সেদিনের ইংরেজ বিচারক
কাজির বিচারের যুগ শেষ হয়ে গেল ইংরেজরা এদেশে আসার পরে। সাধারণ মানুষ ভাবল, অপরাধ, দণ্ড ও বিচার সম্বন্ধে তাদের পুরনো সব ধ্যান-ধারণাটি বোধহয় বদলে ফেলতে হবে। কাজির বিচারের ভয় ভাবনা থেকে হয়ত এবার তারা মুক্তি পাবে, এবং অপরাধ লঘু কি গুরু তার ন্যায্য বিচার করে নবযুগের বিচারকরা দণ্ডবিধান করবেন। কিন্তু আঠার শতকে, এবং উনিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত, ইংরেজ শাসকরা যে-অপরাধের জন্য যে দণ্ড দিতেন তা আজকের দিনে ভাবলেও অনেকে শিউরে উঠবেন। ইংরেজ আমলের আদিপর্বের এই সব অপরাধ ও দণ্ডের কথা মনে হলে, মধ্যযুগের বর্বরতা ছাড়া আর কিছু তা মনে হয় না।
আইন-আদালত ও দণ্ডনীতির দিক দিয়ে ইংরেজরা তখন নিজেদের দেশেও যে খুব বেশিদূর অগ্রসর হতে পেরেছিলেন তা নয়। বিচারের বিধিবিধান উদ্ভাবনের দিক থেকে তাঁরা তখনও মধ্যযুগের স্বেচ্ছাচারিতার সীমা অতিক্রম করতে পারেননি। সৈন্যসামন্তদের উপর তখনও দাস-দস্যুদের মতন নির্মমভাবে অত্যাচার করা হত এবং সাধারণ মানুষকেও দণ্ড দেবার সময় ঠিক ‘মানুষ’ বলে মনে করা হত না। দ্বিতীয় জর্জের রাজত্বকালে একজন সৈনিককে ষোল বছরের মধ্যে সংযমশিক্ষা দেবার জন্য ত্রিশ হাজার বেত্রাঘাত করা হয়েছিল, যদিও মানুষ হিসেবে সৈনিক ছিল ‘hearty and well’. দৃষ্টান্তটি ট্রেভেলিয়ান তাঁর ‘ইংলণ্ডের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। গোটা সতের ও আঠার শতক ধরে পার্লামেণ্টে একটির পর একটি প্রাণদণ্ডের আইন পাস করা হয়েছিল, এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণদণ্ডের অপরাধের সুদীর্ঘ তালিকা সংখ্যার দিক থেকে দুইশত পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ট্রেভেলিয়ান লিখেছেন :
Not only were horse and sheep-stealing and coining capital crimes, but stealing in a shop to the value of five shillings and stealing anything privily from the person, were it only a handkerchief. But such was the illogical chaos of the law, that attempted murder was still very lightly punished, though to slit a man’s nose was capital,-English Social History, ৩৪৮-৪৯
ঘোড়া-ভেড়া চুরি ও টাকাপয়সা জাল করলে প্রাণদণ্ড তো হতই, যে-কোনো দোকান থেকে পাঁচ শিলিং দামের জিনিস, অথবা যে-কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে সামান্য একখানি রুমাল চুরি করলেই অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। কোনো লোক খুন করার চেষ্টা করলে সামান্য শাস্তি পেত, কিন্তু কেউ কারও নাক কেটে দিলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হত। ইংলণ্ডের এই আইনের বিশৃঙ্খলাকে ট্রেভেলিয়ান ‘illogical chaos of law’ বলেছেন। তিনি একথাও উল্লেখ করেছেন যে, ইংরেজরা তখন অপরাধীদের এই সব কঠোর দণ্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেও ভালবাসতেন। Parson Woodforde-এর ডাইরি থেকে তিনি দুটি ঘটনার কথা এই পাশবিক আচরণের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন :
১৭৭২, ২২ জুলাই। রবার্ট বিগেন আলু চুরি করেছিল বলে তাকে বেত্রদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। একটি ঠেলাগাড়ির পেছনে বেঁধে তাকে চাবুক মারতে মারতে জর্জ-ইন থেকে এঞ্জেল পর্যন্ত, এবং সেখান থেকে আবার রাস্তার উপর দিয়ে রয়াল-ওকের ভিতর দিয়ে জর্জ-ইন পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়েছিল।
১৭৮১, ৭ এপ্রিল। আমার ভৃত্য উইলকে আজ ছুটি দিতে হল। তিনজন দস্যুর ফাঁসি দেওয়া জন্য সে আজ নরউইচ পর্যন্ত দশমাইল পথ হেঁটে যাবে ঠিক করেছে। উইল ফিরে এল সন্ধ্যা সাতটার সময়, এবং বলল যে তিনজনেই ফাঁসি যাবার সময় গভীর অনুতাপ প্রকাশ করেছিল।
আঠার শতকের ইংলণ্ডের বিচারের এই দৃশ্য ও দৃষ্টান্তের কথা মনে রাখলে, কলকাতা শহরে ও বাংলাদেশে এই সময়কার অপরাধ-বিচারের কাহিনিগুলি আদৌ আজগুবি বা অস্বাভাবিক বলে মনে হবে না। বরং এই কথাই মনে হবে যে, অপরাধ ও ন্যায়-বিচার সম্বন্ধে তাঁদের নিজেদের দেশের ধ্যান-ধারণাই তাঁরা পুরোপুরি এদেশে বহন করে এনেছিলেন, এবং বিচারবোধের দিক থেকে তাঁরা মধ্যযুগের স্বেচ্ছাচারী শাসকদের চেয়ে তখনও পর্যন্ত একটুও উন্নত হতে পারেননি। ঠিক ইংলণ্ডের মতনই একই অপরাধের জন্য একই দণ্ড তাঁরা এদেশে দিতেন, এবং নিজেদের দেশের মতন সেই দণ্ডের অমানুষিক দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন এদেশের লোকের সামনে। কলকাতা শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে একসময় যে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করে চোর ডাকাতদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত, এবং সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার জন্য আগে থেকে শহরবাসীদের ঢেঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হত, সেকথা আজ কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না। অথচ দেড়শো দুশো বছর আগেও এই নতুন কলকাতা শহরের নতুন নাগরিকরা বিচারের এই ভয়াবহ দৃশ্য প্রায় প্রাকৃতিক দৃশ্যের মতন দেখতেন। এইবার ইংরেজ আমলের এইসব অপরাধ ও তার বিচারের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেব।
৫ এপ্রিল ১৭৫৯। কলকাতার ইংরেজ জমিদাররা আশরফ ও মানিক দাস দুই ব্যক্তির অপরাধের (?) দণ্ডবিধান করে বোর্ডের কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করেন। দু’জনেই প্রতি শুক্রবার ১০১ ঘা করে বেত খাবে, তিন মাসের জন্য। বোর্ড এই দণ্ড বিধান মঞ্জুর করেন।
২ জুন, ১৭৬০। ‘Benautrom Chattogee’-মনে হয় বেচারাম চ্যাটার্জি এইভাবে ইংরেজি অক্ষরে রূপান্তরিত হয়েছেন। অপরাধী হলেন বেচারাম। বেচারি বেচারাম, বোধহয় সাহেবদের সুনজরে পড়ার আশায়, নতুন ফোর্টউইলিয়ম কেল্লা নির্মাণের কাজে জনৈক ক্যাপ্টেন-ইঞ্জিনিয়ার কীভাবে দু’হাতে টাকা চুরি করছেন, সেই খবরটা ইংরেজ জমিদারদের জানিয়ে দেন। বিচারের আগেই ইঞ্জিনিয়ার কোনো কারণে অকস্মাৎ ‘গত’ হয়েছিল মনে হয়। সুতরাং বিচারের দিন কৌন্সিলের সভাকক্ষে বেচারামকে তো ডাকা হয়ই, তার সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারের পুত্র মিস্টার বার্টনকে ডাকা হয়। সভাকক্ষে যখন বিচার চলেছে, বার্টন তখন দরজার পাশে দণ্ডায়মান বেচারামের দিকে চেয়ে রাগে ফুলছেন, এবং বেচারাম বার্টনের রক্তবর্ণ চক্ষুর দিকে চেয়ে ভয়ে কাঁপছেন। বার্টনের ক্রোধের কারণ কী? বেচারাম তার পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাঁকে অপসারিত করেছে। তার মৃত পিতার আত্মা সেজন্য ক্ষুব্ধ এবং বার্টন তাঁর সুযোগ্য পুত্র হিসেবে তার প্রতিশোধ নেবেন। তারই আগুন ধূমায়িত হচ্ছে তাঁর চোখে। বেচারাম অতটা বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন, বিচার হবে এবং অপরাধীর দণ্ড হবে। তাতে বার্টনেরই চিন্তিত হবার কথা। তিনি এমন কোনো অপরাধ করেননি, অন্যের চুরির কথা জানিয়ে, যে তার জন্য তার শাস্তি হতে পারে। বেচারাম এইসব কথা ভাবছেন এমন সময় এক অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটে গেল। ক্রুদ্ধ বার্টন এক হুঙ্কার দিয়ে বেচারামের ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়লেন। সঙ্গে তাঁর দু-চারজন বেয়ারাও ছিল। বেয়ারাদের সাহায্যে তিনি বেচারামের হাত পা বেঁধে, একটা বাঁশের ডগায় তুলে, ঠিক চড়ক-গাছের মতন বনবন করে ঘোরাতে লাগলেন। বেচারামের চিৎকারে সভাকক্ষের হতভম্ব বিচারকরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন, কিছুই করতে পারলেন না। ঘূর্ণিপাকের পর বেচারামকে চ্যাংদোলা করে নামিয়ে বার্টন সাহেব নিজের হাতে ‘Chawbooked him is the most cruel manner almost to the deprivation of life.’ কেবল চাবুক মেরেই বার্টন ক্ষান্ত হননি। বেচারাম চাটুয্যের ব্রাহ্মণত্ব সম্বন্ধে সাহেবের টনটনে জ্ঞান ছিল। সুতরাং চাবুক মারার পর ইংরেজনন্দন এদেশি কুলীন ব্রাহ্মণতনয়কে চিৎ করে ফেলে, বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসে, জোর করে মুখে গোমাংস গুঁজে দেবার চেষ্টা করছিলেন। সভার বিবরণীতে লেখা আছে-‘And all this without giving ear to, or suffring the man to speak in his own defence, or clear up his innocence to him.’-এতদূর পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বেচারামকে তার পক্ষে একটি কথাও বলবার সুযোগ দেওয়া হয়নি। হলওয়েল সাহেব নিজে ব্যাপারটা অত্যন্ত অন্যায় মনে করে বার্টনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। বার্টন কোনো কৈফিয়ৎ দেননি, কেবল বলেছিলেন যে বেচারাম একটি ‘profligate spy’, অতএব তাকে এইভাবে শাস্তি দেওয়াতে কোনো অন্যায় হয়নি।
১৭ নভেম্বর, ১৭৬০। অন্যায় করলে অপরাধীদের ইংরেজ জমিদাররা চাবুকাঘাতে মেরে ফেলতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের মনে হল, অপরাধের উপযুক্ত দণ্ড দেওয়া হচ্ছে না। চাবুক মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘sufficiently public’ নয়। সেইজন্য তাঁরা সভা করে সিদ্ধান্ত করেন যে, চাবুক না মেরে, কামানের মুখে বসিয়ে কামানদেগে প্রাণদণ্ড দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
১৭৬১ সালে লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে যখন ভীষণ চুরিডাকাতি আরম্ভ হয়, তখন কৌন্সিল বাংলার নবাবের কাছে এই মর্মে আবেদন করেন যে, স্থানীয় ফৌজদারকে হুকুম দেওয়া হোক, চোরের সর্দারকে সামনে দাঁড় করিয়ে কামান-দেগে মেরে ফেলতে। তা না হলে চুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে না-‘To fire off the mouth of a cannon the leader of the thieves who was made prisoner that others may be deterred’ ২৭ আগস্ট ১৭৬৪ সালের Secret Department-এর বিবরণী থেকে জানা যায় যে, রংপুরের ‘black servant’-দের একবার ঢেঁড়া পিটিয়ে কোনো বিষয়ে সত্য বিবৃতি দেবার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে একথাও সকলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, মিথ্যা বিবৃতি দিলে স্থানীয় ফৌজদার ‘would have their ears and noses cut off-তাদের নাসিকা ও কর্ণ দুইই ছেদন করে ফেলবেন, আস্ত রাখবেন না।
২৯ জানুয়ারী ১৭৬৬, তারিখের বিবরণীতে কলকাতা শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি আবেদনপত্র উদ্ধৃত করা হয়েছে। ইতিহাসখ্যাত গোবিন্দরাম মিত্রের পৌত্র রাধাচরণ মিত্রকে প্রতারণার অপরাধে যে ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন ইংরেজরা, তা মুকুব করার জন্য এই আবেদনপত্র লেখা হয়েছিল। কুমোরটুলির প্রসিদ্ধ মিত্রবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দরাম মিত্র কলকাতার ইংরেজ জমিদারের সহকারী ছিলন। সেইজন্য ইতিহাসে তিনি ‘ব্ল্যাক জমিদার’ বলে খ্যাতিলাভ করেন। আঠার শতকে কলকাতার দেশি ও বিদেশি উভয় সমাজেই তাঁর অখণ্ড প্রতিপত্তি ছিল। তাঁর পৌত্রকে জালিয়াতির অভিযোগে প্রাণদণ্ড দিলে শহরের সম্ভ্রান্ত সমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। আবেদনপত্রে প্রতারণার অভিযোগ সম্বন্ধে যে সব কথা বলা হয়েছিল, তা এখানে উল্লেখ না করলেও চলে। কিন্তু বিদেশী ইংরেজদের আইনকানুন সম্বন্ধে যে কথা আবেদনকারীরা বলেছিলেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা বলেছিলেন :
They find themselves subject to the pains and panalties of Laws to which they are utter strangers…many things being it seems capital by the English Laws, which are only fineable by the laws of your petitioner’s forefathers, subject to which they have hitherto been bred, lived, and been governed…
এমন অনেক অন্যায়ের জন্য ইংরেজি আইনে প্রাণদণ্ড হয়, যা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন না। কারণ তাঁদের পূর্বপুরুষদের আমলে এই সব অপরাধের জন্য জরিমানার বেশি কোনো শাস্তি হত না। তাঁরা বংশপরম্পরায় এই ধরনের আইনকানুন মেনে চলেছেন, তাই ইংরেজদের বিজাতীয় আইন ও বিসদৃশ বিচারনীতি অনেক সময় তাঁরা বুঝতে পারতেন না। আবেদনপত্রে হুজুরিমল, শুকদেব মল্লিক, শোভারাম বসাক, রাসবিহারী শেঠ, রাধামোহন বসাক, দয়ারাম ঠাকুর, দুর্গারাম ঠাকুর, নিমাই-চরণ শেঠ, মানিকচাঁদ, মদন দত্ত, হরেকৃষ্ণ ঠাকুর, নবকৃষ্ণ মুন্সী (মহারাজা নবকৃষ্ণ), রামনিধি ঠাকুর, গৌরচরণ শেঠ, পীতাম্বর শেঠ, কেবলরাম ঠাকুর প্রমুখ কলকাতার ৯৫ জন তদানীন্তন স্বনামধন্য ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ইংরেজি আইন সম্বন্ধে তাঁরা যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন তা বর্ণে বর্ণে সত্য। অন্তত আঠার ও উনিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ইংরেজরা তাঁদের নিজেদের দেশ ইংল্যাণ্ডে যেসব রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা শাসিত হতেন, আমাদের দেশে মুসলমান ও হিন্দু আমলেও সমাজ-শাসনের আইনকানুন তার অনেক বেশি উদার ও মানবিক ছিল। এদেশের লোক কল্পনাই করতে পারত না যে চুরি, প্রতারণা বা মিথ্যাকথা বলার অপরাধে তাদের নৃশংভাবে কামানের মুখে বসিয়ে, অথবা বেত্রাঘাতে হত্যা করা হবে। এই বিচিত্র দণ্ডনীতির মর্ম তাদের উপলব্ধি করতে অনেক সময় লেগেছে। তার মধ্যে অবশ্য ইংরেজদেরও বিচারবোধ অনেক উন্নত হয়েছে, এবং দেশের সমাজ-সংস্কারকদের আন্দোলনের ফলে তাঁরা ইংরেজি আইনকে ক্রমে অনেক উদার ও মানবিক করে তুলেছেন।
কিন্তু সেকথা আমাদের আলোচ্য নয়। সেদিন ইংরেজ বিচারকদের কথা এখনও শেষ হয়নি। দণ্ডবৈচিত্র্যের বিবরণ এখনও কিছু বাকি আছে। ক্যালকাটা গেজেট, ইণ্ডিয়া গেজেট, ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল প্রভৃতি প্রত্রিকা থেকে বিবরণগুলি সংকলিত। ১ আগস্ট, ১৭৯৫ কলকাতার সুপ্রিমকোর্টের বিচারে সিঁদকেটে চুরি করার অপরাধে ৬ জন ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়, ১৮ আগস্ট কয়েকজন ছিঁচকে চোরকে হাত পুড়িয়ে দেওয়ার হুকুম দেওয়া হয়। লোচন নামে একজন অপরাধীকে কিছু রুপোর গহনা চুরি করার অপরাধে বড়বাজারে প্রকাশ্যে চাবুক মারার পরে তিন মাস House of correction-এ বন্দি করে রাখার আদেশ দেওয়া হয়। হিন্দুস্থান ব্যাঙ্ক থেকে একটি মোহর চুরি করার অপরাধে কানাই দে নামে কোনো ব্যক্তিকে দশ দিন জেলখানায় আটকে রাখার পর ছেড়ে দিয়ে বড়বাজারের দক্ষিণদিকে একস্থানে নিয়ে আসা হয়, এবং সেখান থেকে বড়বাজারের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত চাবুক মারতে মারতে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়। ১০ ডিসেম্বর ১৮০২ সুপ্রিমকোর্টের বিচারে ডাকাতির জন্য বিজু মশালচির মৃত্যুদণ্ড হয়; চক্রান্ত করার জন্য আনন্দীরাম ও কতুলকিসনের দু’বছর করে জেল হয়; রামসুন্দর সরকারের সাত বছর দ্বীপান্তর হয়; ইমামবক্সের হয় যাবজ্জীবন দীপান্তর। অথচ ৪ নভেম্বর, ১৮০৪, মানুষ খুনের অপরাধে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকরা অপরাধীদের যে দণ্ড দেন, তা পূর্বের অপরাধ ও দণ্ডের সঙ্গে তুলনা করলে নিতান্ত হাস্যকর বলে মনে হয়। জন ম্যাকলকলিনের খুনের অপরাধে ১ টাকা জরিমানা ও একমাস কারাদণ্ড হয়; মহম্মদকে খুনের অপরাধে ঐ একই শাস্তি দেওয়া হয়। ম্যাথু নামে আর-এক ব্যক্তিকে খুনের অপরাধে এই দণ্ডেই দণ্ডিত করা হয়। জন, ম্যাথু ও মহম্মদ তিন জাতি ও সম্প্রদায়ের লোক। সুতরাং বিচারের দিক থেকে ইংরেজ বিচারকরা যে কোনো জাতিগত পক্ষপাতিত্ব দেখাননি, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। উইলিয়ম কেরি এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন : Verily the crimes of forgery and theft were considered by the lagislators of those days more heinous than that of manslaugther.’
সেদিনের ইংরেজ বিচারকরা চুরি-জালিয়াতিকে মানুষ খুনের চেয়ে অনেক বেশি গুরু অপরাধ বলে মনে করতেন। সুপ্রিমকোর্টের রায়গুলি (উনিশ শতকের গোড়ার দিকে) অনুধাবন করলে দেখা যায় যে, সামান্য চুরির অপরাধে হাত পুড়িয়ে দেওয়া তখনকার দিনে খুব সাধারণ দণ্ড বলে গণ্য হত।
দণ্ডদানের রীতি। লঘু অপরাধে গুরু দণ্ড, এবং গুরু অপরাধে লঘু দণ্ড দিয়েই বিচারকরা অপরাধীদের নিষ্কৃতি দিতেন না। বিচারের রায় দেবার পর অপরাধীদের দণ্ড দেওয়া হত সাধারণত প্রকাশ্যে চৌরাস্তার মোড়ে। যেমন ১০ জুন ১৮০৭, ছুরিমারার অপরাধে এক ব্যক্তিকে সুপ্রিমকোর্টে ফাঁসির হুকুম দেওয়া হয় এই ভাষায়-‘to be executed on Saturday, the 13th, at the four roads which meet at the head of Lall Bazar Street.’
১৩ জুন শনিবার লালবাজার স্ট্রীটের চৌরাস্তার মোড়ে প্রকাশ্যে অপরাধীকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে। ১৩ ডিসেম্বর ১৮১৫, অন্য একটি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে হত্যা করার জন্য পাঁচজন পর্তুগিজকে হুগলিনদীর উপর ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করে অভিনব কায়দায় ফাঁসি দেওয়া হয়। জাহাজের নাবিকরা যাতে এই দৃশ্য দেখতে পায়, এবং এরকম অপরাধ আরও কখনও না করে, সেইজন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
১৮০০ সালের ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল থেকে আরও দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। একজন এদেশি স্ত্রীলোককে অল্পবয়সের একটি বালিকা চাকরাণীকে হত্যা করার অপরাধে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে কলকাতার চৌরাস্তার মোড়ে তাকে নির্দিষ্ট দিনে ফাঁসি দেবার ব্যবস্থা করা হয়। যথাসময়ে ফাঁসির মঞ্চের চারিদিকে বহুলোকের ভিড় জমে। আসামী একগ্লাস জল খেয়ে, সমবেত জনতার দিকে চেয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেয় এবং বক্তৃতান্তে সকলকে সেলাম জানিয়ে বিদায় নেয়-‘Having drunk a cup of water, she addressed a few words to the multitude and made a salam as a final adieu to this world.’
ব্রজমোহন দত্ত নামে এক ব্যক্তিকে জনৈক সাহেবের বাড়ি থেকে একটি ঘড়ি চুরি করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। লালবাজারে চৌরাস্তার মোড়ে তাকেও ঐ একই পদ্ধতিতে ফাঁসি দেওয়া হয়। ব্রজমোহন উপস্থিত দর্শকদের সেলাম জানিয়ে, ‘সাহেব, তৈয়ার’ বলে তার প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করে। তারপরেই তাকে ফাঁসিকাঠে দর্শকদের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
আইন ও বিচারের দিক থেকে আঠার শতকের ইংলণ্ডের যে সামাজিক অবস্থার কথা ট্রেভেলিয়ান বর্ণনা করেছেন, আমাদের সমাজে ঠিক সেই অবস্থারই উদ্ভব হয়েছিল দেখা যায়। নবযুগের নূতন মানবতা-বোধ তখন ইংরেজদের মনে আদৌ জাগেনি। উদারতার আলোকেও ইংরেজ-সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। রূঢ় ও দুঃসাহসী ইংরেজ বণিক-শাসকদের মতনই ছিলেন সেদিনের ইংরেজ বিচারকরা। কলকাতার প্রভাবশালী ‘নেটিব’ অধিবাসীদের (আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধের) আবেদনের সারকথার মধ্যে সত্য আছে অনেকখানি। সেদিনের ইংরেজ বিচারকের চেয়ে আমাদের দেশে কাজির বিচার বা দণ্ডনায়কের বিচার অনেক বেশি ‘মানবিক’ ছিল। ট্রেভেলিয়ানের ভাষায় বলা যায়, ইংরেজরা সেদিন তাঁদের আঠার-শতকের সমাজের ‘Illogical chaos of law’ আমাদের সমাজে বহন করে এনে রীতিমত এক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলেন, যা নবাবি আমলের অতি মন্দ দিনেও কোনো স্বেচ্ছাচারী নবাব করতে সংকোচবোধ করতেন। বেচারাম চাটুজ্যের ঘূর্ণীপাক, উত্তম-মধ্যম প্রহার ও গোমাংস গলাধঃকরণ হয়ত সেদিনের সাহেবি ঔদ্ধত্যের বেহিসেবি প্রকাশ হতে পারে। কিন্তু কথায় কথায় সামান্য অপরাধের জন্য, মিথ্যা-প্রতারণা বা চুরি-জালিয়াতির জন্য লোকজনের নাক-কান কেটে ফেলা, হাত পুড়িয়ে দেওয়া, কামানের মুখে বসিয়ে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া, লালবাজারের মতন প্রকাশ্য স্থানে ফাঁসিকাঠে লটকে দেওয়া, অথবা বড়বাজারের মতন জনবহুল (তখনও অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বড়বাজার জনবহুল ছিল) অঞ্চলে চাবুক মারতে মারতে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়া-এরকম বিচারের কথা আমাদের দেশের লোক চরম অত্যাচারী রাজা-বাদশাহের কালেও কল্পনা করতে পারেনি। তাই সেদিনের ইংরেজ বিচারকের কাছে অনেক বেচারাম, কানাই, বলাই, মন্নু ও ইমামবক্স, লঘু অপরাধের জন্য অকারণে গুরুদণ্ড ভোগ করেছে, এমন কি মহারাজা নন্দকুমার বা গোবিন্দরাম মিত্রের পৌত্রের মতন সমাজের কর্ণধাররাও রেহাই পাননি।