০৪. বণিকরাজা

চতুর্থ অধ্যায় – বণিকরাজা

নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের যে সমৃদ্ধি তাতে ওখানকার বণিকরাজাদের (mer-chant princes) অবদান অনস্বীকার্য। এই বণিকরাজারা একাধারে সওদাগর, ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার, মহাজন-—সব কাজই এঁরা করতেন। এঁরা শুধু প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেন না, বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি ও মুর্শিদাবাদ দরবারে এঁদের প্রভাব ছিল প্রবল। এঁদের রাজকীয় আচার আচরণ ও জীবনযাত্রা দেখে অনেক ইউরোপীয় পর্যটক এঁদের ‘বণিকরাজা’ হিসেবেই গণ্য করতেন। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশকে বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতি এবং সে জন্যই কিছুটা বাংলার সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এঁরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসেও এঁদের গুরুত্ব অনেকখানি। আবার অন্যদিকে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে এঁদের ভূমিকাও নিতান্ত নগণ্য নয়। এই বণিকরাজাদের মধ্যে জগৎশেঠদের মূল আস্তানা ছিল মুর্শিদাবাদে; অন্য দু’জনের মধ্যে উমিচাঁদের কলকাতা আর আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের হুগলি। তবে যেহেতু এই বণিকরাজাদের মুর্শিদাবাদের দরবারে নিত্য আনাগোনা ছিল, সেজন্য এই তিনজন বণিকরাজাকেই মুর্শিদাবাদের লোক বলে গণ্য করা যেতে পারে।

বণিকরাজাদের মধ্যে জগৎশেঠরা অষ্টাদশ শতকের প্রায় গোড়া থেকেই বাংলার অর্থনীতিতে বিশিষ্ট ভূমিকা নিতে শুরু করেছিলেন, উমিচাঁদ ১৭৩০-র দশক থেকে আর খোজা ওয়াজিদ ১৭৪০-র দশক থেকে। বাংলার বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রশাসনে এই তিন বণিকরাজারা মিলে একাধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। বাংলার টাকার বাজার ছিল এঁদেরই হাতে এবং এঁরাই একদিকে শিল্পবাণিজ্য ও অন্যদিকে নবাব সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতেন। মুর্শিদাবাদের নবাবদের আনুকূল্যে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের একচেটিয়া ব্যবসা ও অন্যান্য বেশ কিছু বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা করায়ত্ত করে এঁরা বাংলার শিল্পবাণিজ্যে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গেও ছিল তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কোম্পানিগুলি এঁদের মাধ্যমে শুধু যে রফতানি পণ্য সংগ্রহ করত তা নয়। তারা এঁদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা ধার করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালাত। এঁদের কাছেই তারা ইউরোপ থেকে পাঠানো সোনা রুপো বিক্রি করে নগদ টাকা জোগাড় করত। তবে এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে এই বণিকরাজাদের উত্থান, প্রভাব ও প্রতিপত্তির প্রধান সোপান ছিল মুর্শিদাবাদ নবাবদের দাক্ষিণ্য। নবাবদের আনুকূল্যেই এঁরা এতটা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

এই বণিকরাজাদের মধ্যে সবদিক থেকে অগ্রগণ্য ছিলেন জগৎশেঠরা। এঁদের বলা হয় ‘Rothchilds of the East’। রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চলের নাগর থেকে এঁদের পূর্বপুরুষ হীরানন্দ শাহু ভাগ্যান্বেষণে ১৬৫২ সালে পাটনা চলে আসেন। তাঁর সাত পুত্রের জ্যেষ্ঠ মানিকচাঁদ তখনকার বাংলার রাজধানী ঢাকায় এসে মহাজনি ব্যবসা শুরু করেন। এঁরা ছিলেন শ্বেতাম্বর জৈন।

ঢাকায় মানিকচাঁদের সঙ্গে নবাগত দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। মুর্শিদকুলি যখন বাংলার তৎকালীন সুবাদার আজিম-উস-শানের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ১৭০৪ সালে দেওয়ানি দফতর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন, তখন তার সঙ্গে মানিকচাঁদও ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। তখন থেকেই মুর্শিদকুলির আনুকূল্যে জগৎশেঠদের উন্নতির শুরু—তাঁদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁদের রমরমা এই মানিকচাঁদ ও তার উত্তরসূরী ফতোচাঁদের সময়। ১৭১৪ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যু হওয়ার পর তাঁর ভাগ্নে ফতেচাঁদ গদিতে বসেন। ফতেচাঁদের সময়ই জগৎশেঠরা প্রভাব ও প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয়। সম্ভবত মুর্শিদকুলির অনুরোধে মুঘল সম্রাট ১৭২২ সালে ফতেচাঁদকে ‘জগৎশেঠ’ (Banker of the World) উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধি বংশানুক্রমিক।

প্রায় তিরিশ বছর ধরে বাংলার বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বিস্তার করে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ ১৭৪৪ সালে মারা যান। তাঁর উত্তরাধিকারী হন তাঁর দুই পৌত্র জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচাঁদ। ১৭৬৩ সালে মীরকাসিমের আদেশে গঙ্গাবক্ষে তাঁদের সলিল সমাধি হয়। বাংলায় জগৎশেঠদের বিপুল আয়, প্রচও ক্ষমতা ও বিশেষ মর্যাদার কতগুলো উৎস ছিল। সেগুলি হল: মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির প্রায় একচ্ছত্র অধিকার, বাংলার রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ জমা নেওয়ার অনুমোদন, মুদ্রা বিনিময়ের হার ধার্য করার ক্ষমতা ও সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনি ব্যবসা। বাংলার সুবাদার মুর্শিদকুলির প্রচ্ছন্ন সমর্থনে জগৎশেঠরা ১৭২০ সাল নাগাদ টাঁকশালের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তার প্রমাণ মেলে ১৭২১ সালে লেখা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি: ‘…Futtichund having the entire use of the mint, no other shroff dare buy an ounce of silver’.

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেশ কিছুদিন ধরেই টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির অনুমতি পাওয়ার চেষ্টা করছিল। এই মর্মে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিকে কোম্পানি অনেকবার নির্দেশ পাঠায় তারা যেন নবাবের কাছ থেকে এ জন্য অনুমতি জোগাড় করার চেষ্টা করে। কাশিমবাজার কাউন্সিল নবাবের দরবারের গণ্যমান্য অমাত্যদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করে। কিন্তু ওটা যে হওয়ার নয় তা বুঝতে পেরে তারা ফোর্ট উইলিয়ামকে জানাল যে: “We are informed that while Futtichund is so great with the Nabab, they [the English] can have no hopes of that Grant, he alone having the sole use of the mint nor dare any other shroff or mer- chant buy or coin a rupee’s worth of silver.’

টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকার জগৎশেঠদের আয়ের একটি বড় উৎস ছিল। তার ফলে তাঁরা সে অধিকারে অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দিতে কোনওমতেই রাজি ছিলেন না। যে কোনও মূল্যেই তাঁরা এটা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এমনকী, ১৭৪৩ সালে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা লিখছে যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ যতদিন জীবিত আছেন, ততদিন ইংরেজদের অন্য কারও পক্ষে টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করার অনুমতি পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ বাংলার নবাব ও মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর এমনই প্রভাব যে তিনি যা চাইবেন তার অন্যথা হবে না। ফলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির খুবই মুশকিল হত। তারা বাংলার রফতানি পণ্য কেনার জন্য ইউরোপ থেকে যেসব সোনা-রুপো নিয়ে আসত (প্রায় সবটাই রুপো) সেগুলোর বেশিরভাগই জগৎশেঠদের কাছে বিক্রি করতে হত কারণ এগুলোর বিনিময়ে তাদের স্থানীয় মুদ্রা সংগ্রহ করতে হত এবং তা দিয়েই রফতানি পণ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হত। আর যেহেতু জগৎশেঠদের হাতেই টাঁকশালের কর্তৃত্ব, তাদের আমদানি করা রুপো জগৎশেঠদের কাছে বিক্রি করা ছাড়া কোনও উপায় তাদের ছিল না। শুধু তাই নয়, জগৎশেঠরা যে দাম দিতেন, সেটাই তাদের নিতে হত। বলা বাহুল্য সে দাম বাজারের দামের চেয়ে কমই হত। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির পক্ষে এ ব্যবস্থা মেনে নিতেই হত কারণ তারা এ দেশে পণ্য কেনার জন্য যে রুপো নিয়ে আসত, জগৎশেঠদের ছলচাতুরির জন্য তারা সেগুলি দিয়ে টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করতে পারত না। অথচ দাদনি বণিকদের মাধ্যমে রফতানি পণ্য সংগ্রহ করার জন্য তাদের নগদ টাকার খুবই প্রয়োজন হত।

জগৎশেঠদের প্রভূত আয়ের আরেকটি বড় উৎস ছিল বিভিন্ন রকমের মুদ্রার বিনিময়ের হার বা বাট্টা ধার্য করার অধিকার। বাংলার নবাবদের সঙ্গে শেঠদের এমনই ঘনিষ্ঠতা এবং তাঁদের ওপর ও বাংলার টাকার বাজারে এঁদের এমনই প্রভাব ছিল যে (যার অন্যতম প্রধান কারণ, তাঁরা নবাবদের প্রয়োজনে বরাবরই অর্থ সাহায্য করে গেছেন) তাঁরা নবাবদের দিয়ে তাদের সুবিধামতো বিনিময়ের হার ধার্য করাতে পারতেন। তখনকার বহু নথিপত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া এ সময় বাংলায় নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্নরকমের মুদ্রা আসত, বাংলায়ও ছিল নানা রকমের মুদ্রা। বাজারে কিন্তু এসব চলত না। সব রকমের মুদ্রাকেই সিক্কা টাকায় পরিবর্তিত করতে হত—এ জন্য দিতে হত বাট্টা। এ বাট্টার হার ঠিক করত জগৎশেঠরা, তাঁদের লাভের অঙ্ক মাথায় রেখে। ফলে বাট্টা থেকেও তাঁদের প্রচুর লাভ হত। জগৎশেঠরা পুরনো বা অন্য প্রান্ত থেকে আসা সব মুদ্রা টাঁকশালে পাঠিয়ে নতুন চলতি মুদ্রায় (সিক্কা) পরিবর্তিত করতেন আর এই মুদ্রা পরিবর্তন করার জন্য তাঁরা বাট্টা নিতেন। সেটা থেকে তাঁদের আয় হত প্রচুর। লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের (Luke Scrafton) অনুমান অনুযায়ী (১৭৫৭ সাল) জগৎশেঠরা বছরে ৫৮ লক্ষ টাকার মতো মুদ্রা তৈরি করত এবং এ বাবদ তাদের বার্ষিক আয় হত ৩-১/২ লক্ষ টাকা। এ ছাড়াও দেশি ও বিদেশি মুদ্রা বাংলায় চলতি সিক্কা টাকায় বিনিময় করে দেওয়ার জন্য শেঠদের প্রচুর আয় হত। তাঁরা নবাবের প্রাপ্য রাজস্বও জমা নিতেন। জমিদার ও আমিলরা তাঁদের কাছে ভূমি রাজস্ব জমা দিত। তা ছাড়াও যারা রাজস্ব আদায়ের নিলাম কিনত, শেঠরা তাদের জামিনও হতেন, অবশ্যই লাভের বিনিময়ে।

জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের আরেকটি সোজা রাস্তা ছিল চড়া সুদের মহাজনি ব্যবসা। তারা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে বার্ষিক শতকরা ১২ টাকা হারে টাকা ধার দিতেন। বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য এসব কোম্পানিরা ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো, বিশেষ করে রুপো, নিয়ে আসত ঠিকই। কিন্তু ইউরোপ থেকে জাহাজ আসতে অনেক সময় দেরি হত। আবার এসব রুপো সোজাসুজি টাঁকশালে নিয়ে গিয়ে সেগুলি থেকে মুদ্রা তৈরি করা সম্ভব হত না কারণ টাঁকশাল ছিল জগৎশেঠদের কর্তৃত্বে। বাজারে বা জগৎশেঠদের কাছে এসব রুপো বিক্রি করে নগদ টাকা জোগাড় করতে সময় লাগত অনেক। এদিকে রফতানি পণ্য জোগাড় করতে টাকার খুব প্রয়োজন হত কারণ ঠিক সময় এসব পণ্য সরবরাহ করার জন্য দাদনি বণিকদের আগাম টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করতে না পারলে পরে অনেক বেশি দামে এসব পণ্য কিনতে হত। আর ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো পাঠালেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে কোম্পানিগুলির প্রায় সবসময় নগদ টাকার ঘাটতি হত। সে জন্য বাজার থেকে তারা টাকা ধার করতে বাধ্য হত এবং মূলত তারা জগৎশেঠদের কুঠি থেকেই এই টাকা ধার করত, যদিও তারা কলকাতার দাদনি বণিক বা কাশিমবাজারের কাটমা পরিবারের কাছ থেকেও টাকা ধার করত।

জগৎশেঠদের কাছ থেকে সহজে টাকা ধার করা গেলেও শতকরা ১২ টাকা সুদ কোম্পানিরা খুব বেশি বলেই মনে করত এবং কোনও উপায় নেই বলেই এত চড়া সুদ দিতে বাধ্য হত। কোম্পানিগুলির কর্ণধাররা ইউরোপ থেকে বার বার লিখে পাঠাত যে সুদের হার ‘exorbitant’ এবং তাই ‘rank poison to our commerce’। তাই তারা বাংলায় ধার করাটা একেবারেই চাইত না কারণ ‘the interest…eats deep and insensibly’১০। কিন্তু বাংলায় টাকা ধার না করে তাদের পক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব ছিল না। ১৭৩০-র দশক ও ১৭৪০-র দশকের প্রথম দিকে বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান ডুপ্লে (Dupleix) জগৎশেঠ ফতেচাঁদকে ‘greatest of Jews’ এবং ‘our chopping-block’ বলে বর্ণনা করলেও টাকার জন্য তাঁর কাছেই হাত পাততে বাধ্য হতেন বারবার।১১ ১৭১৮ থেকে ১৭৩০ সালের মধ্যে ইংরেজ কোম্পানি মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠদের কাছ থেকে বছরে গড়ে প্রায় ৪ লক্ষ টাকার মতো ধার করেছিল।১২ আর ১৭৫৫ থেকে ১৭৫৭, এই তিন বছরে জগৎশেঠদের কাছ থেকে ডাচ কোম্পানি ২৪ লক্ষ টাকা ধার করেছিল।১৩ ১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে যখন ইংরেজদের কাছে চন্দননগরের পতন হল, তখন শেঠদের কাছে ফরাসিদের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লক্ষ টাকা।১৪

সুদের হার কমানোর কোনও উপায় নেই দেখে কোম্পানিগুলি জগৎশেঠদের কাছে এ জন্য অনুনয় বিনয় করত। তাতে আগে কোন ফল হয়নি। ১৭৪০ নাগাদ শেঠদের বোধহয় মনটা একটু নরম হল। ১৭৪০-র ১১ ডিসেম্বর কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা কলকাতায় জানাল যে কোম্পানি যদি জগৎশেঠদের কাছে সুদের হার কমাবার জন্য আবেদন করে, তা হলে তা হয়তো মঞ্জুর হয়ে যাবে।১৫ সে অনুযায়ী কলকাতা কাউন্সিল সেদিন জগৎশেঠ ফতেচাঁদকে সুদের হার শতকরা ১২ টাকা থেকে কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখে। ইংরেজদের প্রার্থনা অনুযায়ী জগৎশেঠরা সুদের হার কমিয়ে শতকরা ৯ টাকা করে দিলেন। ১৭৪০-র ২১ ডিসেম্বর কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠিয়ালরা জগৎশেঠের কুঠি থেকে শতকরা ৯ টাকা হারে ৬০,০০০ টাকা ধার করল।১৬ তখন থেকে ইউরোপীয়রা কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ ও জগৎশেঠদের অন্যান্য কুঠি থেকে ওই হারে টাকা ধার করতে লাগল। ১৭৪২ সালের ২৯ মার্চ একদিনে ইংরেজ কোম্পানি কলকাতায় জগৎশেঠদের কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা ধার করে।১৭ ইংরেজদের মতো ডাচ, ফরাসি ও অন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি জগৎশেঠদের বিভিন্ন কুঠি থেকে প্রয়োজন মতো ঋণ নিত, একই সুদের হারে। জগৎশেঠরা যে একদিনের মধ্যেই সুদের হার কমিয়ে দিতে পারল তা থেকে বাংলা তথা উত্তর ভারতের টাকার বাজারে তাঁদের একাধিপত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে জগৎশেঠরা একটি প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে ওঠে। বাংলার অন্য সব ব্যাঙ্কার, সওদাগর-ব্যবসায়ী, শরাফ প্রভৃতি সব ব্যাপারেই জগৎশেঠদের অনুকরণ করে চলত। মারাঠা আক্রমণের জন্য জগৎশেঠ যখন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান, তখন কাশিমবাজারের ইংরেজ কাউন্সিল কলকাতায় লিখেছিল (৭ জুন ১৭৪২) যে যতদিন না জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদে ফিরে আসছেন, ততদিন সেখানকার কোনও সওদাগর, মহাজন বা শরাফ নিজেদের নিরাপদ ভাববে না। তাই নবাব আলিবর্দি জগৎশেঠকে অনুনয় জানালেন তিনি যেন তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন কারণ ‘his presence being as necessary to the Nabub as to the merchants’ এবং ‘his conduct being the general guide to all of them’।১৮ ক’দিন পর (১৪ জুন ১৭৪২) কাশিমবাজার থেকে কুঠিয়ালরা জানাল যে জগৎশেঠ মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছেন এবং সে খবর পেয়ে অন্যান্য মহাজন ও ব্যবসায়ীরাও শহরে ফিরে এসেছে।১৯ আবার ফতোচাঁদ যখন পরের বছর (১৭৪৩ সাল) মারাঠা আক্রমণের আশঙ্কায় মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে গেলেন তখন কাশিমবাজার কাউন্সিল ফোর্ট উইলিয়ামে লিখছে যে ফতেচাদ চলে যাওয়ায় মুর্শিদাবাদে টাকা ধার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে—বাজারে টাকার এত অভাব জগৎশেঠের মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাওয়ার জন্য।২০ তারা আবার ২ জুলাই লিখেছে যে ফতেচাঁদ ফিরে এসেছেন, ফলে বাজারে এখন টাকার কোনও অভাব নেই।২১

জগৎশেঠরা অষ্টাদশ শতকের প্রায় প্রথম থেকেই মুর্শিদাবাদ দরবারের স্থায়ী সদস্য ছিলেন। বাংলার নবাব ও তাঁদের শাসনপ্রক্রিয়ার ওপর জগৎশেঠদের যে বিরাট প্রভাব ছিল তা অভূতপূর্ব—বাংলার ইতিহাসে এমনটি আর কখনও দেখা যায়নি। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার প্রত্যেকটি রাজনৈতিক পালাবদলে শেঠরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দিল্লির মুঘল শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গেও ছিল তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।২২ বাদশাহি দরবারে তাঁদের যে কতটা প্রভাব ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাঁরা মুঘল দরবার থেকে বাংলার নবাবদের স্বীকৃতি ও অনুমোদন জানিয়ে ফরমান আনিয়ে দিতেন। এভাবে জগৎশেঠ ফতোচাঁদ মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর নবাব সজাউদ্দিনের জন্য দিল্লিতে দরবার করে তাঁর জন্য অনুমোদন জোগাড় করেন। তাই সুজাউদ্দিন ফতোচাঁদের প্রতি মুর্শিদকুলির চেয়েও অনেক বেশি উদার ছিলেন এবং শেঠদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নানা রকমের সুবিধা দিয়েছিলেন। ১৭৩০ সালে কাশিমবাজারে শেঠদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা ঝামেলা হয়—কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির ভারতীয় গোমস্তাকে নিয়ে। ইংরেজরা তখন নবাবের অন্যতম দুই প্রধান অমাত্য, হাজি আহমেদ ও দেওয়ান আলমচাঁদকে দিয়ে শেঠদের বিরুদ্ধে সুজাউদ্দিনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দু’জনেই তাদের পরামর্শ দিলেন, ফতোচাঁদকে নবাব খুবই শ্রদ্ধা এবং সমীহ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোন কথাই নবাব শুনবেন না। তাই শেঠদের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নিলেই ইংরেজরা ভাল করবে, কোনও অমাত্যেরই জগৎশেঠের বিরুদ্ধে নবাবকে কোনওভাবেই প্রভাবিত করার সাধ্য নেই।২৩ হাজি আহমেদ কাশিমবাজার কাউন্সিলকে জানান যে ‘Futtichund’s Estate was esteemed as the King’s treasure and the Nabob was resloved to see him satisfied.২৪

অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সব রাষ্ট্রবিপ্লবেই জগৎশেঠদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ হাত ছিল। তাঁদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদলই সম্ভব ছিল না। সমসাময়িক প্রায় সব ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক ও ফারসি ইতিহাসে এর সমর্থন পাওয়া যায়। পলাশির যড়যন্ত্র ও বিপ্লবে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নেন, যদিও এ চক্রান্তের মূল উদ্যোক্তা ছিল ইংরেজরা। তারা উমিচাঁদের মাধ্যমে প্রথমে ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা করে। লতিফ সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে নবাব হওয়ার বাসনা জানিয়েছিল এবং তিনি যে জগৎশেঠদের সমর্থন পাবেন তা জানাতেও ভোলেনি। পরে যখন মীরজাফরকে পাওয়া গেল তখন ইংরেজরা তাড়াতাড়ি ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরকেই নবাব করার ষড়যন্ত্র করল। তার কারণ শুধু এই নয় যে ইয়ার লতিফের তুলনায় মীরজাফর অনেক বেশি ক্ষমতাশালী অমাত্য (তিনি নবাবের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ), তার চেয়েও বড় কারণ তিনি জগৎশেঠদের অনেক বেশি কাছের লোক।২৫ কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ লিখেছেন: ‘It is this family [of Jagat Seth] who conducted all his (Alivardi’s) business and it may be said that it had long been the chief cause of all the revolutions in Bengal.:২৬

বাংলায় জগৎশেঠদের যে প্রবল ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল তা দেখে বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষরা সবাই তাদের উত্তরসূরিদের জন্য লেখা ‘মেমোরি’তে (mem- orie—যাতে বাংলার শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সওদাগর-মহাজন সবকিছু সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ ও পরামর্শ থাকত) জগৎশেঠদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখার ওপর বিশেষ জোর দিতেন। ১৭৪৪-এ বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান সিকটারম্যান (Sichtermann) তাঁর ‘মেমোরি’তে লেখেন যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার (‘greatest banker of Hindosthan’ বা ‘voornaamsten wis- selaar van geheel Hindosthan’)। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য, মহাজনি কারবার ভারতবর্ষের সর্বত্র বিস্তৃত। তিনি যদিও ব্যক্তিগতভাবে শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তা হলেও পুরো ব্যাপারটাতেই তাঁর প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। সে জন্য তাকে সবসময় খুশি রাখা এবং তাঁর সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখা খুবই দরকার। এটা করার সবচেয়ে ভাল উপায় তাঁকে নিয়মিত বিরল প্রজাতির ছোট পাখি, ভাল মশলা ও ছোটখাট এবং দুষ্প্রাপ্য জিনিস উপহার দেওয়া।২৭

সিকটারম্যানের পরবর্তী ডাইরেক্টর ইয়ান হাউখেনস (Jan Huijghens) ১৭৫০ সালে তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে কোম্পানির পক্ষে হুগলিতে জগৎশেঠের গোমস্তা বৈজনাথের (Baijnath) সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার কারণ তা হলে তিনি তাঁর মনিব জগৎশেঠদের দিয়ে মুর্শিদাবাদ দরবার থেকে তাদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধে আদায় করতে পারবেন।২৮ তাঁর উত্তরসূরি ইয়ান কারসেবুম (Jan Kerseboom) ১৭৫০ সালে তার ‘মেমোরি’তে লেখেন যে জগৎশেঠ ফতেচাঁদের দুই উত্তরাধিকারী, জগৎশেঠ মহতাব রাই ও মহারাজা স্বরূপ চাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে ও বিস্তৃত হচ্ছে। কারণ তাঁরা নবাবকে সবসময় নবাবের প্রয়োজনমতো অর্থ সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। তাই কারসেবুম জোর দিয়েছেন যাতে কোম্পানি জগৎশেঠদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখে।২৯

কারসেবুমের উত্তরসূরি লুই টেইলেফারটও (Louis Taillefert) তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে জগৎশেঠরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার। তিনি জানাচ্ছেন ডাচরা বাংলা থেকে চিঠিপত্রে এতদিন ধরে জগৎশেঠ ফতেচাঁদের কথা লিখেছে যে হল্যান্ডে কোম্পানির কর্মকর্তাদের সন্দেহ হতে পারে এমন নামের কোনও ব্যক্তি আদৌ ছিল কি না। আসলে বিভিন্ন শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রে জগৎশেঠদের কুঠিগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। হুগলিতে তাঁদের কুঠির নাম ছিল শেঠ মানিকচাঁদজী ও শেঠ আনন্দচাঁদজী, ঢাকায় শেঠ মানিকচাঁদজী ও জগৎশেঠ ফতেচাঁদজী, পাটনায় শেঠ মানিকচাঁদজী ও শেঠ দয়ানন্দজী।৩০ আনন্দচাঁদ, দয়াচাঁদ ও মহাচাঁদ জগৎশেঠ ফতেচাঁদের তিন ছেলে। ফতেচাঁদ বেঁচে থাকতেই প্রথম জনের মৃত্যু হয়। আমরা আগেই দেখেছি জগৎশেঠ মহতাবচাঁদ ও মহারাজা স্বরূপচাঁদ ফতেচাঁদের পৌত্র ও তাঁর উত্তরসূরী।৩১ এখানে উল্লেখযোগ্য যে জগৎশেঠদের এমনই প্রতিপত্তি ও প্রভাব ছিল যে বাংলা ও বিহারের সব ব্যাঙ্কার-মহাজন, শরাফ তাঁদের তাঁবে থেকেই নিজেদের কাজকারবার করত। কেউ তার অন্যথা করলে তার রক্ষা ছিল না—জগৎশেঠরা তাকে শেষ করে ছাড়তেন।৩২

ইউরোপে যেমন কিছু কিছু পরিবার রাষ্ট্রের ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করতেন, জগৎশেঠরাও তেমনি কার্যত বাংলার নবাবের ব্যাঙ্কার ছিলেন। তাই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এন. কে. সিনহা মন্তব্য করেছেন: ‘The Jagat Seth house was to the Bengal Nawabs what the Fugger of Augsburg were to the Emperor Charles V of Germany and the Medicis of Florence were to the Papacy in the Middle Ages’.৩৩

শেঠদের ধনসম্পদের পরিমাণ সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা করা খুবই কঠিন। সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন খান লিখেছেন:

…their riches were so great that no such bankers were ever seen in Hindustan or Deccan…. nor was there any banker or merchant that could stand comparison with them all over India…. Their wealth was such that there is no mentioning it without seeming to exaggerate and to deal in extravagant fables.৩৪

এক বাঙালি কবি বলেছেন গঙ্গা যেমন শতমুখে জলরাশি এনে সমুদ্রে ফেলে, তেমনি ধনরত্ন এসে জমা হত জগৎশেঠদের কোষাগারে।৩৫ ১৭৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts) অনুমান করেন যে শেঠদের ব্যবসার মূলধন ছিল ৭ কোটি টাকার মতো।৩৬ অন্যদিকে এন. কে. সিনহার ধারণা, জগৎশেঠদের সমৃদ্ধির যুগে তাঁরা অন্তত ১৪ কোটি টাকার মালিক ছিলেন।৩৭ লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের হিসেব অনুযায়ী ১৭৫৭ সালে জগৎশেঠদের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মতো।৩৮

সারণি ১

জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়, ১৭৫৭
(টাকায়)

রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ জমা নেওয়া বাবদ ১০% হারে১০,৬০,০০০
জমিদারদের কাছ থেকে সুদ বাবদ ২০% হারে১৩,৫০,০০০
বছরে ৫০ লক্ষ টাকা টাঁকশালে 
নতুন মুদ্রায় পরিবর্তন করার জন্য ৭%৩,৫০,০০০
৪০ লক্ষ টাকার ওপর সুদ, ৩৭-১/২% হারে১৫,০০,০০০
বাট্টা বা বিনিময়ের সুদ বাবদ, ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা৭,০০,০০০
মোট৪৯,৬০,০০০

(সূত্র: ক্লাইভকে লেখা স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ১৭ ডিসেম্বর ১৭৫৭)

জগৎশেঠদের কী পরিমাণ টাকা ছিল তার একটা আন্দাজ করা যেতে পারে মারাঠারা যখন ১৭৪২ সালে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে, তখন মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠের বাড়ি লুঠ করে নগদ ২ কোটি টাকা (সিয়রের লেখক গোলাম হোসেনের মতে, যদিও মুজাফ্‌ফরনামার লেখক করম আলি বলেছেন তিন লক্ষ টাকা) নিয়ে চলে যায়। সিয়রের অনুবাদক হাজি মুস্তাফা লিখেছেন, এই বিশাল পরিমাণ টাকা লুঠ হয়ে গেলে ইউরোপের যে কোনও রাজাই বিচলিত হয়ে পড়তেন কিন্তু জগৎশেঠ ফতেচাঁদের হাবভাবে বিশেষ কোনও তারতম্য হল না, ‘he continued to give govern-ment bills of exchange at sight of full one crore at a time’৩৯

জগৎশেঠদের খ্যাতি এতই ব্যাপক ছিল যে মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যত বিশিষ্ট ইউরোপীয় কর্মচারী ছিল, তাদের সবাই শেঠদের সম্বন্ধে মন্তব্য করে গেছে। ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম (Robert Orme) কিছুকাল বাংলায় ছিলেন। তিনি ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিকে লিখেছেন যে সারা পৃথিবীতে জগৎশেঠরাই সর্বশ্রেষ্ঠ শরাফ ও ব্যাঙ্কার।৪০ ক্যাপ্টেন ফেন্‌উইক (Captain Fenwick) নামে এক ইংরেজ স্বাধীন বণিক (Free Merchant), যিনি কলকাতায় থাকতেন, বলেছেন যে জগৎশেঠ মহতাব রাই নবাবের খুবই প্রিয়পাত্র এবং লন্ডনে ব্যাঙ্কারদের কেন্দ্র লম্বার্ড স্ট্রিটের সমস্ত ব্যাঙ্কারকে যোগ করলেও তাঁর মতো ব্যাঙ্কার হবে না।৪১ ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী ও পলাশি চক্রান্তের মূল নায়কদের অন্যতম লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন (Luke Scrafton) জগৎশেঠ সম্বন্ধে ১৭৫৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে ক্লাইভকে লেখেন: ৪২

Jugget Seat is in a manner the government’s banker; about two thirds of the revenues are paid into his house, and the government give the draught (draft) on him in the same Manner as a Merchant on the Bank.

কোম্পানির আরেক কর্মচারী ও পলাশি ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক, কাশিমবাজার কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের মতে জগৎশেঠ ছিলেন ‘the greatest Banker in the Empire of Indostan and the Second in Power in Bengal.’৪৩ আর ফরাসি কোম্পানির কাশিমবাজার কুঠির অধ্যক্ষ জাঁ ল’ (Jean Law) লিখেছেন যে, জগৎশেঠরা হচ্ছেন ‘bankers of the Mogul, the richest and the most powerful who have ever lived’.৪৪

আমরা আগেই বলেছি জগৎশেঠরা ছাড়া মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আরও দু’জন বণিকরাজা, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের কথা বলা দরকার, যদিও মুর্শিদাবাদে তথা বাংলায় জগৎশেঠদের মতো অতটা প্রভাব বা প্রতিপত্তি এঁদের ছিল না। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে এই তিন বণিকরাজা মিলে মধ্য-অষ্টাদশ শতকের মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতি থেকে রাজনীতি সবকিছুকেই যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিলেন। জগৎশেঠদের মতো অন্য দুই বণিকরাজার স্থায়ী নিবাস মুর্শিদাবাদে না হলেও মুর্শিদাবাদের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই নবাব ও নবাবের দরবারের অনুগ্রহলাভের জন্য মুর্শিদাবাদে তাদের আস্তানা করতে হয়েছিল এবং মুর্শিদাবাদই হয়ে উঠেছিল তাঁদের অন্যতম কর্মস্থল।

এই দুই বণিকরাজার মধ্যে একজন উমিচাঁদ বা আমিরচাঁদ। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশক ধরে বিশেষ করে, তিনি বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। উত্তর ভারত, সম্ভবত আগ্রা থেকে৪৫ তিনি বাংলায় আসেন ১৭২০-র দশকে এবং কলকাতার বিশিষ্ট দাদনি বণিক ও ইংরেজ কোম্পানির ‘ব্রোকার’ বিষ্ণুদাস শেঠের৪৬ অধীনে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেন।৪৭ ১৭৩০-র দশকের প্রায় প্রথম দিক থেকেই তিনি নিজেকে কলকাতার একজন গণ্যমান্য ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের দুই প্রধান ক্ষেত্র ছিল কলকাতা ও পাটনা। তার কাজকারবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কলকাতায় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে, বিশেষ করে ইংরেজ কোম্পানিকে পণ্য সরবরাহ, মহাজনি কারবার এবং অন্তর্বাণিজ্য আর বিহারে সোরা ও আফিং-এর ব্যবসা। ১৭৩০-র দশকের শেষ দিক থেকে তিনি পাটনাতে আলিবর্দির প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। ১৭৪১ সালে তিনি এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে পাটনা টাঁকশালের নিলাম কেনেন।৪৮ তাঁর ভাই দীপাচাঁদ বিহারে সোরা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘সরকার’ শরণের (Saran) ফৌজদারি চালাতেন। ইংরেজ কোম্পানিকে সোরা সরবরাহকারীদের অন্যতম প্রধান ছিলেন উমিচাঁদ। তিনি ও তাঁর ভাই দীপাচাঁদ মিলে বিহার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সোরার একচেটিয়া ব্যবসা প্রায় কুক্ষিগত করেছিলেন।৪৯

সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে অবশ্য উমিচাঁদের খুব একটা সুনাম ছিল না। ইংরেজ কোম্পানি কয়েকবারই তাঁর বিরুদ্ধে অসৎ উপায় অবলম্বন করার অভিযোগ করেছিল। কিন্তু কোম্পানি তাকে তাদের দাদন বণিকের কাজ থেকে বরখাস্ত করতে সাহস পায়নি, এই ভয়ে যে তা হলে তিনি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসি বা অন্য কোন ইউরোপীয় কোম্পানির পণ্য সরবরাহের কাজ নিয়ে নিতে পারেন। আসলে উমিচাঁদের ব্যবসায়ী বুদ্ধি, দক্ষতা ও অর্থবল সম্বন্ধে ইরেজদের এতই আস্থা ছিল যে তাঁকে তারা হাতছাড়া করতে চায়নি। এমনকী ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের এক সদস্য জন ফরস্টার (John Forster) লিখেছেন: ৫০

his [Umichand] natural and acquired capacity for business, his extra-ordinary knowledge of the inland trade and his greater command of money all which qualities I think render him a prosper person to deal with.

তবে উমিচাঁদের প্রতিষ্ঠা, সমৃদ্ধি ও সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল বাংলার শাসকগোষ্ঠীর, বিশেষ করে বাংলার নবাব ও মুর্শিদাবাদ দরবারের, সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ১৭৩৫ সালে যখন ইংরেজ কোম্পানি তাদের দাদনি বণিকদের তালিকা থেকে উমিচাঁদের নাম কেটে দিল, তখন আলিবর্দির বড় ভাই ও মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রভাবশালী অমাত্য, হাজী আহমেদ, কোম্পানিকে জানান যে উমিচাঁদকে যেন আবার দাদনি বণিক হিসেবে নিয়োগ করা হয়—তিনি নিজে উমিচাঁদের জন্য জামিন হতে প্রস্তুত।৫১ এ থেকে স্পষ্ট যে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে উমিচাঁদ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তার সোরা ও আফিং-এর প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা মুর্শিদাবাদ নবাবের দাক্ষিণ্যেই সম্ভব হয়েছিল। নবাব আলিবর্দিকে ছোটখাট বিদেশি ও দুষ্প্রাপ্য জিনিস উপহার দিয়ে তিনি তাঁর প্রশ্রয় পেয়েছিলেন।৫২ শুধু তাই নয়, নবাব সিরাজদ্দৌল্লারও তিনি প্রিয়পাত্র এবং বিশ্বস্ত সভাসদ হয়ে ওঠেন।

উমিচাঁদ যে একজন ধনী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। কোন অগ্রিম বা দাদনি না নিয়েই তিনি ইংরেজ কোম্পানির জন্য ১০ লক্ষ টাকার পণ্য সরবরাহ করতে পারতেন। ১৭৫০ সালে কোম্পানির কাছে তাঁর পাওনা ছিল ১৬ লক্ষ টাকা।৫৩ পাটনাতে তাঁর ভাই দীপচাঁদের বার্ষিক আয় ছিল এক লক্ষ টাকা, এ থেকে উমিচাঁদের,—যাঁর বাণিজ্যিক পরিধি আরও অনেক ব্যাপক ছিল—আয়ের কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে।৫৪ তিনি কলকাতার সবচেয়ে বড় ও ভাল অনেকগুলি বাড়ির মালিক ছিলেন। তাঁর সশস্ত্র কর্মচারী ও পিওনের সংখ্যা ছিল তিনশো।৫৫ ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম ১৭৫০-র দশকের প্রথমদিকে কলকাতায় ছিলেন এবং উমিচাঁদকে ভাল করেই জানতেন। তিনি উমিচাঁদ সম্বন্ধে লিখেছেন:৫৬

Among the Gentoo merchants established in Calcutta, was one named Omichand, a man of great sagacity and understanding, which he had employed for forty years with unceasing diligence to increase his for- tune…he was become the most opulent inhabitant of the colony [Calcutta]. The extent of his habitation, divided into various parts, the number of his servants continually employed in various occupations and a retinue of armed men in constant pay, resembled more the state of a prince than the condition of a merchant.

কলকাতায় উমিচাঁদের আস্তানা হলেও ১৭৪০র দশক থেকে তিনি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন মুর্শিদাবাদে যাতে নবাব ও তাঁর দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা সুদৃঢ় হয়। কারণ চতুর ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি জানতেন তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্যের জন্য নবাব ও তাঁর দরবারের দাক্ষিণ্য একান্ত প্রয়োজনীয়। পলাশি চক্রান্তের সময় দেখা যাচ্ছে তিনি প্রায় সর্বদাই মুর্শিদাবাদে। আমরা পরে দেখব, তাঁর মাধ্যমেই ইংরেজরা মুর্শিদাবাদে ইয়ার লতিফ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারপর থেকে পলাশির যুদ্ধের মাত্র ক’দিন আগে পর্যন্ত তিনি মুর্শিদাবাদেই ছিলেন। তাই তাঁকে বাদ দিলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের আরেক বণিকরাজা ছিলেন আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদ। সপ্তদশ শতক থেকেই আর্মানিরা বাংলায় বিদেশি বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম। তারা যে-সব পণ্য নিয়ে বাণিজ্য করত, তার মধ্যে অন্যতম বস্ত্র ও কাঁচা রেশম। তাই কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি অন্তত মধ্য-সপ্তদশ শতক থেকেই। মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে এদের প্রধান ঘাঁটি ছিল কারণ এরাও জানত যে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্যের জন্য মুর্শিদাবাদ দরবারের আনুকূল্য একান্তভাবে প্রয়োজন। সৈয়দাবাদে প্রথম আর্মানি গির্জা স্থাপিত হয় ১৬৬৫ সালে— তার ধ্বংসাবশেষের পাশে ১৭৫৮ সালে তাদের নতুন গির্জা তৈরি হয়।৫৭

বাংলায় আর্মানি বণিকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খোজা ওয়াজিদ। বাংলার বাণিজ্যিক রাজধানী হুগলি ছিল ওয়াজিদের প্রধান কর্মস্থল, সেখান থেকেই তিনি তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য চালাতেন। একদিকে ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি, অন্য দিকে উমিচাঁদের মাধ্যমে তিনি ইংরেজ কোম্পানিকে তাদের রফতানি পণ্য সরবরাহ করতেন তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যানধারণা ছিল তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য—যে কোনও মূল্যেই তিনি সেটার শ্রীবৃদ্ধি করতে প্রস্তুত ছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দির দাক্ষিণ্যেই তিনি বিহার অর্থনীতির অনেকটাই কুক্ষিগত করতে সমর্থ হন—বিহারে দু’টি প্রধান রফতানি পণ্য, সোরা ও আফিং-এর একচেটিয়া ব্যবসা তিনি নিজের করায়ত্ত করেন ১৭৪০-র শেষ দিক থেকে।৫৮ ১৭৫৩ সালে তিনি আলিবর্দির কাছ থেকে বিহারে সোরার একচেটিয়া ব্যবসা করার ইজারা পান।৫৯ তার আগের বছর তিনি নবাবকে ২৫ বা ৩০ হাজার টাকা দিয়ে লবণের ব্যবসার ইজারাও নেন।৬০

অন্য বণিকরাজাদের মতো খোজা ওয়াজিদের ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু দেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না—তিনি সমুদ্র বাণিজ্যেও লিপ্ত ছিলেন। মনে হয় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তিনি বর্হিবাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেন ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে। ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে (যদিও সেগুলি অসম্পূর্ণ, মাঝেমধ্যেই ফাঁক আছে) জানা যায়, পঞ্চাশের দশকে ওয়াজিদের অন্তত ৬টি বাণিজ্যতরী ছিল।৬১ এগুলির মাধ্যমে তিনি তখনকার বাংলার সবচেয়ে বড় বন্দর হুগলির সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর জাহাজগুলি হুগলি থেকে বিভিন্ন পণ্যসম্ভার নিয়ে জেড্ডা (Jedda), মোখা (Mokha), বসরা (Basra), সুরাট, মসুলিপট্টনম প্রভৃতি বন্দরে বাণিজ্য করতে যেত। জাহাজগুলির নাম—‘সালামত রেসান’, ‘মোবারক’, ‘গেনজামের(?)’, ‘মদিনা বক্স’, ‘সালামত মঞ্জিল’ ও ‘মুবারক মঞ্জিল’। ডাচ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুম ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের লেখা থেকে জানা যায় যে সুরাটে ওয়াজিদের একটি বাণিজ্য কুঠিও ছিল।৬২

মুর্শিদাবাদ দরবারে ওয়াজিদের যে প্রবল প্রভাব ও প্রতিপত্তি, তা শুধু জগৎশেঠদেরই ছিল। নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ, নবাব তাঁকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি, বিশেষ করে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে, দৌত্যে নিযুক্ত করতেন। ইংরেজরাও তাঁর সঙ্গে নবাবের ঘনিষ্ঠতার কথা ভাল করে জানত। তারা তাঁকে মুর্শিদাবাদ দরবারের একজন অমাত্য বা দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশীল ব্যক্তি বলেই মনে করত।৬৩ রবার্ট ওরম তাঁকে বাংলার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।৬৪ আর কাশিমবাজার ইংরেজ কুঠির উইলিয়াম ওয়াটস ও ম্যাথু কোলেট (Mathew Collet) লিখেছেন যে তিনি সুবে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ সওদাগর এবং নবাবের ওপর তাঁর প্রচণ্ড প্রভাব ছিল।৬৫ ফারসি ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খানও জানাচ্ছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দির এক ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় বন্ধু। ব্যবসা-বাণিজ্য করে তিনি প্রচুর ধনোপার্জন করেন এবং লোকে তাঁকে ‘ফখর-উৎ-তুজ্জার’ (সওদাগরদের গর্ব—pride of merchants) নামে জানত।৬৬

বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে ওয়াজিদ যে ১৭৪০-র শেষদিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন তা ডাচ রেকর্ডস থেকে স্পষ্ট। ১৭৫০ সালে বাংলায় ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টর ইয়ান হাউখেনস তাঁর ‘মেমোরি’তে লিখেছেন যে ডাচদের উচিত ওয়াজিদের সঙ্গে হৃদ্যতা রেখে চলা কারণ মুর্শিদাবাদ দরবারে তিনি খুবই ‘সম্মানিত ব্যক্তি’।৬৭ পঞ্চাশের দশকে যে তিনি নবাবের দরবারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি, তা বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষ ইয়ান কারসেবুমের ১৭৫৫-র লেখা থেকে পরিষ্কার। কারসেবুম লিখেছেন:৬৮

While mentioning those persons whose friendship would be very useful to your Honour I cannot neglect Coja Mahmet Wazit, recently honoured with the title of Faqqur Tousjaar meaning supporter of the treasure because he is truly the maintainer of the riches of the rulers. He gives them a lot willingly rather than under compulsion.

বলা বাহুল্য, পঞ্চাশের দশকের প্রথম কয়েকবছর, পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত, ওয়াজিদ মুর্শিদাবাদ দরবারের স্থায়ী সদস্য ছিলেন এবং স্বভাবতই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন মুর্শিদাবাদেই। আলিবর্দির মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হবেন এটা ধরে নিয়ে তিনি ১৭৫২ সাল থেকেই সিরাজের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। ধুরন্ধর এই আর্মানি বণিক খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য নবাব ও দরবারের আনুকূল্য অত্যন্ত জরুরি। সে জন্য তিনি প্রথমে নবাব আলিবর্দির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিলেন, পরে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গেও। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর প্রভাব যে কতটা প্রবল তার প্রমাণ সিরাজদ্দৌল্লা মসনদে বসার পর তাঁকেই ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করেন। জাঁ ল’-ও মন্তব্য করেছেন যে ওয়াজিদ ইউরোপীয়দের সঙ্গে নবাবের কূটনৈতিক আলাপ আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন।৬৯

ওয়াজিদ ইংরেজদের চেয়ে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি বেশি অনুকূলভাবাপন্ন ছিলেন। ক্লাইভ তাঁকে ফরাসিদের ‘এজেন্ট’ বলে মনে করতেন।৭০ আসলে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি তাঁর যে মনোভাব তা ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিপন্থী ছিল না। জাঁ ল’-র মন্তব্যই সঠিক যে ওয়াজিদ সবার সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।৭১ এর কারণ, তাঁর কাছে তাঁর নিজের ব্যবসার স্বার্থই ছিল সবচেয়ে বড়। তিনি ভাল করেই বুঝেছিলেন যে ইংরেজদের বিতাড়িত করে তাঁর কোনও স্বার্থসিদ্ধিই হবে না। তাঁর সেরা ও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা বা আফিংয়ের বাণিজ্য কিংবা তাঁর সমুদ্র-বাণিজ্য, ইংরেজদের তাড়িয়ে দিলে এসবের কোনওটাতেও বিশেষ কিছু লাভ হবে না।

ওয়াজিদ যেহেতু মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম, তাই পলাশির ষড়যন্ত্রে তাঁর একটা ভূমিকা অবশ্যই ছিল। তবে তিনি ছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত, এবং অনেকটা ইংরেজ-বিরোধী ও ফরাসিদের সমর্থক। তাই প্রথম দিকে তিনি পলাশি চক্রান্তের সঙ্গে একেবারেই যুক্ত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রে তিনি সামিল হন একেবারে শেষ মুহূর্তে। কিন্তু কেন? মনে হয় ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (জানুয়ারি ১৭৫৭) পর তিনি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি সিরাজকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করার জন্য পরামর্শ দেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ মার্চ ইংরেজদের হাতে ফরাসি চন্দননগরের পতনের পর ওয়াটস লেখেন যে ফরাসিদের পরাজয়ের পর সিরাজদ্দৌল্লা ওয়াজিদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন কারণ ওয়াজিদ নবাবকে বুঝিয়েছিলেন যে ফরাসিরা ইংরেজদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কখনওই সফল হতে পারবে না।৭২ এটা থেকে স্পষ্ট যে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের সম্ভাব্য আঁতাতকেই ওয়াজিদ তাঁর নিজের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে ভেবেছিলেন। সেটা তো হল না কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সবার শেষেই পলাশির ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ষড়যন্ত্র সফল করার পক্ষে প্রধান অন্তরায়। তাই ওয়াটস ৩ মে ক্লাইভকে লেখেন:৭৩

আমি শুনলাম যে খোজা ওয়াজিদের গোমস্তা শিববাবু আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।….তাঁর মনিব [ওয়াজিদ] ফরাসিদের মঙ্গলার্থে আত্মোৎসর্গ করেছেন এবং প্রথম থেকেই তিনি দরবারে তাদের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি সেখানে তাদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফরাসিদের ক্ষমতা ও সামরিক শক্তি সম্বন্ধে নানারকম অতিরঞ্জিত গল্প বাজারে চালু করেছেন…সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। নবাবের সঙ্গে আমাদের যে ঝামেলা চলছে তার জন্য তিনিই অনেকাংশে দায়ী। তিনি নবাবকে সবসময় আমাদের বিরুদ্ধে উস্কে দেন এবং আমাদের সম্বন্ধে প্রায়ই নবাবের মনে ভীতি ও আশঙ্কা ধরিয়ে দেন…শিববাবু এবং তাঁর মনিব আমার আর স্ক্র্যাফ্‌টনের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ এবং পারলে আমাদের খতম করে দেন।

সুচতুর ও পাকা হিসেবি ওয়াজিদ শেষ মুহূর্তে ষড়যন্ত্রে সামিল হন যখন তিনি বুঝলেন যে নবাবের পরিত্রাণের আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি জানতেন তার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য রাজনৈতিক আনুকূল্যের খুবই প্রয়োজন। ততদিনে মুর্শিদাবাদ থেকে জাঁ ল’র বিতাড়নের (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) ফলে নবাবের পক্ষে ফরাসিদের হস্তক্ষেপের সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়। আবার সিরাজদ্দৌল্লাকে দেওয়া তাঁর পরামর্শ—নবাব ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করুন—ব্যর্থ হওয়ায় সিরাজ তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং নবাব তাঁকে পরিত্যাগ করেন। মে মাসের প্রথমদিকে দরবারে তাঁর অবস্থা এমনই শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং তিনি নিরাপত্তার এমনই অভাব বোধ করতে থাকেন যে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় নেন। ওয়াটস ক্লাইভকে ৯ থেকে ১৩ মে’র মধ্যে কোনও এক সময় লেখেন: ‘খোজা ওয়াজিদ এখন নবাবের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। উমিচাঁদকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন তাঁকে আমাদের কুঠিতে [কাশিমবাজারে] লুকিয়ে আশ্রয় দিই।’৭৪

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওয়াজিদ নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য বাঁচাতে অনন্যোপায় হয়েই একেবারে শেষ মুহূর্তে পলাশির যড়যন্ত্রে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এবং তাঁর মতো অন্য দু’জন বণিকরাজারও কপাল খারাপ— পলাশি কিছুটা আগে-পরে বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের এই তিন বণিকরাজারই পতন ডেকে আনে। ১৭৫৮ সালেই ওয়াজিদের পতন সম্পূর্ণ হয়ে যায়—তিনি ঘোষণা করেন যে ইংরেজরা তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করেছে এবং তাঁকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। ওয়াজিদের পতন পলাশিতে ইংরেজ বিজয়ের প্রত্যক্ষ ফল, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

অবশ্য জাঁ ল’ বলছেন যে ওয়াজিদ তাঁর কূটনীতি ও হঠকারিতার শিকার হয়েছেন।৭৫ এটা সঠিক বলে মানা যায় না। যদি কোনও একটা বিশেষ কারণকে ওয়াজিদের পতনের মুখ্য কারণ হিসেবে ধরতে হয়, তবে তা হল তাঁর প্রতি ক্লাইভের প্রচণ্ড রোষ। ক্লাইভ তাঁকে ‘ভিলেন’ বলে মনে করতেন কারণ তিনি সন্দেহ করতেন, ওয়াজিদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভের ঘোরতর সন্দেহ ছিল যে পলাশির পর ১৭৫৭-তে ফরাসিদের বাংলায় হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনার সঙ্গে ওয়াজিদও যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখেন: ‘কাগজপত্রের মধ্যে ওয়াজিদের একটা চিঠি পাওয়া গেছে যাতে ওসব [ফরাসিদের পরিকল্পনা] ব্যাপারের উল্লেখ আছে। আমি চাই যে আপনি ওই ভিলেনের সর্বনাশের ব্যবস্থা করুন—ও কিন্তু মনেপ্রাণে ফরাসি।’৭৬ ইংরেজদের পক্ষে ওয়াজিদের সর্বনাশ সম্পূর্ণ করার সুযোগ এল ১৭৫৯-এ।

ওয়াজিদ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা যতদিন বাংলায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, ততদিন তাঁর ধ্বংসোন্মুখ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার কোন উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে তিনি আবার জুয়া খেলে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলেন। জুয়ায় আবার হারলেও তাঁর আর বেশি কী ক্ষতি হবে, জিতলে অনেক লাভ—হয়তো এটাই তিনি ভেবেছিলেন। তিনি ডাচদের সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন, ডাচরা বাংলা আক্রমণ করে ইংরেজদের তাড়াবার চেষ্টা করবে। কিন্তু পলাশির মতো তাঁর এই দ্বিতীয় জুয়া খেলাও ব্যর্থ হল। ডাচদের পরাজয়ের পর ওয়াজিদের সর্বনাশ ঠেকানো আর কোনও রকমেই সম্ভব ছিল না। ক্লাইভ খুব উৎফুল্ল হয়ে ওয়াজিদের পতন বর্ণনা করেছেন: ‘আমি জানতাম যে নবাবের সঙ্গে আমাদের কলকাতায় যে সাম্প্রতিক ঝামেলাটা হয়েছিল তার প্রধান হোতা হচ্ছে ওই ‘রাসকেল’ ওয়াজিদটা। আবার আমাদের সঙ্গে ডাচদের বিরোধ বাঁধাতে সে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তাকে হাতকড়া পরানো দরকার যাতে সে ভবিষ্যতে মহামান্য নবাব [মীরজাফর], আপনি [মীরণ] এবং আমার [ক্লাইভ] মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে তা ভাঙতে না পারে।’৭৭ ওয়াজিদকে ধরে জেলে পোরা হল। সেখানে তিনি বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।৭৮

উপরোক্ত তিন বণিকরাজা ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার, মহাজনও ছিল। কারণ এই অঞ্চল ছিল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের অন্যতম প্রধান উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র। শুধু বাংলা থেকে নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকী ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও বহু এশীয় বণিকরা কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য এই অঞ্চলে আসত। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কাশিমবাজারের কাটমা পরিবার ছিল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের অন্যতম ব্যবসায়ী। এরা মহাজনি কারবারেও লিপ্ত ছিল। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি এদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা ধার করত। ১৭২৪-র সেপ্টেম্বর মাসে কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ডাচ কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লক্ষ টাকা। এই ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিল কাটমা পরিবারের।৭৯ ফরাসি কোম্পানির অধ্যক্ষ ডুপ্লের (Dupleix) সময় তারা কাশিমবাজারের কাটমাদের কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়েছিল।৮০

এই কাটমা পরিবার থেকে ইংরেজ কোম্পানি কাশিমবাজারে তাদের ‘ব্রোকার’ বা প্রধান সওদাগর নিয়োগ করত। ১৭৩০ সালে তারা হাতু (Hathu) কাটমাকে এই পদে নিযুক্ত করেছিল। কারণ তিনি ছিলেন ‘a man of unquestionable credit and the properest person for the post of a broker’, এবং ‘a man of considerable estate.’৮১ কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে বিবাদের ফলে ১৭৩৭ সালে তিনি পদচ্যুত হন এবং তার জায়গায় ‘ব্রোকার’ হলেন কাটমা পরিবারেরই অন্যতম সদস্য, বলাই বা বলরাম কাটমা (রেকর্ডসে Bally)। তাঁকে নিয়োগ করার কারণ তাঁর ছিল ব্যবসায়ী হিসেবে বহুদিনের অভিজ্ঞতা এবং তিনি ছিলেন খুব ধনী পরিবারের লোক।৮২ ১৭৪১ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন—সে বছর ওই পদটি তুলে দেওয়া হয়।

মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার থেকে পণ্য, বিশেষ করে কাঁচা রেশম, সংগ্রহ করার জন্য ওখানে গুজরাট, লাহোর, মুলতান, দিল্লি, আগ্রা, বেনারস, গোরখপুর, পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বহু সওদাগর ভিড় জমাত।৮৩ তা ছাড়া ছিল আর্মানিরা—মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে তাদের বড় ঘাঁটি ছিল। তবে কাঁচা রেশমের বাজারে সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল গুজরাটিরা—দামের কোনও তোয়াক্কা না করে তারাই সবচেয়ে ভাল রেশম কিনত, যার জন্য সবথেকে উৎকৃষ্ট রেশমের নামই হয়ে যায় ‘গুজরাটি সিল্ক’। অবশ্য বাজারে অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীও ছিল, যাদের সাধারণত পাইকার বলা হত। এরা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ও এশীয় বণিকদের কাঁচা রেশমের জোগান দিত। এ সব ব্যপারীদের মধ্যে বাঙালি ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের অবাঙালি এবং আর্মানিরাও ছিল। ১৭৫৩ সালে ইংরেজ কোম্পানি কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সরবরাহের জন্য যে ৪২ জন ব্যাপারীর সঙ্গে চুক্তি করে তার মধ্যে অন্তত ১০/১২ জন ছিল গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের ব্যবসায়ী। বাঙালিদের মধ্যে উঁচু নিচু সব জাতের লোকই ছিল—ব্রাহ্মণ, বৈদ্য থেকে তেলি পর্যন্ত।৮৪

এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জাতির, গোষ্ঠীর হলেও তাদের মধ্যে একটা জোটবদ্ধতা ছিল যার ফলে কলকাতার দাদনি বণিকদের চেয়েও তারা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তারা অনেক সময়ই এরকম ‘জোট’ (ring) তৈরি করে ইউরোপীয় কোম্পানি বা বড় বড় এশীয় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করত এবং নিজেদের দাবিতে অটল থাকতে পারত। ১৭৪১ সালে ইংরেজ কোম্পানির এসব দাদনি বণিকরা চুক্তিমতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করার চেষ্টা করা হলে তারা জোটবদ্ধভাবে তা দিতে অস্বীকার করল কারণ এরকম জরিমানা তাদের কোনওদিন দিতে হয়নি। তাই এখনও তারা তা দেবে না। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি কলকাতা কাউন্সিলকে জানাল, কোম্পানির দাদনি বণিকরা জোটবদ্ধ হয়ে এমনই দৃঢ়তার সঙ্গে জরিমানা দিতে অস্বীকার করছে যে ইংরেজদের ক্ষমতা নেই তাদের বাধ্য করে।৮৫

এসব ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হয়ে থাকায় তাদের ওপর জোরজুলুম করার প্রচেষ্টাকে তারা অনেকাংশেই প্রতিহত করতে পারত। সাধারণভাবে কোম্পানিগুলি ব্যবসায়ীদের যে অগ্রিম (দাদনি) দিত, তার জন্য তাদের কাছ থেকে জামিন নিত। কিন্তু মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকগোষ্ঠী এরকম কোনও জামিন দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল। এরা যে কত স্বাধীনভাবে কাজ কারবার করত তা কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট: (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৪২)৮৬

…as to giving security as demanded of them [the merchants] is what they would not do on any account that some of them did business for Guzzeraters, Multaners, Armenians and other merchants and for greater amounts than with us and yet no such thing was ever demanded of them…besides there were none among them but what were esteemed men of credit and many of them substantial men….In short that none of them would submit to the reproaches/as they call it/ of giving security.

কোনওমতেই এ ব্যবসায়ীদের জামিন দিতে রাজি করাতে না পেরে কোম্পানি তাদের শর্ত মেনে নিয়েই তাদের সঙ্গে কাঁচা রেশম সরবরাহের চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৮৭

আসলে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকগোষ্ঠী অগ্রিমের জন্য জামিন দিতে এত অনিচ্ছুক ছিল কারণ তারা অনেকেই বিশিষ্ট সওদাগর এবং তারা বড় বড় ভারতীয় ও এশীয় ব্যবসায়ীদের পণ্য সরবরাহ করত। তাদের আশঙ্কা ছিল, একবার যদি তাদের জামিন দেওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে তা হলে বাজারে তাদের যে সুনাম আছে তা নষ্ট হয়ে যাবে এবং সবাই ভাববে যে তারা তেমন নির্ভরযোগ্য নয়।৮৮ ১৭৪৪ সালে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি থেকে কলকাতায় জানাচ্ছে যে তাদের যে পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সরবরাহ করতে বলা হয়েছে, তা ওখানে পাওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য তাদের মুর্শিদাবাদ-সৈয়দাবাদ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে হবে। এদের মধ্যে অনেকে বেশ ধনী এবং বাজারে এদের খুব সুনাম, বিশেষ করে রাম সিং, গোঁসাইরাম, রামনাথ ইচ্ছানাথ প্রভৃতি। এদের সাহায্য ছাড়া ওই পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এরাই প্রধানত এই পণ্যের ব্যবসায়ী এবং এরা সবচেয়ে ভাল মানের জিনিস সরবরাহ করে—অন্যান্য ব্যবসায়ীরা এই পণ্য সরবরাহ করতে একেবারে চাইত না। কিন্তু ওই ব্যবসায়ীরা অগ্রিমের জন্য কিছুতেই জামিন দিতে নারাজ। আর যদি এদের সঙ্গে রেশমিবস্ত্রের জোগান দেওয়ার জন্য ইংরেজরা চুক্তি না করে, তাহলে ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি সঙ্গে সঙ্গে এদের লুফে নেবে। তাই শেষ পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানি জামিন ছাড়াই এদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৮৯

সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সুরাটে যেমন বণিকদের ‘মহাজন’ বা ‘গিল্ড’ গোছের জিনিস ছিল,৯০ তেমনি মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের ব্যবসায়ীদেরও পঞ্চায়েত ছিল (রেকর্ডে ‘punch or whole body’)। পঞ্চায়েত যা ঠিক করত, সব ব্যবসায়ী তা মেনে নিত। ১৭৫৫ সালের কাশিমবাজার কুঠির লেখা থেকে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম ও বিধান সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যেতে পারে:৯১

Our merchants having entered into and signed a punch or agreement whereby they are bound not to allow of our taking the 10 percent penalty for the short delivery of goods in the year 1752, and that in case of our discharging any of them from our Employ, the whole body should quit our Business, and that any one or more, should for private ends violate these agreements, he or they should be liable to pay a penalty both to the merchants dismissed and to the Government with several other restrictions.

এটা থেকে বোঝা যায়, মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের ব্যবসায়ীদের পঞ্চায়েত বেশ শক্তিশালী ও কার্যকরী সংগঠনই ছিল।

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. J.H. T. Walsh, Murshidabad, pp. 254-58; J. H. Little, ed., N K. Sinha, Jagat Seth, p. VI.

২. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 7, 3 Jan. 1745; BPC, vol. 17, f. 437, 4 Jan. 1745; C & B Abstr., vol. 5, f. 28, para 49, 9 Jan. 1745.

৩. BPC, vol. 4, f. 462, vo.4, Nov. 1721.

৪. ঐ. vol. 4, f. 438 vo, 28 Aug. 1721. জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ টাঁকশালের ওপর প্রায় পুরোপুরি কর্তৃত্ব করতেন বলে আমার যে বক্তব্য, তা ওম প্রকাশ মানতে রাজি নন। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (‘On Coinage in Mughal India’, IESHR, 25, 4 (1988), p. 487) তিনি এটা বলেছেন। এখানে আমি যেসব তথ্য দিয়েছি এবং আমার বই From Prosperity to Decline, Chapter IV,এ যে-বিশদ আলোচনা আছে তা থেকে বলা যায় যে ওম প্রকাশের বক্তব্য সঠিক বলে মনে হয় না। অবশ্য এটা ঠিক যে বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির অধিকার সবারই ছিল কিন্তু জগৎশেঠরা নবাবের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে টাঁকশালের কাজকর্ম নিজেদের কুক্ষিগত করে নিয়েছিল। ফলে কাগজে কলমে যাই থাকুক না কেন, টাঁকশালের পুরো কর্তৃত্ব ছিল জগৎশেঠদের হাতে।

৫. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 16 March 1743.

৬. S. Chaudhury. From Prosperity to Decline, pp. 77-87, 111-112.

৭. BPC, vol. 11, f. 349, 8 Nov. 1736; vol. 12, f. 17, 13 Dec. 1736; Bengal Letters Recd., vol. 21, f. 507, 13 Jan. 1750; BPC, vol. 25, f, 43, 3 Feb. 1752.

৮. ক্লাইভকে লেখা লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, Orme Mss., India, XVIII, f, 5043, 17 Dec 1737.

৯. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 67-55.

১০. D. B., vol. 95, f, 519, 18 Jan. 1705.

১১. Indrani Ray, ‘Some Aspects of French Presence in Bengal, 1731-40’. CHJ. vol. 1, no. 1, July 1976, pp. 99-101.

১২. J. H. Little, ed., N. K. Sinha, Jagatseth, p. x, See also, Kantu Papers, BPC, vol. 8, f, 256, Annex. to Consult., 29 June 1730.

১৩. VOC, 2874 থেকে তথ্যের ভিত্তিতে।

১৪. J. H. Little, ed., N. K. Sinha, Jagatseth, p. XI; ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Fenwick) বলেছেন, ১৭৪৭-৪৮ সালে জগৎশেঠদের কাছে ফরাসি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লক্ষ টাকা আর ১৭৫৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি উইলিয়াম ওয়াটস একটি চিঠিতে ক্লাইভকে লিখেছেন যে শেঠদের কাছে ফরাসিদের ১৩ লক্ষ টাকা ধার আছে। Orme Mss. India, VI, f. 1525; ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, Bengal, vol. II, p. 229-এ উদ্ধৃত।

১৫. BPC, vol. 14, f. 317-17vo, 11 Dec. 1740.

১৬. ঐ, vol. 14, f. 337, 26 Dec. 1740.

১৭. ঐ, vol. 15, f. 84vo, 29 March 1742.

১৮. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 7 June 1742; BPC, vol. 15, f. 188, 10 June 1742.

১৯. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 14 June 1742; BPC, vol. 15, f. 194vo, 21 June 1742.

২০. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 6 June 1743; BPC, vol. 16, f. 181vo, 10 June 1743.

২১. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 2 July 1743.

২২. W.W. Hunter, Statistical Account of Bengal, vol. IX, p. 254.

২৩. BPC, vol. 8, f. 260, 13 July 1730.

২৪. ঐ, vol. 8, f. 234vo, 2 June 1730.

২৫. বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমার বই পলাশির অজানা কাহিনী, The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757 ও এ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

২৬. S.C. Hill, Three Frenchmen in Bengal, p. 77.

২৭. Sichtermann’s ‘Memorie’, VOC, 2629, f. 967, 14 March 1744.

২৮. Jan Huijghens’ ‘Memorie’, VOC, 2763, f. 467, 20 March 1750.

২৯. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, VOC, 2849, ff. 128-128vo, 14 Feb. 1755.

৩০. Louis Taillefert’s ‘Memorie’, VOC, 2849, ff. 247vo-248vo, 27 Oct. 1755.

৩১. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ৩৮

৩২. Louis Taillefert’s ‘Memorie’, VOC, 2849, f. 248-248vo, 27 Oct. 1755.

৩৩. J.H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. IV.

৩৪. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫৮।

৩৫. J.H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. 3.

৩৬. William Bolts, Considerations, p. 158.

৩৭. J. H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. XVII.

৩৮. Luke Scrafton to Colonel Clive, 17 Dec. 1747, Orme Mss., India, XVIII, f. 5043; Eur. G 23, Box 37.

৩৯. Quoted in J. H. Little, Jagatseth, ed., N. K. Sinha, p. 125; J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 29.

৪০. Orme Mss., India VI, f. 1455.

৪১. ঐ, f. 1525.

৪২. Orme Mss., India XVIII, f. 5041.

৪৩. Law’s Memoir, Hill, III, p. 185.

৪৪. Watts’ Memoirs, p. 28.

৪৫. ইংরেজ কোম্পানির পাটনা কুঠির নথিপত্রে উমিচাঁদ ও তাঁর ভাই দীপচাঁদকে (উপাধি ‘আগ্রাওয়ালা’) ১৭৪৭ সালে আজিমাবাদের (পাটনার তখনকার নাম) বাসিন্দা বলে বর্ণনা করা হয়েছে, Fact. Records, Patna, vol. 2, 3 April 1742. অন্য একটি সূত্রে উমিচাঁদকে ‘আগ্রার পূর্বতন বাসিন্দা’ বলা হয়েছে, BPC, vol. 17, f. 276vo.

৪৬. কলকাতার বিখ্যাত শেঠ পরিবার—যাদের অনেকেই দাদনি বণিক ছিলেন, জগৎশেঠদের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই। এই পরিবারের কয়েকজন ইংরেজ কোম্পানির প্রধান সওদাগর বা ‘ব্রোকার’ হিসেবে কাজ করেছে।

৪৭. N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, p.6.

৪৮. C & B Abstr., vol. 4, f. 376, 11 Dec. 1741.

৪৯. Home Misc. Series, vol. 192, f. 64; BPC, vol. 17, f. 769, 16 Dec. 1744.

৫০. BPC, vol. 20, f, 109-9 vo, 15 Aug 1747.

৫১. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 5, 21 Jan. 1736.

৫২. Hill, vol. II, pp. 63-64.

৫৩. BPC, vol. 23, f. 186, 1 July 1750.

৫৪. ঐ, vol. 17, f. 372 vo, 1 Dec. 1744.

৫৫. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 60, 128.

৫৬. ঐ, vol. II, Sec. I, pp. 60, 128.

৫৭. P. C. Majumdar, Musnud, p. 233.

৫৮. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 120.

৫৯. BPC, vol. 26, f. 110, 2 April 1753; Beng. Letters Recd., vol. 22, para 18, f. 410.

৬০. Orme Mss., O.V. 134, f. 13; Mss. Eur. D. 283, f. 22; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 120-21.

৬১. এসব তথ্য ডাচ রেকর্ডস থেকে সংগৃহীত। VOC 2661, 2689. 2862.

৬২. VOC 2849; Hill, II, p. 87.

৬৩. BPC, vol. 26, f. 132vo, 3 May 1758; C & Abst., col. 5, f. 424; Beng. Letters Recd., vol. 22, f, 412.

৬৪. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 58.

৬৫. Records of Fort St. George, Diary and Consultation Book, 1756, vol. 86, p. 32; Orme Mss., O.V. 19, p. 104.

৬৬. Yusuf Ali Khan, Zamia-i-Tadhkira-i-Yusufi, p. 17.

৬৭. ‘Memorie’ of Jan Huijghens, VOC 2763, f. 458, 20 March 1750.

৬৮. ‘Memorie’ of Jan Kerseboom, VOC 2849, f. 128 vo, 14 Feb. 1755.

৬৯. Law’s Memoir, Hill, vol. III, p. 187.

৭০. ওয়াটসকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Orme Mss. India, X, f. 112 vo.

৭১. Law’s Memoir, Hill, vol. III, p. 190.

৭২. সিলেক্ট কমিটিকে ওয়াটস, Select Committee Consults., Orme Mss., India V, f. 1210; O.V. 170, f. 215.

৭৩. ক্লাইভের ওয়াটস, ৩ মে ১৭৫৭ Hill, II, pp. 374-75.

৭৪. ক্লাইভের ওয়াটস, ৯-১৩ মে ১৭৬৭, Hill, II, pp. 379.

৭৫. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190, f. n. 1.

৭৬. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Orme Mss., India X, f. 112 vo.

৭৭. মীরণকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ নভেম্বর ১৭৫৯, Clive Mss., 269 No. 982.

৭৮. Mss. Eur. G 37, Box 22.ওয়াজিদ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণের জন্য আমার প্রবন্ধ “Trading Networks in a Traditional Diaspora. Armenians in India, c. 1600-1800’, paper presented at the XIIIth International Economic History Congress, Buenos Aires, July 2002.

৭৯. VOC 2030, ff. 156-58, 16 March 1725.

৮০. Indrani Ray, ‘Some Aspects of French Presence in Bengal, 1731-40’, CHJ, vol. 1, No. 1, July 1976, pp. 99-101.

৮১. BPC, vol. 8, f. 321, 7 Dec. 1730.

৮২. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 5. Consult. 5 Feb: 21 Feb; 19 March 1737; C & B.Abstr. vol.4, f.210. para 4, 15 Feb. 1737; BPC, vol. 12, f.162, 16 April 1737.

৮৩. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 233.

৮৪. ঐ, p.241, fn. 82.

৮৫. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 25 Dec. 1741.

৮৬. ঐ, vol. 6, 26 Frb. 1742.

৮৭. ঐ.

৮৮. ঐ. vol. 6, 27 Jan. 1744.

৮৯. BFC, vol. 17, f. 66, 23 April 1744; Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, 19 April 1744.

৯০. S. Chaudhury, The Surat Crisis of 1669—A Case Study of Mercantile Protest in Medieval India’, CHJ, vol. V, no. 2, Jan-June 1981, pp. 129-46.

৯১. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 12, 21 Oct. 1754.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *