রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস : প্রাচীন ভারতীয় ভাবনা
স্থান, কাল এবং প্রসঙ্গের ভেদে একই বস্তু দুই, তিন, চার রকমের চেহারা নেয়। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রাম, ফরাসি বিপ্লব, চিন-রাশিয়ায় বিপ্লব আন্দোলন–এইসব ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে অনেক ক্ষেত্রেই সন্ত্রাস ছিল, ছিল প্রতিপক্ষের রক্তপাত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদিতার মধ্যে যে খলতার দুষ্ট চিহ্ন আছে, সে চিহ্ন মুছে দিয়ে বৃহত্তর এবং মহত্তর এক আদর্শের ব্যঞ্জনায় এইসব আন্দোলন দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ অথবা দর্শনের মাহাত্ম লাভ করেছে। সন্ত্রাসবাদ যে এই মাহাত্ম লাভ করে না, তার একটা বড় কারণ হয়তো–এখানে হিংসা, নাশকতার কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। ধর্ম, ভাষা, রাষ্ট্র, জাতি অথবা অর্থনৈতিক প্রতিকার, যে উদ্দেশ্যেই হিংসা প্ররোচিত হোক না কেন, সেই হিংসার কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না। যে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই রাষ্ট্রের নিরীহ মানুষকে যত্র-তত্র হত্যা করা, সেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনের জন্য বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজ করা, এমনকী সেই রাষ্ট্রকে বিব্রত করার জন্য অন্যতর রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনও সন্ত্রাসবাদিতার পরিসরের মধ্যেই পড়ে।
সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসবাদের চরিত্র এতই বিচিত্র যে পণ্ডিত-সজ্জনেরা পৃথিবীময় সংঘটিত বিভিন্নধর্মী সন্ত্রাসবাদের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্দেশ করতে পারেননি এবং এই প্রবন্ধে অধুনা-প্রচলিত সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আমরা আলোচনা করব না। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের যে স্বতোবিভিন্ন চরিত্র আছে বা প্রকার আছে, সেই প্রকারগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল–অন্তঃরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং অন্যটি হল–এক রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকার কর্তৃক নিজ রাষ্ট্রে এবং পররাষ্ট্রে সংঘটিত সন্ত্রাস। আমরা বলতে চাই-প্রাচীনকালে যখন রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল, সেই সময় থেকে আজকে যে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের তথাকথিত সুব্যবস্থা চলছে, সেখানেও বহুক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষ, প্রতিনেতা এবং বিপক্ষ দলের প্রতি যে মনোভাব এবং আচরণ ব্যক্ত হয়, তা অনেক সময়ই সন্ত্রাসবাদিতার নামান্তর।
প্রাচীন রাজতন্ত্রের পরম্পরায় রাজারা নিজেদের ব্যক্তিশাসন বজায় রাখার জন্য যেভাবে শত্রুপক্ষকে উচ্ছিন্ন করার কথা ভাবতেন, গণতন্ত্রের হোতারাও কখনও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে পার্শ্ববর্তী অথবা দূরবর্তী শত্রুরাষ্ট্রকে উচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেন, আর অন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে জনগণের শান্তি, সুরক্ষা এবং স্বার্থরক্ষার নামে নির্বিচারে প্রতিপক্ষের ক্ষতিসাধন করেন–তবে একটু রেখে-ঢেকে এবং তাতে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞাটা আরও জটিল এবং ধূসর হয়ে ওঠে। বর্তমান প্রবন্ধের পরিসরে আমরা দেখানোর চেষ্টা করব যে, প্রাচীনকালে রাজতন্ত্রসেবী রাজারা অন্তঃরাষ্ট্রীয় তথা পররাষ্ট্রীয় শত্রুশাসন করবার জন্য যে ধরনের সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতেন, এখনকার দিনের পরিশীলিত সমাজব্যবস্থাতেও রাষ্ট্র সেই সন্ত্রাসী ভূমিকাই পালন করে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের নামে। অবশ্য আধুনিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আমাদের ভাবনার বিষয় হবে না এখানে, তবে রাজতন্ত্রের অবশিষ্ট স্মারক হিসেবে সেই সন্ত্রাস তুলনীয় বিষয় হিসেবে গণ্য হবে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও।
ভগবদ্গীতার যে কথাটা প্রাবাদিক স্তরে পৌঁছেছে, সেটা আমরা সকলেই জানি–পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্। পরম ঈশ্বর যেমন ধর্মস্থাপনের জন্য অবতার গ্রহণ করেন, প্রাচীন রাজারা ঈশ্বরের অবতার হিসেবে গণ্য না হলেও, তারা ঈশ্বরের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতেন, অতএব ধর্ম-রক্ষা করাটাকে তারাও নিজেদের কাজ বলেই মনে করতেন। কারণ, ধর্ম মানে শৃঙ্খলা এবং রাজাকেই ধর্মের প্রতিভূ বলে মনে করা হয়েছে প্রাচীন রাজনীতিশাস্ত্রে–বর্ণানাম্ আশ্ৰমাণাঞ্চ রাজা সৃষ্টোভিরক্ষিতা। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ থেকে আরম্ভ করে প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলির মধ্যে সর্বত্রই যদিও প্রজাকল্যাণ এবং জনকল্যাণের উদার আদর্শেই রাজার কৃত্য-কর্তব্যগুলি নির্ধারিত হয়েছে, তবু রাজশাসন পরিচালনা করার সময়–যাঁরা রাজার বিপক্ষতা সৃষ্টি করবেন, কিংবা যাঁরা তার প্রতি বিদ্বেষ-ভাব পোষণ করবেন, তাদের প্রতি কোনো মৃদু, উদার বা শিথিল আচরণের অবকাশ প্রাচীন রাজনীতিশাস্ত্রকারেরা রাখেননি।
মনু-মহারাজ এ-ব্যাপারে দুটিমাত্র পক্ষ বোঝেন। এক, যাঁরা রাজার অনুকূলে আছেন রাজাও তাঁদেরই নিজের ইষ্ট’ বা অভীষ্ট জন বলে মনে করবেন, আর যারা বিদ্বেষী,রাজাকে যারা পছন্দ করছেন না, তারা রাজার ‘অনিষ্ট’ পক্ষ অর্থাৎ তারা রাজার প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষ বিদ্বেষীদের রাজা কোনোমতেই বাঁচতে দেবেন না। মনুর মতে রাজার প্রতি যাঁরা বিদ্বেষ আচরণ করছেন তাদেরকে খুব তাড়াতাড়িই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য রাজা সিদ্ধান্ত নেবেন–তস্য হ্যাঁশু বিনাশায় রাজা প্রকুরুতেমনঃ–অতএব সাধারণ মানুষের প্রতি মনুর উপদেশ–ভুলেও যেন রাজার প্রতিকূল আচরণ কোরো না। রাজার উৎপত্তি বিষয়ে মনু-মহারাজ ঐশ্বরিক মতবাদে বিশ্বাস করেন বলেই তার উপদেশের মধ্যে যৌক্তিকতা কম আছে, এটা মনে হলেও এ-কথা মাথায় রাখতে হবে যে, কৌটিল্য এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদেরাও কিন্তু একটা বিষয়ে একমত এবং সেটা হল–রাজা কখনও কাউকে বিশ্বাস করবেন না এবং এই অবিশ্বাস এতই প্রগাঢ় হওয়া উচিত যে, রাজার অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রীরা এবং নিজের ঔরসজাত রাজপুত্রেরাও তার বিশ্বাসের পাত্র নন। আর রাজোপজীবী মন্ত্রী-অমাত্য-সেনাপতি এবং অন্যান্য রাজকর্মচারীদের বৃত্তি সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে কৌটিল্য বলেছেনরাজার কাছে যারা জীবিকার জন্য আশ্রয় নিয়েছে, তাদের কাজ অনেকটা আগুনের মধ্যে খেলা দেখানোর মতো–আগুন তো তবু ভালো, কেননা দেহের যে অংশটুকু অগ্নিস্পৃষ্ট হয়, সেই অংশটুকুই শুধু দগ্ধ হয়, কিন্তু রাজা হলেন এমনই এক আগুন, যা মানুষের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার-পরিজন, ঘর-বাড়ি সব ধ্বংস করে দেয়। আগুনের এই উপমাটা কৌটিল্য যেভাবে দিয়েছেন, মনুও ঠিক সেইভাবেই দিয়েছেন।
স্ত্রী-পুত্র-পরিবার এবং রাজোপজীবী মানুষদের সবাইকেই যদি অবিশ্বাস করতে হয়, তাহলে রাজার দিক থেকে একটা সার্বত্রিক সন্ত্রাস-সৃষ্টির ভাবনা আপনিই চলে আসে। আমরা বলেছি–প্রাচীন রাজতন্ত্রে রাজারা যে কখনো কখনো ভীতিজনক হয়ে উঠতেন কিংবা রাজনৈতিকভাবেই যে তাদের সন্ত্রাসজনক হয়ে ওঠাটা শাস্ত্রসম্মত ছিল, তার পিছনে পূর্বকল্প হল একটাই–রাজার কাছে যে ব্যক্তি, যে গোষ্ঠী অথবা যে রাষ্ট্র ‘অনিষ্ট’অনভীষ্ট বা প্রতিকূল, তাদের উচ্ছিন্ন করাটাই তৎকালীন রাজার পরম এবং চরম উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে, আর সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করাটাও রাজধর্মের অন্তর্গত ছিল। রাজতন্ত্রে রাজা এবং তার রাষ্ট্রের মধ্যে যেহেতু ব্যক্তিসম্বন্ধটা খুব বেশিমাত্রায় জাগ্রত ছিল, তাই রাজার আত্মরক্ষার বিষয়টিও যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনই প্রজার সুরক্ষা। ফলে অনিষ্ট-শমন এবং প্রতিকূলতা নাশ করার জন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছিল রীতিমতো জরুরি এবং তা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং পররাষ্ট্রে দুই জায়গাতেই প্রসারিত ছিল।
এ-কথা অবশ্যই এখানে মনে রাখতে হবে যে, প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজতন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিসর্বস্বতা থাকলেও দার্শনিকভাবে এবং নীতিগতভাবে রাজতন্ত্রের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার অবসর ছিল না কোনো। ইচ্ছে করলে রাজা জোর করেই নিজের ইচ্ছে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারতেন, কিংবা দণ্ডবিধানও করতে পারতেন মন্ত্রী-অমাত্যের অভিমত উপেক্ষা করে, কিন্তু দণ্ডের এতাদৃশ প্রয়োগ রাজতন্ত্রের অতিবড়ো সমর্থক মনু-কৌটিল্যরা কেউই অনুমোদন করেননি। দণ্ড প্রয়োগের ব্যাপারে মনুর সোম্ফাস মন্তব্যগুলি দার্শনিকতার বিচারে কৌটিল্যের চেয়ে খানিকটা ক্রুড় মনে হবে নিশ্চয়ই, এমনকী এক জায়গায় রাজনীতিবিদদের যান্ত্রিকতা এবং স্বার্থপর তথা আত্মলাভের কারণেই চিন্তা-বোধ-হীন দণ্ডপ্রয়োগের হাজার দৃষ্টান্ত মনে রেখেও মনু বলেছেন-ন্যায়-নীতি-শৃঙ্খলা রক্ষার মূল প্রতিভূ হল দণ্ড। এই অকপট উক্তি এবং দণ্ডের সম্বন্ধে একই সঙ্গে রাজা, পুরুষ, নেতা এবং শাসিতা শব্দের প্রয়োগ করে মনু বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, শুধু রাজতন্ত্র নয়, অন্যবিধ শাসনতন্ত্রেও বিপন্ন সময়ে দণ্ডই হল শাসকগোষ্ঠীর প্রধান অবলম্বন।
দণ্ডের এই উৎকট এবং অকপট স্বরূপ মনুসংহিতায় যতই প্রশংসিত হোক অন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রজা বা অন্যতর রাষ্ট্র–কারও উপরেই অন্যায়ভাবে দণ্ডপ্রয়োগের কথা মনু বলবেন না এবং তা বললে রাজা শুধুমাত্র সন্ত্রাস-সৃষ্টিকারী হিসেবেই চিহ্নিত হতেন। অন্যদিকে অন্যায়কারী ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ওপর দণ্ডপ্রয়োগ করাটাও সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য হতে পারে না, কেননা রাজার প্রতি যে ব্যক্তি ব্যক্তিগত বিরোধিতায় অবতীর্ণ হচ্ছে, সে যুক্তিসঙ্গতভাবেই তা করুক বা ন্যায় অনুসারেই করুক, সেই ব্যক্তিকে কিন্তু রাজা জীবিত থাকতে দেবেন না এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই অনিষ্ট ব্যক্তিকে বিনাশের উপায় রাজা খুঁজে বার করবেন–এটাই মনুর মত এবং রাজতান্ত্রিক সংবিধানে এটাই প্রায় নিয়মের মধ্যে পড়ে। যেন-তেন প্রকারে শত্রুনাশের পদ্ধতি গ্রহণের ব্যাপারে কৌটিল্যও মনুর সঙ্গে একমত হবেন বটে, তবে ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ বলেই তার কথা এত স্পষ্ট নয়।
এ কথা অবশ্যই মানতে হবে যে, ব্যক্তিগত শত্রুই হোক অথবা রাষ্ট্রের শত্রুই হোক অথবা সেটা হোকশরাষ্ট্র–এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দণ্ডবিধানের ব্যাপারে এক ধরনের দার্শনিকতা এবং নৈতিকতা কাজ করেছে এবং সেই কারণেই চরম দণ্ডবিধানের আগে নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক বোধের ভিত্তিতেই চতুরুপায়ের তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। সাম, দান, ভেদ এবং দণ্ড–এই চারটি উপায় হল রাজনৈতিক উপায় এবং এই চতুরুপায় অন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যক্তিগত শত্রুর ক্ষেত্রেও যেমন প্রযোজ্য ছিল তেমনই পররাষ্ট্রীয় বহিঃশত্রুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। চারটি উপায়ের মধ্যে তিনটিই যদি অসফল হয়, তবেই দণ্ডের মাধ্যমে শত্রুর শাস্তিবিধান করে তাকে অনুকূলে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন মনু। অর্থাৎ ভালো কথায় এবং আলাপ আলোচনায় সাম-নীতিতে যদি কাজ না হয়, তবে দান-নীতি প্রয়োগ করে কিছু দান দিয়ে শত্রুর লোভ উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দেওয়াটাও মনু যেমন পছন্দ করেন না, তেমনই ভেদনীতির মাধ্যমে অযথা সময় নষ্ট করাটাও তার মত নয়। সামে কাজ না হলেই দণ্ডদান করাটাই মনু যথার্থ মনে করেন।
দণ্ডদানের ক্ষেত্রে কৌটিল্যের মত একটু ভিন্ন। তার পূর্বকালের যে বিবরণ তাঁরই লেখায় পূর্বাচার্যদের অভিমত হিসেবে পাওয়া যায়, তাতে দেখি, রাজনীতিবিদরা কেউ কেউ দণ্ডপ্রয়োগের ক্ষেত্রে একেবারে নির্বিকার থাকতে বলেছেন। তাঁরা মনে করেন–মানুষকে নিজের অধীনে নিয়ে আসবার এমন ভালো উপায় আর নেই, যেমনটি দণ্ড। কৌটিল্যের পূর্বসূরিদের সোজা-সাপটা বক্তব্য এইটাই যে, যেমনভাবেই হোক ভয় দেখিয়ে, শাস্তি দিয়ে সকল মানুষকে নিজের বশে নিয়ে আসাটাই রাজতন্ত্রের সঠিক পদক্ষেপ। কৌটিল্য অবশ্য সযৌক্তিকভাবেই এই ধরনের আদর্শকে প্রায় সন্ত্রাসবাদের আখ্যায় চিহ্নিত করেছেন এবং বলেছেন–এমনটি চলতে থাকলে বানপ্রস্থী পরিব্রাজকেরাও রাজার উপরে বিরূপ হয়ে উঠবেন, সাধারণ প্রজারা তো কথাই নেই।
পররাষ্ট্রীয় নীতিতেও কৌটিল্য ক্রমান্বয়ে চতুরুপায় প্রয়োগের পক্ষপাতী। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে সাম, দান, ভেদ এবং দণ্ডের প্রয়োগ বিশ্লেষণ করে কৌটিল্য বলেছেন যে, চতুরুপায়ের উপযুক্ত হল বলবান শত্রু। তিনি মনে করেন–দুর্বল শত্রুকে সামনীতি এবং দাননীতির দ্বারাই বশীভূত করা যেতে পারে আর বলবান শত্রুকে বশে আনতে গেলে ভেদ এবং দণ্ডের প্রয়োগ করা উচিত–সাম-দানাভ্যাং দুর্বলা উপনময়েৎ, ভেদ-দণ্ডাভ্যাং বলবতঃ। ভেদ এবং দণ্ডের মাধ্যমে বলবান শত্রুকে শমন করার যে বুদ্ধি, তার মধ্যেই কৌটিলীয় সন্ত্রাসের প্রকৃতি লুকানো আছে এবং তা যে আধুনিক অর্থেও বেশ প্রযোজ্য এবং আধুনিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রকৃতিই যে এই ভেদ-দণ্ডের মধ্যে সমাহিত, তা আমরা পরে দেখব। লক্ষণীয় ব্যাপার হল–দণ্ডপ্রয়োগের ক্ষেত্রে কৌটিল্য দার্শনিকভাবে এবং নীতিগতভাবে মনুর মত এবং তার পূর্বাচার্যের মতের পরিপন্থী হলেও রাজার ইষ্টানিষ্ট কিংবা অনুকূল-প্রতিকূল ব্যক্তির বিষয়ে তিনি যে খুব ভিন্নমত, তা তার বাস্তব মন্তব্যগুলি থেকে মনে হয় না।
মনু-মহারাজের রাজকর্ম-বিশ্লেষণে রাজার হাতে যত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তার মর্মমূলে আছে দণ্ড। তিনি সামনীতির যতই প্রশংসা করুন, সমস্ত প্রজাবর্গ কিংবা পররাষ্ট্রের কাছেও রাজার আকার-প্রকার-অভিসন্ধি খুব স্নিগ্ধ-মধুর হয়ে উঠুক, এটা মনুর আকাঙ্ক্ষিত রাজধর্ম নয় এবং তা বোঝা যায় একটিমাত্র শ্লোক থেকেই। মনু বলেছেন–রাজাকে সদা সর্বদা এই ভয় সর্বত্র জিইয়ে রাখতে হবে যেন শাস্তি দেবার জন্য তিনি অভিমুখ হয়েই আছেন, সৈন্যসামন্তেরাও অস্ত্রশস্ত্রে শান দিয়ে, হাতি-ঘোড়া-রথের কুচকাওয়াজ করে যুদ্ধের প্রকট অভ্যাস প্রদর্শন করবেন, আর তার সঙ্গে অস্ত্রবিদ্যার অভ্যাস প্রকাশিতভাবে দেখাবেন–নিত্যমুদ্যতদণ্ডঃ স্যান্নিত্যং বিবৃতপৌরুষঃ। মনুর এই রাজধর্ম বিষয়ক প্রস্তাবের মধ্যে যে কোমল কোনো অভিসন্ধি নেই, অথবা রাজাকে প্রজামনোমাহন রূপে প্রতিষ্ঠিত করার বাস্তব তাৎপর্যও যে মনু অনুভব করছেন না, সেটা প্রমাণিত হয়–কৌটিল্য যখন পূর্বাচার্যদের প্রস্তাবিত তীক্ষ্ণ দণ্ডের প্রসঙ্গ খণ্ডন করার সময় হুবহু মনুর মতটাই উল্লেখ করেছেন। কৌটিল্য বলেছেন–আমার পূর্বাচার্যরা বলে থাকেন যে, লোকযাত্রা, সমাজ-ব্যবহার এই দণ্ডনীতির উপরেই নির্ভর করে। অতএব যে রাজা লোকযাত্রার সম্যক অনুষ্ঠানে তৎপর, তিনি নিত্য উদ্যতদণ্ড অর্থাৎ দণ্ড প্রণয়নে সদা-সর্বদা উদ্যত থাকবেন–নিত্য উদ্যতদণ্ডঃ স্যাৎ। কেননা, আচার্যের এইটাই মত যে, দণ্ড ছাড়া অন্য কোনোপ্রকার সাধন তেমন কার্যকর হতে পারে না, যাতে করে সকলকে বশে রাখা যায়।
কৌটিল্য নীতিগতভাবে এই মত মানেন না। কেননা সদা-সর্বদা উদ্যতদণ্ড রাজা অনেক ক্ষেত্রেই তীক্ষ্ণ দণ্ডের পক্ষপাতী হয়ে পড়তে পারেন এবং সেই কারণে সমস্ত লোকের কাছে রাজার একটা সন্ত্রাসীভাব প্রকট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকায় সকলের কাছেই তিনি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারেন বলে মনে করেন কৌটিল্য। কিন্তু নীতিগতভাবে এই মত না মানলেও অন্তঃরাষ্ট্রীয় তথা পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কৌটিল্যের প্রস্তাবিত নীতিগুলি বাস্তবে একপ্রকার সন্ত্রাসের চেহারাই প্রকট করে তুলবে। সে-কথায় আমরা পরে আসব এবং এখন যে প্রসঙ্গে আলোচনা করব, সেখানেও অবসর অনুযায়ী আমরা কৌটিল্যের মতও উল্লেখ করব। প্রথমে জানানো দরকার–কৌটিল্য যেটা পূর্বাচার্যের মত বলে উল্লেখ করেছেন, তা প্রধানত মনুর মতের সঙ্গে আপাতভাবে মিলে গেলেও এটা আসলে প্রাচীনপন্থী রাষ্ট্রনীতিবিদদের অনেকেরই মত। এই ধারণার নৈতিক এবং বাস্তব সমর্থন সবচেয়ে ভালো পাওয়া যাবে ভারতবর্ষের মহাকাব্যগুলিতে। মহাভারতেই প্রধানত রাজা এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চরিত্র খুব স্পষ্ট, এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হলেও রামায়ণেও এই সন্ত্রাসের প্রকৃতি ধরা পড়ে। একই সঙ্গে বলা দরকার–এই সন্ত্রাসের পিছনে মহাকাব্যকারের নৈতিক সমর্থন নেই এবং সেইজন্যই এই সন্ত্রাস সবসময়েই প্রতিনায়কের মনোবৃত্তিপ্রসূত–যা অন্যায় এবং অধর্মের সংজ্ঞায় চিহ্নিত হয়েছে। এই সন্ত্রাসের বিপ্রতীপ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মহাভারতীয় যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ্য অথবা রামায়ণে রাবণের মৃত্যুর পর বিভীষণের রাজ্যাভিষেক এবং সার্বিক রামরাজ্য।
রাজা বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের তত্ত্বগত যে চেহারাটা আমরা মনুসংহিতা, মহাভারত বা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও পাই, সেটা প্রতিপক্ষীয় সন্ত্রাসের কারণ থেকেও জন্ম নিয়েছে, আবার আরও গভীরে গেলে দেখা যাবে-প্রতিপক্ষ যে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিচ্ছে তার সুপ্রাচীন অন্তর্গত কারণ লুকিয়ে আছে আর্যায়ণের মধ্যে। এ কথা মানতেই হবে যে, সুপ্রাচীন কালে আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর যে প্রকৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদানগুলিতে অথবা বেদ, ব্রাহ্মণ বা উপনিষদ-গ্রন্থগুলির মধ্যে পাওয়া যায়, তাতে বেশ বোঝা যায় যে, আর্যরা যথেষ্ট যুদ্ধপ্রিয় জনগোষ্ঠী ছিলেন। তাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জীবনধারণের জন্য খাদ্য, আবাস এবং সুস্থিতি যেহেতু যথেষ্ট জরুরি ছিল, অতএব যুদ্ধ করার জন্য আর্যদের কোনো ভালো অজুহাত দরকার ছিল না। আবাসের জন্য অথবা কৃষিকর্মের জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজটা যেহেতু পরাজিত শত্রুকে দিয়েই অনায়াসে সম্পন্ন হয়, তাই প্রায় যাযাবর-বৃত্তি জনগোষ্ঠীর পক্ষে যুদ্ধ করাটা অনেক বেশি সুবিধেজনকও। আর যুদ্ধ যদি একবার উত্তেজিত রক্তের মধ্যে সংক্রমিত হয়, তাহলে সেখানে এক ধরনের সন্ত্রাস উৎপন্ন হবেই।
ঋগবেদের মধ্যে এমন বহুতর ঋমন্ত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে যেখানে আর্যগোষ্ঠীর যুদ্ধনায়ক ইন্দ্র তার সামরিক তেজের দ্বারা ভারতবর্ষের পূর্বনিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্র, ভূমি এবং সম্পত্তি অধিকার করে নিয়েছিলেন। পূর্বস্থিত জনসাধারণ অনেক সময়েই দস্যু বা দাস নামে চিহ্নিত এবং তাদের অনেকের নামও মন্ত্রের মধ্যে সরলভাবে উল্লিখিত হয়েছে। একটি মন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে–ইন্দ্র অন্য সহযোগী দেবতাদের সঙ্গে মিলে তথাকথিত দস্যুদের শিম নামে এক প্রতিপক্ষ-নেতাকে হত্যা করে তাদের কৃষিক্ষেত্র নিজেদের শ্বেতবর্ণ বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন–দমিংশ্চ পুরুত এবৈত্বা..সনৎক্ষেত্রং সখিভিঃ শ্বিত্নেভিঃ। আসলে বেদের মধ্যে অনার্য জনগোষ্ঠীর বহুতর আহত এবং হত নেতাদের নামও এমনভাবে চিহ্নিত হয়েছে যে, ইন্দ্র রীতিমতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু এই ঐতিহাসিকতা এসেছে আর্যেতর গোষ্ঠীর জমি, সম্পত্তি, পশুধন এবং শস্যের মূল্যে।
বৈদিক স্তুতিমন্ত্রের মধ্যে অন্যান্য যুদ্ধপ্রিয় দেবতাদের সঙ্গে ইন্দ্রের বিভিন্ন যুদ্ধোন্মত্ততার যেসব ছোটো ছোটো চিত্র ফুটে উঠেছে, সেগুলির সারবত্তা বিচার করলে দেখা যাবে যে, পরবর্তী সময়ের যুদ্ধনীতির মধ্যে যে মহাকাব্যিক নৈতিকতা লক্ষ করা যায় তার এতটুকুও তখন উপস্থিত ছিল না। ফলত তৎকালীন যুদ্ধনীতির মধ্যে বেশিরভাগটাই ছিল সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসের চেহারা আরও শাণিত হয়েছে যুদ্ধাস্ত্রের অঙ্গে-অঙ্গে লৌহ ব্যবহারের সূচনায়। ১৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার বিপর্যয় ঘটে যাবার পর ধাতুর আকর গলিয়ে লোহা পৃথক করে নেবার (iron smelting) গূঢ় বিদ্যাটি আশপাশের প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে যেতে থাকে। লৌহ-কর্মকারেরা কাজ পেতে থাকে অন্যান্য প্রাচীন যুদ্ধপ্রিয় জনগোষ্ঠীর কাছে। বেদের মধ্যে রিভুদের নাম পাওয়া যাবে, যারা ইন্দ্রের ভয়ংকর লৌহবজের উপাদান সৃষ্টি করেছিলেন। সিন্ধু-সভ্যতার আদিবাসী মানুষেরা ব্রোঞ্জের ব্যবহার জানতেন, কিন্তু লোহার ব্যবহার জানতেন না। পণ্ডিতদের মতে মোটামুটি একাদশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতের মাটিতে লৌহকর্মের প্রবর্তন ঘটে এবং সেই লোহাই ইন্দ্রের ভয়ংকর শত্রুঘাতী অস্ত্র বজ্রের নিদান–যার মাধ্যমে অহি, নমুচি, ধনি, শিম, চুমুরি এবং বৃত্রের মতো প্রাগার্য যুদ্ধনায়কেরা একে-একে ইন্দ্রের কাছে আনত হন। অগ্নি, বায়ু, সোম, মরুৎ অথবা বিষ্ণু–এইসব দেবতাদের নামও যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত বটে, তবে তারা শত্রুদমনে ইন্দ্রের সহায়তা করেন মাত্র, মূল নায়ক ইন্দ্রই।
ইন্দ্রের মতো নির্মম অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে প্রাগার্য ভারতীয়দের যুদ্ধকৰ্ম অত সহজ ছিল না, অন্তত অস্ত্ৰযুদ্ধ তো সহজ ছিলই না। এর ফলে ইতস্তত চোরাগোপ্তা আক্রমণই তাদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল। বৈদিকরা এই উপায়ের নাম দিয়েছেন মায়া’, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ছলনা, কপটতা এবং ইন্দ্রজাল। এই মায়া’ ব্যাপারটা যে তথাকথিত অসুরদেরই একচেটিয়া ছিল, তা নয়, কেননা অতি পরাক্রমী ইন্দ্রকেও আমরা ছলনার মাধ্যমে অসুরদের ভূমি-সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে দেখেছি। কিন্তু তবুও বলতেই হবে যে উন্নততর অস্ত্রশক্তির অধিকারী আর্য যুদ্ধনায়কদের বিরুদ্ধে অসুর-রাক্ষসদের অন্যতম প্রতিরোধই ছিল আকস্মিক সন্ত্রাস এবং মায়াযুদ্ধ। অসুরদের ছলনা-কপটতা এবং আকস্মিক সন্ত্রাসের এই সূত্র, ভারতবর্ষের প্রাচীন দুই কাব্য রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যেও বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যের প্রতীক যজ্ঞস্থলগুলিতে বারবার হানা দিয়েছেন তথাকথিত অসুর-রাক্ষসেরা, আকস্মিক সন্ত্রাসে ব্রাহ্মণদের উত্ত্যক্ত করেছেন বারবার–এমন ঘটনা তো রামায়ণে বিশেষভাবে পাওয়া যাবে, আর মহাভারতে এই সন্ত্রাসের প্রতীক হয়ে উঠেছেন আর্যদেরই অন্যতর এক জ্ঞাতিগোষ্ঠী, কিন্তু তাদেরও পূর্বজন্মের পরিচয় চিহ্নিত হয়েছে বিবাদের প্রতীক কলি এবং পৌলস্ত্য যক্ষ-রাক্ষসদের পরিচয়ে।
রামায়ণে আমরা দেখেছি–বিশ্বামিত্র মুনি দশরথ-রাজার কাছে সাহায্য চেয়ে বলেছেন–আমরা যে যজ্ঞ-ব্রত অনুষ্ঠান করেছিলাম, সেখানে দুই মায়াবী রাক্ষস এসে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে–তস্য বিঘ্নকরৌ ঘৌ তু রাক্ষসৌ কামরূপিনৌ। এই রাক্ষসেরা–যাদের নাম মারীচ এবং সুবাহু–তারা যেভাবে অমেধ্য মাংস এবং রক্তে যজ্ঞস্থল অপবিত্র করে দিয়ে যজ্ঞ নষ্ট করে দিত, সেটা ছিল ব্রাহ্মণ্যের ওপরে চোরাগোপ্তা আঘাত। তবু এখানে কোনো গুপ্তহত্যার চক্রান্ত নেই যেটা পাওয়া যাবে অরণ্য-কাণ্ডে। সেখানে যোগী মুনিঋষিরা রামচন্দ্রের কাছে রাজা হিসেবে নালিশ জানিয়েছেন রাক্ষসদের উৎপীড়ন-কাহিনি শুনিয়ে। এমনও বলেছেন যে, রাক্ষসদের আকস্মিক আক্রমণে কীভাবে তারা প্রাণ হারাচ্ছেন। পম্পা-সরোবর, মন্দাকিনী নদীর তীর এবং চিত্রকূট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে কত শত মুনির মৃত শরীরও তারা দেখাতে চেয়েছেন রাক্ষসদের গুপ্ত এবং আকস্মিক আক্রমণের প্রমাণ হিসেবে
এহি পশ্য শরীরাণি মুনীনাং ভাবিতাত্মনাম্।
হতানাং রাক্ষসৈর্ঘোরৈ বন্ধুনাং বহুধা বনে৷৷
রামায়ণে রাক্ষসদের অবস্থান এবং আক্রমণের প্রকৃতি বিচার করলে বোঝা যায় যে, উত্তর, পশ্চিম এমনকী পূর্বভারতেও আর্যায়ণ-পদ্ধতি অনেকটাই সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পর দক্ষিণ ভারতের দিকে ছড়িয়ে পড়া আর্যেতর জনগোষ্ঠী–যাঁরা অন্তত আর্যদের উন্নততর অস্ত্রসিদ্ধির সামনে সুসংহত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছিলেন না, তারা নিজস্ব ভূসম্পত্তি হারিয়ে এই অদ্ভুত সন্ত্রাসের পথই বেছে নিয়েছিলেন। এই প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল এবং রামায়ণে রাক্ষসদের এই গুপ্ত এবং প্রকীর্ণ সন্ত্রাসের কাহিনি আমরা এই কারণেই লিপিবদ্ধ করছি যাতে উলটো দিক থেকে বোঝা যায় যে, আর্যায়ণের পূর্বকল্পে যেভাবে আর্যেতর জনজাতি তথাকথিত দেবতাপ্রমাণ আর্যদের হাতে যেভাবে পর্যদস্ত হয়ে ভূমি-সম্পত্তিহারিয়েছিলেন, তারই প্রতিক্রিয়া ঘটেছে চোরাগোপ্তা গুপ্ত আক্রমণের মাধ্যমে। সম্মুখযুদ্ধে অস্ত্রসিদ্ধ আর্যদের হাতে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হওয়ায় চুরি, রাহাজানি, ডাকাতি এবং বহুতর হিংসাকর্মই যে তাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ মেলে কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় সংহিতায় মন্ত্রোদ্দিষ্ট আক্রোশের মধ্যে। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি অগ্নির উদ্দেশে বলছেন–যারা চোর, যারা বাড়ি ভেঙে ডাকাতি করে, যারা তস্কর তাদের সবাইকে তোমার দাঁত দিয়ে চিবোও, তোমার হনু দিয়ে মস্ মস্ করে গুঁড়ো করে ফেল।
এখানে চোর, তস্কর, দস্যু, অপিচ গুপ্ত তথা প্রকট শত্রুর বিদ্বেষ-ভাবনা থেকে অগ্নির কাছে যে মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়েছে, তার মধ্যে বৈদিক জনজাতির ক্রোধাবেশটুকু টের পাওয়া যায়। এই ক্রোধের মধ্যেও মায়া নেই, মমতা নেই, এমনকী নীতিনিয়মও কিছু নেই এবং সেইজন্যই সেটাকেও সন্ত্রাস বলতে আমাদের অসুবিধে হয় না। বস্তুত সন্ত্রাস কথাটার মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধের বলদর্পিত নৈতিক তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্য কোনোটাই নেই। যা আছে, তার অনেকটাই ভীতিজনক এবং নৃশংস হয়ে ওঠার পদ্ধতি এবং সেইজন্যই সেটাকে সন্ত্রাস বলতে আমাদের বাধে না। বরঞ্চ বলা ভালো–দেবাসুর-দ্বন্দ্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বৃহৎ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র সন্ত্রাস।
তৈত্তিরীয়-সংহিতায় অগ্নিদেবের কাছে পূর্বোক্ত প্রার্থনায় যে দস্যু-তস্কর তথা বিদ্বিষ্ট জনজাতিকে তার দাঁতের মধ্যে পিষ্ট করার আক্রোশ দেখানো হয়েছে, সেটা রূপক মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা খোদ ঋগ্বেদের মধ্যেই এমন-এমন মন্ত্র অনেক পাওয়া যাবে, যেখানে তথাকথিত ঐতিহাসিক দেবচরিত্র এবং বৈদিক যুদ্ধনায়ক ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে বেদ-বিদ্বেষীদের বিচিত্র উপায়ে ধ্বংস করার জন্য। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল–এই ধ্বংসের জন্য প্রকট যুদ্ধের পাশাপাশি জলে ডুবিয়ে মারা, আগুন দিয়ে পোড়ানো, বিষদিগ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার–এগুলির কোনোটাই বাদ যেত না। ঋগবেদের একটি সূক্তে অধিষ্ঠাত্ দেবতার নামই রাক্ষস-বিনাশী অগ্নি’। এই সূক্তে রাক্ষস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন তারাই যারা ব্যবহারিকভাবেই শত্রু এবং যাঁরা আর্য-জনজাতির ভাবনা-বিশ্বাসের বিরোধী অর্থাৎ তাদের ‘heathen, unbeliver বলা হয়েছে–যারা এই বেদস্তুতি মানে না, সেই সব রাক্ষসদের তুমি ভদ্র করে দাও। আমাদের শত্রু এবং আমাদের নিন্দাবাদীদের নিন্দা থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর–দহাশসো রক্ষসঃ পাহ্যস্মন্ হো নিদো মিত্রমহো অবদ্যাৎ।
রাক্ষসধ্বংসী অগ্নির কাছে যে প্রার্থনা-সূক্তি রচিত হয়েছে, তার বিশেষত্ব হল–এখানেও দুই ধরনের শত্রুর কথা বলা হচ্ছে–যে শত্রু দূরে আছে তারা এবং যারা কাছে আছে তারাও–যো নো দূরে অঘশংসো যে অত্যগ্নে। নিকটে এবং দূরে অবস্থিত শত্রুর সঠিক অবস্থান জানবার জন্য অগ্নিকে বলা হয়েছে শীঘ্রতম চর নিয়োগ করতে এবং তারপর তাদের উপর আক্রমণ চালাতে। এই আক্রমণের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়ে বৈদিক মন্ত্রকার বলছেন–হে অগ্নি! তুমি তোমার সমস্ত দাহাত্মক তেজোরাশি নিয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হও, তারপর সেই অগ্নিজ্বালায় পুড়িয়ে মারো আমাদের শত্রুদের–উদগ্নে তিষ্ঠ প্ৰত্যা তনুম্বন্যমিত্র ওষতাত্তিগুহেতে। আগুনে পুড়িয়ে মারার উপায়টা সঠিক যুদ্ধনীতির মধ্যে পড়ে না, যেমন পড়ে না জলে ডুবিয়ে মারার নৃশংসতা। অতি-জড়বাদী পণ্ডিতেরাও ইন্দ্রকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মেনে নিয়েছেন, কেননা উরণ, অবুদ, পি, শুষ্ণ, নমুচি, রুধিক্রা ইত্যাদি অসুর-রাক্ষসদের প্রতিপক্ষেইন্দ্রের দাক্ষিণ্যপ্রাপ্ত কুৎস, আয়ু, অতিথিন্থ অথবা সুদাসের মতো রাজারাও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এঁদের পক্ষে যুদ্ধ করবার সময় অথবা স্বেচ্ছায় প্রতিপক্ষ শাসন করবার সময় ইন্দ্র শত শত প্রতিপক্ষীয় নেতাদের ভূমিতে মৃত্যুর কোলে শুইয়ে দিয়েছেন–এটা কোনো বিরুদ্ধ সংবাদ নয়, কিন্তু সংবাদ এটাই যে শ্রুত, কবষ এবং বৃদ্ধ নামের তিন জনকে তিনি জলে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।
আগুনে পুড়িয়ে মারা, জলে ডুবিয়ে মারা–এই ধরনের নৃশংসতার সঙ্গে বিষদিগ্ধ অস্ত্রের প্রয়োগ করে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করাটাও আর্য জনগোষ্ঠীর পরম নৃশংসতার মধ্যে পড়ে। বিষদিগ্ধ তির যেহেতু অতি শীঘ্র শত্রুর বিনাশ ঘটায়, অতএব তার শতমুখী প্রশংসা শোনা গেছে বৈদিক স্তুতিতে। আশ্চর্য হল–এই স্তুতি বেদের যে অংশে অবস্থিত সেটিকে পণ্ডিতেরা battle hymn বা war hymn বলেছেন। তার মানে, এখানে-ওখানে আকস্মিক আক্রমণের জন্য নয়, এমনকী যুদ্ধকালেও নীতিবিগর্হিত অস্ত্রের প্রয়োগ অনুমোদিত ছিল বৈদিক কালে।
আরও লক্ষণীয়, দেবতা এবং অসুরদের নিয়ম-বিধি-সমন্বিত সন্ধিও সম্পন্ন হয়েছে এক-এক সময়ে অথচ এইসব সন্ধির পরেও সন্ধি ভঙ্গ করে বিষ্ণুর সহায়তায় ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে মেরে ফেলেছিলেন, অতি অন্যায়ভাবে মেরে ফেলেছিলেন নমুচিকেও। ইন্দ্র-বৃত্রাসুরের যুদ্ধ তো রীতিমতো ঐতিহাসিক ব্যাপার–বৃত্র এমনই এক প্রতিপক্ষ-নায়ক যার কথা শতবার বেদের মধ্যে এসেছে এবং পৌরাণিকেরা বৃত্রাসুরের কারণেই প্রথম বজ্র নির্মাণের প্রয়োজন স্মরণ করেছেন। অন্যদিকেনমুচি-দৈত্যের স্বর্গাধিকারের প্রসঙ্গে তার ভয়ংকর নৃশংস সন্ত্রাসী আচরণ এতটাই লোকচর্চার বিষয় ছিল যে কাব্যকারেরাও সেই সন্ত্রাসের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। হয়তো এই আসুরিক নৃশংসতা দেবতাদের পক্ষে অসহনীয় ছিল বলেই তৈত্তিরীয় সংহিতার মতো প্রাচীন যজুবৈদিক গ্রন্থে নমুচির সঙ্গে ইন্দ্রের সন্ধিপত্র সাক্ষরিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে–ইন্দ্ৰশ্চ বৈ নমুচিশ্চ অসুরঃ সমদধাত–এবং হয়তো এত কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রের কিছু করার ছিল না বলেই নমুচির সঙ্গে ইন্দ্রের সাময়িক সন্ধি রচিত হয়। কিন্তু দেবতাদের স্বার্থরক্ষার জন্য এই সন্ধিপর্ব জলাঞ্জলি দিয়ে কেমন করে ইন্দ্র মেরে ফেলেন নমুচিকে তার বিশদ বিবরণ আছে সেই প্রাচীন তাণ্ড্যমহাব্রাহ্মণ গ্রন্থে এবং আছে মহাভারতেও।
মনে হতে পারে যেন, বেদ এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলি থেকে দেবাসুর-দ্বন্দ্বের যে চিত্র আমরা তুলে ধরলাম, তাতে ভারতীয় সভ্যতা এবং আর্যায়ণের প্রথম কল্পে তথাকথিত দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে যেসব হত্যার ঘটনাগুলি ঘটেছে, সেগুলির সন্ত্রাসের চেহারা যত না উজ্জ্বল, তার চেয়ে বেশি আছে আক্রমণ এবং নৃশংসতার উপাদান যা যুদ্ধেরই অঙ্গীভূত। আমরা কিন্তু যা বোঝাবার চেষ্টা করেছি, সেটা হল–সেই প্রাচীনকালে যুদ্ধের নিয়ম-নীতি খুব সুশৃঙ্খল এবং বিধিসম্মতভাবে তৈরি হয়নি বলেই এগুলিকে আমরা একভাবে সন্ত্রাসই বলতে চাইব। অন্যদিকে এটা বলা আরও ঠিক হবে যে, বৈদিকোত্তর মহাকাব্যের যুগে যখন সুসংগঠিত রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে এবং যখন পররাষ্ট্রনীতি এবং যুদ্ধও রীতিমতো একটা সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে এসে পড়েছে, তখন যেসব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলি অনেক সময়েই রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির বিরুদ্ধে স্ব-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রনায়কের সন্ত্রাস বলেই গণ্য হওয়া উচিত। সন্ত্রাসবাদ বলতে আধুনিক পণ্ডিতেরাও যেখানে ‘premeditated politically motivated violence caricata 978 অনেকক্ষেত্রেই সেটা যখন অন্যতর মানুষদের মনে ভীতিসঞ্চার করার জন্যই প্রধানত সংগঠিত হয়, তাই সেই সন্ত্রাসের চেহারাটা কিন্তু আমাদের মহাকাব্যগুলির মধ্যে বিশেষত মহাভারতের মধ্যে আরও বেশি স্পষ্ট এবং প্রকট।
মহাভারতের মতো বিশাল মহাকাব্য যে পটভূমিকায় রচিত হয়েছিল, সেখানে আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব ছিল না; যা ছিল, তা হল–পূর্ব-দক্ষিণ ভারতে আর্যায়ণ সম্পূর্ণ হবার পর একটি নির্ভেজাল আর্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞাতিশত্রুতার কাহিনি। দেশের রাজা পাণ্ডু মারা যাবার পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির এখানে রাজ্যের অধিকার পাচ্ছেন না এবং পূর্ব রাজা পাণ্ডুর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে হস্তিনাপুরে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অযোগ্য রাজপুত্র দুর্যোধন এখানে রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইছেন। পাণ্ডুর পঞ্চ পুত্র যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল এবং সহদেব তাদের জননী কুন্তীকে নিয়ে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়েই বড়ো হচ্ছিলেন বটে, কিন্তু দুর্যোধন বাল্য বয়স থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, পাণ্ডবরাই তার রাজ্যলাভের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সেই কারণেই প্রথম থেকেই তার লক্ষ্য ছিল কীভাবে পাণ্ডবদের একে একে অথবা একসঙ্গে হত্যা করে রাজ্যের দখল নেওয়া যায়।
কৌরব-পক্ষের বৃদ্ধ আত্মীয় এবং রাজমন্ত্রীরা ন্যায়-নীতি এবং ধর্মের ভাবনাতে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকেই তাঁর পিতার উত্তরাধিকারে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ফলে দুর্যোধন এটা স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে, ন্যায়-নীতি বজায় রেখে তার পক্ষে রাজ্যলাভ সম্ভব নয়, অতএব অন্যায়ভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেই তিনি তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবেন। এই বুদ্ধিতে চলতে গিয়ে তিনি প্রথম যে পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন, সেটা হল-মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে হত্যা করার চেষ্টা এবং সেই হত্যার মাধ্যমে অন্য পাণ্ডব-ভাইদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছে দেওয়া যাতে হস্তিনাপুরের রাজ্যের দিকে আর কেউ হাত না বাড়ায়।
শারীরিক শক্তিতে ভীম অন্যান্য ভাইদের চেয়ে অনেক বেশি বলবান ছিলেন বলে দুর্যোধন তার প্রথম বয়সে ভীমকেই তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নিয়েছিলেন এবং সেইজন্যই হস্তিনাপুরের বাইরে প্রমাণকোটি বলে একটি জায়গায় ঔদরিক ভীমকে বিষমিশ্রিত খাবার খাইয়ে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। হত্যার এই ষড়যন্ত্রের পিছনে দুর্যোধনের যে ভাবনা ছিল, তা মহাভারতে বলা আছে। বলা আছে যে, ভীমের শক্তি এবং ক্ষমতা বিখ্যাত হয়ে পড়েছিল বলেই দুর্যোধন ছলনার মাধ্যমে তাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন–প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভীমকে যদি মেরে ফেলা যায় তাহলে যুধিষ্ঠিরকে কারাগারে বন্দি করতে কোনো সমস্যাই হবে না।
এই গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্রের পিছনে একা ভীমকে মারার চেয়েও পাণ্ডবপক্ষীয় সকলকে যে ভয় পাইয়ে দেবার তাগিদ ছিল, সেটা বোঝা যায় পরবর্তী ঘটনার সূত্রে। ভীমকে অজ্ঞান অবস্থায় জলে ফেলে দেবার ঘটনা অন্যান্য ভাইরা কেউ লক্ষ করেননি এবং তাঁরা জানতেনও না ভীমের কী হয়েছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে ভীমকে না দেখে এবং বহু অন্বেষণের পর তাকে না পেয়েও রাজবাড়িতে তাঁরা কোনো শোরগোল তুলতে পারেননি ভয়ে। পিতৃব্য বিদুরকে কুন্তী-জননীর বাসগৃহে আনা হয়েছে গোপনে।তিনি পুত্রহারা জননীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন মাত্র, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু অন্য পাণ্ডব-ভাইদের নিরাপত্তার কারণেই রাজযন্ত্রকে ব্যবহার করতে পারেননি অন্বেষণের সহায়ক হিসেবে। সবচেয়ে আশ্চর্য হল–ভীম যখন প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরে এলেন। এবং দুর্যোধনের অন্যায় অপকর্মগুলি জোরে জোরে সবিস্তারে বলতে আরম্ভ করেছিলেন, তখন যুধিষ্ঠির তাঁকে প্রায় ধমকে থামিয়ে দিয়েছিলেন।
এইভাবে ভীমকে থামিয়ে দেবার তাৎপর্য একটাই, অর্থাৎ ঘটনা যদি দুর্যোধনের প্রতিকূলে জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে দুর্যোধনের ক্রোধ আরও বাড়বে এবং তিনি আরও ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন পাণ্ডবদের। এইসব আকস্মিক আক্রমণের প্রতিরোধ এবং প্রতিষেধক হিসেবে যুধিষ্ঠির একটাই পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেটা হল–কেউ যাতে আমরা বিপদে না পড়ি, তার জন্য এখন থেকে আমরা পরস্পর পরস্পরকে রক্ষা করব–ইতঃ প্রভৃতি কৌন্তেয়া রক্ষতানন্যান্যমাদৃতাঃ।
যুধিষ্ঠির প্রত্যেককে আত্মরক্ষায় যত্নবান হতে বললেন কিন্তু রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনায়ক এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধ জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘটনা জানাজানি হতে দিলেন না ভয়ে, দুর্যোধনের ভয়ে। লক্ষণীয়, আধুনিক কালে সন্ত্রাসের যেসব সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, তার সঙ্গে দুর্যোধন-কৃত এই সন্ত্রাসের তাৎপর্য মিলে যায়। মাইকেল স্টোল (Michel Stohl) নামে এক আধুনিক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন সন্ত্রাসবাদী হানায় আক্রান্ত যে বিশেষ ব্যক্তিটির শারীরিক ক্ষতি হয়, সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য তার চাইতে অনেক বৃহত্তর। আক্রান্ত ব্যক্তিটির চাইতেও যারা এই সন্ত্রাসের ঘটনা দেখছে বা সবিস্তারে শুনছে এবং ভয়ে শিউরে উঠছে–সন্ত্রাসবাদীর কাছে সেটা অনেক বড়ো পাওয়া। এ-বিষয়ে নাকি একটা চিনে প্রবাদও আছে–একজনকে মারো আর হাজার জনকে ভয় দেখাও।
হত্যার মাধ্যমে অন্যদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে দেবার এই ভাবনাটা দুর্যোধন মাঝে মাঝেই ভাবতেন। দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বিবাহের পরে তার মুখে আমরা স্পষ্টভাবে শুনেছি যে, কীভাবে গোপনে তিনি পাণ্ডবদের ক্ষতিসাধন করতে চান। বিভিন্ন বিকল্পের কথা বলার সময় দুর্যোধন প্রথমে বলেছিলেন যে, তিনি বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণদের কাজে লাগিয়ে পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের প্রত্যেকের মধ্যে এমনভাবে ভেদ সৃষ্টি করবেন, যাতে তারা একে অপরকে আর সহ্যই করতে পারবেন না। একইভাবে পাণ্ডবদের তৎকালীন আশ্রয়দাতা দ্রুপদ যাতে পাণ্ডবদের ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠেন অথবা এমন অবস্থা সৃষ্টি করা, যাতে পাণ্ডবরা আর কিছুতেই দেশে না ফিরে পঞ্চাল-রাজ্যেই থেকে যান–এইসব বিচিত্র ভাবনার শেষে দুর্যোধন এবার সবচেয়ে ঈঙ্গিত কথাটা বললেন। বললেন–পাণ্ডবদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান মানুষটি হলেন ভীম। গুপ্তঘাতক দিয়ে নিপুণ উপায়ে সেই ভীমকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে–মৃত্যুর্বিধীয়তাং ছন্নৈঃ স হি তেষাং বলাধিকঃ।
ভীমকে কেন মারা দরকার–এ-বিষয়ে দুর্যোধনের ধারণা হল এই যে, পাণ্ডবরা তারই শক্তি আশ্রয় করে যুদ্ধ করেন এবং অর্জুন যে অর্জুন, তাকেও তিনি তেমন আমল দেন না, কিন্তু ভীম তার পিছনে থাকলেই তবে সে অজেয় হয়ে ওঠে। ভীমকে মারলে কী ফল হবে–সে ব্যাপারে দুর্যোধনের বক্তব্য হল–প্রথমত ভীম না থাকলে অর্জুন তাঁর কর্ণের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। দ্বিতীয়ত, ভীমের অভাবে পাণ্ডবদের প্রত্যেকটি লোক দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তারা জীবনে আর দুর্যোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করবার চেষ্টা করবে না–অস্মন্ বলবতো জ্ঞাত্বা ন যতিষ্যন্তি দুর্বলাঃ। এই একবার মাত্র নয়–পাণ্ডবদের একজন বা দুজনকে মেরে অন্যদের ভয় পাইয়ে দেবার কল্পনা বারেবারেই করেছেন দুর্যোধন। এই সমস্ত পরিকল্পনার সবচেয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা ছিল-বারণাবতে পাঠিয়ে পাণ্ডবদের জতুগৃহের আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায়। এই পরিকল্পনায় স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রও শামিল ছিলেন এবং তিনি এই নৃশংস ভাবনা কার্যকর করার আগে রাষ্ট্রগত বা রাষ্ট্রচালিত সন্ত্রাসের দার্শনিক সমর্থন পেয়েছিলেন তার আমন্ত্রিত মন্ত্রী কণিকের কাছ থেকে।
মহাভারতে কণিকের বিশেষণ দেওয়া হয়েছে রাজশাস্ত্রার্থবিত্তম’অর্থাৎ রাজনীতিশাস্ত্রের সর্বশেষ প্রয়োজন তার জানা আছে। ধর্ম-কাম-অর্থের সুষ্ঠু সমন্বয়ে যে আদর্শ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়–যার কথা বিদুর বলেছেন, ভীষ্ম বলেছেন–এই রাষ্ট্রনীতি তার থেকে আলাদা বলেই কণিকের রাজনীতি ভাবনাকে মহাভারতে তীক্ষ্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে–উবাচ বচনং তীক্ষং রাজশাস্ত্রার্থদর্শন। কণিক নিজেও জানেন যে, তার ভাবনা-চিন্তা শুনলে সুস্থ মানুষের নীতিবোধ, ধর্মবোধ আহত হবে, কেননা দুর্বল, সবল, মাঝারি–শত্রু যেমনই হোক, শত্রু ভাবলেই তাকে মেরে ফেলাটাই কণিক নীতির সার কথা। লোকে যেহেতু রাজদণ্ডকেই সবচেয়ে ভয় পায়, অতএব সবসময় সেই ভয়টুকু জিইয়ে রাখতে হবে সকলের মধ্যে এবং যাকে রাজা একবার তার বিরোধী বা অপকারী বলে মনে করবেন–সে ক্ষুদ্র হোক বা শক্তিমান হোক তাকে তিনি বাঁচতে দেবেন না–বধমেব প্রশসন্তি শক্ৰণাম্ অপকারিণাম্। দুর্বল শত্রুর ক্ষেত্রে তার দুর্বলতা, শরণাগতি, আর্তভাব–এগুলির কোনো মূল্য নেই কণিকের কাছে। শত্রু-শব্দের মানে তার কাছে একটাই–মেরে ফেলল। কেননা মেরে ফেলার পরেই শুধু আর ভয় থাকে না।
মহাভারতে কণিক যে রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলেছেন তার মধ্যে আধুনিক অর্থে ‘ডিপ্লোমেসি’-র অংশ যতটুকু আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে তাড়না বা সন্ত্রাসী রাজনীতি। তিনি বলেন–কার্যসিদ্ধির জন্য নিজের চেহারায় এবং বেশবাসে একটা সাধু-সাধু ভাব বজায় রাখো, দরকার পড়লে প্রচুর হোম-যজ্ঞ করো, জটা বল্কলও ধারণ করতে পারো, কিন্তু সুযোগ পেলেই বন্য কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ো শত্রুর উপর। যতক্ষণ পর্যন্ত সময়-সুযোগ না আসে, ততক্ষণ কলসির মতো কাঁখে করেও বইতে পারো শত্রুকে, কিন্তু সময় এলেই কলসি বা শত্রুকে পাথরে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলো। শত্রুকে কী কী প্রচ্ছন্ন উপায়ে শেষ করতে হবে, সেখানে কণিকের পছন্দের তালিকায় বিষ দেওয়া, আগুনে পুড়িয়ে মারা অথবা যত রকম অন্যায় সন্ত্রাস হতে পারে, তা সবই আছে এবং এই কণিকের ভাবনায় উদ্দীপিত হয়েই দুর্যোধন বারণাবতে সবরকম দাহ্য পদার্থ দিয়ে জতুগৃহ তৈরি করলেন এবং বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মুখ দিয়ে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে বলিয়ে পাণ্ডব-ভাইদের বারণাবতে পাঠিয়েও ছিলেন। পরিকল্পনা যেমন নিচ্ছিদ্র ছিল, তাতে পাণ্ডবরা বাঁচতেন না, শুধু বিদুরের অসাধারণ বুদ্ধিতে পাণ্ডবরা কণিকনীতির সন্ত্রাস থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।
জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনাটাই শুধু একমাত্র সন্ত্রাসের উদাহরণ নয় মহাভারতে। প্রতিপক্ষকে ভয় পাইয়ে দেবার এই সন্ত্রাসী নীতি দুর্যোধন মাঝে-মাঝেই প্রয়োগ করেছেন পাণ্ডবদের ওপর; এমনকী বনবাসকালে পাণ্ডবদের সাময়িক আবাসস্থলে গিয়ে নিজেদের শক্তি দেখিয়ে আসার ভাবনা এবং অজ্ঞাতবাসের সময় প্রায় বিনা কারণে বিরাট-রাজার গোধন আহরণ করার অছিলায় তার রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনাও এই সন্ত্রাসনীতির মধ্যেই পড়ে। দুর্যোধন সফল হননি তার কারণ অন্য, কিন্তু প্রাচীনকালের রাজনীতিতে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করাটা রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ ছিল এবং তার প্রমাণ মিলবে অর্থশাস্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থেও। লক্ষণীয়, মহামতি কৌটিল্য রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় তার পূর্বর্তন রাজনীতিবিদদের নাম উল্লেখ করেছেন এবং সেই প্রসঙ্গে উপরিউক্ত কণিকের নামও তিনি উল্লেখ করেছেন, যদিও সেই নামের বানানটা একটু আলাদা। কৌটিল্য কণিষ্ক’ নামে এক বিখ্যাত রাজনীতিবিদের নাম করেছেন এবং যেখানে, যেভাবে তিনি কণিষ্কের মতবাদ উল্লেখ করেছেন, সে-সব জায়গায় তার মত খানিকটা পৃথক হলেও কৌটিল্য কিন্তু অনেক জায়গাতেই কণিষ্কের কূট পরামর্শ গ্রহণ করেছেন–বিশেষত অন্তঃরাষ্ট্রীয় শত্রু দমনের ক্ষেত্রে এবং পররাষ্ট্রে নাশকতা চালানোর ব্যাপারে।
কৌটিল্য এক জায়গায় লিখছেন–নিজের অনুকূল স্বপক্ষীয় মানুষের মধ্যেই হোক, অথবা শত্রুর মধ্যেই হোক, রাজা যাকে তার বিরোধী বা অপকারী বলে মনে করবেন, সেখানেই নিশ্রুপে চোরাগোপ্তা হত্যাকাণ্ড চালাবেন–স্বপক্ষে পরপক্ষে বা তুষ্ণীং দণ্ডং প্রযোজয়েৎ। কৌটিল্য শুধু এইটুকু সাবধান যে, রাজা যেন অন্যায়ী, অপকারী ছাড়া ভালো লোকের ওপর এই নিঃশব্দ-দণ্ডের প্রয়োগ না করেন। কিন্তু নির্বিচারে শত্রুধ্বংস করার ব্যাপারে কৌটিল্যের অভিমত মহাভারতীয় কূটনীতিক কণিকের থেকে কিছু পৃথক নয়। কৌটিল্য এমন কথাও বলেছেন যে, রাজা বাইরে নিজেকে যতই ক্ষমাশীল দেখান নিজের অপকারী ব্যক্তিকে গোপনে হত্যা করার ক্ষেত্রে তিনি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চিন্তা করবেন না–আয়ত্যাং চ তদাত্বে চ ক্ষমাবান্ অবিশঙ্কিতঃ।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যোগবৃত্ত বলে একটি অধিকরণ আছে। এইখানেই গোপন-হত্যা বা উপাংশুদণ্ডের আলোচনা আছে। এই অধিকরণের সাধারণ নাম কণ্টক শোধন’অর্থাৎ পথের কাঁটা সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা। রাষ্ট্রশাসনের নানান মুখ্যপদ যাঁরা অধিকার করে থাকেন–যেমন মন্ত্রী, পুরোহিত, সেনাপতি, যুবরাজ ইত্যাদি–এঁরা যদি কেউ রাজার ওপর টেক্কা দিয়ে রাষ্ট্রের শাসন-যন্ত্র নিজের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেন অথবা এই মুখ্য পুরুষেরা যদি রাজার চিহ্নিত শত্রুদের সঙ্গে মেলামেশা, যাতায়াত আরম্ভ করেন, তবে কৌটিল্যের পরামর্শ হল–ওইসব মুখ্যদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী ব্যবস্থা নিতে হবে। কৌটিল্য অনুভব করেছেন যে, রাজ্যের এইমুখ্যপুরুষদেরও যেহেতু বুদ্ধি, ক্ষমতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং জনসংযোগ থাকে, তাই প্রকাশ্য উপায়ে এঁদের মেরে ফেলা সম্ভব নয়, উচিতও নয়, অতএব এসব ক্ষেত্রে রাজা সেইসব ক্ষুব্ধ মানুষের আশ্রয় নেবেন, যারা ওই পূর্বোক্ত মন্ত্রী, অমাত্য বা যুবরাজের দ্বারা অপমানিত হয়েছে।
সমস্ত কাজটাই কিন্তু হবে গোপনে এবং গুপ্তচরদের মাধ্যমে। যেমন ধরা যাক, রাজার মুখ্য অমাত্য রাজার বিরুদ্ধে কাজ করছেন। রাজা তখন গুপ্তচরের মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন ওই অমাত্যের ভাই বা তার নীচবর্ণা স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র, অথবা তার রক্ষিতার গর্ভজাত পুত্রের সঙ্গে। সাধারণত এইসব লোকেরা প্রশাসনিক স্তরে স্থান পাবার জন্য পূর্বোক্ত মন্ত্রী, অমাত্য, যুবরাজের ওপর ক্ষুব্ধ এবং ঈর্ষালু হয়েই থাকেন। বাস্তবে কিন্তু তারা রাজার ওপরেও ক্ষুব্ধ। গুপ্তচরেরা ওইসব ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের যে-কোনো একজনকে পূর্বোক্ত রাজদ্রোহী মন্ত্রীকে গুপ্তহত্যা করার জন্য উৎসাহিত করে রাজাদের সঙ্গে দেখা করালে মন্ত্রীর মৃত্যুর পর তার বিষয়-সম্পত্তি সবই ওই ভাইয়ের উপভোগ্য হবে–রাজা এমন প্রতিজ্ঞা করবেন। এর পর সেই ক্ষুব্ধ ব্যক্তি অস্ত্র দিয়েই তোক অথবা বিষ দিয়ে পূর্বোক্ত মহামাত্যকে হত্যা করবেন। কিন্তু এই হত্যার পর ওই ভাইটিকেও ভ্রাতৃহন্তার অপবাদ দিয়ে হত্যা করবেন রাজা। অথবা ওই ক্ষুব্ধ ভ্রাতা এবং ওই মন্ত্রী–এই দুই পক্ষকেই রাজা তার ঘাতক গুপ্তচরদের দিয়ে হত্যা করবেন, কিন্তু এই হত্যার পিছনে জনসমক্ষে প্রচার কিন্তু থাকবে অন্য।
কৌটিল্যের এই গুপ্তহত্যার ভাবনাতে কেউ রাজার আপন নন, কেননা যুবরাজ নামক মানুষটি তো প্রধানত রাজার ছেলেই হয়ে থাকেন। কিন্তু যুবরাজও যদি রাজার বিরুদ্ধে যান, তবে তারও মরণ থেকে রেহাই নেই এবং যে তাকে মারবে সেও বাঁচবে না, কেননা রাজা গুপ্তহত্যার প্রমাণ রাখবেন না। কৌটিল্য যে’যোগবৃত্ত’রচনা করেছেন, তা প্রধানত গুপ্তচরদের মাধ্যমে কপট বা গুপ্তহত্যার পরিসর এবং এখানে কৌটিল্য যেসব উপায় বলেছেন তার মধ্যে অস্ত্র ব্যবহারের সঙ্গে বিষ দেওয়া, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া সবই আছে এবং তার সঙ্গে আছে দুষ্যপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং রাজার অনুকূল প্রচার। এই অধ্যায়ে কৌটিল্যের কূট-কৌশলগুলি এখনকার গণতন্ত্রের বহু রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে সমানভাবে তুলনীয়, যদিও প্রচারের কৌশলটাও এখনকার দিনে থাকে গণতান্ত্রিক। অথবা সবই যেন জনগণহিতায়।
নিজের রাজ্যে কূট উপায়ে শত্রুবধ করে নিজের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করাটা যেমন রাজার পক্ষে জরুরি, তেমনই পররাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনে শত্রু-রাজার নানারকম ক্ষতিসাধন করে তাকে দুর্বল করে দেওয়াটাও রাজার পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম উপাদান। পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে অথবা একই সঙ্গে যেসব কৌশল প্রয়োগ করতে হয়, সেগুলির পরিভাষিক নামগুলি হল সাম, দান, ভেদ এবং দণ্ড। প্রধানত রাজার পরিপন্থী বিরুদ্ধবাদীদের (স্বরাষ্ট্রে এবং পররাষ্ট্রে) নিজের অধীনে আনার জন্যই ওই চারটি উপায়ের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে বলেছেন প্রাচীন তাত্ত্বিকেরা। এর মধ্যে প্রথম উপায় হল সাম অর্থাৎ মধুর কথা, মধুর ব্যবহার, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে নেওয়া। এতে কাজ নাবহলে দাননীতি, অর্থাৎ কিছুটা ছেড়ে দিলে যদি শত্রু রাজা-অনুকূল হন সেই চেষ্টা করা। তবে দাননীতির অসুবিধে হল–পরিপন্থী শত্রু বা শত্রুরাষ্ট্র যদি পূর্বোক্ত রাজার দানবৃত্তি দেখে সেই রাজাকে দুর্বল ভাবতে থাকেন, তবে শত্রু মাঝে মাঝেই দান গ্রহণ করার চেষ্টা করবে অথচ সে পুরোপুরি অনুকূলও হবে না। এই অবস্থায় ভেদনীতি গ্রহণ করতে হবে অর্থাৎ শত্রুরাজার পরিপন্থী ব্যক্তির সঙ্গে তার সমমনা ব্যক্তিদের বিরোধ তৈরি করে দিতে হবে। পররাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই ভেদনীতির মাধ্যমে শত্রু-রাজার সঙ্গে তার মন্ত্রীদের, রাজার সঙ্গে সেনাপতির, এমনকী জনসাধারণকেও রাজার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য রাজার সঙ্গে তাদের ভেদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। কিন্তু এই নীতির সমস্যা হল–শত্রু-রাজার বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে সেই রাজার ভেদসৃষ্টি করতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়, সেই সময় দিতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে বিজিগীষু রাজার নিজের সমস্যা বেড়ে যায়। অতএব সেক্ষেত্রে শেষ উপায় হল দণ্ড। আগেও এ-কথা বলেছি।
সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের শেষ অঙ্গ ‘মিত্রশক্তি বা বলা উচিত–সেটাই পররাষ্ট্র নীতি। কৌটিল্য সেইখানেই ওই চতুরুপায় সাম-দান-ভেদ-দণ্ডের আলোচনা করেছেন সবিস্তারে। তাঁর মতে চতুরুপায়ের শেষতম দণ্ড-প্রয়োগের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত আধার হল বলবান শত্রু। কৌটিল্য মনে করেন–দুর্বল শত্রুকে সামনীতি এবং দাননীতির মাধ্যমেই বশীভূত করা যায়, কিন্তু বলবান শত্রুর দুর্বলতা সৃষ্টি করতে হলে ভেদ এবং দণ্ডের কথাই চিন্তা করতে হবে–সামদানাভ্যাং দুর্বলান্ উপনয়েৎ, ভেদ-দণ্ডাভ্যাং বলবতঃ। পররাষ্ট্রে এখনও যে নাশকতা এবং সন্ত্রাস চালানো হয়, সেগুলি প্রাচীন তাত্ত্বিকদের ভেদনীতি এবং দণ্ডের অন্তর্গত। কেননা প্রবলতর শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে যেহেতু সফল হওয়া যায় না, অতএব তার রাজ্যে নাশকতা এবং সন্ত্রাস চালিয়ে তাকে যতটা দুর্বল করে দেওয়া যায়, ততটাই লাভ। ভেদনীতি দুই-তিন রকমের হতে পারে। শত্রুসৈন্যকে দুর্বল করে দেওয়া, শত্রুর মিত্রপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়া, প্রবল-পরাক্রান্ত অন্য কোনো রাজার আশ্রয় গ্রহণ করা অথবা শত্রুর হীনতা বা ছিদ্রগুলিকেই নিজের প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা। অন্যদিকে দণ্ড, এককথায় শত্রুকে শাস্তি দেবার ব্যাপার হলেও তারও লঘু-গুরু প্রকার আছে এবং সেইখানেই সন্ত্রাস বা নাশকতার উপযোগিতা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রাচীন তাত্ত্বিকেরা। শুক্রনীতিসার যদিও তুলনায় খানিকটা অর্বাচীন গ্রন্থ, তবু তার লেখক কৌটিল্যের ভাবনাটা ঠিক ধরেছেন। তিনি বলেন–দণ্ড মানে শুধু শত্রুরাষ্ট্রকে আক্রমণ করা নয়, এই আক্রমণের অন্য উপায়ও আছে। হয়তো যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যয় এবং লোকক্ষয় রোধ করার সঙ্গে শত্রুকে আগে থেকেই ভয় পাইয়ে দেবার ব্যাপারটা এখানে কাজ করে, অর্থাৎ পররাষ্ট্র সন্ত্রাস, নাশকতা ইত্যাদি কাণ্ডগুলি অনায়াসেই চরম দণ্ড বা আক্রমণের প্রাথমিক উপায় হিসেবে কাজ করতে পারে। নীতিসার বলেছে–শত্রুরাজ্যে দস্যু পাঠিয়ে চুরি-ডাকাতি করানো, রাজকোষ এবং শস্যের ক্ষয় করা, শত্রুর দুর্বলতার স্থানগুলি খুঁজে খুঁজে বার করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া, নিজের সৈন্যশক্তি এবং কূটনৈতিক বুদ্ধি প্রদর্শন করে পররাষ্ট্রকে ভয় দেখানো এবং যুদ্ধ লাগলে নিভকিভাবে যুদ্ধ করা–এগুলি সবই দণ্ডের মধ্যে পড়ে।
নীতিসার বেশ পরিষ্কারভাবে বলেছে-ত্রাসনং দণ্ড উচ্যতে–অর্থাৎ ভয় দেখানো বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করাটাই দণ্ডের আসল কাজ–যুদ্ধটা একেবারে শেষ অস্ত্র। তবে যুদ্ধ না করে পররাষ্ট্রে যেসব নাশকতা চালানো হয়, সেখানে কৌটিল্য দণ্ড বলতে রাজি হবে না, কেননা এই ধরনের সন্ত্রাস সৃষ্টি করাটা ভেদনীতির প্রয়োগিক দিক। ভেদনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কৌটিল্য শুক্রনীতিসারের চেয়ে অনেক বেশি কুশল। বলবান শত্রুর ওপর ভেদনীতি প্রয়োগের সময় বিজিগীষু রাজা নিজে কাজটা করেন না, তিনি অন্য লোককে কৌশল ব্যবহার করে নিজের কাজ সারেন। এক্ষেত্রে ব্যবহার করার মতো মানুষেরা হলেন অন্য প্রতিবেশী সামন্ত রাজা, বনাঞ্চল রক্ষায় নিযুক্ত আটবিক পুরুষ–যিনি খুব সহজে শত্রুরাষ্ট্রের অপকার সাধন করতে পারেন, শত্রুর নিজের বংশের শত্রুভাবাপন্ন জ্ঞাতি অথবা শত্রু-রাজার আশঙ্কিত কোনো অবরুদ্ধ রাজপুত্র।
ভয় দেখিয়ে ভেদসৃষ্টি করাটা কূটনীতি বা ডিপ্লোমেসি’-র মধ্যেও আসবে, কিন্তু ভেদসৃষ্টি করার জন্য উপযুপরি সন্ত্রাস সৃষ্টি করাটাই ভেদনীতির আসল উদ্দেশ্য এবং সে কাজটা যথেষ্টই জটিল। এর মধ্যে মিথ্যা রটনা, গুপ্তচর পাঠিয়ে শত্রুর রাজ্যে উলটো প্রচার চালানো, নিজের রাজ্য থেকে আশঙ্কিত অমাত্যদের পররাজ্যে নিষ্কাশিত করে শত্রুর অপকার করা–এগুলি তো প্রাথমিক কাজ। কিন্তু এই প্রাথমিক কাজগুলিই যেভাবে করতে হবে তার মধ্যে সন্ত্রাস-সৃষ্টির প্রক্রিয়াটাই যেন প্রধান হয়ে ওঠে, কেননা এই অপকার-সাধনের মধ্যে বিষ দেওয়া, আগুন দেওয়া, অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা–সবই থাকবে- ‘অগ্নি-রসশস্ত্রেণ।
ভেদনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কৌটিল্য যেসব নীতি-নিয়ম নির্দেশ করেছেন তার মধ্যে নৈতিকতা খুব একটা নেই এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে, বিশেষত প্রবলতর শত্রুকে আয়ত্তে রাখার জন্য সে-সমস্ত অনৈতিক কাজকে অন্যায়ও মনে করেন না কৌটিল্য। ভেদনীতি প্রয়োগের পূর্বাবস্থা হিসেবে কৌটিল্য এটাই চান যে, বিজিগীষু রাজার সঙ্গে শত্রু-রাজার এক ধরনের বিরোধিতা যেন থাকেই। ধরা যাক এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে যদি বিজিগীষু রাজার ধ্রুবক-উদাহরণ হিসেবে ধরি তাহলে প্রবলতর ভারতের সঙ্গে এক ধরনের শত্রুতা সে সবসময়েই জিইয়ে রাখে। উলটো দিকে ভারতও হয়তো তাই করে। অর্থাৎ কিনা সাময়িক বিদ্বেষই হোক, চিরন্তন বৈরিতাই হোক অথবা অপকারের আশঙ্কা থোক–এই তিনটের একটা যদি সবসময়েই জিইয়ে রাখা যায়, তবেই নৈতিকতাহীন ভেদনীতির প্রশ্ন আসবে।
নৈতিকতাহীন এই ভেদনীতির সবচেয়ে বড়ো সাধন হল গূঢ়-পুরুষ। আজকের দিনে দেশে-বিদেশে যেসব গুপ্তচরচক্র চালু আছে যারা একাধারে সংবাদ সংগ্রহ করে এবং অন্যদিকে নাশকতাও চালায়, সেই চক্রান্ত পরিকল্পনার আদি পুরুষ হলেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে চরদের নাম হল গূঢ়-পুরুষ, রাজকার্যে তাদের গুরুত্ব এতটাই যে মন্ত্রী-অমাত্য নিয়োগ করার পরেই রাজাকে গূঢ়-পুরুষ নিযুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে পাঁচ প্রকারের গূঢ়-পুরুষ আছে–কৌটিল্য তাদের সাধারণ নাম দিয়েছেন সংস্থ-রাজার প্রয়োজনে তারা নিজ-রাজ্যে এবং পর-রাজ্যে এক-একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নাশকতা চালায়। সংস্থাগুলির নাম-কাপটিক, উদাস্থিত, গৃহপতিব্যঞ্জন, বৈদেহব্যঞ্জন এবং তাপসব্যঞ্জন। এই পাঁচ প্রকার সংবাদ সংস্থা ছাড়াও আরও একপ্রকার গুপ্তচর-গোষ্ঠীর নাম হল সঞ্চার। সর্বত্র এদের অবাধ গতিবিধি-বিভিন্ন জায়গায় নজরদারি করা ছাড়াও শত্রুরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় সাবোতাজ’ করা, রাজা বা মন্ত্রীকে বধ করা–এসব সঞ্চার’ গুপ্তচরদের কাজ। এই সিঞ্চার’ গুপ্তচরদের মধ্যে দুটি প্রকার হল তীক্ষ্ণ এবং রসদ-সন্ত্রাসমূলক কাজে তাদের জুড়ি নেই।
তীক্ষ্ণ নামটা শুনেই বোঝা যায় এরা নৃশংস পুরুষ। জিনিসপত্র এবং অর্থের লোভ এদের এমনই যে, এরা নিজের জীবনের পরোয়া করে না। স্বরাষ্ট্রে বা শত্রুরাষ্ট্রে অনিষ্ট পুরুষকে হত্যার জন্যই রাজাকে এদের ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন কৌটিল্য। এই হত্যার ব্যাপারে আরও নির্মম হল। রসদ’-পুরুষেরা। রস’মানে এখানে বিষ বা প্রাণঘাতী কোনো কেমিক্যাল। মায়া-মমতা বলে কোনো পদার্থ এই রসদ’-পুরুষের মধ্যে নেই, সেই কারণে পররাষ্ট্রে অনভীষ্ট রাজপুরুষকে বিষ দিয়ে মারতে এদের এতটুকু কুণ্ঠা হয় না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এই তীক্ষ্ণ এবং রসদ গূঢ়-পুরুষদের অবস্থান নির্ণয় করার সময়েই আমরা বুঝতে পারি যে, ‘পর’ বা শত্রুরাষ্ট্রে পরিকল্পিতভাবে নাশকতা চালানো বা সন্ত্রাসের সৃষ্টি করাটা কৌটিল্যের। পররাষ্ট্র নীতির স্বীকৃত অঙ্গ বলেই পরিচিত।
আমরা কেজিবি, সিআইএ অথবা আইএসআই ইত্যাদি নানা গুপ্ত সংস্থার সংবাদ জানি। যারা বহুতর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালায়। এইসব সংস্থার সঙ্গে কৌটিল্য-কথিত সন্ত্রাসের মিল আছে। তাতে এটা আরও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, রাষ্ট্রের অনুমতভাবেই পররাজ্যে সন্ত্রাস চালানো বা নাশকতার কাজ করাটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এখন যেসব বিদ্রোহী-গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে–যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা সেইসব বিদ্রোহীগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় দেশ-জাতির স্বাধীনতাকামী–এরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রীয় মতে যে ব্যবহার লাভ করতেন, তা দু’রকম হতে পারে।
যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিচ্ছিন্নতাকামী, তারা মনু-মহাভারত বা কৌটিল্য সবার কাছেই রাজার অনভীষ্ট বিদ্রোহীগোষ্ঠী হিসেবেই পরিচিত হতেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রীয় যুক্তিতে প্রথমে এইসব গোষ্ঠীর নেতাদের চরিত্র বিচার করে নেবার কথা। নেতাদের মধ্যে ক্রুদ্ধ, ভীত, লোভী, অপমানিত এবং মানী–এই চার চরিত্রের মানুষ থাকবেই। এদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি কীভাবে করতে হবে তা অর্থশাস্ত্রের সংঘবৃত্তে বলা আছে। সংঘবৃত্তের কথা এইজন্য বললাম যেহেতু আজকের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীরা প্রধানত নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত সংহত সুসংগঠিত থাকে। সংহত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করা খুব কঠিন–এ-কথা কৌটিল্যই বলেছেন। কিন্তু কঠিন হলেও তা অসাধ্য নয়, অতএব প্রতিকূলাচারী গোষ্ঠীকে ভেদ এবং দণ্ডের মাধ্যমেই শেষ করে দিতে হবে। গোষ্ঠীপ্রধানদের চরিত্র গুপ্তচরদের মাধ্যমে বিচার করে ক্রুদ্ধ নেতাকে নানা কৌশলে অন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলে, ভীত পুরুষকে আশ্রয়ের ভরসা দিয়ে লুব্ধ পুরুষকে অর্থ, ভূসম্পত্তি এবং কামুকতার আশ্বাস দিয়ে, অপমানিত নেতাকে অন্যের বিরুদ্ধে চালিত করে এবং মানী ব্যক্তিকে সম্মানের আশ্বাস দিয়ে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলাটাই কৌটিল্যের পরামর্শ।
কিন্তু ধরা যাক, একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে স্বাধীনতা-সংগ্রামী হিসেবেই চিহ্নিত করা হল, ধরে নেওয়া যাক, পৃথিবীর অনেক রাজশক্তির চোখেই তারা স্বাধীনতা-সংগ্রামী সেক্ষেত্রে এই গোষ্ঠী যতই ছোটো হোক, তাদের ওপরে বিজিগীষু’ রাজার চরিত্র আরোপ করতে হবে। বিজিগীষু’ রাজা একটি ধ্রুবকমাত্র, যিনি অন্য রাজার ওপরে আত্মভাব বিস্তার করে অর্থ, ঐশ্বর্য এবং ভূমিখণ্ডের ওপর অধিকার কায়েম করতে চান। সম্পূর্ণ অর্থশাস্ত্রই এই ‘বিজিগীষু’ রাজার আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনি। অতএব যে গোষ্ঠী স্বাধীনতা চায়, তার মধ্যে যদি রাজতন্ত্রের বীজ না থাকে, সংঘবৃত্তের গুণ বা চরিত্র থাকে, তাকেও কিন্তু প্রবলতর শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মবিস্তারের জন্য ভেদ এবং দণ্ডের আশ্রয়ই নিতে হবে এবং উপায়-কৌশল ভিন্ন হলেও সাধারণ মানটা সেই একই অর্থাৎ শত্রুসৈন্যকে দুর্বল করে দিতে হবে, শত্রুর মিত্রপক্ষকে দুর্বল করে দিতে হবে, প্রবল পরাক্রান্ত অন্য কোনো রাজশক্তির আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে এবং শত্রুর দুর্বলতা এবং হীনতাকেই নিজের প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
ভারতবর্ষের মাটিতে যারা বিচ্ছিন্ন আচরণ করেছেন, তারা যেহেতু কোনো রাষ্ট্রশক্তি নয় এবং নেহাতই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী–যারা অপর শত্রুরাষ্ট্রের স্বার্থসাধনে ব্যস্ত, তাদের অনুকূলে নিয়ে আসা বা তাদের ধ্বংস করার ব্যাপারটা আজকের দিনে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ওপরেই অনেকটা নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে প্রবলতর শক্তির একটা ভূমিকা আছে বলেই সন্ত্রাসবাদীরা যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছেন, তার উত্তরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ব্যবস্থা এবং তদুপরি চরম দণ্ডের একটা ভূমিকাই কিন্তু কৌটিল্যের মতো রাষ্ট্রনীতিবোদ্ধার পরামর্শ হবে।