এক চামচ গ্লুকোজে পেঁপের আঠার ফোঁটা ফেলে আমাকে খাওয়াতে মা। কোনো কোনোদিন আবার কুমারেশ, কিংবা কালমেঘের বড়ি। বেলপোড়া, বেলের মোরব্বা, কিংবা চুনের পানি, এইসবও চলতো। ঘুম থেকে উঠে সকালে খালি পেটে খেতে হতো।
পোকা, এই ছিল আমার ডাক নাম। কেনারাম বাবুর দেওয়া নাম। তিনি ছিলেন আব্বার বন্ধু। আমরা ডাকতাম কাকা।
কেনারাম বাবুকে নিয়ে একটা ছড়া প্রচলিত ছিল:
কেনারাম কিনে আনে
তুলারাম তুলে রাখে
ফেলারাম ফেলে দেয়
বেচারাম বেচে দেয়
কেনারাম কাকাই জানেন আমার নাম পোকা দিয়েছিলেন কেন। পোকা, পোকা, পোকা আছিস– এই বলে তিনি হাঁকডাক শুরু করে দিতেন।
আমি বেরুলে বলতেন, যা, জুতো পায়ে দিয়ে আয়।
কেনারাম কাকা আমার হাত ধরে হাতিপুকুরের দিকে যেতেন। হাতিপুকুরের গোটা এলাকাটা বিশাল বিশাল রেনট্রিতে ঘেরা ছিল। আর ছিল গুলোর। গাছগুলোর নাম তার মুখ থেকেই শোনা, গাছাগাছড়ার কতো নাম যে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এখানে সেখানে বড় বড় গাছের ছায়ায় বিছিয়ে থাকতো তেঁতুলের মতো শুকনো ফল; সেগুলো গরু-ছাগলের খুব পছন্দের ছিল।
হাতিপুকরের ঠিক মাঝখানে ঢিপির মতো দ্বীপ। লোহার সাঁকো পেরিয়ে সেখানে যেতে হতো। ঢিপির চূড়ায় গোল চবুতারার নিচে বেদি ছিল, সেখানে আমরা বসতাম।
ওখানে বসে বসে দ্বীপের গায়ের এক একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে কেনারাম কাকা বলতেন, ঐ যে গন্ধরাজের মতো যেটা দেখছিস, ওটা হলো গিয়ে তোর হিং গাছ, আর ঐ যে পামের মতো যেটা, ওটা হচ্ছে গিয়ে তোর সাবুদানার গাছ।
ফেরার পথে বলতেন, কি খাবি, পান্তুয়া না রসগোল্লা?
বলতাম, রসমঞ্জরি!
ওই সময় কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আব্বার সঙ্গে তার অবনিবনা চলছিল, কথাবার্তা বন্ধ ছিল দুজনের। পরে অবশ্য ওসব মিটে যায়।
মাঝে মাঝে ইরানি জিপসিদের তাবু পড়তো হাতিপুকুরের পাড়ে। কুঁচিওলা ঘাঘরা পরা লম্বা লম্বা বেণী ঝোলানো মেয়েরা মাথায় ফুটতোলা রুমাল বেঁধে কামসুতোর দড়ি পাকাতো। ছুরি, কাঁচি, নানা রঙের পাথর আরমার চুলের গুছি, এইসব নিয়ে তারা ঝঝ দুপুরে বাড়ি-বাড়িতে ঘুরতো।
মনে আছে, একদিন ভরদুপুরে মাথায় রুমাল জড়ানো এক জিপসি মেয়ে কিভাবে আমাদের ভয় দেখিয়েছিল। জামার ভেতর রঙিন পুঁতির মালা বের করে ফিসফিসিয়ে মেয়েলোকটি মাকে বললে, বাহোৎ কিমতি, বাহোৎ বাহোৎ কিমতি, সস্তেমে দে দেতা, লেলো, লেলো–
মার কোনো উৎসাহ না দেখে সে আবার বললে, কিসিকোত বোলনা মাৎ, সেরেফ দাশ রুপেয়া, লেও–
মার দরোজা বন্ধ করার উদ্যোগ দেখে সে ফস করে কোমরে গোঁজা ছুরি বের করলে। ভয়ে তো আমাদের হাতে-পায়ে খিল ধরা অবস্থা। সেই পুঁতির মালা শেষ পর্যন্ত মাকে নিতে হয়েছিল।
আর একবার একটা কাণ্ড ঘটেছিল। হঠাৎ এক দুপুরে এসে হাজির চিমটেওলা এক সাধু, সারা গায়ে ছাইমাখা, মাথায় গিটবাধা খোঁপা। বললে, মানস সরোবর থেকে আসলাম
মা একটা আধুলি দিলে আমার হাতে, বললে যা দিয়ে আয়—
সাধু বললে, আমি ভিক্ষে নিই না।
মা জিজ্ঞেস করলে, তাহলে আপনি কি চান?
তোর ঘরে না একটা সিন্দুক আছে কাঠের?
মা আমতা আমতা করে বললে, আছে, আমরা তাতে লেপতোষক রাখি—
জানি জানি, সবই জানি, না জানলে আর বলছি কিভাবে! তুই একটা বোকা সাধু হেসে বললে, লেপ-তোষক দিয়ে ওটাকে ভরিয়ে রেখছিস! আমি ইচ্ছে করলে তোর ঐ সিন্দুকটাকে টাকায় ভরে দিতে পারি।
সব শুনে মা হাঁ হয়ে গিয়েছিল।
শুধু একটা ফুঁ! যে টাকায় ফুঁ দেব সেটা এক লক্ষ গুণ বেড়ে যাবে–
কুড়িয়ে-বাড়িয়ে গুচ্ছে নোট এনে সামনে ধরে মা। ফুঁ দেবার পর সাধু বললে, গোপন রাখার কথাটা, বলবি না কাউকে, রাত ঠিক দুটোর সময় টাকায় আর যাবে সিন্দুক।
মেঝের ওপর টাকাগুলোকে ছড়িয়ে দিয়ে দুহাতে ঘেঁটে দিলে সাধু।
কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
রাতে বারবার উঠে মার সিন্দুক খোলাখুলি দেখে আব্বা সম্ভবত কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। বললে, আসলটা গুণে দ্যাখো–
সে হিসেব মার নিজেরও জানা ছিল না। কৌটো-কাটা, বিছানার তলা, বাক্স, শাড়ির ভাঁজ, এইসব হাতড়ে যেখানে যা পেয়েছিল, তাই হাজির করেছিল সাধুর সামনে। তবে বহু টাকাই যে হাতসাফাই হয়ে থােয়া গিয়েছিল তা ধরতে কোনো অসুবিধে হয়নি।
মাকে ঠকানো খুব সহজ ব্যাপার ছিল। কেঁদে পড়লেই হলো। চাল-ডাল, পুরনো কাপড়, আলুটা পেঁয়াজটা বিলানো এসব তো ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। খুব সহজেই মানুষের মুখের কথা বিশ্বাস করে ফেলতো মা। এভাবে প্রায়ই একে-তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিত। তারপর দুচারদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল এটা-ওটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যথারীতি নতুন মানুষটিও উধাও।
আমরাও নানারকমে মাকে ঠকাতাম। টিপু ভাইজান ও মনি ভাইজান যোগসাজশ করে প্রায়ই বোকা বানাতো মাকে। অনেক সময় রানিবুবু বুঝতে পেরে সব ফাঁস করে দিত মার কাছে। ঝগড়াফ্যাসাদ কম হয়নি এসব নিয়ে।
এই রকম কতো কি!
শীতকালের সকালে মাঝে মাঝে পুকুরের কোণে জোড়া কুলগাছের তলায় মাদুর পেতে আসন গেড়ে বসে দুলে দুলে রিডিং পড়তো সবাই পাল্লা দিয়ে। আব্বা ডুবে থাকতো ডিকশেনারির ভেতর। কোনো কোনোদিন আবার বসে মটরশুঁটি ছিলতো। ছোলা হয়ে গেলে বলতো, পোকা যাও, তোমার মাকে দিয়ে এসো। আর কিছু ছোলার থাকলে তাও নিয়ে আসবে।
কুলগাছতলায় বসেই দুধ-মুড়ি থিন এ্যারারুট বিস্কুট, এইসব খাওয়া চলতো। তখনো বইপত্তর ছুঁইনি, মাঝে মাঝে কেবল শ্লেটপেন্সিল নিয়ে মাছ আর হিজিবিজি কাগাবগা আঁকি।
আমাদের একপাশে ছিল কলকাতার বাবুদের বিশাল বাগান, নন্দনকানন। বাগান দেখাশোনার জন্যে কুঁড়েঘর তুলে বসবাস করতো সাঁওতালরা। ওদের ডাকতে হতো সর্দার বলে। কাঠবিল্লীর ওপর ছিল ওদের ভারি লোভ, চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই, ঘচাং করে তীর মেরে তাকে মাটিতে ফেলবে। মাঝে মাঝে দেখা যেতো তারা দল বেঁধে শিকার থেকে ফিরছে; কাঁধের বাঁশে ঝোলানো বুনো শুয়োর, বনবিড়াল আর কাঠবিল্লী। ওদের কুকুরগুলো ছিল বেজায় রাগী।
আমাদের আশুচাচাও একজন ডাকসাইটে শিকারী ছিলেন। সাঁওতালদের নিয়ে তিনি বছরে দুএকবার শিকারে বেরুতেন। খোলা জিপগাড়ির মাথায় বাঘ শুইয়ে বল্লমধারী সাঁওতালদের নিয়ে তিনি সবগুলো রাস্তায় চক্কর দিতেন। বিশেষ করে এস.ডি.ও আর মনুসেফ সাহেবের কুঠির সামনে পৌঁছানোর পর সাঁওতালদের হৈ হৈ রৈ রৈ আরো বেড়ে যেতো। হরিতলার মোড়ে এলে কিছুক্ষণের জন্যে গাড়ি থামাতেন। তারপর যখন দেখতে না দেখতে মাছির মতো চারপাশে চাক বাঁধাতো মানুষজন, তখন ব্যস্ত হয়ে বলতেন, আঃ কি মুশকিল! ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো, কি এমন দেখার আছে।
হরিতলায় একটা টিউবওয়েল ছিল। উড়ে নটবরকে প্রায় সারাদিনই দেখা যেতো কল পাম্প করতে। অনেক বাড়িতেই সে সময় টিউবওয়েল ছিল না। তার কাজ ছিল গালের একপাশে পানের ঢিবলে খুঁজে বাঁকে করে বাড়ি বাড়িতে পানি পৌঁছে দেওয়া। সে বেচারা ছিল ভারি ভালো মানুষ। ভালো মানুষ পেয়ে অনেকেই তার পেছনে লেগে থাকতো। আমাদের মনি ভাইজানও তাদের ভেতের একজন। নটবর উড়েকে দেখলেই সে ধক্কা মারিবি ধক্কা মারিবি, তংকা মারিবি কাঁই–বলে চিৎকার করে দৌড়ে একদিকে পালিয়ে যেতো।
সবকিছু ছিল থিতানো। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, উপদ্রব নেই; থাকলেও সব বোঝার মতো বয়েস হয়নি তখনও।
দিন দিন একটু একটু করে রাস্তাগুলো চোখের সামনে বড় হয়, আলো-বাতাসের ভেতর নানা রঙের পালক ভেসে বেড়ায়, জানা হয়ে যায় অনেক বাড়ি, তাদের নাম। দত্তবাড়ি, মিত্তিরবাড়ি, ঘোষালবাড়ি, বোসবাড়ি, গোদবুড়ির বাড়ি, করিমন বিবির বাড়ি, এসবই ততদিন চেনা হয়ে গেছে।
মাঝে মাঝে আমরা থলে নিয়ে করিমন বিবির জঙ্গলে ডোবা বাগান গিয়ে হাজির হতাম। তার বাড়ির কাশীর পেয়ারা ঐ অঞ্চলে আমাদের জন্মাবার বহু আগে থেকেই বিখ্যাত ছিল।
হাঁকডাক শুনে একচালা মাটির ঘরের ভেতর থেকে ছেড়া ধুন্ধুড়ি মাকা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে থক খক করে কাশতে কাশতে বেরিয়ে আসতো বুড়ি। বলতো, কি চাইগ কেঁাকারা, এ্যামন হুমদাম নাগিয়েচো ক্যানো!
পেয়ারার কথা শুনে বলতো, আগে দেকেনি পয়সা কতো এনেচো, দাও–
প্রতিবারই বরাদ্দ ছিল সিকি। কাঁপা কাঁপা হাতে পয়সা নিয়ে বলতো, না বাপু, এ্যাতো কোমে কিভাবে দিই বনো দিকিনি! তা কোনো বাড়ির ছেনে তোমরা?
শোনার পর বলতো, এয়েচো যকোন ফেরাবো না। মাকে বোনো, এরপর থেকে এক টাকার কোমে আমি প্যায়রা দিতি পারবো না।
প্রতিবারই এইরকম হতো। বুড়ির কেউ ছিল না। ছানি পড়েছিল চোখে। দুতিন গণ্ডা পেয়ারার নাম করে মনি ভাইজান থলে ভরে পেয়ারা পেড়ে নিত। বুড়ির আন্দাজ ছিল সাঙ্ঘাতিক।
এইরকম আরো একজন ছিল। গিরিবালা। মুখময় তার গুটিবসন্তের দাগ। মাঝে মাঝে আমরা তার ফাইফরমাশ খেটে দিতাম। চলাফেরার তেমন ক্ষমতা ছিল না বুড়ির। আমাদের কাউকে দেখলে মাঝে মাঝে ডেকে বলতো, ও ড্যাবরাচোখে খোকা, আমারে পেঁচোর দোকান থেকে এক পয়সার ইসবগুলের ভুষি এনে দিবি বাবা–
কোদালদেঁতো, খ্যাংরাকাঠি, দেঁতোমাণিক, লগিঠেঙো, পেত্নী চোঁষা, কোমরভাঙা, হুপো—এইভাবে এক একজনকে এক এক নামে ডাকতো বুড়ি।
আমাকে বলতো, হরে ড্যাবরাচোখো, বে করবি আমারে, তোরে আমার ভারি পচন্দ।
গিরিবালাকে আমরা নাম ধরেই ডাকতাম। বলতাম, গিরিবালা, ও গিরিবালা–
ভেতর থেকে বুড়ি বলতো, গিরিবালা মরেচে—
মনি ভাইজান বলতো, শ্মশানে যাবি?
তোর সঙ্গে সমরণে যাবো, নিবি?
বছরে একবার একটা অন্ধ ফকির আসতো, ফেদু। দেশ ফরিদপুর।
তার নাম করে ফেতরার পয়সা ভোলা থাকতো। সে এসে একরাত থেকে যেতো। আমরা তার কাছে নানান রকমের গল্প শুনতাম। সে বলতো ভূত ধরার মন্ত্র জানে। বলতো, বড়শিতে কাঁচা মাছ গেঁথে বাঁশের ছিপ দিয়ে সে নাকি একসময় বাড়ি বাড়ি ভূত ধরেছে।
তার ঝোলায় একটা রাক্ষসের শিং ছিল; তার ভেতরে খুচরো পয়সা ভরে মুখে ছিপি এঁটে রাখতো। একটা কৌটোয় সুগন্ধি কবিরাজি বড়ি ভরা থাকতো; কাশির দোষ থাকায় সে ঐ বড়ি গালে রাখতো। চাইলে একটার বেশি কখনোই দিত না। একবার মনি ভাইজান ফেদুর কৌটোর সব বড়ি বেমালুম সাবাড় করে দিয়েছিল।
ছোলাভাজা, মটরভাজা, কিংবা আখ চিবুতে চিবুতে গিরিবালার দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান ডাকতো, গিরিবালা, ও গিরিবালা–
গিরিবালা গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করতো, কে র্যা?
মনি ভাইজান বলতে, আমি তোর বর, মনি—
ওরে আমর ধম্মোপুত্তুর র্যা?
মটরভাজা এনেছি খাবি?
মন খারাপ থাকলে এক একদিন হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিত। অকারণেও অনেক সময় তাকে এইভাবে পা ছড়িয়ে বসে কপাল ঠুকে বিলাপ করে কাঁদতে দেখা যেতো।
মনি ভাইজান তখন বলবে, দ্যাখো দ্যাখো, কি সুন্দর বুড়ির গানের গলা!
মর আবাগীর ব্যাটা, মর! তোর ওলাউঠো হোক, জিব খসে পড়ক–গিরিবালা সুর করে এইসব জুড়লে মনি ভাইজান পকেট থেকে ভেলিগুড়ের প্যাকেট বের করে তার হাতে দিত। মনি ভাইজানের অভ্যেস ছিল চাল-তেল-চিনি সকলের অগোচরে বাড়ি থেকে সরানো। গিরিবালা খুব খুশি হলে মনি ভাইজানের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, অ সোনা, অ মাণিক, রাজচক্কোত্তি হ বাপ, রাজকপালে হ বাপ, আমার মতো ফুটোকপালে যেন কেউ না হয়–
তিনকুলে কেউ ছিল না বুড়ির। একটা পলস্তারা খসা দোতলা বাড়ির কোণের ঘর আগলে কিভাবে যে পড়ে থাকতো। উঠোনময় ছিল জঙ্গল। উঠোনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে একটা কাঁঠাল গাছ, সেখানে আস্তানা ছিল তক্ষকের। মাঝে মাঝে তক্ষকটা যখন ডেকে উঠতো, তখন গোটা উঠোন, উঠোন ঘেঁষা বাড়িটা, কেমন যেন হা হা করে উঠতো সবকিছু। উঠোনের জঙ্গলের ভেতর রাশি রাশি তারার মতো ফুটে থাকতো করমচা। সিড়ির গা ছুঁয়ে ছিল গাঁদা, দোপাটি আর সন্ধ্যামণির ঝোপ; আপনা আপনিই হতো এসব।
গিরিবালা উঠোনের জঙ্গলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মাঝে মাঝে মনি ভাইজানকে বলতো, রাতের বেলায় কারা যেন হোথায় আসে, ফিসফাস করে কথা কয়–
তোর ঘাড় মটকাবে একদিন, দেখিস?
বুড়ি বলতো, ওরা সব আমার আপনজন, একদিন তো এরা সব এ বাড়িতেই ছিল। বাড়ির মায়া, সে কি কেউ কখনো ত্যাগ করতে পারে র্যা! বড় মায়া! দ্যাখনা, দাঁতে দড়ি দিয়ে কেমন পড়ে রইলুম, সে তো ঐ মায়ার জন্যেই–
কলুদের মেয়েরা গিরিবালার বাড়ির সবগুলো দেয়ালে খুঁটে দিয়ে রাখতো। কার বারণ কে শোনে। একে ছানিপড়া চোখ, তায় হাড় জিরজিরে; এমন কেউ নেই যে তার হয়ে দুটো কথা বলে; ঘরের দেয়াল, বারান্দার গা, পাঁচিলের গা, কোথাও বাদ রাখতো না। মনে হতো গোটা বাড়িটাই ঘুঁটের তৈরি।
কলুদের মেয়েরা ছিল ভারি মুখফোঁড়া। চোপার জোর আর গলাবাজিতে তাদের সঙ্গে কেউ পেরে উঠতো না। খুব ছোট থাকতেই মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যেত।
গিরিবালার সঙ্গে প্রায়ই এটা-ওটা নিয়ে ঝগড়া লাগতো ওদের। শেষ পর্যন্ত ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে কপালে করাঘাত শুরু করতো বুড়ি। আর শাপমণ্যি, সে তো আছেই।
আমাদের বাড়িতেই ঘুঁটের দরকার হতো। মনি ভাইজান পয়সা নিজের পকেটে রেখে গিরিবালার দেয়াল থেকে থলে ভরে খুঁটে আনতো। একবার ব্যাপারটা আমি দেখে ফেলি। মনি ভাইজান বলেছিল, বলবি না কাউকে, তোকে ভাগ দেব।
বলার সাহস আমার এমনিতেই ছিল না। তবু নানাভাবে মনি ভাইজান এটা-সেটা ভাগ দিতো। যেদিন পরোটা আর ডিম হতে সকালে, আমি আগেই ডিম খেয়ে ফেলতাম। মনি ভাইজান নিজের ভাগ থেকে আমাকে ধার দিতো। এইভাবে মাছগোশ থেকে শুরু করে সবকিছুই ধার দিতো খাবার সময়। ঝগড়া বাধলেই বলতো, এক্ষুণি সব ফেরত চাই!
অবশ্য আমাকে কখনো শোধ দিতে হয়নি সেসব।
মনি ভাইজান বাক্সের তালা খোলার মন্ত্র জানতো। টিনের ফলা লাগানো তীর ছুঁড়ে গাছ থেকে এঁচোড় পাড়তে পারতো। পুকুরে নেমে পাল্লা দিয়ে টিপু ভাইজানের সঙ্গে সাঁতার কাটতো। ডুবসাঁতারে কারো সাধ্যি ছিল না তার সঙ্গে পেরে ওঠা। পোকাটা একটা ভ্যাবলা–এই ছিল মনি ভাইজানের ধারণা।
মনি ভাইজানের সামনে পড়ে গেলে সবসময় একদিকে কেটে পড়বার তাল করতো পানু। মনি ভাইজান ধরে ফেলে বলতো, এ্যাই, টিনজার মানে কি?
পানু আমতা আমতা করে বলতো, টাঁজা।
টিনচার মানে কি?
টাচা।
প্যাঁপোঁ মানে কি?
পোঁপা–
তখন মনি ভাইজান বলতো, প্যান্ট খোল হারামজাদা, প্যান্ট খোল!
পানু বোতাম খুলে প্যান্টটা ছেড়ে দিতো।
এইবার গুণে গুণে তেরোবার কান ধরে উঠ-বস কর। দম ছাড়বি না, খবরদার!
পানু তাই করতো।
এইরকম অদ্ভুত অদ্ভুত সবখেয়াল ছিল মনি ভাইজানের। ঘোষালদের ছেলে গনু একবার কুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সেই থেকে গনুকে দেখলেই মনি ভাইজান, বলতো, এই, পা টেপ, মুও ছাতুছানা করে দেব তোর।
গনু বসে বসে পা টিপে দিত মনি ভাইজানের। আর মনি ভাইজান গান ধরতো আয় বাদি আয় বেগম হবি, আমি খোয়াব দেখেছি, আমি পেখম মেলেছি, আমি সজ্জা করেছি—
মনি ভাইজানের সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে হাতিপুকুরের পাড়ে যেতাম। মনি ভাইজান বলতো, ঐ কোর্টবাড়িতে যাবার একটা গোপন সুড়ঙ্গ আছে পানির তলায়, সুড়ঙ্গটা বের করতে হবে। ঐ গোলবাড়িটার নিচে কি আছে জানিস পোকা? ওয়ারেন হেস্টিংস-এর গুপ্তধন। বড় হলে তার কথা জানতে পারবি।
মাঝে মাঝে হাতকড়া পরা কয়েদীর পালকে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে নেওয়া হতো। মনি ভাইজান তখন রাস্তার ধার থেকে চেঁচিয়ে বলতো, এই যে জাহামাহাই বাহাবাহারা জিহিলিহিপিহি খাবে?
চোখে পড়লে এইসব ব্যাপার নিয়ে টিপু ভাইজান অভিযোগ তুলতো, আব্বাকে দেখতাম বকাঝকা করতে।
এমন ঘটলে মনি ভাইজান রেগে গিয়ে টিপু ভাইজানকে বলতো, দাঁড়া, তোর লাগালাগি আমি বার করছি। সব্বাইকে বলে দেবো তোর নাম দুদু।
টিপু ভাইজানের ডাক নাম ছিল দুদু। আমাদের নানীমার দেওয়া নাম। এই নাম ধরে অনেকেই তাকে ক্ষ্যাপাতো বলে শেষ পর্যন্ত সেটা বাতিল হয়ে যায়। এই নামটার ব্যাপারে টিপু ভাইজানের ভেতরে ভেতরে বোধহয় একটা ভয় ছিল।
বাধ্য হয়ে মনি ভাইজানের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হতো। বোঝাপড়া মানে, কিছু না কিছু একটা ঘুস দিয়ে তবে রফা।
প্রতি বছরই রথের মেলা থেকে কিছু না কিছু চারা অথবা কলম কেনা হতো। আব্বা আমাদের সকলের ভেতরে সেগুলো ভাগ করে দিত। ভারি সুন্দর ধরেছিল হাতের একটা ফলশা গাছ। পুঁটির কাছ থেকে শিখে আমিও ঐ গাছটার সঙ্গে কথা বলতাম। গাছটা উত্তর দিত না ঠিকই, কিন্তু জন্তুর কানের মতো চওড়া চওড়া পাতা নেড়ে খুব মনোযাগ দিয়ে সব শুনতো।
টিপু ভাইজানের লাগানো গোলাপজাম গাছের মাথায় একদিন সকালে দেখা গেল একটা খোলাপিঠে ঝুলছে। হুলস্থুল কাণ্ড। কিন্তু পিঠেটি আমাদের কারে ভাগ্যে জোটেনি। একটা হনুমান দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে এসে সেটাকে ছিঁড়ে নিয়ে গালে পপারে। এই নিয়ে মনি ভাইজানের একটা গান ছিল, বীর হনুমান লাফ দিয়েছে, বাঁচবে না বাঁচবে না–
কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, গোটা তিনেকপিঠে ধরেছে গাছে। টিপু ভাইজানকে তখন মনি ভাইজান বললে, তোকে ভুল করে গোলাপজাম গাছের চারা মনে করে খোলাপিঠের চারাই দিয়ে দিয়েছে—
টিপু ভাইজান বলেছিল, হতেও পারে, অসম্ভব কিছু নয়!
এই নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছিল। গল্পটা রটে গিয়েছিল মধ্যমগ্রাম কি কাজীপাড়া পর্যন্ত। টিপুর ভাইজানকে দেখলে দুর্গাদাস বাবু ঠাট্টা করে বলতো, ও টিপু পিঠে বেচবে, কতো করে নেবে জোড়া?
কেউবা জিগ্যেস করতো, তোমার পিঠেগাছের ডালের তক্তা কেমন, মজবুত তো? আমার একটা জলচৌকি দরকার—
টিপু ভাইজান এইসব ব্যাপারে খুব বেশি একটা মেলামেশা করতো না কারো সঙ্গে। তার স্বভাবও ছিল কিছুটা মখুচোরাগোছের। ইস্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর ইস্কুল, এই ছিল তার সীমানা।
দুপুরে মা যখন কাঁথা সেলাই করতে বসতো, তখন রানিবুবু তাকে সাহায্য করতো। মা যখন নতুন কথা পাড়তো, তখন আমিও ধারেকাছে থাকতাম। ওটা বোধহয় একটা নেশা ছিল মার। সুঁয়ে সুতো পরিয়ে দেওয়া, ঝোল চেকে নুন হয়েছে কি না বলা, একটা কঞ্চি হাতে করে বসে বসে রোদে দেয়া আচার পাহারা দেওয়া আমার কাজ তো ছিল এইসবই।
পাড় জুড়ে জুড়ে বড় সুন্দর একটা দস্তরখানা তৈরি করেছিল মা। মনি ভাইজান বলতো, ওটা রেখে দাও, আমার বউ আসলে দিও–
মাঝে মাঝে দূর সম্পর্কের এক নানা আসতেন আমাদের বাড়িতে। সবাই বলতো তাঁর মাথায় না-কি ছিট। স্বদেশী আন্দোলনের সময় তিনি ইংরেজের চাকরি ছেড়ে বইয়ের ব্যবসা খুলেছিলেন। তবে সে ব্যবসা তাঁর চলেনি। পরে ইস্কুলে মাস্টারি করতেন।
আমরা যখন তাকে দেখি, তখন তাঁর ঝরঝরে অবস্থা। তাঁর কোটের পকেটে পিপড়ে আর তেলাপোকার বাস ছিল। পকেটে চিনি রাখতেন, মাঝে মাঝে কাঁকড়াবিছেও রাখতেন তিনি পকেটে! পিপড়েগুলো ছিল তাঁর পোষা। কখনো শুনিনি তাঁকে কামড়েছে।
কামড়ায় না?
কেন কামড়াবে? আমি তো ওদের কামড়াইনি! বলতেন, আল্লাতালার জীব, সব এক–
বলতেন, ম-এ মুসলমান, ম-এ মু্র্দফরাস, ম-এ মুচি, সব সমান।
তাঁর কোলে যখন আমাদের রানিবুকুর বিড়াল কুন্তি লাফ মেরে উঠে বসতে, তিনি বলতেন, বড় আদর চায় এরা, এরা আদর ভালোবাসে, সবাই আদর ভালোবাসে—
সিনেমার সন্ধ্যারানী বলতে অজ্ঞান ছিলেন। বলতেন, আমি ওকে বিয়ে করবো, বড় ভালো মেয়ে, বড় ভালো মেয়ে, আহা কি মায়া–
মনি ভাইজান বলতো, নানাভাই, আজ তোমার সেই সন্ধ্যারানী আসবে!
নানা বলতেন, সত্যি?
বিকেলে দেখো, আমি তোমার কথা বলেছি—
বিকেলে একহাত ঘোমটা টেনে দরজার সামনে যে এসে দাঁড়ালো, নানাভাই প্রথমে তাকে চিনতে পারেন নি। কেমন একটু হতভম্ব মতো হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমটায়। অবশ্য পরে ধরতে পেরেছিলেন। ওল্টানো ছাতা ধরে তাড়া করেছিলেন তিনি শাড়ি জড়ানো মনি ভাইজানকে, সেই বড় রাস্তা পর্যন্ত। কতো কি যে হতো! রানিবুবুর ক্লাসের অনেক মেয়েরাই আসতো আমাদের বাড়িতে। ছবি, তরু, রমা, রানু, বেলা, শিবানী, আরো অনেকে। তারা সবাই ছিল চৌধুরীপাড়ার মেয়ে। দক্ষিণ পাড়ার মানুষজনের ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়টা একটু বেশিই ছিল, তারা গা বাঁচিয়ে চলতে সবসময়; তারা আমাদের বলতো মোচোনমান। গলায় গলায় ভাব ছিল ছবিদির সঙ্গে। ছবিদিকেও ক্ষেপাতো মনি ভাইজান। ব-র-ক-ধ-ঝ বললেই ছবিদি চটে যেতো। চটলে মনি ভাইজানকে বলতো, গুপ্তা।
মনি ভাইজান বলতো, গুণ্ডি।
তোর কোনো লাজলজ্জা নেই, মেয়েদের পেছনে লাগিস কেন? এই বলে বকাবকি করতো মা।
ওরা এতো গুজগুজ করে কেন?
তাতে তোর কি, তোর কি দরকার এসব দেখার?
ছবিদি আমাকে খুব ভালোবাসতো। কত জলছবিই যে আমি তার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। একবার বইয়ের মলাটে এঁকে দিয়েছিল একটা রাজহাঁস, সে কি তার গর্বিত ভঙ্গি, আমি সেটা খুব যত্ন করে চারটে ভাঁজ ফেলে তোষকের তলায় রেখে দিয়েছিলাম।
তোষকের তলায় দেশলায়ের বাক্সের ভেতর পুরে টিকটিকির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা তোলাও ছিল একটা খেলা।
ছবিদি মিত্তির বাড়ির মেয়ে। তার বাবা শিবশংকর মিত্তির ছিলেন নামকরা উকিল। রানিবুবুর সঙ্গে সঙ্গে প্রায়ই মিত্তির বাড়িতে যেতাম আমি। ছবিদির ঘরে দেয়ালের তাকে ছোট দুটো কাচের বয়ামে কুঁচ সাজানো থাকতো। একটায় লাল কুঁচ। অপরটায় লালের মাথায় ছোট্ট কালো ফোঁটা। ফাঁক পেয়ে এবার বেশকিছু কুঁচ বের করে নিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে শিশিতে ভরে সেই কুঁচগুলো আমি তোষকের তলায় রেখে দিয়েছিলাম।
ছবিদিদের বাড়ি থেকে আমি আরো একটি বস্তু সংগ্রহ করেছিলাম, সেটি একটি রাক্ষসের ছবি। মোটা একটি বইয়ের ভেতর থেকে রঙিন পাতাটি খাসিয়ে নিয়ে বইটি যথাস্থানে আবার রেখে দিয়েছিলাম। ফেদুর ঝোলার ভেতরের কালো কুচকুচে শিং-এর সঙ্গে ছবির রাক্ষসের শিং-এর বেশ মিল ছিল।
কুঁচের কথা যেভাবেই হোক ছবিদি জেনে গিয়েছিল। একদিন বললে পোকা, তোকে আমি ভালো জানতাম—
কিছু না বুঝে আমি তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
ছবিদি বললে, আমি কি দিতাম না, চাইলেই তো পারতিস, মনিদার পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিস তুইও—
কুঁচভরা ছোট্ট একটা বয়াম দিয়ে দিয়েছিল ছবিদি, মনে আছে।
একদিন সকলে মিলে আমাদের বাগানে চড়ুইভাতি করলে। সেদিন সকলে শখ করে শাড়ি পরেছিল। মনি ভাইজান চোখ মটকে ছবিদিকে বললে, স্টাইল!–-
সে কি কান্না ছবিদির, ছোটলোক। ছোটলোক! রানিবুবু ছুটে গিয়ে তখুক তখনই মাকে বলে দিয়েছিল।
রাখ, তোর বজ্জাতিপনা আমি বার করছি–এই বলে হাতে কাঠের বেলুন নিয়ে মা সেই কোহিতুর আমগাছের গোড়া অবধি মনি ভাইজানকে তাড়া করেছিল।
সেসব কতো কথা। ইচ্ছে করলেও এখন আর সব মনে পড়ে না। কতো কথা, কতো চার ভঁজ-করা ছবি, তেশিরা কাচ, লালকুঁচ, কতো সকাল-দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা! কখনো মনে হয় নি, একদিন সবকিছুরই আবার খোঁজ পড়বে নতুন করে। বড় অবহেলা ছিল পোকার, বড় অবহেলা। অযত্ন আর হেলাফেলায় কতো কিছুই যে সে হারিয়ে ফেলেছে! জিনজার এখন গানের মতো বাজে, হিনজার এখন বুকের ভেতরে নিরবচ্ছিন্ন শব্দ তোলে। হু হু বাতাসের গায়ে নকশা-ভোলা ফুলের মতো অবিরল আকুলতা, পোকার বুকের ভেতরের ফাঁকা দালানকোঠা গুম গুম করে বাজে, পোকা তুই মর, পোকা তুই মর।
যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার জিনজার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শোনে, শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়।