রেখা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললে, কাল অত রাত অব্দি বসে বসে কি করলে?
আবদুল খালেক বললে, এই একটু বইপত্তর নাড়াচাড়া আর কি!
বইপত্তর? আমি তো দেখলাম কি কোথায় সব লিখছিলে তুমি!
ওই আর কি–
বলতে অসুবিধে আছে?
অসুবিধে আবার কিসের—আবদুল খালেক লজ্জিত হয়ে বললে, বলার মতো তেমন কিছু নয়, এই হিজিবিজি!
ঠিক বুঝলাম না, হঠাৎ আবার তোমার ডায়েরি লেখার শখ চাপলো কেন!
আবদুল খালেক শিস টেনে কাপে চুমুক দিয়ে বললে, ধরো কোনো কারণ নেই–
শুধু শুধু সময় নষ্ট–রেখা টেবিল গোছাতে গোছাতে ঠাণ্ডা সাদামাঠা গলায় বললে, কি লাভ এসবে!
কি জানে, তুমিই বোঝ—
রেখা, আজকাল সবকিছুতে তুমি লাভ খোজো। এমন তো আর কোনো কথা নেই যে সবকিছুতেই লাভের গন্ধ থাকতে হবে–
নেই, আবার আছে! আগের চেয়ে অনেক রূঢ় শোনায় রেখার গলা। বললে, তুমি ছাড়া আর সকলেই লাভ-লোকসানে হিসেব কষে চলে। সবাইকে চলতে হয়। চলা উচিত—
আবদুল খালেক আহত হয়ে বললে, আমাদের কি চলছে না?
একে চলা বলে না, কোনোরকমে জোড়াতালি মেরে আমি চালিয়ে নিচ্ছি, তোমার মুখের দিকে চেয়ে, জোর করে। তুমি সংসার পাতোনি, অথচ তার জালে জড়িয়ে পড়েছ, তোমার অবস্থাটা এই। সব বুঝি। তুমি না পারছো গিলতে, না পারছো ওগরাতে। দিনের পর দিন তো দেখছিই, কোনো ব্যাপারেই তোমার কোনো চাড় নেই!
আবদুল খালেক বললে, তুমি কি আমাকে আমার ক্ষমতার বাইরে চলতে বলো, না কেউ তা পারে?
না পারারই-বা আছেটা কি? তোমার জায়গায় আমি হলে তাই করে দেখাতাম। চিরকাল ঠুঁটো হয়ে হাত-পা জড়ো করে বসে থাকবে, আর ক্ষমতার দোহাই পাড়বে, এটাই বা কেমন কথা! তোমার ভেতরে ছিটেফোঁটা উদ্যোগও যদি থাকতো একটু ভেবে নিয়ে রেখা বললে, কেন, তোমাদের টি. মোল্লা কতোদিন থাকলো কলেজে? মাত্র আট মাস! মাস্টারির মুখে ঝাড়ু মেরে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকে তার কি বেশি টাকা রোজগার হচ্ছে না?
আবদুল খালেক বললে, ও চাকরি টি. মোল্লার আরো আগেই পাবার কথা। নিছক বসে থাকবে না বলে ঐ সময়টুকুর জন্যে মাস্টারিতে ঢুকেছিল। ও তো নিজেই বলতো। সকলের সব সোর্স থাকে? টি. মোল্লার আত্মীয়স্বজন কারা তা দেখবে না?
তোমার মতো মানুষদের চিরকাল এইভাবেই নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে হয়, ঘেন্না লাগে আমার–
আবদুল খালেক হেসে ফেললে। কেন হাসল, নিজেই তা জানে না।
বললে, তুমি যাই বলো, আমরা কিন্তু বেশ আছি, বেশ আছি। সস্তায় খাঁটি দুধ, সস্তায় ছানা, জ্যান্ত মাছ, খারাপটা তুমি দেখলে কোথায়। শহরে থেকে দেড়-দুহাজার টাকা কামিয়েও এভাবে চলা যেতো না, বাড়িভাড়া আর গাড়িভাড়াতেই সব উবে যেতো। এখানে তোমার না লাগছে বাড়িভাড়া না গাড়িভাড়া, সিনেমা-থিয়েটার দেখে, দেন-দরবার করে যে বাজে পয়সা ওড়াবে, তারও কোনো পথ নেই। আমি তো বলি আমরা অনেক ভালো আছি।
রেখা কিছু একটা ভাবলো, তারপর বললে, টি. মোল্লার স্বভাবটাই ছিল দাপুটে, তোমার মতো আধমরা নয়–
রাখো তোমার দাপুটে স্বভাব। স্বর্গে বাস করেই মানুষ স্বর্গের জন্যে কাঁদে, নরকে বাস করে অস্থির থাকে নরকের ভয়ে, চকিতে মনে হলো আবদুল খালেকের; মুখে বললে, জি.এম. মামাশ্বশুর থাকলে অমন দাপট আমারও দেখতে–
কেন কাস্টমস-এ তো তোমার আত্মীয়স্বজন খুব একটা কম নেই, তারা কেউ ভুলেও কখনো পোঁছে?
আবদুল খালেক বললে, সবাই সব পারে না—
এটা কি কোনো জীবন! কান্নায় ভেঙে এলো রেখার গলা। বললে, ইচ্ছে করে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ি। এমন একটা জায়গা নেই, যেখানে যাই। এমন একটা মানুষ নেই, যার সঙ্গে দুটো কথা বলি। জঙ্গলের ভেতরে দিনের পর দিন তুমি আমাকে পচিয়ে মারছো, এইভাবে আমাকে দিচ্ছ!
আবদুল খালেক বললে, এতো দূর থেকে কথা বলো কেন, তুমি কিন্তু তোমার মনের শান্তি নিজেই নষ্ট করছে এভাবে। তোমার সঙ্গে আমার কিসের শত্রুতা? শাস্তির কথা ওঠে কেন? আমি লোকটা এতোই খারাপ, এতোই চণ্ডাল!
পরের ঘরে মানুষ জানো বলেই তুমি ভাবো আমি তোমার জ্যান্ত মাছ আর খাটি দুধছানার কাঙাল। খেয়ে-পরেই মানুষ হয়েছি, পেটে পাথর বেঁধে থাকতে হয়নি কখনো–
নিজের জ্বালাতন তুমি নিজেই ঘটাচ্ছ, ইচ্ছে কের গায়ে পড়ে—
আমি জানি কেন তোমার এতো তাচ্ছিল্য, ভালো করেই বুঝি!
আবদুল খালেকের ঘন ঘন ভাবান্তর হয়। এক একবার মনে হয় ভেতরে ভেতরে ধারালো জেদ তাকে মরিয়া করে তুলছে। সে বললে, অতো বুঝ না, অত বুঝতে নেই। তোমার চেয়ে অনেক বিষয়েই আমি কম বুঝি। কম বুঝি বলেই তোমার মতো এমন উটকো ঝক্কিও আমাকে পোহাতে হয় না। আমি যতটুকু, ঠিক ততটুকুই। নিজেকে এর বেশি মনে করতে গেলেই গোলমাল বাধে, বুঝলে!
আমি মানে তুমি। তুমি শুধু একটা কাজই পার, আমাকে ছোট করতে। এতেই তোমার আনন্দ।
আমার সবকিছুতেই আনন্দ, এখন বাজারের থলে দাও, পরে আর কিছু পাওয়া যাবে না–
যেতে হবে না তোমাকে বাজারে!
থলে দাও, থলে দাও–
বললাম তো, দরকার নেই তোমার যাবার, আজ আমি কিছুই করতে পারবো না।
তুমি না পারলে আমি পারবো। দুপুরের পরে শুধু ডিগ্রীর একটা ক্লাস নিলেই চলবে। কেমন পটেটো চটকই আজ দেখো—
চায়ের কাপ নিয়ে উঠোন পেরোয় রেখা, তারপর রান্নাঘর থেকে বলে, বাপও হয়েছ বলিহারি, উঠে থেকে ছেলেটার একবার খোঁজ নিলে না।
উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আবদুল খালেক বললে, কেন ওটার আবার কি হলো?
একগ্লাস দুধ কোনোমতে ওষুধগেলা করে তারপর উধাও–
খুব বেশিদূর যেতে হলো না আবদুল খালেককে। গালে আঙুল পুরে পুকুরে পাকাটির ছিপ ফেলে হাবার মতো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল টুকু।
আবদুল খালেক বললে, এইসব হচ্ছে—
টুকু বললে, আব্দু, তোমার ছংগে দাবো
আবদুল খালেক তার কপালে চুমু খেয়ে বললে, বাজারে অনেক ভিড়। এখন ঘরে যান। আপনার জন্যে পেয়ারা নিয়ে আসবো
তালে লুলতি আনবে!
লুলতি মানে গুলতি; আবদুল খালেক ছেলের গাল টিপে দিয়ে বললে, আনবো, সব আনব। টুকুবাবু, আপনি এবারে ঘরে যান—
দুটি বেলে, তিনটি ট্যাংরা, গোটা কয়েক পুরু পুরু খলশে বৈচা এলং টাটকিনি পিয়ালি আর পনেরো বিশটার মতো পুঁটি, এই নিয়ে একভাগা মাছ। পছন্দমতো জালি কুমড়াও পেল আবদুল খালেক। বেগুন কিনলো আধসের। তারপর টুকুর পেয়ারা আর গুলতি।
মুদিখানার একটা ছোকরার হাতে থলেটা পাঠিয়ে দিয়ে অন্যান্য দিনের মতো নরহরি ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসে আবদুল খালেক। বললে, রাত্রে ঘুমের বড় ব্যাঘাত হয়েছে—
নরহরি ডাক্তার হেঁকে চায়ের কথা বলে সিগ্রেটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। বললে, আমি নিজেও দুরাত ভালোমতো ঘুমুতে পারিনি। গরমটা কি! শালার বসে সুখ নেই, খেয়ে সুখ নেই, শুয়ে সুখ নেই। জল বেড়েছে কি রকম এ-দুদিনে দেখেছেন?
সেই রকমই যেন মনে হলো সকালে, ঘাটের তক্তায় পা রাখলে ডুবে যায়।
নরহরি ডাক্তার বললে, ছেলেকে দিয়ে এই একটু আগে চালতা পাঠিয়ে দিয়েছি আপনাদের বাড়িতে, দুপুরে টক খাবেন। আমার তো দুপুরে টক না হলে চলেই না।
বেশ আছেন আপনি ডাক্তারবাবু!
ঠিকই বলেছেন, বেশ আছি।
দুজন রুগী ঢোকায় নরহরি ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের নিয়ে। জহর মাঝি আর বাপের হাতধরা পাঁচ-ছবছরের একটি বাচ্চা। জহর মাঝির বগলে থার্মোমিটার পুরে ছেলেটাকে নাড়াচাড়া করতে থাকে ডাক্তার।
বললে, শরীরে মাংস লাগবে কোত্থেকে, একেবারে ফ্যাকাসে মেরে গেছে, পেট বোঝাই শুধু কেঁচো।
ছেলেটির বাপের দিকে মুখ তুলে নরহরি ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, অহনে কই থাকো?
মধ্যপারা।
বগলেই। বহুৎ গরম! তাপডি গিয়া লউক। কি বুঝলা?
অহনে লয়া যাইতে কন তো?
হ, তাতডি ধরলেই ভান কইরা লয়া আইবা।
জহর মাঝির বগল থেকে থার্মোমিটার বের করে নরহরি ডাক্তার বললে, দুই! বরপোলার খবর কি?
জহর জ্বরের ধকল সামলাতে সামলাতে হাঁপধরা গলায় বললে, অহনে ঢাহায় ফল বেচনের কামে লাগছে।
গ্যারেজের কামডি ছারান দিছে ক্যান?
হের আমি কি কমু।
ট্যাকাউকা দেয় তোমারে?
গেল মাসে যেমুন কিছু পাইছিলো—
পায়খানা হয়?
কষা—
জিব্বা দেহি।
জিভ দেখতে দেখতে নরহরি ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, কই দোকান দিছে?
হুনতাছি যেমুন হোসেনি দা–
বাধা দিয়ে নরহরি ডাক্তার বললে, উহু, জিব্বা–শেষে বললে, শিশি আনছো?–
আনি নাই।
মিকচার লইবা কিসে?
আপনেরথে দিয়া দ্যান, ফিরায়া দিয়া যামু—
দিছ আর! লগে পয়সা আনছো কতো, সুই নেওন লাগবো তো–
আনছি কিছু। পয়সার লাইগা চিন্তা কইরেন না, আমারে চাঙ্গা কইরা দ্যান। খারইতে পারি না, মাতা ঝিক মাইরা ওডে!
গাঞ্জাউঞ্জা চারান দিছো তো? দিনে তিন দাগ। কাগজের দাগ খায় ফালায়ো না যেমুন। কাউলকা আয়া ফের সুই লয়া যাইবা, দুদরুটি, নো তালিবালি!
রুগী বিদায় দিয়ে নরহরি ডাক্তার সিগ্রেটের প্যাকেট সামনে ধরে বললে, কি ব্যাপার, চুপচাপ কেন, সিগ্রেট জ্বালান, সিগ্রেট জ্বালান!
হাঁ, কিছু যেন বলছিলেন,বেশ আছি, এই তো? তা বেশ আছি—
স্বচক্ষেই তো সব দেখছি!
মুশকিলটা ঠিক এখানেই। আরে সাহেব দেখার আড়ালেও কিছু আছে। গতরাতে কখন ঘরে ফিরেছি তা জানেন? রাত দুটোয়। ডাইনী দিয়ে ঐসব করালে শেষ পর্যন্ত যা হয়! অবস্থা যখন মরমর, আর কোনো আশা নেই, তখন ছোটো শালা ডাক্তারের কাছে, কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। ইশ, বিয়ের দিন-তারিখ সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল মেয়েটার। ক্রিমিন্যাল এ্যাবরশন এখন একটা ডালভাতের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে!
এইভাবে বোধহয় অনেক মরে?
মরে আবার না! সিগ্রেটে লম্বা টান মেরে নরহরি ডাক্তার বললে, সিগ্রেট টেনেও আর কোনো সুখ নেই, যে শালার ঘাস খাচ্ছি। শুনেছেন কিছু? রহমান ব্যাপারীর শালার খুনি নাকি পরশু রাতে বাহিরঘাটায় ধরা পড়েছে।
শুনিনি—
আরে সাহেব আপনাদের কলেজের অতবড় ডোনার রহমান ব্যাপারী, আর খবরই রাখেন না! আরে সেই যে হেকমত, মনে নেই, আপনাদের কলেজের ইউকশনে ব্যালট বাক্স যে ছিনতাই করলে সেবার! ব্যাপারটা নার্কি প্রেম সংক্রান্ত।
আপনি দেখছি সব খবরই রাখেন–
কানে আসে, শুনি। হতভাগাটার মেদেনীমণ্ডলের দাদন মিজির বৌয়ের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক ছিল। মিজিই খারাবিটা ঘটিয়েছে।
কি হবে এখন মিজির?
কি আবার হবে, ঘোড়ার ছাই। নতুন আর দুখানা লঞ্চ চালু করেছে দাদন মিজি,–এম.এল. মীরকাদিম আর এম, এল. ভোগদা, সব মিলে হলে গিয়ে পাঁচটা। গায়ের গন্ধ মোছার জন্যে হয়তো হাতের ময়লা কিছু ঝাড়তে হবে, এর বেশি আর কি!
মিজি এক কাঁড়ি টাকা মাদ্রাসার পেছনে ঢাললো, অথচ কলেজের জন্যে এক কানাকড়িও খসালো না, বেশ কঠিন লোকটাকে বোঝা; কম ধরাধরি হয়েছে! অন্তত দুএক হাজার হলেও তার দেওয়া উচিত ছিল—।
রোগটাই এখনো ধরতে পারেননি দেখছি–নরহরি ডাক্তার হেসে বললে, রহমান ব্যাপারীর নামগন্ধ আছে যেখানে সেখানে দাদন মিজি নেই। এ হচ্ছে নতুন মালকড়িওলাদের নিজেদের ভেতরের খালবিলের নৌকো বাইচ, এ রোগের কোনো দাওয়াই নেই, কি বুঝলেন?
কথায় কথায় বেলা চড়লো অনেকখানি। আবদুল খালেকের যখন ওঠার খেয়াল হলো তখন বাজার ফাঁকা হয়ে গেছে। ফেরার পথে তার মনে হলো এতোটা ভালো নয়, সবকিছুতেই কমবেশি একট হিসেব করে চলা উচিত; মাঝে মাঝে এই যে রেখা তাকে ঝাড়াই করে তা একেবারে অকারণে নয়। সে জানে ঘরে ফিরে এখন তাকে কোন্ ধরনের কথা শুনতে হবে; ছেড়ে কথা বলবে না রেখা।