০৫. কাজের নেচার

০৫.

পার্থসারথি বললেন, —কাজের নেচারটা বুঝতে পারছ তো? খুব সহজ নয়। খাটতে হবে।

শরণ্যা মাথা নাড়ল, —হ্যাঁ, স্যার। এতগুলো সেন্‌সাস রিপোর্ট স্টাডি করা। বেছে বেছে একটা বিশেষ ইনকাম গ্রুপের মধ্যে মেয়েদের এডুকেশান কতটা ছড়িয়েছে তা শর্ট আউট করা… তাও শুধু ওয়েস্ট বেঙ্গল বা ইন্ডিয়ার নয়, সব কটা সার্ক কান্ট্রির… এ তো স্যার হিমালয়ান টাস্ক।

—উঁহু, আরও আছে। প্রোজেক্টের উদ্দেশ্যটা ভুলো না। ফিমেল লিটারেসি কী ভাবে পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করছে তা স্টাডি করাই আমাদের গোল। কাজটা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। করবে?

শরণ্যা সামান্য চিন্তায় পড়ে গেল। সে আজ স্যারের কাছে এসেছিল গবেষণার বিষয় ঠিক করতে। ভেবেছিল এখনও রেজিস্ট্রেশান হয়নি বটে, কিন্তু অল্প অল্প করে কাজ তো শুরু করে দেওয়াই যায়। কিন্তু স্যার আজ রিসার্চের টপিক নিয়ে মোটেই আগ্রহী নন। চেতনা নামের এক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে পার্থসারথির, বলা যেতে পারে বকলমে তিনিই চেতনার কর্ণধার। চেতনা বেশ কয়েকটা প্রকল্প তৈরি করে পাঠিয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়, সম্প্রতি তার মধ্যে একটি ইউনেস্কোর অনুমোদন পেয়েছে। পার্থসারথির ইচ্ছে তাঁর কৃতী ছাত্রী শরণ্যা এই প্রোজেক্টে যোগ দিক। বিনা পয়সায় খাটাবেন না, মাসে হাজার ছয়েক করে দেবেন। প্রস্তাবটা লোভনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু টাকা নিলে খানিকটা বাধ্যবাধকতাও এসে যাবে না? চাকরি করার মতো?

একটু ইতস্তত করে শরণ্যা বলল, —কিন্তু স্যার …রিসার্চের কাজটাও শুরু করব ভেবেছিলাম…

পার্থসারথি কাঁধ ঝাঁকালেন, —রিসার্চের সঙ্গে প্রোজেক্টের তো কোনও বিরোধ নেই। দুটোই পাশাপাশি চলতে পারে। ইনফ্যাক্ট, দিস উইল হেলপ ইউ ইন রিসার্চ। প্রথমত, তুমি এই কাজটা করতে গিয়ে প্রচুর মেটিরিয়াল পাবে যা থেকে তোমার বেশ কয়েকটা পেপার হয়ে যাবে। সেকেন্ডলি, প্রোজেক্টেরই কোনও একটা এরিয়াকে ডিটেলে হাইলাইট করে ইউ ক্যান গো ফর ইয়োর থিসিস। আমি তো সেই লাইনেই ভেবেছি। আগে কয়েকটা পেপার পাবলিশড হয়ে থাকলে তোমার থিসিসও স্পেশাল ওয়েটেজ পাবে।

—হুঁ, তা অবশ্য ঠিক। শরণ্যা স্বীকার করতে বাধ্য হল, —প্রোজেক্টটা কতদিন চলবে স্যার?

—সে কি এক্ষুনি বলা যায়? আপাতত এইট্রিন মান্থসের একটা ডেটলাইন দেওয়া আছে। তবে প্রোজেক্ট যদি সুষ্ঠু ভাবে এগোয়, টাইম মে বি এক্সটেন্ডেড। আপাতত আমি দু’জন প্রোজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়ে কাজ শুরু করব। পরে রেট অফ প্রোগ্রেস দেখে নাম্বারটা বাড়াতেও পারি। তবে মনে রেখো, কাজটা কিন্তু শুধু বই ঘেঁটেঘেঁটে হবে না। উই নিড সাম ফার্স্টহ্যান্ড ইনফরমেশান। তৃতীয় বিশ্বের স্যাম্পল সিটি হিসেবে কলকাতা খুব আইডিয়াল। এখানকার কারেন্ট ডাটা প্রোজেক্টটাকে এনরিচ করবে।

—বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডাটা কালেকশান করতে হবে স্যার?

—পারলে তো খুবই ভাল। …অন্য আর কী ভাবে ডাটা জোগাড় হবে তা তোমরা নিজেরাও ডিসাইড করে নিতে পারো।

শরণ্যা স্যারের কথার অর্থ ঠিক ধরতে পারল না। স্যার নিশ্চয়ই ডাটা ম্যানুফ্যাকচার করার কথা বলছেন না? প্রফেসার পার্থসারথি বসু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উজ্জ্বল অধ্যাপক। শরণ্যাদের ম্যাক্রো ইকনমিকসের ক্লাস নিতেন তিনি। দারুণ ফান্ডা, পড়াতেনও চমৎকার। রিসার্চ গাইড হিসেবেও পার্থসারথির যথেষ্ট খ্যাতি আছে, প্রায় বছরেই তাঁর হাত থেকে একটা-দুটো পি এইচ ডি বেরোয়। অর্থাৎ শরণ্যাদের ভাষায় হাইলি ফারটাইল। তবে ছাত্রছাত্রী মহলে একটা চাপা গুঞ্জনও আছে পার্থসারথিকে নিয়ে। দুধে জল মিশিয়ে যেমন করে হোক গবেষণার কাজ শেষ করিয়ে দেন রিসার্চ স্কলারদের। ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য এ নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করে না। দেশে বিদেশে পার্থসারথির দারুণ কানেকশানও আছে যে।

ইঙ্গিতটা স্পষ্ট বুঝে নিতে চাইল শরণ্যা। জিজ্ঞেস করল, —মানে?

—কাজ চলতে চলতে বুঝে যাবে। পার্থসারথিও খেলোয়াড় লোক, ঝেড়ে কাশছেন না। বছর পঞ্চান্নর খুদে চেহারার মানুষটি চশমা খুলে কাচ মুছছেন। ফের চশমা পরে নিয়ে মুচকি হাসলেন, —আরে, প্রোজেক্টটা তো তুমি একা করছ না। আওয়ার টিম উইল রান ইট। তোমার সঙ্গে আর একজন তো থাকছেই। সে খুবই চালাক চতুর।

—কে স্যার? শরণ্যা কৌতূহলী হল, —আমাদের ব্যাচের কেউ?

—তোমাদের আগের ব্যাচ। শুভ্র। চেনো নিশ্চয়ই?

শরণ্যা সামান্য হোঁচট খেয়ে গেল। শুভ্রকে সে ভাল মতোই চেনে। মহা ফক্কড় ছেলে। কারণে অকারণে মেয়েদের টিপ্পনী কাটত। শর্মিষ্ঠার নাম দিয়েছিল বিষ্ঠা, এমন অসভ্য। দেবলীনাকে লাইন করার চেষ্টা করেছিল খুব, ভালমানুষের মতো মুখটি করে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসে এসে বসে থাকত প্রায়ই। প্রেমটা অবশ্য পাকাতে পারেনি, এম-এ পড়তে পড়তেই দেবলীনা ঝুলে গেল এক আই-পি-এসের গলায়। তারপরও খুচখাচ ছক চালাত এদিক ওদিক। ওই লক্কড়টায় সঙ্গে কাজ করা কি শরণ্যার পোষাবে? লেখাপড়ায় অবশ্য ভালই ছিল ছেলেটা, মাত্র কয়েক নম্বরের জন্য মিস্ করেছিল ফার্স্ট ক্লাস।

পার্থসারথি ভুরু কুঁচকোলেন, —এত কী ভাবছ? তোমার কি অন্য কোনও প্রবলেম আছে? আই মিন… শ্বশুরবাড়ি…?

—না না, সে রকম কিছু নেই স্যার। শরণ্যা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, —ওঁরা খুবই ওপেন মাইন্ডেড। ইনফ্যাক্ট, ওঁরাই বলছেন এখনও আমি কাজকর্ম শুরু করছি না কেন!

—তবে আর কী, জয়েন করে যাও। কাল…। না, কাল তো হবে না, কাল আমার একটা পি-এইচ-ডি-র সেমিনার আছে। পরশুও বিজি থাকব। তুমি বরং সোমবার চলে এসো চেতনার অফিসে। বাই দা বাই, চেনো তো অফিসটা? মনোহরপুকুরে। দেশপ্রিয় পার্কের পেছনে। বাইরে বোর্ড আছে।

—চিনে নেব স্যার। আমার শ্বশুরবাড়ির কাছেই তো।

—ওয়েল। সোমবারই তবে তোমায় গাইডলাইন দিয়ে দেব। শুভ্রও থাকবে, কথাও বলে নিতে পারবে দু’জনে। ফার্স্ট আওয়ারেই চলে এসো।

চোরা একটা উত্তেজনা নিয়ে পার্থসারথির ঘর থেকে বেরিয়ে এল শরণ্যা। করিডোর ধরে হাঁটছিল অলস পায়ে। ডিপার্টমেন্টের ক্যাম্পাসটা এখনও একই রকম আছে। এখানে ওখানে জটলা, কলরব, হিহি হাসি, হাহা হাসি। পিন পড়লে শোনা যায় এমন ক্লাসে গমগমে স্বরে পড়াচ্ছেন ডি এন, ক্লাসরুমটা পেরিয়ে চলে আসার পরও শোনা যাচ্ছে স্যারের গলা। ওপাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় ফুল এসেছে, নিষ্পত্র ডালপালা যেন সেজেছে লাল গয়নায়। শেষ ফাল্গুনে হাওয়া বইছে এলোমেলো। সব মিলিয়ে যেন একটা মন কেমন করা অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছিল শরণ্যার বুকে। একেই কি নস্টালজিয়া বলে?

বেশ গরম পড়েছে আজ। দুটো বাজে, মধ্যাহ্নের সূর্য যেন ঝলসে দিচ্ছে চামড়া। রঙিন ছাতাখানা মাথায় ধরে সিঁথির বাস স্টপটায় এসে দাঁড়াল শরণ্যা! গড়িয়াহাট যেতে পাক্কা সওয়া ঘন্টা লাগবে বাসে, একটা ট্যাক্সি করে নিলে কেমন হয়? অনিন্দ্য শ দুয়েক টাকা দিয়ে গেছে, উড়িয়ে দেবে? অনিন্দ্যর টাকাও তো নিজেরই টাকা ভাবা উচিত, তবু যে কেন বাধো বাধো ঠেকে? মাকে কখনও বাবার কাছে হাত পাততে দেখেনি বলেই কি? ছ’ হাজার টাকাটা কম নয়, হাত খরচ চালিয়েও দিব্যি কিছু সঞ্চয় করা যাবে। পছন্দসই কেনাকাটার জন্য অনিন্দ্যর কাছে বায়না জুড়তে হবে না।

দুপুরের বাসে ভিড় নেই তেমন। উঠেই শরণ্যা বসার জায়গা পেয়ে গেল। টিকিট কাটতে গিয়ে থমকাল একটু। ফার্ন রোড ফিরে কী হবে এখন? দুপুরবেলা ওই বাড়িটা তো ভূতের বাড়ি হয়ে থাকে। নির্জন। নিঝুম। শাশুড়ি তো থাকেনই না, শ্বশুরমশাই থেকেও নেই, নীলাচল আড্ডা মারতে বেরিয়ে যায়, কিংবা ঘুমোয় ভোঁস ভোঁস। আর সুনন্দ আছে কি নেই বোঝে কার সাধ্যি! থাকলেই বা কী, সে কি শরণ্যার সঙ্গে গল্প করবে? শরণ্যা বেশ কয়েক বার গায়ে পড়ে কথা বলার চেষ্টা করে দেখেছে, সেভাবে আমলই দেয় না সুনন্দ। এমন একটা বাড়িতে দুপুরবেলাটা যে কী অসহ্য! মনে হয় বিশাল দোতলাটা যেন গিলে খেতে আসছে। একা একা হেঁটেচলে বেড়াতেও কেমন গা ছমছম করে। তখন হয় একটু টিভি চালাও, নয় শুয়ে শুয়ে বই পড়ো, কিংবা একে তাকে ফোন করে জ্বালাও। এর জন্য এখন তেতেপুড়ে ফার্ন রোড ছুটবে শরণ্যা? মানিকতলায় নেমে পড়লেই তো হয়। মা-বাবা নেই, ঠাম্মা তো আছে।

অন্নপূর্ণা শুয়েছিলেন। দরজা খুলে নাতনিকে দেখে থতমত, —ওমা, তুই? হঠাৎ? এখন? শরণ্যা তরল গলায় বলল, —কেন, আসতে নেই?

—না, তা নয়… কিন্তু… ফোন-টোন করলি না, দুম করে ভরদুপুরে…?

হায় রে, কী অবস্থা তৈরি করেছে অনিন্দ্য! ও বাড়ির সবাই কাঁটা হয়ে থাকে এখন। বাপেরবাড়িতে শরণ্যার রাত্রিবাস তো ঘুচেই গেছে, দিনেরবেলা এলেও এখন আগে থেকে জানিয়ে আসতে হয়। বাবা-মা মুখে বলে, ফোন করে এলে আমরা কেউ-না-কেউ বাড়িতে থেকে যেতে পারি। কিন্তু সেটাই কি আসল কারণ? শরণ্যা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে?

জোর করে হাসল শরণ্যা, —বেশ করেছি এসেছি। ইচ্ছে হয়েছে এসেছি। ঝটপট কিছু খেতে দাও তো, পেট জ্বলে যাচ্ছে।

—সেকী? এত বেলায় এলি… খেয়ে বেরোসনি?

—উঁহু।

—কেন রে? ঝগড়া করে চলে আসিসনি তো?

—কার সঙ্গে ঝগড়া করব? বরের সঙ্গে? শরণ্যা এবার সত্যি সত্যি হেসে ফেলল। ঠাম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, —না রে বাবা, না। এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? গিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটিতে। স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। খিদে ছিল না বলে ভাত খাইনি। আমার শ্বশুরবাড়িতে যা হেভি ব্রেকফাস্ট হয়।

—তাই বল। এতক্ষণে অন্নপূর্ণার মুখে অনাবিল হাসি, —তা বড়লোকদের বাড়ি কী জলখাবার হয় রে?

—জলখাবার নয় ঠাম্মা, বলো ব্রেকফাস্ট। আজ হ্যামস্যান্ডুইচ তো কাল চিকেন স্যান্ডুইচ। বাটারটোস্ট হলে সঙ্গে পোচ ওমলেট কিংবা সসেজ কিংবা সালামি। টিনফিশও থাকে মাঝে মাঝে। আর ফ্রুটস তো আছেই। কলা আপেল ব্যাগারা ব্যাগারা।

—ওমা, এ তো একেবারে সাহেববাড়ির খানা রে।

সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে শরণ্যা। কাঁধের দোপাট্টা ছুড়ে দিল টেবিলে। পা দোলাতে দোলাতে বলল, —ব্রেকফাস্টটাই যা সাহেবি। লান্‌চ ডিনার পাতি ইন্ডিয়ান।

—মানে?

—দুপুরবেলা ভাত, সঙ্গে ট্যালটেলে ডাল, জল একদিকে গড়ায়, ডাল একদিকে প্যাটপ্যাট তাকিয়ে থাকে, একটা ঘ্যাঁট মতো তরকারি, আর পাতলা পাতলা কাটাপোনার ঝোল। রাত্তিরে ঘাসের মতো ব্রয়লার মুরগি, আর সীতাদির বিকেলে সেঁকে দিয়ে যাওয়া রুটি। বিশ্বাস করবে না, চার মাসে এক দিনের জন্যও ওই মেনুর বদল হয়নি। নট্ ইভন্ ইন ছুটির দিন।

—বলিস কী? রোজ এক খাবার খাওয়া যায় নাকি?

—খায় তো দেখি সব। মুখ বুজেই খায়। কারুর তো কোনও হিল্‌দোল দেখি না। সীতাদির রান্নাও যে কী যাচ্ছেতাই তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। মুখে তুলে থু থু করে ফেলে দেবে।

—আহা রে। বলিসনি তো আগে?

—বলিনি। রোজই ভাবতাম কাল বোধহয় মেনু বদলাবে।

—তোর তো তা হলে খুব কষ্ট হয়!

—চলতা হ্যায়। শরণ্যা হাত উলটাল,—এটাও পার্ট অফ লাইফ ঠাম্মা।

অন্নপূর্ণা তবু যেন সান্ত্বনা পেলেন না। ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন খুব। মোটাসোটা দেহটা নিয়ে আজকাল হাঁটাচলা করতে বেশ কষ্ট হয়, তবু নাতনির খাওয়ার আয়োজন করতে থপথপ ছুটে বেড়াচ্ছেন এদিক ওদিক। একবার রান্নাঘরে ঢুকছেন, একবার ফ্রিজ খুলছেন। শরণ্যাকে জিজ্ঞেস করলেন, —অ্যাই বুবলি, ভাত দিই একটু?

—আছে ?

—গরম করতে হবে।

—সঙ্গে কী দেবে?

অন্নপূর্ণা অপ্রস্তুত মুখে তাকালেন, —ভাত ডাল তরকারি মাছের ঝোল…

—কী মাছ?

অন্নপূর্ণা যেন আরও সংকুচিত, —আজ অন্য মাছ নেই রে। কাটা পোনা।

শরণ্যার পেট গুলিয়ে হাসি উঠে এল। হাসির দমকে ফুলে ফুলে উঠছে। একেই কি বলে টকের ভয়ে পালিয়ে এলাম, তেঁতুলতলায় বাস?

অন্নপূর্ণা ম্রিয়মাণ মুখে বললেন, —তুই যদি সকালেও একটা ফোন করে দিতিস…! অন্য কিছু বানিয়ে দেব? ডিমে ডুবিয়ে ডুবিয়ে পাঁউরুটি… তুই তো খেতে ভালবাসিস।

—কিছু লাগবে না। জো হ্যায় ওহি চলেগা। শরণ্যা টুসকি বাজাল, —তুমি সরে এসো, আমি ভাত গরম করে নিচ্ছি।

শরণ্যার সম্মতিটুকু পেয়ে অন্নপূর্ণার জোশ বেড়েছে যেন। কর্তৃত্বের সুরে বললেন, —বোস তো। এখনও আমি অত অথর্ব হইনি। খেতেটেতে দিতে পারি। ততক্ষণ তুই বরং নবু আর বউমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে নে। এখানে এসে খাওয়াদাওয়া করছিস শুনলে ওরা খুব খুশি হবে।

—ধুস্‌, কী হবে ফোন করে ? তুমিই বলে দিয়ো৷ বোলো ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে…

—যদি তাও গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসে?

—তা হলে বোলো লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম। তোমার আদর খেতে।

অন্নপূর্ণা পুলকে গলে গেলেন। দুলে দুলে চলে গেলেন রান্নাঘরে। একটার পর একটা বাটি গরম করে এনে রাখছেন টেবিলে। থালা সাজাচ্ছেন, গ্লাস বসালেন, জল ভরলেন গ্লাসে।

শরণ্যা একদৃষ্টে ঠাম্মাকে দেখছিল। বুকটা চিনচিন করছে হঠাৎ। ছোট্ট বুবলি স্কুল থেকে ফিরলে এ ভাবেই খাবার সাজিয়ে দিত ঠাম্মা। কী অপরূপ এক আলোয় ভরে থাকত ঠাম্মার মুখ। আলো? না মায়া? আলোটা আছে এখনও, শুধু বুবলিটাই হারিয়ে গেল।

তুৎ, কী হবে মিছিমিছি মন ভার করে? মানুষ কি চিরকাল এক জায়গায় স্থির থাকে? বিয়ের মতো কিছু একটা হলে বদল তো ঘটবেই।

খাবার টেবিলে এসে শরণ্যা হাঁ। একটা কোথায়, তিন তিনটে সবজি! সর্ষে পটল, আলু ভেণ্ডি, পুঁই কুমড়ো বেগুনের চচ্চড়ি।

টাগ্রায় একটা শব্দ করে শরণ্যা বলল, —এত?

—আহা, কী এমন আছে! খা তো।

শরণ্যা আর কথা বাড়াল না। হড়াস করে ডাল ঢালল পাতে, খাচ্ছে হাপুস হাপুস। সত্যি জব্বর খিদে পেয়েছিল।

নাতনিকে নিয়ে অন্নপূর্ণার ভাবনা এখনও যায়নি। পাশের চেয়ারটিতে বসে প্রশ্ন জুড়লেন, —হ্যাঁ রে বুবলি, এই যে তোদের রোজ একঘেয়ে রান্না হয়, তোর শাশুড়ি তাতে কিছু বলে না? সে তো একটু দেখতে টেখতে পারে।

আলগোছে এক ঢোক জল খেয়ে শরণ্যা বলল, —শাশুড়ির সময় কোথায়? তিনি কত ব্যস্ত মানুষ। এখন তো আবার একটা বৃদ্ধাশ্রম গড়া নিয়ে ছোটাছুটি করছেন।

—তা করুক না। দেশের দশের কাজ করছে, পুণ্যি হচ্ছে। তাই বলে মেয়েমানুষের কি ঘরসংসার অবহেলা করলে চলে? শত কাজের মধ্যেও ফুরসত করে নিতে হয়।

—ওঁর পক্ষে সম্ভব নয় ঠাম্মা। ওঁর যে কত কাজ। তা ছাড়া উনি একেবারে অন্য রকম। ওঁর স্ফিয়ারটাই আলাদা। সংসারটংসার নিয়ে উনি কোনও কালেই মাথা ঘামাননি। এখন নীলাচলের হাতে লাগাম, আগে হয়তো কোনও জগন্নাথের হাতে ছিল। ওদের পরিবারটাই ভৃত্যতান্ত্রিক ঠাম্মা।

—কী জানি বাপু, বাইরের কাজ করলে কি সংসার দেখা যায় না? তোর মাকে তো দেখিস, কী ভাবে হাঁচোর পাঁচোর করে ফিরে আসে অফিস থেকে। ওরে, মেয়েমানুষ বেশি বারমুখো হলে সংসার ভেসে যায়, বাড়ির লোকদের পাতে রোজ কাটাপোনাই জোটে।

ঠাম্মার কথাটা পুরোপুরি মানতে পারল না শরণ্যা। মেয়েদেরই সংসার দেখতে হবে, না দেখলে সংসার উচ্ছন্নে গেল, আদ্যিকালের এই সংস্কারটা এখনও কেন মেনে চলতে হবে? ছেলেরা সংসারের দেখভাল করলেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়?

নিবেদিতার ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা একটু আলাদা। তাঁর একটু গৃহিণীপনা থাকলে বোধহয় ভালই হত। অনিন্দ্যর মনে তা হলে হয়তো এত ক্ষোভ জমত না। সুনন্দও যে এত উড়ু উড়ু, বাড়ির কারুর ওপর সুনন্দর কণামাত্র টান নেই, এর মূলেও হয়তো ওই নিবেদিতাই। দায়িত্ব পালন করতে না পারা আর দায়িত্ব ত্যাগ করা কি একই জিনিস? তবে হ্যাঁ, মহৎ কাজে যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেন, তাঁদের বোধহয় এটুকু ছাড় পাওয়াই উচিত। সবাই তো আর দেবেন ঠাকুর নন যে, ঈশ্বর আর জমিদারি একই দক্ষতায় সামলাবেন!

মুখে আর কিছু বলল না শরণ্যা। খেয়ে উঠে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়েছে একটু। ঘরটা এখনও একই রকম আছে। সিঙ্গলবেড খাট, ছোট আলমারি, চেয়ার টেবিল, স্টিলের বুকর‍্যাক, টেবিলল্যাম্প, কিছুই স্থানচ্যুত হয়নি। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে আমজাদ আলির প্রোগ্রাম শুনতে গিয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। সঙ্গতে ছিলেন জাকির হুসেন, সরোদ তবলার যুগলবন্দিতে মোহিত হয়ে গিয়েছিল শরণ্যা। পরদিনই খুঁজে খুঁজে দু’জনের পোস্টার কিনে এনেছিল। এখনও ধ্যানমগ্ন আমজাদ আর উচ্ছল জাকির হুসেন সাঁটা আছেন দেওয়ালে। বিছানাতেও এখনও সেই বুবলি বুবলি গন্ধ। তবু যে আজকাল ঘরটাকে কেন অচেনা অচেনা লাগে! সত্যি, মেয়েদের জীবন এক ধাক্কায় কোত্থেকে যে কোথায় চলে যায়!

অন্নপূর্ণা গুটিগুটি পায়ে ঢুকেছেন ঘরে, হাতে ভাজা মৌরির কৌটো। নাতনির হাতে মৌরি ঢালতে ঢালতে বললেন, —তা শাশুড়ি নয় কাজের লোক, তুই কী করিস?

শরণ্যা হেসে ফেলল। ঠাম্মা আজ একা পেয়েছে তাকে, কৌতূহলে পেট ফুলছে। এখন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বুবলির শ্বশুরবাড়ির সব কথা টেনে বের করবে!

হাসতে হাসতে শরণ্যা বলল,—কী করার কথা বলছ?

—শাশুড়ি যখন দেখেই না, সংসারটাকে তুই তো কন্ট্রোলে নিয়ে নিতে পারিস। টিভি দেখে দেখে তো কী সব রান্না শিখেছিলি, সেগুলো কর। দেখবি দু’দিনে শ্বশুরবাড়িতে তোর নাম ফেটে পড়বে।

—ওটি হওয়ার জো নেই ঠাম্মা। বললাম যে, ভৃত্যতান্ত্রিক পরিবার। জোর করে দু’দিন রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম, ওমনি দেখি নীলাচলের মুখ ভোলো হাঁড়ি।

—বুঝেছি। সে যা পাচ্ছে লুটেপুটে নিচ্ছে।

—উপায় নেই। মেনে নিতেই হবে। অনিন্দ্যও চায় না আমি রান্নাঘরে গিয়ে হাত পোড়াই।

অন্নপূর্ণা চুপ মেরে গেলেন। বুঝি নাতজামাইয়ের নাম শুনেই সন্ত্রস্ত। তারপর ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বললেন,—তা হলে তোকে সারাজীবন কাটাপোনা আর ব্রয়লার খেয়েই কাটাতে হবে? এ তো দেখি বালবিধবারও বাড়া দশা রে!

বিচিত্র উপমায় হি হি হাসছে শরণ্যা। কৌটো থেকে এক খাবলা মৌরি তুলে নিয়ে বলল, না গো বাবা, না। অলটারনেট ব্যবস্থা আছে।

—কী রকম? কী রকম?

—সে এক বিটকেল সিস্টেম। যার যা খেতে ইচ্ছে করবে, কিনে এনে টেবিলে বসে যাও। কেউ কাউকে অফারও করবে না, কেউ কারুর প্লেটের দিকে তাকাবেও না। হাসিও পায়, বিচ্ছিরিও লাগে। এই তো কবে যেন …শ্বশুরমশাই মুড়ি-সিঙাড়া খাচ্ছেন, ছোটছেলে বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে পাশে বসে গেল, তার পরেই মোমো হাতে শাশুড়ি। কেউ কারুর প্লেটের দিকেও টেরিয়েও দেখছিল না ৷

—ততাকেও কেউ দিল না একটু?

—বললাম যে, ও বাড়িতে অফার করার রেওয়াজ নেই। অনিন্দ্যও আনে। আমরা ঘরে বসে খাই।

—আশ্চর্য! এমন তো জম্মে শুনিনি!

—বেশি বনেদি বাড়িতে এ রকমই হয়। না চাইতেই শরণ্যার গলায় শ্লেষ ফুটে গেল,—তোমরাই তো দেখেশুনে ও বাড়িতে দিয়েছ আমায়!

—তোর সুরটা যেন কেমন কেমন? তোর কি শ্বশুরবাড়ি ভাল লাগছে না?

—তা তো বলিনি। বলছি, ও বাড়িতে সবাই যে যার মতো থাকে। আমিও আছি। আমার মতো করে।

অন্নপূর্ণা কেন যেন থমকে গেলেন। কপাল কুঁচকে ভাবছেন কিছু।

শরণ্যা বলল,—কী হল? কোয়েশ্চেনিয়ার শেষ?

অন্নপূর্ণা ফোঁস করে আর একটা শ্বাস ফেললেন,—তোর বাবা-মা ঠিকই বলে। অত বড়লোকের ঘরে বিয়ে দেওয়াটা বোধহয় ঠিক হয়নি।

—ওফ ঠাম্মা, আমি আগেও বলেছি ওরা আর তেমন বড়লোক নেই। এখন আর তালপুকুরে ঘটি ডোবে না। যা ছিল, সবই তো শাশুড়ির বাবার সম্পত্তি। সেই কলসি থেকে গড়িয়েই এখনও ঠাটবাট বজায় রাখার চেষ্টা চলছে।

—কেন, তোর শ্বশুরের কিছু নেই?

—কী থাকবে, তিনি তো নেহাতই চাকরিবাকরি করা মানুষ। মাইনেটাইনে ভালই পেতেন, পেনশানটাও মনে হয় মন্দ পান না। রিটায়ারমেন্টের সময়ে হয়তো কিছু টাকাও পেয়ে থাকতে পারেন। সে আর কত বলো?

—হুম। অন্নপূর্ণা ঝুপ করে প্রসঙ্গ পালটে ফেললেন,—তা তোর শ্বশুরমশাই এখন তোর সঙ্গে কথাটথা বলে? নাকি সারাক্ষণ বই মুখে করেই বসে থাকে?

—তিনি তো কারুর সঙ্গেই কথা বলেন না ঠাম্মা। তাঁর পৃথিবীটাই তো আলাদা। শরণ্যা সামান্য উদাস যেন,—তবে হ্যাঁ, উনি যেন ইচ্ছে করেই একটা খোলসে ঢুকে থাকেন। আমি অবশ্য আজকাল টুকটাক ওঁর ঘরে ঢুকে যাই। টেবিলফেবিল গুছিয়ে দিই, বইপত্র সাজিয়ে রাখি…বেশ খুশিই হন মনে হয়। একবার উসকে দিলে কথাও বলেন বেশ। ক’দিন আগেই তো ইতিহাস নিয়ে ওঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা হল।

—তাই নাকি? বাহ্, ভাল ভাল। শ্বশুরের একটু সেবাযত্ন কর। এ ভাবেই দেখবি শ্বশুরবাড়ির লোকরা সব তোর আপন হয়ে গেছে।

—আবার ওই কথা? বললাম যে, আমার শ্বশুরবাড়িতে কেউ কাউকে আপন করতে চায় না! স্বামী-স্ত্রী, ছেলে, বাবা-মা সবাই যে যার মতো মুক্ত। স্বাধীন। কেউ কারুর হাওয়াটি পর্যন্ত গায়ে লাগতে দেয় না। আমার শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িতে মাসে একটা কথা হয় কিনা সন্দেহ। খাবারটেবিলে ছেলে নুনের জায়গা এগিয়ে দিলে মা বলে থ্যাংকস। ওরা খুব এটিকেটদুরস্ত ঠাম্মা। বড্ড বেশি ফরমাল।

অন্নপূর্ণা কী বুঝলেন কে জানে, ঠোঁট উলটে বললেন—যাক গে যাক, যে যেমনই হোক, ও বাড়িতে আসল জায়গা তো তোর বর। সে তো বাবা তোকে চোখে হারায়!

এবার আর কথার পিঠে কথা নেই শরণ্যার। চুপ করে আছে। অনিন্দ্য কি সত্যিই তাকে চোখে হারায়? নাকি অক্টোপাশের মতো আঁকড়ে থাকে? এক এক সময়ে বড় চাপের মতো মনে হয় বেষ্টনটাকে। অনিন্দ্য ছাড়া সন্ধেবেলা এক পা বেরোনো যাবে না, অনিন্দ্য ঘরে থাকলে বাবা-মার সঙ্গে বেশিক্ষণ টেলিফোন কথা বলাও চলবে না, অনিন্দ্য ছাড়া শরণ্যার একটাও বন্ধু থাকবে না, এগুলো কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? শরণ্যা যে এক রাত্তিরের জন্যও এখানে এসে থাকতে পারে না, এও তো এক ধরনের আগ্রাসন।

অবশ্য এত রকম গোঁয়ারতুমি, অবুঝপনা সত্ত্বেও অনিন্দ্যকে বেশ ভালই বেসে ফেলেছে শরণ্যা। ভালবাসা বলবে, নাকি সহানুভূতি? অনিন্দ্যর মধ্যে এখনও একটা শিশু যেন ঘাপটি মেরে আছে, শিশুটা ভীষণ ভাবে ভালবাসার কাঙাল। ছোটবেলায় বাবা-মার কাছ থেকে তেমন আদরযত্ন পায়নি অনিন্দ্য, তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের জগতে, হয়তো বা সেই জন্যেই। বাবার চেয়েও মার ওপর অনিন্দ্যর রাগটা বেশি। ক্রোধের মুহূর্তে মাতৃস্নেহ না পাওয়ার আর্তিটাই যেন অনিন্দ্যর চোখে ঝলসে ওঠে।

নিবেদিতা একটু সময় করে সঙ্গটুকু তো দিতে পারতেন ছেলেদের।

অন্নপূর্ণা ঠেলছেন নাতনিকে, —কী রে, বরের নাম শুনে বাক্যি হরে গেল যে? লজ্জা পেলি নাকি? নাতজামাই তোকে চোখে হারায় না? বল?

—সে আর বলতে। শরণ্যা আলগা হাসল,—চোখে হারানোর বহরটা তো টের পাচ্ছ!

—আহা, বিয়ের পর পর বউকে ছেড়ে থাকতে হলে অনেক বরই অমন খ্যাপামি করে। অন্নপূর্ণা সহসা অনিন্দ্যর দলে,—তোর ঠাকুরদা কী কাণ্ডটা করত জানিস? আমি বাপেরবাড়ি গেলেই সেখানে গিয়ে হত্যে দিয়ে বসে থাকত। সন্ধে গড়িয়ে যায়, রাত্তির হয়ে যায়, নড়ার নামটি নেই। শেষমেশ বাবা বলতে বাধ্য হত, বাবাজীবন, তুমি রাতটুকু তবে এখানেই থেকে যাও।

—তা হলে আর কী। তোমার নাতজামাই তোমার বরের মতোই হয়েছে।

—আমি তো তোর বাবা-মাকেও তাই বলি। ওরা যে কেন মিছিমিছি এত টেনশান করে!

—হুম্।

—অনিন্দ্যকে একদিন জোর করে এখানে ধরে নিয়ে আয়। আমি জানি তুই ওকে খুব গঞ্জনা দিয়েছিস। বেচারা আর লজ্জায় এখানে আসতে পারে না। অন্নপূর্ণা চোখ টিপলেন, —এবার এলেই আগে ওর রাতে থাকার বন্দোবস্ত করে দেব।

—আহা, রসে মরে যাই।

আরও খানিকক্ষণ এতালবেতাল কথা বলে উঠে পড়ল শরণ্যা। সাড়ে চারটে বাজে, বাসেট্রামে ভিড় হতে শুরু করেছে, এরপর ট্যাক্সি পেতেও অসুবিধে হবে। অনিন্দ্যর ফেরার টাইম ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টা, বাড়ি এসে শরণার মুখ দেখলে মেজাজ টং হয়ে যাবে বাবুর।

পি-এস-বি’র প্রোজেক্টে কাজ করার খবরটা শুনে কী প্রতিক্রিয়া হবে অনিন্দ্যর? ছ’ হাজার হাতে পাবে শুনলে চোখ কি গোল গোল হয়ে যাবে? শুভ্রর কথা বলা চলবে না। অনিন্দ্যর মনের গতিপ্রকৃতি সরল নয়, কী ভেবে বসে কে জানে!

অন্নপূর্ণা দরজা অবধি এসেছেন। শরণ্যার চিবুক ছুঁয়ে বললেন,—ভাল থাকিস বুবলি।

শরণ্যা আবছা হাসল,—সেই চেষ্টাই তো করছি ঠাম্মা।

সহজ সুরেই কথাটা বলতে চেয়েছিল শরণ্যা। কেন যে তবু গলাটা কেঁপে গেল!

.

০৬.

আর্য অন্যমনস্ক হাতে ভাত মাখছিলেন। অতি ধীর লয়ে। অনেকটা সিনেমার স্লো মোশানের মতো। দৃষ্টি নিবদ্ধ সংবাদপত্রের চতুর্থ পৃষ্ঠায়। দিন দশেক আগে টালিগঞ্জের ফুটপাত ধরে হাঁটছিল মা-ছেলে, খোলা ম্যানহোলে হঠাৎ পড়ে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে বাচ্চাটার। খবরের কাগজের প্রতিবেদন পাঠ করে জনসাধারণ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত, তাদের চিঠিপত্রেই আজ ছেয়ে আছে পাতাটা। কারুর মতে পুরসভাই দায়ী, কেউ বা আঙুল তুলেছে সরকারি অপদার্থতার দিকে, কোনও কোনও চিঠিতে মুন্ডুপাত করা হয়েছে পুলিশের। নাগরিকদের মধ্যে ন্যূনতম সিভিক সেন্স গড়ে ওঠেনি বলেও আক্ষেপ করেছে অনেকে। অকালে একটা টাটকা ফুল ঝরে যাওয়ার বেদনায় চোখের জলও কম ঝরেনি।

সত্যি তো, এ কেমন দেশ? দিনের পর দিন ম্যানহোল খোলা পড়ে থাকে, পুরসভার ভ্রূক্ষেপ নেই। ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি হয়ে যায়, পুলিশ মাথাই ঘামায় না। পথেঘাটে হাঁটাচলার মতো সামান্য একটা ব্যাপারেও মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে না সরকার। আর নাগরিকদের তো কোনও রকম সিভিক সেন্স নেইই। চুরি না আটকাতে পারুক, গর্তে একটা পাথর চাপা দিতে পারেনি?

সব ঠিক। কিন্তু, মা’টির কথা কেউ লেখে না কেন? বাচ্চার হাত ধরে হাঁটার সময়ে মা কী করে এত বেখেয়াল হয়? কেমন মা? সামনে গর্ত আছে না ঢিবি, একবার তাকিয়ে দেখবে না? দোষটা তো মাকেও দেওয়া উচিত।

—বাবা, আপনাকে একটু মাছের ঝোল দেব?

চিন্তা ছিঁড়ে গেল। পাতের দিকে তাকালেন আর্য।।

শরণ্যা ফের জিজ্ঞেস করল,—দিই ঝোল? অল্প করে?

—উঁ, নাহ্, লাগবে না।

—বড্ড শুকনো শুকনো খাচ্ছেন যে?

—ঠিক আছে। আমি এ রকমই তো খাই।

শরণ্যার ওই যত্নটুকু ভাল লাগল আর্যর। মেয়েটা বেশ, কথাবার্তা ভারী মিষ্টি। মুখার্জিবাড়ির…উঁহু, মুখার্জি নয়, চ্যাটার্জিবাড়ির ধারায় পড়ে এখনও তাঁকে অশ্রদ্ধা করতে শেখেনি। বাবা-মা সুশিক্ষাই দিয়েছেন মেয়েটাকে। আর্যর ছোটখাটো সুখসুবিধেগুলোর ব্যাপারে এই প্রথম বুঝি কেউ নজর রাখছে। চা’টা কফিটা দিয়ে আসে ঘরে, খেতে ডাকে, একসঙ্গে খেতে বসে, অন্তত এই দুপুরবেলাটায়…আর্যর কাছে এই প্রাপ্তিটুকুও কম নয়।

মেয়েটা অন্তর থেকেই করে তো? না করলেই বা কী? করুণা করলেই বা কী যায় আসে? আর্য ভাল মতোই জানেন, তিনি এ-বাড়িতে করুণারই পাত্র। আজ বলে নয়, চিরটাকাল।

খবরের কাগজে মন ফেরানোর আগেই ফের শরণ্যার গলা শুনতে পেলেন আর্য,—আমি তো বাবা একদম শুকনো খেতে পারি না। ঝোল না হলে হয়? গলায় আটকে যাবে না? আমার মা তো বলে, বুবলির ভাত নদীতে ভাসে।

আর্যর শুনতে মজা লাগছিল। এমন ফুরফুরে সুরে এ-বাড়িতে তো কেউ কথা বলে না। কৌতুক করে বলতে ইচ্ছে হল, তাই বুঝি? আর তরকারিগুলো কি নৌকো হয়ে ঘুরে বেড়ায়?

শব্দই ফুটল না গলায়। এ-বাড়ির কারুর সঙ্গে খোলা মনে কথা বলতে গেলে কোত্থেকে যে একটা অবরোধ এসে দাঁড়ায়!

কিন্তু শরণ্যাকে কি ঠিক এ-বাড়ির কেউ বলা যায়? একদিক দিয়ে দেখতে গেলে তাঁর আর শরণ্যার তো মুখার্জিবাড়িতে একই স্ট্যাটাস। উঁহু, মুখার্জিবাড়ি নয়, চ্যাটার্জিবাড়ি। একজন সোমশংকর চ্যাটার্জির নাতির বউ, অন্যজন সোমশংকরের মেয়ের বর। দু’জনেই বহিরাগত। ওই সূত্র ধরেই তাঁরা কি পরস্পরের আর একটু ঘনিষ্ঠ হতে পারেন না? প্রবীণতর হিসেবে আর্যরই তো উদ্যোগটা নেওয়া উচিত।

অবশ্য ওই মেয়ে একাই একশো। একা একাই বকে যেতে পারে। সপ্তাহ দু’য়েক হল ইউনেস্কোর কী এক প্রকল্পে কাজ শুরু করেছে, রোজই ফেরার সময়ে একবার ঢুঁ মারে তাঁর ঘরে, গল্প শোনায় সেদিন কতটুকু কী হল। প্রশ্নও করে খুব। কালও প্রাচীন গ্রিসে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে কত কী জানতে চাইছিল। কৌতূহলের দাবি মেটাতে মেটাতে আর্য হিমশিম। সেই কতকাল আগে হারিয়ে যাওয়া অধ্যাপক হতে চাওয়া মানুষটাকে খুঁড়ে খুঁড়ে বার করতে হয়, মন্দ লাগে না আর্যর।

শরণ্যা বকবকম করেই চলেছে,—বাবা, আপনার কিন্তু অনেকটা ভাত পড়ে রইল। আপনি কিন্তু আজ খাচ্ছেন না।

স্নেহের ধমকটুকু উপভোগ করলেন আর্য। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,—খাচ্ছি তো। আমি তো আস্তে আস্তেই খাই।

—উঁহু। আপনি যেন কী একটা ভাবছেন? কাগজে কোনও ইন্টারেস্টিং খবর আছে নাকি?

পলকের জন্য আৰ্যর মনে হল চিঠিচাপাটিগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করেন শরণ্যার সঙ্গে। পরক্ষণে মন বদলালেন। যদি শরণ্যার সঙ্গে মতে না মেলে? বাচ্চাটার মৃত্যুর জন্য তিনি মাকেও অংশত দায়ী করতে চান, শরণ্যা বোধহয় এটা মানতে পারবে না। হয়তো একটা তর্ক শুরু হবে। তর্কে আর্যর তীব্র অনীহা।

আর্য বললেন,—তেমন কিছু নেই। বলেই খবরের কাগজখানা উলটে রাখলেন পাশে। জিজ্ঞেস করলেন, —তুমি আজ বেরোবে না?

—কাল একগাদা বই এনেছি। বেশ কয়েকখানা রেফারেন্সও। আজ কম্পিউটার থেকে রেফারেন্স ধরে ধরে ডাটা কম্পাইল করব। এক দিনে হবে না, দু-তিন দিন বাড়িতেই কাজ করতে হবে এখন।

—তোমরা নেপাল ভূটানের ডাটা পাচ্ছ কোত্থেকে? ওখানে কি সেনসাস হয় নিয়মিত?

—হ্যাঁ, হয় তো৷

—আর মায়নামার? ওদের তো নাকি কোনও কিছুই বাইরে আসে না!

—এখন আসছে। কয়েকটা বেশ ভাল ভাল স্টাডি রিপোর্টও আছে। এখনও অবশ্য জোগাড় হয়নি…

বলতে বলতে ঝুপ করে থেমে গেল শরণ্যা। মুখটা যেন কেমন করে বসে রইল একটুক্ষণ। তারপর আচমকাই মুখ চেপে দৌড়োল বড় বাথরুমটায়।

আর্য শব্দ পেলেন ওয়াক ওয়াক করে বমি করছে মেয়েটা। ঘাবড়ে গেলেন খুব। এই মুহূর্তে কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছিলেন না। উঠে গিয়ে দেখবেন শরণ্যাকে? তিনি বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লে মেয়েটার অস্বস্তি হবে না তো?

মিনিট তিন-চার পর ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে বেরিয়ে এল শরণ্যা। সালোয়ার কামিজের ওড়নায় মুখ মুছছে।

আর্য উদ্‌বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,—কী হল হঠাৎ ?

অল্প অল্প হাঁপাচ্ছিল শরণ্যা। দম নিতে নিতে বলল,—গা’টা কেমন গুলিয়ে উঠল!

এ-বাড়ির সদস্য হওয়ার সুবাদে নিজের অজান্তেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার প্রবৃত্তিটা হারিয়ে ফেলেছেন আর্য। তবু কেন যেন আজ এখানেই থামতে পারলেন না। হয়তো এ বাড়ির কেউ সামনাসামনি নেই বলেই। হয়তো কন্যাপ্রতিম মেয়েটির ওপর কণামাত্র হলেও দুর্বলতা জন্মে গেছে আর্যর।

অভিভাবকের সুরে প্রশ্ন করলেন,—কেন? গা গুলোল কেন? হজমের গণ্ডগোল?

—তাই হবে।

—সকালে উলটোপালটা কিছু খেয়েছিলে?

—না তো। ওই সসেজ আর ব্রেড।

—নির্ঘাত তা হলে পেট গরম হয়েছে!… এখন কেমন ফিল্‌ করছ?

—বেটার।…একটু ভাল।

—বমি ভাবটা নেই তো আর ?

—কমে গেছে অনেকটা। মনে হয় খুব অম্বল হয়েছিল।

—ওষুধ খাবে কিছু? আমার ঘরে অ্যান্টাসিড আছে।

—একটু দেখি। তেমন বুঝলে নিয়ে আসব।

আর্য আর প্রশ্নে গেলেন না। টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন। ঈযৎ চিন্তিত মুখে বেসিনে মুখ ধুচ্ছেন। তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে চোখে পড়ল মেয়েটা ঘরে যায়নি, ডাইনিংটেবিলে বসে আছে ঝুম হয়ে। এখনও কি অসুস্থ বোধ করছে ?

পায়ে পায়ে শরণ্যার সামনে এলেন আর্য। নরম গলায় বললেন, —এখন আর পড়াশুনো নিয়ে বোসো না। রেস্ট নাও। শোও গিয়ে। যদি মনে হয় ফের শরীর খারাপ লাগছে আমায় ডাকবে। ডক্টর মিত্র দুপুরের পর থেকে বাড়িতেই থাকেন, আমি ওঁকে একটা ফোন করে নেব।

শরণ্যা বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল,—আচ্ছা।

কথাগুলো বলতে পেরে ভেতরে ভেতরে আর্য একটা অচেনা তৃপ্তি অনুভব করছিলেন। ঘরে গিয়েও খানিকক্ষণ রয়ে গেল রেশটা। কতকাল পর বুঝি কারুর জন্য একটু উদ্‌বিগ্ন হতে পারলেন।

টেবিলঘড়িতে একটা দশ। ইজিচেয়ারে শরীর ছেড়ে বসে আছেন আর্য। বিশ্রাম নিচ্ছেন। বড়সড় বেঁটে ঘরখানার দু’দিকে দুই দু’গুণে চারখানা জানলা। চারটে জানলা দিয়েই চৈত্রের শুকননা বাতাস ঢুকে পড়ছে হঠাৎ হঠাৎ। স্ট্যান্ডফ্যানের হাওয়ায় ধাক্কা খেয়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। বাতাসটা বেশ গরম। হলকার মতো লাগে। তবু উঠে জানলা বন্ধ করলেন না আর্য, চোখ রেখেছেন গরাদের ওপারে। বাড়িটা দক্ষিণমুখখা। আর্য কখনও রাস্তার দিকে মুখ করে বসেন না, তাঁর প্রিয় দিক পশ্চিম। এ-পাশে বাউন্ডারি ওয়ালের আগে এক ফালি সবুজ আছে, একটা-দুটো গাছ স্নিগ্ধ করে রেখেছে জায়গাটাকে। ঝাঁকড়া কামিনী গাছটায় কোত্থেকে আজ একটা পাখি ডাকছিল। পিকপিক পিকপিক। পাখিটার একটানা ডাক শুনতে শুনতে আর্য ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিলেন তন্দ্রায়।

ঘুম ভাঙল নীলাচলের ডাকে,—বাবু…?

ধড়মড়িয়ে উঠলেন আর্য। চোখ রগড়ালেন।

নীলাচল দরজায়। বলল,—কখন কফি রেখে গেছি। আপনি এখনও ওঠেননি ?

—ক’টা বাজে?

—তিনটে। টেবিলঘড়ি নয়, নিজের সোনালি ডায়ালের রিস্টওয়াচখানা দেখল নীলাচল। বলল,—না না, তিনটে পাঁচ।

এতক্ষণ ঘুমিয়েছেন আর্য ? কোনওকালেই আর্যর দিবানিদ্রার অভ্যেস নেই। বড় জোর পাঁচ-দশ মিনিট চোখ বুজে থেকে ভাতের আমেজটা ছাড়িয়ে নেন। দুপুরে ঘুমোন না বলে এই চৌষট্টি বছর বয়সেও তাঁর শরীর যথেষ্ট ফিট। ঘরে বসে থেকেও। সকালে হাঁটার অভ্যেসটা সুগার প্রেসারকেও বশে রেখেছে। কিন্তু আজ কেন ঘুমিয়ে পড়লেন? আবছা ভাবে মনে পড়ল তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত একটা পাখির ডাক ভেসে আসছিল কানে। পাখিটাই কি তবে ঘুম পাড়িয়ে দিল?

অলস রোমান্টিক চিন্তায় সময় কাটানো আর্যর শোভা পায় না। পুরু লেন্সের চশমাখানা চোখে লাগিয়ে ইজিচেয়ার ছেড়ে স্টাডি-টেবিলে এলেন। ফ্লাস্ক খুলে কালো কফি ঢাললেন ঢাকনা-গ্লাসে।

চিনিবিহীন তেতো কফি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে মগজকে। কাগজ গুছিয়ে কলম খুললেন। এক্ষুনি চিঠিটার মুসাবিদা করে ফেলবেন। লেখা শুরুর আগে আর একবার পড়ে নিলেন আজকের প্রকাশিত চিঠিগুলো। দাগ মারলেন কোন কোন চিঠিকে তিনি আক্রমণ করবেন।

সংবাদপত্রে পত্রাঘাত করা আর্যর নেশা। এ-বাড়ির লোকরা বলে বাতিক। নেশা না বাতিক কোন কথাটা তাঁর জন্য সুপ্রযোজ্য হবে আর্য নিজেও বোঝেন না। তবে বিশেষ এক ধরনের সংবাদ তাঁকে প্রণোদিত করে। পারিবারিক খুনখারাপি অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যু। মাসখানেক আগে একটি মেয়ে তার মাকে হত্যা করেছিল। প্রেমিককে বিয়ে করায় বাধা দিচ্ছিল মা, ঠান্ডা মাথায় পথের কাঁটা উপড়ে ফেলে মেয়েটি। ঘটনাটি নিয়ে কলকাতার সমস্ত খবরের কাগজেই ক’দিন কী আলোড়ন। প্রায় সব চিঠিপত্রেরই ঘুরে ফিরে এক বয়ান। আজকালকার ছেলেমেয়েরা দারুণ উন্মার্গগামী হয়ে গেছে, তাদের এতটুকু সহ্যশক্তি নেই, গুরুজনদের মতামতকে তারা সম্মান দিতে জানে না, যা চায় তা পেলেই তারা দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, সিনেমা টিভির ভায়োলেন্স এদের আরও বিগড়ে দিচ্ছে, সব চেয়ে আপনজনকে যে সন্তান খুন করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর্য ভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মেয়ের এ রকম মনোভাব গড়ে ওঠার পিছনে মায়েরও দায়িত্ব আছে। প্রকারান্তরে বলা যায় মা নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে এনেছেন। মা মেয়ের সম্পর্কে ফাঁক ছিল বলেই এমন কাজ করতে পেরেছে মেয়ে। যে সন্তান মাকে ভালবাসতে পারে না, তাকে দণ্ড না দিয়ে সমবেদনার চোখে দেখাটা বেশি জরুরি। অনেকেই তাঁর বক্তব্য মানতে পারেননি, প্রতিবাদ করে বেশ কয়েকটা চিঠিপত্রও বেরিয়েছিল। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থনও করেছিলেন এক-আধজন। এর আগেও এক কিশোর তার বাবা-মাকে নৃশংস ভাবে খুন করেছিল, সেবারও আর্য ঢেউয়ের বিপরীতে গিয়ে কলম ধরেছিলেন। এ রকম এক-দু’বার নয়, বার বার তিনি গড্ডলিকার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর চাঁচাছোলা বক্তব্য ছাপতে রাজি হয় না খবরের কাগজ, তবু আর্য দমেননি। তিনি বিশ্বাস করেন, সমাজ বা পরিবেশ নয়, ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকৃতির মূল কারণ নিহিত থাকে তাদের পরিবারে।

কোত্থেকে এই ধারণা জন্মাল আর্যর? নিজের পরিবার? অনিন্দ্য বা সুনন্দ কাউকেই তাঁর স্বাভাবিক মনে হয় না! এক জনের মধ্যে শুধুই ঘৃণা, অন্য জন চরম উদাসীন। আর্য যদি নিজের মত নিজে মানেন, তা হলে তিনি নিজেও তো ছেলেদের অস্বাভাবিকতার জন্য দায়ী। হ্যাঁ, আর্য মনকে চোখ ঠারেন না। প্রতিটি চিঠিতে তিনি নিজেকেও চাবুক কষাতে চান। ভেতরটা তাঁর ক্ষতবিক্ষত হয়, যন্ত্রণাটা তিনি উপভোগ করেন। এ তাঁর একধরনের মর্ষকামিতা। স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের চাপে চিরকাল নুয়ে থেকেছেন তিনি, অথচ একটা অক্ষম ক্ষোভ অহর্নিশি তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। অনুভূতিটা শুধু তাঁদের দাম্পত্য সম্পর্ককেই শীতল করেনি, দুই ছেলের কাছে ঘেঁষতেও তিনি আগ্রহ হারিয়েছেন। মনে হয়েছে, ওরা আমার কে? দু’জনেই তো সোমশংকরের মেয়ের ছেলে! নিবেদিতার গা-ছাড়া মনোভাব যখন ছেলেদুটোকে বদলে দিচ্ছিল, আর্য তখনও এগোতে পারেননি। অনেক দেরি হয়ে গেছে যে তখন। ছেলেদের চোখে আর্য তখন প্রায় অস্তিত্বহীন। অথবা ক্লীবমাত্র। যাকে কোনও কোনও মুহূর্তে করুণা করা যায়, কিন্তু মানুষ বলে গণ্য করা যায় না।

নিজের এই বিপন্নতা বড় পীড়া দেয় আর্যকে। বুঝি ওই চিঠিগুলো লিখেই তিনি একটু মুক্তি পেতে চান। নিজেকে আঘাত দিয়ে রফা করতে চান মনের সঙ্গে।

আজ চিঠিটার মুসাবিদা ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না আর্যর। কখনও মনে হয় বড্ড বেশি কড়া হয়ে যাচ্ছে, কখনও বা যুক্তি খেই হারিয়ে ফেলছে। একবার কাটলেন, দু’বার কাটলেন, বার কয়েক কাটাকাটির পর বেশ খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়লেন আর্য। ছেঁড়া কাগজ দলামোচড়া করে ঢোকাচ্ছেন ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে। কফি খেলেন দু’চুমুক। উঠে পায়চারি করছেন ঘরে। আর্য আর অনিন্দ্যর মুখ একই ছাঁচে ঢালা। ফরসা ফরসা মেয়েলি ধাঁচের মুখখানায় নানান রংয়ের অভিব্যক্তি ফুটে উঠছে। মাথা ঝাঁকাচ্ছেন আর্য। আপন মনে বিড়বিড় করছেন। যেন চিঠির বক্তব্য গোছাতে গিয়ে লড়াই করছেন কারুর সঙ্গে।

টেবিলে পেলোপোনেশিয়ান ওয়ার বইটা পড়ে আছে। অনেককাল পর কাল রাত্রে আর্য উলটেপালটে দেখছিলেন বইখানা। অন্যমনস্ক ভাবে বইটা হাতে তুলেও সরিয়ে রাখলেন টেবিলের একধারে। ফের বসেছেন চিঠি নিয়ে। পৌনে পাঁচটা বাজে, লেখার জায়গাটায় আলো একটু কম কম লাগছে, টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে নিলেন আর্য। সাদা কাগজে শুরু করলেন—মাননীয় সম্পাদক মহাশয়…

তিন লাইন লিখতে-না-লিখতেই ভাবনা ছিঁড়ে ফরদাফাঁই। উৎকট বাজনার আওয়াজ। গোটা বাড়ি যেন কাঁপছে ঝনঝন। সুনন্দর সাঙ্গোপাঙ্গরা এসেছে ! কখন এল? তারা তো নিঃশব্দে সিঁড়ি ভাঙার পাত্র নয়! আর্য যখন ঘুমোচ্ছিলেন তখনই কি…? এতক্ষণ চুপচাপ ছিল? নাকি এইমাত্র উঠল, আর্য খেয়াল করেননি?

হঠাৎ হঠাৎ এক এক দিন এই অত্যাচারটা করে সুনন্দ। চলে প্রায় ঘণ্টা দু’ তিন। আর্যর তখন পাগল পাগল লাগে, মনে হয় বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান রাস্তায়।

বাজনার পরদা চড়ছে ক্রমশ। হঠাৎই শরণ্যার কথা মনে পড়ল আর্যর। মেয়েটার আজ শরীর খারাপ, নিশ্চয়ই বিশ্রাম নিচ্ছে। বেচারা এই উৎপাতে তো অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। ওপরে গিয়ে বারণ করে আসবেন? ধমকাবেন সুনন্দকে? বলবেন, অন্যদের সুবিধে অসুবিধের কথা একটু ভাবতে শেখো?

একটা তেতো হাসি ফুটে উঠল আর্যর ঠোঁটে। তিনি জানেন তিনি কিছুই বলতে পারবেন মা। বসে বসে শুধু গুমরোনোটাই তাঁর নিয়তি।

দু’হাতে কান চেপে আরামকেদারায় এসে বসলেন আর্য। শেষ সূর্যের আলো পড়েছে কামিনী গাছের মাথায়, ডগার পাতাগুলো চিকচিক করছে আলোয়। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আর্যর শরীর ক্রমে শিথিল হয়ে এল। বাজনার আওয়াজ অসহ্য, তবে যেন সয়ে আসছে কানে। চোখের সামনে থেকে একটা দিন মুছে যাচ্ছে। আরও একটা নিষ্ফলা দিন। একটা বিফল মানুষের আয়ু আরও কয়েক ঘণ্টা কমে গেল।

আর্যর দৃষ্টি আবছায়ায় স্থির। আবছায়া? না শুধুই ছায়া? ক্রমশ ছায়া যেন গাঢ় হচ্ছে। অন্ধকারে গাঢ়তর আঁধার হয়ে ফুটে উঠছে অতীত। সারাটা জীবন কী করলেন তিনি? এম-এ-তে অসাধারণ রেজাল্ট করার সুবাদে চাকরি পেলেন, অথচ প্রথম দিনই ক্লাসে গিয়ে পা কাঁপতে লাগল, বুক ধড়াস ধড়াস। ছাত্রছাত্রীদের সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও গলা শুকিয়ে কাঠ। গোড়ার দিকে ভেবেছিলেন এ বুঝি প্রাথমিক জড়তা, আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে যাবেন, কিন্তু হল কই? জানা বিষয়ও ক্লাসে গিয়ে ভুলে যান, লেকচার দিতে গিয়ে তোতলাতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু হল কলেজে, ক্লাসে ঢুকলে ছেলেমেয়েরা বিচিত্র আওয়াজ করে, করিডোরে টিটকিরি দেয়, স্টাফরুমেও তিনি সহকর্মীদের মজার খোরাক। প্রিন্সিপাল বারীন গুপ্ত একদিন ডেকে বললেন, কথা বলাটা যখন তোমার আসে না, তুমি নোট বানাতে শুরু করো। মরিয়া হয়ে আর্য রাত জেগে দিস্তে দিস্তে ইতিহাসের নোট বানালেন, তাতেও সমস্যা মিটল না। বোর্ডে লিখতে গেলে হাত কাঁপে, দেখে দেখে পড়তে গেলে গলা। শিক্ষকতার পেশাটা ছেড়েই দিলেন আর্য, মিউজিয়ামে চাকরিটা পেয়ে যেন বেঁচে গেলেন। এক কোণে ঘাড় গুঁজে নিজের কাজটি করে যাও, সামনে আর অনেক মুখ নেই, এই তো বেশ। টানা আঠাশটা বছর জাদুঘরে চাকরি করলেন আর্য, কোথাও এতটুকু ছাপ পড়ল না। প্রাচীন পাথরের মাঝে এক টুকরো জীবন্ত ফসিল হয়ে কাটিয়ে দিলেন দিব্যি। অফিসকলিগরা আড়ালে তাঁকে কী নামে ডাকতেন তাও তিনি জানেন। মিস্টার ডাম্ব। ডাম্বু। অফিসে কত অবিচারের শিকার হয়েছেন আর্য। প্রাপ্য প্রোমোশান পাননি, অকর্মণ্য হিসেবে তাঁকে দেগে দেওয়া হয়েছে, ছুড়ে ফেলা হয়েছে অপ্রয়োজনীয় বিভাগের ডাস্টবিনে। সহকর্মীদের দেওয়া নামের মর্যাদা রাখতেই বুঝি টুঁ শব্দটি করেননি।

বাড়িতেই বা কী পেয়েছেন? এক-আধ বার আহত কুকুরের মতো ফুঁসে ওঠা ছাড়া?

এ রকম একটা মানুষের জীবন থেকে একটা দিন খসে গেলেই বা কী?

তবু যে কেন এক অচেনা ভয় আঁচড় কাটে আর্যর বুকে? মৃত্যু কি আরও এক কদম এগিয়ে এল ?

আশ্চর্য, বেঁচে থাকা অর্থহীন জেনেও কেন যে মৃত্যুকে এত ভয়?

ইজিচেয়ার সামান্য নড়ে উঠল।

ঝাঁকুনি খেয়ে আর্য চমকে তাকালেন। নীলাচল।

অবাক চোখে নীলাচল দেখছে আর্যকে,—আপনার হল কী বাবু?এই ঝাঁপঝাঁইয়ের মাঝেও ফের ঘুমিয়ে পড়েছেন?

আর্য গোমড়া মুখে বললেন, —আমি জেগে আছি।

—সাড়া দিচ্ছেন না যে? কখন থেকে ডাকছি!

—কেন?

—আপনার ফোন।

আর্যর কপালে প্রশ্ন চিহ্ন।

—আপনাকেই খুঁজছে। হ্যান্ডসেটটা এনে দেব?

হ্যান্ডসেট থাকে সোমশংকরের মেয়ের ঘরে। আর্য বললেন,—থাক। আমি যাচ্ছি।

দোতলায় বাজনার দাপট আরও বেশি। কিছুই প্রায় শোনা যাচ্ছে না। এক কান চেপে রিসিভার অন্য কানে নিলেন আর্য,—হ্যালো…? কে বলছেন? জোরে বলুন।

—কে? …বড়দা? ক্ষীণ স্বর ভেসে এল,—আমি ভোম্বল।

—ও।…বল।

—তোমার বাড়িতে কোনও ফাংশান হচ্ছে নাকি?

—অ্যাঁ?… হ্যাঁ। একটু গানবাজনা…

—বেশ আছ।

ভোম্বলের স্বরে শ্লেষ। আর্যর গলা আরও ভারী হল, দরকারটা কী বল।

—তোমাকে একটা খবর দেওয়ার ছিল। মেজজামাইবাবু মারা গেছেন।

আবছা ভাবে মেজ বোনের বরের মুখটা মনে পড়ল আর্যর। আবছা ভাবেই। স্বরে বিশেষ আবেগ ফুটল না। বললেন,কবে?

—পরশু। রাত্তির সাড়ে এগারোটা নাগাদ।

—ও।…কী হয়েছিল?

—সেরিব্রাল অ্যাটাক। হাসপাতাল নার্সিহোম অব্দি নেওয়া যায়নি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই…

—ও।

—মেজদি খবরটা তোমায় দিতে বলল। পারলে একবার এসো।

টেলিফোন রেখে আনমনে ঘরে ফিরলেন আর্য। চেয়ারে বসে ছোট্ট একটা শাস ফেললেন। বুলুর বর মারা গেছে পরশু রাতে, খবরটা তাঁকে দেওয়া হল প্রায় দু’ দিন পর। ঠিকই তো আছে। ভাইবোনদের সঙ্গে আর্যর তো এখন এ রকমই সম্পর্ক। যোগাযোগ যেটুকুনি আছে, সেও তো প্রায় না থাকারই মতো। এক ডোম্বলই যা আসে ন’ মাসে-ছ’ মাসে। বাঁকা চোখে দেখে সোমশংকরের প্রাসাদটাকে, তবু আসে। বাকিদের সঙ্গে তো বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া দেখাই হয় না। বুলুরা তো অনিন্দ্যর বিয়েতেও আসেনি। তাঁকে যে আদৌ দুঃসংবাদটা জানানোর কথা বুলুর মনে পড়ল এই না ঢের।

আর্য জানেন তাঁর ওপর ভাইবোনদের একটা উগ্ৰ অভিমান আছে। থাকাটা অস্বাভাবিকও নয়। পরিবারের উজ্জ্বলতম রত্ন বলে যাকে মনে করা হত, সে যদি বড়লোকের ঘরজামাই হওয়ার টানে সবাইকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, তাকে কি বাড়ির লোক পুজো করে! অবশ্য বিয়ের পরও আর্য বাড়ি যেতেন নিয়মিত, অন্তত যতদিন বাবা-মা ছিলেন। বুলু-টুলুর বিয়েতে যেচে টাকাপয়সাও দিয়েছেন। তবে টের পেতেন তাঁকে আর কেউ ও বাড়ির মানুষ বলে মনে করে না। কতদিন আর একতরফা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর দায় নেওয়া যায় ? আর্যও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ক্রমশ। ভেতরটা বিশ্রী ভাবে জ্বলত তখন। একসময়ে সেই জ্বালাপোড়াও মরে গেল, তার জায়গায় ভর করল এক অদ্ভুত নির্লিপ্তি। ইচ্ছে হলে খবর নিয়ো, না হলে নিয়ো না, এমন একটা মনোভাব। অনিন্দ্যর বিয়েতে বুলুরা এল না, বড়দিও না, তার জন্য কতটুকু আহত হয়েছেন আর্য ?

বুলুর বরের মৃত্যুসংবাদেও কি তিনি মুহ্যমান? উঁহু। শুধু খবরটা দেরি করে পাওয়ার জন্যই বুঝি খচখচ করছে মনটা। একান্তই অর্থহীন, তবু কেন যে করছে?

নীলাচলকে ডেকে ফ্রিজ থেকে সোডার বোতল আনালেন আর্য। বসলেন তরল পানীয় নিয়ে। নিত্য অভ্যাসে সুরা আর তেমন ক্রিয়া করে না মস্তিষ্কে, তবু যেন একটু শিথিল হয় স্নায়ু, শান্তি শান্তি আমেজ আসে একটা। এখন তিনি বই খুলবেন, অক্ষরের অরণ্যে ডুবে থাকবেন খানিকক্ষণ। অক্ষরের জঙ্গল ঝাপসা হওয়ার আগে খেতে উঠবেন ওপরে। নেমে এসে দেখবেন দেড় তলার ঘরে সিংগল বেড খাটখানায় শোয়ার আয়োজন সম্পূর্ণ করে রেখে গেছে নীলাচল। টেবিলে সাজানো আছে গ্লাস, জলের জগ। আর্য জল খাবেন একটু। বাথরুমেও যাবেন, তবে তক্ষুনি তক্ষুনি শোবেন না। ইজিচেয়ারে ছড়িয়ে দেবেন শরীর, ফিকে আঁধারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসবে চোখ, স্ট্যান্ডফ্যানের মুখ বিছানা অভিমুখে ঘুরিয়ে ঈষৎ বেসামাল পায়ে আর্য গড়িয়ে পড়বেন বিছানায়।

আজ ছন্দপতন ঘটল। খাওয়ার পর নেমে এসে জলে চুমুক দিয়েছেন কি দেননি, ঘরে চেনা পায়ের শব্দ। সোমশংকরের মেয়ে।

আর্যর ভুরু কুঁচকে গেল। ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন,—কিছু বলবে?

নিবেদিতার পরনে নাইটি হাউসকোট। হাউসকোটের ফিতে টাইট করতে করতে বললেন,—তোমার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল।

আর্য মনে মনে বললেন, জরুরি কথা ছাড়া কি আসো তুমি?

মুখে বললেন, —বলো।

—শুনেছ তো, আমাদের শোভাবাজারের বাড়ি এক্ষুনি বিক্রি হচ্ছে না?

আর্য মনে মনে বললেন,—আমায় বলবেটা কে? আর শুনেই বা কী করব?

মুখে বললেন, —এই শুনলাম।

—বাড়িটা বিক্রি না হয়ে খুব অসুবিধেয় পড়ে গেলাম। টাকার খুব দরকার ছিল।

আর্য মনে মনে বললেন, তো?

মুখে বললেন,—হুম্।

—তুমি আমায় কিছু ধার দাও। মাস ছয়েকের মধ্যে শোধ দিয়ে দেব।

দুটো আর্য মিশে গেল,—কত?

—এই লাখ দেড়েক মতো।

—এত টাকা! কেন?

—টাকা কীসের জন্য লাগে ? নিশ্চয়ই আমি ওড়াব না। নিবেদিতা ঝেঁঝে উঠলেন। বুঝি বা আর্যর কাছে হাত পাততে অস্বস্তিও ছিল, সেটাই যেন প্রকাশ পেল অন্য সুরে,—বাড়িটা দিন দিন ঝাঁঝরা হচ্ছে, নজরে পড়ে? শুধু রং করালেই কি কাজ শেষ হয়ে যায়? একতলাতে তো হাতই পড়েনি। ভাড়া দিতে এসে প্রতি মাসে মাথুর শুনিয়ে যাচ্ছে, এখানে চাপড়া খসে পড়ছে, ওখানে মেঝে ফেটে যাচ্ছে……। ওদের আমি কথা দিয়েছিলাম বাথরুমগুলো রেনোভেট করে দেব…..। গাড়িটারও তো ওই কন্ডিশন! দশ দিন গ্যারেজে কাজ হল, উনিশ হাজার টাকা খরচা করলাম, তার পরও রোজ বন্ধ হচ্ছে! চলে এ ভাবে? নতুন না হোক, একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িও তো কিনতে হয় এবার। উটপাখির মতো মুখ গুঁজে আছ থাকো, অন্তত ঝড়ের খবরগুলো তো রাখো।

আর্য বলতে পারতেন, আমার তো এত সব জানার কথা নয়। বাড়ি তোমার, ভাড়াটে তোমার, টাকাও তোমার ব্যাগেই ঢোকে। গাড়িটাও তুমিই চড়ো।

বলতে পারলেন না। তবে অপ্রসন্ন স্বর ফুটল গলায়,—বটেই তো। বটেই তো। সব খবর তো তুমি একাই রাখো।

—রাখিই তো।

—বাড়িতে একটা বাইরের মেয়েকে এনেছ, তার দিকে খেয়াল আছে?

—কেন? নিবেদিতা থমকালেন, —কী হয়েছে শরণ্যার?

—আমাকে উটপাখি বলার আগে নিজেকে আয়নায় দ্যাখো।… মেয়েটা আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বমি করছিল।

—কখন ?

—দুপুরবেলায়। আমি ওকে জোর করে বললাম, শুয়ে থাকো, রেস্ট নাও…

—সো কাইন্ড অফ ইউ। নিবেদিতার স্বরে বিদ্রুপ,—ছেলেদের খোঁজখবর তো কোনও দিন রাখলে না, তাও অন্তত ছেলের বউয়ের খবরটা রাখছ!

—তোমার ছেলেদের খবর রাখার আমি কে? তারা আমায় পোঁছে? আমি তো শুধু কলুর বলদ, তাদের জন্য শুধু ঘানিই টেনে যাচ্ছি। ভুলে যেয়ো না, ক’দিন আগেও তোমার ছেলের বিয়েতে আমি দেড় লাখ টাকা দিয়েছি।

—তোমার ছেলে তোমার ছেলে করছ কেন? ছেলে আমার একার? তার বিয়েতে খরচ করা তোমার কর্তব্য নয়?

আর্য ফের দু’ টুকরো হয়ে গেলেন। একটা আর্য গজগজ করতে লাগলেন, হ্যাঁ, আমার তো শুধু ওইটুকুই কর্তব্য। অধিকারবিহীন দায়িত্ব পালনটাই আমার কাজ। ছেলের জন্য মেয়ে দেখলে তুমি, পাকা কথা বললে তুমি, বিয়ের দিনও তুমি স্থির করলে….আশীর্বাদের আগে হঠাৎ মনে পড়ল ছেলের একটা বাবাও তো আছে! তাকে বরকর্তা সাজিয়ে বিয়ের মণ্ডপে বসিয়ে রাখলে তো মন্দ হয় না ! বউভাতের দিন যাত্রাদলের রাজার মতো ধরাচূড়ো পরিয়ে তাকে দিয়ে অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নের কাজটাও তো চালিয়ে নেওয়া যায়! ছেলের বিয়ে নিয়ে একটা পরামর্শও তুমি করেছ আমার সঙ্গে?

মুখে বললেন,—ওই কর্তব্যটুকুই তো করছি সারা জীবন। তুমি আজীবন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়িয়েছ, আর আমি টাকা রোজগার করে এনে হাওয়ায় ঢেলেছি।

—থাক, লেকচার মেরো না। নিবেদিতার স্বর বেঁকে গেল,—ওটাও তোমার ঠিকঠাক আসে না।

পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন নিবেদিতা। মাঝে মাঝেই দেন ঠেসটা। এখনও। স্মরণ করিয়ে দেন আর্য একজন ব্যর্থ অধ্যাপক।

অন্য দিন মিইয়ে যান আর্য। আজ ওই দুর্বল জায়গাটায় ঘা পড়তেই আর্যর চোয়াল শক্ত হল। বরফ স্বরে বললেন,—আমি টাকা দিতে পারব না। আমার পক্ষে আর সঞ্চয় ভাঙা সম্ভব নয়।

—দেবে না তুমি? দেবে না? নিবেদিতা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। অপমানে মুখ কালো হয়ে গেছে। বললেন,—ধার…তাও দেবে না?

আর্য চুপ।

—ভেবেছ টাকা না দিয়ে আমায় জব্দ করবে? নিবেদিতা চোয়ালে চোয়াল ঘষলেন,—বুড়ো হলে, এখনও তোমার জ্বলুনি গেল না! আমার নাম, আমার খ্যাতি এখনও তোমায় পুড়িয়ে মারে, অ্যাঁ?

আর্য নীরব।

নিবেদিতা জ্বলন্ত চোখে দু’-এক সেকেন্ড দেখলেন আর্যকে। মেঝেয় পা ঠুকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন দরজায়। ঘুরে বললেন,—কী দেখে যে তোমার মতো একটা অশ্বডিম্বকে আমি বিয়ে করেছিলাম! কেন এখনও এক ছাদের নীচে বাস করছ ঢং করে? চলে যেতে পারো না কোথাও? আমি মুক্তি পাই!

হৃদয়ের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে আর্যর। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, বহুকাল আগেই তো বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। সব কিছু ছেড়ে। পারলাম কই? কোন সুতোর টানে আটকে গেছি তুমি বোঝো না?

আর্য কিছুই বলতে পারলেন না। এই না-পারাটাই তো তাঁর স্বভাব। না-পারাটাই তাঁর যন্ত্রণা।

.

০৭.

লান্‌চে যাবে বলে উঠি উঠি করছিল অনিন্দ্য, পুট করে এক চিঠি এসে হাজির। চিঠি নয়, কর্তৃপক্ষের হুকুমনামা। দুর্গাপুরে ফ্লাইওভার তৈরির কাজ শুরু করছে কোম্পানি, অবিলম্বে অনিন্দ্যকে সেখানে জয়েন করতে হবে। থাকতে হবে সাইটে, দেখাশুনো করতে হবে কাজকর্মের। দুর্গাপুরে জয়েন করার সময়সীমাও নির্ধারিত করে দিয়েছে কোম্পানি। দোসরা মে।

চিঠিখানা হাতে নিয়ে অনিন্দ্য একটুক্ষণ থম বসে রইল। প্রাথমিক অভিঘাতটা সামলাল। তার চারপাশে অহরহ চক্রান্তের জাল বোনা হচ্ছে এ তো সে জানেই। বিশ্বসংসারে কে না তাকে কোণঠাসা করে রাখতে চায়! কিছুদিন ধরেই অফিসে কানাকানি চলছিল সদর দপ্তরে একটা রিসাফল্‌ হবে। কোপটা তার ঘাড়েই পড়ল তা হলে?

উঠে সোজা চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে গেল অনিন্দ্য। বাদল ভৌমিকের চেম্বার ফাঁকা নেই আজ, এক সাপ্লায়ার বসে। মুখচেনা। বেলিলিয়াস রোডের জি এম ফাউন্ড্রির মালিক। ঘুরনচেয়ারে হেলান দিয়ে তাকে কী সব বোঝাচ্ছেন বিবি।

অনিন্দ্যকে দেখেই থামলেন বি বি,—কিছু বলবে মুখার্জি?

খামসুদ্ধ অর্ডারটা টেবিলে ছুড়ে দিল অনিন্দ্য,—এটা কী?

বি বি খামটার দিকে তাকালেনই না। ঠান্ডা গলায় বললেন, —বোসো। আগে মিস্টার কেজরিওয়ালকে ছেড়ে দিই।

এই হিম হিম গলাই তো ষড়যন্ত্রের সংকেত! অনিন্দ্য বসে মুঠো পাকাতে শুরু করল। ভ্রূক্ষেপহীন স্বরে কেজরিওয়ালকে ধমকে চলেছেন বি বি। নমুনা মাফিক মাল পাঠায়নি জি এম ফাউন্ড্রি, তাদের একটা গোটা কন্‌সাইনমেন্ট বি বি বাতিল করেছেন, কী কী ত্রুটি ছিল চাঁছাছোলা ভাষায় শুনিয়ে চলেছেন। শাসালেনও। পরের বার কোয়ালাটি ফল করলে জি এম ফাউন্ড্রিকে কোম্পানি ব্ল্যাকলিস্টেড করবে।

অনিন্দ্য ধৈর্য হারাচ্ছিল। শব্দ করে চেয়ারটা টেবিলের কাছে টানল। ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন, যেন এক্ষুনি তার প্লেনট্রেন কিছু ছেড়ে যাবে।

কেজরিওয়াল শুকনো মুখে বেরিয়ে যেতেই অনিন্দ্য হাঁই হাঁই করে উঠল,—আমাকে এ রকম একটা চিঠি দেওয়ার অর্থ কী?

বি বি-র শান্ত মুখচোখ আচমকাই শক্ত হয়ে গেছে। গলা ভারী করে বললেন,—অর্ডারের ল্যাংগুয়েজটা কি আন্‌ক্লিয়ার ?

—আমি জানতে চাইছি কেন আমাকেই দুর্গাপুর পাঠানো হচ্ছে?

—স্ট্রেঞ্জ! তুমি কি কৈফিয়ত চাইছ নাকি? অফিস ডেকোরাম জানো না ? তোমার লাস্ট কাজটা ভাল লেগেছিল বলে আমি তোমাকে রেকমেন্ড করলাম, আর তুমি আমাকেই এসে তড়পাচ্ছ?

ও, বি বি-ই তা হলে নাটের গুরু? খচড়ামিটা বি বি-ই করেছে?

সিদ্ধান্ত মনে মনে নেওয়াই ছিল, দুম করে অনিন্দ্য বলে দিল,—আমি দুর্গাপুর যাচ্ছি না।

—কেন জানতে পারি?

—আমি আপনাকে জবাব দিতে বাধ্য নই। অনিন্দ্যর মুখ বেঁকে গেল, —আমি চাকরি থেকে রিজাইন করছি। ফ্রম দিস ভেরি মোমেন্ট।

—তুমি…..তুমি…..! বি বি হতভম্ভ, —ভেবে বলছ?

—পাওনাগন্ডটা রেডি রাখবেন। মাসপয়লায় এসে নিয়ে যাব। আমারও ডেটলাইন দিয়ে গেলাম। ওই দোসরা মে।

বলেই আর বসল না অনিন্দ্য। বাদল ভৌমিকের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখখানা উপেক্ষা করে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। খসখস করে লিখল পদত্যাগপত্র, ড্রয়ার খুলে খাম বার করে ভরল সদর্পে। নিজের দু’-একটা ব্যক্তিগত জিনিস রাখা থাকে ড্রয়ারে। সানগ্লাস, রুমাল, পেন, চাবি, টুকিটাকি কিছু ড্রয়িং অ্যাপারেটাস। ব্রিফকেসে সব পুরে ডাকল বেয়ারাকে, বাদল ভৌমিকের ঘরে পাঠিয়ে দিল খামখানা। আঃ, নিশ্চিন্ত। আরও একটা ওভার শেষ হল।

অফিসের বাইরে এসে অনিন্দ্য বুক ভরে শ্বাস টানল একটা। তাকে জব্দ করতে চেয়েছিল বি বি, মুখের ওপর জব্বর উত্তরটা দেওয়া গেছে। হাহ্, অনিন্দ্যকে প্যাঁচে ফেলতে চাস? এখন বোঝ কার সঙ্গে তুই লড়তে এসেছিলি!

বৈশাখের সূর্য চাঁদি ফাটাচ্ছে। চৈত্রের শেষে পর পর বেশ কয়েকদিন কালবৈশাখী এসেছিল, ঝড়বৃষ্টির পর একটু ঠান্ডা হয়েছিল প্রকৃতি। গত কয়েকদিনে আকাশ থেকে মেঘ যেন উবে গেছে, রোজই থার্মোমিটারের পারা চড়ছে ওপরে। বাতাস একটা আছে বটে, সেও ভারী শুকনো। ঘাম কম হচ্ছে, কিন্তু পুড়ে যাচ্ছে চামড়া।

সানগ্লাস চোখে ব্রিফকেস হাতে দুলে দুলে হাঁটছিল অনিন্দ্য। রোদ্দুর মাড়িয়ে। কোনও তাড়া নেই, কোনও লক্ষ্য নেই, এ ভারী সুখের সময়। থিয়েটার রোডের মুখে এসে দাঁড়াল একটু। সামনে একটা রেস্টুরেন্ট দারুন বিরিয়ানি বানায়, ঢুকে এক প্লেট খেয়ে নেবে কি?

দোকানে ঢুকে মনের সুখে বিরিয়ানি সাঁটাচ্ছে অনিন্দ্য, হঠাৎ পাশ থেকে ডাক,—আরে, অনিন্দ্য না ?

জিন্‌স-টিশার্ট পরা পাশের টেবিলের চাঁপ-পরোটা ভোক্তাকে চিনতে অনিন্দ্যর সময় লাগল দু’এক সেকেন্ড। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যচমেট। যুধাজিৎ।

কলেজে কারুর সঙ্গেই তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না অনিন্দ্যর। সে কারুর সঙ্গে মিশলে তো! পাশটাশ করার পর সহপাঠীদের এক-আধ জনের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়। যুধাজিতের সঙ্গে এই প্রথম।

যুধাজিৎ চোখ নাচিয়ে বলল,—কী খবর? কেমন আছ?

অন্যদিন হলে অনিন্দ্য এড়ানোর ভঙ্গিতে উত্তর দিত, কিন্তু আজ তার মেজাজ শরিফ। কাঁধ নাচিয়ে বলল,—ও ফাইন।…. তোমার কী খবর?

—আমি তো এখন এল্ এ-তে। আই মিন লসএঞ্জেলেস। এম-বি-এতে চান্স পেয়েছিলাম, জামশেদপুরে গিয়ে পড়লাম…..জানো তো ওখানে একটা ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউট আছে……

—জ্যাভেরিয়ান?

—ইয়া। ওখান থেকে ম্যানেজমেন্ট করে ব্যাংগালোরে জব পেয়েছিলাম। ওরা একটা প্রোজেক্টে আমায় ঘানায় পাঠিয়েছিল। সেখানেই এক মাল্টিন্যাশনাল ডেকে নিল। অ্যান্ড দেন আই ফ্লু ফর আলাবামা। তারপর এখন ওদেরই একটা কাজে মাস ছয়েক হল এল্‌-এ তে আছি।

—ও।

অনিন্দ্যর গুলিয়ে যাচ্ছিল। শিবপুর থেকে জামশেদপুর ব্যাংগালোর ঘানা আলাবামা লসএঞ্জেলেস…..মাত্র তিরিশ বছর বয়সে অনেকটা দুনিয়া তো চরে ফেলেছে যুধাজিৎ! অথচ জয়েন্টে যুধাজিতের পজিশন অনিন্দ্যর চেয়ে নীচে ছিল, অনিন্দ্যর স্পষ্ট মনে আছে। এও তো এক ধরনের চক্রান্ত! কেন যধাজিৎরাই এই সব সুযোগগুলো পায়? কেউ যাবে লসএঞ্জেলেস, আর কারুর কপালে দুর্গাপুর?

যুক্তিগুলো যে আদৌ ঠিক নয়, তার যে পরিশ্রমেই অনীহা, এই সামান্য সত্যটুকুও সুস্থ মাথায় বিশ্লেষণ করে দেখার ক্ষমতা নেই অনিন্দ্যর। একা থেকে থেকে তার মধ্যে এক ধরনের পরশ্রীকাতরতাও জন্ম নিয়েছে। কমপ্লেক্সও।

যুধাজিৎ হাসছে,—তোমায় আগে খেয়াল করিনি, তা হলে তো এক টেবিলেই বসতে পারতাম। যাব? বলেই সম্মতির অপেক্ষায় না থেকে প্লেট তুলে নিয়ে এসে বসল সামনে। হাসি চওড়া করে বলল,—পুরনো ব্যাচমেটদের দেখলে যা আনন্দ হয়! আশিস কোথায় আছে জানো?

—নাহ্‌।

—শুভঙ্কর ? …..ও তো এম-ই করছিল?

—বলতে পারব না ঠিক।

—তুমি কী করছ?

অনিন্দ্য একটা ঢোঁক গিলল। গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল,—আমিও তো এখন বাইরে।

—তাই নাকি? কোথায়?

—ইয়োকোহামা। আই মিন জাপান। এখানে একটা কন্সট্রাকশান কোম্পানিতে কাজ করছিলাম, তাদের সঙ্গে এক জাপানি মাল্টিন্যাশনালের কোলাবরেশান হল…..তার পরই আমি ওদের ওখানে…..। কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পেরে অনিন্দ্য বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করল। মাটনের শেষ টুকরোটা মুখে পুরে বলল,—তুমি কি এখন ছুটিতে?

—ওই আর কি। বোনের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে এসেছিলাম, এক ঢিলে দুটো পাখি মেরে দিচ্ছি। চোখ টিপল যুধাজিৎ,—বাবা-মা লম্বা লিস্ট করে রেখেছিল, ঝপাঝপ মেয়ে দেখে যাচ্ছি। পছন্দ হয়ে গেলে ডিসেম্বরে এসে বিয়েটা সেরে ফেলব।…..হোয়াট অ্যাবাউট ইউ? তুমি বিয়ে করেছ?

—ও শিয়োর। অনিন্দ্য যুধাজিতের ভঙ্গিতেই উত্তর দিল,—ইনফ্যাক্ট, বউকে নিয়ে যেতেই তো এবার আমার ক্যালে আসা।

—ভেরি গুড। বিদেশে কি একা একা থাকা পোয়? ইউ নিড সামওয়ান এল্‌স।

আরও খানিকক্ষণ খাজুরা চালাল যুধাজিৎ। অনর্গল প্রশ্ন হানছে অনিন্দ্যর জাপানবাস নিয়ে। কত মাইনে পায় অনিন্দ্য, কী রকম জায়গায় থাকে, গাড়ি কিনেছে কিনা, কোন মডেলের গাড়ি, কী কী অ্যাটাচমেন্ট আছে গাড়িতে, জাপানে ওয়ার্ককালচার এখন কেমন, হেন তেন। অনিন্দ্য মনের ভাবই বেশিক্ষণ গোপন রাখতে পারে না, কাঁহাতক সে গুল মারে!

যুধাজিতের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অনিন্দ্য। ক্ষণিকের জন্য মনে হল, মিথ্যেগুলো ধরা পড়ে যায়নি তো? জাপানে চাকরি করে, অথচ কলকাতার রাস্তায় ব্রিফকেস হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েও তো তোতলাচ্ছিল মাঝে মাঝে, নির্ঘাত সন্দেহ হয়েছে যুধাজিতের। ধুস্, অনিন্দ্যর তাতে বয়েই গেল। সেও তো ধরে নিতে পারে যুধাজিৎ তাপ্পি মারছিল। লসএঞ্জেলেস থাকে, এদিকে থিয়েটার রোডের একটা থার্ড গ্রেড রেস্টুরেন্টে বসে পরোটা চিবোচ্ছে, এ’ও কি বিশ্বাসযোগ্য? সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কেউ লসএঞ্জেলেসে গেছে…..গত দশ বছরে শোনেনি অনিন্দ্য! একেই কি বলে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি?

বাসস্টপে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য নিজের মনে হেসে নিল একটুক্ষণ। সময় কেটেছে খানিকটা, কিন্তু এবার সে করবেটা কী? শরণ্যা কি বাড়ি ফিরেছে এখন ? না এলেও পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে এসে যাবে নিশ্চয়ই। ততক্ষণ ঘরে কম্পিউটার খুলে বসাই যায়। অনেকদিন চ্যাট রুমে ঢোকা হয়নি, দেখতে দেখতে দু’-তিন ঘণ্টা কেটে যাবে।

ইন্টারনেটে চ্যাট করা কিছুদিন আগেও নেশার মতো ছিল অনিন্দ্যর। সে কখনও ভয়েস চ্যাট করে না, একটা বড়সড় চ্যাট রুমে অজস্র মানুষ অক্ষরের আঁচড়ে ভাব জমাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে—সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই ভারী ভাল লাগে তার। মনে হয় একটা ভিড়ে মিশে আছে একা হয়ে। তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু সে নজর রাখছে সবার ওপর। ক্বচিৎ কখনও একটা-দুটো বাক্য টাইপ করে দেয় কোথাও কোথাও, এন্‌টার মেরে উৎসুক চোখে দেখে কেউ তার কথার জবাব দিল কিনা। যদি কেউ দৃষ্টি ফেরায়, সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দ্য নীরব।

শরণ্যার জন্য আজকাল আর অনিন্দ্যর চ্যাটে বসা হয় না। শরণ্যার অপছন্দ বলে নয়, শরণ্যা খেলাটার মজা পেয়ে গেছে বলেই পিছিয়ে এসেছে অনিন্দ্য। এত সহজে শরণ্যা চ্যাট রুমে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। ইচ্ছে মতো এক-আধ জনকে ডেকে নেয় ব্যক্তিগত আলাপে, অচেনা বন্ধুর সঙ্গে অক্ষরমিতালির নেশায় মেতে ওঠে—অসহ্য লাগে অনিন্দ্যর। পাশে অনিন্দ্য থাকতে কেন শরণ্যা অন্য কারুর সঙ্গে মজে যাবে? ধুস্ শালা, তার চেয়ে বরং খেলাটাই বন্ধ থাক।

এখন শরণ্যা বাড়ি নেই। সম্ভবত। ইন্টারনেট খুলে এখন অনিন্দ্য মাঠে নেমে পড়তেই পারে। নাকি শরণ্যার অফিসে চলে যাবে? হঠাৎ গিয়ে চমকে দেবে শরণ্যাকে? বলবে, তোমাকে নিতে এলাম?

দ্বিতীয় বাসনাটাই অনিন্দ্যর বেশি মনে ধরল। একটু আগে প্রায় এ রকমই একটা কথা সে বলেছিল না যুধাজিৎকে?

শুভ্র ঘাড় গুঁজে একটা জার্নাল গিলছিল। তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মাঝে মাঝেই তার আঙুল দুটো উঠে আসছে ঠোঁটে, নীলচে ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে চেতনার ছোট্ট ঘরখানা। ঘাড় না তুলেই সিগারেটের শেষটুকু অ্যাশট্রেতে চাপল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধরিয়ে ফেলেছে পরবর্তী সিগারেট। ধূমপান ছাড়া শুভ্র পড়াশুনোয় মনঃসংযোগই করতে পারে না।

তামাকের ধোঁয়ায় কষ্ট হচ্ছিল শরণ্যার। খুকখুক কাশছে। লেখা থামিয়ে কটমট চোখে শুভ্রকে দেখল,—এটা কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।

শুভ্র যেন ঠিক শুনতে পেল না। বলল,—উঁ ? কিছু বলছিস ?

—বলছি সারা দিনে ক’প্যাকেট হল? প্যাসিভ স্মোকিংয়ে এবার আমার লাভ্‌স যে ফুটো হয়ে যাবে।

শুভ্র এক হাত জিভ কাটল,—ওহো, সরি সরি। আমি একদম খেয়াল করিনি।

—সরি বললেই বুঝি দোষ কেটে যায় ?

—নাকখত দেব? কান মুলব? যা বলবি তাই করতে রাজি।

শরণ্যার হাসি পেয়ে গেল। এ ক’দিন ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার সুবাদে বুঝে গেছে শুভ্রর ওপর সিরিয়াসলি রাগ করা কঠিন। সর্বক্ষণ ফাজলামি করে গেলেও শুভ্রর মধ্যে একটা অন্য ধরনের তন্ময়তাও আছে। পড়াশুনোর সময়ে শুভ্র যেন একদম অন্য মানুষ। কী বলছে, কী করছে কোনও হুঁশ নেই। এই যে এতবার করে সরি সরি বলছে অথচ হাতে সিগারেটটি জ্বলছেই এখনও।

শরণ্যা গলাটাকে ইচ্ছে করে ভারী করল,—শাস্তি তো পরে হবে। আগে অন্তত হাতেরটা তো নেবা।

—দেখেছ কাণ্ড! শুভ্র ফের জিভ কাটল। অ্যাশট্রে উপচে পড়ছে পোড়া টুকরোয়, চেপে চেপে হাতের সিগারেটখানা গুঁজে দিল ছাইদানে। মুচকি হেসে বলল,—আমার দু’গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারা উচিত। এতগুলো শিয়োর শট কেঁচে গেল, তাও এখনও শিক্ষা হল না!

শরণ্যা ভ্রূকুটি করল,—মানে?

—সবই তো জানিস। কেন লজ্জা দিস? কোন মেয়ে কীসে পটে সেটা পরে জানলেও চলে। আগে জানা দরকার সে কী কী ডিসলাইক করে। স্রেফ এইটুকুনি পারলাম না বলেই না আজ আমার এই দুর্গতি।

—ফের ভাট বকছিস?

—আমার কেসহিষ্ট্রিগুলো জেনেও আমার ওপর তোর করুণা হয় না? দেবলীনা চলে গেল, মধুরিমা কেটে গেল, সুদক্ষিণা উড়ে গেল, সবই তো এই সিগারেটের ধোঁয়ায়।

শরণ্যাকেও কি দেবলীনা টেবলীনাদের পঙ্‌ক্তিতে ফেলছে শুভ্র? উহুঁ, ছেলেটার মুখচ্ছবি তো তা বলে না। শুভ্র যে শরণ্যার প্রতি কোনও অশোভন ইঙ্গিত করছে না এ বুঝি হলফ করে বলা যায়

শরণ্যা চোখ পাকাল,—অ্যাই, তোর ব্যর্থপ্রেমের ডাব্বাটা বন্ধ কর তো। আর এখন থেকে ঘরে নো সিগারেট। নেশা চাপলে বাইরে চলে যাবে। সোজা রাস্তায় ।

—যো হুকুম ম্যাডাম। আই প্রমিস।

—এই নিয়ে ছ’ বার প্রমিস হল।

—আই প্রমিস টু ব্রেক দেম। চার্চিলের উক্তিটা আউড়ে দিল শুভ্র। হ্যা হ্যা করে হাসছে,—প্রতিজ্ঞা না ভাঙলে প্রতিজ্ঞার মূল্য কী বল?

একটু রঙ্গরসিকতা করেই কাজে মনোযোগী হয়েছে শুভ্র। জার্নালের যে প্রবন্ধটা পড়ছিল এতক্ষণ, সেটা প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝাচ্ছে শরণ্যাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশেষত ভারতে, লিঙ্গ পক্ষপাতের কারণ সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন চিন্তাভাবনা আছে লেখাটায়। শরণ্যা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিল। মাঝে মাঝেই একটা শারীরিক অস্বস্তি এসে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে মগজটাকে, গাগুলোনো ভাবটা ফিরে আসছে আবার।

শুভ্র কথা বলতে বলতে থেমে গেল,—তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?

শরণ্যা আড়ষ্ট ভাবে মাথা নাড়ল,—তেমন কিছু নয়। বল।

—উহুঁ, মুখচোখ তো ভাল নয়। গরমে কষ্ট হচ্ছে? ঘাড়ে মাথায় জল ছিটিয়ে আসবি?

—না না, ঠিক আছি।

—নাহ্, বিয়ে থা হয়েও তুই সাবালিকা হলি না। আমরা কি আর ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট আছি? উই আর কলিগ্‌স নাউ, একসঙ্গে একটা কাজ করছি। তোর কোনও সমস্যা হলে আমায় বলবি, আমার কোনও প্রবলেম হলে আই উইল আস্‌ক ফর এ সাজেশান ফ্রম ইউ। পরশু আমার মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি তোর কাছ থেকে স্যারিডন চেয়ে নিইনি?

—আহা, বলছি তো তেমন কিছু নয়। শরণ্যা অপ্রতিভ ভাবটা কাটাতে এদিক ওদিক তাকাল, —জলের জগটা কোথায় গেল রে?

—তেষ্টা পেয়েছে? জল খাবি? বললেই তো হয়। শুভ্র ব্যস্ত ভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে,—এক সেকেন্ড। নিয়ে আসছি। মিস্টার কামুক সেই যে কখন ঠান্ডা জল ভরে আনছি বলে নিয়ে গেল….

শরীরের অস্বাচ্ছন্দ্যটা ভুলে হেসে ফেলল শরণ্যা। ধীমানবাবুর একটা নামকরণ করেছে বটে শুভ্র। প্রথম দিন ধীমান ঘোষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময়ে পি-এস-বি বলেছিলেন, মিট ধীমান, ইনিই এখানকার সব। সেক্রেটারি কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার কাম অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাম ক্যাশিয়ার কাম লিয়াজঁ অফিসার কাম ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট….। শুভ্র কানে কানে বলেছিল, ইয়েস, হি ইজ ফুল অফ কাম। মিস্টার কামুক। বেচারা ধীমানবাবু!

চেতনার অফিস একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে। খুদে খুদে দু’খানা ঘর, মাঝারি সাইজের হল, রান্নাঘর বাথরুম ব্যালকনি মিলিয়ে জোর সাড়ে ছ’শো স্কোয়্যার ফিট। একটা ঘরে কাজ চলছে প্রোজেক্টের, অন্যটা চেতনার কর্তাব্যক্তিদের। অফিসটা হলঘরে। সেখানেই দেয়াল আলমারিতে বই আর ফাইল। মাঝে মাঝে চেয়ার ভাড়া করে এনে হলে সেমিনারও হয় চেতনার। দেশি বিদেশি অনেক জ্ঞানীগুণীজন আসেন তখন, প্রধানত আর্থসামাজিক সমস্যা নিয়েই মত বিনিময় করেন তাঁরা। ধীমানকে যে নামেই ডাকা হোক, ধীমানই চেতনার মূল সংগঠক।

রোগাসোগা নিরীহ চেহারার চশমা পরা ধীমান সারাদিন ব্যস্ত থাকে কম্পিউটার আর টেলিফোনে, তার টেবিল থেকে জলের জয় নিয়ে এল শুভ্র। সঙ্গে একটা সুসংবাদও। শুভ্র আর শরণ্যার রেমিউনারেশান বিল রেডি, কাল ফার্স্ট আওয়ারেই চেক মিলে যাবে। তবে এটা গত মাসের টাকা। প্রথমবার বলে পেতে দেরি হল, সামনের মাস থেকে প্রথম সপ্তাহেই পৌঁছে যাবে।

শরণ্যার মুখে হাসি ফুটে উঠল,—কত পাচ্ছি রে?

—তোর আঠেরো দিনের টাকা, আমার পঁচিশ দিনের। এবার ক্যালকুলেটারে ফেলে দে। …..আমার তো মনে হয়, চার-সাড়ে চার মতন হবে….না না, প্রায় পাঁচ হাজার।

শরণ্যা চোখ টিপল, —নট ব্যাড, অ্যাঁ?

—হুম। নেইমামার চেয়ে তো কানামামা ভাল। অ্যাটলিস্ট মা তো খানিকটা রিলিভড হবে।

শুভ্রর পারিবারিক অবস্থার কথা শরণ্যা এখন জানে মোটামুটি। বাবা নেই শুভ্রর। মারা গেছেন শুভ্রর এম-এ ফাইনালের ঠিক আগে আগে। ব্রেন ক্যানসার। বেশিদিন আর চাকরি ছিল না শুভ্রর বাবার, অফিস থেকে যা প্রাপ্য হত তার প্রায় সবটাই চলে গিয়েছিল তাঁর চিকিৎসায়। ভাঁড়ার শূন্য বলে ইদানীং বড় টেনশানে থাকেন শুভ্রর মা। পড়াশুনো শেষ করেও ছেলে চাকরি পাচ্ছে না, তাই নিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তা কম নয়। শুধু কয়েকটা টিউশ্যনি করত শুভ্র, তাতে আর কীই বা হয়! যাক, এতদিনে শুভ্রর কাঠবেকার দশা তো কাটল।

শরণ্যা মাথা নেড়ে বলল,—কিন্তু প্রোজেক্টের কাজ তো টেম্পোরারি রে। আজ বাদে কাল শেষ হবে। তার পর?

—দাঁড়া, সবে তো শুরু হল। এখনই শেষের চিন্তা?

—তবু কী করবি না করবি তার তো একটা প্ল্যান ছকবি।

—কী কী করব না ঠিক করে ফেলেছি। কলেজে পড়াব না, রিসার্চ করবনা…. মে বি আইল্‌ বি সিটিং ফর আই-ই-এস্….. অর্‌ এনি শর্ট অফ জব…..

কথার মাঝেই কলিংবেলের শব্দ। মুহূর্ত পরেই ধীমান চেঁচিয়ে ডাকছে,— শরণ্যা, আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন।

অবাক হল শরণ্যা। দরজায় গিয়ে আরও অবাক। অনিন্দ্য!

অনিন্দ্য উঁকি দিচ্ছে ভেতরে,—এই তোমাদের অফিস?

—হ্যাঁ। শরণ্যা মাথা নাড়ল,—তুমি হঠাৎ?

—সারপ্রাইজ দিতে এলাম।… চেয়ার টেবিল লোকজন কিছু দেখছি না তো?

—আমাদের খুব ছোট্ট ব্যাপার। অত কিছু না হলেও চলে। শরণ্যা টানল অনিন্দ্যকে, —এসো না, ভেতরে এসো।

চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে অনিন্দ্য। শরণ্যা ধীমানের সঙ্গে অনিন্দ্যর আলাপ করিয়ে দিল। তারপর নিয়ে এসেছে ছোট ঘরটায়, —এই দ্যাখো, এই হচ্ছে শুভ্র। শুভ্র দাশগুপ্ত। আমার কলিগ।

শুভ্র উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল, —আপনার পরিচয় দিতে হবে না। আপনি নিশ্চয়ই দেবাদিদেব মহাদেব? আই মিন মিস্টার শরণ্যা?

রসিকতাটা বুঝল না অনিন্দ্য। বলল, —না, আমি অনিন্দ্য মুখার্জি। শরণ্যা আমার ওয়াইফ।

—আমিও তো তাই বলছি। মহাদেব তো শরণ্যা অ্যালিয়াস মাদুর্গার হাজব্যান্ড

—ও ।

—দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন। প্লিজ।

—নো থ্যাংকস। বলেই অনিন্দ্য শরণ্যার দিকে ফিরেছে, —চলো, আজ একসঙ্গে বাড়ি ফিরব।

—এক্ষুনি? শরণ্যা অপ্রস্তুত, —দাঁড়াও তা হলে। কম্পিউটারে কয়েকটা ডাটা দিয়েছি, সেভ করে নিই।

—কতক্ষণ লাগবে?

শুভ্র পাশ থেকে বলে উঠল, —বসুন না একটু। চা-টা খান। ইউ আর আওয়ার অনারড গেস্ট।

—নো থ্যাংকস।…শরণ্যা, তুমি তাড়াতাড়ি সারো।

শরণ্যা কম্পিউটারের মাউসে আঙুল রাখল। কি-বোর্ড টিপছে, মাউস নাড়ছে, কাজ করছে দ্রুত। শুভ্র আলাপ জমানোর চেষ্টা করছে অনিন্দ্যর সঙ্গে, হুঁ হুাঁ করে দায়সারা গোছের উত্তর দিচ্ছে অনিন্দ্য। শরণ্যার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। শুভ্রর গল্প খুব একটা করেনি অনিন্দ্যর কাছে, মনে মনে অনিন্দ্য কিছু ভেবে নিচ্ছে না তো? শুভ্রই বা কী ভাবছে অনিন্দ্যকে? রামগরুড়? হুঁকোমুখো?

শুভ্র বুদ্ধিমান ছেলে। বুঝে নিয়েছে অনিন্দ্য মোটেই মিশুকে নয়। মানে মানে কেটে পড়ল ঘর থেকে। সম্ভবত সিগারেট খেতে গেল, ব্যালকনিতে।

শরণ্যাও কম্পিউটার অফ করে বেরিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। অনিন্দ্যর পাশে পাশে হাঁটছে। অনিন্দ্যকে চুপচাপ দেখে নিজেই কথা শুরু করল,—তুমি আজ অফিস থেকে এত আগে বেরিয়ে পড়েছ যে?

অনিন্দ্য টেরচা চোখে তাকাল, —তোমার কলিগটা খুব বাচাল তো?

শুভ্র তো চিরকালের ফাজিল, বলতে গিয়েও সামলে নিল শরণ্যা। আগে থেকেই সে শুভ্রকে চেনে, বলার কী দরকার!

গলায় মেকি বিরক্তির প্রলেপ মাখিয়ে শরণ্যা বলল, —হ্যাঁ, বড্ড বকে। মাথা ধরিয়ে দেয়।

—তুমি ওর সঙ্গে কাজ করো কী করে?

—পৃথিবীতে কত কিসিমেরই তো মানুষ থাকে, একটু মানিয়ে গুনিয়ে নিতে হয় আর কি।

জবাবটায় অনিন্দ্য বেজায় খুশি।বলল, —একটা ট্যাক্সি ধরি?

—তা হলে তো ভালই হয়। আমার শরীরটা আজ ঠিক নেই।

—কেন?

—বলছি না ক’দিন ধরে, বমি বমি লাগছে, মাথা ঘুরছে…

অনিন্দ্য ভাল করে শুনলই না। পাশ দিয়ে একটা হলুদকালো যাচ্ছিল, দৌড়ে গিয়ে পাকড়েছে ড্রাইভারকে। ডাকল, —অ্যাই, চলে এসো।

ট্যাক্সিতে বসে ঘাড় পিছনে এলিয়ে দিল শরণ্যা। চোখ বুজেছে। বেশ কিছুদিন ধরে যে আলোড়নটা উঠছে শরীরে, তার কারণ এখন শরণ্যার কাছে মোটামুটি পরিষ্কার। মাসের দু’ তারিখে পিরিয়ড হওয়ার কথা ছিল, চব্বিশ তারিখ হয়ে গেল…। নির্ঘাত আসছে কেউ। আসছে। ভাবতে কেমন লাগছে। শরণ্যার? সে কি চিন্তিত? উদ্‌বিগ্ন ? নাকি আহ্লাদিত? মা হওয়ার অনুভূতি এখনও সে ভাবে জাগেনি ভেতরে; শুধু একটা অস্বস্তি…। এমনটাই কি হয় প্রথম প্রথম? তারপর ধীরে ধীরে গোটা বুকে ছেয়ে যায় সেই অচেনা প্রাণ? খবরটা বাবা-মাকেও জানানো হয়নি। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করে। এমনটাও কি হয়?

জ্যামে ঠোক্কর খেতে খেতে এগোচ্ছে ট্যাক্সি। ত্রিকোণ পার্কের কাছে এসে একদম দাঁড়িয়ে গেল। নট নড়ন চড়ন। সামনে বাস মিনিবাস ট্যাক্সি প্রাইভেটকারে জট পাকিয়ে গেছে, ফাঁক দিয়ে ইঁদুরের মতো গলে গলে যাচ্ছে অটো আর দ্বিচক্রযান।

অনিন্দ্য বিরস মুখে বলল, —ধুস্‌, এইটুকু পথ হাঁটলেই হত।

শরণ্যা সাড়া দিল না।

অনিন্দ্য ঠেলল, —অ্যাই, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

শরণ্যা চোখ খুলল, —না তো।

—তোমায় একটা খবর দেওয়ার ছিল। আজ চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।

শরণ্যা ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হল, —যাহ!

—ইয়েস। পোষাচ্ছিল না। দোজ বাগারস ভেবে নিয়েছিল অনিন্দ্য মুখার্জি ওদের কেনা গোলাম, দিয়েছি আজ মুখের উপর রেজিগনেশান ছুড়ে।

শরণ্যা হাঁ। খানিক পরে কথা ফুটল, —এখন কী হবে?

—কী আবার হবে? অন্য একটা চাকরি খুঁজব।

—কিন্তু…

—অত ভাবছ কেন? আরে বাবা, আমি তো টাকা ওড়াই না, ব্যাংকে আছে কিছু। অনিন্দ্য আলগা ভাবে হাত চড়িয়ে দিল শরণার কাঁধে। গদগদ মুখে বলল, —তা ছাড়া আমার বউয়ের তো এখন একটা ইন্‌কাম আছে, না কি?

অনিন্দ্যর এমন মনোভাবে শরণ্যার তো গর্বিত হওয়া উচিত। ক’টা বর হুট করে বেকার হয়ে গিয়েও বউয়ের রোজগার আছে বলে এমন প্রফুল্ল থাকতে পারে? এতটুকু কমপ্লেক্স আসছে না অনিন্দ্যর, এটা নিশ্চয়ই একটা বড় গুণ। আর শরণ্যা তো এখন অনিন্দ্যর গুণগুলোকেই খুঁজছে।

তবু মনটা খচখচ করছে। সামান্য ইতস্তত করে শরণ্যা বলেই ফেলল, —কিন্তু আমার টাকা তো এখন একটু আনসার্টেন হয়ে যাবে।

—কেন?

—রেগুলার কি যেতে পারব বেশিদিন? চেতনা হয়তো তখন…

—কেন যেতে পারবে না?

—আহা, বুঝছ না? শরণ্যা মুখ টিপে হাসল,—বললাম যে গা গুলোচ্ছে, মুখে রুচি নেই, মাথা ঘুরছে…

—তো?

—সত্যিই তুমি বুঝতে পারছ না? মেয়েদের কখন এসব হয় জানো না?

—কখন হয়?

—ওরে আমার বোকারাম হাঁদারাম…। শরণ্যা খিলখিল হেসে উঠল। ট্যাক্সিড্রাইভারের কান বাঁচিয়ে ফিসফিস করে বলল, —আমি প্রেগ্‌ন্যান্ট, বুঝেছেন স্যার? তুমি বাবা হতে চলেছ।

অনিন্দ্য যেন মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পরক্ষণে তার মুখ থেকে যেন রক্ত শুষে নিয়েছে কেউ।

শরণ্যা বিস্মিত মুখে বলল, —কী হল? তুমি খুশি হওনি?

অনিন্দ্য বিড়বিড় করে বলল, —কী করে হল?

—নেকু। জানো না কী ভাবে হয়?

—তুমি প্রিকশান নাওনি?

—নেওয়া হয়নি। একদিক থেকে তো ভালই হয়েছে। মা বলে, কম বয়েসেই এসব ঝামেলা ঝঞ্ঝাট চুকে যাওয়া ভাল।

অনিন্দ্য গুম হয়ে গেল। সারাটা পথ টুঁ শব্দটি নেই। বাড়ি এসেও মুখ কালো করে শুয়ে আছে বিছানায়। শরণ্যার শত ডাকাডাকিতেও উঠে চা জলখাবার ছুঁল না। রাতের খাবারও না।

অনিন্দ্যর অদ্ভুত আচরণের মাথামুন্ডু খুঁজে পাচ্ছিল না শরণ্যা। চাকরি ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সন্তান-আগমনের সংবাদ পেয়ে অনিন্দ্য কি খুব বেশি বিচলিত হয়ে পড়ল? হয়তো ভাবছে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো চাকরি ছাড়াটা তার মূর্খামি হয়ে গেছে! নাকি অনিন্দ্য এখন বাচ্চা চায় না ? এখন চায় না, নাকি কোনও দিনই চায় না? বাবা-মার ছেঁড়া ছেঁড়া সম্পর্কের মাঝে পড়ে ছোটবেলাটা বড় যন্ত্রণায় কেটেছে অনিন্দ্যর। এ কি তারই কোনও বিকৃত প্রতিক্রিয়া? হতেই পারে। অনিন্দ্যদের বাড়ির সবাইই তো একটু অদ্ভুত ধরনের।

শরণ্যা আর বেশি খোঁচাখুঁচি করল না। নিজের কাজ নিয়ে বসল কিছুক্ষণ, তারপর শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। ক্লান্ত লাগছিল।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। রাতবাতির মৃদু আলোয় শরণ্যা দেখল অনিন্দ্য পায়চারি করছে ঘরে। মাঝে মাঝে এসে বসছে খাটে, উঠছে, আবার হাঁটছে।

শরণ্যার চোখ বড় বড়, —একী? তুমি শোওনি?

শরণ্যার গলা পেয়ে ঝট করে ঘুরেছে অনিন্দ্য। দু’-এক সেকেন্ড। হঠাৎই ঝাঁপিয়ে এসেছে বিছানায়। শরণ্যার মুখের ওপর ঝুঁকে বলল,—শোনো, অ্যারবশন করে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দাও।

—যাহ্। শরণ্যা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, —কেন করব অমন কাজ? আমাদের প্রথম বাচ্চা…! অসম্ভব। তা হয় না।

—কেন হয় না? কেন হয় না? অনিন্দ্যর মুখচোখ হিংস্র সহসা। ক্রুর গলায় বলল, —আমাদের মাঝখানে আর কেউ আসবে না। কেউ না।

.

০৮.

সরকারি দপ্তরটিতে আজ সাজো সাজো রব। দেশীয় এক কম্পিউটার কোম্পানি থেকে জনা তিনেক ঝকঝকে তরুণ এসেছে, যন্ত্রগণক বসাচ্ছে ডিরেক্টর-ডেপুটি ডিরেক্টরদের ঘরে। অত্যুৎসাহী কর্মচারীরা উঁকিঝুঁকি মেরে আসছে ঘন ঘন, বেসরকারি কর্মকাণ্ড দেখতে সরকারি কাজ আজ শিকেয়। উচ্চৈস্বরে আলাপচারিতা চলছে গোটা দপ্তরে। সর্বত্র একটিই আলোচ্য বিষয়— কম্পিউটার। যাক, অ্যাদ্দিনে তবে ঘুম ভাঙছে সরকারের! সরকারি অফিস আধুনিক হচ্ছে!

নিবেদিতা রীতিমতো অধৈর্য বোধ করছিলেন। বিশ মিনিটের ওপর ঠায় বসে আছেন, বড়বাবুর টিকিটি নেই। সেই যে তিনি আসছি বলে সেঁধিয়ে গেলেন ডেপুটি ডিরেক্টরের ঘরে…! কতক্ষণ আর তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করবেন নিবেদিতা?

এমনিতেই নিবেদিতার মনটা আজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পরশু থেকে বাড়ি ফিরছে না সুনন্দ। পর পর দু’ রাত। এমন নয় যে সুনন্দ অতি সুবোধ বালক, প্রতিদিন সে নির্দিষ্ট সময়ে গৃহ হইতে নির্গত হয় এবং যথাসময়ে প্রত্যাগমন করে। সে তো মাঝে মাঝেই ফেরে না। হয় কোনও বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটায়, নয় ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে যায় কলকাতার বাইরে। ক’দিন আগেই তো গানের দল নিয়ে শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ঘুরে এল। তবে সর্বদাই যাওয়ার আগে একটা অন্তত খবর ছুঁইয়ে যায়। এবার যাওয়াটা অন্য রকম। মেজাজ দেখিয়ে বাবু এবার বিলকুল হাওয়া। পরশুর আগের দিন হুট করে দশ হাজার টাকা চেয়ে বসল নিবেদিতার কাছে। ভীষণ দরকার। দিতেই হবে। আশ্চর্য, অত টাকা কোত্থেকে দেবেন নিবেদিতা? দেবেনই বা কেন? পঁচিশ বছরের ধাড়ি ছেলে, এখনও বাপ-মার হোটেলে বসে খাচ্ছিস আর প্রাণের সুখে খঞ্জনী বাজিয়ে বেড়াচ্ছিস…! অপ্রিয় সত্যি শুনে উলটো আক্রমণ, তুমি কার পয়সায় ড্রেস মেরে বেড়াও? ক’টা পয়সা রোজগার করেছ জীবনে? উফ্ কী সব মুখের ভাষা! কোত্থেকে যে নিবেদিতার ছেলেরা এত খারাপ করে কথা বলতে শিখল? কেন জন্মেছিলি তোরা? কেন আঁতুড়েই মরে যাসনি? ।

চিন্তায় ছেদ পড়ল। বড়বাবু ফিরেছেন। এক খালি-গা কিশোর কেটলি হাতে টেবিলে টেবিলে চা দিচ্ছে, হয়তো বা তার টানেই। চেয়ারে বসে কাপে চুমুক দিয়ে অপ্রসন্ন গলায় বললেন, —এখনও বসে আছেন ?

নিবেদিতার গলাতেও বিরক্তি ফুটল, —আপনিই তো বলে গেলেন ওয়েট করতে।

—কিন্তু আজ তো কোনও কাজ হবে না।

—কেন?

—দেখছেন না, সবাই কেমন বিজি? কম্পিউটার বসছে।

কম্পিউটার বসার সঙ্গে কাজ বন্ধ হওয়ার কী সম্পর্ক মাথায় ঢুকল না নিবেদিতার। তবে ফস করে কোনও মন্তব্যও করলেন না। বড়বাবু লোকটিকে দরকারে অদরকারে কাজে লাগে। তিনি চটে গেলে সুহাসিনী অসুবিধেয় পড়তে পারে। কোথায় পুট করে কী নোট দিয়ে দেবেন, সুহাসিনীর টাকাটাই হয়তো আটকে গেল। আগের ডিরেক্টরের কাছে সোজাসুজি গিয়ে কথা বলতেন নিবেদিতা, বর্তমান যিনি আছেন তিনি বিশেষ আমল দিতে চান না, এই বড়বাবুর কাছেই ঠেলে দেন।

কোষ্ঠকাঠিন্যের রুগির মতো মুখঅলা বছর পঞ্চান্নর বড়বাবুকে আলগা জরিপ করে নিলেন নিবেদিতা। নরম গলাতেই বললেন, —আমার ছোট্ট কাজ। রুটিন জব। অ্যানুয়াল গ্রান্টের অ্যাপ্লিকেশান আর এস্টিমেটটা খালি জমা করব।

—অ। তা দিয়ে দিন রিসিভিংয়ে।

—কিন্তু আপনার সঙ্গেও যে একটু কথা ছিল।

—বলুন। চটপট।

—লাস্ট ইয়ার আমাদের গ্রান্ট একটু কম স্যাংশান হয়েছে…মানে তার আগের বছরের থেকে হাজার পঁচিশেক বাড়াতে বলেছিলাম…ডিরেক্টর সাহেব আমায় কথাও দিয়েছিলেন হয়ে যাবে, কিন্তু…

—আমরা আর পেরে উঠছি না, বুঝলেন। চারদিকে এখন শুধু সমাজসেবার হিড়িক, ব্যাঙের ছাতার মতো অরগ্যানাইজেশান গজিয়ে উঠছে। সকলেরই বিরাট বিরাট বুলি, হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা…। কত দেব, অ্যাঁ?।

বড়বাবুর কথার ভঙ্গিটি যথেষ্ট অমার্জিত। মনে হয় যেন নিজের মাসমাইনে থেকে পুজোর চাঁদা দিচ্ছেন! নিবেদিতা তবু রাগলেন না। ঠান্ডা মাথাতেই বললেন, —আমাদের অরগ্যানাইজেশান তো ভুঁইফোড় নয়। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে চলছে। তা ছাড়া লাস্ট ইয়ার যিনি ইন্সপেকশানে গেছিলেন, তিনি কিন্তু টাকা বাড়ানোর ফেভারেই নোট দিয়েছিলেন।

—নোট দিলেই তো হবে না, আমাদের অনেক হিসেবপত্র করে চলতে হয়। আপনাদের নাম কুড়োনোর দৌলতে আমাদের যে দেউলিয়া হওয়ার দশা। বড়বাবুর মুখে বাঁকা হাসি, —আপনারা আর একটা কী যেন শুরু করতে চলেছেন না?

—হ্যাঁ। বৃদ্ধাশ্রম।

—তার জন্যও তো গ্রান্টের অ্যাপ্লিকেশান করেছেন?

—হুঁ।

—প্রাইভেট ডোনেশানের ওপরই বেশি নজর দিন, বুঝলেন। আমাদের ওপর আর বেশি ভরসা করবেন না।

—আমরা যত দূর সম্ভব তাই করি। বৃদ্ধাশ্রমের জমি আমরা ডোনেশানের টাকাতেই কিনেছি। বাড়ি করার খরচ তত হিউজ, তাই গভর্নমেন্টের কাছে পারশিয়াল হেলপ চেয়েছি একটা। তাও এক্ষুনি নয়। প্ল্যান স্যাংশান হওয়ার পর আমরা নিজেরাই কাজ শুরু করব। আমাদের অগ্রগতি দেখে গভর্নমেন্ট যেটুকু দেওয়া উচিত মনে করবে আমরা সেটুকুতেই কাজ চালিয়ে নেব। সরকারকে ফতুর করা সুহাসিনীর মটো নয়।

শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে উচ্চারিত নিবেদিতার কথাগুলো এতক্ষণে যেন থমকে দিয়েছে বড়বাবুকে। ঈষৎ অপ্রস্তুত গলায় ভদ্রলোক বললেন, —না না, আপনারা তো ভাল কাজই করেন। তবে বোঝেনই তো, ফিনান্স এখন খুব ঝামেলা করছে। দু’ পয়সার জন্য দু’ হাজার ফ্যাকড়া তোলে।

—আমি জানি। তবে আপনারা যদি স্পেশালি আমাদের কেসটা রেকমেন্ড করেন, সুহাসিনীর একটু সুবিধে হয়। নিবেদিতার স্বর আরও ঋজু হল, —ব্যাপারটা কী জানেন? একটা ওয়েলফেয়ার স্টেটে রাষ্ট্রের যে কাজগুলো করা উচিত, আমরা সেই কাজগুলোই করি। আর সেই জন্যই আমরা মনে করি আমাদের জন্য অর্থ ঢালাটা রাষ্ট্রের অপচয় নয়।

বড়বাবু কথাটা যেন ঠিক বুঝলেন না। কিংবা হয়তো বোঝার তাগিদ অনুভব করলেন না। বুঝি বা ভাবলেন মহিলা গায়ে পড়ে তাঁকে কথা শোনাচ্ছেন, জ্ঞান দিচ্ছেন অনর্থক।

নিবেদিতার বাড়িয়ে দেওয়া কাগজগুলো পচা ইঁদুর ধরার ভঙ্গিতে হাতে নিলেন বড়বাবু। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, —ঠিক আছে, শুনলাম তো সব। দেখি কী করতে পারি।

—আমি কি সামনের মাসে এসে জেনে যাব?

—আসতে পারেন। তবে অ্যালটমেন্ট পেতে পেতে জুলাই। বড়বাবু চোখ সরু করলেন, —এবার যেন কত বাড়াতে বলেছেন?

—ওই পঁচিশ হাজারই৷ মানে যেটা পাইনি…

—ইউটিলাইজেশান সার্টিফিকেট দেওয়া আছে ?

—সব আছে। ওই তো অ্যাপ্লিকেশানটা তুলুন, ওর ঠিক নীচেই…

—দেখে নেব’খন। ধরে করে ইন্সপেকশানটা আগে করিয়ে নিন। ওই রিপোর্টটাও লাগবে।

নিবেদিতার মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। কী বাদশাহি চালের কথাবার্তা! সরকারি পরিদর্শন তো রুটিন কাজ, তার জন্য নিবেদিতার ধরা করা করতে হবে কেন? অথচ করতে হয়, এটাই দস্তুর। দয়া করে তিনি পদধূলি দেবেন, খোশগল্প করে পছন্দ মতো বড়িটা আচারটা নিয়ে চলে যাবেন, ধন্য হবে সুহাসিনী! সরকারি প্রতিনিধির তো মাসে অন্তত একটা মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার কথা, সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে নিয়ম করে চিঠিও পাঠানো হয়, কিন্তু ঠিকঠাক তাঁর দর্শন মেলে কি? সারা বছরে একবারই তিনি আবির্ভূত হন। সেই বার্ষিক সাধারণ সভায়। এমন সব সরকারি কর্মচারীদের ওপর নির্ভর করে তবেই না নিবেদিতাদের সমাজসেবার ব্রত উদ্‌যাপন! দপ্তরের এক নগণ্য কর্মচারীও বুঝিয়ে দেয় নিবেদিতা তার দয়ার পাত্র। ভাল লাগে ?

ধীর পায়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন নিবেদিতা। লিফ্‌ট খারাপ, নামতে হল সিঁড়ি বেয়ে। বড্ড গরম আজ, এইটুকুতেই নিবেদিতা ঘেমে নেয়ে একসা। গাড়িতে বসেও রেহাই নেই, সিটটিট আগুন হয়ে আছে তাপে। জৈষ্ঠ্যের সূর্য নিষ্ঠুর তেজে ঝলসাচ্ছে শহরটাকে। খোলা জানলা দিয়ে ঝাপটা আসছে লু।

নিবেদিতার তেষ্টা পাচ্ছিল। অন্যমনস্ক হাত ঘোরাফেরা করল সিটে। ইস, ভুল হয়ে গেছে, জলের বোতলটা আজ নেওয়া হয়নি। সুরেনের কাছে নিশ্চয়ই জল আছে। চাইবেন? ড্রাইভারের জল খেতে নিবেদিতার কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু সুরেন অস্বস্তিতে পড়ে যাবে না তো?

সামান্য ইতস্তত করে চেয়েই ফেললেন, —তোমার জলের বোতলটা একটু দাও তো।

গরমে সুরেনও বেশ কাহিল। শার্টের কলার ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে পিঠের ওপর, বাঁ হাতের তোয়ালে-রুমালে ঘন ঘন মুখ মুছছে। স্টিয়ারিং থেকে অল্প ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, —আমার জল কি খেতে পারবেন? হেববি গরম হয়ে আছে।

—দাও একটু। গলা ভিজিয়ে নিই। সুহাসিনীতে গিয়ে নয় একটা বোতল কিনে নেব ঠান্ডা জলের। এখন পথে আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না।

লাল শালুতে মোড়া নিজের বোতলখানা সন্তর্পণে বাড়িয়ে দিল সুরেন৷ দু’ ঢোক খেয়ে বোতলটা পাশেই রাখলেন নিবেদিতা। ফস করে প্রশ্ন করলেন, —তোমাদের পাড়ায় সুনন্দর এক বন্ধু থাকে না? ঝাঁকড়া চুল? ফরসা মতন?

সুরেনের চোখ পলকে রেয়ারভিউ মিররে। বুঝি বা পড়ে নিতে চাইল প্রশ্নটাকে। আয়নায় চোখ রেখেই বলল, —ছোড়দা ওখানে যায়নি মাসিমা।

—কী করে জানলে?

—কাল সন্ধেবেলা ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বললাম ছোড়দা বাড়ি ফেরেনি, শুনে কাঁধ উলটে চলে গেল।

কী সব বন্ধুবান্ধব! বন্ধু বাড়ি ফেরেনি জেনেও ভ্রূক্ষেপ নেই? নাকি এটাই এখনকার ধারা ? যে যার তালে ঘোরে, সঙ্গে থাকার সময়টুকু ছাড়া কেউ কারওর খোঁজ রাখে না!

বেজার মুখে নিবেদিতা বললেন, —ছোড়দার আর কোনও বন্ধুটন্ধুকে চেনো?

—পথেঘাটে অনেককেই তো দেখি ছোড়দার সঙ্গে। কিন্তু তাদের বাড়িটাড়ি তো…

—হুম।

নিবেদিতা আর কিছু প্রশ্ন করলেন না। ক্ষণিকের জন্য মনে হল মা হিসেবে সুনন্দর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর আর একটু বেশি অবহিত থাকা উচিত ছিল। হয়তো তিনি বৃথাই দুশ্চিন্তা করছেন, সুনন্দ হয়তো গানের দলের সঙ্গে কোথাও প্রোগ্রাম করতে গেছে। মাকে জব্দ করার জন্যই বলে যায়নি। সুনন্দটা বরাবরই খামখেয়ালি। রগচটা। তার পক্ষে সবই সম্ভব।

পুরনো স্মৃতি আবছা দোলা দিয়ে গেল নিবেদিতাকে। স্কুল থেকে মাঝে মাঝেই রাত করে বাড়ি ফিরত সুনন্দ। নির্মলার বাড়ি চলে যেত ছেলে। নির্মলা, মানে সুনন্দর ছোটবেলার আয়া। সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত সুনন্দর দেখাশুনোর ভার ছিল ওই নির্মলার হাতেই। ক্লাস এইট-নাইনে পড়ার সময়েও নির্মলার বাড়ি গিয়ে নাকি সটান শুয়ে পড়ত ছেলে, আর উঠতেই চাইত না। নির্মলাই এসে গল্প করেছে। একদিন সুনন্দ হুল ফোটানোর মতো করে শুনিয়েও দিয়েছিল, নির্মলাকে তার নাকি অনেক বেশি মা মা মনে হয়।

একটা তপ্ত শ্বাস পড়ল নিবেদিতার। বাইরের উষ্ণতর বাতাসে মিশে গেল নিঃশ্বাসটা। তাঁর ছেলেরা বুঝল না আর পাঁচটা নেটিপেটি সংসার করা মহিলাদের সঙ্গে তাদের মাকে এক করে দেখা ঠিক নয়। নিবেদিতা আলাদা। ঘরগেরস্থালি ছেলেপুলে মানুষ করার বাইরেও এই বিশাল পৃথিবীতে মানুষের আরও অনেক কাজ থাকে। অনেক বড় কাজ। নিবেদিতা সেই বৃহত্তর কাজে উৎসর্গ করেছেন নিজেকে। তিনি খেলেও বেড়াচ্ছেন না, ফুর্তিও করছেন না। মানুষের কথাই ভাবছেন, মানুষের জন্য কাজ করছেন। দৈনন্দিন সংসারের তুচ্ছতায় ডুবে যাননি বলে কেন তাঁর ওপর অভিমান করবে তাঁর আপনজনেরা? তাও তো নয় নয় করে সংসারের অনেক চিন্তাই তিনি করেছেন। সুনন্দকেই তো বার বার তিনি চার্টার্ড পড়ার জন্য বলেছিলেন, সে যদি বিদঘুটে গানের জগতে ঢুকে সুখ পায় নিবেদিতা কী করবেন? ধুস্, যে চুলোয় গেছে যাক। নিবেদিতা আর ভাবতে পারছেন না। কোথাও কি এতটুকু শান্তি নেই? এক এক ছেলে এক এক চিজ। অনিন্দ্যর বিয়ে দিয়ে ভাবলেন এবার হয়তো ছেলের মাথা ঠান্ডা হবে, শান্ত ভাবে ঘরসংসার করবে। কোথায় কী? চাকরিবাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি এখন শুয়ে শুয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছেন! কী মিষ্টি একটা বউ এল ঘরে। কথায় কথায় চোটপাট করে তার ওপর! মেয়েটার বাচ্চাকাচ্চা হবে, কোথায় তার একটু যত্নআত্তি করবি, দরকার হলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি, কোনও দায়িত্ব নেওয়ারই দায় নেই! ছেলে যেন বাপেরও এক কাঠি বাড়া। আর্যও এত নিষ্ঠুর ছিল না, বাচ্চা হওয়ার আগে নিবেদিতার খেয়ালটুকু অন্তত রাখত। বেচারা শরণ্যা সারাক্ষণ এখন মুখ শুকনো করে ঘুরছে। মাকে ছেড়ে কেন যে এখন বউয়ের ওপর মেজাজ করা শুরু হল অনিন্দ্যর? চাকরি নেই বলে ?

শরণ্যার মুখ মনে পড়তেই নিবেদিতার হৃদয়টা দ্রব হয়ে এল। বাড়িতে একমাত্র শরণ্যাই যা সম্মান করে নিবেদিতাকে, চেষ্টা করে বোঝার। মেয়েটার মনটাও ভাল। প্রোজেক্টের কাজে কী-ই বা আহামরি পায়, অথচ প্রথম মাসের টাকা থেকে বাড়ির সকলের জন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে এসেছিল। শাশুড়ির জন্য তাঁত কলাক্ষেত্ৰম, শ্বশুরের জন্য পাঞ্জাবি…। মধ্যবিত্ত মনোভাব, তবু বেশ লেগেছিল নিবেদিতার। এ মাসে তো আর এক কাণ্ড, জোর করে দু’ হাজার টাকা গুঁজে দিল নিবেদিতার হাতে, নরম করে বলল, আপনার ছেলের তো এখন কাজকর্ম নেই মামণি, ধরুন আমি ওর হয়েই এই টাকাটা…। বেচারা জানেও না তার স্বামীটি কস্মিনকালে সংসারে ফুটো পয়সাটি ঠেকায় না। কিংবা হয়তো জেনেও না জানার ভান করে টাকা দিল যাতে পরিবারে তার বেকার বরের সম্মানটা থাকে। রোজগার থাকলে টাকা না দিয়েও হাতের গুলি ফোলানো যায়, কিন্তু চাকরিবাকরি না থাকলে সেটা তো হয় না। শরণ্যা নিশ্চয়ই এই সত্যিটা বোঝে। মেয়েটার এই আত্মমর্যাদাবোধ যদি নিবেদিতার একটা ছেলের মধ্যেও থাকত।

গলাটা আবার শুকিয়ে গেছে। বোতলের ছিপি খুলে ফের একটু কণ্ঠনালী ভেজালেন নিবেদিতা। সুহাসিনীর গেটে পৌঁছোনো পর্যন্ত চোখ বুজে হেলান দিয়ে রইলেন সিটে। নেমে অফিসঘরে ঢোকার আগে থমকালেন সামান্য। ভেতরে দময়ন্তীর গলা পাওয়া যাচ্ছে না?

একা দময়ন্তী নয়, আরও কয়েকজন এসেছে আজ। অর্চনার টেবিল ঘিরে রীতিমতো চাঁদের হাট। দময়ন্তীই একা বকে যাচ্ছে, বাকিরা সবাই মুগ্ধ শ্রোতা।

নিবেদিতাকে দেখেই দময়ন্তী বলে উঠল, —এসে গেছেন নিবেদিতাদি? আপনার জন্য আমরা কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি।

রুমালে ঘাড় গলা মুছতে মুছতে অর্চনার পাশের চেয়ারটিতে বসলেন নিবেদিতা, —কেন, আমায় কী দরকার পড়ল?

—বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আমি একটা প্রস্তাব রাখছিলাম। রিগার্ডিং ফান্ড তোলা।

—কী প্রস্তাব?

—লোকের দরজায় দরজায় আর কত হাত পাতব?

—হাত পাতাই তো আমাদের কাজ ভাই। নিবেদিতা মৃদু হাসলেন, —আমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে।

—এটা ওল্ড কনসেপ্ট নিবেদিতাদি। সমাজসেবার কাজটাও আজকাল প্রফেশনালি করতে হয়। আই মিন, কাউকে বেশি বিরক্ত না করে…বোঝেনই তো যারা টাকা দেয়, সবাই তো আর উচ্ছ্বসিত হয়ে দেয় না… ধরুন যদি একটা গ্যালা এন্টারটেনমেন্ট প্রোগ্রাম করা যায়… লোকেও এনজয় করল, এক লপ্তে সুহাসিনীর ফান্ডেও মোটা টাকা এসে গেল!

দীপালি বলে উঠল, —দময়ন্তীর আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয় নিবেদিতাদি। বহু প্রতিষ্ঠানই তো আজকাল ফাংশান করে টাকা রেজ করছে।

নিবেদিতার ভুরুতে ভাঁজ পড়ল, —খুব লাভ হবে কি? ফাংশান তো আমরা করেছি কয়েকবার। নতুন বিল্ডিং তোলার আগে রবীন্দ্রসদনে গানের প্রোগ্রাম করলাম না? সুচিত্রা মিত্র এলেন, সুবিনয় রায় এলেন… আলটিমেটলি কত টাকা লাভ হল, বলো? দু’মাস ধরে টিকিট বিক্রি করলাম, খরচখরচা বাদ দিয়ে হাতে এল সাকুল্যে হাজার আঠেরো-উনিশ। ওই টাকায় তো বৃদ্ধাশ্রমের ভিতও হবে না।

—আমরা ও রকম ছোটখাটো ফাংশানের কথা ভাবছি না নিবেদিতাদি। বড় করে কিছু করার কথা বলছি।

—কী রকম?

—যদি মুম্বাই থেকে আর্টিস্ট এনে প্রোগ্রাম করি? বড় কোনও জায়গায়? যেমন ধরুন নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে?

—হিন্দি নাচগান? নিবেদিতা নাক কুঁচকোলেন, —বৃদ্ধাশ্রমের জন্যে?

—দোষের কী আছে? নাচ গান ইজ নাচ গান, তার আবার হিন্দি বাংলা কী? দময়ন্তী নড়েচড়ে বসল। এই গরমেও সিলকের শাড়ি পরেছে দময়ন্তী। বয়স তার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, দেখে অবশ্য আরও কম মনে হয়। মোমে মাজা মসৃণ ত্বক, তীক্ষ্ণ নাক, টানা টানা চোখ, তুলিতে আঁকা ভুরু— রূপসি দময়ন্তী ভিড়ের মাঝেও আলাদা করে চোখ টানে। নিজের রূপ সম্পর্কে সে যথেষ্ট সচেতনও। মরালীর মতো গ্রীবা হেলিয়ে দময়ন্তী বলল, —বাঙালি উন্নাসিকতাগুলো ছাড়ুন নিবেদিতাদি। মহৎ উদ্দেশ্যে যে কোনও ধরণের অনুষ্ঠানই আমরা করতে পারি।

দময়ন্তীর বাগভঙ্গিটা পছন্দ হল না নিবেদিতার। মতটাও মানতে পারলেন না পুরোপুরি। ক্যানসার হসপিটালের সাহায্যার্থে ক্যাবারে নাচ কি বিধেয় ? মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে কী রুচিবোধের কোনও সম্পর্কই নেই?

অর্চনা ফস করে মন্তব্য করলেন, —ফাংশনে সব রকমের গানই থাকতে পারে। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, হিন্দি গান… সব ধরনের দর্শকই এনজয় করবে।

দময়ন্তী বলল, —মুম্বাই আর্টিস্ট বলতে বাঙালি শিল্পীই থাকবে। কুমার রবীন, পল্লবী সেন…

সুপ্রিয়া বললেন, —কুমার রবীন তো নজরুলগীতিও ভাল গায়।

অর্চনা বললেন, —কুমার রবীনের তো দারুণ ক্রেজ এখন! তার তো রেটও অনেক।

—বললাম যে ওগুলো কোনও ফ্যাক্টরই নয়। দময়ন্তী গর্বিত মোরগের মতো নিবেদিতাকে দেখল এক ঝলক, —এগজিকিউটিভ কমিটি শুধু ব্যাপারটা অ্যাপ্রুভ করে আমার ওপর ছেড়ে দিক, কুমার রবীনকে আনার দায়িত্ব আমার। এই তো মাস তিনেক আগে আমার কর্তা কুমার রবীনের বাবার গল ব্লাডার অপারেশান করেছে। আপনারা কুমার রবীনের ফ্যান, আর কুমার রবীন আমার বরের ফ্যান। কলকাতায় এলে ফোন করবেই। ও একবার মুখ ফুটে বললে কুমার রবীন শত ব্যস্ততার মাঝেও এসে প্রোগ্রাম করে যাবে। আর সে এলে পল্লবী সেন তো কোনও ব্যাপারই নয়।

দীপালি বলল, —তা হলে তো আমাদের এখন থেকেই নেতাজি ইনডোরের জন্য চেষ্টা চালাতে হয়। নিশ্চয়ই শীতকালে হচ্ছে ফাংশানটা?

—হ্যাঁ, ডিসেম্বর জানুয়ারিই বেস্ট টাইম। ক্রাউড পাওয়া যায়। ওই সময়ে বৃদ্ধাশ্রমের কাজও শুরু হবে, হাতে টাকাও…

—টিকিট কত করে করা যায়?

—মিনিমাম একশো। অবশ্য অল্প কিছু পঞ্চাশ রাখলেও ভাল হয়।

সকলেই উৎসাহী মতামত দিয়ে চলেছে। নিবেদিতার মনে হল তিনি যেন ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছেন, তাঁর উপস্থিতি কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না। যেন সবকিছুই স্থির হয়ে গেছে, তাঁর মতামত এখন নেহাতই মূল্যহীন। বৃদ্ধাশ্রমের জমির জন্য শেষের দিকে প্রায় লাখ দেড়েক টাকা কম পড়েছিল, ধূর্জটি পাইন টাকাটা দিয়ে দিয়েছিল, তাই কি ধরাকে সরা জ্ঞান করার অধিকার জন্মে গেছে দময়ন্তীর?

নিবেদিতা আর নীরব থাকতে পারলেন না। স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন, —থামো, থামো। সুহাসিনীতে একটা কন্সটিটিউশান আছে। এখানে কাজকর্মের একটা ধারা আছে। এমন একটা করার আগে সমস্ত সদস্যের মতামত নেওয়া উচিত।

—আপনি কি অ্যানুয়াল জেনারেল মিটিংয়ের কথা বলছেন? ওখানে পাশ হয়ে যাবে।

—আগে হোক। তারপর নয় আলোচনা কোরো।

সবাই চুপ। ঘর অস্বাভাবিক রকমের থমথমে। কেউই যেন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ পছন্দ করছে না। হঠাৎ স্বাগতা বলে উঠলেন, —নিবেদিতাদি কিন্তু ঠিকই বলেছেন। সুহাসিনীর ভাল কিছু হলে নিবেদিতাদিই তো সব থেকে খুশি হবেন। তবে ডেকোরামগুলোও তো মানতে হবে। কেউ একটা প্রস্তাব দিল, সঙ্গে সঙ্গে সবাই নাচতে শুরু করল…

সুপ্রিয়া বললেন, —জেনারেল মিটিং মানে কিন্তু সেপ্টেম্বর। তারপর ফাংশান অরগ্যানাইজ করা কিন্তু মুশকিল হবে।।

—হলে হবে। একটা ফাংশান না হলে বৃদ্ধাশ্রম বন্ধ হবে না।

—এ তো ব্যাগড়া দেওয়া পলিসি।

—ল্যাঙ্গুয়েজটা ঠিক করা দীপালি।

উত্তেজনা আর বেশি বাড়াবার আগে দময়ন্তীই দু’হাত তুলে থামাল। মুখে একটা স্বর্গীয় হাসি ফুটিয়ে বলল, —ও কে। ও কে। তিন-চার মাস পরেই নয় প্ল্যান হবে। একবার যখন করব বলে ঠিক করেছি, কিছু একটা তো করবই। যতই হোক এর সঙ্গে আমাদের বৃদ্ধাশ্রমের ইন্টারেস্ট জড়িত।

নিবেদিতার আর ভাল লাগছিল না। কেন যেন মনে হচ্ছে সুহাসিনীর ওপর তাঁর কর্তৃত্বের রাশ আলগা হয়ে আসছে ক্রমশ। এই কাকলি দীপালিরা একসময়ে কী অসম্ভব অনুগত ছিল তাঁর। অর্চনাকে তো তিনি প্রায় হাতে ধরে সেক্রেটারির চেয়ারে বসিয়েছেন। আজ তারাও কেন অন্য সুরে গায়?

নিবেদিতা কি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না? পিছিয়ে পড়ছেন? সঙ্গীসাথীরা কি তাঁকে পুরনোপন্থি ভাবছে?

বাড়ি ফেরার পথেও সুহাসিনীর চিন্তাতেই ডুবে রইলেন নিবেদিতা। নাহ্, দময়ন্তীর কাছে হেরে যাওয়া চলবে না, নতুন করে জমি তৈরি করতে হবে সুহাসিনীতে। প্রত্যেকটি সদস্যের সঙ্গে তিনি নিজে যোগাযোগ করবেন। বোঝাবেন, দময়ন্তী সত্যিই সুহাসিনীর ভাল চায় না, ক্ষমতা গ্রাসই তার একমাত্র লক্ষ্য। কীসে সুহাসিনীর ভাল হতে পারে, কীসে বা মন্দ হওয়ার সম্ভাবনা তাও তিনি সমঝাবেন সবাইকে। দময়ন্তীকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার সুহাসিনী এখনও নিবেদিতারই।

ঘরে এসে শাড়ি বদলে একটুক্ষণ বিছানায় ঝুম হয়ে বসে রইলেন নিবেদিতা। সন্ধে নামছে। বাইরে আলো এখনও মরেনি পুরোপুরি, তবে অন্দরে আবছা আঁধার। নিবেদিতার মনেও দুলছে আলোছায়া। হিসেব কষছেন কাকে কাকে পুরো জপিয়ে ফেলেছে দময়ন্তী, কী ভাবে তাদের নতুন করে হাতে আনা যায়। কিছুটা টাকার জোর থাকলেও মেয়েটার সঙ্গে পাঞ্জা কষা সহজ হয়। কবে যে শোভাবাজারের বাড়িটা বিক্রি হবে? মিনু যদি এসে যায়, সেপ্টেম্বরে টাকাটা হাতে এসে যাবে। তেমন বুঝলে ওখান থেকেই লাখ খানেক সুহাসিনীতে ডোনেট করে সাধারণ সদস্যদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করা যায়। জোর গলায় তখন বলতে পারেন, আসুন আমরা নিজেরাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ওল্ডহোমটা গড়ে তুলি, ওসব চটুল ধ্যাতাং ধ্যাতাং নাচাগানা করে সুহাসিনীর ঐতিহ্যে কালি ছেটানোর প্রয়োজন নেই।

কিন্তু মিনু ফিরছে তো। যদি ফের ঝুল দেয়? একবার সোনাদাকে কি ফোন করবেন নিবেদিতা? সেদিন মুখের ওপর নগ্ন সত্যিটা শুনিয়ে দেওয়ায় সোনাদা রীতিমতো চটিতং, আর যোগাযোগই করছে না। অবশ্য নিবেদিতার তাতে বয়েই গেল। তিনি করবেন কেজো ফোন, অন্যের মান অভিমান নিয়ে ভাবার তাঁর দায় নেই।

দরজায় ছায়া। পরদার ওপারে ভারী গলা, —আসব?

নিবেদিতা চমকে তাকালেন। হঠাৎ আর্য এ ঘরে?

নিরাবেগ গলায় নিবেদিতা ডাকলেন, —এসো।

ভেতরে ঢুকে টিউবলাইটটা জ্বালিয়েছেন আর্য। ফ্যাটফেটে আলোয় ঘরটা ভরে গেল। গলা ঝেড়ে আর্য বললেন, —একটা কথা ছিল।

—বলো।

—তোমার ছোট ছেলের সন্ধান কিছু পেলে ?

বুকটা ধক করে উঠল নিবেদিতার। ছি ছি, সুনন্দর কথা তিনি ভুলেই গেছিলেন! নিজের ওপর ক্ষোভটা উলটো ভাবে ফুটে বেরোল। হৃদয়ের গহনে লুকিয়ে থাকা উদ্বেগটা ঠিকরে এল ব্যঙ্গ হয়ে, —তুমি তা হলে ছোট পুত্রের না ফেরার খবরও রাখো? স্ট্রেঞ্জ!

আর্য থমকালেন সামান্য। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, —কী করব, ইন্দ্রিয়গুলোকে তো অচল করতে পারিনি। কান আছে শুনতে পাই, চোখ আছে দেখতে পাই।

—তারপর ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকো, তাই তো ?

—উপায় কী? হাত-পা ছুড়লেই কি তোমার ছেলেদের নাগাল পাব ?

—তা হলে আর ভাবছ কেন? গর্তে ঢুকে বসে থাকো। মনের দুঃখে বোতল খোলা।

—তাই তো করি। আমার তো সবই সয়ে গেছে। নেহাত মেয়েটা বার বার এসে বলছে…

—কে মেয়েটা?

—শরণ্যা। এ বাড়ির ধারায় এখনও রপ্ত হতে পারেনি, তাই টেনশান করছে। বলছিল, মামণির সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল… দিনকাল বড় খারাপ… আমার কিন্তু ভাল ঠেকছে না বাবা।

মা-ছেলের কাজিয়াই যে সুনন্দর গৃহত্যাগের কারণ এ তো নিবেদিতাও জানেন। কিন্তু শরণ্যার মতো একটা নবাগত মেয়ে কেন এ ব্যাপারে নাক গলাবে? তাও আবার আলোচনা করছে কার সঙ্গে? না আর্যর সঙ্গে! এতে কি নিবেদিতার অহংয়ে লাগে না?

চড়াং করে মাথা গরম হয়ে গেল নিবেদিতার। বিকৃত স্বরে বলে ফেললেন, —দু’দিন এসেই এত দরদ ? আশ্চর্য!

—ও ভাবে বলছ কেন? সেও তো এখন বাড়ির একজন। ভাবনা তো তার হতেই পারে।

—বেশি আহ্লাদিপনা কোরো না তো৷ নিবেদিতা ফের ঝামরে উঠলেন, —শাশুড়ি দেওর নিয়ে ও মেয়ের এখন না ভাবলেও চলবে। নিজেরটা আগে নিজে সামলাক।

কথাটা কি একটু বেশি জোরে বললেন নিবেদিতা? পরদার ওপাশ থেকে একটা ছায়া সরে গেল না? শরণ্যা নয় তো? মেয়েটা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল তবে?

নিবেদিতা স্থির হয়ে গেলেন।

.

০৯.

দুপুরবেলা একা ঘরে শুয়ে ছিল শরণ্যা। শরীর আজ বেশ খারাপ। নাক সুড়সুড, মাথা টিপ টিপ, জ্বর জ্বর ভাব। কাল চেতনা থেকে ফেরার পথে ঝড়বৃষ্টি নেমেছিল জোর, ছাতা খুলেও সামাল দেওয়া যায়নি। ট্রামরাস্তা থেকে এ-বাড়ি আর কতটুকু, তার মধ্যেই শরণ্যা ভিজেমিজে একসা। সকালে তো আজ ঘুম থেকে উঠতেই পারছিল না, মাথা যেন তখন ইটের মতো ভারী।

একটু আগে বেরোল অনিন্দ্য। সারা সকাল টেপরেকর্ডার নিয়ে খুটুর খুটুর করছিল। ভাল মতোই বিগড়েছে বোধহয়, সঙ্গে করে নিয়ে গেল সারাতে। ক’দিন ধরে খুব গান শোনার ঝোঁক চেপেছে অনিন্দ্যর। ঘরে থাকলেই ক্যাসেট বাজছে। ইংরিজি গান। পপ। তা শুনুক, নিমপাতা খাওয়া ভাবটা তো অনেক কেটেছে। মাঝে যা আরম্ভ করেছিল। বাচ্চা নষ্ট করো, বাচ্চা নষ্ট করো…। শরণ্যা প্রায় অতিষ্ঠ হওয়ার জোগাড়। কোনও কথাই অনিন্দ্য শুনতে রাজি নয়। সারাক্ষণ হয় হাউহাউ চেঁচাচ্ছে, নয় একেবারে স্পিকটি নট। রীতিমতো অত্যাচারও শুরু করেছিল। বিচ্ছিরি মাইগ্রেনে ছটফট করছে শরণ্যা, ক’হাত দূরেই গাঁক গাঁক টিভি চালিয়ে অনিন্দ্য হরর মুভি দেখছে। অতি কুৎসিত ছবি। বদখত কয়েকটা প্রাণী কিলবিল করছে পরদায়, সারাক্ষণ শুধু রক্ত আর রক্ত…। অনিন্দ্য ভাল মতোই জানে ও রকম ছবি দেখলে শরণার সর্বাঙ্গ গুলিয়ে ওঠে, তবু ওটাই সে চালাবে। তুমি আমার ইচ্ছেটা মানোনি, আমিও তোমার সুবিধে অসুবিধের পরোয়া করব না, এমন একটা ভাব। তাতে তুমি মরে যাও, হেজে যাও, পচে যাও, যা খুশি হোক। একেবারে যুক্তি-বুদ্ধিহীন শিশুদের মতো আচরণ। নিজের চাওয়াটুকুই শুধু জানে, না দিলে তোমায় জ্বালিয়ে মারবে— বাচ্চারাই তো এমন নিষ্ঠুর হয়, না কি? শরণ্যা যদি কখনও রাগ করে বলে তোমার সঙ্গে থাকব না, কালই মানিকতলা চলে যাব, তা হলেও বাবুর মুখ আষাঢ়ে মেঘের মতো কালো। শরণ্যা যতক্ষণ না বলবে, ঠিক আছে বাবা, যাব না, আই উইথড্র, ততক্ষণ বাবু অন্নজল ত্যাগ করে ভোম হয়ে বসে। এটাকে ছেলেমানুষি ছাড়া আর কী বলবে শরণ্যা?

জামাইষষ্ঠীর পরদিন থেকে ছবিটা যেন বদলেছে সামান্য। সেদিন ও বাড়িতে গিয়েও বিশেষ কথা বলছিল না অনিন্দ্য, বাবা-মা’ও যেন খানিকটা সিঁটিয়ে ছিল, হঠাৎ ঠাম্মাই জিজ্ঞেস করে বসল, —বুবলিকে তোমরা তা হলে এখানে কবে পাঠাচ্ছ বাবা?

অনিন্দ্য চোখ পিটপিট করল, —মানে?

—বা রে, প্রথম বাচ্চা তো বাপেরবাড়ি থেকেই হয়।

—ও ।

—পুজোর আগে আগেই তা হলে চলে আসুক বুবলি? তখন তো সাত মাস পুরে যাবে। তুমিও নয় তখন মাঝে মাঝে রাতে এসে থেকে যেও ভাই।

অনিন্দ্য জবাব দেয়নি, কেমন যেন ধন্দ মেরে গিয়েছিল।

সেদিন অনিন্দ্যর মুখখানা দেখে ভারী মায়া হয়েছিল শরণ্যার। ফেরার পথে নরম করে বুঝিয়েছিল, বাচ্চা হলে স্বামীর ওপর টান কমে না মেয়েদের, বরং ওই শিশুই এক নতুন বন্ধন গড়ে তোলে। আর মানিকতলায় গিয়ে থাকা? সে তো মাত্র ক’মাসের জন্য। তারপর তো শরণ্যা আবার অনিন্দ্যর অনিন্দ্যর অনিন্দ্যর।

কী বুঝল অনিন্দ্য কে জানে, সে রাত্রে গুম হয়ে থাকলেও পরদিন থেকে তার হাঁকডাক কমে গেল অনেকটা। ড্রিঙ্ক একটু বেশিই করছে, তবে অসভ্যতাটা আর নেই। সারাক্ষণ কী যেন একটা ভাবে। বোধহয় মনের সঙ্গে বোঝাপড়া চলছে। তা চলুক, শরণ্যা আর ঘাঁটায় না অনিন্দ্যকে। এর মধ্যে তো আবার আর একটা কাণ্ডও ঘটে গেল। মা’র সঙ্গে রাগারাগি করে ছোটভাই পাঁচ দিনের জন্য নো ট্রেস। ভয়ংকর না হলেও ক’টা দিনের জন্য একটা আবর্ত তো তৈরি হয়েছিল বাড়িতে। তালেগোলেই বোধহয় অনিন্দ্যর পাগলামিটা থিতিয়ে গেল আরও।

আর একটা সুলক্ষণ। শরণ্যার শরীরের খবর এখন অল্পস্বল্প রাখছে অনিন্দ্য। এই তো সকালেও নীলাচলকে বলছিল, বউদির চায়ে ভাল করে আদা দিয়ে দে, তোর বউদির আরাম লাগবে। বেরোনোর সময়েও জিজ্ঞেস করল শরণ্যার জন্য পেইন বাম কিনে আনবে কিনা।

এটুকুই কি কম? কচু কাটতে কাটতেই তো ডাকাত হয়।

বিটকেল উপমাটা মাথায় আসতেই হেসে ফেলল শরণ্যা। ডাকাতই তো। ডাকাতটা যা উদ্দাম হয়ে হামলায় এক একটা দিন!

শরণ্যা পাশ ফিরল। বিছানায় আধখোলা গল্পের বই। হাত বাড়িয়ে ফের টানল বাংলা উপন্যাসখানাকে। আধপাতাও পড়তে পারল না, চোখে লাগছে। পরদা ভেদ করে বেশ তো আলো আসছিল ঘরে, হঠাৎ কমে গেছে যেন? আকাশে মেঘ করল? আজও? হ্যাঁ, তাই তো! গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে বাইরে। হঠাৎই শরণ্যার মনে পড়ে গেল ছাদে বেশ কয়েকটা কাপড়চোপড় মেলা আছে। দু’-তিনটে সালোয়ার কামিজ, নীল রংয়ের নাইটিটা, অনিন্দ্যর শার্ট প্যান্ট… । এ বাড়ির ওয়াশিংমেশিন সেমি অটোমেটিক, কাচার পরে ভিজে জামাকাপড় শুকোতে দিতে হয়। নীলাচল কি বৃষ্টি এলে নামাবে মনে করে? সে নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে নেই। এ পাড়ার ঠাকুর-চাকররা দুপুরবেলা ফুটপাতে বসে জমিয়ে টোয়েন্টিনাইন খেলে। নীলাচলও তাসের পোকা। নাহ্, নিজেই গিয়ে তুলে আনা ভাল। শুকনো জামাকাপড় ফের ভিজলে বিশ্রী একটা গন্ধ হয়।

বিছানা ছেড়ে উঠল শরণ্যা। পা দুটো টলছে অল্প অল্প। মাথাটাও। দুপুরের দোতলা রোজকার মতোই নিঝুম। ছায়া মাখা। আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙছে শরণ্যা। ছাদে এসে তার থেকে কাপড়জামা নামাচ্ছে এক এক করে।

সহসা চোখ চিলেকোঠায়। সঙ্গে সঙ্গে ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকটা। রংজ্বলা কাঠের দরজাটা হাট করে খোলা। মনে হয় যেন ভেতরে কেউ আছে।

সুনন্দ কি তালা লাগিয়ে যায়নি? শরণ্যা রোজই তো একবার করে ছাদে ওঠে, দরজা যে খোলা আছে নজরে পড়েনি তো! শিকল টানা থাকত কি?

পায়ে পায়ে ঘরটায় ঢুকল শরণ্যা। চাপা কৌতূহল নিয়ে। কোনওদিন ঢোকেনি ঘরটায়, আজই প্রথম। চিলেকোঠার তুলনায় ঘরটার আয়তন বেশ বড়ই। মেঝেয় তেমন ধুলো নেই, আজই বোধহয় ঝাঁট পড়েছে। আসবাব নেই বিশেষ। একটা শুধু সিংগলবেড খাট, একখানা পরিত্যক্ত সোফা, আর একটা নড়বড়ে টেবিল। নিজের ঘরের চেয়েও এই ঘরের নির্জনতাতেই থাকতে বেশি ভালবাসত সুনন্দ। বন্ধুবান্ধবদেরও নিয়ে আসত এখানেই। উধাও হয়ে যাওয়া ছেলেটা কি সত্যি সত্যিই গৃহত্যাগী হল?

সুনন্দর খোঁজ অবশ্য একটা পাওয়া গেছে। নীলাচলই ঘুরে ঘুরে তার সন্ধান এনেছে। হাওড়ার কোন এক তন্ময় নামের বন্ধুর বাড়িতে নাকি সে অধিষ্ঠান করছে এখন। অজ্ঞাতবাসের ঠিকানাটা জোগাড় করে তার কাছে গিয়েও ছিল নীলাচল, সে নাকি সটান জানিয়ে দিয়েছে ফার্ন রোডের বাড়িতে সে আর ফিরবে না।

আধভাঙা সোফাটার ওপর একটা ডায়েরি পড়ে আছে। ডায়েরিটা তুলতে গিয়েও শরণ্যা থমকাল একটু। অন্যের ডায়েরি কি পড়া উচিত? তুৎ, জানছেটা কে? যার ডায়েরি সে তো এখন গঙ্গার ওপারে।

পাতা উলটোচ্ছে শরণ্যা। তেমন কিছুই নেই, শুধু টাকার হিসেব, হিজিবিজি, কাটাকুটি…। মাঝে মাঝে এক একটা পাতায় উদ্ভট উদ্ভট সেন্টেন্স। দেঁতো হাসি বেতো ঘোড়া, রোল খায় থোড়া হোড়া! শ্মশানেই সব শেষ, শশা নেই সব শেষ! রাম আর আল্লাহ্, ভারী ভারী পাল্লা! সুনন্দটা ধাঁধাফাঁদা বানাত নাকি? পিছনের পাতায় আস্ত একটা গানও রয়েছে। তলায় তিন-চার ভাবে নাম সই করা। এস এম। কী বিটকেল গান রে বাবা! ইউরিয়া মুড়ি, অন্ধ্রের রুই/ সারের পালং, মার্কিনি কই/ ধন্য হউক ধন্য হউক ধন্য হউক হে ভগবান/ বাংরেজি ভাষা, ফাস্টফুড জাংক/ বিদেশে উড়ান, পাতাখেকো পাংক/ পুণ্য হউক পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান…

শরণ্যা হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না। যে ছেলের মধ্যে এত সুন্দর রসবোধ আছে সে অমন জঘন্য ভাষায় মা’র সঙ্গে ঝগড়া করে কী করে? মা’ই বা কেমন, কোনও ছেলের কাছ থেকে এতটুকু শ্রদ্ধা আদায় করতে পারেনি? নীলাচল বলছিল দশ হাজার টাকা দিয়ে নাকি একটা সেকেন্ডহ্যান্ড স্প্যানিশ গিটার কেনার ইচ্ছে হয়েছিল সুনন্দর। আশ্চর্য, এইটুকু বাসনার কথাও মাকে খুলে বলতে পারে না ছেলে? মা-বাবার সঙ্গে ছেলেদের কী অদ্ভূত সম্পর্ক! মা যেই শুনলেন ছেলে বেঁচেবর্তে আছে, ওমনি কেমন নিশ্চিন্ত। ফিরল তো ফিরল, না ফিরলে কী আর করা এমন একটা হাবভাব! বাবারই বা কী এমন ভাঙচুর হল? সেই মুখে কুলুপ, সেই চোখে মোটা বই! শুধু একটু যেন বেশি গোমড়া, ব্যস।

আর অনিন্দ্য ? সে তো কাঁধ ঝাঁকিয়ে অবলীলায় বলে দেয়, পোযায়নি তাই কেটে গেছে! ঝগড়া করেছে মা, ফেরাতে হলে মা ফেরাবে, আমি কেন নাক গলাতে যাব!

শরণ্যার সংশয় হয়, অনিন্দ্য-সুনন্দ এক মায়ের পেটের ভাই তো? যতই বাইরে বাইরে মানুষ হোক, ছোটভাইকে ঘিরে দাদার কি শৈশবের কোনও স্মৃতিই নেই? নাকি অনিন্দ্যর সেই তন্ত্ৰীটাই নেই, যা রক্তের টানে বেজে ওঠে? ভায়ে ভায়ে বিবাদ থাকলেও এই নির্লিপ্তিটাকে নয় চেনা যেত…

জামাকাপড় কাঁধে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল শরণ্যা। দক্ষিণের আকাশ ঘন হয়ে এসেছে। বিদ্যুৎ ঝিলিক মারছে হঠাৎ হঠাৎ। ঠান্ডা একটা বাতাস দৌড়ে এল। কাছেপিঠে নির্ঘাত কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক উঁচু থেকে দুটো চিল নেমে আসছে নীচে। এরকম সব মুহূর্তে মনটা যেন কেমন হু হু করে ওঠে। কান্না পায়। কেন যে পায়?

কোথায় যেন টেলিফোন বাজছে। দোতলায় নয় তো? নীচে ফোন তোলার কেউ নেই, শ্বশুরমশাই এখন কিছুতেই ওপরে উঠবেন না। শুভ্রর ফোন কি?

মনে হতেই ছুটল শরণ্যা। হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি ভাঙছে। ফ্রেঞ্চ লিভ নিয়েছে। আজ, শুভ্র ফোন করতেই পারে। শরীর বেগতিক বলে শরণ্যাকে খুব সাহায্য করছে শুভ্র। পি-এস-বি ক্যানিং ব্লকে সার্ভের কাজ অ্যালট করেছিলেন, শরণ্যা যেতে পারল না, শুভ্র একা একাই ঘুরে এসে কাজটা দু’জনের নামে ভাগ করে দেখিয়ে দিল। আজ শরণ্যারই ওকে একটা ফোন করে দেওয়া উচিত ছিল।

হাঁপাতে হাঁপাতে এসে রিসিভার তুলল শরণ্যা, —হ্যালো?

—কী রে, তুই আজ কাজে যাসনি কেন? শরীর খারাপ?

শুভ্র নয়। মা।

শরণ্যা দম নিয়ে থিতু করল নিজেকে। তারপর হালকা ভাবেই বলল, —তেমন কিছু নয়। এমনিই ইচ্ছে করছিল না।

—বললেই হবে? গলা তো ভারী ভারী লাগছে!

এই না হলে মা? ঠিক ধরে ফেলেছে। পলকের জন্য শরণ্যার মনে হল সে যখন ডাইনিংটেবিলে ভাত ঘাঁটছিল, শাশুড়ি বেরোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে তার সঙ্গে কথা বললেন। সন্ধেবেলা বাবুয়া বলে কে যেন আসবে শাশুড়ির কাছে, শরণ্যা যেন তাকে বসিয়ে রাখে। কই, একবারের জন্যও তো শাশুডির চোখে পড়ল না শরণ্যার শরীরটা ঠিক নেই? এটাই কি মার সঙ্গে শাশুড়ির তফাত? নাকি শরণ্যার শাশুড়িই এ রকম?

গলা ঝেড়ে শরণ্যা বলল, —তোমার টেনশান করার মতো কিছু হয়নি মা। জাস্ট একটু সর্দি…কাল এমন আলটপকা ভিজে গেলাম…

—তোমার এখন সাবধানে থাকা উচিত বুবলি। এমনিই এসময়ে শরীর নড়বড়ে থাকে।—

—আমি সাবধানেই থাকি মা। মিনিবাসে ওঠা ছেড়ে দিয়েছি, ট্রামে চেপে কাজে যাই, দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি ভাঙি না। বলেই একটু মুচকি হাসল শরণ্যা,—তা হঠাৎ তোমার দুপুরে ফোন? তোমাদের টাইম তো রাত্তিরবেলা!

—দরকার আছে। তাই তো তোর অফিসে ফোন করেছিলাম। …শোন, আমি ডক্টর মন্দিরা সেনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করছি। এই গোটা পিরিয়ডটা তুই ওঁর আন্ডারেই থাকবি। ডক্টর সেনের নিজের নার্সিংহোম আছে। চমৎকার অ্যারেঞ্জমেন্ট, ডেলিভারির সময়ে কোনও প্রবলেম হবে না। আরও সুবিধে, ওঁর হাজব্যান্ড চাইল্ড স্পেশালিস্ট। বুঝলি?

—হুঁ। বুঝলাম। ঘরের পয়সা ঘরেই থাকে।

—ফাজলামি করিস না। আজই ভাবছি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে যাব। কোন দিনটা তোর সুবিধে হবে? উনি নিজের নার্সিংহোমে বসেন সোম বুধ শুক্কুর সন্ধেবেলা।

—তা সেটা কদ্দূর?

—সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ আর বিডন স্ট্রিট ক্রসিংয়ে। মহাশ্বেতা একটু থেমে থেকে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বললেন, —আমাদের ওখান থেকে জায়গাটা খুব দূর নয়।

—হুঁ।

মহাশ্বেতা আবার একটু থেমে থেকে বললেন, —অনিন্দ্যর সঙ্গে ভাল করে কথা বলে নিয়েছিস তো?

—কী নিয়ে?

—এই… তুই আমাদের কাছেই থাকবি…

দুর্ভাবনাটা এখনও ঘোচেনি। শরণ্যা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কথা তো সেদিন হয়েই গেল। যা কাস্টম তাই হবে।

—দেখিস বাবা, অশান্তি যেন না হয়।

শরণ্যার বুকটা চিনচিন করে উঠল। তাকে নিয়ে বাবা-মার উদ্‌বেগটা কিছুতেই আর কমছে না। রোজ টেলিফোন করেও স্বস্তি নেই, প্রায় সপ্তাহেই দু’জনে ছুটে আসে ফার্ন রোডে। সরেজমিনে বুঝে নিতে চায় মেয়ের হাল।

জোর করে হেসে উঠল শরণ্যা,—তোমরা সারাক্ষণ এত টেনশান করো কেন বলো তো? অনিন্দ্য কোনও প্রবলেম করবে না।

মহাশ্বেতা চুপ।

শরণ্যা আর একটু গলা ওঠাল,—অনিন্দ্যকে নিয়ে তোমরা মিছিমিছি ভয় পাও মা। ও একটু অন্য রকম ঠিকই। ছোটবেলা থেকে ছাড়া ছাড়া ভাবে মানুষ হয়েছে, কারুর সঙ্গে তেমন মেশেনি… ওর এক্সপ্রেশানগুলোই একটু আলাদা ধরনের।

—হুঁ। ওপাশ থেকে তবু যেন ছোট্ট শ্বাস ভেসে এল,—অ্যাপয়েন্টমেন্টটা তা হলে করে ফেলি?

—করতে পারো। তবে…

—কী তবে?

—রেগুলার অদ্দূর গিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে এখন? উনি কি এদিকে কোথাও বসেন না?

—বসেন বোধহয়। এলগিন রোড না কোথায় যেন। জেনে নিতে হবে।

—তো সেখানেই তো ভাল।

—ঠিক আছে, দেখছি। …ও হ্যাঁ, ভাল কথা। আমার ছাই কিছুতেই মাথায় থাকে না…

—কী?

—একদিনও তো গিয়ে নিবেদিতাদির সঙ্গে দেখা হচ্ছে না… তাঁর সঙ্গেও তো আলোচনা করা দরকার।

—কী ব্যাপারে?

—ওঁর যদি কোনও স্পেশাল ডাক্তারের ব্যাপারে ফ্যাসিনেশান থাকে…

শরণ্যার হাসি পেয়ে গেল। বাচ্চা হবে জানতে পারার পর শাশুড়ি এক দিনই বুঝি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ডাক্তার দেখিয়েছ? তারপর বোধহয় আর স্মরণেই নেই ঘটনাটা। নাহ্, ভুল হল। আরও এক-দু’বার প্রশ্ন করেছেন বটে। শরীর কেমন ? ঠিক আছ তো?

স্বর সহজ রেখে শরণ্যা বলল, —তুমি তোমার মতন অ্যারেঞ্জমেন্ট করো মা। মামণি কিছু মনে করবেন না।

—তবু একবার ওঁর মতামত তো নেওয়া উচিত।

—সে নয় ফোনে কথা বলে নিয়ো।

—ওঁকে তো যেতেও বলতে হবে।

—কোথায় ? ডাক্তারের কাছে? মামণির বোধহয় সময় হবে না মা।

—তা ঠিক। উনি যা ব্যস্ত মানুষ। …এমনি বাড়ির সব খবর ভাল?

—চলছে। অ্যাজ ইউজুয়াল।

—সুনন্দ?

—ওই। অ্যাজ ইউজুয়াল।

—ফোনটোনও করেনি?

—উঁহু।

—নিবেদিতাদি কী বলছেন?

—কিছুই না।

—নিবেদিতাদি নিজে একবার গিয়ে দাঁড়ালে বোধহয় ছেলের অভিমানটা চলে যেত।

হয়তো। কিন্তু তেমনটি কি ঘটবে? এ বাড়িতে সবাই-ই তো যে যার মান নিয়ে মটমট করছে। অভিমান এখানে শুকিয়ে পাথর হয়ে যায়।

মহাশ্বেতা ফের বললেন,—যাই বলিস, ছোটপুওুরটিও বেশ ট্যাঁটা আছেন। এত্ত কীসের তেজ? বাবা-মার মনে কষ্ট দিয়ে কী সুখ যে পায় এরা!

সুনন্দর প্রসঙ্গ আর ভাল লাগছিল না শরণ্যার। কচলে কচলে তেতো হয়ে যাচ্ছে যেন। তা ছাড়া সুনন্দকে নিয়ে সে রোজ আলোচনা করবেই বা কেন? কে সুনন্দ? নেহাত এ বাড়িতে শরণ্যার বিয়ে হয়েছে বলে আইন মোতাবেক একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ব্রাদার-ইন-ল। কিন্তু ব্রাদার-ইন-ল-টি সিস্টার-ইন-ল-কে কতটা পুঁছেছে? প্রথম মাইনে পেয়ে শরণ্যা অত সুন্দর একটা টিশার্ট কিনে আনল, খুলে একবার দেখল না পর্যন্ত! প্যাকেটখানা হাতে নিয়ে শুধু এক টুকরো শুকনো থ্যাংক্‌স্‌। দেওর-বউদির মধ্যে কত সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়, এ বাড়িতে সুনন্দ তার ভাল বন্ধু হতে পারত… কোনও দিন কাছেই ঘেঁসল না। শরণ্যা একটি আস্ত গাড়োল বলেই না ভেবেছিল এ বাড়ির বউ হিসেবে সুনন্দর জন্যে তার উদ্‌বিগ্ন হওয়া উচিত? গাল বাড়িয়ে কেমন চড়খানা খেল? লাভ হল একটাই। নিবেদিতা দেবীর একটা অন্তত মনের কথা জানা গেল। অন্য একটা চেহারাও। বাইরে যতই মহৎ সাজুক, ভেতরে ভেতরে তিনিও একজন টিপিকাল শাশুড়ি। নইলে ওই রকম একটা মন্তব্য কেউ করে। ছি।

অবশ্য মাকে এসব মরে গেলেও বলবে না শরণ্যা। নাক টেনে বলল, —ছাড়ো তো ওর কথা। ফিরলে ফিরবে, না ফিরলে না ফিরবে।

কথাটা উচ্চারণ করেই শরণ্যা সচকিত। নিজের কানেই ঠং করে বেজেছে কথাটা। তার গায়েও কি তবে এ বাড়ির হাওয়া লেগে গেল? সঙ্গদোষ?

শরণ্যা আলগা ভাবে প্রসঙ্গ ঘোরাল,—মা, কাকাদের বাড়ির টেলিফোনটা খারাপ নাকি? সকালে কত বার ডায়াল করলাম, খালি রিং হয়ে যাচ্ছিল?

—না তো। তবে ওদের লাইন তো মাঝে মাঝেই প্রবলেম করে। আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল্, সারাক্ষণ রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে…। কেন, কাকাকে তোর কী দরকার পড়ল?

—উঁহু, কাকাকে নয়। ঝিমলিকে। ওকে একট ঝাড়তাম।। বজ্জাত মেয়ে, গড়িয়াহাটে কলেজ করতে আসে, একদিন এখানে আসতে পারে না?

—তুই বাড়ি থাকলে তো যাবে।

—আমার অফিসটাও তো দূরে নয় মা। ইচ্ছে হলে ওখানেও..কদ্দিন ওর সঙ্গে দেখা হয় না। ওকে তুমি বোলো, আমি খুব রাগ করেছি।

—বলব। …হ্যাঁ রে, অনিন্দ্যর কাল একটা ইন্টারভিউ আছে না?

—হ্যাঁ।

—যাবে তো?

—বলছিল তো যাবে।

—এবার ওর একটা কিছু হওয়া দরকার। অনেকদিন তো হল…

—হুঁ।

শুধু মা-বাবা নয়, অনিন্দ্যর চাকরি নিয়ে শরণ্যাও যথেষ্ট ভাবিত এখন। কাল যেখানে ইন্টারভিউ, তারা শিলিগুড়ি অফিসের জন্য ইঞ্জিনিয়ার চাইছে। জেনেও অ্যাপ্লাই করেছে অনিন্দ্য। কলকাতা ছেড়ে নড়তে মনে মনে রাজি হয়েছে বোধহয়। বাইরে কোথাও চলে গেলে মন্দ হয় না। মা-বাবাকে ছেড়ে দূরে যেতে শরণ্যার একটু খারাপ লাগবে, তবে এ বাড়ির দমবন্ধ করা স্বাধীন পরিবেশটা থেকে তো মুক্তি। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে অনিন্দ্যও হয়তো অনেক স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

—কী রে, চুপ করে গেলি কেন? কী ভাবছিস?

শরণ্যার চিন্তাটা ছিঁড়ে গেল। হেসে বলল,—আর কী, এবার রাখো। অফিসে কোনও কাজকর্ম নেই? এতক্ষণ কথা বলছ কী করে?

—আজ আমাদের অফিসে বেশ ছুটি ছুটি ভাব। আমাদের এক কলিগের ছেলে মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করেছে, খাওয়াদাওয়া হচ্ছে জোর। সাবির থেকে মাটন্ রেজালা আসছে, তন্দুরি রুটি…

—আছ ভাল। সাধে কি গভর্নমেন্টের এই দশা!

—পাকামো করিস না। প্রাইভেটরা কত কাজ করে জানা আছে। কথায় কথায় গণেশ উলটোয় কেন, অ্যাঁ?

—হুঁউ ?

—সাবধানে থাকিস। রাখছি।

মা’র সঙ্গে বকবক করে শরীর অনেকটা ঝরঝরে লাগছে। সোফার ওপর ফেলে রাখা জামাকাপড়গুলো তুলে নিয়ে শরণ্যা ঘরে ফিরল। নেমে গেছে বৃষ্টি। বড় বড় দানায়। হাওয়াও চলছে। যাক, মোক্ষম সময়ে ছাদে গিয়েছিল শরণ্যা।

জানলার পরদা সরিয়ে শরণ্যা বৃষ্টি দেখছিল। ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে চরাচর। বর্ষা তা হলে পুরো দমে এসে গেল ? নীলাচল বলছিল এসময়ে সে নাকি একবার করে দেশে যায়। দিন সাত-দশের জন্য। জমিজমা আছে দেশে, দাদা-ভাইদের সঙ্গে চাষের কাজে হাত লাগায়। নীলাচল নিজেও নিশ্চয়ই জমিটমি কিনছে দেশে? যা গোছানো ছেলে। নীলাচল চলে গেলে এ-বাড়ির বাবু বিবিদের কী হাল হয়? বদলি লোক দিয়ে যায় বটে নীলাচল, তবে সে কি আর নীলাচল হবে?

ছাঁট আসছে। ভিজে যাচ্ছে বিছানা। শরণ্যা জানলা বন্ধ করল। এইবার? এখন? উফ্, কাজে না বেরোলে দিনগুলো এত লম্বা হয়ে যায়। জামাকাপড়গুলো ইস্ত্রি করে ফেলবে? ইচ্ছে করছে না। বই? ভাল লাগছে না। এমনিই শুয়ে গড়াবে একটু ? উঁহু, গা ম্যাজম্যাজ ভাব বেড়ে যেতে পারে। বেশ কিছু ডাটা কম্‌পাইল করা আছে, বসবে কাগজকলম নিয়ে? স্ট্যাটিস্টিকাল অ্যানালিসিসের কাজ শুরু করে দিলে হয়। থাক, আজ আর ব্রেনকে ট্যাক্স করে লাভ নেই। আজ কাম্ বন্‌ধ, তো কাম বন্‌ধ। ইস, অনিন্দ্যটা ঘরে থাকলেও নয় সময় কাটত। কথা বলে। কথা না বলে। কখন যে অনিন্দ্য ফিরবে?

অনিন্দ্য ফিরল সন্ধের পর। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। আকাশ তখন প্রায় নির্মেঘ। শরণ্যা তখন টিভি দেখছিল।

ওই সন্ধেটা বুঝি মৃত্যু পর্যন্ত স্মরণে থাকবে শরণ্যার।

অনিন্দ্যর হাতে ছিল চিকেন পকোড়ার প্যাকেট। এসেই চায়ের জন্য হুকুম ছুড়ল নীলাচলকে। হাসি হাসি মুখে শরণ্যাকে বলল, —গরম গরম খেয়ে নাও। তোমার এখন ঝাল ঝাল ভাল লাগবে বলে নিয়ে এলাম।

শরণ্যার অল্প অল্প খিদে পাচ্ছিল। তবু বলল, —বাইরের ভাজাভুজি খাব? আমার আজকাল যা অম্বল হচ্ছে!

—কিচ্ছু হবে না। খেয়ে ফ্যালো তো। অম্বল হলে ওষুধ আছে।

অনিন্দ্যর জোর করাটা ভাল লাগল শরণ্যার। পকোড়ায় সস মাখিয়ে চিবোচ্ছে। আলগা ভাবে জিজ্ঞেস করল, —তোমার টেপের কী হল? দিল না সারিয়ে আজ?

অনিন্দ্য পোশাক বদলাচ্ছিল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, —ভাল মেকানিকটা নেই। কাল আসবে। কাল সন্ধে নাগাদ পেয়ে যাব।

—তোমার ক্যাসেটরা তো আজ কাঁদবে তা হলে!

—হুঁম্।

টুকটাক আলাপচারিতা চলছিল। টেপরেকর্ডার নিয়ে। অনিন্দ্যর আগামী ইন্টারভিউ নিয়ে। টিভির পরদায় চলমান প্রোগ্রামটা নিয়ে। তার মধ্যেই চা শেষ করল অনিন্দ্য। কাপে চুমুক দিতে দিতে আয়নার সামনে চুল বাঁধতে বসল শরণ্যা। খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলও নিজেকে। চোখের নীচে হালকা কালির ছোপ, গোটা মুখটা কেমন ফোলা ফোলা লাগে। রক্তশূন্যতা ?

আনমনে বলে ফেলল, —জানো, মা গাইনির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করছে।

—কার সঙ্গে?

—গাইনি। ডাক্তার। মন্দিরা সেন। নাম শুনেছ?

উঠে এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল অনিন্দ্য। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে বলল, —হঠাৎ ডাক্তার? এখনই?

—বা রে, এখন থেকেই তো চেকআপ করাতে হয়। বাচ্চাটার টাইম টু টাইম কী পজিশান, গ্রোথ ঠিক মতো হচ্ছে কিনা…

—ও।

—তুমি যাবে সঙ্গে? এলগিন রোডে চেম্বার… বোধহয় এই শনিবারেই মা… অনিন্দ্য চুপ।

—চলো না। প্লিজ।

—দেখা যাক। শনিবার তো আসুক।

আরও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনিন্দ্য ঢুকে গেল বাথরুমে। গরমকালে মাঝেমধ্যে সে সন্ধেবেলা স্নান করে। তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে মিনিট কুড়ি পর বেরিয়ে এসেছে।

শরণ্যা রিমোট টিপে টিভির চ্যানেল পালটাচ্ছিল। ঠাট্টা করে বলল, —শীতকাতুরে ছেলের আজ হঠাৎ এত গরম লাগল যে?

সামান্য চোয়াল ফাঁক করে হাসল অনিন্দ্য। তারপর হঠাৎ এসে শরণ্যার কাঁধে হাত রেখেছে, —একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

—হুঁউ।

—তোমার বাচ্চাটার নড়াচড়া টের পাও তুমি?

—তোমার নয়, বলো আমাদের। শরণ্যা হাত ছোঁয়াল অনিন্দ্যর হাতে।

—যা জিজ্ঞেস করছি বলো না। টের পাও?

শরণ্যার বেশ মজা লাগল। এত দিনে তা হলে বাবুর একটু একটু টান জন্মাচ্ছে?

ঠোঁট টিপে বলল, —এখনই কী? সবে তো তিন মাস।

—কিচ্ছু বোঝা যায় না? তোমার শরীরের মধ্যে একটা ক্রিচার…

—এখন ক্রিচারই থাকে। পাঁচ মাসের আগে মানুষের ফর্মে আসে না।

—মানে এখনও তা হলে মানুষ নয়?

—মানুষ কি এক ধাপে হয়? স্টেজ বাই স্টেজ। সেই এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে… এখন ইন্টারমিডিয়েট স্টেজে আছে।

অনিন্দ্য মাথা নাড়ছে আপন মনে। হঠাৎই শরণ্যার হাতে তোয়ালেটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, —এটা বাথরুমে রেখে দিয়ে এসো না, প্লিজ।

অনিন্দ্যর গালটা আলতো টিপে দিয়ে শরণ্যা বাথরুমে ঢুকল। মুহূর্ত পরেই তক্ষ্ণ এক আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাড়িতে। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেছে শরণ্যা।

নীলাচল দৌড়ে এল। আর্য পর্যন্ত ছুটে এসেছেন ঘর থেকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে স্নানঘর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *