॥ ২ ॥
ফেলুদা যদিও একদিন সময় চেয়েছিল, সুধীরবাবু চলে যাওয়ার এক ঘন্টার মধ্যেই ও রাজস্থান যাওয়া ঠিক করে ফেলল। কথাটা আমাকে বলতে আমি বললাম, ‘আমিও যাচ্ছি তো?’
ফেলুদা বলল, ‘এক মিনিটের মধ্যে রাজস্থানের পাঁচটা কেল্লাওয়ালা শহরের নাম করতে পারলে চান্স আছে।’
‘যোধপুর, জয়পুর, চিতোর, বিকানির আর…আর…বুঁদির কেল্লা!’
রিস্টওয়াচের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে তড়াক করে সোফা থেকে উঠে পড়ে সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে পায়জামা পাঞ্জাবি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরে নিয়ে ফেলুদা বলল, ‘আজ রোববার—দুটো পর্যন্ত ফেয়ারলি প্লেস খোলা—চট করে রিজার্ভেশনটা করে আসি।’
একটার মধ্যে ফেলুদা কাজ সেরে বাড়ি ফিরে এসে প্রথমেই ডিরেক্টরি খুলে নম্বর বার করে ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরার বাড়িতে একটা টেলিফোন করল। যে লোকটা নেই, তাকে ফোন করা হচ্ছে কেন জিজ্ঞেস করাতে বলল, ‘সুধীরবাবু লোকটা সত্যি কথা বলেছে কি না সেটার প্রমাণের দরকার ছিল।’
‘পেলে প্রমাণ?’
‘হ্যাঁ।’
দুপুরবেলাটা ফেলুদা বুকের তলায় বালিশ নিয়ে উপুড় হয়ে তার খাটে শুয়ে এক সঙ্গে পাঁচখানা বই ঘাঁটাঘাঁটি করল। দুটো বই পেলিক্যানের—সেগুলো প্যারাসাইকলজি সম্বন্ধে। এগুলো নাকি ফেলুদা তার কলেজের পুরনো বন্ধু অনুতোষ বটব্যালের কাছ থেকে ধার করে এনেছে। অন্য তিনটের মধ্যে একটা হল টড সাহেবের লেখা রাজস্থানের বই, আরেকটা হল গাইড টু ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বার্মা অ্যান্ড সিলোন, আর আরেকটা হল ভারতবর্ষের ইতিহাস, কার লেখা ভুলে গেছি।
বিকেলে চা খাবার পর ফেলুদা বলল, ‘তৈরি হয়ে নে। একবার সুধীরবাবুর বাড়ি যাওয়া দরকার।’
এখানে বলে রাখি যে, বাবাকে রাজস্থান যাচ্ছি বলাতে উনি খুব খুশি হলেন। উনি নিজে দাদুর সঙ্গে ছেলেবেলায় দুবার রাজস্থান ঘুরে এসেছেন। বললেন, ‘চিতোরটা মিস করিস না। চিতোরের কেল্লা দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। রাজপুতরা যে কত বড় বীর যোদ্ধা ছিল সেটা তাদের দুর্গের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।’
সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাত আমরা সাত নম্বর মেছোবাজার স্ট্রিটে গিয়ে হাজির হলাম। ফেলুদা যেতে রাজি হয়েছে শুনে সুধীরবাবুর মুখে আবার সেই গদ্গদ ভাব ফুটে উঠল।
‘কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব আপনাকে তা বুঝতে পারছি না।’
ফেলুদা বলল, ‘এখনও সেটার প্রয়োজন আসেনি সুধীরবাবু। এখন ধরে নিন আমরা এমনি বেড়াতে যাচ্ছি, আপনার অনুরোধে যাচ্ছি না!’
‘যাই হোক, একটু চা খাবেন তো?’
‘সময় খুব কম। আমরা কালই রওনা হচ্ছি। কিন্তু তার আগে দুটো কাজ আছে। এক হচ্ছে—আপনার ছেলের একটা ছবি চাই। আর দুই—যদি সম্ভব হয়, তা হলে সেই নীলু ছেলেটির সঙ্গে একবার দেখা করব—সেই যাকে কিডন্যাপ করেছিল।
সুধীরবাবু বললেন, ‘এমনিতে সে ছেলে বিকেলে বাড়িতে থাকে না। তা ছাড়া পুজোর বাজার, বুঝতেই তো পারছেন। তবে আজ বোধহয় তাকে আর বেরোতে দেবে না। দাঁড়ান, আগে ছবিটা এনে দিই আপনাকে।’
সুধীরবাবুর বাড়ির তিনটে বাড়ি পরে একই ফুটপাথে হল সলিসিটর শিবরতন মুখার্জির বাড়ি। ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন; সামনের বৈঠকখানায় তক্তপোশে একজন মুখে শ্বেতীর দাগওয়ালা লোকের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছিলেন। সুধীরবাবুর কথা শুনে বললেন, ‘আপনার ছেলের দৌলতে আমার নাতিরও যে খ্যাতি বেড়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি।—বসুন আপনারা। মনোহর!’
চাকর এলে পর শিবরতনবাবু বললেন, ‘এঁদের তিনজনের জন্য চা কর। আর দেখ তো নীলু আছে কি না—বল আমি ডাকছি।’
আমরা একটা বড় টেবিলের পাশে তিনটে চেয়ারে বসেছিলাম। আমাদের দু পাশের দেয়ালের সামনে সিলিং পর্যন্ত উঁচু আলমারি মোটা মোটা বইয়ে ঠাসা। ফেলুদা বলে যে আইনের ব্যাপারে যত বই লাগে, অন্য কিছুতেই নাকি তত লাগে না।
আমি এই ফাঁকে একবার মুকুলের ফোটোটা ভাল করে দেখে নিলাম। বাড়ির ছাতে তোলা ছবি। ছেলেটি রোদে ভুরু কুঁচকে গম্ভীর মুখ করে সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
শিবরতনবাবু বললেন, ‘নীলুকে আমরাও অনেক কিছু জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করেছি। গোড়ার দিকে তো কথাই বলছিল না; নাভার্স শকে গুম মেরে গিয়েছিল। বিকেলের দিক থেকে একটু নরম্যাল মনে হচ্ছে।’
‘পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘ধরে নিয়ে যাবার পর দেওয়া হয়েছিল। তবে তারা কিছু করবার আগেই তো দেখছি ফেরত এসে গেল।’
এইবার নীলু ছেলেটি এসে চাকরের সঙ্গে ঘরে ঢুকল। সত্যিই, ছবিতে মুকুলের যে চেহারা দেখছি, তার সঙ্গে বেশ মিল আছে। দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে ছেলেটির এখনও ভয় কাটেনি। সে সন্দেহের ভাব করে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে।
ফেলুদা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ‘তোমার হাতে বুঝি ব্যথা পেয়েছ, নীলু?’
শিবরতন কী জানি একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ফেলুদা তাঁকে ইশারা করে থামিয়ে দিল। নীলু নিজেই প্রশ্নটার জবাব দিল—
‘ওরা যখন আমার হাত ধরে টানল, তখন আমার হাতে ভীষণ জ্বালা করল।’
কবজির কিছু ওপরে কাটা দাগটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
ফেলুদা বলল, ‘ওরা বলছ—তার মানে একজনের বেশি লোক ছিল বুঝি?’
‘একজন লোক আমার চোখটা আর মুখটা চেপে ধরলে, আর কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠল। আর আরেকজন তো গাড়ি চালাল। আমার খুব ভয় করছিল।’
‘আমারও ভয় করত,’ ফেলুদা বলল, ‘তোমার চেয়েও বেশি। তুমি খুব সাহসী। তো তোমাকে যখন ধরল, তখন তুমি কী করছিলে?’
‘আমি ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিলাম। মতিদের বাড়িতে পুজো হয়। মতি আমার ক্লাসে পড়ে।’
‘রাস্তায় তখন বেশি লোকজন ছিল না বুঝি?’
শিবরতনবাবু বললেন, ‘এ দিকটায় পরশু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। বোমা-টোমা পড়েছিল। তাই কাল সন্ধের দিকে লোক চলাচলটা একটু কমেছে।’
ফেলুদা মাথা নেড়ে একটা হুঁ শব্দ করে আবার নীলুর দিকে ফিরে বলল, ‘তোমাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেল?’
‘জানি না। আমার চোখ বেঁধে দিয়েছিল। অনেকক্ষণ গাড়ি চলল।
‘তারপর?’
‘তারপর একটা চেয়ারে বসাল। তারপর বসিয়ে একজন বলল, তুমি কোন ইস্কুলে পড়? আমি ইস্কুলের নাম বললাম। তারপর বলল, তোমাকে যা জিজ্ঞেস করছি তার ঠিক ঠিক উত্তর দাও, তা হলে তোমার ইস্কুলের সামনে নামিয়ে দেব, আর তা হলে তুমি বাড়ি যেতে পারবে তো? আমি বললাম, হ্যাঁ পারব। তারপর আমি বললাম, কী জিজ্ঞেস করবে তাড়াতাড়ি করো, দেরি হলে মা বকবে। তখন লোকটা বলল, সোনার কেল্লা কোথায়? তখন আমি বললাম, আমি জানি না, আর মুকুলও জানে না; ও খালি সোনার কেল্লা জানে। তখন ওরা সব কী ইংরিজিতে বলল, মিসটেক। তারপর বলল, তোমার নাম কী? আমি বললাম, মুকুল আমার বন্ধু কিন্তু সে রাজস্থানে চলে গেছে। তখন বলল, জায়গাটার নাম তুমি জান? আমি বললাম, জয়পুর।’
‘জয়পুর বললে?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘না না, যোধপুর। হ্যাঁ, যোধপুর বললাম।’
নীলু একটু থামল। আমরাও সকলে চুপ। চাকর চা আর মিষ্টি এনে রেখে গেছে, কিন্তু কারুরই সে দিকে দৃষ্টি নেই। ফেলুদা বলল, ‘আর কিছু মনে পড়ছে?’
নীলু একটু ভেবে বলল, ‘একজন লোক সিগারেট খাচ্ছিল। না না, চুরুট।’
‘তুমি চুরুটের গন্ধ জান?’
‘আমার মেসোমশাই খায় যে।’
‘সেই রাত্রে তুমি ঘুমোলে কোথায়? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
নীলু বলল, ‘জানি না তো।’
‘জান না? জান না মানে?’
‘আমাকে একবার বলল, দুধ খাও। তারপর একটা খুব ভারী গেলাসে দুধ দিল আর আমি খেলাম। আর তারপর তো আমি ঘুমিয়ে পড়লাম বসে বসেই।’
‘তারপর? ঘুম ভাঙল কখন?’
নীলু একটু বেচারা-বেচারা ভাব করে শিবরতনবাবুর দিকে তাকাল। শিবরতনবাবু হেসে বললেন, ‘ওর ঘুম ভাঙে বাড়িতে আসার পর। ওকে ওর স্কুলের সামনে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। তখন ও ঘুমন্ত। বোধহয় ভোর রাত্রের দিকে। তারপর আমাদের বাড়িতে যে লোকটা খবরের কাগজ দেয়, সে ভোরে সাইকেল করে ওখান দিয়ে যাবার সময় দেখতে পায়। ও-ই এসে আমাদের বাড়িতে খবর দেয়। তারপর আমি আর আমার ছেলে গিয়ে ওকে নিয়ে আসি। ডাক্তার বললে যে, কোনও ঘুমের ওষুধ একটু হেভি ডোজে খাইয়ে দিয়েছিল আর কী।’
ফেলুদা গম্ভীর। চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিয়ে চাপা গলায় একবার শুধু বলল, ‘স্কাউন্ড্রেলস্!’ তারপর নীলুকে পিঠ চাপড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ নীলুবাবু। এবার তুমি যেতে পারো।’
শিবরতনবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় বেরোবার পর সুধীরবাবু বললেন, ‘চিন্তার কারণ আছে বলে মনে করছেন কি?’
ফেলুদা বলল, ‘কয়েকজন অত্যন্ত লোভী এবং বেপরোয়া নোক যে আপনার ছেলের ব্যাপারে একটু বেশি মাত্রায় কৌতূহলী হয়ে পড়েছে সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে তারা রাজস্থান পর্যন্ত যাবে কি না সেটা বলা মুশকিল। ভাল কথা, আপনি বরং আমাকে একটা চিঠি দিয়ে দিন। ডক্টর হাজরা তো আর আমাকে চেনেন না। আপনি আমাকে ইনট্রোডিউস করে দিলে সুবিধে হবে।’
চিঠিটা দেবার পর সুধীরবাবু আরেকবার ফেলুদাকে রাজস্থানের ভাড়াটা অফার করলেন। ফেলুদা তাতে কানই দিল না। বাসস্টপের কাছাকাছি এসে ভদ্রলোক বললেন, ‘গিয়ে অন্তত একটা খবর দেবেন স্যার। বড্ড চিন্তায় থাকব। অবিশ্যি ডাক্তারবাবু লিখবেন চিঠি, নিজেই কথা দিয়েছেন। কিন্তু যদি নাও লেখেন, আপনি অন্তত একখানা…’
বাড়িতে ফিরে এসে গোছগাছ করার আগে ফেলুদা তার বিখ্যাত নীল খাতা ভলিউম সিক্স খুলে খাটে বসে বলল, ‘কতগুলো তারিখের হিসেব বল তো দেখি—লিখে নি। ডক্টর হাজরা মুকুলকে নিয়ে রাজস্থান রওনা হয়েছেন কবে?’
‘গতকাল ৯ই অক্টোবর।’
‘নীলুকে কিডন্যাপ করেছিল কবে?’
‘কালই। সন্ধেবেলা।’
‘ফেরত দিয়েছে আজ সকালে, অথাৎ ১০ই। আমরা রওনা হচ্ছি কাল ১১ই সকালে। আগ্রা পৌঁছাব ১২ই। সেদিনই বিকেলে ট্রেনে চড়ে সেদিনই রাত্রে পৌঁছাব বান্দিকুই। বান্দিকুই থেকে রাত ১২টায় গাড়ি, মারওয়াড় পৌঁছাব পরদিন ১৩ই দুপুরে। সেখান থেকে আবার গাড়ি বদল করে যোধপুর পৌঁছাব সেদিনই—অর্থাৎ ১৩ই—সন্ধ্যাবেলা, ১৩ই…১৩ই…’
এইভাবে ফেলুদা কিছুক্ষণ আপন মনে বিড়বিড় করে কী জানি ক্যালকুলেট করল। তারপর বলল, ‘জিয়োমেট্রি। এখানেও জিয়োমেট্রি। একটা বিন্দু—সেই বিন্দুর দিকে কনভার্জ করছে কতগুলো লাইন। জিয়োমেট্রি…’