আশ্বিন
আশ্বিন মাস। শারদীয় দুর্গোৎসবের মাস।
আকাশে ছেঁড়া ঘেঁড়া সাদা মেঘের আনাগোনা। বিলের উপর দিকের মাঠে বাতাসে দোল খায় রাশি রাশি, সাদা সাদা কাশফুল।
গরু-বাছুর দেখাশুনা করা ছাড়া তেমন কোনো মেঠো কাজ থাকত না এই সময়ে নমশূদ্র কৃষকদের। গোটা বিল জুড়ে তখন শুধু ঘন সবুজ আমন ধান। বিলের জলে নাক উঁচু করে সাঁতার কাটছে যেন। গাছের ডগা মোটা হচ্ছে। বাড়ছে গোছায়। ধানের শিষের দুধে একটু একটু করে শক্তভাব আসতে শুরু করেছে।
মাঝেমাঝে নৌকা নিয়ে তারা যায় ধানের খেতে। পরীক্ষা করে দেখে, কচুরিপানা বা ক্ষতিকর অন্য কিছু খেতে জমে আছে কি না। থাকলে সযতনে তারা সেগুলো সরিয়ে খেত পরিষ্কার করে দিত। ধান খেতের ফাঁকে ফাঁকে আইল জুড়ে লম্বা করে পাততো কৈ জাল। কৈ ছাড়াও রয়না, পাবদা, বাইম, টাকি ইত্যাদি মাছ ধরা পড়ত সেই জালে। মাঝিরা এ সময় বিলে এসে ভেসাল জাল পাতত। রাতদিন সেই ভেসাল জালে চলত মাছধরা। ধান খেতের আশপাশ দিয়ে দেখা যেত শোলার খেত। হলুদ ফুলে ছেয়ে থাকত শোলাগাছ। বিয়ের টোপর বানানো হতো পাতলা শোলার কাঠ দিয়ে। আর থাকত ধৈঞ্চা খেত। ধৈঞ্চার পাতা গরুর উপাদেয় খাদ্য। আর গাছ ব্যবহার হতো রান্নার জ্বালানি হিসেবে। জল শুকিয়ে গেলে ধৈঞ্চার সবুজ ডাল-পাতা লাঙল দিয়ে চষে মাটির সাথে মিশিয়ে রাখা হতো। সবুজ সার হিসেবে জমির উর্বরতা বাড়াত ধৈঞ্চা গাছ। ডাঙ্গার দিকে গাছের ছায়ায় বেড়ে উঠত মেটে আলু, মানকচু গাছ। কৈ মাছ রান্না হতো মেটে আলু, মানকচু দিয়ে। সুস্বাদু সেই তরকারি খেত তারা আয়েশ করে।
এসে পড়ত দুর্গাপূজা। দুর্গাপুজা ব্যয়বহুল। দরিদ্র নমশূদ্রদের এই পূজা করার মতো আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। তাই নমশূদ্র কোনো গ্রামে তখন দুর্গাপূজা হতো না। তাই বলে পুজোর আয়োজনে কোনো ঘাটতি থাকত না তাদের। ঘরে চাল বাড়ন্ত। নতুন ধান গোলায় ওঠেনি তখনও। তারপরও ঘরে ঘরে নাড়ু, চিড়ে, মুড়ি, খৈ, মুড়কি বানানোর ধুম পড়ে যেত। পরম যত্নে ঘরদোর ধুয়েমুছে পরিষ্কার ঝকঝকে করে রাখত। গোবর লেপে তকতকে করত উঠোন।
দুর্গোৎসবের ঢেউ বয়ে যেত বামুন-কায়েতপাড়ায়। জমিদার বাড়িতে। নমশূদ্র নারী-পুরুষও কাজে লেগে যেত সেই পুজোর আয়োজনে। জমিদার বাড়িতে নমশুদ্র পুরুষরা কাঠ ফাঁড়ত, গাছ থেকে নারকেল পাড়তো, উনোন কাটত। মেয়েরা ব্যস্ত থাকত ভেতর বাড়িতে। হাঁড়ি-কুড়ি মাজা, বাসন ধোয়া, বাটনা বাটা, টেকি পাড় দেয়া, উঠোন-ঘরদোর পরিষ্কার করা। কাজের অন্ত নেই। এই কাজের সাথে মিশে থাকত তাদের গভীর আন্তরিকতা। জীবিকার প্রয়োজনে এই কাজ নয়। মা আসছেন কৈলাস থেকে মর্ত্যধামে বাপের বাড়িতে। এ কাজ, সেই মায়ের কাজ।
মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গা প্রতিমা তৈরির প্রস্তুতি চলত জোরেশোরে। নিজের গ্রামে প্রতিমা নেই বলে নমশূদ্র ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে যেত দূরের পূজামণ্ডপে। গভীর মনোযোগে বসে বসে দেখত প্রতিমা গড়ানো। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায়। থাকত, কবে শেষ হবে রঙের কাজ, গর্জন তেলের প্রলেপ দেয়া। কবে পড়ানো হবে শাড়ি-গহনা।
নমশূদ্র সংসারে এই সময়ে টানাটানি। ঘরে ধান ওঠার সময় হয়নি তখনও! পাট বিক্রির যেটুকু টাকা হাতে ছিল, তাও নিঃশেষ প্রায়। এতটাই অভাব থাকত যে, নতুন কাপড় কেনা তো দূরের কথা, কাপড় ধোয়ার সাবান, সোডা কেনার পয়সাও ঘরে থাকত না। শুকনো কলাপাতা, বাশের খোসা, মাদার ফুল (শিমুল ফুল) এসব পুড়িয়ে যে ছাই হতো, তাই দিয়ে খার বানাত তারা। টগবগে গরম জলে সেই খার গুলিয়ে তার মধ্যে ময়লা কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে সেদ্ধ করত। সেদ্ধ কাপড় কাঠের পাটায় আছড়ে কেচে পরিষ্কার করত। তারপর ভালো করে জলে ধুয়ে মেলে দিত রোদে শুকানোর পর সেই কাপড় হতে ময়লাহীন ঝরঝরে, কড়মড়ে।
দূর থেকে ভেসে আসত ঢাক আর কাশির বাদ্য। সেই বাজনা প্রাণের মধ্যে নাড়া দিত, হৃদয়ে জাগাত সাড়া। শত অভাব-অনটনের মধ্যেও তাদের আনন্দে ঘাটতি হতো না। আতিথেয়তারও কমতি হতো না। মেয়ে-জামাই, বোন-ভগ্নিপতি বেড়াতে আসত। ধারদেনা করে চলত তাদের যত্নআত্তি। খাবারের মানে কমতি থাকলেও ঘাটতি পূরণ হতো আন্তরিকতা আর সেবা যত্নে।
দূর্গা পুজোয় পরনে নতুন কাপড় না থাকলেও নমশূদ্রদের আনন্দে কমতি হতো না। ভাটা পড়ত না তাদের পুজো দেখে বেড়ানোর উৎসাহে। ধোয়া, কাঁচা কাপড় পরে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত পুজো দেখতে। দূর দূরান্তে চলে যেত হেঁটে হেঁটে। ঘুরত মণ্ডপে মণ্ডপে। যত বেশি প্রতিমা দেখতে পারবে, ততই হবে পুণ্য।
সাজে রঙে মন্দিরগুলো তাদের কাছে মনে হতো স্বপ্নিল এক আলাদা জগৎ। ভক্তিভরে প্রণাম জানাত মাকে। প্রার্থনা করত, ধনে-মানে সংসার ভরে দিও মা। দু-পয়সার জিলিপি কিনত, কিনত মাটির পুতুল। বাচ্চার জন্য কিনত বাঁশির মাথায় লাগানো বেলুন। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে বেলুন ফোলাত বাচ্চারা। তারপর ছেড়ে দিত। বাজতে থাকত বাঁশি। অনাবিল আনন্দে মন ভরত তাদের।
সপ্তমীর রাত থেকে শুরু হতে যাত্রা গানের আসর। নামকরা সব দল নিয়ে আসত বাবুরা। নমশূদ্রদের জন্য এ ছিল এক মহোৎসব। আলো ঝলমল নাট্যমঞ্চে নট-নটীদের উচ্চগ্রামের সংলাপ, বিবেকের গান আর নত্যের ঝংকারে তারা হারিয়ে যেত। বাস্তবতার মাটি ছেড়ে ভেসে বেড়াত স্বপ্নময় কল্পনার জগতে। যেখানে সে নিজেই রাজা, নিজেই রাজকন্যা।
বাবুদের আসন সামনের সারিতে। নমশূদ্রদের স্থান পেছনের দিকে। খড় বিছানো চটের উপর। তাই সই।
যাত্রাপালার আমেজে কেটে যেত অষ্টমী, নবমী। মহানবমীতে লুচি খেত নমশূদ্ররা। কিন্তু পাঁঠার মাংস কেনার সামর্থ্য নেই তাদের। তারা লুচি খেত কুশুরে (আখের) গুড় দিয়ে।
দশমীর দিনে সকাল থেকেই নমশূদ্রদের মনে বাজত বিসর্জনের সুর। সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা। শূন্যতা বুকের ভেতর। বিদায়ের বিষণ্ণতা বিরাজ করত চারিদিকে। দুপুরের পরপর নমশূদ্র বউরা থালায় ধান, দূর্বা, সিঁদুর নিয়ে সার বেঁধে চলত পূজামণ্ডপের দিকে। সেখানে পৌঁছে অপেক্ষা করতে হতো তাদের। বাবুদের বউ-ঝিরা আগে সিঁদুর পরাবে মাকে। তারপর নমশুদ্র বউরা।
মাকে সিঁদুর পরিয়ে মেলা থেকে জিলাপি, দানাদার, বাতাসা কিনে ঘরে ফিরত তারা। গুরুজনদের প্রণাম করে, কোলাকুলি সেরে মিষ্টিমুখ করত সবাই।
দুর্গোৎসব শেষ হবার পঞ্চম দিনে ভরা পূর্ণিমাতে শ্রীশ্রী লক্ষ্মীপুজো। কোজাগরি পূর্ণিমাও বলে এই পূর্ণিমাকে।
লক্ষ্মী পৌরাণিক দেবী। সুখ, সমৃদ্ধি আর সৌভাগ্যের প্রতীক। নমশূদ্রদের ভাষায় ধান-চালের দেবী লক্ষ্মী। হতদরিদ্র নমশূদ্রদের কাছে ধন-সম্পদ মানেই ধান-চাল। কোনোমতে পেটের ভাত জোগাড় হলেই তারা মহাসম্পদশালী মনে করত নিজেদেরকে। কৃতজ্ঞতাভরে বারবার প্রণাম জানাত ধন-সম্পদের দেবী মা লক্ষ্মীকে। কিন্তু ধুমধামের সাথে লক্ষ্মী পুজো করার আর্থিক সামর্থ্য তাদের থাকত না। তবে অন্তরের ভক্তিভাব সমস্তটুকু ঢেলে দিয়ে তারা এই পুজো করত।
পুজোর দিন রমণীরা ঘুম থেকে উঠে ঘর-উঠোন গোবর গোলা দিয়ে লেপে-পুছে পরিষ্কার করত। তারপর স্নান সেরে আতপ চালের পিটুলি গুলে প্রত্যেক উঠোনের মাঝে বড় বৃত্তাকারে আঁকত আলপনা। এই আলপনায় থাকত গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, কৃষক-কৃষাণী, লাঙল-জোয়াল, লতা-পাতা, গাছ-নদী, ঘাস আরও কত কিছু। উঠোন থেকে শুরু করে আলপনা আঁকতে আঁকতে তারা চলে যেত ঘরের ভিতরের মাচা ও ধানের ডোল পর্যন্ত। প্রত্যেক মাচা ও ধানের ডোলে লক্ষ্মী-নারায়ণ জ্ঞানে কৃষাণীরা মধ্যমাঙ্গুলের তিন টানে। দুটো করে মূর্তি আঁকত। এই মূর্তির সামনে সোলার মুকুট ও কপালি বসিয়ে ধান ও ধনের দেব-দেবী লক্ষ্মী-নারায়ণের পুজো দিত। ব্রাহ্মণ এসে গ্রামের প্রথম বাড়ি থেকে পুজো শুরু করত। তারপর একটার পর একটা বাড়ি। একে একে সব বাড়ি। সারারাত ধরে পুজো চলত এভাবেই।
পরদিন সকালে উপোস থেকে মেয়েরা স্নান সেরে তিল-তুলসী হাতে নিয়ে গোল হয়ে এক জায়গায় বসে আলাপ করত লক্ষ্মী পুজোর মাহাত্ম কথা। এরা পড়তে জানে না। তাই সামনে তাদের পাচালীও থাকত না। মুখে মুখে বলে যেত প্রবীণ নারীদের মধ্যে কেউ। অন্যরা শুনত গভীর ভক্তিভরে। দম নিয়ে বলতে শুরু করত প্রবীণা–
এক ছিল রাজা। রাজা ছিল যেমন ভালো, তেমনি সৎ। এই সাধু রাজা ছিল মা লক্ষ্মীর পরম ভক্ত। রাজা ছিল সত্যবাদী। মুখে যা বলত, তাই করত। রাজার এই সততার জন্যি রাজবাড়িতে ছিল সব দেব-দেবীর বসত।
একদিন রাজা ভাবল, গ্রামে একটা হাট বসাবে। তাতে গ্রামের লোকের উপকার হবে। এলাকার সব লোকজনকে ডেকে রাজা ঘোষণা দিল–এই গ্রামে হাট বসবে। তোমরা জিনিসপত্র হাটে নিয়ে এসে বিক্রি করবে। যেগুলো বিক্রি হবে না, সেগুলো নগদ পয়সায় আমি কিনে নেব। তাহলে আর কারো কোনো লোকসান হবে না।
এ শুনে গ্রামের প্রজারা খুব খুশি হল। প্রত্যেক হাটে বেশি বেশি করে মালপত্র নিয়ে যেতে লাগল তারা। কয়েক দিনের মধ্যেই হাট জমে উঠল। হাট শেষে মালপত্র যা পড়ে থাকে, রাজা তার পাইক পেয়াদা দিয়ে কিনে নেয়।
একদিন এক কুমোর আঁকা ভরে রঙ করা পুতুল নিয়ে হাটে এলো। সন্ধ্যা হতে হতে কুমোরের সব পুতুল বিক্রি হয়ে গেল। পড়ে রইল শুধু একটা পুতুল। পাইক-পেয়াদারা গিয়ে রাজাকে বলল–মহারাজ, একটা পুতুল বিক্রি হয়নি। রাজা বলল-যাও। কিনে আনো পুতুলখানা।
সেই পুতুলটা হলো অলক্ষ্মী। পাইক-পেয়াদার পুতুল কিনে নিয়ে এলো। পুতুলটা দেখে রাজা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল–ঠিক আছে তুলে রাখো যত্ন করে। পাইক-পেয়াদারা তাই করল।
রাতে মা লক্ষ্মী স্বপ্নে রাজাকে দেখা দিয়ে বলল–রাজা, তোমার বাড়িতে কতকাল ধরে আছি। আর তো থাকা যায় না।
রাজা বলে–কেন?
মা লক্ষ্মী বলে–তুমি যে বাড়িতে অলক্ষ্মী নিয়ে এলে!
রাজা বলে–তাতে তোমার অসুবিধা কী?
মা লক্ষ্মী বলে–লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মী তো এক গৃহে বাস করতে পারে না।
রাজা বলে–কিন্তু মা, আমার কী দোষ! আমি তো শুধু কথা রক্ষা করেছি।
লক্ষ্মী বলে–অতশত বুঝিনে বাপু। অলক্ষ্মীর সাথে আমার থাকা সম্ভব নয়। আমি চললাম।
মা লক্ষ্মী চলে গেল রাজবাড়ি থেকে।
পরের রাতে স্বয়ং নারায়ণ স্বপ্নে দেখা দেয় রাজাকে। বলে–রাজা মশায় আর তো পারলাম না থাকতে। আজ চলে যাচ্ছি।
রাজা বলে–কেন?
নারায়ণ বলে–যেখানে লক্ষ্মী নাই, সেখানে আমি থাকি কী করে? এই বলে রাজবাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেল নারায়ণ।
পরের রাতে মা সরস্বতী স্বপ্নে রাজাকে দেখা দিয়ে বলে–চললাম, রাজা। রাজা বলে তুমি যাবে কেন?
সরস্বতী বলে–যে বাড়িতে লক্ষ্মী-নারায়ণের ঠাঁই হয় না, সেই বাড়িতে আমি থাকি কী করে!
এইভাবে এক এক করে সব দেবতা রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যায়। রাজা কাউকে না বলতে পারে না। বসে বসে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
সবার শেষে সত্য দেবতা রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলল-দাঁত কামড়ে পড়েছিলাম এতদিন রাজবাড়িতে। আর তো পারি নে। আজ আমিও চললাম।
রাজা তখন বলে তুমি কেন যাও? সত্য দেবতা বলে–সবাই যখন চলে গেল, আমি আর থেকে কী করব? এই বলে সে রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াল।
রাজা সাথে সাথে সত্য দেবতার পা চেপে ধরল। বলল–সবাই গেছে যাক। কিন্তু তুমি তো যেতে পারবে না।
সত্য দেবতা অবাক হয়ে বলে–কেন!
রাজা বলল–কেন, তুমি জানো না? তোমাকে রক্ষা করার জন্যই তো আমি ঘরে অলক্ষ্মী কিনে আনতে বাধ্য হয়েছি। না হলে যে সত্যরক্ষা হতো না। তাহলে তুমি চলে যাও কীভাবে?
সত্য দেবতা চুপ। কোনো উত্তর নাই মুখে।
রাজা বলে–ঘরে ফেরো। তুমিই এখন আমার একমাত্র দেবতা।
সত্য দেবতার বোধের উদয় হয়। ভাবে–রাজাই তো ঠিক। সে তার সত্য রক্ষা করেছে। রাজাকে ছেড়ে চলে যাবার কোনো উপায় তো তার নাই।
সত্য দেবতা তার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে।
কয়েকদিন পর মা লক্ষ্মী রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিল। বলল–আমি ভুল করেছি।
রাজা বলল–ভুল কেন?
মা লক্ষ্মী বলে–সত্য ছাড়া লক্ষ্মী থাকতে পারে না। সত্য যেখানে, লক্ষ্মীও সেখানে। আজ থেকে তাই তোমার ঘরেই আমার ঠাঁই।
তারপর! সব দেব-দেবী তাদের ভুল বুঝতে পারে। একে একে ফিরে আসে রাজবাড়িতে।
আর অলক্ষ্মী! শেষমেশ টিকতে না পেরে সেই একদিন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
সুখে-শান্তিতে সবার বসবাস শুরু হলো আবার।
এই কথা শেষ করে লক্ষ্মীর আড়িতে প্রণাম করে সবাই। উলুধ্বনির মাধ্যমে শেষ হতো লক্ষ্মীর ব্রত আলাপ।
আশ্বিন মাসে শেষ রাতের দিকে শিশির পড়তে শুরু করে। ভোরবেলা ঘাসের ডগায় জমে থাকে সেই শিশির বিন্দু। লাল সূর্য ওঠে পূর্ব দিগন্তে। রোদের ছটা পড়ে মুক্তোর মতো ঝলমল করে ওঠে সেই শিশির বিন্দুগুলো। বেলা বাড়ে, শিশির মিলিয়ে যায়। একটু একটু করে সূর্য উঠে আসে মাথার উপর। গুমোট গরম ছড়িয়ে পড়ে। রাতে আবার শিশির-ঠান্ডা।
ঠান্ডা-গরমে অরক্ষিত নমশুদ্র ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা দিত কাশি আর খুসখুসে জ্বরের প্রকোপ। গ্রামে গ্রামে বেড়ে যেত কবিরাজের আনাগোনা। শিকড়-বাকড় বেটে চিকিৎসা চলত। সাথে নাকশি, কবজ। থাকত জলপড়া, তেলপড়া। তার উপরে শরীর বন্ধ, ঘর বন্ধ। যেমন পয়সা, তেমন চিকিৎসা।
ঘর বন্ধ করতে লাগত সোয়া ছয় আনা। এত পয়সা নমশূদ্রদের কাছে আকাশ স্পর্শ সম। ঘর বন্ধ নেয়া তাই বেশিরভাগের পক্ষেই সম্ভব হতো না। তার চেয়ে আর একটু কম খরচে হতো শরীর বন্ধ। এর ব্যয় সোয়া এক আনা। তবে কার্যকারিতা অনেক কম। বাড়ির সবাই এই বন্ধে সুরক্ষিত হয় না। কিন্তু উপায় নেই। কষ্টেসৃষ্টে বড়জোর সোয়া এক আনা পর্যন্ত খরচ করা চলে। এর বেশি নয়।
শরীর বন্ধের জন্য প্রয়োজন হতো খই বা মুড়িভাজা মাটির খোলার পেছনের কালি। এক নিশ্বাসে মন্ত্র পড়ত কবিরাজ–
কালী কালী মহাকালী ঘোর অন্ধকার
শ্মশানে শ্মশানে থাকে মুণ্ডু গলায় যার।
সমুদ্র মন্থনে বাঁচালে শরীর প্রাণ
সেই রহম এই ভক্তের করো গে তুমি ত্রাণ।
ডান হস্তে বরাভয় বাম হস্তে অসি
অসুর কাটে করলে রাশি রাশি।
আশীর্বাদ করো তুমি কই আমি ব্যস
ভূত প্যাত (প্রেত) রোগ শোক, কবরী সব শ্যাষ।
আমার এই আজ্ঞে যদি নড়ে
মহাদেবের জট খসে ভূমিস্তে পড়ে।।
পরপর তিনবার পড়ত সে মন্ত্র। মন্ত্র পড়ে কবিরাজ প্রতিবার সেই কালিতে ফুঁ দিত। তারপর মন্ত্রপূত সেই কালি ছিটিয়ে দিত রোগীর মাথায়। রোগী খুশি হতো। নিশ্চিন্ত থাকত অভিভাবক।
কবিরাজ শুধু রোগ ভালো করার মন্ত্রই পাঠ করত না; দিত জ্ঞান-বৃদ্ধির মন্ত্রও। এর খরচ বেশি নয়। এক আনা পয়সা। মন্ত্রের উপকরণ, শুকনো মচমচে বটপাতা। বটপাতার খানিকটা ছিঁড়ে হাতের তালুতে গুঁড়ো করে তার উপরে এক নিশ্বাসে মন্ত্র পড়ত কবিরাজ–
এসো এসো সরস্বতী (যার জন্য এই মন্ত্র তার নাম)
কণ্ঠে করো ভর
চার যুগ চার স্তর (যার জন্য এই মন্ত্র তার নাম)
করো হে অমর (যার জন্য এই মন্ত্র তার নাম) এর থেকে যদি তুমি
অন্য দিকে ধাও
দোহাই লাগে মা সরস্বতী
কার্তিক গণেশের মাথা খাও।।
একইভাবে পাঁচবার মন্ত্র পড়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে পাঁচবার ফুঁ দিয়ে বট পাতার পুরো গুঁড়োটুকু তাবিজে ভরে দিত। তারপর যাকে পরানো হবে এই তাবিজ, তাকে স্নান করিয়ে আনা হতো। নতুন লাল সুতোয় তাবিজটা ঝুলিয়ে ছেলে হলে বাম হাতে আর মেয়ে হলে ডান বাহুতে বেঁধে দিত। প্রতিদিন স্নান সেরে তিনবার করে ওই তাবিজ ধোয়া জল পান করতে হবে পর পর সাত দিন। দিন যত গড়াবে, তাবিজের কার্যকারিতা ততই বাড়তে থাকবে।
আপদে-বিপদে সর্বরোগে নিষ্কৃতিদাতা কবিরাজ ছিল তাই নমশূদ্রদের কাছে দেবতাসম। ভূত-প্রেত ঝাড়ানো গুনীন, সাপের বিষ নামানো ওঝা–সবাই ছিল তাদের কাছে দেবতা। সাপে কাটা রোগীর জন্য নমশূদ্ররা দৌড়াত ওঝার কাছে।
সাপে কাটার খবর শুনেই ওঝা মন্ত্র পড়া শুরু করত-
বিষ বিষ ওরে বিষ, তুই কী তা জানি
তোর থেকে বড় করে পদ্মা মারে মানি।
কই তোরে, তুই যদি আর উপরে যাস
সত্যি করে তুই তয় পদ্মার মাথা খাস।
শিবের কাছে তে কই, তুই ফিরে আয়
এরপর বিষ যদি উল্টো দিকে ধায়।
দোহাই পদ্মার দোহাই, আর যদি যাস
শিব, দুর্গা, মা পদ্ম সবার মাথা খাস।।
এই মন্ত্র তিনবার উচ্চারণ করে উপরে মুখ তুলে তিনবার ফুঁ দিয়ে ওঝা রওনা দিত রোগীর বাড়ির উদ্দেশে। তার আগে নিজের শরীর বন্ধ করে নিত মন্ত্র পড়ে–
ওরে ওরে বুড়ো শিব আমি তোর ধন
দেখিতে চলিলাম আমি তোরই নন্দন।
কোন কানি কুঁদেছে তারে করেছে দংশন
দেখিব তাহারে আমি সে কোন জন।
তুই বাবা গুরু মোর তুই হলি সার
মা পদ্মার দোহাই লাগে সে বেটি আমার।
উড়োনচণ্ডী আমি উড়িলাম তয়
বাবা তুই সাথে থাক আর কী বা ভয় ॥
এই মন্ত্র পুবমুখো হয়ে ওঝা তিনবার উচ্চারণ করে নিজের শরীরে তিনবার ফুঁ দিয়ে নিজের শরীর বন্ধ করে যাত্রা করত।
সাপে কাটা রোগীর বাড়ি এসে ওঝা প্রথমেই যেখানে দংশন তার উপরে শক্ত করে বাঁধন দিত। তারপর রোগীর গায়ে দিত হাত চালান। হাত চালান দিয়ে পরিমাপ করত, বিষ শরীরের কোন পর্যন্ত উঠল। হাত চালানের সময় বাম হাতের তালু মাটিতে রেখে ডান হাতে এক চিমটি মাটি তুলত। এরপর বাম হাতের উপর মুখ রেখে মন্ত্র বলত আর ডান হাতের মাটি একটু একটু করে বাম হাতের পিঠের উপর ছাড়ত। আর চলতে থাকত মন্ত্র–
হাত চলে, অঙ্গ চলে, আকাশ বাতাস চলে
চলে ড্যাও, চলে দানব, ডাকিনী যুগিনী চলে
দেব চলে, দেবী চলে, চলো চলো হস্ত
সেবক কষ্ট পায়, দিয়ে নাকো কষ্ট
দোহাই বুড়ো শিব, দোহাই মা বসুকী।
এই মন্ত্র বারকয়েক পড়ত ওঝা। তারপর ওঝার হাত চলতে শুরু করত। সাপে কাটা রোগীর গায়ে যত দূর পর্যন্ত হাত যেত, ওঝা এবং উপস্থিত সবাই বিশ্বাস করত ততটুকু পর্যন্ত বিষ উঠেছে। রোগী পুরুষ হলে তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে, আর নারী হলে বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের একেবারে গোড়ায় একফালি পাকানো পাটের আঁশ বেঁধে দিত। একে বলত গাটোরী। গাটোরীর রশির দুই প্রান্ত ধরে একজন হালকা মোলায়েম ভঙ্গিতে টানতে থাকত। আর ওঝা অবিরাম মন্ত্র পড়ে যেত–
আয় আয় বিষ আয়, ঘা মুখে আয়
নয় তোর মা দ্যাখ কার বাড়ি যায়।
এখনো বস্ত্র আছে, আছে মাথায় কেশ
ঘা মুখে না আলি, দেখিস কি বেশ।
শ্মশানে মশানে নেব, দেহ করব খালি
ওর বিষ তোর মা, জানি কোন বালী।
আমার এই কথা যদি এ্যাক চুল নড়ে
মহাদেবের জট খসে ভূমিস্তে পড়ে।।
একই মন্ত্র বারবার ঘনঘন পড়ে যেত ওঝা। কখনও উচ্চৈঃস্বরে, কখনও রাগতস্বরে, কখনও আবার নিম্নস্বরে। এরপরও বিষ যদি ঘা মুখে না আসত, তখন শুরু হতো খিস্তি মন্ত্র। অশ্রাব্য সেই খিস্তি শুরু হলে রুচিশীল মানুষের পক্ষে তা দাঁড়িয়ে শোনা সম্ভব হতো না। দূরে সরে যেত তারা। এক একসময় এক এক মন্ত্র অবিরত পাঠ করে যেত ওঝা—
(১)
রাম করে, লক্ষ্মণ করে, করে হনুমান
গাছে চড়ে নুনু নাড়ে বুড়ো জাম্বুমান।
বিষ তুই কনে যাবি, তোর কর ফাঁক
তোর মা তারও করব, শীঘ্র করে ডাক।
(২)
ওপারে কাঁচা ছেড়ি পাকা বরই খায়
আমি শালা গেলি ছেড়ি
ঘরে দুয়োর দ্যায়।
ওর মার চিতে জ্বালি
বিষ বিষালি ছাই
মাই ধরে টানে ছিঁড়ি
কোনো বিষ নাই।
প্রয়োজনে এর থেকেও কড়া উগ্র খিস্তিতে মন্ত্র পড়ত ওঝা। এরপর একসময় দড়ির গিঁট বাঁধা বুড়ো আঙুলের মাথা কালো হয়ে ব্যথায় টনটন করতে থাকত। ওঝা তখন সেই আঙুলের মাথায় বেলের কাটা ফুটিয়ে কালো রক্ত বের করে আনত। ওঝার ভাষায় যা বিষ মিশ্রিত রক্ত।
এই বিষ বের করলেই যে রোগী বেঁচে যেত তা নয়। রোগী মারা গেলে ধরে নেয়া হতো, কালসাপে দংশন করেছে। শত চেষ্টা করলেও তাকে বাঁচানো যেত না। কী আর করবে ওঝা বাবাজি। মৃত্যুর দায় তাই কেউ ওঝার উপর চাপাত না। ধরে নিত এটাই তার নিয়তি।
ওঝা তার এই বিশাল কর্মকাণ্ডের বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা নিত না। এমনকি রোগীর বাড়িতে জল পর্যন্ত স্পর্শ করত না। গুরুর নিষেধ। এই বিদ্যা সাধনার ধন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জন। উপার্জনের জন্য নয়। তবে রোগী ভালো হয়ে গেলে, খুশিমনে তারা কোনো উপহার দিলে সেটা নেয়াতে দোষ ছিল না।
আশ্বিনের শেষ দিন। নমশূদ্রদের ব্যস্ততার দিন।
শুধু’দিন নয়, রাতও। এই দিন শেষে রাতে গার্সি। কেউ কেউ এই রাতকে বলত জাগরণের রাত। সারাদিন ধরে নমশূদ্র নারীরা ঘর-উঠোন, হাতা-খুন্তি, চালন-কুলো, হাঁড়ি-পাতিল, দা-কাচি, খোন্তা-কোদাল সব ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করত। পুরুষেরা লাঙল-জোয়াল ধুয়ে-মুছে তেল-সিঁদুর পরাত। গাই, বলদ স্নান করাত। তাদের শিঙে মাখাত তেল সিঁদুর। নারীরা ধোয়া-মোছা ধামা, কাঠা, চালন, কুলো শুকিয়ে পরম ভক্তিভরে তাতে তেলমাখা সিঁদুরের ছোপ দিয়ে দিত। মা লক্ষ্মী ও নারায়ণের আশীর্বাদ কামনা করত। বলত–মা লক্ষ্মী, তুমি আমাদের ধামা, কাঠা, ডোল, গোলা ফসলে ভরে দ্যাও।
বিকালে মেয়ে-বউরা আঠালো মাটি দিয়ে চড়ইবাতি বানাত। সন্ধ্যায় এই চড়ইবাতি প্রত্যেক ঘর আর উঠোনে জ্বালানো হতো। সারা গ্রাম আলোময় হয়ে
ডুইবাতির আলোয়। ছোট-বড় সবার মুখ সেই আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মন ভরে থাকত আনন্দে।
গার্সির রাতকে নমশূদ্ররা সর্বমঙ্গলের রাত বলে জ্ঞান করত। ভাবত, এই রাতে তারা যার কাছ থেকে যা অর্জন করবে তাই এদের সারা জীবনের জন্য মঙ্গলময় হয়ে থাকবে। এই রাতকে তাই তারা গুরু রাতও বলত। রাত জেগে এরা গুরুর কাছ থেকে নানা বিদ্যাও অর্জন করত।
রাতভর তারা দলবেঁধে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরত। গাছের ফল কাটত। এই কাটাকুটিতে কেউ বাধা দিত না। বরং উৎসাহ যোগাত। এদের বিশ্বাস ছিল, এই রাতে যেসব গাছের ফল কাটা পড়বে, আগামীতে সেইসব গাছ আরও বেশি ফলবান হয়ে উঠবে।
গার্সির রাত অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাত নমশূদ্র গেরস্থরে কাছে। আশ্বিনের শেষ রাতে বধূরা রান্না করে ভাত, তরকারি। তৈরি করে পিঠেপুলি। পাটিসাপটা, কুলি পিঠা। গার্সিতে কার্তিকের প্রথম সকালে জমির ধানগাছকে তারা সাধ খাওয়ায়। ধানগাছ এইসময়ে পূর্ণ গর্ভবতী। আশ্বিনের শেষদিনে রান্না করে কার্তিকের সকালে ধানগাছকে সাধ খাইয়ে নিজেরা আহার করে। মুখে মুখে বচনও প্রচলিত আছে–
আশ্বিনে রাধে বাড়ে কার্তিকে খায়
যে বর মাঙে সে, সেই বর পায়।।
রাতেই মেয়েরা কাঁচা তেতুল, কাঁচা হলুদ, সন্ধ্যার মূল, নিমপাতা ইতাদি বেটে আলাদা আলাদা করে কলাপাতায় সাজিয়ে রাখত। ভোর সকালে গেরস্থ কর্তা-গিন্নিসহ বাড়ির সবাই কলাপাতায় ভাত, তরকারি, পিঠেপুলি, বাটাকোটা, তালের শাঁস সব নিয়ে পাশের ধান খেতে যায়। সাধ খাওয়াত ধান গাছকে। প্রথমে খেতের ভিতরে একটু জায়গা ফাঁকা করে সবকিছু রাখত। তারপর বাধতো একগোছা ধানের পাতার ঝুটি। তেল মাখিয়ে স্নান করানো হতো ধানগাছকে। তারপর লাগানো হতো সিঁদুর, পরানো হতো কাজল। তারপর সব খাবার একে একে নিবেদন করা হতো ধানগাছকে। মুখে বলত
ধান তুমি সাধ খাও, ফুইল্যা পাইক্যা ঘরে যাও
যে বলবে ভালো ধান, তারে দিব গুয়া পান।
যে বলবে মন্দ ধান, তার কাটবো দুই কান।।
নিবেদন শেষে গেরস্থ সবাইকে খাবার বিতরণ করে নিজেরাও খেত।
বিলের নমশুদ্র কৃষকদের মূল ফসল ছিল আমন ধান। আমন ধানের সাথে তাই ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধন। মা লক্ষ্মীর আবাহন তাই হতো গার্সিতে ধানগাছকে সাধ খাওয়ানোর মাধ্যমে। কামনা করত মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ।
এইসময় পাট ধোয়া খানা-খন্দে, ডোবা, জলাশয়ে প্রচুর মশা জন্মাত। মশারি কেনা ছিল দরিদ্র নমশূদ্রদের জন্য বিলাসিতা। মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য তাই মশা তাড়ানোর অনুষ্ঠান করত তারা। গার্সি রাতের পরের সকালে সমস্ত নমশূদ্র ছেলেমেয়েরা পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, বাড়ি বাড়ি, পথে পথে, চাল কুলো পিটিয়ে ছুটে বেড়াত। আর মুখে ছড়া গাইত
মশা মশা গুয়া মশা
পায় চন্দন দাড়ি
এবারের মতো যা রে মশা
যম রাজার বাড়ি।।
নমশুদ্র কৃষকরা বিশ্বাস করত, এরপর আর মশা থাকবে না। মশা তাড়িয়ে এসে নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই স্নান সেরে অষ্ট সবজি দিয়ে রান্না করা নিরামিষ পরম তৃপ্তিতে খেত। আর বলত, গার্সি ঠাকুর আগামী বছর ধনে মানে জনে সবাইকে তুমি ভালো রেখে।
শুধু মশাই নয়। চালন কুলো পিটিয়ে তারা অলক্ষ্মীকেও গ্রামছাড়া করে দিয়ে আসত। চালন-কুলো পিটিয়ে তারা দৌড়াত। আর মুখে জোরে চিৎকার করে বলত–
দূর যা, দূর যা
অলক্ষ্মী দূর যা
লক্ষ্মী আসে ঘরে বয় ॥
আশ্বিন মাসে হঠাৎ কখনও মেঘ কালো করে উথাল-পাথাল ঘূর্ণিঝড় বয়ে যেত। মেঘ-বাতাস কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে যেত একদিক থেকে আর একদিকে। সেই ঘূর্ণির ভিতরে যা কিছু পড়ত উড়িয়ে নিয়ে যেত। ঘরের বেড়া, খড়ের পালা, টিনের চাল। কোনোকিছুই বাদ পড়ত না। নিম্নচাপের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা প্রবল হলে গাছ, এমনকি টিউবওয়েল পর্যন্ত উপড়ে নিয়ে যাবার খবরও শোনা যেত মাঝেমধ্যে। ক্ষতি হতো জীবনের, সম্পদের। ধ্বংস হতো ঘরদোর। এরকম মেঘ-বাতাসের কুণ্ডলীকে আকৃতিভেদে নানা নামে অভিহিত করত। কখনও বলত ভূতের লেজ, কখনও বলত হাতির শুড়।
আশ্বিন মাসজুড়েই নানা পার্বণ, অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকত নমশূদ্র গৃহস্থরা। শত ব্যস্ততার ভিতরে একটা একটা করে দিন পার হয়ে যেত। এভাবেই নমশূদ্রদের জীবন থেকে চলে যেত আরও একটি আশ্বিন মাস।