পরিকল্পনা
পরিকল্পনার অর্থ সঙ্কল্পিত কাজটিকে বাস্তবায়িত করার উপায় বা প্রণালী উদ্ভাবন।
সঙ্কল্পিত কাজটিকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে উপায় আবিষ্কার করতেই হবে আপনাকে। এর জন্যে মাথা ঘামানোর দরকার পড়ে। আপনাকে চিন্তা করে উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।
ভয়ের কিছুই নেই, কারণ চিন্তা করে উপায় উদ্ভাবনের ব্যাপারটা মোটেই কঠিন নয়। এর জন্যে প্রতিভাবান বা অসাধারণ বুদ্ধিমান না হলেও চলবে।
কাজ একটি, কিন্তু সেটিকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে অনেকগুলো উপায়ের দরকার। ধরুন, পিকনিকে যাবেন। আপনার বন্ধু-বান্ধবদের কারো মাথায় এলো, সে-ই প্রকাশ করলো ইচ্ছের কথাটা। আপনারা সবাই রাজি হলেন যেতে।
এবার পরিকল্পনা রচনার পালা।
কাজ একটি–পিকনিক। পরিকল্পনা করতে হলে এই কাজটিকে বেশ কয়েকভাগে ভাগ করে নিতে হবে। এবং প্রত্যেকটি ভাগকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আলাদা আলাদা উপায় আবিষ্কার করে নিতে হবে।
প্রথমেই যে প্রশ্নটি দেখা দেবে সেটি হলো, কোথায় যাবেন? এ ব্যাপারে মত বিরোধ দেখা দিতে পারে। কেউ বলবে চন্দ্রায় যাবো, কেউ বলবে জয়দেবপুরের নাম বা সুদূর কক্সবাজারের নাম। ধরুন, আপনারা দশজন বন্ধু যাবেন, ছয়জনই এর আগে চন্দ্রায় পিকনিক করে এসেছেন। একই জায়গায় দু’বার যেতে চায় না। সাধারণত কেউ। তর্ক-বিতর্ক চলবে আপনাদের মধ্যে। আরো উল্লেখযোগ্য জায়গার নামে প্রস্তাব উঠবে। কিন্তু দেখা গেল প্রশ্নটার সমাধান হচ্ছে না। উপায়?
আবিষ্কার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা গেল, রাজবাড়িতে যাবার কথা বলছে সাতজন। বাকি তিনজন রাজি নয়, কারণ রাজবাড়িতে আগে গেছে তারা। এই তিনজনের মধ্যে হয়তো আপনিও আছেন। সমস্যাটার সমাধানকল্পে, অধিকাংশ বন্ধু যখন রাজবাড়িতেই যেতে চাইছে, আপনিও সম্মতি দিলেন। বাকি রইলো দু’জন। এদেরকে বোঝানো দরকার। সবাই মিলে চেষ্টা করলেন। দুজনই হয়তো, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত, রাজি হলো রাজবাড়ি যেতে। কিংবা, যদি রাজি না হয়, অগত্যা ওদের দুজনকে বাদ দিয়েই আপনারা সিদ্ধান্ত নিলেন, রাজবাড়িতেই যাবেন পিকনিক করতে।
এক নম্বর সমস্যার সমাধান হলো। এরপর দু’নম্বর সমস্যা। কবে যাবেন?
এ ব্যাপারেও মতবিরোধ দেখা দেবে। কেউ বলবে আগামী মাসের এক তারিখে.শুক্রবার, ছুটির দিন, ওই দিনই চলো। কিন্তু দু’জন মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলো, আগামী মাসের এক তারিখে জরুরী কাজ আছে, কোনোমতেই যেতে পারবো না। ব্যবসা করে এমন দুই বন্ধু হয়তো বলবে, তাহলে দু’তারিখে, শনিবার দিন চলো। পাঁচজন হয়তো সাথে সাথে প্রতিবাদ জানাবে, কারণ, তারা চাকরি করে, শনিবার দিন অফিস কামাই করা অসম্ভব।
প্রশ্নটাকে নিয়ে সমস্যার উদ্ভব হবে। সমস্যাটার সমাধান করতে হলে উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। আগামী মাসের আট তারিখ, শুক্রবার। সকলের ছুটির দিন। কেউ হয়তো এই দিনটির কথা বললো। ওই দিনে হয়তো আপনার জন্যে ঢাকার বাইরে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। কারণ, ওই আট তারিখে, আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে, স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবেন। সাত তারিখে বেতন পাবেন, আট তারিখে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাবেন-কথা দিয়েছেন স্ত্রীকে। প্রায় বছর খানেক স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখেননি। রীতিমতো ঝগড়া-ঝাটি, মান-অভিমানের পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অমুক তারিখে নিয়ে যাবেনই। এই অবস্থায় সিনেমা না দেখিয়ে আপনার উপায়ই নেই, প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে।
ওদিকে, আপনি ছাড়া, আর সবাই ওই আট তারিখে পিকনিকে যাওয়ার ব্যাপারে একমত। এখন উপায়? চিন্তা করতে হবে আপনাকে। উপায় বের করতে হবে।
সিনেমাও দেখাতে হবে, পিকনিকেও যেতে হবে। একই দিনে দুটো কাজ। করা সম্ভব নয়। চিন্তা করতে গিয়ে আপনি দেখবেন, সমস্যাটার সমাধান একটা। নয়, বেশ কয়েকটি আছে। যেমন, এক-নির্দিষ্ট তারিখের আগেই স্ত্রীকে সিনেমা দেখিয়ে দেয়া। দুই স্ত্রীকে সমস্যাটার কথা বলা, তাকেও পিকনিকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দেয়া। তিন-স্ত্রীকে ঘুষ দেয়া (সিনেমা দেখাতে খরচ হবে ত্রিশ টাকার মতো, তাকে পঞ্চাশ বা একশো টাকার কিছু দেবার লোভ দেখান, বলুন, পরে সিনেমা দেখাবো)। চার-মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে তাকে ক্ষান্ত করা। আপনি বলতে পারেন, আট তারিখে বসের বাড়িতে যেতে হবে, পদোন্নতির ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্যে (তবে, মিথ্যে অজুহাত না দেখানোই ভালো)। অর্থাৎ কোনো না কোনো ভাবে আপনার ব্যক্তিগত সমস্যাটার সমাধান আপনি করে নিলেন। মিটে গেল পিকনিকে যাবার দু’নম্বর সমস্যা।
এইভাবে, এক এক করে প্রতিটি বাধা এবং সমস্যা খতিয়ে দেখে উপায় উদ্ভাবনের মাধ্যমে সব কিছু স্থির করতে হবে আপনাকে। একের পর এক প্রশ্ন উঠবে। প্রত্যেকটিরই উত্তর বের করে নিতে হবে। কখন রওনা হবেন, কখন ফিরবেন, খাওয়া-দাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে, কতো টাকা করে চাঁদা ধরা হবে, তৈজসপত্র সাথে নেবেন কি কি, কার কাছে কি তৈজসপত্র আছে,ইত্যাদি আরো
অনেক ব্যাপারে আলোচনা করে প্রত্যেকটি ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাদেরকে। অর্থাৎ পিকনিকে যাবার ইচ্ছাটাকে একটা পরিকল্পনার মধ্যে বন্দী। করতে হবে। আপনাদের পরিকল্পনা যতোটা নিখুঁত হবে পিকনিকটাও সেই পরিমাণ নির্ঝঞ্ঝাট, আনন্দ মুখর ও উপভোগ্য হবে। এই-ই নিয়ম।
এই নিয়ম সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কোনো কাজে সাফল্য চান? পরিকল্পনা রচনা করুন।
আপনি সাফল্য চান। সাফল্যের পথে রওনা হতে চান। কি করতে হবে আপনাকে তা এখন আবার নতুন করে বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, একটি সুন্দর, নিখুঁত পরিকল্পনা রচনা করা দরকার এখন।
কোথায় কোথায় যাবেন? সাফল্যের পথে যাত্রা শুরু করার আগে এই প্রশ্ন উঠছে, তাই না? কোথায় যে থায় যাবেন অর্থাৎ কি কি চান আপনি?
সাফল্যের পথে যাত্রা, বই গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা। মুখে মুখে বা মনে মনে এর। পরিকল্পনা করা উচিত হবে না। কাগজ কলম নিন।– কাগজ কলম নিয়েছেন? বেশ। একটু সবুর করুন, প্রয়োজনীয় দু’চার কথা বলে নেই আগে। কি কি চান তা ঠিক করবেন আপনি, ঠিক করে জিনিসগুলোর। নাম লিখবেন কাগজে। অর্থাৎ একটা তালিকা তৈরি করবেন।
আপনার প্রয়োজন এবং আপনার ইচ্ছা বা কামনা-এ অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কি কি চান আপনি তা আপনাকে নিখুঁত, পরিষ্কার এবং বিশদভাবে জানতে হবে। এবং যা যা চান, গুরুত্ব অনুসারে, এক এক করে সাজাতে হবে।
কিন্তু তারও আগে, যা যা চান তা ঠিক করার আগে, আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি কি কি চান না।
একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করছি।
ধরুন, আপনি একটি পুরানো বিল্ডিংকে ভেঙে নবরূপ দিতে চান। প্রথম পদক্ষেপটা কি হবে আপনার? একজন আর্কিটেক্টকে ডাকা, তাই না? বেশ, আর্কিটেক্ট এলেন। তাঁর প্রথম পদক্ষেপটা কি হবে? বিল্ডিংটিকে ঠিক কি রূপে রূপান্তরিত করতে চান তিনি তা সবচেয়ে আগে স্থির করতে হবে তাঁকে। নবরূপ দানের জন্যে তিনি একটি পরিকল্পনা রচনা করবেন অর্থাৎ তিনি একটি নকশা তৈরি করবেন এবং নকশাটিকে বাস্তবে রূপ দেবার সূচনা-স্বরূপ তিনি স্থির করবেন বিল্ডিংটা থেকে কি কি জিনিস সরিয়ে ফেলতে হবে, কোন কোন অংশ আংশিক বা সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে হবে। অন্য কথায়, গড়ে তোলার আগে তাকে ভাঙার কাজে হাত দিতে হবে।
নতুন করে জীবনটাকে গড়ে তুলতে হলে আর্কিটেক্ট ভদ্রলোকের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে আপনাকেও।
আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদরা প্রত্যক্ষদর্শনে বিশ্বাসী। আপনার পরিকল্পনাটা কাগজে লিখে নিন, প্রয়োজনে কাগজের ভাঁজ খুলে লিখিত পরিকল্পনা পরীক্ষা করুন বারবার এবং প্রয়োজন মতো সংশোধন করুন-এই প্রচলিত নিয়ম পালন করার পরামর্শ তো তারা দিচ্ছেনই, তারা আরও বলছেন, তুমি যা চাও অর্থাৎ তোমার অবজেকটিভ বা কাম্যবস্তু যে জিনিসটি সেটির ছবি তোমাকে দেখতেই হবে।
ছবি দেখতেই হবে–কিভাবে? পরে বলছি। তার আগে আপনার জানতে হবে কিভাবে তৈরি করবেন আপনার অবজেকটিভের তালিকা।
আপনার অবজেকটিভের সংখ্যা জানতে হবে আপনাকে। কি কি চান, লিখে ফেলতে হবে এক এক করে, সাধারণ একটা তালিকা তৈরি করতে যাচ্ছি আমরা। এটাকে আপনি কাম্যবস্তুর তালিকা বা অবজেকটিভ চার্ট বলতে পারেন। চার্টটাকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করে নেবো। এই চার্টের তালিকা হয়তো আপনার নিজস্ব চাহিদার তালিকার সাথে মিলবে না। আপনার প্রয়োজন এবং মনের ইচ্ছাগুলো হতে পারে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। সেক্ষেত্রে, তালিকার নমুনাটা বুঝে নিয়ে আপনি নিজেই নিজের জন্যে একটি আলাদা চার্ট তৈরি করে নেবেন, আপনার নিজস্ব প্রয়োজন এবং মনের ইচ্ছাগুলো অনুযায়ী।
আসুন, শিখে নিন। কাগজ নিন দুশিট ফুলস্কেপ। কলম নিন।
নিয়েছেন কাগজ-কলম?
বেশ। প্রথম কাগজটার উপরে লিখুন, বেশ বড় বড় অক্ষরে-বস্তু। এবার স্থির করুন অর্থাৎ চিন্তা করে নির্ধারণ করুন কি কি বস্তু প্রয়োজন আপনার। এক এক করে, সিরিয়াল নম্বর দিয়ে লিখে ফেলুন আপনার প্রতিটি প্রয়োজন। ধরুন, আপনার এক নম্বর প্রয়োজন (বস্তুগত উপকরণ)-একটি নতুন বাড়ি। কাগজে লিখুন, ১) একটি নতুন বাড়ি। এর নিচে লিখুন, ২) একটি নতুন ব্যবসা। এইভাবে নম্বর দিয়ে লিখতে থাকুন এক এক করে প্রত্যেকটি প্রয়োজনের নাম-৩) নতুন গাড়ি। ৪) টেলিভিশন। ৫) ইলেকট্রিক ফ্যান। ৬) ফ্রিজ। ৭) স্টীল আলমারি। ৮) দামী ক্যামেরা। ৯) ড্রেসিং টেবিল। ১০) থ্রী-ইন-ওয়ান। ১১) রেডিওগ্রাম। ১২) গহনা। ১৩) দামী ঘড়ি। ১৪) কার্পেট। ১৫) এয়ারকুলার। ১৬) পোশাক পরিচ্ছদ। ১৭) সোফা। ১৮) অ্যান্টিকস। ১৯) বন্দুক। ২০) দূরবীক্ষণ যন্ত্র। ২১) প্রজেক্টর। ২২) মুভিক্যামেরা। ইত্যাদি।
বস্তুগত উপকরণের শেষ নেই। সুতরাং তালিকাটা দীর্ঘ হবে না ক্ষুদ্র হবে তা সম্পূর্ণ আপনার প্রয়োজনের উপর নির্ভর করছে। ইচ্ছা করলে তালিকা আপনি যত খুশি বড় করতে পারেন, কিংবা প্রথমে ছোটখাট একটা তালিকা তৈরি করতে পারেন। পরে, যথাসময়ে, আরো প্রয়োজন যোগ করবেন। দীর্ঘ হয়ে উঠবে ক্রমশ তালিকাটা। যথাসময়ে বলতে আমি বলতে চাইছি, ছোটো তালিকার সবগুলো প্রয়োজন মিটে যাবার পর। এক এক করে বগুলো প্রয়োজন মেটাবেন আপনি। তারপর আরো প্রয়োজন যোগ করবেন তালিকায়। যোগ করার মতো চাহিদার অভাব কোনোদিনই হবে না আপনার। যতদিন বেঁচে থাকবেন, এটা সেটার প্রয়োজন লেগেই থাকবে। সেই প্রয়োজনের জিনিসগুলো অর্জন করে নিতে। হবে আপনাকে।
আপনার প্রয়োজনের (বস্তুগত উপকরণের) তালিকার প্রথম দু’চারটির মধ্যে কিন্তু থাকতে হবে-অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার ব্যবস্থা।
এবার দু’নম্বর কাগজটি নিন।
এটির উপর বড় বড় অক্ষরে লিখুন-বিষয়।
কি কি বিষয়ে পারদর্শী হতে চান আপনি, ভেবে বের করুন। তারপর সেগুলো সিরিয়াল নম্বর দিয়ে এক এক করে লিখে ফেলুন।
ধরুন, আপনি হতে চান ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী। লিখুন।
১) ভালো স্বাস্থ্য চাই। ২) ওজন কমিয়ে একহারা হতে চাই। ৩) স্মরণশক্তি বাড়াতে চাই। ৪) অভ্যাসের নিয়ন্ত্রক হতে চাই। ৫) মনোনিবেশ করার ক্ষমতার অধিকারী হতে চাই। ৬) সুখী হতে চাই। ৭) আত্মবিশ্বাসী হতে চাই। ৮) স্মার্ট হতে চাই। ৯) দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া শিখতে চাই। ১০) আরো জ্ঞান অর্জন করতে চাই। ১১) ধূমপান ছাড়তে চাই। ১২) পরচর্চা ত্যাগ করতে চাই। ১৩) সকলের। প্রশংসা পেতে চাই। ১৪) নেতৃত্ব লাভ করতে চাই। ১৫) সম্মানজনক পেশা পেতে চাই। ১৬) পারিবারিক মর্যাদা বাড়াতে চাই। ১৭) মানসিক শান্তি পেতে চাই। ১৮) বিদেশে ভ্রমণে যেতে চাই। ১৯) সৃষ্টিধর্মী কাজে পারদর্শী হতে চাই। ২০) সুন্দর বাচন ভঙ্গির অধিকারী হতে চাই অর্থাৎ সুন্দরভাবে কথা বলা শিখতে চাই। ২১) আত্মীয়-স্বজনের প্রিয়পাত্র হতে চাই। ২২) ছেলে-মেয়েদেরকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ২৩) সৎ হতে চাই। ২৪) সমাজের সেবা করতে চাই। ২৫) বন্ধুত্ব অর্জন করতে চাই। ২৬) সম্মানী মানুষদের সংস্পর্শে আসতে চাই। ২৭) চাকরিতে উন্নতি করতে চাই। ২৮) আধুনিক জীবন-যাপন পদ্ধতি শিখতে চাই। ইত্যাদি।
এক লাফে গাছে চড়তে গেলে যেমন পপাত ধরণীতল হবার আশঙ্কা আছে। তেমনি আপনার অবজেকটিভের তালিকার সবগুলো বস্তু এবং বিষয় যদি একবারে একসাথে অর্জন করতে চান তাহলে বিপদ ঘটবার সমূহ সম্ভাবনা। তাছাড়া কোন দৈব-বলে সব যদি একবারে পেয়েও যান, কদিন পরেই বাসি হয়ে যাবে সব, নতুন বিষয় ও বস্তু খুঁজতে হবে পাগলের মতো। কাজেই একবারে একটি বস্তুবা বিষয়কে বেছে নিন, সেটিকে অর্জন করার চেষ্টা করুন।
একটার পর একটা কা বস্তু অর্জন করবেন, জীবনটা হয়ে উঠবে আনন্দ, মুখর, বৈচিত্র্যময়।
তালিকা তো তৈরি করেছেন। এবার প্রত্যক্ষদর্শনের পালা। আপনার অবজেকটিভকে কি করে প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করবেন তাও জানতে হবে আপনার। নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, সেগুলো আপনাকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে একটা অত্যাশ্চর্য প্রাকৃতিক শক্তিকে।
কিন্তু প্রত্যক্ষ দর্শনের নিয়ম শেখার আগে আরো কিছু কথা জেনে রাখুন, উপকারে আসবে।
সাফল্যের পথে যাত্রী আপনি। সাথে কি কি নেবেন, ঠিক করতে হবে না? যোদ্ধা যায় যুদ্ধ করতে, সাথে নেয় সে অস্ত্র-শস্ত্র। আরো কিছু জিনিস সাথে নিতে হয় তাকে। বলুন তো কি সেই জিনিস?
বেশ কয়েকটি জিনিস সাথে নিতে হয় তাকে। যেমন-এক, দেশ প্রেম। দুই, সাহস। তিন, ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা। চার, নিয়মানুবর্তিতা। পাঁচ, আদেশ। পালনের দৃঢ় সংকল্প, ইত্যাদি।
আপনাকে কিন্তু বিশেষ কিছুই সাথে নিতে হবে না। বস্তুগত উপকরণ-দরকার নেই। যা পরে আছেন, কাপড়চোপড় ছাড়া, আর কিছু নিতে হবে না সঙ্গে। কিন্তু মনের ভাণ্ডারে কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে, যা হবে আপনার সাফল্যের ভ্রমণে পাথেয়-স্বরূপ। কি কি নিতে হবে, আসুন, ঠিক করে ফেলা যাক।
.
আমি পারবো–এই বিশ্বাস
আমি পারবো এই বিশ্বাস আপনার না থাকলে আপনি কোনো কাজে হাতই দেবেন, তাই না? সুতরাং আগে আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আপনি পারবেন। এটাই প্রথম কাজ।
প্রশ্ন করতে পারেন, আমি পারবো এই বিশ্বাস কিভাবে নিজের মধ্যে আনা যায়?
নিজের মধ্যে এই বিশ্বাসটি আমদানী করা খুবই সহজ কাজ। যা আপনি সত্যি করতে চান তা করতে সবরকম উপায়ই ব্যবহার করবেন, সম্ভাব্য সব কিছু করতে রাজি আছেন-মাত্র এই চিন্তাটুকুই আপনার মধ্যে “আমি পারবো” এই বিশ্বাস এনে দেবে।
সম্ভাব্য সবকিছুই আপনি পারবেন, এটা নির্ভেজাল সত্যি কথা। আপনি মানুষ, মানুষের দ্বারা যা সম্ভব, আপনার দ্বারাও তা সম্ভব। লিঙ্কনের কথা ধরুন। অতি সাধারণ লোক ছিলেন তিনি। কিভাবে পরবর্তী জীবনে তিনি হতে পেরেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট? আমি হতে পারবো-এই বিশ্বাস তার মধ্যে ছিল বলেই তো।
আবিষ্কারক, উদ্ভাবক, মনীষী, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের জীবনী ঘেঁটে দেখুন, এঁদের অধিকাংশই ছিলেন আমার-আপনার মতোই সাধারণ মানুষ। পারবো-এই মনোবল এবং বিশ্বাসই তাদেরকে বড় করেছে। আপনিও মনে করুন-পারবো। তাহলেই পারবেন। যত বড় হতে চাইবেন, ঠিক তত বড়ই হতে পারবেন।
কোনো কাজকে কঠিন মনে করা উচিত নয়। কারণ, কোনো কাজই আসলে কঠিন নয়। দশতলা একটা দালান দেখে কি মনে হয়? মনে হয় না কি, এইরকম একটা বিল্ডিং তৈরি করা কঠিন কাজ? কিন্তু আসলে কি তাই? না, তা নয়। সম্পূর্ণ কাজটিকে এক নজরে দেখে কঠিন বলে মনে হলেও আসলে তা সত্যি কঠিন নয়। একরাতে একজন লোক বিল্ডিংটাকে তৈরি করেনি। করেছে বহু লোকজন মিলে, একটু একটু করে, অনেকদিন ধরে। বিল্ডিংটা একটা বড় কাজ। সেটাকে ছোটো ছোটো কাজে ভাগ করে নিয়ে সবাই মিলে প্রতিটি ভাগকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। ক্ষুদ্র কাজগুলোর একত্রিত রূপ হলো দিন। শুংটা। যারা এটা তৈরি করার জন্যে খেটেছে তাদের কাছে মোটেই কঠিন বলে মনে হয়নি। তারা নিয়ম পালন করে মনের আনন্দে যার যার কাজ করে গেছে মাত্র।
আপনাকেও নিয়ম পালন করে কাজ করতে হবে। কাজ করতে যদি আপত্তি না থাকে, তাহলেই যা করতে চান তা করতে পারবেন।
.
আমি করবো–এই দৃঢ় সংকল্প
আমি করবো এই দৃঢ় সংকল্প নিজের মধ্যে আনা যায় কিভাবে?
এক, সুখী একজন মানুষ বলে মনে করুন নিজেকে। দুই, উদ্দেশ্যের প্রতি উৎসাহী থাকুন।
তিন, বাধাবিঘ্নগুলোকে খুঁটিয়ে দেখে নিন, যেগুলোকে আপনার টপকাতে হবে।
চার, সক্রিয় তৎপরতামূলক পরিকল্পনা রচনা করুন।
পাঁচ, জড়তা কাটিয়ে উঠন। কাজ ফেলে রাখার বদভ্যাস ত্যাগ করুন। ছয়, কাজে হাত দেবার জন্যে তৈরি হোন এবং তৈরি হয়েই হাত দিন। সাত, একনাগাড়ে এগিয়ে যান।
.
সুখী বলে মনে করুন নিজেকে
বলবেন, হুহ মনে করলেই কি সুখী হওয়া যায়?
এ আসলে, যায়। কিন্তু তার আগে সুখী হওয়ার সুফল সম্পর্কে বলতে হয় দু’চার কথা। অসুখী হওয়ার কুফলও আলোচ্য এ প্রসঙ্গে। আপনি অসুখী হলে মন তো বটেই, শরীরও আপনার দুর্বল হবে, নড়তে চড়তে চাইবে না। অসুখী লোক না-বাচক মতামত পোষণ করে, নৈরাশ্যব্যঞ্জক মানসিকতার অধিকারী হয়। ছোটোখাটো কাজ তার কাছে হয়ে দাঁড়ায় জটিল, নিরস, পাহাড়প্রমাণ।
উৎসাহ তৈরি করে, মনে আগ্রহ জন্মায়, প্রেরণা ও উদ্যম যোগায় এই সুখবোধই। আপনি যখন সুখী, শরীরটাও চমৎকার থাকে। এমনকি কাজের সময়গুলোও অত্যন্ত দ্রুত এবং আনন্দের মধ্যে দিয়ে কেটে যায়।
সুতরাং, সুখী হোন। কিভাবে? আপনি বলবেন, জীবনে যা যা চেয়েছিলাম। তার কিছুই তো পেলাম না। সুখী নই তবু নিজেকে সুখী বলে মনে করতে হবে?
সুখী নন, কে বললো? আসলে আপনি সুখী, মুশকিল হলো ব্যাপারটা গোপন রয়েছে আপনার কাছে। আপনি সুখী, কিন্তু তা আপনি জানেন না। জীবনে যা যা চেয়েছিলেন, পাননি এতোদিন-কিন্তু এবার তো পাবেন! ‘আমি পারবো’ এই বিশ্বাস আছে আপনার, আমি করবো এই সংকল্পও গড়ে তুলছেন নিজের মধ্যে-জীবনের সব শখ-সাধই তো পূরণ হতে যাচ্ছে আপনার, সকল কাম্যবস্তুই তো পাচ্ছেন, বলা যায় পেয়ে গেছেন-এরপরও কি কোনো যুক্তি আছে আপনার নিজেকে সুখী বলে মনে না করার?
যাদের মধ্যে ‘আমি পারবো’ এই বিশ্বাস এবং আমি করবো এই সংকল্প নেই তারা কাজে হাত দেবার পূর্বেই ব্যর্থতাকে মেনে নেয় এবং তাদের ব্যর্থতার কারণস্বরূপ অসংখ্য অজুহাত দেখিয়ে বেড়ায়। লক্ষ্য করুন, অজুহাত শব্দটি ব্যবহার করছি আমি, যুক্তি শব্দটি নয়। সে আপনাকে অজুহাত হিসেবে দেখাতে পারেশিক্ষার অভাব। এটা একটা যুক্তি নয়। বর্তমান যুগের রেডিও-টেলিভিশন, অসংখ্য লাইব্রেরী, প্রকাশনালয়, নাইট স্কুল ইত্যাদির বদৌলতে যে-কেউ যে কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জন করে নিতে পারে।
এ সময়ের অভাবটাকে কেউ কেউ ব্যর্থতার যুক্তি হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করে। এটাও একটা অজুহাত মাত্র। গঠনমূলক কাজে মানুষ যতোটা না সময় খাটায় তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সময় অপব্যয় করে সে নিষ্ফল, উৎপাদনহীন কাজে।
সময়টাকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজের জন্যে ভাগ করে নেয়াটা জরুরী। সঠিকভাবে সময়ের বাজেট না করলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র আধ ঘণ্টার কাজ বাজারে যাওয়ার সময়ও আপনি খুঁজে পাবেন না।
কিছু মানুষ আছে যারা দায়সারা গোছের কাজ করতে অভ্যস্ত। এরা হাফ আন্তরিক ভাবে কাজ করে। ফলে, সময় ঠিকই বয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে, কাজটা যেমন সুচারু হওয়া উচিত ছিল তেমন হয় না। কাজটা মানগত দিক দিয়ে নিকৃষ্ট বিধায় মানসিক সন্তুষ্টির অভাব ঘটে, এবং সময়ের পরবর্তী ভাগগুলো উপভোগ্য হয় না বা গঠনমূলক কাজের উপযুক্ত থাকে না।
অভিজ্ঞতার অভাব-এটাও একটা অজুহাত, যুক্তি নয়। কেউই অভিজ্ঞ হয়ে জন্মায় না। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। কাজে হাত দিলেই অভিজ্ঞতা হয়। অভিজ্ঞতা নেই মনে করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে কোনোদিনই অভিজ্ঞতার অধিকারী হতে পারবেন না।
বাংলাদেশে প্রখ্যাত এক ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট জজ কোর্টের চত্বরে ঘুরে ঘুরে কেটলীতে গরম চা বিক্রি করতেন, কাপ প্রতি এক আনা, পাকিস্তান আমলের প্রথম যুগে। সেই ব্যক্তি এখন নিজের বিশাল কারখানায় তৈরি ছাতা বিদেশে রফতানী করেন। অ্যাকাডেমিক ডিগ্রী ছিল না ভদ্রলোকের, ছিল না ছাতা তৈরি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতাও।
পুরানো ঢাকার বসুবাজার নামক পাড়ায় রাস্তার উপর দশ ইঞ্চি একখানা ইটের উপর বসে সিঙ্গাড়া, পিয়াজি, ফুলুরি বিক্রি করতেন হোসেন আলী, মাত্র ছয় বছর আগে। সাতাত্তরে তিনি একজন হোটেল ম্যানেজার মাসে বেতন পাচ্ছেন আড়াই হাজার টাকা।
‘আমি পারি’ এই বিশ্বাস এবং সচেতনতা নিজের মধ্যে আমদানী করা সহজ হবে আপনার পক্ষে যদি আপনি এই সত্যটা জানেন: সফল এবং ব্যর্থ মানুষের মধ্যে পার্থক্য হলো, একজন জানে, বিশ্বাস করে এবং ভাবে আমার দ্বারা সম্ভব; আর একজন জানে, ভাবে, বিশ্বাস করে, আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
সুখী হবার সবচেয়ে বড় ও সহজ এবং একমাত্র উপায় হলো, নিজেকে সুখী বলে মনে করা। মনে করে দেখুন, নিজেকে সুখী মানুষ বলে স্বীকার করে নিতে বিশেষ দেরি হবে না। সত্যিই সুখ আসবে আপনার অন্তরে।
.
উদ্দেশ্যের প্রতি উৎসাহী থাকুন
লক্ষ্যের প্রতি আগ্রহ এবং উৎসাহের কমতি হলে সে-লক্ষ্যে পৌঁছানো কক্ষনো সম্ভব নয়। এমনকি ‘আমি পারবো’ এই বিশ্বাস আপনার মধ্যে থাকলেও, দক্ষতা অর্জনে, যোগ্যতা অর্জনে বা সিদ্ধিলাভে আপনি সফল হতে পারবেন না-অর্জনে যদি উৎসাহ না থাকে।
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী–পুরোহিত ডক্টর নরম্যান ভিনসেন্ট পীলের মতে, ভালোবাসা বা প্রেম হলো উৎসাহের সবচেয়ে বড় উৎসস্থল। একজন মানুষ তার স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালোবাসে, সে তার স্ত্রীকে সুখী করার জন্যে, খুশি করার জন্যে বিস্ময়কর সব বস্তুগত, আদর্শগত উপকরণ সংগ্রহে উৎসাহ বোধে সর্বদা আপ্লুত থাকবে।
খ্যাতি, দক্ষতা, যোগ্যতা, মর্যাদা, সৌন্দর্য এগুলোর প্রতি ভালোবাসা থাকলে অঢেল উৎসাহ আসে এগোবার কাজে।
আপনি নেতৃত্ব চান, চান সাধারণ মানুষের চেয়ে উপরে উঠতে, চান সবাই আপনাকে বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখুক, শ্রদ্ধা করুক-এই ইচ্ছা, এই চাওয়া আপনাকে উৎসাহ যোগাতে পারে, এবং এই উৎসাহ আপনাকে এগিয়ে যাবার কাজে সক্রিয়, তৎপর করে তুলবে।
.
বাধাবিঘ্ন গুলোকে খুঁটিয়ে দেখে নিন
আপনার এবং আপনার যে-কোনো কাম্যবস্তুর মাঝখানে মাথা তুলে শত্রুর মতো দাঁড়িয়ে আছে কিছু বাধা-বিঘ্ন। এই বাধাবিঘ্নগুলো না থাকলে যা ইচ্ছা তাই তুলে নিলেই হতো, কামনা করামাত্র হাতের মুঠোয় পেয়ে যেতেন আপনি, শুধু নেয়ার অপেক্ষা।
চিনে-জেনে নিন আপনার এবং আপনার কাম্যবস্তুর মাঝখানে কি কি বাধা রয়েছে।
বাধাবিঘ্নগুলো চেনা হলে আপনার পক্ষে সহজ হবে সেগুলোকে টপকাবার। জন্যে কি কি বাস্তবধর্মী ব্যবস্থা নেবেন তা ঠিক করা। পরিকল্পনা করে এগোবেন আপনি। একটা করে বাধাকে বেছে নেবেন, আগে থেকে ঠিক করা ব্যবস্থা অনুযায়ী বাধাটাকে টপকাবার কাজে হাত দেবেন। এই ধরনের তৎপরতামূলক কাজে প্রচুর মজা পাওয়া যায়। একটা করে বাধা টপকাবেন এবং নিজেকেই নিজের শিক্ষক বলে গর্ব অনুভব করবেন, যা অন্য কোনো ভাবে অনুভব করার সুযোগ নেই আপনার।
.
জড়তা কাটিয়ে উঠুন
জড়তার মানে হতে পারে কুঁড়েমি। উৎসাহের অভাবেও জড়তা আসে। অকারণ চক্ষুলজ্জ, মিথ্যে সম্মানবোধ, অহেতুক ভয় ইত্যাদির ফলে জড়তার শিকার হতে পারেন আপনি। জড়তা মানুষকে বন্দী করে রাখে তার হাতের মুঠোয়, এতোটুকু নড়তে চড়তে দেয় না। বন্দী মানুষ কি কাজের কাজ কিছু করতে পারে? পারে না। জড়তায় আক্রান্ত মানুষ মৃত মানুষের সমতুল্য। জড়তা মানে অচলতা, এবং অচলতা উন্নতি, প্রগতি ও সাফল্যের পরম শত্রু।
এক ব্যক্তির কথা ধরুন, চাকরি জীবনে সে হয়তো জড়তাগ্রস্ত, অফিসে উপস্থিত হয় নামেমাত্র, কাজে মন নেই, চেয়ারে বসে ঘুমে ঢোলে। এই ব্যক্তিই বেলা দুটোর পর নিউজপ্রিন্টের বাজারে দালালী করে, তখন তাকে দেখলে চেনাই মুশকিল। গোটা বাংলাবাজার এবং নয়াবাজার এলাকাটা সে সন্ধ্যা পর্যন্ত অমন পঞ্চাশবার চক্কর মারবে, কাজ ছাড়া ফালতু এক সেকেণ্ড ব্যয় করবে না। এরকম দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি দেয়া যায়। কেন হয় এরকম? কাজে আনন্দ থাকলে সে কাজ করতে ভালো লাগে, এটাই কারণ। যে কাজে আনন্দ আছে সে কাজ করতে জড়তার বাধা আসে না।
জড়তার কবল থেকে মুক্ত থাকতে হলে আপনাকেও কাজের ভিতর আনন্দ পেতে হবে। জেনে রাখুন, আপনার কাজগুলোয় আনন্দের অভাব ঘটতেই পারে। না। কারণ, আপনার কাজের দ্বারা আপনি মুক্তি, নিরাপত্তা, সচ্ছলতা, প্রশংসা, ক্ষমতা, মর্যাদা এবং সুখ অর্জন করতে যাচ্ছেন। যে-সব কাজ করবেন সেগুলো আপনাকে দেবে প্রাচুর্য। শুধু যতোটুকু না হলেই নয়, ততোটুকু না-অঢেল, প্রচুর। সুতরাং আপনার কাজের ভিতর আনন্দ থাকবেই।
.
কাজে হাত দেবার জন্যে তৈরি হোন
কখনো কি অকস্মাৎ অচল হয়ে যাওয়া গাড়িকে ঠেলে চালু করার চেষ্টা করেছেন? করে থাকলে নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, গাড়িটাকে চালু করার জন্যে আপনার দেহের সর্বশক্তি ব্যয় করতে হয়েছিল। তাই-ই হয়। কিন্তু গাড়িটা একবার চালু হয়ে গেলে সামান্য শক্তিতেই সেটাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়। মানুষের বেলাতেও সেইরকম-একটা কাজ শুরু করতে উইল-পাওয়ার দরকার হয়, কিন্তু কাজটায় একবার হাত দেয়া হলে তা শেষ করার জন্যে তেমন কোন বেগ পেতে হয় না।
.
একনাগাড়ে এগিয়ে যান
একজন শল্য চিকিৎসকের কথা ধরুন। অপারেশন থিয়েটারে রোগী শুয়ে আছে। চিকিৎসক অপারেশনের জন্যে এলেন। রোগীর পেট কেটে বের করতে হবে একটা পাথর। চিকিৎসক পেট কাটলেন কিন্তু পাথরটা বের না করে তিনি ত্যাগ করলেন অপারেশন থিয়েটার। কয়েক ঘণ্টা বা ক’দিন পর কাজটা সম্পন্ন করবেন তিনি। এরকম ভাবা যায়? যায় না। অপারেশন যখন শুরু হয়েছে, সেটাকে শেষ করতেই হবে, ফেলে রাখা চলবে না। সেইরকম যে-কোনো কাজেই হাত দিন, কাজটা শেষ না করে ক্ষান্ত হবেন না। শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম শেষের দিকে এগিয়ে যেতে কুন, শেষ পর্যন্ত পৌঁছুন।
.
গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল?
বইয়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে রয়েছেন আপনি। এরপর তৃতীয় পরিচ্ছেদ। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটা শেষ করে বইটা বন্ধ করে যদি আলমারিতে তুলে রাখেন, সত্যি খুব খুশি হবো। দুদিন পর আবার বের করবেন বইটা, পড়বেন তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
এই দু’দিন বইটা না পড়ে বর্তমান যুগের প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদদের পরামর্শ অনুযায়ী আপনি পরিকল্পনাভিত্তিক প্রত্যক্ষদর্শনে মনোনিবেশ করুন। আপনার তৈরি অবজেকটিভ তালিকাটা, আর একবার খতিয়ে দেখে নিন। তারপর মানসপটে দেখতে থাকুন কাম্যবস্তুগুলো আপনার অধিকারে এসে গেছে। সবচেয়ে বেশি কাম্য যে বস্তু-কি সেটা? ঠিক, নতুন একটা, চমৎকার একটা বাড়ি দরকার আপনার। বেশ। এবার প্রত্যক্ষদর্শনের জন্যে কাজে হাত দিন। কোন্ কোন্ এলাকা পছন্দ আপনার ঠিক করুন। বাড়িটা যে এলাকায় চান সেই এলাকাটা দেখে আসুন আজই। সেই এলাকায় নিজের পছন্দ মতো কোনো বাড়ি আছে কিনা, বেছে বের করুন। থাকলে ভালো, না থাকলে আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী একটা বাড়ির ছবি আঁকিয়ে নিন কোন আর্কিটেক্টকে দিয়ে, কিংবা পত্র-পত্রিকায় ছাপা কোনো বাড়ির ছবি যদি আপনার পছন্দ হয়ে যায়, সেটা কেটে নিন কাঁচি দিয়ে। ঠিক যে-ধরনের বাড়ি আপনি চান হুবহু সেই ধরনের একটা বাড়ির ছবি সংগ্রহ করতে হবে আপনাকে। ছবিটা দেখবেন এবং মনকে অসংখ্যবার বলবেন, এই বাড়িটা আমার। আশা বা ইচ্ছাভিত্তিক কিছু ভাববেন না। আপনি বিশ্বাস করবেন ওইরকম একটা বাড়ির মালিক হয়ে গেছেন আপনি ইতিমধ্যেই। বাড়িটা অর্জন করেছেন আপনি, শুধু দখল পাওয়াটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার মাত্র।
নতুন, ঝকঝকে, হাল ফ্যাশনের একটা প্রাইভেট কার পেলে খুব মজা হতো, না? চান একটা ওইরকম গাড়ি? ঠিক আছে। বলে দিচ্ছি কি করতে হবে। দেরি না। করে গাড়ির ডিলার বা এজেন্টদের শো-রূমে যান একবার। আজ গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়। সেখানে অনেকরকম গাড়ি দেখবেন, কিন্তু পছন্দ করবেন যেটা চান সেটা। পছন্দ করার পর থেকে ভাবতে শুরু করুন, ওই বিশেষ কোম্পানির বিশেষ গাড়িটি আপনারই। মনে মনে কল্পনা করুন, দেখবেন ভালো লাগবে, গাড়িটা নিয়ে বন্ধু-বান্ধব বা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সমেত বেড়াতে যাচ্ছেন রাঙ্গামাটি বা কক্সবাজার। ও হ্যাঁ, একটা ছবি সংগ্রহ করতে হবে গাড়িটিরও।
ফার্নিচার, কাপড়, স্বর্ণ এবং অন্যান্য দোকানে যান, জিনিসপত্র পছন্দ করুন। ঘুরে ঘুরে। এতোদিন যে-সব জিনিসের স্বপ্ন দেখেছেন সেই সব জিনিস দোকানে। দোকানে ঢুকে চাক্ষুষ করুন, প্রত্যক্ষ করুন, মনের পর্দায় গেঁথে ফেলুন প্রত্যেকটি জিনিসের ছবি-এবং ভাবুন এসব জিনিস আপনার আয়ত্তে না আসার কোনো কারণ নেই, এসব জিনিস আপনারই জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে, এগুলো আপনারই।
কাম্যবস্তু অর্জন করা কি কি কারণে সম্ভব নয় তা ভাবতে যাবেন না। অধিকাংশ মানুষ সর্বদা অজুহাত দেখায় এই–এই কারণে সে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। তারা কক্ষনো সফল হবার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। অর্থাৎ পরিকল্পনায় হাত দেবার আগেই পরিকল্পনাটাকে ব্যর্থ বলে মেনে নেয়। তারা। তাদের দ্বারা সাফল্য আশা করা বৃথা। কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ প্রমাণ হয়ই, সেক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনা করা দরকার। বিকল্প পদ্ধতি থাকেই, গ্রহণ করলেই হয়। ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া মানে নিজের কাছে অপরাধ করা।
আপনি অভিযোগ তুলে বলতে পারেন, যে জিনিস এখনো আমি পাইনি সে জিনিস পেয়েছি বলে মনে করে আনন্দে মাতোয়ারা হবে কেন? এ তো গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতো ব্যাপার। ব্যাপারটা আসলে তাই-ই, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতোই। তেল দিন গোঁফে, গাছের কাঁঠালটা আপনার জন্যেই নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে। ওটা আপনারই। গোঁফে তেল না দিলে কাঁঠাল পাবার আশা নেই আপনার।
আমার স্নেহভাজন শেখর চৌধুরী, (বলা বাহুল্যঃ ছদ্মনাম) পেশাদার লেখক, বহু বছরের সম্পর্ক তার সাথে, ব্যক্তিগত আলোচনা প্রসঙ্গে প্রায়ই সে নৈরাশ্যব্যঞ্জক সংলাপ উচ্চারণ করতো। শুধু লেখা বিক্রি করে সংসার ধর্ম পালন করছে ও। এটা একটা কঠিন, প্রায়-অসম্ভব কাজ এদেশে। গড়পড়তা মাসিক যা আয় তাতে দিন চলে যাচ্ছে, কিন্তু অভাব রয়েছে আর্থিক নিরাপত্তাবোধের, সঞ্চয়ের কোঠা শূন্য থাকছে, বীমা করার সঙ্গতি নেই-ইত্যাদি। অর্থাৎ স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষদের। যা যা সমস্যা, ওরও সেই সমস্যা। ওটা আসলে খুবই ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতি। ও বা ওর পরিবারের কেউ যদি কঠিন কোনো রোগে পড়ে, চোখে অন্ধকার দেখবে গোটা পরিবারটা। তার উপর রয়েছে একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। প্রয়োজনীয় বিলাস দ্রব্যের অভাব, এবং সেইহেতু বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভের কারণে ও লেখার কাজে ততোটা আন্তরিক হতে পারছে না যতোটা হওয়া উচিত, পরিবারের প্রতি ততোটা দায়িত্বশীল হতে পারছে না যতোটা হওয়া উচিত, সমাজ এবং সভ্যতার জন্যে অবদান রাখতে পারছে না ক্ষমতানুযায়ী যতোটুকু রাখা উচিত।
ওর সমস্যাটা নিয়ে একদিন আলোচনা করলাম আমরা। দেখলাম, ওর ভয়ঙ্কর অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে ওর। আরো আবিষ্কার করলাম, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবার উপায় কি তাও জানে ও। তার মানে, ‘আমি পারি’ এই সচেতনতা আছে ওর। নেইটা তাহলে কি?
‘আমি করবো’-এই সংকল্পের অভাব। দেখিয়ে দিলাম ওর ত্রুটিটা। আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলাম, কিভাবে এই ত্রুটি সংশোধন করা যায়।
স্থির হলো, অতিরিক্ত আয়ের একটা উপায় বের করতে হবে। অতিরিক্ত আয়-কি ভাবে সম্ভব? আরো বেশি লিখলে কি আরো বেশি টাকা আসবে? এমনিতেই ও যথেষ্ট বেশি লিখতে পারে, যা লেখে তা-ই ছাপার জন্যে পাবলিশার পাওয়া যায় না। তাছাড়া আরো বেশি লিখলে লেখার মান খাটো হয়ে যাবে। শুধু লেখা কেন, অনুন্নত মানের কোনো কিছুই বাজারে বিকায় না।
তাহলে?
ব্যবসা করার পরামর্শ দিলাম ওকে। সাথে সাথে কয়েকটা সমস্যা মাথা তুলে দাঁড়ালো, সামনে এগোতে দেবে না। ব্যবসা মানেই পুঁজি। পুঁজি তো নেই। উপায়?
উপায় বের করার আগে ওকে স্থির করতে বললাম, কি ব্যবসা করতে চায়।
ও বললো, বইয়ের ব্যবসাটাই ওর কাছে ওর রুচি অনুযায়ী ভদ্র ব্যবসা। ছোটোখাটো একটা বইয়ের দোকান করতে পুঁজিও লাগবে কম। পরিচিত পাবলিশারদের কাছ থেকে ধারে বই তুলতে পারবে দোকানে। দোকানে বসে লেখার কাজও চালাতে পারবে।
আলোচনা এইটুকুই। ও, হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি, আলোচনা শেষে সেলফ ইমপ্রুভমেন্ট সম্পর্কিত কয়েকটি বই দিলাম ওকে পড়তে।
মাত্র পনেরোদিন পর ও এলো। বললো, দোকান পেয়েছি। কিছু টাকা দিন। জিজ্ঞেস করলাম কতো? বললো, দুশো দিলেই চলবে। অবাক কাণ্ড, দুশো টাকায় দোকান হয় কিভাবে? প্রশ্ন করতে বললো, দোকানের জন্যে অ্যাডভান্স দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। বেনু সুইট ল্যাণ্ডের ‘আই উইল’ বইটির পরামর্শ অনুযায়ী বন্ধু, আত্মীয় এবং শুভানুধ্যায়ীদের একটা তালিকা তৈরি করেছে ও। একজনের উপর চাপ সৃষ্টি না করে, টাকা ধার চাইবে ও মোট ত্রিশ জনের কাছে। দুশো করে চাইবে, সকলের কাছ থেকে পেলে হবে ছয় হাজার টাকা। দোকান নেয়া হয় তাহলে।
এরপর মাত্র চারদিন পর ফিরে এলো ও। বললো, সকলের কাছে যাবার দরকার পড়ে, মাত্র চারজনের কাছে গিয়েই পেয়েছি চার হাজার টাকা। চেয়েছিলাম দুশো করেই কিন্তু আমার পরিকল্পনা শুনে চারজনই দিয়েছে এক হাজার টাকা করে।
দোকানটা এককোণায় পড়ে গেছে। খুব একটা ভালো বেচাকেনা হবার কথা নয় ওখানে। কিন্তু ওর উদ্যম, পরিশ্রম এবং বিক্রি বাড়াবার নিত্য নতুন কৌশল। বিস্ময়কর ঘটনা ঘটাচ্ছে। আশাতীত বেচাকেনা করছে ও।
এটা একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শেখরের মধ্যে সব ছিলো, ছিলো না শুধু ‘আমি করবো’ এই সংকল্প। এই সংকল্পের অভাবটাই ওকে ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতির মধ্যে বন্দী করে রেখেছিল।
সংকল্পবদ্ধ হয় ও এবং সেই সাথে রচনা করে একটা নিখুঁত পরিকল্পনা। যার ফল, একটি চালু বইয়ের দোকান, একটি লাভজনক ব্যবসা।
ওর মতো সফল হবেন আপনিও, যদি ওর পদ্ধতিটা গ্রহণ করেন। ভ্রমণের পরিকল্পনাটা প্রচুর খেটে তৈরি করুন, আপনাকে আটকায় এমন কেউ জন্মায়নি। এখনও পৃথিবীতে।
.
গোপনসূত্র বা প্রত্যক্ষদর্শন
প্রত্যক্ষদর্শন এখন একটি প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক কৌশল হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবী বিখ্যাত আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদরা প্রত্যক্ষদর্শনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, যা পেতে চাও তার ছবি দেখতে হবে, মনে গেঁথে নিতে হবে তার চেহারা।
প্রত্যক্ষদর্শন নতুন কোনো ব্যাপারও নয়। প্রাচীনকালের মানুষও কাম্যবস্তুর ছবি আঁকতো গুহার দেয়ালে, কল্পনা করতে হত্যা করেছে সে বাইসনটাকে। কোনো কিশোর হয়তো স্বপ্ন দেখতো সে বড় হয়ে যোদ্ধা হবে। রণক্ষেত্রে যোদ্ধার পোশাক পরে, অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখতে পেতো সে নিজেকে, মানসপটে। রাজপুত্র স্বপ্ন দেখতো অমুক রাজার মেয়ে, রাজকুমারী চপলাকে সে। বিয়ে করবে। সে রাজকুমারীকে চাক্ষুষ করতো মনের পর্দায়। আজকের মানুষও কাম্যবস্তুর স্বপ্ন দেখে। মনের পর্দায় দেখার সাথে যোগ হয়েছে খাতার পাতায় দেখা।
বইটা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরোন, দোকান থেকে কিনে আনুন একটা বাইণ্ডিং করা খাতা। আর যদি ওরকম একটা খাতা হাতের কাছে থকে, তাহলে তো কথাই নেই। এখুনি বসে পড়ুন কাজে। গোপন সূত্র দিচ্ছি, লিখে নিন। যাদুর মতো কাজ দেবে এই সূত্র।
এই খাতাটাকে আপনি রোমাঞ্চকর এক ছবির খাতায় পরিণত করবেন। কাম্যবস্তুর ছবি সংগ্রহ করুন এক এক করে, প্রত্যেকটি ছবি খাতার পৃষ্ঠায় এক এক করে আলাদা আলাদা ভাবে আঠা দিয়ে সেঁটে দিন। নতুন, সুন্দর একটি বাড়ি চাই আপনার। কোনো ডিজাইনারকে দিয়ে মনের মতো একটা বাড়ির নকশা আঁকিয়ে নিন। সেই নকশাটা খাতার পৃষ্ঠায় লাগান। বাড়িটার সামনে, পিছনে, পাশে যদি সুন্দর বাগান, লেক, খেলার মাঠ ইত্যাদি থাকে, সেগুলোও যেন ডিজাইনের মধ্যে স্থান পায়।
নতুন একটা গাড়ি, হোক না আপনার দু’নম্বর কাম্যবস্তু। যে মডেলের গাড়ি চান, সংগ্রহ করুন তার একটা ছবি, তারপর খাতার দু’নম্বর পৃষ্ঠায় আঠা দিয়ে সাটুন সেই ছবি।
একটা বিখ্যাত কোম্পানির টেলিভিশন সেট যদি হয় আপনার তিন নম্বর কাম্যবস্তু, যোগাড় করুন সেই কোম্পানির টিভি সেটের একটা ছবি, খাতার তিন নম্বর পৃষ্ঠায় আটকান এটাও। আর কি? আর যা যা দরকার সংগ্রহ করুন সবগুলোর একটা করে ছবি এবং খাতায় লাগান আঠা দিয়ে।
বিদেশ ভ্রমণ করতে চান, যেতে চান লণ্ডন, নিউ ইয়র্ক বা কায়রোতে? বেশ তো, সংগ্রহ করুন যে-দেশে যেতে চান সে-দেশের রাজধানীর একটা বিখ্যাত এলাকার ফটো। সেটাকেও খাতার পৃষ্ঠায় স্থান দিন।
প্রশ্ন করবেন, যে জিনিস আমি চাই সেই জিনিসের ছবি সংগ্রহ করলেই কি তা আমি পাবো?
এর উত্তরে বলবো, হ্যাঁ, পাবেন। আপনি যদি কোনো জিনিস অন্তর দিয়ে চান সে জিনিস কিভাবে যেন পেয়ে যান। এই রকমটি সব মানুষের বেলাতেই ঘটে। চাইলেই হয়, চাওয়ার মধ্যে আন্তরিকতা ও গভীরতা থাকলে, তা পাবেনই।
খাতায় ছবি সাঁটলেই কিন্তু কাজ হচ্ছে না। প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার প্রথম কাজ হবে ড্রয়ার থেকে বা তোশকের নিচ থেকে খাতাটা টেনে বের করে পাতা ওল্টানো। প্রত্যেকটি ছবি, নকশা বা ফটোর দিকে তাকাবেন আপনি। একটি ছবির দিকে কমপক্ষে দেড় মিনিট, ঊর্ধ্বে পাঁচ মিনিট করে তাকিয়ে থাকতে হবে। যতো বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকবেন ততোই ভালো ফল লাভের আশা। ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকার সময় কক্ষনো ভাববেন না যে ছবির এই জিনিসটি পাওয়ার ইচ্ছে আছে আমার বা পেলে ভালো হয় কিংবা ওটা পেলে আমার আশা পূরণ হয়। ছবিটির দিকে দৃষ্টি রেখে আপনি ভাববেন, ওটা আমার। ওটার একচ্ছত্র অধিপতি হতে যাচ্ছি আমি। জিনিসটাকে আমার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।
এ কাজ আমার দ্বারা হবে না, জিনিসটা পাবার আশা নেই, আশা করে লাভ কি, জানিই তো কপাল খারাপ, সে যোগ্যতা আমার নেই, পারবো না, করবো না, যেমনটি চাই তেমনটি ঘটবে না-আপনি কদাচ না-সূচক বাক্য উচ্চারণ করবেন না। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা আপনার জন্যে হারাম।
ইতিবাচক মনোভাবের সুফল হলো, আপনার অবচেতন মনকে আগে-ভাগেই মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন আপনি, অমুক কাজটা করবো বলে ভেবেছি, সুযোগ এলে খবর দিয়ে আমাকে, সাহায্য কোরো।
অবচেতন মনকে গুরুত্ব দেয়া দরকার আপনার। আপনি সচেতনভাবে যা করার পরিকল্পনা করেন আপনার অবচেতন মন আপনাকে সেই কাজ সম্পন্ন করার কাজে পরম বন্ধুর মতো সাহায্য করতে পারে।
সুতরাং, ইতিবাচক মনোভাবের অধিকারী হোন। সুফল হাতে হাতে ফলবে।
একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক অলকেশ বিহারীর কথা ধরুন। মাত্র বছর কয়েক আগে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ‘চার আনা’, ‘চার আনা’, ‘চার আনা’, ‘যে-কোনো বই চার আনা’–গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতো। তখনও দেখেছি ওকে, এখনও দেখছি। ফুটপাথের হকার ছিলো, তখনও বলতো, হবে। কি হবে? বলতো গাড়ি হবে, বাড়ি হবে, পত্রিকা হবে, পাবলিকেশন হবে, সুখ হবে, সম্মান হবে, টাকা হবে, পেপটিক আলসার ভালো হবে।
হবে, হবেই হবে-এই ছিলো অলকেশের মূলমন্ত্র। নেতিবাচক বক্তব্য তার মুখ থেকে কেউ কখনো শোনেনি। ফলাফল?
মাসিক একটি পত্রিকার মালিক সে এখন। বাংলাবাজারে বইয়ের দোকান আছে। শতাধিক বইয়ের প্রকাশক। মাসিক আয় দশ হাজার টাকার উপর। চারটে বড় বড় সুসজ্জিত কামরা নিয়ে তার অফিস। নতুন আরো একটি পত্রিকা বের করার জন্যে ডিক্লারেশন চেয়েছে, পেলো বলে। প্রচুর জমি কিনেছে। বাড়িতে টিভি, থ্রী-ইন-ওয়ান, রেডিও, ফ্রিজ, দামী আসবাবপত্র, মুভি ক্যামেরা, প্রজেক্টর-ভালো থাকতে হলে যা যা দরকার প্রায় সব উপকরণই সংগ্রহ করেছে সে ইতিমধ্যে। শুনেছি, শিগগিরই গাড়ি কিনবে একটা।
প্রায় নিরক্ষর যে, বাল্য এবং কৈশোর কাল দুর্যোগপূর্ণ যার, ক্লেদাক্ত পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে যার বয়স বেড়েছে-তার এরকম সাফল্যের কারণ কি?– ইতিবাচক মনোভাব। হবে, হবেই হবে-এই ছোট্ট অথচ যাদুকরী শব্দ তিনটিই অলকেশের সাফল্যের একমাত্র গোপনসূত্র।
সাফল্যের পথে ভ্রমণে বেরুবার আগে আপনার কাছে দুটি অনুরোধ করবো আমি। এক, অতীতের স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা ভুলে যান। অতীতের ব্যর্থতার জন্যে মনে দুঃখ পুষে রাখা দরকার নেই। কারণ, আপনার জীবনের সব আশা এবং সব রঙিন স্বপ্নই বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। আরো পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, এক এক করে আপনার কাম্যবস্তু পেতে শুরু করেছেন আপনি।– হ্যাঁ, পেতে শুরু করেছেন, কোনো সন্দেহ নেই এতে। পাবার জন্যে কি কি করতে হবে, জেনে ফেলেছেন আপনি, তাই না? যা যা করতে হবে, করতে শুরু করেছেন। কি দাঁড়ালো? পেতে যাচ্ছেন আপনি আপনার কাম্য-বস্তু, কোনো বাধা নেই আর, ঠিক?
কেউ যদি আশপাশে না থাকে, আমার কথায় সায় দিন, বলুন, বেশ জোরে বলুন–ঠিক।
দুই, তৃতীয় পরিচ্ছেদ শুরু হবে এরপর। কিন্তু তৃতীয় পরিচ্ছেদে যাবার আগে। পিছনের প্রতিটি পৃষ্ঠায় একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিন। প্রত্যেকটি প্যারাগ্রাফ পড়ুন। প্রতিটি বাক্যের অর্থ সঠিকভাবে আপনি হৃদয়ঙ্গম করেছেন কিনা। পরীক্ষা করুন। কোনো বক্তব্য যদি অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য বলে মনে হয়, বারবার পড়ুন সেই অংশটা। যতক্ষণ না সম্পূর্ণ, পরিষ্কার অর্থটা বুঝতে পারেন ততোক্ষণ পড়ুন, বুঝুন। কারণ সাফল্যের চাবিকাঠি রয়েছে প্রথম দুটো পরিচ্ছেদেই। এরপর সমস্তই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ।