অগ্রহায়ণ
অগ্রহায়ণ মাস। মিঠে কড়া শীতের আমেজ প্রকৃতিজুড়ে। ধূসর কুয়াশায় ঢেকে থাকে চারিদিক।
জীবনানন্দ দাশের ভাষায়—
“ধানকাটা হয়ে গেছে কবে যেন–ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম–সাপের খোলস নীড় শীত”
কানায় কানায় ভরা বর্ষার থৈ থৈ বিলের জল শুকিয়ে যায় প্রায়। বিলের গভীরে জমে থাকা জলে গিয়ে জড়ো হতো সব মাছ। কম জলে অল্প পরিশ্রমে ধরা পড়ত প্রচুর মাছ। আস্তে আস্তে জল আরও কমে যায়। একসময় হয়ে যায় দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। সেই মাঠের ওপারে একটু একটু করে সূর্য নামে পাটে। নরম রোদে প্রকৃতিজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে শীতের ধূসর কুয়াশা। শীতের আমেজে মাঠে মাঠে তখনও চলত ধান কাটার উৎসব।
অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি শেষ হয়ে যেত ধানকাটা! মাঠে মাঠে পড়ে থাকত নাড়া, খড়, কুটো। পড়ে থাকত ঝরে যাওয়া ধান। ধানের বাইল। দলবেঁধে সেগুলো কুড়াতে ছেলেমেয়েরা, গ্রামের গরিব মহিলারা। ইঁদুরের গর্ত খুড়ে তারা বের করে আনত ধান।
বড় গেরস্থ বাড়িতে বাইরে থেকে কিষান আসত ধান কাটতে। ধানকাটা, মাড়াই, শুকানো ইত্যাদি শেষে তারা একদিন চলে যেত। ঘটা করে বিদায় করা হতো তাদেরকে। এর নাম ছিল ‘কিষান বিদায়’। তৈরি হতো পিঠে, রান্না হতো পায়েস। ভালো খাবার-দাবার। পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করা হতো। খাওয়া-দাওয়া শেষে গালগপ্পে, কলকোয় তামাক আস্বাদনে রঙ্গরসিকতায় মেতে উঠত তারা। পরদিন বিদায় নিয়ে চলে যেত কিষানরা। আশা ব্যক্ত করে যেত, বেঁচে থাকলে সামনের বছরেও আবার তারা আসবে ধান কাটতে।
নমশূদ্রদের থালায় থালায় এই সময়ে থাকত নতুন আমন ধানের ঝকঝকে সরু চালের ভাত। কাসার গ্লাসে গ্লাসে ফিরত সাঁঝবেলার টলটলে খেজুরের রস। অগ্রহায়ন মাসে খেজুর গাছ ঝোরা শুরু হয়ে যেত। প্রথম ঝোরার কালে গাছে রস হতো পরিমাণে কম। তবে সেই রস হতো হালকা, টলটলে। খেতে সুস্বাদু। এ গাছ ও গাছ বেয়ে রস হতো বড়জোর দুই-চার হাড়ি। গামছায় হেঁকে সেই কাঁচা মিষ্টি রস এক ঠোঁকে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলত বিলের নমশূদ্র ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ।
দিন গড়ানোর সাথে সাথে খেজুর গাছ যত বেশিবার ঝোরা হতো, ততই বাড়ত রসের পরিমাণ। সেই রস জ্বাল দিয়ে বানানো হতো পিঠে, পুলি, পায়েস। হরেক রকমের পিঠে সেসব। নাম ছিল তার নানা রকম। চিতই, সরা, ভেজানো পিঠে, পুলি, ছই, কাটা, পাকানো পিঠে, দোলো, ভাজা পিঠে, দুধ পুলি, চরকা পিঠে ইত্যাদি। এলাকাভেদে একই পিঠের আবার ভিন্ন নামও হতো।
খেজুরের গুড় ছাড়া নবান্নের পিঠা-পায়েস হতো না। খেজুর রস জ্বাল দিয়ে তার ভিতরে দুধ মিশিয়ে ভেজানো হতো পিঠে। সেই পিঠে পরদিন সকালের রোদে পিঠ ঠেকিয়ে তৃপ্তির সাথে খেত বিলের নমশূদ্ররা।
নমশূদ্ররা নিজেদের খেজুর গাছ নিজেরাই ঝুরত। তাই খেজুর গাছ কাটা, ঝোরাও নমশূদ্র সংস্কৃতির সাথে একসময় জড়িয়ে ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে। তারা বলত খেজুরের চাষ।
খেজুর গাছ যারা কাটত তাদেরকে বলা হতো গাছি। এক একজন গাছি প্রতিদিন দুই-আড়াই গণ্ডা থেকে সাত-আট গণ্ডা পর্যন্ত গাছ ঝুরত। দুপুর থেকে শুরু হতো গাছির গাছ কাটা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আগে আগে গাছে গাছে পাতা হয়ে যেত মাটির হাঁড়ি। রাতভর জমত রস সেই হাঁড়িতে। সূর্য ওঠার আগেই গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করত গাছি। নমশূদ্রদের ভাষায় একে বলে রস তোলা।
খেজুর গাছ কাটা, রস তোলার সাথেও মিশে থাকত তাদের জীবন সংগীত। গাছ ঝোরা শুরু হলে নমশূদ্র গ্রামে গ্রামে মাঠে-প্রান্তরে সুর ছড়িয়ে পড়ত গানের
গাছ কাটো ও গাছি ভাই
হৃদকথা তোমায় বলি
শুভযোগে গাছ কেটো
ঠিক রেখো কপালী ॥
গাছে জোয়ার এলে ফেনা ঝরে
সে রস যেন না যায় ভাঁড়ে
সেও কথা তোমায় বলি।।
ওরে লাল চোঙায় গাছ মারা যায়
ভাঁড় যেন হয় না খালি
ও গাছি ঠিক রেখো ভাই দড়াদড়ি
পা ফসকালে ভাঙবে রে মাথার খুলি
হৃদকথা তোমায় বলি।।
নিয়মিত বিরতিতে খেজুর গাছের মাথায় ওঠে ধারালো ছ্যান দিয়ে গাছ পরিষ্কার করত গাছি। নতুন করে চেঁছে নলী বসাত, হাঁড়ি পাতত। ভালো রস সংগ্রহের পরের দিন পাতত ওলা হাঁড়ি। ওলা রস টক আর ঘোলা। সেই রসে ভালো গুড় হতো না। জ্বাল দিয়ে ঘন করে মুড়ি দিয়ে মেখে খেত তারা।
খেজুর গাছ ঝোরার কাজে একইসাথে দুই হাতেরই ব্যবহার থাকে। তাই মোটা দড়ি গাছির কোমর পেঁচিয়ে গাছের সাথে বেঁধে নিতে হতো। গাছির কোমরের পেছনে বাঁধা থাকত বাঁশের তৈরি লম্বা একটা পাত্র। নমশূদ্রদের ভাষায় ঠুঙ্গি। তার ভিতরে থাকত ছ্যান, দা, বাঁশের নলি ইত্যাদি গাছ ঝোরার সরঞ্জাম। গাছ ঝুরতে ঝুরতে আপন মনে গান ধরত সে।
অগ্রহায়ণ মাস নমশূদ্রদের মুলো ষষ্ঠীর মাস। অগ্রহায়ণ মাসের যে কোনো মঙ্গলবার নমশূদ্র বধূরা মুলো ষষ্ঠী পালন করত। এই দিনে মেয়েরা উঠোনের মাঝে আলপনা আঁকত। আলপনার মাঝখানটায় পুঁতে দিত বড়ই গাছের কাঁচা ডাল। তার নিচে ফুল, বিল্বপত্র দিয়ে বসানো হতো ঘট। ঘটের সামনে একজোড়া মুলো রেখে দিত মঙ্গলচণ্ডীর পুজো। এই পুজোর উদ্দেশ্য যেমন বংশের কুল রক্ষা, তেমনি বংশের কারো মুখে কোনো কালি না লাগা। নমশূদ্র রমণীরা তাদের মনোষ্কামনা পূরণের লক্ষ্যে পুজো দিত। পুজো শেষে চলত ব্রত আলাপ–
এক গ্রামে ছিল একটা মেয়ে। সে ছিল মা মঙ্গলচণ্ডীর খুব ভক্ত। সেই মেয়ে একদিন জোড়া কলা খায়ে ফেলাল। বছর না ঘুরতিই তার যমজ ছাওয়াল হল। কিন্তু বিয়ে হয় নাই যে মেয়ের, সে করল সন্তান প্রসব! মেয়ের বাবা-মা লজ্জায় আর মানষির সামনে মুখ দেখাতি পারে না। কী করবি! শেষে, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মেয়েটাকে দিয়ে আসল বনবাসে।
গভীর বনের ধারে এক গাঙের পাশে ছাওয়াল দুডোরে নিয়ে মেয়েটা থাকে। কাশ আর কুশের পাতা দিয়ে এট্টা কুঁড়েঘর বানায়ে তার মদ্যি বাস করতি লাগল। আর মন-প্রাণ ঢালে করতি লাগল মা মঙ্গলচণ্ডীর পুজো।
দেখতি দেখতি মাস যায়, বছর গড়ায়ে যায়। ছাওয়ালরাও বড় হয়ে যায়। ছাওয়াল দুড়ে একদিন গাঙের কূলে বেদি বানায়ে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করতিছে। সেই সময় এক সওদাগর সেই গাঙের পথ ধরে দেশে ফিরে যাচ্ছে বাণিজ্য করে। সাথে তার সাত ডিঙ্গি ধন-সম্পদ। ডিঙ্গি দেখে ছাওয়াল দুড়ে চাচায়ে কয়–ও সওদাগর, আমরা কাঙাল, মা চণ্ডীর পুজো করতিছি। পুজোর জন্যি কিছু দিয়ে যাও।
সওদাগর বলে–না গো, তোমাগের দিবার মতো আমার কিছু নাই। আমার ডিঙ্গি ভরা শুধুই লতাপাতা।
দুই ভাই তখন কয়–তালি লতাপাতাই দিয়ে যাও।
সওদাগর বলল–না। তোমাগের কিছুই দেয়া যাবি নে।
কিছু দূর যাবার পর সওদাগর দ্যাখে, তার ডিঙ্গিতে কোনো ধনরত্ন নেই। সব লতাপাতা হয়ে গেছে। সওদাগরের তো মাথায় হাত। সে তাড়াতাড়ি ডিঙ্গি ঘুরোয়ে সেই দুই ছাওয়ালের কাছে ফিরে আসে। আসে কাঁদে কাঁদে কয়–আমারে তোমরা ক্ষ্যামা করে দাও। আমি তোমাগের কাছে মিথ্যে কথা কইছি। অন্যায় হয়ে গেছে। মাফ করে দ্যাও।
একথা শুনে দুই ভাই কয়–আমরা তো কিছু জানি নে। আমার মা আছে ঘরে। তার কাছে যাও। সে যদি কোনো উপায় করে দিতি পারে।
সওদাগর তাড়াতাড়ি ওদের মার কাছে যায়। খুলে বলে সব কথা।
সব শুনে মা কয়–তুমি মিথ্যে কথা বলিছো। হাতে হাতে তার ফলও পাইছো। আমি আর কী করতি পারি। তয় বাড়ি যায়ে জোড়া মুলো দিয়ে কুল গাছতলায় মা মঙ্গল চণ্ডীর পুজো দ্যাও গে। মার যদি দয়া হয়, তালি ফিরে পাতিউ পারো সবকিছু আবার।
সওদাগর বাড়ি চলে গেল। যায়ে ভক্তিভরে মা চণ্ডীর পুজো দিল। পুজো দেওয়ার পর সওদাগর তার সব ধনরত্ন আবার ফিরে পালো।
সেই থেকে নমশূদ্ররা ভক্তিভরে করে আসছে মুলো ষষ্ঠীর পুজো।
.
অগ্রহায়ণের শেষ প্রায়।
কৃষকের ধান কাটা, মলন মলার কাজও প্রায় শেষ। দিনের কাজ সেরে সন্ধ্যায় যুবকেরা মিলে মাঙনে বের হতো গ্রামে গ্রামে। এক এক রাতে যেত এক এক গ্রামে। গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে গিয়ে সবাই দুই হাতে তালি বাজিয়ে গান গাইত–
।ওরে চখা বলে চখীরে, এবার বড় বান
উঁচো করে বাঁধব বাসা, খুঁটে খাব ধান।
এক খারু দুই খারু নয়, খারু পাঁচ ছয়
ধান দিলি আমাগের, মন তুষ্ট হয়।।
রাজার ব্যাটা জগন্নাথ, ঘোড়ায় চড়ে যায়
ঘোড়ায় চড়ে যাতি যাতি, পাঁচ কাপড়া পায়।
পাঁচ কাপড় পায়ে ব্যাটা, মাথায় বাঁধে শাড়ি
সেই শাড়ি উড়ে গেল, হারান রাজার বাড়ি।।
কী করো, কী করো রাজা! বসে আছি ঘরে
তোমার ছাওয়াল মারছে প্রজা, সভারই ভিতরে।
আর মারে না, আর মারে না, ফুলো ব্যাতের বাড়ি
কাল সকালে দেব তোমার খাজনা আরও কড়ি।
এক বাড়ির কম্ম না ভাই, আরেক বাড়ি যাই
এ বাড়ির মানুষ গরু রাখিবেন ভালোই ॥
আরেক উঠোনে গিয়ে তারা গাইত–
আলামপুরে তামুক রে ভাই, লম্বা লম্বা পাতা
মেয়া মানুষ খাচ্ছে তামুক, কেউ শুনছে কতা।
কুড়ুত কুড়ুত করে যেই দম মারে খুব কষে
কোলের ছাওয়াল খকখকিয়ে মরে বেজায় কাশে।।
মরুক মরুক অমন ছাওয়াল, আরও পাব কত
তামুক পাতা ফুরোয়ে গেলি কার দুয়ারে যাব।
বংশে বাড়ক মানুষ গরু, খ্যাতে ফলুক ধান
পাঁচটি কড়ি সোয়া সের ধান, সবাই করুক দান ॥
আরেক উঠোনে গিয়ে হয়তো ধরত–
চাষা গেল বাঁশ কাটতি, হারায়ে আলো দাও
আসতি আসতি পড়ে পালো, খ্যাঁকশিয়ালের ছাও
মেয়া আসে বলে বাবা, হাতে উডা কী
গোল করিস নে, ভাডোর মেয়া জামাই আনিছি
রাত পোয়ানোর কালে শিয়াল করে হুয়া হুয়া
মেয়া উঠে বলে বাবা, জামাই দেচ্ছে দোয়া ॥
শিয়াল আলো শ্বশুরবাড়ি, খাবার দেব কী
পায়েশ পিঠে খুরমা ভাজা আরও কত কী
এ্যাক বাড়ির কম্ম না ভাই, আরেক বাড়ি যাই
এ বাড়িখেন ভালো থাকুক, দয়াল রে জানাই ॥
কখনও কখনও গৃহস্থ ও মাঙন মাঙাদের মধ্যে পাল্লা বেঁধে যেত। তখন গৃহস্থের পাল্লা কেটে বের হয়ে মাঙনওয়ালাদের ওই উঠোন থেকে অন্য উঠোনে যেতে হতো। গৃহস্থ মাঙনওয়ালাদের আটকাতে গাইত–
বাড়ি ঘিরে ফেললাম জাল
কোন পথে যাবা সোনার চানের পাল
উত্তরে মাঙনওয়ালারা গাইত–
আমাগের মূল গায়েনের হাতে ছুরি
জাল কাটে করি কুচি কুচি
সেই পথে বেরোবি চানের পাল।
গৃহস্থ গাইত–
আমার উঠোন কাটে করলে ফালা
জোড়া লাগাও, নয় বুঝবা জ্বালা
সে জ্বালার কী তেজ!
মাঙনওয়ালা উত্তর দিত–
আনে দ্যা জোকের নাড়ি
উঠোন দ্যাও কাত করায়ে
আমরা সেলাই করি।
গৃহস্থ আবার বলত–
আধ খানি কই মাছ তালগাছ বায়
তোমাদের মূল গায়েনীর
শুকনো গু গায়।
মাঙনওয়ালা উত্তর দিত–
এ চালে কদু ও চালে কদু
আমাগের মূল গায়েনের
গলা ভরা মধু
গৃহস্থ আবার প্রশ্ন রাখত–
এসব সোনার চানের বাপের নাম কী?
মাঙনওয়ালারা জবাব দিত–
আলো চাল ধূপীর গুঁড়ো
আমাগের বাবার নাম আতারাম বুড়ো
এই দিয়ে শেষ হতে পাল্লাপাল্লির গান। মধুরেণ সমাপয়েত। হতো দুই পক্ষেরই জয়। সমান জয়ে কোলাকুলিতে মজে মনের সুখে তারা চলে যেত আরেক বাড়ি।
এভাবে যুবকেরা গ্রামে গ্রামে মাঙন মেঙে নতুন চাল সংগ্রহ করত। সব এক জায়গায় জড়ো করে পিঠে-পায়েসের আয়োজন করত। যেসব গ্রাম থেকে তারা মাঙন করে আসে, সেসব গ্রামের মুরব্বিদের নিমন্ত্রণ করা হতো। এক উঠোনে বসে সবাই মিলে ধুমধাম করে পিঠে-পায়েস খেত। এটাই ছিল নমশূদ্রদের নবান্ন উৎসব।
ফসল চাষের মতো বিলে মাছধরাও ছিল নমশূদ্রদের এক উৎসব। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে বিলে থৈ থৈ করত জল। আশ্বিন থেকে এই জল কমতে শুরু করত। কার্তিক মাসে জল ও বিলে সমতা এলে কৃষকেরা রাই, সরিষা, যব, গম, খেসারি, মসুরি, মটর, মুগ, ছোলা ইত্যাদি চৈতালি ফসল বোনা শেষ করে বিলে মাছধরার উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় থাকত। অগ্রহায়ণের শুরুতেই স্থানীয় হাট-বাজারে কড়া পিটিয়ে ঘোষণা করা হতো কবে কোন বিলে পলোয় মাছধরা হবে। এক এক সপ্তাহে এক এক বিলে। মাছ ধরার সে ছিল বিশাল আনন্দ আয়োজন। দূরের কাছের মিলিয়ে পাঁচশো সাতশো হাজার কৃষক কোমরে নেংটি এঁটে পলো হাতে মাছ ধরতে নামত। সেছিল এক শৃঙ্খলাবদ্ধ মাছধরা। এজন্য কাউকে কোনো অর্থব্যয় করতে হতো না।
পলো হাতে বিলের জলে সবাই সারি বেঁধে লাইন দিয়ে দাঁড়াত। এক লাইনের পর আর এক লাইন। প্রয়োজনে এ রকম চার-পাঁচ লাইনে দাঁড়াত তারা। এই লাইনকে এরা বলত ‘বাহুত’। এক এক বাহুতে দেড়শ, দুইশ জন করে পলো হাতে দাঁড়ায়। বাহুতের মধ্য থেকে একজন জাকোর দেয়–
ধর রে.. ধর..
যে থাকপে পাছে
তারে ধরবে শোল বোয়াল মাছে ॥
এরপর বাহুতের সবাই–ধর রে ধর… বলে পলো ছাবাতে শুরু করত। একটানা ছাবাতে ছাবাতে এগোেত সামনের দিকে বহুদূর পর্যন্ত। ছোট বিল হলে, বিলের এক পাড় থেকে পলো ছাবানো শুরু করে অন্য পাড়ে গিয়ে উঠত। এ সময় বিলের শোল, কাতলা, রুই, বোয়াল লাফালাফি করতে থাকে। আর মনের আনন্দে বাহুতেরা পলো ছাবায়, মাছ ধরে। পলো ছাবানো শেষে প্রত্যেকেই দশ-বিশখানা করে বোয়াল, রুই, কাতলা, শোল নিয়ে ঘরে ফিরত।
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এরা এ বিল সে বিলে মাছ ধরে বেড়াত। মৌসুমের ফসল বোনা শেষে নমশূদ্ররা পলোয় মাছধরার উৎসবে মেতে উঠত। মাছধরা ছিল নমশূদ্রদের কাছে ফসল কাটা উৎসবের মতোই শীতকালীন আর এক অজর খুশির উৎসব। এই উৎসবে সব বয়সের মানুষই শরিক হতো। কিশোর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। কখনও কখনও দুই এক দিনের দূরত্বের বিলেও এরা চলে যেত পলো দিয়ে মাছ ধরতে।
বিলের নমশূদ্ররা বছরের অন্য মাসগুলোর তুলনায় অগ্রহায়ণ মাসে কাটাত অনেকটাই বেশি নিশ্চিন্তে। পুরো মাস তাদের কেটে যেত হাসি-আনন্দে। জীবন হতো খানিকটা হলেও ছন্দময়। ঘরের মাচা বোঝাই থাকত নতুন ধান। হাতে থাকত না তেমন কাজ। সময় কাটাত মাছ ধরে, নৌকা বাইচ দেখে। বাড়িতে আসত আত্মীয়-কুটুম। পিঠা-পায়েসের গন্ধে ম ম করত বাড়ি, উঠোন। দেখতে দেখতে এভাবেই কেটে যেত বিলের নমশূদ্রদের অগ্রহায়ণ মাস।