কয়লা কুড়োন ছেলেমেয়ের দল ঝুড়ি মাথায় বাড়ি ফিরছে।
নিজেদের মধ্যে অনর্গল কথা বলে চলেছে এরা। রেলওয়ে ইয়ার্ডের কালো ধোয়ার ফাঁকে আকাশ দেখা যায় না। চারপাশে ইঞ্জিনের সিটি আর পুশ পুশ শব্দ। বিকেলের রোদে চিকচিক করছে রেল লাইনগুলো। একটা দুটো করে সেগুলো ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো শওকত? মুখ তুলে তাকালে দেখলো, অদূরে একটা পানির ট্যাঙ্কের নিচে হারুন আর জাহানারা। নিবিড় ভঙ্গীতে পায়চারি করছে আর কি যেন আলাপ করছে ওরা।
শওকতের পায়ের গতি শ্লথ হয়ে গেলো।
চারপাশে কত লোক আসছে, যাচ্ছে, কারো প্রতি ক্ষেপ নেই। নিবিষ্ট মনে দুজনে দুজনের কথা শুনছে। বলছে। এরই নাম বুঝি ভালাবাসা শওকত ভালো। আর ভাবতে গিয়ে নিজের জীবনের একটা অসম্পূর্ণ ছবি সহসা স্মৃতির কোণে উঁকি দিয়ে গেলো ওর। শহরে নয় গ্রামে।
আমন ধানের মরশুম তখন। সারা মাঠ জুড়ে সোনালি ফসলের সমারোহ। চাষিরা দল বেঁধে ধান কাটছে। গলা ছেড়ে গান গাইছে। ভারায় ভারায় ধান কাধে করে বয়ে এনে বাড়ির উঠোনে পালা দিচ্ছে ওয়া। ওদের মুখে হাসি, কোমরে লাল গামছা জড়ানো। সবার চলার মধ্যে একটা চপল ভঙ্গী। ব্যস্ততার ভাব। চাষী-বউদের পরনে লাল পাড়ের চেক শাড়ি। উঠোনে গরু দিয়ে ধান মাড়াচ্ছে ওরা। রোদে মেলে দিয়ে শোকোচ্ছে সেগুলো। দল বেঁধে ধান ভানছে ঢেঁকিতে।
সবার চোখে মুখে মানে এক অসীম আনন্দের আমেজ। তার মাঝে একটি মেয়ে। অনেকটা যেন এই জাহানারার মতো দেখতে। শেখদের ছোট মেয়ে আয়েশা। বারো ছাড়িয়ে তোয়োয় পড়ছে। যৌবনের প্রথম ঢেউ এসে সবে তার দেহে প্রথম চুম্বন এঁকে দিয়ে গেছে। তার অপুষ্ট বুকে আর অপূর্ণ অধরে তখনো কারো ছোয়া লাগে নি। শীতের শিশির ঝরা সকালে বাড়ি বাড়ি মোয়া বিক্রি করে বেড়াতো সে। হঠাৎ কখনো গাছের ডালে পাখি ডেকে উঠলে চমকে সেদিকে তাকাতো। দূরে কোন রাখালিয়া বাঁশির শব্দ শুনলে ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়াতে মেয়েটি। ধান ক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটতে গিয়ে কখনো কোন দমকা বাতাসে গায়ের আঁচলখানা সরে যেতে লজ্জায় রাঙা হয়ে চারপাশে সভয়ে দেখতে আয়েশা। কেউ দেখে ফেললো নাতো?
তখনো সারা গাঁয়ে নবান্নের উৎস। চাষী-বউরা রসের সিন্নি রেঁধে মসজ্জিদে পাঠাচ্ছে। বাড়ি বাড়ি নতুন গুড়ের পিঠে তৈরি করছে ওরা। রাতভর পুঁথি পড়া আর কবি গানের আসর।
এমনি সময়ে আয়েশার খবর শুনে আঁতকে উঠলে সবাই। গ্রাম ছেড়ে দলে দলে মাঠে ছুটে এলো ছেলে বুড়ো মেয়ে। সোনালি ধানের বুক উঁচু ক্ষেত। তার মাঝখানে শুয়ে জীবনের শেষ ঘুম ঘুমাচ্ছে আয়েশা। চারপাশের পাকা ধান গাছগুলো
জুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে আছে। অনেকগুলো পাকা ধান ঝরে পড়ে আছে শুকনো মাটির বুকে! যে টুকরিতে করে মোয়া বিক্রি করতো সেটাও পাওয়া গেলো অদূরে। মোয়গুলো সব ছড়িয়ে আছে চারপাশে। সোনালী ধানের কোলে শুয়ে আছে আয়েশা! ওর সারা মুখে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ। ওর অপুষ্ট স্তনের কোল ঘেঁষে দুটো ক্ষত। রক্তের একজোড়া ফিনকি বোটা ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়েছে একগোছা ধানের শীষের উপরে।
হঠাৎ একটা ট্রেনের তীব্র হুইসেলের শব্দে সম্বিত ফিরে পেলো শওকত। ও যে লাইনে দাঁড়িয়ে সেদিকে এগিয়ে আসছে ট্রেনটা ইঞ্জিনের ভেতর থেকে মুখ বের করে বুড়ো ডাইভার চিৎকার করে উঠলো আন্ধ্যে হোয়া?
শওকত তাকিয়ে দেখলো, জাহানারা আর হারুন অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে। এতক্ষণের একান্ত ঘনিষ্ট আলাপে ওদের ছন্দপতন ঘটলো।
শওকত নিজেই যেন লজ্জা পেলো। কোন দিকে যাবে ঠিক করতে না পেরে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে ফিরে গেল শওকত।
কাউন্টারে অনেক লোকের ভিড়
সবার সঙ্গে একগাল হেসে কথা বলছে মার্থা। সবার সব রকমের চাহিদা চটপট পূরণ করতে হচ্ছে ওকে। ক্রেতাদের হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে এক নজর চোখ বুলিয়েই শো কেসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। স্যরি কড লিভার অয়েল ফুরিয়ে গেছে। বিকাডেক্স আছে। বসুন, এক্ষুণি দিচ্ছি।
কি বললেন? হ্যাঁ, সকালে একটা। দুপুরে একটা ব্রার রাতে ঘুমোবার আগে একটা। আচ্ছা থ্যাঙ্কস। পয়সাগুলো নিয়ে গিয়ে রাতকানা লোকটার হাতে পৌঁছে দিয়ে আবার কাউন্টারে ফিরে আসচ্ছে মার্থা।
গুড ইভিনিং মিস্টার হোসেন, আপনার শরীর এখন কেমন আছে, ভালোতো?
মার্থার চোখেমুখে অফুরন্ত হাসির ফোয়ারা।
ওটাই ওর কাজ।
ক্রেতাদের অসন্তুষ্ট করলে চলবে না। তাদেরকে সব সময় খুব আদরে সোহাগে সম্বোধন করতে হবে। যেন একবার এ দোকানে এলে বারবার ফিরে আসে।
বুড়ো আহমদ হোসেন বলে, শালার বিকার। বিকার। সব ব্যাটা বিকারে ভুগছে। মেয়ে দেখিয়ে টাকা রোজগারের ফন্দি, খদ্দের বাড়ানোর কারসাজি। পনেরো বছর ধরে অলি-গলি সব চষে ফেললাম আর এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারিনে। শোন, এক কেরানির কিচ্ছা বলি। বেতন মাসে দেড়শো টাকা পায়। পরিবারে পুষ্যি হলো আটজন। সত্তর টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হয়, রইলো কত? আশি টাকা। ওই আশি টাকায় আটটি মানুষ এই শহরে বেঁচে থাকতে পারে? পারে না। কিন্তু পারছে। ঠিক পেরে যাচ্ছে। বলবে সেটা কেমন করে। তাহলে শোন, সেই কেরানির একটি মেয়ে আছে। মেয়েটি সবে পনেরোয় পড়ি পড়ি করছে। যখনি টাকার টান পড়ে তখনি পিতৃদেব কন্যাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে সামনের মেসে পাঠিয়ে দেন। না, কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। টাকা ধার চাইতে। আর ওই যে মেসের কথা বললাম, ওখানে থাকে আট দশটি জোয়ান ছেলে। তিরিশের ধারে পাশে বয়স। বউ চালাবার মুরোদ নেই বলে বিয়ে করতে সাহস পাচ্ছে না, কিন্তু হাজার হোক পুরুষ মানুষতো, মেয়ে দেখলেই মজে যায়। হাতে টাকা না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে ধার করে এনে মেয়েটিকে ধার দেয়। তারপর ধরো একদিন সে টাকা ফেরত চাইতে এলো কেউ। পিতৃদেব বাড়িতে থেকেও নেই। দরজা খুলে মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ালো। করুণ চোখ জোড়া মেলে তাকালো ছেলেটির দিকে।
ব্যাস। আর কি চাই। ছেলের মস্তিষ্ক ততক্ষণে গুলিয়ে গেছে। বলতে গিয়ে বিকার গ্রস্ত রোগীর মতো বার বার হাসে বুড়ো আহমদ হোসেন।
বাইরের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাউন্টারে দাঁড়ান মার্থার ব্যস্ততা লক্ষ্য করলো শওকত। তারপর ভেতরে পা দিতেই মার্থার চোখ পড়লো ওর দিকে।
এসসা, আস্তে করে ওকে কাছে ডাকলো মার্থা। দেয়াল ঘড়িটার দিকে এক নজর তাকিয়ে নিয়ে বললো, মিনিট দশেক তোমাকে বসতে হবে। তারপর আমার ছুটি।
আরেকজন খদ্দেরের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে আবার কাজে লেগে গেলো মার্থা। শওকত বললো, আমি তাহলে একটু ঘুরে আসি।
ঘুরে আসার নাম করে আবার চলে যেও না যেন। শশা-কেস থেকে কি একটা ওষুধ খুঁজতে গিয়ে জবাব দিলো মার্থা।
শওকত বললো, না এই বাইরের ফুটপাথে ঘুরবো।
মার্থা বললো, থ্যাঙ্কস্। ওকে নয়, একজন গ্রাহককে। কাল রাত থেকে ওরা আপনির পালা চুকিয়ে দিয়ে দুজনে দুজনকে তুমি বলে সম্বোধন করছে।
প্রেম নয়। এমনি।
কাল রাতে ভাত খেতে বসে মার্থা বলছিলো, না, আপনি আর আমাকে আপনি আপনি করবে না তো, ভীষণ খারাপ লাগে।
ঠিক আছে, আজ থেকে না হয় তোমাকে তুমিই বলবো।
শওকত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছে। অবশ্য তুমি যদি আবার আপনি করে ডাকো, তাহলে কিন্তু সব গোলমাল হয়ে যাবে।
কেন? আমি আপনার চেয়ে বয়সে ছোট। আমি যদি আপনি বলি, সেটা ভালোই দেখাবে।
ভালো মন্দ বুঝিনে বাবা। বুড়ো আহমদ হোসেনের কাছে গিয়ে একদিন শুনে এসো। ছোট বড় বলে কিছু নেই। খোদা আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে তৈরি করেছেন। শুধু দুনিয়াতে পাঠবার সময় একটু আগে পরে পাঠাচ্ছেন। বুঝলে?
শুনে শব্দ করে হেসে উঠেছিলো মার্থা। তোমার কি মার্থা খারাপ হয়েছে?
হয়নি। তবে এভাবে আরো মাস কয়েক বেকার থাকলে মার্থাটা আপনা থেকেই খারাপ হয়ে যাবে। বলতে গিয়ে গলায় ভাত আটকে গিয়েছিলো ওর।
এক গ্লাস পানি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে মার্থা উৎকণ্ঠিত স্বরে বলেছিলো, কি হলো?
ও কিছু না। পানিটা খেয়ে নিয়ে শওকত জবাব দিয়েছিলো। অন্যের রোজগারের ভাত ততা, গলা দিয়ে সহজে নামতে চাইছে না। কথাটা বলে ফেলে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো সে।
মার্থা কিন্তু সহসা কোন জবাব দিতে পারে নি। শুধু একবার চমকে তাকিয়েছিলো ওর দিকে। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলেছিলো, আমি তো তোমাকে বিনে পয়সায় খাওয়াচ্ছিনে। যে দিন টাকা আসলে হাতে, হিসেব করে সব চুকিয়ে দিয়ো।
তারপর আর একটা কথাও বলে নি মার্থা।
সকালে যখন ওর ঘরে চা আর নাস্তা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলো তখন চুপ করে ছিলো সে। ওকে নিঃশব্দে চলে যেতে দেখে শওকত পেছন থেকে ডেকেছিলো, শোন।
কি।
বিকেলে দোকানে থাকবে তো?
কেন?
না এমনি। ভাবছিলাম ওদিকে একবার যাবো।
দশ মিনিটের কথা বলে আধঘণ্টা পরে বাইরে বেরিয়ে এলো মার্থা। শওকত তখনো ফুটপাতে পায়চারি করছে।
অনেক দেরি করিয়ে দিলাম তোমার, পেছন থেকে এসে বললো মার্থা। তুমি নিশ্চয় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার শ্রাদ্ধ করছিলে, তাই না?
হ্যাঁ, করছিলাম বৈকি।
সত্যি? মার্থারের চোখে মুখে হাসি। আজ সকালের মার্থা যেন বিকেলে এসে অনেক বদলে গেছে। একটা ফুটপাত ছেড়ে আরেকটাতে পা দিয়ে মার্থা বললো, শোন, এখন বাসায় ফিরবো না। একটা ছবি দেখবো আজ।
ছবি।
সিনেমা?
হ্যাঁ? তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে। অবশ্য টিকেটের টাকাটা আমি পরে তোমার কাছ থেকে কেটে নেবো। ভয় পেয়ো না। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে এ রকম বাকি-বকেয়া চলে।
শওকত বুঝলো। সুযোগ পেয়ে ওকে একটা খোঁচা দিলো মার্থা। সারাদিন কি করে কাটালে? পথ চলতে চলতে মার্থা আবার শুধালো।
শওকত বললো, রোজ যেমন কাটে।
কোথাও গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
কিছু হলো।
না।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো দুজনে। সিনেমা হলের সামনে এসে মার্থা বললো, আজ আমি তোমার কথা একজনকে বলেছি।
কে।
তুমি চিনবে না। আমাদের একজন পার্মেনেন্ট খদ্দের, সরকারী অফিসের কর্তা ব্যক্তি, দুচারটে লোককে চাকুরি দেয়ার ক্ষমতা আছে ওর।
কি বললে?
বললাম, তোমার একটা চাকুরি দরকার। এর আগে আরো অনেক জায়গায় কাজ করেছে।
অভিজ্ঞতা আছে প্রচুর।
কি বলে আমার পরিচয় দিলে? এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে টাকা বের করলো মার্থা। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি টিকেট কিনে এক্ষুণি আসছি। চারপাশের লোকজনকে দুহাতে সরিয়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলো মার্থা।
রাতে যখন সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরলো ওরা, তখন পুরো পাড়াটা ক্লান্ত কাকের মতো ঝিমুচ্ছে। শুধু কুষ্ঠ রোগীটা এখনো জেগে। ওর চোখে ঘুম নেই।
উঠোনে পা দিয়ে মার্থা চাপা গলায় বললো, ছাদে একটা মেয়ের ছায়া দেখলাম।
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ছাদের দিকে তাকালো শওকত।
কোথায়?
আমাদের পায়ের শব্দ শুনে সরে গেছে।
ও কিছু না।
আলকাতরার মততা অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে পকেট থেকে দিয়াশলাইটা বের করে আগুন জ্বালালো শওকত।
মার্থা হঠাৎ প্রশ্ন করলো, আচ্ছা তুমি ভূতে বিশ্বাস করো? মানে ঘোষ্ট।
হঠাৎ ভূতের কথা কেন?
না, এমনি। বল না, বিশ্বাস করো?
করি।
কোন দিন দেখেছো?
হ্যাঁ।
নিজ চোখে?
হুঁ।
সত্যি? মার্থা চোখ বড় বড় করে তাকালো ওর দিকে।
শওকত আরেকটা কাঠি জ্বালতে জ্বলতে বললো, দরজা খোল।
দিয়াশলাই-এর স্বল্প আলোতে তালা খুলে ঘরে ঢুকলো ওরা। মার্থা একটা মোমবাতি জ্বেলে টেবিলের ওপরে রাখলো।
সত্যি, তুমি নিজ চোখে দেখেছো?
কি।
ভূত!
হ্যাঁ। ইচ্ছে করলে তোমাকেও দেখাতে পারি। ওই দেখো বলে মার্থার পেছনের দেয়ালে পড়া তার নিজের লম্বা ছায়াটাকে হাতের ঈশারায় দেখালো শওকতকে।
নিজের ছায়াটার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিলো মার্থা। বাব্বাহ, আমি ভেবেছিলাম বুঝি সত্যি। বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো সে। তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। শওকতের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললো, আমি দেখতে ভূতের মতো, তাই না?
শওকত অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিলো, আমি কি তাই বললাম নাকি? ওর কথাগুলো মার্থারের কানে গেলো না। মনে হলো সে যেন কি চিন্তা করছে।
শওকত বললো, চুপ করে গেলে যে
মার্থা স্নান হেসে বললো, জানো, ছোট বেলায় রাস্তার ছেলেমেয়েরা আমাকে কালো পেত্নী বলে ডাকতো। আমি দেখতে খুব বিশ্রী, তাই না?
বারে, কালো হলে বুঝি কেউ দেখতে বিশ্রী হয়? শওকত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো। সত্যি বলছি, তুমি কিন্তু রীতিমত সুন্দরী।
মার্থা মুখ তুলে তাকালো ওর দিকে। ওর চিবুকে আর চোখে এক ঝলক লজ্জা আর ঠোঁটময় এক টুকরো কৌতূকের হাসি কাঁপছে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আস্তে করে বললো, সে আমি আর সেই বাচ্চাটি নেই বুঝলে। যাকগে, এ কথা বলার জন্যে তোমাকে আজ একটা স্পেশাল খাবার খাওয়াবো। তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি ওগুলো গরম করে নিচ্ছি।
আরেকটা মোমবাতি ধরিয়ে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো মার্থা। পাশাপাশি দুখানা ঘর ওর। একটাতে ও শোয়।
আরেকটাকে বৈঠকখানা হিসাবে ব্যবহার করে। খান কয়েক বেতের চেয়ার। একটা টেবিল। আর কোন আসবাব নেই ঘরে। দেয়ালে দুটো ছবি টাঙ্গাননা। একটা মাতা মেরির, শিশু যিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন তিনি, আরেকটা ক্রুশে বিদ্ধ পিতা যিশুর ছবি। খেতে বসে মার্থা বললো, তুমি এক কাজ করবে?
কি?
তোমার ঘরটা ছেড়ে দাও।
তারপর?
এ ঘরে এসে থাকো। মার্থা সহজ গলায় বললো, দুটো কামরা আমার কোন কাজেই আসে না। একটাতে তুমি অনায়াসে থাকতে পারো। ভয় নেই, মাসে মাসে ভাড়ার টাকাটা ঠিক কেটে রাখবো। তাতে করে আমার সুবিধে হবে, আর তুমিও আপাতত নগদ বাড়ি ভাড়া দেবার হাত থেকে বেঁচে যাবে।
পাগল না মার্থা খারাপ! শওকত সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো।
শওকত শান্ত স্বরে বললো, তাহলে আর এ বাড়িতে থাকতে হবে না। সবাই মিলে ঝেটিয়ে বের করবে।
ও। মার্থা এতক্ষণে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ঠিক আছে, মাঝখানের দরজাটা না হয় বন্ধ করে দেবো আমরা। তোমার এক ঘর, আমার এক ঘর। অন্য অনেক ভাড়াটেরা তো ওভাবেই আছে। কি, রাজি?
শওকত ম্লান হেসে বললো, দাঁড়াও, চট করে কিছু বলতে পারছি না। একটু চিন্তা করতে হবে। সব কিছুতেই তোমার অমন চিন্তা করতে হয় কেন বলতো? মার্থার কণ্ঠস্বরে শাসনের ভঙ্গী। আর কোনকথা শুনতে রাজি নই। কাল পরশুর মধ্যে তুমি শিফট করছে।
এর কোন উত্তর দিতে পারলো না শওকত। শুধু মনে মনে ভাবলো মার্থা যেন ওর সব কিছুর ওপরে ধীরে ধীরে তার কর্তৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভাবতে গিয়ে মৃদু হাসলো শওকত। মার্থা ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, হাসছো কেন?
শওকত হাসি থামিয়ে বললো, এমনি।
মার্থা মাথা নাড়লো, মোটেই না নিশ্চয়ই তুমি কিছু ভাবছিলে। মোমের আলো মার্থার মসৃণ ত্বকে একটা স্নিগ্ধ আভার জন্ম দিয়েছিলো।
শওকত আস্তে করে বললো, ভাবছিলাম তুমি একটা আস্ত পাগল। রাতে কোলাহলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো শওকতের। জেগে উঠে মনে হলো পুরো বাড়িটা ভেঙ্গে পড়বে। ছাদে, বারান্দায়, সিঁড়িতে, উঠোনে ছেলে বুড়ো মেয়ের ভিড়। সবাই কলকল করে কথা বলছে। হাত-পা ছুঁড়ছে। কিন্তু কারো কথা স্পষ্ট করে বোঝবার কোন উপায় নেই।
জেগে উঠেই মার্থার কথা মনে হলো শওকতের। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলো সে। সেখানে লোকজনের ভিড়। ওদের কোন কথা শোনা কিম্বা ওদের কাছ থেকে কিছু জানার অপেক্ষা করলো না শওকত। ভিড় ঠেলে সিঁড়ির দিকে এড়িয়ে এলো সে। ওর ধাক্কা খেয়ে কে একজন চিৎকার করে উঠলো। আরে অ মিয়া চোখে দেহেন না। ধাকান ক্যান।
মাঝ সিঁড়িতে মাৰ্ধার সঙ্গে দেখা হলো। সে উপরে আসছিলো। তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।
কি হয়েছে? উৎকণ্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করলো মার্থা।
কি হয়েছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললো শওকত।
ওহ্। মার্থা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে অনেকটা হালকা করে নিলো সে। আমি ভেবেছিলাম বুঝি তোমার কিছু হয়েছে। ওর বিবর্ণ মুখখানা এতক্ষণে স্বাভাবিকতায় ফিরে এসেছে। উহ, আমি যা ভয় পেয়েছিলাম। বলতে গিয়ে সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠলো ওর।
শওকত বললো, কিন্তু।
জুয়াড়িদের একজন চিৎকার করে উঠলো। ওসব কিন্তু টিন্তু বুঝিনে। বাড়িটা একটা বেশ্যাখানা নয় যে, যার যেমন খুশি তাই করবে। মাওলানা সাহেব বললেন, তওবা, তওবা। এসব কোন্ দেশী বেলেল্লাপনা আঁ।
শওকত আর মার্থা এতক্ষণ নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলো যে এই হট্টগোলের আসল হেতু খোঁজার অবকাশ পায় নি। হাতের কাছে মোহসীন মোহসিন মোল্লকে পেয়ে শওকত জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে।
অ খোদা, এতক্ষণেও কিছু শোনেন নি আপনি। মোহসিন মোল্লা অবাক হলো। ও কি কিছু বলার আগে মোবারক আলী বললো, কমু কি হালার, কলিকালের কথা। ছাদের উপরে মতিন সাবের মাইয়া আর আজমল সাহেবের ছেইলা। বলতে গিয়ে ফ্যাসফ্যাস গলায় হাসলো সে।
মোহসিন মোল্লা ওর অসম্পূর্ণ কথাটা শেষ করে দিয়ে বললো, প্রেম করছিলো। ধরা পড়েছে।
মার্থা তাকালো শওকতের দিকে। ওর চোখমুখ রাঙা হয়ে উঠেছে। জাহানারাদের ঘরের দরজা জানালাগুলো সব বন্ধ। লজ্জায় বাইরে বেরোবার সাহস পাচ্ছে না হয়তো। বুড়ো মাস্টার, কারো সাতে পাঁচে থাকে না সেই সকালে বেরিয়ে যায়, বিকেলে ফেরে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা কথা বলেনা। আজ দশ বছরের ওপরে হলো এ বাড়িতে আছে কিন্তু কারো সঙ্গে কিছু নিয়ে একটু বচসাও করেনি কোনদিন। এ সময়ে তার মনের অবস্থাটা সহজে অনুমান করতে পারে শওকত।
মার্থা বললো, নাচিয়েদের ওখানে সেলিনা বলে একটা মেয়ে আছে না! ও নাকি প্রথমে দেখেছিলো বেশ কদিন আগে। জাহানারার মাকে ও হুশিয়ার করে দিয়েছিলো। কিন্তু ওর কথা কেউ বিশ্বাস করে নি।
আজমল আলীর ঘরে বাতি জ্বলছে। ছেলের বাবা তিনি। তার এত লজ্জার কিছু নেই। জোয়ান বয়সে ছেলেরা অমন এক আধটু ফষ্টিনষ্টি করে। তবু ছেলেকে যে তিনি শাসন করেন নি তা নয়। উত্তম-মধ্যম কিছু দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ইতিমধ্যে ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছেন। জাহানারাদের চৌদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না তিনি।
মতিন মাষ্টারের বদ্ধ ঘরে বাতি জ্বলছিলো। এবার সেটাও নিভে গেলো। প্রতিবাদ করার মতো কিছু নেই ওদের। মেয়ে দোষ করেছে। হাতেনাতে ধরা পড়েছে। লোকে এখন কুৎসা গাইবেই। জোর করে ওদের মুখ বন্ধ করার কোন মন্ত্র কারো জানা নেই।
বারান্দা আর উঠোনের ভিড়টা অনেকখানি হাল্কা হয়ে গেছে।
নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেছে অনেকে। কিন্তু কথার খৈ ফুটা এখনো বন্ধ হয়নি।
শওকত দেখলো বউ-মারা কেরানির বউটা বারান্দার এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ঘোমটার ফাঁকে চারপাশে চেয়ে চেয়ে দেখছে সে।
জুয়াড়িরা বারান্দায় তাস নিয়ে বসে গেছে। বাকি রাতটা আর ঘুমিয়ে কি হবে। ভোরে ভোরে যারা কাজে বেরিয়ে যায় ওদেরই দুএকজন ইতিমধ্যে কলতলায় স্নান পর্ব সারার কাজে লেগে গেছে। শওকত বললো, ঘরে যাও মার্থা।
মার্থা বললো, আমার আর ঘুম আসবে না। তার চেয়ে এক কাজ করি শোন, তুমি বসো। আমি চট করে দুকাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি।
শওকত কোন জবাব দিবার আগে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো মার্থা। বাইরে দুএকটা কাক ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। ভোর হবার আর দেরি নেই।