০১. শীত শেষ হইয়া বসন্তের বাতাস

প্ৰথম পরিচ্ছেদ

শীত শেষ হইয়া বসন্তের বাতাস বহিতে শুরু করিয়াছে। পুরাতন পাতা ঝরিয়া গিয়া গাছে গাছে নতুন কচি পাতার সমারোহ। এই দিনগুলাতে কাজলের বেশিক্ষণ বাড়িতে মন বসে না-বিশেষত বৈকালের দিকে। সূর্য বাশবনের মাথা ছাড়াইয়া একটু নামিলেই রোদটা কেমন রাঙা আর আরামদায়ক হইয়া আসে। রানুপসিদের গাইটা অলস মধ্যাহ্নে জঙ্গলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঘাস লতা খায়। কাজল উত্তরের জানালায় বসিয়া লক্ষ করে। কিছুক্ষণ পরে তাহার আর মন টেকে না-বাহিরে যাইবার জন্য ছটফট করিতে থাকে। বন্য লতাপাতার যে বিশেষ ঘ্রাণটা বাতাসে বহিয়া আসেসেটাই যেন তাহাকে আরও চঞ্চল করিয়া তোলে। গন্ধটার সহিত এই বাহিরে যাইবার ইচ্ছার যে কী সম্পর্ক-তোহা সে বুঝিতে পারে না, কেমন যেন রহস্যময় ভাব হয় মনে।

সন্তৰ্পণে দরজার খিল খুলিতে গেলে অসাবধানে আওয়াজ হয়। রানু আসিয়া বলে-ছেলের বুঝি আবার বেবুনো হচ্ছে?

কাজল একটু অপ্রতিভ হয় বটে, কিন্তু ভয় পায় না। খিলটা হাতে ধরিয়াই দুষ্টামিব হাসি হাসিতে থাকে।

বাহির হইতে দিতে রানুর আপত্তি নাই। শুধু সাবধান করিয়া দেয়—খবরদার, নদীতে নামবি নে, নৌকোয় উঠবি নে কিন্তু-বল, উঠিবি নে?

কাজল প্রতিজ্ঞা করিয়া। তবে বাহিরে যাইবার অনুমতি পায়।

অপু বলিয়া গিয়াছিল—দেখো রানুদি, নদীতে যেন একলা না যায়। চান করবার সময় তুমি সঙ্গে নিয়ে যাবে। ছেলেমানুষ, সাঁতার জানে না-ড়ুবে যেতে পারে। কাজলও রানুপিসির কথার অবাধ্য হয় না-ইছামতীর ঘাটে জেলেদের মাছধরা নৌকাগুলি বাধা থাকে। এপাড়ার ওপাড়ার কিছু ছেলে জমা হইয়া তাহার উপর উঠিয়া খেলা করে। কাজলের পাড়ে বসিয়া দেখা ছাড়া গত্যন্তর নাই। পিসি বারণ করিয়াছে যে।

বাড়ি হইতে বাহির হইয়া কাজল বাবার নতুন কেনা আমবাগানের দিকে হাঁটিতে থাকে। বাগানের প্রান্তে কাহাদের একটা বাঁশঝাড়। সতুকাকা সেদিন বলিতেছিল বাঁশগাছ নাকি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। রাতারাতি নাকি বাঁশের কোঁড় একহাত লম্বা হইতে দেখা গিয়াছে। কথাটা শুনিয়া কাজলের মনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জাগিয়া উঠিল। তাই এ জায়গাকেই সে উপযুক্ত স্থান হিসাবে নির্বাচিত করিয়াছে। বাগানের শেষ গাছটার নিচে একখানি বাঁশেব কোঁড় হইয়াছে। হাত দিয়া মাপিয়া আমগাছের গুড়িতে সমান উচ্চতায় কাজল ঝামা ঘষিয়া একটা দাগ দিয়া রাখে প্রত্যেক দিন। পরের দিন গিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখে গাছ কতখানি বাড়িল। গাছটার কাছে পৌঁছিয়া কাজল ভালো একটা ঝামা খুঁজিতে লাগিল। কাছাকাছি পাওয়া গেল না। কাজলকে ঢুকিতে হইল বাঁশবনের মধ্যে। বাঁশবনের ভিতরকার আগাছা কেহ কোনদিন পরিষ্কার করে না–মালিকের দায় পড়ে নাই। নির্দিষ্ট সময়ের শেষে কয়েক গাড়ি বাঁশ কাটিয়া চালান দিয়া সিন্দুকে পয়সা তুলিলেই তাহার কাজ শেষ। বাঁশ তো বিনা যত্বেই বাড়ে। তাহার জন্য আবার কে–

কাজল একবার থামিতেই পায়ের নিচের শুকনো বাঁশপাতার মচমচ শব্দও থামিয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় লুকানো পাখিটার কুবকুব ডাক স্পষ্ট হইয়া ওঠে। বাঁশপাত হইতে কেমন একটা গন্ধ ওঠে-কাজলের মন-কেমন-করা ভাবটা বাড়িয়া যায়। উপরে-নিচে কোনদিকেই পাখিটাকে দেখা যায় না। রানুপিস ডাকটা চিনাইয়া দিয়া বলিয়াছিল-কুবোপাখি। কাজলের হাসি পাইয়াছিল নামটা শুনিয়া। কেমন নাম দ্যাখো-বলে কিনা। কুবো পাখি–

খোকার মধু-ঝরা হাসি দেখিয়া রানির কী একটা পুরানো কথা মনে পড়ে। এক পলকের জন্য সে অন্যমনস্ক হইয়া যায়। পরমুহূর্তে হাসিয়া বলে-পাগল একটা, এত হাসবার হল কী নাম শুনে?

কাজলের একবার মনে হয় ডাক বাঁদিকের ঝোপ হইতে আসিতেছে। সেদিকেই বনটা বেশি। ঘন। কিছুদিন আগে এই জঙ্গল হইতে কী একটা জন্তু শিকার করিয়া লইয়া গিয়াছে। কাজেই একেবারেই যে গা ছমছম করে না। এমন নহে। কিন্তু পাখিটাকে দেখিবার কৌতূহলও কম নহে। রানুপিসি বলিয়াছে লাল লাল চোখ-সে দেখিবে কেমন লাল চোখ।

কিন্তু বিশেষ সুবিধা করা যায় না। কিছুটা বাঁদিকে হাঁটিলে মনে হয় ডানদিক হইতে আওয়াজ আসিতেছে। ডানদিকে একটু অগ্রসর হইলেই আওয়াজটা পিছনে ঘুরিয়া যায়। আবার খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরিয়া পরে কাজল হাল ছাড়িয়া দেয়।

ভারি তো পাখি-পরে দেখা যাইবে। আরও একটু সন্ধান করিলে কি দেখা হইত না? নিশ্চয় হইত। নেহাত কাজ আছে বলিয়া তাহাকে অন্যত্র যাইতে হইতেছে।

সন্ধ্যায় সতুকাকার দু-একজন বন্ধুবান্ধব এপাড়া-ওপাড়া হইতে আসিয়া জোটে। মোটা কালোমত একজন লোক-গলায্য কঠি, ঠুকিয়া ঠকিয়া খোলটাকে ঠিক সুরে বাঁধে। পবে সবাই মিলিয়া কীর্তন শুরু করে। একদিন কাজলের খুব মজা লাগিয়াছিল। গানের মাঝামাঝি-যেখানে ‘কোথা যাও প্ৰভু নগর ছাড়িয়া’ পদটা আছে সেখানে সবাই এমন হ্যাঁ করিয়া দীর্ঘ টান দিয়াছিল যে কাজল হাসি চাপিতে পারে নাই। এতগুলি বয়স্ক মানুষকে এক সারিতে হ্যাঁ করিয়া বসিয়া থাকিতে দেখিলে কাহার না হাসি পায়?

কীর্তন তাহার খুব ভালো লাগে নাই। গানের যে স্থানটিতে তাহার আমোদ হয়, সে স্থানটিতেই উহারা পরস্পরের গলা জড়াইয়া ধরিয়া অশ্রুবিসর্জন করিতে থাকে। ব্যাপার দেখিয়া প্রথম দিন। সে অবাক হইয়া গিয়াছিল। রানি তাহকে খাওয়াইয়া বিছানায় শোওযইযা আসার পরেও এক একদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত গান হয়। শুনিতে শুনিতে সে ঘুমাইয়া পড়ে। কখনও কখনও বিনা কারণে মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া যায়-দেখে জানালা দিয়া সুন্দর জ্যোৎস্না আসিয়া বিছানায় পড়িয়াছে। বাহিরের আতাগাছটা-ভূতোবোম্বাই আমগাছটা-উঠানটা অপূর্ব জ্যোৎস্নায ভাসিয়া যাইতেছে। ঘুম-ঘুম চোখে সেদিকে তাকাইয়া থাকিলে বেশ লাগে। মনে হয়, কেহ যেন ওই জঙ্গল হইতে উঠানের জ্যোৎস্নায় আসিয়া দাঁড়াইবে। তাহার গায়ে রূপকথার দেশের পরিচ্ছদ, মৃদু চন্দ্রালোকে সে। একবার কাজলের দিকে তাকাইয়া হাসিবে-পরে ইশাবায় ডাকিয়া আনিবে সঙ্গীদের। একদল পরীর দেশের লোকে উঠান ভরিয়া যাইবে। তাহদের ভাষা বোঝা যায় না-কিন্তু তাহা সংগীতময়। উঠানের ধুলায় চাঁদের আলোয় ছায়া সৃষ্টি করিয়া তাহারা লীলায়িত ভঙ্গিতে নৃত্য করবে। মাঝে মাঝে কাজল নিজে অবাক হইয়া যায় তাহার চিন্তার গতি দেখিয়া।

এই সময় বাবার কথা মনে পড়ে খুব। রানুপিসি পাশে ঘুমাইতেছে। পিসির নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাইতেছে। জানালার বাহিরে উঠানে সেই অপার্থিব চাদের আলোর দেশ। এ সময় বাবা থাকিলে বেশ হইত। মনের যে ভোবই হোক না কেন, বাবাকে বুঝাইয়া বলিবার দরকার পড়েনাবাবা নিজেই কেমন সব বুঝিয়া লয়। বাবা হয়তো বলিতে পারিত কেন সে এমন অদ্ভুত চিন্তা করে। শুধু এ সব কারণেই নহে-অন্য কারণও আছে। হ্যাঁ, সে লুকাইবে না-বাবাকে দেখিতে ইচ্ছা করে, বাবার জন্য তাহার মন কেমন করিতেছে।

পরের দিন দুপুরে ললিতমোহন বাড়জ্যের ছেলে। চনু আসিয়া তাহাকে একা-দোক্কা খেলিতে ডাকে। চড়কতলার মাঠে খেলা জমিয়া ওঠে। অবশ্য কাজল খেলায় খুব পটু নহে। তাহার তাকও প্রশংসার অযোগ্য। তিন নম্বর ঘর টিপ করিয়া ঘুটি খুঁড়িলে সেটা পাঁচ নম্বর ঘরে পড়িবেই। অবশ্য প্রত্যেকবারই কাজল এমন ভান করিয়া থাকে যেন সে ওটা পাঁচ নম্বর ঘরেই ফেলিবার চেষ্টা করিতেছিল। খেলা সমাপ্ত হইলে সন্ধ্যার আরছা আঁধারে বাড়ি ফিরিবার সময় কাজল চনুকে প্রশ্নটা করিয়া ফেলে-তুই জানালার পাশে শুয়ে ঘুমোস?

চনু বাক্যালাপের গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া সংক্ষেপে বলে—

–রাত্তিরে জাগিস নে কখনও? চান্দনি রাত্তিরে?

–কত!

–কিছু দেখিস? মানে, ভাবিস কিছু?

–ভাবিব। আবার কী? দাদা গায়ে পা তুলে দেয় বলেই না ঘুম ভাঙে। পা-টা নামিয়ে দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কেন রে?

—মনে হয় না কিছু? এই, কোন অদ্ভুত দেশের কথা, কী গল্পে পড়া কোন লোকের কথা? গল্প বলিতে চনু পড়িয়াছে কথামালার ‘ব্যাঘ্র ও পালিত কুকুর’। তাহা চাঁদনি রাত্রে স্বপ্ন দেখিবার জন্য খুব আদর্শ উপাদান নহে। কাজলটা কি পাগল নাকি? সন্ধ্যাবেলা যত উদ্ভট কথা! না, চন্দ্রালোকিত রাত্রে অগ্রজের তাড়নায় জাগিয়া তাহার বিশেষ কিছু মনে হয় না।

কাজলও যে বিশেষ কিছু দেখিতে পায়, তাহা নহে। কিন্তু একফালি চাঁদের আলো-একটি পাতা খসিয়া পড়া হইতে সে অনেক কিছু কল্পনা করিয়া লইতে পারে। নিজের বৈশিষ্ট্য বুঝিবার বয়স তাহার হয় নাই—তবুও তাহার সঙ্গীদের সহিত একটা চিন্তাগত পার্থক্য সে অনুভব করিতে পারে। যেমন দুৰ্গা পিসির কথা। বাবা ও রানুপিসির কাছে গল্প শুনিয়া সে দুর্গার চেহারা ও স্বভাব কিছুটা কল্পনা করিয়া লইয়াছে, নির্জনে বসিয়া ভাবিতে চেষ্টা করিয়াছে, পিসি সামনে দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছে। এই একটা ফল কুড়াইয়া লইল কোন গাছতলা হইতে, এই আধখানা ভাঙিয়া তাহাকে দিল খাইতে। অপু ও রানি দুর্গার শৈশবের গল্পই করিয়াছে—এখন থাকিলে পিসির যে অনেক বয়স হইত, তাহা কাজলের কখনও মনে হয় নাই। শুধু এইটুকু সে বোঝে, পিসি বাঁচিয়া থাকিলে তাঁহাকে খুব ভালোবাসিত।

নিশ্চিন্দিপুরের সহিত কাজলের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল। অথচ কোথায় ছিল সে এক বৎসর আগে! দাদামশায়ের ভয়ে জুজু হইয়া থাকিতে হইত। প্রকৃত ভালোবাসার স্বাদ সে দাদামশায়ের কাছ হইতে পায় নাই কখনও—তাড়নাই জুটিত বেশি। কেবল দিদিমার কথা মনে পড়ে। বাবা যে তাহাকে মামাবাড়ি হইতে নিজের বাড়িতে লইয়া আসিল-দিদিমা পাইল না। তাহা দেখিতে। দিদিমাই যা-একটু বাবার গল্প করিত। আর কাহারও জন্য মন খারাপ করে না তত। এখানে সে ভালোই আছে। বাবা নাই বটে-কিন্তু বাবা তো আসিবে। পিসি তাহাকে ভালোবাসে। সবার উপর তাহকে আকর্ষণ করে গ্রামের একটা নীরব ভাষা। কেহ সঙ্গে থাকিলে অনেক সময় ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে যখন সে নিজেদের পুরাতন ভিটায় যায়-অন্তত তখন তো নয়ই। সম্পত্তির স্বত্ববোধ তাহার মধ্যে এখনও জন্মে নাই। কিন্তু নিজের পিতৃপুরুষের ভিটায় বসিয়া চিন্তা করার মধ্যে যে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি আছে-তোহা মনকে দোলা দেয়। দুপুরে গিয়া জঙ্গল ঠেলিয়া চুপি চুপি সে উঠানে বসিয়া থাকে। চুপি চুপি বসিবার বিশেষ কারণ আছে। এদিকে বিশেষ লোকজন আসে না-আসিবেই বা কী প্রয়োজনে? একমাত্র আকর্ষণ সজিনাগাছটাও কুড়া হইয়া গিয়াছে, ফল ভালো হয় না তত। কাজেই সেজন্য সতর্ক হইবার প্রয়োজন নাই। আসলে এই জায়গায় উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে না একেবারে। অন্য জায়গা হইলে কাজল বটের ঝুরি ধরিয়া বুলিয়া, এখানে ওখানে লাফাইয়া এক তাণ্ডব বাধাইয়া তুলিত। কিন্তু এ ভিটায় আসিয়া বসিলে কে যেন তাহার ছোট্ট মনটাকে শান্ত করষ্পর্শে স্নিগ্ধ করিয়া দেয়। এখানে তাহার ঠাকুমা রান্না করিয়াছেপিসি পুতুল খেলিয়াছে-বাবা রাজা সাজিয়াছে আরশির সামনে-ঠাকুরদা বসিয়া বালি কাগজে পালা লিখিয়াছে। তাঁহাদের পুণ্যস্মৃতিমণ্ডিত স্থানে কি প্ৰগলভ হওয়া যায়? কেহ তাহাকে বলিয়া দেয় নাই। সে আপনি চুপ হইয়া থাকে। দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া যায়। কেমন একটা অদ্ভুত ছায়া নামিয়া আসিতে থাকে। কাজলের মনে হয়, এই বুঝি কেহ পিছন হইতে কথা বলিয়া উঠিবে। যেন সে আমলটা শেষ হইয়া যায় নাই। সে মিথ্যা বলিবে না-ভূতপেত্নীতে তাহার একটু ভয় আছে। কিন্তু এই সময় যদি তাহার ঠাকুমা কী পিসি আসিয়া তাহার সহিত কথা বলে, তবে সে একটুও ভয় পাইবে না। সে তো তাহদের একান্তু আপনার, কাহারও নাতি-কাহারও ভাইপো। কত আদর করিত সবাই বাঁচিয়া থাকিলে। একটু আগের রাঙা বাসন্তী রোদটার মতোই তাহারা কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিবার সময় গাছের মাথায় সপ্তর্ষিমণ্ডল জ্বলজ্বল করিতে থাকে। বাবা তাহাকে চিনাইয়া দিয়াছিল সব। কালপুরুষ ঝুঁকিয়া থাকে। পশ্চিম দিগন্তের কাছাকাছি। বাবা একবার বলিয়াছিল কালপুরুষের ছোরাটা যে তিনটি নক্ষত্ৰ দিয়া তৈয়ারি-তাহার মধ্যে একটা দেখিতে নক্ষত্র বলিয়া মনে হইলেও আসলে নীহারিকা। সে একটা দূরবীন পাইলে দেখিবার চেষ্টা করিত। যাহা হউক, আপাতত আমবাগানটা তাড়াতাড়ি পার হইয়া যাওয়া ভালো। সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে।

বাড়ি ঢুকিলে রানি বলে-এতক্ষণ ছিলি কোথায়, হ্যারে-ও খোকন? এই রাতবিরেতে কি বাইরে বেড়াতে আছে বাবা? কোথায় ছিলি?

কাজল আরক্ত মুখে আমতা আমতা করিয়া বলে-এই, একটু ওই পুরানো ভিটেয়—

রানি আর প্রশ্ন করে না। তাহার হঠাৎ সমস্ত ব্যাপারটা কেমন সুন্দর লাগিতে থাকে। খোকন চিনিয়া লইয়াছে আপনার সঠিক স্থান। রক্তের ভিতরকার অমোঘ আকর্ষণ তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়াছে পবিত্র তীর্থে। ঐতিহ্যের ধারার গতি ধীর-কিন্তু অনিবাৰ্য। এ ভিটাকে ছাড়িয়া তাহারা কেহ। কোথাও থাকিতে পারে নাই। অপু গিয়াছিল চলিয়া-সেও কি বেশিদিন পারিল দূরে থাকিতে? বংশের সন্তানের হাত ধরিয়া আবার তো সেই ফিরিয়া আসিতেই হইল। কী যেন টান রহিয়া যায়, তাহা রানি ব্যাখ্যা করিতে পারে না। হয়তো এতদিনে মণিকণিকার ঘাট হইতে হরিহরের দেহাবশেষ বাতাসে ভাসিয়া অন্ধ সংস্কারে ফিরিয়া আসিয়াছে নিশ্চিন্দিপুরে। সর্বজয়ার অদৃশ্য উপস্থিতি হয়তো এখনও ভিটার অণুতে অণুতে। গোবৎস যেমন জন্মগ্রহণ করিয়াই ঠিক মাতৃস্তন্য খুঁজিয়া লয়তাহাকে চিনাইয়া দিতে হয় না, কাজলকেও তেমনি কোন নির্দেশ দিতে হয় না। সমস্ত বিশ্বজগৎটা একটা নিয়মের শৃঙ্খলে বাধা পড়িয়া গিয়াছে। কাহাকেও কিছু বলিতে হয় না-করাইয়া দিতে হয় না। সব ঠিক ঠিক চলে।

মাস দুই পরের কথা। গরম বেশ পড়িয়াছে। আজ আহার করিতে একটু বেলা হইয়াছিল। রানি এখনও কাজলকে বাহির হইতে দেয় নাই, বিশ্রামের জন্য নিজের কাছে শোয়াইয়া রাখিয়াছে। কাজল কান্ত হইয়া শুইয়া পা দুইটা পিসির গায়ে তুলিয়া দিয়া গল্প শুনিতেছিল। রানির হইয়াছে বিপদ-যতই গল্প চলুক, কাজলও ঘুমায় না।–তাহারও ঘুম হয় না। এমন সময় বাহির হইতে কে ডাকিল-শ্ৰীমান অমিতাভ রায়, চিঠি আছে-অমিতাভ রায়! কাজল প্রথমটা বিশ্বাস করে নাইনিশ্চয়ই ভুল শুনিয়াছে। তাহাকে চিঠি লিখিবে কে?

দৌড়াইয়া চিঠিটা নিতে গেল সে। বেশ মোটা কাগজে রঙীন খামের চিঠি। রানিও উঠিয়া আসিয়াছিল কাজলের পিছু পিছু। সে বলিল–খোল তো খোকন, কার চিঠি-।

রানির বুক টিবি টিব করিতেছিল। হয়তো তাহারই ঠিক-কতদিন আর ভুলিয়া থাকিতে পারে!

কাজল খাম খুলিয়া চিঠিটা বাহির করিয়া প্ৰথমে যেন চোখে ধোঁয়া দেখিল। কিছু বুঝিতে পারিল না প্রথমটা। খুব চেনা, খুব পরিচিত হস্তাক্ষর, এ নিশ্চয়ই-। পরীক্ষণেই রানির হৃৎস্পন্দনকে দ্রুতায়িত করিয়া মুখ তুলিয়া সে বলিল–বাবা দিয়েচে-বাবার চিঠি পিসি। এই দ্যাখো, বাবার হাতের লেখা।

উত্তেজনায় সে হাঁপাইতেছিল।

একটু পরেই রানি দেখিল, সে আর কাজল দুজনেই অঝোরধারে কাঁদিতেছে।

অপু রানিকে লিখিয়াছে—

‘ফিজি থেকে আফ্রিকায় এসেছি। কখন কোথায় ঘুরছি কিছু ঠিক নেই। ফিজিতে একটা মিশনারী স্কুলে মাস্টারি করলাম কিছুদিন। অ্যাশবার্টন সাহেবই সব ঠিক করে দিয়েছিল। জীবনটাকে যেমন করে দেখতে চেয়েছিলাম-ঠিক তেমনি করেই দেখছি রানুদি। কোথাও ধাক্কা খেলাম না। আশ্চর্য একটা অসীমত্বের সন্ধান পেয়ে গেছি। মনে হয় যেন সময় অফুরন্ত–তা ফুরিয়ে যাবে না কোনদিন। জীবনও তাই বাঁধনহারা, অসীম। মহাকাল এত বিশাল-তার আঁচলটুকুই এত বড়ো যে সেই বিশালতাকে অনুভব করা বহু দূরের কথা, ধারণাটাকে কল্পনায় আনতেই মানুষের যুগযুগান্ত কেটে যাবে। এই জীবনকে-ত্রিকালকে বুকের পাঁজরে পাঁজরে ব্যথায়-বেদনায়, আনন্দে-উল্লাসে, স্বপ্নে-জাগরণে প্রতিক্ষণে অনুভব করছি। আমার আর ভয় কী রানুদি? এখন মনে হচ্ছে, ভক্তি ভাবটা শুধু মেয়েদেরই একচেট নয়-আমার মনেও একটা ভক্তির ভাব জেগে উঠেছে। এ ঠিক ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নয়। বর্তমানের ক্ষুদ্র গণ্ডী পেরিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতে রহস্যের প্রদোষালোকে আলোকিত পরিসরে বিস্তৃত যে মহাজীবন-তার প্রতি ভক্তি। এ যেন কিছুটা নিজেরই প্রতি ভক্তি। নিজেকে, বিশেষ করে নিজের জীবনকে জানিবার অদম্য স্পৃহায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে যেন তা ছাড়িয়ে আরও বেশি কিছু জেনে ফেলেছি। কিন্তু সে কথা প্ৰকাশ করা যায় না। রানুদি-সে বোধ ভাষার অতীত। সে সকল জানার জানা-এক অনির্বাচনীয় পরম পাওয়া।’

কাজলকে লিখিয়াছে—

তোমার জন্যই হয়তো আমাকে ফিরে আসতে হবে। কতদিন ফিজিতে সমুদ্রের তীরে বসে আশ্চর্য সূর্যস্ত দেখতে দেখতে তোমার কথা ভেবেছি। তুমি আমার প্রাণের অংশ দিয়ে তৈরি স্বপ্ন, বাবা। চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে। তুমি পিসির কথা শুনে চলো তো? বেশি রাতে বেরুবে না। নদীর ধারে বেশি যেয়ে না। আমার যে ফার্স্ট বুকটা আছে–সেটা মনোযোগ দিয়ে পড়বে। এখানে অনেক মজার মজার জিনিস দেখছি।-ফিরে তোমাকে গল্প বলবো। তোমাকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে। আমার জন্য তোমার মন খারাপ হয় না?’

বাবার জন্য তাহার মন খারাপ হয় কিনা! এমন দিন কবে গিয়াছে যে, সকাল হইতে রাত্রির মধ্যে সে বাবার কথা ভাবে নাই? বরং বাবাই তো তাহাকে ফেলিয়া বেশ থাকিতে পারিতেছে। বাবা ফিরিয়া আসিলে সে বাঁচে।

দুপুরে অপুর রাখিয়া যাওয়া সুটকেস হইতে ডায়েরিখানা বাহির করিয়া সে পড়িতে বসে। ইহা সে মধ্যে মধ্যেই পড়িয়া থাকে। এক বৎসরের ঠাসবুনোট লেখায় ভর্তি ডায়েরি। পাতা উলটাইতে উলটাইতে এক জায়গায় তাহার দৃষ্টি আটকাইয়া গেল। কাশীর কথা লেখা আছে কয়েক পাতা। বাবা তাহাকে রাখিয়া একবার কাশী গিয়াছিল বটে। কাজল পড়িয়া ফেলে পাতা কয়টা। এ কাহার কথা লেখা! লীলা কে? তাহার মেয়ের সহিত বাবা তাহার বিবাহে ইচ্ছা প্ৰকাশ করিয়াছে যে! বিবাহ! এ তো বড়ো মজার কথা হইল। কলিকাতায় থাকিতে গলির ওপারে একটা বাড়িতে সে বিবাহের উৎসব দেখিয়াছিল। বর মোটরগাড়ি করিয়া মালা-চন্দন পরিয়া আসে। পরে গাড়ি হইতে নামিলে একজন মেয়ে কুলোর উপর কী সব সাজাইয়া তাহাকে বরণ করে ও অন্যান্যরা জোরে হাতপাখা নাড়িয়া বাতাস করিয়া থাকে। ওপাড়ার চনুর দিদিরও তো বিবাহের কথা চলিতেছে। চনু বলিতেছিল, দিদি কালো বলিয়া নাকি পত্রিপক্ষ এক হাজার টাকা পণ চাহিয়াছে। বেশ মজা তো! বিবাহ করিলে সেও টাকা পাইবে তাহা হইলে। কিন্তু বাবা তো লিখিতেছে লীলার (এ কে?) মেয়ে ফরসা। ফরসা মেয়েকে বিবাহ করিলে টাকা দিবে তো? টাকা পাইলে সে সব টাকা বাবাকে দিবে। আচ্ছা, কত বৎসর বয়স হইলে বিবাহ হইয়া থাকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *