আলো ছায়ায় যুগলবন্দি
পচ্চিমে বাতাস ছারছে, লাগে জানি পানি হুকায়া যাইবো।
আবদুল খালেক জিগ্যেস করলে, মরণ, এটা কোন্ গ্রাম?
চন্দনধুল।
কাছাকাছি নদী নেই?
আছে না! হাপেরচরের শ্যাষমুখে হইল গিয়া আপনের বরগাঙ, ইছামতি।
আবদুল খালেক বললে, সুন্দর গ্রাম পড়ে পথে?
পাইবেন। গেরামের অভাব নাই। রাজাদিয়া, টেংগুইরপারা, পাওলিদিয়া, বাহিরঘাটা–
তোমার কথা ও বোঝেই নি–রেখা বললে।
আবদুল খালেক বললে, এদিকটা তোমার ভালো লাগছে?
কেমন যেন! শুধু আখখেত আর আখখেত, কোনো কিছু দেখা যায় না–
তাহলে অন্যদিকে ঘোরাতে বলি, কি বলো?
তুমি যা ভালো বোঝে।
আবদুল খালেক মরণ ঢালিকে বললে, নৌকো ঘোরাও বাপু, না হয় আড়িয়লের দিকে চল—
মরণ ঢালি বললে, আইজ আর ফেরন লাগবে না, বিলের মাইদ্যে রাইত কাটাইতে পারবেন নি-ও?
তাহলে তোমার যেদিকে খুশি সেদিকে যাও, গ্রামের পাশ দিয়ে যাবে—
একটার পর একটা গলাপানিতে ডোবা আখখেত। না দেখা যায় মানুষজন, না কোনো গ্রামের মাথা। বাতা আর ছইয়ের গায়ে তুমুল বৃষ্টির শব্দ তুলে আখবনের দাঁড়া ভেঙে লগি মেরে চলেছে মরণ ঢালি।
বনময় টুব-টু-টুব শব্দ। একটার পর একটা ঢিল এসে পড়ছে পানির ওপর, ডাইনে বায়ে, চতুর্দিকে; এইরকম মনে হয় এক একবার। কখনো মনে হয় পানির ওপরে একটা তার টান টান করে বেঁধে অবিরাম টুব-টুব-টুব বাজিয়ে চলেছে কেউ। রেখা কান পেতে শুনছিল। আবদুল খালেক বললে, ডাহুক—
তাই বুঝি—
নৌকোয় ওঠার আগে কাঁদছিলে কেন?
এমনিই!
তুমি খুব কষ্ট পাও, তাই না?
রেখা ভাঙা গলায় বললে, তোমার আর কি কি মনে হয়?
একটু ভেবে নিয়ে আবদুল খালেক বললে, আমি তোমাকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করি নি, এইসব মনে হয়। বরং উল্টোটা করেছি। একতরফা তোমার কাঁধে নিজের অনেক কিছু চাপিয়েছি। তোমাকে যে আমার কিছু দেবার আছে, এসব ভাবি নি, কেবল দাবি করে এসেছি তোমার কাছে। ধর কালকের কথা, তুমি না এক সময়ে বললে, তোমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, তাই তোমার খুব চিন্তা। ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার কাছে খুব ছোট হয়ে গেলাম। একটা মেয়ে, তার জীবনের সবকিছু দিয়ে একজনকে ধরে রাখতে চায়, তার সব চিন্তার শেকড় ঐ এক মাটিতে, ঐ এক জায়গায় শক্ত করে বাঁধা, আমি ভাবতেও পারি না, কোনোদিন ভেবে দেখি নি এভাবে। এ চিন্তা তো আমারও হতে পারতো, একটি মেয়ে, জীবনভর তাকে চাই, তাকে ছাড়া আমার চলবে না, সবকিছু অন্ধকার, অর্থহীন তাকে ছাড়া, ভীষণভাবে পেতে চাই, কই কখনো তো মনে হয় নি। তাকে আমার ধরে রাখতেই হবে, যেভাবেই হোক একবারও মনে হয় নি। বেশির পক্ষে সবকিছু ছিল এই রকম, সে আছে, চলে যাচ্ছে, চলে যাবে। জিনিসটা দাঁড়াচ্ছে এই, তার তো আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, পালাবার কোনো পথ নেই, যেমন আছে, তেমনি থাকবে। শুনতে যতোই খারাপ লাগুক, একটা অস্পষ্ট ধোয়াটে ব্যাপার গোটা জিনিসটা। তুমি আমাকে অনেক সুখ দিয়েছে, রেখা আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ
রেখা বললে, তুমি না বলেছিলে কেউ কারো দুঃখ নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো না, অন্তত এই দিনটায়, ভুলে গেলে? এসব কথায় মন খারাপ হয়ে যায়।
এসে যায়। আমরা একে অপরের এতো চেনা যে, নিজেদের বাইরে যেতে পারছি না। এর বাইরে যেতে গেলেই সবকিছু সস্তা অভিনয় হয়ে যাবে! তখন এভাবে ভেবে দেখি নি।
রেখা বললে, তুমি আর একটু ভেতরের দিকে এসে বসো, মুখে রোদ লাগছে।
আবদুল খালেক সরে এলে রেখা বললে, ডাহুকগুলো ওভাবে ডাকছে কেন?
ডিম দেয়ার সময় এখন। বর্ষার পানি থাকতে থাকতে দুতিনবার ডিম দেয় পাখিগুলো—
টুকুর জন্যে খুব খারাপ লাগছে, নিয়ে এলেই হতো—
আবদুল খালেক বললে, মোমেনার সঙ্গে ও দিব্যি থাকবে।
আমরা কোনদিকে যাচ্ছি?
একদিকে গেলেই হয়–
একটা সিগ্রেট ধরায় রেখা। আলতোভাবে টান দিতে গিয়ে সে কেশে ওঠে। বললে, নাও, ধরো–
আবদুল খালেক বললে, আরো দুটো টান মার না, কি হবে।
না বাপু! এমনিতেই কেমন যেন গা গোলাচ্ছে–
দুজনে খেলে ভালোই লাগে!
মামাও এরকম বলতো—
বলতো নাকি?
তোমার বোধহয় বিশ্বাস হয় না? রেখা হেসে বললে, ওপর থেকে দেখে মামাকে ওই রকম কাটমোল্লা মনে হয়, ভেতরে ভেতরে রস আছে বুড়োর। রোজ শোবার ঘরের দরোজা বন্ধ করে মৃতসঞ্জীবনীর বোতল নিয়ে বসতো মামা। বলতো স্বাস্থ্যটা একটু ভালো করা দরকার, বল পাই শরীরে। মাঝে মাঝে মামীও খেত। মামাই বোধহয় জোর করে খাওয়াতো। তারপর সে কি হাসাহাসি। দুএক সময় এমন হুটোপুটি বেধে যেতো ঘরের ভেতর, আমার নিজেরই লজ্জা লাগতো।
আবদুল খালেক হাতের ওপর কাত হয়ে শুয়ে বললে, ভালোই তো!
রোজ রাতে মামীকে সাজতে হতো, কত রকমের যে শখ মামার! কিছু ভেবে রেখা বললে, তোমার কখনো এরকম ইচ্ছে হয়?
সাজলে ভালোই লাগে—
একদিনও তো বললে না?
তুমি যদি আবার অন্য কিছু ভাবো!
কি ভাববো অন্য কিছু?
কতো রকমের সন্দেহ থাকতে পারে—
নিজের মনের জোর থাকলে আবার কি। বলেই দেখতে!
আচ্ছা, এবার থেকে বলবো—
তবু ভালো— রেখা হেসে বললে, শুধু মনে হতো লোকটার কোনো শখ নেই, একটা মরা কাঠের তক্তা ধরে ভাসছি!
আবদুল খালেক অনেক চিন্তা করে বললে, আচ্ছা, মানুষ কি সত্যিই ভালোবাসে, না জীবনভর এইসবের অভিনয় করে?
সেটা তোমারই জানার কথা!
বোঝা গেল খুশি হয় নি রেখা।
আবদুল খালেক বললে, এই সব বোধহয় কথার কথা। সময় নষ্ট করার জন্যে কতগুলো জিনিসকে খাড়া করা। আসল সমস্যা তো ভাত-কাপড়ের–
তা তো দিচ্ছোই!
একে দেয়া বলে না।
তাহলে কি বলে?
কোনোমতে চলে যাচ্ছে। তুমি চালিয়ে নিচ্ছো—
এটাই ভালোবাসা, সত্যিই যদি এভাবে থাকো। তুমি কি মনে করো, হাতি-ঘোড়া মারার দরকার হয়? কাছাকাছি থাকলে কোনো কষ্টই নয়, তখন এক ধরনের জোর থাকে মনের, ভেতর থেকে সাহস আসে। যখন মনে হয় মানুষটা কেমন যেন একটু দূরে দূরে, কোনো কিছুতেই জড়াতে চাচ্ছে না, ব্রিত হয়ে আছে, একটার পর একটা আড়াল তৈরি করে যাচ্ছে, একটু একটু করে তখন ভেতরে ভাঙন ধরে।
আবদুল খালেক বললে, তোমার সব কথা আমি বুঝতে পারছি।
রেখা কেঁদে ফেললে। বেশ সময় লাগলো তার নিজেকে সামলাতে। এমন অদ্ভুত সব কথা তার মনের ভেতরে ওত পেতে আছে, সে নিজেই জানতো না। নিছক ওপরের সাজগোজ দিয়ে ঢেকে রেখেছিল নিজেকে, কিন্তু ভেতরে এমন অগোছালো, এমন দলা পাকানো, যে সে নিজেই ভয় পেল। সে বললে, তুমি আমাকে কিছুই দিও না, তোমার কাছে আমি কিছু চাই না, শুধু একটু কাছে থেকো, চিরকাল তোমার হাত যেন আমার গায়ের ওপরে থাকে, চোখ খুলেই যেন প্রথমে তোমাকে দেখি, বেঁচে থাকার জন্যে তুমি শুধু এইটুকু আমাকে দিও—
আমি কি তা দিচ্ছি না?
হয়তো দিচ্ছে, কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারি না, বোঝার ক্ষমতাটাই বোধহয় জট পাকিয়ে গেছে। মনে হয় গায়ের ওপরে তুমি যে হাত রেখেছে তাতে রক্ত নেই, প্রাণ নেই, অন্য কারো হাত। চোখ খুলে যাকে দেখি সে যেন অন্য কেউ অচেনা। কি রকম যে হয়, তোমাকে বোঝাতে পারি না। আগে কখনো এসব মনে হতো না, ঘুমের ভেতর তুমি স্বপ্ন দেখলেও আমি বুঝতে পারতাম। এখন এতো দূর থেকে কথা বলো, এমনভাবে বলো, যেন আমি তোমার কেউ নই। এখন তুমি ভয় করে চলো, গা বাঁচিয়ে চলো; নিজেকে এমনভাবে আড়াল করে রাখো, যাতে আমার চোখে না পড়ো। তুমি তো খেয়ালই করো না, করলে দেখতে, সারাটা রাত শুধু উশপিশ করে কাটাই, ঘুম আসে না, কি যে যন্ত্রণা। একবার দেখি তুমি মড়ার মতো পড়ে আছো, একবার দেখি জেগে আছো, তবু মশারির বাইরে তোমার হাত, মশায় খাচ্ছে, তোমার সাড়াই নেই–
আবদুল খালেক উপুড় হয়ে শুয়ে গলা তুলে দেখলো রেখাকে। রেখার হাতের ওপরে একটা হাত রেখে বললে, আমি জানতাম না তোমার ভেতরে এতো কথা আছে। সকলের ভেতরেই বোধহয় এই রকম আরো একটা আলাদা সংসার পাতা থাকে, সেখানে সে তার খেলার পুতুলের জন্য নিজের যথাসর্বস্ব দ্যায়, এক টুকরো ভাঙা কাচের জন্য বুক ভরে কাঁদে, নিছক কাগজের নৌকো ডুবে গেলে একেবারে সর্বস্বান্তু হয়ে যায়–
রেখা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। এই মুহূর্তে নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হলো। সে চায় আবদুল খালেক কিছু বলুক। অনেক কিছু শুনবে বলে সে আজ তৈরি হয়েই নৌকোয় উঠেছে।
আবদুল খালেক বললে, মনি ভাইজানকেও শেষ পর্যন্ত আমি এমনভাবে দেখেছিলাম—
রেখা বললে কিভাবে দেখেছিলে?
সেকথা এখন থাক, কথা যখন উঠেছেই বলবো এক সময়–আবদুল খালেক ডুব দিয়ে ওঠার মতো করে বললে, তবু একটা জলজ্যান্ত রক্ত-মাংসের মানুষের জন্যে তুমি এমন উতলা হয়ে উঠেছে। আর আমার কথা জানো? একটা সামান্য রোগা ঠ্যাং ভাঙা শালিককে দেখতে না পেলে এক সময় এক একটা দুপুর আমার কাছে মিথ্যে হয়ে যেতো। দুপুরটাকে মনে হতো জীবন; নিংড়ে নিংড়ে তার সব আলো এখন কেউ চুষে নিয়েছে। এই রকমই হয়। এই রকম হয় বলেই হাত-পাগুলো ভাঙা থাকে মানুষের। সে খোঁড়া হয়ে থাকে, নুলো হয়ে থাকে, অথর্ব মেরে যায়। হাঁটু মুড়ে ভ্যাবলা হয়ে বসে থাকে। তা না হলে, দাঁত জানে তার কি কাজ, নখ জানে তার কি কাজ, ভেতরের ডাকাতটাকে তো মানুষ ভাত-কাপড় দিয়ে পোষেই। এই রকম হয় বলেই একটা মানুষ তার দুটো হাতকে হাসিমুখে আরেকজনকে বিলিয়ে দিতে পারে, বলতে পারে আর কি নেবে নাও, তোমার যা খুশি নাও। তা না হয়ে চোখের সামনে থেকে একটা চুলও কেউ উড়তে দিতো না, একটা কুটোগাছও তার হাত থেকে গলতো না–
রেখা ভয়ে বললে, আজ কিন্তু আমি তোমাকে রাগ করতে দেবো না। আমার মনে যা যা হয়, তোমাকে শুধু সেই কথাগুলোই বলতে চেয়েছিলাম। তুমি যদি না শোনো আর কাকে বলবো–
আবদুল খালেক অসহিষ্ণু হয়ে বললে, যখন তুমি বললে তোমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, তখন সব অপরা্ধের বোঝা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। আমার তো মনে আছে, যেদিন তুমি প্রথম এলে, সেদিন কি ছিলে তুমি। দেখে আর আশ মেটে না, সকালে দেখি, দুপুরে দেখি, যতোবার ইচ্ছে দেখি, তোমার সমস্ত শরীর তখন ঝনঝন করে বাজে, শুধু লোভ হয়। একেবারে রাজছত্র খুলে বসলাম। তোমার সমস্ত শরীরকে চাইলাম পাগলামির ভেতর, গুণ্ডামির ভেতর, খুনোখুনির ভেতর। একটা নদী যখন শুকিয়ে যায়, তখন তাকে কেউ অপরাধী বলে সাব্যস্ত করে না, তার কথা মনে করে শুধু দুঃখ পায়। একটা সামান্য মানুষকেও ঠিক এইভাবে দেখো। এইভাবে দেখলে তার ধ্বংসস্তৃপই কেবল তোমার নজরে আসবে। বুকের ওপর দুটো হাত জড়ো করে মার-খাওয়া মানুষ যখন বলে মুঠোয় কি আছে দেখতে চেয়ো না, দোহাই তোমাদের, এ তোমাদের কোনো কাজে লাগবে না, সারাজীবনের সঞ্চয় শুধু এইটুকুই, এই সামান্য স্বপ্নটুকুই, তখন ধরে নিতে হয় সে বেঁচে আছে বেবল স্মৃতির ভেতর। তার চেয়ে নির্বিষ, তার চেয়ে নিরাপদ জানোয়ার আর কে!
রেখা আবদুল খালেকের একটা হাত দুমুঠোয় পুরে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বললে, আমি তোমাকে কোনো দোষ দেই নি। স্বামীর কাছে পুরোনো হয়ে যাওয়ার মতো দুঃখ মেয়েদের কাছে আর কিছু নেই। বোধহয় কলঙ্ককেও তারা এতোটা ভয় করে না। তুমি যাকে অপরাধ বললে, মেয়েদের জীবনের ঐশ্বর্য ঠিক অতোটুকুই। মেয়ে হলে তুমি বুঝতে–
কি জানি, তোমরা বোঝো। ভাত-কাপড়ের বেশি আমার মাথায় বোধহয় আর কিছু ঢোকে না—
রেখা বললে, আমি বুঝি, এখন তুমি হাঁপিয়ে পড়েছে। এখন তো হেঁজিপেঁজিরাও ইচ্ছে করলে একটা চাকরি ধরতে পারে। তুমি যদি অমত না করো ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এ একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারি–
আবদুল খালেক হেসে বললে, আর কি কি ভেবে রেখেছো?
আগে একটু গুছিয়ে নিতে হবে, তারপর একটা মেয়ে দরকার। তোমার তো মেয়ের শখ—
ও মোমিন মিয়াবাই–মরণ ঢালি সামনের দিক থেকে আসা নৌকোর প্রস্রাবে মগ্ন সোয়ারির উদ্দেশে বললে, এলা ফিরান দিয়া হুকার পানি বদল করেন, নায়ের ভিৎরে মানু—
আমন খেতের ফাঁকে ফাঁকে এক একটি ফাঁকা চক, হয়তো পাট ছিল, এখানে সেখানে কেবল বাতাসের নাচন। গলুইতে এসে বসে আবদুল খালেক কিছুক্ষণের জন্যে। কাচের মতো পানি। তলা দেখা যায়। নানাজাতের জলজ উদ্ভিদ দোল খায়। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে পানি থেকে সবুজ ঝাঁঝি তুলতে থাকে আবদুল খালেক।
মাঝি, আমরা কতোদূর?
হপায় সুজানগর পার হয়া আইলাম—
বলেছিলে না আমাদের নামাবে কোথাও?
মরণ ঢালি বললে, জাঙ্গাইলা আয়া লউক, খাওন-লওনের কাম শ্যাষ কইরা অক্করে দিঘলীতে লয়া ফালামু আপনেগো, পদ্মা দেইখা আইবেন।
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে বাড়িয়ে দিল রেখা। দুখানা বিস্কুট। ধনিচা বনের গায়ে নৌকো রেখে চা খেল মরণ ঢালিও!
আবদুল খালেক বললে, পদ্মার দিকে যে যাবে, ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে না?
মরণ ঢালি বললে, দিনে দিনে মেলা করুম, বেশি রাত হইবো। রাইতে আমার নাও বাওন তো অহনতরি দেহেন নাই, বাওয়া খেতের ওপরদা পিরপিরায়া লগি মাইরা যামু, ঘুরান পথ ধরে কোন বোন্দায়। অহনে খেতে দারা ফালাইলে ব্যাড়ারা কিলাইয়া আর আস্তা থুইবো না–
বয়েস হলেও লোকটা ঝাড়েমুলে এখনো বেশ টন্কো সপ্রাণ। আবদুল খালেকের তাই মনে হলো। নৌকা রেখে একটা ভেঁসাল থেকে সে মাছ কিনলো। ফিরে এসে আবার লগি ধরে একগাল হেসে বললে, আউজকা খাইবেন মাঝির হাতের পাক—
আবদুল খালেক বললে, বলছো কি তুমি?
এলা বয়া বয়া সব দেইখেন, কতো মাইনসেরে পাক কইরা খাওয়াছি। ডাকতরে সব বন্দোবস্ত কইরা দিছে—
দূরে দূরে এক এটি জলবন্দি নিস্তব্ধ গ্রাম। থেকে থেকে এক একবার কোড়া ডেকে ওঠে ধানখেতের মাঝখানে হু-হু বাতাসে সবুজ গন্ধ। সবকিছু শান্ত, কোথাও কোনো দাগ লেগে নেই, কোথাও কোনো জোড়াতালি নেই। এমন অকপট সবকিছু, এমন নির্দোষ যে, নিজের ভারে নিজেকে বিপন্ন মনে হয়।
রেখা বললে, ভিতরে এসে বোসসা, চুপচাপ ভালো লাগে। কেমন দমবন্ধ হয়ে যায় আবদুল খালেক বললে, তোমার ছেলেবেলার কথা বলো, শুনি–
রেখা বললে, আজ থাক, খামোকা মন খারাপ করে কি লাভ। কিছু কিছু তো জানোই। পরগাছার আবার ছেলেবেলা কি?
কখনো কারো জন্যে কাঁদোনি?
মনে পড়ে না—
পুতুলের বিয়ে দিয়ে কাঁদো নি?
সে তো ন্যাকড়ার, কাঁদবো কেন?
আবদুল খালেক হেসে বললে, তখন তোমার বুদ্ধি আরো পাকা ছিল তাহলে?
তাই বলে ন্যাকড়ার পুতুলের জন্যে কেউ কাঁদে?
এও তো ন্যাকড়ারই পুতুল, যাকে নিয়ে সংসার পেতেছো—
ঘোরালো কথা তুলতে পারবে না বলে দিচ্ছি–চোখ পাকিয়ে রেখা বললে, ন্যাকড়ার পুতুল কেন? একটা প্রেম করতে পারছে না বলে? ধরে রেখেছি বলে?
কোথায় ধরে রেখেছো, একে ধরে রাখা বলে? আবদুল খালেক হাসতে হাসতে বললে, আমি তো ছাড়াগুরু ইচ্ছে করলেই পরের খেতের ধান সাবড়ে দিতে পারি!
ইচ্ছে করলেই তো হয়!
ওই ইচ্ছে করাটুকুই হচ্ছে কষ্টের। তুমি বরং আরো একটু বেশি করে ধরে রেখো, কষে, যাতে বাবাগো বলে চেঁচিয়ে উঠি, প্রাণ বেরিয়ে যায়—
আবদুল খালেক হাসতে লাগলো।
কি যে হাসো! বোঝা গেল, রেখা ভালোমতোই চটেছে।
আবদুল খালেক বললে, উহু, তুমি চটে যাচ্ছো, এরকম কোনো কথা ছিল না।
রেখা বললে, তুমি নিজেই তো একটা কিছু বাধাবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছো–
আবদুল খালেক একটা সিগ্রেট ধরিয়ে খুব সহজ গলায় বললে, কেউ কাউকে ধরে রাখে না, অধিকারটাকে সবচেয়ে বড় করে দ্যাখে বলে ঐরকম মনে হয়। তুমিও আমাকে বেঁধে রাখো নি, আমিও তোমাকে বেঁধে রাখি নি। মানুষ কি গরু-ছাগল-ভেড়া যে, দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা যাবে?
রেখা বললে, তোমার একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথার কোনো মিল নেই। তুমি কি সত্যিই সবকিছুকে এভাবে দ্যাখো, না কথার পিছে কথা? এসব যদি সত্যি হয়, তাহলে ঘর-সংসার করার কোনো মানে হয় না—
কেউ যখন ঘর-সংসার করে, তখন সে তার মানে খুঁজতে যায়। মানে খুঁজতে গেলেই বিপদ। চোয়া ঢেকুর তুলতে তুলতে নাককান বুজে সে শুধু তার আয়ু ক্ষয় করে যাবে, আবার কি? মানেফানে নেই বুকে হেঁটে,গড়িয়ে গড়িয়ে, ডিগবাজি খেয়ে তাকে চালিয়ে যেতে হবে, ব্যাস্!
রেখা বললে, এই নিয়ে তর্ক করতে চাই না। এ তোমার শুধু এক ধরনের বলতে পারা, এর ভেতরে কোনো বাহাদুরি নেই। তুমি চুপ করো—
আবদুল খালেক বললে, ঠিক আছে, দুই একটা মাছের নাম করো।
আগে বলো কেন?
বলছি, আগে উত্তর দাও–
ধরো রুই।
একটা পাখির নাম—
ধরো ময়না—
একটা নদীর নাম—
তিতাস—
একটা মানুষের নাম—
টুকু–
আবদুল খালেক বললে, ভেবে দ্যাখো আগাগোড়া ব্যাপারটা। তুমি রোজ খাচ্ছো চুনোপুঁটি, কিন্তু মাছ বলতে প্রথম তোমার মনে এলো রুই মাছের কথা। প্রতি মুহূর্তেই তুমি ডাহুকের হাক শুনতে পাচ্ছো, মাছরাঙা, বক, ফিঙেকে উড়তে দেখছো, তবু ময়নার নাম প্রথমেই মনে এলো। ময়না বোধহয় বাঁধাবুলি আওড়ায়, হয়তো সেই জন্যেই। আমরা যাচ্ছি পদ্মার দিকে এই একটু আগেও তুমি শুনলে, অথচ নদীর নাম বললে তিতাস। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ব্যাপারটা তো এই! অভ্যস্তার বাইরে তুমি যেতে পারলে না। একটা মানুষের কথা বললে টুকু। সামনে আমি ছিলাম, এমন কি মরণ ঢালির নামও তুমি করতে পারতে। তার মানে টুকুর কথা তুমি সবসময় ভাবছো, অথচ সঙ্গে আনো নি। সব ব্যাপারটাই হচ্ছে গরমিলের। এই গরমিলের ভেতরে হয়তো হিসেব নেই, কিন্তু সত্যি আছে। তোমার ওই ঘর-সংসারের কথাই যদি ওঠে, সেখানে দেখো ঐ গরমিলের ভেতরে সত্যিটাকে কেউ পোছেই না, তার বেলায় শুধু গা বাচিয়ে চলা, টানা-হাচড়া হয় কেবল হিসেবটাকে নিয়ে–
রেখা বললে, আমি তোমার ছাত্রী হতে চাই না।
আবদুল খালেক বললে, ভালো হচ্ছে না রেখা, খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু–
ইস, তোমাকে আমি ভয় পাই? কি করবে কি?
কি করবো? অন্তত ঐ মাঝির সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরে চাকুম-চুকুম করে দুচারগণ্ডা চুমু খেয়ে ফেলতে পারি—
বাহাদুর!
পারি না বলছো?
তুমি সব পারো—
তাহলে দেখ নিজের বৌকেও চুমু খেতে পারছি না, তাকে অপদস্থ করা হচ্ছে।
না গো, তোমার সঙ্গে আমি ঘর করতে পারবো না–রেখা আবদুল খালেকের ঊরুতে চিমটি কেটে বললে, তুমি মানুষটা বড় ঘোরালো, জান বেরিয়ে যায়—
আবদুল খালেক বললে, তাহলে ছেড়ে দিচ্ছো?
যাও দিলাম—
আবদুল খালেক গলা বাড়িয়ে বললে, ও মাঝি, এটা কোন্ গ্রাম?
মালনি মিঠুসার—।
এখানে নৌকো ভেড়াও–রেখার দিকে তাকিয়ে আবদুল খালেক চাপা গলায় বললে, আমি এখানেই নেমে যাবো—
মরণ ঢালি বেছে বেছে একটা আড়াল খুঁজে বের করে।
গলাপানিতে দাঁড়ানো হিজল গাছের কোল ঘেঁষে ঘন বৌনার জঙ্গল। এর মাঝ দিয়ে রাস্তা করে কচু আর নলবনের ওপর মড়মড়িয়ে সে তার সুকাঠের নৌকোটাকে ঠেলে দেয়। নৌকো পাড়ে ভিড়তে না ভিড়তে আধশোয়া কাশবনের ভেতর লাফিয়ে পড়ে আবদুল খালেক দৌড় দিল,
আমি চললাম—
ইচ্ছামতো ঘুইরা লন! পাক-শাক কইরা খায়ালয়া এলা হের পর স্যান মেলা করুম মরণ ঢালি রেখাকে নামিয়ে দিয়ে বললে, জনমনিষ্য নাই, খালপাড় বরাবর ব্যাকই জঙ্গল!
কেমন যেন একটু গা ছমছম করে রেখার। বড় ভয় তার সাপখোপের। পা টিপে টিপে হাঁটে আর ঐদিক-ওদিক দ্যাখে। ওগো, তুমি কই?
কোনো সাড়া পাওয়া যায় না আব্দুল খালেকের। চেঁচামেচি জুড়ে দেয়া একটা কাঠঠোকরা উঠে যায়। যতোই এগোয়, খাড়া মাস্তুলের মতো কদমের ঘন বন দেখতে পায়। বর্শার ফলার মতো পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুকু রোদ এসে পড়ছে তা কিছুটা ছিন্নভিন্ন, ফালাফালা, তার কোনো তেজ নেই। রেখা আবার ডাকলো, ওগো তুমি কই?
তা লুকোচুরি খেলার জায়গা বটে। রেখার মনে হয়, পাজিটা হয়তো ঘাড় গুজে চুপিসারে পেচ্ছাব করতে বসেছে কোথাও।
একজোড়া ইষ্টিকুটুম পাখি তার সাড়া পেয়ে ঝটপট করে একটু দূরে জামগাছে গিয়ে বসে। রেখা বললে, ও কুটুম পাখি, তাকে দেখেছো?
রেখার চোখ গেল একটা নধর গুইসাপের ওপর। ঝোপে ঢুকতে গিয়েও সে থেমে গেছে, ঘাড় ঘুরিয়ে খুব মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে।
দেখাচ্ছি মজা এই বলে একটা মাটির ঢেলা ছুঁড়লো সে, নচ্ছার হ্যাংলা!
আসশ্যাওড়া পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার গন্ধ শুকতে শুকতে রেখার মনে হলো, কোনোদিন সে এইভাবে বাইরে আসে নি! নাগালে পেলেই এক একটা পাতা ছেড়ে আর নাকের কাছে ধরে। বুনো ঝঝে মাথা ঝিমঝিম করে। এই গাছগুলোর প্রাণ আছে। এক একটা হেঁড়া পাতার গায়ে হালকা নিশ্বাসের গন্ধ, আমাকে মারলে–এই রকম। রেখা বললে, মারবো, আরও মারবো। পারলে বাধা দাও। যতো খুশি মারবো, ইচ্ছেমতো মারবো। একটা একটা করে সব পাতা ছিঁড়ে ফেলবো, সব গাছ উপড়ে ফেলবো। আমার নাম রেখা, আমি তোমাদের রানী—
রেখার নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। গা জড়াজড়ি করা কদমের বন তাকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে, এক একটি লতা খুশিতে উপচে উঠে দোল খেয়ে বলছে, তাহলে তুমি এসেছো, এতোদিন পরে মনে পড়লো আমাদের–
রেখা মনে মনে বললে, আসতে পারি নি, কাজে বড় ব্যস্ত থাকি, তা না হলে বেশ লাগে, এই যেমন এখন—
একটা ধেড়ে কোলাব্যাঙ তিন লাফে অদৃশ্য হয় আর মার্টির হুঁকোবুড়োর মতো মাথা নাড়তে থাকে কালকচুর পাতা। ব্যাঙটা একটা বেহায়া জোকার, রেখা ভাবলো, লাফ মারার ভেতরেও পষ্ট ইয়ার্কি, হাত-ছুঁড়ে কেমন যেন তে-ফেরেঙা হয়ে লাফাচ্ছিল, ব্যাটার খুব চর্বি হয়েছে, খুব আনন্দে আছে—
বনময় সিল্কের বাতসে; পাটভাঙা, নরোম, আলুথালু। রেখার মনে পড়লো, ইস্কুলে থাকতে সেই শেষের দিকে, তারা একবার দল বেঁধে পিকনিকে গিয়েছিল শ্রীমঙ্গলে। একা একা সে শালবনের ভেতর ঘুরেছিল। কেন যে তার এমন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন! ভীষণ কান্না পেয়েছিল। রাখ, তোকে কিভাবে জব্দ করি দ্যাখ—সমস্ত নিস্তব্ধতা যেন দাঁত কিড়মিড় করে তার দিকে তেড়ে এসেছিল। ঘরে ফিরে মার খেয়েছিল সে মামির কাছে। এমন এমন গাল শুনতে হয়েছিল তাকে যে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল নিজের ওপর। মনে হচ্ছিল, এমন দাঁতে দাঁতে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না, গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়ে মরবে।মামার আড়ালে সর্বক্ষণ পিশপিশ করতো মামি। উঠতে-বসতে খোটা দিতো। চুল আচড়াতে দেখলে হাত থেকে কাঁকুই কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতো। বলতো, সবসময় শুধু সাজন–গোজন, কুটোটি নেড়ে দুখানা করবে না, গাগতরে যে ঘুণ ধরবে। দুটো চেহারা ছিল মামীর। মামার সামনে এক রকম, আড়ালে ঠিক তার উল্টোটি, গলার স্বরই বদলে যেত মামীর। একবার অসাবধানে তার হাত লেগে তেলের বোতল উল্টে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে লাথি মেরেছিল মামী, মামী মামী-রেখার দুচোখ ছাপিয়ে উঠলো, অনেকদিন পর একটা কষ্ট ভেতরে ভেতরে তাকে ছত্রখান করে দিল, মনে হলো কোনোদিন তার কেউ ছিল না, সে খুব একা, সে কি কোনোদিন কারো আপন হতে পারবে না।
রাজা গো! তুমি কই?
ঘু-ঘু করে ঘুঘু ডাকে। কাটবাদাম গাছের শুকনো লাল পাতার আড়ালে একটা ছাতারে পাখি উঁকি মেরে টু-কি টু-কি করে তাকে দ্যাখে। রেখা বললে, খুব মজা লাগছে না? শুয়োর—
এক একবার এক একটা কথা উঁকি দেয়। কেন যে আমি টুকু সোনাকে রেখে এলাম, এ কেমন মা! ঐ লোকটাকে আমি এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না; যতো খারাপই হোক, তবু তো আমি নাড়ি-নক্ষত্র বুঝে ফেলেছিলাম মামীর। আর এই লোকটা, এর কিছুই বুঝি না, পা থেকে মাথা এর হেঁয়ালি, গোলমেলে। পরিপাটি করে খোঁপা বেঁধে দিলে খুশি হতো মামী। তলপেটে তেল মালিশ করে দিলে বড় আরাম পেত। সেদিন সব গোনা মাপ। সবসময় তার তালে তাল দিতে হবে, এই রকমই একটা আবদার ছিল মামীর। এই লোকটি কি যে চায় বোঝা যায় না। না, কোনো কিছুই চায় না এ লোকটা! এমন ভেতরগোজা মানুষ নিয়ে ঘর করা কি কঠিন!
পোকা, পোকামণি!
রেখার ডাকাডাকিতে বুনো গন্ধ শির শির করে, হলুদে সবুজে হু-হু করে গুমরে ওঠে শান্ত আলো। শেষ পর্যন্ত আবদুল খালেককে খুঁজে বের করলে রেখা। একটা তমাল গাছের গায়ে পিঠ রেখে পা লম্বা করে বসেছিল সে।
ঝপ করে বসে পড়ে রেখা।
তুমি এখানে?
আবদুল খালেক তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
রেখা বললে, রাজা, তুমি আমাকে ভালোবাসো। রাজা তুমি আমাকে ভালোবাসা দাও, আমি মরে যাবো–
আবদুল খালেক তার চোখে চুমু খেল। তারপর বললে, তুমি খুব সুন্দর, তুমি জীবনভর থেকো, যেদিন মরবো, তোমাকে দেখতে দেখতে যেন মরি—
রেখা কাঁদলো; আর এমনভাবে কাঁদলো যেন তার প্রতিজ্ঞা ছিল আজ সে ঠিক এইখানে, এইভাবে, মাটির ওপর উপুড় হয়ে, শেষবারের মতো করে কাঁদবে। প্রাণভরে নিজেকে নিংড়ে নিংড়ে। তার সে কান্নায় এমন কিছু ছিল, যাতে আবদুল খালেকের এই প্রথমবারের মতো মনে হয়, ওর কোনো অভিযোগ নেই, ও কিছুই চায় না,জীবনে এত শক্ত মার খেয়েছে। সে বললে, আমার মাধুরী, মাধুরানী আমার, কেন এমন করে জীবন দিয়ে ফ্যালো–
রেখা কোনো কথা বললে না। তার ভেতরে দারুণ একটা জিদ, আজ যদি আবদুল খালেক তাকে ধরে মারেও, সে কোনো কথা বলবে না। বলার মতো তার আর কিছুই নেই। যা বলার সব সে বলে দিয়েছে। আর সে বেহায়াপনা করতে পারবে না।
আবদুল খালেক অবলীলাক্রমে তাকে তুলে নেয়। তারপর দপদপ করে হাঁটে। কদমের বনে দামাল বাতাসের এক একটা ঝাপটা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝোপের আড়ালে নিয়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে দেয় সে রেখাকে। রেখা বললে, ওগো আমার ভয় করে, এখানে না। কেউ যদি দ্যাখে—।
আবদুল খালেক বললে,তোকে আমি ভীষণভাবে চাই, ওরে মাধু আবদুল খালেক তার ভেতরের এক থাবাওলা, লোমশ, দাতাল অচেনা জানোয়ারকে দেখতে পেল, গাছের ছায়ায় ছায়ায়, পাখির সরল শিসে, যে এতদিন অকাতরে ঘুমিয়েছে। সে তাকে আহ্বান করলো।
রেখা বললে, রাজা, আমার পিঠে লাগে—
লাগুক—
আমাকে ভালোবাসো রাজা, আদর করো–
গরগরে চণ্ড ও আত্মবিস্মৃত আবদুল খালেক তার গহিন উন্মত্ততার পাতাল থেকে বললে, আমার মাধুরী, মাধুরানী–
রেখা বললে, রাজা আমি মরে যাবো, আমাকে আদর দাও–
অনেক অনেকক্ষণ পর আবদুল খালেক যখন উঠতে যাবে রেখা তার গলা জড়িয়ে ধরে। বললে, আমাকে ধরো, আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো।
আবদুল খালেক রেখার কানে মুখ নিয়ে বললে, ব্যথা পেয়েছো?
রেখা কান্নার মতো করে বললে, বুঝতে পারো নি?
ঠিক ইচ্ছে করে নয়, কি ভাবে যেন হয়ে গেল—
আমি ভয় পেয়েছিলাম!
এ কথায় আবদুল খালেকের ভিত পর্যন্ত কেঁপে যায়। সে জানে তার দুটো হাত নির্বোধের মতো রেখার গলার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, যে-কোনো মুহূর্তে ভীষণ একটা কিছু ঘটে যেতে পারতো,
যে-কোনো মুহূর্তে; অশ্য তখন রেখার চোখ বন্ধ ছিল।
সে বললে, হয়তো অনেকদিন পর, তাই! আর কখনো হবে না–
রেখা বললে, আমি কিছু মনে করি নি। তোমার ভালো লেগেছে?
খুব!
তুমি সুখী হয়েছে?
আবদুল খালেক সে কথা প্রমাণ করার জন্যে রেখাকে বুকের ভেতরে নিয়ে অস্থির করে দিল চুমোয় চুমোয়।
একটা গলা ডোবানো হিজলের আড়াল নিয়ে পানিতে নামে রেখা। আবদুল খালেক বললে, ভয় নেই, ভালো করে নামো, এখানে দেখার কেউ নেই।
রেখার পরনে পেটিকোট আর ব্লাউজ। শাড়ি ডাঙায় রেখে সে পানিতে নেমেছে। আবদুল খালেকও নামে সেইভাবে, গাছের ডালে তার সার্ট-প্যান্ট।
রেখা আবদুল খালেকের পিঠ ধরে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটে।
আবদুল খালেক বললে, কিছুদূর যাবে?
রেখা বললে, দূরে যেতে ভয় করে—
ধরে থাকো–এই বলে খালের বেশ কিছুদূর পর্যন্ত যায় আবদুল খালেক। বেশ কিছুদূরে ধানখেতের মাঝখানে একটা নৌকা। আবদুল খালেক আর এগোয় না। ফিরে আসে।
প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে তারা এইভাবে পানি ছিটোয় আর মাতামাতি করে। রেখা বললে, চলো, খুব হয়েছে, জ্বর না আসে আবার —
গেঞ্জি দিয়ে মাথা মুছে রেখাকে সেটা দেয় আবদুল খালেক। রেখা বললে, কতো অসুবিধে, এতো জানলে কাপড়-চোপড় নিয়ে আসতাম। এখন খালি গায়ে শুধু শাড়ি জড়িয়ে থাকতে হবে। কেমন দেখাবে? লোকে দেখলে কি বলবে?
আবদুল খালেক বলে, ছইয়ের ভেতরে বসে থাকবে, আমি ছাড়া আর দেখছে কে?
মরণ মাঝি কি ভাববে বলো তো?
আবদুল খালেক রেখার গাল টিপে দিয়ে বললে, ভাববে মেয়েলোকটা একটা বখাটে ছোঁড়ার সঙ্গে যাচ্ছেতাই ইয়ে করে বেড়াচ্ছে–
রান্না শেষ হয়ে গিয়েছিল মরণ ঢালির। কলাপাতায় ঢেলে তিনজনে একটা গাছের ছায়ায় বসে বসে খেল। ইলিশ মাছ আর ভাত। রেখার খুব খিদে পেয়েছিল। সে পেটভরে খেল। বললে, মাঝির রান্নার হাত খুব সুন্দর। আমাকে রান্না শেখাবে?
মরণ ডালি লজ্জা পেয়ে বললে, কি যে কন? এইগুলো অইলো গিয়া আপনের ভক্কর-চক্কর, ঠ্যাকার কাম চালাইন্যা পাক…
দুপুর শেষ হবার আগেই নৌকো ছাড়ে মরণ ঢালি। জাঙ্গাইলা বোলতলী, বাইল্যাগাঁও, ভোগদা, একটার পর একটা গ্রামের পাশ কাটিয়ে নৌকো এগোয়। নৌকোর ভেতরে দালামোচড়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রেখা। মরণ ঢালি ছইয়ের মুখে একটা ছালা টানিয়ে দিয়েছিল। গলুইয়ে বসে থাকতে থাকতে আবদুল খালেকেরও যেন কেমন একটু তন্দ্রার ভাব এলো।
একটু পরে মরণ ঢালি বললে, ভিতরে গিয়ে বহেন স্যার। পাথাইল্য হোত। এলা ভান কইরা মান্দার বনে নাও ঢুকায়া দিবার পারে।
একটু একটু করে বিকেল মরে আসে। খালের ঘোলা পানি আর কলরব দেখে আবদুল খালেক বোঝে, এখন তারা পদ্মার খুব কাছে।
মরণ ঢালি একটা বাঁক পার হবার পর পানির তোড়ের দিকে চোখ রেখে বললে, রাগ দেখছেন নি!
বিকেল শেষ হবার আগেই লৌহজং পৌঁছায় নৌকো। আবদুল খালেক গায়ে হাত দিয়ে রেখাকে জাগায়। রেখা বললে, আমার তো আর বেরুনোর উপায় নেই–
নৌকোর ওপরে বসে দ্যাখো–
শাড়ির আঁচলে কানমাথা সব টেকে ছইয়ের মুখে নেমে বসে রেখা। আবদুল খালেক নৌকো থেকে নেমে হাঁটতে থাকে।
এখন তাহলে এই! এই অবস্থা!
বেশ দূরে সরে গেছে পদ্মা। পালতোলা নৌকোর বহর আবছা আবছা দেখা যায়। যা ভেবেছিল এখন আর তার কিছুই নেই। হাজা-মজা, শুকনো। এই লৌহজং নামটা তার মাথার ভেতরে অন্ধকারে দোলা দূর নৌকোর বাতির মতো এখন টিপ টিপ করে জ্বলে। গোয়ালন্দ, আরিচা, ভাগ্যকুল, তার পাশা, ষাটনল, এই নামগুলোর ভেতরে এখন সে দারুণ এক দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়।
ভাবতেই পারে নি আবদুল খালেক, এমনভাবে তাকে হতাশ হতে হবে। তার সব উৎসাহে ভাটা পড়ে। কেন এলো এতোদূর, শুধু একটা নামের জন্যে, লৌহজং একটা নাম, এই নামের জন্যে।
কতোকাল আগেকার কথা সেসব, মাঝরাতে হঠাৎ এক শোরগোল তার কানে এলো, ভাগ্যকুল, ভাগ্যকুল! তারপাশা, তারপাশা!
কতোকাল আগেকার কথা সেসব? সেই অস্ট্রিচ, সেই এমু, সেই কিউই, সেই সব ইস্টিমার, কতোকাল আগের কথা সে সব?
আবদুল খালেকের মনে হলো, তার ভেতরের সব ঘোলা পানি এখন শান্ত, তাতে আর ঢেউ নেই। এক একটা বড় ফ্ল্যাট, ক্যান্টারবেরি, পোর্টমাউথ, লীখ, হালোয়ারা, তার দেহের ওপরে থরথর করে ভেসে আসে।
এইভাবে সবকিছু একদিন গল্প হয়ে যায়। জীবনে সেই প্রথম, এক গভীর রাতে, তার কানে বেজে উঠেছিল–লৌহজং, লৌহজং। পাশে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান, মনি ভাইজানের জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ, যে গন্ধে অনেক দুঃখ, যে দুঃখে অনেক ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় অনেক ছেলেবেলা…।
এইভাবে সবকিছু একদিন গল্প হয়ে যায়। জীবনে সেই প্রথম, এক অন্ধকার রাতে তার কানে বেজে উঠেছিল—তারপাশা তারপাশা! পাশে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান, মনি ভাইজানের হাতে একটা লোহার ক্লিপ। মনি ভাইজান বিড়বিড় করে হাওয়ার কানে কানে বললে, আমরা যি কোথায় যাচ্ছি!
কে জানে, কে কোথায় যায়!
গোয়ালন্দ থেকে নারায়ণগঞ্জ–পথ যেন আর শেষই হতে চায়। মনি ভাইজানকে দেখা যাচ্ছিল কুয়াশাছন্ন। কেউ যেন তাকে মুছে দিয়েছে। ঝাপসা, অস্পষ্ট। এইসব ভাবলো আবদুল খালেক। নৌকোয় ফিরে এলো।
তাকে ফিরতে দেখে মরণ ঢালি বললে, নাওয়ের ইলশা পাইলেন নি?
তুমি নৌকো ছাড়ো–-
আবদুল খালেক ছইয়ের ভেতরে ঢুকে কাত হয়ে শুলো।
রেখা বললে, তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?
কেমন দেখাচ্ছে? অন্যমনস্কভাবে জিগ্যেস করে আবদুল খালেক।
কই দেখি—কপালে হাত দিয়ে দেখে রেখা বললে, গা তো ঠিকই আছে, ভেবেছিলাম বুঝি জ্বর এসেছে–
আবদুল খালেক কিছুটা পরে বললে, এই লৌহজং আমি আগেও একবার দেখেছি, এখন যেন অন্যরকম, না এলেই বোধহয় ভালো ছিল—
মরণ ঢালি নৌকো ছেড়ে দিয়েছিল আগেই। আবদুল খালেক লম্বা হয়ে শুয়ে হাতের ওপর মাথা রেখে বলতে থাকলো, দেখেছিলাম স্টিমার থেকে, তখন এই এতটুকু, সঙ্গে মনি ভাইজান–
রেখা বললে, আজ তোমার মনি ভাইজানের কথা বলো, কতো কথা তো হয়, কিন্তু আসল কথা তো একদিনও বললে না! আমার খুব ইচ্ছে করে জানতে–
কি বলবো, কি আছে বলার। ভাঙাচোরা মানুষকে নিয়ে কি-ইবা এমন থাকে বলবার, সে তোমার ভালো লাগবে না–
রেখা অনুনয় করে বললে, তবু তুমি বলো, লক্ষ্মীটি—
আবদুল খালেক বললে, তখন তো কিছু বুঝতাম না, একটা শালিক পাখির জন্যে কি হাহাকারটাই না ছিলো বুকের ভেতর। একদিন দেখা না পেলে সবকিছু মিথ্যে হয়ে যেত, একটা ভাঙা কাচের শেকলকে কতো যত্ন করেই না লুকিয়ে রেখেছি। এখন কাচের সেই শেকল গলায়, না পারি খুলতে, না ফেলতে, খুলতে গেলে যদি গলা কেটে যায়—
রেখা বললে, এই বুঝি তোমার মনি ভাইজানের কথা হচ্ছে?
কিভাবে বলবো, কি এমন জানতাম, না, কিছু না। আমি ছিলাম সকলের ছায়ায় ছায়ায়, কেউ চাইতো না সামান্য একটু রোদ লাগুক গায়ে, রাতে ঘুমের ঘোরেও খুঁজতাম, বিছানা হাতড়ে দেখতাম কাছে কেউ আছে কি না, এইভাবে গায়ে গায়ে, ছায়ায় ছায়ায় আমি বড় হচ্ছিলাম। কলেজে ভর্তি হয়ে যাবার পর থেকে টিপু ভাইজান হয়ে গিয়েছিল দূরের মানুষ, নাগাল পাওয়া খুব শক্ত ছিল। আমার ছিল মনি ভাইজান। যখন একা একা বসে থাকতাম চোখ ভরে আসতো পানিতে, কেবলই মনে হতো যদি কোনোদিন মনি ভাইজানের কিছু হয়ে যায় আর যদি ঘরে না ফেরে। কেন যে এরকম মনে হতো! অথচ মনি ভাইজান ছিল একেবারে উল্টো ধাচের। বকাঝকা করলে, সেদিন হাঁড়ি উল্টে আরো বেশি করে খেত। মা বলতো, বেহায়া তোর যে কি হবে! রেগে গেলে আব্বা বলতো, কি আবার হবে, পুঁতলে চারা হবে। এসব যে গ্রাহ্য করার ব্যাপার, মনি ভাইজানকে দেখে কখনই তা মনে হতো না। এরপর হুট করে একদিন পাকিস্তান হয়ে গেল। কি হলো না হলে অতো বুঝতাম না, কেবল মনে আছে আমাদের বাড়িতে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো সেদিন। বাইরে রাস্তায় হুড়োহুড়ি রসগোল্লা ছোঁড়াছুঁড়ি বহু কিছু চলছিল, অথচ আমাদের কিছু করবার নেই, আব্বা বললে, কেউ বাইরে যেও না, ঘরে থাক সবাই। তা আমরা ঘরেই থাকতাম। দুএকদিনের মধ্যেই বুঝলাম এমন একটা কিছু ঘটে গেছে যাতে আমরা কেউই ভালো নেই, আমাদের আর ভালো থাকা সম্ভব নয়, আমাদের পরিবারের সুখ-শান্তি চুরি হয়ে গেছে। আব্বাকে সবসময় দেখতাম থমথমে। মাঝে মাঝে মার সঙ্গে তর্ক হতো। আর অনেকের সঙ্গেই তর্ক হতো। শেষে সকলের অমতে আব্বা পাকিস্তানে চলে এলেন। এতদিন তবু একরকম ছিল। আমরা ইস্কুলে যেতাম, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতাম, কেউ কেউ এসে ডাকতো। এই ডাকাডাকিটা কেন যেন বন্ধ হয়ে গেল। এক সময় দেখি আর কেউ আসে না, আর কেউ এসে বাইরে যাবার জন্যে ডাকে না। কি সব কানাঘুষো হয়, হারিকেন জ্বেলে সারারাত বিছানায় বসে বসে মা আমাদের পাহারা দ্যায়, কিছু বুঝি না কেন। আব্বা পাকিস্তানে চলে আসাটাকে কেউ ভালো চোখে দেখে নি। আব্বা বলতো মাথা উঁচু করে চলতে পারাটাই বড় কথা। যেখানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবো, সেটাই দেশ। মা বলতো তাই বলে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে অজানা এক দেশে আমাদের থাকতে হবে। এটা কোন কথা। আমি কোথাও যাবো না, মরতে হলে এইখানেই মরবো, কপালে যা থাকে তা হবে। এ কথায় খেপে উঠতো আব্বা। বলতো দেশ আবার কি, এক দেশ না ছাড়লে আরেক দেশ পাওয়া যায় না। সকলের জীবনেই একবার হিজরত আছে। রুসুলুল্লার কথা ভুলে গেলে? তিনি মদিনা শরীফকেই বেছে নিয়েছিলেন— কেনারাম কাকা মাকে প্রবোধ দিয়ে বলতেন, আমরা সবাই তো আছিই, দেশ ছেড়ে যাবে কেন, আজন্মকালের সম্পর্ক! কিভাবে যে চলছিল, মনেও নেই সব। সবসময় ঘরের ভেতর গুমোট, কারো মুখের দিকে তাকানো যায় না, এক এক সময় টিপ ভাইজান এক একটা খবর নিয়ে আসে, তাই নিয়ে সলাপরামর্শ হয়, গুজগুজ হয়, অতশত আমাদের মাথায় ঢুকে না। কেবল এটুকুই বুঝতাম, কোথাও না কোথাও একটা জটিল গলদ দেখা দিয়েছে, কারো কোনো কিছুতেই কোনো স্বস্তি নেই, কেউ মন খুলে কথা বলে না, এই রকম। মাঝে মাঝে দুএকজন জিজ্ঞেস করে, হ্যারে তোর বাবা পাকিস্তানে গেল কেনরে, তোর বাবা নাকি ভালো লোক নয়? এইসব শুনে মন খারাপ হয়ে যায় ভীষণ, ইচ্ছে করে না কারো সঙ্গে মিশি, কারো সঙ্গে কথা বলি। আমি যে মুসলমান, ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারার জন্যে কষ্টো হয়, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এইভাবেই চলছিল, কোনো একভাবে চলছিল, হঠাৎ টিপু ভাইজানের কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের বাইরে বেরুনো বারণ হয়ে গেল আমাদের। কেনারাম কাকা মাকে এসে কি কোথায় সব বললো। এলেন দুর্গাদাস বাবু, নির্মল কাকা। কি কোথায় সব বোঝালেন টিপু ভাইজানকে, মাকে। আমরা অন্য কেউ কিছু বুঝলাম না। মনি ভাইজান টিপু ভাইজানকে জিগ্যেস করলে, এত গুজগুজ কিসের, কি ব্যাপার। খেপে গিয়ে টিপু ভাইজান বললে, তোর অতো মাথা ঘামানোর কি আছে, সব কথা তোকে শুনতে হবে। আমরা থাকি দূরে দূরে, ভয়ে; যখন এইসব কথা হয় ধারে কাছে থাকলে টিপু ভাইজান খাউ করে ওঠে। হঠাৎ একরাতে এলো একটা ট্রাক। তাড়াহুড়ো করে কিছু বাঁধাছাদা হলো। ট্রাকে বসে নির্মল কাকা। বললেন, দেরি করো না, দেরি করাটা উচিত হবে না। বেশকিছু মালপত্র তোলা হলো ট্রাকে। টিপু ভাইজান বললে, তোরা সবাই এক এক করে ট্রাকে ওঠ, মালপত্রের সাথে বসে থাক। মা বললে, আমরা পাকিস্তান যাচ্ছি বাবা। মনি ভাইজান বললে, তোমরা যাও আমি যাবো না। মা মনি ভাইজানের পিঠে হাত রেখে বললে, টিপু যা বলছে তাই কর, চারদিকে খুনোখুনি হচ্ছে, ট্রাকে গিয়ে বোস, এই বলে মা দেয়ালে মাথা রেখে কান্না শুরু করলে। মনি ভাইজান চুপিচুপি আমাকে বললে, পোকা শোন, আমার সঙ্গে চল কাজ আছে। আমি মনি ভাইজানের চোখ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার হাত ধরে মনি ভাইজান দৌড়তে শুরু করলো। বললে আরো জোরে ছোট, পা চালা। বারবার আমি পেছনে যাই। মনি ভাইজান আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। ধমক মারে আর বলে এক গাট্টা মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো তোর মাথার, শুয়োর কোথাকার, আরো জোরে দৌড়ো, আরো জোরে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আমি দম নিয়ে নিই, আবার ছুটতে থাকি, ছোটা যেন আর শেষই হয় না। শেষে ছবিদিদের বাগানে পৌঁছে আমরা থামি। মনি ভাইজান বললে, একটু জিরিয়ে নে, কেউ কিছু জিগ্যেস করলে কিছু বলবি না, বলবি রানির কথা, রানি একটা বই নিতে পাঠিয়েছে। চুপি চুপি ছবিকে বলবি আমার কথা, আমি এইখানে। পারবি তো? বললাম, পারবো। সেই অন্ধকারে ছবিদিদের বাড়ির পেছনের বাগানে ডেকে আনলাম। ছবিদি পড়ার ঘরে একা বসেছিল একটা বই নিয়ে। বললাম, মনি ভাই তোমাকে ডাকে ছবিদি, পেছনের বাগানে দাঁড়িয়ে। ছবিদি চোরের মতো পা টিপে টিপে মনি ভাইজানের সামনে এসে দাঁড়ালো। মনি ভাইজান, পুকুরে ডুবে যাওয়ার মতো হাঁসফাস করে বললে, ছবি, আমরা চলে যাচ্ছি। ছবি, আমরা আর এখানে আসবো না, আমাকে মাফ করে দাও। কোনো কথা না বলে মাটির ওপরে বসে পড়লো ছবিদি, ফুপিয়ে উঠলো। মনি ভাইজান আবার বললে, আমরা চলে যাচ্ছি ছবি। ছবিদি বললে, মনিদা কোনোদিন মন থেকে তোমাকে গাল দিই নি–। মনি ভাইজান বললে, আমাকে কিছু দাও ছবি, আমাকে কিছু দাও। উঠে দাঁড়িয়ে ছবিদি বললে, কি নেবে মনিদা, কি নেবে তুমি? মনি ভাইজান বললে, তোমার যা খুশি, যা দিতে পারো, হাতে সময় নেই, দেরি হয়ে যাচ্ছে, দাও। ফস করে মাথা থেকে ফিতে খুলে দিল ছবিদি। বললে, এটা নেবে? মনি ভাইজান ভিক্ষা নেওয়ার মতো দুহাত পেতে বললে, তোমার মাথার কাটা, ক্লিপ, যা পারো,সব দাও। ছবিদি দিলো। দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠলো। বললে, মনিদা, আমি মরে যাবো, আমি মরে যাবো। মনি ভাইজান অন্যদিকে তাকিয়ে বললে, আমি আসবো, যে করেই হোক আমি আসবো ছবি, তুমি থেকো। তারপর আবার ছোটা। ছুটতে ছুটতে আবার ফিরে আসি দুজনে। সকলে ট্রাকে। টিপু ভাইজান আমাদের জন্যে ছটফট শুরু করে দিয়েছে। কাছে আসতেই ঠাস করে একটা চড় মারলো মনি ভাইজানের গালে। বললে, শুয়োর কোথাকার, কোথায় গিয়েছিলি, লাট সাহেবের জন্যে সবাই বসে থাকবে। কোনো কথা না বলে মনি ভাইজান ট্রাকে উঠলো। কেনারাম কাকা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ভালো থেকো, যেখানেই যাও ভালো থেকো, মানুষ হয়ো–
রেখা বললে, কাঁদছো কেন?
আবদুল খালেক বললে, কি জানি, আজকাল আমার এই রকম হয়। আগে কখনো হতো না। আগে কখনো এভাবে ভাবি নি। এভাবে মনে পড়ে নি। এখন মনে পড়লেই এরকম হয়। তুমিই বলো না, কেন এরকম হয়?
রেখা হাত বুলিয়ে দিল আবদুল খালেকের মাথায়। আবদুল খালেক বললে, সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেল সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগলো না। আর কখনো জোড়া লাগবে না। মনি ভাইজান পারে নি, পারতে চায় নি। যদি পারবে, তাহলে ওভাবে মরতে গেল কেন। মার সামান্য একটা কথায় অতোগুলো ঘুমের বড়ি খেতে যাবে কেন, তা না হলে? তুমি পারতে? ঐ ছেঁড়া তার জুড়ে দিতে? স্টিমারে সারারাত আমরা দাঁড়িয়ে কাটিয়েছিলাম। সারাক্ষণ আমি মনি ভাইজানের পাশে সারাক্ষণ। এক একটা ঘাট আসে, তারপাশা, ভাগ্যকুল, ষাটনল, মনি ভাইজান হু-হু করে কাঁদতে থাকে। বলতে থাকে, তারপাশা তোকে আমি মারবো, ভাগ্যকুল তোকে আমি মারবো, নদী-তোকে আমি মারবো, শেষ মারা আর শেষ হয় না কিছুতেই–
রেখা বললে, থাক, তুমি চুপ করো, ঘুমোও, তুমি যে কী—
আর কোনো কথা বললে না আবদুল খালেক। এক সময় বোধহয় তার তন্দ্রা এলো। ঘুমোবার আগে রোজ যা হয়, সেই হাত-পা মুড়ে, হাঁটু দ-করে টুকুর মতো এই এতোটুকু হয়ে গেল সে। তারপর এক সময় হাতড়ে হাতড়ে রেখার একটা পায়ের ওপর হাত রেখে সে বললে, আমাকে কোলে নাও মাধুরী–
অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ