০৩. বাবুল মিঞাও অপেক্ষায় ছিল

বাবুল মিঞাও হয়তো অপেক্ষায় ছিল যে, ময়না তাকে কিছু বলবে, কিন্তু ময়না মিঞা তার কাছেও আসে না, ফলে বাবুল মিঞাই একদিন ঠাটারি বাজারে ময়না মিঞার কাছে যায় এবং জিগাস করে, কিরে মাইয়া দেইখা আইলি, কিছু কচ না!

তখন ময়না মিঞা তাকে বলে যে, হারিকলের ঘোলা আলোয় ঘোমটা দিয়া থাকা খৈমনের কিছুই সে দেখতে পায় নাই, সে কেমনে বলবে মেয়ে দেখতে কেমন, পছন্দ হয়, নাকি হয় না! এই কথা আব্দুল জলিল এবং জরিমন, শোনে, রশিদুল শোনে; খৈমন তাদের খুবই আদরের মাইয়া, সোহাগের বইন, তারা তরকারিঅলা ময়না মিঞাকে আবার মেয়ে দেখানোর কথায় রেগে যায়, ছোটলোক একটা, তারা বলে, আমাগো মাইয়া রাস্তায় কুড়ায়া পাইছি নিহি, বারে বারে দেখামু।

তারা পুনরায় মেয়ে দেখানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেয় এবং ভাবে যে, এইভাবে খৈমনকে এক নিদারুণ ও গভীর অপমান থেকে বাচালো; তখন হয়তো জরিমন একদিন বিকালে বা রাইতে খৈমনকে এইসব কথা বলে, হয়ত জুরিমন নারিকেলের তেল মেখে তার চুল বেন্ধে দেয়, চুলের একটা মোটা বেণি করে আগায় লাল সাটিনের ফিতার একটা ফুল বানায়া পিঠের উপরে ঝুলায়া দিয়া বলে, কয় দেখে নাইকা, গাধা, আমাগো মাইয়া কি গাঙ্গের পানির লগে ভাইসা আইছে নিহি যে আবার দেখামু! কারণ ফখরুল আলম লেদু যখন মামুনকে খুঁজতে তাদের বাসায় যায়, সে মামুনকে পায় না এবং তখন মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমানকে বলে, কৈ যায় মামুন? কৈ কৈ ঘোরে? মামুন হয়তো সিলভারডেল কেজি স্কুলের এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান টিচার মিসেস মেরি জে ক্লার্ক অথবা মিজ ডি কস্তার বাসায় যায়—হয়তো মিসেস ক্লার্কের বাসাতেই-কারণ মিসেস ক্লার্কই তার ছাত্রদেরকে ভালবাসা এবং প্রশ্রয় দিত, ফলে তারা তার বাসা পর্যন্ত চিনা ফালায়। মামুন হয়তো তার বাসাতেই যায়, কারণ সেখানে ছিল তার টকিং বার্বি ডলের মত মেয়ে জুলি ফ্লোরেন্স, মামুন হয়তো ফখরুল আলম লেদুকে কিছু বলে না, সে হয়তো গোপনে নিয়মিত যাতায়াত করে মিসেস ক্লার্কের বাসায়, টিকাটুলি নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে, হয়তো জুলির সঙ্গে সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোর মধ্যে চুপচাপ বসে থাকে, হয়তো জুলি ফ্লোরেন্স ক্লার্ক বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকায়া থাকে আর মামুন দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবি দেখে; অথবা তারা হয়তো কথা বলে, মামুন দেওয়ালের একটা ছবি দেখে বলে, এইটা কুন মসজিদ? তখন জুলি ফ্লোরেন্স হাসে, ইটস নট এ মস্ক, এটা চার্চ, সেন্ট পিটার্স বেসিলিকা, সেন্ট পিটারের চার্চ, ভ্যাটিকানে।

: ভ্যাটিকান কুন জায়গায়?

: কুন জায়গায় বলেন ক্যানি? ভ্যাটিকান রোমে, ইটালিতে।

: ইটালি কোথায়?

: ইটালি ইউরোপে।

: ইউরোপ কুন জায়গায়?

জুলি ফ্লোরেন্সের মনে হয় যে, মামুন মিঞা তার সঙ্গে মশকারি করে, সে বলে, আমি জানি না কোথায়!

: যেইখানেই হোক তুমার ইউরোপ যাইতে মন চায়?

: চায়, ইয়েস, আই যুড লাইক টু গো, বাট মাই মম ইজ ট্রায়িং টু গো টু অস্ট্রেলিয়া।

তখন মামুন মিঞা চুপ করে আবার ছবি দেখে, তার মনে পড়ে সে যখন প্রথম দিন মিসেস ক্লার্কের বাসায় একা আসে তার ইচ্ছা ছিল এ্যাংলো মেয়েদের সঙ্গে একটু লটরপটর করে, এইটা মুসলমানের দ্যাশ এইখানে। এদের সঙ্গে এইসব ইকটু করলে কিছু এমন হয়না, ফলে সেদিন সে যখন জুলিকে একটা ফুল তোলা ছিট কাপড়ের হাতা কাটা ফ্রকের ভিতর দেখে, তার শরীর ঝিমঝিম করে, জুলির অল্প উথিত স্তন, অনাবৃত বাহুমূল, হাঁটু এবং পা, গলায় স্টার্লিং সিলভারের মিহিন চেনের সঙ্গে ছোট্ট একটা ক্রুসিফি। তার মনে হয় যে, জুলি ফ্লোরেন্স মানুষ না, পরী, এখনই উড়ে যাবে রোম কিংবা অস্ট্রেলিয়ায়, তার বড় ইচ্ছা হয় জুলি ফ্লোরেন্সকে জড়ায়া ধরে একটা কিস করে; সে বলে, তুমি সাংঘাতিক জুলি, কিন্তু মেয়েটা ছিল বড় টনটইনা, সে মামুন মিঞার কাছ থেকে দূরে দরজার কাছে একটা বেতের চেয়ারে বসে থাকে, কাছে এসে বসে না, তার কথাও সে না বোঝার ভান করে, কারণ সে জানে এইসব কথা হচ্ছে ফান্দের দরজার মত, একবার ঢুকলে জড়ায়া যাবে। মামুন মিঞা তখন তাকে বলে, তুমি অতো দূরে বসে থাক কালা? কাছে আইসা বসো!

কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের বয়স চৌদ্দ হলেও তার শরীরের ভিতর নারী সত্তা বাঘের রাজ্যে হরিণের মত কান খাড়া করে রাখে, সে বলে, আপনে কালা বলেন কেন?

মামুনের মনে হয় যে, জুলি হয়তো তার সঙ্গে একটু একটু খেলে, তার এই খেলা ভাল লাগে; সে বলে, ক্যালা কমু না কালা?

: বলেন, কেন। ক্যালা না, বলেন, কেন বলব না?

: বললাম, কেন। কেন যাইতে চাও তুমরা অস্ট্রেলিয়া?

জুলি ফ্লোরেন্সের ভাল ধারণা নাই, তার মা মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক যেতে চায়, তার বাপ রবার্ট ফ্রান্সিস ক্লার্ক এবং ভাই যোসেফ ইউজিনও যেতে চায়, কিন্তু কেন চায়, কেন চাও দেশ ছেড়ে যেতে? ক্যালা?

জুলি ফ্লোরেন্সের মনে হয় যে, তার উত্তর জানা নাই, অথবা হয়তো আছে; তাদের হয়তো এদেশে কিছু করার নাই, তার বাপ, বব, ব্রিটিশ কাউন্সিলের গার্ডেন সুপারভাইজার, বাগানের মালিদের দেখাশোনা করে, ঘাস লাগায়, কাটায়, মৌসুম বুঝে মালিদের দিয়া ফুলের চাষ করে, এবং নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে এসে বৌ-বাচ্চাদের কাছে তার এইসব আজগুবি কাজের গল্প করে, হল্যান্ড থেকে এই মৌসুমে ক্রিসেনথিমামের বিচি আনা হবে, জন স্টেইনবাকের একটা বিখ্যাত গল্প আছে এই ফুল নিয়া, আর-যদি টিউলিপ ফোটান যেত এই দেশে। তার গল্প হয়তো বালিকা জুলি আগ্রহ নিয়া শোনে, বয়স কম হলেও বাপের জন্য তার চিত্ত ব্যকুল হয়, জীবনের ব্যর্থতার বোধ থেকে নিজেকে কিভাবে বাচানোর চেষ্টা করছে লোকটা, হয়তো তার মনে হয়, সত্যিতো যদি এই দেশে টিউলিপ ফুটতো তার বাপ তাহলে নিশ্চয়ই ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলের বাগানে টিউলিপ ফুটাইতে পারতো, ফলে তখন হয়তো ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক স্টিভ, মিস্টার স্টিভেন এইচ আর্নল্ড, কখনো এই ফুল দেখে খাড়ায়া পড়তেন, দুইটা আঙ্গুল লম্বা করে কোন ফুলের গায়ে স্পর্শ করে হয়তো বলতেন, আরে বব, একি কাণ্ড, তুমি দেখি আমস্টার্ডামের হলুদ টিউলিপ এইখানে ফুটায়া ফালাইছো, ব্রাভো!

তখন হয়তো রবার্ট ক্লার্ক স্মিত হেসে বলতো, এমন কিছু না স্যার, আর একটু যদি শিশিরের পানি পাওয়া যেত তাহলে দেখতে কেমন টিউলিপ আমি এই দেশেই ফোটাই!

কিন্তু তা হবার নয়, এইখানে, এই দেশে, শুধু কসমস আর ডালিয়া, আর আছে হলুদ গেন্দা, আছে অবশ্য কলাবতীও; রবার্ট বলে যে, স্টিভেন যখন নাইরোবি থেকে বদলি হয়া নতুন ঢাকায় আসে সে বৃষ্টির দিনের সাদা কলাবতীর খুব ভক্ত হয়া ওঠে। কিন্তু একই জিনিস কত আর ভাল লাগে মানুষের, যদি এই দেশে আর একটু বেশি শিশির হতো, শীতটা একটু লম্বা আর গভীর হতো, তাহলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো রবার্ট ফ্রান্সিস ক্লার্কের; তার জন্য জুলি ফ্লোরেন্সের মন খারাপ লাগে, কিন্তু যোসেফ বাপের কথা শুনতে পারে না, সে বলে, এইসব আলবিলাতি কথা কেন বলো, মালির আবার ভাল খারাপ কি, কিছু না, কুছু নেহি, তুমি ইউজলেস মানুষ। ড্যাড, টেক ইট ইজি এন্ড ইনজয় ইয়োর ফিউটিলিটি!

জুলি হয়তো যোসেফের বিষয়টাও বোঝে, যোসেফ তেজগাওয়ে বিজি প্রেসের মেকানিক, যোসেফ ইউজিন ক্লার্ক হচ্ছে, যোসেফ মিস্ত্রি; কম্পোজিটার এবং মেশিনম্যানরা তাকে সালাম দেয়, সে সরকারি প্রেসের হাইডেলবার্গ কিংবা হনার ট্রেডেল মেশিন অথবা জাপানে তৈরি ইয়াহিমা ডবল ডিমাই কিংবা ডবল ক্রাউন ফ্লাট মেশিন নষ্ট হয়া গেলে মেরামত করে। সে মাসে বেতন পায়—১৯৮৫ এর জাতীয় বেতন স্কেলের হিসাবে মূল বেতন-১৩৫০ টাকা, তবে উপরি আছে তার-খুচরা পার্টস কেনার পয়সার ভাগ পায় সে-এবং অফিসের পরে প্রাইভেট পার্টিও আসে কল দেওয়ার জন্য, মেশিনম্যানরা এসে ডেকে নিয়া যায় বংশাল কিংবা বাংলাবাজারে, হয়তো নবাবপুরে আলেকজান্ডার মেশিনি প্রেসে-ইকটু দেইখা দেন ওস্তাদ রোলার নিয়া বহুত ঝামেলায় আছি-যোসেফ মিস্ত্রি মেশিনে হাত দিলে মালিক খুশি, হয়তো মেশিনও; কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের মনে হয় যে, তার মা খুশি হয় না, তার মা এইটা ভুলতে পারে না যে, সে সিলভারডেল কেজি স্কুলের টিচার আর তার স্বামী মালিদের সর্দার এবং একমাত্র ছেলে। ছাপাখানার মেশিনের মিস্ত্রি! এইসব কারণে তার মা ভোগে, জীবনে হলো

কিছু, এবং জুলি ফ্লোরেন্স যখন বড় হতে থাকে তখন সে বুঝতে পারে যে, তার বড় হওয়া নিয়াও তার মার অস্থিরতা বাড়ে, কিন্তু কোন কিছুই তার বড় হওয়া আটকায়া রাখতে পারে না, তার স্কার্ট ফ্রক প্যান্টি ক্রমাগত ছোট হয়া যায়, তার মনে হয় যে, শরীরের এই বেড়ে ওঠায় তার নিজেরও দিশাহারা মতন লাগে, কি হবে এখন, এই দেশে সে বড় হয়া যাইতাছে-এই দেশে এই শরীর নিয়া এখন কি হবে! তখন তাদের নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে কিশোর মামুন মিঞা একটা শিয়ালের মত আসে, কাকের মুখ থেকে যদি গোসের টুকরা বাইচান্স পড়ে, জুলি ফ্লোরেন্স হয়তো বিষয়টা বোঝে, অথবা খুব পরিষ্কার বোঝে না, তার তবু অনির্দিষ্ট অচেনা ভয় হয়, মামুন মিঞার মুখের দিকে তাকায়া তার কিছুটা বিভ্রান্তও হয়তো লাগে, তার হয়তো মনে হয় যে, মামুন মিঞা এই কথা বলে কেন? মামুন মিঞা কি জানে না কেন তারা যেতে চায় অস্ট্রেলিয়া? সে বলে, কেন যেতে চাই জানি না, আমার মম যেতে চায়, পার্টিকুলারলি শি ওয়ান্ট টু গো, কেন চায় জানি না, হয়তো এখানে ভাল লাগতেছে না মার।

: তুমি চাও যাইতে? কেন চাও?

মামুন মিঞার কথায় জুলি ফ্লোরেন্স বিচলিত হয়া পড়ে, তার কৈশোরিক জীবনে হয়তো এইরকম আচরণ এর আগে সে দেখে নাই, সে মামুন মিঞার মুখের দিকে তাকায়, বলে, কি বলেন আপনে, যাব না? মম গেলে অফকোর্স আই উইল গো-থাকব কোথায়?

মামুনুল হাই কি তখন সন্ধ্যার অন্ধকারের ভিতর কেন্দে ফেলে? হয়তো কান্দে না, বিষণ্ণ হয়া থাকে, জুলি ফ্লোরেন্সকে অন্ধকারের ভিতর জোর করে কিংবা আধা-জোর করে চুমা খাওয়ার চিন্তা সে বাদ দেয়, তার মনে হয় কি যে সুন্দর টিচারের এই মেয়েটা, এই দেশে তার থাকার জায়গা নাই কোন, সে বলে, তুমি যায়ো না জুলি, তুমি একটা ফুল পরী, তুমি অস্ট্রেলিয়া যায়ো না, এই দেশে থাক, তুমি গেলে গা আমাদের কি হবে, আমাদের ফুল বাগানের কি হবে বলো?

ফখরুল আলম লেদু ব্যাপারটা খুবই আন্দাজ করতে পারে, কারণ তাকে যত বোকা মনে হয় তত বোকা সে মোটেও না, সে মামুনকে বলে, টিচারের বাইতে ঘন ঘন যাস?

: গেলে, তর কি?

: জুলি ফ্লোরেন্সের দিকে নজর দেছ? কিস দিছস?

: পারি নাইকা অখনো, ইচ্ছা আছে।

: আমারও ইচ্ছা আছে।

: মান্দারপোলা, মাইরা ফালামু তরে, ভদ্র একটা মেয়েরে নিয়া তুমি বদমাইশি চিন্তা করো!

: তুমি কি করো হারামদা বান্দর? তুই যদি আবার টিচারের বাইতে যাবি আমি টিচাররে কমু, তুই বদমাইশি করনের লাইগা ঘুরতাছচ!

কিন্তু লেদুর কথায় কাজ হয় না, মামুন বোঝে যে, লেদু এইসব কথা এমনি বলে; ফলে ফখরুল আলম লেদু আবার মামুনদের বাসায় যায় দেখে যে, সে বাসায় নাই, তখন তার মার সঙ্গে দেখা হলে সে বলে, কৈ যায় কনতো খালা?

মিসেস জোবেদা রহমান এইবার চানমিঞার প্রসঙ্গে না যায় বলে, তগো এক টিচার আছিল কি জিনি নাম?

লেদু বুঝতে পারে, সে বলে, টিচারের বাইতে যায়?

: হঁ, তগো টিচারের মাইয়া আছে একটা, হের কাছে।

: আপনেরে কইলো কেঠা?

হয়তো মামুনের কাছ থেকেই তার মা শোনে, এবং মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, এই রকম মাইয়ামানুষ আমার পছন্দ না, বেড়া মানুষরে গিল্লা খাওনের লাইগা হাঁ কইরা বয়া থাকে-চানমিঞার মা খৈমনের মত-এই রকম সেয়ানা মাইয়ালোক খালি ধান্দা বুজে; কিন্তু জোবেদা বেগম এইসব কেন বলে? কারণ খৈমনের হয়তো ঠাটারি বাজারের সজি বিক্রেতা ময়না মিঞাকে বিয়া করার জন্য শেষ পর্যন্ত ছলাকলার আশ্রয়ই নেওয়া লাগে, তখন তার বয়স হয়তো ছিল ষোলসতের, কারণ তখন কম বয়সেই মেয়েদের বিয়া হতো, অথবা হয়তো আরো বেশি, বিশ/বাইশ, জোবেদা রহমান যেমন বলে, বুড়ি হয়া গেছিল গা, কেউয়েই দেইখা পছন্দ করতো না। তখন, তার বয়স যোলসতের কিংবা বিশ বাইশ যাই হোক, ময়না মিঞা দেখে যাওয়ার পর বলে যে, সে তাকে দেখতে পায় নাই; এর পিছনে ময়না মিঞার বদমাইশি থাকতে পারে, মেয়ে দেখার পর কেউ এইরকম বলে? আশ্চর্য! ফলে খৈমনের বাপম ঠিকই রাগ করে, কিন্তু তারা যতই রাগ দেখাক, হম্বিতম্বি করুক, খৈমনেরতো দিন কাটে না, রাইত গোয়ায় না, তার ডাগর চোখের কোনায় পাতিলার তলার মত কালি জমে, তার মনে হয় যে, ময়না মিঞা হয়তো আসলে দুষ্টামি করে, সে হয়তো তাকে ঠিকই দেখেছে, তবু হয়তো তাকে আর একবার দেখার ইচ্ছা হয় তার। ফলে তখন তার মা জরিমন যখন বলে, অতো সস্তা না, আমরা বারে বারে মাইয়া দেখাই না, তখন খৈমনের মুখের দিকে তাকায়া তার কথা বন্ধ হয়া যায়, সে বলে, কি হইছে তর, খৈ?

খৈ বলে, দেখবার চাইলে আবার দেখাও।

জরিমন তখন আব্দুল জলিলকে বলে, আব্দুল জলিল বলে বাবুল মিঞাকে, এবং ঠাটারি বাজারের রাস্তার উপরে আঁকার ভিতরে আনাজ সাজায়া বসা ময়না মিঞার কদর বোঝা যায় এই বঙ্গদেশে, তবে সে আর বেশি নখরা করে না, করলে খৈমন বেগম কেন্দে দিত অথবা ঠাটারি বাজারে যায় তাকে হয়তো জিগাস করতো, আপনে এমুন করতাছেন। ক্যালা? কিন্তু সে আর কিছু করে না, কেবল খৈমনকে আর একবার দেখতে চায়, এবং পুনরায় একদিন ভূতের গল্লিতে খৈমনদের বাড়িতে আসে। তখন ঘটনাটা ঘটে এবং সে জন্যই হয়তো মিসেস জোবেদা রহমান তার সম্পর্কে এত কথা বলে, কারণ ঘটনাটা হয়তো সাজানোই ছিল, খৈমন সাজিয়েছিল মহল্লার পোলাপানদের সঙ্গে নিয়া; কিংবা হয়তো তা সাজানো ছিল না, হয়তো ব্যাপারটা কাকতালিয় ছিল মাত্র। সেইদিন সন্ধ্যায় ময়না মিঞা সার্ট পান্ট এবং প্লাস্টিকের জুতা পরে মন্দিরের পাশের গল্লি দিয়া যখন হেটে আসে, ৩৬নম্বর বাড়ির বাইরের ঘরে পুনরায় কেরাসিনের বাত্তি জ্বালায়া খৈমন একটা মাদি মাকড়সার মত অপেক্ষা করে-মনে হয় একটা ব্লাক উইডো স্পাইডার শিকার ধরার জন্য সুতার জাল বিছায়া মাঝখাখে স্থির হয়া থাকে-ফলে ময়না মিঞা আগায়া আসে। সে ২৫নম্বর বাড়ি পার হয়, এবং তখন হয়তো বর্ষাকাল ছিল, ফলে সে এই বাড়ির ভিতর থেকে আসা কামিনি ফুলের ঘন ঘ্রাণ পায়, তারপর সে ৩২নম্বর বাঘঅলা বাড়ির সামনে দিয়া হেঁটে যায়, সে দেখে যে, বাড়ির সামনের সান বান্ধানো প্রাঙ্গণের দুই পাশে বেদির উপরে দুইটা সিমেন্টের বাঘ মাথা উঁচা করে শুয়ে আছে; ভারপর সে যখন ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায় তখন একদল পোলাপান হৈহৈ করতে করতে একদম হঠাৎ কোনখান থেকে যে দৌড়ায়া আসে বুঝতে পারা যায় না, এবং তখনই কোখেকে একটা কুত্তাও এসে হাজির হয়, তাগড়া মোটাসোটা কুত্তাটার লেজের আগা কাটা; ময়না মিঞা খৈমনদের বাড়ির গেট পার হয়া, ভিতরে ঢুকবে এইরকম সময় পোলাপানগুলা তার পিছনে কুত্তাটা লেলায়া দেয়, তারা ময়না মিঞার দিকে হাত লম্বা করে দিয়া বলে, ছুঁলে টমি, ছুঁ ছুঁ।

বিপজ্জনকভাবে লাফাইতে থাকা কুত্তাটা তখন ময়না মিঞার গায়ের উপরে উঠে পড়তে চায়, ফলে সে ভয়ে দৌড় দেয়, বাড়ির ভিতরে ঢুকে ঘরের মধ্যে চলে যায়-তখন খৈমন বেগম হারিকেনের বাত্তি জ্বালায়া প্রতীক্ষায় ছিল। তবে ঘরের ভিতর ঢুকেও ময়না মিঞার দুর্গতি শেষ হয় না, দরজার চৌকাঠে পাও আটকায়া সে আধোঅন্ধকারের মধ্যে হুড়মুড় করে চৌকির উপর পড়ে যায়, তারপর তার যখন সম্বিৎ ফেরে এবং চোখে ঘরের অন্ধকার সয়া আসে, সে হারিকেনের অল্প আলোয় দেখে যে, তার দেহের নিচে চাপা পড়ে আছে খৈমনের দেহ-তখন খৈমন হয়তো তাকে ভৎসনা করে, কি করেন, সরেন!

অথবা সে হয়তো তার শরীরের উপর চাপ দিয়া থাকা ময়লা মিঞার চোখ নাক এবং চাপা চিবুকের দিকে তাকায়া বলে, আমারে নিকি আপনে দেখেন নাইকা, অখনে দেইখা লন, আবার কয়েন না যে হারিকল বাত্তির আলোয় চোক্ষে দেখেন নাইকা কিছু!

ময়না মিঞা তখন কি করে তা বলা মুশকিল, সে হয়তো তার হাত দিয়া খৈমনের নরম তরুণ শরীর বেষ্টন করে এবং খৈমনের দিশা হরানোর দশা হয়, হয়তো খৈমন বলে, আমারে আপনে বিয়া করেন ময়না মিঞা, আপনে শ্যামবাজার ধন তরকারি কিন্না আননের পর আমি বাইছা ধুইয়া পরিক্ষার কইরা দিমু, আপনের কিছু করন লাগব না, আপনে খালি আরাম করবেন, পানবিড়ি খাইবেন, উক্কা টানবেন, তারপর আমি আপনের মাথায় গামছার বিড়া বানায়া চাঙ্গারি তুইলা দিলে আপনে বাজারে যাইবেন, আপনের যুদি নিকি তাও কষ্ট হয়, ভারি লাগে, আমি মাথায় কইরা চারি সয়া যামু আপনের পিছনে, অাপনে যাইবেন আগে আগে, আপনেরে দুকান সাজায় বহায়া দিয়া আমি ফিরা আমু বাইতে, আইসা আপনের লাইগা ভাত রান্দুম, ছান রাম, আপনের যা যা খাইতে মন চায় তার ব্যাক রাম, আপনে বেচাকেনা শ্যাষ কইরা আইসা ভাত খাইবেন, আমি তালের পাংখা লয়া বমু কাছে, আপনে আমারে বিয়া করেন; কিংবা খৈমন হয়তো দিশা হারায় না, ময়না মিঞা দ্রুত খৈমনের গায়ের উপর থেকে উঠে চৌকির এক কোনায় যায় বসে বলে, পোলাপানগুলান এমুন বদ, আমার পিছনে কুত্তা ইয়ায়া দিল।

: ডরাইছেন?

: না ডরামু কেন, পোলাপানগুলা খুবই বদমাইশ!

খৈমন ভিতরে যায়া তরিতে করে জরিমনের বানানো চাইলের পায়েস নিয়া আসে, কাচের গ্লাসে করে রুহ আফজা দিয়া বানানো শরবত আনে, ময়না মিঞা চিনামাটির অজ্ঞরি থেকে চামচের খচখচ শব্দ তুলে পায়েস খায়, ঢক ঢকর শব্দ করে শরবত খায়, খৈমন তার খাওয়া দেখে; তখন থৈমন টেবিলের উপরে রাখা হারিকেনের আলোর সামনে মুখ আগায়া নিয়া তাকায়া থাকে, তার চোখ বলে, আমারে দেখো, তার মুখ বলে, আমারে দেখো, তার বঙ্কিম অস্পষ্ট শরীর বলে, আমারে আবার দেখো ময়না মিী! ময়না মিঞা একবার হয়তো তাকায়, তারপর চাইলের ক্ষির খায়া ফি যাওয়ার পর সে বাবুল মিঞাকে বলে, আপনে বিয়ার ব্যবস্থা করেন, আর মাইয়ার বাপেরে জিগান আমারে কি দিব, এবং ফখরুল আলম লেদুকে যখন মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমান এইসব কথা বলে, তখন লেদু জিগাস করে, আপনে কেমনে জানলেন?

: বাহ জানুম না? এক মহল্লায় থাকি না!

বৈমনের তাহলে তখন ময়না মিঞার সঙ্গে বিয়া হয়া যায়, এইটা হয়তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগেই ঘটে, কারণ একাভুর সনে মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখের রাইতে যখন যুদ্ধ লাগে তখন চানমিঞা হয়তো খৈমনের গর্তে, হয়তো তখন সে ভরা পোয়াতি, ফলে পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়ে মহল্লার সকলে যখন পালায়া যায় কুমিল্লা কিংবা জিঞ্জিরার দিকে, তখন বৈমনের পক্ষে গৃহ ত্যাগ করা সম্ভব হয় না। মহল্লা একদম খালি হয়া গেলে জরিমন অস্থির হয় পড়ে, অব্দুিল জলিলও বিচলিত হয়; তারপর, মহল্লায় থেকে সকলে মিলে একসঙ্গে মরার চাইতে জরিমন মেয়েকে নিয়া বাসায় থাকে, আব্দুল জলিল তার ছেলে এবং মেয়ের জামাইকে নিয়া জিঞ্জিরার চরাইল গ্রামে জরিমনের মামাতো কিংবা খালাতো বোনের বাড়িতে যায় ওঠে। জিঞ্জিরায় পাকিস্তানি মিলিটারি ঢাকা থেকে পালায়া আসা লোকদের ইন্দুরের মত্ত ধরে, ফাটায়; ঢাকা শহরের নারী পুরুষ বৃদ্ধ শিশু এসে জড় হওয়ার পর তারা সেখানে অপারেশন চালায়, আব্দুল জলিল তার ছেলে এবং মেয়ের জামাইকে নিয়া জিঞ্জিরার ধান ক্ষেতের উপর দিয়া ছোটাছুটি করার পর মাঠের এক প্রান্তে একতলা একটা পাকা দালান দেখতে পায়, দালানের চাইর দিকে দেওয়াল দিয়া ঘেরা, দেওয়ালের একপাশে একটা কাঠের দরজা, এই দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তখন আব্দুল জলিল এবং তার সজিদের মনে হয় যে, তাদের পক্ষে আর দৌড়ানো সম্ভব না, তাদের শরীরের শক্তি প্রায় শেষ এবং এইভাবে মাঠের ভিতর দিয়া দৌড়াইতে থাকলে পাকিস্তানি মিলিটারি তাদের দেখে ফেলবে এবং গুলি করে মারবে। তারা তাই বাড়িটার প্রাঙ্গণের দরজায় যায় ধাক্কা দেয়, কিন্তু কেউ দরজা খোলে না, তারা আবার ধাক্কায়, আবার কেউ আসে না, তখন তারা নিচা স্বরে ডাকে, আমাগো বাঁচান, দরজা খোলেন!

তবুও দরজা না খুললে রশিদুল দেওয়াল টপকায়, টপকাইতে হয়, কারণ জান বাঁচান ফরজ, সে ভিতরে ঢুকে দরজা খুলে দিলে আব্দুল জলিল এবং ময়না মিঞা বাড়ির ভিতরে ঢোকে এবং তারা দেখে যে দালানের ঘরের দরজা খোলা। তখন তারা কাছে যায় ঘরের ভিতরে উকি মারে, এবং দেখে ঘরের মধ্যে আজানুলম্বিত সাদা আলখাল্লা পরা একজন লম্বা দাড়িঅলা লোক মাটিতে পাতা মাদুরের উপর বসে দেওয়ালে হেলান দিয়া চোখ বুজ্জে তসবি টেশে, তাকে ধ্যানমগ্ন মনে হয় তার হাতের দুইটা আঙ্গুল শুধু নড়ে। এই লোকটাকে দেখে তাদের বিস্ময় লাগে, কথা বলে কিংবা ঘরের ভিতরে ঢুকে লোকটার ধ্যান ভাঙ্গাইতে তাদের ভয় হয়, তারা ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে উঠানে আর কোন লোকজন দেখে না, তারা অন্য এক ধরনের বিপদের মধ্যে পড়ে। তারা বাইরের প্রাঙ্গণের দরজা লাগায়া দিয়া নিচা হয়া উঠানের এক কোনায় বসে থাকে, এবং তিন জনেই বিড়বিড়ায়া দোয়া পড়ে; তখন অনেক সময় কাটে, তারপর তারা দূরে জনতার অস্পষ্ট কোলাহল শোনে, তারা কান খাড়া করে থাকে, কোলাহল ক্রমে কাছে আসে এবং তখন তারা কোলাহলের ভিতর থেকে শব্দাবলী বিছিন্ন করতে পারে, তারা শোনে জনতা শ্লোগান দেয়, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আব্দুল জলিল এবং তার সঙ্গিরা বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানি মিলিটারি হয়তো এদিকে এগিয়ে আসছে এবং মিলিটারি দেখে মানুষ ভয়ে শ্লোগান দেয়। জনতার শ্লোগানের শব্দ স্পষ্ট হতে হতে একদম কাছে এসে পড়ে, তখন তাদের কলিজার পানি শুকায়া যায়, তারা উবু হয়া থেকেই দৌড় দিয়া যায় ঘরের মধ্যে ঢোকে, এবং তাদের দেখে লম্বা আলখাল্লা পরা লোকটা উঠে খাড়া হয়, তার ডাইন হাতটা শরীরের পাশে একটু উঁচা করে ধরা এবং এই হাতে বাদামি রঙের পুঁতি দিয়া গাঁথা তসবির মালা অনিশ্চিতভাবে দোলে, সে প্রবল চঞ্চলতায় অস্থির হয় পড়ে, আব্দুল জলিল এবং তার সঙ্গি অন্য দুই জনের কোন পরিচয় জানার আগেই বলে, আপনেরা থাকেন, আমি গেলাম; তারপর সে ঘর থেকে বের হয়া বাড়ির পিছনের দেওয়াল টপকায়া নেমে যায়। তাদের কিছু করার থাকে না, তারা পিছনের দেওয়াল টপকায়া এই লোকের মত পালানোর ইচ্ছা বাদ দেয়, তারা ঘরের ভিতরে তিনজনে মাদুরের উপরে দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসে থাকে, দোয়াদরুদ পড়ে; আব্দুল জলিল পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়া একটা কিস্তি টুপি বের করে মাথায় দেয়, তারপর, আবার কিছু সময় কাটে, তাদের মনে হতে থাকে যে, মিলিটারির বিপদ হয়তো কেটে গেছে, ফলে তারা উৎকণ্ঠা এবং ক্লান্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়া পড়ে, এই সময় অনেকটা ঘুমের ভিতরেই তাদের মনে হয়, কোথাও কেউ দরজায় ঠকঠকায়! তাদের তন্দ্রা কেটে গেলে তারা কান পাতে এবং নিশ্চিত হয় যে, এই বাড়ির বাইরের দরজায় বেশ জোরে থাপড়ায় কেউ, তাদের কোন উপায় থাকে না, রশিদুল অথবা ময়না মিঞা, হয়তো রশিদুলই, যায় দরজা খুলে দেখে সামনে চাইনিজ রাইফেল হাতে খাকি পোশাক পরা মিলিটারি, তারা দরজা ঠেলে প্রাঙ্গণে ঢোকে, তাদের একজন বলে, ইয়ে কেয়া দারবিশকা মাকান হায়? কাহা হায় তুমহারা দারবিশ?

রশিদুল কি বোঝে বলা মুশকিল, সে ভয়ের চোটে হাত তুলে ঘরের দিকে দেখায় এবং বলে, এই, এই।

সেইদিন দুপুরে মিলিটারি যখন এই ঘরের দরজায় এসে খাড়ায়, তারা ভিতরে দেওয়ালে হেলান দিয়া বসা মাথায় টুপি পরা দাড়িঅলা আব্দুল জলিলকে পায়, এবং তারা বলে, আপ দারবিশ হায় কেয়া?

মিলিটারি দেখে আব্দুল জলিল উঠে খাড়ায়, মিলিটারিরা তা দেখে অস্থির হয়া ওঠে, আগের সেই লোকটাই কথা বলে, হয়তো সেই এই চাইর/পাঁচজনের দলের সর্দার, সে যখন বলে, আপ বৈঠিয়ে জি, আপ বুজুর্গ হায়, আপ বৈঠিয়ে, তখন আব্দুল জলিল বসে, এই সুযোগে রশিদুল এবং ময়না মিঞার মনে হয় দৌড় দিয়া পালায়া যায়, কিন্তু দুইজন মিলিটারি ঘরের দরজায় খাড়ায়া বাইরের দিকে তাকায়া ছিল, ফলে তাদের পক্ষে দৌড় দেওয়া সম্ভব হয় না, তারা খাড়ায়াই থাকে, থাকাই লাগে। তবে একটা জিনিস তাদের কাছে পরিষ্কার হতে থাকে, হয়তো ঘরের ভিতরে আতঙ্কে ঘেমে গোসল করে ওঠা আব্দুল জলিলও ব্যাপারটা অল্প অল্প বুঝতে পারে; যে লোকটা দেওয়াল টপকায়া পালিয়েছিল তাকে হয়তো এলাকার মানুষ দরবেশ বলে ডাকে, সে কথা পাকিস্তানি মিলিটারি পাবলিকের কাছে শোনে, এখন এখানে এসে আব্দুল জলিলকে দেখে তারা বিভ্রান্ত হয়, তার লম্বা সাদা দাড়ি এবং মাথার টুপি তাদের জন্য বিভ্রম তৈরি করে রাখে-আব্দুল জলিলের ময়লা পাঞ্জাবি, তারচাইতেও ময়লা লুঙ্গি দেখেও বিষয়টা তাদের কাছে পরিষ্কার হয় না-তখন আব্দুল জলিল পুনরায় মাদুরের উপর বসে, হাত দিয়া মাদুরের খালি জায়গা দেখায়া দিয়া বলে, আপনেরা বসেন। এটা নিশ্চিত যে, আব্দুল জলিলের কথা তারা কিছু বোঝে নাই তবে মাদুরের দিকে ঈঙ্গিত করায় তাদের সর্দার, হয়তো বালুচ কিংবা পাঞ্জাব কিংবা সিন্দ রেজিমেন্টের ল্যান্সনায়েক অথবা নায়েক সুবেদার খামিসু খান। কিংবা শাহবাজ খান কিংবা বাচ্চা খান মাথা ঝাঁকায়, নেহি নেহি, হামলোগ নেহি বৈঠেগী, আপকা ইয়াহা কেয়া পানি হায়, হাম পানি পি সাকতা?

তখন বোঝা যায় যে, পাকিস্তানি মিলিটারি মানুষ মেরে হয়রান হয়া গলা শুকায়া ফালায়, এবং তারা দরবেশের বাসায় পানি খেতে আসে, ফলে আব্দুল জলিল হাঁক দেয়, রশিদুল, ময়না মিঞাঁ এই দিকে আহহ!

রশিদুল এবং ময়না মিঞা মিলিটারিদের ঠেলে দুই আসামির মত কাপতে কাপতে ঘরের ভিতরে এসে খাড়ায়, তখন আব্দুল জলিল বলে, ইনারা পানি খাইব, ইনাগো লাইগা পানি আনো!

রশিদুল এবং ময়না মিঞা বুঝতে পারে, পাকিস্তানি মিলিটারিকে পানি খাওয়াইতে না পারলে জান বাঁচবে না, তারা বাইরের এই ঘর থেকে পিছন দিকের একটা ঘরে যায় এবং সেখানে এলুমিনিয়ামের জগ এবং কাচের দুই/তিনটা গ্লাস পায়, কিন্তু তারা দেখে যে, জগে কিংবা ঘরের কোথাও পানি নাই, তখন ঘরে পানি না পায় তারা গ্লাসগুলা মাদুরের উপর রেখে জগ নিয়া বের হয়, তারা ঠিক করে যে, পানি পেলে তারা ফিরবে, না পেলে আব্দুল জলিলকে ফেলেই ভেগে যাবে। কিন্তু তারা বাড়ির পিছন দিকে একটা চাপকল পায় এবং ময়না মিঞা কলের হাতল চেপে জগে পানি ভরে, তখন রশিদুল পিছনের দেওয়ালের কাছে যায় পায়ের পাতার উপরে উঁচা হয়া দেওয়ালের অন্য পাশে তাকায়, সে দেখে যে, দেওয়াল থেকে সামান্য দূরে বাড়ির ভিটা ঢালু হয়া নেমে যায়া ক্ষেতের সঙ্গে মিশেছে, এইখানে ভিটার ঢালের উপরে দরবেশের গুলি খাওয়া প্রাণহীন এলোমেলো দেহ উপুড় হয়া পড়ে আছে; কিন্তু বাবুল মিঞা যখন খৈমনের বিয়া ঠিক করে, তখন পোলার যৌতুকের দাবীর কথা শুনে আব্দুল জলিল এবং জরিমনের আক্কেল গুড়ুম হয়, তারা বলে, এইটা কেমুন পোলা, কয় জিগান আমারে কি দিব, এবং তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে, পোলাটা ভাল না, সে তাদের মাথায় চড়ে যাচ্ছে, তখন তারা পুনরায় বলে যে, তাদের মেয়ে অত সস্তা না যে, এক তরকারি বিক্রেতার সঙ্গে দেওয়া-খোয়া করে বিয়া দিতে হবে, দিমু না বিয়া মাইয়ার।

কিন্তু খৈমনের এত উত্তেজনা হয় না, সে বলে, জিগাও কি চায়, যা চায় দিয়া দেও!

ময়না মিঞা তাদের বাড়ির অর্ধেকটা দাবী করে, শুনে খৈমনেরও কান্দা এসে যায়, সে কান্দে আর কান্দে, এই কান্দা ফুরায় না, তার মনে হয় যে, এ কেমন লোক, একটা তরকারিঅলা মাত্র, কোন অফিসের দারোয়ান না, পিয়ন না, স্কুলের দপ্তরিও না, ফকির একখান, সে কিনা ঢাকা শহরের এক কাঠা জমির উপরকার বাড়ির অর্ধেক ভাগ চায়! যখ, কান্দাই গৈমনের সাথি হয়, তখন বাবুল মিঞা আসে, সে অবস্থার বিচার বিশ্লেষণ করে দেখে, তার এ বিষয়ে সন্দেহ থাকে না যে, গ্রামের পোলাটা খুবই অবিবেচক, সে একটা মুদি দোকান করার পয়সা চাইতে পারতো, সে অন্য কোন ব্যবসা করার বায়না ধরতে পারতো, তা না করে সে একেবারে কইলজায় হাত দিয়া দিল, তখন বাবুল মিঞা পুনরায় হুমায়ুন কবিরের কথা বলে, এবং তার এই কথা শুনে খৈমন দ্রুত কান্না থামায়, সে তার মাকে বলে, যা চায় দেও, আমি যেটুকু পামু সেইটুকুই দিয়া দেও, আমারইতো থাকব।

আব্দুল জলিল এবং জরিমন শেষে মেনে নেয়, রশিদুলও আপত্তি করে না, বিয়ার দিনই সাদা ফুলসক্যাপ কাগজের উপরে লেখা দানপত্রের নিচে আব্দুল জলিল চোখের পানি মুছে নিয়া আঁকাবাকা হাঙে সই করে, এর পরেই কেবল ময়না মিঞা কবুল বলে। এইভাবে মোছা : খৈমনের বিয়া হয় এবং বাসর রাইতে প্রথমেই সে ময়না মিঞাকে জিগাস করে, আপনে এমুন করলেন!

: কি করছি আমি।

: বিয়া করনের লাইগা বাড়িই লেইখা লইলেন?

: তুমি কুত্তা লাগাইছিলা, আমি বাড়ি নিলাম!

খৈমন হয়তো ভাবে এই লোকটা কি গনক? কিভাবে জানলো যে, সে এই কাজ করেছে। অথবা হয়তো তার অবাক লাগে, মনে হয় যে, কি বলে লোকটা, কিসের কুত্তা, সে কেন কুত্তা লাগাতে যাবে, আশ্চর্য!

সে বলে, আমি কুত্তা লাগামু ক্যালা!

আমি জানি!

তবে খৈমনকে জানতে ময়না মিঞার হয়তো আরো বাকি ছিল, ফলে ময়না মিঞা যখন বাসর ঘরে ঢোকে খৈমন বোঝে, তার পাঞ্জাবির পকেটের ভিতরে একটা কাগজ আছে এবং তার মনে হয় যে, এটা অর্ধেক-বাড়ি লিখা দেওয়ার দানপত্র, লোকটার এই কাগজ বেখে আসার একটা জায়গা পর্যন্ত নাই, এমন একটা লোক এই কাজ করলো! যাহোক, আব্দুল জলিল হয়তো বলে, মাইয়ার মুখের দিকে তাকায়া করলাম; জরিমনের মন হয়তো ভার হয়া থাকে, তবু সে ভাবে, মাইয়াটার বিয়া দেওন ফরজ আছিল! তখন মনে হয় যে, বাসর রাইতে ময়না মিঞা হয়তো খৈমনের সঙ্গে একটু বেশি কথাই বলে, কারণ, তরকারি বিক্রেতা ময়না মিরি বাড়ি লিখা দেওয়ার আবদারী বাড়াবাড়িই ছিল, ফলে এই কারণে, অথবা বিয়াজনিত ধকলের কারণে খৈমন লাল বেনারসি অথবা লাল রঙের অন্য কোন শাড়ি পরে বাসর শয্যায় হয়তো বিমর্ষ হয়াই বসে ছিল, আব্দুল জলিলের বাড়ি লিখা দেওয়ার সময়কার চেহারাও তাকে হয়তো খুবই বিচলিত করে রাখে-তারপরেও সে একটা আনন্দের প্রতীক্ষায়ই ছিল। কিন্তু ময়না মিঞা তাকে কুত্তা লেলায়া দেওয়ার বিষয়ে অভিযুক্ত করলে তার ভাল লাগে না, রাইত একটু গড়ালে ময়না মিঞা যখন প্রথম সহবাসের আয়োজনে ব্যস্ত হয়, তখন খৈমন প্রথমে চুপ করে থাকে, তারপর বলে, পাঞ্জাবির পকেটের ভিতরে কি রাখছেন, খচড়মচড় করে!

ময়না মিঞা কিছু বলে না, তখন খৈমন আবার বলে, কাগজ বাইর কইরা টেবিলের উপরে রাখেন না ক্যালা?

উত্তেজনায় বেহুশ ময়না মিঞা তাই করে, পকেটে ভাজ করে রাখা শক্ত কাগজটা বের করে সে শয্যার পাশের টেবিলের উপরে রাখে, তারপর কাজ শেষে বিছানায় কাইত অথবা চিৎ হয়া শুয়ে থাকে এবং খৈমন দ্রুত উঠে কি সব করে, টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি টেলে খায়, ময়না মিঞাকৈ দেয়, এবং এই কাজ করতে যায় সে দুর্ঘটনা ঘটায়, তড়বড় করায় জগ কাইত হয়া পড়ে, জগের ভিতরের অবশিষ্ট পানি টেবিলের উপরে গড়ায়া যায় ময়না মিঞার হঠাৎ পাওয়া বাড়ির দলিল ভিজায়া দেয়; ময়না মিঞা বলে, কি হইলো?

শৈমন কিছু বলে না, ময়না মি হয়তো ক্লান্ত ছিল, ফলে সেও চুপ করে থাকে, তারপর তারা ঘুমায়া যায়, অথবা ঘুমায় না, ময়না মিঞা অনেকক্ষণ পর আবার জিগাস করে, কি হইছে? এবং তখন মৈন বলে যে, জগের পানি পড়ে গেছে টেবিলের উপরে, তারপরেও হয়তো ময়না মিঞা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। তখন অনেকক্ষণ পর ময়না মিঞা বিছানা থেকে ওঠে, সে দেখে, খৈমন দেওয়ালের ধার ঘেঁষে চৌকির ওপর গুটিশুটি হয়া ঘুমায়, তারপর হারিকেনের সলতে বাড়ায়া দিয়া সে যখন পেশাব করার জন্য বাইরে যাওয়ার আয়োজন করে, সে খেয়াল করে যে, টেবিলের উপর তার শ্বশুরের লিখা দেওয়া জমির দলিল ভিজা কাই হয়া আছে! ময়না মিঞার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়া যাওয়ার যোগাড় হয়, সে বাত্তির সলতে আরো বাড়ায়া দিয়া কাগজটা তুলতে গেলে পানিতে অনেকক্ষণ ধরে ভেজায় সেটা ছিঁড়া যায়; তখন সে আর্তনাদ করে ওঠে, তারপর সতর্কতার সঙ্গে কাগজের ভাজ খুলে টেবিলের উপরে বিছায়া দেখে যে, আব্দুল জলিলের কলমের কালিও হয়তো পাকা ছিল না, হয়তো হিরো ওয়াশএবল রয়াল ব্লু কালি ছিল, ফলে পানিতে সব ধুয়ে সাফ হয়া গেছে, নিল দাগ ছাড়া কাগজে আর কিছু নাই। ময়না মিঞা তখন কান্দে, বিক্রমপুইরা পোলা, লম্বা কালা উঁচানাকের তরকারি বিক্রেতা ভেউভেউ করে, তার কানে অবশ্যই খৈমনের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে, কি করেন, কি করেন আপনে, তখন অন্য ঘর থেকে বাসার সকলে উঠে আসে, তারা দেখে যে, নতুন জামাই বাসর রাইতে কেন্দে বুক ভাসায়; কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না, তখন খৈমন তাকে সান্ত্বনা দেয়, আপনে কাইন্দেশ না এমুন কইরা, একটা কাগজ গেছে, আর একটা লেইখা দিবলে! ফলে খৈমনের প্রসঙ্গে জোবেদা বহমান যে ক্ষেপে, মনে হয় তার পিছনে কারণ আছে, তবে আবার হয়তো বলা যায় খৈমন আসলে কোন সেয়ানামি করে নাই, ঘটনাগুলা ঘটেই এইভাবে এবং এতে তার কোনই হাত ছিল না-ভলু এটা প্রমাণ করা খুবই কষ্টকর হয়। তবে খৈমন যদি চালাক হয়াই থাকে তাতে মামুনের মার কি ক্ষতি তা বুঝতে পারা যায় না, অবশ্য অনেক বছর পর চানমিঞী যখন মহল্লায় বান্দর বাহিনী গঠন করে, তখন মনে হয় যে, জোবেদা রহমান যুক্তি দিয়া বোঝার আগেই প্রবৃত্তি দিয়া কিছু জিনিস হয়তো বুঝতে পেরেছিল—একদিন এই বান্দরেরা তার কি করবে-যদিও হয়তো তার কাছে বিষয়গুলা খুব পরিষ্কার ছিল না। তখন মনে হয় যেন ধৈমনের নিন্দা করা তার একমাত্র কাজ হয়, ফখরুল আলম লেদুকে অথবা অন্য কাউকে সে হয়তো বলে যে, কেমুন চালাক মায়ালোক দেখ, পোলার দেখাশোনা করার সময় নাই দেখে কেমন করে কি ভাবে জংলি একদল জানোয়ারকে সে এই কাজে লাগায়া দিল, খাট তরা. আমি আরাম করি; ফলে বান্দারে চানমিঞাকে দুধ খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, পাহারা দিয়া রাখে, আর ওই বেটি মহল্লায় টো টো করে। এই কথা হয়তো ঠিক, অথবা ঠিক না, কারণ জঙ্গলের বান্দর দিয়া হয়তো এত কিছু করা সম্ভব না, কিন্তু খৈমন নিজেও কি এইসব কথা নুরানি বিলকিস উপমাকে বলে নাই? নুরানি বিলকিস মাঝেমধ্যে বিরক্ত হলেও তার সঙ্গেই খৈমনের ভাব, সে সুযোগ পেলেই তার ৩৬নম্বর বাসা থেকে নুরানি বিলকিসদের ৩৭নম্বর বাসায় যায়, বলে, আফা আমারে কিছু একটা দেন!

সেদিন নুরানি বিলকিসের শরীর এবং মন ভাল ছিল, সে বলে, কি দিমু? চিনি দেই এক কাপ লয়া যা।

: চিনি দিয়া কি করুম, চিনি উড়াইছি।

: তাইলে এক বাটি ছালুন লায়া যা, বেগুন দিয়া খইলসা মাছ রানছি।

কিন্তু দেখা যায় যে, খৈমনকে যত ছোচা মনে করা হয় তত ছোচা সে, সে বলে যে, ছালুনের তার দরকার নাই।

: তাইলে কি নিবি?

: আমারে একটা শাড়ি দেন। নুরানি বিলকিসের তখন সত্যি রাগ হয়।

: ছাড়ি চাছ, তুই জানছ একটা ছাড়ির দাম কত?

: পুরান দেইখা দেন!

তখন নুরানি বিলকিসের রাগ কমে।

: তর পোলারে ঘরে রাইখা আহস ডরাছ না?

: বান্দরগুলিরে ডরাই, কিন্তু কি করুম, বাইরেতো যাওনই লাগে।

বান্দরগুলাকে খৈমন কেন ডরায় সেই গল্পও সে হয়তো নুরানি বিলকিসের কাছে করে, অথবা হয়তো অতটা করে না, কিছু করে কিছু চেপে যায়, হয়তো বানায়াও বলে কিছু। সে বলে যে, একদিন কোত্থেকে যেন সে ফিরেছে, হয়তো উপমা বেগমদের বাসা থেকেই ফিরেছে, ফিরে দেখে যে, তার ঘরের সামনে দেওয়ালের উপর সারি দিয়া বান্দরেরা বসা, তাকে ফিরতে দেখে তারা অলসভঙ্গিতে একে অপরের উকুন বাছে, এইরকম তিন/চাইর দিন ঘটে, তার খুব ভয় লাগতে থাকে, এবং সে দেখে যে, এই বান্দরের দলের মধ্যে কোলে কচি বাচ্চা একটা বান্দরনিও আছে, আর এই বান্দরনিটা ঘরের খোলা জানালার শিকের ফাঁক দিয়া চৌকিতে শোয়ানো চানমিঞার দিকে কেমন করে তাকায়া থাকে, দেইখাতো আমার কইলজার পানি শুকায়া যায়, সে বলে। তারপর সে তার ঘরের জানালায় পুরান শাড়ি কেটে পর্দা লাগায়, সে বলে যে, সে যখন কাছেই কোথাও যায়, ছেলেকে ঘরের ভিতরে রেখে তালা লাগাতে তার ইচ্ছা করে না, খারাপ লাগে—সে শিকল তুলে দিয়া বাইরে যায়। কিন্তু বান্দরের উৎপাতের কারণে জানালায় পর্দা লাগায়া তার হয়তো কোন লাভ হয় না, কারণ বান্দরতো বান্দরই, তারা পর্দা খুলে ফেলে; সরপর খৈমন যখন জানালা বন্ধ করে দিতে শুরু করে তখন বান্দরেরা যড়াবাড়ি করে ফেলে, তাদেরতো অতো জ্ঞান নাই, বান্দরগুলা একদিন দেওয়ালের উপর বসে পরস্পরের পিঠ চুলকাতে যায় যখন দেখে যে, খেমনের ঘরের জানালা বন্ধ তাদের খারাপ লাগে, তখন মা বান্দরটা পথ দেখায়, বান্দরের দল দরজার শিকল খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে বসে থাকে, তাকের উপর থেকে ভাতের পাতিলা নামায়া ভাত খায়, বাচ্চা বান্দরটা তার মায়ের পায়ের চিপা থেকে বের হয়া ফালাফালি করে, ফলে তখন মুতে ভিজায়া রাখা খেতার মধ্যে শোয়া চানমিঞার ঘুম ভাঙ্গে এবং বান্দরের বাচ্চাটা তার সঙ্গে খেলা জুড়ে দেয়। বান্দনিটা শুয়ে বসে এই খেলা দেখে, তারপর সে তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়, তখন চানমিঞা কেন্দে উঠলে এই বান্দরনি তার মুখে দুধের বোঁটা গুজে দেয়; যদিও ফখরুল আলম লেদু বলে যে, এইটা সম্বব না, কিন্তু লেদু বললেতো হবে না, লোকে তার কথা মানবে কেন? খৈমন যদি বলে যে, বান্দরেরা তার বাসার দেওয়ালের উপর বসে থেকে চান মিঞাকে পাহারা দেয়, তা যদি তারা পারে, তাহলে এই বান্দরেরা ঘরে ঢুকে দুধ খাওয়াতে কেন পারবে না! খৈমন হয়তো এত ঘটনা জানে না, নিজের ছেলেকে সে হয়তো বান্দরের দুধ খাওয়াতে চায় নাই, কিন্তু মিসেস জোবেদা রহমান যদি এই কথা না মানে, তাহলে সে না মানতেই পারে। ফখরুল আলম অথবা অন্য কাউকে হয়তো সে বলে যে, শুধু দুদ খাওয়ানোই না, খৈমন তার ছেলের লালনপালনের ভার মহল্লার বান্দরদের হাতে ছেড়ে দেয়, নিজে ঠোঙ্গা বানায়া বেচার ধান্ধায় ব্যস্ত হয়া থাকে, তার প্রমাণ চানমিঞার জন্মের পর তাগড়া শরীর থাকা সত্ত্বেও তার নিজের বুকের দুধ মরে গেলে সে প্রথমে গোয়ালার কাছ থেকে দুধ নিতে শুরু করে, দয়াগঞ্জ কিংবা জোরপুলের পানির টাঙ্কির কাছ থেকে দুধঅলা এসে দুধ দিয়া যেতে থাকে, কিন্তু যেই মাত্র সে বন্দিরগুলাকে, বিশেষ করে দুধঅলা বান্দরনিটাকে দেখে অমনি তার বুদ্ধি গজায়, সে বান্দরনিটাকে কিভাবে ম্যানেজ করে এবং গোয়ালার দুধ নেওয়া ছেড়ে দেয়, চান মিঞা বান্দরনির মাঙ দুধ খায়া বড় হতে থাকে; দ্বিতীয়ত, খৈমন দেখলো যে, বান্দরগুলা উৎপাত করছে, ঘরের ভিতর কষ্টি পোলাটার দিকে বান্দরনিটা বিষণ্ণ চোখে তাকায়া থাকে, দেখে সে বিচলিত হলো, জানালায় পর্দা লাগালো, পরে জানালার পাল্লাও লাগায়া দিল, কিন্তু সে দরজাটা এমনভাবে রাখলো যাতে বান্দরেরা শিকল নামায়া ঘরে ঢুকতে পারে, এবং জোবেদা রহমান বলে, কেমুন চালাক মায়ালোক আল্লা!

চানমিঞা বান্দরের দুধ খেয়েছিল কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল, তবে তার নাম বন্দরের সঙ্গে বেশি করে জুড়ে যাওয়ায় পরে হয়তো সে বান্দরদের দিকেই ঝুঁকে পড়ে, এবং তখন বিষয়টা জোবেদা রহমানের জন্য ভাল হয় না, বান্দরেরা তার বাড়ির ছাদে এসে হোগে যেতে থাকে! তবে খৈমনের হয়তো কিছু করার ছিল না, তার যুক্তিও খুব দুর্বল না, দূরে গেলে সে চানমিঞাকে কোলের মধ্যে করে নিয়াই যেত, কিন্তু বাড়ির কাছে থাকলে ছেলেকে তালা দিয়া রাখায় মায়ের মন না মানতেই পারে, আর এই ফাঁকে বান্দরেরা যদি কিছু করে, সেজন্য তাকে সেয়ানা বা চালাক বা বদমাইশ বলা ঠিক না।

ফলে খৈমন হয়তো আবার ঘরের দরজায় শিকল তুলে দিয়া বিকাল বেলা নুরানি বিলকিসের বাসায় যায়, যাওয়ার সময় সে দেখে আসে যে, দেওয়ালের উপর লম্বা লাইন দিয়া বান্দরের দল বসে আছে, সে বান্দরগুলার কাছে একটু থামে, বাচ্চাঅলা বান্দরনিটার দিকে তাকায়, তার তাকানো দেখে বান্দরদের হয়তো অস্বস্তি লাগে, তারা তাদের লম্বা হাত দিয়া শরীর চুলকায়, চোখ পিটপিট করে মুখ ঘুরায়া নিয়া অন্যদিকে তাকায়া থাকে। খৈমন তারপর নুরানি বিলকিসের কাছে যায় হাজির হয়, বলে, আহনের সুময় দেকলাম বান্দরগুলা লাইন দিয়া আমার ঘরের সামনে দেওয়ালের উপরে বয়া রইছে, আমারে দেইখা চোখ পিটপিটায়।

: পোলা রাইখা আহছ, তার ডর লাগে না!

: কি করুম? অখনে মনে হয় বান্দরগুলা খরাপ না।

: কুলে উঠায়া লয়া যাইব গা তর পোলারে দেখি!

নুরানি বিলকিস তার আশঙ্কার কথাই শুধু বলে, কিন্তু এটা পরে জানা যায় যে, মানুষ যা ভাবে তা ঘটতে পারে যদি তার অনুকূল পরিস্থিতি থাকে, এ ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা ছিল, খৈমন বান্দরের ব্যাপারে ক্রমে সাহসী হয়া ওঠে এবং বেখেয়াল হয়া পড়ে, তখন শিশু চানমিও হয়তো বাচ্চা বান্দরটাকে পছন্দ করতে থাকে, ফলে বান্দরনিটা একদিন তাকে তুলে নিয়া যায়। খৈমন যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে তখন তার কিছুই করার থাকে না, অথবা হয়তো তুতদিনে বন্দিরদের এইসব আচরণে তার আর কিছু মনে হয়, সে ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু নুরানি বিলিকিসের কাছে সে প্রথমে ধরা পড়ে, কারণ, একদিন রাইতের কোন এক সময় টাট্টিতে যাওয়ার জন্য নুরানি বিলকিস উপমা ঘরের দরজা খুলে বের হলে তার মনে হয় যে, কাছেই কোথাও ছোট বাচ্চা কান্দে সে প্রথমে ভাবে খৈমনের ঘর থেকে হয়তো এই শব্দ আসে, তারপর সে বুঝতে পারে যে, এই কান্দার শব্দ আসে আশপাশের কোন দালানের ছাদের উপর খেকে, তখন সে একটু বিচলিত হয়, কিন্তু ঘরে ফেরার পথে সে যখন পুনরায় কান্নার শব্দ পায়, তখন কুয়ার পাড়ে খাড়া হয়ে সে বান্দরের কিচিরমিচিরও শোনে এবং খুব ভীত হয়া পড়ে, তার মনে হয় যে, বেহুঁশ বেখেয়াল মেয়েলোকটার পোলাটারে বন্দিরে নিয়া যায় নাইতো, হায় আল্লা! তখন সে খৈমনদের বাসার দেওয়ালের কাছে উঁচা করা ইটার উপরে খাড়ায়া খৈমনকে ডাকে, এত রাইতে ডাক শুনে খৈমন ঘুম থেকে উঠে আসে এবং জানালার পাল্লা ফাঁক করে উঁকি দিলে নুরানি বিলকিস তাকে বলে যে, চীনমিঞাকে বান্দরেরা নিয়া গেছে। খৈমন অবাক হয় এবং বলে, কি কন আপনে!

: কি কমু, কুয়ার পাড়ে খাড়ায়া হুনলাম ছাদের উপরে পোলা কান্দে।

: আপনে যায়া ঘুমান, আমার পোলা না!

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ May 24, 2022 at 7:53 pm

অসাধারণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *