০৭. কতিপয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্য
রুদ্র ছিলেন দ্রোহী, অভিমানী, হাস্যোজ্জ্বল এক প্রাণবন্ত যুবক। আড্ডায় তার জুড়ি নেই। কবিতায় স্থির, সিদ্ধ কিন্তু বৈষয়কি বুদ্ধিতে অস্থির, ব্যর্থ। বারবার পেশা বদলিয়েছেন, কিন্তু সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান নি। তার সম্পর্কে আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমান বলেছেন–
এই তরুণ কবির মধ্যে এক ধরনের বাউণ্ডুলেপনা ছিল, যা তাকে সুস্থির হতে দেয় নি, নিজেকে পুড়িয়েছেন আতশবাজির মতো। যারা এই দৃশ্য দেখে তাদের কাছে সেটা মনোহর, চিত্তাকর্ষক মনে হয় কিন্তু যে পোড়ে তার পক্ষে এই জ্বলতে থাকা অত্যন্ত, যন্ত্রণাময়।(২৯)
রুদ্র ছিলেন প্রচণ্ড মিশুক প্রকৃতির। অল্পসময়েই আপন করে নিতে পারতেন বড়-ছোট, পরিচিত-অপরিচিত কিংবা খ্যাতিমান ও খ্যাতিহীনকে। যাটের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন–
রুদ্রের অহেতুক কিছু কাজকর্মে আমি ওর উপর রাগ হতাম এবং না-করার জন্য বলতাম তবে বয়সে তরুণ হলেও আমার একান্ত বন্ধু ছিল। অসীম সাহার ছাপাখানায় রুদ্রের আড্ডায় আমিও অংশ নিতাম। আমার ভালো লাগছে ওর জীবদ্দশায়–মুহম্মদ নূরুল হুদা ও রুদ্রকে আমার সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যখানি উৎসর্গ করেছিলাম।(৩০)
ষাটের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি মহাদেব সাহা রুদ্র-সম্পর্কে লিখেছেন–
মৃত্যুর পর রুদ্রকে আমি দেখি নি। আমি ছিলাম ঢাকার বাইরে। জীবিত রুদ্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখই আমার কাছে তার শেষস্মৃতি। রুদ্র সবসময়ই ছিলো অসম্ভব রকম জীবন্ত ও সক্রিয়। নানা আগ্রহ ও কৌতূহল আকর্ষণ করতো তাকে। তার মধ্যে হয়তো অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় আগ্রহও ছিলো। এই সব আগ্রহ, কৌতূহল ও উদ্যমের মাত্রা কিছুটা প্রশমিত হলে তার কাব্যজীবনই সম্ভবত লাভবান হতো। কিন্তু তবুও সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। কেননা একেকজন মানুষের স্বভাব বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একেক রকম, কবিরতো কথাই নেই, এই ভিন্নতা তার জন্যে আরো বেশি সত্য। বাইরের একধরনের উদ্যমশীলতা, আয়োজন-মগ্নতা ও হুল্লোড়-প্রিয়তার মধ্যেও তার নির্জন অসুখী জীবন তার প্রতি আগ্রহী কোনো মানুষেরই সম্ভবত চোখ এড়ায় নি। এড়ানোর কথাও নয়, যদিও এই আত্মদহনের নিদারুণ যন্ত্রণা সে খুবই সাবধানে নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। ব্যক্তিগত কথা সে জানতো না সত্য, কিন্তু তার জীবনাচরণের মধ্যে তা অনেকটাই উন্মোচিতও হয়ে পড়তো। সে যে কষ্ট পাচ্ছিলো তা না-বললেও প্রায় কারো কাছেই খুব অগোচরও ছিলো না। আমাদের জীবনাচরণের একটি ভাষা আছে, সেই নিঃশব্দ অনুচ্চারিত ভাষাও অনেক কিছুই বলে দেয়। রুদ্র তার দেহ ও হৃদয়ে পীড়িত থেকেও আত্মার উদ্দেশ্যকে ম্লান হতে দেয় নি। এই কাজটি করেছিলো সে প্রকৃত কবির মতো। সেজন্যেই এই রোগ ও অসুস্থতা, দুঃখ ও হতাশার মধ্যেও সে ক্রমাগত বেড়ে উঠছিলো, আরো কবি হয়ে উঠছিলো।
রুদ্র তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পার করেছেন কবি অসীম সাহার আড্ডায় বসে। বলা যায় অসীম সাহার আড্ডাই ছিল তার সে-সময়ের বাঁচার অবলম্বন। অসীম সাহার সঙ্গে তার গভীর ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছিল। রুদ্রসম্পর্কে কবি অসীম সাহার উপলব্ধি—
ব্যক্তিগত জীবনে রুদ্র ছিলেন একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার সামান্য ছাপাখানায় প্রায়ই কবি যেতেন এবং আড্ডা বসাতেন। কবির অস্থির এবং হতাশাগ্রস্ত মন সবসময় আমাকে দংশন করতো। সবসময়ই কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল মনে। অনেক ছোটখাট ঘটনায় কবি অনেকের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে একা একা থাকতে ভালোবাসতেন।(৩২)
কবি-সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ রুদ্রের সহপাঠী, রুদ্রের জীবনের অনেক আনন্দ-বেদনার সঙ্গী। এক লিখিত সাক্ষাতকারের তিনি বলেন–
ভিন্ন আদলে গড়া এক অনিরুদ্ধ মানুষ ছিল। যেন তার সব কিছুতেই এক স্বতন্ত্র আবহ, বৈশিষ্ট্যটুকুও নিজস্ব। মোহমুগ্ধ আকর্ষণে অনায়াসে টেনে নিতো যে-কোনো জনকেই। তারুণ্যের অসম সাহস, অন্তহীন ভালোবাসা গ্রহণের দক্ষতা আর হৃদয় উজাড় করে বিলিয়ে দেবার পাশাপাশি নানা গুণের মিশ্রণে সম্পন্ন মানুষের পথে চলেছিল। মাঝপথ পেরিয়ে যাওয়া হলো না আর।
দেখার আগেই লেখার সঙ্গে পরিচয়পর্বটি ৭৩ সালের। ‘পূর্বদেশ’ দৈনিকের ‘চাঁদের হাট’, কিশোর পাতা। আর সেখানেই ‘বরণী’ শিরোনামের ১২ লাইনের অন্ত্যমিলের কবিতার সঙ্গে নামটক টেনে নিয়েছিল। চাদরে হাটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি তখন আয়োজন। হয়েছিল অবজারভার-ভবনে। সেই অনুষ্ঠানে পাঠ করা ঐ কবিতাটি, আর গ্রুপছবিতে ও ধরা পড়েছিল। ‘৭৪ সালের গোড়ায় সেই নামটুকু আবার পেলাম ঢাকা কলেজে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হবার সময়। সেবার ভর্তি পরীক্ষা হয় নি। এসএসসিতে পাওয়া নম্বরের ভিত্তিতে নোটিস বোর্ডে টাঙানো তালিকায় মানবিক বিভাগে প্রথম নামটিই ছিল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মাকসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল। তাই মানবকি বিভাগের তালিকার শীর্ষে ছিলো তার নাম। কলেজের প্রথমদিনের ক্লাশেই শুশ্রুমণ্ডিত তার সাথে পরিচয়। তারপর কত ঋতু, কত বছর, মাস, দিন-রজনী পেরিয়ে গেছে, সূর্য-রৌদ্রে নিজেদের ভিজিয়ে হেঁটেছি পথ।
জীবনযাপনের সব প্রসঙ্গটুকু এড়িয়ে যাবার প্রবণতা ছিল না। বাইরে যতটা এলোমেলো ভেতরে তত গোছানো–এমনটাই ছিল। তবু তার অস্থিরতার পায়রাগুলো ছটফট করতো। সৃজনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশকে ডেকে নিতো কত অবলীলায়। সংকীর্ণতা তাকে ছোয় নি কখনো, পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পথে শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে যাবার সাধনায় ছেদ পড়ে নি।
জাগতিক বিষয়ের মধ্যে থেকেই লেখালেখির নিরন্তর সাধনা তার ছিল অপরিসীম। মধ্যরাতে জেগে উঠে কাগজ-কলম নিয়ে বসে যাওয়া, বারবার উচ্চারণে ছন্দের গতিপথ নির্ধারণ করা, শব্দকে নেড়েচেড়ে, ঝাঁকিয়ে, কত না ভেঙেচুরে বসিয়েছে ছন্দের নিজস্ব নিয়মে। চিন্তার পরিধি তার ছড়াতো সুন্দর আবহে। নতুন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যান্দোলনে নিজেকে নিবেদিত করে পরিবর্তনের ধারা নির্মাণের ব্যাকুলতারও কমতি ছিল না।
নষ্ট সময় আর নষ্ট প্রজন্মের ভিড়ে সুদিনে সুবাতাস বইয়ে দেবার জন্য প্রান্ত থেকে প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে। সৃষ্টিশীলতার ভেতরে সঁপে দেয়া এক জীবন বহন করে গেছে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
অভিমানের বিশাল আকাশটুকু দেখা যেতো মাঝে মাঝেই। মানুষের কাছে মানুষের কথা, জীবনের কাছে জীবনের কথা পৌঁছে দেবার শ্রমে অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছিল। আমার সময়ের বিশাল হৃদয়ের সহিষ্ণু তুখোড় তরুণ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। আলো আঁধারের পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলো জীবনের সারাৎসার। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে নষ্ট স্বদেশে সৃষ্ট মানুষের বিপরীতে সটান দাঁড়িয়ে মুখোশ উন্মোচনে খামতি ছিল না। সমকালের মানুষের কাছে স্বতন্ত্র ও স্বকীয়তায় অনন্য রুদ্র। সব কিছু ছাপিয়ে উপচে পড়েছিল তার কবিতার পঙক্তিগুলো।(৩৩)
রুদ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে রুদ্র ছিলেন এক অজাতশত্রু মানুষ। অত্যন্ত সরল, কিন্তু প্রতিবাদী, সাহসী। তার বন্ধু রেজা সেলিমের দৃষ্টিতে–
ঢাকার বাইরে ছিল রুদ্রের আর একটি জগৎ। আমার সুযোগ ঘটেছিলো বাংলাদেশের অনেক জেলা ও তৎকালীন মহকুমা শহরে অনুষ্ঠিত সাহিত্য বা কবিতা-সম্মেলনে যোগ দেবার। আমরা দেখতাম সে-সব অনুষ্ঠানে রুদ্র একটি বড়ো আকর্ষণ। ওর অকপট সারল্য সাহস, ব্যক্তিত্ব, কবিত্ব এবং আর একটি প্রধান গুণ কবিতাকে আবৃত্তি করা–সব কিছুরই সম্মিলিত আকর্ষণ ক্ষমতা ছিল। আমার বিশ্বাস এই সবগুলো মিলে-মিশে ব্যক্তি রুদ্রকেও জনপ্রিয় করে তুলেছিল।(৩৪)
তাঁর কবি-বন্ধু কামাল চৌধুরীর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে রুদ্রের ভিন্ন চরিত্র। রুদ্রের কবি-জীবনের ভেতরের ব্যক্তিজীবনকেও কামাল চৌধুরী চিনতেন। রুদ্রসম্পর্কে তার উপলব্ধি–
রুদ্র স্বভাবে অমিতচারী ছিলো। সে ছিলো বেপরোয়া। তার চালচলন, আচার-আচরণ ছিলো আমাদের চেয়ে স্বতন্ত্র। শোকসভায় কবি রফিক আজাদ তাকে মাইকেল ঘরানার উত্তরসূরী বলেছিলেন। যথার্থ অর্থে রুদ্র ছিলো তাই। প্রতি সন্ধ্যায় হাটখোলার নন্দের দোকানে হাজিরা না দিলে তার চলতো না। আমরা অনেকেই অনিয়মিতভাবে সেখানে গিয়েছি তবে রুদ্রের সাথে তাল মিলিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। জলীয় ব্যাপারটি তার নিত্যদিনের কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছিলো। এজন্য কোনো নিষেধ, অনুরোধ শুনতে সে রাজি ছিলো না।
বাইরে এই বেপরোয়া বেহিসেবি জীবন, অথচ ভেতরে ভেতরে রুদ্র ছিলো আশ্চর্য রকম সুশৃংখল। কবিতার কাগজ-কলম থেকে শুরু করে পরিধেয় বস্ত্র কোনোকিছুই এলোমেলোভাবে রাখতো না। হাত-মুখ ধুয়ে শান্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে প্রতিদিনকার ঘটনা লিখে জানাতে প্রেমিকাকে। জীবনের সব সত্য প্রকাশযোগ্য নয়–একথা মানতে রাজি ছিলো না রুদ্র। বলতো যে তাকে ভালোবাসবে সে যেন জেনেশুনেই ভালোবাসে। আসলে তার হৃদয় ছিলো বিশাল এক সারল্যে ভরা। প্রয়োজনে অনেকের সে বিরোধিতা করেছে তবে কখনো ষড়যন্ত্র করে নি। কাব্যহিংসা তার ছিলো–তবে পরশ্রীকাতরতা ছিলো না কখনো।(৩৫)
তাঁর আরেক বন্ধু কবি আলমগীর রেজা চৌধুরীর মূল্যায়ন–
রুদ্রের মধ্যে কিছুটা বেপরোয়া ভাব ছিলো। দ্রোহী স্বভাব, কী চলনে, কী বলনে! কবিতায় শেকড়সন্ধানী আত্মমগ্নতা আমাকে প্রথম থেকে আকর্ষণ করেছিলো। পঁচফুট সাড়ে চার ইঞ্চি লম্বা, মাথায় কঁকড়া চুলের অধিকারী, মুখে গোঁফ, পোষাকে রং চকচকে পাঞ্জাবি, আর জিন্সের প্যান্ট। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো ওর অসাধারণ দুটো চোখ। সত্যি কসম করে বলি, আমি ওকে হিংসে করতাম। রুদ্রকে বল্লে ও হাসতো। সবকিছুর মধ্যে বাউলাপনা ছিলো। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে যখন টিএসসি মোড় থেকে বাংলা একাডেমির দিকে হেঁটে যেত তখন মনে হত নগরে বাউল। ঢাকা শহরে প্রত্যেক অলিগলির কোনো-না-কোনো মুদির দোকানদারের সঙ্গে ওর জানাশোনা ছিলো। প্রচুর সিগারেট খেতে পারতো। স্টার ছিলো ওর প্রিয় ব্রান্ড। পরবর্তীতে গেল্ডলিফ। চা খেত প্রচুর। যে-কোনো জায়গায় বসে যেত চা খেতে। ফুটপাত থেকে ফাইভ স্টার। আর মদ! হ্যাঁ সম্ভবত এটাও ওর প্রিয় বিষয়ের একটি। কবিতার মতো। প্রিয় নারী লীমার মতো। রাজনীতির মতো।
সত্যি রাজনীতি ওর প্রিয় বিষয় ছিলো–কী কবিতায়, কী জীবনযাপনে! ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য। ডাকসুতে নির্বাচন করেছিলো সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে। এ-প্রসঙ্গে একটি স্মৃতি মনে পড়ছে। এ-সময় আমাদের আরো দু’জন বন্ধু আলী রীয়াজ এবং কামাল চৌধুরী একই পোস্টে নির্বাচন করেছে। জাফর ওয়াজেদ। সদস্য পদের জন্য। ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রসংগঠন এদেরকে মনোনয়ন দিয়েছিলো। ৩০৯ নম্বর ফজলুল হক হল আমাদের নির্বাচন প্রচারকেন্দ্র। একই পোস্টের জন্যে প্রচারের ব্যাপারে আমার ভূমিকা সমান। শুধু নির্বাচনের দিন আমি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পালিয়ে গিয়েছিলাম। আলী রীয়াজ ডাকসুতে সাহিত্য-সম্পাদক নির্বাচিত হয়। আমার এ-হেন ব্যবহারের জন্যে রুদ্র সামান্যতম ক্ষুব্ধ হয় নি। শুধু স্মিত হেসে বল্ল-আগামী দিনগুলোতে সংগ্রাম করবি কীভাবে? সত্যিকার অর্থে আমি কাউকে দুঃখ দিতে চাই না। আমাদের সম্পর্কের সুতো ততদিন অত্যন্ত শক্তভাবে গ্রন্থিত হয়ে গিয়েছে।(৩৬)
প্রকৃত বিচারে রুদ্রের কোনো শত্রু ছিল না। যারা তাঁর বিরুদ্ধচারণ করতো রুদ্র তাদেরকেও বকে টেনে নেয়ার বিশাল হৃদয় তৈরি করেছিলেন। অনেক ঘনিষ্ঠজনদের নিকট থেকে আঘাত পেয়ে কেঁদেছেন, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, আবার তারা এলে কিংবা দেখা হলে সেই রুদ্রই একগাল হাসি দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছেন। তার এসব প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে বন্ধু কথাসাহিত্যিক ইসহাক খান জানান–
এলোমেলো এই অশান্ত তরুণকে অনেকেই ভুল বুঝেছে। আসল সত্যটি তারা খোঁজে নি। আমি আসল সত্যটি লিখব। লিখব রুদ্রের শত্ররা কিভাবে তাকে আঘাত করেছে। সেই অভিমানে সারারাত কেঁদেছে রুদ্র। তারপরও বিশাল হৃদয়ের এই সিংহপুরুষ তার শত্রুদের সঙ্গে হেসে কথা বলেছে। আবার বুকে টেনে নিয়েছে। কখনও-কখনও আমি অভিযোগ করে বলতাম, ‘তুই আসলে বন্ধু চিনতে ভুল করিস।’ হেসে বলতো, ‘বন্ধু আমি ঠিকই চিনি। ওদের সঙ্গে মিশি, কারণ ওরা আমার বিরোধিতা করলেও শেষপর্যন্ত আমার কাছেই ফিরে আসতে হয়। সেক্ষেত্রে পরাজয় কার? আমার? না ওদের?’
হ্যাঁ, রুদ্র মিথ্যে বলে নি। ওরাই বার বার হেরে গিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে। সর্বকালের জন্যে রুদ্র অপরাজিত।(৩৭)
সব কিছু ছাপিয়ে রুদ্রের যে-রূপটি বেশি প্রতিভাত, তা হল তার রুদ্ররূপ, প্রতিবাদী রুদ্ররূপ। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংস্কৃতিকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠন করেন। আবার এশীয় কবিতা উৎসবের প্রতিবাদে আয়োজন করেন জাতীয় কবিতা উৎসবের। কিন্তু এসব সংগঠন যখন ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে, অনেকে ফায়দা লোটার জন্যে সংগঠনে আসছে, রুদ্র তখন সরে দাঁড়িয়েছেন। এ-সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে তিনি শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু নেন নি। তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন বলেন,
রুদ্রের জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে যেমন মূল ভূমিকা ছিল, সেটি যখন অস্তিত্ব অটুট প্রতিষ্ঠা পেলো, তখন সে নেই। আবার পরিষদের অস্তিত্ব যখন একটু নড়বড়ে হয়ে দেখা দিলো রুদ্র এসে হাজির, আবার যখন পরিষদটি বেশ দৃঢ়পায়ে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিলো, তখন সে নেই। রুদ্র যেন ত্রাণকর্তার মতো প্রয়োজনে আসতো আর যেতো। জানি না অন্য ব্যাপারে তার কী ভূমিকা থাকতো, তবে জাতীয় কবিতা পরিষদের বেলায় তার ভমিকা এমনিভাবেই পালিত হয়েছে। মননে ও চিন্তায় রুদ্র দেশদরদী ছিল। দরদষ্টিসম্পন্ন ছিল ওর চিন্তা-চেতনা। কবিতার বেলায়ও তার দৈশিক ঐতিহ্য এবং আবহমান বাংলার আদিরূপের উপাসনা, মগ্নতা ও সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যেতো। এসব কারণে তার কবিতা এত লোকপ্রিয় ছিল। আমরা যারা ওর চেয়ে বয়সে বড় ছিলাম, তাদের প্রতি সে সবসময় শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাতো। মনে মনে দ্ৰোহী আবার বাইরে ভদ্র ও বন্ধুপ্রিয়। ব্যক্তিগত মনোকষ্টে খুব ব্যথিত হয়েছে কিন্তু বাইরে তত প্রকাশ না-পেলেও তার কবিতার মধ্য দিয়ে সেটি প্রকাশিত হয়েছে। তার কষ্ট কবিতার লাইনে ফুটে উঠেছে। এসব জাতকবির লক্ষণ। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে দেশের জন্যে বোধ, কষ্ট-সুখ, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তার কবিতার মাধ্যমে। মানবপ্রেমিক যেমন ছিলো তেমনি দেশপ্রেমীও।(৩৮)
হ্যাঁ, রুদ্র ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তাই দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেখে, কিংবা পরাজিত শত্রুর উত্থান দেখে তিনি শংকিত। দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন। নিজের হাতে গড়া সংগঠনে যখন তিনি স্বৈরাচারী পরিবেশ লক্ষ করেন, সেখানেও জ্বলে ওঠে তার প্রতিবাদী রুদ্ররূপ। তার বন্ধু কবি তুষার দাশের ভাষায়–
Rudra was a friend. But as a person he was on a higher plain because he had all the courage which we never had. From the stage of Jatiya Kabita Parishad he spoke out in the face of numerous adversaries; ‘I am reading out my poems in defiance of the autocratic government and all the autocracies inside this very Kabita Parishad.’ It was not possible for us to protest as he did. There, Rudra was the most courageous soul of our brave time. To call him a friend is a source of pride.
He possessed a natural simplicity. We came to the city at a much later age and yet we were consumed by an urban crookedness, inferiority complex, deception and slyness. But nothing could destroy his simplicity. His smile reflected his simple personality and was familiar to all acquaintances.(৩৯)
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ভণ্ডামিকে তিনি সহ্য করতে পারতেন। আপোসকামিতাকে ঘৃণা করতেন। নিজের শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি বেখেয়ালি ছিলেন–এই তার বড় দোষ। আর কবি হিসেবে ছিলেন একটু বেশি। আবেগপ্রবণ। তার ব্যক্তিচরিত্র এবং কবিচরিত্র সম্পর্কে কবি ফেরদৌস নাহার বলেছেন–
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন। কবি হিসেবে তার কোনো ক্ষুদ্রতা ছিল না। একটু সেন্টিমেন্টাল ছিলেন। তবে তার যাপিত কবি-জীবনকে অনেকটা ইচ্ছাকৃত বলে মনে হয়। কবিতা নিয়ে তার Regular Practice ছিল। তার সময়ে যে তিনি বড় মাপের এবং উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রেমের কবিতাগুলি অসাধারণ। তাঁর সরাসরি প্রতিবাদের ভঙ্গিটিও আমার ভালো লাগে।(৪০)