০৪. শ্রাবণ

শ্রাবণ

শ্রাবণ মাস। নমশূদ্রদের ভাষায় শাওন মাস।

মাঠে মাঠে সোনালি পাকা আউশ। যেন রূপসী রমণীর গলায় সোনার হার। ঝকঝকে রোদ এসে পড়ত ধানের ছড়ার উপরে। সেই রোদে চিকচিক করে উঠত গোটা মাঠ। মৃদুমন্দ বাতাস দোলা দিয়ে যেত ধানের খেতে। সেই দোলায় মন নাচত কৃষাণ-কৃষাণীর। মাঠে মাঠে চলত খুশির কাস্তে। এক এক পোঁচে ধানের গোছায় হাতের মুঠো ভরে যেত পাকা ধানে। ধানের সোঁদা গন্ধে মাতাল হতো হৃদয়। আনন্দে তিরতির করে নাচত মন। চোখে ভাসত চিকচিক স্বপ্ন। মুখে থাকত রঙ্গরসের গান–

ছোট বউ-এর শব্দ শুনি সে নাকি বড় রাঁধুনি
ও রে কচু বঁধতে নুন দেয় না, আহা মজার ছালুনি
আবার মালপোকা (তেলাপোকা) পড়ল রে ভাই
সখের ভাজা বাগুনি (বেগুনি) ॥

হলদি কুটতে হঠাৎ করে কয়
বড় বউয়ের মাজার ব্যথা হয়
আবার শাক রাঁধতে মাঝে (মেজো) বউয়ের
আঁচল পুড়ে যায়
নাতনিটা কাঁদে পাছে সে বড় জ্বালায় ॥

নোয়া বউয়ের পেচিতে (পাত্রে) নেই ত্যাল (তেল)
তার আলগা জবর ফাল (লাফ)
বিনে ত্যালে ব্রাধে পচা ডাল
তাই তো মাঝেমাঝেই পড়ে রে ভাই
পিঠের পরে তাল ॥

এ শুনে আরেক কণ্ঠ গেয়ে ওঠে–

শোনো শোনো বুনো ভালুক, ডুবোলে ওঠে না শালুক
কী করতে যে পদ হারালে, হারালে বাবার তালুক
এখন তোমার মাথায় সবাই আলকাতরা ঢালুক ॥

গোল কোরে না, গোল কোরে না, পাছে আছে খাসা দই
খাসা খায়ে মজা পাবা, দেব মনের মতোই
চিটেগুড়ের মিঠে খায়ে হয়ে যাবা সই ॥

ভাবে কথা বলি আমি, চ্যাংটার হবে রে মুশকিল
দাঁড়া থুয়ে বে-দাঁড়ায় গেলি, ভূতে ধরবি কিল
কিলের চোটে মাথা পাছা হয়ে যাবি ছিল ॥

খেতে খেতে ধান। ধান কেটে বোঝা বেধে নিয়ে আসত তারা জল-কাদা ভেঙে। এনে ধপাস করে ফেলত বাড়ির উঠোনে।

কিন্তু, যে আনন্দ আর স্বপ্ন নিয়ে তারা শুরু করত ধান কাটা, সেই আনন্দের রেশ একটু একটু করে তাদের কমতে থাকত। হারিয়ে যেত মনের সুখ। মহাজনের ঋণ শোধ করতে হবে। দিতে হবে সুদ। সুদে-আসলে সবকিছু পরিশোধ করার পর হয়তো ঘরে থাকবে না আর তাদের এক আধলা ধানও।

শ্রাবণ মাসে বিলের মানুষের অসুখ-বিসুখ বেড়ে যেত। জল-কাদায় সারা মাঠ, পথ-ঘাট পাঁচপেচে, ভরভরে। সেই জল-কাদার মধ্যেই বাচ্চারা খেলে বেড়াত, খানাখন্দে ডুব সাঁতার কাটত। ঘরে ঘরে দেখা দিত জ্বর-কাশি, খোস পাঁচড়া, পেটের পীড়া। বেড়ে যেত কবিরাজের আনাগোনা। কাগজের লেবেল সাঁটা বোতলে দিত লাল রঙের মিকশ্চার ওষুধ। রোগী দেখে কবিরাজ কোনো ফি নিত না। দিতে হতো শুধু ওষুধের দাম। হাতে কড়ি না থাকলেও সমস্যা ছিল না। আলু, কচু, লাউ, কুমড়োর বিনিময়েও চলত রোগের চিকিৎসা।

অবস্থাভেদে দেয়া হতো রোগীর ব্যবস্থাপত্র। যারা হতদরিদ্র, তাদের জন্য ছিল গাছ-গাছড়ার শিকড়, বাকল, তেল পড়া, জল পড়া। কখনও নাকশি কবজ, কখনও বা মন্ত্রপড়া ঝাটা বারুণ। অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের জন্য মিকশ্চার ওষুধ।

আর ছিল বাণ মারা। বাণ মারার প্রতিকার টোটকা চিকিৎসায় হতো না। দোষ কাটাতে হতো। তার জন্য লাগত মন্ত্র। গ্রামে চিকিৎসা করতে গেলে সর্বরোগহরণকারী ডাক্তার হতে হতো। কবিরাজও তাই সবই পারত। মন্ত্রও জানতে হতো তাকে। বাণ মারা রোগী হলে, কবিরাজ তাকে আগে স্নান করিয়ে শুদ্ধ করাত। কিন্তু তেলের কোনো স্পর্শ থাকতে পারবে না। না মাথায়, না গায়ে। তেল মাখানো যাবে না কোথাও। আর লাগত লাল জবাফুল। স্নান শেষে রোগী এসে বসত পিঁড়ির উপরে আসন করে। কবিরাজ রোগীর মাথায় বাম হাত রেখে মন্ত্র পড়ে যেত–

ডানে রাম, বামে লক্ষ্মণ
লক্ষ্মণ রাম, করি ভক্ষণ
যার বাণ তারে যা
পাঁচ যুগ পাঁচ, ইন্দ্র কাড়ে খা।
এই আজ্ঞে যদি নড়ে
দোহাই লাগে দোহাই মা সীতে
তোর লব কুশের মাথা কাটে
ভূমিস্তে পড়ে ॥

কবিরাজ এই মন্ত্র পড়ে তিনটা জবাফুল নিয়ে রোগীর মাথায় ছিটিয়ে দিত। এভাবে হতো তিনবার মন্ত্রপাঠ। তিনবার তিনটি করে মোট নয়টি জবাফুল ছিটিয়ে মন্ত্রপড়া পর্ব শেষ হলে আশ্বস্ত হতো সবাই। বুকের মধ্যে তাদের গভীর বিশ্বাস দানা বাঁধত, বাণ কেটে বেরিয়ে যাবে রোগী। আর কোনো চিন্তা নাই। সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে সে এখন থেকে।

পেটের পীড়ায় কষ্ট পেলে, খাওয়া-দাওয়ায় রুচি না থাকলে, মুখে বমি বমি ভাব থাকলে তারও ছিল মন্ত্র-চিকিৎসা। জবাফুল নয়, এই রোগের জন্য দরকার হতো কালো সুতো। রোগীকে সামনে দাঁড় করিয়ে দুই হাতে সুতো নেড়েচেড়ে টিপেটুপে সামনে ধরে এক নিশ্বাসে মন্ত্র পড়ত কবিরাজ–

করাত করাত মহা করাত
আসতি কাটে যাতি কাটে,
শ্বেত কাটে পেত কাটে
ড্যাঁও কাটে বাও কাটে
তেত্রিশ কোটি দেবতার বাণ কাটে।
হু হু শব্দে ছাড়িলাম বাণ কার
আজ্ঞে কামরূপ কামাখ্যার আজ্ঞে
ড্যাঁও পেত শীঘ্র করে ছাড় গে
আমার মন্ত্র যদি নড়ে কামাখ্যা দেবীর
মুণ্ডু কেটে ভূমিস্তে পড়ে ॥

তিন নিশ্বাসে তিনবার মন্ত্র পড়ে কালো সুতোয় নয়টি গিঁট দিয়ে রোগীর গলায় মালার মতো বেঁধে দিত কবিরাজ। বলে দিত, নয় শনিবার পর এই নাকশি খুলতে হবে। এই শরীরে আর কোনো রোগ ব্যাধি আসতে পারবে না। শুনে আশ্বস্ত হতো গৃহস্থ। কবিরাজকে দিত যা তাদের সামর্থ্যে কুলাত।

প্রসবজনিত সূতিকা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল তখন গ্রামে গ্রামে। সন্তান প্রসবের পর প্রায়ই দেখা দিত এই রোগ মায়েদের। গোপন রোগ হিসেবে ধরা হতো সুতিকা রোগকে। রোগীর জন্য খানিকটা লজ্জাজনকও ছিল বটে।

এই রোগের চিকিৎসাও হতো মন্ত্রগুণে। এরজন্য ছিল আলাদা বিশেষ গুণীন। তবে অনেক কবিরাজও এই রোগের চিকিত্স-মন্ত্র জানত। হাতের কাছে গুণীন না পাওয়া গেলে, তখন কবিরাজকেই স্মরণ করত গোপনে নমশূদ্র রমণীরা। যে বউয়ের এই রোগ, তাকে যেতে হতো জলের ঘাটে। পুকুরের জল সাতবার উজোন-ভাটি করে তারপর ঘটি ডুবিয়ে জল ভরতে হতো। জলভরা ঘটি পুণ্যচিত্তে মাথায় অথবা কাখে করে নিয়ে আসত ভিতর বাড়ির উঠোনে।

সেই জলের ঘটি ডান হাতের তালুর উপর রেখে গুণীন বা কবিরাজ পুব দিকে মুখ করে বি ভঙ্গিতে ঘটির উপর মন্ত্র পড়তে শুরু করত-

ওরে ওরে ব্যাথা তোরে আমি চিনি
বঙ্কোরার ঘরে তোর জন্মের উৎপত্তি
জগতে মারে ফাল
বাড়ে ব্যথা কাল বেকাল
নাড়ি থেকে নাড়ে চলে
হাড় থেকে হাড়ে চলে
আগ পাছ পাশ ব্যথা
ওড়নে করি ভর
ওরে ওরে ব্যথারে তুই
শীঘ্র করে ছাড়
কার আজ্ঞে মহাদেবের আজ্ঞে
আমার এই মন্তর যদি নড়ে
মহাদেবের জট খসে ভূমিস্থলে পড়ে।

এই মন্ত্র তিনবার পড়ে তিনটি ফুঁ দিয়ে বউয়ের হাতে জলের ঘটি ধরিয়ে দিত কবিরাজ। নির্দেশ দিয়ে দিত–মাটি থেকে শূন্যে তুলে রাখতে হবে ঘটি। তিন দিন তিন চুমুকে শেষ করতে হবে ঘটির পুরো জল। পরম ভক্তিভরে রোগাক্রান্ত বউটি জলের ঘটি দুই হাতে তুলে নিত। ঘরে গিয়ে পাটের শিকেয় সেটি ঝুলিয়ে রেখে আবার এসে কবিরাজের সামনে দাঁড়াত। এবার ওষুধ দেবে কবিরাজ। ঝোলা থেকে বের করত শিকড়-বাকড়। সেসব বেঁটে রস করে খেতে হবে বাসি পেটে প্রতিদিন। দাওয়াই পেয়ে স্বস্তিতে ভরে যেত গৃহবধূর মন।

প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে উঠোনে চলত নড়ই, পরাঙ্গি, হস্টামুড়ি, গদাডাঙ্গা, শালি, লক্ষ্মীপ্রিয়া ইত্যাদি ধানের মলন। মলনের গরু ঘুরাত দুই-তিনজনে। কেঁদোল চালিয়ে ধান উপর-নিচ করত আরও তিন-চারজন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলত কলকো। কুড়ৎ কুড়ৎ শব্দে চলত হুকে টানা। হুকে ঘুরত এক হাত হতে আর এক হাতে। পরিশ্রমী শরীরে বল আসত নতুন করে। চাঙ্গা হতো মন হতো। শুরু হতো নতুন উদ্যমে মলন মলা। চলত দিন-রাত।

শ্রাবণের শেষ রাতে নমশূদ্র মা-বৌয়েরা করত সর্প পুজো। চেষ্টা করত মা মনসাকে তুষ্ট রাখতে। উদ্দেশ্য সর্পদংশন থেকে স্বামী-সন্তানকে মুক্ত রাখা। পরিবারে যতগুলো মানুষ, মুখ গুনে ততগুলো ঘট কুমোরপাড়া থেকে কিনে নিয়ে আসত তারা। সেই ঘটে আঁকা থাকত বিভিন্ন রঙে রং করা সাপের ফণাতোলা মুখ। কুমোর মেয়েরা অতিযত্নে নিজের হাতে গড়তে সেই ঘট। রঙ তুলিতে মনের রঙে ঘট রাঙিয়ে তুলত। একে বলত সাপঘট বা সর্পঘট।

শ্রাবণের শেষ সকালে সমস্ত নমশূদ্র নারী স্নান সেরে ভেজা বস্ত্রে শোবার ঘরের মাঝখুঁটির গোড়ায় ছোট্ট একটা মাটির বেদি তৈরি করত। বেদির উপরে সাপঘটগুলো সাজিয়ে বসানো হতো। প্রতিটি ঘটে আঙুলের টানে সিঁদুরের রেখা আঁকা হতো। তারপর কাঁচা দুধ দিয়ে ভরত ঘটগুলো। পুজোর ভোগ তৈরি করত চেঁকিতে কোটা নতুন আউশ চালের ছাতু দিয়ে।

পুজোর সব উপাচার সাজিয়ে ভেজাবস্ত্রে ধান, দূর্বা, ফুল, বিল্বপত্র ছিটিয়ে সর্পদেবী মা মনসার কাছে মনের আকুতি জানিয়ে পুজো সম্পন্ন করত। পরদিন সকালে পাড়ার সব রমণী বাসিমুখে স্নান সেরে উঠোনে একসাথে এসে বসত। হাতে মঙ্গল ফুল-পাতা নিয়ে পরম ভক্তিভরে শুনত মনসার ব্রত আলাপ। অভিজ্ঞ বয়স্ক কোনো নারী সবাইকে শোনাত ব্রতকথা–

এক বুড়ির ছিল দুই ব্যাটার বউ। তারা গেল গাঙের ঘাটে ডুবোতি। যাওয়ার পথে দ্যাখে, একটা গরু পাড়ার গর্তে দুডে চ্যাং মাছ লাফায়ে বেড়াচ্ছে। সিতা দেখে ছোট বউ কয়, এই মাছ পুড়ায়ে খাতি খুব ভালো লাগে।

বড় বউ কয়, তালি নিয়ে চল মাছ দুডে। এই কয়ে দুই বউ নদীতে ডুব দিয়ে মাছ দুডে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। ঘরে আসে মাটির এক পাতিলের মধ্যি মাছ দুডে রাখে দেয়। পরদিন বিয়ানে মাছ পুড়ানোর জন্যি ছোট বউ পাতিলের মুখ খোলে। দ্যাখে, হাঁড়ির মধ্যে ফুটফুটে দুডে মণি বসে রইচে। তারা ছোট বউরে কয়, দিদি আমরা তোরে নিতি আইচি। তোর শাশুড়ি আর বড়জার কাছে এই কতা ক।

ছোট বউ শাশুড়ি আর বড়জার কাছে এই কতা কয়। এ শুনে শাশুড়ি আর জা কয়–তালি যা।

মণি দুডে কয়, আমাগের বাড়ি হচ্ছে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার। তুই ভয় পাস নে। আমরা তোর চোখ বাঁধে পিঠির উপর করে সাপ হয়ে উড়তি উড়তি নিয়ে যাব।

দিদি কয়, যা তোরা ভালো মনে করিস তাই কর। এরপর ওরা সাপ হয়ে উড়ে তাগের দিদিরে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে নিয়ে যায়। তারপর আবার সেই ফুটফুটে দুড়ে মানুষ হয়ে দিদিরে নিয়ে হাঁটতি শুরু করে। হাঁটতি হাঁটতি দেবপুরী মা পদ্মার কাছে দিদিরে নিয়ে যায়।

বউডারে দেখে মা পদ্মা কয়–কিডা এ? কারে নিয়ে আইচিস? এ যে দেবপুরীর জন্যি কলঙ্ক!

ছাওয়াল দুড়ে কয়–না মা। দিদি খুব ভালো। আমাগের দ্যাখাশুনা করবি।

এ শুনে মা পদ্মা নরম হয়। বউরে কয়–তুই রান্নাবান্না কর। তয় খাবার দিবার সময় দেখপি, দুধ য্যান গরম না থাকে। ঠান্ডা দুধ আর সবরি কলা দিবি সরার মদ্যি।

বউ তাই করে। ঠান্ডা দুধ আর সবরি কলা সরায় করে খাতি দেয়।

এই করতি করতি বউ একদিন ছাওয়াল দুইজনরে কয়–অনেক দিন তো হয়ে গেল। আমারে এহন তোরা বাড়ি রাখে আয়। মা পদ্মাবতীর কানেও কথাডা পৌঁছোয়।

পদ্মাবতী একথা শুনে বউরে কয়–তুই এতদিন থাকলি। আমার ছাওয়ালরা তোরে এত পছন্দ করে। যাওয়ার সময় কী চাস তুই আমার কাছে?

ছাওয়াল দুড়ে দিদিরে আগেরতেই গোপনে শিকোয়ে দিছিল-মা কিছু দিতি চালি, কবি তোর চাওয়ার কিছুই নাই। তয় দিতিই যদি চাও, তালি একটা কাঁপ শুধু দেও।

বউ তাই করে। মা পদ্মাবতী খুশি হয়ে বউডারে একটা সোনার ঝাঁপি দ্যায়।

তারপর তারা রওনা দেয় বাড়ির দিকে। বাড়ি ফেরার পথে ছাওয়াল দুডে দিদিরে আবার শিকোয়ে দ্যায়। বলে–শোন দিদি, বাড়ি যায়ে ঘটি-বাটি, থালা-বাসন, ধামা-ঝকা হাতের কাছে যা পাবি, তাই আছড়ানো শুরু করবি।

বউ কয়–ঠিক আছে। তাই হবি। ঘরে ফিরে বউ হাতের কাছে যা পায় তাই আছাড় দিয়ে ফেলায়ে দ্যায়।

শাশুড়ি কয়–কি লো বউ, এ কী করিস? জিনিসপাতি আছড়াস ক্যা? বউ কোনো উত্তর দেয় না। কথাও কয় না।

দুই ভাই দিদির বাড়ি রাত কাটাল।

ওই রাতেই রাজার একমাত্র ছাওয়ালরে সাপে কাটল। কত কবিরাজ, কত বৈদ্য আলো, গেল। রাজার ছাওয়ালরে কেউ বাঁচাতি পারে না। শ্যাষম্যাশ রাজা গোটা রাজ্যে ঢোল পিটোয়ে দেয়, আমার ছাওয়ালরে যে বাঁচাতি পারবি, তারে সোনার খাট, রুপোর পালঙ্ক উপহার দেব।

এ সুমায় ছাওয়াল দুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজার বাড়ি অনেক মানুষ দেখে তারা আগোয়ে যায়। জানতি চায়–কী হইছে রাজার বাড়ি? যার কাছে শোনে,

সে-ই কয় রাজার ছাওয়াল রে সাপে কাটিচে।

কী সাপে?

বিষের বড় তাপ। আওলা সাপ।

ছাওয়াল দুড়ে কয়–আমরা নামায়ে দিতি পারি এই বিষ।

সাথে সাথে সেই কতা রাজার কানে যায়। রাজা ছাওয়াল দুডেরে ডাকে নিয়ে কয়-বিষ যদি নামাতি পারো, আমার ছাওয়াল যদি বাঁচাতি পারো, তালি যা কইচি সৰ তোমরা পাবা। আরও যা চাবা তা-ই পাবা।

মা পদ্মাবতীর দোহাই দিয়ে তারা মন্ত্র পড়তে শুরু করে। বিষ নামে যায়। রাজার মরা ছাওয়াল চ্যাতন ফিরে পায়। রাজা মহাখুশি হয়ে দুই ভাইরে সোনার খাট আর রুপোর পালঙ্ক উপহার দ্যায়। সাথে দ্যায় সোনা-রুপো আরও কত উপহার। সব উপহার নিয়ে ছাওয়াল দুড়ে চলে আসে দিদির বাড়ি। সবকিছু দিদিরে দিয়ে তারা চলে যায় নিজির দ্যাশে। সোনারুপো পায়ে দিদি রাতারাতি অনেক ধন-দৌলতের মালিক হয়ে গেল।

মা পদ্মাবতীর গুণগান চারদিক ছড়ায়ে পড়ে। ভক্তি করে সবাই তারে পুজো দ্যায়। আমার কথাও ফুরোয়ে যায়।

সকল শ্রোতা নির্বাক মন-প্রাণ ঢেলে এই কাহিনি শুনত। স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ির মঙ্গল কামনা করত। ভক্তিভরে মা পদ্মার উদ্দেশ্যে জানাত প্রণাম।

মা পদ্মার মূর্তিও গড়াত তখন কেউ কেউ। ধুমধাম করে পুজো দিত। সেই পুজোয় বসত মনসা-মঙ্গল কীর্তনের আসর। আসরে রাত দিন পাল্লা করে মনসা কীর্তনের ঝাপান গাইত তারা। আয়োজন করা হতো সাপের খেলা। শ্রোতা-দর্শকের হাসি-আনন্দে জমজমাট হয়ে উঠত নমশুদ্র পল্লি।

এভাবেই দেখতে দেখতে আনন্দ-উৎসবে পার হয়ে যেত নমশূদ্রদের জীবন থেকে আর একটা শ্রাবণ মাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *