অষ্টম পরিচ্ছেদ
মামাবাড়িতে আসিবার আগে কাজলের মনে দ্বিধার ভাব ছিল। কিন্তু কয়েকমাস কাটিবার পর সে অনুভব করিল, এ বাড়ির সহিত তাহার মানসিকতা বেশ খাপ খাইয়াছে। মামাবাড়িতে সবসময়ই একটা সাহিত্য ও শিল্পের হাওয়া বহিতেছে। সেটাই তাহাকে ক্রমশ সুস্থ করিয়া তুলিল। প্রতাপ একটি গ্রন্থকীট। তাহার সহিত কাজলের চমৎকার সময় কাটে। দিদিমা তাহাকে খুব ভালোবাসেন, তার সম্বন্ধে কাজলের অস্বস্তি দু’দিনেই চলিয়া গিয়াছিল। সর্বাপেক্ষা বেশি জমিয়াছে কিন্তু দাদুর সঙ্গে।
সুরপতি কাজলকে ছাড়া একটুও থাকিতে পারেন না। কাজলের জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখেন নাই, নিজেই পড়ান। ধাৰ্মিক মানুষ তিনি, কাজলের চারিত্রিক শিক্ষার জন্য তাহাকে শিষ্য বানাইয়া লইলেন। সন্ধ্যায় ঘরের বাতি নিভাইয়া দাদুর পাশে বসিয়া কাজলকে ধ্যান করিতে হয়। সুরপতি তাহাকে বলিয়াছেন। মনঃসংযোগ ব্যতীত জীবনে সিদ্ধি আসে না, সন্ধ্যায় কাজল তাই মনঃসংযোগ অভ্যাস করে। দুইগাছা রুদ্রাক্ষের মালা কেনা হইয়াছে–তাহার একটা সুরপতি নিজের গলায় দেন, অন্যটা ধ্যান করিবার সময় কাজল পরে।
এই তিন-চার বৎসরে মালতীনগরে আরও অনেক উন্নতি হইয়াছে। নতুন দোকানপাট বসিয়াছে, রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড বাড়িয়াছে, বাড়িঘর অনেক তৈয়ারী হইয়াছে। কলিকাতা খুব দূরে নহে, ব্যবসাপত্রের বেশ প্রসার হইতেছে।
মালতীনগরের গোলমাল ছাড়িয়া মাইল দুয়েক গেলে কয়েকটি সুন্দর গ্রাম আছে। পিচের রাস্তা ছাড়িয়া মাঠের মধ্যে দিয়া হাঁটিয়া কিছুটা দূরে চমৎকার বাঁশবন, পুকুর, কলসী-কাঁখে গ্ৰাম্যবধূ দেখা যায়। ধুলাবালি মানুষজনে বিবক্ত হইয়া কাজল মাঝে মাঝে হাঁটিয়া গ্রামের দিকে যায়। নিশ্চিন্দিপুরে যাওয়া হইয়া ওঠে না, এই ভাবেই কাজল প্রকৃতির সহিত সম্পর্ক বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। এক ছুটির দিনে কাজল দুপুরে বসিয়া পড়িতেছে, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়িয়া উঠিল। দরজা খুলিয়া দেখে গোফদাড়িওয়ালা এক বলিষ্ঠদেহ লোক দাঁড়াইযা, কাঁধে কাপড়ের ঝুলি, পায়ে সস্তা দামের চটি। কাজল প্ৰথমে চিনিতে পারে নাই। তারপরে সে অবাক হইয়া বলিল–মামা?
প্ৰণব জেলে গিয়াছিল। পুলিশ সন্দেহ করিয়াছিল, বিপ্লবীদের সহিত তাহার যোগাযোগ আছে। তিন বৎসর আগে সে গ্রেপ্তার হয়। জেলে বসিয়াই সে অপুর মৃত্যু সংবাদ খবরের কাগজে পড়িয়াছে। সব কাগজেই সাহিত্যিক অপূর্বকুমার রায়ের মৃত্যুসংবাদ ছাপা হইয়াছিল। নিশ্চিন্দিপুর গিয়া রানির নিকট হইতে ঠিকানা সংগ্ৰহ করিয়া প্রণব এখানে আসিয়াছে।
দৌড়াইয়া কাজল হৈমন্তীকে ডাকিয়া আনিল। হৈমন্তী প্রণবকে কখনও দেখে নাই। ঝুলিটা নামাইয়া প্রণব বসিতে বসিতে বলিল–এ পৃথিবীতে অপূর্ব আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু ছিল। তা ছাড়া আরও একটা পরিচয় আমার আছে–আমি কাজলের মামা।
বিকালে জলখাবার খাইয়া প্ৰণব কাজলের বইপত্ৰ দেখিতেছিল। কাজলের আলমারিতে বেশ কিছু বই জমিয়াছে। কিছু অপু কিনিয়া দিয়াছিল, কিছু মালতীনগরে আসিবার পর কাজল প্রতাপকে দিয়া কিনাইয়াছে। কাজল এখন বেশ ইংরাজি পড়িতে পারে।
বইগুলি নাড়িতে নাড়িতে প্রণব বলিল–অনেক পড়ে ফেলেছিস খোকা। তুই আর সেই বাচ্চা খোকন নেই।
সত্যিই, অবাক হইয়াছিল সে। বয়সের তুলনায় কাজল বেশি পড়াশুনা করিতেছে। তার বয়সী অন্য ছেলে এসব বইয়ের নামও শোনে নাই।
–তুই বাপের ধারা পেযেছিস। বাব্বাঃ, অপু তো কলেজ লাইব্রেরি প্রায় শেষ করে ফেলেছিল।
–আমিও রিপন কলেজে পড়ব পুলুমামা!
প্রণব নিজের ঘন দাড়িতে একবার আঙুল চালাইল।
–বেশ তো, তাতে আপত্তি কী? স্কুলে ভালো রেজাল্ট কর—
–আজকে রাত্তিরে তোমাদের কলেজের গল্প বলবে?
প্ৰণব হাসিল।
–আমাকে আজকেই চলে যেতে হবে খোকন।
কাজলের মুখ শুকনো হইয়া গেল।
–সে কথা বললে শুনচি নে, তোমাকে থাকতেই হবে ক’দিন।
–আজকের রাতটা না হয় থাকবো, কিন্তু বেশি তো থাকবার উপায় নেই খোকা।
–কেন?
প্রণব কাপড়ের ঝুলিটা দেখাইয়া বলিল–কারণ এইটে।
–কী আছে ওতে?
–ওতে একটা যাদুকাঠি আছে, মানুষের দুঃখ দূর করার।
কাজল আবছাভাবে ব্যাপারটা বুঝিল।–এটা নিয়ে কী কববে তুমি?
–আমি কিছু কবব না। ঝোলোটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে আমোর ছুটি।
সন্ধ্যাবেলা অনেক গল্পগুজব হইল। প্রতাপ, হৈমন্তী, কাজল, সরযূ সবাই বসিয়া প্ৰণবের গল্প শুনিল। জেলের নৃশংসতার কথা শুনিয়া সরযূ আর হৈমন্তী প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল। কাজল প্ৰণবের কাছে ঘেষিয়া বসিল।
–পুলুমামা, বলেছিলে তোমাদের কলেজ-জীবনের গল্প করবে?
-সে কি একদিনে হয় রে? কী মজাই না করতাম আমরা! তোর বাবা আর আমি ছিলাম দুটো পাগল। তবে আমার চেয়ে ও একটু উঁচু ধরনের পাগল ছিল। একবার তো মাঝরাতে আমাদের পুলিশে তাড়া করেছিল—
–কেন?
—পার্কে বসে মাতালের অভিনয় করছিলুম থিয়েটার দেখে বেরিয়ে। তাড়া করতেই দুজনে রেলিং টপকে দৌড়।
সরযূ বলিল–আপনি মানুষটিও দেখছি খুব শান্তশিষ্ট নন।
প্ৰণব কৌতুক বোধ করিয়া দাড়িতে ঘন ঘন আঙুল চালাইল, তারপর বলিল–শান্ত যে নই তা ভারত সরকারও জানে। দৌরাত্ম্য করার অভ্যোস একেবারে রক্তের ভেতরে মিশে গেছে।
পরের দিন সকালে প্রণব বিদায় লইল। যাইবার সময় হৈমন্তীকে বলিল–আপনাকে সান্ত্বনা দেবো না। অপু আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিল। সে চলে যাওয়ায় নিজেই অনুভব করছি, এর সান্ত্বনা হয় না। তবে আপনি তার সঙ্গে ছিলেন, ভরসা করি শোক সহ্য করবার ক্ষমতা আপনি তার কাছ থেকে পেয়েছেন।
কথা থামাইয়া বার দুই দাড়িতে হাত বুলাইয়া পরে কাজলকে দেখাইয়া বলিল–ওকে দেখবেন। ওর চোখে ওর বাবার আগুন রয়েছে।
রাত্রে কাজল ছাদে একটা মাদুর পাতিয়া শোয়, যতক্ষণ না নিচে হইতে খাওয়ার ডাক আসে। আকাশে মেঘ না থাকিলে ছায়াপথটা দেখা যায়–আকাশের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিরাট সাদা নদীর মতো দুই দিগন্তকে যুক্ত করিতেছে। বাবাব জ্যোতির্বিজ্ঞানের বইগুলি সে প্রায়ই নাড়াচাড়া করিয়া দেখে, তাই আকাশের আকর্ষণ তার কাছে অসীম। নক্ষত্রে গ্রহে নীহারিকায় একটা রহস্য লুকাইয়া আছে, সে ছাদে শুইয়া রহস্যের আমেজটা উপভোগ করে। বই দেখিয়া দেখিয়া সে অনেক রাশি এবং নক্ষত্রমণ্ডলী চিনিয়াছে।
একদিন হঠাৎ তাহার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিয়াছিল। কোথায় অনন্ত শূন্যে ধূমকেতু গ্ৰহ-উপগ্ৰহ বিশাল নীহারিক অনন্তকাল হইতে ভ্ৰমণ করিতেছে, আর কোথায় ক্ষুদ্র এক গ্রহ পৃথিবীর অতিক্ষুদ্র মালতীনগরে সে ছাদে শুইয়া তাহাদের কথা ভাবিতেছে। বিশ্বের বিশালত্বের নিকট তাহার তাৎপর্যহীনতা একেবারে স্পষ্ট হইয়া গেল।
পুরাতন সেই স্কুলেই সে আবার ভর্তি হইয়াছে। পড়াশুনায় সে সাধারণ ছাত্রদের অপেক্ষা অনেক আগাইয়া আছে বলিয়া কয়েকজন শিক্ষক তাহাকে স্নেহ করেন, কিন্তু বেশির ভাগই বিরূপ। পরীক্ষার খাতায় বা হোম টাস্কের খাতায় কাজলের লেখা উত্তর তাহদের নিকট অকালপক্কতা বলিয়া মনে হয়। ছুটির দিনে দুপুরে সবাই ঘুমাইয়া পড়লে বাবার বই যে আলমারিতে রাখা আছে, সেটা খুলিয়া বই নামাইয়া সে পড়ে। অনেক বই-এর বিষয়বস্তু বুঝিতে পারে না, কিন্তু সব বই সে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে। শুধুমাত্র বই নাড়াচাড়া করিয়া নীটসে, সোপেনহাওয়ার, ইমানুয়েল কান্ট, প্রভৃতির নাম মুখস্থ হইয়া গিয়াছে।
দুপুরবেলা কোথাও কোনো শব্দ নাই, রাস্তায় গাড়িঘোড়ার চলাচল কম, বাড়িটা যেন ঝিমাইতেছে। সময়টা পড়াশুনা করিবার অত্যন্ত উপযুক্ত। বই খুলিয়া কোলের উপর রাখিয়া পড়িতে পড়িতে মাঝে মাঝে সে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখে। দুপুরবেলার নির্জনতার সহিত তাহার মনটা একাত্ম হইয়া আসে। বিভিন্ন বিষয়ের বই একটা অদ্ভুত জগৎকে হাতের কাছে আনিয়া দেয়-নীহারিকার জগৎ, প্রাণীজগৎ, বিভিন্ন দেশের বিচিত্র উদ্ভিদের জগৎ। ছোটবেলায় বাবা মুখে মুখে তাহাকে বিবর্তনবাদ বোঝাইত, এখন সে আলমারি হইতে বাবার নাম সই করা ‘অরিজিন অব দি স্পিসিজ’ বইটা নামাইয়া পড়িবার চেষ্টা করে। দাঁত ফুটাইতে পারে না, কিন্তু বইখানা খুব আকর্ষণ করে। চারিদিকে যেন শীতকালের শেষবেলার রৌদ্রের মতো একটা সুদূরের হাতছানি-অজানার আহ্বান।
সেদিন আকাশ দেখিয়া মনে হইতেছিল বৃষ্টি নামিবে। কিন্তু কাজলের মনটা সকাল হইতেই কী কারণে বেশ প্রসন্ন ছিল। বৃষ্টির আশঙ্কা উপেক্ষা করিয়া সে বিকালে বেড়াইতে বাহির হইল।
চারিদিকে যেন সন্ধ্যার ছায়া। মেঘ খুব নিচে নামিয়াছে। যে কোন সময়ে বৃষ্টি আসিতে পারে। আকাশে একটাও পাখি নাই, রাস্তায় লোক কম। গাছের ঘন সবুজ পাতা নীল মেঘের পটভূমিতে ভারি সুন্দর দেখাইতেছে। গুমগুম করিয়া একবার মেঘ ডাকিয়া উঠিল।
রাস্তার ধারে ঘন ঘাসের মধ্যে অজস্র ঘাসফুল ফুটিয়া আছে। কাজলের ইচ্ছা হইল ঘাসে একবার হাত লাগাইয়া দেখে। রাস্তা ছাড়িয়া নিচু হইয়া সে ঘাসের উপর হাত দিল। সুন্দর কার্পেটের মতো পুরু হইয়া ঘাস জন্মিয়াছে। নরম, সবুজ, সজীব। অসংখ্য ঘাসফুল কালো আকাশে নক্ষত্রের মতো ছড়াইয়া ফুটিয়াছে। কাজল লক্ষ করিয়া দেখিল, প্রত্যেকটি ফুলের তিন পাশে তিনটি করিয়া ঘাসের শীষ বাহির হইয়াছে। কোথাও নিয়মভঙ্গ হয় নাই। একটা করিয়া সাদা ফুল, পাশ দিয়া তিনটি করিয়া ঘাসের শীষ।
একটা ঘাসফুল হাতে করিয়া দাঁড়াইয়া কাজলের মনে হইল—কী অদ্ভুত নিয়ম! কিছুতেই একটু এদিক ওদিক হয় না। এই ছোট সামান্য ফুলটাও সেই নিয়মের শিকল দিয়া আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। নীহারিকাময় বিশ্বের কত ক্ষুদ্র নাগবিক, তবু নিজের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে বিশ্বে একটা স্থান অধিকার করিয়া আছে। কয়েকটা ঘাসফুল হাতে করিয়া লইল কাজল মাকে দেওয়ার জন্য। আর একটু হাঁটিয়া সে বাড়ি ফিরিবে।
কয়েক পা হাঁটিয়াই সে হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। সামনে রেললাইন। ডাইনে সেই ঘাসে ছাওয়া ঢালু জায়গাটা, সেখানে অনেকদিন আগে বাবার সঙ্গে বেড়াইতে আসিয়া মৃত গরু পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিল।
বুকের মধ্যে হঠাৎ কেমন করিয়া উঠিল। ভয় পাইয়াছিল বলিয়াই বাবা সেদিন সস্নেহে হাত ধরিয়া বাড়ি লইয়া গিয়াছিল, আজ কেহ নাই।
একটা ভয়ের ঢেউ তাহার মনকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। হনাহন করিয়া হাঁটিয়া প্ৰায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে হৈমন্তীর কাছে পৌঁছিয়া মুঠ খুলিয়া বলিল–এই দ্যাখো মা, তোমার জন্যে কী এনেছি।