০১-২. জিষ্ণু আর পরি

ধুলোবালি — উপন্যাস — বুদ্ধদেব গুহ

জিষ্ণু আর পরি বেরিয়ে গেছে অফিসে। কাক ডাকছে আলসেতে। হেমপ্রভা বারান্দাতে বসে আছেন চা খাওয়ার পর। এমন সময়ে ফোনটা বাজল। সকাল এগারোটা।

হ্যালো।

কেমন আছ?

ওপাশ থেকে হীরুবাবু বললেন।

 ভালোই। তবে আজ একাদশী তো! পায়ের বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। তুমি কেমন আছ?

আর থাকা! চলে যাচ্ছে। রোজ সকালে আমার পায়ের পাতা দুটো আর ডান পা-টা গোল হয়ে ফুলছে।

ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

 দেখাব। হিতেন ডাক্তারকেই তো দেখাই। তবে ও আজকের আর কালকের দিনটা একটু ব্যস্ত থাকবে তো। অবশ্য গোদা কম্পাউণ্ডারকেও দেখিয়েছি। ওর ওখান থেকেই করছি ফোন। জাইলোরিক ট্যাবলেট দিয়েছে। ইউরিক অ্যাসিডের জন্যে। সারাজীবন খেতে হবে। সকাল বেলা একটি করে।

কম্পাউণ্ডারের ওষুধ খাওয়ার কী দরকার! ডাক্তার ব্যস্ত থাকবে কেন?

বাঃ। কাল শনিবার নয়? ঘোড়দৌড়ের দিন! আজ তারই প্রস্তুতি।

সে কী! রেসুড়ে ডাক্তার জোটালে কোত্থেকে?

আরে ও রেস খেলে থোড়ি! ও যে ঘোড়ার ডাক্তার। শুক্র আর শনিবারে মাঠে ওকে। যেতেই হয়।

তাই এল? এতদিনে ঠিক ডাক্তারই ধরেছ। তুমিও তো ঘোড়াই।

কথাটা গায়ে না মেখে হীরু বললেন, শ্ৰীমন্ত কোথায়? তুমি একলা হবে কখন?

আজ ও নেই-ই। দেশে গেছে।

কেন?

কুকুরে কামড়েছে ছেলেকে।

আর মোক্ষদা?

সে তো মাসের প্রথম শুক্রবারে এই সময়ে থাকে না। জানোই তো!

মোক্ষদাও নেই এবং শ্ৰীমন্তও নেই আর তুমি এতক্ষণে আমাকে একটা ফোন করতে পারলে না! বেশ লোক তো!

আমার বয়েই গেছে। যত বয়েস বাড়ছে তোমার এসবও আরও বাড়ছে।

বয়েসকালে স্বধর্মকে বেশি গলাটিপে রাখলে অসময়ে তা প্রকট হয়। এই নিয়ম। যা ভবিতব্য তাই ঘটছে। বুঝেছ হেম?

 বুঝছি কি আর না! ভয় হয়, কোন দিন জিষ্ণু আর পরির কাছে ধরাই না পড়ে যাই। ইতিমধ্যেই পড়েছি কি না কে জানে? পরির হাবভাব আমার ভালো লাগে না আজকাল। বড়োই উদ্ধত হয়েছে। আমাকে বিশেষরকম তাচ্ছিল্য করছে। ভয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারি না কিছু। মুখের ওপর যদি বলে দেয় খারাপ কিছু? ভয় করে বড়ো।

আধেক ধরা পড়েছি গো, আধেক আছে বাকি।

হঠাৎ অচেনা গলা বলে উঠল ফোনে।

হীরু বললেন, কে? কে? কী বলছেন?

 হেম চুপ করে গেলেন। বিপদের গন্ধ মেয়েরা অনেকই আগে পায়।

কে?

আবার বললেন হীরু।

বুড়ো বয়েসে কী প্রকট হয় বলছিলি রে বুড়ো?

 কে আপনি?

আমি তোমার যম। সবাইকে বলে দেব।

কী? কী বলে দিবি রে ছোঁড়া? বাঁদর কোথাকার।

হীরু অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললেন।

 অপরপ্রান্ত বলল, যা-বললে ফাঁসবি তোরা বুড়োবুড়ি।

কী। কী ইয়ার্কি হচ্ছে?

 ইয়ার্কি নয় বাপ। সব সত্যি। তুমি আমাকে না চিনলে কী হয়, আমি তোমাকে চিনি। দেখো কী করি! মা–ন–তু।

ধ্যেৎ।

বললেন, হীরু।

 হেমপ্রভা নীরব।

আমি ছেড়ে দিচ্ছি। বুঝেছ! কোনো চ্যাংড়া ছোঁড়ার সঙ্গে ক্রস-কানেকশন হয়েছে।

হীরু বললেন।

হ্যাঁ গো কেষ্ট ঠাকুর! আমি হলাম গিয়ে চ্যাংড়া আর তুমি তো ভ্যাংড়া হয়েও রসের বন্যা বওয়াচ্ছ।

 চোপ। একচড়ে দাঁত ফেলে দেব।

বলেই, রিসিভার নামিয়ে রাখলেন হীরু। প্রচন্ড উত্তেজিত হয়েছিলেন। কপালের শিরাগুলো দপদপ করছিল। হীরু ফোন করছিলেন গোদা কম্পাউণ্ডারের ডাক্তারখানা থেকেই। হিতেন ডাক্তার বিকেলে এখানেই বসে ছ-ঘণ্টা। গোদা কম্পাউণ্ডারবাবুকে নিজের সি এ বি-র সিজন টিকিটখানা প্রতিক্রিকেট মরশুমে দিয়ে দেন হীরুবাবু। তাতেই বন্ধুত্ব অটুট আছে। ছিপছিপে কম্পাউণ্ডারবাবুর নাম গোদা। হীরুর চেয়ে একটু ছোটোই হবে বয়েসে। আজকালকার ডাক্তারেরা তেমন প্রেসক্রিপশন লিখতেই জানে না। তাই কাজের মধ্যে ইনজেকশান দেওয়া, ড্রেসিং করা; এই। কিছু রেগুলার বুড়ো রসিক পেশেন্ট আছেন। হর্মোন ইনজেকশান নিতে আসেন। নিউমার্কেট থেকে চড়াই পাখি কিনে নিয়ে এসে ভেজে খান। তাতে নাকি ফাকিং-পাওয়ার বাড়ে।

চক্কোত্তি সাহেব বলেছিলেন গোদাকে।

রোজ সল্টলেক থেকে ইনজেকশান নিতে আসেন চক্কোত্তি সাহেব। নিজে কাকে ইনজেকশান দেন তা অবশ্য জানা নেই গোদার। নিজের স্ত্রীকে নিশ্চয়ই নয়। স্ত্রীকে দেখলে মনে হয় চক্কোত্তি সাহেবের ঠাকুমা। তিনি এসব রিপুমুক্ত হয়ে গেছেন অনেকদিন আগেই। সাঁইবাবাই এখন তাঁর সব কিছু।

গোদা বলল হীরুকে, আরে চটো কেন? তাও তো বেঁচে গেছ বে-থা করোনি। আমার বাড়িতে জ্যাঠতুতো দাদার মেয়েটা কলেজে যায়। তাকে যে, কত চ্যাংড়ায় ফোন করে তা কী বলব! আর তাদের কথার কী ছিরি! শুনলে গা গরম হয়ে যায়। আমরা কোনো কথা বলার আগেই ঝড়ের মতো বলে দেয়। শালা কী দিনকালই যে হল।

আমি বলি, হ্যালো

উত্তরে সে বলে, দুর শালা! খ্যাঁচা বাপটা ধরেছে মাইরি। ফোন করার পয়সাটাই জল!

 হীরু হাসেন। গোদার কথা শুনে। তার পর বলেন, পুলিশে খবর দাও না কেন?

ভালোই বলেছ। আস্ত মেয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তাই পুলিশ কিছু বলে না আর ফোন। কাল বিকেলে মহাসমারোহে পাড়ার সব কটা রিকশাওয়ালাকে ধরে নিয়ে গেল। তাদের কী অপরাধ জানা গেল না। হল্লা এসেছিল। আজ সকালেই দেখি তারা নিজের নিজের জায়গাতে ডিউটিতে।

কী ব্যাপার? ওরা বলল জন প্রতি এক-শো টাকা করে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।

 কীসের টাকা?

 বড়োবাবুর মেয়ের বিয়ের প্রেজেন্ট। বড়োবাবুর ছোটোমেয়ের নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে।

কী হবে এসব দেখে মন খারাপ করে? তার চেয়ে চলে যাও দাদা যেখানে যাচ্ছ। আমাকে তো একদিনটির তরে দেখালেও না মাইরি তোমার সোনার মূর্তিটিকে। কী যেন নাম? হেম না কী যেন! আমি কি তোমার ভাগে ভাগ বসাতুম? তবে চালিয়ে তো গেলে! প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল। কী গো? এবারে ইনজেকশানটান লাগলে বোলো। প্রবলেমটা বললেই হল। সলিউশান তো আমারই হাতে।

হীরু চিন্তান্বিতভাবে আবার ফোনটা ওঠালেন। ডায়াল ঘোরালেন। বললেন, হ্যালো।

আনন্দবাজার। কাকে চাইছেন? ও। দয়া করে একটু ধরুন, একটু ধরুন। লাইন এনগেজ আছে।

শুনুন, শুনুন, কত নম্বর? নম্বরটা কত?

এক্সটেনশান নাম্বার দিয়ে কী হবে? এই নিন। দিনু, দেশ এর ঘরে।

হ্যালো। বলুন, আমি সঞ্জীব বলছি।

 সঞ্জীববাবু? মানে? সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়?

হ্যাঁ।

সঞ্জীববাবু, আমার কী সৌভাগ্য!

হীরু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললেন।

 আমারও খুব সৌভাগ্য। আপনার জন্যে কী করতে পারি?

সঞ্জীববাবু বললেন।

গদগদ হয়ে হীরুবাবু বললেন, আজ্ঞে আপনাকে কিছুই করতে হবে না। রং-কানেকশানের দৌলতে আপনার সঙ্গে আজ কথা হয়ে গেল। ভালো থাকবেন স্যার। ভালো লিখবেন। আমি আপনার একজন গ্রেট অ্যাডমায়রার। অবশ্য অগণ্যজনের মধ্যে একজন।

অনেক ধন্যবাদ।

নমস্কার।

নমস্কার। গোদা বলল, হীরুবাবুর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে, হলটা কী তোমার?

আজ দিন খুব খারাপ। আবার খুব ভালোও। ভালো কারণ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। পড়েছ, ওঁর শ্বেতপাথরের টেবিল? অন্য কোনো বই?  

গোদাবাবু লেখাপড়ার ধার ধারেন না বিশেষ। তবে খবরের কাগজ পড়েন। বললেন, ওঁর মেক্সিকো পড়ছি আনন্দবাজারে। রবিবারে রবিবারে। দারুণ লাগছে।

বলেই বললেন, আর টেলিফোন ফেলিফোনের চেষ্টা না করে দুগগা বলে বেরিয়ে পড়ো তো দাদা। শুভকাজে বিলম্ব করতে নেই। রোদও চড়া হচ্ছে ক্রমশ।

হীরুবাবু যখন ট্যাক্সি ধরে পোঁছোলেন গিয়ে হেমপ্রভার কাছে তখন বেলা সাড়ে এগারোটা পৌনে বারোটা। হেমই দরজা খুললেন।

 বাঃ। ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে।

হীরু বললেন।

তুমি তো রোজই সুন্দর দেখছ আমাকে গত তিরিশ বছর ধরেই।

 তা দেখি। মিথ্যে বলব না।

 মিথ্যে এই একটা ব্যাপারে না বললে কী হয়? মিথ্যেতে তো আপাদমস্তকই মোড়া তুমি। মোড়া আমাদের এই সম্পর্কও। যার বিয়ে করার সাহস হল না আমাকে সমাজের ভয়ে, তাকে আর যাই বলি, সাহসী তো বলতে পারি না।

ভয় শুধু আমার কারণেই নয়। যদি সকলে জানত যে পরি আমারই মেয়ে, স্থিরব্রতর মেয়ে নয়; তবে যে-সম্মান আজ তুমি পরি এবং জিষ্ণুর কাছে পাও তা কি পেতে?

গম্ভীর মুখে হেমপ্রভা বললেন, সেই সম্মানেই টান পড়েছে এখন। ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। যদি সত্যিই ওরা জেনে যায় তবে ইহকালও গেল, পরকালও। তা ছাড়া ওরা তো চিরদিন আমার থাকবে না। জিষ্ণুর বিয়ে হলেই সে পর হয়ে যাবে। আজকালকার মেয়েদের তো দেখছিই। হয়তো এ-বাড়ি ছেড়ে দিয়েই চলে যাবে বউ-এর হাত ধরে নতুন ফ্ল্যাটে। পরিও চলে যাবে স্বামীর সঙ্গে। তখন?

তখনও যদি আমি বেঁচে থাকি তখন তোমার কাছে এসেই থাকব। মরার সময়ে যেন তোমার কোলে মাথা দিয়েই মরতে পারি।

বাজে কথা থাক। আমাকে যে অজুহাত দেখিয়ে গেলে সারাটা জীবন, সে-অজুহাত তোমার আর টিকবে না। সোনার মূর্তিও কালো হয়ে যায়। সময় বড়ো বলবান। ধুলোবালি সব জায়গাতেই পৌঁছোয় হীরু।

তার পর হেম একটু চুপ করে থেকে বললেন, কী খাবে? খেয়ে যাও আজ আমার সঙ্গে। ফিরে গিয়ে তো গদাধরের ওই ঠাণ্ডা খাবার গিলবে। বড়ো অবহেলা করে ও তোমাকে।

আমিও তো কম অবহেলা করিনি ওকে। তিরিশ বছর কাজ করছে আমার কাছে। কিন্তু কী দিয়েছি ওকে? মুখের কথা ছাড়া? তা ছাড়া এ-বয়েসে যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো।

সংযম বুঝি কেবল খাবারই বেলায়?

হ্যাঁ।

হেসে ফেলে বললেন, হীরু।

চলো, ঘরে বসবে তো!

বসবার জন্যে কি এসেছি? নাকি খেতে?

 আসোনি?

ধরা-পড়া হাসি হাসলেন হীরু। লজ্জার হাসি।

বললেন, স্বীকার করতে লজ্জা নেই।

তা জানি। তোমার মতো নির্লজ্জ কমই আছে।

বিছানাতে গিয়ে বসলেন হেমপ্রভা। বয়েস চল্লিশের কোঠার শেষে। কিন্তু শরীরের গড়ন পেটন এতটুকু নষ্ট হয়নি। পরি ওঁর শরীরের বাঁধনটি পেয়েছে এবং হীরুর নাক-চোখ এবং দৈর্ঘ্য। স্থিরব্রত বেঁটে ছিলেন। তাই পুরুষের চোখ একবার পরির ওপরে পড়লে আর নড়ে না। পরি ডানা-কাটা পরিরই মতো সুন্দরী। কিন্তু হেমপ্রভার মুখের আলগা সৌন্দর্যটি পায়নি সে। অবশ্য যা-পেয়েছে, তা খুব কম বাঙালি মেয়েই পায়।

জানালাগুলো বন্ধ করে দাও।

সব?

সব। বৃষ্টি আসছে।

ঘরে, না বাইরে?

 হেম হেসে বললেন, ঘরে-বাইরে।

তার পর শাড়িটা ছেড়ে রাখলেন চেয়ারের ওপরে। শায়া আর ব্লাউজ পরেই বিছানাতে গিয়ে শুলেন।

ব্লাউজটা খুলবে না? ভেতরের জামা?

না! অত শখে আর কাজ নেই! দিনের বেলা। কখন কে এসে পড়ে!

আহা! রাতের বেলা কবে যেন আদর খেয়েছ আমার! পরিও তো এসেছিল দিনের বেলাতেই।

হ্যাঁ।

দিনের পরি বলেই আসল পরি হল না।

জানলা বন্ধ করতে করতে হীরু বললেন।

 হীরু বিছানাতে গিয়ে যেই বসলেন অমনি নীচে কলিং বেল বাজল।

দেখলে! বলেছিলাম! কথা শোনো না তুমি।

বিরক্ত ও উদবিগ্নকণ্ঠে বললেন হেমপ্রভা।

তুমি থাকো। আমি বরং দেখে আসি।

না, তুমি খাওয়ার ঘরে গিয়ে বোস। আমিই দেখছি।

খাওয়ার ঘরে যেতে যেতে হীরুবাবু ভাবছিলেন ছোটো স্টেশনের স্টেশনমাস্টারেরা যেমন রাতের বেলার মেল ট্রেনকে বাতি দেখাতে হয় বলে দিনের বেলাতেই স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হন নিরুপায়ে, ওঁর দশাও তেমনই।

নীচে গিয়ে দরজা খোলার আগে আরও দু-বার বেলটা বাজল।

দরজা খুলেই হেম দেখলেন তারিণীবাবু। রং-জ্বলে-যাওয়া নীল-রঙা প্যান্টটার দু জায়গাতে তালি। সাদা সুতো দিয়ে। জামাটাও ঘেঁড়া। কাঁধের কাছে। হাতে একটা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ছাতা। মুখটা গরমে তেতে বেগুনি হয়ে উঠেছে। হাঁপাচ্ছিলেন বৃদ্ধ তারিণীবাবু।

কী ব্যাপার? না বলে-কয়ে এমন অসময়ে?

বিরক্ত গলায় ভুরু কুঁচকে বললেন হেম।

কোনো সময়ই তো আপনার সুসময় নয়। এদিকে আমিও আর পারি না যে, হৈম দেবী।

তারিণীবাবু এ-বাড়ির বাড়িওয়ালা। তিরিশ বছর আগে তিরিশ টাকায় এ-বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন। তারিণীবাবুর দুই ছেলেই ভালো চাকরি করে। কিন্তু বিয়ে করে অনেকদিনই আলাদা হয়ে গেছে। অবশ্য চাকরির কারণেও। একজন থাকে ইংল্যাণ্ডে। পাঁচ বছরে আসে একবার। অন্যজন জামশেদপুরে আছে। সে আসেই না। হয়তো কলকাতার খুব কাছে বলেই। মেয়ের বিয়ে হয়েছে চিত্তরঞ্জনে। জামাই নবকুমার অতিসাধারণ চাকরি করে লোকোমোটিভ ফ্যাক্টরির স্টোর্স-এ। ছেলে-মেয়ে নিয়ে তারা একেবারে ল্যাজে গোবরে। মেয়ে কাছে থাকলে হয়তো দেখত কিন্তু তারিণীবাবুকে দেখার সামর্থ্য সে রাখে না। বৃদ্ধ এখন তিন-শো টাকা পেনশান পান। পেনশানের এখনকার রমরমা তখনকার দিনে ছিল না। বাড়িভাড়া তিরিশ বছরে তিরিশ থেকে বেড়ে হয়েছে এক-শো তিরিশ। আর বাড়েনি। হেমপ্রভাই বাড়াননি। অনেক বারই বলেছেন তারিণীবাবুকে, কোর্টে যান অসুবিধে হলে।

হৈম দেবী। একটু জল পেতে পারি কি?

তারিণীবাবু বললেন।

হেমপ্রভাকে তারিণীবাবু চিরদিনই হৈমদেবী বলেন। হেমপ্রভা কোনো দিনও আপত্তি করেননি।

শুকনো গলায় হেমপ্রভা বললেন, আসুন। ভেতরে এসে বসুন।

ওঁকে একতলার বসার ঘরে বসিয়ে হেমপ্রভা খাবার ঘরে এলেন দোতলাতে।

হীরু বললেন, কোন আপদ?

বাড়িওয়ালা তারিণীবাবু। আপদেরও বাড়া। সেই ঘ্যানঘ্যানে আবদার। ভাড়া বাড়াও।

বাড়ি তো তোমারই হয়ে গেছে। পাঁচ-দশ হাজারে কিনে নাও এখন। কত ভাড়াটে করছে। এখন তো ভাড়াটেদের দিকেই আইন। পুরোনো বাড়িওয়ালারা কেঁদে কূল পাচ্ছে না।

তাড়া ছিল, তাই কথার উত্তর না দিয়ে ট্রেতে করে ঠাণ্ডা জলের বোতল আর গেলাস নিয়ে গেলেন হেম। দুটি রসমুন্ডি ছিল ফ্রিজে কেষ্ট ঠাকুরের জন্যে তাও নিলেন একটি প্লেটে।

 রসমুন্ডিটা খেলেন না তারিণীবাবু। বোতল থেকে ঢেলে ঢেলে পুরো বোতলের ঠাণ্ডা জলই খেয়ে ফেললেন।

আঃ। বড়ো পিপাসা পেয়েছিল। মে মাসের গরম।

 বলুন, কী বলতে এসেছেন?

রুক্ষস্বরে হেম বললেন।

আমি তো একা। জানেনই তো। স্ত্রী তো গত কুড়ি বছর গত হয়েছেন।

 সে তো কুড়ি বছর হলই জানি।

এখন থাকবার মধ্যে আছে একটি কুকুর।

কী কুকুর? অ্যালসেশিয়ান?

আজ্ঞে না। মালিকই খেতে পায় না তা, অ্যালসেশিয়ান রাখব কী করে? সে একটি নেড়িকুত্তা।

অ!

আমি আর সে খাই। দুটি পেট। তিন-শো পেনশান আর এক-শো তিরিশ ভাড়াতে কত হয়?

চার-শো তিরিশ।

ভাগের বাড়িতে দেড়খানা ঘর পেয়েছি। তাতেই আছি গত পনেরো বছর। তাও কর্পোরেশান ট্যাক্স, ইলেকট্রিক বিলে চলে যায় মাসে তিরিশ, মানে গড় হিসেবে ধরলে। চার শোতে কি চলে বলুন? বাতের ওষুধ ব্লাড-প্রেশারের ওষুধ আছে, হার্টের ওষুধ আছে। এসবেই তো চলে যায় এক-শো।

সংক্ষেপে বলুন। আমার তাড়া আছে। একজন অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে।

তা তো হতেই পারে। ভাড়াটা কি আর অন্তত এক-শো বাড়ানো যায় না? মাসে?

টাকা কি খোলামকুচি?

জানি, তা নয়।

কিন্তু আজ এ-বাড়ি ফাঁকা হলে কমপক্ষে একহাজার টাকা ভাড়া হত।

তা হত। কিন্তু একবছরে বারোমাস। তিরিশটি বছর ধরে যে-ভাড়া পেয়েছেন তা আজ জমিয়ে ব্যাঙ্কে রাখলে কত সুদ পেতেন? হাজার টাকার ওপরে। সেই সুদের টাকাটা আমার লস।

কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকলেন তারিণীবাবু হেমপ্রভার দিকে। ছাতাটা দিয়েই মুখের ঘাম মুছলেন। বুড়োরা শিশুদের মতো ইল-ম্যানারড হয়। জীবনের শেষে এসে ম্যানার্স-এর মতো ওইসব বাড়তি ফালতু আড়ম্বরের অসারতা সম্বন্ধে তাঁরা নিঃসন্দেহ হয়ে যান বলেই হয়তো।

একটু দম নিয়ে তারিণীবাবু বললেন, হৈম দেবী, জিষ্ণুর অফিসের ঠিকানাটা দিতে পারেন?

অফিসটা তো কাজের জায়গা। উমেদারির নয়। তা ছাড়া আপনার ভাড়াটে তো আমি। জিষ্ণুর কী বলার থাকতে পারে এ-ব্যাপারে? আপনারও তো তাকে বলার কিছুই নেই।

তা জানি। তবে কোন সময় এলে ওকে বাড়িতে পাব?

এসে লাভ কী? ওর কাছে? তা ছাড়া কখন থাকে না থাকে, তা ঠিক বলতে পারি না। আজকালকার ছেলে।

তবে হীরুবাবুর বাড়িতেই কি যাব?

 হীরুবাবু? তিনি আমাদের কে?

হেম অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বললেন।

কেউই নন?

অবাক এবং আহত গলায় শুধোলেন তারিণীবাবু।

কেউই নন তা বলব না। দুর সম্পর্কের আত্মীয়র মতো। বন্ধুও বলতে পারেন। কিন্তু আমাদের ব্যাপারে আপনি তাঁকে বিব্রত করবেন কেন? তা ছাড়া তাঁর কথা আমি শুনবই বা কেন?

তাও তো বটে। তবে কী করি?

বাড়িটা আমাকে বিক্রি করে দিন।

 বিক্রি? কত টাকায়?

 দশ হাজার টাকায়।

মাত্র দশ হাজার টাকায়? আজকাল যে ছারপোকার মতো গাড়িগুলো বেড়িয়েছে, মারুতি; তার দামই তো একলাখ বারো হাজার।

তা আমি জানি না। তাহলে আমার আর কিছুই করার নেই। আপনার ছেলে-মেয়েরা আপনাকে ত্যাগ করেছে। কিন্তু তার দায়িত্ব তো আমার নয়।

তা ঠিক, আমার দায়িত্ব আপনার কেন হতে যাবে?

একটু চুপ করে থেকে বৃদ্ধ বললেন, তবে কী করব বলতে পারেন হৈম দেবী?

তা আমি আর কী করে বলব? বেলা বাড়ছে। আমার কাজ আছে। এবারে আপনি আসুন। এই অসময়ে কখনোই আসবেন না। মিছিমিছি আসেন কেন? বলেইছি তো কেস করে দিন। এমন উত্তক্ত করলে রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া জমা দেব এবার থেকে। তা কি ভালো হবে?

না। না। আমি চলি। ঠিক আছে। আমাকে সেই বাগবাজারের খালপাড় থেকে আসতে হয় তো। মিনিবাস চড়ার বিলাসিতাও আজ আর করতে পারি না। যা গরম পড়েছে।

আপনার ছেলে-মেয়েরা আপনাকে দেখে না কেন? নিশ্চয়ই কোনো দোষ আছে আপনার?

কী করে বলব বলুন? কপালের দোষ। তবে হ্যাঁ, দোষই তো। দোষ বলতেই পারেন। যৌবনের প্রথম থেকে আমার একমাত্র চিন্তা ছিল, তাদের ভালো করা; তাদের ভবিষ্যৎ। নিজের দিকে এক বারও তাকাইনি। সব কিছু তাদেরই দিয়েছি। তাদের লেখাপড়ার জন্যে। তাদের বিয়েতে। এটাই দোষ। মস্ত দোষ হৈম দেবী।

 তা নয়। তাদের ঠিক করে মানুষ করতে পারেননি। ছেলে-মেয়ে মানুষ করা কি চাট্টিখানি কথা? ক-জন তা পারে?

মানুষ তো করেছিলামই! বড়োজন ইঞ্জিনিয়ার, ছোটোজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তাদের মানুষ করে তোলার চেষ্টা তো আমার বৃথা হয়নি। একে কি মানুষ করা বলে না হৈম দেবী? আমি তো সামান্য টিকিট কালেক্টারের চাকরি করতাম। তাদেরই জন্যে আমার প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা কমুট করেছিলাম সেই কতদিন আগে। আমার সাধ্যের বাইরে গিয়েও পড়িয়েছিলাম তাদের। একটু চুপ করে থেকে তারিণীবাবু বললেন, আমার জ্ঞাতিরাও আপনি যা বললেন তাই-ই বলেন। সবই নাকি আমার দোষে। বলেন, টিকিট-কালেক্টার হয়ে ঘুসের টাকায় ছেলেদের লাট-বেলাট বানিয়েছ এখন ছেলেরাই তোমাকে না দেখলে আমরা কী করতে পারি? ভগবানের হাত তো দেখা যায় না হৈম দেবী। তাঁর মার আসে ঠিক সময়ে। কারোরই নিস্তার নেই। পাপ করলে শাস্তি পেতেই হয়। আজ আর কাল।

বুড়ো হলে মানুষ বড়োই বেশি কথা বলে। অসহ্য একেবারে। ভাবছিলেন, হেম।

একটু ঢোঁক গিলে তারিণীবাবু বললেন, আসলে আমার জ্ঞাতিদের কারো অবস্থাই তো ভালো নয়। নুন আনতেই পান্তা ফুরোয়। এই বাড়িটিই বাবা আমাকে আলাদা করে দিয়ে গেছিলেন। প্রথম থেকেই আমি এখানে এসেই থাকতে পারতাম। কিন্তু তখন তিরিশ টাকারও যে, অনেক দাম ছিল আমার কাছে হৈম দেবী।

 দাম ছিল বই কী! আপনার কাছে যেমন ছিল আমার মতো একজন প্রায় অসহায় সদ্য বিধবার কাছে তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল। কথাটা মানেন তো?

আমি তো সেই কথাই বলছি আপনাকে। আপনি বুঝতেই চাইছেন না।

 আমি বুঝি।

অতীতের দিকে একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে হেমপ্রভা বললেন।

জানেন, বড়োখোকার জন্যে প্রাইভেট টিউটর-এর দরকার ছিল। খুকির গানের মাস্টার। তাই ভাবলাম, বাড়িটা ভাড়াই দিয়ে দিই। তারিণীবাবু বললেন। বড়োখোকা এখন কভেন্ট্রিতে আছে (ইংল্যাণ্ডে)।

তাই? কবে গেল? দিল্লিতে ছিল-না?

 হ্যাঁ। ওখানে যাওয়ার আগে ছিল।

হেমপ্রভা এবারে দাঁড়িয়ে উঠলেন।

বললেন, আপনার চাকরিতে ঘুস-ঘাসও তো ছিল একটু-আধটু। জ্ঞাতিরা যা বলেন তার সবটাই তো আর মিথ্যে নয়।

তারিণীবাবু একটুও লজ্জিত হলেন না।

বললেন, মফসসলেই পোস্টিং ছিল চিরদিন। কলাটা মুলোটা জুটত। একেবারে শেষের দিকে বড়ো স্টেশান পেলাম। তা হৈম দেবী মিথ্যে বলব না আপনাকে; রিটায়ার করার সময়ে হাজার তিরিশেক জমিয়েও ছিলাম ক্যাশ। শেষজীবনের রোজগার। হার্ড-ক্যাশ। আমাদের সময়ে ঘুসখোরদের সমাজে মাথা নীচু করে হাঁটতে হত। আজকের মতো দিনকাল ছিল না। হাঁসের বাচ্চারা ডিম ফুটে বেরিয়েই যেমন সাঁতার কাটে এখনকার দিনের ছেলেরা প্রায় সেরকমই মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই ঘুস খায়। স্তন্যপায়ী জানোয়ারদের দুধ খাওয়ার মত। এদের মধ্যে বিবেক-টিবেক বলে কোনো গোলমেলে ব্যাপারই নেই।

হেমপ্রভা বৃদ্ধর প্রলাপ থামিয়ে বললেন, কী করলেন সেই টাকা? তিরিশ হাজার?

সেই তিরিশ হাজার?

হ্যাঁ।

সঞ্চয়িতা।

সঞ্চয়িতা? মরুন তাহলে। অতিলোভে তাঁতি নষ্ট। ছত্রিশ পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট। তখন বাগবাজার আর শ্যামবাজারের বাজারে যারাই গলদা চিংড়ি বা ইলিশ কিনত তারা সবাই কিনত সঞ্চয়িতার সুদের টাকায়। ওঃ কী গরমই না হয়েছিল মানুষের। বেশ হয়েছে। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।

আমি কী করব?

যা ভালো মনে করেন।

 জিষ্ণুর ফোন নাম্বারটা?

না। দেওয়া যাবে না। জিষ্ণু কে? বলেইছি তো! আপনি কোর্টে কেস করুন বরং তারিণীবাবু। কুকুরটাকে ওয়ারিশ করে যাবেন। আপনার যা অবস্থা দেখছি, খুব বেশিদিন যে আছেন, তাও তো মনে হচ্ছে না।

আঃ। তাই-ই আশীর্বাদ করুন হৈম দেবী। তাই আশীর্বাদ করুন। যত তাড়াতাড়ি যাই ততই মঙ্গল।

তারিণীবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ-ই বললেন, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যেদিন আপনি হীরুবাবুর মধ্যস্থতায় এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তখন আপনার মন এবং মুখের চেহারাও কিন্তু অনেকই নরম ছিল। সদ্য-বিধবা আপনাকে দেখে আমার দয়া হয়েছিল। তাই ওই ভাড়াতে..। নইলে, তখনও এ-বাড়ির ভাড়া ইজিলি এক-শো টাকা হতে পারত মাসে। কী হত-না?

হ্যাঁ। তারিণীবাবু আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এককথাই অনেকবার হল। এবার

আপনার মনের ভাব আর মন নরম ছিল না?

 হেম বললেন, তখন অনেকই নরম ছিল আমার মন। শুধু মনই কেন, অনেক কিছুই নরম ছিল। বাইরেটা এই তিরিশ বছরে যেমন শক্ত হয়ে গেছে, ভিতরটাও হয়েছে। নিশ্চয়ই হয়েছে। আপনারও কি হয়নি?

এইকথাটা তারিণীবাবুকে অফ-গার্ড করে দিল মুহূর্তে। তারিণীবাবু উঠে পড়ে দরজার দিকে এগোলেন। এগিয়ে গিয়ে নিজেই দরজার খিল খুললেন।

বেশ ঝুঁকে হাঁটেন এখন। আগে কেমন টানটান চেহারা ছিল। পেছন থেকে লক্ষ করলেন হেম। ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, এ-বাড়ির সব দরজা-জানালা বার্মা টিক-এর। জানেন? বাবা, বার্মার বিখ্যাত সেগুন কাঠের কারবারি স্যালউইন টিম্বার থেকে আনিয়েছিলেন এই কাঠ। ল্যাজারাস কোম্পানিও রেঙ্গুন থেকে কাঠ আনাত এই স্যালউইন টিম্বার কোম্পানি থেকেই। বার্মার স্যালউইন নদীর দু-পাশে ছিল নিবিড় সেগুনের জঙ্গল। ব্রিটিশ আর্মির জেনারেল উইংগেটের নাম শুনেছেন কখনো হৈম দেবী? যিনি শুধুই পেঁয়াজ খেয়ে থাকতেন? তাঁর আর্মির অসাধ্যসাধনের ক্ষমতায় হেড কোয়ার্টার্স-এ আর্মির অফিসারেরা তাঁর নাম রেখেছিলেন উইংগেটস সার্কাস। জানেন?

বুড়ো হলে মানুষ বড়োই বাজে বকে। ভাবছিলেন হেম। নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছিলেন।

জানি না। আপনি এবারে এগোন তারিণীবাবু।

দরজা খুলেই, তারিণীবাবু বললেন, উরে বাবাঃ মেঘ গজরাচ্ছে। জোর বৃষ্টি হবে।

হেমপ্রভা মাথা নাড়লেন।

 চলে যেতে যেতেও তারিণীবাবু একবার হেম-এর দিকে চেয়ে হঠাৎ বললেন, আমাকে দেখে সাবধান হবেন হৈম দেবী।

কেন? কীসের সাবধান?

আপনি যেমন ভাসুরপো আর মেয়ের জন্যে করেছেন, আমিও নিজের ছেলে-মেয়ের জন্যে তার চেয়েও বেশি করেছি। নিজের দিকে তাকাবেন। কিছু আশা করবেন না সংসারে কারো কাছ থেকেই। আমার মতো বোকা হবেন না।

হেমপ্রভা বেশ ধাক্কা খেলেন কথাটিতে।

তারিণীবাবু চলে গেলে, দরজায় খিল দিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে ওপরে এসে দেখলেন যে, হীরুর আর তর সয়নি। হৈমর বিছানাতে প্রায় বিবস্ত্র হয়েই পাখাটা অন করে দিয়ে শুয়ে আছেন।

হেম গম্ভীর হয়ে গেছিলেন। তারিণীবাবুর শেষকথাটি তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল।

কী এত আসল-সুদের কারবার করছিলে এতক্ষণ?

 রসিকতা করে বললেন হীরুবাবু।

হেমপ্ৰভা কথা না বলে হাসলেন।

জানলা-বন্ধ প্রায়ান্ধকার ঘরে তাঁর দিকে তাকিয়ে হীরুবাবুর মনে হল, এখনও হেম যুবতীই আছেন। হারায়নি কোনো কিছুই। হেমের মতো সুন্দরী, জেদি এবং স্বয়ম্ভর নারী তিনি কমই দেখেছেন জীবনে। নইলে আর নিজে সারাজীবন বিয়ে না করে কেন…

হেমপ্রভা বললেন, বোলো না আর! জ্বালাল ওই বাড়িওয়ালা তারিণীবাবু।

বেচারা। তোমার ঢলঢলে মুখোনি দেখে মাসে মাত্র তিরিশ টাকায় এ-বাড়িটি ভাড়া দিয়েছিলেন। আজ তাঁর কী দুর্গতি! চার কাঠার ওপরে বাড়ি। এ-বাড়ির দাম আজকে চার পাঁচ লাখ হবে।

তা হবে। সবাই তো তোমার মতো চালাক নয়। বেশিরভাগ পুরুষই তারিণীবাবুর মতোই বোকা। ঢলঢলে মুখ আর ঝরঝরে শরীর দেখে যে-ভুল করেছিলেন, সারাটা জীবনই তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হল। এবং হবেও তাঁকে।

আমি তো একনম্বরের বোকা।

হীরুবাবু বললেন।

বোকাই বটে। কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নিয়েছ সব কিছুই। এখন দেনা হয়ে গেছে আমার কাছে পাওনার বদলে।

মিটিয়ে দেব, মিটিয়ে দেব, এখনও যদি সব মিটে গিয়ে না থাকে। পরির বিয়েও আমিই দিয়ে দেব। ভেবো না কিছু।

পরি হয়তো ভাবতেই দেবে না আমাদের। তবু পরির বিয়ে হয়ে গেলে আমি আর তুমি তীর্থে চলে যাব। তখন লোকে কে কী বলল, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকবে না। আমার অন্তত থাকবে না। তোমারও থাকা উচিত নয়। লোকভয় বুকে করে আর বাঁচতে পারি না। বড়ো কষ্ট।

আজ তুমি বড়ো কথা বলছ হেম। এসো তো এবারে।

প্রথম বারের অনুরোধে না করেছিলেন। তাই হীরুকে অনেকক্ষণ প্রতীক্ষায় রাখার খেসারত হিসেবে নিরাবরণ হয়েই এলেন এবারে হেমপ্রভা। আয়নাতে তাঁর শরীর অন্ধকারে ঝিলিক মারল। এখনও কোথাওই একটু বাড়তি মেদ নেই। তলপেটে অতি সামান্য ছাড়া। ওখানে না থাকলে খারাপই দেখাত। খুশি হলেন হেমপ্রভা নিজেকে দেখে।

হীরু অধৈর্য দু-হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন হেমপ্রভার ঠাণ্ডা, মসৃণ, উজ্জ্বল, কোমল শরীরকে। হেমপ্রভার শরীরে কোনো দিনও কোনো দুর্গন্ধ পাননি তিনি। চূড়ান্ত গরমেও না। অথচ হেমপ্রভা মাথায় লক্ষ্মীবিলাস তেল ছাড়া সর্বাঙ্গের কোথাওই কোনোদিন প্রসাধন তো দূরের কথা পাউডার বা তেলও ব্যবহার করেননি। পদ্মিনী নারী।

মনে মনে বলেন হীরু।

হেমপ্রভা সবে নিজের শরীরটিকে যেই আলগা করে দিয়েছেন হীরুকে গ্রহণ করবেন বলে নিঃশব্দ আড়ম্বরে অমনি কলিং বেলটা আবার বাজল।

হীরু দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন।

হেমপ্রভা বললেন, দাঁড়াক গে! যে এসেছে সে। যত্ত আপদ অসময়ে।

হীরু একসেকেণ্ড সময় নিলেন ভাবতে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বেলটা বেজে উঠল একই সঙ্গে বার বার। আবার। ঝনঝন করে। হীরুবাবুর গড়ে তোলা ইমারত ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

 হেমপ্রভা উঠে পড়ে জামাকাপড় পরতে পরতে বললেন, নিশ্চয়ই পরি। ও ছাড়া এমন অধৈর্যর মত বেল আর কেউই দেয় না। তোমার যে এত ধৈর্য তার কি ছিটেফোঁটাও পেতে পারত না মেয়েটা?

হীরু উঠে পড়ে বললেন, তুমিই তো বলে এলে চিরদিন যে, ও আমারই মেয়ে। কার যে মেয়ে তা স্থিরব্রতও জানত না হয়তো। আমি তো জানিই না। ছেলে-মেয়ে যে আসলে কার তা মায়েরাই জানে।

তাড়াতাড়ি করো তো। কথা বোলো না এত।

রাগ ও বিরক্তির গলায় বললেন হেমপ্রভা।

কী বলবে? দোর খুলতে দেরি হওয়ার কারণ?

চিন্তান্বিত গলায় হীরু শুধোলেন হেমপ্রভাকে।

বলব, বাথরুমে ছিলাম। তারিণীবাবু আসাতে চানে যেতে দেরি হয়ে গেছিল।

আমি কোথায় থাকব?

 ধরা-পড়া চোরের মতো হীরুবাবু বললেন।

 তুমি জিষ্ণুর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে থাকো।

দুস, পরকীয়ায় বড়ো ফ্যাচাং। এই বয়েসে আর পোষায় না।

 তিরিশ বছর পরে বুঝলে বুঝি? বিয়ে করার মুরোদ থাকলে তো পরকীয়া করতেই হত না।

বিয়ে করা লোক দেখে ঘেন্না হয়ে গেছে। পরকীয়া মানুষকে নতুন রাখে।

হীরু গিয়ে জিষ্ণুর ঘরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে খবরের কাগজটা নিয়ে বসলেন। বেলটা বেজেই চলেছে। ঝনঝন ঝন ঝন। হীরুবাবুর মাথার মধ্যে অতীত ভাঙছে কাঁচের বাসনের মতো। হীরুবাবু ভাবছিলেন, পরি এসে এক্ষুনি কলকল করে কথা বলতে বলতে বারান্দাতে ঢুকবে। মাঝে মাঝে বড়ো ব্যথা বোধ করেন। নিজের হয়েও মেয়েটা নিজের হল না। পরিকে দেখলেই বুকের মধ্যে নানা গভীর বোধ উথাল-পাথাল করে। অপত্য। অথচ সমাজ তাঁকে সে-আনন্দ থেকে বঞ্চিত করল।

পরি কিন্তু এল না। আসেনি। শ্ৰীমন্তর গলা শুনলেন একটু পরেই হীরুবাবু।

শ্ৰীমন্ত বলছিল হেমকে আর বোলো না গো মা। মিছিমিছি হয়রানিটা করালে। মদনাটা চিরকালই অমনই বে-আক্কেলে। কুকুরে কামড়েছে বটে, ছোটোছেলেকেও বটে; তবে আমার ছেলেকে নয়।

তবে?

আমার যে জ্যাঠতুতো ভাই, গোবর্ধন, বাবার ধান-জমি যে মেরে দিলে গতবছর পঞ্চায়েতকে ঘুস খাইয়ে, সেই তারই ছেলেকে। ছেলেটা মরলে বাঁচি। খামোকা গরমের মধ্যে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে গেলাম। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। পাপ করেচ, পাচিত্তির করবে না?

তোমার রান্নাও তো করিনি। তাড়াতাড়ি যা-হোক দুটো ফুটিয়ে নাও তোমার জন্যে।

বিরক্তির গলায় হেমপ্রভা বললেন।

আর হীরুবাবু এসে বসে আছেন বাড়িওয়ালা আসবেন বলে। তিনিও তো এলেন না।

বাবু কোথায়?

দেখো কোথায়? বোধ হয় দাদাবাবুর বারান্দায় আছেন।

ইতিমধ্যে হীরু এসে দাঁড়ালেন।

এতবেলা যখন হল দুটি খেয়েই যাও। গিয়ে তো ঠাণ্ডা ভাত খাবে! গদাধরকে কিন্তু তাড়ানো দরকার। বড়োই অযত্ন করে ও তোমার। এ-বয়সে এত সইবে কেন?

না, না চলেই যাই।

সে কী বাবু! এবার শ্ৰীমন্ত বলল। এই রোদে চলে যাবেন কী? আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।

তোমার বাড়তে হবে না শ্ৰীমন্ত। তুমি আগে চান-টান করো। গরমে এসেছ। আমিই বেড়ে দিচ্ছি।

হেমপ্রভা বললেন।

তাই করি।

শ্ৰীমন্ত বলল।

শ্ৰীমন্ত তার পুঁটুলি নিয়ে ছাদে নিজের ঘরে গেল। ছাদেই চান করবে। মোক্ষদা যখন থাকে, দোতলাতেই থাকে। তখন নিরিবিলি হওয়া হেম-এর পক্ষে আরও মুশকিল।

শ্ৰীমন্ত চলে যেতেই হীরু চাপা গলায় বললেন চলো।

হেমপ্রভা হীরুর চোখে চিরন্তন পুরুষের অধৈর্য কাম দেখতে পেলেন। মুখে বললেন, আজ থাক। শ্ৰীমন্ত হুট করে নেমে আসবে। বাধার পর বাধা আসছে আজ।

হীরু বললেন, যাইহোক। আমি আজ তোমাকে চাই-ই।

হেমপ্রভা আস্তে শব্দ না করে দুয়ার দিলেন। ঠিক সেই সময়েই দরজায় ধাক্কা দিল শ্রীমন্ত। বলল, মা, বাবুকে তো খুঁজে পাচ্ছি না। চলে গেলেন নাকি? আপনি কি পুজোয়?

 হেমপ্রভা ভাবলেন, পুজো নিশ্চয়ই। তবে তিনি এখন দেবীর ভূমিকায়। তার পর দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তিতে বললেন, হ্যাঁ। পুজোয়।

শ্ৰীমন্ত নীচে নামতেই নিঃশব্দে আবার দরজা খুলে হেমপ্রভা হীরুকে বললেন, তুমি শিগগির পরির ঘরে চলে যাও। শ্ৰীমন্তকে বলবে যে, আমি পুজো করছি। আসছি দু-মিনিটে। কী যে করো-না! তোমার জন্যে আমার সর্বস্ব যাবে।

আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে হেমপ্রভা ভাবছিলেন, মিথ্যার এই দোষ। একটা মিথ্যা বললে দশটা মিথ্যা দিয়ে তা ঢাকতে হয়।

ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েই হেমপ্রভা দেখলেন শ্ৰীমন্ত। শ্ৰীমন্তরও এ-বাড়িতে কুড়ি বছর হল। আর মোক্ষদার প্রায় পঁচিশ বছর। শ্ৰীমন্তর চুলের প্রায় সবই সাদা। সাদা চুল ওর কাটা কাটা মুখকে এক সম্ভ্রান্ততা দিয়েছে। মোক্ষদার বয়েস শ্ৰীমন্তর চেয়ে বেশি হলেও ওর কপালের দু-পাশটুকুই সাদা হয়েছে শুধু।

শ্ৰীমন্ত হেমপ্রভার চোখে তাকাল। তাকিয়েই চোখ নামিয়ে আনল।

শ্ৰীমন্ত বলল, দরজা তো ভেতর থেকেই খিল দেওয়া ছিল।

দিদিমণির ঘরে দেখো তো। সেখানেই আছেন তাহলে।

দিদিমণির ও দাদাবাবুর ঘর-বারান্দা দেখেই তবে আপনার ঘরে ধাক্কা দিয়েছিলুম মা। বাবু তো কোথাওই নেই।

হেমপ্রভার চোখ জ্বলে উঠল মুহূর্তের জন্যে শ্ৰীমন্তর চোখে তাঁর চোখ পড়তেই। শ্ৰীমন্তর। চোখে দুঃখ-মিশ্রিত বিস্ময় ছিল। হেমপ্রভাকে শ্ৰীমন্ত সম্মান করত। আজ …

হেমপ্রভা বললেন, ওই দু-ঘরেই আবার দেখো, পাবে নিশ্চয়ই। জলজ্যান্ত মানুষটা তো উবে যাবে না।

এমন সময়ে পরির ঘর থেকে বেরিয়ে হীরু বললেন, ব্যাপারখানা কী? তোমরা কি পুলিশে ফোন করবে নাকি? এই তো আমি!

হেমপ্রভা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবছিলেন যে, আজ হীরুকে বাধা দেওয়া উচিত ছিল। খুবই উচিত ছিল। কিন্তু তাঁর ভেতরেও এক তাগিদ বোধ করছিলেন যেন। সব দিন এমন করেন না। বিপদের ঝুঁকি আর নেই বলেই মাঝে মাঝে আজকাল শরীরকে প্রবলভাবে বোধ করেন। আগুন বাধা পেলে জোর হয় বোধ হয়। ভাবছিলেন মোক্ষদার কাছে তো বহু বারই দিনে এবং রাতে ধরা পড়েছেন। আজ প্রথম শ্ৰীমন্তর কাছেও পড়লেন। মেঘলা আকাশে দুপুরের কলকাতায় ঘুরেঘুরে চিল উড়ছিল। স্টেইনলেস স্টিল-এর বাসনওয়ালি আর ডাবওয়ালা হেঁকে যাচ্ছিল নির্জন দগ্ধ গলিতে। খাবার গরম করতে করতে হেমপ্রভা ভাবছিলেন যে, মোক্ষদা সব জেনেও তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছে। অবশ্য একথা মোক্ষদা জানে না যে, পরির বাবা হীরুই। স্থিরব্রতকে মোক্ষদা চোখেও দেখেনি কখনো। মোক্ষদাও বালবিধবা। তার বাঁ গালে একটা কাটা দাগ। এবং ক-টি তিল। দুশ্চরিত্র-র লক্ষণ। ছেলেবেলায় আমচুরি করতে গিয়ে কাঁটাতারের বেড়ায় লেগে গাল চিরে গেছিল। নইলে চেহারাটা ভারি স্নিগ্ধ। হিজল বনের ছায়ামাখা মুখোনি। এ-বাড়িতে যে-পুরুষই আসে মোক্ষদার মুখে তার চোখ আটকাবেই। শরীরের বাঁধনও চমৎকার। বাদার নোনা-নোনা গন্ধ লেগে আছে যেন। মোক্ষদা বালবিধবা বলেই হয়তো হেমপ্রভার দুঃখের কিছুটা বোঝে। এবং হয়তো বোঝে বলেই ওঁর দুঃখপূরণের অপরাধটাকে খাটো করে দেখে। অবশ্য হেমপ্রভাও ওকে ছাড় দেন। ওর এক গ্রামতুতো দাদা প্রায়ই দুপুর বেলা আসে ছুটির দিনে ওর সঙ্গে দেখা করতে। কোনো কোনো দিন হেমপ্রভা এই বাজারেও তাকে খেয়ে যেতে বলেন। রান্নাঘর, সংলগ্ন বারান্দার ছায়াচ্ছন্ন ভাঁড়ার ঘর এসবই মোক্ষদার রাজত্ব। সেই গ্রামতুতো দাদা রামু এলে হেমপ্ৰভা শব্দ করে কপাট বন্ধ করে নিজের ঘরে ঢুকে যান। বলে যান, চারটের সময়ে চা দিয়ে মোক্ষদা। তার আগে আমাকে তুলো না। আমি ঘুমোব। ফোন এলে তুমিই ধোরো। যে-ই করুক, বোলো যে, চারটের পরে করতে।

মোক্ষদা বুদ্ধিমতী। বোঝে তার খেলার বেলার আয়ুষ্কাল। এবং তা নির্বিঘ্ন।

হেমপ্রভা দরজা খোলার অনেক আগেই খেলা সাঙ্গ করে মোক্ষদার গ্রামতুতো দাদা ফিরে যায়। খেলাটা যে কী প্রকারের তা জানার কোনো কৌতূহল হেমপ্রভার ছিল না কখনোই। ওরা দুজনে হয়তো মুখোমুখি বসে গল্পই করে। যাই-ই করুক মোক্ষদা, হেমপ্রভা জানেন অন্তরে অন্তরে যেকোনো মানুষের পক্ষেই একা দীর্ঘদিন থাকা বড়ো কষ্টের। মন তো বটেই, শরীরও দোসর চায়। হেমপ্রভা পাপী। তাঁর এই পাপ যৌবনেই এবং স্বামীকে বঞ্চনা করেই। বিয়ের অত অল্পদিনের মধ্যেই পরি গর্ভে আসে তাঁর অথচ সে-সন্তান স্থিরব্রতর নয়। স্থির জানেন একথা হেমপ্রভা এবং হীরু, হীরেন্দ্র অধিকারী।

 কেন, কী করে এসব ঘটল সেসব অনেক কথা। অনেক কথা। অনেকদিনের কথাও। মনে আনতে চান না হেমপ্রভা। শুধু একটি কথা ভেবে এখনও দুঃখ পান। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে স্থিরব্রত একটিই কথা বলেছিলেন : পরি কোথায়? আমার পরি? ওকে আনো।

বহুবছর হয়ে গেছে। অপরাধবোধ এখন ভোঁতা হয়ে এসেছে। এমনকী মাঝে মাঝে মনে হয়, ব্যাপারটা মিথ্যা।

 দুঃস্বপ্ন একটা।

হীরু বললেন, চলি হেম।

 হ্যাঁ যাও। ও খেয়ে যাও। নইলে শ্ৰীমন্ত কী মনে করবে?

কিছু মনে করবে না। যাই।

একতলায় নেমে হেমপ্রভা দরজা খুলে দিলেন।

হীরু বললেন, আসি। হেম।

বলে, দু-হাতের পাতা দিয়ে হেমপ্রভার দুটি গাল ছুঁলেন।

মাথা নাড়লেন হেম। মাথা নেড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে হঠাৎ-ই তারিণীবাবুর কথা ক-টি মনে পড়ে গেল হেমপ্রভার। এবং মনে পড়ে ভয় হল খুব। আকাশ কালো করে তো ছিলই।

খুব জোরে বৃষ্টি নামল। পায়রারা ছটফট করে উঠল আলসেতে। ডানা ঝটপট করতে লাগল। কে জানে, হীরু বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছোতে পারলেন কি না। ট্যাক্সি পেলেন কি না? একটি মারুতি বুক করেছেন হীরু। পাবেন শিগগিরই।

 ভেবে আর কী করবেন হেমপ্রভা? কিছু বৃষ্টি নিজেকে ভেজায়, কিছু বৃষ্টি অপরকে। আরও কিছু বৃষ্টি আছে যা, সকলকেই ভেজায়। মাথার ওপরের আশ্রয় ছেড়ে যাওয়া মানুষকে সেইসব বৃষ্টি থেকে বাঁচানো যায় না। কে জানে তারিণীবাবুও হয়তো ভিজে গেলেন! সকলের জন্যেই এক ধরনের চাপা কষ্ট বোধ করেন হেম বুকের মধ্যে। নিজের জন্যেও করেন না যে, তাও নয়।

আরও জোরে বৃষ্টি নেমে এল অন্ধকার করে চারদিক। মন খারাপ লাগে বড়ো একা মানুষের এমন এমন দুপুরে।

.

০২.

একটা গান গাও-না পরি?

পুষি থাকতে আমি কেন?

পুষির গান তো শুনতেই পাবে জিষ্ণু সারাজীবন। পুষি বলল।

 আমার গান কেন শুনতে পাবে না?

বাঃ রে। তুমি কি চিরদিনই কুমারী থাকবে? এ-বাড়িতেই থাকবে?

যদি থাকি? তোমার আপত্তি?

এমন করে কথা বলছ কেন তুমি পরি?

 জিষ্ণু এবার বলল মাঝে পড়ে, আহা বলুকই না। আমরা-আমরা কথা বলছি, তুমিই বা এরমধ্যে কথা বলতে এলে কেন?

ঠিক আছে।

তোমার গলাটা কিন্তু সত্যিই ভালো। একটু চর্চা করলে…

পুষি বলল, আমার সবই ভালো। কিছুরই চর্চা যখন করলাম না, তখন আর শুধু গানেরই বা কেন?

তোমরা কি ঝগড়াই করবে, নাকি গান শুনতে পাব একটা?

 আমি গাইব না। পুষি গাইলে গাক। শুনব আমি। আমার ইচ্ছে করছে না আজ।

তাহলে পুষিই গাও। গাও পুষি। জিষ্ণু বলল।

কী গান? হৃদয়নন্দন বনে নিভৃত এ নিকেতনে গাইব?

আবার সেই রবীন্দ্রসংগীত! তোমরা পারোও বাবা। কথাগুলো, সুরগুলো তো সব পচে গেল, উনিশ-শো নব্বই পেরুলে বাঁচা যায়।

পরি বলল।

কেন?

তখন আমি আমার সুরে আমার তালে আমার রাগেই রবীন্দ্রসংগীত গাইব। এখন যেসব রবীন্দ্রসংগীতের স্কুল আর রবীন্দ্রসংগীতের সেলফ-অ্যাপয়েন্টেড সমালোচকরা, স্বরলিপির অথরিটিরা, নিজেদের খেয়াল-খুশি ও নিজ নিজ স্বার্থ ও উদ্দেশ্য সাধনের কারণে সকলের মাথাতেই চাঁটি মেরে বেড়াচ্ছেন তা আর করতে পারবেন না। দে উইল বি কাট টু দেয়ার ওওন সাইজেস। যাঁরাই এতদিন যা-নয়-তাই করে গেছেন মনের সুখে, তাঁদের ভাতে হাত পড়বে। সুখে কাঁটা।

আহা! কারোরই ভাতে হাত-পড়ার চিন্তা না করাই ভালো।

জিষ্ণু বলল, তা বললে হবে কেন? তেমন তেমন সমঝদার শ্রোতা সমালোচকদের কাছে রবীন্দ্রসংগীতের অনাদর কখনোই হবে না। যে যাই বলুক রবীন্দ্রসংগীত এখন জনগণের সংগীত হয়ে উঠেছে বটে কিন্তু তা আসলে কোনোদিনও ছিল না।

তবে ভুসিমালেরা সব ফুটে যাবে। তুমি যাই এল জিষ্ণু, রবীন্দ্রসংগীত বাংলার অনেক ক্ষতি করেছে।

পুষি বলল, ও বাবা, তুমি তো সেইসব সাহিত্যিকদের মতোই বলছ দেখছি।

জিষ্ণু হেসে বলল, কী বলেছিলেন তাঁরা?

বলেছিলেন না যে, বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষার ক্ষতি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ না লিখতে পারতেন ছোটো গল্প না উপন্যাস। শরৎ চাটুজ্যে লেখকই নন।

খারাপটা কী বলেছিলেন? আমারও তো তাই মত। তবে আমি বলব, বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বড়ো ঔপন্যাসিক আর জীবনানন্দও রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বড়ো কবি ছিলেন।

পুষি আহত গলায় বলল, বলছ রবীন্দ্রনাথ তা হলে কিছুমাত্রই ছিলেন না?

পস্টারিটি তাই প্রমাণ করবে। পরি বলল। থাকলে হয়তো গানটুকুই থাকবে।

 জিষ্ণু বিব্রত হয়ে বলল, প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক। গানটা কি হবে পুষি?

আজ গান থাক। রবীন্দ্রসংগীত তো নয়ই! তার চেয়ে মাইকেল জ্যাকসন বা হুইটলি হুস্টনের কোনো গান শোনাও পরি।

পরি, পুষির কথার উত্তর দিল না। ঠোঁট উলটে অনিচ্ছা প্রকাশ করল।

তার পর দীর্ঘ নীরবতা। তিনজন তিন দিকে চেয়ে রইল।

পরির দিকে চেয়ে পুষি বলল, কম্পিউটার ব্যাপারটা কী পরি? অনেকদিন ধরে অনেককেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু লজ্জায় পারিনি।

লজ্জা কেন? পরি শুধোল।

বাঙাল ভাববে।

 বাঙালদের বাঙালত্ব সম্বন্ধে লজ্জা থাকা উচিত নয়। আমরা যে কলকাতার লোক তাতে গর্বিতই বোধ করি আমরা। লজ্জা আসে ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স থেকে।

আমি প্রচুর গর্বিত বাঙালদের চিনি। এবং তাদের গর্ব করার কারণও আছে।

 সকলের যে লজ্জা থাকে না।

পরি হাওয়ায় ছুঁড়ে দিল কথাটা মুখ কালো করে। কথাটা ও নিছক রসিকতার জন্যেই বলেছিল।

জিষ্ণু বলল, আজ তোমার কী হয়েছে পরি?

কই? কিছু না তো!

অপমানটা গায়ে না মেখে পুষি বলল, আমার কম্পিউটারের প্রশ্নটার কিন্তু এখনও উত্তর দিলে না।

পরি বলল, কমপিউটার হচ্ছে তোমাদের রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর রাজার রাজ্যের যন্ত্র। যেখানে মানুষের নাম থাকে না, ফুলের নাম থাকে না, পাখির নাম মুছে দেওয়া হয়। সব কিছুকেই সংখ্যায় এনে ফেলা হয় যে-রাজ্যে। সংখ্যাতেই ডিটারমিনড হয় সব কিছুর আইডেনটিটি। কোডিফায়েড হয়ে যায় সবাই। যেই ডাটা ফিড করে বোতাম টিপে দেবে কম্পিউটারে, চিচিংফাঁক-এরই মতোই, যে যাই জানতে চাইছে তার উত্তর, দরজাখোলা সংখ্যায় এসে দাঁড়াবে স্ক্রিনের ওপরে। তার পরে তাকে ডি-কোডিফাই করে নাও। অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট। ইয়েস।

বলেই, পরি কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিল বাঁ-হাতের এক ঝটকাতে।

আর ডাটা ফিড করবার সময়েই যদি গন্ডগোল হয়ে যায়?

বুদ্ধিদীপ্ত চিকন চোখ তুলে পুষি শুধোল।

তবে তো গেলই সব। গার্বেজ ফিড করলে গার্বেজই বেরোবে।

শুনেছি, কম্পিউটারের জন্যে এয়ার-কণ্ডিশানড ঘর লাগে?

হ্যাঁ। ধুলোবালি একেবারেই সহ্য করতে পারে না কম্পিউটার। আমারই মতো। অ্যালার্জি।

আর যে-মানুষ তাকে অপারেট করে সে যদি ধূলিমলিন হয়?

তার বাইরেটার কথা বলছ?

দিঘল গভীর চোখ তুলে পরি শুধোল পুষির চোখে চোখ রেখে।

না। মানে তা নয়। আজকালকার মানুষেরা তো, বাইরে অন্তত, সবসময়েই ফিটফাট।

 ও। মনের ময়লার কথা বলছ?

 বলেই, রহস্যজনকভাবে হাসল পরি।

হ্যাঁ। তাই।

হয়তো তাতেও আপত্তি থাকার কথা ছিল কম্পিউটারের এবং আমার তো বটেই। কিন্তু ফরচুনেটলি মন তো দেখা যায় না। পরি বলল।

ভাগ্যিস যায় না।

যে-যুগ এসেছে তাতে বাইরেটাই সব। অন্তঃসারশূন্য যুগ এ। পুষি বলল হেসে।

 কিন্তু পরি, এবং জিষ্ণু বুঝল সে-হাসিটা হাসি নয়।

আসি।

বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল পুষি, আজ!

চলো, তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।

 বলেই, জিষ্ণু ডাকল, শ্ৰীমন্তদা, নীচের ঘরটা খোলো তো, স্কুটারটা বের করি।

না থাক। আমার বড়ো ভয় করে স্কুটারে চড়তে। এখন যা-ভিড় থাকবে পথে। তা ছাড়া খোঁড়াখুঁড়ি আছে সার্কুলার রোডে।

আবার কবে আসবে পুষি?

পরি শুধোল হেসে। এবারে আন্তরিকভাবেই।

তুমি যেদিন বলবে।

হেসে বলল পুষিও। এবারে বাসি হাসি নয়। টাটকা হাসি। কাকিমাকে বলে আসি।

পুষি আবার বলল।

মা নেই তো! তোমাকে বলেই তো বেরোলেন, ভুলে গেলে?

ও হ্যাঁ।

ওরা সকলে মিলে নীচে নেমে এল বাইরের দরজা অবধি। ওরা নেমে গেলে মোক্ষদা ঘরের বারান্দায় গেল কফির পেয়ালার ট্রে-টা নিয়ে আসতে।

জিষ্ণু বলল, চলো পুষি তোমাকে ট্যাক্সি ধরিয়ে দিই।

আসলে কিছু কথাও ছিল জিষ্ণুর পুষির সঙ্গে। পরির ব্যবহারের জন্যে ক্ষমাও চাওয়ার ছিল। জিষ্ণু বুঝতে পারে না, কেন তার খুড়তুতো বোন পরি বেজির মতো আক্রমণ করে পুষিকে দেখতে পেলেই। আর পুষি যেন লাজুক চিকন কোনো সাপ। লড়াই না করে মাথা নীচু করে পালিয়ে যায় বার বার।

জিষ্ণু ভাবছিল, পুষির সঙ্গে ওর বিয়ের পর এ-বাড়িতে আর থাকা যাবে না। পরি হয়তো বিষ খাইয়েই মেরে রাখবে কোনোদিন পুষিকে। পরি যদিও জিষ্ণুর আপন বোন নয়, খুড়তুতো বোন, তবু আপনের চেয়েও বেশি। পরিকে বুঝতে পারে না জিষ্ণু। ভাবী ননদের পক্ষে ভাবী বউদিকে যতখানি ঈর্ষা বা হিংসে করা সম্ভব তার সব সম্ভাব্য মাত্রাই ছাড়িয়ে যাচ্ছে পরি। পুষিকে ও একমুহূর্তের জন্যও সইতে পারে না। গত ছ-মাস, যেদিন থেকে পুষির সঙ্গে ওর আলাপ এবং বাড়িতে নিয়ে আসা, সেদিন থেকেই ও এটা লক্ষ করছে। অথচ পুষি কোনো দিক দিয়েই পরির যোগ্য নয়। তবু কেন যে পরির এত রাগ পুষির ওপর কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না জিষ্ণু।

তুমি ফিরে যাও। তুমি তো রোজই ট্যাক্সি ধরাও পুষিকে। আমিই ধরিয়ে দিচ্ছি আজ। পথে এক জায়গায় নেমেও যাব। কাজ আছে আমার একটু।

পরি বলল।

একটু অবাক হল জিষ্ণু। বলল, ফিরবে কখন পরি? কাকিমার তো নেমন্তন্ন। খাব তো শুধু আমি আর তুমিই।

আমার দেরি হতেও পারে। তুমি সময়মতোই খেয়ে নিয়ো। শ্ৰীমন্তদা আর মোক্ষদাদিকে বসিয়ে রেখো না।

না। আমি অপেক্ষা করব। বেশি দেরি কোরো না তুমি।

 পরক্ষণেই বলল, যাচ্ছটা কোথায়? রাত প্রায় ন-টা তো বাজে।

 জিষ্ণুর গলাতে একাধিক কারণে বিরক্তি ছিল একটু।

পরি বলল, জাহান্নম।

তার পরই বলল, বলতে বাধ্য নই। আমরা স্বাধীন জেনানা। কী বলো পুষি?

বলেই, হাসল পরি। পুষিও হাসল লাজুক লাজুক মুখে।

মাথাময় রেশমি কালো চুল ঝাঁকিয়ে, পুষির হাত ধরে ঢেউ তুলে পথে নেমেই ঘাড় ঘুরিয়ে পরি বলল, কোথায় যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি? কখন ফিরব? ফিরব কি না আদৌ? এসব প্রশ্ন তুমি আমাকে কোনোদিনও কোরো না। আমি কি তোমার বউ? বউ যদি হতাম তাহলেও এসব প্রশ্ন করলে উত্তর দিতাম না। আমি অন্যরকম। আমার নাম পরি, আমি আশমানের পরি। তুমি কি জানো না তা? এতদিনেও?

পুষি হেসে উঠল পরির কথাতে এবং কথা বলার ভঙ্গিতেও।

তুমি কি জানো না তা? এতদিনেও? এই প্রশ্নটা পুষিকে ভাবিয়ে তুলল। এমন অদ্ভুত ভাই-বোনের সম্পর্ক কখনো দেখেনি ও।

জিষ্ণু বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকল।

পুষি যাওয়ার সময়ে হাত তুলল জিষ্ণুর দিকে। তার উত্তরে হাত তুলতেও ভুলে গেল জিষ্ণু।

দরজা বন্ধ করে দোতলাতে উঠে নিজের ঘরের বারান্দায় এসে বসল ও আলো নিভিয়ে।

এলমেলো হাওয়া দিচ্ছে একটা। গানুবাবুদের বাড়ির লন-এর বিভিন্ন গাছগাছালি থেকে মিশ্ৰফুলের গন্ধ উড়ে আসছে। গন্ধটা ঝাঁকাঝাঁকি করছে বারান্দায়। হাওয়ার সঙ্গে বারান্দার এ প্রান্ত এবং ও-প্রান্তের সীমা পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েই ধাক্কা খেয়ে ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে যাচ্ছে। নিঃশব্দে। হরজাই গন্ধ, কোনো অদৃশ্য তরলিমার মতো চুঁইয়ে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে বারান্দাময়।

পরি জিষ্ণুর চেয়ে তিন বছরের ছোটো। দুজনের দুজনকে তুই-তোকারি করাই উচিত ছিল ছেলেবেলা থেকেই। জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো পিঠোপিঠি ভাইবোন। কিন্তু শিশুকাল থেকেই পরির ব্যক্তিত্বটা এমনই যে, ওকে তুই কখনোই বলা যায়নি। জিষ্ণু তো দূরের কথা, কাকিমা, মানে পরির গর্ভধারিণী মা, অথবা বাড়ির বহুপুরোনো কাজের লোকেরাও কেউই শিশুকালেও ওকে তুই বলে ডাকতে সাহস পায়নি। জিষ্ণু তো নয়ই!

অথচ এই পরিই সেদিন জিষ্ণুকে শুনিয়ে কাকে যেন বলছিল যে, অন্য সেক্স-এর কাউকে তুমি সম্বোধন করতে নেই কখনো। তাতে সম্পর্কটা প্রেমের হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে।

আপনি অথবা তুই বলাই ভালো।

যাকে বলেছিল, সে শুনে বলেছিল, প্রেমের হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নয় কেন? আশঙ্কা কেন?

কিছু প্রেম হয়তো থাকে, যা আনন্দের নয়, দুঃখের। সুন্দর সম্ভাবনার নয় আশঙ্কারই।

 হেসে বলেছিল পরি।

বড়ো স্বাধীনচেতা, অদ্ভুত স্বভাবের মেয়ে এই পরি। পড়াশুনোতে চিরদিনই খুবই ভালো ছিল, জিষ্ণুর চেয়েও। ম্যাথমেটিকস-এ এম এস সি করে ছ-মাসের জন্যে স্টেটস-এ গেছিল স্কলারশিপ নিয়ে। ফাস্ট-ক্লাস-ফাস্ট হয়েছিল এম এস সি-তে। ফিরে এসে একটি খুব বড়ো মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে কম্পিউটার ডিভিশনের হেড হয়ে চাকরি করছে। অবশ্য ক-টি মালটিন্যাশনাল কোম্পানিই আর এখন বিদেশি আছে? শুধু ফেরা আইনের আওতাতে পড়ছে বলেই নয়, বেশিই কিনে নিয়েছে ভারতীয় ব্যাবসায়ী সম্প্রদায়।

দেশের সব জায়গায়ই ব্রাঞ্চ আছে পরিদের কোম্পানির। ওকে প্রায়ই ট্যুরেও যেতে হয় দিল্লি, বম্বে, ম্যাড্রাস, ব্যাঙ্গালোর। জিষ্ণুর চেয়ে অনেক বেশি মাইনেও পায় পরি। পরির চরিত্রে এমন কিছু আছে যে, মাঝে মাঝেই জিষ্ণু এবং অন্য সকলেরই মনে হয় যে, ও পুরুষ, মেয়ে নয়। অথচ যখন ও, মেয়ে হতে চায় তখন ও, সব মেয়ের চেয়েই বেশি মেয়ে।

যেদিন পুষিকে প্রথম দিন নিয়ে আসে জিষ্ণু এ-বাড়িতে সেদিন থেকেই এক আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ করছে ও, পরির মধ্যে। ও যেন কেমন হিংস্র, অসভ্য প্রকৃতির হয়ে উঠছে। পুষির সঙ্গে প্রথম দিন থেকেই অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও অভদ্র ব্যবহার করছে।

লজ্জিত হয়ে একদিন জিষ্ণু বলেছিল পুষিকে এ-বাড়িতে তুমি আর এসো না। আমিও তোমাকে কোনো দিনও সঙ্গে নিয়ে আসব না।

পুষি হেসে উঠেছিল জোরে। বলেছিল, বলো কী? তোমাকে বিয়েই যদি করব বলে মনস্থ করেছি তবে তোমার একমাত্র কাজিন বলল, বোন বলল, আমার একমাত্র ননদিনি বলো, তার সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পারলে চলবে কেন? আই বিলিভ ইন উইনিং ওভার মাই অ্যাডভার্সারিজ। নট টু ফাইট উইথ দেম। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারি না। অনেক ভেবেছি জিষ্ণু এ-নিয়ে, রাতের পর রাত। পরির আমার প্রতি যে-বিরূপতা সেটা কিন্তু তোমারই কারণে। তোমাকে ভালোবাসে বলেই ও, আমাকে সহ্য করতে পারে না। ভাই বোনের ভালোবাসা নয়। এ এক বিশেষ ভালোবাসা। একজন মেয়ের চোখে অন্য মেয়ে ধরা ঠিকই পড়ে।

বা:

 লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে জিষ্ণু বলেছিল, একসঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছি একই বাড়িতে। কাকিমাও কখনো কোনো তফাত করেননি আমাদের দুজনের মধ্যে। আমার যে মা-বাবা নেই তা একমুহূর্তের জন্যেও বুঝতে দেননি কাকিমা। তাই পিঠোপিঠি বলেই শুধু নয়, একমাত্র সঙ্গী, আমার একমাত্র কাজিন, একমাত্র সঙ্গী ওই পরি। তা ছাড়া জানো, আমাদের ছেলেবেলায় কাকিমার খুব কড়া শাসন ছিল। আমাদের কারোরই কোনো বন্ধু-বান্ধব বাড়িতে আসাটা মানাও ছিল। আমরাও কোথাওই যেতাম না। ও-ই আমার সব ছিল আর আমিও ওর তাই। আমাকে ভালো তো বাসবেই। আমরা অন্য দশজনের মতো করে বড়ো হয়ে উঠিনি। তাই হয়তো কিছুটা অস্বাভাবিক লাগে তোমার চোখে।

পুষি অনেকক্ষণ চুপ করেছিল। তার পর বলেছিল, তা তো ঠিকই। কিন্তু তুমি কিছু মনে কোরো না, আমার প্রতি পরির ঈর্ষাটা ঠিক যে-ধরনের তা কিন্তু ভাই-বোনের ভালোবাসাজনিত নয়। বুঝেছ তুমি? কী বলতে চাইছি।

না, বুঝিনি।

রেগে গিয়ে বলেছিল জিষ্ণু, তোমার কথা সত্যিই বুঝিনি। তুমি বলতে চাও কী?

 ভুল বুঝো না। তোমাকে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। তোমার সম্বন্ধে আমার চিন্তা করা ও চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। তোমার দিক দিয়ে যে, কিছুমাত্র দুর্বলতা নেই পরির প্রতি, মানে ভাইয়ের যতটুকু ও যেরকম দুর্বলতা বোনের প্রতি থাকার কথা সেটুকু ছাড়া নেই যে, তা আমি জানি। কিন্তু পরির দিকের ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ নই।

তুমি কি পাগল হলে পুষি?

দেখো জিষ্ণু, আমরা যে-যুগে, যে-পলিউশনের মধ্যে, যে-টেনশানে এবং যে-শহরে বাস করছি তাতে আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ তো পাগলই। পুরো পাগল না হলেও, আংশিক পাগল। এক একজনের পাগলামির প্রকাশ এক একরকম। সুস্থ বাকি আর কেউই নেই। থাকা সম্ভব নয় জিষ্ণু, এত বক্রতা, ভান, ভন্ডামি এবং মিথ্যাচারের মধ্যে। বড়ো ময়লা, আবর্জনা, ধোঁওয়া, ধুলো চারদিকে। যেখানে নিঃশ্বাস নেওয়াই কষ্টের সেখানে মানুষ সুস্থ থাকেই বা কী করে! কতরকম বিকৃতিই দেখি চারপাশে যে, সুস্থতাকেই এখন বিকৃতি বলে মনে হয়।

বারান্দাতে একা বসে বসে নানাকথা ভাবতে ভাবতে সময় চলে যাচ্ছিল।

 গানুবাবুদের লনের মার্কারি ভেপার ল্যাম্পটা দুলছিল হাওয়ায়। সমস্ত বাগানটাই যেন দুলছিল।

পরি ওর খুড়তুতো বোন, ওকে ভালোবাসে?

হা :! পাগলের কথা! নিজের মনেই হেসে উঠল জিষ্ণু। পরির অফিসেই তো কত হ্যাণ্ডসাম, ওয়েল সেটলড়, ভালো পরিবারের এক্সট্রিমলি ওয়েল-অফফ ছেলে আছে। তারা মাঝে মাঝে ফোন করে বাড়িতেও পরিকে। তাদের গলার স্বর শুনেই বোঝে জিষ্ণু যে, পরির প্রেমে তারা ডগমগ। বাড়িতে আসে না যদিও কেউই। পরি বলে, আমরা বড়ো হয়েছি যদিও বেশ আরামেই কিন্তু এই গলিতে, এই বাড়িতে কোনো ডিসেন্ট রেসপেক্টবল বাইরের লোককে আনা যায় না।

জিষ্ণু শিগগিরই ফ্ল্যাট বুক করবে একটা। ওদের কোম্পানি থেকেই অফিসারেরা কো অপারেটিভ করে করছে। পরিকে তো কোম্পানি থেকেই সানি পার্ক-এ ফ্ল্যাট অ্যালট করেছিল। নেয়নি ও। তবে যেকোনো দিন চাইলেই ও, সাউথের পশ এলাকাতে মনের মতো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে শিফট করতে পারে। গাড়ি অবশ্য পেয়েছে তবে বাড়িতে গ্যারেজ নেই, কাছেপিঠেও পায়নি ভাড়াতে তাই গাড়ি আট ঘণ্টা ডিউটি করে চলে যায়।

একদিন জিষ্ণুকে বলেছিল পরি, কবেই চলে যেতাম। যাইনি শুধু তোমার জন্যে।

 আর কাকিমা?

ওঃ আই হেইট দ্যাট লেডি।

 জিষ্ণু কথা বাড়ায়নি। কেন জানে না কাকিমাকে পরি মায়ের সম্মান ও মর্যাদা আদৌ দেয় না। বছর দুয়েক হল ব্যাপারটা লক্ষ করছে ও। জিষ্ণু যতখানি শ্রদ্ধাভক্তি করে তাঁকে মায়েরই মতো পরি তা আদৌ করে না। কাকিমাও যেন পরিকে ভয় পান। এ-বাড়িতে পরিই শেষকথা। পরিকে কিছু বলতে হলে কাকিমা জিষ্ণুকে দিয়েই বলান। সাম্প্রতিক অতীত থেকে।

কতক্ষণ কেটে গেছে বারান্দায় বসে হুঁশ ছিল না জিষ্ণুর। এমন সময়ে হালকা পায়ে পরি এল। এসে, বারান্দার দোলনাটাতে বসল দু-পা তুলে আসন করে। কোলের কাছে একটা তাকিয়া নিয়ে। পুরোপাড়াটা নির্জন হয়ে গেছে। উঠে গিয়ে ঘড়ি দেখার আগেই গানুবাবুদের বাড়ির পেটাঘড়িতে এগারোটা বাজল।

কোথায় গেছিলে?

বলতে গিয়েও থেমে গেল জিষ্ণু।

 বলল, খাবে তো এখন?

বলে এসেছি মোক্ষদাদিকে।

পরি বলল।

তার পরই বলল, চারটে খেয়ে এলাম।

 কী?

জিন।

তাই? সোজা হয়ে বসল জিষ্ণু। পরি বলল, নেশা হয়ে গেছে আমার। অফিসের পর বাড়ি ফিরে চানটান করে তিন চারটে খাই রোজ।

বাড়িতেই?

হ্যাঁ। আকাশ থেকে পড়ছ কেন? আমার অফিসের, আমার স্ট্যাটাসের পুরুষরা তো বাড়িতে বার মেইনটেইন করে। বার-এ বেয়ারা পর্যন্ত উর্দি পরে টুপি পরে মজুত থাকে আটটা থেকে। কোম্পানির পয়সাতে। আর আমি কি মেয়ে বলে…

না। তা নয়। তবে আমাকেও নিয়ে গেলে না কেন?

দুর। পাবলিক বার-এ একা একা বসে মদ খেতে দারুণ লাগে। তুমি মেয়ে হলে বুঝতে পারতে মজাটা কেমন? অনেক কিছুই মিস করলে এ-জীবনে! এ-দেশে কটা জন্তু আর জঙ্গলে বা চিড়িয়াখানায় আছে? সবাই ভিড় করেছে এসে শহরগুলোতে। কত হতকুচ্ছিত ক্যাডাভেরাস মানুষেরা যে কাছে আসতে চায়, আলাপ করতে চায়। সুন্দরী হওয়ারও দরকার নেই। শুধুমাত্র মেয়ে হলেই চলবে। সবচেয়ে এনজয় করি আমি তাদের চোখের দৃষ্টি। জিন এ আর কতটুকু নেশা হয়। জিন খাই আমি সিপ করে করে আর ওরা খায় আমাকে চোখ দিয়ে চেটে চেটে। তুমি আমাকে পারভার্টেড বলতে পারো। হয়তো আমি তাই। কিন্তু কে নয়? চারদিকে চেয়ে দেখো তো, নয় কে? মিথ্যুক ভন্ড বিকৃত নয় কে আজ?

কাল থেকে বাড়িতেই খেয়ে পরি। আমি এনে রেখে দেব। বার-এ যেয়ো না।

তাহলে তোমার ঘরে এসে খাব। আমার একা খেতে ভালো লাগে না।

আমি রাম খাই।

জিষ্ণু বলল।

তুমি তাই খেয়ো।

 কিন্তু কাকিমা? মোক্ষদাদি? শ্ৰীমন্তদা?

 লোকভয়? হি:। মাই ফুট। জিষ্ণু, আমাদের একটাই জীবন এবং তারও প্রায় অর্ধেক শেষ করে এনেছি। ভুল করে ফিফটি পার্সেন্ট লস্ট হয়েছে।

তার প্রায়শ্চিত্ত কি রোজ মদ খেয়েই করতে হবে?

ছিঃ। তা নয়। এখনই, যা যখন খুশি হবে তাই করতে হবে। পরে করার সময় আর নাও পাওয়া যেতে পারে। কে কী ভাববে বা বলবে তা নিয়ে ভেবে নষ্ট করার মতো সময় আর নেই। সত্যিই নষ্ট করার সময় নেই। যা করতে চাই, তাই করব এখন।

কিন্তু কাকিমা?

তুমি চুপ করো জিষ্ণু।

আমার না হয় কাকিমা, তোমার যে, মা পরি! আমাদের বুকে করে মানুষ করেছেন। কাকার কর্তব্যও উনি একাই করেছেন। ভুলে যেয়ো না কখনো।

স্টপ ইট জিষ্ণু। মিশনারি ফাদারদের মতো জ্ঞান দিয়ো না। আই অ্যাম সিক অফ ইট। আর শুনতে ভালো লাগে না।

কাকিমা যদি কখনো ঘরে ঢুকে এসে কিছু বলেন?

আসবেন না, বলবেন না। মা আমাকে ভালো করেই চেনেন। শি উড নট ডেয়ার টু ডু ইট।

 যদি আসেন? তুমি এত স্যাঙ্গুইন হচ্ছ কী করে?

আই উইল ফেস হার। তবে তুমি জেনে রাখো যে, মা আসবেন না। আই নো ইট ফর সার্টেন।

 কথা বোলো না কিন্তু, আরও খেতে ইচ্ছে করছে আমার। এই আমার দোষ। খেলে আর থামতে পারি না।

খাওয়াতে বাহাদুরি নেই। সমাজের সব স্তরের মানুষেরাই, ভালো-মন্দ, চোর-বদমাশ, স্মাগলার-খুনি সব লোকই মদ খায়। থামতে জানাটাই শিক্ষা।

আমি থামতে চাই না। জানি না। পাজি লোকেরা গুনে গুনে মদ খায়। তারা মিন। তোমার

অকেশানাল পার্টি-টার্টিতে অনেকেই খায়। আমিও খাই। তুমিও নিশ্চয়ই খেতে। কিন্তু এমন নেশা করলে কবে থেকে যে, সন্ধেবেলা না হলেই চলে না?

নেশা?

 হ্যাঁ।

 পনেরো-ই আগাস্ট, উনিশ-শো পঁচাশি।

 শ্ৰীমন্তদা এসে বলল, দাদাবাবু, দিদিমণি, মোক্ষদা খাবার সাজিয়ে দিয়েছে টেবিলে।

 জিষ্ণু বলল, চলো। আমরা যাচ্ছি। চলো, পরি।

চলো।

খেতে খেতে জিষ্ণু বার বার মনে করার চেষ্টা করছিল পনেরোই অগাস্ট, উনিশ-শো পঁচাশি। ওই তারিখটি খুব চেনা, চেনা লাগছে। অথচ মনে করতে পারছে না চেনা কেন?

কী ভাবছ?

 পরি বলল, খাওয়া থামিয়ে।

 ভালো করে পরির মুখে চেয়ে দেখল জিষ্ণু। পরি অত্যন্তই সুন্দরী।

দাদারা, ভাইরা অন্য চোখে বোনেদের দিদিদের মুখে চায়। এই চোখ কি অন্য চোখ? এত বছর কেন লক্ষ করেনি পরিকে এমন করে কে জানে! অথচ পরির সঙ্গেই বড়ো হয়েছে। কত খেলা, স্মৃতি, প্রথম কৈশোরের গা-শিরশির করা নানা অনুভূতি। মনে পড়ে।

কী ভাবছ জিষ্ণু?

বলল, পরি।

না:। কিছু না।

ভাবা খুব ভালো। ভাবনা শুধু মানুষেরই প্রেরোগেটিভ। এমন করে ভাবতে তো আর কোনো প্রাণীই পারে না।

জানি। জিষ্ণু বলল।

খেয়ে উঠে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল জিষ্ণুর যে, এইট্টি ফাইভের পনেরোই অগাস্ট সকালে চানচানির বাড়িতে ওদের প্রতিবেশী পুষির সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল জিষ্ণুর।

হঠাৎ হেসে উঠল জিষ্ণু।

হাসলে যে?

 কুইজ-এর আনসার পেলাম।

কী?

মনে পড়ে গেছে। এইট্টি ফাইভের ফিফটিনথ অগাস্ট পুষির সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল আমার।

তাই? স্ট্রেইঞ্জ! তার সঙ্গে আমার ড্রিঙ্ক করার কী সম্পর্ক? পরি বলল। ক্যাজুয়ালি।

না। সম্পর্ক থাকবে কেন?

তার পর তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জিষ্ণু বলল, হোয়াট আ কো-ইনসিডেন্স।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *