হুঁ, তারপর, বলো বলে যাও, থামলে কেন? চায়ের কাপটা শব্দ করে পিরিচের ওপরে নামিয়ে রাখলো বুড়ো আহমদ হোসেন। ঘিঞ্জি-গলির মাথায়, দরমায়-ঘেরা রেস্তোরাঁর অসমতল টুলের ওপরে দুজনে বসে।
শওকত বললো, বললাম তো সব। আর কী বলবো।
মুখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে, কী যেন আটকে ছিলো সেটা বের করলো বুড়ো আহমদ হোসেন। ভেজা আঙুলটা নাকের কাছে এনে ঝুঁকলো। তারপর বিড়বিড় করে বললো, শালার তুমি একটা উল্লুক। মেয়েটাকে চুমু দিতে গিছলে কেন, কামড়ে দিতে পারলে না। কসম করে বলছি, তাহলে আর কাঁদতো না ও। আরে বাবা, এসব মেয়ে আমার অনেক দেখা আছে। সতেরো বছর ধরে দেখছি।
শওকত সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো। না না, তুমি মার্থাকে জানো না। ও খুব ভালো মেয়ে।
ভালো? কথাটা বলতে গিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো বুড়োটা। কোন ব্যাটা আছে এই শহরে, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে আমি ভালো। সব জোচ্চোর। বদমাশ। আমার ছেলেটাকে যেদিন কুড়ি বছর ঠুকে দিলো সেদিন বুঝে ফেলেছি, চিনি ফেলেছি সবাইকে।
বাদামতলির নিষিদ্ধ এলাকায় কী একটা খুনের মামলায় জড়িত হয়ে ছেলে তার জেল খাটছে। তার কথা মনে পড়ায় সহসা কথার বল্গায় লাগাম টানলো বুড়ো। বার্ধক্যের ছানি পড়া চোখজোড়া ছলছল করছে। অকস্মাৎ চিৎকার করে উঠলো সে। বাদামতলি খারাপ।
বাদামতলি খারাপ। আর তোমরা কী? ওই তো ব্যাটা আলি খান কন্ট্রাক্টর। ফরসা জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। বুঁইঝুঁই গাড়ি হাঁকায়। আলিশান বাড়িতে থাকে। তিন তিনটে বউ ঘরে শালার। কেউ খোঁজ রাখে? রোজ রাতে দুই বউকে ব্যাটা বড় বড় সাহেবদের বাড়িতে ভেট পাঠিয়ে কন্ট্রাক্ট বাগায়। একটাকে রেখে গিয়েছে নিজের জন্যে। ওটা কাউকে ছুঁতে দেয় না। কেউ বেঁ জ রাখে? বলতে গিয়ে খকখক করে কিছুক্ষণ কাশলো সে। মুখে-আসা থুতুগুলো আবার গিলে নিয়ে বললো-যাকগে, তোমার একটা চাকরির দরকার বলছিলে, তাই না?
হ্যাঁ, যাই পাও একটা জুটিয়ে দাও। যদি তোমার খোঁজে থাকে। উৎসাহে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে এলো শওকত।
শেষ চাটুকু একঢেকে গিলে নিয়ে বুড়ো আহমদ হোসেন বললো, দিতে পারি যদি করতে রাজি থাকো। চাকরি নয়। তবে চাকরিও বলতে পারো।
কি? শওকতের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
টুলের ওপরে একখানা পা তুলে নিয়ে উরু চুলকাতে চুলকোতে কী যেন ভাবলো বুড়ো। ভেবে বললো, কিছু না এই এদিকের মাল ওদিক করা আর কী?
তার মানে?
শওকতের সপ্রশ্ন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হেফাঁকলা দাঁত বের করে নতুন বিয়ে করা বউ–এর মতো হাসলো বুড়ো আহমদ হোসেন। শোনো, তাহলে খুলেই বলি। তোমার কাজ হবে, যেই সন্ধে হলো অমনি, কয়েকটা জায়গা দেখিয়ে দেবো তোমায়, ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর কয়েকটা লোক দেখিয়ে দেবো তোমায়, প্রথম প্রথম অবশ্যই তোমার চিনে নিতে কষ্ট হবে, তারপর মাসখানেক কাজ করলেই ওদের ভাবভঙ্গি দেখে তুমি ঠিক বের করে নিতে পারবে। এই বের করাটাই হচ্ছে আসল কাজ। তারপর, একটা কথা শিখিয়ে দেবো তোমায়, এই কথা গিয়ে ওদের কানে কানে বলবে। ব্যাস্। তারপরের কাজটা এক্কেবারে পানির মত সহজ! কতকগুলো বাড়ি দেখিয়ে দেবো তোমায়। লোকগুলোকে সঙ্গে করে এনে সেই বাড়িগুলোতে পৌঁছে দিয়ে যাবে। ছানিপাড়া চোখ পিটপিট করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো বুড়ো আহমদ হোসেন। কি, রাজি?
শওকত উসখুস করালো কাজটা ঠিক বুঝলাম না।
বুঝবে, বুঝবে, বুঝবে না কেন। আবার একগাল হাসলো বুড়োটা। শোনো, তাহলে আরো খুলে বলি। ওই-যে বাড়িগুলোর কথা বল্লাম, ওখানে খাসাখাসা কতকগুলো মেয়ে থাকে। আহা অমন উসখুস করছো কেন, পুরোটা শুনে নাও না। তুমি নিজে তো আর কিছু করছো না, তোমার কী এলো গেলো। তুমি তো শুধু বকরা ধরে আনবে। নগদানগদি টাকা।
মেয়ের দালালি করতে বলছো আমায়? বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলো শওকত।
বুড়ো আহমদ হোসেন ঘোঁত করে উঠলো। এইতো এবার মুখ খারাপ করতে হয় আমার। আরে বাবা, যে-শালারা এসব কাজ করে বেড়ায় তারা লেখাপড়ায় তোমার চাইতে কম না, অনেক বেশি। নিজেকে কী অমন কেউকেটা ভাবো যে কাজটা নিতে লজ্জা করছে? আর এই ছুঁড়িগুলো, এরা তোমার ওই নালা-খন্দ খেকে কড়ি আনা নয়। সব ভদ্র ঘরের মেয়ে। স্কুল-কলেজে পড়ে। ঘর-সংসার করে। ইচ্ছে করলে কোনোদিন তুমি নিজেও গিয়ে দু-এক রাত শুয়ে আসতে পারো ওদের সঙ্গে। তোমার কী? টাকা রোজগার হলেই হলো। ওরাও তো টাকার জন্যেই করছে এসব।
চলি এবার! এই অস্বস্তিকর প্রস্তাবের নাগাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার না মনটা আঁকুপাকু করছে শওকতের। সে উঠে দাঁড়ালো।
ব্যস। পছন্দ হলো না তো। বুড়ো আহমদ হোসেন শুয়োরের মতো ঘোঁতঘোঁত করে বললো, তা পছন্দ হবে কেন। যাও মার্থার কাছেই যাও, গিয়ে মার্থার ঠোঁট চোষো গিয়ে, তাতেই পেট ভরবে। আমার কাছে এসে আর পেনপেন কোরো না। ঘুষি মেরে একদম নাকের ডগা গুঁড়ো করে দেবো।
শেষের কথাগুলো একতের মনে গেলো না। ততক্ষণ রাস্তায় নেমে গেছে সে। মার্থার কাছেই যাবে সে। হ্যাঁ, মার্থার কাছে।
মার্থা ওকে ঘৃণা করবে। করুক। ওর কাছে মাফ চাইবে সে। বলবে, আমাকে ক্ষমা করে দাও মার্থা। আমি না-বুঝে অন্যায় করে ফেলেছি। তুমি যা ভাবছো আমি তা নই। সারাটা জীবন আমি দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। এক কাজ ছেড়ে অন্য কাজ নিয়েছি। কোথাও শান্তি পাইনি। আমি তোমার কাছে শুধু একটু শান্তি পেতে গিয়েছিলাম। আর কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিলো না। মার্থা, তুমি কেন আমাকে কাছে টেনে নিলে না মার্থা।
মার্থা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে। ক্রেতাদের সঙ্গে সেই আগের মতো হেসে-হেসে কথা বলছে সে। তেমনি সহজ। স্বাভাবিক।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখলো শওকত। বিকেলে আসতে বলেছিলো সে। এখন রাত। যে-লোকটার আসার কথা ছিলো সে বোধহয় এসে চলে গেছে। ভেতরে যাবে কিনা ভাবলো। ভাবতে গিয়ে কাল রাতের কথা আবার মনে হলো ওর। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ের রাক্ষস এলে গ্রাস করতে চাইলো ওকে। পা কাঁপলো। মার্থা ব্যাগঝিম করে উঠলো। বুকটা ধুকধুক করছে।
মার্থা কাউন্টার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। ওর মনে হলে এখনি একটা দৌড় দিয়ে পালাতে পারলে বেঁচে যায় সে। কিন্তু, মার্থা সোজা ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। কী ব্যাপার, ভেতরে না গিয়ে এতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন? চলো। মার্থার গলার স্বর আর মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে অনেকটা আশ্বস্তু হলো শওকত? ভেতরে যেতে যেতে মার্থা আবার বললো, এত দেরি করে এলে কেন, ভদ্রলোক তোমার জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছেন। বসো এখানে। বসো এখানে। ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আবার কাউন্টারে চলে গেলো মার্থা।
রাতকানা লোকটা চশমার ফাঁকে বারকয়েক তাকালো ওর দিকে। কেমন যেন একটা সন্দেহের দৃষ্টি যেন এক একটা মস্তবড় অন্যায় করে ফেলেছে। আর ওই রাতকানা লোকটাকে সব বলে দেয়নি তো? নইলে লোকটা গোঁফের নিচে অল্পঅল্প করে হাসছে আর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে কেন ওকে। পা থেকে মার্থা পর্যন্ত।
এসো। কতক্ষণ পরে মনে নেই, মার্থা এসে ডাকলো ওকে। ওর দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলো শওকত। এতক্ষণ চোখে পড়েনি, মার্থা আজ সেজেছে। বিয়ের আগে সেই বেকারীতে আসার সময় যেমন সাজতো সে, তেমনি। হঠাৎ যেন বয়সটা অনেষ্ক কমে গেছে ওর।
রাস্তায় নেমে কিছুদূর পথ কোনো কথা বললো না মার্থা। ওকে বেশ গম্ভীর মনে হলো। শওকত ভাবলো, আর দেরি না করে এই পথচলার ফাঁকে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলে হয়।
মার্থা অকস্মাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো, তোমার করিটা বোধহয় হবে না।
হবে না? ওর কথাটারই যেন প্রতিক্তি করলো শওকত।
মার্থা বললো, হোতো। এখনো হয়। ওর কথায় যদি আমি রাজি হয়ে যাই।
কে জানে হয়তো মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকলে সব জায়গায় এমনি আদর-সোহাগ পাওয়া যায়। শওকত ভাবলো।
কী কথা? শওকতের দম বন্ধ হয়ে এলো।
মার্থা বললো, থাক, নাইবা শুনলে।
শওকত গুনে ছাড়বে। বললো, বলোই না।
মার্থা বললো, লোকটা আমাকে দিন কয়েকের জুন্যে ওর সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে যেতে বলছিলো।
কেন?
মার্থা ম্লান হাসলো। তোমাকে চাকরি দেয়ার জন্যে।
ততক্ষণে একটা সেলুনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। শওকত বললো, এখানে কী?
মার্থা ওর মুখের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, মুখের দাড়িগুলো কত লম্বা হয়ে গেছে। একবার আয়নায় গিয়ে দেখো। চলো, শেভ করে নাও।
এখন, এই রাতে?
হ্যাঁ, এখন, যাও ঢোকো। মার্থার চোখেমুখে শাসানের ভঙ্গি। ভালোই লাগলো শওকতের, কাল রাতের কথা হয়তো ভুলে গেছে মার্থা। খোদা, ওকে সব ভুলিয়ে দাও।
সেলুনের লোকগুলো টেরিয়ে-টেরিয়ে দেখছে মার্থাকে। হাতজোড়া কোলে নিয়ে মার্থা এককোণে চুপচাপ বসে। যে-লোকটা ওর মুখে সাবান ঘষছে তার যেন কোনো তাড়া নেই। অফুরন্ত অবসর। অথচ এর আগে যখন সেলুনে দাড়ি কামাতে এসেছে সে, তখন লোকগুলো এত তাড়াহুড়ো করেছে যে, অর্ধেকটা দাড়ি থেকে গেছে মুখে। ব্যাগ থেকে পয়সা বের করে পাওনা চুকিয়ে দিলো মার্থা, তারপর আবার রাস্তায় নেমে এলো ওরা।
মার্থা বললো, আজ আর বাসায় ফিরে গিয়ে রান্নাবান্না করতে পারবো না। চলো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে নেবো। মার্থার গলায়, কথায়, অভিব্যক্তিতে সামান্য জড়তা নেই। অথচ কাল রাতে বালিশে মুখ গুঁজে মেয়ে কেমন ডুকরে কাঁদছিলো। শওকতের মাথায় আবার সবকিছু তালগোল পাকাতে শুরু করেছে। একটা জট খুলতে গিয়ে সহস্র জটে জড়িয়ে যাচ্ছে চিন্তার সূতোগুলো।
রেস্টুরেন্টের একটা কোণ বেছে পাখার নিচে গিয়ে বসলো ওরা।
মার্থা শুধালো, কী খাবে বলো।
শওকত শুধালো, তুমি কী খাবে বলো।
মার্থা বললো, আমি শুধু এক কাপ চা খাবো। আমার ক্ষিদে নেই।
বারে আমি একা খাবো।
হ্যাঁ। তুমি খাবে আর আমি বসে-বসে তোমার খাওয়া দেখবো। এতক্ষণে এক টুকরো হাসি ঝিলিক দিয়ে গেলো ওর মুখে। কী খাবে বলো।
কাবাব-পরটা।
অর্ডার দেয়ার বিছুক্ষণের মধ্যে এসে গেলো। মার্থা তার কথামতো বসে-বসে ওর খাওয়া দেখলো। মাঝে মাঝে দু-একটা কথা বললো সে। বললো, সকালে অমন মোষের মতো ঘুমুচ্ছিলে কেন? দরজায় কত ধাক্কা দিলাম, জাগলে না। দুপুরে নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়া হয়নি। নাহ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না আমি। দ্যাখো তো শেভ করে নেয়ায় তোমাকে এখন কত ভালো দেখাচ্ছে। কী রকম বিশ্রী আর রোগা রোগা লাগছিলো। বললো, পরটা রেখে দিলে কেন, খেয়ে নাও। আরেকটা কাবাব আনতে বলবো?
কাল রাতের একটু চিহ্নও নেই মার্থার চোখেমুখে। তবু রিকশায় উঠে শওকত ভাবলো মার্থার কাছ থেকে এই ফাঁকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়।
শওকত ডাকলো, মার্থা।
মার্থা বললো, কী।
শওকত ঢোক গিললো। একটা কথা বলবো?
বলো।
তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর রাগ করেছে তাই না?
কেন। রাগ করবো কেন? মুখ ঘুরিয়ে শওকতের দিকে তাকালো সে। পরক্ষণে যেন রাগ করার কারণটা মনে পড়ে গেলো ওর। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখখানা কেমন কালো হয়ে এলো মার্থার।
শওকত লক্ষ্য করলো।
মার্থা বললো, ওহ! বলে চুপ করে রইলো সে।
অন্ধকার গলি দিয়ে এগিয়ে চলেছে রিকশাটা। দুজনে নীরব। কী অসহ্য এই নীরবতা। শওকতের মনে হলো এখনি ভেঙে পড়বে সে। মার্থা ধীরে ধীরে বললো, সত্যি এটা তোমার কাছ থেকে আশা করিনি।
শওকত মরিয়া হয়ে বললো, মার্থা, আমাকে মাফ করে দাও তুমি, তুমি যা ভাবছো আমি তা নই। বিশ্বাস করো।
ওর একখানা হাত নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে নিলো মার্থা। মৃদু হেসে বললো, পাগল। তুমি একটা আস্ত পাগল। যে-জিনিসটা চাইলেই পেতে, তাকে অমন চোরের মতো পেতে চাও কেন? জানো, কাল রাতে আমার মনে হয়েছিলো তুমিও আর পাঁচটা লোকের মতো। নিতান্ত সাধারণ। তোমার চোখজোড়া কী বিশ্রী লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো একটা মাতাল। গুণ্ডা। ছোটলোক। সত্যি, তোমার ওপরে হঠাৎ ভীষণ ঘেন্না এসে গিয়েছিলো আমার। আমি সেটা সহ্য করতে পারিনি, তাই কেঁদেছিলাম। ওর হাতখানা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরলো মার্থা।
শওকত একটা সুবোধ বালকের মতো বললো, আর আমি অমন করবো না মার্থা।
মার্থা হাসলো। পাগল।
রিকশাটা বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে। পুরো পাড়াটা ঝিমুচ্ছে ঘুমের ঘোরে।
শওকত আস্তে করে ডাকলো, মার্থা।
মার্থা ওর হাতটা কোলের কাছে টেনে এনে বললো, বলো।
শওকত ইতস্তত করলো। এখন একটা চুমো দিই।
না।
কেন?
রিকশাওয়ালাটা কি মানুষ না নাকি? মার্থা ফিসফিস করে বললো, ঘরে গিয়ে দিয়ো। যত ইচ্ছে দিয়ো।
রিকশা থেকে নামলো ওরা।
কুষ্ঠরোগীটা রকের ওপর বসে। আজ ওর প্রতি হঠাৎ বড় মায়া হলো শওকতের। মার্থার দিকে চেয়ে বললো, লোকটাকে একদিন হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়। এখনো ঠিকমতো চিকিৎসে করলে হয়তো ভালো হয়ে যাবে। কী বলো?
কিন্তু মার্থা ওর কথার কোনো জবাব দিলো না। রিকশার পয়সাটা ঢুকিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো, এসো।
অন্ধকার করিডোরে দাঁড়িয়ে মার্থা আবার বললো, ম্যাচিশটা জ্বালাও তো। তালা খুলি।
পকেট থেকে দিয়াশলাই-এর বাক্সটা বের করে জ্বালালো শওকত। খুট করে একটা শব্দ হলো পেছনে। শওকত ফিরে তাকালো। পেছনে দরজার আড়ালে একটা ছায়া। কাঁচা হলুদের মতো যার গায়ের রঙ। তামাটে যার চোখ। আর গাঢ় বাদামি যার অধর। শওকতের মার্থাটা আবার ঝিমঝিম করে উঠলো। একটা ভয়ের রাক্ষস এসে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে ওকে।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো মার্থা। মিষ্টি গলায় ডাকলো, এসো।
না। এখন না। মার্থা। শওকত ঢোক গিললো। তারপর আর একমুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না সে। মার্থা অবাক হয়ে দেখলো অন্ধকার সিঁড়ির মোড়ে হারিয়ে গেলো শওকত।
ভয়ের রাক্ষস তাড়া করছে ওকে।
সংক্ষিপ্ত ব্লাউজের নিচে আড়াল-রাখা একজোড়া উদ্ধত যৌবন, নিচে তার ঘরে নাচের মহড়া দিচ্ছে। এখান থেকে তার ঘুঙুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছে শওকত।
মার্থা বললো, দেরি করছো কেন, ওঠো। তাড়াতাড়ি বাড়িটা দেখে আসি গিয়ে। আমাকে আবার দুটোর মধ্যে দোকানে যেতে হবে। এ বেলা ছুটি নিয়েছি। শওকতের শুকনো চুলের দিকে চোখ পড়তে বললো, মাথায় তেল দাও। ভালো করে চুলগুলো আঁচড়ে নাও। এমন ছন্নছড়ার মতো থাকো!
না। আর এই ছন্নছাড়া জীবন নয়। এবার নিজেকে গুছিয়ে নিতে চায় শওকত। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছে। জীবনের সহস্র সর্পিল পথের বাঁকে থেমেছে। দেখেছে। ঘুরেছে অনেক। আজ বড় ক্লান্ত সে।
ওরা অনেক টাকা ভাড়া চাইবে। শওকত ধীরে ধীরে বললো, কমপক্ষে দেড়শ টাকা।
মার্থা বললো, চলো না, একবার গিয়ে দেখি তো।
গত কয়েকদিন ধরে অনেক বাড়ি দেখেছে ওরা। অনেক অলিগলি ঘুরেছে। বাড়ি পছন্দ হলেও ভাড়ার অঙ্ক শুনে চুপসে গেছে মন।
বাবুবাজারের বাড়িটা পেলে মন্দ হতো না। শওকত চুলে তেল দিতে-দিতে বললো। ভাড়াটাও কম ছিলো।
কিন্তু অত টাকা আগাম দেবে কোত্থেকে? ওর দিকে চিরুনিটা বাড়িয়ে দিলো মার্থা। আমাদের তো আর একগাদা জমা-টাকা নেই। কথাটা বলে স্নান হাসলো সে। তাছাড়া বাড়ি ভাড়াতে সব টাকা খরচ হয়ে গেলে, খাওয়া-পরা চলবে কেমন করে। পরের কথাটা বলতে গিয়ে থামলো মার্থা। লজ্জায় মুখখানা রাঙা হলো ওর। আস্তে করে বললো, বিয়ের পর সংসারটা তো আর অমন ছোট থাকবে না। বাড়বে। বলে রাঙা মুখখানা অন্য দিকে সরিয়ে নিল সে।
শওকত মনে-মনে হিসেব করে দেখলো, সত্যিই তো। মাসে দেড়শ টাকা করে পায় মার্থা। একশ টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে গেলে আর থাকে কত। ভাবতে গিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হলো ওর। ও যদি একটা চাকরি পেতো।
আচ্ছা মার্থা, ও লোকটা তোমাকে কক্সবাজার নিয়ে যেতে চায় কেন?
কোন্ লোকটা।
ওই যে, যাকে আমার চাকরির কথা বলেছিলে।
ও, মার্থা সহসা গম্ভীর হয়ে গেলো। একটু পরে ম্লান হেসে বললো, কেন নিয়ে যেতে বোঝ না?
ওর চোখের দিকে চোখ পড়তে শওকত আর কোনো কথা বলতে পারলো না। মুখখানা রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেলো ওর।
মার্থা সেটা লক্ষ্য করে বললো, এতসব নিয়ে তুমি মার্থা ঘামিয়ো না তো! যা হবার হবে। চলো। চারপাশে সন্তর্পণে অকিয়ে ওর খুব কাছে এগিয়ে এসে মুহূর্তে ওকে একটু আদর করে দিয়ে আবার বললো, চলো।
শওকত বললো, যাই বলো বিয়ের পরে কিন্তু এ বাড়িতে থাকা চলবে না।
মার্থা বললো, ঠিক আছে। আমি তো অমত করিনি। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে আমি যাবো। আপাতত একটা বাড়ি খুঁজে তো বের করি। চলো।
সেলিনার ঘরের দরজাটা খোলা। ভেতরে এখনো নাচের মহড়া দিচ্ছে সে। কাঁচা হলুদ মাংস বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে ওর। নানা রঙের বুটি-আঁকা অপরিসর কামিজের নিচে যৌবনের ভাজগুলো থরেথরে সাজানো। তাকাবে-না তাকাবে-না করেও একবার তাকাতে হলো। তাড়াতাড়ি চোখজোড়া ফিরিয়ে নিলো সে। না, ওকে আর ভয় করবে না শওকত। মার্থা রয়েছে সঙ্গে। নতুন বাড়িতে গিয়ে মার্থাকে নিয়ে নতুন জীবনের ভিত পাতবে সে। না, আর ভয় করবে না।
ওরা রিকশা নিলো না। হেঁটে চললো।
মার্থা বললো, এই তো অল্প একটু পথ।
শওকত তার কথা শেষ করলো। হেঁটেই যাওয়া যাবে। শওকত জানে, কদিন থেকে বেশ হিসেবি হয়ে উঠেছে মার্থা। আটআনা পয়সা বাঁচতে পারলে মন্দ কী। কাজে আসবে।
এ পথে উদ্দেশ্যবিহীন বহু হেঁটেছে শওকত। মার্থাকে নিয়ে আজকের এই হেঁটে যাওয়ার সঙ্গে তাদের কোনো মিল নেই। এই শহরে কত লোক। কত বাড়ি। তারই এককোণে একটা বাসায় পোজে বেরিয়েছে ওরা। মার্থা আর শওকত।
শওকত আর মার্থা। একটা পছন্দমতো ঘর। কিছু আশা। কিছু স্বপ্ন। অনেক ভালোবাসা। আর হয়তো অশেষ দৈন্যে-ভরা একটুকরো সংসার। তাই হোক।
সামনের রাস্তা দিয়ে একটা লম্বা মিছিল যাচ্ছে। ছাত্ররা স্ট্রাইক করেছে। গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে শ্লোগান দিচ্ছে ওরা। হাতে হাতে অসংখ্য যান। প্লাকার্ড। মিছিলটা বেরিয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত থামালো না।
মার্থা আস্তে করে শুধালো, কী ভাবছে।
কত বললো, কিছু না।
মার্থা বললো, আমি কী ভাবছি বল তো।
শওকত চিন্তা করে নিয়ে বললো, তুমি। তুমি ভাবছো একটা বাড়ির কথা।
না। মোটেই না, মৃদু হেসে মার্থা নাড়লো মার্থা। আমি ভাবছি বাড়িটা পেলে কেমন করে সাজাবো তাই।
শওকত তাকিয়ে দেখলো মার্থার চোখে স্বপ্ন। আজকাল আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর লাগে ওকে।