এইসব কাইজার জন্য পোলার নাম চানমিঞা না রাখার পিছনে খৈমনের অনেক যুক্তি ছিল, চানমিঞা কেমুন একটা নাম, পীড়া প্রতিবেশী শুনে কি বলবে, বিশেষ করে মিসেস জোবেদা রহমান? কিন্তু পোলার বাপে প্যাচটা লাগায়া রেখে যায়, এবং জোবেদা রহমান শুনে বলে, খুবই চুন্দর নাম, আমরা চান্দু কয়া ঢাকা পারুম; ফলে সিলভারডেল কেজি স্কুলের টিচার মেরি জয়েসও হয়তো চানমিঞাকে একদিন চান্দু বলে ডাকে, হয়তো মামুন কিংব্রা লেদু কিংবা অভিজিৎকে সে চানমিঞাকে চান্দু বলে ডাকতে শোনে, এবং তার হয়তো মনে হয়, পেট নেম ধরে ডেকে একটু আদর করি পোলাটাকে। এর ফল হয় উল্টা, মিসেস মেরি জয়েন্স ক্লার্কের এদেশের অনেক কিছুই জানা হয়া ওঠে নাই, যদিও তার জন্ম এদেশেই, ঢাকার তেজকুনি পাড়ায়। মেরির ঠাকুর্দা আলবার্ট চার্লস ডিসুজা গোয়া থেকে আশিনিব্বই বছর আগে এসে যশোরের শিমুলিয়া গ্রামে ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েতির ক্যাথলিক মিশনারিদের সঙ্গে কাজ শুরু করে; এইসব কথা, হয়তো মেরি তার মেয়ে জুলিকে বলে, নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির ভিতরে বসে সোনামুখি সুঁই দিয়া লম্বা স্কার্টের হেম টাক দিয়া ঠিক করতে করতে সে জুলিকে এই সব বলে, জুলি তখন স্টিভেন আর্নল্ডের নিয়া আসা মাউস ট্র্যাপ পড়ে, মেরির কথা তার এক কান দিয়া টুকে আর এক কান দিয়া বের হয়া যায়, মেরি বোঝে, তবু জানালা দিয়া বাইরে দূরের একটা বিল্ডিংয়ের সঙ্গে ল্যাপটায়া থাকা বিকালের সূর্যের নরম আলোর দিকে তাকায়া সে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে। তার ঠাকুর্দা আলবার্টের গায়ে ছিল খাটি পর্তুগিজ রক্ত, লিসবন থেকে জাহাজে করে সে ভারতের পশ্চিম উপকূলের পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়ায় সরাসরি এসে নামে, সেখানে একদুই মাস থাকার পর তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়, কৃষ্ণনগর মিশনারিতে এসে সে কয়েকদিন থাকে, বাংলাদেশের মানুষ এবং আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়; তারপর সে যশোর আসে, যশোরের বক্সলপুর গ্রাম, শিমুলিয়া, জগদানন্দকাঠি পল্লি এবং বিকেরগাছায় ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তির সঙ্গে ক্যাথলিক ধর্মীয় সংস্কার প্রচারের কাজে লাগে, কিন্তু তার বয়স ছিল কম এবং দেশ ত্যাগ করে আসায় তার মন ছিল খুবই বিষণ এবং উদাস, গোয়ায়ও তার বেশি দিন থাকা হয় নাই, কিন্তু ধর্ম প্রচারের কাজে ঝিকরগাছায় গেলে তার এদেশীয় খ্রিষ্টান রমণী কুমারী লাবণ্যপ্রভা দাসী এবং তার বোন কুমারী বিদ্যুন্মালা দাসীর সঙ্গ দেখা হয়, বাক্যালাপ হয় এবং তাদেরকে তার ভাল লাগে, ফাদার আন্তনিও প্রথমে হয়তো কিছু বোঝে না, সে হয়তো বলে, আলবার্ট এত সময় এবং শ্রম কেন ঝিকরগাছায় ব্যয় করতাছ? প্রটেস্টান্টদের সরায়া তুমি ওখানে কিছুই করতে পারবা না, কিন্তু ফাদার আন্তনিওর কথা আলবার্টের কানে যায় না, কারণ তখন দুই বোনের সঙ্গে তার দেখা হয়া গেছে! লাবণ্যপ্রভার বাপ বিধুভূষণ দাস ছিল প্রটেস্টান্ট খ্রিষ্টান, তার পাটের করিবার ছিল, কাঁচা পাট রেলগাড়িতে করে ঝিকরগাছা স্টেশন থেকে বনগাঁ দিয়া কোলকাতার পার্ট কলে যেত। বিধুভূষণ তখন কপোতাক্ষ নদীর কাছে স্টেশন রোডের একটা দোতলা বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়া খাকে, তার ক্যাথলিকদের বিষয়ে আগ্রহ ছিল না, যদিও সে জানতো দুই/এক জন ক্যাথলিক মিশনারি সাহেব যশোর থেকে বিকিরগাছায় মাঝেমধ্যে যাতায়াত করে, তখন একদিন বিকরগাছা রেলস্টেশনে আলবার্ট ডিসুজার সঙ্গে তার দেখা হয়, লম্বা আলখাল্লা দেখে বিধুভূষণ আগায়া যায়-সে ভাবে নাই যে, এই সাদা ফাদারটা ক্যাথলিক হবে। বিধুভূষণ মোটামুটি ইংরেজি জানতো, ফলে সে পাঞ্জাবির পকেটে ধুতির খুঁট ঢুকায়া দিয়া তার ডাইন হাত লম্বা করে ধরে, হ্যালো, আই এ্যাম এ ক্রিশ্চিয়ান, মাই নেম ইজ বিধু ভাস!
বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটা ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের জন্য ফাদার আলবার্ট চার্লস ডিসুজা কৃষ্ণনগরে থাকার সময় দুইটা বই যোগাড় করে, একটা, পর্তুগিজ মিশনারি ম্যানোয়েল দা আসসুমসাঁও এর লেখা Crepar Xaxtrer Orth,bhed বা কৃপার শাস্ত্রের অর্থ, ভেদ, যার ভূমিকায় বলা 2006-Doxto Bengali, xono: puthi xocoler utom puthi, xaxtro xocoler utom xaxtro;… অন্যটা হচ্ছে একটা পর্তুগিজ-বাংলা অভিধান vocabulario. Portuguez E Bangalla. আলবার্ট ডিসুজা নমস্তে বলে শুরু করে কথাবার্তা খুবই কাঁচা বাংলায় আগায়া নেয়, যখন পারে না, সে ইংরেজি বলা শুরু করে, এবং দেখা যায় যে, সে ইংরেজিও ভাল জানে না; তবে আলবার্ট ডিসুজা বোঝে যে, বিধুভূষণ বন্ধুবৎসল লোক, কথা বলতে পছন্দ করে, আলাপ জমাইতে চায়, ফলে সে প্রটেস্টান্টদের এই ঘাঁটিতে বিধুভূষণকে হারাতে চায় না, তার সাদা কাসকের পকেটে দুইটা চম্পা কলা ছিল, সে একটা কলা বের করে যখন বলে, আমার লগে দুইটা কেলা রইছে, একটা আপনি খাউন? তখন বিধুভূষণ দাস এই নতুন সাহেব পাদ্রির দুরাবস্থা বুঝতে পারে, ফলে বেশি কথা না বলে বিধু দাস পাদ্রির আগায়া দেওয়া কলা খায়, এবং সে বলে, মহাশয় আমার বাটি নিকটেই, আমার বাটিতে চলুন আপনাকে কিঞ্চিত জলযোগ করাই। বিধুভূষণের সঙ্গে যখন সে তার বাড়ির দিকে রওনা হয়, তখন হয়তো আলবার্ট ডিসুজার মনে হয়, তার পরিচয়ের বিষয়টা বিধুভূষণের কাছে পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন, সে তাকে বলে যে, সে যশোরে ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তির সঙ্গে কাজ করে, ফাদার ম্যারিয়েত্তি তাকে ঝিকরগাছায় পাঠিয়েছে ক্যাথলিক খ্রিষ্ট বিধানের নিয়ম প্রচার করতে; কিন্তু বিধুভূষণের তখন আর ফিরা যাওয়ার পথ ছিল না, তার বাড়ি এবং মালগুদাম স্টেশনের একদম কাছে, এই কয়টা কথা বলতে বলতেই তারা বাড়ির দরজায় এসে হাজির হয়, ফলে তার মেয়ে লাবণ্যপ্রভা কিংবা স্ত্রী জগত্তারিণী বাইরের দরজা খুলে দিলে বিধুভূষণ সমাদর করে আলবার্ট ডিসুজাকে ভিতরে নিয়া যায় বসায়। জগত্তারিণী যখন অতিথির জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে, কাঁসার বগি থালায় ভিজানো চিড়ার সঙ্গে দই সন্দেশ কলা এবং তার পাশে চাইরটা নারকেলের নাড় সাজায়া আয়োজন পূর্ণ করে আনে তখন বিধুভূষণ ভিতর বাড়িতে আলবার্ট ডিসুজার পরিচয় প্রকাশ করে দেয়, সাহেব কিন্তু ক্যাতোলিক; কিন্তু তখন একহাতে কাসার গ্লাসে করে পানি এবং অন্য হাতে খাবারের খালি নিয়া লম্বা করে ঘোমটা দিয়া জগত্তারিণী বাইরের ঘরে এসে খাড়ায়, তাদের ষোল বছর বয়সী বড় মেয়ে লাবণ্যপ্রভাও সাহেব দেখার লোভে মায়ের সঙ্গে আসে, এবং ডিসুজাকে দেখে জগত্তারিণীর মনে হয় যে, খুবই কম বয়স ছেলেটার, হয়তো তার ছেলে মিহিরের চাইতে খুব বেশি বড় হবে না। ফলে জলখাবারের পর টুকটাক কথা বলতে যায় যখন বেলা বেড়ে যায়, জগত্তারিণী দুপুরে দুইটা শকান্ন গ্রহণ করার জন্য ডিসুজাকে পীড়াপীড়ি করে; লাবণ্যপ্রভা ঘরের ভিতরে ঢুকে বেশিদূর অগ্রসর হয় নাই, দরজার কাছেই খাড়ায়া সাহেব পাদ্রির খাওয়া দেখে, হাত দিয়া তুলে খেতে যায় সে কেমন কাপড়ে মাখায়া ফালায়। লাবণ্যপ্রভা সাহেব পাদ্রি সবসময়ই দেখে, ঝিকরগাছা খুবই ছোট একটা জায়গা, সে ঝিকরগাছার ব্যাপ্টিস্ট চার্চে প্রতি রবিবার উপাসনায় যোগ দেয়, হয়তো চার্চ কয়ারে অংশ নিয়া গায় .মম অন্তর মাঝে, যেন সদা বাজে, মধুমাখা যিশুর নাম গো …, কিন্তু তাদের ঘরের ভিতরে একটা আস্ত এবং জ্যান্ত সাহেব সে কোন দিনই দেখে নাই, তার মনে হয় যে, লোকটা তরি মার কথায় রাজি হয়া গেলেই পারে, তাহলে সে তাকে শিখায়া দিতে পারবে কিভাবে হাত দিয়া খাবার উঠায়া মুখে পুরতে হয়, কিন্তু আলবার্ট ডিসুজা দুপুরের খাবার গ্রহণে রাজি হয় না, তবে সে ভালভাবেই লাবণ্যকে দেখে এবং নামও জিগাস করে, কন্যার নাম কি হয়? লাবণ্য নাম বলার পর সে বলে, সাধু, এবং আরো এক গ্লাস পানি খায়া হাতের উল্টা পিঠ দিয়া মুখ মুছে উঠে খাড়ায়, তারপর দুই হাতের কর বুকের কাছে পরস্পর সংযুক্ত করে বিধুভূষণ, জগত্তারিণী এবং লাবণ্যপ্রভার দিকে মাথা ঝুকায়া বলে, নমস্তে, আজ্ঞা দেউন। কিন্তু গৃহকর্তা এবং কত্রী আজ্ঞা দিলেও দেখা যায় যে, গৃহ তার মায়ায় পড়ে গেছে, পুরান আমলের ছোট দরজা দিয়া বের হতে যায়া নিচা চৌকাঠে তার কপাল ঠুকে যায় এবং দরজার বাইরে এসে সে বিদ্যুন্মালাকে দেখে; বাড়ির চৌদ্দ কিংবা সাড়ে চৌদ্দ বছরের ছোট মেয়ে বিদ্যুন্মালা কোত্থেকে ঘুরে এসে বাড়িতে ঢুকে সাদা পাদ্রির সামনে পড়ে এবং তার দিকে তাকায়া তার দুরাবস্থা দেখে সে। হেসে ফেলে, আহা দুয়ারটার সঙ্গে কি দুশমনি গো, সে বলে, তখন আলবার্ট ডিসুজার তার পকেটের দ্বিতীয় কলাটার কথা মনে পড়ে, সে আলখাল্লার বিরাট পকেটের ভিতর থেকে ছোট্ট চম্পা কলাটা বের করে মেয়েটার দিকে আগায়া দেয়, আমার লগে একটা কলা আছে…। মালা দাস একটু বিব্রত হয়, তারপর কলাটা নেয়, একটা বুড়া আঙ্গুলের সমান হলুদ ফলটার বোটার দিকে নরম হয়া গেছে, তবুও, তথাপি, আলবার্ট ডিসুজা চলে যাওয়ার পর সে এই ছোট্ট একখান নিচুজাতের কদলি—এটা একটা শবরি কলা হলেও কথা ছিল-এই কলিটা যত্নের সঙ্গে ছিলায়া ইন্দুরের মত একটু একটু করে দাত দিয়া কামড়ায়া খায়, এবং এই জিনিসটা লাবণ্যের নজর এড়ায় না।
হয়তো ডিসুজার গল্প শোনার সময় জুলি ফ্লোরেন্স এই দুই অদেখা মরে হেজেমজে ভূত হয়া যাওয়া রমণীর কথা ভাবে, তার মনে হয় লাবণ্যপ্রতাইতো তার মায়ের ঠাকুমা হতে পারতো, কিন্তু মেরি জয়েস এইখানে এসে গল্প অন্যদিকে নিয়া যায়, লাবণ্যপ্রভা শেষ পর্যন্ত যশোর কিংবা খুলনায় যায় খ্রিস্টানদের মঠের নান হয়, এবং সে হারায়াই যায়, হয়তো নিয়তি এবং কাকতালীয় ঘটনার বুলি হয়া যায় সে, আলবার্ট ডিসুজার যদি প্রথমদিন ঘরের ভিতরে বসে জগত্তারিণীর বানানো ফলার ভক্ষণ করার সময় পকেটের চুম্পা কলার কথা মনে পড়তো তাহলে হয়তো ঘটনা অন্যরকম হতো, হয়তো সে সেটা লাবণ্যপ্রভাকেই দিত, কিন্তু ডিসুজার তা মনে পড়লো না; লাবণ্যপ্রভার মনে হয়েছিল যে, ডিসুজা নিশ্চয়ই অচিরেই একদিন আতিথ্য গ্রহণ করে কোন এক বেলা তাদের বাসায় ব্যঞ্জনসহযোগে অন্ন গ্রহণ করবে, প্রথমে হয়তো বিধুভূষণ যায়া আলবার্ট ডিসুজাকে নেমন্তন্ন করে আসবে, তখন বাড়িতে আয়োজনের ধুম লেগে যাবে এবং উত্তেজনায় বাড়ির সকলের মূৰ্ছা যাওয়ার দশা হবে, শরীর ক্লান্ত হয়া পড়বে এবং আলবার্ট ডিসুজা খেতে বসে মুখের ভিতরে ঠিকমত খাবার তুলতে পারবে না, তখন লাবণ্যপ্রভা এই ফিরিঙ্গিকে হাত দিয়া ভাত খাওয়ার কায়দা শিখায়া দেবে, বলবে, বুড়া আঙ্গুল ব্যবহার করেন, বুড়া আঙ্গুল দিয়া ঠেলে দেন। বস্তুত বিধুভূষণের হাত থেকে ডিসুজার নিস্তার ছিল না, যতই সে রোমানক্যাথলিক হোক, কিন্তু লাবণ্যপ্রভার দুর্ভাগ্য যে আয়োজন করে ব্যাপারটা ঘটে না, একদিন হঠাৎ করে ঘটে; হয়তো আবার একদিন রেলস্টেশন কিংবা ঝিকরগাছা বাজারে বিধুভূষণের সঙ্গে ডিসুজার দেখা হয় এবং বিধুভূষণ তাকে ধরে নিয়া আসে, তখন হয়তো বাসায় লাবণ্যপ্রভা ছিল না, বিদ্যুন্মালা ছিল, ফলে লাবণ্য যখন ফেরে তখন সে দেখে কাঠের বড় আসনের উপরে পদ্মাসনে বসে আলবার্ট ডিসুজা ঘরে যাই ছিল তাই দিয়া ভাত খায়। এই বিষয় নিয়া মালার অস্থিরতার সীমা থাকে না, সে লাবণ্যকে বলে, দেকি কি দিদি, ভাত তুলতে পারে না গো, আমি বুলি কি বুড়ো আঙুল ব্যবহার করো সাহেব, কিন্তু আমার কতা বুজতেই পারে না, তকন আমি হাতে ধরে না শিকিয়ে দিলাম,,, লাবণ্যপ্রভা তখন ভাগ্যের মাইরটা বোঝে, যার ভাগ্যে নাই তার নাই, যার আছে, ভাগ্য তার হাতে ধরে সার্থকতার পথে নিয়া যাবে। ডিসুজার মিশনারি কাজকারবার চুলায় ওঠে, সে সকাল কিংবা বিকালে বিধু দাসের বাড়িতে এসে বিদ্যুন্মালা দাসীর সঙ্গে গপসপ মারে, ক্যালিক খ্রিস্ট মগুলির মঙ্গলের চাইতে একটা রমণীর সঙ্গে ফালতু বসে থাকায় তার বেশি আগ্রহ হয়, সে সঙ্গে করে Crepar Xaxtrer Oith,bhed বইটা নিয়া আসে, মালাকে পড়ে শোনায়-xaxtri xocoler utom xaxtri Christor xaxtri, Crepar xaxtro ebong Crepar Xaxtrer puthi… বিদুন্মাল হেসে গড়ায়, তুমি এইগুলা কি পড় সাহেব, আসো তোমাকে বাংলা শিকাই। তারা কোষা নৌকা নিয়া কপোতাক্ষ নদীতে জলবিহারে যায়, ঝিকরগাছার লোকেরা দেখে, যশোরে ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তি চিন্তিত হন, তার অন্য সহায়তাকারী ফাদার লুইজি ব্রিওস্কি ভবরপাড়া অঞ্চলে ভাল কাজ করছে, কি আলবার্টের হইলো কি? তিনি আলবার্টকে আবার একদিন জিগাস করেন, তোমার অগ্রগতি কি হইলো বুজতে পারতেছিনা ডিসুজা, খামাখা যেয়ে পড়ে রইছো; ফলে আলবার্ট ডিসুজার জন্য সঙ্কট তৈরি হতে থাকে, স্থানীয় জনগোষ্ঠী কিংবা প্রটেস্টান্টদের মধ্যে কাজে তার মন বসে না, এতদিন হয়া গেল সে একটাকেও ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় বিধান বুঝায়া দলে ভিড়াতে পারে নাই, সে এইবার যশোর থেকে ফিরা চিন্তিত এবং মনমরা হয়া থাকে, বিদুলাকে বলে যে, তার কপালে দুঃখ আছে, তখন বিদ্যুন্মালা রাইতের বেলা দিদির সঙ্গে দোতলার ঘরে শুয়ে ডিসুজাকে নিয়া গল্প করে-বেচারা, দেক দিদি একন আর পকেটে করে কলা আনে না, কি অসভ্য, বলে যে কলা কিনবো টাকা কোতায় পাব, দেখ দিকিনি একনই বলে টাকা কোতায় পাব, কি ফাজিল বাবা!
তখন লাবণ্যপ্রভার ঘুম এসে যায়, কিন্তু মালার চোখে ঘুম নাই, সে বলে যে, ডিসুজার ফাদার তাকে বকে দিয়েছে, ফলে তার মন খারাপ; বিদ্যুন্মালা বলে, ফাদার আন্তনি না কি য্যানো নাম গোদাটার, তারে বলেছে একটাও ক্যাতোলিক কত্তি পারলে না, এত ঝিকরগাছা যায়ে তুমার কাম কি? ভাল হয়েছে, এবার মজা বুজুগে, কলা আনতি বললে বলে পয়সা পাব কোতায়!
লাবণ্যপ্রভা মনে হয় ছোট বইনের এইসব কথা কিছু শোনে নাই, সে দূরে স্টেশনের উপর দিয়া আসা পঁাচা এবং শিয়ালের ডাকের শব্দের ভিতর ঘুমে তুলায়া যায়। ডিসুজাকে কয়েকদিন দেখা যায় না, সে কোথায় কোথায় ঘোরে একটা দুর্বল হিন্দু, কি মুসলমান, কি প্রটেস্টান্ট-কর্তাভজের জন্য; ব্যাপ্টিস্ট মিশনের পাদ্রিরা কর্তাভজ লোকগুলাকে আগেই নিজেদের দলে টেলে নিয়া গেছে, এখন এখানে একটা দুর্ভিক্ষ যদি হয়, যদি কপোতাক্ষ কিংবা বেতনা নদীতে কূল ছাপায়া বন্যা হয়, বুধখান বিল, খড়মদা বিল কিংবা সমুন্দর বিলের পানি উপচায়া ফসলের মাঠ এবং বসত বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে, তাহলে একটা হাহাকার লাগে, এবং তাহলে হয়তো কিছু সেবার কাজ করা যায়। ডিসুজা ঘোরাঘুরি করে এবং রাইতের বেলা দোতলার ঘরে শুয়ে বিদ্যুন্মালা দুশ্চিন্তায় ধুম মেরে থাকে, তখন হয়তো কপোতাক্ষের দিক থেকে একটা বিচ্ছিন্ন গাঙচিল অন্ধকারের ভিতরে কা কা করে উড়ে আসে, লাবণ্যপ্রভার চোখে হয়তো ঘুম এসে যেতে থাকে, কিন্তু নিশাচর পাখির চিৎকারে তার কান খাড়া হয় এবং সে হঠাৎ করে তার ছোট বোনের বিষণ্ণতার বিষয়ে সচেতন হয়; সে বলে, সায়েবরে বল দিদি কাতালিক হবে-আমারে বাপতাইজ করতি বল।
আলবার্ট ডিসুজা রেল গাড়িতে করে লাবণ্যকে যশোর নিয়া যায়া ফাদার আন্তনিওর সামনে হাজির করে, যাওয়ার সময় বিদ্যুন্মালা কি বোঝে, সে কেন্দে ভাসায়, তার শোক বান্ধ মানে না, আমার কিছু চাইনে দিদি, আমাগের সাতে তুই থাক; কিন্তু তখন লাবণ্যপ্রভার আর থাকার সময় ছিল না, আলবার্ট ডিসুজার সঙ্গে সে যায়া ট্রেনে ওঠে। ঝিকরগাছা থেকে যশোর যেতে সময় লাগে খুব কম, মাত্র এই সময়টুকু, তারপর যশোর স্টেশনে লাবণ্যপ্রভা ডিসুজার পিছন পিছন ট্রেন থেকে নেমে আসে, তার টিনের ফুল তোলা ট্রাঙ্কের ভিতরে ছিল কাপড়চোপড়, ডিসুজা সেটা কান্ধের উপরে ফালায়া হাঁটে এবং তখন পকেটের ভিতরে হাত দিয়া সে দেখে যে, একটা চম্পা কলা এক কোনায় রয়া গেছে, সে কলাটা বের করে লাবণ্যপ্রভার দিকে আগায়া দেয়, আমার লগে একটা …। লাবণ্য কলাটা খায়, অনেক দিন আগে সে যেভাবে বিদ্যুন্মীলাকে খেতে দেখেছিল, সেইভাবে একই কায়দায়, পানির ভিতরে মাছের শেওলা খাওয়ার মত করে, অল্প অল্প ঠোক্কর দিয়া যত্নের সঙ্গে। তারপর সে যেন কোথায় চলে যায়, ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তি তাকে কোথায় যে পাঠায়, হয়তো খুলনায়, হয়তো কৃষ্ণনগরে, কিত্ত্বা হয়তো নদীয়ার ভবরপাড়া প্যারিশের কনভেন্টে, সেখানে সে হয়তো সিস্টার ললিতা, সিস্টার এ্যাপোলিন, সিস্টার কুমারী আর্নেটিনা (হাসি) গোমেজকে পায়, তারা ফুলহাতা সাদা ব্লাউজ এবং সাদা পাড়ের ছাইরঙা শাড়ি পরে কটিবন্ধে রোজারিমালা এবং গলায় ক্রুশ ঝুলায় ব্যস্ত হয়া থাকে, লাবণ্যপ্রভা হয়তো রবিবারে প্রার্থনা সঙ্গিতের সময় গায়, আমি সকলি ত্যাজিয়া, যাইব চলিয়া শ্ৰীযিশুর চরণ তুলে … অথবা গুড়ফ্রাইডের শোকশোভাযাত্রায় যোগ দিয়া গান করে, যিশু তুমি মম তরে কত দুঃখ সহিলে …।
লাবণ্যপ্রভার জন্য হয়তো জুলি ফ্লোরেন্সের মন খারাপ হয়া থাকে, মিসেস ক্লার্ক যখন তার বালিকা-কিশোরী কন্যার দিকে তাকায়া হাসে, কি হইছে? জুলি মুখ বেঁকা করে রাখে, এবং তখন মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক তার নাকের উপরকার চশমা ঠেলে দিয়া বলে, বিওয়্যরি অব ম্যান এন্ড বানানা তরু জুলির এই গল্প ভাল লাগে-রোমান্টিক এন্ড স্যান্ড; আলবার্ট ডিসুজার জীবনের পথ বাংলাদেশে এসে বেঁকা হয়া যায়, বিদ্যুন্মালাকে বিয়া করে সে সন্ন্যাসী থেকে গৃহী হয়, প্যান্ট এবং ক্যাসক খুলে ফালায়া ধুতিফতুয়া ধরে, গায়ে ভাল করে আঁটি সরিষার তেল মেখে স্ত্রীর বড় ভাই মিহির কান্তি দাসের সঙ্গে যায় কপোতাক্ষ নদীতে গোসল করতে। শ্বশুর বাড়িতে থেকে সে পাটের ব্যবসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, হয়তো এই ব্যাপারে শ্বশুরের মারিও ভাল লাগে না তার, সে তখন কুষ্টিয়ায় র্যালি ব্রাদার্সের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কয়েকদিন কাজ করে, তারপর মেদিনীপুর জমিদারি এস্টেটের এসিস্টেন্ট ম্যানেজারের চাকরি নেয়, কিন্তু এই চাকরিও তার ভাল লাগে না, ফলে সেখান থেকে অবশেষে ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় এসে স্থিত হয়, বেগুনবাড়িতে একটা বেকারি খুলে বসে। টাকার যোগন দেয় বিধু দাস, কারণ বিদ্যুন্মালা বাপের কাছে যায়া কান্দাকাটি করে, ও টাকা কোতায় পাবে, পাদ্রি মানুষের কি কিচু থাকে?-তখন বিধু দাসকে দিতে হয়। মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক তার মেয়ে জুলি ফ্লোরেন্সকে বলে যে, কোথাকার লিসবনের এক ডিসুজা ঢৗকার হাতিরঝিলের পাশে খাস্তা আর বৈলা বিস্কুট বানায়া জীবন কাটাইতে থাকে পাকিস্তান হওয়ার পর যশোরে মেরি জয়েসের ঠাকুমার পরিবার পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর চলে যায়, যশোর বৃটিশভারত ভাগ হওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে পড়ার আগে কৃষ্ণনগরখ্রিষ্টঅঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, পাদ্রি ফাদার মারো তখন কৃষ্ণনগরের বিশপ ছিলেন, তার ভিকার জেনারেল ফাদার লুইস গোবেত্তির সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানের অনেক রোমান ক্যাথলিক কৃষ্ণনগরের কাছে পল্লিতে জমি কিনে বসতি স্থাপন করে, তখন তেজকুনি পাড়া থেকে বুড়া ডিসুজার ৫ ছেলের মধ্যে চারজনই চলে যায়, কিন্তু মেরির বাপ, বুড়া ডিসুজার ৫নম্বর ছেলে জন ডিসুজা গেল না, সে বললো, না ওইখানে যায় কি করব? ফলে মেরিরা ফাইসা যায় বাংলাদেশে, লোকসানি ব্যবসার কারণে বুড়া আলবার্ট ডিসুজার এক বিঘা জমির উপরকার বাড়িটা ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। তার ছিল রেসের ঘোড়ার উপরে বাজি ধরার নেশা, সে শনিবারে রমনার রেসকোর্সে যায়া পড়ে থাকত, ঘোড়ার জাতকুল এবং অন্যান্য টিপসসহ কতগুলা কাগজ বের হতো, হকার এসে তেজকুনিপাড়ার বাসায় প্রতি সপ্তাহে দুইটা কাগজ দিয়া যেত, একটা জিমখানা রেসটিপ, অন্যটা চানমিঞা সাহেবের রেসটিপ; কত নামের যে ঘোড়া দৌড়াতো-ফ্ল্যাক ডায়মন্ড, ফুইন অব ক্যালকাটা, ফিনিক্স। মেরি জয়েসের চাচারা কৃষ্ণনগর চলে যাওয়ার আগে তেজকুনিপাড়ার বাড়ি বিক্রি করে ভাইয়েরা টাকা ভাগ করে নেয়, তখন মেরির বয়স হয়তো ছিল ৮/১০ বছর। এরপর থেকে তাদের ভাড়া বাসায় থাকী এবং ভেসে বেড়াইনা জীবনের শুরু, এর ভিতরে সে সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুল থেকে সিনিয়র কেম্বিজ পাশ করে এবং নটরডেম কলেজের ল্যাবরেটরি ডেমন্সট্রেটর রবার্টের সঙ্গে তার পরিচয় ও পরিণয় হয়; রবার্ট ছিল খুবই চটপটে এবং সুদর্শন যুবক, লক্ষ্মীবাজার কিংবা গেন্ডারিয়ায় বাপমায়ের সঙ্গে ভাড়া থাকতো, তখন হয়তো কোন এক রবিবারে তেজগাওয়ের হলি রোজারি চার্চের রবিবারের প্রার্থনা অনুষ্ঠানে মেরির সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়, এই চার্চের উঠানে হয়তো একটা উঁচা বড় শিমুল গাছ ছিল এবং তখন হয়তো বসন্তকাল ছিল, ফলে গাছের তলায় একটা লাল রঙের ফুল পড়ে ছিল; মেরি যখন নিচা হয়া ফুলটা কুড়ায়া নেয় তখন কালো প্যান্ট, কালো জুতা এবং সাদা শার্ট পরা রবার্ট গির্জায় ঢুকতে যায়া মেরিকে দেখে, সে বলে, সুন্দর ফুল।
মেরি মনে করতে পারে না তেজগাওয়ের হলি রোজারি চার্চ বা পবিত্র জপমালার গির্জায় আগে রবার্টকে দেখেছে কিনা, তবে তার কথা শুনে মনে হয় মেরি জয়েস ডিসুজা একটু ব্ৰিত হয়, সে হয়তো চায় নাই এই জংলি শিমুল ফুল কুড়ায়া নেওয়ার কাজটা কেউ দেখুক, কারণ সে নেহায়েত হঠাৎ ভাললাগার বশে কাজটা করে, ফলে রবার্টের কথা শুনে সে মুখ টিপা হাসে এবং বলে, ইয়েস!
: গাছটাও।
মেরির হঠাৎ মনে হয়, লোকটা এত কথা বলার চেষ্টা করতাছে কেন? তবু সে তখন গাছটার দিকে ঘাড় উঁচা করে তাকায়, কাঁটাঅলা গাছটাকেও তার ভালই লাগে, সে বলে, ইয়েস।
: ডু ইউ নো দা নেম অব দা ট্রি?
: শিমুল, সিল্ক কটন ট্রি, আই থিঙ্ক।
রবার্ট হালে পানি পায়, সে তখন সুন্দরী মেরিকে তার জ্ঞানের বাহাদুরি দেখানোর কাজে নামে, সে বলে যে, গাছটার একটা বোটানিক্যাল নামও আছে। শুনে মেরি হাসে, সে বলে যে, সব গাছেরই একটা বোটানিক্যাল নাম থাকে, থাকে না কি? এইটারও নিশ্চয়ই হয়তো আছে!
: এবং আপনি কি নামটা জানতে চান না?
মেরিকে তখন হাল ছেড়ে দিতে হয়, লোকটা খাতির জমানোর চেষ্টা। করছে; সে বলে, আপত্তি নাই, ইফ ইউ ক্যান সে কুইকলি!
রবার্ট ফ্রান্সিসের মনে হয় যে, সে সাড়া পাচ্ছে, মেরি সাড়া দিচ্ছে, অথবা হয়তো বিষয়টা অতটা না; এবং সে বলে, ইটস কল্ড বোম্বা সীবা লিনা।
মেরি অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্রুতই ইম্প্রেসড হয়, মেরির বাপ জন ডিসুজাও আপত্তি করে না; বিয়ার পর প্রথম কিছু দিন লক্ষ্মীবাজারে, তারপর মেরির স্কুলের কাছে হওয়ায় নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় তারা বাসা ভাড়া করে। রবার্ট তার চাকরি বদলায়া পিডাব্লডির আরবরিকালচার ডিপার্টমেন্টে চাকরি নেয়, তারপর একাত্তর সনে দেশ স্বাধীন হয়া যাওয়ার পর বৃটিশ কাউন্সিলের গার্ডেন সুপারভাইজার হয়, এবং সে যখন একদিন তার বস স্টিভেন এইচ আর্নল্ডকৈ বলে যে, এই দেশের শীতটা যদি একটু গভীর হতো.., স্টিভ আগায়া যায় তার কান্ধের উপরে একটা হাত রেখে বলে, তুমি খুব ভাল লোক বব, এবং তখন বব তাকে বলে যে, আগামী অমুক মাসের তমুক তারিখে আমার মেয়ের জন্মদিন, আপনি কি অনুগ্রহ করে গরিবের বাসায় পায়ের ধুলা দিবেন? স্টিভেন আর্নল্ড রাজি হয় এবং জুলির জন্মদিনে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে আসে, বিশেষ করে রাজি হয় যখন সে শোনে যে, রবার্টের স্ত্রী একজন শিক্ষিকা; এবং সে রবার্টের স্ত্রী এবং মেয়ের জন্য এক বান্ডিল বই নিয়া আসে। তখন জুলি মাউসট্রাপ এবং তার মা মাদাম বোভারি নিয়া পড়ে, অথবা মিসেস মেরি ক্লার্কের হয়তো আগ্রহ হয় না, হয়তো তার সময়ও হয় না এইসব বই পড়ার, স্কুলের পোলাপানের একজামের খাতা নিয়াই সে কাহিল হয়া যায়, এবং ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খৈমনের যুদ্ধ জারি থাকে, মিসেস জোবেদা রহমানের স্বামী গোলাম রহমান বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মহল্লায় ফিরা আসে, কিন্তু খৈমনের কেউ ফেরে না, বরং তার বাপের বাড়িটার অর্ধেক স্বাধীনতার একমাসের মধ্যে বেদখল হয়া যায়, দক্ষিণমৈশুন্দি থেকে লম্বা চুলঅলা দুইজন আসে এবং বলে যে, বাড়ির অর্ধেক তাদের, ময়না মিঞার কাছ থেকে তারা এই বাড়ি কিনেছে, খৈমন বোঝে যে, হয়তো ময়না মিঞা বাড়ি লিখে দেওয়ার বিষয়ে কাউকে কিছু বলেছিল, কিন্তু সে নিশ্চয়ই এই লোকদের কাছে বাড়ি বেচে নাই, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে খৈমনের কিছু করার থাকে না, এই পোলাপান দয়া করে বাড়ির অর্ধেকটা দখল করে, বাকি অর্ধেকটা খৈমন এবং জুরিমনকে ছেড়ে দেয়; দখলদাররা তাদের অংশটা নতুন করে আস্তর লাগায়া এবং চুনকাম করে ভাড়া দেয়, এইটার নম্বর হয় ৩৫১ ভূতের গল্লি। খৈমনদের বাসা ৩৬নম্বরই থাকে, কিন্তু তখন জারিমনও কোন কারণে মরে যায়, হয়তো ছেলের শোকে কিংবা বাড়িটা দখল করে নিয়া বুকের উপরে বাইরের লোক চাইপা বসে থাকার যন্ত্রণায়, এবং এইরকম ঝামেলার দিনে বান্দরেরা এসে খৈমনের সঙ্গে দিকদারি শুরু কতে! খৈমন যখন চানমিঞাকে নিয়া যায়া রোকেয়া আনোয়ারের সিলভারডেল কেজি স্কুলে ভর্তি করে তখন অনেকে অবাক হয়া যায়, ঠোঙ্গা বানায়া বেচইনা খৈমন, মাতারি সে, মহল্লায় তার কি দাম? কিছু না, তার পোলা কিনা গলায় টাই বেঁধে ভূতের গল্লির রাস্তা দিয়া হাঁটে; তারা জিগাস করে, পড়াবি কেমনে, অয়কি ইংরেজি পারব? তখন খৈমন বলে যে, না পারার কারণ নাই কোন, কালা পারব না? সে কি চান মিল্লাকে মাষ্টার রেখে তালিম দেয় নাই? কিন্তু মহল্লার লোকদের, হয়তো মিসেস জোবেদা রহমানেরই, মনে হয় যে এই সবকিছুর পিছনে বান্দরদের হাত ছিল, সে হয়তো বলে, বান্দরে খিলায়, বান্দরে পিলায়, খাড়া না দেখ না বান্দরে আর কত কি করে! হতে পারে, বাংলাদেশের বন্দিরেরা কি খুবই মজার প্রাণী নয়? কারণ মুরানি বিলকিস উপমার ৩৭নম্বর বাড়িতে গল্প করতে যায় খৈমনই এইসব গপ মারে, খৈমন দেখে যে, সে যখন চানমিত্রী এবং বান্দরের গল্প করে তখন নুরানি বিলকিস কেমন আগ্রহ নিয়া তার দিকে তাকায়া থাকে, তার মুখে আবছা হাসি ছড়ায়া যায়, চোখে ঘোলা আলো জেগে ওঠে, সে খৈমনের কথা গেলে, খায়, হয়তো কখনো বলে, গপ মারো? তখন খৈমন আকাশ থেকে পড়ে, তার মুখটা নির্লিপ্ত করে রেখে বলে, জীবনে নাগপ মারুম ক্যালা, হাচা কই; এবং তার মনে হয় যে, কিছু খসানোর এইটাই উপযুক্ত সময় এবং সে যখন বলে, অফা পান নাই আপনের ঘরে? নুরানি বিলকিস উঠে যায়া পান নিয়া আসে, পানের বোঁটায় করে চুন আনে-নুরানি বিলকিসের এই গল্প পছন্দ হয়, বান্দরের সঙ্গে মানুষের আশ্চর্য ভালবাসার কথা সে শুনতে চায়! তবে বান্দর নিয়া হয়তো খৈমন সত্যিই গল্প মারে না, বান্দরগুলা আসলেই বদমাইশ হয়া ওঠে, কিন্তু খৈমন গরিব মাইয়ালোক, ঠোঙ্গা বানায়া বেইচ্চা খাওয়াইনা মহিলা, তার ভাত যোগাড় করে খাওয়া লাগে, ফলে সে বান্দরগুলার সঙ্গে পারে না। ভুতের গল্লির বান্দরগুলা চানমিঞার দিকে নজর দিয়াই রাখে, ঢাকা শহরের এই বন্দিরগুলার সংবেদনশীলতা হয়তো মানুষের মত হয়া ওঠে, হয়তো ঠিক মানুষের মত না-কারণ, মানুষের সংবেদনশীলতার বিষয়টাই হয়তো একটা মিথ-তথাপি এই বান্দরেরা হয়তো বুঝতে পারে যে, পোলাটার কেউ নাই, বাপ ভাই নাই, মামাচাচা নাই, নানা/নানি, দাদা-দাদি, কিচ্ছু নাই, ফলে ধূসর বান্দরনিটার বাচ্চার সঙ্গে সে খেলা করে বড় হয়-মানুষের একটা বাচ্চা, বান্দরের একটা বাচ্চার সঙ্গে খেলাধূলা করে বড় হয়া উঠতেই পারে। কিন্তু বান্দরের বাচ্চাতো বন্দরের বাচ্চাই, দ্রুত বড় হয়া যায়, সেটার হোলের বিচি মোটা হয়া পিছনের দুই ঠ্যাংয়ের ফাঁক দিয়া লটরপটর করে, তার হোগার উপরে সিন্দুরের মত লাল হয়া ওঠে, সে মহল্লার বাড়িঘরের দেওয়াল কিংবা ছাদের কার্নিশের উপর দিয়া তার কান্তিময় তেজি লেঙ্গুর উঁচা করে ধরে বাংলাদেশী পুরুষ র্যাম্প মডেলদের মত হেঁটে আসে, ভূতের গল্লি, দক্ষিণ মৈশুদি এবং পদ্মনিধি লেনের অনেক কিশোরী ও যুবতী বান্দরনি তার জন্য ব্যাকুল হয়া পড়ে, কুলনারী বান্দরনি কুলত্যাগী হয়, এবং সে এইসব ভালবাসার পাত্রীদের বিমুখ করতে পারে না, তখন চাইরপাঁচটা বান্দরনি তার ঔরসজাত চাইর/পাঁচটা বাচ্চা ঠ্যাংয়ের চিপায় বুকের সঙ্গে ঝুলায়া মহল্লার কোন বিল্ডিং কিংবা দেওয়ালের উপর এসে খাড়ায়; কি নতুন যৌবনপ্রাপ্ত এই হুলাবান্দর-চানমিঞার প্রথম খেলার সাথি–চানমিঞাকে ভুলে যায় না, চানমিঞাতো মানুষের বাচ্চা, ৩/৪ কিংবা ৫ বছরে সে কিছুই বড় হয় না, ফলে এই বান্দর তার ৫ বান্দরনি এবং পোলাপানদের নিয়া তাকে দেখতে আসে, বাচ্চাদের হয়তো বলে, এইটা তগো চাচা লাগে, সালাম দে, বল আস্সালামালাইকুম, তখন বাচ্চা বান্দরগুলা চানমিঞার পায়ের কাছে ডিগবাজি খায়া ফুরতি দেখায়! খৈমন হয়তো নতুন করে নুরানি বিলকিসের কাছে এই কথা বলে, একদিন দেখি কি চাইরপাচটা বান্দরনি দেওয়ালের উপরে বয়া একটা আরেকটার উকুন বাছে, চোখ পিটপিটায়, ঘরের ভিতরে ঢুইকা দেখি বান্দরের ৫/১০টা বাচ্চা চানমিঞার লগে ফালাফালি কিলাকিলি করে, আমারে দেইখা বাচ্চাগুলান দাঁত ভেটকি দিয়া থাকে। হুলাবান্দরটা ক্রমে হয়তো বদমাইশও হয়া ওঠে, সে মহল্লায় টেরর হয়া খাড়ায়, হয়তো একদিন সে একটা জাম্বুরা নিয়া আসে, খৈমনের ঘরের ভিতরে ৫ বান্দরের বাচ্চা এবং চানমিঞা সেইটা দিয়া ফুটবল খেলে, একদিন হরলিক্সের বোতল আনে, তারা হৈচৈ করে খায়, তারপর একদিন এই নতুন বাপ-বন্দর চানমিঞার জন্য নিয়া আসে একটা বই, বান্দর হলেও সে বুঝতে পারে যে মানুষের পোলার লেখাপড়া করা লাগবে, বান্দর হলে চলবে না, ফলে নুরানি বিলকিস উপমাকে খৈমন বলে যে, একদিন ঘরে যায় সে দেখে বান্দর-সুন্দরের কোন খবর নাই, চাইর দিকে নীরব-তখন আমারতো ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া, কিরে পোলার কুন ভাজ পাইনা, গেল কৈ, ঘুমায় নিহি? ঘরে ঢুইকা দেখি একটা বইয়ের উপরে পোলা আমার উপুড় হয়া আছে। কিন্তু খৈমনতো পড়তে পারে না, উম্মি জেনানা সে, ফলে বইটা নিয়া সে পূর্ণলক্ষ্মীর কাছে যায়, পূর্ণলক্ষ্মী হয়তো ম্যাট্রিক ফেলের পর তখনো তার বাপ চন্দ্রকান্ত বিয়ার জন্য একটা বসাক পোলা যোগাড় করে আনবে এই আশায় প্রতীক্ষা করে ছিল,
তখন খৈমন বান্দরের আনা বইটা নিয়া যায় হাজির হয় এবং পূর্ণলক্ষ্মীকে আবোলতাবোল সব কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে; কারণ সেতো বলতে পারে না যে, মহল্লার বান্দরেরা এই বই চুরি করে আনে তার পোলার জন্য, পূর্ণলক্ষ্মী পাতা ছিঁড়া ফালানো বইটা নিয়া পড়ে, মাই ফাস্ট ইংলিশ বুক, এবং খৈমনকে বলে, তর পোলারে পড়াইব কে? কিন্তু মিসেস জোবেদা যখন বলে যে, খৈমনতো সবসময়ই ধুরন্ধর প্রকৃতির মাইয়ালোক, সে কি খুব বাড়ায়া বলে? খৈমনতো ধানাইপানাই করেই জীবন কাটাতে থাকে, পূর্ণলক্ষ্মী হয়তো এমনি তাকে কথাটা জিগাস করে, কিছু বলতে হয় সেই জন্য বলে, কিন্তু খৈমন তার কথা মাটিতে পড়তে দেওয়ার আগেই যখন বলে, তাইলে তুমি পড়াও, তখন পূর্ণলক্ষ্মী ভ্যাবাচেকা খায়া যায়, সে বলে, আমি কেমনে পড়ামু তর পোলারে?
: ক্যালা তুমি পড়ালিখি ভুইল্লা গেছ নিহি, বইয়া না থাইকা চানমিঞারে পড়াও, টাকা চাইলে টাকা নিও।
পূর্ণলক্ষ্মী চানমিঞাকে পড়াতে শুরু করে, হয়তো টাকার জন্য না, হয়তো এরকম নিরালম্ব ইয়া থাকা যায় না বলে, অথবা হয়তো টাকার জন্যও, কিন্তু চানমিঞার বান্দর বন্ধুরা তার পিছনে লেগে থাকে, তার প্রথম বান্দর বন্ধু তার কাচ্চাবাচ্চা এবং স্ত্রীদের নিয়া যখনতখন আসে, এবং খৈমন যখন ঘরে থাকে না তখন এই বান্দর বান্দরনিরা এবং তাদের পোলাপান তার ঘর ভরে ফেলে গ্যাঞ্জাম করে, চানমিঞা তার বান্দর মেহমানদের সঙ্গে হৈহৈরৈরৈ করে কাটায়; খৈমন হয়তো পোলাকে বকে, বান্দরের লগে থাইকা বান্দর হয়া গেতাছচ, সে নুরানি বিলকিস উপমাকে পুনরায় বলে, কেমুন পোলা হইলো আল্লাহ, রাইতদিন বান্দরগুলিরে লয়া আছে। খৈমন হয়তো চানমিঞাকে মাইর লাগানোরও হুমকি দেয়, বলে, ঘরের ভিতরে বান্দর লয়া ফালাফালি করলে মাইরা তরে ফাটামু, কিন্তু বান্দারেরাই চানমিঞার বড় বন্ধু হয়া খাড়ায়, মাইরা ফাটানোর কথা বলায় বুড়া হুলাটা এসে খৈমনকে ভেংচি দিয়া ভয় দেখায়; তিন চাইরপাঁচ কিংবা দশ প্রজন্মের পঞ্চাইশটা বান্দর তার খেলার সাথি হয়া পড়ে এবং এই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ে। চানমিঞা পূর্ণলক্ষ্মীর কাছে যায় পড়ার জন্য, অথবা পূর্ণলক্ষ্মীই আসে তাদের বাসায় এবং চানমিঞাকে বলে, পড়, সি-তে ক্যাট, ক্যাট মানে বিলাই, চানমিঞা মাথা হেলায়াদোলায়া পড়ে, ক্যাট মানে বিলাই, তখন তার পড়ার সময় দেওয়ালের উপর বান্দরেরা অপেক্ষায় থাকে এবং পূর্ণক্ষ্মীর মনে হয় এই পোলারতো লেখাপড়া হবে না, এবং তবু একদিন খৈমন র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে সিলভারডেল কেজি স্কুলে যায় হাজির হয়, বাইরের গেটে টুলের উপরে বসা দারোয়ান তাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চায় না, খৈমনের দিকে তাকায়া থাকে, তার পরনে একট ইস্তারিহীন লেড়লেড়া রঙ জ্বলা ছাপার শাড়ি, পায়ে গোড়ালি খাওয়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল; দারোয়ান। হয়তো ভাবে যে, এই বেটির এইখানে কি কাম? তখন খৈমন আসল কথাটা বলে, আমার পোলাটারে ভর্তি করুম, আমারে যাইতে দেন দারোয়ান ভাই।
দারোয়ান রামদাস হয়তো প্রথমে আপত্তি করে, কারণ তার মনে হয় যে, মাতারির মত এই মাইয়ালোকের স্কুলের ভিতরে ঢুকে কাম নাই, একে ঢুকতে দিলে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তারে চাবায়া খাবে, বলবে, রামদাস তুমি গেটে খাড়ায়া খাড়ায়া কি ঘুমাও, এইসব লোকজন ভিতরে ঢুইকা যায়? কিন্তু খৈমন তাকে ভাই বোলাইছে, তার মনে হয় যে, মাইয়ালোকটা ভাল, সে তাদের ঢুকতে দেয়, ভাবটা এমন করে যে, সে তাদেরকে দেখেই নাই, সে। জানেই না কোনখাল দিয় ঢুইকা গেল এমন দুইজন মানুষ, আমি কইতে পারব না ম্যাডাম, আমি দেখিই নাই কিভাবে ভিতরে ঢুকছে! তখন ভূতের গল্লির খৈমন তার এতিম পোলা চনিমিঞাকে নিয়া মিসেস রোকেয়া আনোয়ারের রুমের দরজার পর্দা সরায়া হুড়মুড়ায় ঢোকে এবং সে নুরানি বিলকিস উপমাকে বলে যে, তার দিকে তাকায়া রোকেয়া আনোয়ার তার চেয়ার থেকে ধুপ করে পড়ে যায়, খৈমন হয়তো এইগুলা বানায়া বলে, কারণ উপমা বেগমকে বান্দরের কথা বলতে যায় সে গল্প বানাইতে শেখে, হয়তো বিকালে নুরানি বিলকিসের রান্না ঘর কিংবা কুয়াতলায় বসে গল্প করার সময় আর কিছু বলার না পেয়ে খৈমন এইসবই বলে, তখন উপমা বেগম তার কথা মানতে চায় না, সব তর চাপা, এবং তখন খৈমন বলে, আমারে ইকটু তরকারি দেন পোলাটারে খাওয়াই। ফলে নুরানি বিলকিসের আর কি উপায় থাকে? সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তার খারাপ লাগে, তবুও সে ভাবে, গরিব এতিম পোলা এবং সে বলে, লয়া যা—খৈমন নুরানি . বিলকিসের এনামেলের বাটিতে বেগুন কিংবা ঝিংগা কিংবা আলুর তরকারি নিয়া ঘরে ফেরে। তখন চানমিঞা খায় এবং হয়তো তার মাকে ধমকায়, আম্মা পত্যেক দিন বাইগনের তরকারি আনো ক্যালা? এইসময় খৈমন নুরানি বিলকিসকে বলে যে, সিলভারডেল কেজি স্কুলের ভোটকু রোকেয়া আনোয়ার তাকে দেখে মাথা উঁচু করতে যায়া কেমন করে চেয়ার থেকে পড়ে যায়, খৈমন বলে, হয়তো সে চেয়ারে বয়া ঘুমাইতেছিল, বেড়ি নিজের স্কুলের চেয়ারে বয়া নিজেই ঘুমায়; এবং তখন ফ্লোর থেকে উঠে খাড়ানোর পর সে বিব্রত হয়া পড়ে এবং খৈমন যখন বলে, আপা আপনে পইড়া গেলেন? আমার পোলাটারে ভর্তি করেন, রোকেয়া আনোয়ার হয়তো পতনের পরে পুরাপুরি সুস্থির হয় নাই, তবে সে বিহ্বলতা কাটায়া দ্রুত এই ঝামেলা নিষ্পত্তি করতে সচেষ্ট হয়, সে বোঝে যে, এই মাইয়ালোকটা তার এই দুর্বলতা এবং পতনের সাক্ষী, ফলে সে খৈমনকে ক্ষেপাইতে চায় না, আয়াকে পাঠায় মিসেস ক্লার্ককে ক্লাস থেকে ডেকে আনার জন্য, এবং মেরি ক্লার্ক আসার পর তাকে বলে, টেক হিম টু ইয়োর ক্লাস। মেরি জয়েস একটু বিভ্রান্ত হয়া পড়ে, কারণ প্রিন্সিপালের ঘরের আলোয় আলো হয়তো কম ছিল–সে প্রথমে কেবল খৈমনকে সেখানে খাড়ায়া থাকতে দেখে, তার মনে হয় যে, কাকে সে ক্লাসে নিয়া যাবে? তখন এক মুহূর্তের খটকার পর সে খৈমনের হাঁটুর কাছে আঁচল খামচায়া ধরে খাড়ায়া থাকা চানমিঞাকে দেখে, এবং তবু যখন মেরি ক্লার্কের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয় না, সে বলে, এক্সকিউজ মি ম্যাম? তখন রোকেয়া আনোয়ার তার ধৈর্য হারায়া ফালায়, চোখে দেখো না তুমি মেরিঃ টেক দা বয় টু ইয়োর ক্লাস, এবং মেরি জয়েস সঙ্গে করে চানমিঞাকে নিয়া বের হয়া যাওয়ার পর সে বৈমনকে বলে, আমি পড়ে যাই নাই! রোকেয়া আনোয়ার হয়তো তখন আত্মবিশ্বাস ফিরা পেতে থাকে, ফলে তার রাগ বাড়ে, সে খৈমনকে আর পাত্তা না দেওয়ার ভাব দেখায়, সে মুখটা কঠিন করে খৈমনের দিকে তাকায়া বলে, এই স্কুলের বেতন কিন্তু অনেক টাকা, তখন খৈমন তার আঁচলের খুঁটে বান্ধা গিঁটু দেখায় এবং বলে, ট্যাকা আছে; এবং তখন মিসেস রোকেয়া আনোয়ারের খোঁড়া স্বামী এবং দুই নাবালক ছেলেমেয়ে, রিয়া এবং ফারুবারকে নিয়া যার সংসার-মুখের কঠিন রেখার ভিতরে হাসির আভাস দেখা দেয়, এই মহিলা কিংবা মাইয়ালোক কিংবা মাতারি আঁচলে বান্ধা টাকা দিয়া সিলভারডেলে পোলা পড়াইতে চায়, আশ্চর্য, সে নিশ্চিত হয় যে, এই সব মহিলার জন্য তার মনের কোনায় কোন মমতাই সে জাগায়া তুলবে না-রিয়াকে শিলং বোর্ডিং স্কুলে পাঠাইতেই হবে! কিন্তু মিসেস মেরি ক্লার্ক যখন চানমির শীর্ণ এবং প্রায় অস্তিত্বহীন একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়া প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হয়া কেজি ওয়ানের দিকে যায়, তার মনে হয় যে, এইসব পোলাপানকে রোকেয়া আনোয়ার স্কুলে ভর্তি করতাছে, এইগুলি কি করছে সে! কিন্তু তখন চানমিঞা মনে হয় মেরি জয়েসের হাতের ভিতরে অস্তিত্বহীনতার প্রান্ত থেকে ফিরা আসে, সে জ্যাক এন্ড জিল দ্রুত শিখা ফালায়, এবং মেরি ক্লার্ক পুচি চানমিঞার দিকে নজর দেয়, সে বলে, ভেরি গুড়, খুবই ভাল ছান মিঞা!
সিলভারডেল কেজি স্কুলের স্টাইলই ছিল আলাদা, ছাত্রছাত্রীর জন্য ছিল ইউনিফর্ম, সাদা সার্ট কিংবা টপের সঙ্গে মেরুন রঙের হাফ প্যান্ট কিংবা স্কার্ট, সঙ্গে মেরুন রঙের টাই, স্কুল প্রাঙ্গণের পাশে ছিল কাঠের বানানো দুইটা সি-স এবং একটা স্লাইড-এইগুলা রোকেয়া আনোয়ারের কায়দা, তার কথা হচ্ছে একটা কেজি স্কুল চালাইতে হলে এগুলা করা লাগে। প্রত্যেক বছরের প্রথমে বাচ্চা ভর্তি করা হয়া গেলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার আয়োজন ছিল ডা: নন্দির বাসায়, এটাকে মিসেস রোকেয়া আনোয়ার নাম দেয়, মেডিকেল চেকআপ আপন এন্ট্রি; ডা: এম এন নন্দি তখন র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে স্কুলের পাশের দোতলা বাসায় থাকে, নিচ তলার একপাশে তার চেম্বার, ফলে একদিন সকালে কেজি ওয়ানের পনের/বিশটা ছেলেমেয়েকে তাদের টিচার মেরি জয়েস লাইন ধরায়া রাস্তা পার করে ডা: নন্দির চেম্বারে নিয়া যায় হাজির হয়। মেরি জয়েস বাচ্চাদের নিয়া করিডোরে সোফায় বসে অপেক্ষা করে, কম্পাউন্ডার তালিকা থেকে নাম ডেকে ডাক্তারের রুমে বাচ্চা ঢোকায়, ডা: নন্দি বাচ্চাদের পরীক্ষা করে, সে তাদের সার্ট উঠায়া বুকে স্টেথো লাগায়া শোনে, প্যাট টিপা পিলার সাইজ দেখে ঠিক আছে কিনা, জিব দেখে, হাঁ করায়া গলার ভিতর দেখে, চোখের নিচের পাতা টেনে দেখে কিরকম লাল, তারপর ছেলেদের প্যান্ট টেনে নামায়া উঠবস করায়। চানমিঞা ডা: নন্দির রুমের বাইরে টিচারের সঙ্গে বসে থেকে দরজার পর্দার ফাঁক দিয়া ঘরের ভিতরে ন্যাংটা ছেলেদের কসরত করতে দেখে, এবং যখন আর দুই/তিনজন বাকি তখন মেরি জয়েস দেখে যে, বাচ্চা একজন কম, চানমিঞা নাই, এবং তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না; ফলে মেরি খুব বিব্রত হয় পড়ে এবং রোকেয়া আনোয়ার তাকে বকাঝকা করে, তুমি কেমন মেয়ে মেরি, এই পনেরটা পোলাপান দেখে রাখতে পার না!
তখন মেরির খুব রাগ হয় চানমিঞার উপর, এবং পরদিন সে যখন স্কুলে আসে তখন মেরি তাকে ধরে, তুমি কেমন পোলা, হেঁ?
চানমিঞা অধোবদন হয়া থাকে।
: তোমার সমস্যা কি, তুমি এরকম না বলে চলে গেলা কেন?
চানমিঞা কথা না বলে কান্দে, ফোঁপায়।
: তুমি কান্দো কেন, কেন কান্দো?
তখন চানমিঞা থামে এবং বলে, আমার ভয় লাগছে!
চানমিঞাকে নিয়া মেরি জয়েস আবার ডা: নন্দির চেম্বারে যায়, যেতেই হয়, না হলে রোকেয়া আনোয়ার তাকে আবার বকবে-তুমি এই রকম কেন কর বলতো? নিয়া যাও, দেখায়া নিয়া আস-তখন প্যান্টে সাসপেন্ডার লাগানো ভুড়িঅলা ফরসা ডাক্তার নন্দি তার চেম্বারে চানমিঞাকে দুই হাতে উঁচা করে ধরে, সে মুখ দিয়া একটা লম্বা শব্দ করে-আঃ-এবং মেরিকে বলে, এইটাতো দেখি ম্যাডাম এক আশ্চর্যজনক পোলা, বলে ভয় লাগছে, ভয় কিসের! তখন ডাক্তার তাকে চেম্বারে নিয়া পরীক্ষা করে, জিব দেখে, চোখ দেখে, এবং ডাক্তার নন্দি যখন তাকে জিগাস করে, তুমি ভয় পাইছো কেন? তখন সে বলে, আপনে প্যান্ট খুলছেন, আমার ভয় লাগছে।
ডাক্তার নন্দি বলে, এইটাতো ম্যাডাম দেখি এক আশ্চর্যজনক ভদ্রপোলাও, এই কথা শুনে মেরি একটু হাসে, চানমিঞার মাথার চুল আঙ্গুল দিয়া একটু নেড়ে দেয় এবং বলে, হি ইজ শাই এন্ড ব্রিলিয়েন্ট, তখন ডা: নন্দি টেবিলের সামনে বসা মেরিকে বলে, আপনে একটু বাইরে যায় বসেন, এবং তারপর ঘরের ভিতরে চানমিঞা একা হলে তার প্যান্ট নামায়া তাকে ওঠাবসা করায়, হার্নিয়ার কোন লক্ষণ আছে কিনা দেখার জন্য, ডাইন হাতে একটা পাতলা রাবারের দাস্তানা পরে চানমিঞার বড় সাইজের সিমের বিচির মত অণ্ডকোষ নিয়া নাড়াচাড়া করে দেখে, একটা, না দুইটা; তারপর তার চোখ পরীক্ষা করে, চানমিঞা একচোখ বন্ধ করে ঘরের কোনায় রাখা স্নেলেন এলফাবেট চার্ট থেকে পড়ে:
টি
ই পি
এল এইচ ভি
ও এস টি এ
এল সি ভি ই
এফ জেড টি এইচ পি
এন এল ও এস ভি এইচ
ও জেড ইউ এফ কে এল
টি ই পি সি এল ভি ও
ডাক্তার তখন তার কালার পারসেপশন বোঝার জন্যও পরীক্ষা করে এবং সে দেখে যে, চানমিঞা ইশিহারা কালার স্কিম থেকে পড়তে যায় গুলায়া ফালায়, সে ইংরেজি সংখ্যা ৭৪-কে পড়ে ২১, ডাক্তার বলে, আবার বল।
চানমিঞা বলে, টুয়েন্টিওয়ান।