প্রিয় বকুল,
তুমি কেমন আছ? আমি ভালো আছি। মানুষ চিঠিতে সবসময় লেখে তুমি কেমন আছ আমি ভালো আছি–আমি আগে কোনদিন লিখিনি কারণ আগে আমি কখনো ভাল ছিলাম না। সবসময় আমার অসুখ ছিল। আজমল চাচা বলেছেন আমি এখন ভালো হয়ে গেছি সেজন্যে লিখলাম। হা হা হা।
আমি আসলেই ভালো হয়ে গেছি। তোমার জন্যে আসলে আমার অসুখ ভালো হয়েছে। এখন আমার সবসময় খিদে থাকে আর আমি সবসময় খাই। আমাকে দেখে আগে যেরকম কাঠির মতো লাগত এখন সেরকম লাগে না। আমি এখন মোটাসোটা হয়েছি। মনে হচ্ছে কয়েকদিনের মাঝে আমি মোটা হতে হতে একেবারে গোলআলুর মতো হয়ে যাব, কেউ ধাক্কা দিলেই তখন বলের মতো গড়াতে থাকব। সব দোষ হবে আমার। হা হা হা।
বকুল, তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছে কাজেই এখন তোমাকে আমার প্রাণের বন্ধু হতেই হবে। প্রাণের বন্ধু আর জীবনের বন্ধু। তুমি আমাকে চিঠি লিখে জানাও তোমার প্রাণের বন্ধু আর জীবনের বন্ধু হতে কোন আপত্তি আছে কি না।
ইতি তোমার প্রাণের বন্ধু নীলা।
পুনঃ টুশকি কেমন আছে? তাকে আমার হয়ে একটু রগড়া দিও।
পুনঃ পুনঃ জমিলা বুড়ি কেমন আছে? তাকে কি এখনো তোমরা ভয় পাও?
পুনঃ পুনঃ পুনঃ খেলার মা এবং মতি পাগলা এবং বিশু-চোরা কেমন আছে?
.
প্রিয় নীলা,
আমি তোমার চিঠি সময়মতোই পেয়েছি কিন্তু উত্তর দিতে দেরি হল কারণ চিঠি পোস্ট করার জন্যে কোন খাম ছিল না–পোস্ট অফিস অনেক দূরে, আনতে দেরি হয়েছে।
তুমি লিখেছ আমি তোমার জীবন বাঁচিয়েছি কিন্তু আমি তো কিছুই করি নাই, আমি কেমন করে জীবন বাঁচালাম? মনে হয় মোরগ সদকা দেওয়াটাতে কাজ হয়েছে। তোমার জান না নিয়ে মোরগের বাচ্চার জান নিয়েছে। আমার তাই মনে হয়।
আমি তোমার জান না বাঁচালেও আমি তোমার প্রাণের বন্ধু হতে রাজি আছি। আমার কোনই আপত্তি নাই। সারাজীবনের জন্যে প্রাণের বন্ধু কীভাবে হতে হয়? কোন কি নিয়ম আছে?
ইতি তোমার প্রাণের এবং জীবনের বন্ধু বকুল।
পুনঃ জমিলা বুড়ি ভালোই আছে, এখন তাকে দেখলে বেশি ভয় লাগে না। মতি পাগলা সেদিন ছুটে গিয়েছিল, দা হাতে নিয়ে লাফ দিচ্ছিল তখন সবাই মিলে তাকে ধরে ফেলেছে। বিশু-চোরা ভালোই আছে, মনে হয় তার চুরি ভালোই হচ্ছে।
পুনঃ পুনঃ টুশকির সাথে প্রায় প্রত্যেকদিনই দেখা হয়। গ্রামের লোকজন এখন আর টুশকিকে দেখে ভয় পায় না। আমি সেদিন টুশকির পিঠে উঠেছিলাম, সে আমাকে নিয়ে নদীর মাঝখানে গিয়েছিল, তবে তার বুদ্ধি খুব কম। নদীর মাঝেখানে গিয়ে আমাকে নিয়ে পানির নিচে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। হা হা হা।
.
প্রিয় বকুল,
তোমার যেন চিঠি লিখতে দেরি না হয় সেজন্যে অনেকগুলো স্ট্যাম্প পাঠালাম। এখন আর তোমার পোস্ট অফিসে যেতে হবে না। প্রাণের বন্ধু এবং জীবনের বন্ধু হওয়ার প্রথম নিয়ম চিঠি পেলে সাথে সাথে উত্তর দিতে হয়।
টুশকির পিঠে চড়ে তুমি নদীর মাঝেখানে গিয়েছিলে শুনে আমি হিংসার চোটে প্রায় মারা যাচ্ছি। আমাকে ছাড়া তুমি একলা টুশকির পিঠে চড়বে না। না না না। তবে আমার আব্বু বলেছে যতদিন আমি সাঁতার না শিখব ততদিন আমাকে টুশকির পিঠে নদীর মাঝে যেতে দেবে না। আমি আব্বুকে বলেছি আমাকে এক্ষুনি সাঁতার শিখিয়ে দিতে। আলু বলেছে শমসের চাচাকে। শমসের চাচা বলেছে এক দুই। সপ্তাহের আগে নাকি সাঁতার শেখা যাবে না। ই ই ই ই (এটা মানে রাগ)।
আব্বু বলেছে আমাকে একবার নিউইয়কে নিয়ে ডাক্তার দেখাবে। এই শেষবার। আর যেতে হবে না। মনে হয় সামনের সপ্তাহে যেতে হবে। তুমি কিন্তু চিঠি লিখে যাবে। শমসের চাচাকে বলে দেওয়া আছে, শমসের চাচা তোমার চিঠি আব্বুর নিউইয়ক অফিস, না হলে হোটেলে ফ্যাক্স করে দেবে। তাড়াতাড়ি চিঠি লিখবে।
তোমার প্রিয় বন্ধু প্রাণের বন্ধু এবং সারাজীবনের বন্ধু নীলা।
.
প্রিয় নীলা,
একটা অনেক গরম খবর আছে। সেইদিন স্কুল থেকে আসছি তখন বিশু চোরার সাথে দেখা। তাকে দেখে প্রথম চিনতে পারি নাই কারণ তার মাথার সব চুল এমনকি ভুরু পর্যন্ত কামানো। তা ছাড়া কপালে এবং মুখে আলকাতরার দাগ। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, প্রথমে স্বীকার করতে চায় না, অনেক জোরাজুরি। করার পরে বলল, সে নাকি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, তখন গ্রামের লোক তার চুল এবং ভুরু কামিয়ে দিয়ে আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে। সে ন্যাংড়াতে ন্যাংড়াতে হাঁটছিল, মনে হয় তাকে ধরে কিছু পিটুনিও দিয়েছে।
তুমি নিউইয়কে যাবে শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি বইয়ে পড়েছি সেখানে অনেক ঠাণ্ডা। তুমি ভালো করে সোয়েটার পরে ঘর থেকে বের হবে।
তোমার সাঁতার শেখার কী অবস্থা? আমার কাছে এলে আমি তোমাকে একদিনে সাঁতার শিখিয়ে দেব। (গাছে উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেব, তুমি হাবুডুবু খেয়ে একবার সাঁতার শিখে যাবে। হা হা হা।)।
ইতি প্রাণের বন্ধু জীবনের বন্ধু বকুল।
পুনঃ টুশকির বুদ্ধি মনে হয় একটু বেড়েছে। আমাকে নিয়ে সে যখন নদীর। ভিতরে ঢুকে যেতে চায় আমি তখন তার পিঠে থাবা দেই, তা হলে আবার সে ভেসে ওঠে। আমি আজকে টুশকির পিঠে করে অনেকক্ষণ নদীতে সাঁতার কেটেছি। আমার মা-বাবা এবং বড়চাচার ধারণা এই কাজটা খুব খারাপ। মেয়েদের নাকি ঘরের ভিতরের কাজ শেখা উচিত। রান্নাবান্না করা, বাসন এবং কাপড় ধোয়া এবং সেলাইয়ের কাজ। ই-ই-ই-ই-ই।
.
প্রিয় বকুল,
তুমি ঠিকই বলেছ, নিউইয়কে অনেক ঠাণ্ডা। শুধু সোয়েটার পরলে হয় না, তার উপর একটা জ্যাকেট পরতে হয়। আজকে আমার আব্বু বলেছে ডাক্তারদের ধারণা আমার বিপদ কেটে গেছে। বলেছে সবসময় হাসিখুশি থাকতে। হা হা হা হি হি হি হো হো হো (হাসিখুশি থাকছি!)
আমার সাঁতার শেখা এখনও শুরু হয়নি। নিউইয়কে বেশিদিন থাকলে এখানে আব্বু সাঁতার শেখার স্কুলে ভর্তি করে দেবে। কিন্তু এখানে আমার একেবারে ভালো লাগে না। তবে দোকানগুলো অনেক সুন্দর। আমি তোমার জন্যে একটা গিফট কিনেছি, সেটা দেখলে তোমার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। হা হা হা।
টুশকির বুদ্ধি একটু বেড়েছে শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। আমাকে নিয়ে যদি পানির নিচে ডাইভ দেয় কী বিপদ হবে জান? তবে প্লিজ প্লিজ প্লিজ তুমি একা একা সব মজা শেষ করে ফেলো না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
প্রাণের বন্ধু জীবনের বন্ধু পৃথিবীর অন্য পাশে থেকে নীলা।
.
পুনঃ বিশু চোরার ভুরুর চুল কি গজিয়েছে? আমি শুনেছিলাম ভুরু একবার কামানো হলে সেটা নাকি আর গজায় না। তুমি অবশ্য অবশ্য আমাকে জানাও।
.
প্রিয় নীলা,
আমি বিশু চোরার সাথে কথা বলেছি। সে বলেছে ভুরু কামালে আবার নাকি ভুরু গজায়, তবে অনেকদিন সময় লাগে। বিশু চোরার ভুরু নাকি আগেও একবার কামানো হয়েছিল।
নিউইয়কের ডাক্তার বলেছে তোমার বিপদ কেটেছে শুনে আমি নিশ্চিন্ত হলাম কারণ এদিকে একটা সাংঘাতিক বড় গোলমাল হয়েছে। সাংঘাতিক সাংঘাতিক বড় গোলমাল। তুমি শুনলে ভয়ে তোমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তোমার মনে আছে সাজ্জাদ বলেছিল কারও জান বাঁচানোর জন্যে আরেকটি জান দিতে হয়? সেইজন্যে আমরা মোরগের বাচ্চাটা সদকা দিয়েছিলাম খেলার মাকে? তোমার মনে আছে আমরা খেলার মাকে বলেছিলাম সে যেন অবশ্য অবশ্যই সেটা জবাই করে খেয়ে ফেলে?
তুমি বিশ্বাস করবে না খেলার মা কি করেছে! সে মোরগের বাচ্চাটা জবাই করে নাই। শুধু তাই না, সেটাকে সে খাইয়ে-দাইয়ে এই মোটা করেছে। তুমি চিন্তা করতে পার? জানের বদলে জান দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা দেওয়া হয় নাই। আমি অনেক রাগ হয়েছিলাম, তখন খেলার মাও আমার উপর অনেক রাগ হয়েছে। সে নাকি মোরগ খায় না। শুধু মোরগ না, মাছ মাংস ডিম কিছুই খায় না। চিন্তা করতে পার?
টুশকির খবর ভালো। আমি তাকে এখন পানির মাঝে লাফ দেওয়া শিখাচ্ছি। প্রথমে আমাকে নিয়ে সে পানির নিচে চলে যায়, আমি তার পিঠ আঁকড়ে বসে পা দিয়ে পেটের মাঝে পুঁতো দিতেই সে পানি থেকে লাফ দিয়ে বের হয়ে আসে। কী যে মজা হয় তুমি চিন্তাও করতে পারবে না!
তোমার প্রাণের বন্ধু বকুল।
প্রিয় বকুল,
আমাকে নিয়ে আব্বু ওয়াশিংটনে ডি. সি. গিয়েছিল, সেখানে অনেক সুন্দর সুন্দর মিউজিয়াম দেখেছি। এসেই তোমার চিঠি পেয়েছি, আমার একটা অনেক বড় চিঠি লেখার ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটা লিখতে পারব না কারণ আব্বু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে নিয়ে ব্রডওয়েতে একটা থিয়েটার দেখতে যাবে। থিয়েটার দেখে এসে আমি তোমাকে চিঠি লিখব।
প্রাণের বন্ধু জীবনের বন্ধু নীলা।
পুনঃ আব্বু আমাকে নিয়ে ফ্লোরিডা যাচ্ছে বলে এখন তোমাকে বড় চিঠি লিখতে পারছি না। ই-ই-ই-ই–
পুনঃ পুনঃ টুশকির খবর পড়ে আমার হিংসা বেড়েই যাচ্ছে।
.
প্রিয় নীলা,
টুশকির একটা বড় খবর আছে। এতদিন টুশকির যখন ইচ্ছা হত তখন সে আমার কাছে আসত। নদীতে যখন লাফঝাঁপ দিতাম তখন সে শব্দ হলে চলে আসত। গত কয়েকদিন হল টুশকিকে ডাকার একটা উপায় বের করেছি। নদীর পাড়ের হিজল গাছটার কথা মনে আছে? সেটা আরও বাঁকা হয়েছে, একটা ডাল পানিতে লেগে আছে। সেই ডালে উঠে লাফালে পানিতে শব্দ হয়, সেই শব্দ শুনে টুশকি চলে আসে। কী মজা! যখন ইচ্ছা তখন তাকে ডাকতে পারি। অনেকটা টেলিফোন করার মতো। টুশকির কাছে টেলিফোন। হা হা হা।
টুশকির খবর মনে হয় আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে কারণ আমি দেখেছি অনেক দূর দূর থেকে লোকেরা টুশকিকে দেখতে আসে। সেদিন খবরের কাগজ থেকে লোক এসেছিল কিন্তু আমার বাবা বলেছে মেয়েদের খবরের কাগজের লোকের সাথে বলা ঠিক না। তুমি চিন্তা করতে পার? ই-ই-ই-ই
ফ্লোরিডাতে কী দেখলে আমাকে লিখে জানিও।
প্রাণের বন্ধু জীবনের বন্ধু বকুল।
.
প্রিয় বকুল, তোমার বাবা খবরের কাগজের লোকের সাথে কথা বলতে দেননি শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে, দেওয়া উচিত ছিল। তবে দিলে আমার হিংসা আরও অনেক বেশি হত–এত বেশি হত যে আমি মনে হয় ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যেতাম। এক দিক দিয়ে ভালোই হল। হা হা হা হা।
ফ্লোরিডায় আমি কি দেখেছি তুমি চিন্তাও করতে পারবে না! একটা জায়গা আছে সেটার নাম হচ্ছে সী-ওয়ার্ল্ড। সেখানে পানির মাঝে থাকে ডলফিন ঠিক টুশকির মতো। সেই ডলফিন যে কী মজার খেলা দেখায় চিন্তা করতে পারবে না। আমি আব্বুকে বলেছি দেশে এরকম একটা পার্ক খুলতে সেখানে টুশকি খেলা দেখাবে। কী মজা হবে না?
আব্বু আমাকে এখনই কেনেডি স্পেস সেন্টারে নিয়ে যাবে বলে চিঠি আর বড় করতে পারলাম না। দেশে ফিরে আসার জন্যে জীবন বের হয়ে যাচ্ছে।
ইতি প্রাণের বন্ধু নীলা।
পুনঃ আর কয়েকদিনের মাঝেই আমরা দেশে চলে আসব। হা হা হা।