিশ্চয়ই, অন্য কোনো সম্পর্কই টেকে না এ পৃথিবীতে। কিন্তু টাকা ফেরতও দিতে আসেনি পিকলু। এবং জিষ্ণুকেও ওই কথাটা বলার সুযোগ দেয়নি। কোনো দিনই কোনো টাকা ফেরত দিতে আসেনি সে।
তারও পর যখন মেয়ে হল পিকলুর? বর্ধমানের বেস্ট নার্সিংহোমে ভরতি করাল পিকলু খুশিকে। কাকাবাবুর, মানে পিকলুর বাবার সঙ্গে কী নিয়ে যেন মতান্তর ঘটেছিল পিকলুর। কলকাতায় ডেলিভারি হবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির সূত্রে বর্ধমানেই সব ঠিকঠাক করল পিকলু। খুশি পিকলুর স্ত্রী হাসপাতালে ভরতি হয়েছে এই খবর পেয়ে সবচেয়ে আগে যে-ট্রেন পেল তাই ধরে বর্ধমানে পৌঁছেই সোজা নার্সিং হোমে পৌঁছেছিল জিষ্ণু। গিয়ে দেখে, পিকলু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে একা। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। শ্রাবণ মাস ছিল। মনে আছে।
পিকলু বলল, ওর শালা খেতে গেছে। ফিরলেই ও খেতে যাবে।
শালা ফিরলে, জিষ্ণু পিকলুকে নিয়ে ওর অফিসের কলিগ ঝন্টুদার বাড়ি গেছিল। বউদি সেদিন অনেক রান্না করেছিলেন সকাল থেকে। কাদের যেন খেতে বলেছিলেন। অনেক পদ দিয়ে ওই অবেলাতে খাইয়ে দিলেন। খেয়ে, সাইকেলরিকশা করে ফেরার সময়ে পিকলুকে আবারও জিজ্ঞেস করেছিল জিষ্ণু, কোনো সাহায্যর দরকার আছে কি না?
পিকলু বিষণ্ণ মুখে বলেছিল, সিজারিয়ান হবে। টাকা-পয়সার জোগাড় নেই।
কথাটা শুনেই খুবই অবাক লেগেছিল জিষ্ণুর। কিন্তু অবিশ্বাস হয়নি। না। এর আগে কোনো দিনও অবিশ্বাস করেনি পিকলুকে। ওর প্রাণের সখাকে। তখনও বিশ্বাস অটুট ছিল। তবে দুঃখ হয়েছিল বন্ধুর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে রিকশা ফিরিয়ে নিয়ে ঝন্টুদার বাড়ি গিয়ে জিষ্ণু তিন হাজার টাকা ধার করে পিকলুকে দিয়েছিল। সেই টাকাও পিকলু শোধ করেনি। শোধ করার কথা বলেওনি কখনো। ঝন্টুদাকে শোধ করে দিয়েছিল সেই টাকা জিষ্ণু, নিজের অনেক অসুবিধে সত্ত্বেও। ছ-মাসের মধ্যে।
বন্ধুর সম্বন্ধে, বিশেষ করে বাল্যবন্ধুর সম্বন্ধে এসব কথা ভাবলেও বুকের মধ্যে কষ্ট হয়। তা ছাড়া জিষ্ণুর বন্ধু-বান্ধব তো কোনো দিনই বেশি ছিল না। যতটুকু সময় পেত ও, পড়াশোনা, গানবাজনা, ছবি আঁকা নিয়েই থাকত। পুরোপুরিই ইনট্রোভার্ট ছিল। তাই তার ছেলেবেলার বন্ধু পিকলু যে এইরকম ব্যবহার করবে তার সঙ্গে বার বার, জেনেশুনে, একথা বিশ্বাস করতে বড়োই কষ্ট হচ্ছিল ওর। সত্যিকথা বলতে কী, এই মুহূর্তেও এই তঞ্চকতা যে সত্যি সে-কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না ও।
কিন্তু আজকের ব্যাপারটা তো সত্যি সত্যিই অভাবনীয়! বিশ্বাসে চিড় সহজে ধরে না। অন্তত জিষ্ণুর। বহুভাবে নিশ্চিত না হয়ে কখনো কারো সম্বন্ধে মত পরিবর্তনও করে না ও। পিকলুর মেয়ের মুখেভাতও হয়ে গেছে। সবই মিটে গেছে। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা যে-দিন পাওয়ার কথা, সেই দিনটিও অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, অথচ পিকলুকে সে-টাকাটা দিতে পারেনি বলে জিষ্ণুকে পিকলু নেমন্তন্ন পর্যন্ত করল না এবং সব মিটে যাওয়ার পরেও টাকা চাইতে এল। জবরদস্তি করল। মিথ্যে করে কাবুলিওয়ালার কথা বলল। যেন পিকলুর নিজের জীবনের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ওর শ্বশুরবাড়ির মানুষদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর সবটুকু দায়িত্ব শুধু জিষ্ণুরই। এত বড়ো চক্ষুলজ্জাহীন, আত্মসম্মানজ্ঞানহীন মানুষকে বন্ধু বলে মানা আর সম্ভব নয়। রাগ নয়; দুঃখে জিষ্ণু মরে যাচ্ছিল।
বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে মুখটা তেতো লাগছিল। বন্ধু যে, যে উষ্ণ হৃদয়ে তার বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের হৃৎপিন্ড কেটেও একদিন দিতে পারত যাকে, সেও এমন তঞ্চকতা করল জিষ্ণুর সঙ্গে! জিষ্ণুর মতো বন্ধুর সঙ্গে? জিষ্ণু ভাবছিল, একদিন পিকলুর মেয়ে খুঁকিও বড়ো হবে। খুশির কানেও কীভাবে কথাটা পৌঁছেছে পিকলু তার নিজস্ব কায়দায় তা জিষ্ণু জানে না। হয়তো জিষ্ণুকেই ভিলেইন সাজিয়ে রেখেছে নিজেকে হিরো বানাতে। পিকলুর খলবৃত্তির কারণে খুশি এবং খুকির সঙ্গেও হয়তো জিষ্ণুর সম্পর্ক চিরদিনেরই মতো খারাপ হয়ে যাবে। অথবা হয়তো থাকবেই না।
কান্না পাচ্ছিল জিষ্ণুর। বুক ভেঙে যাচ্ছিল এই কথাগুলো ভাবতে অথবা বিশ্বাস করতে।
এমন সময়ে চানচানি ফিরে এল।
বাঁচল জিষ্ণু।
হ্যাভনট ইউ প্লেসড দ্য অর্ডার ফর ফুড?
নো।
বলল, অন্যমনস্ক গলায় জিষ্ণু।
আজীব আদমি তু ইয়ার। অফিস কব লোওটেঙ্গে?
স্টুয়ার্ড! স্টুয়ার্ড!
বলে, ডাকল চানচানি।