বকুলাপ্পু
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এভাবে।
চন্দ্রা নদী তীর ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে এসে পলাশপুর গ্রামের বড় হিজল গাছটা পর্যন্ত এসে হঠাৎ করে থেমে গেল। হিজল গাছটার অর্ধেক তখন শূন্যে নদীর কালো পানির উপর ঝুলছে, বাকি অর্ধেক কোনভাবে মাটি কামড়ে আটকে আছে–দেখে মনে হয় যে-কোনমুহূর্তে পুরো গাছটা বুঝি পানিতে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। এই গাছটা ছিল পলাশপুর গ্রামের বাচ্চাকাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় গাছ। তারা এর মোটা ডাল বেয়ে উপরে উঠত, মাঝারি ডালগুলোতে ঘোড়ার মতো চেপে বসে দুলত, সরু ডালগুলো ধরে ঝুল খেয়ে নিচে লাফিয়ে নামত। নদীর ভাঙনের মাঝে পড়ে যাওয়ায় প্রথম প্রথম বাচ্চারা কেউ এই গাছে উঠতে সাহস করত না। এক-দুই দিন যাবার পর গ্রামের দুর্দান্ত আর ডানপিটে কয়েকজন একটু একটু করে গাছটায় আবার ওঠা শুরু করল, কিন্তু ঠিক তখন জমিলা বুড়ি একদিন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে হিজল গাছটা নিয়ে তার বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণীটা ঘোষণা করল। তারপর আর কাউকে হিজল গাছের ধারেকাছে দেখা যায়নি।
এই এলাকার সবাই জানে জমিলা বুড়ির বয়স কম করে হলেও একশো পঞ্চাশ, তার কমপক্ষে এক ডজন পোষা জ্বীন আর পরী রয়েছে এবং জোস্নারাতে সে ‘গাছ-চালান’ দিয়ে শ্যাওড়া গাছে বসে আকাশে উড়ে বেড়ায়। তার মাথার চুল পাটের মতো সাদা, এই গ্রামের যারা থুরথুরে বুড়ো তারাও দাবি করে যে জন্মের পর থেকেই তারা জমিলা বুড়ির পাকা চুল দেখে আসছে। মানুষের বয়স বেশি হয়ে গেলে মাথার চুল পাতলা হয়ে যায়, কিন্তু জমিলা বুড়ির মাথাভরা সাদা চুল এবং সে দুই হাতে সবসময় তার মাথার চুল বিলি কাটতে থাকে। বয়স বেশি হওয়ার কারণে সে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, হাতে একটা লাঠিতে ভর দিয়ে কেমন জানি ভঁজ হয়ে দাঁড়ায়। জমিলা বুড়ির লাঠি নিয়েও নানারকম গল্প রয়েছে–অনেকেই মনে করে এটা আসলে একটা শঙ্খচূড় সাপ, জমিলা বুড়ি জাদু করে লাঠি তৈরি করে রেখেছে। কবে নাকি এক চোর জমিলা বুড়ির কুঁড়েঘরে চুরি করতে গিয়েছিল, তখন বুড়ি তার লাঠি ছুঁড়ে দিতেই সেটা ফণা তুলে চোরকে ধাওয়া করেছিল, কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে সেই চোর। জমিলা বুড়ির পিঠে থাকে তালি-দেওয়া একটা ঝোলা। সেই ঝোলার ভিতরে কী থাকে সেটা নিয়েও নানারকম গবেষণা হয় যদিও সবাই একমত হতে পারে না। কেউ বলে ছোট ছোট বাচ্চাদের জাদু করে ইঁদুর নাহয় ব্যাঙে পালটে ফেলে সে ঝোলার মাঝে রেখে দেয়, কেউ বলে, তার ঝোলার মাঝে আটকা পড়ে আছে বেয়াদব ধরনের কিছু জ্বীন। জমিলা বুড়ি সবসময় বকবক করে কথা বলছে, দেখে মনে হতে পারে সে বুঝি নিজের সাথে কথা বলে, কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষেরা দেখেই বুঝতে পারে যে সে তার পোষা জ্বীনদের সাথে কথা বলছে। কী বলছে সেটা অবিশ্যি বোঝা খুব কঠিন, দাঁতহীন ভোবড়ানো মুখের কথা শোনা গেলেও ঠিক বোঝা যায় না।
ছোট ছোট বাচ্চারা জমিলা বুড়ি থেকে দূরে দূরে থাকে, কোন্ সময় তাদের ধরে তার ঝোলার মাঝে ঢুকিয়ে নেবে সেই ভয়ে তারা ধারেকাছে আসে না। যারা একটু বড় এবং একটু বেশি সাহসী তারা মাঝে মাঝে জমিলা বুড়িকে দেখলে দূর থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, ‘জমিলা বুড়ি জমিলা বুড়ি–পাস না ফেল?’
জমিলা বুড়ি সাধারণত এইরকম প্রশ্নের উত্তর দেয় না, আপন মনে বিড়বিড় করে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ কখনো কখনো ফোকলা-মুখে ফিক করে হেসে বলে, ‘পাস’। যাকে বলে তখন তার আনন্দ দেখে কে, জমিলা বুড়ি বলেছে ‘পাস’ অথচ সে পরীক্ষায় পাস করেনি এরকম ঘটনা পলাশপুর গ্রামে এখনও ঘটেনি।
সবাইকেই যে জমিলা বুড়ি ‘পাস’ বলে তা নয়। মাঝে মাঝে তার মেজাজ গরম থাকে, তখন সে তার লাঠি নিয়ে তাড়া করে বলে, ‘ফেল ফেল তোর চৌদ্দগুষ্ঠি ফেল। যাদেরকে এরকম অভিশাপ দেওয়া হয় তারা সাধারণত পড়াশোনা করা ছেড়ে দেয়। দেখা গেছে তারা শুধু যে পরীক্ষায় ফেল করে তাই নয় তাদের বাবারা মামলায় হেরে যায়, চাচাঁদের বাড়িতে চুরি হয়, মামাদের গরু মরে যায়, বোনদের বিয়ে হয় না (যদিবা বিয়ে হয় যৌতুক নিয়ে জামাইয়েরা বউদের মারধর করে)–এক কথায় তাদের জীবনে এই ধরনের হাজারো রকম ঝামেলা শুরু হয়ে যায়।
এই জমিলা বুড়ি একদিন নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হিজল গাছটাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। যারা আশেপাশে ছিল তারা দেখল জমিলা বুড়ি গাছটাকে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করল এবং গাছ যে উত্তরটা দিল সেটা তার পছন্দ হল না বলে লাঠি নিয়ে ঠুকঠুক করে হেঁটে হেঁটে কাছে গিয়ে গাছকে কষে লাথি দিয়ে গালিগালাজ করতে শুরু করল। গাছের সাথে জমিলা বুড়ির কী নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে সেটা সাধারণ মানুষদের পক্ষে বোঝা কঠিন, কিন্তু তাদের দুজনের মাঝে যে খুব রাগারাগি হচ্ছে সেটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ রইল না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল জমিলা বুড়ি তার লাঠি তুলে গাছকে অভিশাপ দিল, আগামী ‘চান্দের’ আগে এই গাছ নদীতে ভেসে যাবে। শুধু তাই না, এই গাছ যখন পানিতে হুড়মুড় করে পড়বে তখন একজন মানুষের জান কবজা করে নিয়ে যাবে।
যে-গাছ নতুন চাঁদ ওঠার আগে একজন মানুষের জান নিয়ে নদীর পানিতে ধসে পড়বে সেই গাছের ধারেকাছে যে কেউ যাবে না তাতে অবাক হবার কী আছে? কাজেই পলাশপুর গ্রামের বিশাল হিজল গাছটা অর্ধেক ডাঙায় আর অর্ধেক নদীর পানির উপর বিস্তৃত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, একসময় যার ডালে ডালে ছোট ছোট বাচ্চারা লাফঝাঁপ দিত এখন সেটি জনশূন্যে নির্জন, সেখানে কেমন যেন চাপা ভয়-ধরানো থমথমে ভাব। গাছে ওঠা দূরে থাকুক তার নিচেও কেউ যায় না।
একেবারে কেউই কখনো হিজল গাছটার নিচে যায়নি সেটা অবিশ্যি পুরোপুরি সত্যি নয়, কাজীবাড়ির ছোট মেয়ে বকুলকে এক দুই বার সেই গাছের নিচে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে।
বকুল কাজীবাড়ির মেজো ছেলের ছোট মেয়ে। তার বয়স বারো। তাই বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে এবং তারা সুখে সংসার করছে। তার বড় দুলাভাইয়ের সদরে মনোহারী দোকান রয়েছে, মেজো দুলাভাই ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার। বকুলের ছোট ভাই শরিফ নেহায়েৎ শান্তশিষ্ট ছেলে, বড় হয়েও যে সে শান্তশিষ্ট থাকবে এবং একটা স্কুলের (কিংবা কে জানে হয়তো কলেজের) মাস্টার হয়ে যাবে সেটা নিয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই। তবে বকুলকে নিয়ে কী হবে সে-ব্যাপারে শুধু কাজীবাড়ির নয় পুরো পলাশপুর গ্রামের সব মানুষের মনে সন্দেহ রয়েছে। তার বয়স বারো, আর কয়েক বছরের মাঝেই এই গ্রামের নিয়মে তার বিয়ের বয়স হয়ে যাবে কিন্তু বকুলের কথাবার্তা আচার আচরণে তার কোন ছাপ নেই। তার সমবয়সী কোন মেয়ের সাথে তার ভাব নেই, সে ঘোরাফেরা করে ছেলেদের সাথে। তার মতো ফুটবল কেউ খেলতে পারে না, মারবেল খেলে সে এলাকার সবাইকে ফতুর করে দিয়েছে। চোখের পলকে সে যে-কোনো গাছের মগডালে উঠে পড়তে পারে, বর্ষাকালে বানের পানিতে যখন চন্দ্রা নদী ফুলেফেঁপে ওঠে তখন সে আড়াআড়িভাবে সাঁতরে নদী পার হয়ে যায়। পলাশপুর গ্রামে কোন হাইস্কুল নেই বলে বড় বড় সব মেয়ের পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু বকুল একরকম জোর করে পাঁচ মাইল দূরে হাইস্কুলে পড়তে যায়। ভোরবেলা সে পলাশপুর গ্রামের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায়, স্কুলে যাবার এবং সেখান থেকে ফেরার সময় সড়কের দুই পাশের গাছপাছালি, পুকুর, খাল, বিল সবকিছু চষে বেড়ায়।
বকুলের সমবয়সী মেয়েরা, যারা কয়েক বছরের মাঝে বিয়ে করে ঘর-সংসার করার জন্যে রান্নাবান্না আর ঘর-সংসারের কাজকর্ম শিখছে তারা বকুলের কাজকর্মের কথা শুনে একেবারের হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেও ভিতরে ভিতরে সবসময় কেমন যেন হিংসা অনুভব করেছে।
বকুলকে যারা পছন্দ করে তাদের সংখ্যা খুব কম নয়। তাদের বেশির ভাগের বয়স পাঁচ থেকে দশের মাঝে। তারা একেবারে বাধ্য সৈনিকের মতো বকুলের পিছনে পিছনে ঘোরে, বকুল তার এই অনুগত ভক্ত ছেলেমেয়েদেরকে মারতে হয় তার কায়দা-কানুন তাদের বাড়ির পিছলছল। তার ছিপছি কেমন করে গাছে চড়তে হয় শেখায়, নদী সাঁতরে পার হওয়া শেখায়, পাখির বাচ্চা ধরে এনে দেয়, গুলতি তৈরি করে দেয়, ফুটবল খেলায় কেমন করে ল্যাং মারতে হয় আবার অন্য কেউ ল্যাং মারার চেষ্টা করলে কীভাবে লাফিয়ে পাশ কাটাতে হয় তার কায়দা-কানুন হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেয়।
এই বকুল ভরদুপুরবেলা তাদের বাড়ির পিছনের পেয়ারা গাছের মগডালে থেকে একটা উঁশা পেয়ারা ছিঁড়ে নিচে নেমে আসছিল। তার ছিপছিপে শরীরে প্রায় কাঠবেড়ালির মতো গাছ বেয়ে ওঠা এবং নামা হিংসার চোখে দেখতে দেখতে পাশের বাড়ির সিরাজ একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মেয়েছেলেদের গাছে ওঠা ঠিক না।”
বকুল নেমে গাছের মাঝামাঝি মসৃণ একটা ডালে পা ঝুলিয়ে বসে পেয়ারায় একটা বড় কামড় দিয়ে বলল, “মেয়ে আবার ছেলে হয় কেমন করে? আর কী হয় মেয়েরা গাছে উঠলে?”
সিরাজ গম্ভীর হয়ে বলল, “দোষ নয়। মেয়েছেলেদের কাজ হচ্ছে ঘর সংসারের কাজ।”
বকুল গাছের ডালে বসে থেকে পিচিক করে নিচে থুতু ফেলে বলল, “তোকে বলেছে! মেয়েরা আজকাল পকেটমার থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবকিছু হয় তুই জানিস?”
মেয়েরা প্রধানমন্ত্রী হয় শুনে সিরাজ বেশি অবাক হল না, কিন্তু পকেটমার হয় শুনে সে চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি? মেয়েরা পকেটমারও হয়?”
বকুল তার মাথার এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে বলল, “খালি পকেটমার? আজকাল মেয়ে-ডাকাত পর্যন্ত হয়! জরিনা ডাকাতের নাম শুনিসনি?”
সিরাজ নামটা শোনেনি, কিন্তু ছেলে হয়ে মেয়েদের এত বড় বীরত্বের কাহিনীটা সে এত সহজে মেনে নেবার পাত্র নয়, মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু সাহসের কাজ বেশি করে ছেলেরা!”
বকুল তার গাছের উপর থেকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “কচু! ছেলেরা যখন একটা সাহসের কাজ করে মেয়েরা তখন করে একশোটা!”
“কে বলছে?”
“বলবে আবার কে? সবাই জানে। পৃথিবীর যত মানুষ আছে সবার জন্ম হয়েছে মায়ের পেট থেকে। বাচ্চা জন্ম দেওয়া কত বড় সাহসের কাজ তুই জানিস? আছে কোন ব্যাটা ছেলে যে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে? আছে?”
সিরাজ খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “কিন্তু—”
“কিন্তু আবার কী? জানা কথা মেয়েদের সাহস বেশি, ছেলেদের কম। জমিলা বুড়ি হচ্ছে মেয়ে আর তাকে দেখে সব ছেলে কাপড়চোপড়ে–হি হি হি …” বকুল কথা শেষ না করে খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।
বকুল যে-ঘটনাটা মনে করে হাসতে শুরু করেছে সেই ঘটনার নায়ক সিরাজ নিজে। সে যখন ছোট হঠাৎ একদিন জমিলা বুড়িকে দেখে ভয় পেয়ে পরনের কাপড় ছোট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছিল, এতদিন পরেও কারণে-অকারণে সেটা মনে করিয়ে তাকে নানাভাবে অপদস্থ করা হয়। কাজেই সিরাজ বকুলর কথাটা খুব সহজভাবে নিল না। চোখমুখ লাল করে বলল, “তার মানে তুই বলতে চাস তুই জমিলা বুড়িকে ভয় পাস না?”
বকুল পেয়ারার শেষ অংশ মুখে পুরে কচকচ করে চিবুতে চিবুতে বলল, “একটা বুড়িকে আবার ভয় পাবার কী আছে?”
“তার মানে তার মানে–সিরাজ রাগের চোটে তার কথা শেষ করতে পারে না। বকুল গাছের সরু ডালে একটা দোল খেয়ে নিচে নামতে নামতে বলল, “তার মানে কী?”
“তার মানে তুই জমিলা বুড়ির কথা বিশ্বাস করিস না?”
“পাগল মানুষের কথা বিশ্বাস করলেই কি আর না-করলেই কী?”
“তুই বলতে চাস, তুই—তুই–”
“আমি কী?”
“তুই হিজল গাছে উঠতে পারবি?”
বকুল একটু চমকে উঠল। যখন জমিলা বুড়ি আশেপাশে নেই তখন তাকে অবিশ্বাস করা, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা এক কথা, আর যে-গাছটি একজন মানুষের জান কবজা করে পানিতে ভেসে যাবে সেই গাছে ওঠা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। বকুল থতমত খেয়ে চুপ করে রইল, তাই সিরাজে মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে, সে চোখ ছোট ছোট করে বলল, “পারবি না, না?”
বকুল একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “কে বলেছে পারব না?”
সিরাজের চোখ গোল হয়ে যায়, “পারবি? হিজল গাছে উঠতে পারবি?”
“একশো বার।”
সিরাজ খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বকুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মিছিমিছি বলছিস, তাই না?”
“মিছিমিছি বলব কেন? চল আমার সাথে তোকে দেখাই!”
সিরাজ হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল, বলল”থাক, দরকার নেই।”
বকুলের মুখ আরও শক্ত হয়ে যায়, “কেন দরকার নেই? ভাবছিস আমি ভয় পাব? কখনো না! আয় আমার সাথে।”
এবারে সিরাজ আরও ঘাবড়ে গেল, বলল, “ঠিক আছে যা, আমি বিশ্বাস করেছি তুই পারবি।”
“কেন তুই মিছিমিছি বিশ্বাস করবি? আয় আমি সত্যি সত্যি উঠে দেখাই।”
কাজেই ভরদুপুরবেলা বকুলের পিছুপিছু সিরাজ নদীর দিকে রওনা দিল। বাড়ির বাইরে আসতেই আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চা পাওয়া গেল। কী করা হবে শুনতে পেয়ে তাদের আত্মা শুকিয়ে গেল, তারাও নানাভাবে বকুলকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু কিছু-একটা বকুলের মাথায় ঢুকে গেলে সেটাকে বের করে আনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। যখন বোঝা গেল সত্যি সত্যি বকুল হিজল গাছে উঠবেই তখন তারাও সাথে রওনা দিল–অন্তত ব্যাপারটা চোখে দেখা যাক। একজন মানুষ জীবনে আর কয়টা সাহসের কাজ দেখার সুযোগ পায়?
নদীর ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের দল ভারী হয়ে আসে, দূর থেকে দেখে সেটাকে একটা ছোটখাটো মিছিলের মতো মনে হতে থাকে। সবার সামনে বকুল তার পিছুপিছু সিরাজ এবং তার পিছনে নানা বয়সের বাচ্চাকাচ্চা। খবর পেয়ে বকুলের ছোট ভাই শরিফও চলে এসেছে, সে অনেকক্ষণ থেকে বকুলকে বুঝিয়েও কোনো সুবিধে করতে না পেরে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “আমি কিন্তু বাবাকে বলে দেব।”
বকুল উদাস গলায় বলল, “যা, বলে দে। তারপর দেখ তোকে আমি কী ধোলাই দিই।”
শরিফের বয়স আট, তার এই আট বছরের জীবনে সে তার বাবার ওপরে যেটুকু নির্ভর করে তার থেকে অনেক বেশি নির্ভর করে বকুলের উপর। কাজেই সে যে বকুলের ভোলাই খেতে চাইবে না সেটা বকুল খুব ভালো করে জানে।
শেষ পর্যন্ত দলটি হিজল গাছের কাছে হাজির হল। সবাই দূরে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, ভয় এবং উত্তেজনায় তারা নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলতে ভুলে গেছে। বকুল ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে কোমরে শক্ত করে বেঁধে প্রায় ছুটে এসে একটা ডাল ধরে নিজেকে ঝুলিয়ে একটা হ্যাঁচকা টানে উপরে উঠে গেল। দূরে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই একসাথে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দেয়। বকুল তরতর করে আরও খানিকটা উপরে উঠে হাত তুলে বলল, “কী দেখলি?”
সিরাজ ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “দেখেছি। নেমে আয় এখন।”
বকুল কাঠবেড়ালির মতো আরও খানিক দূর উঠে গিয়ে নদীর দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে দূরে রাজহাঁসের মতো সাদা লঞ্চটা দেখতে পেল।
মাঝেমাঝেই নদীতে এই লঞ্চটা আসে, অন্য লঞ্চে যেরকম মানুষ গাদাগাদি করে থাক, ভটভট শব্দ করে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যায়, এটা মোটেও সেরকম না। এটা একেবারে ধবধবে সাদা, প্রায় নিঃশব্দে পানি কেটে এগিয়ে যায়। লঞ্চটা দেখতেও অন্যরকম, একটা ছোট বাসার মতো। নিচে থাকার ঘর, উপরে পাটাতন, সেখানে আবার ঝালর-দেওয়া ছাদ। ঝলর-দেওয়া ছাদের নিচে এক-দুজন মানুষ থাকে, তাদের দেখেই বোঝা যায় তারা খুব সুখী। তাদের জামাকাপড়গুলো হয় সুন্দর, তাদের চোখে থাকে রঙিন চশমা, তারা নিজেদের মাঝে কথা বলে, হাসে। তারা হেসে হেসে কিছু-একটা খেতে খেতে নদীর তীরে তাকিয়ে থাকে। মানুষগুলোকে দেখে মনে হয় তারা বুঝি স্বপ্নজগতের মানুষ। এই লঞ্চটা এলেই বকুল সবসময় লঞ্চটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কারণ সে জানে এই লঞ্চে ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে থাকে। সে-মেয়েটা একেবারে পরীর মতো সুন্দর, গায়ের চামড়া যেন গোলাপ ফুলের মতো নরম, চুলগুলো একেবারে রেশমের মতো। হালকা রঙের একটা ফ্রক পরে মেয়েটা শান্তচোখে
১৯৮
তাকিয়ে থাকে। যে মানুষের চেহারা এত সুন্দর, যে এরকম রাজহাঁসের মতো লঞ্চে করে স্বপ্নের জগতের মানুষদের সাথে নিঃশব্দে পানি কেটে কেটে যায় তার মনে না জানি কী বিচিত্র ধরনের সুখ। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বকুল কেমন জানি একধরনের হিংসা অনুভব করে। আহা, সেও যদি এরকম সুন্দর কাপড় পরে এরকম সেজেগুঁজে এই রাজহাঁসের মতো লঞ্চে করে যেতে পারত।
লঞ্চটা আরও এগিয়ে আসতে থাকে, বকুল ভালো করে দেখার জন্যে ডাল বেয়ে বেয়ে নদীর পানির দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে দুটি সরু সরু ডাল বের হয়ে এসেছে, ডাল দুটিতে পা রেখে সাবধানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। বকুল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায় চাপা একটা শব্দ করতে করতে লঞ্চ এগিয়ে আসছে, উপরে একটা চেয়ারে বয়স্ক একজন মানুষ বসে আছে, তার পাশে আরেকটা চেয়ার রেলিঙে হাতের উপর মুখ রেখে সেই মেয়েটি বসে আছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে বকুল প্রায় একটা চাপা শব্দ করে ফেলল, ইশ কী সুন্দর মেয়েটি। আর হঠাৎ কী আশ্চর্য, মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে সোজাসুজি বকুলের দিকে তাকাল। বকুলকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠল মেয়েটি, বকুল দেখতে পেল সোজা হয়ে বসেছে হঠাৎ, মুখটিতে কেমন যেন একটা বিস্ময়ের ছাপ পড়েছে, অবাক হয়ে দেখছে সে বকুলকে। লঞ্চটা প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে, একজনের কাছে আরেকজন আরও স্পষ্ট হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। বকুল দেখতে পাচ্ছে মেয়েটার চুল বাতাসে উড়ছে, তার মুখে অস্পষ্ট সুক্ষ্ম একধরনের হাসি, চোখে আশ্চর্য একধরনের বিস্ময়–
“কী হচ্ছে এখানে?”
হঠাৎ গাছের নিচে থেকে বাজখাই একটা ধমক শুনতে পেল বকুল। তার বড়চাচার গলার স্বর, গাছের নিচে বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় দেখে এগিয়ে এসেছেন। হিজল গাছটা নিয়ে কিছু-একটা ঝামেলা হয়েছে বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। মুখ ঘুরিয়ে তাকাবেন এক্ষুনি, বকুলকে দেখতে পাবেন সাথে সাথে, মহা একটা কেলেঙ্কারি হবে তখন। বকুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেকে আড়াল করে ফেলতে চায় গাছের পাতার আড়ালে। “কী হল, কথা বলে না কেন কেউ?”
বড়চাচার প্রচণ্ড ধমক খেয়ে সিরাজ আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে–”
বকুল বুঝতে পারল আর এখানে থাকা যাবে না, পালাতে হবে। বাচ্চাকাচ্চা যারা আছে তারা নিজে থেকে কখনো বকুলের কথা বলে দেবে না, কিন্তু ধমক খেলে অন্য কথা। বড়চাচার ধমক বিখ্যাত ধমক, বয়স্ক মানুষেরা পর্যন্ত কেঁদে ফেলে। বকুল নিচে তাকাল, নদীর কালো পানি ঘুরপাক খাচ্ছে, ছোট একটা ঘূর্ণির মতো হয়েছে সেখানে। গাছটা অনেকখানি উঁচু, পানি আরও নিচে, এত উঁচু থেকে আগে কখনো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, কিন্তু তাতে কী হয়েছে? বকুল নিঃশব্দে হাত উঁচু করে ডাইভ দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়, নদীর পানি ছলাৎ ছলাৎ করে তীরে আঘাত করছে, সেই শব্দের আড়ালে যথাসম্ভব নিঃশব্দে ডাইভ দিতে হবে, ব্যাপারটি এমন কিছু কঠিন নয় তার জন্যে। বকুল গাছের ডালে নিঃশব্দে দোল খেয়ে নিচের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ছিপছিপে শরীরে তীরের মতো নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে পড়তে সে শেষবারের মতো লঞ্চে বসে-থাকা মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটির চোখে আতঙ্ক এবং অবিশ্বাস, আর্তচিৎকার করে রেলিং ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে সে।
পানির নিচে ঝপাং করে অদৃশ্য হয়ে গেল বকুল। দুই হাত দিয়ে পানি কেটে কেটে এগিয়ে যেতে থাকে সে, স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে যেতে হবে যতদূর সম্ভব, তারপর ভেসে উঠবে। বড়চাচা কোনদিনও জানতেও পারবেন না কে ছিল হিজলগাছে।
কালো পানিতে সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে যেতে থাকে বকুল, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরীর মতো মেয়েটার চেহারা, কী বিচিত্র অবিশ্বাস আর আতঙ্ক ছিল মেয়েটার চোখে! কী ভাবছিল মেয়েটি? তার লাল রুক্ষ চুল, রং-জ্বলা ফ্রক, শ্যামলা রং, শুকনো হাত-পা দেখে মেয়েটার কি হাসি পাচ্ছিল? সে কি হাসছিল মনে-মনে? যারা স্বপ্নের জগতে থাকে তারা কি কখনো ভাবে বকুলের মতো এরকম মেয়েদের কথা? কোন কি কৌতূহল হয় তাদের?