ডলি আক্তারের অবস্থার যখন কোন উন্নতি হয় না তখন আব্দুল ওদুদ চৌধুরি পুনরায় মোজাহার ডাক্তারের কাছে যায়, তবে ডাক্তারের কিছু করার থাকে না, সে পুনরায় শুদুদ চৌংয়ের বাড়িতে আসে এবং ডলি আক্তারকে পরীক্ষা করে বিদায় নেয় এবং আব্দুল ওদুদ মিঞা ভুলু নদী পার হয়া–মির্জাখিল মাজারে যায়া মাজারের গদ্দিনশিন পীর হযরত মওলানা জালালুল হাইয়ের কাছ থেকে আরো দুইটা তাবিজ এনে ডলি আক্তারের গলায় ঝুলায়া দেয়। তারপর যখন সময় হয় ডলি আক্তার এবারও বেশি সময় নেয় না, তবে শরীর দুর্বল থাকায় আম্বিয়ার মাকে খবর দেওয়ার পর সে মূর্খা যায়, মাদুরের উপর বেহুশ হয়া থাকে, তখন আম্বিয়ায় মা আসে এবং ডলি আক্তারের যখন জ্ঞান ফেরে সে দেখে যে, তার বুকের উপরে দুইটা শিশু, আম্বিয়ার মা তাদের নাড়ি কেটে পরিষ্কার করে খেতায় জড়ায়া দিয়েছে, আম্বিয়ার মা বলে, একগুয়া মাইয়া একগুয়া মরদ ফোয়া-আল্লার ইচ্ছা। ডলি আক্তার ভ্যাবাচেকা খায়া যায়, তবে সে হয়তো ভাবে যে, এটা হতেও পারে, নয় কেন, মানুষের কি না জানায়া যজ বাচ্চা হয় না। কিন্তু ডলি আক্তারের সন্দেহের কারণে, আব্দুল ওদুদের মনে সন্দেহ আসে এবং সে মোজাহার ডাক্তারকে খবর দিয়া ডেকে আনে; খবর পায়া ডাক্তার হন্তদন্ত হয়া দৌড়ায়া আসে, এবং আব্দুল ওদুদের কথা শুনে সে বোকা হয়া যায়, সে তাদের কথার মানেই বুঝতে পারে না, তার মনে হয় যে, এরা এইরকম করে কেন? মেয়ে সন্তান না হলে তাদের ভাল লাগে না, আবার হলে পড়ে এত কথা বলে, আশ্চর্য; যাহোক তখন সাতকানিয়া বাজারের একমাত্র এমবিবিএস ডাক্তার এই বিষয়ে একমত হয় যে, এইরকম না হতে পারার কোন কারণ নাই, একটা বাচ্চা আছে মনে করলেও দুইটা থাকতে পারে, তিনটাও পারে। তখন আব্দুল আলি মিঞা তার ছয় নম্বরু নাতির নাম রাখে আব্দুল ওহাব চৌধুরি এবং চিন্তা ভাবনার পর সদ্যজাত মেয়ের নাম রাখা হয় আসমানতারা ঘুরে জান্নাত।
মোজাহার ডাক্তারের বিস্তারিত ব্যাখ্যার পর ডলি আক্তারের সন্দেহ থাকে না যে, তার পেট থেকে একই সঙ্গে আব্দুল ওহাব এবং হুরে জান্নাতের জন্ম হওয়া সম্ভব; কিন্তু আসমানতারাকে নিয়া তার মন তবু খুঁতখুঁত করে—আসমানতারাকে নিয়া তার এই সন্দেহ হয় কেন? এর কারণ কি এই যে, সে ভাবেই নাই তার মেয়ে হবে বা হতে পারে। ফলে তার জ্ঞান ফিরা আসার পর আম্বিয়ার মা যখন তাকে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে হওয়ার কথা বলে, মনে হয় যেন তার আনন্দ হয় না, তার মনে হতে থাকে যে, ব্যাপারটা বানানো, কিন্তু সে যখন তার বুকের উপর দুইটা নরম মাটির পিরে মত দুইটা শিশু দেখে সে বুঝতে পারে যে, কথা মিথ্যা না; কিন্তু তারপরেও তার সন্দেহ যায় না। ডলি আক্তার পরে ভেবে দেখার চেষ্টা করে যে, প্রথম দিন দুইটা বাচ্চার দিকে সে যখন তাকায় তখন তার মনে হয় একদম কচি আব্দুল ওহাবের পাশে মেয়েটাকে কেমন ডাঙ্গর দেখায়, ঝরঝরে লাগে; কথাটা সে হয়তো আম্বিয়ার মাকে বলে, তার মনে হয় যে, আম্বিয়ার মা তার কথা শুনে কেমন ঘাবড়ায়া যায়, অথবা হয়তো বিষয়টা তার মনের ভুলই ছিল, আম্বিয়ার মা তার কথা শুনে বলে, অনে ইন হতা ন কইওন, মাইয়া পোয়াতে ইবা আগে হৈয়ে দে। ডলি আক্তারের মনে হয় যে, আম্বিয়ার মার যুক্তিটা শক্ত না, তার কাছে মেয়েটারই কাটা নাড়ি বেশি শুকনা লাগে, ছেলেটার নাড়ি একদম কাঁচা-এরকম কি হয়? তখন ডলি আক্তার বেগম পুনরায় আম্বিয়ার মাকেই বিষয়টা জিগাস করে, আম্বিয়ার মা তার কথা শুনে পুনরায় আকাশ থেকে পড়ে, বলে, ইন গম অয় বাবি, অনে মাইয়া পোয়া চাইলেনদে আল্লায় অনেরে মাইয়া পোয়া দিইয়্যে, আনে ইন হতা পুছলিন্দে কিয়া?
ডলি আক্তার তখন শরমিন্দা হয়, আল্লার কাছে মাফ চায়, আঁরে মাফ গরো খোদা, সে কান্দে এবং দীর্ঘ সময় পর তার নবজাতক মেয়েটার দিকে সে ভালমত তাকায়, তার মুখ টেনে তুলে স্তন অনাবৃত করে পুরে দেয়; কিন্তু ডলি আক্তার দেখে, মেয়ে মুখের ভিতর দুধের বোটা নিয়া চুপ মেরে থাকে, টানে না। ডলি আক্তারের প্রথমে মনে হয় যে, ব্যাপারটা কিছু না, তার মনে হয় যে, আসমানতারা হয়তো চোখ খোলা রেখে ঘুমায়, কি তখন সে বুঝতে পারে বাচ্চাটা ঘুমায় নাই—চোখ বড়বড় করে সে সব দেখে। তখন ভুলি আক্তার একটু বিচলিত হয়, তার মনে হয় যে, মেয়ের হয়তো পেট ভরা, খাওয়ার গরজ নাই; কিন্তু তারপর দুপুরে বিকালে কিংবা সন্ধ্যায় সে যখন আবার তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে, আসমানতারা হুরে জান্নাতি পুনরায় দুধের বোটা মুখে নিয়া চুপ করে থাকে। তখন ডলি আক্তার ভয় পায়া যায়, হৈচৈ শুরু করে, তার চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে ছুটে আসে, হয়তো আব্দুল ওদুদ বাড়িতে ছিল, সে আসে, তার বুড়া বাপ আব্দুল আলি চৌধুরি আসে এবং পাশের বাড়ি থেকে আসে আম্বিয়ার মা; তার কথা শুনে সকলে তাজ্জব হয়, সকাল থেকে মেয়ে খায় না, বলে কি! আম্বিয়ার মায়ের সামনে ভুলি আক্তার পুনরায় বিষয়টা মহড়া দিয়া দেখায়, সে স্তন অনাবৃত করে মেয়ের মুখে দেয়, কিন্তু আসমানতারার কোন ভাবান্তর নাই, তখন আম্বিয়ার মা বলে যে, সে এ রকম তার জীবনে দেখে নাই। ফলে তখন আসমানতারা হুরে জান্নাতের জীবন নিয়া সংশয় দেখা দেয়, তাদের মনে হয় যে, অনেকটা অনাহুতের মত পৃথিবীতে এসে পড়ায় সে কি লজ্জিত, অভিমান করে সে কি না খায়া মরে যেতে চায়? অথবা সে কি জন্মের পরেই রোযা করে? কিংবা এমনকি হতে পারে যে, ডলি আক্তারের এলোমেলো সন্দেহ এবং আচরণের কারণে সে ক্ষুব্ধ? আম্বিয়ার মা এই কথাটা বোকার মত উলি আক্তারকে একবার বলে, গুড়া মাইয়া ফোয়া ইবায় অনের লগে গোস্বা হইরগে ফানলার!
ডলি আক্তার অবশ্যই আম্বিয়ার মার কথা বিশ্বাস করে না, পেট থেকে পড়েই মেয়ের পক্ষে গোসা করা সম্ভব না, কিন্তু বাচ্চা যখন চব্বিশ ঘন্টা না খায়া থাকে এবং এ জন্য কান্দেও না, তখন আব্দুল আলি চৌধুরির বাড়িতে কান্দাকাটি শুরু হয়, ডলি আক্তারই কান্দে বেশি, এবং তখন আম্বিয়ার মা আবার আসে এবং সঙ্গে করে চিনামাটির বাটিতে নিয়া আসে গরুর দুধ। আম্বিয়ার মা এসে দেখে যে, ঘরের ভিতরে ডলি আক্তারের দুধের বোঁটা মুখে নিয়া ছোট্ট মেয়েটা নির্জীবের মত তাকায়া আছে, মনে হয় যেন এই শিশুর মুখের ভিতর ডলি আক্তারের কিঞ্চিত টোল খাওয়া তথাপি থরোথরো ফরসা স্তন একটা অপাঙক্তেয় উচ্ছিষ্ট ফলের মত উল্টা হয়া আছে এবং এই স্তনের মালিক ডলি আক্তার বসে বসে কান্দে। আম্বিয়ার মা ডলি আক্তারের কাছ থেকে আসমানতারাকে টেনে নেয়, নিজের কোলের উপর শোয়ায়া চা চামচ দিয়া তার মুখে বাটি থেকে গরুর দুধ তুলে দেয়, এবং তখন তারা দুইজন অবাক হয়া দেখে যে, সে চুক চুক করে গরুর দুধ খায়। ডলি অক্তিার হয়তো তার কান্দা থামায়া এনেছিল, এখন আসমানতারাকে আম্বিয়ার মায়ের হাত থেকে দুধ খেতে দেখে সে হাউহাউ করে ওঠে, তার অনাবৃত প্রত্যাখ্যাত পয়োধর কান্দার উচ্ছাসে আকুল হয়া কাপে, মনে হয় যেন আসমানতারা এইটা প্রমাণ করে যে, সে এত সহজে আসে নাই, এবং কোন হেলাফেলা তার ভাল লাগবে না; ডলি আক্তার সেদিন আম্বিয়ার মার দুধ খাওয়ানো হলে আসমানতারাকে কোলের মধ্যে টেনে নেয়, দঅও, আঁর কাছে দঅও।
মোজাহার ডাক্তারকে আবার খবর দেওয়া হয়, ডাক্তার বুঝতে পারে না যে, দুইটা বাচ্চার একটা খেতে পারলে অন্যটা কেন পারবে না, তখন সে ওদুদ চৌধুরির বাসায় এসে বাচ্চার মুখ পরীক্ষা করে দেখে মুখের ভিতরে লাল ঘও হয়া আছে; সে বলে যে, কয়েকদিন গরুর দুধ খেলে মুখের ঘাও শুকায়া যাবে, তারপর বাচ্চা বুকের দুধ চুষে খেতে পারবে। ব্যাপারটা তেমনই ঘটে, তিনচাইর দিন ডলি আক্তার তাকে বুকের ভিতরে জড়ায়া রেখে চামচ দিয়া গরুর দুধ খাওয়ায়, লোহাগা পোড়ায়া মধুর সঙ্গে মিশায়া মুখের ঘাওয়ে লাগায়, এবং যখন তার সঙ্গে কথা বলে, আর সোনা আঁর মানিক, আঁর লগে অনে গোস্বা কইরগনদে না, ওড়ি গোস্বা কইরগেনদে না? তখন ডলি আক্তার দেখে যে, শিশুটা চোখ বুজে ঘুমায়, এবং তখন সে তার ব্লাউজের বোতাম খুলে স্তনের বোঁটা মুখে পুরে দিলে আসমানতারা হুরে জান্নাত চোখ বুজে থেকেই চপচপ শব্দ করে টানে, মনে হয় যেন বাচ্চাটাই ডলি আক্তারের শরীরের গাছে ধরা একটা লাউ, কুমড়া কিংবা বাঙ্গি ডলি আক্তারের তখন আবার আনন্দে কান্দা আসে; এবং আসমানতারা হুরে জান্নাতের জন্ম হয় চোরাচালানের সারের সঙ্গে কাঠের ভুসির ভিতরে পাচার হয়া আসা খরকোসের সাথে দেখা হওয়ার জন্য, কিন্তু মামুনুল হাইয়ের মা, ভূতের গল্লির ২৫নম্বর বাসার বাসিন্দা মিসেস জোবেদা রহমান বলে, এ সবই বুজরুকি, তার ঘরে বসে সে যখন ফখরুল আলম লেদুকে বলে যে, মামুন তাদের স্কার্ট পরা এ্যাংলো টিচারের বাসায় তার মেয়ের কাছে যায়, তখন সে যতই নাক সিঁটকায়া এই কথা বলুক লেদুর মনে হয় যে, পোলার এই সাফল্যে জোবেদা রহমান গোপন আনন্দের মিহিন একটা ভাব নিয়াই এই কথা বলে। ফখরুল আলম লেদুর মনে হয় যে, তারা যখন মিসেস রোকেয়া আনোয়ারের সিলভারডেল কেজি স্কুলে ভর্তি হয়, তাদের কেজি ওয়ানের ছাত্রদের ভিতর সবচাইতে খাপছাড়া ছাত্র ছিল চানমিঞাই, এবং এ কারণেই হয়তো তাদের ক্লাস টিচার অতিশয় সুন্দরী নারী মেরি জয়েস ক্লার্ক-প্রোগ্রেস রিপোর্ট কার্ডে যে সই করতো এমজেক্লার্ক-চানমিঞার প্রতি বেশি স্নেহপ্রবণ হয়া পড়ে, তবে ছাত্রও চানমিঞা ভাল ছিল। ক্লাস শুরু হওয়ার পর একদিন এ্যাট হোম বুক ওয়ান” খুলে মেরি ক্লার্ক তাদেরকে জ্যাক. এ্যান্ড জিল পড়ায়, দেখা যায় যে, চনিমিঞাই সকলের আগে কবিতাটা মুখস্ত করে ফালায়, জ্যাক এ্যন্ড জিল/ ওয়েন্ট আপ টু দা হিল.. ইত্যাদি; তখন ক্লাসের দুই বালিকা নার্গিস এবং ইফফাত চোখ বড় করে তার দিকে তাকায় থাকে এবং মেরি ক্লার্ক কাছে যায় তার শীর্ণ কান্ধের উপরে হাত দিয়া অলিতো করে চাপড়ায়া দিয়া বলে, ইউ আর ব্রিলিয়েন্ট ছান মিঞা!
ক্লাসে বসে মামুন, লেদু এবং অভিজিৎ এইসব দেখে, টিচার চানমিঞাকে ব্রিলিয়েন্ট বলে, লাভলি বলে, কিন্তু কেজি ওয়ানে তাদের কিছু করার থাকে না, মিসেস ক্লার্কের ক্লাসে চানমিঞাকে একহাত দেখানো যায় এবং পরে তারা ব্যাপারটা ভুলে যায়। কিন্তু মনে হয় যেন মিসেস ক্লার্ক চানমিঞাকে তবুও ভোলে না, দুই বছর পর স্ট্যান্ডার্ড টু তে যায়া মিজ রোজালিন ডি কস্তা তাদের ক্লাস টিচার হয়, তখন ডি কস্তার ক্লাসে মেরি ক্লার্ক কখনো আসে এবং জিগাস করে, কেমন করছে আমার বাচ্চারা? তখন লেদু, মামুন এবং অভিজিৎ-এর মনে হয় যে, মিসেস ক্লার্ক হয়তো আসলে। চানমিঞার কথাই জিগাস করে, এবং মিজ ডি কস্তা তার কথা শুনে কষ্ট করে হাসে এবং বলে, করছে আরকি, নট ব্যাড! তখন ফাইনাল পরীক্ষার পর খেলাধুলা এবং প্রাইজ গিভিং সিরিমনি হয়, রঙ্গিণ কাগজে জড়ান একটা বান্ডিল কেজি টু এর এক মেয়ের, হয়তো খালেদা কিংবা তাবাসসুমের, হাতে আসে এবং সে পড়ে দেখে যে তাতে ইংরেজিতে লেখা, তোমার যে বন্ধুর জুতা সবচাইতে ময়লা তাকে দাও। বাচ্চা মেয়েটা প্যাকেটটা নিয়া ঘোরে, সে মন ঠিক করে উঠতে পারে না কার জুতা সবচাইতে ময়লা, তারপর সে মনে হয় চানমিঞাকে টার্গট করে এবং মিসেস ক্লার্ক বুঝতে পেরে দ্রুত এসে চানমিঞার জুতা পরিষ্কার করে দেয়, ফলে একটা নোংরা ছেলেকে খুঁজে বের করার জন্য মেয়েটাকে আরো ঘুরতে হয়, এবং তখন হয়তো প্যান্ডেলের নিচে বালিকা জুলি ফ্লোরেন্স ছিল, সে হয়তো বিষয়টা দেখে এবং যখন তার মাকে জিগস করে, মম হু ওয়াজ হি? তার মা বলে, হি ইজ দা মাঙ্কি বয়; অবশ্য তখন মামুন এবং লেদুর মনে হয় যে, অনেক বছর তারা তাদের প্রিয় টিচার এবং বালিকা জুলি ফ্লোরেন্সকে দেখে না, তারা সিলভারডেল স্কুল ছেড়ে শাহ সাহেব লেনে যায়। হয়তো সেন্ট যোসেফ স্কুলে ভর্তি হয়, সেখানে অঙ্ক ক্লাসে ভুল করায় ব্রাদার টুম তার হাঁটুর উপরে তাদেরকে কাইত করে চেপে ধরে হোগার উপরে কাঠের রুলার দিয়া মারে, ব্রাদার ডানিয়েল হোমওয়ার্ক না করার জন্য প্রায় প্রত্যেক দিন ডিটেনশন ক্লাস দিয়া রাখে, নোট বইয়ে রোল নাম্বার টুকে নিয়া যায়, তখন তাদেরকে স্কুলের পর বিকালে ডিটেনশন ক্লাসে যেতে হয়, তারা ব্লাক বোর্ডে লিখা দেওয়া একটা বাক্য-যেমন ম্যান ইজ নোন বাই হিজ কম্পানি—যার যার শাস্তির মাত্রা অনুযায়ী পঞ্চাশ, একশ কিংবা দুইশ বার লেখে, তারপর খাতার পাতা ছিঁড়া জমা দিয়া আসে। কিন্তু এইখানে, এই স্কুলে, তারা পায় বাস্কেট বল এবং ক্রিকেট, কাছেই পায় রেল লাইন এবং স্কুলের পিছনের গেট দিয়া বের হয়া মনির হোসেন লেন ধরে দয়াগঞ্জের রেলওয়ে ব্রিজে যায়া বসে থাকার পথ, ফলে তারা মিসেস মেরি ক্লার্ক এবং তার বালিকা মেয়ে জুলিকে দীর্ঘ দিন ভুলে থাকে। পরে যখন সেন্ট যোসেফ স্কুল আসাদগেট চলে যায় এবং মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদুর জীবনে বাস্কেটবল ও ক্রিকেট তাৎপর্য হারাতে শুরু করে, তাদের হাঠাৎ মনে হয় যে, কত দিন তারা টিচারকে দেখে না। তখন একদিন গভীর রাইতে হয়তো মামুনের বুকের ভিতরে আকাক্ষা জেগে ওঠে, সে তখন লেদুকে ফোন করে এবং বলে, ল যাই টিচাররে দেইখা আসিগা।
: যাইতে পারি।
তাদের তখন জুলি ফ্লোরেন্সের জন্মদিনের তারিখের-২১ সেপ্টেম্বর-কথা মনে পড়ে; যখন তারা কেজি ওয়ানে ছিল, টিচার তার ক্লাসের সব ছাত্রকে জুলি ফ্লোরেন্সের জন্মদিনে তার বাসায় প্রথম নিয়া যায়; তারপর তারা প্রতি বছর পাশ করে ক্লাস বদলায়, কিন্তু টিচার তার পুরান ছাত্রদের মধ্যে মামুন, লেদু এবং চানমিঞাকে ভোলে না, সে জুলির জন্মদিনে তাদেরকে সবসময় দাওয়াত করে। তারা স্কুলের ড্রেস পরে জুলি ক্লার্কের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যায় এবং অন্য পোলাপানদের সঙ্গে হ্যাপি বার্থ ডে টু… গায়, জুলি একটা সাদা কেক কাটে, তারপর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো কাগজের পেট মোটা একটা বড় ঠোঙ্গা বাড়ি দিয়া ফাটানো হলে এর ভিতর থেকে কুঁচিকুঁচি করে কাটা রঙ্গিণ কাগজের অজস্র টুকরা ঝরে পড়ে, কাগজের টুকরার সঙ্গে পড়ে রঙপেন্সিল, রাঙতা জড়ানো টফি এবং খুচরা পয়সার মুদ্রা। তখন সে কি হৈচৈ শুরু হয়, মামুনুল হাই তিনটা টফি পায় এবং লেদু পায় দুইটা, চানমিঞা পায় পঁচিশ নয়া পয়সার একটা মুদ্রা। তখন তারা ছিল স্ট্যান্ডার্ড টু-এ এবং তারা বেশ বড়, জুলি ফ্লোরেন্সও শিশু থেকে বালিকা হয়া উঠেছে, অথবা উঠি উঠি করছে, সেদিন সাদা মাইলনের ফ্রকের ভিতরে তাকে দেখে মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদু হাঁ করে থাকে, তারপর জন্মদিনের কেক কেটে ভাগ করা হলে তারা তার ভাগ খায়, কাগজের ঠোঙ্গার ভিতর থেকে পাওয়া টফি চাবায়, মামুনুল হাই তার তিনটা টফির দুইটা খায়া ফেলে এবং একটা চানমিঞাকে পটায়া তার কাছে বেচে; অবশ্য এ জন্য পরে সে পস্তায়, কারণ চানমিঞা একটাও টফি কুড়ায়া নিতে পারলেও মামুনুল হাই এর কাছ থেকে কেনা টফিটা সে জুলি ফ্লোরেন্সকে দেয়, এবং জুলি সেটার রাঙতা খুলে মুখে পুরে দিয়া চোষে, লেদু মামুন। এবং অভিজিৎ-এর মনে হয় যে, পোলাতো কম সেয়ানা না! কিন্তু সেদিন সেখানেই ঘটনা শেষ হয় না, চানমিঞা তার প্লেট থেকে তুলে কেকের টুকরাটা নিজে খায়, সাগর কলাটা জুলির দিকে আগায়া ধরে, ভাবখান এমন যে, নেও, এবং জুলি নিয়া কলাটাও খায়। ফলে বহুদিন পর মিসেস ক্লার্ক একদিন যখন জুলিকে বলে, বি ওয়্যার অফ ম্যান এন্ড বানানা, তখন খুব দেরি হয়া যায়, তবে সেইদিন জন্মদিনের পার্টিতে তখন তারা দেখে যে, টিচার একটা ফুল তোলা কাপড়ের লম্বা ফ্রক পরে এসে জুলিকে নিয়া ছবির জন্য পোজ দেয়, কালা রঙ্গের কোট এবং সাদা সার্টের সঙ্গে কালা বো-টাই পরা বর পাশে এসে খাড়ায়, তার হাতে তামাক খাওয়ার পাইপ, তখন তাদের সঙ্গে ছবিতোলার জন্য বাচ্চারা আসে, কিন্তু তারা খেয়াল করে না যে, চানমিঞা ভিড়ের মধ্যে নাই, ফলে মধ্য রাইতে মামুনুল হাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে এবং লেদু জুলি ফ্লোরেন্সের জন্মদিনে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় হাজির হয় এবং আশ্চর্য হয়া দেখে যে, টিচার এই দীর্ঘ দিন একই বাসায় রয়া গেছে। আরো পরে মামুন একদিন মিসেস ক্লার্কের ড্রয়িং রুমে বসে দেওয়ালে ঝুলান ছবি দেখার সময় জুলিকে এই কথা জিগাস করে, তুমরা এই বাইতে এতদিন ধইরা রয়া গেলা? দুনিয়া বদলায়া গেল তুমরা এক জাগায় থাইকা গেলা?
: কোথায় যাব?
: ভাড়াইটারাতে রেগুলার বাসা বদলায়।
: কি জানি, আমাদের সমস্যা আছে, উই আর নট লাইক আদার্স, আমরা অন্যদের মত হইতে পারি না!
মামুনুল হাই তখন জুলির দিকে তাকায়া থাকে, কেন পার না, হোয়াই নট?
: বিকজ উই ক্যানট!
: বাট হেয়াই?
: বিকজ আই এ্যাম নট লাইক ইউ!
মামুন পুনরায় তকিয়া থাকে, জুলি তার মত না, কেন না? হয়তো সে বোঝে, হয়তো বোঝে না; তবে আব্দুল ওদুদ চৌংয়ের লোকেরা চোরাচালানের সারের ভিতর মামুনকে ট্রাক, সাতকানিয়ায় পৌছার পর আবিষ্কার করে, শেষ রাইতের দিকে তারা যখন বস্তা সরানোর কাজ শুরু করে তখন কাঠের ভুসির মধ্যে তাকে পায়, তারা দেখে যে, সে জীবিত আছে তবে তখনো হয়তো অচেতন, এবং তখন তাদের মনে পড়ে যে, পোলাটার নাম মামুন; তায়া সারের বস্তার সঙ্গে তাকে বাড়ির ভিতরে পুকুর পাড়ে একটা টিনের ঘরের মধ্যে নিয়া মায়া রাখে।
সকাল বেলা সতিকানিয়া থানার ছোট কিংবা মেঝ দারোগা হাতে একটা লাঠি নিয়া এসে হাজির হয়, তখন আব্দুল ওদুদ চৌধুরি হয়তো চিটাগাং থেকে এসে পৌঁছাতে পারে নাই, অথবা হয়তো খুব সকালেই তার টয়োটা করোনায় করে সে এসে পড়ে এবং জানতে পারে যে, ভূসির মধ্যে মামুনকে পাওয়া গেছে, ফলে তারপর দারোগা এসে যখন তাকে জিগাস করে, সওদাগর সাব, গম আছেন নি? আব্দুল ওদুদ চৌধুরি ব্যাপারটা বুঝতে পারে, সে এই ছোট অথবা মেঝ দারোগাকে বাড়ির ভিতর নিয়া যায় বেঠকখানায় ভেলভেটের সোফায় বসায় এবং বলে, আছি, খারাপ অয়, ভিতরে আইয়োন।
দারোগা ওদুদ চৌধুরির ঘরে যায়া বসে, চা পানি খায়, তারপর বলে, রাইতে ট্রাক আসছে শুনলাম, কি ছিল?
: কাঠের ভুসি আইনি এরি।
: কাঠের ভুসি দিয়া কি করবেন?
: একেনে একটা বরপের কল দেব যে, বরপের জন্য কাঠের ভুসি এনে রাখিদ্দেরি।
দারোগার কষ্ট হলেও সে বোঝে, বরফের কল বসালে ভূসি লাগতে পারে, ঠিক আছে, কিন্তু সে তখন অন্য কথা বলে, একটা ছেলে কি ছিল ভুসির মধ্যে? কিন্তু এইটা কি হয়? এইটা হয় না এবং আব্দুল ওদুদ চৌধুরি বলে যে, এটাতো সম্ভব না, ছেলেতো হাতের মোয়া না যে ভুসির মধ্যে পাওয়া যাবে, কাঠের ভুসির মধ্যে মানুষের বাচ্চা পাওয়া যেতে পারে না, ঢাকা থেকে আনা তার ভাইয়ের করাত কলের ভুসির মধ্যে মানুষের বাচ্চা, একটা বড় খরগোস পাওয়া যায়, হয়তো পাহাড়ের কাছ দিয়া যখন ট্রাক আসছিল তখন-হয়তো সীতাকুণ্ড কিংবা পাহাড়তলির কাছে কোন উপায়ে জটা ট্রাকের ভিতরে চড়ে বসে। দারোগা তারপর বেনসন খায় এবং তার। মনে হয় যে, হইতে পারে, অসম্ভব কি, এইসব পাহাড়ি আধা-পাহাড়ি এলাকায় অশোস ট্রাকে উঠে বসতেই পারে, তখন সে বিদায় নিয়া চলে গেলে চাকরদের কাছ থেকে ডলি আক্তার এবং বাড়ির অন্যান্য মহিলা এবং শিশু খরগোসের কথা জানতে পারে। আসমানতারা দুরে জান্নাতের তখন হয়তো ৩/৪ বছর বয়স, সে গরগোসের কথা শুনে উত্তেজিত হয়া পড়ে, আঁই খরকোস দেইক্কম, আম্মা অরে খরকোস আনি দও, সে বলে।
বাড়ির চাকরেরা তাকে বোঝায় যে, খরগোস খুবই খারাপ জানোয়ার, কামড়ায়া দেয়, গায়ে গন্ধ এবং খু্ব পাজি, কিন্তু আসমানতারা বুঝ মানে না, তখন ডলি আক্তারকে বিষয়টার দিকে নজর দিতে হয়, কারণ সে তার মেয়ের ছুটুকালের দুধ খাওয়া নিয়া কাণ্ডের কথা ভোলে না, সে চাকরদের সঙ্গে পুকুর পাড়ের টিনের ঘরের বন্ধ দরজার কাছে যায় তালা খোলায় এবং দেখে যে, একটা ছেলে শুয়ে আছে ভিতরে বস্তার সারির মাঝখানে। ডলি আজার বিস্মিত হয়, ওড়া আবুইল্যা, খরগোস খডে? গুড়া ফোয়া ইবা খন? সে জিগাস করে এবং বাড়ির চাকরদের তখন সব খুলে বলতে হয়, তারা হয়তো আব্দুল ওদুদের কাছ থেকে এইসব কথা শোনে, তারা বলে যে, ছেলেটার নাম মামুন, এবং তখন হয়তো মামুন মিঞার চেতনা ফিরতে থাকে; সে চোখ মেলে তাকায়, বিহবল হয় তার সামনে খাড়ানো ভলি আক্তার এবং আসমানতারাকে দেখে, ডলি আক্তার তার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বলে, নাম কি তুয়ার।
তার কথা শুনে ছেলেটা তাকায়া থাকে, তখন বাড়ির চাকরেরা তাকে বলে যে, তার নাম মামুন মিঞা, তারপর মামুন জানতে পারে যে, তার বাড়ি ঢাকার নারিন্দায়, ভূতের গরিতে। কিন্তু সেদিন চাকরেরা যখন বলে যে, তার নাম মামুন মিঞা, আসমানতারা তা মানতে চায় না, সে চিকরি করে, না ইবা খরকোস, ইবা খরকোস!
তখন আব্দুল ওদুদের চাকরেরা বাধ্য হয়া মামুন মিঞাকে ভূমিশয্যা থেকে তুলে গলায় একটা দড়ি লাগায়া আসমানতার হাতে তুলে দেয়, মামুন মিঞা আসমানতারার খরকোস হয়া থাকে। কারণ চানমিঞার জন্ম হয় একাত্তর সনে, হয়তো জুন মাসে, ১২ জুন, মিথুন রাশির পোলা হয়তো সে, অথবা জুলাই মাসে, ১২ কিংবা ২২ জুলাই, কর্কট রাশি, কিংবা তার জন্ম হয়তো ডিসেম্বরে, সে ধনু কিংবা মকর রাশির পোলা, সেই জন্য তার নাম হয়তো হতে পারতো বিজয় মিঞা-যাহোক, একার সনে খুবই কষ্ট ও বিপদের মধ্যে যৈমন সন্তান এবং স্বাধীনতার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে। কিন্তু নি মিলিটারি যখন বাঙ্গালি মারা শুরু করে, তখন গৈমনের পেট বোচকার মত গোল হয়া ওঠে, তার পায়ের পাতা ফুলে যায় এবং সে একটা গাভিন বিপর্যস্ত মহিলা বিলাইয়ের মত তাদের ঘরের ভিতরে ছায়ার মত হাঁটে-তখন মহল্লায় রাজাকাররা আসে, অথবা রাজাকাররা হয়তো আসে তার আগেই। রাজাকার কমান্ডার আব্দুল গনি-রাজাকার কমান্ডারদের নাম আব্দুল গনিই হয়-লাঠি হাতে দলবল নিয়া মহল্লায় ঘুরতে যায়। একদিন খৈমনদের বাসায় এসে হাজির হয়, এবং খৈমনের মা জরিমনের সঙ্গে আলাপ করার সময় জানালার ফাঁক দিয়া ঘরের ভিতরে খৈমনকে দেখে এবং জিগাস করে, এইটা আপনের মাইয়া? সম্ভাব্য মাতৃত্বের গরিমায় ঘরের অন্ধকারের ভিতরে হয়তো খৈমনের মুখ বর্ষায় ভেজা কোন একটা ফুল কিংবা পাতার মত মনে হয়, হয়তো পানি ভরা ডোবার কিনারায় শুয়ে থাকা হিজলের একটা ভিজা কালা ঠাইলার মত লাগে, আব্দুল গনি বলতে পারে না তার কি হয়, কিন্তু তার রাজাকার হৃদয় হয়তো হাহাকার করে, মিলিটারি আসলে কি অবস্থা হবে এই মহিলার! সে জরিমনকে বলে, আপনে কন যে আপনের পোলা মুক্তিবাহিনীতে যায় নাইকা, তাইলে আপনের পোলা কৈ গেল তারতো একটা ঠিকঠাক হিসাব দেওন লাগব, নাকি কন? ঘরের ভিতরে ওইটা আপনের মাইয়া নাকি, হ্যারে ডাকেন, জিগাই; এবং তখন জরিমনের খুবই মুশকিল হয়, সে বলে, বাবা তুমি আমার পোলার লাহান, আমার মাইয়াটা পোয়াতি!
: ডাকেন, কথা কই!
তখন খৈমন এসে বারান্দায় খাড়ায়, তার পেট ধোপার গাট্টির মত চিঁড়া . পড়তে চায় এবং তাঁর মুখের দিকে তাকায়া আব্দুল গনি বলে, কত দিন হইলো?
জরিমনের খুবই আতঙ্ক হয়, খৈমন বলে, আপনে কি জিগাইবেন জিগান, এবং আব্দুল গনি ঘন হয়া আগায়া আসে, তখন হয়তো সইন্ধ্যা বেলা ছিল, ফলে সইন্ধ্যা বেলার অনিশ্চিত হওয়ার একটা ঢেউ খৈমনের শাড়ির আঁচল নিয়া মাইতা ওঠে, বাইড়াবাইড়ি করে, পিটাপিটি করে, হুহু করে; বাতাস হঠাৎ কেন যে এমন পাগল হয়া গেল, আব্দুল গনি এবং তার রাজাকাররা বোঝে না, তারা বিহ্বল হয়া পড়ে, খৈমনের শরীরের দিকে তাকায়া তাদের মনে হয় যে, কি একটা ওড়ে, এবং তারা বলে, কি উড়ান?
: কি উড়ামু? আপনেরা হাইনজা বেলা আয়া দিকদারি শুরু করলেন ক্যালা!
আব্দুল গনি তার দলবল নিয়া সেদিন চলে যায়, সে বিচলিত হয়া থাকে, গৈমনকে নিয়া বাতাসের এই খেলার অর্থ বুঝতে পারে না, তখন রাইতের বেলা ময়না মিঞা এই কথা শোনে, তার মনে হয় এবার তারা রাজাকারের পেটে যাবে। সে তখন তার শ্বশুর আব্দুল জলিলকে খুঁজে বের করে, আব্দুল জলিল হয়তো তখন বাঘঅলা বাড়ির ভিতরে আব্দুর রহিম ব্যাপারির সঙ্গে বসে তিন ব্যান্ডের ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওর কাঁটা ঘুরায়া বিবিসি কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে-মুক্তিবাহিনীর গাবুর মাইরের চোটে ভোমা ভোমা পাকিস্তানি মেলেটারিগুলা-তখন ময়না মিঞা তাকে ডেকে বাড়িতে নিয়া এসে যখন বলে, আব্বা, এখন কি করন যায়? তখন আব্দুল জলিল খুবই বিরক্ত হয়, সে বলে, কি করবা, বইসা বইসা খাও, এবং মনে হয় ময়না মিঞাঁ ঠিক বুঝতে পারে না আব্দুল জলিল আসলে কি বলে, সে কি তাকে একটা দিক নির্দেশনা দিল, নাকি সে তাকে গাইল পড়িলো! রাইতের বেলা তার বৌ যখন একটা বেলুনের মত তার পাশে চৌকির উপরে আইসা পড়ে তখন তার মনে হয় যে, তার পোলার নাম রাখা দরকার এবং সে খৈমনকে এই কথা বলে। খৈমন বুঝতে পারে না ময়না মিঞা হঠাৎ এখনই পেটের ভিতরের পোলার নাম রাখার জন্য অস্থির কেন হয়া গেল, সে বলে, এত ডরান ক্যালা, রাজাকাররা আর আইবো না, আপনে ভরায়েন না। কিন্তু ময়না মিঞা হয়তো ভয় পায় নাই, তার হয়তো এমনিতেই মনে হয় যে, নামটা রাইখা ফালানোই ভাল, তখন সে আব্দুল জলিলের কথা বলে, আমি জিগাইলাম কি করন যায়, হায় কইলো বইসা বইসা খাও, ক্যান কইলো এই কথা? খৈমন বুঝতে পারে না ব্যাপারটা কি, সে চুপ মেরে থাকে, হয়তো সে ঘুমায়া যায়, কিন্তু ময়না মিঞা জানে সে ঘুমায় নাই, এমনি ভ্যান্দা ধরে আছে, ফলে সে এই প্রথম জিঞ্জিরার ঘটনা বিশদ খুলে বলে, তুমার বাপে কিন্তু দরবেশ, এবং খৈমন ঘুমের ভিতর থেকে বলে, আমি জানি; রাজাকাররা হয়তো খৈমনদের বাড়ির ঘটনা দক্ষিণ মৈশুন্দি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবু বকর মওলানাকে বলে, অথবা আব্দুল গনি হয়তো আরো অপেক্ষা করে, এবং রাইতের বেলা ময়না মিঞার কোলের কাছে খৈমন যখন ঘুমায়া পড়তে চায়, ময়না মিঞা তাকে জাগায়া রাখে, বলে, পোলা হইলে নাম রাখুম চানমিঞা। খৈমনের পক্ষে এই নাম মেনে নেওয়া মুশকিল হয় এবং যদিও আব্দুল গনি দলবল নিয়া ভূতের গল্লিতে চক্কর দেয়, তারা এ বাড়ি যায় ও বাড়ি যায়, কিন্তু পানবিড়ি দোকানদার আব্দুল জলিলের বাড়ির ঘটনা তার মনে কাটার মত বিন্ধা থাকে, তারপর আবার একদিন জরিমন তাদের উঠানে বারান্দার কাছে আব্দুল গনিকে একা খাড়ায়া থাকতে দেখে, তখন সে ঘরের ভিতর থেকে বের হয়া আসে এবং বলে, আপনে?
আব্দুল গনি বোঝে না সে কি চায়, সে বলে, আপনের পোলা রশিদুলরে দেখতে আইলাম, আইজ কি হ্যায় বাইত আছে, নাকি নাইকা? কিন্তু রশিদুলতো বাড়িতে অবশ্যই নাই, থাকার প্রশ্ন ছিল না, ফলে তখন খৈমন। তার আরো ঝুলে পড়া পেট নিয়া ঘরের ভিতরে জানালার পাশে যায়া বসে; আব্দুল গনি জানালার শিকের ফাঁক দিয়া তাকায়া দেখে যে, দিনের আলো খৈমনের মুখের এক সাইডে তেরছাভাবে যায়া পড়েছে, দুইচোখের নিচের ছায়া এমন হয়া আছে যে দেখে মনে হয়, সে একটা পাতলা নেকাব পরে আছে, এই শিফনের নেকাবের ভিতর দিয়া তার নাক-মুখ দেখা যায়, আবার, যায় না, এবং তখন আব্দুল গনি বলে, আপনের মাইয়ারে ডাকেন কথা কই!
এই দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দিন দুপুরে কিংবা দুপুরের পর বিকালে খৈমন পুনরায় বাইর হয়া বারান্দায় এসে খাড়ায়, তার মোটকা পেটের উপরের কাপড় সে হাত দিয়া উঁচা করে টেনে লজ্জা ঢেকে রাখে, এবং সে যখন বলে, আপনে রশিদুলের কথা জিগান? তখন আব্দুল গনি কথা ঘুরায়া ফালায়, সে বলে, আপনের নামের মানে কি?
খৈমন বিপদে পড়ে যায়, সে বুঝতে পারে না যে, আব্দুল গনির উদ্দেশ্যটা কি, এবং তখন আব্দুল গনি বারান্দার দিকে একটু আগায়া যায়, নজ নারীর দিকে তাকায়া বলে, খৈমন কেমুন নাম, এই নামের মানে কি? তখন ক্ষুব্ধ দমকা বাতাসে খৈমনের তেনার মত আঁচল নাইচা ওঠে এবং আব্দুল গনি অনুভব করে যে, সে একটা বাউরি বাতাসের মধ্যে পড়ে গেছে; তার দেহ কেমন হাল্কা হয়া যায়, টলমল করে, মনে হয় ভেসে যাবে কোথাও, ফলে সে তার একটা হাত প্রসারিত করে দিয়া ভারসাম্য রক্ষা করে এবং তখন তার মনে হয় যে, খৈমন কিছু একটা অবশ্যই ওড়ায় এবং সে টাল সামলায়া নিয়া যখন বলে, কি উড়ান? খৈমন বলে, কি উড়ামু? আপনে দিকদারি কইরেন না, এ্যালা যান!
আব্দুল গনি খাড়ায়া থাকে এবং বলে, কি উড়ান আপনে?
ধৈমনের শাড়ির আঁচলতো পতপত করেই, সে দুই হাতে তার শাড়ি টেনে ধরে রেখে বলে, কিছুই উড়াই না।
: কিছুতো উড়ান-ই, আমাগো দেখলেই আপনের শাড়ির আঁচল উড়বার লাগায়, আপনে কি উড়ান কন?
খৈমন তখন অধৈর্য হয়া পড়ে, সে কান্ধের উপর দিয়া আঁচলটা ছেড়ে দিয়া বলে, ফেলাগ উড়াই, এবং জরিমন ভয় পায়া যায়, কি কচ তুই; ফলে ময়না মিঞা রাইতের বেলা তার শ্বশুরের সঙ্গে বাঘলা বাড়িতে যায় বিবিসি কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম শোনে, রহিম ব্যাপারির রেডিওতে স্বপ্না রায়ের গান বাজে—এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এবং তখন আব্দুল গনি খৈমনদের বারান্দার নিচে খাড়ায়া দমকা হাওয়ার মধ্যে পড়ে, তার মনে হয় যে, এই বাতাস তাকে উড়ায়া নিয়া যাবে, সে তখন তার দুই হাত উঁচা করে ধরে-তার ডাইন হাতের ভিতরে থ্রি নট থ্রি রাইফেলটা উপর দিকে তাক করা থাকে আকাশের দিকে মুখ করে উদ্বাহু হয়া নাচে, সে দেখে আকাশ লাল হয়া আছে এবং এই পাগলা হাওয়া প্যাঁচ খায়া উপরের দিকে উঠে যায়; তখন সে অকস্মাৎ তার বন্দুকের ঘোড়া টিপা দিলে ধড়াম করে কান ফাটা একটা শব্দ হয় এবং দেখা যায় যে, বন্দুকের কুঁদার বাড়ি খায়া আব্দুল গনি মাটির উপরে ধূলাবালির ভিতরে চিৎ হয়া পড়ে আছে। এই ঘটনায় জরিমনের মূৰ্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়, সে জগে করে পানি এনে আব্দুল গনির চোখে মুখে ছিটায়া তাঁকে চাঙ্গা করে তোলে, খৈমনকে সঙ্গে নিয়া তাকে টেনে তুলে খাড়া করে, এবং তাকে যখন জিগাস করে, ব্যথা পাইছো নি বাবা? আব্দুল গনি তখন হাত দিয়া তার শরীর থেকে পানিকাদা ঝাড়ে, দেখে খৈমন ঘরের ভিতরে যায় জানালার পাশে রাজরানির মত বসে আছে, এবং তখন জানালরি শিকের ফাঁক দিয়া দাগ টানা খৈমনের দিকে তাকায়া সে বুঝতে পারে না সে এখন কি করবে, ফলে সে বলে, ব্যথা পাই নাই, আপনের মাইয়ারে ডাকেন কথা জিগাস করি। তখন খৈমন পুনরায় বারান্দায় এসে খাড়াইলে সে বলে, কিসের ফেলগি উড়ান আপনে, বলেন কিসের ফেলা উড়ান, ফাইজলামি পাইছেন, রেজাকারগো লগে ফাইজলামি মারেন? তখন জরিমন ভয় পাইলেও, খৈমনেরতো মাথা তাওয়ার মত গরম, সে আব্দুল গনির কথা শুনে ক্ষেপে, এক কথা বারে বারে কালা জিগান?
: উত্তর তো দেন না, কিসের পতাকা উড়ান-স্বাধীন বাংলার?
খৈমন চুপ করে থাকে।
: পাকিস্তানের?
: পাকিস্তানের পতাকা উড়াই না আমরা!
তখন আব্দুল গনিই শুধু তাজ্জব হয় না, খৈমনের কথা শুনে জরিমন পর্যন্ত খেই হারায়া ফালায়, সে ঘরের ভিতর কোন কোনাকাছি থেকে একটা কুঁচকায়া যাওয়া মাঝারি সাইজের সবুজ-সাদা রঙের পতাকা এনে আব্দুল গনির সামনে উঁচা করে ধরে বলে, পাকিস্তানি পতাকাতো কিন্না রাখচি, ১৪ই আগস্ট আইলে উড়ামু! কিন্তু এই কথা আব্দুল গনির কানে ঢোকে না, সে মনে হয় জরিমনকে দেখেই না, তার জগৎ বেড়ায়া তখন শুধু পোটকা মাছের মত ফুলে ওঠা খৈমন জেগে থাকে—শুধু যদি প্যাটে পোলা না থাকতো-এবং খৈমন বলে, আপনে অখনে যান!
তখন বাঘঅলা বাড়িতে রাইতের আসরটা দুঃসাহসিক হয়া যাইতেছিল, দেশের অবস্থা খুবই খারাপ, মহল্লায় শান্তি কমিটি আর রাজাকার নিয়া বসবাস, এই সময় নিয়ম করে এই কাজ করার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আব্দুল জলিলের কাছে ব্যাপারটা নেশার মত খাড়ায়া যায় এবং খৈমনের সঙ্গে রাজাকারদের আজগুবি সংঘাতের পরেও তার মনে হতে থাকে যে, কি আর হবে। কিন্তু সে আসলে ব্যাপারটা বোঝে নাই, ফলে রাজাকাররা রহিম ব্যাপারির বাড়ি বেড় দিয়া তাদেরকে ধরে; তারা যখন বাড়ির পিছনে আন্ধকারের ভিতরে কুয়াপাড়ের উপরে বসে রেডিও শোনায় ব্যস্ত, তখন রাজাকাররা তাদের এই অপারেশন চালায়, হয়তো আবু বকর মওলানা বনগ্রাম থেকে অতিরিক্ত রাজাকার ধার করে আনে, এবং সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার সময় তিনজন ধরা পড়ে, আব্দুল জলিল, ময়না মিঞা এবং ২০ নম্বর বাড়ির পাজি গোফরান, আব্দুর রহিম ব্যাপারি এবং অন্য কয়েকজন ভাইগা যায়। আব্দুল জলিল এবং ময়না মিঞার আর কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায় না, তখন রাজাকাররা আব্দুল জলিলের বাসায় এসে হয়তো কথা পাড়ে, এবং তখন শোকে কাতর জরিমন ঘর থেকে বের না হলে খৈমন এসে পুনরায় বারান্দায় খাড়ায়, এই বারান্দাটা দুই বাড়ির মাঝখানের গল্লি বরাবর হওয়ায় বাতাস মনে হয় যেন একটা চুলার মধ্যে দিয়া এসে প্রবলভাবে বারান্দার উপরে আছড়ায়া পড়ে, আব্দুল গনি খৈমনের উড়তে থাকা কাপড়ের দিকে তাকায়া বাক্যহারা হয়া থাকে।
: কি উড়াই জিগাইলেন না?
: কি উড়ান?
: পাকিস্তানি পতাকা উড়াই, আপনেরা আমার বাপেরে ছাইড়া দেন, আমার হাজবেন্ডরে ছাইড়া দেন।
আব্দুল গনির কি তখনো মনে হয় যে, খৈমনের মুখটা পানিতে ভেজা একটা বৃক্ষ শাখার মত? সে বলে যে, আব্দুল জলিল এবং ময়না মিঞার খবর তাদের জানা নাই, সেদিনের অপারেশনে তারা ছিল না, মিলিটারি ছিল; সে বলে, কে কি ফেলাগ উড়ায় দেখুমনে, আপনে খালাস কইরা লন!
ফলে, খৈমনের জন্যনালিতে গিঁটু লাইগা যায় এবং মনে হয় চানমিঞার জন্ম হইতে চায় না, আব্দুল গনি এবং অন্য চাইর জন রাজাকার আসে আর ঘুরে যায়, খৈমনের পেট তেলের পিপার মত ঢোল হয়া থাকে, নামে না; এবং ফখরুল আলম লেদুকে মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, চানমিতে পোটলার পোলা, এবং লেদু তর্ক করতে চাইলে সে বলে, কি কচ তুই, অয়তো পোটলার ভিতর থন বাইরইছে, মায়ের প্যাটে হয় নাইকা!
মিসেস জোবেদা রহমানের এই কথা হয়তো ঠিকই, পোটল ভিতরে মানুষের বাচ্চা থাকতেই পারে, আবার হয়তো ঠিক না, কারণ পোটলার ভিতর থেকেই মানুষের বাচ্চা হতে পারে না, চানমিঞাও হয়তো হয় নাই। কিন্তু চানমিঞাকে পোটলার পোলা বলার কারণ কি? কারণ খৈমন-তার জিদ এবং চোপা-চানমিঞার জন্মকে খৈমন পেটিলর সঙ্গে জড়ায়া ফালায়! বাঘঅলা বাড়ি থেকে আব্দুল জলিল এবং ময়না মিল্লাকে ধরে নিয়া যাওয়ার পর আব্দুল গনি যখন বলে, আপনে খালাস কইরা লন, তখন খৈমন আসলেই ভয় পায়, কি করবে আব্দুল গনি খালাসের পর? এবং চানমিঞার আসল জন্মের পর খৈমন ফলস প্রেগনেন্সির আয়োজন করে, কোমরে কাপড়চোপড়ের তলায় তানাতুনা জড়ায়া ফুলায়া রাখে এবং আব্দুল গনি আসে আর যায়, কিন্তু খৈমনের খালাসের লক্ষণ দেখা যায় না, আব্দুল গনি যদি জিগাস করে, কয় মাস, খৈমন চুপ করে থাকে এবং বাতাসে। বিপজ্জনকভাবে তার আঁচল উড়ায়া দেয়, কিন্তু তার মা জরিমন রাজাকারদের সঙ্গে আর বাজাবাজিতে যেতে চায় না, সে বলে, অইবো ছয়/ছাত মাছ হইবো, ক্যাল? ফলে চানমিঞা আর জন্মায় না, আগস্ট যায়, সেপ্টেম্বর যায়, খৈমনের ভুড়ি কমে না, আব্দুল গনি আবার আসে এবং জরিমন বলে, এইতো হইবো, কিন্তু তা হয় না, হওয়ার কারণ নাই, কোমরে কাপড় প্যাচায় তারা আব্দুল গনিকে ঠকায়। আব্দুল গনি হয়তো বিভ্রান্ত বোধ করে, হয়তো তার সময়ের হিসাব আউলায়া যায়, তবু সে ছাড়ে না–কিন্তু আব্দুল গনি এইসব কেন করে? তখন অক্টোবর যায়, নভেম্বরের শেষ দিকে ইন্ডিয়ান বোমারু বিমান চাকা এয়ারপোর্টে বোমা ফালায়, ইন্ডিয়ান মিগ কিংবা মিরেজের পিছনে পাকিস্তানি এফ-৮৬ স্যার ফাইটার ঠা ঠা কইরা লৌড়ায়, কিন্তু ধরতে পারে না, ইন্ডিয়ান প্লেনটা ঠিকই রানওয়ের উপরে দুইটা ডিম পাইড়া থুয়া যায়, তারপর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মহল্লায় দুই/একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখা যায়, তারা এই আসে এই যায়, তাদের ভয়ে রাজাকাররা ভাগে, কিংবা তখনো হয়তো তারা ভাইগা যায় না, ঘাপটি মাইরা থাকে, তাদের নেতা মওলানা আবু বকর হয়তো তাদেরকে বলে, খাড়াও না, সপ্তম নৌবহর আইসা পড়লো; খাড়াও না, চীনা সৈন্য আইতাছে না? নেফার ভিতর দিয়া নাইমা আসবো, তখন ইন্ডিয়ান মালুগুলা কৈ যায়, দেখ না!
ফলে হয়তো আব্দুল গনি এবং তার টুডাফা রাজাকার বাহিনী মহল্লায় থেকে যায়, এবং খৈমনের কোমরের বোচকা নামানো হয় না। তখন ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি মিলিটারি সারেন্ডার করে, নিয়াজি সই করে আত্মসমর্পণের দলিল : Instrument of Surrender: The Pakistan Eastern Command agree to surrednder all PAKISTAN Armed Forces in BANGLA DESH to Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Commanding in Chief of the Indian and BANGLA DESH forces in the Eastern Theatre … The PAKISTAN Eastern Command shall come under orders of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA…
১৬ ডিসেম্বর, বিষুদবার বিকালে অল্প শীতের ভিতর রেসকোর্সের মাঠে পাতা একটা টেবিলের সামনে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার এসে খাড়ায়, সঙ্গে আসে জেনারেল অরোরা; এ কে খন্দকার নিয়াজিয়ে বলে, সারেন্ডার করো, অস্ত্র নামাও, ফুটো এই দেশ থেইক্কা। তখন নিয়াজি বড় বড় সেগুন গাছের তলায় মুখটা শুকনা করে রাখে, তার হোগা দিয়া পাতলা ও পড়ে যেতে চায়, সে কোমরের বেল্ট থেকে তার রিভালবার বের করে রাখে টেবিলের উপরে, তখন দাড়িয়াল কাদের সিদ্দিকি আসে, সে এতক্ষণ পিছনে খাড়ায়া এইসব দেখে, কিন্তু নিয়াজি টেবিলের কাছে এসে অস্ত্রটা রাখা মাত্র কাদের সিদ্দিকি দুই পাও আগায়া এসে একটা ঘুসি মারে নিয়াজির খোতার উপরে, শুয়ারের বাচ্চা, চুতমারানির পোলা, তর মায়রে চুদি, সে বলে এবং লেঃ জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ওরফে টাইগার নিয়াজি মাটির উপরে পড়ে যায়া মুখটা ভ্যাটকায়া ফালায়, কানতে কানতে বলে, আই এম এ প্রিজনার অব ওয়ার, আই ডিজার্ভ প্রোটেকশন এন্ড রেসপেক্ট, তখন লে: জেনারেল অরোরা ডাইন হাত উঠায়া দেখে তার পাগড়ি ঠিক আছে কি না, তারপর কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকির দিকে তাকায়া যখন বলে, হু আর ইউ? তখন আব্দুল কাদের বলে, আই এম এ বাঙ্গালি উইথ শক্ত হাড্ডি এন্ড লম্বা বিয়ার্ড, মাই নেম ইজ আব্দুল কাদের, আই কাম ফ্রম টাঙ্গাইল, ডুয়িং গুল্লি, ফাইটিং ফর মাই কান্ট্রি, আর ইউ?
রেসকোর্সের মাঠে এইসব হয়তো ঘটে, ঘটারই কথা, এবং ভূতের গল্লির লোকেরা যখন শোনে তারা বলে, দ্যাছলতা ছাদিন হয়া গেল গা, তখন জরিমন হয়তো রান্না ফালায়া থুয়া আসে খৈমনের কাছে, এবং খৈমন বলে, ই অখনেই, এবং তারা ভিতর বাড়ির বারান্দার কোনায় বানানো অন্ধকার খুপরি ঘরের ভিতর থেকে ময়না মিঞার তরকারির চাঙ্গারি বের করে আনে, এই চাঙ্গারির ভিতরে একটা কাপড়ের পোটলা দেখা যায়। খৈমন তার কোমরে জড়ায়া রাখা কাপড়ে বোচকা খুলে ফেলতে থাকে, সে এক প্যাচ খেলে এবং জরিমন কান্দে, সে আর এক প্যাচ খেলে জরিমন হাউমাউ করে, ভারপর সে সর্বশেষ একটা প্যাচ খুলে পুরান কাপড়টা মাটির উপরে ফেলে দেয়, তখন জরিমন চাঙ্গারির ভিতর থেকে পোটলাটা উঠায়া বুকের ভিতরে চেপে ধরলে সেটা নড়াচড়া করে, খৈমন তার মায়ের কাছ থেকে পোটলাটা নিয়া কাপড় অলিগ করলে ভিতর থেকে বাচ্চা বের হয়া আসে এবং সে বুকের মধ্যে চেপে ধরলে সেটা চিৎকার করে, তখন খৈমন আরো জোরে চাপ দেয় এবং বাচ্চাটা আরো জোরে চেচায়-মহল্লা মাথায় তুলে ফালায়। একাত্তর সনের ১৬ই ডিসেম্বর খৈমনের বাচ্চার কান্দার শব্দ ভূতের গল্লির ভিতর দিয়া প্রবাহিত হয়, কিন্তু আব্দুল গনিকে পাওয়া যায় না–মান্দারপোলা কইছিল খালাস হইব কবে-খৈমনের জীবনে চনিমিঞা এবং স্বাধীনতা আসে, কিন্তু তারা আব্দুল জলিল, রশিদুল এবং ময়না মিঞাকে হারায়।
বোচকার ভিতর থেকে বের করার পর ভূতের গল্লির লোকেরা যখন চানমিঞার কান্দার আওয়াজ শোনে, তারা বলে, খৈমনের কি হইলো, পোলা না মাইয়া? মহল্লার মহিলারা হয়তো তখন আব্দুল জলিলের বাসায় আসে এবং দেখে যে, খৈমন একটা ডাঙ্গর পোলা কোলের মধ্যে নিয়া দুধ খাওয়ায়, তারা যখন বলে, কখন হইলো, এত বড় পোলা কৈ পাইলি তুই? খৈমণ বলে, এইতো এই চাঙ্গারির মইদ্দে কাপড়ের পোটলার ভিতরে আছিল। কিন্তু এইসব করতে যায়া চানমিঞার জন্ম কবে সেইটা ঠিক করা মুশকিল হয়া পড়ে এবং খৈমন যখন তাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়া যায় তখন সে জট পাকায়া ফালায়, সে বলে যে, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে তার পোলার জন্ম, এবং চানমিঞার পোটলার ভিতর থেকে নির্গত হওয়ার বিষয়টাও স্থায়ী হয়া পড়ে। ময়না মিঞার চাঙ্গারির ভিতর থেকে তুলে আনার পর পোলার নাম রাখার জন্য মা এবং নানি তৎপর হয়, জাফর ইকবাল নামটা খৈমনের পছন্দ হলেও, সেটা বাতিল করা হয়, কারণ নামটা বেশি চকচক করে, তখন মায়ের নামের সঙ্গে মিলায়া খ দিয়া তারা একটা ভাল নাম খোজে, কিন্তু পাওয়া যায় কেবল খবির, খলিল কিংবা খয়বর, এইসব নাম যা তা, তখন তারা মসজিদের হুজুরকে ডেকে আনলে হুজুর বলে, নাম রাখ আব্দুল করিম, এবং খৈমন তার মাকে থামায়, থাউক ওর নাম চান মিঞাই রাখো; তখন দুইটা খাসি আল্লাহুয়াকবর দিয়া চানমিঞার নাম পাকা করা হয়।
চানমিঞার জন্মের আগেই হয়তো মিসেস জোবেদার প্রথম পোলা মামুনের জন্ম হয়া গেছে, জোবেদা বেগম হয়তো তখন খৈমনকে ঝুলে পড়া প্যাট নিয়া হাঁটাচলা করতে দেখে, হয়তো তার সঙ্গে কথা হয়, হয়তো খৈমনের সঙ্গে তার দেখা হয় গেন্দা পোলা নিয়া বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে, খৈমন যখন তাকে জিগাস করে, তুমার পোলার নাম কি রাকচা? জোবেদা বেগম হয়তো বলে, নাম অখনো রাখি নাইকা, রাখুম, এউকগা ভালা নাম ক দেখি; কিন্তু খৈমন বলতে পারে না, সে জাফর ইকবালের নামটা তার নিজের পোলার জন্য রাখে। তারপর হয়তো আবার তাদের দেখা হয় এবং জোবেদা বেগম তাকে বলে, তর উজুরি দেখি ফাল পাইড়া বাড়তাছে, ছিঁড়া পড়ব দেখিচ! খৈমন তার মেজাজ ঠিক রাখার চেষ্টা করে এবং সে যখন আবার জিগাস করে, তুমার পোলার নাম কি রাখলা? জোবেদা বেগম তার আল্লাদের অবস্থায় ফিরা যায়, নাম বিচরায়া পাই নাতো, এউকগা ভালা নাম দে না দেখি; কিন্তু খৈমনের কাছে একটা ভাল নাম কোথায়? জোবেদা রহমানের পোলার জন্য একটা ভাল নাম সে কোন দুঃখে দেবে, কারণ খুব শিগগিরই তার নিজের পোলার জন্যই তাকে হয়তো নাম বিচরাইতে হবে, সে বলে, রাখো কিছু একটা। তারপর তাদের আবার দেখা হয়, এই এক সমস্যা, এক মহল্লায় থাকলে বারেবারে দেখা না হয়া কোন উপায় নাই, দেখা হতেই পারে, এবং দেখা হলে পোলার নাম জিগাস করা করা ছাড়া কি বা করার থাকে? ফলে খৈমন জিগাস করে, কিছু নাম রাখলা পোলার? কিন্ত্র–নামতো এত সহজে রাখা যায় না, একটা পোলা বিয়াইতে লাগে দশমাস দশদিন, তার নামতো ভুট করে একদিন দুইদিন কিংবা পাঁচ দিনে রেখে দিয়া গর্ভের মহিমাটা নষ্ট করে দেওয়া যায় না, একবার একটা হাবিজাবি নাম যদি লেগে যায়, হাবলু/ডাব্লু, তাহলে পোলার জিন্দেগিই বরবাদ। মিসেস জোবেদা রহমান এইবার উল্টা খৈমনের উপর বিরক্ত হয়, সে বলে, এত নাম দিয়া কি করবি? খালি নাম জিগাচ, নাম রাখি নাইকা অখনো, এবং তখন খৈল, যেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ওর নাম রাখো দীলিপ কুমার এবং জোবেদা রহমানের মুখের ভাব বদলায়া যায়, সে বলে, তর পোলার নাম রাখিচ দীলিপ কুমার, নিজের পোলার কি নাম রাখচ দেখুমনে! খৈমন তারপরেও বলে, তাইলে ওর নাম রাখ আভা মিঞা!