০৭. বকুল হিজল গাছটার মাঝামাঝি

বকুল হিজল গাছটার মাঝামাঝি পা ঝুলিয়ে বসে বাইনোকুলার দিয়ে দেখছে। বাইনোকুলারের মতো মজার জিনিস পৃথিবীতে কি আর একটাও আছে? একজনকে এত কাছে থেকে দেখা যায় মনে হয় হাত দিয়ে ছোঁয়াও যাবে অথচ সেই মানুষটা জানেও না যে তাকে কেউ দেখছে! বকুল বেশ অনেকক্ষণ থেকে বাইনোকুলারে স্পিডবোটটাতে বসে থাকা দুজন মানুষকে দেখছে। একজন বিদেশি, এত বড় মানুষ অথচ একটা হাফপ্যান্ট পরে বসে আছে, অন্যজন দেশি মানুষ। বিশাল গর্জন করে পানি কেটে স্পিডবোটটা এসেছে, এখন ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দিয়ে সেটা পানির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বাইনোকুলারে স্পষ্ট দেখা যায় মানুষগুলো কথা বলছে কিন্তু সেই কথা শোনা যায় না। বাইনোকুলার দিয়ে যেরকম দূরের জিনিস দেখা যায় সেরকম দূরের মানুষের কথা শোনার এরকম কি কোনো যন্ত্র আছে?

মানুষ দুজন হাত দিয়ে পানির দিকে দেখল তারপর তাদের গ্রামের দিকে তাকাল, কিছু একটা যন্ত্রের মতো। জিনিস পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে অন্য একটা যন্ত্রের মতো জিনিসের দিকে তাকিয়ে রইল। এই স্পিডবোটটা গত কয়েকদিন হল বেশ ঘনঘন আসছে এখানে, এসে নদীর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন করে। আগে বকুল বুঝতে পারত না কী করছে বাইনোকুলারটা পাওয়ার পর সে দেখতে পারে কী করছে কিন্তু এখনও কিছু বুঝতে পারছে না।

বাইনোকুলারটা তার জন্যে এনেছে নীলা। শুধু বাইনোকুলার না, জামাকাপড় জুতো, সোয়েটার, বই, ক্যালকুলেটর, ক্যামেরা কিছু বাকি রাখেনি। মনে হয় আস্ত একটা দোকান তুলে এনেছে। আরও অনেক জিনিস এনেছে যার নাম পর্যন্ত সে জানে না। পানির নিচে সাঁতার কাটার জন্যে একরকম চশমা, সাথে একটা ছোট নল যেন পানিতে ডুবে ডুবে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। ব্যাঙের পায়ের মতো বড় বড় পা, পায়ে লাগিয়ে সাঁতার কাটা ভারি সুবিধে। পাউডার, ক্রিম, লোশন, শ্যাম্পু, এনেছে প্রায় এক বাক্স। গ্রামের সব মেয়েকে দিয়েও মনে হচ্ছে শেষ হবে না। জামাকাপড়গুলো এত সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না, কিন্তু মুশকিল হল যে সে এই কাপড়গুলি কোথায় পরবে বুঝতে পারছে না। ঈদের দিনে কিংবা কারও বিয়ে হলে পরা যায়। বকুলদের বাসায় যেদিন বেড়াতে যাবে সেইদিনও পরতে পারে। তবে ছেলেদের মতো প্যান্ট আর ঢলঢলে টি-শার্টগুলি সে মনে হয় কোনদিনও পরতে পারবে না, কোনো ছেলেকেই দিয়ে দিতে হবে। শহরের মেয়েরা মনে হয় শার্ট-প্যান্ট পরে ঘুরতে পারে, সে কীভাবে পারবে?

যেদিন নীলা এসেছিল সেদিন বকুল আর নীলা সারাদিন একসাথে কাটিয়েছে। সকালবেলা গল্পগুজব, দুপুরবেলা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপিটুশকির সাথে খেলাধুলা, বিকেলে গ্রামে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো। কথা বলে যেন আর শেষ হয় না। যে-কথাটি অনেকদিন থেকে কাউকে বলবে বলবে করে নীলা কখনো কাউকে বলতে পারেনি সেগুলো বকুলকে বলেছে। দীর্ঘ সময় নিয়ে বকুলকে তার মার কথা বলেছে। বলতে বলতে ভেউভেউ করে কেঁদে ফেলেছে। বকুল তখন তাকে শক্ত করে ধরে রেখে নিজেও ভেউভেউ করে কেঁদেছে। দুইজন একজন আরেকজনকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে গ্রামের মাঠের নির্জন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছে। বকুল তার ওড়না দিয়ে নিজের চোখ মুছে নীলার চোখ মুছে দিয়েছে। সান্ত্বনার কথা বলেছে।

ইশতিয়াক সাহেব শমসেরকে নিয়ে গ্রামের মাতব্বরদের সাথে কথা বলেছেন। যে-গ্রামটির জন্যে তার মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন সেই গ্রামের জন্যে কিছু-একটা করতে চান। আপাতত শুরু করবেন একটা স্কুল নিয়ে। স্কুলটা কোথায় হবে, জায়গাজমি কীভাবে জোগাড় করা হবে সেটা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে, গ্রামের ঘুরে ঘুরে দেখেছেন।

সন্ধ্যেবেলা নীলা তাদের রাজহাঁসের মতো লঞ্চটাতে করে চলে গেছে। কয়েকদিনের মাঝে বকুলকে নীলাদের বাসায় বেড়াতে যেতে হবে। বকুল একেবারে গ্রামের মেয়ে, গ্রামের পথঘাট নদীতে ঘুরে বেড়াতে তার কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু নীলাদের বাসায় গিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কখনো কোন বড়লোকদের বাসায় যায়নি, শুনেছে তাদের বাথরুমগুলোই নাকি তৈরি হয় সাদা পাথরের। বিছানা নাকি হয় নরম, ঘরে ঘরে থাকে এয়ারকন্ডিশন, গরমের সময় ঘরটা হয় নদীর পানির মতো ঠাণ্ডা, শীতের সময় হয় কুসুম-কুসুম গরম। বকুল অবিশ্যি নীলাদের বাসায় যাওয়া নিয়ে মোটেও চিন্তার মাঝে নেই, নীলা হচ্ছে তার প্রাণের বন্ধু আর জীবনের বন্ধু, যার অর্থ হচ্ছে দুজন মিলে একজন মানুষ। কাজেই নীলা তাকে সব শিখিয়ে দিতে পারবে–সেও যেরকম নীলাকে গ্রামের জিনিসপত্র শিখিয়েছে, সাঁতার শেখাচ্ছে।

বকুল চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে আবার নদীর মাঝে তাকাল, নৌকায় মানুষ দাঁড় টানছে, একজন মালবোঝাই একটা নৌকাকে লগি দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বকুল মানুষটার মুখের দিকে তাকাল, বুড়োমতো একজন মানুষ মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, শরীরটা পাথরের মতো শক্ত। মানুষটা লগি ঠেলতে ঠেলতে দাঁড়িয়ে গেল তারপর আকাশের দিকে তাকাল, তারপর ঘুর পিছনে হাল-ধরে থাকা মানুষটাকে কিছু-একটা বলল, তখন সেও আকাশের দিকে তাকাল। দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল বাইনোকুলারটি নামিয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকাল, এক কোণায় একটা কালো মেঘ। বকুল মেঘটার দিকে ভালো করে তাকাল, এটার নিশানা ভালো নয়। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মাঝেই একটা বড় ঝড় আসবে। বকুল আকাশের মেঘটার দিকে তাকিয়ে রইল, নিরীহ ছোট একটা মেঘ, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই নিশ্চয়ই সমস্ত আকাশ ছেয়ে যাবে। নদীতে নৌকাগুলোর মাঝে একটা ব্যস্ততার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, সবগুলোই ঝড় শুরু হওয়ার আগে মনে হয় তীরে চলে আসতে চাইছে। বিদেশি সাহেবকে নিয়ে যে স্পিডবোটটা ছিল সেটাকে এখন দেখা যাচ্ছে না, চলে গিয়েছে কি না কে জানে!

বকুল হিজল গাছটা থেকে নেমে এল। ঝড় শুরু হলে মানুষজন খুব আতঙ্কিত হয়ে যায়, কিন্তু ঠিক কী কারণ জানা নেই ঝড় দেখতে বকুলের অসম্ভব ভালো লাগে। যখন আকাশ কালো করে মেঘ হয়ে সেটা জীবন্ত প্রাণীর মতো আকাশে পাক খেতে থাকে–বিজলি চমকে চমকে উঠে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হয়, প্রথমে দমকা হাওয়া তারপর প্রচণ্ড বাতাসে চারদিক থরথর করে কাঁপতে থাকে তখন বকুলের ইচ্ছে করে দুই হাত উপরে তুলে আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে বেড়ায়।

বকুল আবার আকাশের দিকে তাকাল, ছোট মেঘটা দেখতে দেখতে অনেকখানি বড় হয়ে গেছে, আকাশের একটা অংশ এর মাঝে অনেকখানি ঢেকে ফেলেছে। মেঘের মাঝখানে বিদ্যুতের ঝলকানি শুরু হয়ে গেছে। বকুল হিজল গাছ থেকে নেমে এল, বায়নোকুলারটা বাড়িতে রেখে আসতে হবে, ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে গেলে এত সুন্দর জিনিসটা নষ্ট হয়ে যাবে। একবার ঝড় শুরু হয়ে গেলে মা বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না, তাই আগে থেকেই বের হয়ে যেতে হবে। ঝড়ের মাঝে ছুটে বেড়াতে কী মজাই-না লাগে!

বকুল বাড়িতে বাইনোকুলার রেখে আবার যখন নদীর তীরে এসে হাজির হল তখন আকাশের অর্ধেক মেঘে ঢেকে গেছে, একটু আগে দিনটা ছিল আলো ঝলমল, এখন কেমন যেন অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। চারিদিকে থমথমে একটা ভাব, এতটুকু বাতাস নেই। নদীর পানিতে কেমন যেন কালচে একটা রং চলে এসেছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে তীরে আঘাত করছে। বকুল নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, একটু আগেও কতকগুলো নৌকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, এখন চারদিক ফঁকা। আকাশে কিছু পাখি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। মনে হয় পাখিগুলো মানুষ থেকেও আগে বুঝতে পারে কিছু-একটা হতে যাচ্ছে।

বকুল নদীর তীরে হাঁটতে থাকে, অন্যদিন হলে আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চা জুটে যেত কিন্তু আজকে কেন জানি কেউ নেই। বকুল আবার আকাশের দিকে তাকাল, মেঘটা এখন পুরো আকাশকে ঢেকে ফেলেছে, আর কী ঘন কালো মেঘ, মনে হয় যেন কুচকুচে কালো ধোঁয়া। মেঘটা থেমে নেই, জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যাচ্ছে। মেঘের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি উঁকি দিচ্ছে, কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব। বকুলের ভিতরে কেমন জানি একধরনের উত্তেজনার ভাব হয়–ভয়ের একটা ব্যাপার তার কেন এরকম আনন্দ আর উত্তেজনা হয় কে জানে!

নদীর পানিতে ঢেউটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, কালো পানিতে একটা থমথমে ভাব, হঠাৎ হঠাৎ এসে তীরে আঘাত করছে। বকুল হিজল গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে বাতাসের একটা ঝাঁপটা অনুভব করল। ইতস্তত দমকা হাওয়া শুকনো পাতা ধুলোবালি খড়কুটো উড়তে থাকে। পশুপাখির চিৎকার শোনো যায়–চারিদিকে একটা ছুটোছুটি এবং তার মাঝে হঠাৎ কড়াৎ করে খুব কাছে যেন বাজ পড়ল। সাথে বিদ্যুতের ঝলকানিতে চারদিক আলো হয়ে ওঠে। দমকা বাতাসের বেগ বাড়ছে, শোঁ শোঁ আওয়াজ হতে থাকে এবং হঠাৎ আবার বিদ্যুৎ ঝলকানির সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দ করে খুব কাছাকাছি কোথাও আরও একটা বজ্রপাত হল। ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, প্রথমে ছাড়াছাড়াভাবে একটু পরে একটানা। বৃষ্টির ঝাঁপটায় বকুল এক নিমিষে ভিজে চুপসে গেল। কী ভালোই না লাগে তার বৃষ্টিতে ভিজতে!

বাতাসের বেগ বাড়ছে তার সাথে বৃষ্টি। এমনিতে বৃষ্টির ফোঁটার মাঝে কোমল আদর করার একটা ভাব আছে কিন্তু ঝড়ের সময় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হয় রাগী আর তেজি। শরীরের মাঝে এসে বেঁধে তীরের মতো। বকুল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নদীর তীরে হাঁটতে থাকে, বাতাস মনে হয় তাকে উড়িয়ে নেবে কিন্তু সে পরোয়া করে না। দুই হাত উপরের দিকে তুলে চিৎকার করে বলে, “জোরে! আরও জোরে!”

আরও জোরে ঝড় আসে, বিদ্যুতের ঝলকানির সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দ করে বজ্রপাত হচ্ছে, আকাশ চিরে আলোর ঝলকানি নেমে আসছে নিচে। নদীর কালো পানি প্রচণ্ড আক্রাশে যেন ফুঁসে উঠছে, ভেঙেচুরে যেন ধ্বংস করে দেবে চারিদিক।

বকুল নদীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঝড়ের শব্দ শুনতে থাকে, হঠাৎ করে সে ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে আরও একটা শব্দ শুনল–স্পিডবোটের ইঞ্জিনের শব্দ। শব্দটি একটানা নয়, ছাড়াছাড়া–মনে হচ্ছে নদীর ঢেউ আর ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করতে করতে স্পিডবোটটা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এই প্রচণ্ড ঝড়ে পুরোপুরি মাথা খারাপ না হলে কেউ নদীতে স্পিডবোট চালানোর চেষ্টা করে? বিদেশি সাহেবটা নিশ্চয়ই এই দেশের কালবৈশাখীর কথা শোনেনি! বুঝতেই পারেনি এত তাড়াতাড়ি এত বড় ঝড় শুরু হতে পারে।

বকুল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে স্পিডবোটটা দেখার চেষ্টা করল, ঝড় বৃষ্টি, ফুলে ওঠা ঢেউয়ের জন্যে কিছুটা দেখা গেল না। আকাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টির ছাটে চোখ খুলে রাখা যায় না। আবার আকাশ চিরে একটা বিদ্যুতের ঝলকানি নিচে নেমে এল আর সেই আলোতে বকুল দেখতে পেল নদীর মাঝামাঝি স্পিডবোটটা প্রচণ্ড ঢেউয়ে ওলটপালট করছে। ভিতর মানুষ আছে কি নেই সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।

স্পিডবোটের ইঞ্জিনটা আবার একবার শব্দ করল, তারপর আবার ক্ষীণ হয়ে প্রায় থেমে গেল। একটু পরে আবার একটু গর্জন করে উঠল, বিদ্যুতের আলোতে আবার দেখতে পেল স্পিডবোটটা বিশাল ঢেউয়ের উপর অসহায়ভাবে নাচানাচি করছে।

“স্পিডবোটটা নিশ্চয়ই ডুবে যাবে–” বকুল ফিসফিস করে বলল, “হে খোদা, তুমি মানুষগুলোকে বাঁচাও!”

প্রচণ্ড ঝড়ে নিজেকে কোনমতে স্থির করে রেখে বকুল তীক্ষ্ণচোখে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে, বড় ঝড় হলে আজান দেওয়া শুরু হয়, বকুল কান পেতে শুনতে পেল মণ্ডলবাড়ি থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দ, বিদ্যুৎ, বজ্রপাত, বৃষ্টির মাঝে, মানুষের আর্তচিৎকারের মাঝে আজান শুনলে কেমন জানি আতঙ্কের মতো হয়। বকুল সেই ভয়ংকর পরিবেশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল, আরেকবার বিজলি চমকানোর সাথে সাথে বকুল দেখল স্পিডবোটটি নেই।

বকুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, প্রচণ্ড ঝড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তার রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে, বৃষ্টির ছাঁটে চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না তবু সে চোখ খুলে তাকিয়ে রইল পরের বিদ্যুঝলকের জন্যে। সত্যি সত্যি আরেকবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলে বকুল দেখল স্পিডবোটটি নেই, নদীর প্রবল ঢেউয়ে দুজন মানুষের মাথা ভাসছে, হাত নড়ছে কিছু-একটা ধরে ভেসে থাকার চেষ্টায়। স্রোতের টানে মানুষগুলো ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণে। শুধু তাই নয়, বকুলের মনে হল ঝড়ের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ আর বাতাসের শব্দ ছাড়িয়ে সে শুনতে পেল মানুষের আর্তচিৎকার।

ডুবে যাবে মানুষগুলো-বকুলের মাথায় বিদ্যুঝলকের মতো খেলে গেল, কিছু একটা করা না গেলে মানুষ দুটি ভেসে যাবে, কেউ আর তাদের বাঁচাতে পারবে না। এই প্রচণ্ড ঝড়ে মানুষ দুজন কিছুতেই সাঁতরে তীরে আসতে পারবে না, ঢেউয়ের ধাক্কায় শেষ হয়ে যাবে দুজনে। কিছু-একটা করতে হবে বকুলের।

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল বকুল, কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে কেউ তার চিৎকার শুনতে পারল না। শুনতে পেলেও কিছু লাভ হত না, এই প্রচণ্ড ঝড়ে কে যাবে তাদের উদ্ধার করতে?

“টুশকি!” হঠাৎ করে বকুলের টুশকির কথা মনে পড়ল। শুধুমাত্র টুশকিই পারবে তাদের বাঁচাতে–এই প্রচণ্ড ঝড়ে তাদের কাছে সাঁতরে যেতে পারবে শুধু টুশকি। বকুল ছুটে গেল হিজল গাছটার কাছে, ঝড়ে ডালগুলো নড়ছে মনে হচ্ছে, যে-কোন মুহূর্তে বুঝি হুমমুড় করে ভেঙে আছড়ে পড়বে নদীর কালো পানিতে। বৃষ্টিতে ভিজে পিছল হয়ে আছে গাছটি, সাবধানে নিচের ডালে উঠে দাঁড়াল বকুল, বাতাসের ঝাঁপটায় সে পড়ে যেতে চাইছে নিচে, তার মাঝে শক্ত করে ধরে রাখল মোটা ডালটা। চাবুকের মতো ছুটে আসছে সরু ডালগুলো, শরীর নিশ্চয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তার–বুঝতে পারছে না এখন।

গাছের ডালের নিচে নেমে এসে ডালটাকে ঝাঁকাতে লাগল গায়ের জোরে, পানিতে ডালগুলো শব্দ করতে লাগল। টুশকিকে ডাকতে হলে সে এখানে এসে ডালগুলোকে ঝাঁকিয়ে শব্দ করে। কখনোই সমস্যা হয়নি আগে, প্রত্যেকবারই ডেকে এসেছে টুশকিকে। কিন্তু এখন এই ঝড়ের প্রচণ্ড উথালপাতাল শব্দে কি টুশকি শুনতে পাবে পানিতে ডাল ঝাঁপটানোর শব্দ? আসবে কি টুশকি?

হিজল গাছের ডালটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বকুল যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল ঠিক তখন হঠাৎ নদীর কালো পানির মাঝে থেকে ভুস করে টুশকি বের হয়ে এল।

“টুশকি!” বকুল চিৎকার করে বলল”টুশকি! এসেছ?”

টুশকি বকুলর কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু পানিতে ঘুরে এসে আবার ভুস করে ভেসে উঠে লাফিয়ে উপরে উঠে এল। ঝড়ের মাঝে বকুলের যেরকম আনন্দ হয়, টুশকিরও ঠিক সেরকম আনন্দ হয় বলে মনে হচ্ছে।

“টুশকি! আমি আসছি–”বলে বকুল নদীর ফুঁসে ওঠা কালো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্ধকার পানিতে ডুবে যাওয়া সাথে সাথে হঠাৎ করে ঝড়ের প্রবল গর্জন, বাতাসের শব্দ বৃষ্টির ছাঁট সবকিছু অদৃশ্য হয়ে একটা সুমসাম নীরবতা নেমে এল চারপাশে। পানির নিচে ডুবে থেকে আবার ডাকল বকুল”টুশকি!” মুখ থেকে বাতাসের বুদ্বুদ বের হয়ে এল তার কথার সাথে সাথে।

বকুল হঠাৎ তার নিচে টুশকির মসৃণ শরীরের স্পর্শ অনুভব করল, সাথে সাথে জাপটে ধরে পা দিয়ে পেটে একটা খোঁচা দিল টুশকিকে। টুশকি বকুলকে পিঠে নিয়ে ছুটে গিয়ে পানির উপরে লাফিয়ে উঠে আবার পানিতে আছড়ে পড়ল। টুশকি ভাবছে বকুল বুঝি তার সাথে খেলার জন্যে তাকে ডেকে এনেছে।

বকুল টুশকির গলা জড়িয়ে ধরে মাথার কাছে বারকয়েক থাবা দিল, চাপা গলায় চিৎকার করে বলল, “সামনে, সামনে চল। মানুষ ডুবে যাচ্ছে।”

টুশকি বকুলের কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না কিন্তু হঠাৎ গতি পালটে নদীর গভীরের দিকে রওনা দিল। প্রচণ্ড ঝড়ে মনে হচ্ছে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, পানির ঢেউয়ের আঘাতে তলিয়ে নিচ্ছে সবকিছু, তার মাঝে তীরের মতো ছুটে যেতে থাকল টুশকি, তার গলা ধরে শক্ত করে ঝুলে রইল বকুল।

মানুষ দুটি ভেসে ভেসে যেখানে চলে যেতে পারে মোটামুটি সেদিকে ঘুরিয়ে নিতে থাকে টুশকিকে। পানির নিচে দিয়ে যেতে চায় মাঝেমাঝেই–নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতেই খোঁচা দিয়ে টুশকিকে উপরে তুলে আনতে হয় তখন নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে। প্রচণ্ড ঢেউ বৃষ্টির ঝাঁপটা আর বাতাসের শেশো শব্দের মাঝে বকুল টুশকির পিঠে করে ছুটে যেতে থাকে। নদীর মাঝামাঝি পানির প্রচণ্ড স্রোত, বকুল মাথা তুলে তাকাল, কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না খোঁজার চেষ্টা করল কিন্তু কেউ নেই। বকুল টুশকির পিঠে থাবা দিয়ে আবার ছুটে চলল সামনে, গোল হয়ে ঘুরে এল একবার, এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বকুল মাথা তুলে চিৎকার করে একবার ডাকল, “কোথায়? কোথায় কে?”

সাথে সাথে মানুষের ক্ষীণ একটা চিৎকার শুনতে পেল, “এই যে এখানে।”

বকুল গলার আওয়াজের শব্দ লক্ষ্য করে টুশকিকে সেদিকে নিয়ে যেতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে মানুষ দুজনকে দেখতে পায়, নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে দুজনে। হুটোপুটি করে তার মাঝে ভেসে থাকার চেষ্টা করছে কোনো রকমে, বকুল চিৎকার বলল, “আসছি আমি।”

টুশকি প্রথমে অপরিচিত মানুষ দুজনের কাছে যেতে রাজি হচ্ছিল না, বকুলকে বারকতক চেষ্টা করে তাকে রাজি করাতে হল। টুশকি কাছে যেতেই একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে টুশকিকে ধরতেই টুশকি গা-ঝাড়া দিয়ে পানির নিচে ডুবে গেল। বকুল টুশকিকে ছাড়ল না,পা দিয়ে পেটে খোঁচা দিয়ে আবার তুলে আনল উপরে। বকুল আবার টুশকিকে কাছে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার হাত ধরেন।”

মানুষটা তার হাত জাপটে ধরল। বকুল মানুষটাকে কাছে টেনে এনে চিৎকার করে বলল, “টুশকির গায়ে হাত দেবেন না–আপনাকে চেনে না, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে।”

বৃষ্টি আর ঝড়ের শব্দে বকুলের কথা শুনতে পেল না মানুষটা, চিৎকার করে বলল, “কী?”

বকুল আবার বলল চিৎকার করে, মানুষটা এবারে কথা বুঝতে পারল। বকুল এবারে দ্বিতীয় মানুষটার কাছে নিয়ে গেল টুশকিকে। পানিতে ভেসে যাবে না, কেউ-একজন এসেছে সাহায্য করতে এই ব্যাপারটাতেই মানুষ দুজন খুব সাহস ফিরে পেয়েছে। বকুল টুশকিকে নিয়ে কাছে গেলে বিদেশী সাহেবটা সাবধানে বকুলের শরীরে ঝাঁপটে ধরল। বকুল তখন টুশকিকে ইঙ্গিত দিতেই সেটা তীরের দিকে সাঁতার কাটতে থাকে।

দুষ্টুমি করার জন্যে কি না কে জানে মাঝেমাঝেই টুশকি পানির গভীরে চলে যাচ্ছিল, যখন ওদের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছিল তখন আবার ভুস করে পানির উপরে উঠে আসছিল। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে তীরে আসতে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল, ততক্ষণে ঝড়ের বেগ একটু কমেছে, নদীর তীরে বেশকিছু মানুষ জমা হয়েছে ব্যাপারটি দেখার জন্যে। হিজল গাছের নিচে এসে টুশকি পানিতে ডুবে গেল, মানুষ দুজন তখন বকুলকে ছেড়ে দিয়ে কোনমতে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করে। নদীতীরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা এসে মানুষ দুজনকে টেনে উপরে তুলে নিয়ে আসে। নদীতীরে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে যায়, তাদের দুজনকে কোথায় নেবে কী করবে সেটা নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা হতে থাকে। বকুল সেটা দেখার জন্যে আর দাঁড়াল না। একটু আগে সে যেটা করেছে তার জন্যে বাড়িতে বাবা-মার কাছে তার যে কপালে অনেক দুঃখ আছে সেটা বুঝতে বকুলের খুব দেরি হল না।

ঝড়টা যেরকম হঠাৎ করে এসেছে ঠিক সেরকম হঠাৎ করে থেমে গেল। সারা গ্রামে অবিশ্যি ভাঙা গাছ, পাতা উড়ে আসা ছাউনি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র পড়ে রইল। এই ভয়ংকর ঝড়ের মাঝে বকুল কী করেছে যখন সবে মাত্র সেই খবরটা বের হতে শুরু করেছে এবং বাবা-মা বড়চাচা বকুলকে বকাবকি করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন তখন উত্তেজিত শরিফ এসে খবর দিল একজন বিদেশি সাহেব আর একজল্ল দেশি সাহেব বকুলের সাথে দেখা করতে চায়।

বকুল সাথে সাথে বুঝতে পারল মানুষগুলো কে এবং কেন এসেছে। সে বাইরে বের হয়ে এল, মানুষ দুজনকে ঘিরে গ্রামের অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে, ছোট ছোট বাচ্চারা বেশ অবাক হয়ে বিদেশি সাহেবটাকে দেখছে, তারা হাফপ্যান্ট পরা এরকম বিচিত্র গোলাপি রঙের মানুষ আগে কখনো দেখেনি।

দেশি সাহেবটা এগিয়ে এসে বলল, “এই মেয়ে–তু–তুই বুঝি শুশুক নিয়ে আমাদের কাছে গিয়েছিলি?”

লোকটার কথার ভঙ্গি শুনে বকুলের মাথার মাঝে একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ হল। ইচ্ছে হল লাফিয়ে গিয়ে মানুষটার টুটি চেপে ধরে। বিদেশি সাহেবটা ইংরেজিতে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এই মেয়েটাই। সাহসী মেয়ে। চালাক মেয়ে।”

দেশি সাহেবটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ভেজা মানিব্যাগ বের করে, সেখানে থেকে ভেজা দুটি পাঁচশো টাকার নোট বের করে বকুলের দিকে এগিয়ে দিল। বকুলের ইচ্ছে করল খামচি দিয়ে মানুষটার মুখ রক্তাক্ত করে দেয়, কিন্তু সে কিছুই করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

মানুষটি বলল, “নে।”

বকুল চারিদিকে তাকাল, অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তাদের ঘিরে। বামদিকে মণ্ডলবাড়ির সাদাসিধে কামলা বদিও আছে, চোখেমুখে সরল একটা বিস্ময় নিয়ে দেখছে। বকুল হাত বাড়িয়ে, টাকাটা নিয়ে বদির দিকে এগিয়ে দিতেই বদি এগিয়ে এসে লোভীর মতো ছোঁ মেরে নোট দুটি নিয়ে নিল। দেশি সাহেব আহত গলায় বলল, “এটা বিশ টাকার নোট না, পাঁচশ টাকার নোট!”

বকুল বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “বদি ভাই, এগুলো পাঁচশো টাকার নোট।”

দেশি সাহেবটা অবাক হয়ে বকুলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে অপমানের একটা ছায়া পড়েছে। মানুষটা বকুলের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “তু-তু-তুই–”

বকুল মুখ শক্ত করে বলল, “তুই না। তুমি।”

মানুষটির মুখ অপমানে লাল হয়ে যায়। একবার ঢোক দিলে বলল, “মানে বলছিলাম আমার ব্যাগে আসলে টাকা নেই–তাই মানে তোকে–মানে তোমাকে”

বকুল বলল, “আপনার সাথে আমার কথা বলার সময় নেই, স্কুলের পড়া করতে হবে–আমি গেলাম।”

তারপর মানুষটাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে আসে, রাগে দুঃখে অপমানে তার চোখে পানি এসে যেতে চায়। তাকে ঘিরে যদি এতগুলো মানুষ না থাকত তা হলে সে কি খামচি দিয়ে লোকটার মুখ আঁচড়ে দিত না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *