০৭. বুধন সর্দার আর তার ছেলে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বুধন সর্দার আর তার ছেলে সুবর্ণরেখার ধারে কী কাজে আসিয়াছিল। অপুকে বুধন চিনিত, বেড়াইতে বাহির হইয়া অপু বহুদিন তাহার বাড়িতে জল চাহিয়া খাইয়াছে। বুধন দেখিল, ঢালু পাড়ের উপর একখণ্ড পাথরে হেলান দিয়া বাবু ঘুমাইয়া রহিয়াছে। পাশেই চটিজোড়া খোলা রহিয়াছে। পাথরের উপর সরু কঞ্চি।

ছেলেকে দাঁড় করাইয়া বুধনই প্রথম লোক ডাকিয়া আনে।

বাড়িতে শহরের লোক ভাঙিয়া পড়িয়াছে। ডাক্তার বিশ্বনাথ সোমও আসিয়াছেন। তখন আর কিছু করিবার ছিল না। বিশ্বনাথ বিষণ্ণমুখে বলিলেন–রায়মশায়কে এই জন্যই বলেছিলাম পরিশ্রম কম করতে, শুনলেন না সে কথা–

অপুর অনেক ভক্ত আসিয়াছিল। যোগাড় যন্ত্র করিয়া তাহারা দাহ করিবার ব্যবস্থা করিল। অনেক মানুষ, অনেক গোলমাল–তাহার মধ্যে অপু যেন চুপ করিয়া শুইয়া আছে। মুখ দেখিয়া হৈমন্তী স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, শেষ সময়ে অপু বেশি কষ্ট পায় নাই। মুখে একটি তৃপ্তির ভাব মাখানো।

পাড়ার লোকেই হৈমন্তীর বাপের বাড়ি টেলিগ্রাম করিয়াছে। ঘটনাগুলি হৈমন্তীর চোখের সামনে ছায়াবাজির মতো ঘটিয়া যাইতেছিল। সে যেন ইহার সঙ্গে জড়িত নয়, সে শুধু দর্শক মাত্র।

দাহ শেষ করিয়া শেষরাত্রে সবাই ফিরিল। খাটের পায়ার কাছে হৈমন্তী একভাবে বসিয়া আছে, একটুও নড়ে নাই। দিন তাহার চোখের সামনেই রাত্রি হইয়াছিল, আবার রাত্রিও ভোর হইতে চলিল।

সবাই অবাক হইল কাজলকে দেখিয়া। শ্মশানে সে মুখাগ্নি করিয়াছে অত্যন্ত শান্তভাবে। ফিরিয়া সেই যে জানালায় দাঁড়াইল, পরের দিন দুপুর পর্যন্ত আর সেখান হইতে নড়িল না। পাশের বাড়ির ওভারসিয়ারবাবুর স্ত্রী আসিয়া সারারাত হৈমন্তীর কাছে বসিয়া ছিলেন। তিনি পর্যন্ত কাজলের নিস্পৃহতা দেখিয়া অবাক হইলেন।

অকস্মাৎ বজ্ৰপাত হইয়া সব যেন বিনষ্ট করিয়া দিয়াছে। উনানে আগুন নাই, ঠাকুরের কাছে প্ৰদীপ জ্বালা হয় নাই, পরের দিন সন্ধ্যা হইয়া গেল, তখনও কেহ ঘরে আলো জ্বলিল না। ওভারসিয়ারবাবুর স্ত্রী সমস্ত রাত জাগিয়া ক্লান্ত ছিলেন, বিশ্রাম করিতে তিনি বাড়ি চলিয়া গিয়াছেন। আবার সকালে আসিবেন বলিয়াছেন। কিছু ফল ও দুধ আনিয়া তিনি বার বার খাইতে বলিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। ফলের থালা এবং দুধের ঘটি এখনও জলচৌকিটার উপর পড়িয়া আছে-কেহ তাহাতে হাত দেয় নাই।

দুপুরে কাজল অপুর লেখার ঘরে গিয়া বসিল। সমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটা বড়ো খামের ভিতর টেবিলের উপর রাখা। টেবিলের এক কোণে বাবার চুল আঁচড়াইবার যশোরের চিরুনিখানা, তাহাতে বাবার কয়েকটা চুল এখনও জড়াইয়া আছে। ঘাড়ের কাছে ময়লা হইয়া যাওয়া দুইটা জামা দেয়ালের পেরেকে ঝুলিতেছে। এসব দেখিতে দেখিতে কাজল জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইল। বেলা পড়িয়া আসিতেছে। সূৰ্যটা কেমন করুণাহীন-কাহারও দুঃখের সমবাহী নহে, সমস্ত দিন কেবল ঘুরিতেছে। একটা মাকড়সাই দুই দেয়ালের কোণে জাল বুনিতেছে অখণ্ড মনোযোগে।

অনেক রাত্রি পর্যন্ত কাজল টেবিলে এবং হৈমন্তী খাটের পায়ের কাছে বসিয়া রহিল। ঝকঝক শব্দ করিয়া রাঁচি এক্সপ্রেস জামসেদপুবের দিকে রওনা হইয়া গেল। সমস্ত দিন গরমের পর একটু ঠাণ্ডা বাতাস দিতেছে। ঘরে আলো নাই, অন্ধকারের ভিতর সমস্ত বাড়ির শূন্যতাটা হৈমন্তীর কাছে বেশি করিয়া ফুটিল। হঠাৎ পায়ের শব্দ। একটা পরিচিত গলার স্বর শোনা গেল। মানুষটি বারান্দায় উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে ওভারসিয়ারবাবুর গলা–বাঁচি একসপ্রেসেই এলেন বুঝি?

একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলিয়া উঠিল অন্ধকারে। সেই আলোয় কে পথ দেখিয়া আসিতেছে। ঘরের মধ্যে আবার একটা কাঠি জ্বলিতে হৈমন্তী বিরক্তির সহিত মুখ ফিরাইল। কে আসিয়া তাহার মাথায় হাত রাখিয়া বলিল–ভয় নেই মা, আমি এসেছি। বাড়ি অন্ধকার কেন?

সুরপতিবাবু আসিয়াছেন। মালতীনগরে যাইবার আয়োজন হইতে লাগিল। সুরপতিবাবু, হৈমন্তী ও কাজলকে মালতীনগরে লইয়া যাইবেন জিনিসপত্র প্রায় সবই এখানে রাখিয়া যাওয়া হইতেছে, লইয়া যাওয়া খুব কষ্টকর এবং তাহার প্রযোজনও নাই। দুই-চারখানা কাপড় সঙ্গে যাইতেছে মাত্র।

সুরপতিবাবু দিন পাঁচেক মৌপাহাড়ি থাকিলেন। মেয়ে সদ্য শোক পাইয়াছে, একটু সামলাইয়া নিক। বিকালের দিকে শতরঞ্চি পাতিয়া তিনি উঠানে বসেন। অন্যমনস্ক হইয়া চাহিয়া থাকেন কোন একদিকে। কিছুদিন আগে এইখানে বসিয়াই অপুর সহিত গল্প হইয়াছিল। অপু বলিয়াছিল-আত্মার বিনাশ নেই বাবা! আত্মা একটা শক্তি! একটা ভীষণ শক্তি। শক্তির বিনাশ নেই, রূপান্তর আছে মাত্র।

পরলোকে বিশ্বাসী সুরপতিবাবু চারদিকে তাকাইয়া দেখেন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হইতেছে। তাঁহার মনে হয় এই মাটি জল বাতাসের ভিতর, ওই দূরের নক্ষত্রটার ভিতর অপুর আত্মা বুপান্তরিত হইয়া মিশিয়া গিয়াছে।

সারাদিন ধরিয়া মৌপাহাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার তোড়জোড়–অথচ সবাই জানে তোড়জোড় করিবার কিছু নাই। সঙ্গে বেশি জিনিসপত্র যাইতেছে না। মৌপাহাড়ির সহিত এতদিনে যে সম্পর্কটা বন্ধু সুখস্মৃতির সঙ্গে জড়িত হইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে, আসল কষ্ট সেটাকে ছিন্ন করা।।

রাত্রি ঝিমঝিম করিতে থাকে। তখনও আলোকবিন্দুহীন অন্ধকারের ভিতর হৈমন্তী কাজলের পাশে শুইয়া চুপ করিয়া তাকাইয়া থাকে। দূরের থানায় ঘণ্টা বাজিয়া যায়। অনেকক্ষণ পরেও হৈমন্তী বুঝিতে পারে, কাজল জাগিয়া আছে।

পর পর কয়েক রাত জাগিয়া চতুর্থদিন শেষরাত্রে হৈমন্তী ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। ঘুমাইয়া সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখিল। দেখিল সে বড়ো স্টিলের ট্রাঙ্কটা খুলিয়া তার সামনে দাঁড়াইয়া। কোথাও বেড়াইতে যাওয়া হইতেছে। পাশেই বই–এর আলমারি। অপু হাসিয়া বলিতেছে—শুধু জামাকাপড় নিলেই কি চলবে? আমি তো বই ছাড়া মোটে থাকতে পারি নে–

অপু তাহাকে বই আগাইয়া দিতেছে, সে সাজাইয়া লইতেছে ট্রাঙ্কের ভিতর। মন ভরা বেড়াইতে যাইবার আনন্দ। যেন সব ঠিক আছে। যেন কিছুই বদলায় নাই।

পরের দিন ঘুম হইতে উঠিয়া হৈমন্তী সুরপতিবাবুর কাছে গিয়া দাঁড়াইল।

–বাবা!

–কী মা?

–এখান থেকে আর কিছু নয়—শুধু বইগুলো নিয়ে যাবো।

সুরপতি হৈমন্তীর দিকে তাকাইলেন। কোনো প্রশ্ন করিলেন না। কিছুক্ষণ তাকাইয়া মুখ নিচু করিয়া বলিলেন–তাই হবে মা। একটা বইও ফেলে যাবে না।

কয়েকটা প্যাকিং বাক্সে বইগুলি ভর্তি করিয়া সুরপতি মালতীনগরের ঠিকানায় রেলে বুক করিয়া দিলেন।

যাইবার দিন সকালে কাজল একবার সুবর্ণরেখাব ধাবে গেল। বাবা যে পাথরটার উপর বসিয়া লিখিত, সেটা একইভাবে পড়িয়া আছে। কাজলের অবাক লাগিল। যখন কাজলও পৃথিবীতে থাকিবে না, তখনও এটা এইভাবে এখানে পড়িয়া থাকিবে। এই নদী, এই চর, ওই প্রান্তর-সবই একই রকম থাকিবে। আকাশটা নীল থাকিবে। কেবল সে থাকিবে না। যেমন এখন বাবা নাই।

কী-একটা পাখি মাথা সামনে পেছনে নাড়াইতে নাড়াইতে ক্ৰমশ চর বাহিয়া নদীর ভিতরে যাইতেছে। ওপারে বাঁদিকে টিলার মাথায় সূর্যটা যেন আটকা পড়িয়াছে। বাবা এই সমযে অনেকদিন এইখানে বসিয়া লিখিত। সে কতদিন আসিয়া বাবাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছে। একবার তাহার মনে হইল, পিছন ফিরিয়া তাকাইলে বাবা একটা ঝোপের আড়াল হইতে বাহির হইয়া আসিবে।

–অমন লুকিয়ে ছিলে কেন বাবা?

অপু হাসিয়া বলিবে–দেখছিলুম, আমায় না দেখতে পেয়ে তুই ভয় পাস কি না। এমন কতদিন ঘটিয়াছে। বাবা তাহার সহিত ছেলেমানুষের মতো খেলা করিত। লুকোচুরি খেলা শেষ হইলে খাতপত্র গুটাইয়া তাহারা বাড়ির পথ ধরিত।

এবার বাবা বড়ো কঠিন জায়গায় লুকাইয়াছে। আর কেহ তাহাকে পাইতেছে না। আব্ব তাহাকে কোনদিন কেহ খুঁজিয়া বাহির করিতে পরিবে না।

খেলিতে খেলিতে খেলাটা হঠাৎ যেন ভারী রকমের হইয়া গিয়াছে।

হৈমন্তী জানালা খুলিয়া দিতেই প্রথম নজরে পড়িল ইউক্যালিপটাস গাছ দুইটা। সকালেও বাতাস তাহদের পাতায় পাতায় সামান্য কঁপনি ধরাইয়াছে। এই গাছ দুইটার ফাঁক দিয়াই সেদিন রাত্রে চাঁদ ধীরে ধীরে দিগন্তের দিকে নামিতেছিল।

-এবার চল, আমার উপন্যাসটা শেষ হলে হরিদ্বার ঘুরে আসি।

–সত্যি বলছ?

—এমন ভাবে বলছি যেন কোনদিন কোথাও নিয়ে যাইনি। তৈরি হও, এবার বেরিয়ে পড়ব।

কথা রাখে নাই। একই সে লম্বা পাড়ি জমাইয়াছে।

বেলা বাড়িয়া চলিয়াছে। বিকালের গাড়িতে চলিয়া যাইতে হইবে। বাড়িটার, ছোট্ট শহরটার প্রতি ধূলিকণায় তাহার স্মৃতি রহিল। সদর দরজায় তালা ঝুলাইয়া যাইবার পরেও বাড়ির ভিতরে সে থাকিবে একা। তখন হৈমন্তী থাকিবে না। সেই পরিচিত গলা শোনা যাইবে না।

–ভাত নেমেছে? না খাইয়ে আজ মারবার মতলব করেছ নাকি?

দিন কাটিয়া যাইবে, আসবাবপত্রে ধূলা জমিবে। মাস এবং বৎসর আপনি খেয়ালে কাটিতেই থাকিবে। একটা অর্থহীন অস্তিত্ব হৈমন্তীকে সারা জীবন ক্লান্ত করিতে করিতে এক নিরালম্ব অবস্থায় আনিয়া দিবে।

সত্যিই কি অর্থহীন অস্তিত্ব?

একটা কাজ অস্তুত তাহার এখনও রহিয়াছে। অপু শুরু করিয়াছিল, তাহাকে শেষ করিতে হইবে। অনুচ্চারিত প্ৰতিজ্ঞায় সে অপুর কাছে সত্যবদ্ধ।

ঘরের দরজায় শব্দ হইল, কাজল ফিরিয়াছে।

হৈমন্তী বলিল–তোর পড়াশুনোর বইগুলো বেঁধে নিয়েছিস বুড়ো?

দরজায় তালা লাগানো হইয়া গেল। সুরপতি তালাটা ভালো করিয়া টানিয়া দেখিলেন, ঠিকমতো লাগিয়াছে কিনা। ওভারসিয়ারবাবুকে বলা রহিল, এদিকে একটু নজর রাখিবার জন্য।

কাজল বারান্দায় রেলিংয়ে হাত দিয়া গম্ভীর হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহার,বিশ্বাস হইতেছিল না, এখনই এসব ছাড়িয়া অনেকদিনের জন্য-হয়তো বা চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইতে হইবে। যাইতেই হইবে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তাহদের ট্রেন এতক্ষণে জামসেদপুর ছাড়াইয়াছে।

হৈমন্তীর বুকের ভিতর কী একটা আবেগ কোন বাধা না মানিয়া ঠেলিয়া উঠিতেছিল। দরজা বন্ধ না হওয়া অবধি সে বারান্দায় দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি শুইবার ঘরের কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মীর পটাটার দিকে চাহিয়া ছিল। দরজার পাল্লা বন্ধ হইতে দৃশ্যটা আড়াল হইয়া গেল। কাজলের হাত ধরিয়া চলিতে শুরু করিয়াই হৈমন্তীর চোখের বাঁধ ভাঙিল, এতক্ষণে বিচ্ছেদটা যেন সম্পূর্ণ হইল। মৌপাহাড়ির মাটি হইতে পা তুলিয়া লইবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক মিটিয়া যাইবে।

কয়েকটা শুকনো পাতা বারান্দার উপর দিয়া খড়খড় শব্দে সরিয়া গেল। সিড়ি দিয়া উঠানে নামিতে নামিতে কাজল অবাক হইয়া ফিরিয়া তাকাইল। ঠিক মনে হইয়াছিল, কাহার যেন পায়ের শব্দ।

উঁচুনিচু লালমাটির পথে রিকশা চলিল স্টেশনের দিকে। সেখানে তাহদের বিদায় দিবার জন্য অনেকে অপেক্ষা করিয়া আছে, তাহারা ভিড় করিয়া আসিল। এই কয়েক বৎসরে যাহাদের সহিত পরিচয় হইয়াছিল, যাহারা অপুর লেখার ভক্ত–সবাই আসিয়াছিল। এত কলববের মধ্যেও হৈমন্তী বার বার স্টেশনের লাল রাস্তাটার দিকে তাকাইতেছিল। কী একটা যেন ফেলিয়া আসিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *