০৬. আঠারো জোড়া আইনের পা

পর পর কয়েকদিন বুড়ো আহমদ হোসেনের আখড়ার কাছে এসে ফিরে গেলো শওকত। সারাপথ মনটাকে ধরে রাখলেও বুড়ো আহমদ হোসেনের নজরের সীমানার আসার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সত্তা যেন বিদ্রোহ করে উঠে ওর।

মার্থা বলে। তোমার কী হয়েছে বলো তো। দিন দিন অমন শুকিয়ে যাচ্ছো কেন।

শওকত সংক্ষেপে উত্তর কারে। কাজের চাপে।

মার্থা মমতার স্বরে বলে। থাক, ও কাজে দরকার নেই। এটা ছেড়ে দাও! কাজ করে শেষে মরবে নাকি?

শওকত ম্লান হাসে। মার্থা যদি জানতো!

অথচ মার্থা নিজেও খাটছে দিনরাত। আজকাল বাসায় ফিরতে ওরও অনেক রাত হয়ে যায়। তখন বড় ক্লান্ত দেখায় ওকে।

শওকত প্রশ্ন করে। কী ব্যাপার। তুমিও কি কোনো বাড়তি কাজ নিয়েছো নাকি?

না অমন কিছু নয়। মার্থা মৃদু হেসে বলে। রাতকানা লোকটার হিসেব দেখে দিই। সে জন্যে আলাদা করে মাসে মাসে কিছু টাকা দেবে বলেছে। শোনো, হঠাৎ প্রসঙ্গটা পালটে দেয় মার্থা। এক ভদ্রলোক বলেছিলো, ধারে কিছু টাকা জোগাড় করে দেবে। নেবো?

ভদ্রলোকটি কে?

তুমি চিনবে। মার্থা হেসে বলেছে। অবশ্য বলছিলো, মাসে মাসে সুদ দিতে হবে।

থাক। সুদে টাকা ধার নেবার দরকার নেই। শওকত বিমর্ষ গলায় বলেছে। শেষে সুদের টাকা জোগাতে গিয়ে মরবে।

ঠিক আছে নেবো না। মার্থা আবার প্রসঙ্গটা পালটে দিয়ে বলেছে। জানো, কাল রাতে দোকানটা আবার গিয়ে দেখে আসছি আমি। বাড়িওয়ালা বলছিলো, ভালো করে চালাতে পারলে মাসে দেড়শ দুশ টাকা আসে?

শওকত কোনো উত্তর দেয়নি সে কথায়।

সে তখন ভাবছিলো অন্য কথা। মাস যখন শেষ হয়ে যাবে আর মার্থা যখন বলবে, কই, কত টাকা পেলে। তখন ওকে কি জবাব দেবে শওকত।

না। আজ বুড়ো আহমদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করে তারপর বাড়ি ফিরবে সে।

চটের ঘেরা দেয়া টিনের রেস্তোরাঁটায় ঢোকার মুখে একটা নেড়ি কুত্তা বসে কান চুলকোচ্ছে তার। কয়লার চুলোয় কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। বাইরে থেকে বুড়ো আহমদ হোসেনের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো শওকত। বুড়ো আসর জমিয়ে বসেছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে আর হাসছে সে।

শওকতকে দেখে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। চোখ জোড়া পিটপিট করে তাকালো ওর দিকে। দাড়ির অরণ্যে হাত বুলিয়ে নিয়ে কাউন্টারে দাঁড়ানো ছোড়াটাকে ডেকে বললো গেলাশটা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে সাহেবকে এক কাপ চা দে। ওর গলার স্বরে বিদ্রূপের ব্যঞ্জনা।

শওকত যেন হোঁচট খেলো।

বুড়ো বললো, এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে।

শওকত সংক্ষেপে বললো, এমনি। বলে বসলো সে।

বুড়ো তখনো ওর দিকে তাকিয়ে। কিছু বলবে?

হুঁ।

কী।

আমি বিয়ে করছি।

বিয়ে? বুড়ো আহমদ হোসেন প্রচণ্ড শব্দে হেসে উঠলো। ওর হাসির চমকে দোরগোড়ায় বসে থাকা নেড়ি কুত্তাটা ঘেউ ঘেউ করলো। ছোকড়ার হাতের গ্লাস থেকে কিছু চা ঢলকে পড়ে গেলো মাটিতে। বিয়ে করছে কোকে, সে মেয়েটা কে, যার ঠোঁট কামড়ে দিয়েছিলে? ফোকলা দাঁতের ফাঁকে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দিলো সে।

বেয়ারা এসে চায়ের গ্লাসটা সামনে নামিয়ে রাখলো। গ্লাসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বুড়ো বললো, নাও, চা খাও। যাবার সময় অবশ্য পয়সাটা দিয়ে যেও। যাকগে, বিয়ে করছে ভালো কথা কিন্তু সে কথা আমাকে শোনাতে এসেছো কেন?

শওকত বললো, তোমাকে শোনাতে আসিনি। এসেছি এমনি। ঘুরতে ঘুরতে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো তাই বললাম।

না। জমলো না। আসল কথাটা মুখ ফুটে বুড়োকে বলতে পারলো না শওকত। আরো অনেকক্ষণ বসে থেকে আরো আজে বাজে কথা বকে যখন বাইরে বেরিয়ে এলো শওকত, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোতে একটা দুটো করে বাতি জ্বলে উঠছে। সহসা নিজেকে কেমন যেন হাল্কা বোধ করলো শওকত। ভালোই হলো। বুড়ো আহমদ হোসেনকে কথাটি বললে হয়তো এখনি ওর সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে পড়তে হতো। একটা অজানা অচেনা অন্ধকার পথ। যার কিছুই জানে না সে। হয়তো একদিন ধীরে ধীরে সে পথের মোড়ে তিল তিল করে নিজেকে হারিয়ে ফেলতো শওকত। ফিরে যাবার ইচ্ছে থাকলেও পথ খুঁজে পেতো না। গুমরে মরতো। তারচেয়ে এই ভালো হলো।

শওকত ভাবলো একবার বাসায় ফিরে যাবে। কিন্তু মার্থার বাসায় ফিরতে অনেক দেরি হবে। রাত বারোটার আগে ফিরবে না সে। অত রাত পর্যন্ত কি করে মেয়েটা। বলছিল রাতকানা লোকটার সঙ্গে হিসেবের খাতা নিয়ে বসে। রোজ রোজ কিসের হিসেব ভাবতে গিয়ে রাস্তার মোড়ে থমকে দাঁড়ালো শওকত। একটা সন্দেহের রাক্ষস ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে নিচ্ছে ওকে। না না, মার্থা ও ধ ধরনের মেয়ে নয়। ওকে নিয়ে অকারণে শঙ্কিত হচ্ছে শওকত। মিছেমিছি ওর সম্পর্কে এতসব আজে বাজে চিন্তা করছে সে।

শওকত আর হাঁটতে শুরু করলে? কতক্ষণ এভাবে পথে পথে ঘুরলো মনে নেই। ইতিউতি অনেক কিছু ভালো সে। তারপর যখন পথে পা বাড়ালো তখন রাস্তা-ঘাটগুলো প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে! গলির লোকজন অন্য দিল এতক্ষণে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে থাকে। কিন্তু আজ সেখানে কিছু প্রাণের সাড় পেলো শওকত। কুষ্ঠ রোগীটা যেখানে বসে খাকে সে রকের ওপর অনেকগুলো লোকের ভিড়। শওকত অবাক হলো। বাসার সামনে একটা জীপ দাঁড়িয়ে। আশেপাশে কয়েকজন খাকি পোষাক পরা পুলিশের লোক। সবার চোখ বাড়ির ভেতরে। শওকতের পায়ের গতি শ্লথ হয়ে এলো। ধীরে ধীরে জটলার এক কোণে এসে দাঁড়ালো সে। না। কুষ্ঠ রোগীটার কিছু হয়নি। গলিত মাংসের পিণ্ডটা একপাশে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে আর পিটপিট করে তাকাচ্ছে সবার দিকে।

বাড়ির সামনে। করিডোরে। উঠোনে লোকের ভিড়। ছেলে বুড়ো মেয়ে। ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে সবাই। খলখল করে কথা বলছে। হাসছে দুঃখ করছে। ওদের কথা শুনে শরীরের রক্তটা ধীরে ধীরে হিমের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগলো ওর।

শওকত অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো। মার্থা।

উঠোনে অনেকগুলো পরিচিত মুখ সন্দেহকাতর চোখে বার বার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে ওর দিকে। শওকতের মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো। মার্থা। একি করলো মার্থা।

রাতকানা লোকটার দোকান থেকে ওষুধ চুরি করে নিয়ে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে মার্থা। ওকে থানায় আটকে রেখে বাসা সার্চ করতে এসেছে পুলিশ। ঘরের মধ্যেও অনেকগুলো চোরাই ওষুধ পাওয়া গেছে। চৌকির নিচে একটা বাক্সের মধ্যে লুকোনো ছিলো। আর পাওয়া গেছে একটা টিনের কৌটার মধ্যে রাখা নগদ সাতশ টাকা। টাকা আর ওষুধ সব সঙ্গে করে নিয়ে গেছে পুলিশের লোকেরা। উঠোনের মাঝখানে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো শওকত? চিন্তার সুতোগুলো যেন একটা একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিছু ভাবতে পারছে না সে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। চারপাশের অনেকগুলো সন্দেহকাতর দৃষ্টি খুঁটে খুঁটে দেখছে ওকে। হাসছে। কথা বলছে। বিদ্রূপের ধ্বনি জন্ম দিচ্ছে। নাচের মেয়ে সেলিনা। সংক্ষিপ্ত ব্লাউজের নিচে চেপে রাখা উদ্ধত যৌবন তার দিকে চেয়ে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। শওকতের মনে হলো ওদের দৃষ্টির নিচে যেন সমস্ত শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে ওর। আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো চিৎকার করে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে। মার্থা। মার্থা এটা কি করলো।

পরদিন দুপুরে রাস্তায় বেরিয়ে এসে একবার আকাশের দিকে তাকালো শওকত। ওর চোখ সোজা সূর্যের ওপরে গিয়ে পড়লো। সূর্যটি আগুনের মতো জ্বলছে। আর তার লকলকে শিখার উত্তাপে চারপাশের বাড়ির দেয়ালের ইটগুলো গরম হয়ে গেছে। গরমের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ঘরের দরজা জানালাগুলো বন্ধ করে রেখেছে বাড়ির গিন্নীরা। মেঝেটা পানি দিয়ে বারবার ধুয়ে মুছে নিচ্ছে কিন্তু গুমোট গরমের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

বাইরে বাতাস নেই।

মাঝে মাঝে হয়তো একটুখানি বইছে। কিন্তু সে হাওয়া গায়ে এসে লাগতে সহসা শিউরে উঠলো শওকত। মনে হলো কে যেন এক কড়াই গরম তেল ঢেলে দিলো ওর দেহের ওপর। রাস্তার পিচগুলো সূর্যের তাপে গলে গলে সরে যাচ্ছে নর্দমার দিকে। মানুষের পা, মোটর গাড়ির চাকা আর গরুর খুরের সঙ্গে উত্তপ্ত আলকাতরাগুলো উঠে গিয়ে সমস্ত রাস্তা জুড়ে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। রাস্তার পাশে বস্তির একদল ছেলে হল্লা করে মার্বেল খেলছে। অর্ধ উলঙ্গ দেহ বেয়ে ঘাম ঝরছে ওদের। দূরে একটা বাড়ির কার্নিশের কোণে বসে একা একটা কাক গলা ছেড়ে চিৎকার করছে।

গাছের ডালপালাগুলো একটুও নড়ছে না।

মানুষ গরু সবাই ছায়া খুঁজছে।

শওকতের মনে হলো পুরো শহরটায় যেন আগুন লেগেছে। দালান-বাড়িঘরগুলো সকলকে আগুনের শিখার নিচে দাউ দাউ করে পুড়ে ছাই করে দিচ্ছে।

কে জানে মার্থা এখন কোথায়। হয়তো হাজতে কি কোর্টে। ওর জামিন নেওয়ার জন্যে নিশ্চয় কেউ যাবে না। হয়তো মনে মনে শওকতের কথা ভাবছে মার্থা। ভাবছে সে যাবে। না। শওকত কি করবে কিছু ভাবতে পারছে না।

সে শুধু পথ হাঁটছে। উদ্দেশ্যবিহীন পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

তারপর ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে গেলো। গাছের পাতাগুলো একটা দুটো করে নড়তে শুরু করলো। আকাশের কোণে কয়েক টুকরো মেঘ উঁকি দিলো।

রাস্তায় মৃদু মৃদু বাতাস বইছে। বাড়ির আলিসায় ঝোলানো কাপড়গুলো একটু একটু দুলছে। অনেক দূরের আকাশে অনেকগুলো চিল বাতাসে ডানা মেলে একবার উপরে উঠছে আর নিচে নামছে আর মাঝে মাঝে চিঁ চিঁ শব্দে কাকে যেন ডাকছে।

তখনো পথে পথে হাঁটলো শওকত।

রাস্তায় কয়েকটা বাতাসের কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়ে ধুলো উড়লো। শুকনো পাতা ডাল থেকে ঝরে ছুটে গেলো। এ পথের মোড় থেকে অন্য পথের মোড়ে। জানালা-দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

আলিসায় ঝোলানো শাড়িটা পতপত করে উড়ছে। প্রচণ্ড বাতাসের দাপটে পুরো শহরটা যেন ভেঙ্গে পড়তে চাইছে এখন। রাস্তার লোকজন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে।

প্রথমে বড় বড় ফোঁটা তারপর বেগে নেমে এলো বৃষ্টি। সামনের বড় রাস্তায় পেছনের ছোট গলিতে। বাড়ির ছাদে। কার্নিশে। বৃষ্টি নেমেছে। সারা গায়ে বৃষ্টি মেখে ঘরে এসে ঢুকলো শওকত। সমস্ত বাড়িতে কোন মানুষের সাড়াশব্দ নেই। রাতনামার সঙ্গে সঙ্গে দরজার খিল এঁটে দিয়েছে ওরা। বৃষ্টির ছাট এসে বারান্দায় পানি জমে গেছে। বাড়ির উঠোনের মধ্যে ঢুকে অনন্ত বাতাস অজগরের মতো ফুঁসছে।

ঘরে ঢুকে ভেজা জামাটা খুলতে যাবে এমন সময় শওকত শুনলো মাতাল কেরানির বউটা কাঁদছে। মাতালটা চিৎকার করছে আর মারছে ওকে। বাইরে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো একটা। জানালার পাশে সরে এলো শওকত। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বন্ধ দরজাটার দিকে।

করুণ বিলাপের স্বরে কাঁদছে বউটা। মাতাল কেরানি এখনো মারছে ওকে। বিদ্যুতের চমক এসে শওকতের চোখে লাগলো। সহসা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো শওকত। দৌড়ে গিয়ে একটা প্রচণ্ড লাথি মারলো ভেজানো দরজাটার ওপর। খিল ভেঙ্গে দরজাটা খুলে গেলো।

বাইরে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। আর সেই বিদ্যুতের আলোয় শওকত দেখলো পাশে টেবিলের ওপরে রাখা একটা দা। আর দেখলো মাতাল কেরানি আর তার বউটা একজোড়া শবের মতো দরজার দিকে তাকিয়ে।

শওকতের মাথায় খুন চেপে গেলো। হঠাৎ দাওটা হাতে তুলে নিয়ে মাতালটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে। তারপর প্রচণ্ড ঘৃণায় ওর মাথায় আঘাত করতে লাগলো। এ যেন তার আজীবন সঞ্চয় করা আক্রোশ। যে সমস্ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। ভালো মন্দ পাপ পুণ্য ভুলে গেছে সব। বাইরে আবার বিদ্যুৎ চমকালো। একটা তীব্র আর্তনাদ করে মাতাল স্বামীর বুকের উপর লুটিয়ে পড়লো তার বউ।

মুহূর্তে কোন জ্ঞান ফিরে পেলো শওকত। হাতের দাটা রক্তে চপচপ করছে। মানুষের মগজ ইস্পাতের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। হাতে দাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো শওকত। লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে ও রীতিমত হাঁপাচ্ছে। সরু বারান্দাটা পেরিয়ে নিজের ঘরের সামনে আসতে চমকে উঠলো শওকত।

দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সেলিনা। নাচের মেয়ে সেলিনা। কাঁচা হলুদের মতো আর গায়ের রঙ। তামাটে চোখ। গাঢ় বাদামি অধর। শওকতের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা। বাইরে তখনো বাজ পড়ছে। ঝড় হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পানির ছাট এসে ভিজে গেছে বারান্দাটা।

হঠাৎ সেলিনার একখানা হাত শক্ত করে মুঠোর মধ্যে ধরে টানতে টানতে ওকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলো শওকত। সিঁড়ি বেয়ে নিচে করিডোরে। করিডোর পেরিয়ে উঠোন। উঠোন পেরিয়ে আরেকটা করিডোর। তারপর রাস্তা। মেয়েটা একটুও বাধা দিলো না। একটা প্রশ্ন করলো না কোথায় নিয়ে যাচ্ছো।

রকের ওপরে বসে থাকা কুষ্ঠ রোগীটা বৃষ্টির ছাট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এক কোণে সরে সে যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে একবার তার দিকে ফিরে তাকালো শওকত? তারপর সেলিনার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে সেই অন্ধকার রাতে, সেই প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে সামনে ছুটতে লাগলো শওকত! রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরোর সঙ্গে হোঁচট খেয়ে অস্ফুট কাতারোক্তি করে মাটিতে ছিটকে পড়লো সেলিনা। দুহাতে ওকে আবার তুলে নিলো শওকত। তারপর, এই ঝড়, এই বৃষ্টি, এই অন্ধকার আর এই শহরকে দুহাতে ঠেলতে ঠেলতে আবার জুটতে লাগলো ওরা। বৃষ্টির আলিঙ্গনে সারাদেহ ভিজে চুপসে গেছে ওদের। এ বৃষ্টি যেন মার্থার চোখে জল। অন্ধকার হাজতে বলে হয়তো তখন নীরবে কাঁদছে।

 

তারপর।

তারপর একটা সুন্দর সকাল।

বুড়ো রাত বিদায় নেবার আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। তবু তার শেষ চিহ্নটুকু এখানে সেখানে এখনো ছড়ানো। চিকন ঘাসের ডগায় দুএকটা পানির ফোঁটা সুর্যের সোনালি আভায় চিকচিক করছে।

শওকতের বুকে মুখ রেখে; খড়ের কোলে দেহটা এলিয়ে দিয়ে; সেলিনা ঘুমাচ্ছে। ওর মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। ঠোঁটের শেষ সীমানা শুধু একটুখানি হাসি চিবুকের কাছে এসে হারিয়ে গেছে। ওর হাত শওকতের হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখা। দুজনের ঘুমোচ্ছে ওরা।

শওকতের মুখে দীর্ঘ পথ-চলার ক্লান্তি। মনে হয় অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলো ওরা। চুলের প্রান্তে এখনো তার কিছু রেশ জড়ানো রয়েছে। সহসা, গাছের ডালের বুনো পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেলো। মটরশুটির ক্ষেত থেকে একটা সাদা খরগোশের বাচ্চা ছুটে পালিয়ে গেলো কাছের অরণ্যের দিকে। খড়ের কোলে জেগে উঠলো অনেকগুলো পায়ের ঐক্যতান।

আঠারো জোড়া আইনের পা ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে এসে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের। ওরা তখনো ঘুমোচ্ছ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *