কলিযুগ
০১.
কৌরব-পাণ্ডব-বংশের একমাত্র সন্তান-বীজ পরীক্ষিৎ-মহারাজ তখন সবে রাজা হয়েছেন। পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানিকে শেষ গতি লাভ করেছেন এবং ভগবত্তার স্বরূপে চিহ্নিত কৃষ্ণও তখন লীলা সংবরণ করেছেন। পাণ্ডবদের ‘পরিক্ষীণ’ রাজবংশের অপরিণত বংশধর হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষিৎ যে খুব খারাপশাসন চালাচ্ছিলেন, তা নয়। বিশেষতোর পিতৃ-পিতামহকুলের গৌরব তার মনে সদা জাগ্রত থাকায় অন্যায়-অধর্ম প্রশমনের ব্যাপারে পরীক্ষিতের চেষ্টা ছিল যথেষ্ট। যাই হোক, তার শাসন যখন চলছে, সেই সময় হঠাৎই পরীক্ষিতের কাছে এক অপ্রিয় বার্তা এসে পৌঁছল। বার্তাবহ জানাল–তার রাজ্যে কলি’ প্রবেশ করেছে-কলিং প্রবিষ্টং নিজচক্রবর্তিতে।
পরীক্ষিৎ রাজা বলে কথা–সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি–এই চতুর্যুগের স্বরূপ তিনি জানেন। তিনি জানেন যে, চলমান মানব-সভ্যতার পথ বড়ো পঙ্কিল, সময় বাহিত হবার সঙ্গে-সঙ্গে অন্যায়, অধর্ম, অমানবিকতা আরও বেশি-বেশি গ্রাস করে এই পৃথিবীকে। কিন্তু তবু এই সময়ে, তিনি কেবল রাজা হয়েছেন, আর যুগাধম কলি এখনই এসে প্রবেশ করল তার রাজ্যে। পরীক্ষিৎ এমনভাবেই প্রস্তুত হলেন যেন মহাশত্রুর নিপাত ঘটাতে হবে। আসলে সেই সময়ে প্রীক্ষিৎ দিগবিজয় করতেও বেরিয়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাঁর কাছে খবর এসেছে, অতএব আর দেরি না করে তিনি যুদ্ধরথে উঠে পড়লেন কলি-দমনের অভিপ্রায়ে। পরীক্ষিতের রথের কালো। ঘোড়া রথ ছুটিয়ে নিয়ে চলল, তার হাতে ধনুর্বাণ, মনে দৃঢ় সংকল্প-কলিকে তিনি ভয়ংকর শাস্তি দেবেন–শরাসনং সংযুগশৌণ্ড আদদে।
পরীক্ষিতের তখনও তেমন মনোবুদ্ধির পরিণতি ঘটেনি। তিনি বোধহয় বুঝতে পারেননি যে, যুগক্ষয়ের করাল মূর্তিকে অত সহজে চেনা যায় না, সে রূপ ধারণ করে আসে না–সামাজিক ব্যবহারের মধ্যে যুগসন্নদ্ধ অন্যায়-অধর্মের মধ্যেই যুগয় পরিণতি লাভ করতে থাকে। পরীক্ষিৎও, কলিকে সেই রূপকেই দেখতে পেলেন। কালো ঘোড়ার রথ ছুটিয়ে চলতে-চলতে হঠাৎই পরীক্ষিতের চোখের সামনে এক অদ্ভুত অঘটন ঘটে গেল। তিনি দেখতে পেলেন–একটি লোক, সে রাজার পোশাক পরে আছে, সে-পোশাকে সোনার বর্ণ ঝলমল করছে, তার হাতে একটি চাবুক–দণ্ডহস্তঞ্চ বৃষলং দদৃশে নৃপলাঞ্ছন। লোকটি যে জাতিতে শূদ্র, সেটা তেমন বুঝতে পারেননি পরীক্ষিৎ। হয়তো সে যেমন কাজ করছিল সেই নিরিখেই তার অমন ধারণা হয়েছিল।
পরীক্ষিৎ দেখলেন–রাজবেশী পুরুষের সামনে একটি বৃষ দাঁড়িয়ে আছে, তার তিনটে পা-ই ভাঙা। রাজবেশী তাকে চাবুক দিয়ে মারছে। পরীক্ষিৎ আরও দেখলেন–সেই বৃষের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটি গাভী, তার শরীর জীর্ণ মলিন, সে তৃণমুষ্টি চাইছে খাবার জন্য, আর রাজবেশী তাকে মাঝে-মাঝেই লাথি মারছে–গাঞ্চ ধর্মদ্ঘাং দীনাং ভৃশংশূদ্রপদাহতাম্। বৃষটি সাদা রঙের, মুনিঋষিদের সত্ত্ববৃত্তির মতো সে শুভ্র। এমন বৃষটির তিনটি পা ভেঙে গেছে শুধু তাই নয়, রাজবেশী লোকটির দণ্ডতাড়নের ভয়ে সে মূত্র ত্যাগ করে ফেলছে মাঝে-মাঝেই। গাভীটির অবস্থাও তথৈবচ, বাছুরকে না দেখলে যেমন মা গাভী কাঁদে, তেমনই কাঁদছে সে রাজবেশীর পদতাড়নায়।
যজ্ঞভাবিত ব্ৰহ্মবর্তে বৃষ এবং গাভীর এমন অপমান-তাড়না দেখে পরীক্ষিৎ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। ধনুকে শরযোজনা করে প্রহরণের জন্য প্রস্তুত হয়েই তিনি সেই সোনার পোশাক-পরা লোকটিকে বললেন–কে হে তুমি, বদমাশ কোথাকার! নাটুকে নটের মতো রাজার বেশ পরেছ বটে, কিন্তু তোমার কাজকর্ম তো একেবারে চণ্ডালের মতো-নরদেববাসি বেশেন নটবৎ কর্মর্ণ-অদ্বিজঃ। তুমি কী ভেবেছ? আমার রাজ্যে আমার আশ্রয়ে যারা শরণাগত হয়ে আছে, শুধু তুমি বলবান বলেই সেই দুর্বল প্রাণীকে এমন করে তাড়না করবে? সেটা হবে না। তুমি মনে কোরো না–আজ আমার পিতামহ অর্জুন অথবা লোকশ্রুত কৃষ্ণ এই ধরাধামে নেই বলে এমন নিরপরাধ প্রাণীকে তুমি শাস্তি দিতে পারো! তোমাকে আমি মেরেই ফেলব।
পরীক্ষিৎ রাজবেশীকে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ রেখে এবারে সেই বৃষ এবং গাভীটির দিকে নজর দিলেন। বৃষটিকে সাধারণ কোনো ষাঁড় মনে হল না তার। পরীক্ষিৎ তাঁর সবিশেষ পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন এবং অভয় দিয়ে বললেন–বলো, তোমার এই দশা কে করেছে, তোমার তিনটি পা ভেঙে দিয়ে আমার পাণ্ডব-পিতামহদের কীর্তি নষ্ট করেছে কে? বলো তুমি, কে–আত্মবৈরূপ্যকর্তারং পার্থানাং কীর্তিদূষণম্?
পুরাণে বর্ণিত এই অসাধারণ কথোপকথন–যা শেষ হতে এখনও বাকি আছে–এ-কথোপকথনের মধ্যে একটি অসাধারণ রূপক আছে। রূপকে বিবৃত বৃষ হলেন ধর্মের স্বরূপ। বস্তুত অনেক প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম বা জ্ঞান বৃষের স্বরূপে চিহ্নিত। যাঁরা দেবদেব মহাদেবকে বৃষবাহন বলে জানেন, তারা যেন ওই বৃষটিকে সাক্ষাৎ ষণ্ড না ভাবেন। কারণ মহাদেবের কাছে জ্ঞান বা ধর্মের শিক্ষা চাইতে হয় –জ্ঞানঞ্চ শঙ্করাদিচ্ছেৎ-সেইজন্যই তিনি বৃষবাহন। ধর্মকে তাই বৃষের চেহারায় কল্পনা করতে কোনো অসুবিধে নেই। এক একটি যুগের শেষে এই চতুষ্পদী প্রাণীর এক একটি পা ভেঙে দিতে পুরাণকারদের বাধেনি। সত্যযুগে ধর্ম একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ, যাঁড়ের চার পা-ও ঠিকঠাক। কিন্তু সত্যযুগ গিয়ে যেই ত্রেতা এল, অমনি ষাঁড়ের একখানি পা ভেঙে গেল, ধর্ম হল ত্রিপাদ। দ্বাপর যুগে পেছনের দু-পায়ে ভর করে ধর্মের ষাঁড় কোনোরকমে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু কলিকাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার তিনখানা পা-ই ভেঙে গেল। এ অবস্থায় সমস্ত চাপ নিয়ে একখানা পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টকর, তবু ঠিক এই অবস্থাতেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বালকবীর পরীক্ষিতের। তিনি দেখলেন–কে একটা লোক, রাজা-রাজা চেহারা বটে, সে ধর্মের ষাঁড়কে একটা ঠ্যাঙা দিয়ে প্রায় মারে আর কি! তাড়নার ভয়ে ষাঁড়টি ঠকঠক করে কাঁপছে এবং প্রস্রাব করে ফেলেছে-ভয়াৎ মূত্রয়ন্নিব। পরীক্ষিৎ বললেন, খুব সাবধান। অন্যদিকে গাভীটি হলেন জননী বসুন্ধরার স্বরূপ এবং এই স্বরূপও কোনো অপরিচিত রূপক নয়। ভারতীয় সভ্যতার আরম্ভ থেকেই পৃথিবী-জননীকে গো-রূপে কল্পনা করা হয়। মহারাজ পৃথু, যাঁর নামে এই পৃথিবীর নাম পৃথ্বী, তিনি নাকি গোরূপা পৃথিবীকে দোহন করেছিলেন, সেই তিনিই পদতাড়িত হচ্ছিলেন পরীক্ষিতের সামনে। পৃথিবীর রাজা হিসেবে প্রীক্ষিৎ তাই যথার্থ ক্রুদ্ধ হয়েছেন রাজবেশী অন্যায়কারী মানুষটির ওপর।
পরীক্ষিতের প্রশ্নের উত্তরে বৃষরূপী ধর্ম স্পষ্ট করে নিজের পরিচয় দিলেও নিজের বুদ্ধি-ভাবনায় তিনি তাকে চিনতে পারলেন এবং গাভীটিকেও চিনতে পারলেন বসুন্ধরা বলে। পরীক্ষিৎ পৌঁছবার আগেই ধর্মরূপী বৃষ এবং গোরূপা বসুন্ধরার সাক্ষাৎকার হয়েছে। তারা দুজনেই দুজনকে পরস্পর দুঃখ নিবেদন করছিলেন–যুগয়ে ত্রিপাদভগ্ন ধর্ম এবং মলিনা কৃশা বসুন্ধরা যুগপাবনাবতার কৃষ্ণের কথা স্মরণ করে দুঃখ করেছিলেন। বলেছিলেন–কৃষ্ণের পাদস্পর্শে ধর্ম এবং ধরা–কেউই তাদের ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়টুকু বুঝতেই পারেননি–শ্রীমৎপদৈর্ভগবতঃ সমলংকৃতাঙ্গী। কিন্তু সে সুখ এখন গেছে, এখন তারা মার খাচ্ছেন রাজবেশী পুরুষের হাতে।
ধর্ম এবং পৃথিবীকে চিনে ফেলার পর রাজবেশী পুরুষটিকেও পরীক্ষিৎ কলি বলে চিনতে পারলেন এবং সঙ্গে-সঙ্গে বৃষ-গাভী-মিথুনকে অভয় দান করে তিনি খঙ্গ নিয়ে ছুটলেন কলিকে হত্যা করতে–নিশিতমাদদে খং কলয়ে’ধর্মহেতবে। কলি যেই দেখল–রাজা তাকে মারতে আসছেন, অমনি সে আপন রাজবেশ ত্যাগ করে পরীক্ষিৎ-মহারাজের পায়ে পড়ল–তৎপাদমূলং শিরসা সমগাভয়বিহ্বলঃ। আর এইভাবে শরণাগত হলে পাণ্ডব বংশের জাতকেরা তাদের গায়ে হাত তোলেন না। পরীক্ষিৎ তাকে মারলেন না বটে, কিন্তু খুব কড়া গলায় বললেন–তুমি এই মুহূর্তে আমার রাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। একবার তুমি এখানে আস্তানা গাড়লে যত অন্যায়-অধর্ম সব এখানে এসে ঢুকবে। তুমি ভেবেছটা কী? এই পুণ্যা সরস্বতী নদীর পূর্বতীরে তুমি দাঁড়িয়ে আছ, এই বহুশ্রুত ব্রহ্মাবর্ত-প্রদেশে যাজ্ঞিক বৈদিকেরা বিভিন্ন যজ্ঞ বিস্তার করে যজ্ঞেশ্বর বিষ্ণুর উপাসনা করেন-ব্রহ্মবর্তে যত্র যজন্তি যজ্ঞৈঃ/যজ্ঞেশ্বরং যজ্ঞ-বিতানবিজ্ঞাঃ–আর তুমি কিনা সেইখানে এসে ঢুকেছ। বেরোও এখান থেকে। জেনে রেখোধর্ম এবং সত্য ছাড়া এই জায়গায় কারও স্থান হবে না।
পরীক্ষিতের কথা শুনে কলি খুব ভয়বিহ্বল একটা ভাব করল বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ দমে গেল না কিংবা হালও ছাড়ল না। বলল–আপনার এই উদ্যত খঙ্গের সামনে আমি থাকব কেমন করে? তার চেয়ে বরং আপনিই একটা জায়গা বলে দিন যেখানে আমি সুস্থিরভাবে বাস করতে পারি। পরীক্ষিৎ ভাবলেন-কতকগুলো খারাপ জায়গা তো এমনিই চিরকাল আছে, যেখানে অন্যায়-অধর্ম পূর্বচিহ্নিত, অতএব সেইখানেই কলি থাকুক। এই ভেবেই তিনি বললেন–ঠিক আছে, যেখানে জুয়াখেলা হয়, যেখানে মদ্যপানের আসর, যেখানে মাত্রাহীন স্ত্রী-সম্ভোগ এবং যেখানে অকারণ পশ- এই চার জায়গায় থাকো তুমি। আর কোথাও নয়। অন্যায়-অধর্মের মূলাধার কলি অত্যন্ত পাটোয়ারি-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। সে ভাবল–অধর্মের এই স্থানগুলি তো চিরকালীন, এই অধর্ম তো সব যুগে, এমনকী সত্যযুগেও এগুলির নামত উপস্থিতি ছিল। কাজেই পরীক্ষিৎ আর নতুন কী দিলেন! মহাভারতে স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আপন স্ত্রী দ্রৌপদীকে পণ রেখে যে-অন্যায়ে মেতে ছিলেন, তাতে–দূত, পান–এগুলি নিতান্ত পুরাতন অধর্মের জায়গা। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণপর্বে স্বয়ং বিকর্ণ পর্যন্ত অধর্মের স্থান চিহ্নিত করার সময় ওই চারটি জায়গাই বলেছিলেন-মৃগয়াং পানমক্ষাংশ্চ গ্রাম্যে চৈবাতিরক্ততা–অর্থাৎ সেই মৃগয়া, পান, দ্যুতক্রীড়া এবং স্ত্রীলোক অত্যাসক্তি। কাজেই কলির মন ভরল না।
হয়তো আরও একটা ভাবনা ছিল কলির। সে ভাবল–যে-ঘটনা ঘটে গেল এবং পরীক্ষিৎ যেমন রাজশাসন জারি করলেন তাতে জুয়াখেলা মদ্যপান–এ-সব দুৰ্যসনে মেতে উঠতে লোকে ভয় পাবে। বরঞ্চ যেটা দরকার, সেটা হল–লোকের মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া, এবং এই সব অন্যায়ের জন্য রসদও চাই কিছু। অতএব কলি বায়না ধরলেন পরীক্ষিতের কাছে–শরণাগতের প্রতি এ আপনার কেমন কৃপণতা, প্রভু! এসব তো আমার আগেই ছিল। পরীক্ষিৎ বিগলিত হয়ে বললেন–ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে অর্থশক্তির জায়গাটাও দিলাম, তা না হলে লোকে দূতক্রীড়া, মদ্যপানাদি করবে কী করে! আর দিলাম–ব্যক্তির মনের মধ্যে প্রবেশের অধিকার–মিথ্যা, মদ্যপানজনিত মত্ততা, স্ত্রীসঙ্গ-এর অনুষঙ্গ কাম, অকারণ প্রাণীবধের উপযুক্ত গর্ব, হিংসা এবং একটা ফাউ–অকারণ শত্রুতা–তাতোনৃৈতং মদং কামং রজো বৈরঞ্চ পঞ্চমম।
প্রবলবেগে আগত কলির আসন্ন প্রয়াস খানিকটা স্তব্ধ করে পরীক্ষিৎ নাকি ধর্মের ভাঙা পা তিনটিও ঠিক করে দিয়েছিলেন এবং উপযুক্ত স্থিতাবস্থার আশ্বাস দিয়েছিলেন জননী বসুন্ধরাকেও–প্রতিসন্দধ আশ্বাস্য মহীঞ্চ সমবর্ধয়ৎ।
.
০২.
পৌরাণিক এই কাহিনিটুকু হয়তো না বললেও চলত। এমনও করা যেত–পণ্ডিত-সুজনদের প্রথামতো পুরাণের একটা রেফারেনস’ দিয়ে আমরা পরের প্রসঙ্গে যেতে পারতাম। কিন্তু এমনটি যে করলাম না, তার একটা বড়ো কারণ হল–এই রূপক-কাহিনির মধ্যে কলিযুগ ধারণার প্রধান উপাদানগুলি লুকিয়ে আছে। এই উপাদানের প্রধান হলেন মহারাজ পরীক্ষিৎ যাঁর সঙ্গে কলিযুগের পিঠোপিঠি পরম্পরা-সম্বন্ধ আছে। দ্বিতীয়ত, সেই-যে রাজবেশী কলিকে পরীক্ষিৎ বলেছিলেন-তোমাকে দেখতে রাজবেশী বটে, তবে নাটুকে নটেদের মতো রাজবেশে সেজেছ, নইলে তোমার কাজকর্ম অনেকটাই ব্রাহ্মণ্যবিরোধী ব্যক্তির মতো, বলা উচিত, শূদ্রদের মতো-নটবৎ কর্মর্ণ অদ্বিজঃ–এই কথাটার মধ্যেও একটা ইঙ্গিত আছে। অর্থাৎ পূর্বে যে একটা সংস্কার ছিল যে ক্ষত্রিয়-জাতির মানুষেরাই শুধু রাজকর্ম করবেন, তা নয়; মহারাজ পরীক্ষিতের সময়েই শূদ্র-জনজাতি রাজকর্মের মধ্যে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা রাজাও হচ্ছিলেন। পরীক্ষিৎ নিজেও কলিবধে উদযুক্ত হবার আগে ভগবতী পৃথিবীর উদ্দেশে বলেছিলেন–আহা! আজ এই পৃথিবীর কী অবস্থা হয়েছে। কৃষ্ণ যতদিন এই ধরাধামে ছিলেন ততদিন কোনো অমঙ্গল ঘটেনি, কিন্তু আজ তিনি লীলা-সংবরণ করার ফলে পৃথিবী আজ বিমনা হয়ে ভাবতে বসেছে। যে–হ্যায়! এরপর থেকে রাজার বেশধারী ব্রাহ্মণ্যাচারহীন শূদ্ররা এই পৃথিবী ভোগ করবে–অব্ৰহ্মণ্যা নৃপব্যাজাঃ শূদ্রা ভোক্ষ্যন্তি মামিতি।
এই কথা থেকে বোঝা যায়–ধরাধাম থেকে কৃষ্ণের চলে যাওয়াটা একটা যুগাবসানের ইঙ্গিত দেয় এবং শূদ্র-রাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাও ঐতিহাসিক দিক থেকে একটা অন্য যুগের উপস্থিতি, অথবা বলা উচিত–একটা ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা করে। তৃতীয়ত, পরীক্ষিৎ যে ধর্মের তিনটি পা আবার সুস্থিত করে দিলেন–এর মধ্যে একটা পৌরাণিক অতিশয়োক্তি আছে। যুগহ্রাসের ফলে মানুষের মধ্যে যে আচার এবং ক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটছিল–সেটাকে আধুনিকতার প্রসার বলব নাকি জানি না, তবে চিরন্তনী দৃষ্টিতে হয়তো পুরাতন আচার-বিচার, ক্রিয়া-কর্মের উচ্ছেদ ঘটছিল, পরীক্ষিৎ হয়তো রাজশক্তি প্রয়োগ করে সেই সনাতনী ভাবনা আবারও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। ধর্মের ত্রিপাদ-প্রতিসন্ধান হয়তো এই চেষ্টার সূচক।
চতুর্থত, অধর্মের চিরন্তন চারটি স্থান লাভ করার পরে পুনর্বার যাচমান কলিকে যে আরও পাঁচটি স্থান দিলেন পরীক্ষিৎ সেগুলিও মানুষের কোনো অর্বাচীন বৃত্তি নয় এবং প্রথম চারটি অর্ধস্থানের সঙ্গে সেগুলি অবিযুক্তও নয়। বরঞ্চ বলব–ওই পুনদত্ত বস্তুগুলির মধ্যে সবচেয়ে যেটা বিশিষ্ট, সেটা হল–সুবর্ণ, পুরাণ যাকে বলেছে জাতরূপ–পুনশ্চ যামানায়। জাতরূপমদাৎ প্রভুঃ। টীকাকারেরা অর্থ করেছেন–জাতরপং সুবর্ণাদিক–অর্থাৎ সোনা-রুপো ইত্যাদি। অধর্মের ইন্ধন হিসেবে অর্থ-সম্পত্তির জায়গাটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ–এই তথ্যটা যে এখানে খুব জরুরি, এটা বোঝানোর জন্য আমি খুব বিব্রত নই, কেন না ধর্মকার্যে, বিশেষত বৈদিক যজ্ঞাদিকর্মেও অর্থের ইন্ধন যথেষ্টই প্রয়োজন ছিল। কাজেই সেই দিক থেকে নয়, কলির সঙ্গে সুবর্ণ-রজতাদির যোগের ঘটনাটা আমাদের কাছে অতি-বিশিষ্ট এই কারণে যে, ঐতিহাসিকতার খাতিরেই বলতে পারি অতি-প্রাচীন কালে–যে-প্রাচীনত্বকে আমরা সত্য-ক্রেতা-দ্বাপরের সংজ্ঞায় চিহ্নিত করতে পারি–সেই কালে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার ব্যবহার চালু ছিল না, এমনকী সোনা-রুপো তখনও বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল না।
অর্থনৈতিক বিকাশ এবং উৎপাদনের প্রাচুর্য–এ-দুটি যদি নিয়মিত ব্যবসায়িক লেনদেন তথা অন্তঃরাষ্ট্রীয় পারস্পরিকতা তৈরি করে, মুদ্রার প্রচলন ত্বরান্বিত করে, তবে আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, ঋগবেদের আমলেও আমাদের দেশে যথাযথ মুদ্রামান তৈরি হয়নি। কৃষ্ণল’, শতমান অথবা ‘নিষ্ক’-এই ঋগবৈদিক শব্দগুলি যদিও মুদ্রানামের স্মরণ ঘটায়, কিন্তু ঐতিহাসিকেরা যেহেতু এক হাজার থেকে ছ-শো খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সোনা-রুপো-তামা কোনো ধাতুরই কোনো চিহ্নিত মুদ্রা খুঁজে পাননি, অতএব তারা মনে করেন যে, ভারতবর্ষে সভ্যতা তখনও এমন স্তরে পৌঁছয়নি যাতে করে তেমন কোনো উৎপাদন-প্রক্রিয়া এবং অর্থনৈতিক বিস্তার কল্পনা করা যায় এবং সেই কল্পনার সমগোত্রীয় মুদ্রা-বিনিময়ের কথা ভাবা যায়। আমরা যে চন্দ্র-সূর্য অথবা হাতি-ঘোড়ামার্কা ‘পাঞ্চ-মার্কড কয়েন’-এর সন্ধান পাই, সেগুলোও কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রশক্তির পরিচায়ক মুদ্রা নয়, সেগুলো নেহাতই বেসরকারি উদ্যোগে সৃষ্ট এবং আপন ব্যবসায়িক সুবিধার্থে তৈরি করা এলোমেলো ধাতবখণ্ড–কিন্তু সেগুলিও খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের নয় বলেই প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
তবে একটা প্রশ্ন এখানে থেকে যায়–চাক্ষুষভাবে কোনো মুদ্রার সন্ধান হয়তো এক হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে আমরা পাইনি; কিন্তু সাহিত্যের শব্দগুলোও তো একেবারে ভিত্তিহীন নয়। বিশেষত ‘নিষ্ক’শব্দটি, যা পরেও মুদ্রামান হিসেবে চিহ্নিত, অন্তত এই শব্দটির জন্যও আমাদের দু-বার ভেবে দেখার কারণ আছে। আরও একটা কথা। আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণেই জানি যে, খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার থেকে ছ-শো শতকের মধ্যেই কৌশাম্বী (এলাহাবাদের কাছে), কাশী অথবা মগধের মধ্যগাঙ্গেয় অঞ্চলে নগরায়ণ ঘটে গিয়েছিল। আর এটা তো সাধারণ কথা যে প্রান্তিক ভূমিক্ষেত্রওগুলিতে উদ্বৃত্ত কৃষিজ দ্রব্য না মিললে সার্থক নগরায়ণ ঘটে না এবং নগরায়ণ যদি ঘটে থাকে সেখানে গ্রাম এবং নগরে ব্যবসায়িক বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার ব্যবহারও খানিকটা কল্পনা করে নিতেই হয়।
আমরা মুদ্রা-ব্যবহারের উদ্ভব নিয়ে এত কথা বলছি এইজন্য যে, আমাদের বিশেষ ধারণা–মুদ্রা ব্যবহারের সঙ্গে কলিযুগের একটা বিশেষ যোগ আছে। পরীক্ষিৎ মহারাজ যে বিনম্র যাচমান কলিকে ‘জাতরূপ’ অর্থাৎ সুবৰ্ণ-রজতের স্থানাধিকারটুকু ছেড়ে দিলেন-পৌরাণিকের এই রূপক-ব্যবহারের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা এবং বিস্ময় একসঙ্গে কাজ করছে। ঘৃণা এইজন্য যে, জুয়া, মদ্যপান, অবাধ স্ত্রী-সঙ্গ অথবা খুব ‘অ্যাবস্ট্রাক্টলি’ ভাবলে কাম, মদ (গর্ব), রজোগুণের আধিক্য এবং অকারণ বৈরিতার মধ্যে মুদ্রামান-সম্পন্ন সহজ এবং গতিশীল অর্থ-ব্যবহারের একটা প্রক্রিয়া পৌরাণিকরা লক্ষ করেছেন এবং ব্যাপারগুলি সহজ হয়ে গেছে বলেই তা কলির নতুন অধিকারের মধ্যে এসেছে। আর বিস্ময় এইজন্য যে, গ্রাম্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতা থেকে নগরায়ণের রূপান্তর এবং নাগরিক সভ্যতার উদ্বৃত্ত অর্থের যথা-তথা অপব্যবহার, বিশেষত পুরাতন অধর্ম স্থানগুলির সহজ উপযোগ–যা মুদ্রা-বিনিময়ে সহজতর হয়ে উঠেছিল–এই ঘৃণামিশ্রিত চমৎকারই পৌরাণিককে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে যে, সব গেল, ভালর সময় শেষ, এখন কলিকাল এসে গেছে।
মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের পিতা-পিতামহরাও একই কথা বলতেন। বলতেন–ঘোর কলি। যে-ঘরে অসবর্ণ বিবাহ হয়েছে, সেখানে যেমন কলির প্রসঙ্গ আসত, তেমনই কাজের লোক মুখঝামটা দিয়ে যদি মনিবকে দুটো কথা শুনিয়ে কাজ ছেড়ে দিত, তাতেও কলির প্রসঙ্গ আসত। ছেলে যদি বাপের মুখের ওপর তর্ক করত, তাতে যেমন কলির উচ্চারণ শোনা যেত, তেমনই আমার বউদির বান্ধবী যেদিন ‘স্লিভলেস ব্লাউজ পরে আমার পিতাঠাকুরকে কাকু বলে নমস্কার করেছিলেন, সেদিন তিনি আপন স্নিগ্ধতাবশত স্পষ্ট করে কিছু না বললেও পরে তত্ত্বগতভাবে ‘কলির’ জায়গায় ‘কাল’ শব্দটি ব্যবহার করে বলেছিলেন–কালের গতি এমন তো হবেই, পরিবর্তন তো আরও হতে থাকবে যা ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠবে।
এই যে হা-হুতাশ, এই যে পরিবর্তনের স্রোতটাকে সহ্য করতে না পারা, প্রাচীনতা থেকে অর্বাচীন ব্যবহারের মধ্যে এই যে বিবর্তন–এরই মধ্যে আসলে কলিকালের খণ্ড-চরিত্রটুকু ধরা আছে। তবে হ্যাঁ, এটা শুধুই ‘জেনারেশন গ্যাপ’ বা শুধুমাত্র প্রাচীন ধারণার বিবর্তিত পরিবর্তন বলে পার পাওয়া যাবে না। কেননা প্রাচীন গ্রন্থাদির মধ্যে দেখা যাবে যে, আচার-ব্যবহার এবং পুরাতন ধারণার পরিবর্তনের মধ্যে কলিকালের আরোপ ঘটছে বহুকাল থেকে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, পৌরাণিকেরা যখন কলিধর্মের বর্ণনা করছেন–যা অনেকটাই সামাজিক আচার, বিচার এবং ব্যবহারের পরিবর্তন সূচনা করছে, তেমনই, একই সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্র পরিবর্তন, অর্থব্যবস্থার পরিবর্তন এবং এমনকী বিশ্বাস পরিবর্তনের কথাও নির্দিষ্ট করে বলছে। এ কথা মানতে হবে যে, পুরাণগুলি সব এককালে এবং একই দেশে রচিত হয়নি। এতে আরও বেশি সুবিধে হয় এইজন্যে যে, এক-একটি পুরাণে তার সমসাময়িক এবং দেশজ-ভাবনার পরিবর্তনের কথাও কলিধর্মের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছে। অতএব পৌরাণিকেরা যে প্রত্যেকে প্রায় প্রথাগতভাবে সক্ষোভে কলিযুগের অধঃপতন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন সেটার মধ্যে ধর্মের অবক্ষয় ব্যাপারটা যত প্রণিধানযোগ্য, তার চেয়ে বেশি সেটা সামাজিক, রাষ্ট্রীক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ঐতিহাসিক দলিল। এক কথায়, সেটা অতি প্রাচীন যুগের অবসানে মধ্যযুগীয় ইতিহাসের আরম্ভ সূচনা করে।
কলিধর্ম বর্ণনার সবচেয়ে প্রাচীন দলিলটি পাওয়া যাবে মহাভারতে। যদিও, তারও আগে, এই শব্দটার মধ্যে যে একটা নিন্দনীয় কদৰ্থ ছিল এবং সেই অর্থই যে পরবর্তী কালে পৌরাণিক কলি ধর্মে প্রসারিত হয়েছে, তার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। একটা বড় মাপের সময় হিসেবে যুগ কথাটা আমরা অন্তত ঋগবেদে পাইনি। তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতে বড় খারাপ সময় আসছে’–এই হা-হুতাশি কথাবার্তা, যেমনটি আমরা বুড়োরা বলে থাকি, সেই অর্থে যুগ কথাটা ব্যবহৃত হয়েছে ঋগবেদের যম-যমী সংবাদে। সভ্যতার প্রাগভাবনায় যম-যমী সংবাদে, যমী যে ইনসেসচুয়া অ্যাটেম্প্ট’ নিয়েছিলেন, যেখানে যম তাকে শান্ত করেও এমন আশঙ্কা করে বলেছিলেন যে, ভবিষতে বড় খারাপ সময় আসছে, যখন বোনেরা ঠিক আর বোনেদের ব্যবহারটুকু করবে না–আ ঘা তা গচ্ছানুত্তরা যুগানি যত্র যাময়ঃ কৃণবন্নজামি। ঋগবেদের যুগধারণা এইটুকুই। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর-কলির কথা তারা বলেননি। যুগ বলতে ওঁরা জানতেন–পুরাকাল, বর্তমান কাল আর ভবিষ্যৎ। লক্ষ-কোটি বৎসর ব্যাপী চতুর্যুগের ধারণা ঋবৈদিকের ছিল না। অথর্ববেদের মধ্যে অন্তত হাজার হাজার বছর ধরে একটি যুগের কল্পনা এসেছে বটে, এমনি চতুর্যুগের একটা অস্পষ্ট ধারণাও কাজ করছে আথবণিকের মনে–শতং তে সুতং হায়নান্ দ্বে যুগে শ্রীণি চত্বারি কৃণুমঃ–কিন্তু সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলির নামত কোনও স্পষ্ট ধারণা অথর্ববেদেও নেই। তবে হ্যাঁ, কৃত (মানে সত্যযুগ) এবং কলি শব্দটা অথর্ববেদে শোনা যাচ্ছে, তবে এই দুটি শব্দই পাশার দান হিসেবে ব্যবহৃত হত। কৃত’-শব্দটা ঋগবেদেই ছিল এবং পাশাখেলায় সেটা সবচেয়ে ভাল দান হিসেবে গণ্য হত; অথর্ববেদে তার সঙ্গে কলি-শব্দও এসেছে এবং সেটা পাশাখেলার সবচেয়ে খারাপ দান।
পাশাখেলায় কলি-দান ভাল না খারাপ, তা নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে সামান্য মতভেদ আছে। যদি বা তা ভাল দানও হয় তবুও তা ঘৃণ্য জুয়াখেলার সঙ্গে যুক্ত এবং সেই অর্থে কলির মধ্যে খারাপের যন্ত্রণাটুকু রয়েই গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে, একটি অতিব্যাপ্ত যুগ হিসেবে শুধু কলি কেন, সত্য (কৃত), ত্রেতা, দ্বাপর কোনওটাই কিন্তু কাল হিসেবে সদর্থক হয়ে ওঠেনি ঋগবেদ থেকে অথর্ববেদের কাল পর্যন্ত। এমনকী বেদের অব্যবহিত তথা পরবর্তী ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি–যেগুলি তত্ত্বগতভাবে বেদই অথবা বেদের সমগোত্রীয়, সেখানেও কিন্তু একটা কালসমষ্টি হিসেবে কৃত, ত্রে তা, দ্বাপর বা কলির উল্লেখ নেই। কিন্তু অতি প্রাচীন ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আমরা অসাধারণ একটা মন্ত্র শুনতে পাচ্ছি, যেখানে চতুর্যুগের নামগুলি তো আছেই, অপিচ সেই শ্লোকের মধ্যে এই ধারণাটুকু প্রথম পাওয়া যায় যে, যথাক্রমে কৃত, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি–এই চতুর্যুগের মধ্যে পর পর এক ক্রমিক অবক্ষয়ের ব্যঞ্জনা আছে। ঐতরেয় শ্লোকের ভাষা থেকে এটা যদিও স্পষ্ট নয় যে, চতুর্যুগের নাম উল্লেখ আদৌ কোনও কাল সমষ্টি বোঝাচ্ছে অথবা বোঝাচ্ছে না, কিন্তু কলি থেকে কৃত (সত্য) পর্যন্ত ক্রমিক গুণগত উত্তরণ অথবা উলটো দিক থেকে ধরলে যে ক্রমিক অবক্ষয়ের সূচনা ঘটছে, তাতে মনে হয় সত্য থেকে কলির মধ্যে আমরা যে যুগক্ষয়ের ভাবনাটুকু পরবর্তীকালে ভেবেছি, তার একটা অস্পষ্ট উচ্চারণ এই ঐতরেয় শ্লোকের মধ্যে আছে।
ঐতরেয়-এর গাথা শ্লোক বলছে–যে কেবলই উদ্যোগহীনভাবে শুয়ে আছে, সেটাই কলি, যে শয্যালস্য ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করছে, সে হল দ্বাপর, যে সত্যিই উঠে দাঁড়াল, সে হল ত্রেতা, আর উঠে দাঁড়িয়ে যে নিরলসভাবে চলছে সে হচ্ছে কৃত-উত্তিষ্ঠংস্ত্ৰেতা ভবতি কৃতং সম্পদ্যতে চর। সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এর থেকে চরম বোধদায়ক কোনও শ্লোক যে সেই প্রাচীনকালে উচ্চারিত হয়নি, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। সমৃদ্ধি এবং উন্নতির জন্য যে বিরামহীন উদ্যোগ লাগে কৃতযুগ তারই প্রতীক আর কলি হল অলস অবসাদগ্রস্ত এক চিরন্তনী মায়ানিদ্রা যা অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এই গাথা-শ্লোকের মধ্যে অন্যতর যদি কোনও গুঢ়ার্থ থাকে, তবে তা পরে বিচার করব, এখন এইটুকু দিয়েই শুরু করতে চাই যে, কলি এখানে স্পষ্টত যুগ বা কালসমষ্টি হিসেবে নির্ধারিত নয় বটে, এমনকী পরবর্তীকালের মহাভারত এবং কিছু পুরাণও ঐতরেয় ব্রাহ্মণের নির্দিষ্ট বিশেষার্থে কৃত-ক্রেতা-কলির ব্যবহার করেছে, কিন্তু সে একেবারেই বিশেষ অর্থ। বরঞ্চ বলা উচিত–কলি শব্দটার মধ্যে যে অবক্ষয় এবং অন্যায়ের সূচনা ঐতরেয় ব্রাহ্মণের মধ্যেও সূত্রিত থেকে গেছে, সেই অবক্ষয়ের চেতনাটাই বেশি করে পৌরাণিকদের মনে কাজ করেছে–আমরা যদিও সেই অবক্ষয়ের মধ্যেই সভ্যতার গতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েছি, সে পরিবর্তন ভালো না মন্দ–সেটা অন্যতর বিচার, কিন্তু সেটা প্রাচীন থেকে মধ্য অথবা মধ্য থেকে আধুনিক যুগের আরম্ভ সূচনা করে।
.
০৩.
মহাভারত এবং পুরাণগুলি কলিকালে যেসব অন্যায়-অধর্ম ঘটবে বলে বলেছেন, তার একটা বিবরণ নিবদ্ধ করার সঙ্গে-সঙ্গে আমি আধুনিক ঐতিহাসিকদের সমাজ-চেতনার অংশটুকুও এখানে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। কলিকালের বৈশিষ্ট্য দেখাবার সময় মহাভারত এবং পুরাণগুলি যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, তার মধ্যে বেশ কিছু তথ্য আছে, যেগুলি তৎকালীন বিশ্বাসের কথা। ভাবটা এই যেন–ভীষণ অন্যায় এবং অধর্মময় কলিকালে কতকগুলি অদ্ভুত জিনিস ঘটবে। সমস্ত পুরাণ, এমনকী মহাভারতেও এগুলি এক ধরনের স্ট’ ভবিষ্যদ্বাণী–যেমন কলিকাল উপস্থিত হলে গোরুগুলির দুধ কমে যাবে, অর্থাৎ পেলে-পুষে গোরু বড়ো করলাম, কিন্তু সে দুধ দেবে কম–অল্পক্ষীরাস্তথা গাবো ভবিষ্যন্তি কলৌ যুগে। এটা মহাভারতের শ্লোক, কিন্তু এই বিশ্বাসের কথাটাই বিষ্ণুপুরাণ ঘুরিয়ে বলেছে–কলিকালে ধানগুলো সব আকারে ছোটো হয়ে আসবে, আর গোরু দুধ দেবে ছাগীর মতো–অনুপ্রায়ণি ধান্যানি, অজাপ্রায়ং তথা পয়ঃ। কথাটা প্রায় একই শব্দে ভাগবত পুরাণও বলেছে–ছোট্ট ছোট্ট ধান আর ছাগীর মতো গোরুর দুধ দেওয়া। আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজে এই দুর্ভাবনা নিছকই ধর্মের আতঙ্কজাত। এই বিশ্বাসের কথাটুকু ব্যাখ্যা করা কঠিন, তবে আতঙ্কটুকু বোঝা যায়। পশুপালনধর্মী আর্যরা তথাকথিত অনার্যদের কাছ থেকে কৃষিকর্ম শিখে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এখানে সেই আতঙ্কটুকুই প্রকাশ পেয়েছে যখন কৃষিকর্ম বা গো-প্রজননকর্মের দুষ্প্রয়োগে ধান ছোটো হয়েছে অথবা গোরুর দুধ কমেছে।
এমনিতর আতঙ্কের মধ্যে যা কিছু প্রাচীনেরা চোখে ভয় পেয়েছেন, প্রকৃতির যে-কোনও বিপর্যয় তাদের বিপর্যস্ত করেছে, সেগুলি সব তারা চাপিয়ে দিয়েছেন কলিকালের মাথায়। যেমন ধরুন, কলিকালের আকাশে মেঘ ডাকবে প্রচুর কিন্তু তাতে বৃষ্টির জল থাকবে কম, বিদ্যুৎ চমকাবে বেশি, প্রচুর কষ্ট করে বহু বীজ পুঁতে চাষ করা হলেও শস্য হবে কম। বছরের পর বছর অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, ছয় ঋতুর নানান বিপরিবর্তন, ফল-ফুলের অভাব, পত্র-পুষ্পহীন শুষ্ক-রুক্ষ বৃক্ষসম্পদ, খাদ্যশস্যের অভাব, অতিরিক্ত রোগব্যাধি–এগুলি সবই সেই আরোপিত আতঙ্কজ কলিধর্ম, যা প্রাচীন পুরুষেরা দেখেছেন বা যেসব বিপর্যয় থেকে তারা কষ্ট পেয়েছেন। আসলে এসব একেবারে সাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী, কিন্তু এই সামান্য বর্ণনার মধ্যেই একটি বিশেষ প্রাচীন পুরাণ যখন বলবে-কলিকালের দুর্ভিক্ষ, রাজকর আর ব্যাধি-পীড়ায় জর্জরিত হয়ে মানুষ সেই সব দেশে গিয়ে বাস করতে থাকবে, যেখানে খাবার-দাবার অধম প্রকৃতির এবং সেখানকার মানুষেরা গবেধুক’ ধানের চাল খায়–গবেধুক-কদন্নাদ্যান দেশান্ যাস্যন্তি দুঃখিতাঃ-তখন বুঝতে হবে–আর্যরা উত্তর-ভারতের ব্রহ্মাবর্তের গণ্ডি ছেড়ে এইসময়ে দক্ষিণ-ভারতে ঢুকে পড়েছেন, যেখানে খাদ্যচালের গুণমান ভালো নয়। অর্থাৎ বাংলায় যাকে গড়গড়া দে-ধান বলে সেই জাতীয় বড়ো-বড়ো গড়গড়া চালের ভাত হয় সেখানে। এই ভাত তারা খেতে পছন্দ করেননি বলেই কলিকালের কপালে সেই ভাত জুটেছে।
সাধারণ এইসব প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক পরিবর্তন ছাড়াও আর একটা কথা খুব শোনা যাবে এবং সেটা হল–মানুষ সত্যযুগে অনেক লম্বা ছিল, কলিকালে সব বেঁটে হয়ে যাবে। লম্বা হওয়া অথবা বেঁটে হয়ে যাওয়াটা কালের গতির ওপর কতটা নির্ভর করে, এটা তত্ত্বগতভাবে প্রমাণ করা খুব কঠিন, কিন্তু এটা যে ভয়ংকর একটা বিশ্বাস, সেটা খুব ভালো করে পাওয়া যাবে দুটি ঘটনার মধ্যে। প্রথম ঘটনা–কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের বিবাহে। বলরাম-পত্নী রেবতীর পিতা রৈবত ককুষ্মী পূর্বকালে, মেয়ের উপযুক্ত পাত্র খোঁজার জন্য ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার পরামর্শ নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে গন্ধর্বরা গান গাইছিল। গানের সুরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো রৈবত ককুন্নীর চতুর্যগ কেটে গেল। পৃথিবীতে নেমে এসে তিনি দেখলেন–মানুষগুলো সব কেমন বেঁটে হয়ে গেছে, তাদের তেজ-বীর্য-শক্তি আর আগের মতো নেই–দদর্শ হ্রস্বান্ পুরুষান্ অশেষা/অল্পৌজসঃ স্বল্পবিবেকবীর্যান্। ঠিক একইরকম কথা আছে মুচুকুন্দ রাজার মুখে। তিনি ত্রেতাযুগ থেকে ঘুমিয়ে উঠে নিজের নেত্রবহ্নিতে কালযবনকে সংহার করার পর দেখলেন–বেঁটেখাটো মানুষে পৃথিবী পূর্ণ হয়ে গেছে, আগের মতো আর কিছু নেই।
‘কালযবন’ কথাটা শুনেই তো সাহেব-গবেষকরা এর মধ্যে বহুতর কূটতত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছেন। হিটেবেইটল নামে এক প্রসিদ্ধ গবেষক তো বলে দিয়েছেন–কৃষ্ণের সঙ্গে কালবনের সংগ্রাম আসলে ‘a confrontation of cosmologies.’
আমরা এতবড় কথা বলি না। আমরা বুঝি–সভ্যতার মধ্যে একটা দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল। কৃষি, কর্মান্ত, বাণিজ্য এবং রাষ্ট্র–সর্বত্র এমন একটা পরিবর্তন আছড়ে পড়েছিল সেই পূর্বকালে যাতে স্থবির-বৃদ্ধ রৈবত ককুষ্মী অথবা ত্রেতা-যুগ থেকে ঘুমিয়ে থাকা মুচুকুন্দ হঠাৎ এই তরুণী পৃথিবীকে দেখে আমাদের বৃদ্ধকুলের মতো বলে ফেলেছিলেন–কোনো কিছু আর আগের মতো নেই–সেই উৎসাহ, সেই শক্তি, যা আমাদের কালে ছিল, সে-সব এখন কোথায়! একই কথা মহাভারতের কলিধর্ম-বর্ণনাতেও–মানুষের আয়ু অল্প, শক্তি অল্প, শরীর হ্রস্ব এবং তাদের উৎসাহ-উদ্যোগ-প্রাণশক্তিও অল্প–অল্পসার অল্পদেহাশ্চ…স্বল্পবীর্যপরাক্রমা। আসলে এ হল সেই স্থবির বৃদ্ধ পুরাকাল-পুরুষ, যে সব সময় বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পুরুষের শক্তি, প্রাণ এবং প্রেমে সন্দেহ করেছে–
পিছনের পটভূমিকায় সময়ের
শেষনাগ ছিল, নেই;-বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা
নিভে যায়; মানুষ অপরিজ্ঞাত সে অমায়; তবুও তাদের একজন
গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়।
আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু, অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কেনা জেনে কোথায় চলেছি! মহাভারতের ক্রান্তদর্শী কবি বরং যে-কথাটা জননী সত্যবতাঁকে বলেছিলেন–সুখের সময় চলে গেছে, মা–অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ–সামনে বড়ো খারাপ সময় আসছে। পৃথিবী তার যৌবন হারিয়েছে আমাদের কাছে–শঃ শ্বঃ পাপিষ্ঠদিবসাঃ…পৃথিবী গতযৌবনা–আমাদের ধারণা–স্থবিরজনের কাছে এই পাপিষ্ঠ ভবিষ্যৎ-ভাবনাই কলিকালের মানুষের ওপর বর্তেছে–তার প্রাণশক্তি কম, আয়ু কম, শক্তি কম–এত সব অভিশাপ।
এই সাধারণ দুর্ভাবনাগুলি বাদ দিয়ে আর যত আরোপ এবং অধ্যাক্ষেপ আছে কলিকালের ওপর, তাতে পরিষ্কার বোঝা যাবে যে, ইতিহাসের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক এমনকী বৈশিক পরিবর্তনও ঘটছে–প্রাচীনযুগের অবসানে এবং প্রাচীনের তুলনায় ইতিহাস নতুন যুগে প্রবেশ করছে। নতুন যুগ অথবা মধ্যযুগ কথাটা খুব অস্পষ্ট। আরও স্পষ্ট করতে হলে আগে জানা দরকার, এই নতুন যুগটা অর্থাৎ কলিযুগটা পড়ছে কখন? সেটা স্পষ্ট হলে রাষ্ট্রীয় তথা রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের সময়টাও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আমরা প্রথমে যে-উপাখ্যান দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পাণ্ডব-পিতামহদের নাতি পরীক্ষিৎ যখন সিংহাসনে বসেছেন, তখনই কলির প্রবেশ ঘটছে। কিন্তু এ-বিষয়েও পৌরাণিক পণ্ডিতদের মতভেদ আছে। পণ্ডিতদের একাংশ পৌরাণিকদের মত মেনে বলেছেন–ভগবান কৃষ্ণ যেদিন ধরাধাম ছেড়ে চলে গেলেন, ঠিক সেইদিন থেকেই কলিযুগের আরম্ভ–যস্মিন্ কৃষ্ণো দিবং যাত স্তস্মিন্নেব তদাহনি। প্রতিপন্নং কলিযুগং। অন্য পণ্ডিতেরা আবার বলেছেন যে, মহাভারতের সেই ভয়ংকর যুদ্ধ থেকেই কলিযুগেরই প্রবৃত্তি ঘটেছে, কারণ ওই যুদ্ধটাই হয়েছিল কলি আর দ্বাপরের সন্ধিলগ্নে–অন্তরে চৈব সংপ্রাপ্তে কলিদ্বাপরয়োরভূৎ। সমস্ত পঞ্চকে যুদ্ধং….। যুগপুরাণ মন্তব্য করেছে–মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদী যেদিন শরীর এলিয়ে নুয়ে পড়লেন মরণের কোলে, সেদিন থেকে কলিযুগের শুরু। এই সব তথ্যের ওপরে আছে আর্যভট্ট এবং বরাহমিহিরের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বদের অঙ্ক-গণনা।
আমরা যা বুঝি–একেবারে সঠিক করে কলিযুগের আরম্ভকাল নির্ণয় করা খুব কঠিন। কারও মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০১২ শতকে কলিযুগ আরম্ভ, কারও মতে খ্রিস্টজন্মের ২৫০০ বছর আগে এবং কারও মতে খ্রিস্টপূর্ব উনিশ শতকে কলিযুগের আরম্ভ। ঐতিহাসিকেরা বেশিরভাগই বিভিন্ন পুরাণের সেই ঐতিহাসিক উক্তি মেনে নিয়েছেন। অর্থাৎ পাণ্ডব-বংশধর পরীক্ষিৎ এবং খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের মহাপদ্ম নন্দ–এই দুই জনের সময়ের ফারাক হল ১৫০০ বছর–জ্ঞেয়ং পঞ্চশতোত্তর। তার মানে যে-কোনো একটা বৃহৎ বিপর্যয়ই যদি কলির আরম্ভ সূচনা করে থাকে–সে মহাভারতের যুদ্ধই হোক, কৃষ্ণের লীলা-সংবরণ-কালই হোক অথবা দ্রৌপদীর পতন–তা কোনোভাবেই খ্রিস্টপূর্ব উনিশ শতকের খুব আগে যাবে না, বড় জোর খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর। সময়টা এইভাবে যদি মোটামুটি স্থির করে নেওয়া যায় এবং তারপরে মহাভারত এবং পুরাণগুলির সময়কালে ভেবে নিয়ে সেখানে বলা কলিধর্মের বিচার করা যায়, তাহলে পরিষ্কার বোঝা যাবে যে আমরা ইতিহাসের দৃষ্টিতে যে-সময়টাকে প্রাচীন যুগ বলছি, পুরাণগুলি সেই যুগারম্ভের ওপরেই কলিধর্ম চাপিয়ে দিয়েছেন।
প্রথমেই যদি রাষ্ট্র এবং রাজা-রাজড়ার কথায় আসি, তাহলে মহাভারতের কথাই আগে বলতে হয়। মহাভারত বলছে–কলিযুগে বহু জায়গাতেই ম্লেচ্ছদের রাজা হতে দেখা যাবে–বহবো ম্লেচ্ছরাজানঃ পৃথিব্যাং মনুজাধিপ। মহাভারতকার এই ম্লেচ্ছ রাজাদের জাতিনাম কীর্তন করেছেন–এঁরা নাকি আন্ধ্র, শক, পুলিন্দ, যবন, কাম্বোজ, বাহিক, শূর এবং আভীর। লক্ষণীয় বিষয় হল–মহাভারত কলিযুগের রাজা হিসেবে যে জাতিনামগুলি করেছেন, এইসব জনজাতি বা গোষ্ঠী মহাভারতের আমলেই ছিল, বড়োজোর বলা যেতে পারে, আর্য ভূখণ্ডের হৃদয়ভূমি ব্ৰহ্মবর্ত থেকে হস্তিনাপুর পর্যন্তযার ভৌগোলিক অবস্থান, সেখানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-বিপর্যয়ের পর পরীক্ষিৎ রাজা হয়েও পুরাতন প্রসিদ্ধ রাজবংশের প্রভাব তেমন বিস্তার করতে পারেননি। ফলে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত দেশগুলিতে–সেটা দক্ষিণ-দেশেই হোক অথবা পশ্চিমে, অথবা সুদূর উত্তর-পশ্চিমে–যেসব জনগোষ্ঠী ছিল তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ছিল।
আন্ধ্রজন-জাতির কথাই ধরা যাক। এরা মহাভারতে নতুন কোনো জনগোষ্ঠী নয় যে কলিযুগে আলাদা করে তাদের জন্মাতে হবে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, যা নাকি খোদ বেদগ্রন্থের অব্যবহিত পরে লেখা এবং মহাভারতের চাইতে যা নাকি অনেক আগে লেখা, সেখানে পর্যন্ত দস্যুভাবে আহ্বাদের উল্লেখ আছে। মহাভারত অন্যত্র এই জনজাতিকে দক্ষিণদেশের অসভ্য অনাচারী বর্বর জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখ করেছে এবং ওই আহ্বাদের সগোত্রীয় দক্ষিণদেশী অন্য জনজাতিরা হল–পুলিন্দ, শবর, গুহ, চুচুক, মদ্রক। তথাকথিত আর্যভূমির বাইরে বিন্ধ্যপর্বতের আশপাশে পুলিন্দদের বাস ছিল। মধ্যম পাণ্ডব ভীম পুলিন্দদের দিগবিজয়ের সময় হারিয়ে দিলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত বসতিস্থান পুলিন্দনগরের খবর পাচ্ছি আমরা। সবচেয়ে বড়ো কথা–সেই ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পুলিন্দ জনজাতিরও উল্লেখ পাচ্ছি এবং তারা মহাভারতের যুদ্ধে দুর্যোধনের সৈন্যবাহিনীতে স্থানও করে নিয়েছিল, ঠিক যেমন আন্ধ্র-জনজাতিও ছিল দুর্যোধনের অনুকূলেই। অতএব এরা আর নতুন করে কলিযুগের উপদ্রব হবে কী করে?
এরা ছাড়াও কলিযুগের রাজাদের মধ্যে যেসব যবন, শক, বাহিক, কাম্বোজদের উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অনেকেরই বসতি ছিল বর্তমান ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। এখনকার আফগানিস্তান,ইরান-পাকিস্তানের সীমান্তদেশ, উত্তর-পশ্চিমের পাঞ্জাব অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়া এবং গ্রিস-এর নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে আসা শক-হূন-যবনদের প্রতিপত্তির কথাও কিছু কম নেই মহাভারতে। এই উপজাতীয় গোষ্ঠীর নায়কেরা অনেকেই মহাভারতের বিরাট যুদ্ধের সময় কৌরব-পক্ষে দুর্যোধনের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। মার্সেনারি’ সৈন্য বলতে যা বোঝায়–তেমনটা এইসব উপজাতীয় গোষ্ঠীর কাছে খুব সহজলভ্য ছিল। মহাভারতের প্রধান পুরুষদের শাসন-অধিকার চলবার সময় তাদের দাপটে ভারতবর্ষের প্রত্যন্তদেশীয় উপজাতিগুলি স্বাভাবিক কারণেই প্রশমিত এবং দমিত ছিল। কিন্তু পরীক্ষিৎ এবং তার ছেলে জনমেজয়ের স্বর্গারোহণের পর সরস্বতী-নদীর তীর থেকে গঙ্গাতীরবর্তী যে-ভূমিখণ্ড প্রসিদ্ধ কৌরব-পাণ্ডবদের অধিকারে ছিল, তার একতা নষ্ট হয়ে যায়। উত্তরাপথ এবং দক্ষিণাপথের ছোট্ট-ছোট্ট সামন্ত রাজারা–যাঁদের অনেক সময়েই অনার্য-সংস্কৃতির প্রতিভূ মনে করা হয়, তাদের পরস্পর-বিশ্লিষ্ট উত্থান ঘটতে থাকে দ্রুতগতিতে।
আমরা জানি–বিম্বিসার অশোকের দেশে রাজনৈতিক একতার একটা সূত্র তৈরি হয়েছিল অবশ্যই–যা পরে সুপ্রসিদ্ধ নন্দ রাজাদের আমলে এবং বিশেষত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে অনেকটাই দৃঢ় হয়ে ওঠে, যদিও সেই একতা গড়ে উঠেছিল প্রধানত পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ম্যাসিডনের রাজপুত্র আলেকজান্ডারের সময়ে উত্তর-ভারতে আমরা যে-রাজনৈতিক খণ্ডতা দেখেছি, এই খণ্ড রাজনীতি চলছিল বহুদিন ধরে এবং দক্ষিণাপথে আন্ধ তথা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর যে প্রতাপ-প্রভাব বেড়েছিল, তাও ইতিহাসের প্রমাণেই স্বীকৃত। মহাভারতে কলিধর্ম-বর্ণনায়। ম্লেচ্ছরাজা বলে যাঁদের উল্লেখ হয়েছে, সেগুলি হয়তো চিরন্তন-ঘৃণালুষিত জাতিনাম, কিন্তু তারা যে উত্তর এবং দক্ষিণ দুই জায়গাতেই প্রত্যন্ত প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন সে-কথা মহাভারতেই অন্যত্র আছে। শক্তিশালী এবং প্রসিদ্ধ রাজাদের আমলে প্রত্যন্তদেশীয় এইসব জনগোষ্ঠী যে দমিত এবং প্রশমিত ছিল সে-কথা বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে লেখা হয়েছে সর্বভূতোৎপত্তি’-কথনের প্রসঙ্গে।
যে-কোনো ক্ষুদ্র রাজশক্তিও একদিনে বেড়ে ওঠে না, সেটাই স্বাভাবিক এবং সে-কথা মাথায় রেখেই মহাভারত বলেছে–ত্রেতাযুগ থেকেই এইসব প্রত্যন্ত ম্লেচ্ছরাজারা শক্তিসঞ্চয় করছিল–ত্রেতা প্রভৃতি বর্ধন্তে তে জনা ভরতভ। ‘তে জনা’ মানে সেইসব রাজারা। তারা কারা? তার মধ্যে দক্ষিণাপথজন্মা আৰ্দ্ধক, গুহ, পুলিন্দ, শবর, চুচুক এবং মদ্রকেরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন উত্তরপথের অনাৰ্যনামাঙ্কিত জনগোষ্ঠী–যৌন-কম্বোজ-গান্ধারাঃ কিরাতা বর্বরৈঃ সহ। লক্ষণীয়, যে-গান্ধারে ধৃতরাষ্ট্র-মহিষী গান্ধারী জন্মেছিলেন, সেই গান্ধারও স্লেচ্ছ-বর্বরদের সঙ্গে একত্রে কীর্তিত হয়েছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরির প্রাচীন ইতিহাসচর্চার প্রমাণে বলা যায় যে, ৭৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত গান্ধারে যে ভাব-ভাবনা কাজ করেছে, তা ব্রাহ্মণ্য-ভাবধারার বিরোধী ছিল এবং ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি পুকুসাতি নামে যে রাজা ছিলেন, তার সঙ্গে মাগধ নৃপতি বিম্বিসারের চিঠি চালাচালি হয়েছিল বটে একবার, কিন্তু তিনি অবন্তীরাজ্যের রাজা প্রদ্যোতকে হারিয়ে দিয়েছিলেন।
তৎকালীন গান্ধার রাজ্যের মধ্যে আমাদের কাশ্মীর উপত্যকা অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তার মধ্যে তক্ষশিলা নগরীও ছিল অন্যতম জনপদ। কাম্বোজ ছিল একেবারেই লাগোয়া জনপদ। পাণ্ডব-বংশধর পরীক্ষিৎ জনমেজয়, তক্ষশিলা-আসন্দীবতী নগরীতের ভদ্রাসন স্থাপন করেছিলেন–মহাভারতে তার প্রমাণ আছে এবং ওই যে পুকুসাতির কথা বললাম, তিনি বিম্বিসারের সমসাময়িক হলেও ‘পাণ্ডব’ নামে কোনো পাণ্ডব-ধুরন্ধর তখনও পাঞ্জাব-কাশ্মীর অঞ্চলে শক্তিমান ছিলেন এবং পুকুসাতি সেই পাণ্ডবের কাছে সে নিজের রাজ্যেই পরাভূত হয়েছিলেন–সে কথা বলেছেন টলেমি। হয়তো তখনও রাজা জনমেজয়ের বংশবীজ কিছু ছিল পাঞ্জাব-কাশ্মীরের ভূখণ্ডে, কিন্তু সে-সবকিছুই নষ্ট হয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষেই পারস্য নৃপতি দারায়ুসের উত্থান ঘটে গান্ধারে এবং তার বহিস্তান শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তার আগেও গান্ধার ভারতবর্ষীয় আর্যগোষ্ঠীর অধিকার অতিক্রম করেছিল।
গান্ধারের কথা এইজন্য বেশি করে বললাম যাতে ইতিহাসের প্রমাণটা বোঝা যায়। যাতে বোঝা যায়–মহাভারতে কলিকালের নৃপতি বলতে যাঁদের বোঝানো হয়েছে, তাঁরা কেউ ইতিহাস-বহির্ভূত নন। উত্তরাপথ এবং দক্ষিণাপথের আর্যগোষ্ঠীর বহির্ভূত উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলির নাম করে মহাভারত বলেছে–এই সমস্ত পাপী লোকেরাই–সত্যযুগে যাদের চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না–তারাই কলিযুগে চরে বেড়াবে পৃথিবীর সব জায়গায়–এতে পাপকৃতস্তাত চরন্তি পৃথিবীমিমা। লক্ষণীয় ব্যাপার হল-মহাভারতের কবি শাসকদলের কথায় আন্ধ্র-পুলিন্দ, গান্ধার-কাম্বোজীয়দের শাসক হিসেবে উত্থানের কথা বললেও শূদ্রদের রাজকীয় শাসন এবং প্রতিপত্তির কথা তেমন করে বলেননি। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র–এই বর্ণ-ব্যবস্থায় একটা প্রতিকূল বিপরিবর্তনের কথা মহাভারতের কলিধর্মে বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু শূদ্ররা রাজ্যশাসন করছেন, এ-কথা স্পষ্ট করে বলছে না মহাভারত।
ভাষায় এই ভাব-ভঙ্গি থেকে বুঝি–মহাভারতের অন্তর্গত কলিধর্ম যখন লেখা হয়েছে, এখনও হয়তো ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলে কোনো শূদ্র রাজাদের রাজত্ব শুরু হয়নি, তখনও হয়তো বিভিন্ন ক্ষত্রিয় রাজবংশের তেমন অবলুপ্তি ঘটেনি, শুধু ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত প্রদেশে তথাকথিত অনার্য জনজাতির প্রভাব বাড়ছিল। কিন্তু মহাভারতের এই জায়গা থেকে বায়ুপুরাণের কালিক অবস্থানে নেমে আসুন, দেখবেন অসাধারণ একটি ঐতিহাসিক সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বলা হচ্ছে–কলিকালে শূদ্ররাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজা হবে–রাজানঃ শূদ্রভূয়িষ্ঠাঃ পাষণ্ডানাং প্রবর্তকাঃ অর্থাৎ কলিকালে শূদ্র রাজাদের রমরমা বাড়বে, তাই শুধু নয়, তারা পাষণ্ড-মতের সমর্থক হবেন।
ঐতিহ্যধারী ব্রাহ্মণতন্ত্র, বৌদ্ধ-জৈনদের ধর্মমতকে চিরকাল পাষণ্ডদের মত বলে চিহ্নিত করেছে। বহু জায়গায় বৌদ্ধদের কথা বলতে গিয়ে পাষণ্ড’ অথবা ‘পাষণ্ডী’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে এবং দর্শনগ্রন্থে। পৌরাণিক তথা ঐতিহাসিকদের সমস্ত প্রমাণ একত্র করলে দেখা যাবে যে, নৃপতি বিম্বিসার যদিও শৈশুনাগ বংশের অন্যতম প্রসিদ্ধ রাজা, তবুও তিনি যে ক্ষত্রিয় ছিলেন, তা মনে হয় না। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি পিতা কর্তৃক যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়েছিলেন কিন্তু তার নিজস্ব উপাধির প্রসঙ্গে তাঁর জাতি প্রমাণ হয়। তিনি নিজেকে শ্রেণিক (বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশে ‘সেনীয়’ = শ্রেণিক) বলে পরিচয় দিয়েছেন বলে আমাদের ধারণা, তিনি বৈশ্যজাতীয় ছিলেন। অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের রাজপরম্পরা সেই আমলেই লুপ্ত হয়ে গেছে। তাতেও বোধহয় কিছু আসত-যেত না, কিন্তু তিনি নিজে বুদ্ধের সময়ে জীবিত ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মের পরিপোষক ছিলেন বলেই পৌরাণিকেরা যেমন বিম্বিসারকে কলিযুগীয় নৃপতিদের মধ্যে চিহ্নিত করেছেন, তেমনই বিম্বিসার থেকে আরম্ভ করে পরবর্তীকালে মহারাজ অশোকও বৌদ্ধধর্মের প্রতি রাজপোষণ অবাধে উন্মুক্ত করায় পুরাণ সামগ্রিকভাবে বলেছে, কলিকালের রাজারা পাষণ্ডমতের (বৌদ্ধমতের) প্রবর্তক হবেন–পাষণ্ডানাং প্রবর্তকাঃ।
বিম্বিসারের পর শৈশুনাগ বংশের শাসন আরও কিছুদিন চলেছিল বটে, কিন্তু সে-বংশ মহাপদ্ম নন্দের আমলে উচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পৌরাণিকেরা শৈশুনাগ বংশের রাজাদের ক্ষত্ৰবন্ধু’ বলেছেন। ক্ষত্রবন্ধু মানে ক্ষত্রিয়ের জাতটুকু আছে, আচার নেই। এদেরই শেষ বংশধরের শূদ্রা স্ত্রী যিনি ছিলেন, গ্রিক ঐতিহাসিক কার্টিয়াস বলেছেন–সেই রানির সঙ্গে প্রণয় হয় এক নাপিতের এবং সেই নাপিতের ঔরসে রানির গর্ভে জন্মান মহাপদ্ম নন্দ। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ধারক-বাহক পুরাণগুলি মহাপদ্ম নন্দের মতো শূদ্র নাপিতের উত্থানে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং তার ফলে সমস্ত কলিকালের হলাহল নিক্ষেপ করেছেন নন্দ-রাজার ওপরে। তারা বলেছেন–শূদ্রার গর্ভজাত মহাপদ্ম এর পরে রাজা হবেন এবং তিনি সমস্ত ক্ষত্রিয়বংশ উচ্ছেদ করে দেবেন ক্ষান্তক পরশুরামের মতো। তিনি অতি লোভী রাজা-শূদ্ৰাগর্ভোদ্ভবো’ তিলুক্কো মহাপদ্মনন্দঃ পরশুরাম ইবাপরো’ খিল-ক্ষত্রিয়ান্তকারী ভবিতা।
এই যে নন্দরাজবংশ শুরু হল, এই সময় থেকেই শূদ্ররা সব রাজা হবেন, যতদিন না ব্রাহ্মণ কৌটিল্য এসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে সিংহাসনে বসাচ্ছেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যও যে খুব একজন ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন তা নয়, কিন্তু তবু ব্রাহ্মণ কৌটিল্য যেহেতু রাজকর্তা হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন জারি করেছিলেন, তাই তার ওপরে কিছু দুর্বলতা আছে পৌরাণিকদের। বিশেষ দু-একটি পুরাণ শূদ্র নন্দরাজবংশের সমসাময়িক অন্ধ্র পুলিন্দ, যবন, শকদের রাজবংশের বর্ণনা করে সক্ষোভে বলেছেন–এই চলবে কলিকালে। এইসব ব্রাত্য শূদ্র, ম্লেচ্ছ, যবনেরাই পৃথিবীর শাসক হবে এই সময়ে–এতে চ তুল্যকালাঃ সর্বে পৃথিব্যাং ভূভৃতো ভবিষ্যন্তি।
পুরাণকারেরা এবং মহাভারত যেভাবে কলিকালের রাজকুল এবং কলিধর্মের বিবরণ দিয়েছেন, তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মোটামুটি পরীক্ষিৎ জনমেজয়ের পর থেকে ভারতবর্ষের দক্ষিণে এবং পশ্চিম-উত্তরে তথাকথিত অনার্য জনজাতির প্রত্যুত্থান এবং তারপরে নন্দরাজবংশের রাজত্বকালে উত্তর-পূর্ব ভূখণ্ডে শূদ্র নরপতিদের সার্বভৌম শক্তিই কলিকালের প্রথম সূচক হিসেবে কাজ করছে। বিশেষত রাজশক্তি, শূদ্র রাজাদের করতলগত হওয়ায় সমাজে বর্ণব্যবস্থার বিপুল ব্যতিক্রম এবং মিশ্রণ তৈরি হয়েছিল। রাজশক্তি শূদ্রের হাতে থাকায় সমাজে শূদ্ৰ জনজাতিরও প্রাধান্য এবং প্রতিপত্তি বাড়ছিল। শূদ্রদেব এই প্রতিপত্তি কতটা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, সে-কথা মহাভারতে এবং পুরাণের ক্রমিক কলিধর্ম-বিচারেও প্রমাণিত হবে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে সমাজের অন্ত্যবর্ণের মানসিকতা কীভাবে পালটে যায়, মহাভারত তার সূত্র মাত্র করেছে কিন্তু শূদ্র জনজাতির কেউ তখনও বোধহয় রাজা হিসেবে আসেননি।
মহাভারতে যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে এটুকু বোঝা যায় যে, শূদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকের হাতেই টাকা-পয়সা আসছিল। ইতঃপূর্বে যাঁদের তিন বর্ণের সেবায় দিন কাটাতে হয়েছে, দাস শব্দটি যাঁদের ক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত ছিল, তারা অনেকেই বৈশ্য-বণিকের কর্ম গ্রহণ করায় তাদের হাতে টাকা আসছিল।মহাভারত বলেছে–ব্রাহ্মণরা সব শূদ্ৰবৃত্তি গ্রহণ করবে কলিকালে। আর শূদ্রেরা সব টাকা উপায় করবে–ব্রাহ্মণাঃ শূদ্ৰকৰ্মাণস্তথা শূদ্রা ধনার্জকাঃ। আমাদের ধারণা–এর থেকেও একটি তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোক আছে মহাভারতে এবং সেই শ্লোকটি, সব সংস্করণে দেখিনি, তবে পুণা থেকে বেরোনো ক্রিটিকাল এডিশনে এই শ্লোক থাকায় সমাজের ভাঙন বোঝাতে এই শ্লোকের গুরুত্ব বাড়ে।
বস্তুত ব্রাহ্মণতন্ত্রে এতকাল যে-রাজারা পুষ্ট হতেন, তাঁরা সেকালের সমাজের বর্ণাশ্রমের ব্যবস্থাটা অটুট রাখার চেষ্টা করতেন। স্বয়ং মনু, ক্ষত্রিয় রাজাকে বর্ণ এবং আশ্রমধর্মের শৃঙ্খলার প্রতিভূ হিসেবে দেখেছেন—বর্ণানাম আশ্ৰমানাঞ্চ ধর্মস্য প্রতিভূঃ স্মৃতঃ। কিন্তু ক্ষত্রিয় রাজাদের প্রতাপ এবং তথাকথিত সার্বভৌম ভাবনা ভেঙে যেতেই সমাজের বর্ণব্যবস্থারও বিপর্যয় ঘটেছে। মনু যাকে বলেছিলেন–প্ৰবৰ্তেত অধরোত্তর–অর্থাৎ নিচের লোকেরা ওপরে উঠবে, ওপরের লোকেরা নিচে যাবে, মহাভারতের ওই শ্লোকে সেটাই আরও স্পষ্ট হয়ে এরকম দাঁড়িয়েছে–অন্ত্যা মধ্যা ভবিষ্যন্তি মধ্যাশ্চান্তাবসায়িনঃ। অর্থাৎ যাঁরা একেবারে নিম্নবর্ণের মানুষ ছিলেন, তাঁরা মধ্য অবস্থায় এলেন আর যাঁরা মধ্য অবস্থায় ছিলেন তারা অন্ত্যবর্ণের বৃত্তি গ্রহণ করলেন। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, সমাজের অন্ত্য অথবা শেষ বর্ণ শূদ্রেরা বৈশ্যের কাজকর্ম আরম্ভ করলেন আর বৈশ্যেরা শূদ্রের কাজকর্ম ধরে নিলেন।
বিষ্ণুপুরাণে এই বিপর্যয়টা আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। অর্থাৎ বৈশ্যরা কৃষি-বাণিজ্য ছেড়ে দিয়ে আর্টিজ্যান শূদ্রদের শিল্পকর্মের দিকে ঝুঁকছিল–শূদ্ৰবৃত্ত্যা প্রবৎস্যন্তি কারুকর্মোপজীবিনঃ। ঘটনা হচ্ছে–আর্য রাষ্ট্রগুলির একতা ভেঙে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বিভিন্ন প্রদেশে বাণিজ্য করার চাইতে আঞ্চলিক চাহিদা পূরণ করার দিকে নজর পড়ছিল বেশি। তাই কারুকর্ম বা শিল্পকর্ম নয়, বৈশ্যরা প্রধানত স্ব-স্ব-রাষ্ট্রে, হীন ব্যবসাগুলিও আত্মসাৎ করতে আরম্ভ করেছিলেন। কেননা তারা পয়সা বোঝেন, নিজের ঘরে পয়সা পেলে পররাষ্ট্রে দৌড়বেন কেন! স্কন্দপুরাণের কলিধর্মে বলা হচ্ছে–বৈশ্যরা তাদের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে–তেলের ঘানি করবে আর ধান-মাড়াই করবে। তৈলকার’ অথবা তণ্ডুলকার’–এগুলি বড়ো ব্যবসা নয় বটে এবং সমাজে তা ঘৃণ্যও ছিল খানিকটা। কিন্তু অন্ত্য চাষিদের কাছ থেকে তিল অথবা সরষে একত্রে কিনে নিয়ে এবং অবশ্যই পাকা ধান এক লপ্তে কিনে নিয়ে সেগুলিকে ‘প্রসেসিং করাটা পুরাতন বণিকেরা মর্যাদা দিতেন না বলেই এই নতুন ভাবনা কিন্তু কলিযুগের বিপর্যয়ের মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু রাজশক্তির ডিজ-ইনটিগ্রেশন-এর সঙ্গে-সঙ্গে এই ধরনের আঞ্চলিক ভিত্তিতে ব্যবসা করাটা যে বৈশ্যজাতির পরিবর্তনশীল মানসের পরিচয় দেয়, সে কথা পৌরাণিকেরা তেমন অনুধাবন করেননি।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুদ্রদের রাজবংশের পরম্পরা নেমে আসলে চরম অবস্থা হয় ব্রাহ্মণদের। এতদিন যাঁরা রাজার কাছে সম্মান পেয়ে এসেছেন, যাগ-যজ্ঞ, শ্রৌত-বৈতনিক কর্মে যাঁদের সম্মান এবং দক্ষিণা বাঁধা ছিল, সমাজে বর্ণব্যবস্থা বিকল হয়ে যাবার ফলে তাদের মধ্যে তো পরিবর্তন আসবেই। বিশেষত নিম্নতর বর্ণের হাতে তখন টাকা-পয়সা আসছে। এই মুহূর্তে বিভূতিভূষণের ইছামতী’ উপন্যাসে নালু পালের চরিত্র এবং তার, ব্যবহার-বিবরণ স্মরণ করলেই পৌরাণিকদের কলিযুগীয় দুর্ভাবনাটুকু বুঝতে পারবেন। কথা হচ্ছে–নালু পাল যেভাবে সমাজে আপন ধনসম্পত্তির জোরে জায়গা করে নিচ্ছে, তার প্রক্রিয়াটা সেইকালেই শুরু হয়েছে। মহাভারত এই প্রক্রিয়ার সূচনা করে বলেছে–কলিযুগে ধন-সম্পত্তির মালিক শূদ্রেরা ব্রাহ্মণকে তাচ্ছিল্যের সম্বোধনে ডেকে বলবে–আরে, আমি এসে গেছি, এই যে বামুন, দুটো কথা আছে তোমার সঙ্গে। প্রত্যুত্তরে বামুন বলবে–বলুন বাবু! কী কথা–তভাবাদিনস্তথা শূদ্রা ব্রাহ্মণাশ্চার্যবাদিনঃ।
পুরাণগুলির মধ্যে বায়ুপুরাণও সূত্রাকারে মহাভারতের শব্দ পুনরাবৃত্তি করে বলেছে যে, ব্রাহ্মণেরা, যিনি যে-অবস্থানেই থাকুন, তারা সকলেই কলিকালে শূদ্রদের মর্যাদা-সম্বোধনে আহ্বান করবেন–শূদ্রাভিবাদিনঃ সর্বে যুগান্তে দ্বিজসত্তমাঃ। যদি বা এই কথাটা অতিশয়োক্তিও হয়ে থাকে, তবু শূদ্ৰ জনজাতির সঙ্গে ব্রাহ্মণেরা যে ওঠাবসা, মেলামেশা অথবা খাওয়া-দাওয়া করবেন–এ আশঙ্কায় মৎস্যপুরাণ এবং বায়ুপুরাণ এক সুরে বলেছে–শূদ্ৰানামন্ত্যযোনেস্তু সম্বন্ধা ব্রাহ্মণৈঃ সহ। ভবন্তীহ কলৌ তস্মিন্ শয়নাসনভোজনৈঃ শূদ্রবর্ণের আর্থিক প্রতিপত্তি বাড়ল এমনটি হওয়ারই কথা, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কিন্তু নন্দাদি তথাকথিত শূদ্রেরা রাজপদে অধিষ্ঠিত হলে কী হওয়া সম্ভব, তার একটা সার্থক চিত্র আছে কূর্মপুরাণে এবং তা থেকে বোঝা কূর্মপুরাণের কথক-ঠাকুর শূদ্র রাজাদের অধিষ্ঠান-সময়টাকেই কলিকাল বলে বুঝেছেন।
ব্রাহ্মণেরা ততদিনে বেদ পড়িয়ে অর্থ উপার্জন করার সহজ পন্থা পেয়ে গেছেন অথবা তীর্থক্ষেত্রে নিজেদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে পান্ডার কাজ করতে আরম্ভ করেছেন–বেদবিক্রয়িণশ্চান্যে তীর্থবিক্রয়িণঃ পরে–এটা হয়তো আরও কিছু পরবর্তী সময়ের ব্রাহ্মণ্য সংকট, কিন্তু শুদ্র রাজাদের আমলে ব্রাহ্মণদের অবস্থাটা কী, তার সার্থক কলিচিত্র দিয়েছে কূর্মপুরাণ। এই পুরাণ বলেছে–এই কালে অল্পবুদ্ধি সাধারণ লোকেরা যদি উৎকৃষ্ট আসনে বসে ব্রাহ্মণদের গম্ভীর চালে ধর্মোপদেশকের ভূমিকায় দেখতে পায়, তবে তারা কটুক্তি, ব্যঙ্গোক্তি ছুঁড়ে দেয় ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে–আসনস্থা দ্বিজান্ দৃষ্টা চালয়ত্যল্পবুদ্ধয়ঃ। যেসব শূদ্রেরা রাজার ঘরে কাজ করে তারা রাজশক্তিতে বলবান হয়ে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদেরও তাড়না করতে ছাড়ে না। এই কলিকালে বিভিন্ন উচ্চাসনে বসবেন শূদ্ররাই এবং ব্রাহ্মণেরা সেখানে চারপাশে সাধারণ আসনে বসে থাকবেন–উচ্চাসনাস্থাঃ শূদ্রাশ্চ কলৌ কালবলেন তু। আর এরকম হবে নাই বা কেন-কূর্মপুরাণ কারণ দেখিয়েই মন্তব্য করছে–কালের গতি এমনই যে, কলিকালে রাজাও তো ব্রাহ্মণদ্বেষী শূদ্র।
অনেকেই মনে করেন–পুরাণগুলির এত সব কলিধর্মবর্ণনা অনেক পরে লেখা হয়েছে, তাই এগুলিকে ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে না দেখাই ভালো। আমরা বলব–পুরাণগুলিও তো সব এককালে লেখা হয়নি, বিভিন্ন পুরাণ বিভিন্ন সময়ে লেখা হয়েছে। ফলে পুরাণগুলির সময়ের হিসেব পাওয়া গেলে বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত কলিধর্ম বর্ণনা থেকে সমাজের সার্থক শূদ্ৰায়ণ এবং ব্রাহ্মণ্যের অবনতি ক্রমিকভাবে ধরা যায়। কূর্মপুরাণের বর্ণনা থেকে বেশ স্পষ্টভাবে বোঝা যায়–শূদ্রদের ওপরে যে-বাচিক, বৈষয়িক এবং সামাজিক তাড়ন-পীড়ন ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে ঘটত, ব্রাহ্মণরা যেন ঠিক তার উলটো প্রতিক্রিয়াগুলি বর্ণনা করেই তাদের কলিধর্মের ব্যবহারগুলি বিবৃত করেছেন। কিন্তু সত্যদৃষ্টি অথবা কবির ক্রান্তদর্শিতা দিয়েই যে পৌরাণিক এমন কলিধর্মের ভবিষ্যৎ বিবরণ লিখেছেন, তা মনে হয় না। তারা যদি সমাজে এই বিপ্রতীপ চিত্র একটুকুও না দেখে থাকেন, তবে শূদ্রায়ণের ব্যুমেরাংটা এমন সার্থকভাবে দেখানো সম্ভবই হত না। কেউ সুপ্রতিষ্ঠিত সগন্ধ স্বজাতির এমন অধঃপতন বাস্তব দৃষ্টি ছাড়া লিখতে পারে?
ব্রাহ্মণদের স্বাধ্যায়-অধ্যয়ন এবং মর্যাদা আস্তে-আস্তে যে ক্ষীণ হয়ে আসছিল, বহু জায়গা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে, কিন্তু রাজশক্তির পরিবর্তনে তাঁদের মধ্যে যে-স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে তার চিত্রায়ণটি অসাধারণ ওই ভাবী কলিযুগের বর্ণনায়। বলা হচ্ছে–যাদের বেদবিদ্যার জোর তেমন নেই, এমন হতভাগ্য অল্পত ব্রাহ্মণেরা তখন ফুলমালা, বসন-ভূষণ, আরও নানাবিধ মঙ্গলদ্রব্যে শূদ্রদের পরিচর্যা করবে। এর পরেই সেই দারুণ পঙক্তিটি–পুরাতন দুর্ব্যবহার কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেবার প্রসঙ্গ। পুরাণ বলছে–এত ফুল-চন্দন-মাঙ্গলিকে ব্রাহ্মণেরা শূদ্রদের আরাধনা করলেও রাজবৎ সমাগত শূদ্র সেই ব্রাহ্মণদের দিকে ফিরেও তাকায় না–ন প্রেক্ষন্তে অর্চিতাশ্চাপি শূদ্রা দ্বিজবরান্ নৃপ। তবুও ব্রাহ্মণেরা শূদ্রকুলের মুখাপেক্ষী হয়ে তাদের সেবা করার সুযোগ খোঁজেন। শূদ্র অভিজাত পুরুষকে গজ-বাজীর বাহনে যেতে দেখলে ঘিরে ধরেন ব্রাহ্মণেরা, তার কাছে স্তুতি-নতি প্রকাশ করেন-বাহনস্থা সমাবৃত্য শূদ্ৰান্ শূদ্রোপজীবিনঃ।
আসলে এই বিপরীত ব্যবহার খুব অচেনা হবার কথা নয়। বেশ বোঝা যায়–যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা অথবা দান-প্রতিগ্রহে ব্রাহ্মণের আর বৃত্তিলাভ সম্পন্ন হচ্ছিল না, এবং শুধু মগধ নয়, ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বহু রাষ্ট্রেই ব্রাহ্মণ্যবিরোধী ক্ষত্রিয়েতর রাজগোষ্ঠী প্রতিস্থাপিত হওয়ায় তাদের জীবনে দুর্দশা নেমে এসেছিলই। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্ম এবং জৈনধর্মে ধর্মান্তরিত নিম্নতর জাতির আত্মলাভও প্রকারান্তরে ব্রাহ্মণ্যের সুব্যবস্থার অবনতি ডেকে এনেছে এবং এই অবনতিই কলিকাল বলে চিহ্নিত হয়েছে পুরাণে-পুরাণে। পুরাণকারেরা একটা কথা বারবার বলেছেন যে, বেশ খানিকটা ধনৈশ্বর্য এবং বড়ো খানিকটা জমি পেলেই সেটা আভিজাত্যের হেতু হয়ে ওঠে কলিকালে। ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে–আলেকজান্ডারের আক্রমণকালের আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। একমাত্র চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমল বাদ দিলে গুপ্তরাজাদের রাজনৈতিক সমৃদ্ধির সময়টুকু কোনোভাবে ধরা যাবে রাজনৈতিক একতার চিহ্ন হিসেবে। তা নইলে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং সামন্ত রাজাদের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র আধিপত্য–সেকালের পরিচিত চেহারা।
এই রাজনৈতিক অবস্থানের নিরিখে যদি সমাজের বিচার করা যায়, তাহলে দেখব, সমাজেও তখন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের খানিকটা শিথিলতা এসেছে। বর্ণব্যবস্থায় বর্ণসংকর তো ঘটছিলই, অন্যদিকে রাস্তাঘাটের উন্নতি এবং টাকাকড়ির লেনদেন ভালোভাবে শুরু হওয়ায় নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হচ্ছিল।
পৌরাণিকেরা কলিধর্মের বর্ণনায় আরও যেসব বর্ণনা দিয়েছেন তা বিচার করলে দেখা যাবে সমাজে এমন এক ধরনের আধুনিকতার আবরণ তৈরি হচ্ছিল, যা প্রাচীন ধারণার বাহক এবং ধারক পৌরাণিকদের ভালো লাগেনি। সেই দুর্ভাবনার সবকিছু যে খুব সদর্থকভাবে প্রমাণ করা যায়, তা নয়। তবে আমার অন্তত বেশ মনে হয়–সে-সব ঘটনা পৌরাণিকদের নিজের আমলেই ঘটছিল এবং সেগুলি তারা খুব ভালো চোখে দেখছেন না বলেই কলিধর্মের আরোপ এসেছে সেখানে। তবু বলতে হবে–কোনো সমাজেই শিথিলতা একদিনে আসে না, সমাজ আপন প্রক্রিয়াতেই সে-শিথিলতা তৈরি করে এবং সে-শিথিলতা যদি তকালের নায়ক-নেতাদের পছন্দ না হয় তবে তারই মধ্যে নতুন প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়, সমাজ, তাতে আবার নতুন বাঁধনে বাঁধা পড়ে। আবারও আসে উদারীকরণ, পুনরায় আবার বন্ধন-এইভাবেই সমাজ চলে। কিন্তু আমি যা দেখেছি, সেই বৈদিক সমাজ থেকে শুরু করে মহাভারতের সমাজ পর্যন্তও যে-উদারতা ছিল, সেই উদারতা শিথিল হতে থাকে শ্রৌত-স্মার্ত-গৃহ্য নিয়মের সংকীর্ণতায়। কিন্তু নন্দ রাজাদের আমলে শূদ্ররাজ সৃষ্টি হবার পর গুপ্ত রাজাদের শাসন পর্যন্ত যে-অন্তর্বর্তী সময় চলেছে তার যেমন ছায়া পড়েছে মহাভারত এবং প্রাচীন পুরাণগুলির বর্ণনায়, তেমনই পরবর্তী ৯ম, ১০ম কিংবা ১১শ খ্রিস্টাব্দে রচিত পুরাণগুলির কলিধর্ম বর্ণনায় কলিকালের চেহারা সেই পুরাণের সময় অনুসারেই লিখিত। এর পরে আমরা আর কঠিন কোনো আলোচনায় যাব না, শুধু পুরাণগুলিতে বর্ণিত কলিধর্মের নিরিখে দেখব যে, কলিকালের ধর্মশিথিল প্রক্রিয়া কবে থেকে শুরু হয়েছে।
.
০৪.
পরাশর উবাচকলিকালে অষ্টম, নবম এবং দশম বর্ষের পুরুষের সহবাসেই পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তমবর্ষীয়া বালিকারা সন্তানবতী হইবে। কথাটা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি কথা। কেননা প্রথম শ্রেণিতে পড়া একটি মেয়ের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া একটি ছেলের বিবাহ-ঘটনায় পরাশর যে-সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন অলৌকিক বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ছাড়া তা অসম্ভব। মহাভারত বয়সটা একটু বাড়িয়ে সাত-আট বছরের মেয়েদের সঙ্গে দশ-বারো বছরের পুরুষের সংযোগ ঘটিয়ে বদান্যতা দেখালেও টীকাকার নীলকণ্ঠ মূল কথাটি বলে দিয়েছেন–ইঙ্গিতজ্ঞ পণ্ডিতের মতো। তিনি বলেছেন–কলিকালের দিন যত পরিণত হবে, স্ত্রী-পুরুষ তত বেশি জৈব কামনায় দাস হয়ে উঠবে–অতিকামাতুরা ইত্যৰ্থঃ। আসলে সমাজের ব্রাহ্মণ্য-গ্রন্থি যত শিথিল হবে, স্ত্রী-পুরুষের মেলামেশাও তত বাড়বে আর এই বাড়াবাড়িটা পৌরাণিক সংযমীর পছন্দ হয়নি ইত্যর্থঃ।
উল্লিখিত শ্লোকটি দেখে অনেকেই হয়তো মনে করবেন-ঋষিরা এইরকমই উদ্ভট কথা বলেছেন বেশি। কিন্তু সত্যি বলব কী, অনেক কথা তাদের খেটেও গেছে। যেগুলো খেটেছে,সেগুলো বেশিরভাগই অবশ্য নদী-নালা কিংবা জীবজন্তু বিষয়ক। নদী-নালা শুকিয়ে যাওয়া, কিংবা গোরুর পক্ষে ছাগলের মতো দুধ দেওয়া, প্রজানুরঞ্জনের নামে তথাকথিত রাজাদের প্রজাশোষণ, কিংবা সাধু-সন্তের ভণ্ডামি–এগুলোর মধ্যে কালের প্রভাব পড়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু নদী আর গোরুর দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়ে আমরা যদি মনে করি মানুষের ক্ষেত্রেও সব মিলে গেছে, তাহলে বিপদ বাড়বে।
পরাশরের মতো এত নিষ্ঠুর বাল্যমিলনে বিশ্বাসী না হলেও মনু মহারাজ তার পুরুষতান্ত্রিকতায় চব্বিশ বছরের ছেলের সঙ্গে আট বছরের মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছেন; অভিজাত পাত্র পেলে মনুর মতে ছ’ বছরের মেয়েকেও বিয়ে দেওয়া যায়। আমাদের তো তাহলে বলতে হয়–মনু মহারাজই কলিধর্ম কার্যে পরিণত করেছেন, কারণ কলিকালেই এইরকম অকাল-গর্ভধরা রমণীর সন্ধান পাওয়া যাবে বলে পুরাণ-মহাভারত জানিয়েছে। কিন্তু বেদ-ব্রাহ্মণ্যের যখন সোনার দিন ছিল, তখন কিন্তু এমন দুর্বিষহ ভাবনা চালু ছিল না। প্রেমে পড়ে বা না পড়ে একশো বছর যার সঙ্গে কাল কাটানোর বাসনা–জীবেমঃ শরদঃ শতম্, পশ্যেমঃ শরদঃ শত–তার চেহারাটি বেশ উচ্চাবচ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিয়েছেন বৈদিক ব্রাহ্মণেরা। শতপথ ব্রাহ্মণ তো কোনো ইতস্তত না করে সোজাসুজি বলেছে–মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে প্রশংসনীয় চেহারা হল–পৃথুশ্রোণী, ক্ষীণমধ্যা এবং পীনোন্নত পয়োধরা।
এই চেহারা আমাদের কলিযুগের লোকেদের চেনা, বরঞ্চ সপ্তম-অষ্টম অথবা নবম-দশম বর্ষের যে মুকুলিকা বালিকার বৈবাহিক সম্বন্ধ–যা কলিযুগের অভিশাপ অথচ বিধানদাতা মনু-যাজ্ঞবল্ক্যদের অভিমত বিবাহ, তাতে মনে হয়, খ্রিস্টীয় ২/৩ শতক থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সময় পর্যন্তই কলিকাল চলেছে, আমরা পুনরায় অন্তত ত্রেতাযুগে ঢুকে পড়েছি, কেননা ত্রেতাযুগে যজ্ঞাদিক্রিয়ার চরম সময়েই নিশ্চয়ই শতপথ ব্রাহ্মণ, প্রশস্ততরা রমণীর বৈবাহিক রূপ কল্পনা করেছে আমাদেরই মতো উচ্চাবচ দৃষ্টিতে। তবে কিনা, বলতে পারেন, রমণীর শরীরের প্রত্যঙ্গ-বন্ধুর এই বিবরণ নিয়ে শতপথ ব্রাহ্মণ আর কলির জীবের বিসংবাদ না থাকলেও বিসংবাদ কি স্ত্রীলোকের আচরণ নিয়েই আছে? কলিধর্মের ঋষি বলেছিলেন-কলিকালে স্ত্রীলোকমাত্রেই সাধারণত স্বেচ্ছাচারিণী হবে, ধর্মের নিয়মে তাদের বিবাহ হবে না এবং দাম্পত্য সম্বন্ধও হবে বিপরীত। স্বেচ্ছাচারিণী মানে নিশ্চয়ই মেয়েরা নিজের ইচ্ছেমতো চলবে। ধর্মের নিয়মে বিবাহ হবে না–মানে, নিশ্চয়ই সেই অসবর্ণ বিবাহ এবং বিপরীত দাম্পত্য-মানে, নিশ্চয়ই স্ত্রীলোকের পৌরুষেয় আচরণ অথবা পুরুষের মাথায় চড়ে বসা।
কলিকালের এই অসবর্ণ তথা অসামাজিক বিয়ে নিয়ে বেশি কথা কী বলব–এর ঐতিহ্য এত পুরনো এবং উদাহরণ এতই বেশি যে, ঋষিরা যাঁরা কলিধর্ম নিরূপণ করেছেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে একটু আত্মস্থ হলেই আমাদের এই কলি-কলুষ দৃষ্টিপাতের প্রয়োজনই থাকবে না। স্বেচ্ছাচারিতা এবং তাও আবার মেয়েদের স্বেচ্ছাচারিতার ফলেই অসামাজিক অসবর্ণ বিয়ে হয়–এ ধারণাটাও তো নিতান্তই একপেশে। এমনকী ভগবদ্গীতায় কৃপাবিষ্ট অর্জুন পর্যন্ত একই ধারণার কথা বলেছেন–স্ত্ৰীষু দুষ্টাসু বাষ্ণেয় জায়তে বর্ণসংকরঃ- অর্থাৎ স্ত্রীলোক যদি দুষ্ট হয়ে ওঠে তবে সমাজে বর্ণসংকর সৃষ্টি হবে। আমরা বুঝি–মেয়েদের মধ্যে যাঁরা একটু স্বাধীনচেতা এবং যাঁরা কিঞ্চিৎ মধুর হাসে মধুর বাসে সরসতা বিতরণ করেন, পৌরাণিকের কলিকালের ভবিষ্যদ্বাণী তাঁদেরই ওপর গিয়ে চেপেছে। কিন্তু আমাদের ব্যাসপিতা পরাশর মুনি কি দ্বাপর যুগের মানুষ ছিলেন, নাকি কলিকালের? যে-কালেই হোক সেই প্রাচীনকালে যমুনা পার হবার সময় নৌকার ওপর সত্যবতীর অতুল রূপ দেখে তার যে-অবস্থা হয়েছিল, মহাভারত তার বর্ণনা দিতে গিয়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছে, তার অর্থ করলে সোজাসুজি বোঝা যাবে, পরাশর মুনির মাথা একেবারে ঘুরে গিয়েছিল। আমার ভয় হয়–আজকের এই নরম কলিতে মহর্ষিকে যদি যমুনার বদলে গড়িয়াহাটের মোড় পার হতে হত, তাহলে আধুনিক সাজে সজ্জিতা কোনো পৌর-নাগরিকার অপাঙ্গ ইঙ্গিতে তিনি খড়ম পিছলে পড়ে যেতেন, দ্বিতীয় দফায় বিষ্ণুপুরাণের কলিধর্মনিরূপণ’ অধ্যায়টি ছিঁড়ে নিয়ে সেই ললনার পায়ে তিলাঞ্জলি রচনা করে কালিদাসের শিবের মতো বলতেন–অদ্য প্রভৃত্যেবাবনতাঙ্গি তবাস্মি দাসঃ।
অবশ্য আধুনিক স্বেচ্ছাচারিণীরা মহর্ষিকে কতদূর সহ্য করতেন, তাই নিয়ে একটা সন্দেহ করা চলে, কারণ এঁরা তো তপস্যার প্রভাব জানেন না, আর অভিশাপের ভয়ও তেমন নেই। মহাভারতে দেখছি–সত্যবতী নাকি মুনির বাঁচিক তাড়নায় পিতার অনুমতি পর্যন্ত নেবার সময় পাননি। শেষ পর্যন্ত মৎস্যগন্ধের খোলস ছেড়ে যোজনগন্ধা সত্যবতী মুনির প্রভাবে তাৎক্ষণিক গর্ভমোচন করে মুক্তি পেলেন বটে, কিন্তু আমাদের সর্বকালের অভিভাবকমনু-মহারাজ পড়লেন মহাপরে। তিনি বলেছিলেন–যে-ব্রাহ্মণ শূদ্রার অধর-রস পান করিয়াছে এবং শয্যায় তাহার নিশ্বাস গায়ে লইয়াছে এবং তাহাতে সন্তান উৎপাদন করিয়াছে, তাহার ওই কর্মের নিষ্কৃতি অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্তেরও বিধান নাই। অর্থাৎ সারা জীবনের মতো তিনি শেষ মিটে গেল এক প্রেমে জীবনের সর্বপ্রেম-তৃষা।
মনু অবশ্য মুনিঋষিদের চিরতৃষ্ণার্ত অবস্থা বুঝে সমগ্র ব্রাহ্মণ-জাতিকেই কিছু সুবিধে দিয়েছেন এবং সেটা বেশ একটা ফিকির অথবা কৌশলই বলা চলে। মনু বলেছেন যে, ব্রাহ্মণেরা প্রথমে একটি সুবর্ণা ব্রাহ্মণী বিয়ে করে নেবেন, পরে কামবশত যদি আবারও বিয়ে করার ইচ্ছে হয়, তবে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র–সব মেয়েই চলবে। মহাভারতের কবি এ-কথা স্পষ্ট করে বলেননি একবারও যে, পিতা পরাশর পূর্বে কোনো ব্রাহ্মণকন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কলস্বনা যমুনার ওপর কুজঝটিকার মধ্যে নৌকাবিলাসের সময় মৎস্যগন্ধার আতপ্ত নিশ্বাস যদি মহর্ষির গায়ে লেগে থাকে, তবু সেটা আমাদের কাছে বড়ো ভাগ, বড়ো অভ্যুদয়–কেননা মহাভারতের কবি জন্মেছেন। জিজ্ঞাসা হয়–ব্যাস কী কলিকালের গন্ধ গায়ে মেখেই জন্মেছিলেন।
যে-ঘটনা সেদিন ঘটেছিল, সে কি স্ত্রীলোকের স্বেচ্ছাচারিতায় ঘটেছিল, নাকি পরাশর মুনির মতো স্বেচ্ছাচারী স্বচ্ছন্দবিহারী পুরুষের পৌরুষেয়তায়? ভাগবত পুরাণ আমাদের মতো কলির জীবদের সচকিত করে বলেছে–ঈশ্বরস্বভাব তেজস্বী পুরুষের কাছে কোনো কিছুই দোষের নয়, আগুনের মতো তারা সমস্ত দোষ ভস্মসাৎ এবং আত্মসাৎ করতে পারেন–তেজীয়সাং ন দোষায় বহ্নেঃ সর্বভুজো যথা। ভাগবত সাবধান করে দিয়ে বলেছে–তাই বলে যেন সাধারণ মানুষ, তুমি-আমি এসব করতে না যাই। যদি করি, তাহলে শিব ছাড়া অন্য মানুষ বিষ খেলে যে-গতি হবে, সাধারণেও সেই অবস্থা হবে। জীবন তবু বাঁধাধরা নিয়ম মেনে চলে না। সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাচারে বিপন্ন হয়, কিন্তু তেজস্বী পরাশর, জেলের মেয়ে সত্যবতীর জালে ধরা পড়েন, আর তৎপুত্র ব্যাস নিয়োগের প্রযুক্তিতে রাজরানি অম্বিকা, অম্বালিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর জন্ম দিলেন–এটাও তেজস্বী মানুষের কথা। তাহলে কলির ধর্মে বৈবাহিক অথবা দাম্পত্য ব্যবহারে আমরা কী করি!
স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্নে কলিকালের রমণীর কথা এসেছে, কিন্তু সেও তো বুঝি পুরুষেরই চিরায়ত, এখনও, তখনও। পরাশর মুনি বিষ্ণুপুরাণে নিজের দৃষ্টান্তে পুরুষদের ক্ষমা করে দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার সমস্ত দায় চাপিয়ে গেছেন কলিযুগের মেয়েদের ওপর। কিন্তু সরল সাদাসিধে বৈদিক ঋষিরা, যারা পরাশর-মনু–এঁদের অনেক আগের যুগের লোক তারা নির্মল হাস্যে, মেয়েদের মৃদুল-গমনের ছন্দটি মরমি মানুষের মতো ধরে রেখেছেন বৈদিক ছন্দে। যুবতী মেয়ের পেছন পেছন যেমন যুবকরা ঘোরাফেরা করে’–এই ধরনের উপমা যে ঋগবেদে কত বার আছে, তার ঠিক নেই। এতে সেই যুবতীদের ওপর স্বেচ্ছাচারিতার দায় আসে কি না জানি না, তবে এতগুলি যুবকের পশ্চাৎ-পদচারণার ফলে সেই রমণীদের মনে কোনো আকুল আত্মতৃপ্তিও কি হত না? এখনকার কলিকালের মতোই? যে-সমাজের যুবকদের মনে এত গান, সেখানে যুবতীদের মনেও কি গুনগুন ছিল না। কোনো–সমান্তরাল? দশাঙ্গুলির নিষ্পেষণে সংশোধিত হচ্ছে সোমরস–সেখানে উপমাটি হল–দশটি যুবতী একই সঙ্গে যেমন একটি যুবককে আহ্বান করে। বিশ্বামিত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে নদীগুলি, ঠিক যেমন পুরুষদের দিকে ধাবিত হয় রমণী আসঙ্গলিপ্সায়।
এই যেসব ঋক্-মন্ত্র, যেখানে যজ্ঞীয় সোমরস নিষ্পেষণে রমণী-শরীরের উপমা, নদীর স্রোতোগতির মধ্যে যেখানে রমণীয় অভিসারের কথা–এগুলোকে কি স্বেচ্ছাচারিতা বলব, না কি দুই হাতে তালির সেই বিখ্যাত প্রবাদ–যা বড়ো স্বাভাবিক, এ-কালেও ও-কালেও। আর একটি শব্দ আছে ‘সমন’। শব্দটি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচুর বিবাদ আছে, তবু সাধারণ অর্থে এটি এক ধরনের উৎসব, যেখানে সর্বার্থে মেয়েদের আশাপূরণের ইঙ্গিত আছে। ভাষাতত্ত্ববিদ পিশেলের (Pischel) মতে, সমন একটি জনপ্রিয় সার্বজনীন উৎসব, যেখানে মেয়েরা আসত মনের মানুষ খুঁজতে, যশঃপ্রার্থী কবিরা আসতেন স্বরচিত কবিতা পাঠ করে প্রশংসা কুড়োতে, আর ধনুর্বিদেরা আসতেন লক্ষ্য বিদ্ধ করে পুরস্কার জিততে। এই উৎসবের মেয়াদ থাকত সারা রাত। বায়ুর গতির দ্রুততা বোঝাতে বেদের ঋষি উপমা দিয়েছেন–সমনং ন যোষাঃ–অর্থাৎ যে-গতিতে, যে-দ্রুততায় মেয়েরা সমনে যোগ দিতে যায়। মেয়েদের এইসব তিমিরাভিসারে বৈদিক মায়েদের মদতও কম ছিল না। তারা মোহন সাজে সাজিয়ে দিতেন মেয়েদের, যাতে তারা অভিজাত যুবককে আকর্ষণ করতে পারে।
বৈদিক যুগে এমন আধুনিক চর্চা দেখে তো বেশ মনে হয়, বুঝি তখনই কলিযুগের আরম্ভ হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণ থেকে আরম্ভ করে অনেকগুলি পুরাণই বলেছে–কলিযুগে যে-মেয়েদের সোনা-দানা-মণিরত্ন অথবা বস্ত্রালংকার নেই, সেই মেয়েও শুধু তার কেশগুচ্ছে বাহার তুলে নিজেকে অলংকৃত দেখানোর চেষ্টা করবে। কথাটা বোধহয় পুরাণের থেকেও পুরনো, কেননা মহাভারতও বলেছে–কেশশূলাঃ স্ত্রিয়ো রাজন্ ভবিষ্যন্তি যুগক্ষয়ে। স্ত্রীলোকের কেশ ব্যাপারটাকে এখানে লজ্জাহীন আকর্ষণী শক্তি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন টীকাকার নীলকণ্ঠ। কিন্তু পুরাণ এবং মহাভারতে এই কেশসজ্জার পারিপাট্যের মধ্যে আমরা কিছু বাস্তব ইতিহাসের গন্ধ পাই। একটা কথা খেয়াল করতে হবে-রমণীর পারিপাট্যের ঘটনাটা কলিযুগের কোনো নতুন বৈশিষ্ট্য নয়, রামায়ণে রামচন্দ্রের মতো সরল ধীর-গম্ভীর নায়ককে পর্যন্ত কাকপক্ষ (জুলফি) ধারণ করে ঘুরতে দেখেছি–কাকপক্ষধরো ধী–সেখানে রমণীরা বিচিত্র কেশসজ্জা করবেন না, এ কেমন কথা!
সত্যি কথা সংক্ষেপে বলি–অতিপ্রাচীন কালেই ভারতবর্ষে বহুতর কায়দায় রমণীরা চুলের খোঁপা বাঁধতেন এবং আমাদের ধারণা, আলেকজান্ডারের আক্রমণের পর গ্রিকদেশীয় কেশসজ্জাও আমাদের দেশে আমদানি হয়। গান্ধার শিল্পের নরনারীমূর্তিতে যে চুলের বাহার আছে, দিনে দিনে তা বাস্তবভাবেই রমণীর মস্তকে প্রযুক্ত হতে হতে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে সে কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করা যেতে পারে। আর এটাও ঠিক, যার কিছু নেই, শাড়ি-গয়না, রত্ন-অলংকার কিছুই নেই, সেই রমণী যদি চুলের কায়দা করে কিঞ্চিৎ সম্মোহন তৈরি করে, সে কি কলিকালের দোষ? কালিদাসের পার্বতী যখন-মুক্তাকলাপীকৃতসিন্ধুবারং–মুক্তোর মালা-জড়ানো সিন্ধুবার পুষ্পে কেশকলাপ সজ্জিত করে শিবের পায়ে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন, তখন তার মাথা নোয়ানোর আগে তার চুলে গোঁজা কর্ণিকার ফুল, আর কানের পাশে গোঁজা বৃক্ষপল্লব চ্যুত হয়ে পড়েছিল শিবের পায়ে–উমাপি নীলকমধ্যশোভি/বিভ্রংসয়ন্তী নবকর্ণিকার/চকার কর্ণচ্যুতপল্লবেন……
কেশবন্ধন, কেশসজ্জা, এবং কেশ অলংকরণের বিচিত্র উপকরণ নিয়ে যে ইন্ডিয়ান কইফিওর’–সেটা শুধু আলেকজান্ডারের সময়ের পরের সমৃদ্ধি, তা ভাবলে ভুল হবে। মহাভারত, রামায়ণ, বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি এবং অবশ্যই অসংখ্য ভাস্কর্য এ-কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দেবে, চুলের কায়দা-কেতা এবং পারিপাট্য কলিকালের কোনো আবিষ্কার নয়, এ আমাদের বহু প্রাচীনকালের মন্ত্রণা, এই সাজ প্রায় রমণীর মনের সমবয়সি। কৃষ্ণপ্রেয়সী সত্যভামাকে মনে আছে তো! তিনি অতিশয় মানিনী ছিলেন। দেবর্ষি নারদ একবার নন্দনের মঞ্জরী পারিজাতের একটি গুচ্ছ এনে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের পত্নীজ্যেষ্ঠা রুক্মিণীর হাতে। এই পুষ্পস্তবক কৃষ্ণের জীবনে এমনই বিপন্নতা ডেকে এনেছিল, যা বলবার মতো নয়। সত্যভামা এ পারিজাতগুচ্ছের জন্য প্রায় মরণপণ করেছিলেন। তবে সেখানে উদ্দেশ্য ছিল একটাই, রুক্মিণীকে কৃষ্ণের চোখে খাটো করে দেওয়া। কিন্তু তার জন্য যে উপায় ব্যবহৃত হয়েছিল, তা নিজমুখে বলেছেন সত্যভামা। বলেছিলেন–স্বর্গের নন্দনকানন থেকে ওই পারিজাতের গাছটাই উচ্ছিন্ন করে এনে পুঁতে দিতে হবে দ্বারকায়। আমি ওই পারিজাত ফুল খোঁপায় গুঁজে আমার সতীনদের মধ্যে ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে চাই–বিভ্রতী পারিজাতস্য কেশপক্ষেণ মঞ্জরী।
যুক্তি একটা আছে বটে। যুক্তি আছে–কৃষ্ণ আমাদের মতো কলির জীব না হলেও কলিকালেরই অবতার বটে। যে যতই বলুন–দ্বাপরের শেষে কৃষ্ণ লীলাসম্বরণ করলেই তবে কলির আগমন ঘটেছে, আমরা তা মানি না। তিনি কলিতে এসেছিলেন বলেই কলির আচরণ নিজের জীবনে খানিকটা টের পেয়ে গেছেন। এই যে প্রেয়সী সত্যভামার পারিজাতের বায়না হল, তা যেমন কলিসুলভ কেশ-পারিপাট্যের জন্য, তেমনই অন্যদিকে তা কৃষ্ণকেও একেবারে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিয়েছিল। পৌরাণিক কলিধর্মে বলা হয়েছে–কলিকালে স্ত্রীগণ উভয় হস্ত দ্বারা মস্তক চুলকাইতে-চুলকাইতে অনায়াসে স্বামীর বাক্য অবহেলা করিবে–উভাভ্যামেব পাণিভ্যাং শিরঃ কয়নং স্ত্রিয়। আমাদের বক্তব্য–ত্রেতাযুগে মহারাজ দশরথের প্রিয়তমা স্ত্রী কৈকেয়ী কী করেছিলেন? তার অবহেলা এবং দশরথের অনুনয়-বিনয় নিয়ে রামায়ণে অন্তত সাতটি সর্গ রচিত হয়েছে। আর এই যে সত্যভামার কথা বললাম, তার বায়না রাখবার জন্য ভগবান। কৃষ্ণকে স্বর্গে গিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেই পারিজাত-বৃক্ষ এনে রোপণ করতে হয়েছিল দ্বারকায়। এই আচরণকেই বা কী বলবেন–তেজস্বী ঈশ্বর-স্বভাব পুরুষের আচরণে দোষ নেই কোনো?
আমরা তাই প্রথম থেকেই বলে আসছি–কলিযুগ বলে পৌরাণিকেরা যে-ভাবীকালের বিবরণ দিয়েছেন, তা তেমন কোনো সূদুর ভবিষ্যৎ ছিল না তাঁদের কাছে। তাদের কাছে যেটা বর্তমান ছিল এবং সেই বর্তমান যতটুকু ভবিষ্যতের রূপ দেখতে পেয়েছিল তারই সামান্য অনুমান আছে মহাভারত-পুরাণে কলিধর্মের বর্ণনায়। বরঞ্চ বলব–কলিধর্ম ছিল প্রত্যেক বৃদ্ধ পৌরাণিকের কাছে এক রূঢ় বাস্তব, যা সহ্য করতে পারছিলেন না তারা। সমাজে যে আধুনিকতার আমদানি হচ্ছিল, গ্রাম-সমাজ যত নগরায়ণের পথে হাঁটছিল, সমাজের মধ্যে স্ত্রীলোকের ব্যক্তিগত মর্যাদা যত বাড়ছিল, উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীরা যত স্বনির্ভর হচ্ছিল, কলির প্রভাব তথাকথিতভাবে তত বাড়ছিল। এমনকী সমাজে যদি তেমন কোনো উদার মহান বিপ্লবও আসে যা শত-শত, লক্ষ-লক্ষ মানুষের মুক্তি ঘটায়, সেখানেও যে-অনুদার সংরক্ষণশীল মানুষ কলির প্রভাব দেখতে পান, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি মধ্যযুগের চৈতন্যের সমসাময়িক একটি শ্লোকে। যে, চৈতন্য-নিত্যানন্দকে কলিযুগের পবন-অবতার বলা হয়, তাদের উদার বিপ্লবকেও বিরুদ্ধ সংরক্ষণশীলতায় মানুষ বলেছে–ওরে মন! মন রে আমার! তুমি যেন এই ঘূর্ণিপাকে বাঁধা পোড়ো না, কলির পরাক্রম অধুনা বড়ো বেড়ে গেছে–বলী কলিপরাক্রমো বিরম বিভ্রমেভ্যা মনঃ। তার মানে, ‘কলিযুগ’ প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এমনই একটা কনসেপ্ট’, যাকে যে-কোনো নতুনত্ব এবং আধুনিকত্বের বিরুদ্ধে প্রচার করা যায়।