পঞ্চম অধ্যায় – পলাশি
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের সম্যক বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি। তা না করলে এই ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মুর্শিদাবাদেই এ ষড়যন্ত্রের উদ্ভব, বিকাশ ও রূপায়ণ। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে পলাশি বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে শুধু নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পলাশিতে ইংরেজদের বাংলা বিজয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করে। বাংলা থেকেই এবং বাংলার অর্থভাণ্ডার দিয়েই ইংরেজরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করে এবং ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা। সেজন্য তারা কেন এবং কী ভাবে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলা জয় করে, তার আলোচনা করা প্রয়োজন।
স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে শুধু নয়, এস. সি. হিল (১৯০৫) থেকে শুরু করে অধুনা পিটার মার্শাল (১৯৮৭), ক্রিস বেইলি (১৯৮৭), রজতকান্ত রায় (১৯৯৪) প্রমুখের গ্রন্থেও১ সিরাজদ্দৌল্লা এবং পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে কতগুলি বক্তব্য স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে দেখা যায়। সাধারণভাবে এ বক্তব্যগুলি হল—পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল না; সিরাজদ্দৌল্লা এতই দুশ্চরিত্র, দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর ছিলেন যে তাতে রাজ্যের অমাত্যবর্গ শুধু নয়, সাধারণ মানুষও নবাবের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই তাঁকে অপসারণ করতে মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বদ্ধপরিকর হয় এবং এ কাজ সম্পন্ন করতে তারা ইংরেজদের সামরিক শক্তির সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশায় তাদের ডেকে আনে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় একটি ‘আকস্মিক’ ঘটনামাত্র, এর পেছনে তাদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ (মার্শালের ভাষায় ‘no calculated plottings’) ছিল না। মুর্শিদাবাদ দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে তারা মাঠে নেমে পড়ে এবং নবাবের অমাত্যদের সঙ্গে সিরাজকে হঠিয়ে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনায় সামিল হয়।
সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা হয় হয় যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে বিবাদ ও সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলার মসনদও হারালেন, তার জন্য মূলত দায়ী তিনিই। আবার পলাশির ব্যাখ্যা হিসেবে যুক্তি দেখান হয়ে থাকে যে সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে তাঁর আচরণ ও ব্যবহারে প্রভাবশালী অমাত্যবর্গকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়, তার পরিণতিই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। ইদানীং এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে প্রাক্-পলাশি বাংলায় রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ‘সংকটও’ [বিশেষ করে কে. এন. চৌধুরী (১৯৭৮), পিটার মার্শাল (১৯৮০, ’৮৭)] দেখা দিয়েছিল এবং এই ‘উভয় সংকট’ থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই যেন ইংরেজরা ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ বাংলা জয় করে। কোনও কোনও ঐতিহাসিক আবার ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করতে গিয়ে প্রাক-পলাশি বাঙালি সমাজের একটি দ্বিধাবিভক্ত চিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় যত্নবান। এঁদের বক্তব্য, পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলিম শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় মুসলিম নবাবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
উপরোক্ত বক্তব্যগুলি কতটা সঠিক এবং তথ্য ও যুক্তিনির্ভর, তার সূক্ষ্ম এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। গত দু’দশকেরও বেশি ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে, বিশেষ করে ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডসে (India Office Records, British Library, London) রক্ষিত ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র ও ‘প্রাইভেট পেপারস’ এবং হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভসে (Algemeen Rijksarchief, The Hague) সংরক্ষিত ডাচ কোম্পানির দলিল দস্তাবেজ ও কাগজপত্রে (যেগুলি এর আগে পলাশির প্রেক্ষিতে কেউ দেখেননি বা ব্যবহার করেননি) যেসব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি এবং তার পাশাপাশি আগের নানা তথ্য ও সমসাময়িক ফারসি ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পুনর্বিচার করে আমরা ওপরের বক্তব্যগুলি খণ্ডন করেছি।
আমাদের মূল বক্তব্য, পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ইংরেজরাই, ভারতীয়রা নয়। ইংরেজরা বেশ পরিকল্পিতভাবেই একাজ সম্পন্ন করে এবং নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তারা মুর্শিদাবাদ দরবারের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পনায় সামিল করে। শুধু তাই নয়, পলাশির যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে। তবে এটাকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষ স্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। নবাবের দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা অংশ সিরাজদ্দৌল্লার ওপর বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল, একথা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা যে বক্তব্যের ওপর জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই চক্রান্ত পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না।
বিচার্য বিষয়
আলোচনার সুবিধের জন্য বিষয়গুলি আর একটু বিশদভাবে বলা প্রয়োজন। প্রথম, ঐতিহাসিকরা (এবং বেশিরভাগ সমসাময়িক লেখকরাও বটে) সহমত যে নবাব হওয়ার আগে সিরাজদ্দৌল্লা এতই নির্মম, নিষ্ঠুর এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন যে সবাই আলিবর্দির পরে সিরাজের নবাব হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সিরাজের এই ‘কদর্য’ চরিত্র অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রায় সবাইকে শুধু নয়, সাধারণ মানুষকেও তাঁর প্রতি বিরূপ করে তুলেছিল। কাশিমবাজারের তদানীন্তন ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘Before the death of Alivardi Khan, the character of Siraj- uddaula was reputed to be worst ever known. In fact he had distinguished himself not only by all sorts of debaucheries but by a revolting cruelty’২. দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের যে বিবাদ ও সংঘর্ষ হয়েছিল তার জন্য সিরাজদ্দৌল্লাই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। এ সংঘর্ষের কারণ আলোচনা করতে গিয়ে এস. সি. হিল নবাবের উদ্দেশ্য বা কারণ এবং নবাবের ‘মিথ্যা ওজর’ এই দু’ভাগে ভাগ করেছেন। হিলের মতে এ সংঘর্ষের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হল সিরাজদ্দৌল্লার ‘দম্ভ’ এবং ‘অর্থলিপ্সা’। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের যেসব অভিযোগ— ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও দুর্ভেদ্যকরণের প্রচেষ্টা, দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ও বেআইনি অপব্যবহার এবং নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান— সেগুলিকে হিল সাহেব ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য নবাবের ‘মিথ্যা ওজর’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।৩
তৃতীয়ত, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বক্তব্য, পলাশি ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র (ক্রিস বেইলির ভাষায় ‘Indian-born conspiracy’)। এর পেছনে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না। প্রথমদিকে ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল ‘খুবই সীমিত’ কিন্তু তারা যখন উপলব্ধি করল যে মুর্শিদাবাদ দরবারে একটি বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে উৎসুক, তখন তাদের লক্ষ্য আস্তে আস্তে প্রসারিত হল।৪ সাধারণভাবে পলাশির ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধানত মীরজাফরকেই দায়ী করা হয়। মীরজাফরই বিশ্বাসঘাতক—নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে বাংলার মসনদ অধিকার করার মতলবে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে পলাশি চক্রান্তে যোগ দেন— এ মত বহুল প্রচারিত। বাংলায় মীরজাফর নামটাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। এখনও ওই নাম বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দ।
চতুর্থত, প্রাক্-পলাশি বাংলায় অভ্যন্তরীণ ‘সংকটের’ কথাও বলা হয়ে থাকে। আগে এই ‘সংকটকে’ শুধু রাজনৈতিক ‘সংকট’ হিসেবে দেখা হত। কিন্তু ইদানীং এর সঙ্গে অন্য একটি মাত্রাও যোগ করার চেষ্টা হয়েছে—বলা হচ্ছে এটা অর্থনৈতিক ‘সংকট’ও বটে। রাজনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার বাণিজ্যিক-ব্যাঙ্কিং শ্রেণি, জমিদার ও অভিজাতবর্গের সঙ্গে নবাবের যে শ্রেণিগত জোটবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নিজামতকে স্থায়িত্ব দিয়েছিল, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর তা ভেঙে পড়ে। আর অর্থনৈতিক সংকটের লক্ষণ হিসেবে নির্দেশ করা হচ্ছে— অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিল্পবাণিজ্যের অধোগতি, ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণির আর্থিক দুরবস্থা, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণে ঘাটতি, ইত্যাদি। এ সবগুলিকে ১৭৪০-র দশকে যে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ হয়েছিল তাঁর ফলশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।৫
আবার অধুনা বলা হচ্ছে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত যে হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যাঙ্কিং ও ব্যবসায়ী শ্রেণির শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতেই পলাশি বিপ্লবের ব্যাখ্যা করা সমুচিত। হিল সাহেব অবশ্য অনেকদিন আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে তাদের সঙ্গে উপরোক্ত শ্রেণির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।৬ কিছুদিন আগে ব্রিজেন গুপ্ত দেখাবার চেষ্টা করেছেন, বাংলার সঙ্গে ইউরোপীয় সমদ্র বাণিজ্যের ফলে হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বিশেষ শ্রেণিই বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রধান সহায়কের (‘catalytic agent’) কাজ করেছিল।’৭ আর এখন পিটার মার্শাল, ক্রিস বেইলি প্রমুখ ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাংলার হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ওপর জোর দিচ্ছেন— বলছেন, তাঁর ফলে উভয়ের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সে কারণেই হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়।৮ অর্থাৎ সেই ‘কোলাবোরেশন থিসিসের’ ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই থিসিসের মূল প্রতিপাদ্য, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে বাংলায় হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের, বিশেষ করে ইংরেজদের, স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় এবং সেজন্যই এরা ইংরেজদের সঙ্গে পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। বিশদভাবে বলতে গেলে এ বক্তব্য মোটামুটি এরকম: অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যেরই বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি বাণিজ্য করছিল এবং ফলে তারাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ (রুপো, টাকাকড়ি) আমদানি করত। আর এই বাণিজ্যের ফলে হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বেশ লাভবান হতে থাকে এবং সে কারণেই তাদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্রিস বেইলি এমন কথাও বলছেন যে বাংলায় ‘ব্যবসায়ী-ভূস্বামীদের স্বার্থ ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছিল যে কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা তারা সহ্য করতে পারছিল না এবং সেজন্যই পলাশির ঘটনা ঘটল’।৯
সবশেষে এবং একদিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রাক-পলাশি বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত চিত্র। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, পলাশি যুদ্ধের প্রাক্কলে বাংলার সমাজ হিন্দু এবং মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত ছিল। মুসলমান নবাবের অত্যাচারে জর্জরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলমান শাসন থেকে মুক্তি চাইছিল, তাই তারা ইংরেজদের স্বাগত জানাতে উৎসুক ছিল। এ মতবাদের প্রধান প্রবক্তাও এস. সি. হিল। ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার যে সংঘর্ষ বাধে, হিলের মতে তাঁর অন্যতম ‘সাধারণ’ কারণ মুসলমান শাসকদের প্রতি হিন্দুদের অসন্তোষ। স্যার যদুনাথ সরকার সোজাসুজি এ ধরনের কথা না বললেও উদ্ধৃতি দিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, মূলত হিন্দুরাই মুসলমান শাসনের অবসান চাইছিল। ব্রিজেন গুপ্ত বাংলার দ্বিধাবিভক্ত এই সমাজের কথা বলতে গিয়ে প্রায় হুবহু হিলের বক্তব্যকে তুলে ধরেছেন।১০
.
সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্র
ইতিহাসের গল্পকথায় শুধু নয়, মননশীল লেখকদের ভাষ্যেও সিরাজদ্দৌল্লা দুশ্চরিত্র, নির্মম, নিষ্ঠুর ও লম্পট। সন্দেহ নেই, সমসাময়িক বিদেশি পর্যবেক্ষক ও ফারসি ইতিহাসেও এমন বর্ণনাই আছে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য, ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের সংঘর্ষের কারণ খুঁজতে গিয়ে বা পলাশি চক্রান্তের স্বরূপ উদঘাটনে নবাব হওয়ার আগে সিরাজ চরিত্রের এই ‘অন্ধকার’ দিকটা খুঁটিয়ে দেখার খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবু তর্কের খাতিরে ওটা প্রয়োজনীয় বলে যদি ধরেও নেওয়া যায়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে বাংলার প্রায় সব নবাবই একই চরিত্রদোষে দোষী—দুশ্চরিত্র আর নিষ্ঠুর কেউ কম ছিলেন না। তা হলে শুধু সিরাজদ্দৌল্লাকেই ‘দুশ্চরিত্রের’ জন্য দোষী করার প্রচেষ্টা কেন? মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার সব নবাবই নিষ্ঠুরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। সুজাউদ্দিন ও সরফরাজ দু’জনেই দুশ্চরিত্র ছিলেন। সেক্ষেত্রে সিরাজদ্দৌল্লার প্রতিই কেন শুধু এ অপবাদ? এটাকে পলাশির ষড়যন্ত্র ও ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক প্রচার বলে সন্দেহ করা কি খুবই অমূলক?
আমাদের এ বক্তব্যকে কিন্তু সিরাজ চরিত্রের দোষস্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ভুল বোঝার অবকাশ নেই। নবাব হওয়ার আগে দুশ্চরিত্রের অপবাদ সিরাজকে দেওয়া যায় না বা নবাব হিসেবে সিরাজ খুব মহান ছিলেন এটা মোটেই আমাদের বক্তব্য নয়। আমাদের যুক্তি অন্যত্র। আমাদের প্রশ্ন— নবাব হওয়ার পরেও কি সিরাজ আগের সেই চরিত্রের লোক ছিলেন? তার মধ্যে কি কোনও পরিবর্তন এসেছিল বা তার কি চৈতন্যোদয় হয়েছিল? নবাব হওয়ার পরেও কি তিনি আগের মতো উদ্ধত, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর আর নির্মম ছিলেন? ইতিহাসে এর সোজাসুজি সাক্ষ্যপ্রমাণ তেমন কিছু নেই। তবু এখানে ওখানে ছোটখাট কিছু তথ্য, কিছু ইঙ্গিত থেকে একটা ধারণা আমরা করতে পারি। তা ছাড়া নবাব হিসেবে (যদিও স্বল্প সময়ের জন্য—পনেরো মাসেরও কম) সিরাজদ্দৌল্লার আচরণ ও কাজকর্ম বিশ্লেষণ করেও আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি। এখানে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের মনে রাখতে হবে। সিরাজ চরিত্রের যে কদর্য দিকটার দিকে সবাই অঙ্গুলি সংকেত করছেন, তা কিন্তু মুখ্যত সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার আগের চরিত্র (জাঁ ল’ স্পষ্ট বলেছেন ‘Before the death of Alivardi Khan’)। নবাব হওয়ার পরে সিরাজ চরিত্রের এ ‘অন্ধকার’ দিকটার সোজাসুজি কোনও তথ্য বা প্রমাণ কিন্তু অপ্রতুল। এর কারণ সম্ভবত নবাব হওয়ার পরে সিরাজদ্দৌল্লার স্বভাব এবং আচরণের পরিবর্তন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সাম্প্রতিক লেখাতেও সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘জেদী’, ‘একরোখা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তাঁর ‘মেজাজি রাগিস্বভাবের’ ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।১১ লব্ধপ্রতিষ্ঠ এক ঐতিহাসিক আবার সিরাজদ্দৌল্লার ‘নিষ্ঠুরতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ও উন্মাদ স্বভাবের’ গল্পকে ‘পরাজিতের মরণোত্তর পুরস্কার’ বলে উল্লেখ করেও সত্য ঘটনা কী তা এড়িয়ে বলছেন ‘সত্য যাই হোক না কেন, সিরাজদ্দৌল্লা মোটেই আলিবর্দির যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন না।’১২ নবাব হওয়ার পরে সিরাজের চরিত্রে যে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছিল তা আমরা ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টনের (Luke Scrafton) লেখা থেকে জানতে পারি। তিনি লিখেছেন, ‘আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় সিরাজ কোরান ছুঁয়ে শপথ করেন যে তিনি জীবনে আর কোনওদিন মদ্যস্পর্শ করবেন না, সে শপথ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।’১৩ অথচ এই স্ক্র্যাফ্টনই আগে সিরাজকে ‘অতিরিক্ত পানাসক্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। সিরাজ-চরিত্রে এ পরিবর্তন খুবই অর্থবহ কারণ যে যুবক অত্যধিক মদ্যপানে অভ্যস্ত তিনি যে এত সহজে দীর্ঘদিনের বদভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারলেন এবং মৃত্যুপথযাত্রী মাতামহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আজীবন রক্ষা করেছেন, তাঁর পক্ষে ইচ্ছে করলে নিজের স্বভাবচরিত্র সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারা অত্যাশ্চর্য কিছু নয়। ওই কারণে মনে হয় নবাব হওয়ার আগে সিরাজের চরিত্র যেমনই থাকুক না কেন, রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর চরিত্রে পরিবর্তন একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।
এমন পরিবর্তন যে অসম্ভব নয় (যদিও নাটকীয় হতে পারে) এবং তার যে সম্ভাবনাও ছিল সেটা আমাদের জানাচ্ছেন জাঁ ল’, যিনি-ই প্রধানত সিরাজচরিত্রের কদর্য রূপটি তুলে ধরেছেন। তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ: ‘People have flattered themselves that when he (Siraj] became Nawab he would be more humane.’ তিনি নিজেও অবশ্য আশা করেছিলেন যে হয়তো “সিরাজ একদিন [নবাব হওয়ার পরে?] সজ্জনে পরিণত হতে পারেন।’ তাঁর ওরকম বিশ্বাসের কারণও ছিল যার জন্য তিনি লিখেছেন, ‘[ঢাকার] তরুণ নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান১৪ সিরাজের চেয়ে কম দুশ্চরিত্র ও উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন না কিন্তু পরে তিনি সর্বজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন’।১৫
এবার নবাব হওয়ার পর সিরাজদ্দৌল্লার আচরণ বিশ্লেষণ করা যাক। জাঁ ল’র লেখা থেকেই স্পষ্ট যে তিনি ফরাসিদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্নই ছিলেন। ফরাসিদের প্রতি কোনও নিষ্ঠুরতা বা উদগ্র রাগ তিনি দেখাননি। তাঁর দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং মসনদের দাবিদার, ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের প্রতি তিনি কেমন আচরণ করেছিলেন? নবাব হওয়ার আগে তাঁর যে চরিত্র আমরা দেখেছি, তার সঙ্গে মিলে যায় এমন হঠকারিতা বা অবিবেচনাপ্রসূত কিছু কি তিনি করেছিলেন? এর উত্তর কিন্তু একদম ‘না’। তিনি তাঁর প্রথম শত্রু ঘসেটি বেগমকে (যিনি সিরাজকে নবাব হিসেবে একেবারে চাননি এবং সিরাজ যাতে নবাব হতে না পারেন তাঁর জন্য যথাসাধ্য চক্রান্ত করছিলেন) যেভাবে ‘বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্তির সঙ্গে বাগ মানিয়েছিলেন’ তা তারিখ-ই-বংগালা-ই-মবহতজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলি খানও তারিফ না করে পারেননি। তিনি লিখছেন যে বহুলোক, যারা আগে ঘসেটি বেগমকে সমর্থন করছিল, তারা সিরাজের ‘আপোষমূলক নীতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাবার প্রচেষ্টায়’ সন্তুষ্ট হয়ে বেগমের দল ছেড়ে সিরাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। শওকত জঙ্গ অবশ্য আরও অনেক শক্তিশালী ও বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নিজের তখ্ত বজায় রাখতে সিরাজ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হন ও তাঁকে পর্যুদস্ত করেন।
ইংরেজদের সঙ্গেও কিন্তু সিরাজদ্দৌল্লা প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেছেন। পরে একদিকে দৌত্যের মাধ্যমে ও অন্যদিকে অস্ত্রধারণ করে একটা মিটমাট করতে চেয়েছিলেন। একুশ বাইশ বছরের তরুণ এক নবাবের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি জ্ঞানবুদ্ধি আর কী আশা করা যেতে পারে? কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অধ্যক্ষ উইলিয়াম ওয়াটস, যিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের হাঁড়ির খবর পর্যন্ত রাখতেন, সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ক্ষমতা এবং ধনসম্পত্তির প্রাচুর্যে কিঞ্চিৎ বেসামাল’, বলে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা হয়তো সত্যের অনেকটা কাছাকাছি। কিন্তু পনেরো মাসের স্বল্প রাজত্বকালে সিরাজ কোনও পাগলামি, অর্বাচীনতা বা নিষ্ঠুরতার পরিচয় যে দেননি, ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ থেকে তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করা যায়। পাশাপাশি এটাও সত্য যে সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হিসেবে, দেশের শাসক হিসেবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেছেন। এদেশে ব্যবসা করতে এসে নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার মতো কোনও ঔদ্ধত্যকে তিনি সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। ওয়াটসের মতে সিরাজদ্দৌল্লা বিদেশি বণিকগোষ্ঠীর কাছে প্রত্যাশা করেছিলেন যে তারা নবাবের আদেশ বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে। কিন্তু তা বলে সিরাজ সর্বক্ষণ ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব দেখিয়েছেন, এমন কথা ঠিক নয়। যে তরুণ যুবা ‘উগ্র মেজাজ’ এবং ‘নির্মম নিষ্ঠুরতার’ জন্য কুখ্যাত, তিনি কিন্তু নবাব হওয়ার পরে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অবরোধ ও আত্মসমর্পণের পরে পরাজিত ইংরেজদের প্রতি ‘উদার মানবিকতার’ সঙ্গে ব্যবহার করেছেন১৭— এ তথ্য কাশিমবাজার কুঠির এক ইংরেজ কর্মচারীরই। কাশিমবাজারের ইংরেজ বিষয়-সম্পত্তির ওপর সিরাজ হাত পর্যন্ত দেননি, শুধু সেখানকার অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। ইংরেজদের সম্পূর্ণ অসহায় পেয়েও কোন লুঠতরাজ, হত্যা বা নিষ্ঠুরতার আশ্রয় কিন্তু সিরাজ নেননি। সিরাজ চরিত্র সম্বন্ধে ওয়াটসের মন্তব্য: ‘….in his own nature [Siraj was] timid to the last degree.’ স্ত্রী লুৎফুন্নেসার প্রতি সিরাজের গভীর ভালবাসা ও মদ্যপান না করার প্রতিশ্রুতি রক্ষার মধ্যে কিন্তু বদ্ চরিত্রের লক্ষণ কিছু পাওয়া পাওয়া যায় না।
.
সিরাজ-ইংরেজ বিরোধ
নবাব সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজদের মধ্যে যেসব বিশেষ ঘটনা বা নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে বিরোধ এবং যার ফলে শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে, সেগুলি ভাল করে বিশ্লেষণ করা দরকার, যাতে এ সংঘর্ষের প্রকৃত কারণগুলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সিরাজ নবাব হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ও ইংরেজদের পারস্পরিক স্বার্থের সংঘাতের ফলে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আসলে আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে সিরাজ ইংরেজ কোম্পানির বেশ কিছু কাজকর্মের প্রতিবাদ করেছিলেন কারণ এগুলির মাধ্যমে নবাবের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হচ্ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় এবং আলিবর্দির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের মসনদ নিয়ে বিরোধ অবধারিত ভেবে ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই প্রায় প্রকাশ্যে তাদের দুর্গগুলির সংস্কার ও সংহত করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিকে আলিবর্দির গুরুতর অসুস্থতা এবং অন্যদিকে দিল্লি থেকে মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী বাংলার বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য অভিযান করতে পারেন এমন আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সিরাজ আপাতত ইংরেজ ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন।১৮
ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হওয়ার সিরাজদ্দৌল্লার আরও গভীর কারণ ছিল। তিনি নবাব হওয়ার পর ইংরেজরা তাকে কোন উপঢৌকন বা নজরানা পাঠাননি বলে তাঁর ক্ষোভ হয়েছিল বলে যে বক্তব্য, তা মোটেই ঠিক নয়।১৯ প্রথম থেকেই তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে ইংরেজরা তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির বিরোধিতা করতে পারে এবং তারা মসনদের দাবিদার, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মদত দিচ্ছে। এ সন্দেহ কিন্তু একেবারে অমূলক নয়। বস্তুত ইংরেজরা প্রথম থেকে প্রায় ধরেই নিয়েছিল সিরাজের পক্ষে নবাব হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলায় ফরাসি কোম্পানির অধ্যক্ষ রেনল্ট বা কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’র লেখা এবং অন্যান্য বেশ কিছু ইউরোপীয় তথ্য থেকেও জানা যায় যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে একটা মতলব ভাঁজছিল এবং তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। রেনল্ট স্পষ্ট জানাচ্ছেন: ‘ঘসেটি বেগমের দলকে মসনদ দখলের দৌড়ে কেউ আটকাতে পারবে না এবং সিরাজদ্দৌল্লার পতন অনিবার্য, এই স্থির বিশ্বাসে ইংরেজরা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে [সিরাজের বিরুদ্ধে] চক্রান্ত শুরু করে।’২০ জাঁ ল’ও লিখেছেন যে অন্য অনেকের মতো ইংরেজরাও ভেবেছিল, ‘সিরাজদ্দৌল্লা কখনও নবাব হতে পারবেন না এবং তাই তারা কোনও কাজে তাঁর দ্বারস্থ হত না’।২১ তা ছাড়া মসনদের জন্য সিরাজের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের সঙ্গেও ইংরেজদের যোগাযোগ ছিল।২২ এসব দেখেই মনে হয় কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচার বলেছেন যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের ওপর রেগে যাওয়ার যথেষ্ট ইন্ধন যুগিয়েছিল।২৩
সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য তাঁর আত্মম্ভরিতা ও অর্থলিপ্সাই দায়ী বলে যে বক্তব্য তা কিন্তু মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তিনি যদি সত্যিই দাম্ভিক হতেন এবং তাঁর দাম্ভিকতাই যদি বিরোধের অন্যতম কারণ হত তা হলে তাঁর দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গকে পরাভূত করার পরই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থলিপ্সার অভিযোগও ভিত্তিহীন।২৪ আসলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের তিনটি নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। আমাদের কাছে যেসব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে সহজেই প্রমাণ করা যাবে যে এগুলি খুবই ন্যায়সঙ্গত এবং মোটেই ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য সিরাজের ‘মিথ্যা ওজর’ নয়। সিরাজের অভিযোগগুলি হল—(১) নবাবের বিনা অনুমতিতে ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও এটাকে দুর্ভেদ্য ও সুসংহত করার প্রচেষ্টা। (২) দস্তকের বেআইনি ও যথেচ্ছ অপব্যবহার। (৩) নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান। খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করার পর একটি চিঠিতে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ তিনটি অভিযোগের কথা স্পষ্ট করে জানান।২৫
.
কেল্লার সংস্কার
উপরোক্ত অভিযোগগুলিকে কেন্দ্র করেই যেহেতু সিরাজ-ইংরেজ বিরোধ ও সংঘাত, সেজন্য এগুলি আদৌ ভিত্তিহীন কি না তা সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে দেখা দরকার। কোম্পানির নথিপত্র ও কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকে স্পষ্ট যে, সব ইউরোপীয় কোম্পানিই এ সময় তাদের কেল্লাগুলিকে দুর্ভেদ্য ও সুসংহত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ১৭৪০-র দশকে মারাঠা আক্রমণের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানের দিকটাতে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) তৈরি করে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের চারদিকে গড়খাই (ditch) খনন করে। এর পরেও লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় নির্দেশ পাঠায় (১৬ জানুয়ারি ১৭৫২) যে ‘নবাবের অনুমতি নিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে’ ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা আরও শক্তিশালী করে তুলতে।২৬ অবশ্য ওই পরিচালক সমিতি ১৭৫৪ সালে ফোর্ট উইলিয়ামকে জানাচ্ছে, নবাবকে যেন বোঝানো হয় কেল্লা সুসংহত করার ‘মূল উদ্দেশ্য অন্য ইউরোপীয়দের হাত থেকে কোম্পানির বিষয়সম্পত্তি রক্ষা করা এবং বাংলায় শান্তি বজায় রাখা।’২৭ কোনও কোনও ঐতিহাসিক অবশ্য বলছেন২৮ ইংরেজরা ফরাসিদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার কেল্লা সুসংহত করছিল, কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল লন্ডনে লিখেছিল যে এর মূল উদ্দেশ্য ‘দেশীয় শত্রুদের [অবশ্যই নবাব] আক্রমণ প্রতিহত করা’।২৯ সুতরাং সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে ইংরেজরা বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অনুমতি না নিয়েই মূলত বাংলার নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা দুর্ভেদ্য করে তুলছিল। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং বাংলার মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মনে রেখে সিরাজদ্দৌল্লা স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজদের এ প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
এ বিষয়ে এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ:৩০
নবাব সুবাদার তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের স্বাধীন ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এদের মধ্যে ইংরেজরা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তারাই তাঁর ন্যায়সঙ্গত নীতির [just pol-icy] প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়ে।… এটা স্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লার প্রধান ও আসল উদ্দেশ্য ছিল [কলকাতার] কেল্লা ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করা।
এখানে এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা শুধু ইংরেজদের নয়, ফরাসিদেরও আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিক থেকে তাদের দুর্গগুলি সুরক্ষিত করার জন্য যেসব নির্মাণকার্য করেছিল, সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফরাসিরা বিনীতভাবে নবাবকে জানায় যে তারা দুর্গে নতুন কিছু নির্মাণ করেনি—ফলে ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেল। কিন্তু ইংরেজদের মনোভাব ছিল আক্রমণাত্মক ও অবজ্ঞাপূর্ণ, নবাবের কথায় তারা কর্ণপাতও করল না।৩১ হিল সাহেবও স্বীকার করেছেন, দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রশ্নে ইংরেজরা তাদের ‘অধিকারের সীমা লঙ্ঘন’ করেছিল এবং ‘নবাবের অনুমতি না নিয়েই’ বে-আইনিভাবে কেল্লা সুসংহত করেছিল।৩২ সুতরাং এটা অবশ্যই বলা যায় যে এ-ব্যাপারে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, এটাকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর ‘মিথ্যা ওজর’ বলে নস্যাৎ করা যায় না।
.
দস্তকের অপব্যবহার
দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ও বে-আইনি অপব্যবহার সম্বন্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। কোম্পানির নথিপত্রেই অসংখ্য প্রমাণ আছে যে কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল। এই দস্তকের সাহায্যে তারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের (private trade) ক্ষেত্রে বাণিজ্যশুল্ক ফাঁকি দিত না, এমনকী এ দস্তক তারা এশীয় বণিকদের কাছেও বিক্রি করত। ফলে এশীয় বণিকরাও ওই দস্তক দেখিয়ে তাদের পণ্যের জন্য কোনও শুল্ক দিত না এবং তাতে রাজ্যের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হত। কারণ এতে করে বাণিজ্য শুল্ক বাবদ ন্যায্য প্রাপ্য রাজস্ব থেকে রাজ্য বঞ্চিত হত। কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখেছেন: ‘কী লজ্জাকর বেশ্যাবৃত্তিই না চলছে দস্তক নিয়ে’।৩৩ এভাবে নবাব সরকারের যে রাজস্বহানি হচ্ছিল সিরাজ স্বাভাবিকভাবেই তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা লেখক জানাচ্ছেন:৩৪
সিরাজদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্য দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
এমনকী এস. সি. হিলও স্বীকার করেছেন যে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যেসব সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর অপব্যবহার সম্বন্ধে এটা বলতেই হবে যে ইংরেজরা যেভাবে দস্তকের ব্যবহার করেছে, তা [ফারুখশিয়রের] ফরমানে কখনওই বলা হয়নি। এই ফরমান শুধু কোম্পানিকেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধে দিয়েছিল কিন্তু ইংরেজরা এই দস্তক দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যও শুল্কমুক্ত করে দিত।৩৫ সুতরাং ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ যথার্থ, একে তাঁর ‘মিথ্যা অজুহাত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
.
নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান
নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবেরই অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয় দিয়ে নবাবকে অগ্রাহ্য করার প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। নবাব আলিবর্দি খানও এরকম অবৈধ ও বেআইনি আশ্রয়দানের জন্য কয়েকবার জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।৩৬ কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানের পেছনে ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। কৃষ্ণদাস রাজবল্লভের পুত্র আর রাজবল্লভ ছিলেন ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদের ঘনিষ্ঠ কর্মচারী এবং সে সুবাদে ঘসেটি বেগমের দলভুক্ত। রাজবল্লভের বিরুদ্ধে সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগ ছিল এবং সেটা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। রাজবল্লভ ভয় পেয়ে ওয়াটসকে অনুরোধ করেন কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য । ওয়াটসের ধারণা হয়েছিল ঘসেটি বেগমের দল, যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভ, মসনদ দখলের লড়াইয়ে নিশ্চিত সাফল্য লাভ করবে। তাই তিনি কলকাতার গভর্নর রজার ড্রেককে (Roger Drake) লেখেন কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দিতে কারণ ‘রাজবল্লভকে ইংরেজদের কাজে লাগে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি লাগতে পারে’।৩৭ কৃষ্ণদাস সপরিবারে ৫৩ লক্ষ টাকার ধনরত্ন নিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন আলিবর্দির মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে।৩৮ এরপরে কিন্তু ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই এবং ড্রেককে লেখেন যে কৃষ্ণদাসকে এ অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন নয়। ড্রেক তাতে কর্ণপাতও করেননি।৩৯ কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও অবজ্ঞা করেনি, মসনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিরাজের যে বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে নবাবের অপরাধী প্রজাদের অন্যায়ভাবে কলকাতায় আশ্রয়দানের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজের যে অভিযোগ তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।
সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে সংঘর্ষ এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের (জুন ১৭৫৬) আগের যে ঘটনাবলি তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে কলকাতার ইংরেজদের কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব এ সংঘর্ষকে অপরিহার্য করে তোলে। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমাদের বক্তব্যের প্রচুর সমর্থন পাওয়া যাবে। এ সংঘর্ষ বাধার তিনদিন আগে পর্যন্ত সিরাজ কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে একটা আপস মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পাঠানো দূত নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদের দৌত্য নিস্ফল হল মূলত গভর্নর ড্রেকের ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের জন্য। ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করেন। ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করার পর নবাব কলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন।৪০ এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষ করে নবাবের দূত নারায়ণ সিংকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করা নিয়ে, কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচার যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:৪১
Could it be ever imagined any Prince would suffer a set of merchants to protect from him any of his subjects, much less a man who had enjoyed a considerable post under the government or would tamely put up with the insult to his messenger? …turning the messenger away will be construed an insult by the whole world.
.
অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’
প্রাক্-পলাশি বাংলায় অভ্যন্তরীণ সংকট প্রসঙ্গে যে বক্তব্য তাঁর আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমে রাজনৈতিক সংকট। সত্যিই কি এমন কোনও সংকট দেখা দিয়েছিল? আমাদের উত্তর, মোটেই না। সাধারণভাবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নিজামতের সঙ্গে ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণি, ভূস্বামী ও অভিজাতবর্গের যে নতুন শ্রেণিবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল তা সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়ার পরে একেবারে ভেঙে পড়ে কারণ তিনি তাঁর ব্যবহারে ওইসব শ্রেণির লোকজনদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলেন। এর ফলেই রাজনৈতিক সংকট। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই শক্তিজোটকে একটি মজবুত ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা বা একে একটি বিশিষ্ট শক্তিসংঘ হিসেবে গণ্য করা মোটেই ঠিক হবে না। এটি ছিল স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তির একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল—কোনও বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জোট নয়। এটা মনে রাখা দরকার যে নিজামতের দিক থেকে উক্ত ব্যক্তিসমষ্টিকে (যা শ্রেণিনির্ভর নয়) ক্ষমতার অংশীদার করে নেবার কোনও সচেতন প্রচেষ্টা ছিল না। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় যে বড় বড় জমিদার বা বড় বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীর উদ্ভব, তা নবাবদের এই উদ্দেশ্যে অনুসৃত কোনও নীতির ফল নয়— এটা মুর্শিদকুলির শাসনতান্ত্রিক ও রাজস্বনীতির সংস্কারের পরোক্ষ ফল। তা ছাড়া, এই তথাকথিত জোটবন্ধন একেবারেই শ্রেণিভিত্তিক নয়— ফলে এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। আবার এ শক্তিজোট একেবারে অখণ্ড এবং নিশ্ছিদ্র কোনও সংগঠনও নয়। বারে বারে তার মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। তাই সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর ‘নতুন শ্রেণিগত জোটবদ্ধতা’ ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়— এ বক্তব্য খুব সমীচীন বলে মনে হয় না।৪২
ঠিক এমনি ভাবেই দেখানো যায় যে প্রাক্-পলাশি বাংলায় কোনও অর্থনৈতিক সংকটও ছিল না। এ সময় বাংলার শিল্পবাণিজ্যে যে অবক্ষয়ের কথা বলা হয় তা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। মধ্য অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকরা যে বিপুল পরিমাণ পণ্য রফতানি করেছে তা থেকে এটা স্পষ্ট যে মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিল্পবাণিজ্য খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা তাঁর দীর্ঘস্থায়ী কোনও প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি। এটা ঠিকই, ১৭৪০-র দশকের শেষদিকে ও ৫০-র দশকের প্রথমদিকে ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্য কিছুটা কমে যায়। তবে সেটা বাংলার শিল্পবাণিজ্যে সংকটের জন্য নয়, কোম্পানির নিজস্ব সমস্যার জন্য। এ প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, এতদিন বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের কোনও ধারণা আমাদের ছিল না, ফলে এটাকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। ইদানীং আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পেরেছি যে এ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, ইউরোপীয়দের সম্মিলিত বাণিজ্যের চেয়ে অনেক বেশি।৪৩ তাই যে সময় বাংলা থেকে এশীয় ও ইউরোপীয়রা এত বিশাল পরিমাণ পণ্য রফতানি করছে, সে সময় শিল্পবাণিজ্যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল, এ কথা মানা যায় না।
তা ছাড়া পলাশির প্রাক্কালে বাংলার ব্যাঙ্কিং-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আর্থিক দূরবস্থার মধ্যে পড়ে বলে যে বক্তব্য তাও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। আমরা দেখিয়েছি যে এ-সময় ওই গোষ্ঠীর বেশ শ্রীবৃদ্ধিই হয়েছিল। বাংলার তিন বণিকরাজার—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও আর্মানি খোজা ওয়াজিদ— আর্থিক সমৃদ্ধি তখন তুঙ্গে। তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে একদিকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে চলেছিলেন, অন্যদিকে বাংলার বস্ত্র ও রেশমশিল্পে লিপ্ত ব্যবসায়ীদের অর্থ সরবরাহ করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের মহাজনি ব্যবসার তখন রমরমা। সব ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করার জন্য নগদ টাকার অভাব মেটাতে বণিকরাজা ও অন্য মহাজনদের কাছে নিয়মিত টাকা ধার করত।৪৪ এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় ব্যাঙ্কার ব্যবসায়ীদের আর্থিক দুর্গতির কথা মেনে নেওয়া কঠিন।
আবার মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলায় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল বলে যে ধারণার ওপর এখন জোর দেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছি যে প্রাক-পলাশি বাংলায় মূল্যস্তর এমন কিছু বাড়েনি যাতে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল এটা বলা যায়। প্রায় কুড়ি বছরের কাপড়ের দামের যথাযথ বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছি যে ১৭৩০ থেকে ১৭৫০-র প্রথমদিক পর্যন্ত বেশির ভাগ কাপড়ের দামই তেমন কিছু বাড়েনি, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম কমেছে। কাঁচা রেশমের দামে যদিও ওঠা-পড়া লক্ষ করা গেছে, ক্রমাগত ও নিয়মিত দাম বেড়েছে, এমন কথা কোনওমতেই বলা যায় না। চালের দামের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে— বছরের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কারণে দাম কখনও বেড়েছে, কখনও কমেছে কিন্তু সাধারণভাবে চালের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে চলেছে এমন কিছু কিন্তু চোখে পড়ে না। তাই পলাশির আগে বাংলায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল এমন বক্তব্য সম্পূর্ণ অসার।৪৫
‘কোলাবোরেশন থিসিসও’ কিন্তু অচল। এটা যুক্তিগ্রাহ্য হত যদি দেখানো যেত যে মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলার ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী-মহাজনদের সমৃদ্ধি ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। তা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। আমরা অন্যত্র৪৬ দেখিয়েছি যে ওই সময় ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করেছিল এবং তাই তারা-ই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করেছিল, এ বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ইউরোপীয়দের তুলনায় এশীয়/ভারতীয় বণিকদের বাংলা থেকে পণ্য রফতানির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, ফলে তারা-ই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ আমদানি করেছিল, ইউরোপীয়রা নয়। সুতরাং বলা যেতে পারে যে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের সমৃদ্ধি বহুলাংশেই নির্ভর করত এশীয়দের বাণিজ্যের ওপরেই, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ওপর নয়। তাই বাংলার ব্যাঙ্কার-বণিকদের স্বার্থ ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল এটা কিছুতে বলা যায় না। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা অনেকটা পরিষ্কার হবে। বাংলার অন্যতম প্রধান বণিকরাজা জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০ লক্ষ টাকার মতো। তার মধ্যে খুব বেশি করে ধরলেও ১৫ লক্ষ টাকার মতো আয় হত ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকার ফলে। অর্থাৎ শতকরা ৩৩ ভাগের মতো। বাকিটা অবশ্যই এশীয় বাণিজ্যের সঙ্গে সংযুক্তির ফলে।৪৭ তাই ‘কোলাবোরেশন’ থিসিসের মূল যে প্রতিপাদ্য— বাংলার ব্যাঙ্কার-বণিক-মহাজন, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাতবর্গের ভাগ্যের সঙ্গে ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে ইংরেজদের, ভাগ্য ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে দেবেন এই ভয়ে ওরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব ঘটাতে বাধ্য হয়— তা ধোপে টেঁকে না।
পরিশেষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজ। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে অনেক ইউরোপীয়ই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিল এবং এ জয় অনায়াসলভ্য বলে মনে করত।৪৮ সুতরাং বাংলা বিজয় যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন সে অবাধ বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণে যদি তারা বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজের চেহারা খুঁজে বার করতে ব্যগ্র হয়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ প্রেক্ষিতে প্রাক-পলাশি সময়ে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে বক্তব্য তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে যেটা মনে রাখা প্রয়োজন তা হল, পলাশি শুধু হিন্দুদের দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব নয়— হিন্দুরাই শুধু মুসলমান নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেনি। হিন্দু-মুসলমান-জৈন-আর্মানি সব সম্প্রদায়ের লোকই এতে লিপ্ত হয়েছিল। তবে পলাশি বিপ্লব মূলত ইংরেজদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, যাতে তারা শাসকশ্রেণির একটি শক্তিশালী অংশকে— যার মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি মুসলমানও— সামিল করতে পেরেছিল। বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আরও দুটি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল— ১৭২৭ এবং ১৭৩৯/৪০ সালে, যখন শাসকগোষ্ঠীর দুই সম্প্রদায়েরই অভিজাতবর্গ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থানুযায়ী ও অভিপ্রায় অনুসারে নবাবের পক্ষে বা বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়। সুতরাং এ দুটি বিপ্লবের সময় যদি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও প্রশ্ন না উঠে থাকে, তা হলে ১৭৫৬/৫৭ সালেও সে প্রশ্নের অবতারণা অবান্তর।
পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হত, তা হলে সমসাময়িক সাহিত্য ও ফারসি ইতিহাস গ্রন্থে তা অবশ্যই প্রতিফলিত হত। কিন্তু সেরকম কোনও নির্দিষ্ট ইঙ্গিত তখনকার সাহিত্য বা ইতিহাসবেত্তার লেখায় দেখা যায় না। সমাজের উঁচুতলায় কিছুটা টানাপোড়েন নিশ্চয় থাকতে পারে, শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতেই পারে কিন্তু সেগুলি হিন্দু-মুসলমান এই বিভেদমূলক চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়। তার মূল শ্রেণিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের সংঘাত। বাংলায় এই দুই সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলে আসছিল, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তার পরিপূর্ণ রূপ দেখা যায়। এ সময় মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে— এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম সংস্কৃতির সমন্বয় প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র সৃষ্টি- যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। কবি ভারতচন্দ্রের ‘সত্যপীর’ কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।৪৯ এডওয়ার্ড সি ডিমক (Edward C. Dimmock, Jr) একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে মধ্যযুগের (পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত) বাংলা সাহিত্য পড়ে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষের’ পরিচয় পাওয়া দুষ্কর।৫০ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার চমৎকার নিদর্শন অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে কবি ফৈজুল্লার ‘সত্যপীর’ কবিতা, যেখানে ‘যে রাম সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তি সোচ্চার।৫১ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও পরিচয় মেলে না।
তা ছাড়া এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে আলিবর্দি তথা সিরাজদ্দৌল্লার সময় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রাক্-পলাশি বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কথা বলা হয়। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও হল্যান্ডের হেগ শহরের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) ঠিক পলাশির আগে বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা আমি পেয়েছি। প্রথমটিতে (রবার্ট ওরম-এর তালিকা) দেখা যাচ্ছে আলিবর্দির সময় (১৭৫৪-তে) দেওয়ান, ‘তান-দেওয়ান’, ‘সাব দেওয়ান’, বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুদের দখলে, একমাত্র মুসলমান বক্সি হল মীরজাফর। আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু।৫২ দ্বিতীয় তালিকাটি বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুমের (Jan Kerseboom)। সেই তালিকাতেও নায়েব দেওয়ান রায় রায়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদের একচ্ছত্র প্রাধান্য।৫৩ ১৭৫৪/৫৫ সালের এই যে চিত্র, সিরাজদ্দৌল্লার সময় তা আরও স্পষ্ট হয়। তরুণ নবাবের ডানহাত ও সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসভাজন ছিলেন মোহনলাল। বস্তুতপক্ষে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রাজ্যের প্রশাসনিক শাসনযন্ত্রে হিন্দুপ্রাধান্য এত বেশি ছিল যে তা দেখে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেন:৫৪
The Gentoo (Hindu) connection became the most opulent influence in his [Alivardi’s] government of which it pervaded every department with such efficacy that nothing of moment could move without their participation or knowledge.
ওপরের সব তথ্য বিচার করে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সোজাসুজি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েনি।
.
পলাশি কার চক্রান্ত?
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক কে বা কারা? মীরজাফরই শুধু বিশ্বাসঘাতক বলে জনমানসে এখনও যে ধারণা বহুল প্রচারিত, তা ঐতিহাসিকভাবে কতটা সত্য? পলাশি কি শুধু ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র, এতে ইংরেজদের কি কোনও ভূমিকা ছিল না? এখানে অবশ্য বলে নেওয়া প্রয়োজন যে মীরজাফর, জগৎশেঠ প্রমুখ শেষ পর্যন্ত পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিলেন এবং নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের হাতে এমন তথ্যপ্রমাণ আছে যা থেকে স্বচ্ছন্দে বলা যায় যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই, সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তারাই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং তারাই দরবারের চক্রান্তকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের দিন পর্যন্ত তারা স্থানীয় ষড়যন্ত্রীদের নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যাতে দরবারের ওইসব অভিজাতবর্গ শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আমাদের এ-বক্তব্যকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষস্খালনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করছিল, এটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু যে বক্তব্যে আমরা জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত, ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ ষড়যন্ত্র পূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র ও কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমরা সেটা পরে দেখাব— তা থেকে স্পষ্ট হবে কী ভাবে ইংরেজরা পরিকল্পিতভাবে সমস্ত ব্যাপারটা সংগঠিত করেছিল।
পলাশির ষড়যন্ত্রে মুর্শিদাবাদ দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মীরজাফর ও জগৎশেঠ, যদিও উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখও এতে জড়িত ছিলেন। তাই মীরজাফরই একমাত্র ‘বিশ্বাসঘাতক’, এটা সত্য নয়। জগৎশেঠের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজরা প্রথমে সিরাজদ্দৌল্লার জায়গায় নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফ খানকে বসাবার মতলব করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জগৎশেঠদের মনোনীত প্রার্থী মীরজাফরের দিকে ঝুঁকল কারণ তারা জানত জগৎশেঠদের সাহায্য ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব নয়। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ (Jean Law), যিনি দরবারের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতেন, পরিষ্কার লিখেছেন যে ‘ইংরেজরা যা করেছে [পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব] তা জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া তারা করতে কখনও ভরসা পেত না’।৫৫ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসঘাতকার দায় শুধু মীরজাফরের নয়— জগৎশেঠদের দায় মীরজাফরের চাইতে বেশি বই কম নয়।
আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পেছিয়ে গেলেই দেখা যাবে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব কটা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই সময়কার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদেরই হাতে। জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘অনেকদিন ধরে বাংলায় যেসব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিলেন তাঁরাই [জগৎশেঠরা]।’৫৬ ক্লাইভের লেখা চিঠিপত্র পড়েও সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে পলাশি চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদত পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।৫৭ তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ‘মোহনলাল যদি সুস্থ থাকতেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা-রহিত না হতেন, তা হলে জগৎশেঠদের চক্রান্ত অত সহজে সফল হত না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, মোহনলাল কিছুদিন ধরে এবং বিশেষ করে চরম বিপদের এই মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন’। ল’ মনে করতেন যে মোহনলাল জগৎশেঠদের পরম শত্রু এবং তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারার মতো একমাত্র ব্যক্তি।৫৮ মুজাফ্ফরনামার লেখক করম আলির সন্দেহ, মোহনলালকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।৫৯
.
কেন এই চক্রান্ত?
যদিও ইংরেজরা পলাশি চক্রান্ত ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল, যে প্রশ্ন আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং যা এখনও পর্যন্ত কেউ করেননি৬০ তা হল এ চক্রান্ত ও বিপ্লব ইংরেজদের পক্ষে এত জরুরি হয়ে পড়েছিল কেন? তার প্রধান কারণ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা। সমসাময়িক নথিপত্র ও দলিলদস্তাবেজ পরীক্ষা করে দেখলে বাংলা বিজয় সম্বন্ধে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটা স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাবে। এসব কর্মচারীরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে— ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি প্রচুর ধনোপার্জন করে দেশে ফিরে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। বাংলায় কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা ছিল ১৭৩০-র দশক ও ’৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তারপরে ৪০-র দশকের শেষদিক থেকে ৫০-র দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। এর কারণ একদিকে ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যে এসময় অভাবনীয় উন্নতি এবং অন্যদিকে হুগলির আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিস্তার। ফরাসিদের সঙ্গে আবার ওয়াজিদের বোঝাপড়া থাকার ফলে ইংরেজরা খুব অসুবিধের মধ্যে পড়ে যায় এবং তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই বাংলা বিজয় করতে চেয়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির চক্রান্ত ও বিপ্লব ইংরেজদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
১৭৫০-র দশকের প্রথমদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা যে নিদারুণ সংকটে পড়ে তা কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম৬০, কলকাতার এক ইংরেজ বাসিন্দা ক্যাপ্টেন ফেনউকের৬১ লেখা ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের আলাপ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তা ছাড়াও ডাচ কোম্পানির নথিপত্রে বাংলায় আসা-যাওয়া করা জাহাজের যে তালিকা পাওয়া যায় তা থেকে আমাদের বক্তব্যের পরিসংখ্যানগত সাক্ষ্য মেলে। ১৭৫৪ সালে যেসব ইংরেজ জাহাজ বাংলার বন্দরে এসেছিল তাঁর মোট সংখ্যা ২০। এর মধ্যে ১২টি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ আর মাত্র ৮টি যারা ব্যক্তিগত ব্যবসা করত তাদের। অন্যদিকে ওই বছরই বাংলায় ফরাসি জাহাজ এসেছিল ২৭টি— তাঁর মধ্যে ২২টিই ব্যক্তিগত ব্যবসাতে লিপ্ত, আর মাত্র ৫টি ফরাসি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ। আবার টানেজের (tonnage) হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে ১৭৫১ সালে ইংরেজ জাহাজের মোট টানেজ ছিল ৭৪২০ টন, তার মধ্যে ৫০২০ টন ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসার আর ১৭৫৪-তে ফরাসি জাহাজের টানেজের পরিমাণ ছিল ১০,৪৫০ টন, এর মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত জাহাজের টানেজের পরিমাণ ৭৪৫০ টন।৬২ এই পরিসংখ্যান থেকেও এটা সুস্পষ্ট যে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের যে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তার ফলে ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়।
সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পরে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা আরও বেশি সংকটের মুখে পড়ে কারণ এই প্রথম তরুণ নবাব ইংরেজদের দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দেন যে তিনি এই বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কর্মচারীরা তাদের এই লাভজনক ব্যবসা ছাড়তে একেবারেই নারাজ ছিল। তাই তারা তাদের সংকটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য-স্বার্থকে পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ও অন্যদিকে নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা করে। এজন্য রাজ্য জয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন হয়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। তাতে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট দূর করা সম্ভব হবে তা শুধু নয়— উৎপাদনক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজার-হাট, ব্যবসায়ী-সওদাগর, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। একথা শুধু যে পশ্চাৎ-সমীক্ষাতে (hindsight) ধরা পড়েছে তা নয়। কোম্পানির লেখা ও কাজকর্মের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কর্নেল স্কটের (Colonel Scott) বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা (১৭৫২), ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড ও ম্যানিংহামের (Frankland and Manningham) ক্লাইভকে লেখা চিঠি (১৭৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যাতে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্রমাবনতির কথা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে), কোম্পানির পণ্য সরবরাহে দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন (১৭৫৩), নবাবের প্রতি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল ও গভর্নর ড্রেকের অনমনীয় ও মারমুখো মনোভাব—এসবই ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তার নির্দেশক। মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলী কী হবে তা কলকাতার সিলেক্ট কমিটির বৈঠকে আলোচনার সময় রিচার্ড বেচার (Richard Becher) জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা চুক্তির শর্তাবলিতে রাখতেই হবে কারণ ‘তারাই পুরো ব্যাপারটা [নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা] চালু করেছিল’।৬৩ এসব থেকে ইংরেজদের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না।
.
পলাশি চক্রান্তে ইংরেজদের ভূমিকা
পলাশি-প্রাক্কালের ঘটনাবলি এবং আমাদের কাছে এখন যেসব নতুন তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে দেখানো যাবে যে ইংরেজরাই পলাশির মূল ষড়যন্ত্রকারী। সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা দখল করে (জুন ১৭৫৬) ইংরেজদের তাড়িয়ে দেবার পর ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) কাউন্সিল ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠায়। কাউন্সিল তাঁদের যে নির্দেশ দেয় (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) তার মধ্যেই পলাশি চক্রান্তের বীজ নিহিত ছিল বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। এ নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং নবাবের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়ই’ শুধু অভিযাত্রী দলের উদ্দিষ্ট হবে না। তাদের চেষ্টা করতে হবে ‘to effect a junction with any powers in the province of Bengal that might be dissatisfied with the violence of the nawab’s gov-ernment or that might have pretensions to the nawabship’.৬৪ শেষদিকের অংশটুকুর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, এতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর দরবারের মধ্যে যে অসন্তোষ ছিল তা দিয়েই, ক্লাইভের ভাষায়, ‘ইংরেজরা রাজনীতির দাবাখেলায় বাজিমাৎ’ করেছিল৬৫ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল।
নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে ঠিকই কিন্তু ষড়যন্ত্র দানা বাঁধার পক্ষে এবং তা সফল করতে আরও পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন ছিল। সেজন্যই দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা ইংরেজদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল। অংশত তার জন্যই ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের চিঠি (৩১ জানুয়ারি) থেকে তা সুস্পষ্ট।৬৬ ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে যখন ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ নিয়ে ব্যস্ত, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘জগৎশেঠ পরিবার আমাদের পক্ষ যাতে সমর্থন করে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা’ চালিয়ে যেতে।৬৭ ইংরেজরা যে দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে শুধু আগ্রহী নয়, ব্যস্ত হয়েও পড়েছিল তা ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালসকে (John Walsh) লেখা স্ক্র্যাফ্টনের ৯ এপ্রিলের চিঠিতে সুস্পষ্ট। তিনি লিখছেন:৬৮
ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে…· মি. ওয়াটসকে এ-ব্যাপারে একটু ইঙ্গিত ও কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন…·. এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে আমার প্রিয় পুরনো পরিকল্পনাটি [my old favourite scheme] সফল হতে পারে।
স্ক্র্যাফ্টন আবার ১৮ এপ্রিল ওয়ালসকে লিখছেন, ইয়ার লতিফ খানকে নতুন নবাব হিসেবে বসাবার প্রস্তাব দিয়ে, যেটা ওয়াটস ও উমিচাঁদ মিলে চেষ্টা করছিলেন।৬৯ ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখা ২৬ এপ্রিলের চিঠিতে এ পরিকল্পনা সমর্থন করলেন। এদিকে ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার প্রস্তাব সরকারিভাবে গৃহীত হল। আবার ওই একই দিনে ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ জানালেন, স্ক্র্যাফ্টন যাতে মুর্শিদাবাদে থাকতে পারেন তাঁর অনুমতি দেবার জন্য কারণ ওখানে স্ক্র্যাফ্টনের ওপর কিছু জরুরি কাজের ভার দিতে হবে।৭০ এ কাজটা ‘যে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা’ তা অনুমান করে সিলেক্ট কমিটি ক্লাইভের অনুরোধে রাজি হয়ে গেল। কমিটি ২৮ এপ্রিল সিদ্ধান্ত নিল, ক্লাইভ যেন ‘দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নবাবের প্রতি মনোভাব এবং এ নবাবকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য উপযুক্ত লোককে নিয়োগ করেন’।৭১ সে অনুযায়ী ওয়াটস ও স্ক্রাফ্টন ‘ইংরেজদের পরিকল্পনায়’ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যবর্গের সমর্থন লাভের কাজে উঠে পড়ে লেগে গেলেন।
ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম লিখেছেন যে নবাবের দরবারে অভিজাতবর্গের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের পরিমাপ করতে ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর পরই উমিচাঁদ নবাবের উচ্চপদস্থ অমাত্যদের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে দেন।৭২ ফলে ২৩ এপ্রিল ইয়ার লতিফ খান ওয়াটসের সঙ্গে গোপন আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওয়াটস তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে উমিচাঁদকে নবাবের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতির সঙ্গে কথা বলতে পাঠান। ইয়ার লতিফ উমিচাঁদের কাছে তাঁর নবাব হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেন এবং জানান যে রায়দুর্লভ ও জগৎশেঠরা তাঁকে সমর্থন করবেন। ওয়াটস এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেন এবং ক্লাইভকে জানিয়ে দেন। ক্লাইভও তাঁর সম্মতি জানিয়ে দিলেন। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে লতিফ সম্বন্ধে ক্লাইভের কোনও ধারণাই ছিল না। তাঁর সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না, ইয়ার লতিফ হিন্দু না মুসলমান তা পর্যন্ত নয়। তাই এর ঠিক দু’দিন পরে (২৮ এপ্রিল) তিনি ওয়াটসকে লিখলেন: ‘লতিফ কেমন লোক আপনি ভাল করে খোঁজ নিন। উনি কি মুসলমান? ওঁকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা, আফগানরা এলে তা ভেস্তে যাবে না তো? লতির সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ আছে?’৭৩ এ থেকে স্পষ্ট যে ইংরেজরা বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর জন্য এতই ব্যগ্র হয়ে পড়েছিল যে হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই সিরাজের জায়গায় নবাব করতে চেয়েছিল। তিনি কেমন ব্যক্তি, ভাল কি মন্দ, তা নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি।
এমনি সময় মসনদের জন্য আরেকজন প্রার্থী, মীরজাফর, রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হন। যদিও রবার্ট ওর ম বলছেন যে মীরজাফর কলকাতার আর্মানি বণিক খোজা পেক্রসের মাধ্যমে তাঁর প্রস্তাব ইংরেজদের কাছে পাঠান, ওয়াটস নিজে তাঁর পিতাকে পরে লিখেছিলেন যে তিনি ‘নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ’ করেন। তিনি এটাও জানান যে মীরজাফর ‘খুব আগ্রহভরে আমার প্রস্তাবে সায় দেন এবং আমাদের সহায়তায় নবাব হওয়ার বিনিময়ে যে কোনও যুক্তিসঙ্গত শর্তাবলিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হন’।৭৪ খুব সম্ভবত ইংরেজরা হয়তো বুঝতে পেরেছিল, শুধু ইয়ার লতিফের নাম দিয়ে তারা তাদের ‘কঠিন কার্যোদ্ধার’ করতে পারবে না। তাই তারা ইয়ার লতিফকে নবাব করার পূর্ব পরিকল্পনা বাতিল করে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ মীরজাফর শুধু সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সৈন্যাধ্যক্ষই নন, তাঁর পেছনে রয়েছে জগৎশেঠদের সক্রিয় সমর্থন।৭৫ কলকাতায় সিলেক্ট কমিটিও মীরজাফরকে নতুন নবাব করার সিদ্ধান্ত নিল এবং ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দিল।
কিন্তু ষড়যন্ত্রের তখনও অঙ্গুরাবস্থা এবং ইংরেজরা মীরজাফরের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিল না। মীরজাফরও তখন পর্যন্ত যড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হননি। তাই ক্লাইভ ২ মে ওয়াটসকে লিখছেন: ‘মীরজাফরকে যেন আশ্বস্ত করা হয় যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবং ক্লাইভ নিজে তাঁর একজন সৈন্যও জীবিত থাকতে মীরজাফরকে পরিত্যাগ করবেন না।’৭৬ এদিকে সিলেক্ট কমিটিও অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং ১৭ মে স্ক্র্যাফ্টনকে নির্দেশ দেয় মীরজাফরের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করে:
আমাদের পরিকল্পনাকে কী ভাবে রূপায়িত করা যায় তার একটা ছক তৈরি করতে, আমাদের দাবিগুলো যে এমন কিছু বেশি নয় তা তাকে ভাল করে বোঝাতে… এবং আমাদের কথার যে নড়চড় হয় না ও তাঁকে নবাব করতে যে আমরা বদ্ধপরিকর সে সম্বন্ধে তাকে নিশ্চিন্ত করতে।৭৭
এটা থেকেই স্পষ্ট যে ইংরেজরা কী পরিমাণ প্রলোভন এবং আশ্বাস দিয়ে মীরজাফরকে দলে টানার চেষ্টা করছিল। ক্লাইভের অস্থিরতাও বিন্দুমাত্র কম ছিল না। তাই তিনি ২২ মে ওয়াটসকে লিখছেন মীরজাফরকে জানাতে যে ‘তিনি যদি সিরাজকে হঠাতে সাহস করে স্থিরসংকল্প হন তা হলে ক্লাইভ শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশে থাকবেন।’৭৮ পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লিখছেন যে বর্ষা এগিয়ে আসছে এবং তা শুরু হয়ে গেলে বিপ্লব ঘটাবার এ-সুযোগ বরাবরের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে।৭৯ অর্থাৎ বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি রূপায়িত করা যায় তার জন্য ক্লাইভের ছটফটানি।
এদিকে মীরজাফরের সঙ্গে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়াতে ওয়াটস প্রায় ক্ষেপে যান। মীরজাফর পলাশি থেকে ফিরে ৩০ মে থেকে মুর্শিদাবাদে ছিলেন। তা সত্ত্বেও ওয়াটস মীরজাফরের সঙ্গে কোনও চুক্তি সম্পাদন করতে পারেননি। অনুমান, তার জন্য মীরজাফরের কিছুটা অনীহা। তাই অত্যন্ত বিরক্ত ও হতাশ হয়ে ওয়াটস ৩ জুন লিখছেন: ‘এসব অস্থিরচিত্ত, মিথ্যাচারী, মেরুদণ্ডহীন বদলোকের ওপর নির্ভর না করে আমরা নিজেরাই সবকিছু করলে পারতাম।’৮০ ব্যাপারটা নিয়ে লোকে বলাবলি করছে দেখে ক্লাইভও চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে ওয়াটস ৫ জুন মীরজাফকে দিয়ে লাল ও সাদা কাগজে দুটি চুক্তি সই করাতে সক্ষম হলেন। লাল কাগজের চুক্তিটি, যাতে নবাবের কোষাগারের পাঁচ শতাংশ উমিচাঁদের প্রাপ্য বলে বলা হল সেটি নিছক প্রবঞ্চনামাত্র। এতে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সই ক্লাইভের জ্ঞাতসারেই জাল করা হয়েছিল বলে যে সন্দেহ করা হয়, তা খুব অমূলক নয়।৮১ নবাব পদে উমিচাঁদের মনোনীত প্রার্থী ইয়ার লতিফকে বাদ দেওয়ার ফলে উমিচাঁদ নবাবের সম্পত্তির যে ভাগ চেয়েছিলেন, তা ফাঁকি দেওয়ার জন্যই ক্লাইভের এই চাতুরি। এদিকে রায়দুর্লভ সাদা কাগজের চুক্তি সম্বন্ধেও আপত্তি জানালেন এই বলে যে চুক্তির চাহিদা মেটাবার মতো অর্থ নবাবের কোষাগারে নেই। নবাবের সম্পদের পাঁচ শতাংশ তাকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করা হল।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরেও কিন্তু সিলেক্ট কমিটি তাদের বিপ্লবের পরিকল্পনা তাড়াতাড়ি রূপায়ণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তাই কমিটি ১১ জুন বিস্তারিত আলোচনা করল, ‘তখনই সোজা মুর্শিদাবাদ অভিযান করা সমচিত হবে, না মীরজাফরের কাছ থেকে আরও বিস্তারিত খবর এবং কার্যোদ্ধারে কী ভাবে অগ্রসর হবে তার একটা খসড়া পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে’। কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব নিল যে ‘মীরজাফরকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা সেটা সম্পন্ন করার জন্য এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না’। কারণ আর দেরি করলেই সিরাজদ্দৌল্লা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি জেনে ফেলতে পারেন। তখন মীরজাফরকে একেবারে সরিয়ে দেওয়া হবে এবং ফলে ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে’। ইংরেজদের তখন ‘দেশের সংঘবদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে একাই লড়তে হবে’ আর তা হলে ইংরেজদের পরাজয় অনিবার্য।৮২ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্লাইভ ১৩ জুন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন।
ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদ অভিযান শুরু করেন তখনও পর্যন্ত কিন্তু মীরজাফরের কাছ থেকে শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাঁর সঙ্গে মীরজাফরের সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। ১৮ জুন তিনি কাটোয়া দখল করলেন। সেখানে ‘দারুণ অস্বস্তির মধ্যে’ দু’দিন কাটান। তিনি সিলেক্ট কমিটিকে জানালেন যে মীরজাফরের কাছ থেকে স্পষ্ট সংকেত না পেয়ে তিনি ‘খুবই উদ্বিগ্ন’। তিনি আরও লিখলেন যে, মীরজাফর ইংরেজদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও যেভাবে তিনি সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চাইছেন তাতে পুরো ব্যাপারটা ভেস্তে যাবার আশঙ্কা। এটাও তিনি জানালেন যে, মীরজাফর তাঁর সঙ্গে যোগ না দিলে তিনি নদী পেরোবেন না। বর্ষা পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে প্রয়োজন হলে মারাঠারা বা বীরভূমের রাজা বা এমন কী দিল্লির উজির গাজিউদ্দিন খান, কারও না কারও সঙ্গে সমঝোতা করে কার্যোদ্ধার করা যাবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে লিখছেন যে, তাঁর ইচ্ছা খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোনো যাতে ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর কোনও বড় রকমের ক্ষতি না হয়। কারণ এ ফৌজ অক্ষত থাকলে আমাদের বর্তমান পরিকল্পনা সফল না হলেও ভবিষ্যতে যে কোনও সময় বিপ্লব সংগঠিত করার শক্তি আমাদের বজায় থাকবে।’৮৩
এ থেকে পরিষ্কার, মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠাতে ইংরেজদের শেষ পর্যন্ত সাহায্য করতে এগিয়ে না এলেও, ইংরেজরা অন্য কারও সহায়তায় এ কাজ সম্পন্ন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হত না এবং সেই অন্য কেউ দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যরাই যে হবে তার কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। ইংরেজদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কেউ হলেই চলত। আসলে তখনও পর্যন্ত ক্লাইভ মীরজাফর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তাই তিনি সিলেক্ট কমিটির কাছে জানতে চাইলেন, যদি মীরজাফর সাহায্য করতে এগিয়ে না আসেন তা হলে কী করা যাবে? তবে বিপ্লব ঘটাতে তিনি এতই উদ্গ্রীব ছিলেন যে মীরজাফরের ওপর আশা পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি এবং তাকে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে যোগ দিতে বারবার প্ররোচিত করতে লাগলেন। কাটোয়া থেকে ১৯ জুনও তিনি মীরজাফরকে লিখলেন:৮৪
আপনার পক্ষে বিশেষ করে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও আপনি খুব একটা গা করছেন না দেখে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। এ ক’দিনের মধ্যে আমি যখন ফৌজ নিয়ে অভিযান করছি তখন আমি ঠিক কী করব বা কী ব্যবস্থা নেব সে সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে কোনও ইঙ্গিত বা নির্দেশ পাইনি। আপনার কাছ থেকে কোনও সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই অবস্থান করব, আর এগুবো না। আমার মনে হয় অতি সত্বর আমার ফৌজের সঙ্গে আপনার যোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ক্লাইভ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও অস্থির হয়ে যুদ্ধবিষয়ক কমিটির সভা ডাকলেন ২১ জুন— উদ্দেশ্য, নবাবের ওপর তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, না ইংরেজরা যেখানে আছে সেখানে আরও সুসংহত হয়ে বর্ষা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে তারপর নবাবের বিরুদ্ধে মারাঠাদের ‘আমাদের সঙ্গে’ যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, তা জানতে।৮৫ এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে পলাশি যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগেও ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে গদিচ্যুত করার জন্য মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলাবার কথা চিন্তা করছিলেন। এতে এটাই পরিষ্কার, সিরাজকে হঠাবার যে চক্রান্ত সেটা পুরোপুরি ইংরেজদেরই ‘প্রকল্প’ (project)। এ-প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য তারা যে-কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে প্রস্তুত— মুর্শিদাবাদ দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ওপরই শুধুমাত্র তারা নির্ভর করে ছিল না। এদিকে যুদ্ধবিষয়ক কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তখনই নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে চাইল, যদিও ক্লাইভ ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করলেন এবং পরের দিনই পলাশি অভিমুখে যাত্রা করবেন বলে স্থির করলেন। তখনও পর্যন্ত কিন্তু মীরজাফরের কাছ থেকে কোনও ইতিবাচক নির্দেশ বা সংকেত এসে পৌঁছয়নি।৮৬ এতেই স্পষ্ট যে বিপ্লব সংগঠিত করতে ইংরেজরা শুধু অস্থিরই নয়, খুব উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছিল। ২২ জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজবাহিনী পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করল। কিন্তু সেদিনই, সম্ভবত যাত্রা শুরু করার আগে, ক্লাইভ আবার মীরজাফরকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখলেন:৮৭
যদিও আপনি নিজে কিছুই করছেন না, আপনার জন্য সর্বস্ব বিপন্ন করতে আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই আমি নদীর ওপারে পৌঁছে যাব। আপনি যদি পলাশিতে আমার সঙ্গে যোগ দেন তা হলে আমি মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে আপনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারি…· আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এটার ওপর আপনার সম্মান ও নিরাপত্তা কতখানি নির্ভর করছে। আপনাকে আমি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করছি যে এটা করলে আপনি তিন প্রদেশেরই [বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা] সুবাদার [নবাব] হবেন। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সাহায্যার্থে এটুকুও না করেন তা হলে ভগবান আপনার সহায় হোন। আমাদের কিন্তু [পরে] বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারবেন না।
মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার জন্য একদিকে কী ধরনের প্রলোভন এবং অন্যদিকে যে প্রচ্ছন্ন ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছিল, তাঁর উৎকৃষ্ট নিদর্শন ওপরের চিঠিটি। শেষ পর্যন্ত ২২ জুন দুপুরের দিকে ক্লাইভের কাছে মীরজাফরের চিঠি এসে পৌছল এবং বিকেলেই ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে অভিযান করার সিদ্ধান্ত মীরজাফরকে জানিয়ে দিলেন।
এদিকে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অবস্থা বেশ কাহিল। অস্থিরচিত্ত ও বিপদের সময় বিহ্বল হয়ে পড়াটা তাঁর স্বভাবের অন্তর্গত, তাঁর অন্যতম দুর্বলতা। অবশ্য এটা মনে না রাখলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে যে তখন কতগুলি ঘটনা তাঁকে বিভ্রান্ত করেছিল। এসময় তাঁর দৃঢ় সংকল্পের অভাব ও দোদুল্যমান মনোভাবের কতগুলি কারণও ছিল। ১৭৫৭ সালের প্রথম দিক থেকেই আহমদ শাহ আবদালির নেতৃত্বে বাংলায় আফগান আক্রমণের আশঙ্কা তাঁর কাছে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক করে হোক বা ভুল করে হোক, তিনি ভেবেছিলেন ইংরেজদের চাইতে আফগানরাই তখন বড় বিপদ। তাই তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ অংশকে সম্ভাব্য আফগান আক্রমণ প্রতিহত করতে রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে বিহার সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে তাঁর দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ও ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় তিনি বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই সম্ভবত তিনি যারা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে বলে সন্দেহ করছিলেন তাদের সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তখনও তাঁর আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙঘবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সিরাজদ্দৌল্লা মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী অন্যান্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা না নিয়ে বিরাট ভুল করেছিলেন। এটা লিউক স্ক্র্যাফ্টন৮৮ এবং জাঁ ল’ও৮৯ স্পষ্ট ভাষাতে জানিয়েছেন। অথচ সিরাজের অনুগত সেনাপতিরা, বিশেষ করে মীরমর্দান, আব্দুল হাদি খান প্রমুখ তাঁকে বারংবার অনুরোধ ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তা নিলে ইংরেজরা আক্রমণ করতে কোনওমতেই সাহস করবে না।৯০ কিন্তু নবাব তাতে কর্ণপাতও করলেন না, তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে পলাশিতে ইংরেজদের মুখোমুখি হলেন ২৩ জুন।
পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায়দুর্লভ রাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মতো নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মীরজাফর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিতান্ত দর্শক হয়ে, যেন মজা দেখতেই যুদ্ধে আসা।৯১ আর রিয়াজের লেখক বলছেন, মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাঁদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন—নবাব তাকে বারবার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও তিনি একবিন্দু নড়লেন না।৯২ তা সত্ত্বেও কিন্তু পলাশির তথাকথিত যুদ্ধের হারজিত আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায়নি। ২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্টন হতবাক—’they made a most pompous and favourable appearance…. their disposition, as well as their regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them’.৯৩
পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহের ছাদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন। সকাল ৮টা নাগাদ (ক্লাইভের ভাষ্য অনুযায়ী ৬টায়) যুদ্ধ শুরু হল। ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁর অনুগত ও দক্ষ সেনাপতি মোহনলাল, মীরমর্দান, খাজা আবদুল হাদি খান, নবসিং হাজারি প্রমুখের নেতৃত্বে ইংরেজদের সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর সাঁ ফ্রে’র অধীনে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা ক্লাইভের কাছে খুব আশাপ্রদ মনে হল না। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে, তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে নবাবের সৈন্যরা এবং সেনাপতিরা তাঁর ওপর বীতশ্রদ্ধ, তাই তারা ইংরেজদের বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তো তিনি দেখছেন সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।৯৪ পলাশির যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জন উড (John Wood) নামে এক ইংরেজ সৈনিক লিখেছেন যে সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করছিল যাতে অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়া যায়।৯৫ ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খারাপ তা ওয়াটসের লেখা থেকেও স্পষ্ট ‘নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। তা হলে ক্লাইভকে [কলকাতা পালাবার জন্য] রাত্রের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হত। ক্লাইভ আসলে তাই ভেবে রেখেছিলেন।’৯৬
যুদ্ধ চলতে লাগল। নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁর অনুগত সেনাপতিদের নেতৃত্বে অসম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে পলাশির আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজ ফৌজের দিকে এগুতে লাগল। বেলা তখন প্রায় তিনটে। ফারসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছিল।৯৭ ঠিক এসময় দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ একটি গোলার আঘাতে মীরমর্দান গুরুতর আহত হয়ে পড়েন, তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোড় একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন: ‘আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীরমর্দান নিহত হন’।৯৮ মীরমর্দানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজদ্দৌল্লা দিক্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ে রেখে তাঁর কাছে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওইদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন। তিনিও একই পরামর্শ দিলেন। সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীরমর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলাল মূল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেনাপতিদের সকলেই প্রথমে নবাবের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন— এই যুক্তিতে যে ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। কিন্তু সিরাজের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তাঁরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।৯৯ ইউসুফ আলি লিখেছেন, ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য নবাবের অন্যতম সেনাপতি মীর মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে ভর্ৎসনা করতেও দ্বিধা করেননি।১০০
সিরাজদ্দৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাতে নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল ৫টার মধ্যেই পলাশির তথাকথিত যুদ্ধ শেষ। পলাশি যুদ্ধের সাক্ষী ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে কোনওরকমের মুখোমুখি যুদ্ধ বা আক্রমণ ছাড়াই এমন একটি ‘great and decisive’ যুদ্ধের নিষ্পত্তি এবং তাঁর সঙ্গে একটি রাজ্যজয়ও হয়ে গেল।১০১ সন্ধ্যা ৬টায় ক্লাইভ মীরজাফরের অভিনন্দনসূচক বার্তা পেলেন— ‘আপনার পরিকল্পনা সফল হওয়ায় অভিনন্দন গ্রহণ করুন’।১০২ এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন ‘আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] পরিকল্পনা।’ ক্লাইভ পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফ্টন মারফত দাউদপুর থেকে মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন: ‘এ জয় আপনার। আমার নয়। অতি সত্বর আমার সঙ্গে মিলিত হলে খুশি হব। আপনাকে নিয়ে কালই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করব। আশা করি আপনাকে নবাব বলে ঘোষণা করার সম্মান আমি পাব।’১০৩ ক্লাইভই মুর্শিদাবাদে মীরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় নবাবের মুকুট পরিয়ে দেন।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. S. C. Hill, Bengal in 1756-57, 3 vols; P. J. Marshall, Bengal — the British Bridgehead; C. A. Bayly, Indian Society and the Making of the British Empire; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, IHR: পলাশীর ষড়যন্ত্র।
২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 162.
৩. Hill, Vol. I, Introduction, p. liii.
৪. P.J. Marshall, Bengal, p. 91; C. A. Bayly, Indian Society, p. 50: Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 11, 12; পলাশী, পৃ. ১২, ১৬।
৫. আমার প্রবন্ধ, ‘Was there a crisis in mid-Eighteenth Century Bengal?’, presented in the “Workshop on the Eighteenth Century”. University of Virginia, Charlottesville. Now published in Richard B. Barnett, ed., Rethinking Early Modern India, pp. 129-52.
৬. Hill, Vol. 1, p. XXIII.
৭. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 32.
৮. C. A. Bayly, Indian Society, p. 50
৯. ঐ, pp. 49-50.
১০. S. C. Hill, Three Frenchmen in Bengal, p. 120; Bengal in 1756-57, vol. I, Introduction, pp. xxiii, lii; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p.41.
১১. রজতকান্ত রায়, পলাশী।
১২. P.J. Marshall, Bengal.
১৩. Luke Scrafton, Reflections, p. 55.
১৪. নওয়াজিস মহম্মদ খান ছিলেন নবাব আলিবর্দির ভাই সৈয়দ আহমেদের পুত্র, আলিবর্দির কন্যা ঘসেটি বেগমের স্বামী ও ঢাকার শাসনকর্তা বা ছোট নবাব।
১৫. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.
১৬. ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১১৮.
১৭. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 57.
১৮. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 41.
১৯. সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ৩৮-৪১।
২০. ডুপ্লেকে লেখা রেনল্টের চিঠি, চন্দননগর, ২৬ আগস্ট ১৭৫৬, Hill, I, p. 204.
২১. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.
২২. সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ৪১।
২৩. ড্রেককে লেখা বেচারের চিঠি, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd, vol. 23,f. 460.
২৪. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 47-48.
২৫. ওয়াজিদকে সিরাজদ্দৌল্লা, ১ জুন ১৭৫৬, Hill, III, p. 152.
২৬. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসের (লন্ডন) চিঠি, DB, vol. 3, 16 Jan. 1752.
২৭. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে কোর্ট অফ ডাইরেক্টরস, DB, vol. 4, 29 Nov. 1754; FWIHC, vol. I, p. 68.
২৮. C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 9.
২৯. C. R. Wilson, Old Fort William, vol. II, p. 31; Watts to Drake and Fort William Council, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755.
৩০. Mss. Eur, D. 283, f. 26; প্রায় একই রকমের বক্তব্য হলওয়েলের, Holwell to Court of Directiors, 30 Nov, 1756, Hill, II, p. 18; জোরটা আমার দেওয়া।
৩১. Law’s Mentoir, Hill, III, pp. 164-65.
৩২. Hill, I, pp. liv-lv.
৩৩. Mss. Eur. D. 283, ff, 15, 25.
৩৪. ঐ, পৃ. ২৫।
৩৫. Hill, I, p. lv.
৩৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 38-39.
৩৭. কোর্টকে ওয়াটস, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd. vol. 23, f. 378.
৩৮. S. Chaudhury, Prelude to Empire, p. 43 and fn. 30.
৩৯. Hill, III, pp. 332-33; II, pp. 4-5.
৪০. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ৫২-৫৪; S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 43-46, 58-61.
৪১. ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f, 460; ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে বেচার, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 158-60.
৪২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 13-16; Prelude to Empire, pp 73-76.
৪৩. ঐ, পৃ. ২০২-১১, ২৪৯-৫৯।
৪৪. ঐ, পৃ. ১০৯-৩১ এ বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
৪৫. বিস্তারিত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, ‘Was there a Crisis in mid-Eighteenth Century Bengal?’ in Richard B. Barnett, ed., Rethinking Early Modern India, pp. 129-52.
৪৬. S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 70-73.
৪৭. Luke Scrafton to Robert Clive, 17 Dec. 1757, Orme Mss., India, XVIII, f. 5043.
৪৮. বিস্তারিত তথ্যের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 36; Orme to Clive, 25 Aug. 1752, Orme Mss., O.V. 19, ff. 1-2.
৪৯. ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা; D. C. Sen, History of Bengali Language and Literature, PP. 288, 793.
৫০. Edward C. Dimmock, Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, p. 2.
৫১. আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, পৃ. ৪২৩।
৫২. Orme Mss., India VI, ff. 1500-1502.
৫৩. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, 14 Feb. 1755, VOC 2849, ff. 125-26.
৫৪. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 52-53.
৫৫. Law’s Memoir, Hill, III, p. 175.
৫৬. ঐ।
৫৭. ফোর্ট সেন্ট জর্জের গভর্নর পিগটকে (Pigot) লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368: ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 437.
৫৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190.
৫৯. করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭০; ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৯.
৬০. মি. রবিন্সকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ১০ মে ১৭৫১, Orme Mss., O.V. 12,f. 83.
৬১. BPC, Range l, vol. 15, f. 327,7 Oct. 1752; Orme Mss., O. V., 12, f. 83; Eur. G 37, Box 21, 1 Sept. 1753; Orime Mss., India, VI, f. 111vo.
৬২. পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলি ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে উদ্ধার করে টানেজের হিসেব করা হয়েছে, Relevant volumes in VOC.
৬৩. Beng. Letters Recd., vol. 24, f. 236, 20 May 1757.
৬৪. Orme Mss., vol. 170, f. 99; Records of Fort St. George, Diary and Consultation Books, Military Department, 1756, p. 330; Hill, I, pp. 239-40.
৬৫. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 442.
৬৬. সিক্রেট কমিটিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, ৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 205.
৬৭. ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Orme Mss., India, V, f. 1275; Orme Mss.. O.V. 170, f. 397,
৬৮. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.
৬৯. স্ক্র্যাফ্টনের চিঠি, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.
৭০. Select Committee Consultations, 23 April 1757; Orme Mss., India V, f. 1212; O.V. 170, f.222.
৭১. ক্লাইভকে সিলেক্ট কমিটি, ২৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, 368; Select Committee Consults., 28 April 1757, Orme Mss., India, f. 1214.
৭২. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec I. p. 148.
৭৩. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.
৭৪. তাঁর পিতাকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 468.
৭৫. Watts’ Memoirs, p. 82.
৭৬. ক্লাইভ ওয়াটসকে, ২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 373.
৭৭. Orme Mss., India V,f. 1228; O. V. 170, f. 265.
৭৮. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.
৭৯. ঐ, ১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.
৮০. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.
৮১. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ১৮ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 387; পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ওয়ালসের সাক্ষ্য, Hill, III, p. 318; জন কুকের [John Cooke] সাক্ষ্য, Hill, III, p. 120.
৮২. Select Committee Proceedings, 11 June 1757, Orme Mss., India V, ff. 1232-33; O. V. 170, ff. 256-57; জোরটা আমি দিয়েছি।
৮৩. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 417-18.
৮৪. মীরজাফরকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419. জোরটা আমি দিয়েছি।
৮৫. Journal of Eyre Coote, Orme Mss., India VII, f. 1665; Hill, III, p. 54.
৮৬. S. Chaudhury, Prelude to Empire, p. 145.
৮৭. Clive to Mir Jafar, 22 June 1757 (no.1), Hill, II, pp. 420-21, Recd., 22 June at 3 p.m., Hill, II, p. 420; Clive to Mir Jafar, 22 June 1757 (no.2), despatched at 6 p.m., Hill, II, p. 421; জোরটা আমার দেওয়া।
৮৮. Scrafton, Reflections, pp. 91-92.
৮৯. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 211-12.
৯০. করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪-৭৫।
৯১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১।
৯২. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫।
৯৩. Scrafton, Reflections, pp. 93-94.
৯৪. ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; লন্ডনের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; Watts, Memoirs, p. 110.
৯৫. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 178.
৯৬. Watts’ Memoirs, p. 110.
৯৭. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।
৯৮. Scrafton, Reflections, p. 110.
৯৯. তারিখ-ই-বংগলা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩; সিয়র, পৃ. ২৩২-৩৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫-৭৬।
১০০. তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবংজঙ্গী, পৃ. ১৩৩।
১০১. Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 181.
১০২. ক্লাইভকে মীরজাফরের চিঠি, ২৩ জুন ১৭৫৭। (ক্লাইভ পেলেন সন্ধ্যা ৬টায়), Orme Mss., India, XI, f.2814,
১০৩. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২৪ জুন ১৭৫৭, Orme Mss., India, VI, p. 2815.