০৫. গভীর আগ্রহ

গভীর আগ্রহ

প্রখ্যাত প্রবন্ধকার এমারসন বলেছেন, ‘গভীর আগ্রহ ব্যতীত মহৎ কোনো উদ্দেশ্য এযাবৎ সাধিত হয়নি।’

আগ্রহ শব্দটির অর্থ সবাই জানে, আপনিও জানেন। কিন্তু অনেক শব্দ আছে যার অর্থ মানুষ আবছা এবং আংশিকভাবে জানে, পরিষ্কার এবং সম্পূর্ণভাবে জানে না। আগ্রহ শব্দটির অর্থ আপনি কি পরিষ্কার এবং সম্পূর্ণভাবে জানেন?

সংসদ বাঙ্গালা অভিধান বলছে, আগ্রহ মানে ঝোঁক, ব্যগ্রতা, ঐকান্তিক চেষ্টা বা ইচ্ছা; আসক্তি।

আসক্তি শব্দটির কথা ধরুন, এটির অর্থ গভীর অনুরাগ। আবার অনুরাগ মানে, প্রেম।

অর্থাৎ গভীর আগ্রহ মানে গভীর আসক্তি বা গভীর প্রেম। আপনি যে কাজটি করতে চান তা অনেক রকম মনোভাব নিয়েই তো করা যায়, তাই না? কাজটা আপনি প্রয়োজন বলে মনে করে করতে পারেন। করতে পারেন কর্তব্য বলে মনে করে। ঠেকায় পড়ে কাজটা করতে হচ্ছে–ভাবতে পারেন এইরকম। ভাবতে পারেন, না করলেও চলতো, তবু করছি।

উপরিউক্ত যে-কোনো একটি মনোভাব নিয়ে কাজটি করলে যে তা শেষ হবে না, তা নয়। কিন্তু কাজটি সুন্দর হবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তাছাড়া, কাজটা শেষ হতে সময় অনেক বেশি তো লাগবেই, কাজটা করার সময় আপনি বিরক্তি বোধ করবেন, মেজাজ আপনার খিটখিটে থাকবে, নানারকম ক্ষতিকর চিন্তায় ভুগবেন, কঠিন বলে মনে হবে কাজটাকে।

কিন্তু ওই একই কাজ যদি খুশি মনে ধরেন দেখবেন সহজ মনে হবে কাজটাকে এবং দেখতে দেখতে সময় দ্রুত পেরিয়ে যাবে। খুশি মন নিয়ে কাজটা ধরলে আপনি উপকৃত হচ্ছেন।

কিন্তু আরো বেশি উপকার পাবার উপায় আছে। উপায়টা আপনার জেনে রাখা দরকার। কাজটাকে যদি আপনি গ্রহণ করেন গভীর আগ্রহের সাথে আপনি আপনার সবটুকু উৎসাহ, উদ্যম এবং শক্তি প্রয়োগ করবেন, নিজের অজান্তেই। কাজটা শুধু ভালভাবে সম্পন্নই হবে না, হবে আরো নিখুঁত, আরো সুন্দর ভাবে। আর সময়ের ব্যাপারটা? আপনি আরো সময় চাইবেন, আরো বেশি সময় নিয়ে কাজটা করার ইচ্ছা জাগবে আপনার মধ্যে।

কাজের প্রতি প্রেম থাকলে কাজটাকে আপনি কোনো মতেই খারাপভাবে সম্পন্ন হতে দিতে চাইবেন না। আপনার সন্তানকে আপনি ভালবাসেন তাই আপনি। চান না সে খারাপ হয়ে যাক। তাকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তোলবার জন্যে আপনি প্রাণপণ চেষ্টা করেন। সেইরকম আপনার কাজকে আপনি যদি ভালবাসতে পারেন, কাজটা সম্পন্ন করার জন্যে আপনি সম্ভাব্য সবকিছু করবেন, এতে আর। সন্দেহ নেই। এবং ভালো সন্তান যেমন গর্বের বস্তু তেমনি একটি ভালোভাবে সম্পন্ন কাজও মূল্যবান বিষয়। ভালো কাজ ভালো দামে বিকোয়। অনেকগুলো ভালো কাজের সমষ্টিই হলো সাফল্য।

একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে আমার মূল বক্তব্যটাকে আরো পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি।

ধরুন, একজনকে এমন একটা কাজ করতে দেয়া হলো যে-ধরনের কাজ এর আগে সে কখনো করেনি। কাজটাকে সে শুধুমাত্র করণীয় বলে মনে করলে ফলাফল কি দাঁড়াবে?

কাজটিতে হাত দিতে গিয়ে সে ভয় পাবে। পারবো কি পারবো না-এই সন্দেহেও ভুগবে। ফলাফল: ব্যর্থতা।

অপর এক লোককে দেয়া হলো একই কাজের দায়িত্ব। সে কাজটিকে শুধু করণীয় বলে মনে করলো না। কাজটিকে সে গ্রহণ করলো গভীর আগ্রহের সাথে, চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। ফলাফল কি দাঁড়াবে?

আগ্রহ গভীর থাকলে ভয় দূর হয়, সন্দেহ ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। লোকটি ভয়শূন্য, সন্দেহমুক্ত মন নিয়ে কাজটায় হাত দেবে। সাফল্য লাভ করবে সে।

দৃষ্টান্তটি থেকে কি শিখলাম আমরা? গভীর আগ্রহবোধ উদ্দেশ্যের প্রতি নিবেদিত শক্তিই শুধু বৃদ্ধি করে না, সেই সাথে পথ-প্রদর্শকের ভূমিকাও পালন করে।

গভীর আগ্রহবোধ শুধু কাজ সম্পন্ন করার জন্যে দরকার তা নয়। গভীর আগ্রহ আসলে নিতান্তই উপকারী একটা বোধ, যা আপনার মধ্যে থাকলে সর্বক্ষেত্রে, সর্বকর্মে লাভবান হবেন। এই বোধ যাদুকরী ক্ষমতা রাখে।

গভীর আগ্রহকে আপনি অন্যান্য ক্ষেত্রে কিভাবে ব্যবহার করবেন, বলছি এবার।

মানুষের প্রতি, তার কাজে, তার বক্তব্যে, তার সমস্যার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ দেখান। আশাতীত অনুকূল ফল পাবেন।

মুনি ঋষি, মনীষী এবং পণ্ডিতরা বলে গেছেন, মানুষকে ভালবাসো। কেন বলেছেন তারা সবাই এই কথাটা?

কারণ, মানুষকে ভালবাসলে মানুষ খুশি হয়। যেহেতু মানুষের কাছ থেকেই বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ, সহানুভূতি, সাহায্য ইত্যাদি পেতে হবে আপনাকে, তাই তাকে ভালবেসে তাকে খুশি করুন, সে আপনার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হবে।

কাউকে গভীর আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করলে সে নিজেকে সাধারণের চেয়ে উঁচুস্তরের লোক বলে মনে করে, মনে করে আমার মধ্যে বিশেষ কোনো গুণ আছে, তাই আমার প্রতি এতো গভীর মনোযোগ দেখাচ্ছে। লোকটিকে ভালবেসে ও সাহায্য করে আপনি উপকৃত হবেন। সে আপনার প্রতি, আপনার বক্তব্য, সমস্যা এবং কাজের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখাবে।

গভীর আগ্রহবোধকে আপনি হাজার রকম কাজে ব্যবহার করে সুফল পাবেন। যার মধ্যে এই বোধটি নেই সে একটি মূল্যবান গুণ থেকে বঞ্চিত। এই গুণটি আপনার মধ্যে আমদানী করুন। আপনার অধিকারে এই গুণ থাকলে আপনি তরতর করে উপরদিকে উঠে যাবেন, ক্ষমতার অধিকারী হবেন, সম্পদের মালিক হবেন, আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবেন।

দুশ্চিন্তামুক্ত হতে চান? আজেবাজে, ক্ষতিকর চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চান? কাজে এবং কথায় গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে উঠুন। হাতেনাতে যাদুমন্ত্রের মতো অনুকূল ফল পাবেনই।

গভীর আগ্রহবোধের মূল্য এবং তাৎপর্য কতোটুকু, নিশ্চয়ই বুঝেছেন। কিন্তু মূল্য এবং তাৎপর্য বুঝলেই তো হবে না, এই গুণটির অধিকারী হতে হবে আপনাকে, তাই না? গভীর আগ্রহবোধের অধিকারী হওয়া যায় এমন কোনো উপায় আছে কি?

উপায় আছে। শিখে নিলেই হয়।

এই বিশেষ গুণটির অধিকারী হওয়ার উপায় শেখার শুরুতেই আপনি জেনে নিন কয়েকটি বোধ বা গুণের সমষ্টি হলো গভীর আগ্রহবোধ।

তার মধ্যে একটি হলো: অভিপ্রায়।

অভিপ্রায়কে আমরা উদ্দেশ্য বলতে পারি। অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য না থাকলে কোনো জিনিস অর্জন করার ইচ্ছা জাগে না। ধরুন, চাকরি পাওয়াটা আপনার অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য নয়, সেক্ষেত্রে আপনি কি চাকরির জন্যে চেষ্টা করবেন? চাকরি পাবার ইচ্ছা থাকবেই না আপনার মধ্যে।

উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় আগে ঠিক করে নিন, তারপর উদ্দেশ্য হাসিলের পথে নামুন। প্রশ্ন করতে পারেন, অভিপ্রায় কাকে বলে ব্যাখ্যা করুন। নিন ব্যাখ্যা।

এ আপনি কিছু কামনা করুন, কিছু দাবি করুন, কিছু আশা করুন-এর যে কোনোটাই আপনার অভিপ্রায়। সুন্দর একটি এলাকায় চমৎকার একটি বাড়ি তৈরি করতে চান-এটা হতে পারে আপনার একটা অভিপ্রায়।

অসংখ্য বিষয় বা বস্তুকে আপনি আপনার অভিপ্রায়ের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। একটু চিন্তা করলেই দেখবেন, আপনার চাওয়ার শেষ সীমা নেই। কিন্তু প্রত্যেকটি চাওয়াই আপনার অভিপ্রায় হতে পারে না।

চাওয়ার পিছনে জোর থাকতে হবে, চাইলে কায়মনোবাক্যে, প্রত্যক্ষদর্শনের মাধ্যমে, সুখী মনোভাব নিয়ে, জীবনে সাফল্য লাভের একটি অংশ বলে মনে করে, অন্তর দিয়ে, উৎসাহের সাথে চাইতে হবে। তবেই হবে সেটি আপনার একটি অভিপ্রায়।

অভিপ্রায়ের পর আসছে: অর্জন করতে পারবেন এই জ্ঞান।

অভিপ্রায় নির্দিষ্ট হলে আপনাকে সতর্কভাবে ভাবতে হবে অভিপ্রেত বস্তুটিকে বাস্তবে রূপ দেয়া কিভাবে সম্ভব। অথচ, অভিপ্রায় নির্ধারিত করার পর অধিকাংশ লোক কি ভাবে জানেন? ভাবে, উদ্দেশ্য তো ঠিকই আছে, কিন্তু আমার দ্বারা কি কাজটা করা সম্ভব?

নিজেকে এই যে প্রশ্ন, এটা পরিষ্কার সন্দেহ এবং ভয়ের লক্ষণ প্রকাশ করছে। কেউ বৈজ্ঞানিক হতে চায়, কেউ ব্যবসা করতে চায়, কেউ নাবিক হতে চায় অথচ শেষকালে দেখা যায় এরা যা হতে চেয়েছিল তা হতে পারেনি। কেন পারেনি? খোঁজ নিয়ে, তদন্ত চালিয়ে দেখুন, অধিকাংশের ক্ষেত্রে একটিমাত্র কারণ খুঁজে পাবেন–এরা নিজেদের যোগ্যতা, গুণ, ক্ষমতা এসবের প্রতি আস্থাবান ছিলো না। উদ্দেশ্যটা যে তাদের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব একথা তারা নিজেরাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেনি।

ভুলেও কেউ যদি ভাবে অভিপ্রেত বস্তুটি অর্জন করা আমার দ্বারা সম্ভব নাও হতে পারে-তার দ্বারা সত্যি সাফল্যলাভ নাও হতে পারে।

আপনাকে এই বিপদ থেকে সাবধানে থাকতে হবে। আপনি যদি বলেন, পারবো না-শেষ হয়ে গেল ব্যাপারটা, পারার চেষ্টাই আপনি করবেন না। যদি বলেন, নাও পারতে পারি-সন্দেহ রয়েছে আপনার, সন্দেহ থাকলে কাজে হাত দেয়া বোকামি, কারণ ব্যর্থ হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে তাতে। যদি বলেন, পারবো কি!এতেও রয়েছে সন্দেহ এবং ভয়, সুতরাং পরিত্যজ্য। যদি বলেন, বোধ হয় পিরবো-বোঝা যায় আপনার নিজের উপর সম্পূর্ণ আস্থা নেই। যদি বলেন, পিরবো কিনা জানি না-এতেও নিজের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হয়। হয়তো পারবো, পারি কিনা দেখি চেষ্টা করে, মনে হয় পিরবো, পারতেও পারি, পারি বা না পারি দেখি একবার নেড়েচেড়ে-এই ধরনের কথা ভাবা আসলে ক্ষতিকর, নিজের প্রতি অনাস্থার, কাজের প্রতি ভয়ের পরিচায়ক।

আপনাকে ভাবতে হবে জোর দিয়ে পারবো। অবশ্যই পারবো। নিশ্চয়ই পারবো।

নেতিবাচক মনোভঙ্গি সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে আপনাকে। আপনি বিশ্বাস করবেন, পারবো, আমার দ্বারা একশোবার সম্ভব।

এরপর আসছে: দৃঢ় সংকল্প।

স্মরণ করে দেখুন, যাদের সাথে নিত্যদিন আপনার দেখা হয় এখানে সেখানে তারা দেখা হলেই বলে কিনা এটা করবো, ওটা করবো? আপনার আশপাশে এমন প্রচুর লোকের সন্ধান আপনি পাবেন। যাদের মুখে লেগেই আছে এটা করবো, ওটা করবো। কিন্তু তাদের মধ্যে কাজটা করে ক’জন, মাত্র দু’একজনে, তাই না?

আমি পনেরো বছর আগে এক বাকপটু ভদ্রলোককে বলতে শুনেছিলাম, অমুক কাজটি করতে যাচ্ছি আমি। পনেরো বছর গত হয়ে গেছে তারপর। ইদানীং হঠাৎ করে তার সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিল। ভদ্রলোকের চুলে পাক ধরেছে, রেখা পড়েছে মুখে-বয়স বাড়ার ছাপ ফুটে উঠেছে সর্বত্র। অনেক বদলে গেছেন তিনি। কিন্তু দেখা হবার পর কথায় কথায় আমাকে জানালেন-অমুক কাজটি করতে যাচ্ছি আমি।

ভাবুন একবার! গত পনেরো বছর ধরে কাজটা করতে চাইছেন তিনি!

শুধু এই ভদ্রলোকই নন, অধিকাংশ মানুষই বলে করবো, কিন্তু করে না। কেন। করে না? কেউ কি তাদেরকে কাজটি করতে বাধা দেয়?

দেয়। তবে বাধাটা অন্য কোনো মানুষের তরফ থেকে আসে না। বাধাটা। আসে সূংকল্পের অভাব হেতু, নিজের মধ্যে থেকেই। এই ধরনের মানুষ। নিজেদেরকে নিজেরাই নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে।

যার মধ্যে দৃঢ় সংকল্প নেই, জেদ নেই তার নিজের দ্বারা বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। জেদ জিনিসটা আসলে খুবই উপকারী, যদি তা গঠন বা উন্নয়নমূলক কোনো কাজে প্রয়োগ করতে পারেন।

দৃঢ় সংকল্পের অভাব কেন হয় মানুষের মধ্যে?

অনেকগুলো কারণ আছে।

তার মধ্যে একটি হলো: অকাজ বা গুরুত্বহীন কাজ।

কাজ অনেক রকম, সবগুলোই কি আপনার জন্যে উপকারী? তা নয়। কাজটি কি তা নির্ধারণ করার আগে অর্থাৎ অভিপ্রায় নির্দিষ্ট করার আগে আপনি বিবেচনা এবং বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে চিন্তা করে দেখুন যে কাজটি করতে চান বলে ভাবছেন। সেটি আপনার জন্যে কতটা উপকার বয়ে আনবে, কি পরিমাণ লাভবান হবেন, আপনি। কাজটাকে কাজের কাজ হতে হবে। তবেই না সেটা করার জন্যে আপনি আগ্রহী হবেন, সংকল্প গ্রহণ করবেন দ্রুত এবং নিখুঁত ভাবে সেটা সম্পন্ন করার জন্যে।

একটা মূল কাজের অংশ নিজেই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে মূল কাজটার প্রেক্ষিতে, কিন্তু অংশটি এককভাবে তেমন কোনো গুরুত্ব বহন নাও করতে পারে-এই ধরনের আংশিক বা আনুষঙ্গিক কাজকে অবহেলা করতে বলছি না আমি। আমি বলছি সেই সব কাজের কথা যা কিনা নির্দিষ্ট ফলাফল দিতে অপারগ। ধরুন, জুয়ার কথা। এটিকে একটি কাজ মনে করতে পারেন। রোজ সন্ধ্যার পর আপনি খেলতে যান। নির্দিষ্ট ফল দিতে এই কাজ সমর্থ নয়, এটা প্রমাণিত সত্য। সুতরাং, এই কাজ আপনি করবেন না, আপনার করা উচিত নয়। পাকা জুয়াড়ীদেরকে দেখে আমি একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝেছি, তারা আর জেতার জন্যে জুয়া খেলতে বসে না, এতোদিন ধরে তারা যা হেরেছে তার কিছুটা ফিরে পাবার আশায় খেলতে বসে। এদের মধ্যে আমি আবিষ্কার করেছি নৈরাশ্য, নিজের প্রতি অনাস্থা। এতোদিনে তারা টের পেয়ে গেছে, জুয়া খেলাটা কোনো কাজের কাজ নয়, গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়, নির্দিষ্ট ফলপ্রসূ কাজ নয়-যার ফলে তারা এই জুয়া খেলা কাজটির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে।

জুয়া একটি অকাজ বা গুরুত্বহীন কাজ। দৃঢ় সংকল্পের এখানে কোনোই ভূমিকা নেই। জুয়া খেলে জিতবো-এই সংকল্প গ্রহণ করে না কেউ। সংকল্প গ্রহণের ফলে কেউ জেতে না। সুতরাং, জুয়াড়ীর মধ্যে দৃঢ় সংকল্পের অভাব থাকবে।

কোনো কাজ অকাজ বা গুরুত্বহীন কিনা তা অনেক সময় নির্ভর করে সময়ের উপর। অফিস কামাই করে যদি কেউ মাছ ধরতে ব্যয় করে সারাটা দিন-এক্ষেত্রে মাছ ধরাটা অকাজ। ছুটির দিন মজা পাবার জন্যে মাছ ধরতে যান–সেক্ষেত্রে এটা একটা খেলা, একটা আনন্দদায়ক ঘটনা, অকাজ নয়। খেলাও ফলপ্রসূ একটা কাজ। খেলারও প্রয়োজন আছে আপনার।

অফিস কামাই করে মাছ ধরতে গিয়ে দেখুন, মাছ ধরার কাজে উৎসাহবোধ করার চেয়ে অস্বস্তিবোধ করবেন অনেক বেশি। মাছ ধরার প্রতি তেমন মনোযোগী হতে পারবেন না। অথচ আপনার মাছ ধরতে যাবার মূল উদ্দেশ্য: মাছ ধরে মজা পেতে হবে আপনাকে। মজা পাবার জন্যে দৃঢ়ভাবে সংকল্পিত হয়ে পুকুর পাড়ে নেমেছেন আপনি। কিন্তু দৃঢ় সংকল্প আপনার মধ্যে এতোটুকু থাকবে না, অফিস কামাই করে একটা অকাজ করার পিছনে সময় অপব্যয় করছেন বলে।

দৃঢ় সংকল্পের অভাব হবার অন্যতম আর এক কারণ হলো, নেতিবাচক ভঙ্গিতে চিন্তা করার কু-অভ্যাস। পিরবো না, হবে না, সম্ভব নয়-এই রকম ভাববেন না কক্ষনো। আপনার ভাবনা-চিন্তার পদ্ধতি বদলে ফেলুন, ভাবুন-হবে, পারবো, সম্ভব। অর্থাৎ ইতিবাচক ভঙ্গিতে চিন্তা করতে শিখুন। তাহলেই দৃঢ় সংকল্পের অভাব ঘুচে যাবে আপনার মধ্যে থেকে।

এই পরিচ্ছেদে আপনি শিখছেন কিভাবে গভীর আগ্রহবোধের অধিকারী হওয়া যায়। ইতোমধ্যে আপনি শিখেছেন অভিপ্রায় নির্ধারিত করলে, দৃঢ় সংকল্প নিজের মধ্যে আমদানী করলে গভীর আগ্রহবোধের অধিকারী হওয়া যায়। এবার: আত্ম-উপলব্ধি।

আত্ম-উপলব্ধিও অভিপ্রায় এবং দৃঢ় সংকল্পের মতো একটা গুণ। এইসব গুণেরই সমষ্টি হলো গভীর আগ্রহবোধ।

আত্ম-উপলব্ধি।

ধরুন, নিজের কদর বোঝেন আপনি, নিজের প্রশংসা করেন মনে মনে। এতে কি প্রমাণ হয় আপনি অহমিকায় ভুগছেন? না, মোটেই তা প্রমাণ হয় না।

আপনি যা, নিজেকে আপনি তাই বলে মনে করবেন, এতে দোষ কিছুই নেই। এবং যেহেতু আপনি আর সকলের মতোই একজন মানুষ, তাই আপনার সম্ভাবনা। অন্য কারো চেয়ে এতোটুকু কম নয়। যে-কোনো মানুষের সমকক্ষ হতে পারেন আপনি। মানুষের যতগুলো ভালো গুণ আছে, সবই আছে আপনার মধ্যে। সুতরাং ভালো গুণগুলো আছে বলে নিজের প্রশংসা করবেনই তো আপনি।

আসলে, আপনি নিজের সম্পর্কে যা ভাববেন না, যা বিশ্বাস করবেন। না-দুনিয়ার কেউ আপনার সম্পর্কে তা ভাববে না, বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি নিজেকে বহু গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি বলে মনে করেন, লোকেও আপনাকে তাই মনে করবে।

যে ডাক্তার বা আইনবিদের নিজের উপর আস্থা নেই তার উপর কি নিজের সন্তানের চিকিৎসা, কিংবা কোনো আইনসংক্রান্ত দায়িত্ব দিতে চাইবেন আপনি?

কোনোদিন ভেবে দেখেছেন, আপনার মধ্যে হাজারো গুণ আছে? আসলে, না থেকে পারে না। আছেই আছে, আপনি জানুন বা না জানুন।

এবং সেইসবগুলোকে কাজে লাগতে দেখা মানেই নিজেকে উপলব্ধি করা।

কিন্তু অবশ্যই আপনাকে লক্ষ্য রাখতে হবে আত্ম-উপলব্ধির ফলে আপনার মধ্যে যেন সন্তুষ্টি পয়দা না হয়। সন্তুষ্টি আসলে একটি বেড়া, ব্যারিকেড। সন্তুষ্ট ব্যক্তি এগোয় না, এগোবার প্রয়োজন বোধ করে না সে।

অনেকে মনে করে নিজেকে পছন্দ করা মানে আত্ম-উপলব্ধি করা। তা সত্যি নয়। নিজেকে নয়, নিজের কাজকে; যা ভাবছেন, যা করছেন সেই ভাবনা এবং কর্মকে পছন্দ করা মানে আত্ম-উপলব্ধি।

সুখ:

কোটা আগে, মুরগী না ডিম? সুখবোধ গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করে। সেই রকম গভীর আগ্রহবোধ জন্ম দেয় সুখবোধের।

সুখী হওয়াটা জরুরী। আগে দরকার।

সবচেয়ে ভালো হয়, সুখ-এর উপর লেখা পরিচ্ছেদটি এই ফাঁকে জরুরী মনে করে আর একবার পড়ে নিলে। আগে সুখী বলে মনে করুন নিজেকে, তারপর পড়তে শুরু করুন ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *