নবম অধ্যায় – স্থাপত্য
বাংলার স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুর্শিদকুলি যখন ঢাকা থেকে মখসুদাবাদে তাঁর দেওয়ানি কার্যালয় স্থানান্তরিত করেন ও মখসুদাবাদের নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ, তখনও সেটা ছিল প্রায় অজ গ্রাম। কিন্তু বিভিন্ন শাসন দপ্তরের প্রয়োজন অনুযায়ী ঘরবাড়ি, অফিস কাছারি নির্মাণ শুরু হয়ে যায় প্রথম থেকেই। তারপর মুর্শিদাবাদ যখন বাংলার রাজধানী হল তখন এসব নির্মাণ কার্য আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, মুর্শিদাবাদের সব নবাবই নানারকমের ইমারত, প্রাসাদ, মসজিদ তৈরি করতে ভালবাসতেন এবং এটা তাদের প্রায় ‘হবি’তে পরিণত হয়েছিল। তাই মুর্শিদকুলি থেকে আরম্ভ করে সুজাউদ্দিন, আলিবর্দি, এমন কী সিরাজদ্দৌল্লাকে নানারকমের স্থাপত্যকর্ম নির্মাণ করতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, এই ধারা মীরজাফর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল যার প্রমাণ মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগমের তৈরি স্থাপত্যগুলি। পরের নবাবদের মধ্যেও কেউ কেউ এটা বজায় রেখেছিলেন। এ সব নির্মাণ কার্যে নবাবদের মানসিকতাই শুধু সাহায্য করেনি, তাঁদের যে অফুরন্ত ধনসম্পদ ছিল তা এসব কাজের খুবই সহায়ক হয়েছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবরা শুধু নতুন নতুন ভবন ও উদ্যান তৈরি করে মুর্শিদাবাদকে সুন্দর করার চেষ্টা করেননি। নিজামতের কর্মচারী, শ্রেষ্ঠী ও অমাত্যবর্গও প্রাসাদ, ভবন, বাগানবাড়ি, মন্দির, মসজিদ, প্রভৃতি নির্মাণ করে মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্যবৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তাই এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের মতে মুর্শিদাবাদ কখনও কখনও ভারতের রাজধানী দিল্লিকেও হার মানাত।১ কিন্তু পরিতাপের বিষয়, নবাবি আমলের স্থাপত্যগুলি আজ বেশিরভাগই প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
মুঘল যুগে বাদশাহি স্থাপত্যের শিল্পশৈলীর সর্বোৎকৃষ্ট নির্দশন দেখা যায় ঢাকায়। কিন্তু এই শিল্পরীতি যানবাহন ও যাতায়াতের অসুবিধের জন্য, এবং স্থাপত্যকর্মীর অভাবে বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করেনি। তাই বাংলার বেশির ভাগ অঞ্চলেই প্রাক-মুঘল যুগের স্থাপত্যশৈলীই অনুসৃত হয়। অবশ্য পরবর্তীকালে কিছু কিছু অঞ্চলে, যেখানে মুঘল শাসন বেশ কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানকার উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মুঘল শৈলী অনুসরণ করে প্রাসাদ ও ভবন নির্মাণ করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে মুঘল শৈলীর সঙ্গে স্থানীয় শৈলী ও শিল্পরীতির সংমিশ্রণও হয়েছে। কিছু কিছু স্থাপত্যে প্রাক-মুঘল যুগের ইটের দেওয়ালে খচিত শৈলীর নিদর্শনের পাশাপাশি মুঘল শৈলীর নিদর্শন— যেমন গম্বুজও, দেখা যায়। মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যশিল্পে এই সংমিশ্রণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এখানে আমরা নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের বিশিষ্ট স্থাপত্যগুলির পর্যালোচনা করব।
কাটরা মসজিদ
মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যকর্মের অন্যতম নিদর্শন কাটরা মসজিদ। নবাব মুর্শিদকুলি খান ১৭২৩ সালে এটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং শরীর ভেঙে গেছে বুঝতে পেরে তিনি নিজের সমাধি নির্মাণ করে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তাতে একটি মসজিদ ও কাটরা বা বাজারও থাকবে। এই কাটরা বা বাজার থেকেই ‘কাটরা মসজিদ’ নাম। সমাধি, মসজিদ ও কাটরা স্থাপনের জন্য শহরের পূর্বদিকে খাস তালুকের কাছের একটি স্থান বেছে নেওয়া হয়। মোরাদ ফরাস নামে একজন সাধারণ অথচ বিশ্বস্ত কর্মচারী এই কাজের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হন। প্রচলিত ভাষ্য অনুযায়ী মোরাদ কাছাকাছি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সে সব উপকরণ দিয়ে সমাধি ভবন তৈরি করেন। সলিমুল্লার তারিখ-ই-বংগালা গ্রন্থে হিন্দু মন্দির ভাঙার কথা থাকলেও গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস-সলাতিনে কিন্তু এটা নেই। মন্দির ভেঙে সেসব জিনিস দিয়ে কাটরা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি বিখ্যাত রাধামাধবের হিন্দু মন্দির ও অন্য কয়েকটি মন্দিরের খরচপত্র ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। এ ছাড়া কাটরা মসজিদের নির্মাণে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলি সব একই রকমের। বিভিন্ন মন্দির ভেঙে এসব উপকরণ সংগ্রহ করা হলে তাতে এরকম মিল বা সঙ্গতি থাকত না।২
কাটরা মসজিদ একটি চতুর্ভুজাকৃতি উঁচু প্রাঙ্গণে অবস্থিত। মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৪০ ফুট, প্রস্থ ২৫ ফুট আর এতে ৫টি গম্বুজ ছিল। মুর্শিদকুলির নির্দেশমতো মসজিদের দরজায় সিঁড়ির নীচে একটি ছোট ঘর তৈরি করা হয়। এখানেই মুর্শিদকুলিকে সমাধিস্থ করা হয়। মসজিদের দরজায় যেতে গেলে চৌদ্দটি বড় বড় সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয়। দরজা পার হয়ে প্রায় ১২০ ফুট দূরে মসজিদ। গম্বুজগুলি ধাতু দিয়ে তৈরি। মসজিদের দরজায় খুব বড় কালো পাথরের তৈরি চৌকাঠ। ভেতরের দিকে একটি বৃহৎ কক্ষ। তার দেওয়ালের চারদিকে ধনুকাকৃতি খিলান (arch) তির্যকভাবে অবস্থিত। মসজিদ এবং চত্বরের চতুর্দিকে দোতলায় অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কক্ষ যেখানে মুর্শিদকুলির সময় সাতশো’ ‘করি’ বা কোরান পাঠক কোরান পাঠ করত। মসজিদের সঙ্গে মিনার, চৌবাচ্চা এবং ইঁদারাও তৈরি করা হয়।
অনেকে মনে করেন যে কাটরার মসজিদ ঢাকায় তৈরি মুর্শিদকুলির মসজিদের, যা ‘করতলব খানের মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত, অনুকরণ।৩ আবার কেউ কেউ বলেন যে এটি মক্কার মসজিদের অনুকরণে তৈরি।৪ আবার মসজিদের ভেতরের বৃহৎ কক্ষের দেওয়ালে তির্যকভাবে তৈরি যে সব ধনুকাকৃতি খিলান (arch), এই শৈলী দক্ষিণ ভারতীয় বলেও কেউ কেউ মনে করেন। তবে এটা হয়তো ঠিক নয় কারণ এই বিশেষ শৈলী মুঘল যুগের বাংলায় খুবই প্রচলিত ছিল।৫
কাটরা মসজিদের সঙ্গে জাহানকোষা নামক কামানের নাম যুক্ত হয়ে আছে। কাটরার পূর্বদিকে একটি অশ্বত্থ গাছের দুটি কাণ্ডের মাঝখানে এই কামান রক্ষিত বলে বোধহয়। এখানেই মুর্শিদকুলির কামানগুলিও রাখা হয় বলে জানা যায়। সে জন্য এ জায়গাটিকে আজও সাধারণ লোকেরা তোপখানা বলে। জাহানকোষা কামানটি লম্বায় প্রায় ১২ হাত, বেড় তিন হাতেরও বেশি। এর মুখের বেড়টি ১ হাতের ওপর। আগুন লাগার ফুটোটির ব্যাস দেড় ইঞ্চি। কামানটি মুঘল সম্রাট শাজাহানের রাজত্বকালে ইসলাম খাঁর সুবাদারির সময় জাহাঙ্গিরনগরের (ঢাকা) দারোগা শের মহম্মদের নির্দেশে ও হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনার্দন কর্মকার নামক শিল্পী নির্মাণ করেন। এটির ওজন ২১২ মণ, এতে বারুদ লাগে ২৮ কিলো।৬
মুবারক মঞ্জিল
মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার নবাব হন। তিনি ছিলেন দক্ষ কিন্তু আয়েসি ও শৌখিন লোক। শহর মুর্শিদাবাদের রাজসিক বোলবোলাও তাঁর আমলেই বাড়ে। নিত্যনতুন প্রাসাদ নির্মাণ করা তাঁর হবি ছিল। কুচ করে যেখানে তিনি আসতেন, সেখানে মহল তৈরি করতেন, নাম দেওয়া হত মুবারক মঞ্জিল। মুর্শিদকুলির তৈরি ‘চল্লিশ স্তম্ভের প্রাসাদ’ বা চেহেল সুতুনে তিনি সন্তুষ্ট থাকতে নারাজ ছিলেন। ঘরগুলো বাড়িয়ে তিনি এই প্রাসাদের রদবদল করেন। সরকারি নানা বিভাগের জন্য বাড়িঘর তৈরি হয়— দিওয়ানখানা, খিলাতখানা, ফরমান বাড়ি, খালসা কাছারি, আরও কত কী! শুধু তাই নয়, মুর্শিদকুলির আমলের রাজস্ববিভাগের নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী নাজির আহমেদ মুর্শিদাবাদের অদূরে ভাগীরথীর তীরে দাহাপাড়াতে যে মসজিদ ও উদ্যান নির্মাণ শুরু করেছিলেন, সুজাউদ্দিন তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাবার পর অসমাপ্ত মসজিদ ও উদ্যানের কাজ সম্পূর্ণ করেন। সেখানেও তিনি প্রাসাদ, জলাশয় ইত্যাদি নির্মাণ করেন এবং তার নাম দেন ফর্হাবাগ বা ফররাজবাগ (আনন্দ-উদ্যান)। এখানে তিনি সারা বছর পিকনিক ও নানা রকমের আনন্দ উৎসব করতেন আর বছরে একবার তাঁর দরবারের উচ্চপদস্থ ও শিক্ষিত কর্মচারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করতেন।৭
মোতিঝিল
মোতিঝিলের বিখ্যাত প্রাসাদের নির্মাতা নবাব আলিবর্দি খানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিস মহম্মদ খান ওরফে শহমত জঙ্গ, আলিবর্দির দুহিতা ঘসেটি বেগমের স্বামী। মোতিঝিল অর্থাৎ Lake of Pearls— মুক্তোর ঝিল। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের প্রাসাদের দেড় মাইল দক্ষিণ পূর্বে এই সুন্দর জায়গাটির অবস্থান দেখে এবং অশ্বপদাকৃতি ঝিল এর তিনদিক ঘিরে থাকায় নওয়াজিস মহম্মদ এখানে তাঁর নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করেন। তিনি ঢাকার শাসনকর্তা বা ছোট নবাব পদে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আলিবর্দি খান যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকতেন তখন মুর্শিদাবাদ রক্ষা করার ভার তাঁর বেগম ও নওয়াজিসের ওপরই থাকত। তাই তিনি বেশির ভাগ সময়েই মুর্শিদাবাদে থাকতেন। তাঁর বিশ্বস্ত সহকারী হোসেন কুলি খানের ওপর ঢাকার শাসনভার ন্যস্ত থাকত। নওয়াজিস অত্যন্ত বিলাসী ও আমোদপ্রিয় লোক ছিলেন। মুর্শিদাবাদের মধ্যে নিজের বাসভবনে সব সময় থাকতে তাঁর ভাল লাগত না। তাই ১৭৪৩ সালে তিনি মোতিঝিলের প্রাসাদ নির্মাণ করেন।৮ পরে প্রাসাদের পশ্চিম দিকে তোরণদ্বার নির্মাণ করে তাকে সুরক্ষিত করেন। তারই কাছে ১৭৫০/৫১ সালে একটি মসজিদ, মাদ্রাসা ও অতিথিশালাও নির্মিত হয়। মসজিদ ও অতিথিশালার জন্য নওয়াজিস প্রচুর অর্থব্যয় করতেন।৯
বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ের বহু ভগ্নস্তূপ থেকে মার্বেল ও অন্যান্য জিনিসপত্র এনে মোতিঝিলের প্রাসাদ তৈরি করা হয়। প্রাসাদটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত, ভাগগুলি (চত্বর) পরস্পরের অল্প ব্যবধানে। প্রত্যেকটি ভাগ দুটি বৃহৎ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। প্রাচীরগুলি প্রত্যেক দিকেই ঝিলের জল স্পর্শ করত। নওয়াজিস মোতিঝিলের প্রাসাদেই বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। গান, বাজনা, নানা বিলাসবহুল প্রমোদ তাঁর খুব প্রিয় ছিল। নানা নর্তকী ও বাইজি এনে এখানে তিনি মজলিস বসাতেন এবং আত্মীয়পরিজন নিয়ে এখানে থাকতেই তিনি ভালবাসতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ঘসেটি বেগম সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে মোতিঝিলেই বাস করতে থাকেন। সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে ঘসেটি বেগমকে বিতাড়িত করে মোতিঝিল দখল করেন এবং সব ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন।১০
মোতিঝিল প্রাসাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা জড়িয়ে আছে।১১ ১৭৫৭ সালে সিরাজদ্দৌল্লা মোতিঝিল থেকেই পলাশি অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন বলে যে অভিমত, তা সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ তখন তিনি নিজের প্রাসাদ হীরাঝিলেই থাকতেন। ১৭৬৫ সালে লর্ড ক্লাইভ ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলার দেওয়ানি হস্তান্তর করার জন্য নবাবের সঙ্গে আলোচনা করতে এসে মোতিঝিলে ছ’দিন কাটিয়েছিলেন। আবার কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার পর ১৭৬৬ সালের এপ্রিল মাসে ক্লাইভ এখানে এসেছিলেন এবং এ প্রাসাদেই কোম্পানি প্রথম পুণ্যাহ করে। এ উৎসবে নবাব নজমদৌল্লা যথোচিত পোশাক পরিচ্ছদ পরে মসনদে বসেছিলেন, পাশে দেওয়ানের (কোম্পানির) প্রতিনিধি রূপে ক্লাইভ। উপস্থিত ছিলেন জগৎশেঠ, রেজা খান ও মুর্শিদাবাদের অমাত্য ও অভিজাতবর্গ। ওয়ারেন হেস্টিংস যখন নবাব নাজিমের দরবারে কোম্পানির রাজনৈতিক এজেন্ট ছিলেন (১৭৭১-৭৩), তখন তিনি মোতিঝিলের প্রাসাদেই থাকতেন। মোতিঝিলে শেষ পুণ্যাহ হয় ১৭৭২ সালে। তারপরেই রাজস্ব বিভাগ কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। মোতিঝিল কোম্পানি বাগ নামেও পরিচিত কারণ এটা বেশ কিছুদিন কোম্পানির দখলে ছিল। ১৮৭৬ সালে এটা আবার নবাবকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।১২
হীরাঝিল
হীরাঝিলের প্রাসাদ নির্মাণ করেন সিরাজদ্দৌল্লা। তখনও তিনি যুবরাজ, নবাব হননি। ফর্হাবাগ থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে মাইল খানেক দূরে, জাফরাগঞ্জের উল্টোদিকে এই প্রাসাদ। মুঘল সম্রাট শাজাহানের মতো সিরাজদ্দৌল্লারও সৌন্দর্যপ্রীতি ছিল এবং সেজন্যই তিনি এই প্রাসাদ তৈরি করেন বলে মনে করা হয়। প্রাসাদের সঙ্গে তিনি একটি কৃত্রিম ঝিলও তৈরি করেন, ঝিলের নাম হীরাঝিল (Lake of Diamonds)। ঝিলের নাম অনুসারে প্রাসাদের নাম হয় হীরাঝিল প্রাসাদ। ঝিলের দু’দিক পাথর দিয়ে বাঁধানো। গৌড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে নানা রকম পাথর এনে এই ভবন তৈরি হয়। এটি প্রধানত ইঁট দিয়ে তৈরি কিন্তু জায়গায় জায়গায় পাথর বসিয়ে সিরাজ এর সৌন্দর্যবৃদ্ধির চেষ্টা করেন। প্রাসাদের একটি অংশ এমতাজ মহল। এটা এত বিশাল ছিল যে এতে তিনজন ইউরোপীয় ‘নরপতি’ থাকতে পারতেন বলে অনেকের ধারণা।১৩
কথিত আছে যে সিরাজদ্দৌল্লা যখন প্রাসাদটি তৈরি করছিলেন তখন একদিন নবাব আলিবর্দি সপারিষদ এটি দেখতে আসেন। তিনি যখন বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন তখন সিরাজ তাঁকে একটি প্রকোষ্ঠে বন্ধ করে রাখেন এবং নবাবকে জানান যে তিনি মুক্তি পেতে পারেন যদি হীরাঝিল প্রাসাদের নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে ও তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দেন। বৃদ্ধ নবাব বরাবরই সিরাজকে আস্কারা দিয়ে এসেছেন, এবারও তাকে বিমুখ করলেন না। তিনি এ-বাবদ সিরাজকে হীরাঝিলের কাছেই একটি বাজার বা গঞ্জ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিলেন। গঞ্জ থেকে বার্ষিক আয় হত ৫ লক্ষ টাকার ওপর। সিরাজের নাম মনসুর-উল-মুলক থেকে এ গঞ্জের নাম হয় মনসুরগঞ্জ। হীরাঝিলের প্রাসাদকেও অনেকে মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ বলে উল্লেখ করে থাকেন।১৪
হীরাঝিলের প্রাসাদ তৈরি হওয়ার পর সিরাজদ্দৌল্লা সেখানেই বাস করতে থাকেন। নবাব হওয়ার পরেও তিনি কেল্লায় না থেকে হীরাঝিল থেকেই রাজকার্য চালাতেন। এই প্রাসাদের সঙ্গে বহু স্মৃতি বিজড়িত। এখানেই তিনি বিখ্যাত সুন্দরী ও নর্তকী ফৈজিকে এনে আমোদপ্রমোদে মত্ত হন। পরে ফৈজির বিশ্বাসঘাতকতায় নিদারুণ আঘাত পেয়ে তাঁকে প্রাসাদের একটি কক্ষে বন্ধ করে রাখেন, সেখানে তাঁর মর্মন্তুদ মৃত্যু হয়। আবার এই প্রাসাদেই সিরাজ তাঁর প্রিয়তমা পত্নী লুৎফুন্নেসার সঙ্গে বাস করতেন। এখান থেকেই তিনি পলাশি অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন আবার পলাশিতে পর্যুদস্ত হয়ে এখানেই ফিরে এসে লুৎফুন্নেসা ও শিশুকন্যাকে নিয়ে রাত্রের অন্ধকারে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন। সিরাজের পালানোর খর পেয়ে মীরজাফর হীরাঝিলের প্রাসাদ দখল করেন। এদিকে ক্লাইভ এসে মোরাদবাগে আস্তানা নেন। তারপর হীরাঝিল বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদেই মীরজাফরের রাজ্যাভিষেক হয়। প্রাসাদের বিশাল হলে ক্লাইভ মীরজাফরের হাত ধরে এনে মুর্শিদাবাদের তখ্ত মোবারকে বসালেন। মসনদে বসিয়ে ক্লাইভ তাঁকে এক পাত্র মোহর নজরানা দিলেন। তারপর দরবারের অমাত্য ও অভিজাতবর্গ নতুন নবাবকে নজরানা দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
হীরাঝিল প্রাসাদের ধনাগারে সিরাজদ্দৌল্লার কী পরিমাণ ধনরত্ন সঞ্চিত ছিল তার একটা ধারণা করা যেতে পারে মীরজাফর, ক্লাইভ প্রমুখ যখন সেই ধনাগার লুণ্ঠন করেন, তা থেকে। লুণ্ঠনের সময় মীরজাফর, ক্লাইভ ছাড়াও ওয়ালস, ওয়াটস, লাশিংটন, দেওয়ান রামচাঁদ এবং মুন্সি নবকৃষ্ণ প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, সিরাজের এই কোষাগারে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ রৌপ্য মুদ্রা, ৩২ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা, দুই সিন্দুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিণ্ড, ৪ বাক্স অলঙ্কারের ব্যবহারোপযোগী হিরে, জহরত ও ২ বাক্স অখচিত চুনী, পান্না প্রভৃতি দামি পাথর ছিল। এ অনুমান হয়তো অত্যুক্তি কিন্তু কিছুটা যে সত্য সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ ছাড়াও কেউ কেউ বলেন যে হীরাঝিল প্রাসাদের অন্তঃপুরে আরেকটি লুকোনো ধনাগার ছিল এবং তাতে ৮ কোটি টাকার মতো ধনরত্ন সঞ্চিত ছিল। এর খবর ইংরেজরা পায়নি। এই ধন মীরজাফর, তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী আমির বেগ খান, রামচাঁদ ও নবকৃষ্ণের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এটাও নেহাৎ আজগুবি গল্প নয়। কারণ যে রামচাঁদ পলাশি যুদ্ধের সময় মাসিক ৬০ টাকা বেতনে কাজ করতেন, দশ বছর পরে তিনি মারা যাওয়ার সময় তাঁর নগদ ও হুণ্ডিতে ৭২ লক্ষ টাকা, ৪০০টি বড় বড় সোনার ও রুপোর কলসি থাকার উল্লেখ দেখা যায়। তার মধ্যে ৮০টি সোনার, বাকি রুপোর। তা ছাড়াও তাঁর ১৮ লক্ষ টাকার জমিদারি ও ২০ লক্ষ টাকার জহরতও ছিল। নবকৃষ্ণ সে সময় মাসিক ৬০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন কিন্তু তিনি নাকি তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে ৯ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। মীরজাফরের স্ত্রী মুন্নি বেগমও খুব সম্ভবত এই লুঠের টাকাতেই অগাধ সম্পদের মালিক হন। তাঁর যাবতীয় হিরে, জহরত এই লুণ্ঠন থেকেই পাওয়া।১৫ নবাব হয়ে মীরজাফর প্রথমে হীরাঝিল প্রাসাদেই থাকতেন। কিছুদিন পর তিনি ভাগীরথীর পূর্ব তীরে কেল্লার মধ্যে আলিবর্দির ভবনে চলে আসেন।
ইমামবারা-মদিনা
মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত স্থাপত্য ইমামবারা নির্মাণ করেছিলেন সিরাজদ্দৌল্লা। মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের কাছেই উত্তরদিকে সিরাজ ইমামবারার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কথিত আছে যে তিনি নিজের মাথায়/হাতে করে ইট, পাথর বয়ে এনে ইমামবারার কাজ শুরু করেন। কারও কারও মতে নির্মাণকার্যে শুধু মুসলমান কারিগর ও শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়েছিল, হিন্দুদের নয়। ইমামবারার মাঝখানে ‘মদিনা’। মদিনার জন্য ৬ ফুটের মতো জমি খুঁড়ে তাতে মক্কা (কারও কারও মতে কারবালা) থেকে আনা মাটি দিয়ে ভর্তি করা হয়। তার ওপরে ছোট চতুষ্কোণ একটি ভবন তৈরি করা হয়। তাতে একটি গম্বুজ ও চারটি ছোট মিনার। মহরমের সময় সারা দিন রাতই মদিনাতে কোরান পাঠ করা হত। উত্তর ও দক্ষিণের ঘরগুলো গুদাম ঘর ও কর্মশালা হিসেবে ব্যবহৃত হত। মহরমের সময় কয়েকশো লোক রাত্রে ইমামবারা ও মদিনাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত থাকত। ওই সময় প্রত্যেকটি কক্ষেই ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়াল বাতি প্রভৃতি জ্বালানো হত, এবং তাতে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হত। সিরাজদ্দৌল্লা বহুমূল্য বস্ত্রাদি দিয়ে ইমামবারা ও মদিনা সাজিয়েছিলেন। পরে নবাব মীরকাসিম নগদ টাকার জন্য সব বিক্রি করে দেন। সিরাজের সাধের ইমামবারাটি ১৮৪২ সালে বাজি পোড়ানোর সময় পুড়ে যায়। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও ১৮৪৬ সালে আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। রক্ষা পায় শুধু মদিনা।১৬
রিয়াজ-উস-সলাতিনের লেখক গোলাম হোসেন সলিম ইমামবারা দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন:১৭
Its praise is beyond description; its equal is not to be found in the whole of Hindustan. Although at present one-tenth of it does not exist, yet a remnant of it is a fair specimen of the original edifice.
মুর্শিদাবাদের বর্তমান ইমামবারাটি ১৮৪৮ সালে তখনকার নিজামতের দেওয়ান সৈয়দ সাদিক আলি খানের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়। এটি আগের ইমামবারার সামান্য উত্তর দিকে। পুরনো মদিনা যথাস্থানেই রাখা হয়। নতুন ইমামবারাতে একটি নতুন মদিনা তৈরি করা হয়। নতুন ইমামবারা তৈরি করতে ৬ লক্ষ টাকার বেশি খরচ হয়। এটি লম্বায় ৬৮০ ফুট, প্রস্থে নানা জায়গায় বিভিন্ন মাপের হলেও মাঝখানে ৩০০ ফুট। এটি তৈরি করতে ১১ মাস মাত্র সময় লেগেছিল। সাদিক আলি খান পেশায় ইঞ্জিনিয়ার না হলেও পুরো নির্মাণ কার্যের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান করেছিলেন। সব কারিগর ও শ্রমিকদের মজুরি ছাড়াও খাবার দেওয়া হত যাতে তারা দিনরাত কাজ করতে পারে। ইমামবারা তৈরি হওয়ার পর সব কর্মীকেই শাল, দোশালা প্রভৃতি পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়। ফলে একেক সময় মুর্শিদাবাদের অলিতে গলিতে এসব বহুমূল্য পোষাক পরা লোকদের খুবই দেখা যেত।১৮
খোশবাগ
ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে লালবাগের কাছে দক্ষিণ দিকে যে উদ্যান বাটিকা তার নাম খোশবাগ অর্থাৎ সুখস্বর্গ (garden of happiness)। এই উদ্যান আসলে একটি সমাধি ক্ষেত্র। এই সমাধিক্ষেত্রে আলিবর্দি, সিরাজদ্দৌল্লা, লুৎফুন্নেসা বেগম এবং সম্ভবত আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসার সমাধিও অবস্থিত। নবাব আলিবর্দি তাঁর জননীকে সমাধিস্থ করার জন্য এই উদ্যান তৈরি করেন। খোশবাগের সমাধিভবনে প্রধানত দুটি চত্বর— প্রথমটি প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু, দ্বিতীয়টি প্রথমটির পশ্চিম দিকে। এই দ্বিতীয় চত্বরে প্রবেশ করার জন্য আরও একটি প্রবেশদ্বার। প্রাচীর বেষ্টিত এই সমাধি স্থানটির উত্তর দিকে একটি উঁচু স্থানে ১৭টি সমাধি আছে। মূল সমাধি গৃহের মধ্যস্থলে সাদা ও কালো পাথরের তৈরি যে সমাধি, সেটি নবাব আলিবর্দির। তার পূর্বদিকে সিরাজদ্দৌল্লার সমাধি। পলাশির যুদ্ধে পরাভূত সিরাজকে হত্যা করে তার ছিন্নভিন্ন দেহ হাতির পিঠে মুর্শিদাবাদ প্রদক্ষিণ করাবার পর এখানে এনে সমাধিস্থ করা হয়। সিরাজের সমাধির দক্ষিণে তাঁর পায়ের নীচে তাঁর প্রিয়তমা বেগম লুৎফুন্নেসার সমাধি।
আলিবর্দি তাঁর জননীর মৃত্যুর পর এই সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করে এই উদ্যানবাটিকার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভাণ্ডারদহ ও নবাবগঞ্জ নামক দুটি গ্রামের থেকে প্রাপ্য রাজস্ব বরাদ্দ করেন। এর পরিমাণ ছিল মাসিক ৩০৫ টাকা। সিরাজদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর অন্যান্য বেগমদের সঙ্গে লুৎফুন্নেসাকেও ঢাকায় নির্বাসিত করা হয়। সেখানে ৭ বছর কাটাবার পর অনেকটা ক্লাইভের বদান্যতায় তাঁকে মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠানো হয় এবং কিছুদিনের মধ্যে খোশবাগের সমাধি ক্ষেত্র তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়। এর জন্য তিনি মাসিক ৩০৫ টাকা করে পেতেন। লুৎফুন্নেসার জীবিতাবস্থাতেই তাঁর কন্যা উম্মত জহুরার মৃত্যু হয়। সেজন্য লুৎফুন্নেসার মৃত্যুর পর উম্মত জহুরার কন্যা খোশবাগ সমাধিক্ষেত্রের তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব তাঁদের ওপর দেওয়ার জন্য ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে আর্জি পাঠান। হেস্টিংস তা মঞ্জুর করেন। তাঁদের মৃত্যুর পর সেই বংশের লোকরা খোশবাগের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায়।১৯
ফর্হাবাগ, রোশনিবাগ
নবাব সুজাউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন, বিলাসপ্রিয় ও সৌন্দর্যের ভক্ত। তাই মুর্শিদকুলির তৈরি প্রাসাদ চেহেল সেতুন বা অন্যান্য স্থাপত্যে তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। নিজের পছন্দমতো বহু স্থাপত্য, উদ্যান ইত্যাদি তৈরি করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি বোধ হয় ফর্হাবাগ বা সুখকানন। এটি মুর্শিদাবাদের দাহাপাড়াতেই, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে, রোশনিবাগের কিছুটা উত্তরে। এই বাগানটি ও তাতে একটি মসজিদ প্রথম তৈরি করতে শুরু করেন মুর্শিদকুলির নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী এক কর্মচারী—নাজির আহমেদ। সুজাউদ্দিন নবাব হয়ে নাজিরের মৃত্যুদণ্ড দেন কিন্তু ওই বাগান ও মসজিদের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন। ফর্হাবাগের সৌন্দর্যকরণে সুজা কোনওরকম কার্পণ্য করেননি। মসজিদ ছাড়াও এখানে নানা সুন্দর প্রমোদ অট্টালিকাও তিনি তৈরি করেন। বাগানে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ লাগানো হয়। অসংখ্য ফোয়ারা এ বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।২০
ফর্হাবাগের কাছেই রোশনিবাগ বা আলোর উদ্যান (garden of light)। এটি নবাব সুজাউদ্দিনের সমাধি। রোশনিবাগ উদ্যানের সামনে নবাবরা আলোকোৎসব করতেন বলে এর নাম রোশনিবাগ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। রোশনিবাগের বর্তমান সমাধিভবনের উত্তরদিকে এর প্রবেশদ্বার। সেটি অতিক্রম করে কয়েক পা গেলে সুজাউদ্দিনের সমাধি। প্রায় ৩ হাত উঁচু একটি বিশাল ভিতের ওপর সমাধিটি। পুরনো সমাধিটি ধ্বংস হয়ে গেলে নতুন সমাধিটি তৈরি হয়। সমাধিভবনটির দৈর্ঘ্য ১৪ হাত, প্রস্থ ১৩ হাত। মুর্শিদাবাদে এত বড় সমাধি আর একটিও নেই।২১
জাফরাগঞ্জ
জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ ভাগীরথীর তীরে, মুর্শিদাবাদ কেল্লা থেকে আধ মাইল উত্তরে অবস্থিত। মীরজাফর মসনদে বসার আগে এখানেই থাকতেন। তাই এটি মীরজাফরের প্রাসাদ হিসেবেও পরিচিত। সম্ভবত তাঁর নাম অনুসারেই এর নাম জাফরাগঞ্জ। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে এর নামকরণ হয় মুর্শিদাবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকুলি জাফর খানের নাম অনুসারে। সে যাই হোক, মীরজাফর নবাব হওয়ার পর মনসুরগঞ্জে সিরাজদ্দৌল্লার হীরাঝিল প্রাসাদে বসবাস করতে শুরু করেন এবং তাঁর পুত্র মীরণকে জাফরাগঞ্জের ভবন দিয়ে দেন। এই জাফরাগঞ্জেই সিরাজকে হত্যা করা হয়, এটিই সিরাজের বধ্যভূমি। তাই যে ভবনে সিরাজের নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়, তাকে মুর্শিদাবাদবাসীরা ‘নেমকহারামের দেউরি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এই প্রাসাদেই ইংরেজদের সঙ্গে মীরজাফর ও মীরণের গুপ্তসন্ধি হয় এবং ওয়াটস বোরখা পরে লুকিয়ে পাল্কি করে এখানে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে আসেন। জাফরাগঞ্জেই মীরজাফর, মীরণ ও মীরজাফরের বংশধরদের সমাধি। মীরজাফর পত্নী মুন্নি বেগমের সমাধিও এখানে।২২
জগৎশেঠের প্রাসাদ
জগৎশেঠদের প্রাসাদ ছিল মহিমাপুরে। এখন তার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই, প্রায় সবটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত। অথচ জগৎশেঠদের এই প্রাসাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার ইতিহাসের বহু স্মরণীয় ঘটনা বিজড়িত। এই প্রাসাদে বসেই বাংলায় দু-তিনটে রাষ্ট্রবিপ্লবের পরিকল্পনা করা হয়েছিল কারণ শেঠরা ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব ছিল না। পলাশি যুদ্ধের পর ইংরেজদের পক্ষে ওয়াটস ও ওয়ালস চুক্তির শর্তানুযায়ী কী ভাবে টাকাপয়সার লেনদেন হবে তা নিয়ে মীরজাফর ও দুর্লভরামের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় বসেন এই প্রাসাদেই। কয়েকদিন পরে আবার ক্লাইভ, ওয়াটস, স্ক্র্যাফ্টন, মীরণ, দুর্লভরাম মীরজাফরকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসেন এবং জগৎশেঠের সামনে লেনদেন সম্পর্কে কথাবার্তা পাকা করেন। উমিচাঁদ তাঁর অংশ প্রাপ্তির আশায় ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। সভা শেষ হলে ক্লাইভ স্ক্র্যাফ্টনকে জানালেন যে এবার উমিচাঁদকে প্রতারণার কথা ফাঁস করা যেতে পারে। স্ক্র্যাফ্টন বাইরে এসে উমিচাঁদকে দেশীয় ভাষায় জানান যে লাল কাগজের চুক্তিটি জাল, তিনি নবাবের ধনসম্পদের কিছুই পাচ্ছেন না। এতে নাকি উমিচাঁদ মুর্ছা যান এবং তিনি পাগল হয়ে যান। তবে আমরা দেখিয়েছি যে এটা মোটেই সঠিক নয়।২৩
এ ছাড়া, মুর্শিদাবাদে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। মীরজাফরের পত্নী মুন্নি বেগম একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন। চকবাজারে এটি তৈরি করা হয় বলে একে চক মসজিদ বা মুন্নি বেগমের মসজিদও বলা হয়। সৈয়দাবাদের আর্মানিরা ১৭৫৮ সালে একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। তখনই এটি তৈরি করতে খরচ হয় ২ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা। এর পূর্বদিকে আরেকটি গির্জা তৈরি হয়েছিল ১৬৬৫ সালে। সেটি নষ্ট হয়ে গেলে নতুন গির্জাটি তৈরি হয়। হীরাঝিলের কাছে ছিল মোরাদবাগ প্রাসাদ। পলাশির যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদে এসে ক্লাইভ এখানে অবস্থান করেন এবং মীরণ এসে তাঁকে মনসুরগঞ্জ বা হীরাঝিলের প্রাসাদে মীরজাফরের কাছে নিয়ে যান। ওয়ারেন হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ দরবারে ইংরেজ প্রতিনিধি হয়ে আসার পর মোরাদবাগের প্রাসাদেই থাকতেন। বাংলার ইংরেজ গভর্নর ভ্যানসিটার্ট মীরজাফরকে সরিয়ে মীরকাশিমকে নবাব করবার জন্য যখন মুর্শিদাবাদে আসেন, তিনিও তখন এই প্রাসাদে ওঠেন।২৪
সবশেষে, হাজারদুয়ারি। এই ইমারতটি অবশ্য স্বাধীন নবাবি আমলের নয়। তা হলেও মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যের কথা বলতে গেলে হাজারদুয়ারির কথা বাদ দেওয়া যায় না। এটিই মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইমারত। তাই খুব সংক্ষেপে এটির একটু বিবরণ দিচ্ছি। ভাগীরথীর তীরে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের এই বিশাল প্রাসাদ। ইতালীয় ভাস্কর্যের অনুকরণে এটির নকশা করেন ‘বেঙ্গল কোর অফ ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর জেনারেল ডানকান ম্যাকলিয়ড (Duncan Mcleod)। তাঁর তত্ত্বাবধানে এটির নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয়। ১৮২৯ সালে এর ভিত্তি স্থাপন হয় এবং নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হয় ১৮৩৭ সালে। এটি ত্রিতল ইমারত, শীর্ষে একটি গম্বুজ দিয়ে পরিবৃত। এর হাজারটি দরজা বলে নাম হাজারদুয়ারি। যে চত্বরে এটি অবস্থিত তার নাম নিজামত কিল্লা। এর মধ্যে প্রাসাদ ছাড়াও ইমামবারা, মদিনা, ঘড়িঘর, তিনটি মসজিদ এবং অনেকগুলি কক্ষ।২৫
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১৮
২. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 172-73.
৩. Ibid., p. 172.
৪. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, p. 276.
৫. Ibid.
৬. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ২৩।
৭. রিয়াজ, পৃ. ২৯০-৯১; তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭৩।
৮. O’ Malley, Bengal Distict Gazetteers, Murshidabad, pp. 209-10.
৯. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৯৬-৯৭।
১০. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 186-87; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৯৫-৯৯।
১১. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 188.
১২. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১০০; P. C. Majumdar, Musnad of Murshidabad, pp. 188-89;
১৩. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 206; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১০৫.
১৪. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, pp. 277-78.
১৫. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১০৭-১০৮; P. C. Majumdar, Musnud, pp. 207-208; A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, pp. 277-78.
১৬. A. C. Campbell, Glimpses of Bengal, pp. 333-34; J. H. T. Walsh, A History of Murshidabad District, pp. 44-45; P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 118-19.
১৭. রিয়াজ, পৃ. ২৮-২৯।
১৮. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 120-21.
১৯. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১৪৩-৫০; P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 198-99; A. H. Dani, Muslim Architecture in Begal, p. 277.
২০. রিয়াজ, পৃ. ২৯০-৯১, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭৫-৭৬।
২১. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 199; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ২৫-২৮।
২২. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, p. 277; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১৫৩-৫৪।
২৩. P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, p. 153: S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 119-20.
২৪. J. H. T. Walsh, A History of Murshidabad District, p. 75; P. C. Majumdar, Musnud of Murshidabad, pp. 208, 233.
২৫. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal, p. 273.