০১. ধীরেসুস্থে তৈরি হচ্ছিলেন নিবেদিতা

আলোছায়া – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

.

০১.

ধীরেসুস্থে তৈরি হচ্ছিলেন নিবেদিতা। বিকেল সাড়ে চারটেয় সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাপ্তাহিক মিটিং আছে আজ। তাঁদের এই ফার্ন রোডের বাড়ি থেকে হাজরায় সমিতির অফিস গাড়িতে মিনিট পনেরোর পথ, তবু নিবেদিতা চারটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে চান। ছেলের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে পর পর দুটো মিটিংয়ে তাঁর থাকা হয়নি, আজ নিবেদিতার একটু আগে আগেই যাওয়া উচিত।

হালকা প্রসাধন সেরে নিবেদিতা ওয়ার্ড্রোব খুললেন। সার সার হ্যাঙার। শাড়ি ঝুলছে। সুতি সিল্‌ক তসর সিফন…। গয়নাগাঁটির ব্যাপারে নিবেদিতার তেমন একটা আকর্ষণ নেই, কিন্তু শাড়ি সংগ্রহে চিরকালই তাঁর প্রবল ঝোঁক। নানান রাজ্যের বাছাই বাছাই শাড়িতে তাঁর ওয়ার্ড্রোবটি ঠাসা। কাঞ্জিভরম পটোলা গাদোয়াল নারায়ণপেট বোম্কাই ইক্‌কৎ কট্কি মাদুরাই সম্বলপুরী, কী আছে আর কী নেই। বোলপুরের কাঁথাস্টিচ, ফুলিয়ার তাঁত, বিষ্ণুপুরের বালুচরী, আর খোদ বাংলাদেশের জামদানির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে চড়া রং কোনওকালেই ভালবাসেন না নিবেদিতা, এখন বয়স বাড়ার পর রংয়ের ব্যাপারে তো আরও খুঁতখুঁতে হয়ে গেছেন। সাদা জমি, নইলে ঘিয়ে অথবা ছাই ছাই, বড় জোর স্টিল গ্রে, ব্যস।

ঠেলে ঠেলে একের পর এক হ্যাঙার সরাচ্ছেন নিবেদিতা। কোনটা পরবেন আজ? গুর্জরি স্টিচ? নাকি হালকা দেখে কোনও সিল্‌ক? হলুদপাড়ের জলডুরে টাঙাইলই বা মন্দ কি। অনিন্দ্যর শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঠানো নমস্কারিটা এখনও হ্যাঙারে ওঠেনি, পড়ে আছে ওয়ার্ড্রোবর তাকে। শাড়িখানার দিকে তাকিয়ে নিবেদিতা নাক কুঁচকোলেন একটু। সাদা বেনারসি, খোলে বুটিটুটিও নেই, কিন্তু পাড় টকটকে লাল। এত লাল পাড় নিবেদিতা জন্মে পরেননি, বিয়ের পর পরও না। এমন ষাঁড়-খেপানো রং তাঁর ঘোরতর অপছন্দ। শরণ্যা বলছিল তার মা নাকি নিজে পছন্দ করে কিনেছেন এই শাড়ি। নিবেদিতারই দুর্ভাগ্য, শাড়িখানা এখানেই শুয়ে থাকবে অনন্তশয্যায়।

ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত চওড়া মেরুনপাড় সাউথ-কটনখানা হ্যাঙার থেকে নামালেন নিবেদিতা। সঙ্গে মেরুন-বর্ডার লম্বাহাতা ক্রিম-কালার ব্লাউজ। ঘরোয়া পোশাক দ্রুত পালটে নিজেকে বিন্যস্ত করলেন দক্ষিণী সুতির আভিজাত্যে। নিবেদিতার বয়স এখন আটান্ন, কিন্তু এখনও তাঁর ফিগারটি চমৎকার। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের তুলনায় তিনি অনেকটাই দীর্ঘ, অতি সাধারণ শাড়িও একটা আলাদা মাত্রা পায় তাঁর অঙ্গে। মুখশ্রী তেমন আহামরি নয় বটে, তবে গায়ের রংটি রীতিমতো ফরসা, সিঁথিবিহীন কাঁচাপাকা ঘন কেশ টেনে বেঁধে চওড়া কপালে একটা বড় টিপ লাগালে তাকে প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী মনে হয়। এই ব্যক্তিত্বটাই নিবেদিতার আভরণ।

বেশভুষার পালা শেষ। টেবিল থেকে চশমা পেন আর একখানা ছোট্ট রাইটিং প্যাড তুলে নিয়ে সুদৃশ্য ঝোলাব্যাগটিতে পুরলেন নিবেদিতা। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলেন একটু। ডিসেম্বরের শুরু, কলকাতায় এখনও শীত আসেনি, তবে পরশু থেকে অল্প অল্প উত্তুরে হাওয়া বইছে। শিরশিরে। শুকনো শুকনো। এই সময়টায় পুট করে ঠান্ডা লেগে যায়, সঙ্গে গায়ে দেওয়ার কিছু একটা নেবেন কি? দিন কুড়ি পর সুহাসিনীতে যাচ্ছেন, ফিরতে দেরি হতেই পারে।

গুজরাটি চাদরখানা বার করে নিবেদিতা আলমারি লাগাচ্ছেন, দরজায় রিনরিনে স্বর, —মামণি, আসব?

শরণ্যা। এ বাড়িতে পা রাখার পর থেকে নিবেদিতাকে মামণি বলে ডাকছে মেয়েটা। সম্বোধনটা কানে লাগে নিবেদিতার। তাঁর দুই ছেলে তাঁকে মা বলেই ডাকে, পুত্রবধূ কেন যে হঠাৎ মামণি ডাকটা আমদানি করল? কেউ শিখিয়ে দিয়েছে? নাকি শাশুড়িকে মা বলে সম্বোধন করতে অস্বস্তি হয়?

নিবেদিতা গলা ঝাড়লেন— এসো, ভেতরে এসো।

পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকল শরণা। পরনে পেঁয়াজবরণ আনকোরা তাঁত। ফুলে ফুলে রয়েছে শাড়িটা, খানিক এলোমেলোও। দেখেই বোঝা যায় শাড়ি পরার অভ্যেস নেই। রেশম রেশম একটাল চুল পিঠে ছড়ানো, সিঁথি জুড়ে ডগডগে সিঁদুর, গলায় মফ্চেন, হাতে চুড়ি বালার সঙ্গে লাল লাল শাঁখা, সোনায় বাঁধানো লোহা। নতুনবউ-নতুনবউ গন্ধ এখনও লেগে আছে শরণ্যার সর্বাঙ্গে।

পুতুলসাজ পুত্রবধূকে ঝলক দেখলেন নিবেদিতা। এগারো দিন মাত্র বিয়ে হয়েছে, মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবেই এখনও বেশ জড়সড়।

নিবেদিতা হাসলেন নরম করে, —কিছু বলবে?

শরণ্যার চোখ বড় বড়, —আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন মামণি?

—হ্যাঁ। সমিতির অফিসে যাচ্ছি। নিবেদিতা ঘাড় নাড়লেন, —তোমাদের ট্রেন যেন ক’টায়?

—সওয়া সাতটা। আপনার ছেলে বলছিল ছ’টা নাগাদ বাড়ি থেকে স্টার্ট করবে।… আপনি কি এসে যাবেন তার মধ্যে?

—না শরণ্যা। এগজিকিউটিভ বডির মিটিং আছে আজ। আমার দেরি হবে।

—ও

মেয়েটার কি একটু খারাপ লাগল? মুখটা মিইয়ে গেল যেন? কী আশা করছিল শরণ্যা? ছেলে ছেলের বউ হানিমুনে যাচ্ছে বলে নিবেদিতা কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসবেন? নিবেদিতা কর্মী মানুষ, এ ধরনের কোনও জোলো সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দেওয়া তাঁর ধাতে নেই, তা সত্ত্বেও নতুন বউ যেন মনে কষ্ট না পায় তার জন্য গলা আরও কোমল করে বললেন, —আমি তোমাদের সঙ্গে দেখা করেই বেরোতাম। …যাও, দু’জনে ভাল করে ঘুরে এসো। এ সময়ে ঠান্ডার জায়গায় যাচ্ছ। বেশি করে গরম জামাকাপড় নিয়েছ তো?

শরণ্যা ঢক করে ঘাড় নাড়ল।

—তোমাদের গোছগাছ সব কমপ্লিট?

—মোটামুটি।

—শাড়িকাড়ি বেশি নিয়ো না, সালোয়ার কামিজে অনেক ফ্রি থাকবো।

লজ্জা লজ্জা মুখে শরণ্যা বলল, —আপনার ছেলেও তাই বলছিল।

মেয়েটা খালি ‘আপনার ছেলে আপনার ছেলে’ করে কেন? শাশুড়ির সামনে বরের নাম উচ্চারণ করতে সংকোচ? আজকালকার মেয়েদের মধ্যে তো এ রকম সাবেকিপনা থাকা ঠিক নয়। এম-এ পাশ, শিক্ষিত মেয়ে, সে কেন এমন প্রিমিটিভ ভাষায় কথা বলবে!

যাক গে, মরুক গে, এ নিয়ে নিবেদিতার কীসের মাথাব্যথা। নিবেদিতা যেমনটি চাইবেন পুত্রবধূকেও অক্ষরে অক্ষরে তেমনটি হতে হবে, এমন ধারণায় নিবেদিতার বিশ্বাস নেই। পুত্রবধূর ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়াটাও তাঁর রুচিতে বাধে।

ঝোলাব্যাগের চেন আটকাতে আটকাতে নিবেদিতা প্রশ্ন করলেন, —তুমি যেন কী একটা বলতে এসেছিলে?

শরণ্যা বুঝি ভুলেই গিয়েছিল। অপ্রস্তুত মুখে বলল, —ও হ্যাঁ। …আপনার ছেলে চা খেতে চাইছিল। আমি ভাবলাম আপনাকেও একবার জিজ্ঞেস করে যাই।

নিবেদিতা ঘড়ি দেখলেন, —তা খেলে মন্দ হয় না। এখনও হাতে মিনিট পনেরো সময় আছে।

—আমি দু’ মিনিটে করে আনছি।

—তুমি কেন? নীলাচল কোথায়?

—নীলাচলকে আপনার ছেলে কোথায় যেন পাঠাল।

—ও। সাবধানে গ্যাস জ্বেলো।

শরণ্যা হেসে ফেলল, —আমার অভ্যেস আছে মামণি।

ঝুমঝুম গয়নার আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার পর প্রশস্ত ড্রয়িংহলে এসে বসলেন নিবেদিতা। ভারী সোফাটায়। তিরিশ বছর আগে কেনা নামী দোকানের দামি সোফার আয়ু প্রায় শেষ, বসতেই ককিয়ে উঠেছে সোফার স্প্রিং। নিবেদিতার কপালে ভাঁজ পড়ল। এত আওয়াজ হচ্ছে কেন? অনিন্দ্যর বিয়ের হুজুগে সোফার ওপর যথেষ্ট অত্যাচার গেছে, এবার আর না সারালেই নয়। কিন্তু এসব জিনিসের খোলনলচে পুরো বদলাতে যাওয়াও তো অনেক টাকার ধাক্কা। অনিন্দ্যর বিয়েতে জলের মতো খরচা হয়ে গেল। ছেলের বিয়ে বলেই বোধহয় আর্যর হাত থেকে তাও কিছু টাকা গলেছিল, নিবেদিতার সোফাসেটের জন্য সে হাত কি উপুড় হবে? নিবেদিতার চাওয়ার দরকারটাই বা কী। শোভাবাজারের বাড়িটা বিক্রি হল বলে, নিজের ভাগটুকু হাতে এলে ঘরদোরের টুকিটাকি কাজগুলো নিজেই করে নিতে পারবেন নিবেদিতা। বিয়ে উপলক্ষে শুধু দোতলার ঘরেরই তো কলি ফেরানো হল, নীচে ভাড়াটের ঘরগুলো এখনও রং করা বাকি। সুরেন বলছিল গাড়িটাকেও এবার বসাতে হবে, ইঞ্জিনের হাল ভাল নয়।

ভাবনার মাঝেই সামনে অনিন্দ্য। হন্তদন্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ক্যাবিনেটের ড্রয়ারে কী যেন খুঁজছে। পেল না, মাথা ঝাঁকাচ্ছে অস্থির ভাবে। সশব্দে ড্রয়ার বন্ধ করে এপাশে এল। নিচু হয়ে সেন্টারটেবিলের তলার কাগজপত্র ঘাঁটছে। হঠাৎ সোজা হয়ে বলল, —সরো তো একটু।

—কী খুঁজছ?

—এখানে কোথায় যেন একটা খাম রেখেছিলাম।

—কী রকম খাম?

—ব্রাউন কালারের।

—খুব দরকারি?

—নইলে খুঁজছি কেন। অনিন্দ্যর মুখ গোমড়া, —ওর মধ্যে ট্রেনের টিকিট আছে।

—আশ্চর্য, ট্রেনের টিকিট যেখানে সেখানে ফেলে রেখেছ?

—নো লেকচার। পরনে শর্টস টিশার্ট, ফরসা ফরসা চেহারার অনিন্দ্যর গোলগাল কমনীয় মুখে রুক্ষ ভাব, —বলছি তো এখানেই ছিল। তোমার কি নড়ে বসতে অসুবিধে আছে?

—এ ভাবে কথা বলছ কেন? ভদ্র ভাবে বলো।

—কিচ্ছু খারাপ ভাবে বলা হয়নি। হটো, সোফার খাঁজগুলো দেখে নিই।

নিবেদিতা নড়লেন না। অপ্রসন্ন গলায় বললেন, —এখানে কোনও খামটাম নেই। তুমি নিজের ঘরে গিয়ে দ্যাখো।

—তোমার কি সরে বসতে মানে লাগছে?

—অদ্ভুত কথা! মানে লাগার কী আছে?

—বলা যায় না। অনিন্দ্য ঠোঁট বেঁকাল, —ক’দিন ধরে বংশগরিমা নিয়ে যা মটমট করছ। সবার কাছে গিয়ে আমি অমুক বাড়ির মেয়ে, আমার এই ছিল, আমার ওই আছে…

—আহ্ অনিন্দ্য, বিহেভ ইয়োরসেল্‌ফ। বাড়িতে একটা নতুন মেয়ে এসেছে।

—তো?

—নিজের রূপটা কি এখনই তাকে না দেখালে নয়?

জবাবে অনিন্দ্য ফের কী একটা বলতে যাচ্ছিল, টেলিফোন বেজে উঠেছে। বিরক্ত চোখে দূরভাষ যন্ত্রটার দিকে একবার তাকাল অনিন্দ্য, তারপর গটমট ঢুকে গেল ঘরে।

নিবেদিতার চোখেও অসন্তোষ। ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেকে দেখতে দেখতে রিসিভার কানে চাপলেন, —হ্যালো?

—নমস্কার দিদি। আমি নবেন্দু বলছিলাম। শরণ্যার বাবা।

—ও, নমস্কার নমস্কার। নিবেদিতার গলা পলকে মসৃণ, —বলুন কী খবর?

—বুবলিরা…আই মিন শরণ্যারা তো আজ চলল?

—হ্যাঁ, এই তো ছ’টা নাগাদ রওনা দেবে।

—ছ’টা? সর্বনাশ। ও প্রান্তে নবেন্দু যেন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, — মিনিমাম দেড়-দু’ঘণ্টা হাতে নিয়ে বেরোনো উচিত। পিক্ অফিস আওয়ারে যাবে, কোথায় জ্যামে ফেঁসে যায় তার ঠিক আছে!

—না না, পৌঁছে যাবে। ওদের তো অফিসপাড়া দিয়ে যেতে হচ্ছে না, ট্রেন তো ওদের শেয়ালদা থেকে।

—ওই রুটটা তো আরও খারাপ। বেকবাগান মল্লিকবাজার মৌলালি কোন ঘাটে যে আটকে যায়…আজ আবার কাগজে দেখছিলাম কাদের যেন একটা মিছিলও আছে।।

নিবেদিতা উদ্‌বেগটাকে আমল দিলেন না। হাসতে হাসতে বললেন, —মেয়ে জামাইয়ের হানিমুন-যাত্রা নিয়ে আপনি দেখি খুব টেনশানে আছেন?

—আমার আর কী টেনশান। নবেন্দু হেসে ফেললেন, —আসল টেনশান পাবলিক তো বুবলির মা। কাল থেকে দুশ্চিন্তা করে যাচ্ছে। দু’জনেই ছেলেমানুষ…একা একা বেড়াতে যাচ্ছে…

—দু’জনে একা একা কী করে হয় ভাই?

—তবু…বয়সটা কম তো।

একেই বলে মধ্যবিত্ত আহ্লাদিপনা। দুটো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়েছে, তারা যাচ্ছে মধুযামিনী যাপন করতে, বাপ-মা এখনও তাদের জন্য পা ছড়িয়ে বসে ভাববে কেন? বাঙালি অভিভাবকরা কেন যে তাদের ছেলেমেয়েদের বড় হতে দিতে চায় না? চব্বিশ বছরের মেয়েকে কচি খুকিটি ভেবে কী তৃপ্তি পায় তারা?

এমনিতে অবশ্য শরণার বাবা-মাকে বেশ লেগেছে নিবেদিতার। দু’জনেই যথেষ্ট শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল। বিনয়ের অভাব নেই, আবার আচারআচরণে অনাবশ্যক কুণ্ঠা বা জড়তাও নেই। নবেন্দু চাকরি করেন ব্যাঙ্কে, মহাশ্বেতা একটি সরকারি সংস্থার খুদে অফিসার। এমন একটি পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়তে তিনি নিজেই যথেষ্ট আগ্রহী হয়েছিলেন। শুধু এই অকারণ আদিখ্যেতাগুলো যদি না থাকত শরণ্যার বাবা-মা’র।

নিবেদিতা গলায় খানিকটা ব্যক্তিত্ব এনে বললেন, —মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করবেন না। ওরা ঠিক নিজেদেরটা নিজেরা সামলে নেবে।

—আপনার আশীর্বাদ থাকলে নিশ্চয়ই পারবে দিদি।

—বুঝলাম। নিবেদিতা হাসলেন, —তা আপনাদের কি এখনও ছুটি চলছে?

—বুবলি-অনিন্দ্যকে আজ ট্রেনে তুলে দিয়ে তবে ছুটি শেষ। সোমবার থেকে দু’জনেই অফিস জয়েন করব।

—গুড। …শরণ্যাকে ডেকে দেব?

—আছে সামনাসামনি?

চা করছে বলতে গিয়েও সামলে নিলেন নিবেদিতা। বললেন, —ধরুন। ডাকছি।

রান্নাঘর অবধি যেতে হল না, চায়ের ট্রে হাতে এসে পড়েছে শরণ্যা। ফোন ধরতে বলে তার হাত থেকে ট্রেখানা নিয়ে নিলেন নিবেদিতা। ঢুকেছেন ছেলের ঘরে।

খাটের ওপর পোশাক উপচে পড়া দু’খানা স্যুটকেস হাঁ হয়ে পড়ে। একখানা স্যুটকেসের পকেটে কী সব যেন রাখছিল অনিন্দ্য। মার পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় যোরাল।

নিবেদিতা বললেন, —তোমার চা।

—রেখে যাও।

—টিকিট পেলে?

উত্তর নেই।

—সাবধানে যেও।

—হুঁ

—আমি সমিতির অফিসে গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, তোমার শ্বশুর শাশুড়িও সম্ভবত যাচ্ছেন স্টেশনে। ওঁদের মানিকতলায় নামিয়ে দিয়ে সুরেনকে সোজা হাজরায় চলে আসতে বোলো।

—তুমিই তো সুরেনকে বলে দিতে পারো।

কথা না বাড়িয়ে নিজের চা হাতে নিবেদিতা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। শরণ্যা নিবিষ্ট মনে ফোনে কথা বলছে, একটু নিচু গলায়। কী কথা হচ্ছে না হচ্ছে শোনার কৌতূহল অনুভব করলেন না নিবেদিতা, এলেন ঘরের প্রান্তে, ডাইনিং টেবিলে। উষ্ণ পানীয়টুকু শেষ করে পায়ে পায়ে এগোচ্ছেন সিঁড়ির দিকে।

শরণ্যা ফোন রেখে দৌড়ে এল। টিপ করে প্রণাম করল একটা, —দার্জিলিং পৌঁছেই আমরা ফোন করে দেব মামণি।

—অসুবিধে না হলে কোরো। ভুলে গেলেও আমি কিছু মাইন্ড করব না। স্মিত মুখে নিবেদিতা আলগা হাত ছোঁয়ালেন শরণ্যার মাথায়, —আসি তা হলে?

—আচ্ছা।

সিঁড়ির ল্যান্ডিং পর্যন্ত নেমে নিবেদিতা দাঁড়ালেন একটু। চোখ ম্যাজেনাইন ফ্লোরের ঘরখানায়। পরিচিত দৃশ্য। বই-বোঝাই নিচু সিলিংয়ের ঘরখানার এক কোণে ইজিচেয়ারে বসে আছেন আর্য, মুখের সামনে যথারীতি একখানা ভারী কেতাব। পাশে কফির ফ্লাস্ক, পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে চুমুক দেবেন বলে বানিয়ে রেখে গেছে নীলাচল। কফি পানের মেয়াদ অবশ্য বিকেল পর্যন্ত, তারপর আর্যর অন্য পানীয় চাই। দিনের আলো নিবে যাওয়ার পর আর্য কোনও নরম পানীয় স্পর্শ করেন না।

আর্যকে ডাকলেন না নিবেদিতা। কোন দিনই বা ডাকেন! স্বেচ্ছাবন্দি ওই গুহামানবের দরজায় কবেই বা থামেন! আজ তাও খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মানুষটার দিকে। উঁহু, মানুষটাকে নয়, যেন একটা ছবি দেখছিলেন নিবেদিতা। পশ্চিমের বিষণ্ণ আলো জানলার গ্রিল ভেদ করে এসে জাফরি কেটেছে আৰ্যর গায়ে, বুঝি বা আলোছায়া-মাখা সেই নকশাগুলোই টানছিল নিবেদিতাকে। চতুর্দিকে ছড়ানো বই, বুকসেল্‌ফ, আরামকেদারা, টেবিল, স্ট্যান্ডফ্যান, কাগজ, কলম, ডেটক্যালেন্ডার, পেপারওয়েট আর ওই আলোর জাফরিমাখা আর্য—সব মিলেমিশে রচিত হয়েছে এক ইমপ্রেশনিস্ট পেন্টিং। ঘরের ভেতরটা আশ্চর্য রকমের নিশ্চল, বাইরেও বোধহয় বাতাস নেই, আলোটুকুও কাঁপছে না, ঠিক যেন স্টিল লাইফ। বইয়ে ডুবে থাকা আর্যও যেন ওই স্থবির জীবনের অংশমাত্র, ওই ছবির বাইরে আর্যর যেন পৃথক কোনও অস্তিত্বই নেই।

ছবিটাকে অবশ্য বেশিক্ষণ চোখের পাতায় ধরে রাখলেন না নিবেদিতা। নীচে এসে দেখলেন সুরেন গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করে ফেলেছে, অপেক্ষা করছে রাস্তায়। সিগারেট টানছিল সুরেন, নিবেদিতাকে দেখামাত্র ফেলে দিল, চটপট গিয়ে বসল স্টিয়ারিংয়ে। বলল, —গাড়িতে কিন্তু তেল নিতে হবে মাসিমা।

পিছনের সিটে বসে নিবেদিতা দরজা বন্ধ করছিলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, —সেকী? এই তো পরশু দিন না তার আগের দিন পাঁচ লিটার ভরলাম।

—ওইটুকু তেলে পুরনো অ্যাম্বাসাডর কতটুকু যায় মাসিমা? এ গাড়ি তো এখন রাক্ষসের মতো তেল খাচ্ছে।

—কিন্তু গাড়ি তো তেমন বেরোয়নি!

—বা রে, বড়দা বউদি অষ্টমঙ্গলা করতে গেলেন না? মানিকতলা যাতায়াতেই তো…

—এক্ষুনি লাগবে?

—হাজরা গিয়ে নিলেও হবে। রিজার্ভে তো একটু আছে।

—চলো তা হলে।

পাড়াটা পুরনো। রাস্তাঘাট তেমন চওড়া নয়, বাঁকও আছে ঘন ঘন। সুরেনের একটু সাঁইসুঁই করে গাড়ি চালানোর প্রবণতা আছে, কিন্তু এখন সে একদমই গতি তুলছে না। নিবেদিতার কাছে সে কাজ করছে মোটে বছর খানেক, তবে এর মধ্যেই সে নিবেদিতার মেজাজমর্জি বেশ চিনে গেছে। তার শৃঙ্খলাপরায়ণ মালকিন গাড়িতে থাকলে সে কখনওই বেপরোয়া চালায় না।

নিবেদিতা টুকটাক কথা বলছিলেন সুরেনের সঙ্গে। বছর তিরিশ-বত্রিশের সুরেন বউবাচ্চা নিয়ে কাছেই থাকে, কসবায়। সম্প্রতি বাড়িঅলার সঙ্গে তার কিছু সমস্যা চলছে, নিবেদিতা শুনছিলেন সুরেনের সমস্যার কথা। মন দিয়ে। এটা তাঁর স্বভাব। গরিব অসহায় মানুষদের বিপন্নতার কাহিনী তাঁকে ব্যথিত করে।

সুরেনের দেড় বছরের ছেলেটার পেটের অসুখ সারছে না বলে নিবেদিতা রীতিমতো উদ্‌বিগ্ন, —কী করছ কী? ভাল করে ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?

—দেখাচ্ছি তো মাসিমা।

—তোমার ওই হোমিওপ্যাথিতে আর হবে না, এবার অ্যালোপ্যাথি করো। অ্যান্টিবায়োটিকের একটা কোর্স করলে ঠিক হয়ে যাবে।

—কী অ্যান্টি ব্যাটি?

—সে ডাক্তার জানে। তোমাদের কসবায় ভাল ডাক্তার নেই?

—চ্যাটার্জি ডাক্তার আছে। হেব্‌বি ভিড় হয়। একশো টাকা ফিজ্।

নিবেদিতা বুঝে গেলেন আসল সমস্যা ওই ফিজে। সুরেনকে তিনি মাইনে দেন বাইশশো, তবে এ ছাড়াও সুরেনের কিছু উপরি রোজগার আছে। রবিবার তো বটেই, অন্য দিনও ফঁক পেলেই ট্যাক্সি চালায় সুরেন। অবশ্য তা সত্ত্বেও একশো টাকাটা ওর পক্ষে একটু বেশিই।

দু’-এক সেকেন্ড চিন্তা করে নিবেদিতা বললেন, —ঠিক আছে, সমিতির অফিসে গিয়ে তুমি আমায় একটু মনে করিয়ে দিয়ো, আমি বাবুয়াকে একটা চিঠি লিখে দেব। বাবুয়াকে চেনো তো? ওই যে লম্বা মতন, ক্রিকেট খেলে, আমার কাছে আসে মাঝে মাঝে। বাবুয়া একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। সেই যে ভবানীপুরে… আমি নবমীর দিন গেলাম… ওখানে গেলে বিনা পয়সায় তোমার ছেলেকে…

—মাসিমা ! সুরেন হঠাৎ নিবেদিতাকে থামিয়ে দিল, —ওই দেখুন, ছোড়দা!

নিবেদিতা থতমত খেয়ে সামনে তাকালেন। গড়িয়াহাট মোড় পার হয়ে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সিগনালে আটকেছে গাড়ি, বাকি দু’ দিক দিয়ে মুহূর্মুহূ ছুটছে যানবাহন, তারই মাঝে চোখে পড়ল সুনন্দকে। চলন্ত গাড়িঘোড়াকে উপেক্ষা করে অলস মেজাজে রাস্তা পার হচ্ছে। একটা মিনিবাস প্রায় ঘাড়ে উঠে পড়ছিল সুনন্দর। নিবেদিতার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ট্রাফিক সারজেন্ট ধমকে উঠল বিশ্রী ভাবে, ভ্রূক্ষেপ না করে সুনন্দ চলে গেছে ওপারে। ভিড়ে মিশে গেল।

সুরেন বলল, —কাণ্ড দেখলেন মাসিমা ?

—হুঁ।

—এক্ষুনি ফিনিস হয়ে যাচ্ছিল। সুরেন দু’ হাত কপালে ঠেকাল, —জোর বেঁচেছে।

হৃৎপিণ্ড এখনও ধকধক করছে নিবেদিতার। বড় করে একটা শ্বাস টেনে বললেন, —হুঁ।।

—ছোড়দাটা সত্যি কেমন যেন আছে…আলাভোলা… কেমন কেমন… না মাসিমা?

—হুঁ।

—রাস্তায় চলতে চলতেও কী এত ভাবে? ব্যান্ডপার্টির কথা?

তাঁর দুই ছেলের কে যে কখন কোন জগতে থাকে তা যদি জানতেন নিবেদিতা! দু’জন তো দু’ পদের। এক জনের সারাক্ষণ চোয়াল শক্ত। হয় মুখে কুলুপ আঁটা, নয় তো যে কোনও কথাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে হুল ফুটিয়ে চলেছে। মা তোর কোন শত্রু যে মার সঙ্গে অমন ব্যবহারটা করিস? অদ্ভুত ছেলে, সারাটা জীবন হস্টেলে হস্টেলে থাকল, অথচ তেমন কোনও বন্ধু নেই! যতক্ষণ বাড়ি থাকে, দরজা বন্ধ। কী যে ছাই করে নিজের মনে! বিয়ের পরেও এমন হাবভাব, যেন বিয়ে করে নিবেদিতাকে ধন্য করে দিয়েছে! আর ছোটটি তো আর এক কিসিমের। তার বন্ধুর সংখ্যা তত বোধহয় লেখাজোখা নেই। বাড়ির লোককে তিনি তো মানুষ বলেই গণ্য করেন না। কখন আসে, কখন যায়, কোথায় থাকে, তার কোনও ঠিকঠিকানা আছে? জিজ্ঞেস করলে জবাব পর্যন্ত দেয় না, সিগারেট ধরিয়ে ফস ফস ধোঁয়া ছাড়ে মুখের ওপর। ইদানীং তো কোন একটা গানের দলে ভিড়েছে। নীলাচল বলছিল প্রায়ই নাকি দলবল জুটিয়ে চিলেকোঠার ঘরে মহড়া চলে তাদের। এক-দু’ দিন নিবেদিতাও মালুম পেয়েছেন। উত্তন্ড বাজনা বাজিয়ে কী তারস্বরে যে চেঁচায়! সুরেন বোধহয় ওটাকেই ব্যান্ডপার্টি বলছে।

সিগনাল সবুজ হয়েছে, বাঁয়ে ঘুরে হাজরা রোডে ঢুকে পড়েছে গাড়ি। নিবেদিতা অন্যমনস্ক মুখে ভাবছিলেন কেন তাঁর দুই ছেলের একজনও স্বাভাবিক হল না! দু’জনেরই লেখাপড়ায় বেশ মাথা ছিল। অনিন্দ্য তো রীতিমতো ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিল হায়ার সেকেন্ডারিতে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন চাকরিও তো মন্দ করছে না। আশ্চর্য চরিত্র, চাকরি করছে, অথচ একটা ফুটো পয়সা ঠেকায় না সংসারে! নারীসঙ্গের অভাবেই কি মেজাজটা বিগড়েছিল অনিন্দ্য? বিয়ের পর কি শান্ত হবে? হয়তো। সুনন্দই বা কী? বি-কমে তো মোটামুটি ভালই করেছিল, কিন্তু কেন যে আর পড়ল না? চাকরিটাকরিরও তো চেষ্টা করে না। অথচ তার টাকা চাই। আজ একশো, কাল পাঁচশো, পরশু দু’শো…। না পেলে ওই আলাভোলা ছেলে যে কী মূর্তি ধারণ করে, বাইরের লোক তো তা জানে না।

সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটি এসে গেছে। সুরেন হর্ন বাজাতেই মেটে রংয়ের প্রকাণ্ড গেট খুলে দিল জগন্নাথ। সমিতির দ্বাররক্ষী। সামনে সামান্য সবুজ, মাঝখান দিয়ে খোয়া বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে গাড়িবারান্দায়।

নিবেদিতা গাড়ি থেকে নামলেন। গোটা চারেক সিঁড়ি টপকে প্রবেশ করলেন নিজের ঠাকুমার মা’র নামাঙ্কিত সেবা প্রতিষ্ঠানে।

প্যাসেজ দিয়ে ঢুকেই প্রথম ঘরটি সমিতির অফিস। কমিটির মেম্বাররা বেশ কয়েকজন এসে গেছেন। স্বাগতা মঞ্জুলিকা কাকলি জয়শ্রী। জোর গুলতানি চলছে অফিসঘরে।

নিবেদিতাকে দেখে মুহূর্তের জন্য কলতান থেমে গেল। নিবেদিতার বাবা সোমশঙ্কর এই সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা, সেই সূত্রে নিবেদিতা এখানকার আজীবন প্রেসিডেন্ট। সমিতিতে তাঁর একটা আলাদা মর্যাদা আছে, সদস্যরা তাঁকে বেশ সমীহই করে। অল্পস্বল্প ঠাট্টাইয়ার্কিও চলে বটে, তবে নিবেদিতার সম্ভ্রম বাঁচিয়ে।

স্বাগতা উঠে দাঁড়িয়ে লঘু স্বরে বললেন, —ওয়েলকাম নিউ মাদার-ইন-ল, ওয়েলকাম।

মঞ্জুলিকা বলে উঠলেন, —উফ্ নিবেদিতাদি, কত দিন পর আপনি এলেন বলুন তো! আপনাকে ছাড়া সব যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।

সমিতির সেক্রেটারি অর্চনা মৈত্র কাজ করছেন টেবিলে বসে। বয়স বছর পঞ্চাশ, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, মুখমণ্ডলে বেশ একটা দৃপ্ত ভাব আছে।

অর্চনার ঠোঁটেও স্মিত আহ্বান। কলম বন্ধ করে প্রশ্ন ছুড়লেন, —সংসার এখন কেমন লাগছে নিবেদিতাদি? হাউ ইজ লাইফ?

ক্ষণপূর্বের দীর্ঘশ্বাস মুছে ফেলেছেন নিবেদিতা। এই বাড়িটায় ঢুকলেই তাঁর মন অন্য রকম হয়ে যায়। ছেলে স্বামী সংসার সব যেন তখন পলকে বহুদূর। আজ বলে নয়, চিরকালই।

নিবেদিতা দু’ গাল ছড়িয়ে হাসলেন, —খুব ভাল লাগছে। এক্সেলেন্ট। …এই, আর সবাই গেল কোথায় ? চলো চলো। কাজকর্ম শুরু করে দিই।

.

০২.

আজকেও দার্জিলিংয়ের মনমেজাজ ভাল নেই। চাপ চাপ মেঘে ছেয়ে আছে চারদিক, পাঁশুটে ধোঁয়া ঢেকে রেখেছে শহরটাকে। বিষাদের প্রলেপ মেখে ঝিমোচ্ছে পাহাড়ের রানি।

অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। কোথায় এই শেষ হেমন্তে দার্জিলিংয়ের আকাশ ঝকঝকে নীল থাকবে, পেতলরঙা রোদ্দুর নেচে বেড়াবে পাহাড়ে পাহাড়ে, তা নয়, সারাক্ষণ শুধু ধূসর বাষ্পের মিছিল। শরণার কপালটাই খারাপ, পৌঁছে ইস্তক এখনও একবারও কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে দেখা হল না। পরশু যখন দার্জিলিংয়ে পা রাখল, তখনই বৃষ্টি চলছিল। বিনবিনে কান্নার মতো। একটানা। একঘেয়ে। কাল একটুক্ষণের জন্য সূর্যের মুখ দেখা গিয়েছিল বটে, কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফচূড়াগুলো ছিল মেঘের আড়ালে। আর আজ তো সকাল থেকেই এই হাল।

চমৎকার একটা হোটেলে উঠেছে শরণ্যারা। ম্যালের ঠিক ওপরে, উত্তর দিকটা পুরো খোলা। কিন্তু লাভ কী! হিমালয় তো দূরস্থান, বিশ-পঞ্চাশ হাত দূরের গাছপালারাও কেমন ঝাপসা ঝাপসা। বন্ধ কাচের জানলা দিয়ে মেঘ দেখে দেখে শরণার চোখ ব্যথা হয়ে গেল। এতক্ষণ তাও একটু দিন দিন মতো ছিল। এখন পাহাড়ে আঁধার। সন্ধে নামছে।

শরণ্যা সরে এল জানলা থেকে। দুপুর থেকেই লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে অনিন্দ্য, এখনও তার ওঠার নামটি নেই। গোমড়া মুখে তাকে টুকুন দেখল শরণ্যা। কী বিটকেল ছেলে রে বাবা! হানিমুনে এসে কোনও বর এমন পড়ে পড়ে নাক ডাকায় কেউ জন্মে শুনেছে! হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হল তো বউকে পাগলের মতো খানিক ঘেঁটে নিল, তার পরই ভোঁস ভোঁস ঘুম। এদিকে শরণ্যা যে একা একা বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়ালই নেই। ছেলেটা যেন কেমন কেমন! বিয়ের পর প্রথম বেরিয়েছে দু’জনে, কোথায় বউয়ের গায়ে গা লাগিয়ে বসে বকবক করে যাবে, এলোমেলো খুনসুটি করবে, মেঘকে তুড়ি মেরে বউয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়বে দুমদাম… উঁহু, ওসবে অনিন্দ্যর আগ্রহই নেই। বেশ বেরসিক। ফুলশয্যার রাতেও কী আজব ব্যবহারটাই না করল। ফুলে ফুলে সুরভিত হয়ে আছে শয্যা, গাঢ় নীল রাতবাতি জ্বলছে, ঘর জুড়ে স্বপ্ন স্বপ্ন পরিবেশ, সেখানে কিনা নতুন বর দরজা বন্ধ করেই বোম্বেটে সাইজের হাই তুলছে! হ্যাঁ, সারা সন্ধে বউভাতের ধকল গেছে খুব, ক্লান্ত হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। শরণ্যারও তো শ্রান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিল, কিন্তু…! শরণ্যা কত কী আশা করেছিল সেদিন। হুট করে বিয়েটা হয়ে গেল, ভাল করে আলাপ পরিচয় পর্যন্ত হয়নি, ফুলশয্যার রাতে অনিন্দ্য তার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলবে, ঘোর-লাগা চোখে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে, চিনতে চাইবে তাকে, জানতে চাইবে, তারপর…। কিন্তু আদতে কী ঘটল? স্রেফ একটা আনাড়ি চুমু, এবং ঘুমিয়ে পড়ো বলে বিছানায় ধপাস, একেবারে কুম্ভকর্ণের নাতজামাই।

উপমাটা মাথায় আসতেই শরণ্যা ফিক করে হেসে ফেলল। সে কি তা হলে কুম্ভকর্ণের নাতনি? হি হি হি। আপন মনে হাসতে হাসতে ফের অনিন্দ্যকে নিরীক্ষণ করল শরণা। ছেলেটার শোওয়াটাও ভারী অদ্ভূত! মুখটি দেখার জো নেই, আপাদমস্তক ঢাকা। এখানে নয় শীত, কিন্তু কলকাতায়? ক’দিন ধরেই তো দেখছে শরণ্যা, কক্ষনও ঘুমন্ত মুখখানাকে ভোলা রাখে না অনিন্দ্য। হয় আড়াআড়ি হাতে আড়াল করে রাখে, নয়তো মুখ গুঁজে দেয় বালিশে। রাগ হলে বাচ্চারা যে ভাবে মুখ লুকোয়, অনেকটা যেন সে রকম ভঙ্গি। দেখতে যেমন গাবলুগুবলু, হাবভাবও ঠিক তেমনই। ছেলেমানুষ, এক্কেবারে ছেলেমানুষ।

শরণ্যা ঘড়ি দেখল। পাঁচটা পঁচিশ। ইস, কোনও মানে হয়? এই ঘুমকাতুরে ছেলেটার লেপের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই কি আরও একটা সন্ধে কেটে যাবে? নাহ্, একে এবার জাগানো দরকার।

অনিন্দ্যর মুখ থেকে আস্তে করে লেপটাকে সরাল শরণ্যা। ঝুঁকে ডাকল, — এই যে, শুনছ?

কোনও সাড়া নেই।

শরণ্যা মজা করে বলল, —কী হল, ওঠো। ডিনারের সময় হয়ে গেছে। খেতে যেতে হবে।

অনিন্দ্য নিশ্চল।

এবার এক টানে অনিন্দ্যর গা থেকে লেপটাকে সরিয়ে দিল শরণ্যা। সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠেছে অনিন্দ্য। কুঁকড়েমুকড়ে উপুড় হয়ে মুখ গুঁজল বালিশে। জড়ানো গলায় বলল, —আহ্, কী করছ কী? লেপটা দাও। আমি জেগেই আছি।

—তার মানে এতক্ষণ মটকা মেরে পড়ে আছ? কী ছেলেরে বাবা! ওঠো, শিগ্‌গির ওঠো।

—কেন?

—একটু বেরোব না?

চোখ রগড়াতে রগড়াতে অনিন্দ্য উঠে বসল। —এই ওয়েদারে কোথায় যাবে?

—ঘুরব। হাঁটব, ম্যালে গিয়ে বসব। আকাশে মেঘ আছে বলে কেউ দার্জিলিংয়ে এসে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে? শরণ্যা ঠোঁট ফোলাল, —কালও তো ওয়েদারের ছুতো দেখিয়ে নড়লে না, ঘরে বসে বসে ড্রিঙ্ক করলে।

অনিন্দ্যর চোখে সামান্য চাঞ্চল্য দেখা গেল যেন। হাত বাড়িয়ে লেপটাকে টেনে নিয়ে জড়িয়েমড়িয়ে বসেছে। ভাবল কী একটা। তারপর বলল, — অলরাইট, চলো। আজ তো একবার ম্যালে যেতেই হবে।

শরণ্যা সামান্য অবাক, —কেন?

হাত বাড়িয়ে শরণ্যার গালে আলতো টোকা দিল অনিন্দ্য, —আর একটা বোতল কিনতে হবে ডার্লিং।

—আবার কেন? একটা গোটা বোতল তো এখনও স্যুটকেসে রয়েছে!

—যেটা নীলাচল এনে দিয়েছিল? তোমায় বললাম যে, ওটা আমার চলবে না।

—না চলার কী আছে? ওটাও তো হুইস্কিই!

—ওটা রয়্যাল স্ট্যাগ। বাবার ব্র্যান্ড। আমি আর্য মুখার্জির ব্র্যান্ড ছুঁই না।

অনিন্দ্যর স্বরে প্রচ্ছন্ন বিরাগ। শরণ্যা আমল দিল না। চোখ টিপে বলল, — তুমি কী খাও আর্যপুত্র ? মেয়ে হরিণ?

রসিকতাটা বুঝলই না অনিন্দ্য, আরও গোমড়া হয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে বলল, —আর্যপুত্র বলে ডাকতে তোমাকে না বারণ করেছি?

—আহা, বারণ করলেই শুনতে হবে ? শরণ্যা তর্ক জুড়ল,— আর্যপুত্র ডাকটা খারাপ কী? আগেকার দিনে বরকে তো আর্যপুত্র বলাই রেওয়াজ ছিল। পরশুরাম পড়োনি? হিড়িম্বাও ভীমকে…

—ফাজলামি কোরো না। আমার ওই ডাকটা একদম পছন্দ নয়।

—তোমায় তা হলে কী বলে ডাকব? তোমার তো কোনও ডাকনামও নেই!

—নেই তো নেই। অনিন্দ্য বলে ডাকবে।

অনিন্দ্যর চটে যাওয়াটা উপভোগ করছিল শরণ্যা। তবু যা হোক কথা তো বলছে দুটো-চারটে। সারাক্ষণ মুখ বুজে থাকলে কী করে অনিন্দ্যর মনের জানলা খুলবে শরণ্যা।

অনিন্দ্যকে আর একটু উসকে দেওয়ার জন্য শরণ্যা গলায় আদুরে ভাব ফোটাল, —যাই বলো, এটা কিন্তু খুব স্ট্রেঞ্জ। তোমার কোনও ডাকনাম নেই, তোমার ভাইয়ের কোনও ডাকনাম নেই…!

—তো?

—কেন নেই?

—কেউ রাখেনি, তাই। ডাকনাম ধরে ডাকার মতো কারও ইচ্ছে ছিল না, তাই। কিংবা সময় ছিল না কারও।

অনিন্দ্যর স্বরে যেন ক্ষোভের আভাস। ক্ষোভ? না অভিমান? বাবা-মার ওপর অনিন্দ্যর একটা রাগ আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ছেলে তো মা-বাবার কাছে ঘেঁষেই না। বিয়ের পর শরণ্যাকে নিয়ে ফার্ন রোডের বাড়িতে যখন প্রথম ঢুকল অনিন্দ্য, মা-বাবাকে প্রণাম পর্যন্ত করল না। কে জানে হয়তো বা প্রণাম না-করাটাই ও বাড়ির রীতি। খাবার টেবিলে একসঙ্গে বসলেও মা-বাবার সঙ্গে কদাচিৎ বাক্যালাপ হয় ছেলের, নজরে পড়েছে শরণ্যার। দার্জিলিংয়ে এসে নিবেদিতাকে পৌঁছোনো সংবাদ দিতে চাইল শরণ্যা, তাতেও অনিন্দ্যর ঘোর আপত্তি। তোমার বাবা-মাকে ফোন করতে চাও করো, ফার্ন রোডে জানানোর প্রয়োজন নেই! আর্য মুখার্জির ছেলে আর্যপুত্র ডাক শুনেই বা চটে যায় কেন?

বিয়ের সময়ে কি কোনও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে? পারিবারিক অন্তর্কলহ? কে জানে বাবা কী ব্যাপার, তবে শরণ্যার তো অনিন্দ্যর বাড়ির লোকজনকে বেশ লেগেছে। সবাই যে যার মতো থাকে, কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলায় না। শরণ্যারই ভাল, দিব্যি স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবে শ্বশুরবাড়িতে। অনিন্দ্যর বাবা তো নিপাট ভালমানুষ। এক্কেবারে নির্বিরোধী। পণ্ডিত ব্যক্তি, এক সময়ে কলেজে পড়াতেন, মিউজিয়ামেও চাকরি করেছেন দীর্ঘকাল, এখন পড়ে থাকেন শুধু বইয়ের জগতে। শ্বশুরমশাইকে দিনে একটা-দু’টোর বেশি দুটো কথা বলতে শোনেনি শরণা। সন্ধেবেলা একটু ঢুকু ঢুকু করার অভ্যেস আছে, তবে মোটেই নেশাড়ু নন। নেশা নাকি তাঁর একটাই। খবরের কাগজ ম্যাগাজিনে দিস্তে দিস্তে চিঠি লেখা। আর শরণ্যার শাশুড়ি তো রীতিমতো মহীয়সী মহিলা। সামান্যতম গোঁড়ামি নেই, মিছিমিছি শুয়ে বসে অলস জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত নন, কত রকম সমাজসেবামূলক কাজকর্ম করে বেড়ান, এমন শাশুড়ি পাওয়া তো অনেক ভাগ্যের কথা। শ্বশুরবাড়ি আসার আগে মা পই পই করে বলে দিয়েছিল, অত বড় বনেদি বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে, গিয়েই যেন শাড়ি পরব না শাড়ি পরব না বলে বায়না জুড়ো না… অথচ শরণ্যাকে মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে হল না, শাশুড়িই যেচে সালোয়ার-স্যুট পরার পারমিশান দিয়ে দিলেন শরণ্যাকে। কত উদার! শুধু শরণ্যার দেওরটি যা একটু উড়ুউড়ু। তবে মোটেই অভদ্র নয়। তেমন আলাপী হয়তো নয়, কিন্তু শরণ্যা যেচে কথা বললে ভাল ভাবেই তো উত্তর দেয়, এবং কথাবার্তাও যথেষ্ট মার্জিত! এমন সভ্য ভদ্র পরিবারে তেমন বড়সড় বিবাদ কী থাকতে পারে?

থাকলে আছে, না থাকলে নেই। হানিমুনে এসে ওই কাল্পনিক দুশ্চিন্তায় কেন পীড়িত হবে শরণ্যা! তবে হ্যাঁ, অনিন্দ্যর মনে যদি কোনও কষ্ট থাকে, শরণ্যা তা মুছে দেবে।

পাশে বসে অনিন্দ্যর গলা জড়িয়ে ধরল শরণ্যা। ছেলেভুলোনো গলায় বলল, —ডাকনাম নেই বলে খুব দুঃখ মনে হচ্ছে? বেশ, আমি তোমাকে একটা নাম দিচ্ছি।

অনিন্দ্য খুশি হল কি না বোঝা গেল না। চুপ করে আছে।

শরণ্যা একটু চুমু খেল অনিন্দ্যকে। ফিসফিস করে বলল, —আজ থেকে তুমি অনি। আমার অনি। খুশি?

হঠাৎ অনিন্দ্য যেন গলে গেল। লেপের ভেতর টেনে নিয়েছে শরণ্যাকে। মুখ গুঁজে দিল শরণ্যার বুকে। নাক ঘষছে শরণ্যার ঘাড়ে গলায়। দু’ বাহুতে পিষছে শরণ্যার তুলতুলে শরীর।

আদরটাকে বেশ খানিকক্ষণ উপভোগ করল শরণ্যা। তীব্র কামে বিবশ হয়ে আসছে দেহ, কেমন কেমন যেন করছে ভেতরটা। অজান্তেই দু’হাত আঁকড়ে ধরল অনিন্দ্যকে, নখ বিঁধে যাচ্ছে অনিন্দ্যর পিঠে। মাত্র ক’দিন হল এই অচেনা সুখের স্বাদ পেয়েছে শরীর, স্নায়ুকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না শরণ্যা। রাখার ইচ্ছেও নেই।

হঠাৎই দরজায় টকটক। সচকিত শরণ্যা কোনওক্রমে ছাড়াল নিজেকে। আলুথালু বেশ মোটামুটি ঠিকঠাক করে দরজা খুলল। বেয়ারা। এমন একটা প্রগাঢ় মুহূর্তে লোকটার হাজির হওয়ার কোনও অর্থ হয়!

—চা খাবেন না মেমসাব?

শরণ্যা নয়, অনিন্দ্যই অন্দর থেকে রুক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, —কিছু লাগবে না।ভাগো হিঁয়াসে।

মধ্যবয়স্ক নেপালি কর্মচারীটি থতমত খেয়ে পালাচ্ছে। যেতে যেতেও ঘুরে ঘুরে দেখছিল, শরণ্যা দরজা বন্ধ করে দিল। নিজেরও একটু একটু রাগ হয়েছিল বটে, কিন্তু অনিন্দ্যর হাঁড়িমুখখানা দেখে হেসে ফেলল। চোখ ঘুরিয়ে বলল,— ঠিক হয়েছে। একে কী বলে জানো? দেয়ার ইজ মেনি আ স্লিপ্ বিটুইন দা কাপ অ্যান্ড দা লিপ। কিংবা বাড়া ভাতে ছাই।

অনিন্দ্য ছটফট করছিল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল,— লেট কোরো না। এসো।

—উঁহু। গোটা রাত পড়ে আছে। এখন চটপট ড্রেস করে নাও। বেরোব।

অনিন্দ্যকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অ্যান্টিরুমে চলে এল শরণ্যা। এখানেই ড্রেসিংটেবিল, এখানেই ওয়ার্ড্রোব। স্যুটকেস থেকে খান চারেক সালোয়ার স্যুট বার করে সাজিয়ে রেখেছে ওয়ার্ড্রোবে, খান দুয়েক জিণ্‌স টিশার্টও। আজ সালোয়ার কামিজ নয়, জিণ্‌স পরবে। গাঢ় নীলটা নয়, ফ্যাকাশে নীল। এমন ওয়েদারে উজ্জ্বল নীল বেমানান।

নাইটি হাউসকোট ছেড়ে ডেনিম ট্রাউজারখানা পরে নিল শরণ্যা, লাল টুকটুকে টিশার্টের ওপর চড়াল বহুরঙা পোলোনেক্ সোয়েটার। তারপর এসে বসল আয়নার সামনে। ভাল করে ক্রিম মাখছে। শরণ্যা কখনওই চড়া মেকআপ করে না। তার গায়ের রংটি শ্যামলা, কিন্তু নাক চোখ মুখ ভারী নিখুঁত, প্রায় দেবীপ্রতিমার আদলে গড়া, উগ্র প্রসাধনের তার প্রয়োজনই হয় না। সযত্নে আইলাইনার বোলালো চোখে, সূক্ষ্ম রেখার বেষ্টনীতে আরও গভীর হল শরণ্যার কালো চোখ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ছোঁয়াল, আরও যেন প্রস্ফুটিত হল ওষ্ঠাধর। চিকন চিকন চুল মেলে দিল পিঠে। সিঁথির রক্তিম চিহ্নটুকু ছাড়া তাকে এখন আর নববধূ বলে চেনাই দায়।

অনিন্দ্য এমন সাজে এই প্রথম দেখছে শরণ্যাকে। চোখ সরাতে পারছে না।

শরণ্যা ভুরু নাচিয়ে বলল, —কী দেখছ ড্যাবডেবিয়ে? গিলে ফেলবে নাকি?

অনিন্দ্য অস্ফুটে বলল, —উঁহু, চিবিয়ে চিবিয়ে খাব।

—ইস, আমি বুঝি খাবার?

—খাবারই তো। দা বেস্ট অ্যান্ড দা মোস্ট ডিলিশাস্ ফুড।

—বটে? শরণ্যা দুলছে মৃদু মৃদু, —কী রকম ফুড শুনি? চাইনিজ? না কন্টিনেন্টাল?

—মুঘলাই। খাস লখ্‌নৌয়ের বিরিয়ানি।

—দেখো, খেয়ে যেন অ্যাসিড না হয়। দেহে বিচিত্র হিল্লোল তুলে চেয়ার টেনে বসল শরণা। গরম মোজা পায়ে গলাতে গলাতে বলল, —এই, একটা রিকোয়েস্ট করব? রাখবে?

অনিন্দ্য লেপ ছেড়ে উঠে আড়মোড়া ভাঙছিল। বলল, —শুনি তো আগে।

—আজ ড্রিংক কোরো না প্লিজ।

—কেন?

—এমনি। না খেলে কী হয়?

—খেলেই বা কী হয়? তুমিও তো কাল সিপ দিয়েছিলে, খারাপ লেগেছিল?

—তুমি তো চুমুকে থামবে না, ঢকঢক চালাবে। কাল তো আউট হয়ে ঘুমিয়েই পড়লে। ছিঃ, কী বিচ্ছিরি।

—কোনটা বিচ্ছিরি? ড্রিংক করাটা? না ঘুমিয়ে পড়াটা?

—দুটোই।

অনিন্দ্য অ্যান্টিরুমে পোশাক বদলাতে যাচ্ছিল, ভুরু কুঁচকে ঘুরে তাকাল,— তোমার কি ড্রিংক করা নিয়ে কোনও ট্যাবু আছে?

শরণ্যা চট করে জবাব দিতে পারল না। মদ্য পান নিয়ে তার তেমন ছুঁৎমার্গ সত্যিই নেই। তার বাবাও তো খায় মাঝেমধ্যে। তবে মাঝেমধ্যেই। অথবা কালেভদ্রে। শরণ্যার ছোটমামা হঠাৎ হঠাৎ দিদির বাড়িতে হানা দিয়ে হিড়িক তুলতে শুরু করে, —ও নবেন্দুদা, গা’টা ম্যাজম্যাজ করছে, আজ একটু হয়ে যাক। শুনেই হাঁ হাঁ চেঁচাতে থাকে মা, আর বাবা কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে পা টিপে টিপে চুপিসাড়ে বেরিয়ে যায়, ফেরে কাগজে মোড়া ছোট্ট একখানা বোতল নিয়ে, সঙ্গে গাদা গাদা চানাচুর আর আলুভাজা। গজগজ করতে করতে মা শসাটা পেঁয়াজটা কেটে দেয়, পকোড়াও ভেজে দেয় কখনও কখনও। তারপর দরজা জানলা বন্ধ করে, পাড়াপ্রতিবেশীর দৃষ্টি বাঁচিয়ে শুরু হয় শালা-ভগ্নিপতির মদ্যপান। সে এক দৃশ্য! খাওয়ার পর বাবা গোটা ফ্ল্যাট হেঁটে হেঁটে দেখে পা টলছে কিনা! দু’মিনিট অন্তর অন্তর শরণ্যার মুখের কাছে মুখ এনে প্রশ্ন, অ্যাই বুবলি, গন্ধ পাচ্ছিস? ঠাম্মার ঘরে তো তখন কেটে ফেললেও ঢুকবে না বাবা। একদিন ওই সময়ে বেলগাছিয়া থেকে ছোটঠাম্মার ফোন এসেছিল, রিসিভার তুলে কথা বলতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে মুখে রুমাল চাপা দিয়েছিল বাবা। দেখে শরণ্যা আর শরণ্যার মা হেসে কুটিপাটি। এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা শরণ্যার মদ্যপান তো একটু বাধো বাধো ঠেকতেই পারে।

আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে শরণ্যা বলল,— নাহ্, ট্যাবু কীসের। চলো, বেরিয়ে পড়ি।

হোটেলের বাইরে এসে অনিন্দ্য বলল,— উফ্, কী শীত!

মেঘের বজ্জাতি কমেছে খানিকটা, পথঘাট এখন কিছুটা স্বচ্ছ। আকাশ একটু পরিষ্কার হওয়ার দরুনই বুঝি ঠান্ডা ঝপ করে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। হাওয়া বইছে অল্প অল্প। কনকনে। বরফের ছুরির মতো।

শরণ্যা শীতলতাটা দিব্যি উপভোগ করছিল। হাসতে হাসতে বলল, —দার্জিলিংয়ে ঠান্ডা থাকবে না তো কি লু বইবে?

ঠাট্টাটা যেন ছুঁল না অনিন্দ্যকে। বলল, —রুম থেকে মাংকিক্যাপটা নিয়ে এলে হত।

—অ্যাই, হানিমুনে এসে মাংকিক্যাপ পরতে নেই।

অনিন্দ্যর হাত ধরে টানল শরণ্যা। নামছে। হোটেল থেকে ম্যাল মিনিট পাঁচেকের পথ। গোটাটাই উতরাই। ভিজে পাহাড়ি রাস্তা। পিছল। শরণ্যা সাবধানে পা ফেলছিল। বাইরের শৈত্য আর অনিন্দ্যর হাতের তালু থেকে সঞ্চারিত তাপ মিলে মিশে ভারী অদ্ভুত এক অনুভূতি চারিয়ে যাচ্ছে শিরা উপশিরায়। এ যেন শুধু সুখ নয়, আনন্দ নয়, তৃপ্তি নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। এক অজানা রোমাঞ্চ। অচেনা শিরশিরে ভাললাগা।

হাঁটতে হাঁটতে শরণ্যা বলল, —দেখেছ অনি, ওয়েদারটা কেমন ঝুপ করে ভাল হয়ে গেল! দ্যাখো দ্যাখো, একটা-দুটো তারাও ফুটেছে আকাশে!

অনিন্দ্য আলগা ভাবে বলল, —হুঁ।

—ভাবতে কী অবাক লাগে, তাই না? শরণ্যার চোখে স্বপ্ন স্বপ্ন ঘোর, —মাত্র ক’দিন আগেও তুমি আমায় চিনতে না, আমিও তোমায় চিনতাম না… আর আজ কলকাতা থেকে কত দূরে একটা নির্জন পাহাড়ে দু’জনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছি!

অনিন্দ্য ফের আলগা ভাবে বলল, —হুঁ।

—হঠাৎ করে তুমি কেমন আমার আপন হয়ে গেলে ! সব থেকে কাছের লোক!

—হুঁ।

—কী তখন থেকে হুঁ হুঁ করছ? অনিন্দ্যর মেয়েলি ধাঁচের নরম নরম হাতের তালুতে চাপ দিল শরণ্যা, —কিছু বলল।

—কী বলব?

—কিন্তু অন্তত বলো। এখনই তো কথা বলার সময়। এরপর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তুমি তো সেই সকালে অফিসে বেরিয়ে যাবে, সন্ধেবেলা ফিরবে, আর আমি… অ্যাই অনি, আমিও কিন্তু রিসার্চে জয়েন করে যাব।

এবার আর হুঁ হ্যাঁ কিছু নেই।

শরণ্যা উৎসাহভরে বলল, —আমি কী নিয়ে কাজ করব, আন্দাজ করতে পারো? …পারলে না তো? আমার স্যার, মানে পি. এস. বি, অ্যাডাল্ট এডুকেশানের ওপর কাজ করছেন। আমাকেও বলেছেন ওই লাইনেই একটা কোনও টপিক তৈরি করে দেবেন। ডাটা কালেকশানের জন্য তখন কিন্তু আমায় খুব ছোটাছুটি করতে হবে। এই লাইব্রেরি, ওই লাইব্রেরি…। বেশি ফিল্‌ডওয়ার্ক যদি করতে হয় তা হলে তো গেলাম। কোথায় কোন গ্রামেগঞ্জে ঘুরে স্যাম্পল কালেকশান করতে হয় তার ঠিক কী? সুন্দরবন বেল্টটা নিয়ে স্যারের খুব আগ্রহ, হয়তো ওদিকেও ছুটতে হতে পারে। তবে বেস্ট হয় যদি রেডিলি অ্যাভেলেবল্ ডাটা অ্যানালিসিস করে পেপার তৈরি করা যায়। ঝক্কি কত কম বলো? বইটই নিয়ে এসে ঘরে বসেই কাজ করতে পারি। ভাল হবে না তা হলে, বলো?

অনিন্দ্যর সংক্ষিপ্ত উত্তর, —হুঁ।

শরণ্যা টের পেল অনিন্দ্য তার কথা মোটেই মন দিয়ে শুনছে না। জেরার ঢঙে প্রশ্ন করল, —অ্যাই ছেলেটা, এতক্ষণ কী বললাম বলো তো?

অনিন্দ্য যেন সচকিত হল, —অ্যাঁ?

—এত অন্যমনস্ক কেন? কী ভাবছ?

—না মানে… কানে বড্ড ঠান্ডা লাগছে, অন্তত মাফলারটা যদি নিয়ে আসতাম।

ঘর-লাগা মুহূর্তটা পলকে ছিঁড়ে গেল শরণ্যার। কী একবগ্না ছেলে রে বাবা! একবার মাথায় ঢুকেছে ঠান্ডা লাগছে তো ঠান্ডাই লাগছে, ঠান্ডার বাইরে আর কিছু ভাববেই না! যে সব ছেলেরা কম কথা বলে, তারা কি শুধু এ ভাবেই নিজের মধ্যে ডুবে থাকে? শরণ্যার বন্ধু চৈতালির বরটাও নাকি এমন উৎকট টাইপ ছিল, কড়া দাওয়াই দিয়ে চৈতালি তাকে সিধে করেছে। ঘড়ি মেপে টানা দু’ঘণ্টা গল্প না করলে বরকে নাকি অঙ্গ স্পর্শ করতে দেয় না চৈতালি। শরণ্যাকেও কি ও রকম কোনও একটা ওষুধের কথা ভাবতে হবে ?

ম্যাল এসে গেছে। ট্যুরিস্ট সিজন নয়, চত্বরটা এখন প্রায় ফাঁকা। এক-আধ জোড়া কপোত-কপোতী বসে আছে বেঞ্চে, ঘোরাফেরা করছে স্থানীয় লোকজন। আশপাশের দোকানপাট ঝলমল করছে আলোয়, ঠিকরে-আসা দ্যুতিতে খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে আছে ম্যাল।

অনিন্দ্যকে টানতে টানতে শরণ্যা ম্যালের প্রান্তে এসে দাঁড়াল। রেলিংয়ের ওপারে পাহাড় জঙ্গল চা বাগান লোকবসতি সব ডুবে আছে কুয়াশা-মাখা অন্ধকারে, তাকিয়ে থাকলে কেমন গা ছমছম করে। হঠাৎ কোথ্থেকে যেন ধেয়ে আসে উড়ো মেঘ, জলীয় বাষ্প স্যাঁতসেঁতে করে দিয়ে যায় মুখচোখ।

একটা পাহাড়ি কিশোর এসে সামনে দাঁড়াল,— হর্স রাইডিং করবেন বিবিজি?

শরণ্যা অবাক মুখে বলল, —এই অন্ধকারে হর্স রাইডিং?

ছেলেটা ঘ্যানঘেনে সুরে বলল, —চলুন না বিবিজি।সারাদিন কামাই নেই… বেশি লাগবে না, ওনলি টোয়েন্টি রুপিজ।

হাড়জিরজিরে গোটা তিন-চার টাট্টুঘোড়া চরছে ম্যালে। তাদের ঝলক দেখে নিয়ে শরণ্যা বলল, —মাথা খারাপ! এই অন্ধকারে ওই ঘোড়ায় চড়ে মরি আর কি!

—কিছু হবে না বিবিজি। সাব আর আপনি দুটো ঘোড়া নিয়ে নিন, আমি আপনাদের সাথ সাথ থাকব।।

শরণ্যা অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করল, —কী, চড়বে?

জোরে জোরে মাথা নাড়ল অনিন্দ্য, —না না, ও আমার পোয় না।

শরণ্যা চাপা গলায় বলল, —আহা, চলোই না। বেচারা এত করে বলছে, ওর একটু রোজগারও হয়।

—ওর ইনকাম হবে বলে আমায় ঘোড়ায় চড়তে হবে? তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও।

—একা যাব?

—সে তুমি বোঝে।

না’ই বলে দিতে যাচ্ছিল শরণ্যা, পাহাড়ি ছেলেটার দিকে চোখ পড়তে থমকে গেল। ভারী কাতর মুখে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। শুকনো শুকনো চেহারা, গায়ে একটা জীর্ণপ্রায় মলিন ফুলসোয়েটার লগবগ করছে। শরণ্যা রাজি হয়ে গেলে কুড়িটা টাকা তো উপার্জন হয়।

সামান্য ইতস্তত করে শরণ্যা বলল, —চলো। ঘোড়া কিন্তু জোরে চালিয়ে না। বলেই অনিন্দ্যকে হাত নাড়ল হাসি হাসি মুখে,— একটা পাক মেরে আসি তা হলে? তুমি ততক্ষণ বসে বসে একটু ঝিমিয়ে নাও।

সন্তর্পণে বেঁটে ঘোড়ার পিঠে চাপল শরণ্যা। ঘোড়া চলেছে দুল্‌কি চালে, লাগামখানা ধরে আছে পাহাড়ি কিশোর। পাকদণ্ডী বেয়ে প্রথমে খানিকটা নামতে হয়, তারপর চড়াই ধরে ফের ম্যালে উঠে আসা, সময় লাগে বড় জোর মিনিট পনেরো, জানে শরণ্যা। এর আগেও মা-বাবার সঙ্গে দার্জিলিংয়ে এসে চড়েছে ঘোড়ায়। তখন শরণার বোধহয় ক্লাস সেভেন। সেবার ঘুরতে ফিরতে ঘোড়ায় চাপত শরণ্যা, আর বাবা সর্বক্ষণ ছায়ার মতো থাকত সঙ্গে সঙ্গে। সহিসের ওপর ভরসা নেই, যদি ঘোড়া জোরে জোরে ছোটায়, যদি বুবলি পড়ে যায়! ম্যালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মা’রও কী টেনশান। অ্যাই, ঘোড়া খাদের ধারে যায়নি তো? এবার যেন একটু বেশি সময় লাগল, ঘোড়া কি অন্য দিকে চলে গেছিল ?

আজ আলোছায়া মাখা শুনশান পাকদণ্ডীতে শরণ্যা একা।

ভাসমান মেঘে মাঝে মাঝেই ঢেকে যাচ্ছিল শরণ্যা। বুকটা ভার হয়ে গেছে। কী করছে এখন বাবা মা? শরণ্যাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে খুব মনখারাপ? নিশ্চয়ই এতক্ষণে অফিস থেকে ফিরে এসেছে দু’জনে, তারপর টিভি চালিয়ে বসে আছে চুপটি করে। এই মুহূর্তে তারাও হয়তো তাদের বুবলির কথাই ভাবছে। ট্রেন ছাড়ার আগে মা সেদিন বলছিল ঠাম্মার নাকি জ্বর-জ্বর মতো হয়েছে। এখন কেমন আছে ঠাম্মা? পরশু ফোন করার সময় ঠাম্মার খবরটা নেওয়া হয়নি, খুব অন্যায় হয়ে গেছে। আজ হোটেলে ফিরেই আগে টেলিফোন করতে হবে।

অন্যমনস্ক ভাবনার মাঝে অশ্বারোহণ শেষ। নেমে এদিক ওদিক তাকাল শরণ্যা, অনিন্দ্যকে দেখতে পেল না। আশপাশের বেঞ্চিতে নেই, ম্যালেও হাঁটছে না… আশ্চর্য, গেল কোথায়? বোতল কিনতে ঢুকেছে? কী ছেলে! শরণা আসা পর্যন্ত তর সইল না?

পাহাড়ি ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে হনহনিয়ে শরণ্যা ম্যালের লাগোয়া ওয়াইন স্টোরে এল। কই, এখানেও তো নেই! কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে? নাকি কিছু কেনাকাটা করতে গেল?

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বেশ খানিকক্ষণ ম্যালের মধ্যিখানটায় দাঁড়িয়ে রইল শরণ্যা। পাশে পাহাড়ি কিশোর। জুলজুল চোখে সে দেখছে শরণ্যাকে। কী করবে শরণ্যা ভেবে পাচ্ছিল না। ইস, কেন যে বুদ্ধি করে ভ্যানিটিব্যাগ সঙ্গে নেয়নি!

ছেলেটাই যেচে বলল, —কুচ্ছু ভাববেন না বিবিজি। হোটেলের নাম বাতলে দিন, আমি রুপিয়া নিয়ে আসব।

ঝাঁ ঝাঁ বিরক্তি নিয়ে হোটেল ফিরেই শরণ্যা হাঁ। রুমে চলে এসেছে অনিন্দ্য। টেবিলে গ্লাস বোতল সাজাচ্ছে।

শরণ্যা ফেটে পড়তে গিয়েও সামলে নিল। গুমগুমে গলায় বলল, —তুমি আমায় ফেলে চলে এলে?

অনিন্দ্যর বিকার নেই। গ্লাসে সোডা ঢালতে ঢালতে বলল, —কী করব, ভীষণ ঠান্ডা লাগছিল যে।

—তা বলে… তুমি… আমায়! শরণ্যার কথা আটকে গেল।

—মাফলার নিতে এসেছিলাম, তারপর আর যেতে ইচ্ছে করল না। অনিন্দ্য হাসল, —রাগ করছ কেন ডার্লিং। তুমি তো ফিরেই এসেছ।

শরণ্যার চোখে পলক পড়ছিল না। এ কেমন ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হল ? অনিন্দ্য কি হৃদয়হীন? নাকি উদাসীন?

.

০৩.

সকালে ঘুম ভাঙতেই অনিন্দ্যর মনে পড়ে গেল শরণ্যা নেই। গতকাল বিকেলে বাপের বাড়ি চলে গেছে শরণ্যা। মানিকতলায় সে এখন থাকবে দিন দশেক।

অনিন্দ্যর মেজাজটা খাট্টা হয়ে গেল। বিয়ের পর এই দেড় মাসে শরণ্যা কিছু কিছু নতুন অভ্যেস গড়ে দিয়েছে, এখন ক’দিন প্রতিপদে সেই অভ্যেসগুলো হোঁচট খেতে থাকবে। সামান্য এক কাপ চায়ের জন্যও সেই আগের মতো ডাকাডাকি করতে হবে নীলাচলকে। কোনও মানে হয়?

উঠতে ইচ্ছে করছিল না অনিন্দ্যর। শুয়ে আছে প্রকাণ্ড বিছানার প্রান্তে, গায়ে বিদেশি কম্বল। এই তুলতুলে কম্বল, এই নরম গদি বসানো ইংলিশ খাট, বালিশ চাদর সবই শরণ্যার সঙ্গে এসেছে এ বাড়িতে। নিবেদিতা মুখ ফুটে কিছুই চাননি, বরং মানাই করেছেন, তবু প্রচুর দিয়েছেন শরণার বাবা-মা। চমৎকার একখানা ড্রেসিংটেবিল, মেয়ে-জামাইয়ের জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্ড্রোব, আলমারি, মেয়ে বই পড়তে ভালবাসে বলে বাহারি বুককেস…। নতুন আসবাবপত্রে পুরনো আমলের বিশাল ঘরখানার চেহারাই যেন বদলে গেছে। গন্ধও। বালিশে মুখ গুঁজেও অনিন্দ্য গন্ধটা টের পাচ্ছিল।

জানলার পরদা ভেদ করে আলো এসে পড়েছে ঘরে। হলদে আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুবের ঘরখানা। শুয়ে থাকতে থাকতেই হাত বাড়িয়ে সাইডটেবিল থেকে রিস্টওয়াচখানা তুলল অনিন্দ্য। সাতটা পঁয়ত্রিশ। শরণ্যার ঘড়িটাও পড়ে আছে পাশে। সম্ভবত নিয়ে যেতে ভুলে গেছে শরণা। জোড় মিলিয়ে বানানো একই ডিজাইনের ঘড়ি। শরণ্যার ছোটমামার উপহার। দ্বিতীয় ঘড়িখানা তুলেও অনিন্দ্য সময় দেখল একবার। দু’ মিনিট এগিয়ে আছে শরণ্যা। আশ্চর্য, এত তাড়াতাড়ি কেন তফাত এসে গেল? মিলিয়ে এক করে দেবে? শরণ্যাকে পিছোবে? না নিজেরটা এগোবে? কিন্তু কোনটা ঠিক?

ধুস, যেমন আছে থাক। অফিসের দিন, বিছানায় শুয়ে আর দেয়ালা করা ঠিক হচ্ছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গা থেকে কম্বলটাকে লাথি মেরে সরিয়ে অনিন্দ্য নামল বিছানা থেকে। ঢুকেছে লাগোয়া বাথরুমে। অনিন্দ্যর দাদামশাই সোমশংকর চ্যাটার্জি ছিলেন পাক্কা সাহেব, এ বাড়ি বানিয়েছিলেন সাহেবি কায়দায়, প্রতিটি শয়নকক্ষের সঙ্গেই বাথরুম আছে। স্নানাগারগুলোর চেহারাও তারিফ করার মতো। খাঁটি ইটালিয়ান মার্বেল বসানো। বাথটব শোভিত। এখন অবশ্য বাথটবটার ভগ্নপ্রায় দশা, দেখে অতিকায় গামলা মনে হয়। মেঝের মার্বেলও ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। অনিন্দ্য অবশ্য ওসবের দিকে তাকায় না। বাথরুমের কাজটুকু মিটলেই তার যথেষ্ট।

ছরছর করে কমোডে পেচ্ছাপ করল অনিন্দ্য। তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করল পেচ্ছাপের রংটা। কাল একটু হলুদ হলুদ লেগেছিল, আজ মোটামুটি বর্ণহীন। নাহ্, শরীর ঠিকই আছে। নিশ্চিন্ত মনে কল খুলল বেসিনের। জানুয়ারির গোড়ায় এবার বেশ ভালই শীত পড়েছিল, ক’দিন হল ঠান্ডা কমেছে, তবে জলে এখনও বেশ কনকনে ভাব। হাত বাড়িয়ে গিজার অন করতেই ফের তিরিক্ষি মেজাজটা ফিরে এল অনিন্দ্যর। কাল নীলাচলকে বলেছিল গিজার চলছে না, কিন্তু এখনও সারানো হয়নি। নীলাচল আর কী করবে, এ বাড়িতে তো কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম! আচ্ছা, গিজার ইস্যুতে নিবেদিতা দেবীর সঙ্গে একটা ছোট্ট ফাটাফাটি করলে কেমন হয়? বাপের সম্পত্তি শুধু ভোগই করে যাবে, দরকারে অদরকারে দু’ পয়সা ঢালবে না? ওই তো ছিরির একটা রং করা হল, বাড়ির ফাটাফুটোগুলো পর্যন্ত ভাল করে সারাল না! শরণ্যা তো নেই, এ সময়ে দেবে নাকি একটা ঝাড়?

ভাবনাটায় অদ্ভুত রকমের তৃপ্তি আছে। টগবগ ফুটতে থাকল অনিন্দ্য, আবার মনটা যেন শান্তও হল অনেকটা। বাথরুম আগে বেশ অগোছালো থাকত, শরণ্যা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে জিনিসপত্র, দরকারি সাজসরঞ্জাম হাতের কাছে পেতে আজকাল আর অসুবিধে হয় না। ঝটপট মুখ ধুয়ে দাড়ি কামিয়ে নিল অনিন্দ্য। গালে ঠান্ডা জল ছোঁয়ানোর সময় মনে পড়ে গেল গিজার খারাপ বলে শরণ্যা কাল রান্নাঘর থেকে জল গরম করে এনে রেখে দিয়েছিল বাথরুমে। নিজে থেকেই। অনিন্দ্যর ছোট ছোট আরামগুলোর কথাও কী নিখুঁত ভাবে স্মরণে রাখে শরণ্যা।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনিন্দ্য নতুন কাশ্মীরি শালখানা জড়িয়ে নিল গায়ে। এটাও বিয়েতে পাওয়া। তত্ত্বে এসেছিল। ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে চিরুনি বার করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে হঠাৎ নজরে পড়ল কম্পিউটারের আলো জ্বলছে। কাল রাত্তিরে চ্যাট রুমে থাকতে থাকতে ঘুম এসে গিয়েছিল, তাই বোধহয় অফ করা হয়নি। এহ্, পি.সি.-টা কিনতে গাঁট থেকে কড়কড়ে আটত্রিশ হাজার টাকা বেরিয়ে গেছে? এমন ভুলের কোনও ক্ষমা নেই!

কম্পিউটারের সুইচ অফ করছে অনিন্দ্য, দরজায় নীলাচল, —বড়দা, তুমি উঠে পরেছ?

অনিন্দ্য ঘাড় বেঁকাল, —কেন?

নীলাচল এ বাড়িতে এসেছিল বারো বছর বয়সে। বাড়ি মেদিনীপুরের দাঁতনে। নীলাচলের বাবা ত্রিভুবন কাজ করত সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটিতে, বছর দশেক আগে সে তার ছোটছেলেকে নিবেদিতার কাছে দিয়েছিল। বেশ চালাক চতুর ছেলে নীলাচল, এ বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে সে দারুণ সড়গড়ও হয়ে গেছে, রান্নাবান্না ছাড়া সমস্ত ধরনের কাজই করে সে৷ নীলাচলকেই মুখার্জিবাড়ির গিন্নি বলা যায়।

কুচকুচে কালো, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা নীলাচল ঝকঝকে দাঁত বার করে হাসছে,

—বউদিমণি তোমায় আটটার মধ্যে ঘুম থেকে তুলে দিতে বলেছে।

—অ।

—এখানে চা দেব? না টেবিলে আসবে?

—অসুবিধে না হলে ঘরেই দিয়ে যা।

—আমার অসুবিধে কী? যে যা বলবে তাই হবে।

এ বাড়িতে বেড-টির চল নেই। থাকবে কী করে, কে কখন ঘুম থেকে ওঠে তার ঠিক আছে? আর্যর নিদ্রাভঙ্গ হয় ব্রাহ্ম মুহূর্তে, নিয়মিত মর্নিংওয়াকে বেরোন, পথেই কোথায় যেন চা খেয়ে নেন তিনি। নিবেদিতার ঘুম ভাঙার টাইম সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা, কোনও বিশেষ কাজ থাকলে ভোরে উঠেও বেরিয়ে যান, তাঁর বেড-টি খাওয়ার অভ্যেসটিই নেই। আর সুনন্দ কখন বিছানায় যায়, কখন বিছানা ছাড়ে, কখন সে চা খাবে, কখন নয়, সে খবর তো সুনন্দ ছাড়া কেউ জানে না। অনিন্দ্যও উঠত আটটার পরে, বেশির ভাগ দিনই অফিসের দেরি হয়ে যেত, চা খেত একেবারে বেরোনোর আগে, ব্রেকফাস্ট করার সময়ে।

শরণ্যা আসার পর ছবিটা বদলেছে। অন্তত অনিন্দ্যর ক্ষেত্রে। চায়ের কাপ পৌঁছে যাচ্ছে অনিন্দ্যর বিছানায়। এবং সেটা সাড়ে সাতটা বাজার আগেই। শরণ্যা নিজেও বেলা অবধি শুয়ে থাকতে পারে না, অনিন্দ্যকেও বেশিক্ষণ গড়াগড়ি খেতে দেয় না বিছানায়। ছুটির দিনেও না।

এও তো অভ্যেসের বদল। নীলাচল চা দিয়ে গেছে, কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিল অনিন্দ্য। আর কী কী পরিবর্তন ঘটেছে? আগে শার্টপ্যান্ট যেমন তেমন ভাবে ছড়ানো থাকত, যেটা হাতের সামনে পেল সেটাই গলিয়ে অনিন্দ্য ছুট লাগাচ্ছে, এখন কোন দিন কী পরবে শরণ্যাই ঠিক করে দেয়। খাওয়ার সময়ে পাশে কেউ দাঁড়িয়ে, এটাও কি পরিবর্তন নয়! অফিস থেকে ফিরে এতদিন অনিন্দ্যর কাজ ছিল সিডি চালিয়ে হরর মুভি দেখতে দেখতে একা একা মদ্যপান, নয়তো কম্পিউটারে চ্যাট রুম খুলে বসে থাকা। কিংবা স্রেফ শুয়ে থাকা টান টান। আর ছুটির দিনে তো শুধুই শুয়ে থাকা, অনন্ত শুয়ে থাকা। সেই সঙ্গে মনে মনে মাকড়সার জাল বুনে যাওয়া অবিরাম। জীবনে কী কী সে পায়নি, কোনটা কোনটা থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে তার হিসেব কষতে কষতে বিষাক্ত লালা ঝরত হৃদয় থেকে, আঠালো জালে বন্দি হয়ে ছটফট করত অনিন্দ্য। এখন তো সন্ধে মানেই শরণ্যা। কত কী যে কানের কাছে বিনবিন করে যায় মেয়েটা। কী বলে আর কী না বলে। নিজের বাড়ির লোকদের কথা, কলেজ ইউনিভার্সিটির গল্প, বন্ধুদের উপাখ্যান…। শরণ্যা একটুক্ষণ চুপ করে থাকলে ইদানিং কেমন যেন অস্বস্তি হয় অনিন্দ্যর। এ তো রীতিমতো বড়সড় বদল। অনিন্দ্যকে আজকাল দু’ পেগের বেশি পান করতে দেয় না শরণ্যা, হাত থেকে গ্লাস কেড়ে নেয়। ক’দিন আগেও অনিন্দ্যর কাছে এ তো অচিন্ত্যনীয় ছিল।

সবচেয়ে বড় বদলটা বোধহয় এসেছে অনিন্দ্যর মনোজগতে। সে তো ছোট থেকেই একা। এই একাকিত্বকে সে তো নিয়তির মতোই মেনে নিয়েছিল। বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল খানিকটা জৈবিক কারণে। তার এক মামিমা, নিবেদিতার খুড়তুতো দাদার স্ত্রী স্বরূপা, হঠাৎই এনেছিলেন সম্বন্ধটা। শরণ্যার এক মাসি স্বরূপার ঘনিষ্ট বন্ধু, সেই সূত্রে। তা বিয়েটা ঘটে যাওয়ার পরও অনিন্দ্যর ধারণা ছিল শরীরটুকু ছাড়া আর কোনও রকম সম্পর্ক বোধহয় গড়ে উঠবে না মেয়েটার সঙ্গে। শরণ্যাকেও বেশ গায়ে পড়া মনে হত প্রথম প্রথম। কিন্তু দার্জিলিংয়ের একটা রাত তাকে যেন আমূল নাড়িয়ে দিল। সেদিন মাঝরাতে শরণ্যার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অনিন্দ্যর। কী কাণ্ড, বিছানায় উপুড় হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা! শুধু অনিন্দ্য তার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেনি বলে! শুধু অনিন্দ্য তাকে একা ফেলে চলে এসেছিল বলে!

কী অসম্ভব এক দৃশ্য।

একটা মেয়ে শুধু অনিন্দ্যর জন্য এত আকুল হতে পারে?

ওই মেয়ের চোখে অনিন্দ্য এত মূল্যবান?

পৃথিবীতে তা হলে এক জনও অন্তত আছে যে শুধুই অনিন্দ্যর কথা ভাববে এবার থেকে? শুধু অনিন্দ্যকেই ভালবাসবে? মনে করবে অনিন্দ্য ছাড়া তার অস্তিত্ব বৃথা?

মনের মধ্যে গড়ে-ওঠা এই রোমাঞ্চকর ভাবনাগুলোই অনিন্দ্যকে তোলপাড় করছে দিনরাত। ভাবনা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। বিশ্বাস। অহরহ তার হৃদয়ের তন্ত্রীতে ঝংকার উঠছে— শরণ্যা আমার, শরণ্যা আমার, শরণ্যা আমার।

এই অনুভূতিতে যে কী তীব্র সুখ!

সুখটুকুকে গায়ে মেখে স্নানে গেল অনিন্দ্য। বেরিয়ে অফিসের জন্য তৈরি হল ঝটপট। তারপর সোজা খাওয়ার টেবিলে।

সাধারণত এ সময়ে ডাইনিংটেবিল ফাঁকাই থাকে। আজ পরিবারের দুই সদস্য আগেভাগে মজুত। সাবেকি আমলের বড়সড় ডাইনিংটেবিলের ঈশাণ কোণে আর্য, নৈঋত কোণে সুনন্দ। প্রাতরাশ চলছে। সুনন্দ এমন গপগপ করে খাচ্ছে যেন এক্ষুনি কেউ তার প্লেট থেকে খাবার কেড়ে নেবে। সম্ভবত তাড়া আছে। আর্যর মুখের সামনে খবরের কাগজ, ক্কচিৎ কখনও হাত নামছে প্লেটে। মুখ চলছে অতি ধীরে, যেন লোহা চিবোচ্ছেন। অবশ্যই তাড়া নেই।

অনিন্দ্য দখল করল অগ্নি কোণ। তার চেয়ার টানার শব্দ বোধহয় একটু জোরেই হয়েছিল, পলকের জন্য হাত থামল সুনন্দর, কাগজ থেকে উঠল আর্যর চোখ। পরক্ষণেই আবার যে যার নিজস্ব ছন্দে।

অনিন্দ্য গলা ওঠাল, —নীলাচল?

—আসছি। রান্নাঘর থেকে উত্তর উড়ে এল, —এক মিনিট।

অনিন্দ্য ঘড়ি দেখল। আটটা চল্লিশ। মিনিট পনেরোর মধ্যে রওনা দিতে পারলে সাড়ে ন’টায় অফিসে ঢুকে যাবে। শেয়ার ট্যাক্সিতে কতক্ষণ আর লাগবে থিয়েটার রোড। জোর বিশ মিনিট। আজ সপ্তাহের প্রথম দিন, আজ দেরি করাটা উচিত হবে না।

দু’হাতে চায়ের কাপপ্লেট ব্যালান্স করতে করতে রান্নাঘর থেকে ধেয়ে এল নীলাচল। টেবিলের দু’কোণে পেয়ালা পিরিচ নামিয়ে ঝড়ের বেগে অনিন্দ্যর সামনে,— তোমার টোস্ট রেডি। সীতাদি বাটার লাগাচ্ছে। সঙ্গে কী খাবে? হাফ বয়েল ? না ওয়াটার পোচ?

—দে যা হোক। জলদি কর।

—তোমায় দুটো করে কলা দিতে বলেছে বউদিমণি।

শরণ্যা কিছুই বলতে ভোলেনি। অনিন্দ্য টেবিলে টকটক করল, —দে। সঙ্গে আজ কফি দিস।

নীলাচল তির বেগে চলে গেল।

আর্য পুরো কাপ চা খান না, দু’-তিনটে চুমুক দিয়ে উঠে পড়েছেন। কয়েক পা গিয়েও দাঁড়ালেন। শীতল গলায় অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করলেন, —তুমি কি নিউজ পেপারটা দেখবে?

অনিন্দ্য কাঁঝ ঝাঁকাল, —নো। থ্যাংকস্।

কাগজ হাতে আর্য ধীর পায়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখনই টেবিলের বায়ুকোণে যাঁর বসার কথা সেই নিবেদিতার আবির্ভাব। নিজের কোটর থেকে। পরনে সবুজ কটকিপাড় তসর, গায়ে তসর-রঙা শাল। পারফিউম ছড়িয়েছেন শরীরে, সবাসে ভরে গেছে হলঘর।

বায়ুর গতিতে আর্যকে পার হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন নিবেদিতা। ক্ষণপরেই শাড়িতে খসখস শব্দ বাজিয়ে ফিরেছেন। টেবিলের কাছে এসে একবার সুনন্দকে দেখলেন, একবার অনিন্দ্যকে।

কেজো গলায় অনিন্দ্যকে প্রশ্ন করলেন, —শরণ্যা কাল গেল কখন?

শৌখিন কৌতুহল! অনিন্দ্য দায়সারা ভাবে বলল, —গেছে কোনও এক সময়ে।

—তুমি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলে তো?

অনিন্দ্য টেরছা ভাবে বলল, —জানাটা কি বিশেষ জরুরি?

—টেড়াবেঁকা কথা বলছ কেন? সোজা কথার সোজা জবাব হয় না?

—বাঁকা মানুষদের সোজা উত্তর দিতে নেই।

—সক্কালবেলা ফর নাথিং তুমি আমায় ইনসাল্ট করছ কেন?

—তুমিই বা আন্‌নেসেসারি প্রশ্ন করছ কেন?

—স্ট্রেঞ্জ! বাড়ির বউ কখন বাপেরবাড়ি গেল জিজ্ঞেস করাটা আন্‌নেসেসারি কোয়েশ্চেন?

—বাড়ির বউ নয়। আমার বউ। তুমি যখন তার যাওয়া আসার দায়িত্ব নাওনি, তখন সে কী ভাবে গেল, কখন গেল তা জানারও তোমার মরাল রাইট নেই।

—ও কে, ও কে, আয়াম সরি। সামান্য একটা প্রশ্নকে নিয়ে তুমি এত চটকাবে জানলে আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতাম না। নিবেদিতা চাপা স্বরে ঝলসে উঠলেন— বিয়ে করেও তুমি শোধরালে না অনিন্দ্য। দিনকে দিন ক্রুকেড হচ্ছ।

—আমাকে সিধে করার জন্য বিয়ে দিয়েছিলে বুঝি?

—ওফ্, হরিবল্। তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখা খুব মুশকিল।

—কথা বলো কেন? কেটে পড়ো। যেখানে যাচ্ছ, যাও।

নিবেদিতা তবু নড়লেন না, ঘন ঘন কবজি উলটোচ্ছেন।

সুনন্দ নির্বিকার মুখে চা খাচ্ছিল। মুখভাব এমন, যেন দুটো ভিন্ন গ্রহের প্রাণী কথা বলছে তার সামনে, সে তাদের ভাষা বুঝছেও না, শুনছেও না। কাপ শেষ করে উঠে পড়ল, শিস দিতে দিতে ঢুকে গেল নিজস্ব গুহায়।

ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট ছেলেকে দেখতে দেখতে নিবেদিতা গলা চড়ালেন—কী রে নীলাচল, কী হল কী? বললাম না, সুরেন গাড়ি বার করেছে কিনা দ্যাখ?

অনিন্দ্যকে খেতে দিয়েই ত্বরিত পায়ে নীচে গেল নীলাচল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার চিৎকার, —মা, গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।

—ডিসগাস্টিং। নিবেদিতা গজগজ করে উঠলেন, —আজ এত কাজ… হাজরা ঘুরে এগারোটার মধ্যে বেহালা পৌঁছোতে হবে… আজই কিনা…।

টোস্ট চিবোতে চিবোতে অনিন্দ্য পুটুস মন্তব্য ছুড়ল, —গাড়ি যে চড়ে গাড়ির পেছনে তাকে কিছু খরচাও করতে হয়।

—আমি জানি। নিবেদিতা বিরক্ত মুখে তাকালেন, —তোমার নিজের সেই বোধটুকু আছে তো? বলেই হনহনিয়ে নেমে গেছেন একতলায়।

অনিন্দ্য চিড়বিড়িয়ে উঠল। কী ইঙ্গিত করে গেল মা? ইদানীং অনিন্দ্য মাঝে মাঝে গাড়িটা ব্যবহার করছে, তাই নিয়ে খোঁটা দিল কি? অনিন্দ্যর বাথরুমের গিজার অনিন্দ্যকেই সারিয়ে নিতে বলল না তো? নাকি সংসারে থাকতে গেলে টাকাপয়সা দিতে হয়, কায়দা করে সেই কথাটাই শুনিয়ে গেল?

ইল্লি রে, কেন দেবে টাকা? চায়ই বা কোন মুখে? লেখাপড়া শেখানোর খরচটুকু ছাড়া ছেলের প্রতি আর কোন কর্তব্যটা পালন করেছে? একজন তো সারা জীবন গর্তে ঢুকে বসে রইলেন, আর একজন উড়ছেন সর্বক্ষণ! সমাজসেবা! হাহ্। এতই যখন মহৎ সাজার নেশা, মা হওয়ার দরকারটা কী ছিল? ছেলেকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিব্যি হাত ধুয়ে বসে রইল, স্কুলে গিয়ে তাকে একবার দেখে আসার কারুর সময় হয় না! সব ছেলের বাবা-মা আসছে, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো খুশিতে ডগমগ, সারা সপ্তাহের খুঁটিনাটি তারা উগরে দিচ্ছে বাবা-মার কাছে, কোলের কাছে বসে সন্দেশ কমলালেবু খাচ্ছে, শুধু অনিন্দ্য একা দাঁড়িয়ে ফাঁকা করিডোরে। কাঁদতে পারছে না, পাছে বন্ধুরা খেপায়। আরও আছে। ছুটিতে বাড়ি এল অনিন্দ্য, কারুর তাকে সময় দেওয়ার সময় নেই, বাপ-মা দু’জনেই যে যার জগতে বিভোর। কখনও যদি একত্র হয়ও, দু’জনে কামড়াকামড়ি করে কুকুরের মতো। উহু, একজনই কামড়ায়, অন্য জন আর্তনাদ করে। কিছু ভোলনি অনিন্দ্য। সব মনে আছে। সব।

এখন সেই মা কী করে আশা করে ছেলে চাকরি করে তার হাতে টাকা এনে তুলে দেবে?

কিচ্ছু দেবে না অনিন্দ্য। কোনও দিন না। এক পয়সাও না।

নিমতেতো মেজাজে অনিন্দ্য বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। বাইরে একটা ঝকঝকে দিন। আকাশ নির্মেঘ, সূর্য তেমন প্রখর নয়, হাওয়াতেও ভারী নরম শীতলতা। এমন সুন্দর দিনটা, রাস্তাঘাট লোকজন যানবাহন সবই অনিন্দ্যর বিরস লাগছিল আজ।

অফিসে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই ইন্টারকমে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ডাক, —মুখার্জি, একবার এসে তো।

কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অফিস। বিশাল নামজাদাও নয়, আবার একেবারে অখ্যাতও নয়। কাজকর্ম বেশির ভাগই হয় সাইটে সাইটে, অফিসে তাই লোকজনের সংখ্যা কম। জোর জনা চল্লিশ। থিয়েটার রোডের বহুতল বাড়ির পঞ্চম তলার অফিসটাকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে বাঙালি মালিকরা।

চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ঘর ম্যানেজিং ডিরেক্টারের ঘরের পাশেই। প্রধান বাস্তুকার বাদলবরণ ভৌমিক ওরফে বি বি-র বয়স বছর পঞ্চাশ, গোলগাল চেহারা, মাথা জুড়ে টাক আছে। বি বি কোম্পানির একজন অংশীদারও বটে।

অনিন্দ্য যেতেই বি বি সহাস্য মুখে বললেন, —বোসো। মন দিয়ে কথাগুলো শোনো। লাস্ট উইকে রেলের একটা টেন্ডার বেরিয়েছিল। তিনটে ওভারব্রিজ কনস্ট্রাকশানের। উই লাইক টু বিড ফর দি অর্ডার।

অনিন্দ্য ঝিমোনো গলায় বলল, —রেলে অর্ডার আমরা পাব কি স্যার? মনে হয় না।

—তুমি সব সময়ে এত পেসিমিস্টিক কেন বলো তো? এক বার পাইনি, দু’বার পাইনি, থার্ড বার পেতেও পারি। বি বি গাল চওড়া করে হাসলেন। চোখ টিপে বললেন, —ইনফ্যাক্ট, আমরা গ্রিন সিগনালও পেয়েছি। বাট উই হ্যাভ টু প্রসিড ভেরি সুন। শুক্রবার টেন্ডার ভরার লাস্ট ডেট।

—ও।

—সুতরাং বুঝতে পারছ, উইদিন থ্রি ডেজ আমাদের প্ল্যানটা তৈরি করে ফেলতে হবে। ওয়েডনেজডে’ই আমরা এস্টিমেটে বসব।

অনিন্দ্য আবার বলল, —ও।

—তুমি আজকের মধ্যেই ইনিশিয়াল লে-আউটটা করে ফ্যালো। অসীম আর সুজিত তোমায় হেল্‌প করবে।

—এক দিনে কী করে হবে স্যার?

—কাম অন ইয়াং ম্যান। না হওয়ার কী আছে? একটা ওভারব্রিজেরই তো লে-আউট করবে, বাকি দুটো তো সিমিলার কেস। স্টেশনগুলোর ডিটেল ডাটা… আই মিন লেংথ, হাইট, কী চাইছে রেল, সবই আমাদের হাতে আছে। টেবিল থেকে ফাইল বাড়িয়ে দিলেন বি বি, —দ্যাখো খুলে। কাজটা মোটেই কঠিন নয়।

ফাইলে আলগা ভাবে চোখ বোলাল অনিন্দ্য। মাথা নেড়ে বলল, —বাট ইটস্ টাইম কনজিউমিং স্যার।

—টাইম দাও। খাটো। এই বয়সে সময় না দিলে কবে আর কাজ করবে ?

—এক দিনে হবে না স্যার।

—হবে না ইজ এ ডার্টি ওয়ার্ড মুখার্জি। বলতে নেই। প্লিজ গো অ্যান্ড ডু ইট। দরকার হলে লেট আওয়ার্স অব্দি থেকে করে দাও।

বি বি-র চেম্বার থেকে বেরিয়ে মেজাজ আরও বিগড়ে গেল অনিন্দ্যর। মতলটা কী বি বি-র? জানে কাজটা এক দিনে করা সম্ভব নয়, তবু কেন এমন জোরাজুরি করছে? অনিন্দ্যকে ফাঁদে ফেলার ধান্দা? হিউমিলিয়েট করতে চায়? তাড়ানোর প্ল্যান ভাঁজছে নাকি? হাহ্, অনিন্দ্য সে সুযোগ দিলে তো! কী এমন মাইনে দেয় যে রাত দশটা-এগারোটা অবধি কলুর বলদের মতো খাটবে সে? ছ’ বছরে অনিন্দ্য তিনটে চাকরি ছেড়েছে, তেমন হলে এই চার নম্বরটাকেও ছেঁড়া চটির মতো ফেলে দেবে। নয় বসে থাকবে দু’-চার মাস, তারপর একটা কিছু ঠিকই জুটে যাবে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের এখনও তত বুভুক্ষুর দশা হয়নি যে দাঁতে দাঁত চেপে এক চাকরিতেই পড়ে থাকতে হবে।

রাগটা মাথায় পুষে রেখেই টেবিলে এসে কাজে বসল অনিন্দ্য। দুই ড্রাফট্সম্যানকে সঙ্গে নিয়ে। ঘণ্টা পাঁচ-ছয় খেটেখুটে একটা ওভারব্রিজের মোটামুটি নকশা বানিয়েও ফেলল। এখনও নিখুঁত হয়নি, ঘসামাজা দরকার। কিন্তু শরীর আর চলছে না, ঝিমঝিম করছে মাথা।

অসীমকে বলল, —আজ এই পর্যন্ত থাক। কাল ফাস্ট আওয়ারে কমপ্লিট করে ফেলব। বেশিক্ষণ তো আর লাগবে না, কী বলেন?

অসীমের বয়স বছর চল্লিশ। সংসারী, সাবধানী মানুষ। সে নার্ভাস গলায় বলল, —কিন্তু বি বি যে আজকেই কাজটা…!

—সম্ভব নয়। আমি কি মেশিন?

সুজিতের বয়স কম। অনিন্দ্যরই সমবয়সি প্রায়। সে বলল, —আপনি তো বলছেন বাকি দুটোও এক টাইপ হবে। আমরা কি প্রথমটা দেখে দেখে এগোব? যতটা পারি?

সুজিত কি বি বি-র লোক? অনিন্দ্যকে বাজিয়ে দেখছে? অনিন্দ্যর সে রকমই সন্দেহ হল। ধুর, হলেই বা কী এসে যায়? কেউ সামান্যতম বেগড়বাই করলে সে তো চাকরিটা ছেড়েই দেবে।

অনিন্দ্য শ্রাগ্‌ করল, —পারলে করুন। আমি কাল এসে চেক করে নেব। বি বি খোঁজ করলে বলবেন মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল, চলে গেছে।

ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় পথে নেমে পড়ল অনিন্দ্য। কোথায় যাওয়া যায় এখন? বাড়ি? ভালো লাগছে না। সিনেমা দেখতে ঢুকবে? একা একা সিনেমা দেখার অভ্যেস আছে অনিন্দ্যর। সত্যি বলতে কী, অজস্র অচেনা মানুষের ভিড়ে ওই একা হয়ে থাকাটা বেশ উপভোগই করে সে। এ যেন আমি সবাইকে দেখছি, অথচ আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না এমনই একটা খেলা। ধুৎ, সিনেমায় যেতেও ইচ্ছে করছে না আজ। ভেতরে ভেতরে অন্য একটা টান অনুভব করছে অনিন্দ্য। নিশির ডাকের মতো। সদ্য চেনা এক মাদকের আহ্বান বেজে উঠছে রক্তে। কিন্তু কালই তো শরণ্যাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল, আজ আবার ওখানে ঢুঁ মারাটা কি ভাল দেখাবে?

রাস্তায় চরকি খেতে খেতে অনিন্দ্য শেষ পর্যন্ত ঝেড়ে ফেলল দ্বিধাটা। সে যাবে তার শরণ্যার কাছে, এতে এত ভাবাভাবির কী আছে?

শরণ্যাদের বাড়ি মানিকতলা মোড়ের কাছেই। চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি, নবেন্দুরা থাকেন তিনতলায়। অনিন্দ্য পৌঁছে দেখল নবেন্দু মহাশ্বেতা দু’জনেই ফিরে এসেছেন অফিস থেকে। অনিন্দ্যর আকস্মিক আগমনে তাঁরা যতটা না বিস্মিত, তার চেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত। কী করবেন, কী না করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মহাশ্বেতা হুটোপুটি করে ঢুকে পড়লেন রান্নাঘরে, শরণ্যার ঠাকুমাও তাঁর হাতে হাত লাগাচ্ছেন। নবেন্দু ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়লেন, আজ রাত্রে জামাইকে না খাইয়ে ছাড়ছেন না।

অনিন্দ্যকে ঘিরে নবেন্দু-মহাশ্বেতার মাঝারি সাইজের ফ্ল্যাটখানা সহসা যেন খুশির ঝরনা।

শ্বশুরবাড়ির এই আন্তরিক আদর আপ্যায়ন অনিন্দ্যর বেশ লাগে। তার কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এখানে এলেই নিজেকে একজন কেউকেটা বলে মনে হয়। আবার একটু একটু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে কখনও কখনও। মাঝে মাঝেই মনে হয় তাকে এত খাতিরযত্ন করাটা কি স্বাভাবিক হতে পারে? নিশ্চয়ই কৃত্রিমতাটাকে সুচারু ভাবে গোপন করে রাখেন শরণ্যার বাবা-মা! শরণ্যাকেও এ বাড়িতে যেন কেমন অন্য রকম লাগে। ফার্ন রোডের বাড়ির শরণ্যা আর মানিকতলার বাড়ির শরণ্যায় যেন আকাশ-পাতাল তফাত। এখানে শরণ্যার হাঁটাচলা হাসি কথা সবই যেন ভিন্ন প্রকৃতির।

সেই শরণ্যা এখন মুখ টিপে টিপে হাসছে। অনিন্দ্য শরণ্যাকে দেখছিল। দু’জনে বসে আছে সেই ঘরখানায়, যেটা ক’দিন আগেও শরণ্যার বেডরুম ছিল।

ঠোঁটের হাসি চোখে এনে শরণ্যা বলল, —কী দেখছ? হাঁ করে ?

—তোমায়। অনিন্দ্য গুমগুমে গলায় বলল, —দিব্যি মজাসে আছ। সারা দিনে একটা ফোন করারও সময় পেলে না?

—তোমার লাইন পাওয়া গেলে তো। দুপুরে অন্তত এক ঘণ্টা ট্রাই করেছি।

—বাজে কথা। ফার্ন রোড থেকে তো রোজ লাইন পাও, আর মানিকতলায় এসেই…! কী হয় তোমার, অ্যাঁ? এ বাড়িতে ঢুকেই আমায় ভুলে যাও?

শরণ্যা খিলখিল হেসে উঠল, —সেই ভেবে তুমি হালুম হুলুম করে চলে এলে?

হাসিটা অনিন্দ্যর মোটেই পছন্দ হল না। গোমড়া মুখে বলল, —না এলেই বুঝি খুশি হতে?

—ওমা, তাই বললাম নাকি? শরণ্যার হাসি আরও মদির, —আমারও তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। সত্যি। খুব মনকেমন করছিল।

—তা হলে চলো। অনিন্দ্য ঝপ করে বলল, —আর এখানে থাকতে হবে না।

—হুঁউ ?

—হুঁ নয়, হ্যাঁ। তুমি আজই আমার সঙ্গে ফিরবে। অ্যান্ড আই মিন ইট।

—যাহ্, তা হয় নাকি? শরণ্যা ফের হেসে ফেলল, —সবে কাল এলাম…

—তো? কাল এসেছ বলে আজ যাওয়া যায় না?

—এমা ছি। লোকে কী বলবে?

—আমি লোকফোক কেয়ার করি না। তুমি রেডি হয়ে নাও।

এতক্ষণে থমকেছে শরণ্যা। স্থির চোখে অনিন্দ্যকে দেখতে দেখতে বলল, —হঠাৎ ছেলেমানুষি শুরু করলে কেন? বললেই যাওয়া যায় নাকি?

—কেন যায় না?

—বা রে, বাবা-মা’র কাছে ক’টা দিন থাকব বলে এই প্রথম এলাম… বাবা-মা কী ভাববে? কষ্ট পাবে না?

অনিন্দ্য থমথমে মুখে বলল, —বাবা-মা কষ্ট পাবে বলে তুমি যাবে না?

—আমারও খারাপ লাগবে। শরণ্যার গলাটা আদুরে আদুরে হল, —আমার বুঝি বাবা-মার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে না?

—যাবে না তা হলে? অনিন্দ্য ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে, —থাকো তবে। যে ভাবে খুশি। যদ্দিন খুশি।

—অ্যাই অ্যাই, কী হল? কোথায় চললে? বোসো।

—কেন বসব? কীসের জন্য বসব?

বলেই অনিন্দ্য গটমট করে ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেসে। সোফায় বসে জুতো পরছে।

শরণ্যা দৌড়ে এসেছে পিছন পিছন। চাপা গলায় বলল, —অ্যাই, কী সিন ক্রিয়েট করছ? তোমার জন্যে রান্নাবান্না হচ্ছে… কী ভাববে বলো তো সবাই!

অনিন্দ্য দরজা খুলতে খুলতে বলল, —বলে দিয়ে যা হোক কিছু। আমি তো তাদের কাছে আসিনি। আমি তোমার জন্য এসেছিলাম। তোমার কাছে। ও কে?

.

০৪.

সমিতির অফিসঘরে বসে ছোট্ট একটা মিটিং সেরে নিচ্ছিলেন নিবেদিতা। অর্চনার সঙ্গে। সম্প্রতি একটি সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটির মেয়েরা নিয়মিত জ্যাম জেলি আচার বানায়, দু’-চারটে খুচরো বিক্রি ছাড়া তার প্রায় সবটাই কিনে নেয় মাঝারি নামজাদা এক আচার কোম্পানি, নিজেদের লেবেল লাগিয়ে তারা বেচে বাজারে। মাস তিনেক হল তাদের বেশ কিছু বিল বাকি পড়েছে, সুহাসিনীকে তারা ঠিকঠাক পেমেন্ট দিচ্ছে না।

অর্চনা বললেন, —এ ভাবে তো আর পারা যায় না নিবেদিতাদি। পর পর দুটো রিমাইন্ডার দিলাম, নো রেসপন্স। টেলিফোন করছি, বলছে বাজার ডাউন, একটু ধৈর্য ধরুন। কী করা যায় বলন তো?

নিবেদিতার কপালে ভাঁজ, —কত ডিউ আছে?

—এক্‌জ্যাক্ট ফিগারটা দেখে বলতে হবে। তবু ধরুন…দিনে মোটামুটি একশো বোতল সাপ্লাই যায়…জ্যাম জেলি বোতল পিছু আড়াই টাকা, আচারে দুই, সসে দেড়…আমাদের তো জ্যাম জেলি বেশি…। অর্চনা মনে মনে হিসেব কষলেন, —উনিশ-কুড়ি হাজার টাকা তো হবেই। অথচ প্রত্যেক উইকে ওদের পেমেন্ট দেওয়ার কথা ছিল। ভাগ্যিস ওদের ফাস্ট প্রোপোজালটায় রাজি হইনি।

—কাঁচা মাল কেনার ব্যাপারটা?

—হ্যাঁ। কাঁচা মাল আমরা কিনলে কী অবস্থাটা হত বলুন তো? সুহাসিনী লাটে উঠে যেত এত দিনে।

—হুম্। নিবেদিতাকে চিন্তিত দেখাল, —আমি একবার গিয়ে কথা বলে দেখব?

—তা হলে তো ভালই হয়। আপনি গিয়ে দাঁড়ালে তার একটা ওয়েটেজ আছে। আপনি যে ভাবে জোরের সঙ্গে কথা বলেন…

—কথা অনেকেই জোরের সঙ্গে বলতে পারে অর্চনা। কিন্তু দেখা দরকার তাতে সুহাসিনীর কাজ হয়, না অকাজ হয়।

নিবেদিতা ইচ্ছে করেই অর্চনাকে ঠেস দিলেন একটু। ইদানীং দময়ন্তী পাইনকে বড় বেশি মাথায় তুলছে অর্চনারা। সেদিনের একটা মেয়ে, সবে বছর দুয়েক হল সুহাসিনীর সদস্য হয়েছে, এর মধ্যেই গলা ফুলিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে সমিতির মিটিংয়ে। কাজকর্মে উৎসাহ দেখে নিবেদিতা অবশ্য নিজেই তাকে নিয়ে এসেছিলেন এক্‌জিকিউটিভ বডিতে। সম্প্রতি দুটো বড় বড় সংস্থা থেকে মোটা ডোনেশানও জোগাড় করে এনেছে দময়ন্তী। অবশ্যই নিজের ক্ষমতায় নয়, বরের প্রতিপত্তির সুবাদে। প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক ধূর্জটি পাইনের নাম এ শহরে কে না জানে। কিন্তু টাকা আনছে বলে কর্মসমিতির সভায় উদ্ভট উদ্ভট প্রস্তাব রাখার অধিকার জন্মে যাবে? গত মিটিংয়ে কী অবলীলায় বলে দিল, সেলাইটেলাই তুলে ওঘরে কম্পিউটার বসিয়ে দিন! এখন কম্পিউটারের যুগ, মেয়েগুলো চড়চড় করে ওপরে উঠে যাবে! তা কম্পিউটার কেনা হোক না, নিবেদিতার তাতে কীসের আপত্তি! তা বলে সেলাই ডিপার্টমেন্ট তুলে দেওয়ার মতো অবাস্তব কথা বলে কোন বুদ্ধিতে? পোশাকআশাক বানিয়ে মেয়েগুলো দুটো পয়সা রোজগার করে, সুহাসিনীর ফান্ডেও যৎসামান্য আসে, তার জায়গায় কম্পিউটার কোন সুরাহাটা করবে? আশ্চর্য, অমন একটা হাস্যকর কথা শুনেও অর্চনারা কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করল না! এরা এত কেন তেল মারবে দময়ন্তীকে?

অর্চনা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। নিবেদিতার ইঙ্গিত বুঝেছেন। খানিকটা তোষামোদের সুরে বললেন, — আপনার সঙ্গে কার তুলনা নিবেদিতাদি? আপনি আছেন বলেই না সুহাসিনী আছে।

—তা কেন, আমি না থাকলেও সুহাসিনী থাকবে। নিবেদিতা ঈষৎ অপ্রসন্ন গলায় বললেন, — তুমি তো জানো, কী ভাবে শুরু হয়েছিল সুহাসিনী। মাত্র ছ’জন মেম্বার ছিলাম আমরা। বাবা প্রেসিডেন্ট, সঙ্গে আমি ঝটিকাদি বাসন্তী শুভ্রা আর আমার ছোটপিসি। আমি ছাড়া বাকিরা এখন কোথায়? ঝটিকাদি তো মারাই গেলেন। ছোটপিসির কথাও বাদ দাও, তার আর শরীর চলে না। কিন্তু শুভ্রা আর বাসন্তী? শুভ্রা তাও চাঁদাটা নিয়মিত দেয়, অ্যানুয়াল মিটিংটাও অ্যাটেন্ড করে, বাসন্তী তো সুহাসিনীর রাস্তাই ভুলে গেছে। সুহাসিনী কি তাই বলে থমকে গেছে? এখন সুহাসিনীর বিরাশি জন মেম্বার। আমি না থাকলেও এতগুলো সদস্য তো থাকবে।

অর্চনা কথা বাড়ালেন না। চুপ করে আছেন।

—হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল। নিবেদিতা প্রসঙ্গে ফিরলেন, —সে আমি নয় পায়োনিয়ার ফুড প্রোডাক্টসে যাব একবার, ওদের সেনগুপ্তর সঙ্গে কথাও বলব। তবে সঙ্গে সঙ্গে অন্য ভাবনাও তত করে রাখা ভাল।

—কী রকম?

—আমরা গোন্ডেন ফুড প্রোডাক্টসের সঙ্গে কনট্যাক্ট করতে পারি। গোল্ডেন তো আগে আমাদের মাল পছন্দই করেছিল। রেট একটু কম ছিল, এই যা। তা ওরা যদি ক্যাশ টার্মে রাজি থাকে… নেইমামার চেয়ে তো কানামামা ভাল।

—কিন্তু নিবেদিতাদি… অৰ্চনা গলা ঝাড়লেন, —ব্যাপারটা তো আগে কমিটি মিটিংয়ে পাস করাতে হবে।

—আহা, তুমি আগে যোগাযোগটা তো করো। ওভার ফোন কথা বলে দ্যাখো ওরা এখনও ইন্টারেস্টেড কি না। তারপর নয় ফরমাল প্রোপোজাল আনা যাবে।

রেখা চা নিয়ে ঢুকেছে। বছর ষাটেক বয়স, বেঁটেখাটো থপথপে চেহারা। যে চার জন মেয়ে নিয়ে সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটি শুরু হয়েছিল, রেখা তাদেরই এক জন। বর্ধমানের কোন গ্রামে যেন বিয়ে হয়েছিল, বর সাংঘাতিক পেটাত, বাপের বাড়িও ফিরিয়ে নিতে চাইছিল না, সুহাসিনীতে ঠাঁই পেয়ে রেখা বেঁচে গিয়েছিল। সুখের না হোক, স্বস্তির নীড় তো বটে। তা সেই নীড়ে পঁয়ত্রিশ বছর বাস করতে করতে রেখা এখন নীড়েরই অংশ বনে গেছে। দারুণ আচার বানায়, ফাস্ট ক্লাস বড়ি দিতে পারে, সেলাইফোঁড়াইয়ের হাতও মন্দ নয়। ইদানীং রান্নাঘরের দায়িত্বে আছে। সুহাসিনীতে এখন আশ্রিতের সংখ্যা তিয়াত্তর, এতগুলো মেয়ের খাওয়াদাওয়ার ঝক্কিটা রেখাই সামলায়। পুরনো বাসিন্দা বলে নিবেদিতার সঙ্গে এক ধরনের সখ্যও আছে রেখার।

দু’ কাপ চা টেবিলে রেখে একগাল হেসে রেখা বলল, —তোমার বউমার তো দেখি খুব উৎসাহ নিবিদি। ঘুরে ঘুরে সকলের কাজ দেখে বেড়াচ্ছে। এই বাটিকের ঘরে ঢুকছে, এই বেতের কাজ… কৃষ্ণাকে বলছিল, আমায় একটু জ্যাম জেলি তৈরি শিখিয়ে দেবেন?

শরণ্যার কথা এতক্ষণ মাথাতেই ছিল না নিবেদিতার। মেয়েটা আজ এসেছে তাঁর সঙ্গে। আগেও এসেছিল একদিন। সুহাসিনীর কাজকর্ম দেখে শরণ্যা বেশ অনুপ্রাণিতই হচ্ছে মনে হয়। ভাল। তেমন হলে শরণাই তাঁর উত্তরসুরী হতে পারবে। আজ এখান থেকে শরণ্যাকে নিয়ে নিবেদিতা শোভাবাজার যাবেন একবার। কাকিমার শরীর খারাপ, অনিন্দ্যর বিয়েতে আসতে পারেননি, বার বার বউ দেখতে চাইছেন। নিবেদিতারও বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা বুঝে আসা দরকার। আজ এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে।

মৃদু হেসে নিবেদিতা বললেন, —আমার বউমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে রেখা?

—পছন্দ কী গো, সোনার টুকরো মেয়ে। কী মিষ্টি ব্যবহার, আহা। রেখা মাথা দোলাচ্ছে, —তোমার বাড়ি তো আলো হয়ে গেছে নিবিদি।

অর্চনা হাসতে হাসতে বললেন, —কিন্তু তুমি যে সুহাসিনীকে অন্ধকার করে দিচ্ছ গো!

—কেন?

—একটু আগে কী বাঁধাকপি রাঁধছিলে, দুর্গন্ধে তো ওয়াক উঠে আসার জোগাড়।

—জগন্নাথ বাঁধাকপি আনছে কেন? রেখা ঝনঝন করে উঠল, —এই সময়ের বাঁধাকপি থেকে কি গোলাপের বাস বেরোবে? গোরুতেও এখন আর কপি খায় না।

রেখা এ ভাবেই কথা বলে। দাপটের সঙ্গে। নিবেদিতা হেসে বললেন, — বুঝেছি। জগন্নাথকে একটু বকে দিতে হবে।— যাও, এবার আমার বউমাকে ডেকে দাও। বেরোব।

রেখা চলে যাওয়ার পর অর্চনার সঙ্গে বসে আরও কয়েকটা টুকটাক দরকারি কাজ সেরে নিলেন নিবেদিতা। মার্চ মাস পড়ে গেল, সরকারি অ্যালট্‌মেন্টের টাকা এখনও এসে পৌঁছোল না। প্রতি বছরই দেরি করে, এবার যেন একটু বেশি বিলম্ব করছে। শুক্রবারের মিটিংয়ে ফান্ড থেকে কিছু টাকা তোলার প্রস্তাব রাখতে বললেন অর্চনাকে। দারোয়ান, টাইপিস্ট, একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাম ক্লার্ক, দু’জন সেলাই দিদিমণি, ঝাড়ুদার টাড়ুদার মিলিয়ে সুহাসিনীতে জনা বারো কর্মচারী, তাদের মাইনের চেক সই করলেন। মাস ছয়েক হল বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে গভর্নমেন্ট কিছু টাকা দিয়েছে, সন্ধেবেলা সুহাসিনীতে ক্লাসও হচ্ছে নিয়মিত, দশ-বারো জন গরিবঘরের স্থানীয় বউঝি আসছে পড়তে, তাদের নিয়েও আলোচনা হল খানিক।

তার মধ্যেই শরণ্যা উপস্থিত। নিবেদিতার পাশে বসতে বসতে বলল, —একটি মেয়ে কী অসাধারণ কাঁথাস্টিচের কাজ করছে মামণি! আমার তো চোখের পলক পড়ছিল না!

নিবেদিতা জিজ্ঞেস করলেন, —কে? দীপ্তি?

—ওর নাম দীপ্তি বুঝি? ফরসা মতন? ভীষণ রোগা?

—হ্যাঁ। দীপ্তির সুন্দর আর্টিস্টিক সেন্স আছে। চমৎকার আলপনাও দেয়। নিজেই মাথা খাটিয়ে নতুন নতুন ড্রয়িং করে শাড়িতে। ওর তৈরি শাড়ির ভাল ডিমান্ড।

—ইস, কী ব্যাড লাক, না? এত গুণী হয়েও এখানে পড়ে আছে।

অর্চনা বললেন, —না শরণ্যা। ও যে দশায় ছিল তার তুলনায় সুহাসিনী তো স্বর্গ। তুমি জানো ওর হিষ্ট্রি?

—না তো৷ কী?

—শি ইজ আ রেপ ভিক্টিম। প্রেমিক আর তার দুই বন্ধু মিলে মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছিল। কোর্টে অবশ্য তাদের সেন্টেন্স হয়, কিন্তু দীপ্তির বাবা-মা আর মেয়েকে ফেরত নিতে রাজি হয়নি। দীপ্তি থাকলে তার বোনদের নাকি বিয়ে হবে না। শি ওয়াজ সেন্ট হিয়ার বাই দি সোশাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট।

শরণ্যা শিউরে উঠল, —ও মা, কী সাংঘাতিক!

নিবেদিতার মুখে বিষন্ন হাসি, —সুহাসিনীর কোনও মেয়েরই পাস্ট খুব মধুর নয় শরণা। এদের সঙ্গে মিশলে বুঝতে পারবে তুমি যতটা খারাপ কল্পনা করতে পারো, পৃথিবী তার চেয়ে অনেক বেশি কুৎসিত।

অর্চনা বললেন,—থাক নিবেদিতাদি, মেয়েটাকে আর ভয় দেখাবেন না। নতুন বিয়ে, এখন একটা স্বপ্নের জগতে আছে…

খুব স্বপ্নের জগতে আছে কি? নিবেদিতার তো মনে হয় না। অনিন্দ্য যা অবুঝ! এর মধ্যেই তো বোধহয় একটা গণ্ডগোল বাধিয়ে বসেছিল। ক’টা দিন বাপেরবাড়ি থাকবে বলে গেল মেয়েটা, একদিন পরেই বাপ-মা এসে পৌঁছে দিয়ে গেল মেয়েকে। নবেন্দু-মহাশ্বেতার মুখ দেখে মনে হল তারা বেশ ক্ষুন্ন। অনিন্দ্য কি মানিকতলায় গিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে এসেছিল? হতেই পারে। যা উদ্ধত! শরণ্যারও মুখে ক’দিন হাসি ছিল না। ভেতরের ব্যাপার জানার উপায় নেই। শরণ্যাকে জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পাননি নিবেদিতা। আর অনিন্দ্য ? তাকে কে প্রশ্ন করতে যাবে। হয়তো মুখের ওপর বলে দেবে, নিজের চরকায় তেল দাও!

নিবেদিতা শরণ্যাকে বললেন, —তুমি তা হলে বসে অর্চনামাসির সঙ্গে গল্প করো, আমি চট করে একটা চক্কর দিয়ে আসি।

সুহাসিনীতে এসে প্রতি দিন একটা করে রাউন্ড মারা নিবেদিতার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। প্রত্যেকটি ঘরে উঁকি দেবেন এখন, মেয়েদের সঙ্গে দুটো-চারটে কথা বলবেন। সুহাসিনী তো এখন আর ছোট নেই, সময় লাগবে।

সুহাসিনীর পুরনো বাড়িটায় একতলা-দোতলা মিলিয়ে দশখানা ঘর। প্রথম প্রথম বাড়িটা খাঁ খাঁ করত, এখন আর একটা বাড়িতে কুলোয় না, পিছনের ফাঁকা জমিটায় সরকারি অনুদান আর এদিক-ওদিক থেকে কুড়িয়েবাড়িয়ে আরও একটা দোতলা বাড়ি বানানো হয়েছে। দু’ বাড়িরই একতলায় কর্মযজ্ঞ চলে, দোতলায় মেয়েদের বাস।

নিবেদিতা ভেতরের হল মতন জায়গাটায় এসে দাঁড়ালেন ক্ষণকাল। সুহাসিনীর বার্ষিক মিটিংটিটিংগুলো এখানেই হয়। ছোট্ট স্টেজ মতোও করা আছে। মাঝে মাঝে গানবাজনা নাটকটাটক করে মেয়েরা। আশ্রিত বলে জীবনটা একেবারে শুকনো কাটবে, এ নিবেদিতার অভিপ্রেত নয়।

স্টেজের পিছনেই দেওয়ালে পাশাপাশি দু’খানা ফোটো। নিবেদিতার বাবা সোমশংকর মুখার্জি, আর ঠাকুমা করুণা। স্যুট-টাই পরা সোমশংকরের মুখে টুকরো হাসি ঝুলছে, আটপৌরে ঢঙে শাড়ি পরা করুণার চোখে আলগা বিষাদের প্রলেপ।

একজন প্রতিষ্ঠাতা। অন্যজন প্রেরণা।

করুণার মনে সারা জীবন একটা ক্ষত ছিল তাঁর মা সুহাসিনীকে নিয়ে। সুহাসিনীর জীবনটা ছিল ভারী কষ্টের। করুণার বাবার দুই বিয়ে, সুহাসিনী তাঁর প্রথম পক্ষ। কাকবন্ধ্যা সুহাসিনী স্বামীকে পুত্র উপহার দিতে পারেননি বলে কাঁটা হয়ে থাকতেন সব সময়ে, শ্বশুরবাড়িতে লাঞ্ছনা গঞ্জনা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবু তিনি সেখানে টিকতে পারেননি শেষপর্যন্ত। একদিন এক অতি তুচ্ছ কারণে সুহাসিনীকে ত্যাগ করেছিলেন তাঁর স্বামী। ত্যাগ নয়, গলাধাক্কা। এক বস্ত্রে রাতারাতি স্বামীর ঘর ছাড়তে হয়েছিল সুহাসিনীকে। তো অপরাধটা কী ? না মেয়ের ধুম জ্বর, এক্ষুনি ডাক্তারবদ্যি না করলেই নয়, আর্জিটা জানাতে সুহাসিনী মরিয়া হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন স্বামীর বৈঠকখানার আড্ডায়, এবং তখন তাঁর মাথায় ঘোমটা ছিল না! ব্যস, ওই অজুহাতেই পত্রপাঠ নির্বাসন। বাপেরবাড়িতেও জীবনের বাকি দিনগুলো আশ্রিতের মতো কেটেছিল সুহাসিনীর। একটাই সৌভাগ্য, বেশিদিন বাঁচেননি তিনি। করুণার বিয়ের পর পরই সুহাসিনী গত হন। যক্ষ্মায়। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে।

সুহাসিনীর গল্প বলতে গিয়ে শেষ বয়সেও চোখে জল এসে যেত করুণার। ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি সবাইকে তিনি বলতেন, মেয়েমানুষের জীবন বড় কষ্টের রে। নেহাত আমার কপাল ভাল, দেখতে শুনতে মন্দ ছিলাম না, তাই এমন ঘর-বর জুটে গেছে। নইলে আমারও যে কী গতি হত কে জানে! সংসারে দুঃখী মেয়েদের কথা পারলে একটু ভাব তোরা। ভগবানের দয়ায় তোদের তো অনেক আছে, তাদের জন্য কিছু অন্তত কর।

মাতৃভক্ত সোমশংকরকে নাড়া দিত আর্তিটা। গেঁথে গিয়েছিল নিবেদিতার হৃদয়েও। করুণা যখন মারা যান, নিবেদিতা তখন এম-এ পড়ছেন। দুঃস্থ মেয়েদের জন্য কোনও একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তা তখন থেকেই তাঁর মনে দানা বাঁধে।

সুযোগও এসে গেল। আকস্মিক ভাবে। সোমশংকরের এক মক্কেল ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে পাকাপাকি ভাবে দিল্লি চলে যাচ্ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে প্রায় জলের দরে হাজরা রোডের বাড়িটা কিনে নিলেন সোমশংকর। প্রতিষ্ঠিত হল সুহাসিনী ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।

করুণা মারা যাওয়ার ঠিক ছাব্বিশ মাস পর। করুণার জন্মদিনের দিন।

পঁয়ত্রিশটা বছর কেটে গেল তার পরে, নিবেদিতার এখনও মনে হয় এই তো সেদিন!

দেখতে দেখতে সুহাসিনীও আজ অনেক বড় হয়েছে। কী ভাবে যে নিবেদিতা তিলে তিলে গড়েছেন সুহাসিনীকে। সোমশংকর ছিলেন হাইকোর্টের নামী ব্যারিস্টার, ইচ্ছে থাকলেও তাঁর সময় কোথায়, প্রথম থেকেই তাই কাজকর্মের মুখ্য দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন নিবেদিতা। কোনও দিকে তাকাননি, অষ্টপ্রহর শুধু সুহাসিনী সুহাসিনী সুহাসিনী। নিরাশ্রয় মেয়েদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা, কাজ-চলা গোছের লেখাপড়া শেখানো, পাশে পাশে নানান ধরনের হাতের কাজের ট্রেনিং, ঘুরে ঘুরে সমিতির জন্য অর্থসংগ্রহ, গভর্নমেন্টের কাছে গ্র্যান্টের জন্য দরবার— এক নিবেদিতাই তখন একশো নিবেদিতা। সকাল থেকে রাত চরকি খাচ্ছেন। মাঝে বিয়ে হল, ছেলেপুলে হল, তবু কোনও দিন সুহাসিনীর কাজে ঢিল দেননি। আয়ার কাছে বাচ্চা রেখে চলে এসেছেন হাজরা রোডে, ছেলেদের অসুখবিসুখেও কাজে ভাটা পড়েনি।

সুহাসিনী নিবেদিতার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। সুহাসিনী ছাড়া নিবেদিতার আর আছেটা কী?

অফিসঘরে ফিরে নিবেদিতা দেখলেন মঞ্জুলিকা আর জয়শ্রী এসেছেন। সুহাসিনীর সদস্যদের অনেকেই প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ঘরের মহিলা, হাতের কাজকর্ম সেরে রোজই এ রকম কেউ-না-কেউ হাজিরা দেন দুপুরের দিকে। কাজটাজ দেখেন, গল্পগাছা হয়, সুহাসিনীতে বানানো জিনিসপত্রের জন্য খদ্দেরও আনেন মাঝেমধ্যে। মিছিমিছি অলস সময় না কাটিয়ে সমাজের জন্য কিছু অন্তত করার চেষ্টা করেন এঁরা। সুহাসিনীর মতো প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাশ্রম কারুর কারুর সামাজিক মর্যাদাও বাড়ায়।

মঞ্জুলিকাদের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে শরণ্যাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নিবেদিতা। আকাশে অল্প অল্প মেঘ। সূর্য আর মেঘে লুকোচুরি চলছে। ফাল্গুনের রোদ্দুর চড়া নয় তেমন, বাতাসেও বেশ মিঠে মিঠে ভাব। তবু একটা গুমোটও আছে। সম্ভবত ওই মেঘের জন্যই।

শম্বুক গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে সুরেন। কলকাতায় ইদানীং গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে খুব, দুপুরবেলাতেও যত্রতত্র যানজট। নিবেদিতা ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন। দক্ষিণ থেকে উত্তরে পৌঁছোতে কত সময় লাগবে কে জানে!

হঠাৎ শরণ্যা বলল,—মামণি, আপনারা শুনলাম বৃদ্ধাশ্রম করছেন?

নিবেদিতা ফিরে তাকালেন, —কে বলল? মঞ্জুলিকা?

—অর্চনামাসি বলছিলেন। জমিও নাকি দেখা হয়ে গেছে? বেহালায়?

—প্রপার বেহালা নয়, এক্সটেন্ডেড বেহালা। শীলপাড়া চেনো? শীলপাড়া ক্রস করে। জোকা আর শীলপাড়ার মাঝামাঝি।

—কবে শুরু হবে?

—দাঁড়াও, জমিটা আগে হাতে আসুক।…তবে ওল্ডহোমটা স্টার্ট করার একটা টার্গেট ডেট রেখেছি। সামনের বছরের পরের বছর ইন্টারন্যাশনাল বৃদ্ধদিবসে হোম ওপেন করে দেব। এর মধ্যে যে করে হোক কাজ শেষ করতেই হবে।

—তার মানে আপনার খুব পরিশ্রম যাবে?

—পরিশ্রম না করলে কি ফল পাওয়া যায় শরণ্যা? অমানুষিক খাটুনি খাটতে হবে। অনেক টাকার ব্যাপার। সব মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ লাখ টাকার প্রোজেক্ট। জমিতেই তো প্রায় ছ’লাখ পড়ছে। তারপর ফান্ড রেজ করা, আর্কিটেক্টদের ধরে একটা সুন্দর প্ল্যান বানানো, এখানে ছোটাছুটি, ওখানে ছোটাছুটি, রেগুলার দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে বাড়ি তৈরির তদারকি…

—গভর্নমেন্ট টাকা দেবে না?

—কিছু হয়তো দেবে। তবে মেজর পোরশান বাইরে থেকেই তুলতে হবে।

—কিন্তু মামণি, এত ধকল আপনি নিতে পারবেন? এদিকে তো আপনার সুহাসিনীও আছে, সেখানেও তো সময় দিতে হবে।

আপনার সুহাসিনী শব্দবন্ধটা নিবেদিতাকে ভারী তৃপ্তি দেয়। মনে হয় পঁয়ত্রিশ বছরের শ্রম সার্থক। প্রীত মুখে বললেন, —পারতেই হবে। গরিব মেয়েদের নিয়ে কিছু কাজ তো করলাম, এবার মিডল্‌ক্লাসদের কথাও একটু ভাবি। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে বাবা-মাকে শেষ বয়সে যে কী দুর্দশায় পড়তে হয়। তোমার বাবা-কাকারা নয় তোমার ঠাকুমাকে মাথায় করে রেখেছেন, কিন্তু বেশিরভাগ বাড়িতেই তো…

বলতে বলতে নিবেদিতা থমকে গেলেন। শরণার পরিবারের উল্লেখ শরণাকে আহত করল না তো? প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, —তোমার সেই রিসার্চে জয়েন করার কী হল?

—স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না। বাইরে গেছেন। নেক্সট্ উইকে ফিরবেন।

—ও। ডক্টরেটের পর তোমার কী করার ইচ্ছে?

—দেখি। এখনও কিছু ভাবিনি সে ভাবে।

—ও।

নিবেদিতা আর কথা খুঁজে পেলেন না। একবার ভাবলেন অনিন্দ্যর কথা তুলবেন কিনা। পারলেন না। বাধল। শরণ্যার সঙ্গে আর্যরও বেশ ভাব হয়েছে। একমাত্র শরণ্যার সঙ্গেই বাক্যালাপ চলে আর্যর, লক্ষ করেছেন নিবেদিতা। পরশু কী নিয়ে যেন আলোচনাও হচ্ছিল দু’জনের, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে কানে এসেছিল। পড়াশুনো নিয়ে কথা হচ্ছিল কি? কিন্তু দু’জনের সাবজেক্ট তো এক নয়। একজন প্রাচীন ইতিহাস, অন্যজন অর্থনীতি। জিজ্ঞেস করবেন শরণাকে? থাক। আর্য কী বলেন, কী ভাবেন তা নিয়ে কবেই বা মাথা ঘামিয়েছেন নিবেদিতা!

শোভাবাজার পৌঁছোতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। এক বৃদ্ধ দোতলা বাড়ির গাড়িবারান্দায় এসে থামল সুরেন।

নামতে নামতে শরণ্যা বলল, —বাহ্, দারুণ তো। এ রকম পুরনো আমলের বাড়ি আমার ভীষণ ভাল লাগে।

নিবেদিতা বললেন, —বাড়িটাকে দেখতে যত থুরথুরে লাগে, তত বুড়ো কিন্তু নয়। লেট থারটিজে তৈরি। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার লাগার আগের বছরে। আমার ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন। বাগবাজারের পৈতৃক ভিটে ছেড়ে এসে। মেনটেনেন্স নেই তো, তাই এই হাল। দ্যাখো, কার্নিশে বটগাছ গজিয়ে গেছে। আমার বাবা এই বাড়িতেই বড় হয়েছেন।

বাড়িটার একতলা অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা। শীত শীত করে। চওড়া খানিকটা প্যাসেজের পরে ডানদিকে সিঁড়ি উঠে গেছে। ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে একতলায়। প্রেস চলছে।

দোতলায় উঠতে উঠতে শরণ্যা জিজ্ঞেস করল, —আপনাদের বাগবাজারের বাড়িটার এখন কী অবস্থা?

—ভেঙেচুরে গেছে, তবে আছে এখনও। সে তো প্রায় রাজপ্রাসাদের মতো। পাঁচ পুরুষের বনেদি বাড়ি, অজস্র শরিক, এখনও মানুষে গিজগিজ করে। তোমার বউভাতের দিন তো সবাই এসেছিল, দ্যাখোনি?

কথা আর এগোল না। সিঁড়ির মুখে স্বরূপা। নিবেদিতারই সমবয়সি। লম্বা ছিপছিপে চেহারা। মুখে বয়সের ছাপ পড়লেও দেখে বোঝা যায় যৌবনে বহু তরুণের হৃদয় বিদীর্ণ করেছেন।

স্বরূপার মুখে ছদ্ম কোপ, —এতদিনে তা হলে তোমাদের আসার সময় হল?

নিবেদিতা হেসে বললেন, —সত্যি, কিছুতেই আর সময় হচ্ছিল না। জানোই তো কী ভাবে ফেঁসে থাকি।

—আমাকে বলে কী হবে, মাকে গিয়ে বোঝাও।

শরণ্যা প্রণাম করল স্বরূপাকে, —ভাল আছেন তো মামিমা?

—থাক থাক। সুখে থাকো। স্বরূপা শরণ্যার চিবুক ছুঁলেন, —তোমার মাসি… কণার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল। কণা বলছিল তোমার বাবা-মা নাকি এখনও তোমার শোকে মুহ্যমান। দুঃখ ভুলতে তাঁরা নাকি কেদারবদরি বেড়াতে যাচ্ছেন!

শরণ্যা হাসি হাসি মুখে বলল, —এখন তো নয়, যাবে সেই মে মাসে। বাবার এখন তো জোর ইয়ারএন্ডিং চলবে। সেই এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

শরণ্যা কথা বলছে স্বরূপার সঙ্গে। নিবেদিতা সামনে বড় ঘরটায় ঢুকলেন। ঘর জুড়ে সাবেকি আসবাব। মাঝখানে পাতা পালঙ্কে আধশোওয়া হয়ে আছেন শেফালি, পরনে ধবধবে সাদা থান। আশি ছুঁই ছুঁই শেফালির, চুল আর কাপড় দুটোই এক রংয়ের।

নিবেদিতাকে দেখেই শেফালি হাউমাউ করে উঠলেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে শান্ত করলেন নিবেদিতা। বউ দেখালেন।

সুন্দর একটা আনন্দের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। চলছে কথার পরে কথা। নিবেদিতার খুড়তুতো দাদা জ্যোতিশংকরও উঠে এসেছেন ঘুম থেকে, যোগ দিয়েছেন আড্ডায়। জ্যোতিশংকর আর স্বরূপার ছেলেমেয়ে দু’জনেই কলকাতার বাইরে থাকে, স্বরূপা তাদের ছবি দেখালেন শরণ্যাকে, শেফালি শোনালেন তাঁর তিন মেয়ের নাতিনাতনির গল্প।

বাড়ি বিক্রির প্রসঙ্গে আসার জন্য নিবেদিতা ছটফট করছিলেন। স্বরূপা জলখাবারের আয়োজন করতে চলে যাওয়ার পর পাড়লেন কথাটা। বললেন, —তা হলে সইসাবুদগুলো কবে হচ্ছে সোনাদা?

জ্যোতিশংকর এতক্ষণ হালকা মুডে ছিলেন, হঠাৎই টান টান। চিন্তিত মুখে বললেন, —সবই তো রেডি হয়ে গিয়েছিল রে খুকু। এদিকে যে আবার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।

—সে কী? কী হল?

—মিনু তো এখন কানাডা থেকে আসতে পারবে না। সে তো এখন মনট্রিলে আরও ক’মাস আটকে গেল।

মিনু মানে নিবেদিতার বড়পিসির মেজ মেয়ে। শোভাবাজারের এই বাড়িই এখন চার তরফের। সোমশঙ্কররা দুই ভাই, দুই বোন। বড়পিসি মারা গেছেন, তাঁর উত্তরাধিকারী এখন তাঁর তিন মেয়ে। এক মেয়ের সই বাকি থাকলেও এ বাড়ি এখন বেচা যাবে না, নিবেদিতা জানেন। বউয়ের বাচ্চা হবে বলে মিনুকে তার বড় ছেলে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রেখেছে এখন।

নিবেদিতা ভুরু কুঁচকে বললেন, —এ তো ভারী অন্যায় কথা। মিনু তা হলে কাউকে একটা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে দিক।

—সে তো দিয়েই গেছে। নইলে আমি লাখোটিয়ার সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করলাম কী করে। কিন্তু বিক্রির সময়ে সকলকেই তো প্রেজেন্ট থাকতে হবে।

—তার মানে আবার পিছোল?

—কী আর করা। অ্যাদ্দিন যখন ধৈর্য ধরলাম…

নিবেদিতা তেতো হাসলেন, —তোমার তো ধৈর্য ধরতে অসুবিধে নেই সোনাদা। বাড়ি ছ’ মাস পরে বেচলেও যা, বিশ বছর পরে বেচলেও তাই। লস যা হওয়ার তা তো আমাদেরই।

কথার অন্তর্নিহিত অর্থটা ধরতে পেরেছেন জ্যোতিশংকর। তিনি এ বাড়ির পুরো দোতলাটা জুড়ে আছেন, প্রোমোটার নিলে তিনি পাবেন একটি ফ্ল্যাট, বাকিরা নগদ টাকা। কোনও দিনই এ বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে তাই জ্যোতিশঙ্করের তেমন চাড় ছিল না। নিবেদিতার ইঙ্গিতটা সেদিকেও।

ঈষৎ ম্রিয়মান গলায় জ্যোতিশঙ্কর বললেন, —দ্যাখ খুকু, চার ভাগের বাড়ি আমি একা ভোগ করছি ঠিকই, তবে দেখভালও তো করছি। এই তো একতলার সিলিংয়ের চাঙর ভেঙে পড়ছিল, পুরো সারাতে হল…

—কিন্তু খরচা কি তোমার নিজের পকেট থেকে করতে হয়েছে সোনাদা? নিবেদিতা বলব না বলব না করে বলেই ফেললেন, —প্রেস থেকে যে ভাড়াটা পাও, আমরা তো কোনও দিন তার ভাগ চাইনি। আমিও না, মিনু চিনুরাও না, ছোটপিসিরাও না। কী, ঠিক বলছি?

শেফালি হঠাৎ বলে উঠলেন, —সে আর কত পায় রে খুকু? প্রেস তো বসেছে সেই তোর কাকার সময় থেকে। তখনকার দুশো টাকা ভাড়া এখন বেড়ে বেড়ে সাড়ে চারশো। ওই টাকা তো বাড়ির ট্যাক্সেই বেরিয়ে যায়।

—কিন্তু কাকিমা, ভাড়াটের জন্যই তো দামটাও কমে গেছে। পাঁচ কাঠা তিন ছটাক সাতাশ স্কোয়্যার ফিট জমি, বাড়ি বাদ দিয়ে শুধু জমিরই তো এখানে বিশ লাখ টাকা দাম হওয়া উচিত ছিল।

জ্যোতিশঙ্কর বললেন, —সেটা অবশ্য ঠিক। ওই হারামজাদাদের জন্যই দাম পুরোপুরি তোলা গেল না।

নিবেদিতা মনে মনে বললেন, জ্ঞানপাপী! লাখখাটিয়া সাকুল্যে দাম দিয়েছে উনিশ লাখ, নিবেদিতার ভাগে পাঁচ লাখও পুরো জুটবে না। এদিকে সোনাদা নিজেদের জন্য একটি হাজার স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। ক্যাশ নেবে না বটে, তবে এই এলাকায় ওই ফ্ল্যাটের দাম দশ লাখের বেশি বই কম হবে কি? মুখে যাই বলুক, ক্ষীরটা সোনাদা একাই খেল।

শোভাবাজারের বাড়ি থেকে বেরোনোর পরও ভেতরটা বিস্বাদ হয়ে রইল নিবেদিতার। টাকাটা এখন হাতে আসা খুব জরুরি ছিল। আর্য তো শুধু সংসারের কাঁচা বাজারের খরচাটুকু টানেন, আর ইলেকট্রিক টেলিফোনের বিলটা। বাকি সবই তো নিবেদিতার কাঁধে। বাড়িতে কাজের লোক আছে, ড্রাইভার আছে, গাড়ির তেল আছে, মাসকাবারি, এটা সেটা…। নিজের হাতখরচও তো আছে কিছু। এর মধ্যে বাড়িভাড়া থেকে আসে মাত্র চার হাজার, বেশির ভাগটা বাবার রেখে যাওয়া অর্থের সুদেই চলে। তা সেই সঞ্চয়েও তো কবেই হাত পড়ে গেছে। সুরেন বলছিল মেকানিক নাকি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে গাড়ি টিপটপ করতে গেলে অন্তত তিরিশ হাজার পড়বে। তার চেয়ে নাকি নতুন কিনে নেওয়া ঢের লাভজনক। একটা নতুন গাড়ির ইচ্ছে তো নিবেদিতারও আছে, কিন্তু সেও তো প্রায় আড়াই লাখের ধাক্কা। ছ’ মাসের মধ্যে গাড়ি যদি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে, তা হলেই তো চিত্তির। ভল্টে কিছু শেয়ারের কাগজ রাখা আছে, ছেড়ে দেবেন এখন? বাজার এখন খুব ডাল, ভাল দামও তো পাবেন না। নাহ্, সঞ্চয়ের ভাণ্ডার খালি করাটা উচিত হবে না। কখন কী বিপদ আসে কেউ বলতে পারে!

গাড়ি পার্ক স্ট্রিট পেরিয়ে গেছে। বাইরে শেষ বিকেলের মলিন আলো। নিবেদিতা সিটে মাথা রেখে বসে আছেন চোখ বুজে। হিসেব কষছেন। হিসেব মেলাচ্ছেন।

শরণ্যা পাশ থেকে ডাকল, —মামণি?

—উঁ ?

—শরীর খারাপ লাগছে?

—না তো।

—কী ভাবছেন এত?

—কিছু না। নিবেদিতা সোজা হলেন। ঠোঁটে আবছা হাসি ফুটিয়ে বললেন, বৃদ্ধাশ্রমের চিন্তাটাই ঘুরছে মাথায়। কী ভাবে যে কী করব…!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *