নাগরিকতা, অসভ্যতা এবং কৌটিল্য
কথার মানেটা, এখন খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু আগে এমন ছিল না। আমাদের কালে ‘নাগর’ কথাটা লম্পট পুরুষের সম্বন্ধে প্রযোজ্য ছিল, এমন রমণীর মুখে তার প্রেমাস্পদ পুরুষের সম্বন্ধে এই শব্দটা শোনা যেত যা খুব শ্রোতব্য নয়, যাতে ভদ্র-সমাজে তির্যক ভাবেও উচ্চারিত হত-রসের নাগর। যেন নাগর মানেই সে ব্যক্তি কামকলাসিক্ত অভদ্র রসের আকর। বৈষ্ণব পদাবলিকারেরা এ শব্দের গৌণার্থ আরও চড়িয়ে দিয়েছেন, এমনকী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে নিয়ে গৌর নাগরিয়া ভাব এই এখনও গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসতত্ত্বের অন্যতম ধারা। কিন্তু নাগর’শব্দের এমন বিপরীতার্থ আগে ছিল না। এক্কেবারে আভিধানিকভাবে শব্দটার মানে যদিও নগরে যিনি থাকেন, তিনিই নাগর’ বা ‘নাগরক’ কিন্তু একটু বিশদার্থে নাগর মানে অবশ্যই ভদ্রলোক এবং এমন ভদ্রলোক যাঁর রুচি আছে, এমনকী টাকাপয়সাও একটু বেশি আছে। আধুনিক নাগর’ শব্দটির মধ্যে যে লাম্পট্যের কলঙ্ক-চিহ্ন মুদ্রিত হয়েছে তার কারণ হয়তো কামসূত্রকার বাৎস্যায়ন। তিনিই অর্থবান, ঐশ্বর্যশালী, রুচিশীল পুরুষের কামকলাভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে বারে বারে নাগরক’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং পরবর্তী কালে নাগর’ অথবা নাগরক’ শব্দের মধ্যে বাৎস্যায়নী কামতন্ত্রের জঘন্য উত্তরাধিকারটুকু রয়ে গেল, কিন্তু নগরের সভ্যতার অংশটুকু লুপ্ত হয়ে গেল। আরও পরবর্তী সময়ে, হয়তো বা শুধু বাৎস্যায়নী গন্ধ দূর করার জন্যই শব্দটা নাগর’বা নাগরক’-কোনোটাই থাকল না, সেটা হয়ে গেল নাগরিক। শব্দটা এখনও চলছে।
আমাদের বক্তব্য হল–অভিধান তথা প্রত্যয় নিষ্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নাগর, নাগরক এবং নাগরিক–এই তিনটি শব্দের আকর-শব্দ কিন্তু নগর। কিন্তু বাৎস্যায়নের কালেও যেমন এই শব্দের মধ্যে অতিরিক্ত অর্থ ছিল তেমনই আমাদের কালের নাগরিক’ শব্দটির মধ্যে কিন্তু অতিরিক্ত অর্থ আছে। নাগরিক বলতে এমনই একজনকে বোঝায় যিনি করদানের বিনিময়ে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা কিছু পান। এই দৃষ্টিতে একজন গ্রামবাসীও নাগরিক। কিন্তু এটা বেশ জানি গ্রামবাসীরা যতই নাগরিক হোন, তটস্থ হইয়া বিচারিলে আছে তরতম। বাস্তবে নাগরিক হচ্ছেন তিনিই, যিনি নগরে বসবাস করেন, নাগরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করেন এবং নাগরিক আইন মেনে নাগরিক কর্তব্যগুলিও পালন করেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে কিন্তু নাগরক’ অথবা নাগরিক’ কথাটা আমাদের ব্যবহৃত অর্থে প্রযুক্ত নয়। বরঞ্চ নগরপাল বলতে যা বোঝায়, নগরবাসী জনের প্রয়োজন এবং করণীয় কর্তব্য তথা অকরণীয় কর্ম সম্বন্ধে যিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব বহন করছেন, তিনিই কৌটিল্যের মতে নাগরিক বা নাগরক। অবশ্য নগর-প্রশাসনের আরও কিছু কাজ ছিল, যেগুলি নাগরিক ছাড়াও অন্যান্য প্রশাসনিক অধিকারীদের হাতে ন্যস্ত ছিল।
আধুনিক কালে আমাদের শহরবাসী নাগরিক পুরুষেরা পৌরসংস্থার কাছে যে তামাম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন অথবা পৌরসংস্থাই বা আমাদের জন্য কতটা কাজ করে–সে-সব প্রতিতুলনায় স্থাপন করে সবই ব্যাদে আছে এইভাবে কৌটিল্যের মাহাত্ম্য খ্যাপন করাটা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ এটাই আমরা দেখতে চাই, আমাদের প্রতিতুলনায় কৌটিল্য কতটা আধুনিক ছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব সেই চতুর্থ শতাব্দীতে তিনি কতটা ভেবেছিলেন নগরপাল এবং নগরবাসীর কর্তব্য বিষয়ে। এ-বিষয়ে ভাবনা করতে গেলে প্রথমে যেটা বলা দরকার, সেটা হল–জীবনের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলি কোনোটাই কিন্তু আজকের নয়। সে আগেও যেমন ছিল, এখনও আছে, পরেও থাকবে। হাসপাতালে রোগী নিয়ে গেলাম, অথচ উপযুক্ত ডাক্তার পেলাম না অথবা ডাক্তার ডাকলাম তিনি এলেন না, রোগী মারা গেল–এ-সমস্যা আজকের নয় চিরকালের। শহরের রাস্তাঘাট খারাপ অথবা বাজারে গেলে দোকানদার ঠকাচ্ছে, বাড়ির সামনে অন্য লোকমরা ইঁদুর ফেলে গেল, সামান্য সমাধানের জন্য সরকারি কেরানি বা অফিসার ঘুষ নিচ্ছে, কনট্রাক্টে যে সময়ে যে কাজ হবার কথা, হল না–এসব সমস্যা আজকেও আছে, পুরাকালেও ছিল। আমরা বড়োজোর ভাবতে পারি–এই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক যুগে বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধেগুলো নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথাই ছিল না, অথচ তা হয়। আর সেইজন্যই কৌটিল্যের স্মরণ নেওয়া–অন্তত সমস্যাগুলো উচ্চারণ করে জানিয়ে দেওয়া যে, দু-হাজার চারশো বছর ধরে আমরা যেমন ছিলাম তেমনই আছি–তখনকার রাজতন্ত্রে যে সমস্যা ছিল, এখনও তেমনই আছে।
প্রশাসনের সুবিধের জন্য সম্পূর্ণ জনপদকে চারভাগে ভাগ করে নেওয়া অথবা নগর-শাসনের সুবিধের জন্য এক-একটি নগরকে চার ভাগ করে নিয়ে বড়ো-ছোটো মর্যাদার বিভিন্ন প্রশাসক নিযুক্ত করাটা খুব বড়ো বুদ্ধির পরিচয় নয় বলেই না হয় ধরে নিলাম। কিন্তু নগরের এক-একটি অংশে কতকগুলি পরিবারের বসবাস, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের জাতি, গোত্র, নাম এবং তারা কে কী কাজ করে, অপিচ সেই কাজ থেকে তাদের আয়। কেমন হয় এবং ব্যয় কেমন হয়–এই সম্পূর্ণ হিসেবটি কিন্তু থাকতে হবে নগরের কর্তাব্যক্তি গোপ এবং স্থানিকের কাছে। যাঁরা ভাবছেন নগরবাসী মানুষজনের স্থিতি এবং গতাগতি বোঝার জন্য এটা একটা বিশেষ ব্যবস্থা, তাদের জানাই, এটা একটা বড়ো কাজের অঙ্গমাত্র। আমরা যাকে এখনকার দিনে ‘সেনসাস’ (Census) বলি-এ হল তাই। কৌটিল্য সমস্ত রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি গ্রামে কটা মানুষ আছেন, তাদের কাজকর্ম, চরিত্র, আয়ব্যয়–সবকিছুর হিসেব রাখতে বলেছেন।
যেখানে গ্রামের মধ্যেই ক’জন কৃষক পরিবার, ক’জন বণিক, ক’জন গয়লা এবং তাদের মধ্যেও কারা রাজকর দেয় এবং কারা দেয় না এত হিসেব, সেখানে নগরে শহরে এহিসেবের আরও কড়াকড়িই হবার কথা। তবে জনপদের মধ্যে মানুষজনের সংখ্যার হিসেব, তাদের গোত্রবর্ণ এবং ক্রিয়াকর্মের এই হিসেবটা খুব সরলভাবে একটা ‘সেনসাস-রিপোর্ট তৈরি করার জন্যই এবং শহরেও তাই–এতটা সরলভাবে এই ব্যবস্থা কৌটিল্যের মননের মধ্যে ছিল না। কৌটিল্য একই কাজের মাধ্যমে দুটি তিনটি কাজ সেরে ফেলেন। লক্ষণীয়, এই সংখ্যা গোনার কাজটা যেমন প্রশাসনিক উপায়ে সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে চলত, তেমনই এই কাজ সমান্তরালভাবে করা হয় আরও একটি ধারায় এবং সেটা গুপ্তচরের ধারা। এই গুপ্তচরেরা কিন্তু জনপদের কিংবা নগরের শাসক গোপ কিংবা স্থানিকের কাছে রিপোর্ট করবে না, কেননা তারা নিযুক্ত হয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী সমাহর্তার দ্বারা। কেন এমন ব্যবস্থা? কেননা, এই গুপ্তচরেরা একদিকে যেমন গ্রাম-শহরের জমিজিরেত, ঘরবাড়ি, মানুষজনের হিসেব করছে, তেমনই অন্যদিকে প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত গোপ-স্থানিক এবং প্রদেষ্টা পুরুষদের কাজকর্মগুলিও খেয়াল করবে।
কেন এমন ব্যবস্থা ছিল, তা আমাদের কর্পোরেশনের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। কর্পোরেশনের অফিসারেরা (কাজকর্ম দেখে অবশ্য করণিক না অফিসার কোনোটাই বোঝা যায় না) বাড়ি-বাড়ি গিয়ে নানা বিধানে নিরীক্ষণ-পরীক্ষণ করে কর-নির্ধারণ করেন। এই প্রক্রিয়া চলার সময়ে গৃহস্থ সময়মতো সচকিত হলে জমি-বাড়ির কর প্রথাবহির্ভূতভাবে অর্ধেক বা অর্ধেকেরও কম হয়ে যেতে পারে। এইখানেই গুপ্তচরের কাজ। কৌটিল্যের গুপ্তচর গৃহস্থের বেশ ধরে গ্রাম-শহরের জমি-বাড়ির হিসেব রাখত এবং সেখানে কে-কতটা কর দিচ্ছে এবং কারাই বা করে ছাড় পাচ্ছে এবং সেখানে গোপ-স্থানিক-প্রদেষ্টারা কী ভূমিকা নিচ্ছেন, তারা ঘুষ খাচ্ছেন কি না–এই সমস্ত রিপোর্ট তিনি দেবেন সর্বোচ্চ আধিকারিক সমাহর্তার কাছে। আর গণতন্ত্রে কী হয়? এখন কর্পোরেশনের অধিকর্তা নিজের দেওয়ানেই বহুতর অপহারী কর্মচারীদের কৌশল দেখে নিজেই সার্বিক অপহরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক-একটি জমি-বাড়ির দেয় কর প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়ে সেটাই আবার কর্মচারীদের কৌশলী মহানুভবতায় দ্বিগুণে নামিয়ে এনে কর্পোরেশনের সমাহর্তা তার আপন সংস্থা এবং কর্মচারী দুই পক্ষকেই মহান সুযোগ করে দিয়েছেন। কৌটিল্যের আমলে এমনটি হবার উপায় ছিল না। কেননা সরকারি অফিসার বাজারদরের চেয়ে বেশি স্ট্যাম্পে ডিউটি ধার্য করলে যে প্রজা-বিক্ষোভ ঘটত, তারও সংবাদ দিত গুপ্তচরেরাই। এখন অবশ্য ক্ষোভের কথা সোজাসুজি বললেও কিছু হয় না, কেননা এই যুগে গণতান্ত্রিক এবং দলতান্ত্রিক সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের চেয়েও বেশি শোষণ করা যায়।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রীয় কালে গ্রাম-শহরের প্রশাসনে প্রশাসনিক ধারা ছাড়াও আরও একটা কারণে গুপ্তচর নিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে, আরও একটি কারণে এবং সে-কারণ আজকের দিনের একটা জ্বলন্ত সমস্যা। কৌটিল্য বলেছেন–গ্রাম-শহরে, নগরে মানুষের সংখ্যা, বৃত্তি, চরিত্র এবং তাদের আয়ব্যয়ের ওপর নজর রাখা ছাড়াও গুপ্তচরেরা আরও একটি কাজ করবে। তারা জানবে–নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে কারা অন্যত্র গিয়ে বাস করছে, কিংবা অন্যত্র গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। বিদেশ থেকেই বা কারা এ-দেশে এসেছে কেন এসেছে এবং এসেই যদি থাকে তাহলে আবার ফিরে গেল কেন? একই সঙ্গে খবর রাখবে নর্তকী এবং বেশ্যাদের এবং অন্যান্য ধূর্ত বদমাশদের–তারা কোথায় যাচ্ছে এবং অন্য দেশের তেমন কেউ এখানে গুপ্তচরবৃত্তি করছে কি না–এসব খবর সমাহর্তার কাছে পৌঁছে দেবে।
বেশ বোঝা যায়–কৌটিল্যের রাজনীতিতে জনপদ কিংবা নগরে কোথাও অত সহজে অলক্ষ্যে ঢুকে পড়া বা বেরিয়ে যাওয়া যেত না। আজকের দিনে আমাদের এই গণতান্ত্রিক দেশে যেমন দেখতে পাই–অপরাধপ্রবণ মানুষ নির্বিবাদে গ্রামে-শহরে ঢুকে পড়ছে, নির্বিরোধে লোক মারছে এবং নির্বিচারে পালিয়ে যাচ্ছে শত্রু-দেশের এমন দুর্ব্যবসায় কৌটিল্য কিছুতেই বরদাস্ত করতেন না। গ্রাম-শহরের মনুষ্যাবাস ছাড়াও আরও এগারোটা জায়গায় কৌটিল্য নজর রাখতে বলেছেন গুপ্তচরদের। বলেছেন–তারা যেন চোরের বেশেই থাকে এবং চোরের মতোই যেন নিপুণ হয়, কেননা তারা যাদের খবর জানবে, তারাও এক ধরনের চোর। কৌটিল্য বলেছেন–যে-কোনো দেবস্থান যে-কোনো খালি জায়গা যেখানে লোক যায় না, জলাশয়, যে-কোনো তীর্থস্থান অথবা প্রাকারবেষ্টিত দেবমন্দির, অরণ্য-প্রদেশ যেখানে ব্রাহ্মণরা যাগযজ্ঞ করেন, পাহাড়, বন-গহন-এইসব জায়গায় শত্রুরাজ্যের অনিষ্ট পুরুষেরা–যারা লোক মারতে এতটুকু দ্বিধা করে না তাদের প্রবেশের ওপর নজর রাখতে হবে, নজর রাখতে হবে চোরদের ওপরেও। এদের আসা-যাওয়া এবং সাময়িক স্থিতি–সবকিছুর কারণ জানতে হবে–স্তেনামিত্র প্রবীর-পুরুষাণাং চ প্রবেশন-স্থান-গমন-প্রয়োজনানি উপলভেরন্।
আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের সম্পত্তির অধিকার অথবা বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না, কেননা এ-দেশে মানুষ মরলে সরকারের কিছু আসে-যায় না। কিন্তু কোনোমতে বেঁচেই যদি থাকি এবং জমি-বাড়ি-জীবিকার জন্য প্রভূত রাজকর দিয়ে যদি পৈতৃক জীবনটা ধারণই করি, তবে কৌটিল্যের খ্রিস্টপূর্ব কালের তুলনায় তা কেমন করি–দেখা যাক।
নাগরিক সুবিধের কথা মাথায় রেখে প্রথমে রাস্তাঘাটের কথাই ধরা যাক। এ-কথা মেনে নিচ্ছি যে, এখনকার নগরগুলির যেমন চেহারা, তখন নিশ্চয়ই তেমন ছিল না। কিন্তু তখনকার দিনের মতো নগর তো ছিল এবং সেই নগরের সংখ্যা কিছু কম ছিল না। গ্রিক ঐতিহাসিকের মতে আলেকজান্ডার শুধু পঞ্জাবেই দু’হাজার নগর জয় করেছিলেন। কথাটা যদি বাড়াবাড়িও হয়, তবু বলব দু’হাজার না থোক, দুই শত তো হবে, না হলে নিদেনপক্ষে কুড়ি। বিশেষত মহাভারত থেকে আরম্ভ করে বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি, কামসূত্র থেকে অর্থশাস্ত্র–সর্বত্র আরবানাইজেশন বা নগরায়ণ সম্পর্কে এত তথ্য আছে যে, তার পথঘাট নিয়ে বড়ো বড়ো বই লেখা হয়ে গেছে। আমরা ব্যাপারটাকে অত জটিল না করেও বলতে পারি যে, মহাভারত এবং বৌদ্ধযুগেই বেশকিছু দূরগামী রাস্তা আমাদের দেশে তৈরি হয়ে গেছে–উত্তর থেকে দক্ষিণে, পশ্চিম থেকে পূর্বে। এখনকার পেশোয়ার (তখনকার পুরুষপুর) থেকে মাত্র আঠারো মাইল দূরে ছিল গান্ধার (এখনকার কান্দাহার) রাজ্যের রাজধানী পুষ্কলাবতী। সেই পুষ্কলাবতী থেকে মেগাস্থিনিস এক হাজার একশো ছাপ্পান্ন মাইল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মগধের রাজধানী পাটলিপুত্র পৌঁছান। তাঁর আসার পথে পড়েছিল উদভাণ্ড (বর্তমান ওহিন্দ), তক্ষশিলা, পঞ্চনদীর পরিচিত পথ, হস্তিনাপুর, কনৌজ, প্রয়াগ–এইসব বড়ো বড়ো শহর।
এইসব বড়ো শহরে যেসব সাধারণ রাস্তাঘাটের পরিচয় পাই, সেটা নগরায়ণের প্রথম পর্বে খুব মোটা দাগে স্থলপথ, জলপথ, রাজপথ–এইরকম ভাগে ভাগ হলেও বুদ্ধের সময় থেকে কৌটিল্যের সময়ের মধ্যেই সেগুলি একটা নাগরিক স্বরূপ লাভ করেছিল, এমনকী তার মধ্যে অর্থনৈতিক কার্যকারিতার দিকটাও এমন সুচিন্তিতভাবে ভেবেছেন কৌটিল্য, যেটা আজকের দিনের অনেক বহুলালাপী মন্ত্রীদেরও লজ্জা দেবে। কৌটিল্য নগর তৈরির আগে রাস্তা তৈরি করে নিতে চান অর্থাৎ রাস্তা দিয়েই প্রথম পরিকল্পিত বাস্তুবিভাগ সম্পূর্ণ হবে। তার মতে নগর তৈরির সময় তিনটি রাজপথ পূর্ব-পশ্চিমে এবং তিনটি উত্তর-দক্ষিণে আয়ত থাকবে এবং এইভাবে ভাগ করলে সম্পূর্ণ নগরটি ষোলোটি চতুষ্কোণ ভূমি-মণ্ডলে বিভক্ত হবে।
বড়ো বড়ো এইরকম ছয়টি রাজপথ তৈরি হওয়ার পর তৈরি করতে হবে বেশ কতকগুলি বত্রিশ ফুট চওড়া রাস্তা, যেগুলি দিয়ে রথ চলাচল করবে-রথ চলত বলেই হয়তো এগুলির নাম ছিল রথ্যা। এবারে রাজমার্গ থেকে দ্রোণমুখে যাবার রাস্তা-’দ্রোণমুখ’ হল চারদিকে একশো-একশো করে চারশো গ্রামের মাঝখানে যে বড়ো গ্রাম, এখনকার ভাষায় ‘স্মল টাউনশিপ’। থাকবে স্থানীয়-এ যাবার রাস্তা–স্থানীয় রীতিমতো উপনগর–আটশো গ্রামের কেন্দ্রস্থল, যেখানে বাজার-হাট বসে এবং থানা আছে। সম্পূর্ণ জনপদের বিভিন্ন স্থানে যাবার রাস্তার সঙ্গে থাকবে গোচারণ ক্ষেত্র বা গোশালায় যাবার রাস্তা, যাকে বলা হয়েছে ‘বিবীত-পথ। এক সৈন্যশিবির থেকে অন্য সৈন্যশিবিরে যাবার জন্য আলাদা পথ–এমন পথ যেখানে সৈন্যদের ন্যূহ সাজিয়ে মার্চ করে নিয়ে যাওয়া যায়–এই পথ হল বৃহপথ। দেশি-বিদেশি পণ্য যেখানে নির্দিষ্টভাবে ক্রয়-বিক্রয় হয় অথবা বন্দর-শহরে যাবার জন্য পথ হল সংযানীয়।
এই যে তিন-তিন ছটি রাজমার্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে এতগুলি পথ, এই সবকটা পথই কিন্তু চৌষট্টি ফুট চওড়া। কিন্তু এত প্রশস্ত পথ-পরিকল্পনাতেও আমরা আশ্চর্য হই না, বরঞ্চ আশ্চর্য লাগে ভেবে যে, এইসব বড়ো বড়ো রাস্তা ছাড়াও কৌটিল্য এমন কতকগুলি পথের কথা বলেছেন–যেগুলির পিছনে তার মানবিক এবং পরিবেশগত ভাবনা কাজ করেছে। যেমন মানুষের অন্ত্যকৃত্য করার জন্য যে শ্মশানে যেতে হবে, তার জন্য পৃথক একটি পথ রাখতে বলেছেন কৌটিল্য। শবদেহ বয়ে নিয়ে যাবার মধ্যে যে বেদনা এবং শূন্যতাবোধ কাজ করে অন্য লোকের চোখেও সেটা খুব কষ্টকর এবং নঞর্থক ভাব তৈরি করে বলেই কৌটিল্যের ভাবনায় একটা চৌষট্টি ফুটের পৃথক শ্মশান-পথের ব্যবস্থা। এছাড়াও আছে গ্রাম থেকে গ্রামে যাবার পথ, এবং যেসব জায়গা থেকে রাষ্ট্রের অর্থাগম হয় যেমন, ফুল-ফলের বাগান, সবজি-বাগান, ধানক্ষেত্র অথবা সংরক্ষিত বনবিভাগ, যেখান থেকে হাতি, ঘোড়া, গোরুর জোগান আসে, সে-সব জায়গায় যাবার জন্যও বত্রিশ ফুটের রাস্তা থাকতে হবে বিভিন্ন জায়গায়। আজকের দিনের নাগরিকতায় আমরা যেমন ভারী যানবাহন চলবার জন্য পৃথক রাস্তার চিন্তা করে থাকি কৌটিল্য সেকথা ভেবেই সেকালের যানবাহন চলার ক্ষেত্রে হাতি যাবার পথটাকে একেবারে আলাদা করে দিয়েছেন। ক্ষুদ্র পশুর জন্য, বৃহদাকার পশুর জন্য এবং রথ যাবার চক্রপথের জন্য বিভিন্ন ঋতু এবং মাটির গুণাগুণ বুঝে পৃথক পথ তৈরি হলেও এই পথগুলি যে অন্য প্রয়োজনে ব্যবহার হত না, তা বোধহয় নয়, তবু এই পৃথক এবং চিহ্নিত পথ-ব্যবস্থাটাই খুব জরুরি, কেননা আজকের আধুনিকতায় এই ভাবনা বড়ো প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
ভালো ভালো অনেক রাস্তার কথা তো হল, কিন্তু সে রাস্তায় চলাফেরা করার পথে বাধা সৃষ্টি হলে কৌটিল্যের কালে কী হত সেটাও বলা দরকার। আমাদের কাছে তো অবরোধ, যানজট, মিটিং মিছিল, রাস্তা নোংরা করা সবকিছু এমন জল-ভাত হয়ে গেছে যে, কোনো জায়গায় তাড়াতাড়ি পৌঁছলে বা অবরুদ্ধ না হলে নিজেরই কীরকম আশ্চর্য লাগে। কৌটিল্যের নিয়মে–রথ্যা অর্থাৎ যে রাস্তা নিয়ে রথ-শকট চলত, সেই রাস্তায় যদি কেউ ধুলো-ময়লা ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করত তাদের আট পণ জরিমানা হত। রাস্তায় পাঁক, জল এসব ফেলে যদি অবরোধ তৈরি হত তো জরিমানা একের চার পণ। আমাদের রাজপথগুলিতে হাঁটুন, মন্দির, মসজিদ, সরকারি অফিস, অথবা শেয়ালদা-হাওড়া স্টেশনে যান, দেখবেন এখানে-সেখানে মনুষ্যবিষ্ঠা, পশুবিষ্ঠা এগুলি থেকে এখনও আমরা মুক্তি পাইনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন বিষ্ঠা-দূষণ রবীন্দ্র সরোবরে দেখেছি, সল্টলেকে সরকারি অফিসের পাশে দেখেছি, আর শেয়ালদা-হাওড়ায় এবং হাসপাতালে দেখেছি পুঞ্জ পুঞ্জ। কৌটিল্যের সময়ে বিষ্ঠাদণ্ড এবং মূত্রদণ্ড বলে দুটি আইন ছিল। জায়গার গুরুত্ব বুঝে বিষ্ঠাদণ্ড এবং মূত্রদণ্ড উত্তরোত্তর বাড়ত। একমাত্র চরম বিপন্নতার উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া বিষ্ঠাদণ্ড মূত্রদণ্ড থেকে রেহাই ছিল না। আজকের দিনে যাঁরা নিজে হাওয়া খেতে-খেতে এবং গৃহপালিত কুকুরকে হাওয়া খাওয়াতে-খাওয়াতে অন্য মানুষের ঘরের সামনে এবং সরকারি রাস্তায় কুকুরের বিষ্ঠার দায় কুকুরের ঘাড়ে চাপান, আমরা নিশ্চিত জানি, কৌটিল্য বেঁচে থাকলে আজকে সেই পশ্বধিকারীর ওপরে পশুবিষ্ঠাদণ্ড নেমে আসত অন্তত এক পণ।
তার ওপরে এ-জিনিস তো হামেশাই চোখে পড়ে। রাস্তার মধ্যে ইঁদুর-বিড়ালের হানাহানিতে ইঁদুর মারা গেল অথবা দুইটি কুকুরের মারামারিতে একটি কুকুর মারা গেল–এমন ঘটনার কথা বলছি না। কিন্তু আমার বাড়ির সামনে অন্য বাড়ির মৃত ইঁদুর, কিংবা অন্য গৃহের মৃত কুকুর রাস্তায় ফেলে যাওয়া–এমন ঘটনা যে কত দেখেছি এই কলকাতায়, তার ঠিক নেই। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে কৌটিল্যের শাসনটা এইরকম–বিড়াল, কুকর, বেজি, কিংবা সাপের মৃতদেহ যদি নগরের মধ্যে কোথাও ফেলা হয়, তবে অপরাধীর দণ্ড কমপক্ষে তিন পণ। পশু যদি বড়ো হয়, দণ্ডও তাহলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। আর রাস্তায় যদি কোনোভাবে মানুষের মৃতদেহই ফেলে রাখা হয় তাহলে আর রক্ষে নেই, তার দণ্ড পঞ্চাশ পণ।
অর্থবল, জনবল, আলস্য অথবা মানসিক দূরত্বই হয়তো একটা কারণ হিসেবে গণ্য হতে পারে, যখন মানুষ মানুষের মৃতদেহ সৎকার না করে রাস্তায় ফেলে আসে এবং দণ্ড যখন আছে তখন তো এটাও প্রমাণ হয় যে, অপরাধীকে না পাওয়া গেলে রাষ্ট্রই সেখানে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু মনুষ্যশবের ক্ষেত্রে যা সত্য, অন্য পশুশবের ক্ষেত্রে তা সত্য নয়। সেখানে শুধু আত্মগৃহশুদ্ধির প্রবৃত্তিটুকুই কাজ করে। মনুষ্যশব নগরপথে পরিত্যাগ করার জন্য যে অত্যধিক জরিমানা হত, তার কারণ একটাই এবং তা হল–রাস্তায় ফেলা তো দুরের কথা, শব-নিষ্ক্রমণের জন্য একটা আলাদা পথ ছিল, সেই পথে শব নিয়ে না গেলে, এমনকী নগরের যে নির্দিষ্ট দ্বার দিয়ে শব নিয়ে যাবার যে ব্যবস্থা, সেই দ্বার দিয়ে শব নিষ্ক্রমণ না ঘটিয়ে অন্য দ্বার বা অন্য পথে তা করা হলে দুশো পঞ্চাশ পণ জরিমানার ব্যবস্থা ছিল। পুনশ্চ এসব ক্ষেত্রে নগরদ্বারের রক্ষক যদি ঘুষ খেয়ে মানুষকে এই সুযোগ দেয় এবং সে যদি বাধা না দেয়, তবে তার ব্যক্তিগত দণ্ডই ছিল দুশো পণ।
নাগরিক সুবিধার আর একটি বড়ো দিক স্বাস্থ্য-পরিষেবা। মনে রাখা দরকার-স্বাস্থ্য-পরিষেবা কৌটিল্যের দৃষ্টিতে সরকারের বা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শুধু তাই নয়, চিকিৎসার ক্ষেত্রটা আজকের দিনে যেমন কনজিউমারইজমে’র দৃষ্টি থেকে ভাবার চেষ্টা করা হচ্ছে, কৌটিল্য বোধহয় সেই দৃষ্টি সম্বন্ধেও অবহিত ছিলেন। অর্থশাস্ত্রের অন্তত দুটি বিধান থেকে এই দুটি ভাবনাই প্রমাণ করা যায়। ডাক্তারের কাছে রোগী আসল এবং তিনি চিকিৎসা আরম্ভ করলেন, এ তো খুব কাম্য পরিস্থিতি। এ ব্যাপারে ডাক্তারবদ্যিরা এখনও যেমন দায়িত্বশীল তখনও তেমনই ছিলেন। কিন্তু ইমার্জেন্সি কেসে’ যখন রোগী ডাক্তারের কাছে আসে, তখন কৌটিল্যের বক্তব্য হল–কোনো বৈদ্য যদি রোগীকে প্রাথমিক পরীক্ষা করে এমন বোঝেন যে, চিকিৎসা আরম্ভ করলেও বা চিকিৎসার পরেও তার প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে, তবে আগে তিনি উপযুক্ত আধিকারিক রাজপুরুষকে সে। খবর জানিয়ে তবে চিকিৎসা আরম্ভ করবেন। তাতে সুবিধে এই যে, রোগী যদি বেঁচে যায়, তবে কারওরই কিছু বলার নেই, কিন্তু রোগী যদি মারা যায় তবে অন্তত ডাক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে মারধর করা অথবা চিকিৎসালয় ভাঙচুর করার ঘটনাগুলি ঘটবে না। আর কৌটিল্য বলেছেন–প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বৈদ্য যদি তা রাজদ্বারে না জানিয়ে নিজের দায়িত্বে চিকিৎসা আরম্ভ করেন এবং তাতে যদি রোগী মারা যায়, তাহলে ওই বৈদ্যের ভালোরকম জরিমানা হবে।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, নাগরিকের জীবন নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবনা আছে এবং রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য-পরিষেবার মধ্যেও রাষ্ট্রের একটা কনট্রোল’ কাজ করছে। এছাড়াও ডাক্তারির ক্ষেত্রে যে কনজিউমারিজম’-এর কথা বলেছিলাম, তার একটা ভাবনাও প্রমাণ হয় কৌটিল্যর বক্তব্য থেকে। কৌটিল্য বলছেন–বৈদ্য রোগীর যে চিকিৎসা করছেন, সেই চিকিৎসার মধ্যে যদি কোনো ভুল থাকে এবং বৈদ্যের কর্মদোষে অর্থাৎ তার ভুল চিকিৎসায় যদি রোগীর মৃত্যু হয়, তবে সেই বৈদ্যের জরিমানা হবে পাঁচশো পণ। এ কথা ঠিক যে, কনজিউমারিজম’-এর ক্ষেত্রে ক্রেতাস্বার্থে একটা ক্ষতিপূরণের ব্যাপার থাকে, এখানে ব্যাপারটা ঠিক তেমন না হলেও চিকিৎসাকর্মে দোষের জন্য জরিমানা করাটা ক্রেতার স্বার্থ সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তো বটেই। সমাজ তখনও তেমন পরিশীলিত হয়নি, ফলে চিকিৎসার বিভ্রাট বা চিকিৎসকের ক্রটি ক্রেতাস্বার্থের পরিপন্থী হলে সেটা আর্থিক বা অন্য কোনো ক্ষতিপূরণ বা প্রতিপূরণের দিকে না গিয়ে প্রত্যাঘাতের চেহারা দিতে চান কৌটিল্য। যেমন শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তার যদি ভুল করে শস্ত্রাঘাতে রোগীর কোনো গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক ক্ষতি করেন, বা সেই অঙ্গের বৈকল্য (ডিফরমিটি) ঘটান, তবে সেটা মামলা-মোকদ্দমার আওতায় চলে আসবে-টীকাকার বলছেন–সেই মামলায় ডাক্তারকে অভিযুক্ত করে কঠিন দণ্ডের ব্যবস্থা করা যাবে–তদাখ্যেন বিবাদ-পদেন ভিষজমভিযুঞ্জীত–এবং সেই দণ্ড হল এইরকম–ডাক্তার নিজের ভ্রমাত্মক শস্ত্রপ্রয়োগের দোষে রোগীর যে অঙ্গের ক্ষতি করেছেন, ডাক্তারেরও সেই অঙ্গের ক্ষতিসাধন করতে হবে।
এই ব্যবস্থার মধ্যে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা খানিকটা প্রতিহিংসাবৃত্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে বটে, হয়তো এমন কোনো ঘটনা সেকালে বাস্তবায়িতও হয়নি, কিন্তু এই শাস্তির ভাবনা ক্রেতার স্বার্থ-সুরক্ষার দিকে একটা স্পষ্ট পদক্ষেপ বটেই। এমনকী এতবড়ো কথাটা যদি নাও বলি, তবু এটা মানতে হবে যে, নাগরিকের জীবন তো বটেই, তার সম্পত্তির সুরক্ষা এবং যাতে তাকে কোথাও ঠকতে না হয়, সেই ভাবনাটা কিন্তু কৌটিল্যের নাগরিক-বিধির অঙ্গ ছিল, এমনকী মহাভারত তথা অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলিও এ-ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের কাছে হেনস্থা, অথবা বাজারে গিয়ে ঠকে আসার ব্যাপার ছেড়েই দিলাম, নাগরিকের সম্পত্তি-সুরক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্রকে এতটাই সাবধান হতে হত যে, নাগরিক যদি চোরের হাতেও কিছু খুইয়ে বসেন, তবে তা পূরণ করতে হত রাষ্ট্রকে। ধর্মশাস্ত্রকারেরা নির্দেশ দিয়েছেন–রাজার রাজ্যে যদি কারও টাকাপয়সা চুরি যায়, তবে যে বর্ণের লোকই হোক, সব জিনিস চোরের কাছ থেকে আদায় করে তা অধিকারী ব্যক্তির হাতে তুলে দিতে হবে–দাতব্যঃ সর্বর্বর্ণেভ্যো রাজ্ঞা চৌরে হৃর্তং ধন–এবং অনাদায়ে তা রাজাকেই পূরণ করে দিতে হবে রাজকোষ থেকে। এখনকার আধুনিক গণতন্ত্রে জীবন এবং সম্পত্তির অধিকার যেখানে তথাকথিত ভাবে সুরক্ষিত, সেখানে চোরে চুরি করলে চোর ছাড়া বেশিরভাগ নিরীহ অচৌর ব্যক্তিই রাজপুরুষের হাতে নিগৃহীত হয়। আর হৃত দ্রব্য ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে সরকারের দায় শূন্য।
কৌটিল্য, এমনকী যাঁকে আজকাল আপনারা নানা কারণে খুব গালাগালি দিয়ে থাকেন, সেই মনু-মহারাজেরও একটা ব্যাপারে দৃষ্টি খুব স্বচ্ছ ছিল। ওঁরা যতই রাজতন্ত্রের পক্ষপাতী মানুষ হোন, ওঁরা এটা খুব ভালো জানতেন যে, যেসব জায়গা থেকে রাজার রাজকোষে টাকা আসে, সেইসব বিভাগের দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা সাধারণ মানুষকে নানাভাবে, নানান মাধ্যমে ফাঁকি দেন বা ঠকান। একজন ভদ্র নাগরিক যিনি রাজকর ফাঁকি দিচ্ছেন না, তিনি যাতে রাজপুরুষের হাতে হেনস্থা না হন বা তাকে দ্রব্যে, মানে, মূল্যে ঠকতে না হয়, সে কথা বলবার সময় মনু এবং কৌটিল্য দুজনেই ‘চোর’ কথাটা ব্যবহার করেছেন। মনু বলেছেন–রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগীয় দায়িত্ব যাঁদের হাতে থাকে, গুরুত্বপূর্ণ যেসব দফতর তারা সামলান, সেখানে অনেক রাজপুরুষই থাকেন, যাঁরা বস্তুত অন্যের ধন চুরি করেন এবং তাদের স্বভাবের মধ্যেও একটা শঠতা থাকে–রাজ্ঞো হি রক্ষাধিকৃতাঃ পরস্বাদায়িনঃ শঠাঃ। মনু প্রাচীন মানুষ, তাই ঘুষখোর কথাটা না বলে ‘পরস্ব-আদায়ী’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন এবং একই সঙ্গে শঠতার প্রসঙ্গ তুলে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এইসব সরকারি রাজপুরুষেরা নাগরিক জীবনে নানা হেনস্থা সৃষ্টি করে। অতএব এইসব লোক যদি একবার ধরা পড়ে, তবে মনুর মত হল–এদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে রাজ্য থেকে বার করে দিতে হবে।
কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতিতে ঘুষখোর রাজকর্মচারীদের শঠতার বিবরণ সার্বিকভাবে ধরা আছে, কিন্তু কৌটিল্যের মাহাত্ম হল–চুরির জায়গা হিসেবে তিনি শুধু কাস্টমস, সেলস্, একসাইজ বা এইরকম কতকগুলি সংস্থা চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হন না, চুরি বা লোকঠকানি জিনিসটাকে তিনি দু বা তিন দিক থেকে, অথবা বলা উচিত–একেবারে আকর থেকে ধরবার চেষ্টা করেন। খুব সাধারণ একটা জায়গা ধরুন। ধরুন, আপনি বাজারে গেলেন। তা, জিনিস কেনার সময় আমরা ক’দিন বা ক’বার ব্যবসাদারের পাল্লা-বাটখারা পরীক্ষা করি। বলতে পারি এ পরীক্ষা করার কাজটা কাদের? সত্যিই এর জন্য নাকি করপোরেশনের লোক আছে, তা সেই লোকটাকে আমরা বছরে ক’বার বাজারে দেখি। একবারও কি দেখি? কৌটিল্যের পৌতবাধ্যক্ষ, যিনি দাঁড়িপাল্লা-বাটখারার ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ, তিনি বছরে চারবার বাজারে এসে দাঁড়িপাল্লা-বাটখারার পরীক্ষা করে স্ট্যাম্পিং করে যাবেন এবং এরকম সিল’ ছাড়া দাঁড়িপাল্লা-বাটখারা ব্যবহার করা হলে সাড়ে সাতশো পণ দণ্ড একেবারে বাঁধা ছিল। বিশেষত বিভিন্ন বস্তু মেপে নেবার জন্য এত বিচিত্র রকমের দাঁড়িপাল্লার কথা কৌটিল্য বলেছেন, তা ভাবলে পরে অবাক হতে হয়।
ওই যে বলেছিলাম ক্রেতা-স্বার্থ-সুরক্ষার ক্ষেত্রটি কৌটিল্য সব সময় মূল জায়গা থেকে বিচার করবার চেষ্টা করেছেন। একটা কাপড় তৈরি করবার সময় যত ওজনের সুতো দেওয়া হল, বস্ত্র-প্রস্তুতির সময় তার যতটুকু হানি ঘটবে, তা ধরে নিয়েও সেই বস্ত্রের যদি কোনোভাবে অবমূল্যায়ন ঘটে, তবে তন্তুবায়ের জরিমানা ছিল অবধারিত এবং এই জরিমানা কাপড়ের মাপ, কত সুতোর কাপড় এবং কাপড়ের কোয়ালিটি–এর যে-কোনো একটা নিয়েই ঘটা সম্ভব ছিল। তন্তুবায়ের এই উদাহরণ কামার, কুমোর, স্বর্ণকার, অথবা যে-কোনো কারখানার অর্ডার-সাপ্লায়ার সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। ডাক্তার-বদ্যিরাও এই লিস্টিতেই আছেন। এইসব ব্যবসাদার এবং শিল্পমালিকদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কৌটিল্য অদ্ভুত মজা করে একটি কথা বলেছেন। বলেছেন–কেউই সামনাসামনি এঁদের কাউকে চোর বলে না বটে কিন্তু এঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই এই চুরি করার প্রবণতাটুকু আছে বলে এঁদের বাস্তবে চোরই বলা যায় এবং রাজাকে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে তারা দেশবাসীর পীড়া সৃষ্টি না করতে পারে–এবং চৌরান্ অচৌরাখ্যাম্বারয়ে দেশপীড়না।
আজকাল সকলেই একটা কথা বলেন, করপোরেট অফিস থেকে কারখানা, মন্ত্রীমশাই থেকে আমলা–সবই আজকাল কর্মচারীদের অ্যাকাউন্টেবিলিটির কথা বলছেন। কৌটিল্য কতকাল আগে ব্যাপারটা ভেবেছিলেন, ভাবলে অবাক লাগে। কৌটিল্য বলেছেন–শিল্পক্ষেত্রে যারা কাজকর্ম করবে, তারা স্থান-কাল নির্দিষ্ট করে কাজ করবে। অর্থাৎ কোন জায়গায় কাজটা হচ্ছে, কাজটা কী, কাজের স্বরূপ কী এবং কত সময়ের মধ্যে সেটা করে দিতে হবে, সেটা শিল্পশ্রমিককে বুঝে নিতে হবে। আবার কাজ যিনি দিচ্ছেন, তিনি যদি স্থান-কাল সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ না দেন, তবে কেন তা দিচ্ছেন না, তাও জেনে নিতে হবে। স্থান, কাল এবং কাজের স্বরূপ সম্বন্ধে স্পষ্টতা এইজন্যই প্রয়োজন, যাতে নির্দিষ্ট সময়ের অতিক্রম ঘটালে শিল্পশ্রমিককে জবাবদিহি এবং জরিমানা করা যায়। সময়ের মধ্যে কাজ না করলে কৌটিল্যের মত হল–বেতন থেকে টাকা কেটে নেওয়া। শারীরিক বিপর্যয়, আধিভৌতিক বা আধিদৈবিক উৎপাতের কারণে কাজ সময়ে সম্পূর্ণ না হলে অবশ্য বিবেচনা ছিল। তা ছাড়া সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করা, কাজের জন্য দেওয়া অপরিশীলিত নিক্ষিপ্ত কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যাওয়া, কিংবা যেমনটি তৈরি করতে বলা হয়েছিল, তেমনটি না করে অন্যরকম করে দেওয়া হলে শিল্পশ্রমিকের বেতনহানি তো হতই, উপরন্তু ক্ষতিপূরক জরিমানারও ব্যবস্থা ছিল। এমনটি আজকের দিনে হলে ক্রেতা-স্বার্থ-সুরক্ষা এবং ওয়ার্ক-কালচার কোথায় পৌঁছে যেত ভাবা যায়?
পরিচ্ছন্ন নাগরিকতার আর একটা বড়ো অঙ্গ হল নগরের গৃহগুলি। বলবেন–ওই তো কৌটিল্যের প্রমাণ দেখিয়ে ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় দূরে দূরে বাড়ি তৈরির কথা বলবেন। কৌটিল্যের কালে কি এমন নগরায়ণ হয়েছিল, নাকি সব লোক এসে কলকাতায় বাসা বেঁধেছিল। উত্তরে জানাই–আসল কথা হল পরিকল্পনা। নগরের কথা পরে আসবে, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের জনপদ সন্নিবেশে কৌটিল্য জনপদবাসী মানুষের সংখ্যায় একটা সমতা বা ব্যালান্স চেয়েছেন। কৌটিল্যের জনপদ যেহেতু আরিস্টটলের ‘পোলিস’ নয়, তাই তার ভাবনার মধ্যে জটিলতাও কিছু নেই। রাষ্ট্রকে একটি বৃহদাকার জনসমষ্টির আশ্রয় এবং আধার হিসেবে চিন্তা করার ফলে, কৌটিল্য প্রথম থেকেই চেয়েছেন–যেন রাষ্ট্রের একটি অংশবিশেষ জনসংখ্যায় অতিরিক্ত স্ফীত হয়ে না পড়ে, আবার কোনো অংশ যেন জনহীনতার জন্য অব্যবহৃত বা সমস্যাকুল না হয়ে ওঠে। এই উদ্দেশ্যে নতুন জয় করা দেশ থেকে মানুষজন নিয়ে এসে পুরাতন জনপদে বসানো আবার পুরনো জনপদের জনবহুল অংশ থেকে মানুষজন সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নতুন জনপদে স্থাপন করাটা জনপদের উন্নতির প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে মনে করেন।
জনপদ সন্নিবেশেই যখন কৌটিল্য এতটা প্রগতিশীল সেখানেনগর-শহরে কেমনতর বাড়িঘর চাইবেন কৌটিল্য? দক্ষিণ কলকাতা তো সেদিনের সৃষ্টি, কিন্তু উত্ম কলকাতার বউবাজার থেকে শ্যামবাজার অথবা আরও ওদিকে সিঁথি থেকে বরানগর–এসব বসতি নিশ্চয়ই কৌটিল্যের আগে তৈরি হয়নি। কিন্তু এতটুকুও কি ভেবেছি আমরা? কৌটিল্য সেই কোনকালে বলে গেছেন যে দুটি বাড়ির মাঝখানে অন্তত তিন-চার পা জায়গা খালি থাকবে–কৌটিল্যের ভাষায় এর নাম অন্তরিকা’ অর্থাৎ অন্তর, প্যাসেজ। বাড়ির সীমানির্দেশক একটা প্রাচীর থাকবে এবং আজকে যে কাঁটাতারের বেড়া দেখেন, কৌটিল্য তাই ব্যবহার করতে বলেছেন বাড়ির সীমায় চার কোণে চারটে মজবুত ঘুঁটি পুঁতে, তার সঙ্গে লোহার তার যোগ করে। আর বাড়িটি তৈরি করতে হবে ওই সীমান্তদ্যোতক বেড়ার বিস্তার বুঝে, অর্থাৎ আগে প্রাচীর, পরে বাড়ি–তাতে জমি নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি হবে না প্রতিবেশীর সঙ্গে কর্ণকীলায়স-সম্বন্ধোনুগৃহং সেতুঃ। যথাসেতু ভোগং বেশ্ম কারয়েৎ।
প্রতিবেশী, প্রতিবেশীর যাতে অসুবিধে না হয়। সে-যুগে অত-শত ফাঁকা জমির মধ্যেও কৌটিল্য বারবার প্রতিবেশীর কথা ভাবতে বলেছেন, কারণ সেটা পরিচ্ছন্ন নাগরিকতার একটা অঙ্গ। এই আধুনিক শহরেও দেখছি একজনের ছাদের বৃষ্টি-নালিকার জল আর একজনের বাড়িতে এসে পড়ছে,–একজনের বাড়ির নর্দমার লক্ষ্য অন্য বাড়ি। ফ্ল্যাট বাড়ির ওপরতলার প্রতিবেশী, নাকি উচ্চবেশী–তিনি চুল আঁচড়ে চুল ফেলছেন নীচে, ডিমের খোলা এবং মোসাম্বির খোসা নিতান্ত অনিচ্ছায় স্বভাবশতই ফেলে দিচ্ছেন নীচস্থ গতায়াতি মানুষের মাথায়। কৌটিল্যের ভাব দেখে বোঝা যায়–যা কিছু করো, তোমার সীমার মধ্যে করো, এবং নিজের সীমার মধ্যেও নিজের বাড়িটাকে অযথা নোংরা করে নিয়ো না। কৌটিল্য বলছেন–তোমার নিজের বাড়ি থেকে যত জল বেরোবে, যত নোংরা জলের ধারা গড়াবে, তা গর্ত তৈরি করে তোমার নিজের বাড়িতেই রাখতে হবে। জলের নালি, নোংরা জলের পতনস্থান অর্থাৎ পিট’, এবং নর্দমাযা কিছু তৈরি হবে–তার অন্তভাগ যেন নিজের জমিতেই প্রবিষ্ট থাকে এবং তার আরম্ভ এবং শেষ–যা কিছুই হোক, তা যেন প্রতিবেশীর দেওয়াল বা প্রাচীর থেকে অন্তত তিন পা দুরে থাকে। বলতে পারেন–তিন পা আর এমন কী, সেই তো নোংরার গন্ধ বেরোবে। কৌটিল্য বলছেন–কোনো মানুষের নিজের বাড়ির নোংরা ফেলার গর্ত, বাড়ির সিঁড়ি, বাড়ির নর্দমা, বাইরে দিয়ে ওঠবার কাঠের সিঁড়ি এবং শৌচালয় যদি এমন জমিতে তৈরি হয় যাতে প্রতিবেশীর অসুবিধে হয় অথবা প্রতিবেশীর নিজের জমিতে তৈরি তেমন কোনো নির্মাণ যদি আমার আপন বাস্তুতভাগের অসুবিধে সৃষ্টি করে, তবে নাগরিক আইনে অপরাধীর ভালোরকম দণ্ড হবে।
নিজের বাস্তুজমিতেও কৌটিল্য যেখানে-সেখানে যা ইচ্ছে করতে দেবেন না। হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া, কুলকুচি করার জন্য যেমন একটি নির্দিষ্ট স্থান বেছে নিতে হবে, তেমনই বাসন মাজা বা কিছু বোয়ার জন্য যেখানে-সেখানে জল গড়িয়ে যাবে, তাও কৌটিল্যের মতে চলবে না, তার জন্য আলাদা জল-নির্গমনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে পুত্র-কন্যা জন্মালে সেকালে যে প্রসব-গৃহ বা আঁতুড় ঘর তৈরি হত–তার জন্যও জল-নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হত এবং সেই প্রসব-গৃহের মেয়াদ মাত্র দশ দিন, তার পরেই সেটা ভেঙে ফেলতে হবে, তা নইলে জরিমানা। এই জল-নির্গমনের ব্যবস্থা এবং নির্দিষ্ট কর্মের জন্য নির্দিষ্ট স্থানের ব্যবস্থা থেকে একদিকে যেমন স্যানিটেশনের ভাবনাটুকু প্রমাণিত হয়, তেমনই অন্যদিকে এক অসামান্য নাগরিক-বোধ প্রকট হয়ে ওঠে–আমি যা করছি, তাতে যেন অন্যের অসুবিধে না হয় এবং অন্যে যা করছে, তাতে আমার অসুবিধে হলেও আমি তার বিরুদ্ধে আইনসঙ্গত ব্যবস্থা নিতে পারি। নাগরিক বিধিতে বাধা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিক আইনের পক্ষে যাবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল-নাগরিক চেতনার অভাবে কোনো বিবাদ উপস্থিত হলে যার অসুবিধে হচ্ছে সেই প্রতিবেশীর সাক্ষ্য-প্রমাণই কিন্তু আইনভঙ্গকারীর জরিমানার কারণ হয়ে উঠবে।
কৌটিল্য এমন একটা নাগরিক চেতনার কথা বলেছেন, যেখানে উদাসীনতারও স্থান নেই। আজকাল যেমন কেউ কারও ক্ষতির জন্য মাথা ঘামায় না, তেমন উদাসীনতার স্থান কৌটিল্যের আইনে নেই। ধরা যাক, কারও বাড়িতে আগুন লেগেছে। সে আগুন দেখেও যদি অন্য কোনো গৃহস্বামী উদাসীন বসে থাকেন অথবা আগুন নেভানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে দৌড়ে না আসেন, তবে তেমন মানুষের জরিমানা হবে। এমনকী যে বাড়িতে ভাড়াটে রয়েছে, সেও যদি ‘গৃহস্বামীর বাড়িতে আগুন লেগেছে, আমার কী–এমন ভেবে আগুন নেভানোর চেষ্টা না করে, তবে জরিমানা থেকে তারও রেহাই নেই। আগুনের ব্যাপারে অনবধানতায় যদি আগুন লাগে, তবে এমন ক্যালাসনেস’ কৌটিল্যের আইনে সবচেয়ে বেশি দণ্ডযোগ্য অপরাধ। তার মানে, আজকের দিনে যেসব বাড়িতে ঝোপা-ঝোপা ইলেকট্রিক লাইন শর্ট সারকিট’ হওয়ার জন্যই ঝুলছে সেসব বাড়িতে আগুন লাগলে কৌটিল্য তাদের সবচেয়ে বেশি দণ্ড দিতেন।
আগুন যাতে না লাগে, তার প্রতিষেধ হিসেবেও কৌটিল্য অনেক ভাবনা করেছিলেন। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গ্রীষ্মকালে কতটা গরম হয়ে ওঠে, এবং সেই গরমে সামান্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গেই শুকনো ঘরবাড়িতে কতটা আগুন ধরার সম্ভাবনা, সেটা কৌটিল্য বুঝতেন। ফলে গ্রীষ্মকালের ভরদুপুরে ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালানোর কাজটাই তিনি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। রান্না করতে হলে ঘরের বাইরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কথা না শুনলে জরিমানা, যাকে কৌটিল্য বলেছেন অগ্নিদণ্ড। বস্তুত আগুন-লাগার প্রতিষেধ হিসেবে যেসব ব্যবস্থা আছে, সেগুলি না মানলেই একটা বিস্তারিত অগ্নিদণ্ডের তালিকা আছে। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত যারা বাড়িতে আগুনের কাজ করে, তাদের বাড়িতেই বিভিন্ন ধরনের জলাধার পাত্র মজুত রাখতে হবে ফায়ার-এস্টিংগুইশার’ হিসেবে, রাখতে হবে নানান যান্ত্রিক সরঞ্জাম যাতে আগুনের ধোঁয়া অন্য বাড়িতে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে, যাতে আগুন লাগলেও অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থগুলি দূরে টেনে ফেলা যায়। এসব সরঞ্জাম বাড়িতে না থাকলে জরিমানা হবে।
আগুনের ব্যবহার সম্বন্ধে বহু সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও যে আগুন লাগতে পারে, কৌটিল্য সে-কথা জানতেন এবং জানতেন বলেই অন্যান্য দৈব বিপদের সঙ্গে অগ্নিদাহকেও তিনি দৈব বিপদ বলেছেন। কিন্তু দৈব বলেই তার প্রশমনের জন্য আগে থেকেই যে প্রস্তুত থাকা দরকার–কৌটিল্যের দূরদর্শিতা এইখানেই। যেমন বর্ষার সময় বন্যাপ্রবণ এলাকায় জল এসে লোক মরলে তবে আমাদের চেতনা হয়, কৌটিল্য তা হতে দেবেন না। তিনি আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে বলেন। তিনি জানেন–নদীর তীরে যাদের বাস, তাঁরা বাস ছেড়ে যেতে চান না কিছুতেই। তাদের উদ্দেশে কৌটিল্যের বক্তব্য-বেশ তো থাকুন নিজের বাড়িতে, কিন্তু দিনের বেলায় থাকুন। রাত্রিবেলায় নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকতে হবে এবং গ্রামবাসীরা যাতে প্রয়োজনে নদী পার হতে পারে, তার জন্য নৌকো, বাঁশ, কাঠ যথেষ্ট সংগ্রহ করে রাখবেন এবং বন্যা হলে উদ্ধারকার্যে নামাটাও একান্তভাবে রাজার আদিষ্ট কর্ম। সুযোগ এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার না করলে জরিমানা হবে।
আর এক দৈব বিপদ হল দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের কালে কৌটিল্যের পরামর্শগুলি আমার কাছে রীতিমতো বৈপ্লবিক মনে হয়। তিনি বলেছেন–দুর্ভিক্ষের সময় রাজা অন্ন বিতরণের সঙ্গে সঙ্গে চাষবাসের বীজ দেবেন বিনা পয়সায়। যাতে বিপন্ন সময়ে তাদের কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটে, সেজন্য বিভিন্ন কাজের ব্যবস্থা করবেন। তেমন দরকার হলে মিত্ররাষ্ট্রের রাজাকে অনুরোধ করে কিছুদিন তার রাজ্যে দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের থাকার ব্যবস্থা করবেন। আর দুটি শব্দ আছে কর্শন’ আর ‘বমন’। কৰ্শন’ দুভাবে হতে পারে। যে প্রজাদের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে থাকবার প্রয়োজন নেই, তাদের তিনি অন্য জায়গায় সরিয়ে দেবেন। আর এক উপায় হল–ধনী প্রজাদের ওপর রাজকর বাড়িয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের তিনি সাহায্য করবেন। আর বমন’হল–ধনী প্রজাদের সঞ্চিত অর্থ থেকে জোর করে অর্থ সংগ্রহ করা অথবা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া–যেখানে খাবার মিলবে সহজে।
আধুনিকতা বা প্রগতিশীলতার ব্যাপারে কৌটিল্যের বোধ যে কতটা প্রখর ছিল, তার বহুতর উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু তাতে এই প্রবন্ধের মাত্রা বাড়বে, অথচ দু-একটা উদাহরণ না দিলে কৌটিল্যের প্রখর বাস্তব-বোধটুকুও উপেক্ষিত থেকে যাবে। খুব সংক্ষেপে হলেও দুটি বিষয় এখানে বলব। আজকের দিনে আমরা যে-ধরনের অর্থনীতি আত্মসাৎ করবার চেষ্টা করছি, তাতে শুল্ক ছাড় দেবার রেওয়াজটা কমে যাচ্ছে। শুল্ক আদায়ের ব্যাপারে কৌটিল্যের ভাবনায় বেশ কিছু বাড়াবাড়ি আছে বলে মনে করেন অনেকে এবং সেই কালে তার কারণও হয়তো ছিল, কিন্তু সেই শুল্ক আদায়ের মধ্যে যে আধুনিকতা আছে, তাতে পরিচ্ছন্ন নাগরিকতার পথ পরিষ্কার হয়। কৌটিল্য বোধহয় এমন অনেক রাজা দেখেছেন, যাঁরা যখন-তখন যে-কোনো অছিলায় পৌর-জনপদবাসীর কাছ থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ আদায় করছেন। কৌটিল্য মনে করেন–এই অভদ্রতা দূর করার জন্য প্রথমত প্রয়োজন একটি হৃষ্টপুষ্ট রাজকোষ, যা না থাকলে রাজা অহেতুক পুর-জনপদবাসীকে উত্ত্যক্ত করবেন–অক্সকোশো হি রাজা পৌর-জানপদানেব এসতে।
কৌটিল্যের কর-গ্রহণের নীতি-নিয়ম বিশাল এবং মানুষের শ্রমে তৈরি রাষ্ট্ৰজাত এমন কোনো বস্তুই প্রায় নেই যেখানে রাজকর বা জরিমানার প্রসারিত হস্ত থেকে মুক্ত ছিল। গণিকা থেকে সুরা, ভেড়ার লোম থেকে দাঁড়িপাল্লার বাটখারা, সবকিছুর মধ্যেই কৌটিল্য অর্থের অভিসন্ধি লক্ষ করেছেন। কিন্তু এর মধ্যেও যেটা দেখার মতো, সেটা হল–যে জায়গায় যে জিনিস প্রচুর পরিমাণ জন্মাচ্ছে, কৌটিল্য সেখানেই সেটা বিক্রি করতে দেবেন না। কারণ এতে বিক্রেতার লাভ তলানিতে এসে ঠেকে এবং স্থানীয় ক্রেতা এতে যতই লাভবান হোন, উৎপাদনকারীর বস্তু সেখানে বিক্রি না হয়ে পড়ে থাকে। কৌটিল্য চান–উৎপাদনকারী যেন তার বিক্রেয় বস্তু নিয়ে দুরস্থ বাজার ধরতে পারে। হয়তো এই কারণেই এক বিশাল বা মধ্যম জনপদের সঙ্গে দুর্গ-রাজধানীর একটা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন কৌটিল্য এবং সবার ওপরে চেয়েছিলেন একটি প্রশস্ত বণিকপথ–যে পথ দিয়ে পরদেশের পণ্য স্বদেশে নিয়ে আসা যাবে এবং স্বদেশের পণ্য পরদেশে নিয়ে যাওয়া যাবে।
অন্য দেশীয় পণ্য এবং স্বদেশীয় পণ্যের মধ্যে একটা কমপিটিশন মার্কেট তৈরি করার দিকেও কৌটিল্যের নজর ছিল–কিন্তু সেটা স্বদেশকে বলি দিয়ে নয়। বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষেত্রে তার ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্যের মধ্যে রাহা খরচ, নিজের এবং বাহক পশুর খাওয়া-খরচ, চোর-দস্যু থেকে পণ্যরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার খরচ এবং ব্যবসা থেকে নিট লাভ এই সমস্ত কিছু বিচার করার নীতি মেনে নেবার সঙ্গে সঙ্গে কৌটিল্য বলছেন–স্বদেশে পরদেশীয় পণ্যের দ্বার অবশ্যই খুলে দিতে হবে, কিন্তু তা করতে গিয়ে রাজা যদি দেখেন যে, মোটা লাভ সত্ত্বেও তা নিজের প্রজার পক্ষে বা স্বদেশীয় ব্যবসায়িক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে পীড়াদায়ক হয়ে যাচ্ছে, তাহলে তেমন লাভের মুখ তিনি বন্ধ করে দেবেন–স্থূলমপি চ লাভং প্রজানা ঔপঘাতিকং বারয়েৎ। আবার যেসব দ্রব্য রাষ্ট্রের পীড়া সৃষ্টি করে–যেমন, মদ, গাঁজা, আফিং–সেগুলির আমদানি রাজা বন্ধ করে দেবেন। অন্য দিকে রাজা যদি এমন দেখেন যে, ধান-যব ইত্যাদির উৎকৃষ্টতর বীজ অন্য দেশ থেকে আমদানি করলে নিজের দেশের কৃষিব্যবস্থার উন্নতি হবে বা কোনো বস্তু স্বদেশীয় পণ্যের মান বাড়াবে, রাজা সেই দ্রব্যের আমদানি শুল্ক ছাড় দেবেন এবং খুলে দেবেন বিদেশি পণ্যের দ্বার। এইরকম একটা অসাধারণ ব্যবসায়িক ভাবনা কৌটিল্য সেই যুগে বসে ভেবেছিলেন, এমন সংবাদ আমাদের পুলকিত করে।
পরিচ্ছন্ন নাগরিকতার শেষ বিষয় হিসেবে আমরা স্ত্রী-পুরুষের সামাজিক অবস্থানের কথাটা জানাতে চাই। এ-কথা মানি যে, পুরাতন সংরক্ষণশীলতার কিছু কিছু ছায়া অবশ্যই একজন বিদগ্ধ শাস্ত্রকারের ওপরেও পড়ে, কিন্তু তবু কৌটিল্য এতটাই আধুনিক যে দাম্পত্য সম্পর্কের প্রথমেই তিনি পুরুষ এবং স্ত্রীকে এক অদ্ভুত সমতার সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। কৌটিল্য মনে করেন–স্বামী এবং স্ত্রী এই দুয়ের দিক থেকেই এই সমতার প্রত্যাশা আছে। এতকাল শোনা গেছে, সতী লক্ষ্মী রমণী শুধু স্বামীর সেবা করবে, আর স্বামী-দেবতা পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবেন, কৌটিল্য এই একতরফা ধারণা পালটে দিয়ে বলেছেন–বিয়ের পর স্ত্রী-পুরুষের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী যেসব সেবাকর্ম এবং কর্তব্য আছে, তা যদি স্ত্রী না করেন, তাহলে সেই স্ত্রীর যেমন জরিমানা হবে, তেমনই স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি সেই সেবাকর্ম, তথা তার কর্তব্যগুলি না করেন, তাহলে তার জরিমানা হবে স্ত্রীর দুই গুণ। ভাবতে পারেন–কৌটিল্যের কথায় কথায় জরিমানা! এমন হয় নাকি? আসলে এটা কিন্তু কৌটিল্যের বিচারবিভাগীয় কথা। অর্থাৎ বহুদিন ঘর করার পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি এমন অভিজ্ঞতা হয় যে একে অপরের প্রতি ঠিক যথাযুক্ত দায়িত্ব পালন করছেন না, তবে তারা আইন-আদালত করতে পারেন। আমাদের কাছে এইটেই সবচেয়ে বড়ো কথা যে, দাম্পত্য দায়িত্বের বিবাদ নিয়েও আইন-আদালত করা যেত এবং সেখানে স্ত্রী-পুরুষের সমতা ছিল।
আরও অবাক লাগে যখন কৌটিল্যের অতি আধুনিক ভাবনাটুকু প্রকাশ পায় ডিভোর্স নিয়ে। আগের কালের ধর্মশাস্ত্রকারেরা তো বিবাহের যাবজ্জীবন দিয়েই মানুষের দাম্পত্য জীবনকে পরম বন্ধনের সম্ভাবনায় গ্রথিত করে গেছেন। কিন্তু বিচিত্র মানুষ এবং ততোধিক বিচিত্র মনুষ্য-স্বভাবের মধ্যে কত যে বিশ্বাসভঙ্গ, কত যে আস্থাহীনতা এবং কত যে অন্যায়-অবিচার-মানসিক পীড়ন ঘটে, তার খবর ধর্মশাস্ত্রকারদের কানে পৌঁছলেও মনের কাছে পৌঁছয়নি। কৌটিল্য বাস্তববাদী মানুষ। বিবাহবিচ্ছেদের কথা তো যুক্তিসঙ্গতভাবে ভেবেইছেন কিন্তু তার সঙ্গে ভেবেছেন অর্থনৈতিকভাবে অস্বাধীন স্ত্রীলোকের জন্যও। স্বামীর কাছ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া স্ত্রীর জন্য শুধুখোরপোশ’ ব্যাপারটার নাম ছিল ভর্মণ্যা’অর্থাৎ একেবারে চুক্তি অনুযায়ী ভরণপোষণের দায়বদ্ধতা। কিন্তু এই চুক্তিপত্রের বাইরেও সেই বিচ্ছিন্না অবলার প্রতি কৌটিল্যের মমতাটুকু বোঝা যায় এবং সেই মমতা তিনি সঞ্চার করতে চেয়েছেন এতকালের সহবাসী স্বামীর মধ্যে। বলেছেন–বার্ষিক ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত দ্রব্য তিনি দেবেনই, না হয় একটু বেশি দেবেন–অধিকং বা যথাপুরুষ- পরিব্যাপং সবিশেষং দদ্যাৎ।
এর পরে তো আরও আছে আইনের সেকশন, সাব-সেকশন। অত আলোচনার পরিসর এখানে নেই। সবশেষের কথাটি হল–পরিচ্ছন্ন নাগরিকতা এবং আধুনিকতার বিষয়ে আরও যে কত কথা আছে কৌটিল্যে, তাও এখানে বলে শেষ করা যাবে না। তবে নাগরিকতা সম্বন্ধে যত নিয়মবিধি এবং শিক্ষা থাকুক, কৌটিল্য পড়ার পর আপনার এই ধারণা দৃঢ় হয়ে উঠবে যে, আইনি ব্যবস্থা এবং জরিমানা ছাড়া আর কোনো উপায়েই পরিচ্ছন্ন নাগরিক তৈরি করা যায় না। নিজের সুবিধার সঙ্গে অপরের সুবিধেটা দেখতে গেলে যে নিজেরও কিছু অসুবিধে হবে–এই অধিকার এবং কর্তব্যের তত্ত্ব বোঝানোর জন্যই নাগরিক আইন এবং জরিমানার প্রয়োজন বোধহয় এখনও একই রকম আছে।