বিভক্তিকরণ এবং সংযুক্তকরণ
আমাদের কাম্যবস্তুকে যখন আমরা এককভাবে দেখি তখন সেটা সংযুক্ত। সংযুক্ত বা একক কাম্যবস্তুকে কিভাবে বিভক্ত ও বিশ্লেষণ করতে হয় সেই পদ্ধতি শিখতে যাচ্ছেন আপনি এই নতুন পরিচ্ছেদে। সংযুক্ত এবং বিভক্ত কাম্যবস্তু কাকে বলে? একটা উদাহরণ দিয়ে উত্তরটা দেবার চেষ্টা করছি।
ধরুন, একটি হাতঘড়ি। ঘড়িটি যেমন (সংযুক্ত) সেটিকে সেভাবে না দেখে আমরা ঘড়িটির ছোটবড় অসংখ্য সব অংশগুলোকে বিবেচনা করবো (বিভক্ত)। এ বিন্দু বিন্দু পানির সমষ্টি সিন্ধু। এঁটের উপর ইট সাজিয়ে তৈরি করা হয় একটি আকাশছোঁয়া প্রাসাদ। মাইলের পর মাইল অতিক্রম করলে ঢাকা থেকে দিল্লী পৌঁছানো যায়। যে-কোনো বস্তু বা বিষয়কে আপনি দু’ভাবে দেখতে পারেন। একটি তার সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিণত রূপ, অপরটি খণ্ড খণ্ড, টুকরো টুকরো চেহারা।
গোটা একটা জিনিসকে চিন্তা করা, আর তাকে টুকরো টুকরো, আলাদা আলাদা করে চিন্তা করার মধ্যে পার্থক্য আছে।
ধরুন, আপনি একটা বাড়ি তৈরি করতে চান। আপনার মনে, আর কিছু নয়, যদি বাড়িটার স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপটাই সর্বক্ষণ স্থান পায় তাহলে বাড়ি তৈরি করার কাজটা এমন বিরাট এবং অসম্ভব বলে মনে হবে যে কাজে হাত দেবার সাহসই আপনার মধ্যে আসবে না। অথচ একটার উপর একটা ইট স্থাপন করা খুবই সহজ কাজ। সেই ইটটার উপর আর একটা ইঁট চড়ানো, এও জলবৎ তরলং। এইভাবে একটা একটা করে আপনি যদি ইটের উপর ইট গাঁথতে থাকেন, একটা পাঁচিল তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
আপনার কাম্যবস্তুকে দু’রকম দৃষ্টিতে এখন থেকে দেখবেন আপনি। এক, কাম্যবস্তুর স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপটা দেখুন বা চিন্তা করুন। দুই, আপনার কাম্যবস্তুকে দেখুন কয়েক ভাগে ভাগ করে, বিভক্ত অবস্থায়।
এই পদ্ধতিতে দেখা বা চিন্তা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, নিজেকে যোগ্য, পারদর্শী এবং দক্ষ বলে মনে হবে।
একটা বইয়ের কথা ধরুন।
দু’হাজার পাতার একটি বই দশ ইঞ্চি ইটের মতো দেখতে। বইটা দেখে আপনি ভাবতে পারেন, ইস্! এতো বড় বই লেখা চাট্টিখানি কথা নয়! কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করেছেন লেখক। আমার দ্বারা এইরকম একটা বই লেখা কক্ষনো সম্ভব নয়।
আপনার সাথে একমত হতে পারবো না। বইটার লেখক পরিশ্রম করেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন-এ আমি মানতে রাজি নই।
আচ্ছা, বলুন তো,ফুলস্কেপ কাগজের দু’পাতা ব্যাপী একটা চিঠি লিখতে কি আপনার অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়? নিশ্চয়ই হয় না। সারাদিনে ক’টা ওই। রকম চিঠি লেখা সম্ভব আপনার পক্ষে, অমানুষিক পরিশ্রম না করে? গোটা পাঁচেক? আরো বেশি? গুড-দশটা চিঠি তাহলে, কেমন? দশটা চিঠি মানে, কুড়ি পৃষ্ঠা।
এটা একটা তথ্য। তথ্য বলছে, আপনি সারাদিনে কুড়ি পৃষ্ঠা লিখতে পারেন। কিভাবে লেখেন? কুড়ি পৃষ্ঠা কি একসাথে লেখেন? না, তা সম্ভব নয়। এক লাফে যেমন গাছের মগডালে ওঠা যায় না, তেমনি এক ঝটকায় কুড়ি পৃষ্ঠা লেখা সম্ভব নয়।
লেখক প্রথমে শব্দ লেখেন, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্য রচনা করেন। কয়েকটি বাক্য রচনা করার পর হয় একটি প্যারাগ্রাফ। বেশ কয়েকটি প্যারাগ্রাফের সমষ্টি একটি পরিচ্ছেদ। পরিচ্ছেদের সমষ্টি একটি বই।
আপনি এক মাসে লিখতে পারেন ছয়শো পৃষ্ঠা। ফুলস্কেপ কাগজের এক পৃষ্ঠা সমান ছাপা বইয়ের এক পৃষ্ঠা ধরা যাক। তিন মাস যদি নিয়মিত লেখেন আপনি, আঠারোশো পৃষ্ঠার দীর্ঘ চিঠি বের হচ্ছে আপনার হাতের কলম দিয়ে। চিঠি না লিখে আপনি একটা বইও লিখতে পারেন এই তিন মাসে।
দু’হাজার পৃষ্ঠার বই যিনি লিখেছেন তিনি তাঁর বই লেখার কাজটাকে ভাগ ভাগ করে নিয়ে নিয়মিত রোজ কিছু কিছু করে লিখেছেন। অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়নি তাঁকে।
অথচ বইটি দেখে আপনি আঁৎকে উঠে বলেছিলেন, আপনার দ্বারা ওই রকম একটা বই লেখা কক্ষনো সম্ভব নয়। কেন বলেছিলেন কথাটা বলুন তো?
বইটার সম্পূর্ণ রূপ দেখে বলেছিলেন। বইটার সম্পূর্ণ চেহারাখানা এতো বিরাট যে দেখামাত্র ভয় লাগে, বাপরে! এতো বড়! আসলে কিন্তু যতো বড় মনে হয় ততোবড় হয়েও অতোবড় নয়, যদি আপনি বইটিকে ভাগ ভাগ করে দেখে নিতে জানেন।
.
দেখার চোখ
সবাই আমরা দেখতে পাই, চোখ যখন আছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব কম। লোকই পর্যবেক্ষণ করে।
বলতে পারবেন, এক টাকার কাগুঁজে নোটের কোন্ পিঠের কোন্ খানটায় লেখা আছে ওয়ান টাকা?
পাসপোর্ট করা দরকার আপনার। অফিসের সহকারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসটা কোথায় জানো?’
সহকারী বললো, ‘কি আশ্চর্য! আপনি তো, স্যার, অফিসে আসার সময় পাসপোর্ট অফিসের পাশ দিয়েই আসেন।’ এধরনের ঘটনা ঘটেনি আপনার জীবনে?
বেশিরভাগ মানুষই দেখে, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে না।
কেউ কেউ বাগান দেখে, কিন্তু তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাগানে কি কি ফুল দেখলে? বলতে পারবে না সে। দুটো কারণে সে প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারলো না। এক, কি কি ফুল বাগানে আছে, লক্ষ করেনি সে। দুই, ফুল দেখে থাকলেও ফুলগুলোর নাম জানা নেই তার।
প্রমাণ হলো, এই লোক দেখে, কিন্তু দেখে শেখে না। আরো প্রমাণ হলো, এ লোক খুঁটিয়ে দেখে না।
একটা জিনিসের মূল্য বুঝতে হলে তাকে কেবল সামগ্রিক ভাবে দেখলে চলবে না, তাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে, তার বৈশিষ্ট্য কি, ত্রুটি কি, বিশেষত্ব কি-সব লক্ষ্য করে জেনে নিতে হবে।
দেখা মানে চোখের সামনে যা কিছু আছে সে-সবের চিত্র গ্রহণ করা। সেই চিত্রগুলোকে স্মরণের মধ্যে রেকর্ড করাকে পর্যবেক্ষণ বলা যেতে পারে।
স্মরণশক্তির মধ্যে যেগুলো রেকর্ড হয়ে রইলো সেগুলো আপনার সচেতনতার অংশ। বিশেষ হয়ে থাকবে।
পর্যবেক্ষণ শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। আপনার মধ্যে এই শক্তি বৃদ্ধি পেলে কাম্যবস্তু এবং আপনার মধ্যবর্তী বাধাবিঘ্নগুলোকে সহজেই পরিষ্কারভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন, আড়ালের বাধাটাকেও বহু দূর থেকে আপনি দেখতে পাবেন। তার উপর, কাম্যবস্তুর উপাদান বিভক্তিকরণেও সাহায্য পাবেন।
আপনার চিন্তাভাবনাকে গঠনমূলক করতে হলেও কোনো জিনিসকে কিংবা কোনো বিষয়কে দেখতে হবে পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি নিয়ে।
.
ঘনীভূত মনোযোগ
আপনি যা দেখেন তার একটা নোট রাখা মানে পর্যবেক্ষণ করা। কনসেনট্রেশন বা ঘনীভূত মনোযোগ কাকে বলে? নির্দিষ্ট কোনো অবজেক্ট বা সাবজেক্টের উপর যদি আপনি আপনার চেতনা এবং সজ্ঞান চিন্তা সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করেন, যতোক্ষণ না সাবজেক্ট বা অবজেক্টটি সম্পর্কে আপনার পুরোপুরি ধারণা হচ্ছে–এই অবস্থাকে। ঘনীভূত মনোযোগ বা কনসেনট্রেশন বলা চলে।
কন্সালটিং সাইকোলজিস্টদের কাছে যতো লোক যায়, তাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন স্বীকার করে যে চিন্তায় ভাবনায় মনোযোগ ঘনীভূত করার ক্ষমতার অভাব রয়েছে তার মধ্যে।
মনোযোগ ঘনীভূত করতে পারা একটা গুণ, কিন্তু ঈশ্বর প্রদত্ত অলৌকিক কিছু নয়। এ গুণের অধিকারী আপনিও হতে পারেন। কথাটা ঠিকভাবে বলা হলো না, আসলে এই গুণের অধিকারী হতেই হবে আপনাকে। আপনার জন্যে এটা ফরয।
‘চিন্তায় বা কাজে মন বসাতে পারি না আমি।’–এই ধরনের নেতিবাচক কথা ভাববেন না বা বলবেন না। আপনি যদি বারবার বলেন, ‘কিছুই মনে রাখতে পারি না আমি।’-দেখবেন, সত্যি সত্যি কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। এই নিয়ম সব কিছুতে খাটছে। যা ধরে নিচ্ছেন, ফলাফল তাই ঘটছে।
হাতের কাজ সম্পর্কে বিরূপতাও ঘনীভূত মনোযোগের অভাব ঘটায়। চঞ্চল মন পালাবার চেষ্টা করতে পারে। তাই, কাজটাকে আগে পছন্দ করুন। পছন্দসই কাজে মনকে বসাতে হয় না, মনই আপনাকে বসায়।
কুঁড়েমির কারণেও ঘনীভূত মনোযোগর অভাব ঘটা বিচিত্র নয়। কিন্তু কেউ যদি আনন্দদায়ক কোনো কাজ করে, কুঁড়েমি আসতেই পারে না তার মধ্যে। এক্ষেত্রেও ওষুধ ওটাই: আনন্দ দেয় যে কাজ সেই কাজ করুন।
নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করলে কোনো কাজেই ঘনীভূত মনোযোগ প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না।
.
অনুশীলন
আরামদায়ক একটি চেয়ারে এমন পজিশন নিয়ে বসুন, সামনে ফাঁকা দেয়াল ছাড়া যেন আর কিছু দেখা না যায়। ছোটো একটা টুল বা টেবিল রাখুন নিজের সামনে। টেবিলের উপর রাখুন একটা বই–যে-কোনো বই। এখন আপনার একমাত্র কাজ পাঁচ মিনিটের জন্যে দুনিয়া সম্পর্কে যাবতীয় সব কথা ভুলে যান, ভুলে গিয়ে ভাবুন। শুধুমাত্র বইটার কথা। বইটার দিকে তাকিয়ে বারবার, এটা একটা বই…এটা একটা বই… এটা একটা বই…’ উচ্চারণ করার দরকার নেই। বইটা সম্পর্কে। ভাবুন, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে, যতোরকম ভাবে ইচ্ছা ততোরকম ভাবে। আপনি বইটার বিষয়-সূচী সম্পর্কে ভাবতে পারেন, আকার সম্পর্কে ভাবতে পারেন; রঙ, নাম, কাভার, ডিজাইন, বাঁধাই ইত্যাদি সম্পর্কে যা ইচ্ছা তাই ভাবতে পারেন। বইটা সম্পর্কে ভাববার বিষয়বস্তুর অভাব পড়বে না আপনার। আপনি যদি মুদ্রণ সম্পর্কে মোটামুটি জানেন, তাহলে মানসপটে দেখতে পারেন বইটা ছাপা হচ্ছে। এমনকি আপনি কল্পনার চোখে দেখতে পারেন বইটা ডাকযোগে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন এজেন্টদের কাছে চলে যাচ্ছে, বিভিন্ন দোকানে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে।
এইভাবে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট বইটা সম্পর্কে চিন্তা করার পর, কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়ুন বইটা নিয়ে একটা রচনা লিখতে। বইটাকে নিয়ে রচনা লিখবেন, কিসের উপর ভিত্তি করে? পাঁচ মিনিট ধরে বইটার কথা যা ভেবেছেন, সেই
ভাবনাই হবে আপনার রচনার মালমশলা।
লিখেছেন? বেশ। রেখে দিন ওটা।
পরদিন বই নয়, অন্য কোনো একটা জিনিস গ্রহণ করুন আপনার দ্বিতীয় রচনা লেখার জন্যে। আম, কাঁঠাল বা যে-কোনো একটা ফলকে বেছে নিতে পারেন। বইটার উপর যেভাবে পাঁচ মিনিট সময় খরচ করেছিলেন এই ফলটার উপরও সেই পদ্ধতিতে সময় খরচ করুন। ভাবুন, ফলটা কিভাবে জন্মালো, কিভাবে গাছ থেকে বাজারে এলো, কিভাবে বাজার থেকে আপনার বাড়িতে তসরিফ আনলো, ফলটার স্বাদ কি রকম, দেখতে কেমন, কি ভিটামিন কি পরিমাণ, আছে, এই ফল বছরের কোন্ সময় ফলে-ইত্যাদি।
ফলের উপর রচনা লিখলেন, কেমন? রেখে দিন এটাও। ভালো কথা, রচনাগুলো যেন পাঁচশো শব্দের কম না হয়।
এইভাবে, সপ্তাহের সাতদিন সাতটি আলাদা আলাদা জিনিসের উপর সাতটি রচনা লিখবেন আপনি। লিখিত রচনাগুলো রেখে দিতে বলেছিলাম, আপনার সন্তুষ্টির জন্যেই। সর্বশেষ রচনাটি লেখা শেষ হলে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় রচনাটি ড্রয়ার থেকে বের করে পড়ুন। প্রথম দিকের রচনাগুলোয় অনেক ত্রুটি পাবেন। যে-ধরনের ক্রটি আপনার শেষ দিকের রচনাগুলোয় পাবেন না। তার মানে, শেষের দিকে উন্নতি হয়েছে আপনার। রীতিমত বিস্মিত হবেন আপনি শেষের দিকের রচনাগুলোয় আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তির উন্নত প্রকাশ দেখে। এই অনুশীলনের মাধ্যমে আপনি অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ শক্তি অর্জন করছেন, সেই সাথে মনোযোগ ঘনীভূত করার চমৎকার কৌশলটা শিখে নিচ্ছেন। এবং বোনাসস্বরূপ, রচনা লেখকের কৃতিত্ব লাভ করছেন, নিজের চিন্তা-ভাবনাকে গুছিয়ে প্রকাশ করার কায়দাও রপ্ত হয়ে যাচ্ছে আপনার।