বিশ
বাড়িতে ঢোকার মুখেই কুরিয়ার সার্ভিসের বাহকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল প্রমিতের। নিজের নামে আসা অফিসের চিঠিটা দেখে আরেক ভাঙনের ঘণ্টাধ্বনি শুনল। খামটা রিসিভ করে, না খুলে, ভেতরে কী আছে, দেখার ইচ্ছা সংবরণ করে, বাসায় ঢুকে মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল হাঁসফাঁস করছেন মা।
খারাপ লাগছে, আম্মা?
লাগছে। মাথাটা জ্যাম হয়ে গেছে। বুকেও চাপ বোধ করছি।
চলল। চেক আপ করিয়ে আনি। এ বয়সে কোনো চাপকে অবহেলা দেখাতে নিষেধ করেন চিকিৎসকরা।
জানি। চাপকে কি অবহেলা করা যায়? ওটা নিজের এসে জুড়ে ধরে, বুক খামছে খবর দেয় তার উপস্থিতির কথা।
তাহলে চলো। যাই।
অপেক্ষা করো, আমার এক ফ্রেন্ডের মেয়ে, ডা. মোহসেনা আসছে। ও এসে যা বলে তাই করব।
মাকে সহজভাবে কথা বলতে দেখে স্বস্তি পেল প্রমিত। মা স্বাস্থ্য সচেতন আছেন, ছেলের অবর্তমানে ডাক্তার কল করেছেন, জেনে ভালো লাগল। স্বস্তি নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে ও খামটা খুলে বিষয়টা পড়ে চমকাল না। কারণ দর্শানো নোটিশ এসেছে। বেশ কয়েকদিন অফিসে যেতে পারেনি। এ রকম নোটিশ এ অবস্থায় স্বাভাবিক। সংকটের ভেতর ডুবে গিয়ে ও বুঝেছে আগুন যদি সীমালঙ্ঘন করে, যদি এর ধ্বংস চলতেই থাকে তবে আগুনের উৎসটা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। কঠিন সিদ্ধান্ত হবে এটি। কঠিনের ভেতর যে কোমল আরেক জগৎ রয়েছে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
রোদ্দুরের টান উপেক্ষা করবে কীভাবে? ভাবনা থেমে থাকে না। চলমান জীবনও না। শত বাধা থাকলেও তা টপকাতে হয়। বাধা ছাড়া জীবন হতে পারে না। হয় ধৈর্য ধরতে হবে, নয় তো সব কিছু মেনে নিতে হবে। দুয়ের মাঝে দূরত্ব কত? এসব চিন্তা চলমান অবস্থায় কাঁধে ঝোলানো এক ক্যাজুয়েল ব্যাগ নিয়ে বাসার সামনে উবার থেকে। নামল এক তরুণী। ঊনিই কি ডা. মোহসেনা? মায়ের ফ্রেন্ডের মেয়ে! জানি না তো ওর কথা! মা তার জগতে কতটুকু নিজেকে আড়াল করে রাখেন বুঝতে অসুবিধা হলো না। বিশেষ করে অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর এক সন্তানকে মানুষ করা থেকে শুরু করে তার বিয়ে দেওয়া সব কিছুই করে গেছেন নিপুণ ঢংগে। কখনও কারও কাছে হাত পাতেননি। সেই মার বন্ধু আছে। তার মেয়ে ডাক্তার। কল করলে বাসায় চলে আসবে–এতসব ঘটনা মাথায় স্থান পায়নি কখনও।
দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রিসিভ করল প্রমিত।
আপনি ডাক্তার মোহসেনা?
হ্যাঁ।
আমি প্রমিত।
আপনারে জানি।
জানেন? প্রমিতের কণ্ঠে টের পাওয়া গেল বিস্ময়।
আপনার ছোটবেলার ছবি আছে আমাদের বাসায়।
জানি না তো আমি!
এখন তো জানলেন।
জি।
আমার মা আর আপনার মা পিচ্চিকালের ফ্রেন্ড।
আম্মা এসব বিষয়ে আমার সঙ্গে কখনও কথা বলেননি।
বলার প্রয়োজন হয়নি, তাই বলেননি। এখন নিশ্চয় বলেছেন।
জি।
কথা বলতে বলতে দুজনেই চলে এলো মায়ের ঘরে। মোহসেনা একদম কাছে গিয়ে মায়ের মাথাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলল, কতদিন পর আপনাকে দেখলাম।
হ্যাঁ, মা। অনেকদিন পর। আজই তোমার মা ফোন করেছিল। যখন খারাপ লাগছিল তখনই। বলল, তুমি তোমার হাজবেন্ডসহ আমাদের পাড়াতেই থাকো।
জি। মা বলেছেন। আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছিলাম। আর তখনই মা বললেন আপনাদের বাসায় আসার জন্য। বাসাটাও চেনা সহজ। আটাশ নম্বর রোডে মসজিদের পাশে। ঢুকে গেলাম।
এসে ভালো করেছো, মা। কত বড় হয়ে গেছে। অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।
প্রমিত অবাক হয়ে গেল। টেলিপ্যাথি কী বুঝতে পারল। সমুহ কষ্টের সময় ফোন করেছেন পিচ্চিকালের বন্ধু! বাহ!
প্রেসার মেপে, পালস দেখে চোখ আর জিহ্বা দেখে ডা. মোহসেনা বলল, সবই ভালো আছে, আন্টি।
বুক খালি করা একটা শ্বাস বেরিয়ে গেল। স্বস্তি নিয়ে প্রমিত হাত রাখল মায়ের মাথায়। পৃথিবীর স্বর্গটা যেন মাথায় নেমে বসেছে এমনি অনুভূতি জোয়ার এলো মায়ের মনে। আনন্দ-জোয়ারে চোখ ফেটে দরদর করে নেমে এলো লোনাজল। হকচকিয়ে গেল প্রমিত। মোহসেনাও। প্রমিত বুঝল, মা কেবল করেই গেছেন ওর জন্য। কিছুই করা হয়নি মায়ের জন্য।
কিছুটা সময় যেতে দিল মোহসেনা। মায়ের জন্য ছেলের টান আর মায়ের চোখের অশ্রু তাকে জানিয়ে দিল দীর্ঘদিন একা যাতনায় ভুগেছেন মা, সন্তান কাছে থেকেও ছিল না। দূরে সরে গেছে যে টেরও পায়নি ছেলে, মায়ের জন্যও যে আলাদাভাবে কিছু করা উচিত ভেবে দেখেনি, ভাবনায় ঠাঁই পায়নি। সব সময় পেয়ে এসেছে মা থেকে। পাওয়ার স্বভাব থেকে, পাওয়ার লোভটা আকাশ ছুঁয়েছে। দেওয়া বা করার তাগিদ তৈরি হয়নি। প্রতিজ্ঞা করে বসল মাকে আর কষ্ট দেবে না।
কিছুটা স্থিত হয়ে গেলেন সায়েরা আমিন। তারপর চোখ খুলে তাকালেন মোহসেনার দিকে।
কোনো কারণে কষ্ট পেয়েছেন, চাপে ছিলেন, আন্টি?
সরাসরি প্রশ্নটা শুনে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল প্রমিত। মা কী জবাব দেয়, সব বলে ফেলে কিনা ভেবে শঙ্কিত হয়ে, সেই-ই বলল, আমার ব্যক্তিগত কারণে আম্মা কষ্ট পেয়েছেন।
ভালো। নিজের দোষটা ধরতে পেরেছেন। স্বীকার করেছেন। ভালো বেশ ভালো। নিজের ঘাটতি ধরা বেশ ভালো গুণ–আমাদের স্যাররা বলে থাকেন, পড়িয়েছেন ক্লাসে।
হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন। আমাদের একজন প্রিয় শিক্ষক আছেন, আলি আকবর স্যার। রিটায়ার করেছেন তিনি। তাতে কি? এখনও ছেলেমেয়েরা বিপদে-আপদে ছুটে যায় তাঁর কাছে। তিনি সবার কথা মনোযাগ দিয়ে শোনেন। তারপর ভালো সিদ্ধান্ত বেছে নিতে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনিও প্রায়, আপনি যা বলেছেন, এমন কথা বলে থাকেন। আপনার কথা শুনে আমার স্যারের কথা মনে পড়ে গেল।
আমি তো আপনার স্যারের বয়সী না, আপনার বয়সী। আমাদের অ্যালবামে কয়েকটা ছবি আছে। সেসব ছবি আপনার ছোটবেলার কথা আমাকে মনে করিয়ে দিল এই মুহূর্তে। আপনার স্যারের কথার ওজন আমার এখনকার বলা কথার ওজনের সমান। কারণ আমিও আমার স্যারের কথা বলেছি।
বাহ! আপনার কথা শুনে ভালো লাগল। কৌতূহল জাগল আমার ছবির ব্যাপারেও।
হ্যাঁ। জাগবেই তো! আমারও কৌতূহল ছিল আপনার ব্যাপারে। তখনকার আপনাকে এখন দেখে মেলাতে পারলাম না। ওই সিরিজ ছবিতে আপনি আমার গালে চড় মেরেছিলেন। খামছি দিয়েছিলেন। আমার খেলনাটাও কেড়ে নিয়েছিলেন। আর এখন দেখছি আপনি এক আদর্শ সন্তান। মায়ের কষ্টের কথা শুনে ছুটে এসেছেন। মায়ের কপালে হাত রেখে দাঁড়িয়েছেন। মায়ের ব্যথায় উপশম হয়েছে। তা মায়ের মনের কষ্টের ক্ষত তৈরি হাওয়ার উৎস কি আপনিই?
কী ভালোলাগা কথার উল্টো পিঠে কী ভয়ংকর প্রশ্নরে! চমকে গেল প্রমিত। ভালো ভালো, পটনো কথা বলে বলে এভাবে তাহলে কঠিন প্রশ্ন করতে হয়!
স্তব্ধ হয়ে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মোহসেনা আবার বলল, সারাজীবন এভাবে মায়ের যত্ন নিতে হবে।
প্রমিতের মুখে কথা ফুটছে না। বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে সদুপদেশ। আর ঠিক তখনই মুঠোফোন সেটটা বেজে ওঠায় একবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে স্টপ বাটনে টিপে লাইন কেটে দিল প্রমিত। আবার কল আসায় আবারও অফ করে দিল ও। সদুপদেশের আলো ঢুকে যেতে লাগল ওর মুখে।
সায়েরা আমিনের স্বস্তির জগতে আবার উড়ালচাপ আঘাত হানল। এ আঘাতে বিভ্রান্ত না হয়ে বললেন
ফোন ধরো। জরুরি কোনো কল হতে পারে না?
মোহসেনাও বলল, বারবার লাইন কেটে দিচ্ছেন কেন? মায়ের সামনে ফর্মাল হওয়া উচিত নয়। ছোটবেলার খেলার সঙ্গীর সঙ্গেও না।
এ কথাটাও ভালো লাগল প্রমিতের। দুজনে কথার চাপে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেট বের করে স্ক্রিনে ভেসে থাকতে দেখল অফিসের এমডি স্যারের কল! ভেবেছিল
এক্সবুমর এক্সােম এসেছে কলে। সারাক্ষণই ও অস্থির হয়ে কল করে অথচ কল করেছেন বস্! কী সাংঘাতিক কথা। দ্রুত কল ব্যাক করে দেখল এমডি স্যারের নম্বর বিজি। কিছুক্ষণ গ্যাপ দিয়ে আবারও কল করে অস্থির হয়ে উঠল প্রমিত।
ধৈর্য ধরো! অস্থির হচ্ছে কেন? কে কল করেছে?
এমডি স্যার। অফিস প্রধান।
বাহ! আপনার দেখি পরম সৌভাগ্য! সরাসরি এমডি স্যারের কল! বলল মোহসেনা।
এ কথা কানে ঢুকল না প্রমিতের। ও তাকিয়ে রইল ফিরতি কলের আশায়। কল আসছে না। অস্থিরতা বাড়ছে। একই সঙ্গে সেই অস্থিরতা সঞ্চারিত হচ্ছে মায়ের বুকেও। কোনো দুঃসংবাদ নয় তো! ইনটিউশন ঢুকে গেল তাঁর মাথায়।
কিছুক্ষণ গ্যাপ দিয়ে আবার কল করল প্রমিত। এখনও ফোন এনগেজড। কথা বলছেন এমডি স্যার। মা তাকিয়ে আছেন ছেলের মুখের দিকে। ছেলে তাকিয়ে আছে ফোনসেটের দিকে। মোহসেনা চোখ ঘুরিয়ে দেখছে চারপাশ।
আবার রিংটোন বেজে উঠল।
স্যার, স্যরি স্যার, আপনার কল রিসিভ করতে পারিনি!
কী বলছে, বাপি? আমাকে
স্যার বলছো কেন?
রোদ্দুর, তুমি?
হ্যাঁ। মাম্মির নম্বরটা কি নেই তোমার ফোনবুকে?
না। মা। আছে। আমি অন্যকিছু ভাবছিলাম। খেয়াল না করে ভেবেছিলাম আমার অফিসের স্যার কল করেছেন।
তোমার মন কি সারাক্ষণ অফিসের স্যারের কথা ভাবে? আমার কথা ভাবে না?
ভাবি, মা। ভাবি। তুমি হচ্ছো আমার প্রাণের টুকরো। তোমার কথা না ভেবে কি পারা যায়?
তো, আমার মাম্মির নম্বর ফেলে দিয়েছো কেন?
না। দেইনি। আছে তো!
না। তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য চলে গেছো। তুমি আমাকে আদর করো না। মাম্মিকেও না।
ওরে বাপরে! মেয়ের অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে গেল। একই সঙ্গে অস্থির হয়ে উঠল। বুঝল আবার কল আসার নোটিশ সংকেত আসছে। চোখের সামনে সেটটা ধরে দেখল এমডি স্যার আবার কল করেছেন। কিছু ভাবার সুযোগ পেল না ও। সেকেন্ডের সিদ্ধান্তে ক্রিনের ওপর বুড়ো আঙুল দিয়ে স্ক্রল করে ধরল স্যারের কল, কী ব্যাপার, আপনি উধাও, কোনো খবর না দিয়ে এভাবে উধাও হয়ে গেলেন কেননা অফিস থেকে?
উধাও হইনি, স্যার। সমস্যায় আছি, স্যার।
সমস্যার কথা অফিসে জানাবেন না? আমি তো আপনার বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ পাঠিয়েছি। কোন ফাঁকে সিগনেচার করেছি টের পাইনি।
জি, স্যার। নোটিশ পেয়েছি কিছুক্ষণ আগে। এখনও খুলে পড়ার সময় পাইনি। বাসায় চিকিৎসক এসেছেন। হঠাৎ এখন আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন!
স্যরি স্যরি। ওকে, ইটস ওকে। মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
জি স্যার।
লাইন কেটে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল প্রমিত। তারপর বলল, বাব্বা, কী বিপদটাই না গেল!
বিপদ তো মায়ের অসুস্থতার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পার পেলেন। মেয়ের লাইন কাটার বিপদবার্তা কার ঘাড়ে চাপাবেন?
প্রমিত হেসে বলল, নিজের ঘাড়ে।
কথা শেষ করে আগেই আবার কল ঢুকল সেটে। তাড়াহুড়ো করে কল রিসিভ করতে গিয়ে ভয়েজ অপশনে চাপ পড়ে স্পিকার লাউড হয়ে গেল।
মেয়ের লাইন কেটে দিলে কেন? তোমার মতো অসভ্য বর্বর আর হিংস্র বাবা কি আছে এ জগতে! মেয়ে কাঁদছে! তাকেও আঘাত করতে বাধে না তোমার?
আণবিক বোমা শব্দরূপে বিস্ফোরিত হলো এ ঘরে এখন। তার সাক্ষী হয়ে গেল মোহসেনাও!
বিব্রত হলো না সে। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বলল, মন খারাপ করবেন না। ভুল বুঝেছেন তিনি। পরিস্থিতি শান্ত হলে ভুলটা ধরতে পারবেন, বুঝবেন সব। এখন বুঝবেন না তিনি। এখন বোঝাতে কল করাও ঠিক হবে না। অপেক্ষা করুন। ওনার মাথা ঠাণ্ডা হোক। তারপর কল করুন। কিংবা ওনার কাছে গিয়ে সব খুলে বলুন।
মেয়ে কাঁদছে শুনে প্রমিতের মনটাও কেঁদে উঠল। সায়েরা আমিনেরও।
একুশ
ফলো আপ করতে এসে চিকিৎসকের চেম্বারে দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে আছে মিতু। রোদ্দুরও আছে। নানাভাই ধরে আছেন রোদ্দুরের হাত। অস্থির হয়ে ও একবার এদিক যাচ্ছে আবার ওদিক। অন্যান্য অনেক রোগীও অস্থির। সবাই আগে দেখাতে চায়।
কাছে গিয়ে অ্যাটেনডেন্টের রোদ্দুর বলল, আমার মাম্মির নাম ডাকছেন না কেন?
ডাকব। আর দুজন পরেই ডাকব।
এত দেরি হচ্ছে কেন? পাশে থেকে প্রশ্ন করলেন আলি আশরাফ চৌধুরী।
পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল অ্যাটেনডেন্ট। জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে রইল। পাশ থেকে অন্য এক রোগীর অভিভাবক বললেন, ভেতরে কি গল্পসপ্পো চলছে! চা-নাশতা খাচ্ছেন ডাক্তার সাহেব! পাত্তা পেলেন না তিনিও।
রোদ্দুর বলল, আমাদের সঙ্গেও এতক্ষণ কথা বলবেন ডাক্তার?
রোগীকে বেশি সময় দিলেও বিপদ। কম সময় দিলেও। ধৈর্য ধরো। তোমাকেও বেশি সময় নিয়ে দেখবেন।
আমাকে না তো। মাম্মিকে।
হুম। তোমার মাম্মিকে দেখবেন। তোমার সঙ্গেও কথা বলবেন।
আমাদের আগে দেওয়া যায় না?
তাহলে সিরিয়ালে অন্য রোগীরা রাগ করবে। আমাকে আর স্যারকে গাল দিবে। চাও তুমি সেটা?
না। না। আমি সিরিয়াল এলেই ঢুকব।
আলি আশরাফ চৌধুরী খেয়াল করলেন চিকিৎসকের দরজা পাহারা দেওয়া পাথরের মতো বসে থাকা এই অ্যাটেনডেন্টের কথাবার্তাও মূর্তির মতো শক্ত হলেও একদম সহজভাবে সে কথা বলছে রোদ্দুরের সঙ্গে। দেখে তার অস্থিরতা কমে গেল। ধৈর্য নিয়ে তিনি বসলেন মেয়ের পাশে। খেয়াল করলেন বসে থাকতে মিতুর কোনো অস্থিরতা নেই। ধৈর্যের ঘাটতি নেই। মনে হয় অন্য জগতে ছিল সে। মুঠোফোনে ডুবে ছিল। হঠাৎ বাবাকে কাছে বসতে দেখে। মুঠোফোন বন্ধ করে বলল, কিছু বলবে, আব্বা?
আলি আশরাফ চৌধুরী খেয়াল করলেন মেয়ের মুখের এক্সপ্রেশনে সমস্যার চিহ্ন নেই। হাতে ধরা ফাইলটা উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে দেখলেন ওর ডিসচার্জ নোটে অভিভাবকের জায়গায় লেখা আছে
আলম। চমকে উঠলেন নিজের নাম না দেখে। অন্যান্য কাগজপত্রও দেখতে লাগলেন। কোথাও স্বামী বা বাবার নাম নেই। মার নামের তো প্রশ্নই উঠল না। সাধারণত এখন ফাইলপত্রে বাবা-মার নাম লেখা বাধ্যতামূলক। একবার তাকালেন মেয়ের দিকে। মিতু আবার ডুবে গেছে মুঠোফোনে। ছেলে-মেয়েরা মুঠোফোনে কী এত দেখাদেখি করে সারাক্ষণ মুখ গুঁজে থেকে! ভাবতে ভাবতে চোখ তুলে তাকালেন সামনে। রোদ্দুরকে খুঁজলেন। রোদ্দুর নেই। ডানে তাকালেন, নেই। বামে-ও নেই। আচমকা লাফ দিয়ে উঠলেন বসা থেকে।
রোদ্দুর কোথায়?
ও! পিচ্চিটার নাম রোদ্দুর?
হ্যাঁ। কোথায় সে!
ভেতরে গেছে। এক ডাক্তার আপা ঢুকেছেন স্যারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তিনি ওকে দেখে চিনেছেন। তাঁর সঙ্গে ভেতরে ঢুকে গেছে পিচ্চিটা।
আমরা যাব?
না। বসুন। থমথমে গলার ভেতর থেকে না শুনে চমকে গেলেন আলি আশরাফ চৌধুরী। তার মনে হলো ছেলেটা পাথর ও দয়া-মায়াহীন নয়। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পাথর হয়ে বসে আছে। পাথর না হলে এখানে শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিনই হবে।
আবার চমকে উঠলেন। তাকে এক লোক এসে ধমক দিয়ে বললেন, দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি নীতিবান! অথচ ফাঁকে ফাঁকে নীতি ভাঙছেন। সিরিয়াল ছাড়াও তো ভেতরে লোক ঢোকাচ্ছেন।
আবার রোবটিক স্বর বেরিয়ে এলো, সিরিয়াল ছাড়া কোনো রোগী ঢোকেনি।
মুখে তো কঠিন কথা বলছেন। দূর থেকে বসে নিজের চোখেই তো দেখলাম এক সুন্দরী মহিলা এক বাচ্চার হাত ধরে ভেতরে ঢুকে গেল।
উনি রোগী নয়। ডাক্তার। স্যারের ওয়ার্ডের জুনিয়র ডাক্তার।
ডাক্তার হলেই ঢোকা যাবে! লম্বা লাইন বাদ দিয়ে অন্যকে সময় দেওয়া যাবে! এ কেমন ডাক্তারি!
এরকম কথায় লোকটার নাকে একটা ঘুষি উড়ে আসার কথা। তেমন কিছু ঘটল না। অ্যাটেনডেন্ট জাস্ট ইগনোর করল লোকটাকে। চোখ আর মুখের ভাষা কঠিন করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
আশরাফ আলি নিজেও যেন কিছু শিখলেন এই ছোকরার আচরণ থেকে। মানুষের উত্তেজিত কথা কীভাবে সামাল দিতে হয় বুঝে চুপচাপ গিয়ে বসলেন শূন্য চেয়ারে। মেয়ের পাশে। সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে মুঠোফোনটাকে কোলে নিয়ে সরে বসল মিতু। সামনে তাকিয়েই উঠে দাঁড়াল সে। দেখল রোদ্দুরের হাত ধরে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে কাজ করে সেই মায়াবী মেয়েটি, ডা. রুবিনা।
কেমন আছেন, মিতু আপা?
ভালো। ফলো আপে এসেছি।
আচ্ছা। আচ্ছা। বেশ ভালো।
আপনার মেয়েটা কিউট। বলেই ওর গাল টিপে দিয়ে বলল, এখন আসি। জরুরি কাজে এসেছিলাম স্যারের কাছে। বলে মায়ের হাতে রোদ্দুরকে গছিয়ে দিয়ে তিনি হাঁটা দিলেন সামনে।
রোদ্দুর ওর হাত ছাড়ল না। পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমাদের বাসায় আসবে তো!
উত্তরে এ মুহূর্তে হ্যাঁ বলা উচিত। না বলা উচিত নয়। ছোট্ট শিশুটির আবদার উপেক্ষা না করে ডা. রুবিনা কোনোটাই বলল না। কেবল রোদ্দুরের গাল টিপে দিলো। এক মায়াবী হাসি ছড়িয়ে দেওয়ায় রোদ্দুর বুঝে নিল উত্তরের আড়ালে লুকিয়ে আছে হ্যাঁ। হ্যাঁ আবিষ্কার করে, নিজ থেকেই ও ছেড়ে দিল ডা. রুবিনার হাত।
মিসেস মিতু! অ্যাটেনডেন্টের ডাক শুনে একসঙ্গে সচেতন হয়ে গেল ওরা।
প্রথমে ঢুকল রোদ্দুর। পেছনে মিতু। তারপর আলি আশরাফ চৌধুরী।
হাসিমুখে ওদের বরণ করলেন নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান।
কেমন আছেন এখন, মিতু?
মাথাটা ঝিম ঝিম করে। ধরে থাকে। ঘূর্ণিও ওঠে। ব্যথা হয় থেকে থেকে?
চোখে কোনো সমস্যা হয়?
না। তেমন কিছু বুঝিনি
তিনি চোখ পরীক্ষা করার যন্ত্র অফথালমোস্কোপ দিয়ে চোখ পরীক্ষা করলেন। রোগীর বিছানায় শুইয়ে হ্যাঁমার দিয়ে হাতে-পায়ের বিশেষ বিশেষ স্পটে টোকা দিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, সব ঠিক আছে, মিতু।
তো, ব্যথা কেন? উপসর্গগুলো কেন সৃষ্টি হচ্ছে? প্রশ্ন করলেন আলি আশরাফ চৌধুরী।
কোনো চাপে আছেন, মিতু? ইমোশনাল স্ট্রেসের মতো কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন?
অধ্যাপকের প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু হয়ে গেল মিতুর।
আলি আশরাফ চৌধুরী প্রশ্ন করলেন, চাপ মানে কি ধরনের চাপ?
জীবনের নানা ঘটনা থেকে চাপে পড়তে পারি আমরা। আমাদের দেহ-মন সব আক্রান্ত হতে পারে তখন। চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারি–এসব থেকেও এমন উপসর্গ আসতে পারে।
রোদ্দুর বলে বসল, মাম্মি সেদিন চিৎকার চেঁচামেচি করেছে। আমার ফোনকল কেটে দিয়েছিল বাপি। তা দেখে চিৎকার করেছে। বাপিকে জোরে জোরে বকেছে।
মিতু বলল, এ প্রসঙ্গ থাক। এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।
ওকে। আমি বুঝেছি। ঘন ঘন মেজাজ চড়ে গেলে বেটার ইউ স্যুড কনসাল্ট উইথ অ্যা প্রফেশনাল কাউন্সেলর অর সাইকিয়াট্রিস্ট।
.
মন খারাপ করে বেরিয়ে এল মিতু। তার যত ক্ষোভ গিয়ে পড়ল প্রমিতের ওপর। স্ত্রীর এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল অথচ কোনো দায়-দায়িত্বই নেই তার! উল্টো মেয়ের ফোন কলও কেটে দেয়! ভয়ংকর স্বামীটার ওপর ক্রোধের মাত্রা বেড়ে যেতে লাগল চক্রবৃদ্ধি হারে। এসেছিল উপসর্গ নিয়ে আলাপ করতে। বুঝল উপসর্গের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে কালসাপ। স্বামীর অবহেলা, উপেক্ষা। দিচ্ছে বিষের ছোবল। দেহকোষে ছড়িয়ে যাচ্ছে সে বিষের যন্ত্রণা।
মা, মাথা গরম করার দরকার নেই। জাস্ট ইগনোর দ্য বিহেভিয়ার অফ ইওর হাজবেন্ড। ইগনোর করা শিখলে তোমার সব চাপ কমে যাবে। রোদ্দুরের প্রতিও নজর দিতে পারবে। এখন আমাদের কাজ হলো রোদ্দুরকে মানুষের মতো মানুষ করা।
নানাভাই, কী বলছো? আমাকে কীভাবে তোমরা মানুষ করবে? আমি কি মানুষ না?
দ্রিম করে আঘাত হানল প্রশ্নটা। মিতুকে তো বটেই, আলি আশরাফ চৌধুরীও কিঞ্চিৎ হতবাক হয়ে বললেন, মানে তোমার পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে ঠিকঠাক মতো।
ওঃ। আচ্ছা মানুষ হতে হলে পড়াশোনা করতে হবে?
সেটা না করলে তো হবে না মা।
আচ্ছা। তাহলে আমি পড়ব ঠিক মতো।
খুশি হয়ে বাহবা দিলেন আলি আশরফ চৌধুরী। নাতনির পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, গুড গার্ল!
আর ঠিক এ সময় কল এলো তার ফোনে। নিজের ড্রাইভারের কল।
কী, বলো? আমরা নামছি।
স্যার! সমস্যা হয়ে গেছে!
কী সমস্যা?
ভিডিও মামলা দিয়ে ফেলেছেন ট্রাফিক সার্জেন্ট। পাঁচ হাজার টাকা জারিমানা করেছেন। ভিডিও তুলেছেন হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে।
শুনে মাথা ধরে গেল আলি আশরাফ চৌধুরীর। প্রায় চিৎকার করে বললেন, এখন কোথায় আছো, তুমি?
দূরে সরে এসেছি। ঘুরে আসতে তো ২০-৩০ মিনিট লেগে যাবে।
বেয়াদব! আমাকে না জানিয়ে এত দূরে চলে গেলে কেন?
উপায় ছিল না, স্যার!
তোমার আক্কেল হলো না! নামার সময়ে গাড়িটা নিয়ে উধাও হয়ে গেলে!
এই যে তুমি চিৎকার করছো, নানাভাই। ডাক্তার বলল না, চিৎকার চেঁচামেচি করা যাবে না!
দমে গেলেন আলি আশরাফ চৌধুরী।
মিতু বলল, ভেব না আব্বু, সিএনজি অটোতে চলে যাব।
বিকল্প উপায়ে যাওয়া যাবে। উত্তেজিত অবস্থায় কথাটা মনে হয়নি প্রথম। মিতুর কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন তিনি।
রাস্তায় আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা সিএনজি অটো ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। রোদ্দুর দেখল ওটার ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন আলম আংকেল। আলি আশরাফ চৌধুরীও অবাক হলেন। মুখ ফসকে বলে ফেললেন, আরে! আলম! আপনি দেখছি বিপদের বন্ধু!
মুখে কোনো জবাব দিল না আলম। কেবল বিগলিত হাসি দিয়ে নিজের সিট থেকে নেমে এসে পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বলল, উঠুন।
বাইশ
অফিস পরিবেশ অনুকূলে নয়। বরং প্রতিকূলে। ভেবেছিল এমডি স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি শোকজ নোটিশ পাঠালেও মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেছেন, নিশ্চয় ঝামেলা হবে না। এ আশা পূরণ হয়নি। অফিসে এসে শুনল শোকজে সিগনেচার করেছেন ঠিকই, কাগজের ভিড়ে বুঝতেই পারেননি যে শোকজ করেছেন তারই বিশ্বস্ত সহকর্মী প্রমিতের বিরুদ্ধে। আসলে কাজটা খুব চালাকির সঙ্গে করে নিয়েছেন ডিরেক্টর অ্যাডমিন, তার ক্ষমতাও কম নয়। তিনি আবার চেয়ারম্যান স্যারের খাস লোক। আর চেয়ারম্যানের সঙ্গে এমডির বিরোধ চলছে। অফিসের সবাই জানে বিষয়টা। প্রমিতও। তা যে এত জটিল পর্যায়ে গেছে ভাবতে পারেনি, সুযোগ পেলে চেয়ারম্যান কী করে বসেন কে জানে। তাদের দ্বন্দ্বের বলির পাঠা হয়েছে উভয় গ্রুপের কয়েকজন। এখন প্রমিতের একই পরিণতি হয় কিনা তা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছে আর আরেক সুহৃদ কলিগ। এমডি স্যারের সেও ভক্ত। প্রমিতেরও।
সে বলল, আপনি আগেই এমডি স্যারের সঙ্গে দেখা করেন। নইলে চেয়াম্যানের সঙ্গে যোগসাজশে ডাইরেক্টর অ্যাডমিন আপনার ক্ষতি করে ফেলতে পারেন।
কথাটা একদম উড়িয়ে দিতে পারল না প্রমিত। এমন সম্ভাবনার কথা ঢুকেছে ওর মাথায়ও। স্যারের খোঁজ করেছে। আসেননি অফিসে। অফিসের ক্লারিকেল প্রধানকে জিজ্ঞেস করলে খবর পাওয়া যেতে পারে, তিনি না-আসার কারণ জানার কথা ভেবে ইন্টারকমে ফোন করতে গিয়ে, থেমে গেল ও। বরং পিয়ন পঠিয়ে সালাম জানাল তাকে।
অফিস প্রধান মুহূর্তেই হাজির হলো ওর কক্ষে। প্রমিত বলল, ভালো আছেন?
জি। স্যার।
আমার ওপর দিয়ে তো বড় বিপদ গেল। ঝড়-ঝাঁপটা তো চলছেই।
জি, স্যার। শুনেছি। এমডি স্যার আমাকে বলে গেছেন আপনার কথা। •
বলে গেছেন মানে? কোথায় গেছেন?
তিনি তো সাত দিনের জন্য দেশের বাইরে গেছেন, বার্সেলোনায়।
মাথায় বাজ পড়ল কথাটা শুনে। তার প্রতিক্রিয়া বাইরে না প্রকাশ করে প্রমিত জিজ্ঞেস করল, কী বলে গেছেন?
বলেছেন, অ্যাডমিন অফিসার স্যার কৌশলে এমডি স্যারের নলেজে না দিয়ে অনেক চিঠির ভিড়ে আপনার শোকজটা সিগনেচার করে নিয়েছেন। ওটা দিয়ে যেন আপনার বড় কোনো ক্ষতি না হয়ে যায় আমাকে নজর রাখতে বলে গেছেন।
ধন্যবাদ আপনাকে। প্রমিতের কণ্ঠের দুঃশ্চিন্তা অবশ্য বোঝা গেল।
স্যার, কী বলেন? আমাকে ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন নেই।
আচ্ছা। ঠিক আছে, যান। প্রয়োজন হলে ডাকব। আমার কিছু জানার থাকলে জানাবেন।
জি স্যার। জি স্যার।
সুহৃদ কলিগও এসেছেন একই সময়। তিনিও শুনলেন অফিস প্রধানের কথা। সে চলে যাওয়ার পর সুহৃদ কলিগ বললেন, তার কথায় বিশ্বাস করবেন না। সে হলো ডাইরেক্টর অ্যাডমিনের এক নম্বর চামচা।
হ্যাঁ। জানি। তবুও তার মাধ্যমে খোঁজ নিলাম এমডি স্যারের। তিনি দেশের বাইরে থাকলেও তার মোবাইল নম্বর রোমিং করা থাকে। এখন রোমিং পাচ্ছি না। বন্ধ পাচ্ছি।
চিন্তিত হয়ে গেল দুজনেই। এমন সময় পিয়ন এসে বলল, স্যার, আপনাকে সালাম দিয়েছেন ডিরেক্টর অ্যাডমিন স্যার।
বলল, আমি আসছি। পিয়ন ফিরে যাওয়ার অন্তত দশ মিনিট পর হাজির হলো প্রমিত।
কী ব্যাপার, প্রমিত সাহেব! কাউকে কিছু না-বলে উধাও হয়ে গেলেন। ফোনেও তো একটা খবর দিতে পারতেন!
জি স্যার। ঠিক বলেছেন। ফোন করে অফিসে সংকটের কথা জানাব, ঘোরতর বিপদে তা মনে ছিল না। অফিসের কথা মাথাই আসেনি। আর অফিস থেকেও কেউ কল করে আমার খোঁজ নেয়নি! মরে গেলাম না অসুস্থ হলাম–কেউ-ই খবর নেয়নি। এতদিন অফিস করে মনে হলো অফিসে আমার আপন বলে কেউ নেই। অথচ আপনি আর চেয়ারম্যান স্যার বলে থাকেন অফিস হচ্ছে আমাদের একটা পরিবার। খুবই সংবেদের সঙ্গে কথাগুলো বলে স্বস্তি পেল প্রমিত। কোমল উপস্থাপনায় কঠোর কথা শুনে ডিরেক্টর অ্যাডমিন চুপ হয়ে থাকলেন কিছুটা সময়। তারপর বললেন, ঠিক বলেছেন। আমাদেরও দায় ছিল আপনার খোঁজ-খবর নেওয়ার। নিইনি। আপনার কথাটায়
হ্যাঁ বলা ছাড়া না-বলার কোনো উপায় নাই। তবু প্রশাসনিক শৃঙ্খলার জন্য শোকজের জবাব দিয়ে রাখুন। যৌক্তিক সমস্যার জন্য আশা করি সহনশীল থাকবে প্রশাসন। চেয়ারম্যান স্যারও নাখোশ হবেন না নিশ্চয়।
জি। শোকজের জবাব তৈরি করছিলাম। এজন্য আসতে ৫ ১০মিনিট দেরি হয়েছে।
না। ৫-১০ নয়, ঠিক তের মিনিট দেরিতে এসেছেন। সেই দিন চেয়ারম্যান স্যার কী কারণে আপনাকে খুঁজেছিলেন। না পেয়ে শোকজ করতে বললেন। এমডি স্যারও তা সঙ্গে সঙ্গে সিগনেচার করে দিলেন।
ঠিক এ সময় ভাইব্রেশন মোডে রাখা মুঠোফোনটা প্যান্টের ডান পকেটের ভেতর কম্পন তুলল। পকেটে হাত চালান করে আঙুলের অনুমানের ভিত্তিতে ফোনকল বন্ধ করার চেষ্টা করেও পারল না প্রমিত। বার বার কল আসছে দেখে হঠাৎ ইনটিওশন জাগল–রোদ্দুর কল করেনি তো! ভেতরের খবরে দ্রুত পকেট থেকে সেট বের করে দেখল সত্যিই কল করেছে রোদ্দুর। ও একদিন বলেছিল, তোমার কাছে আমি বড় নাকি তোমার অফিস? আমি বড় না তোমার বস? আমি বড় না তোমার ফাইল? আমি বড় না তোমার ও ল্যাপটপ? মুঠোফোন? হুম হুম করে সব কথা মনে পড়তে লাগল। উত্তরে বলেছিল, তুমি বড়।
বাপি, তুমি মিথ্যা বলো, নিজের মেয়ের সঙ্গে মিথ্যা বলা কি ঠিক?
না। ঠিক নয়। ঠিক কথা হচ্ছে অন্তরের টানে কন্যা বড়। আর কাজের টানে অফিস।
এই যে দেখছো, আসলে অফিস তোমার কছে বড়।
না, মা। মানলাম না। কন্যার সঙ্গে অফিসের তুলনা চলে না। কন্যা হচ্ছে আকাশের চেয়েও বড় আকাশ। আর অফিস হচ্ছে ওই ঘরটার চেয়েও ছোটো।
তুমি তো মুখে বলল একটা আর কাজে করো আরেকটা।
যা বলেছি তা আমার মনের কথা, মা।
তো। আমাকে পাপ্পি দাও। মাম্মি আর আমাকে সময় দাও। আমাদের নিয়ে ঘুরতে চলো। কখনও ঘোরো?
রোদ্দুরকে আদর দিয়ে বলল, এই যে পাপ্পি দিলাম।
মাম্মিকেও একটা পাপ্পি দাও।
ওরে বাবা। তোমার মা আমাকে মার দেবে।
কেন? পাপ্পি দিলে মারবে কেন?
সে তো আমার ওপর খেপে আছে।
খেপবে না? তুমি আদর না দিলে আমি খেপে যাব।
এই মুহূর্তে ডাইরেক্টর অ্যাডমিনই বড়। তিনি ইমেডিয়েট বস। তার কথা শোনা উচিত। আবার কন্যার কল ধরাও উচিত ভেবে বলল, স্যার কন্যা ফোন করেছে, ধরি।
বলুন, একটু পরে কলব্যাক করবেন। এখন আপনি আমার সামনে আছেন। আমার কথাই তো গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তাই না?
এটা অফিসের শৃঙ্খলা রক্ষার একটা বড় ইস্যু।
জি, স্যার। বলেই লাইনটা ধরে প্রমিত বলল, মা, কী খবর?
কল ধরছ না কেন?
এই যে ধরলাম!
দেরিতে ধরেছো। তিন বার কল দেওয়ার পর ধরেছো।
আচ্ছা। একটু পর কলব্যাক করি? এখন তো আমার বসের সামনে কথা বলছি।
এই যে, আমি বলেছিলাম না, অফিস তোমার কাছে বড়।
চুপ হয়ে গেল প্রমিত। লাইন না কেটে, উত্তর না দিয়ে সেটটা কানের কাছে ধরে রেখে বাকী কথা শুনতে লাগল।
আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুল থেকে বলল, কাল প্যারেন্টস ডে। মা-বাবা দুজনকে নিয়ে আসতে হবে। তুমি অবশ্যই আসবে।
লাইন কেটে গেল। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল প্রমিত।
ডিরেক্টর অ্যাডিমন বললেন, কোনো দুঃসংবাদ?
সুসংবাদ। কিন্তু আমার জন্য দুঃসংবাদ।
মানে? এটা আবার কী কথা?
এমনিতে স্যার শোকজের খড়গ ঝুলছে মাথায়, আবার মেয়ের দাবি আগামীকাল প্যারেন্টস ডেতে স্কুলে যেতে হবে আমাকে। মেয়ে জেনারেলের মতো কমান্ড করে ফোন কল কেটে দিয়েছে।
চুপ হয়ে গেলেন ডিরেক্টর অ্যাডমিন। কাগজ–ওই কাগজ ঘাটতে লাগলেন। আগামীকাল যেতে পারবেন না বা যাওয়া উচিত এমন কিছু একটা বলা উচিত, বলছেন না। অস্থিরতা বেড়ে গেল ভেতরে ভেতরে। উত্তর শোনার ব্যাকুলতা চেপে রেখেছে তাকে।
অনেকক্ষণ পর তিনি বললেন, মেয়ের মাকে যেতে বলেন।
স্যার, ওর মা অসুস্থ।
সেকি। আপনি তো মিথ্যা বলেন দেখছি। এমডি স্যারকে বলেছেন আপনার মা অসুস্থ। এখন বলছেন স্ত্রী অসুস্থ। বানোয়াট কথা কোনো না কোনো ভাবে ধরা খায়। আপনিও ধরা খেলেন। জানেন। তো আমাদের চেয়ারম্যান অবিশ্বস্ত কাউকে পছন্দ করেন না।
হকচকিয়ে গেল প্রমিত। তারপর মিউ মিউ করে বলল, দুজনই দুই রকমভাবে অসুস্থ। স্ত্রী মাথায় আঘাতজনিত, আর মা বয়সের কারণে।
স্ত্রীকে মেরেছেন? মা না আপনি? কে মেরেছেন?
বাপরে! কী প্রশ্ন! কথার পিঠে কথায় চড়ে ব্যক্তিগত এমন প্রশ্ন কারও অফিস ফোরামে আলাপ করা উচিত নয়। অনুচিত কাজটা করেছেন বস। আর তাই উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে গেল প্রমিত।
শোনেন ঘরের কাহিনি অফিসে টানবেন না। আপনাদের কুরুক্ষেত্র ঘরের ব্যাপার। ঘরে সারবেন।
এ কথারও জবাব দিতে পারল না প্রমিত।
ডাইরেক্টর অ্যাডমিন দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বললেন, চেয়ারম্যান স্যার চেয়েছেন আপনি যেন এমডি স্যারের পক্ষ হয়ে কাজ না করেন। এ কথা কারও কানে দেওয়া যাবে না। এমডি স্যারের কানে তো নয়ই। আমার আর আপনার মধ্যে ডিল এটা। বুঝেছেন?
কোনো জবাব দিতে পারল না প্রমিত। শঙ্কিত হয়ে উঠল। অফিস ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে ভেবে গোপনে দুর্বল হয়ে যেতে লাগল মনের তেজ। স্বচ্ছতা। হ্যাঁ, না কিছুই বলছে না দেখে ডিরেক্টর অ্যাডমিন বললেন, আমার যা বলার বলে ফেলেছি। এই ডিলে সম্মানের গিঁট দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। আমার নয়।
স্যার, আমি তো কারও পক্ষ হয়ে কাজ করি না। অফিসপক্ষই আমার পক্ষ। আপনারা যে দায়িত্ব দেন সেটাই আমার সর্বোচ্চ যোগ্যতা ঢেলে কাজ করি। সেটা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে। কারও ব্যাক্তিগত স্বার্থে কখনও কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না।
এটা আপনার বুঝ। আমারও বুঝ। তবু বলছি, চেয়ারম্যান স্যারের ধারণা আপনি এমডি স্যারের এক শক্ত ডান হাত।
কী বলেন, স্যার! আপনি আমার উপরের বস। আপনি যে দায়িত্ব দেন, তাই তো করি আমি। ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে কখনও তো ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করিনি।
এ কথাটাও উড়িয়ে দিলেন না ডিরেক্টর অ্যাডমিন। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন, সেটা জানি। বুঝি আমি। তবে আমি যা বলছি তা চেয়ারম্যানের কথা। তার ধারণা কেন এমন হলো জানি না। বিষয়টা তো জানালাম আপনাকে। এটাকে কি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। আপনার?
জি। স্যার। ঠিক বলেছেন।
ওকে। ধন্যবাদ। যান। কাল আপনার ছুটির ব্যবস্থা করব। কন্যার স্কুলে হাজিরা দিয়ে ফিরে আসবেন।
এ অনুমতিটা দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
আমার প্রস্তাবটা মেনে নেওয়ার জন্যও ধন্যবাদ।
অবাক হয়ে গেল প্রমিত। কখন মানল প্রস্তাব। প্রস্তাবের পক্ষের কথাটা তো সে আমলেই নেয়নি। কারও পক্ষ নয়। নিরপেক্ষ সে। মানার প্রশ্ন এলো কেন? মানের মধ্যে কথাটা ঠেলে ভেসে উঠলেও এর উত্তেরে কিছুই বলতে পারল না প্রমিত।
যান। আপনার কক্ষে যান। শোকজের জবাবটা পাঠিয়ে দিন। আমি এপ্রুভড করে দেব।
উঠে দাঁড়াল প্রমিত।
ডাইরেক্টর অ্যাডমিন আবারও বললেন, থ্যাংক ইউ।
.
নিজের কক্ষে ফিরে এলো প্রমিত। এ ঘরটাকে আর আপন মনে হচ্ছে। না। অফিসটাকেও না। আচমকা ঝড়ো বাতাসে ও একদম একা হয়ে গেল। আদরের কন্যাটাকে নিয়ে আলাদা থাকছে মিতু। সংসারটাও ঝড়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। অফিসও। কোথায় যাবে? কোন কোলাহলে পূর্ণ হবে জীবন? ডিরেক্টরের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলেনি। তবু হ্যাঁ টাকে তিনি প্রাধান্য দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করে ফেললেন তার নিজের মনোভাবের জট দিয়ে। এ জট খুলবে কীভাবে? নাকি এ হ্যাঁ আরও শক্তভাবে ঠেসে ধরবে জীবন? নাকি আরও আরও সংকটে ডুবে যাওয়ার সিঁড়িতে পা দিল সে শোকজের জবাব লিখতে ইচ্ছে করছে না। নিজের এ একা হয়ে যাওয়া গভীর অসুখের মতো চেপে বসল মাথায়। অসুখের দুঃসহ যাতনা নেই। বরং গভীর নির্জনে একা হয়ে যাওয়াটাকে পরম কাঙ্ক্ষিত মনে হচ্ছে। ক্ষতে মলম মেখে আরোগ্য লাভ করেছে ও–এমন মনে হচ্ছে। বাইরে বাইরে হয়ে যাচ্ছে একা। ভেতরে একা নয়। রোদ্দুর আছে, মিতু আছে। মাও আছে শক্ত সিংহাসনে। তবু কেন এতটা নিঃসঙ্গ লাগছে?
আবার ভাইব্রেশন হচ্ছে মুঠোফোনে। সেটা না বের করে চোখ বুজে ও ভাবতে লাগল কে কল করেছে। রোদ্দুর? মিতু? আম্মা?
মন সায় দিচ্ছে না। একবার কল এসে থেমে গেছে প্রথম পালস। আর কল আসছে না। হিসেব করে নিল নিশ্চয় রোদ্দুর না। একবার কল করে থেমে যাওয়ার মেয়ে নয় সে। এক্সবুম? না। সেও না। মিতু? প্রশ্নই আসে না। যে রাগী আর শক্ত মেয়ে, কিছুতেই ও কল করবে না। মা? তাও মনে হচ্ছে না। উনি কখনও কল করেন না। প্রথমে মেসিজ পাঠাবেন। কল করতে হয় নিজেকে। কে হতে পারে? আলম? মিতুর কোনো দুঃসংবাদের খবর জানাবে না তো? কেউ স্থান পেল না মাথায়। কারও জন্য হ্যাঁ উত্তর এলো না। মনের কোন্ কুঠুরি থেকে হ্যাঁ বেরোয়, জানে না প্রমিত। কোন দরজা দিয়ে হ্যাঁ আসবে তাও জানা নেই ওর। এতসব ভাবনা নিয়ে এবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেট বের করে এনে চোখের সামনে ধরার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল। আবার চেয়ারে বসল সোজা হয়ে। পিঠ টান টান করে বড় বড় চোখ দিয়ে দেখল নামটা, মোহসেনা। পিচ্চিকালের খেলার সঙ্গী। যার গালে চড় মেরেছিল, যার খেলনা কেড়ে নিয়েছিল। কেন ফোন করল মোহসেনা?
পিচ্চিকালের মোহসেনার কোনো স্মৃতি নেই মাথায়। সিরিজ ছবিগুলোর কথা জানা ছিল না, দেখেনি কখনও। নরম কোনো অনুভূতি নেই তার জন্য। তবে সেদিন মাকে দেখে গেছে, মা-তুল্য মমতা দিয়ে কথাবার্তা বলে গেছে, নিজেকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে গেছে। তার কল!
দ্রুত কলব্যাক করে সেট কানে ধরে অপেক্ষা করতে লাগল।
হ্যাঁ। কল ধরেছে মোহসেনা।
শোনো, প্রমিত সকালে অফিসে আসার সময় আন্টিকে দেখে এসেছি আমি।
তিনি কল দিয়েছিলেন?
না। নিজে থেকে গিয়েছিলাম।
কেন?
মনে হয়েছিল তিনি উপরে উপরে শক্ত আছেন। ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছেন। এ সময় এ বয়সে দেহে নানা ঝুঁকি তৈরি হয় এমন ঝামেলায় থাকলে। মনেও সমস্যা হয়। তাঁকে ভালো করে চেক করে এসেছি। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য লিখে দিয়েছি। দ্রুত পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। পরে আমি আবার যাব। রিপোর্টে খারাপ কিছু এলে আমার স্যারকে দেখিয়ে নিব।
খারাপ কিছু হতে পারে?
হবে বলছি না। হতে পারে সম্ভাবনা মাথায় এসেছে, তাও বলছি না। এ সময় রুটিন চেকআপ করিয়ে নেওয়া ভালো, সেটা বলছি। আমরা মরে গিয়ে বাঁচার জন্য লড়াই করি। বেঁচে থাকতেই আসলে লড়তে হবে বেঁচে থাকার জন্য।
দারুণ কথায় শুষ্ক বুকে পানি চলে এলো। তবে ওর সাবলীল ভাষায় তুমি সম্বোধনটাতে এখন ধাতস্থ হতে না পাড়ায় তুমি বা আপনি না-সমোধন করে নিজেই কথা চালিয়ে গেল কিছুক্ষণ।
একাকিত্বের সংজ্ঞাটা আচমকা বদলে গেল। নিজেকে আর একা মনে হচ্ছে না। এক আশ্চর্য অনুভূতি হঠাৎ করে আসন নিল মনে। অন্ধকার থেকে জেগে ওঠা নতুন আলোর সন্ধান পেয়ে খুশি হতে লাগল মন। হাজারো নেই-এর ভিড়ে যেন ও পেয়ে গেল হাজারো বাতির আলো। সেই আলোয় ও খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে লাগল ফেলে আসা জীবনের ভুলগুলো। ভুল ধরতে হবে, তা শুধরাতে হবে–এটাই কি তবে মরার আগে বেঁচে থাকতে বাঁচার লড়াই?
তেইশ
আজ পেরেন্টস ডে রোদ্দুরের স্কুলে। আর মোহসেনার নির্দেশ মায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার তারিখও আজ। কোনটাকে সে গুরুত্ব দেবে? দোটানা নয়, একটানা টান তৈরি হয়ে গেছে দুটান মিলে। ওই যোগফলের টান তীব্র।
সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। কী করবে আজ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেও আকস্মিক দ্বন্দ্বের শক্ত গিঁট হালকা হয়ে গেল।
ডায়াগনোস্টিক ল্যাবে কল করে টেকনিশিয়ানকে ডেকে মায়ের রক্ত আর ইউরিন নেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলল। যে পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতে হবে, তা বিকালে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। সমস্যার আপাতত সমাধান করে হাতে দেখল দেড় ঘণ্টা সময় আছে। যথেষ্ট। এ সময়ের মধ্যে স্কুলের গেটে পৌঁছানো যাবে ভেবে ওয়াশ নিয়ে রেডি হয়ে নিল প্রমিত। আর তখনই এলো মিতুর নম্বর থেকে কল।
কে কল করেছে, রোদ্দুর না মিতু? এক ঝটকায় প্রশ্নটা আক্রমণ করল প্রমিতের চোখের মণি।
কানে ফোনসেট ধরার সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছো এখন? স্কুলে না নানা-বাসায় এসেছ?
সেকি? তুমি তো দশটার সময় স্কুলে যেতে বলেছে। এখন তো সময় আছে।
দশটায় স্কুল, দশটাতেই আসবে? একটু আগে আসতে হবে না?
প্রায় বলেই ফেলেছিল, তোমার দাদুভাইয়ের জন্য টেকনিশিয়ান এসেছে বাসায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। জিহ্বাটা শাসন করে ফেলল। তা না-বলে বলল, আসছি।
আসছি বললে হবে না। সত্যিকারভাবে বলো এখন কোথায় আছো?
আসছি, মা।
আমার প্রশ্ন বোঝো না? আমি বলছি তুমি কোথায় আছো, জানাও।
আমি সরাসরি স্কুলে আসব। বলল প্রমিত।
কথা ঘুরিয়ো না। আমার কথার জবাব দাও। সত্য বলো। কোথায় আছে, জানাও আমাকে। খেপে উঠল রোদ্দুর।
রওনা হচ্ছি, মা।
এখনও রওনা হওনি?
হচ্ছি।
সত্যি বলছো তো?
হ্যাঁ। তিন সত্যি।
তো স্কুলে আসো। আমরা বাসা ছেড়ে স্কুলে চলে এসেছি।
মেয়ের উত্তেজনা প্রমিতের বুকেও বসে গেল। মায়ের ঘরে ঢুকে বলল, ওরা রোদ্দুরকে ওদের বাসার কাছের স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। আজ পেরেন্টস ডে। যেতে হবে, দাবি রোদ্দুরের।
বউমা ডাকেনি?
না। ও তো কথা বলে না। বললেও সব কাজে দোষ ধরে। বকাঝকা করে। সেদিন কল ধরতে দেরি হওয়ায় ভীষণ গালাগালি করেছে।
গালাগাল আর বকাঝকাকে পাত্তাই দিলেন না সায়েরা আমিন। নাতনিকে ওখানে ভর্তি করিয়েছে শুনে বুকটা কামড়ে ধরল। সংসার কুরুক্ষেত্রে এটা শুভ লক্ষণ নয়। বিপদের ঘণ্টাধ্বনিই যেন আবার শুনলেন তিনি। আশ্চর্য! এত বড় একটা সিদ্ধান্ত একাই নিয়ে ফেলল বউমা! শাশুড়িকে একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না সে। কখনও তো বউমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলে মনে হয়নি। ওদের সব আচরণ আর ইচ্ছায় সব সময় হা বলে এসেছেন তিনি। তবে এ সিদ্ধান্তটাকে মনে মনে হ্যাঁ বলতে পারলেন না। হ্যাঁ বলতে হলে তো উপড়ে ফেলতে হবে বুকের শেকড়-বাকড়।
ছেলের মুখে কি উচ্ছ্বাস, না বিষাদ, কী শোভা পাচ্ছে? দেখার জন্য একপলক ঘুরে প্রমিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কি যৌক্তিক বিষয় হলো, বাবা? ওদের ওখানে রোদ্দুরকে ভর্তি করালো! আমি-তুমি কিছু জানলাম না!
আমাকে বলেছিল, আম্মা। তবে বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম রাগের মাথার বলেছে। শীতল হয়ে, রাগ পড়ে গেলে এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিবে না সে। ভেবেছিলাম। এজন্য আর তোমাকে বলা হয়নি।
ও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মনে হয়?
মনে হয় এটা তার একার সিদ্ধান্ত নয়। এখানে আমার রাশভারী শশুরের জোরালো চাপ থাকতে পারে। লোকটা ধরে নিয়েছে মিতুকে পিটিয়েছি আমি। পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। আমি যে মলমপার্টির কবলে পড়ে মরতে বসেছিলাম তা তারা বিশ্বাস করেনি।
তার ভুল ভাঙানো উচিত।
কে ভাঙাবে? বলো? মিতু তো তার আবেগের ঘোরে লাটিমের মতো পাক খায়। তাতে আমার জন্য যে ভালোবাসা নেই, তা নয়। বরং বেশিই আছে। আবেগের টানে সব প্যাচিয়ে ফেলে সে। তাকে শুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই আমার।
ছেলে ইতিবাচক উপলব্ধি দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, যাও। দেরি হলে রোদ্দুর কষ্ট পেয়ে পাবে। অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে।
ঘর থেকে বের হয়ে উবার পেয়ে গেল। কল করার মাত্র দুই মিনিটের মাথায় এসে হাজির হলো।
উবারে চোখ বন্ধ করে বসেছিল প্রমিত। হঠাৎ ভাইব্রেশন মোডে রাখা সেট পকেটের ভেতর জানান দিল ফোনকলের খবর। চোখ খুলে গেল। সেট বের করে হাতে নিয়ে দেখল কল করেছে মোহসেনা।
আন্টির সব পরীক্ষা হয়েছে?
সব হয়নি। কিছু হয়েছে। ব্লাড আর ইউরিন নিয়ে গেছে। এক্সরে, ইসিজি আর আলট্রা সাউন্ড সন্ধ্যায় করাব।
আন্টিকে আবার কষ্ট দিয়েছো?
আমি দেইনি।
কেউ না কেউ দিয়েছে।
কীভাবে বুঝলে? প্রমিতও তুমি বলা শুরু করেছে নিজের অজান্তে। পিচ্চিকালের বন্ধুকে তো তুমি বলা যায়।
কল করেছিলাম তোমাকে কানেক্ট করার আগে। ওনার গলার স্বরটা অচেনা লাগল। কষ্ট পেলে এমন হয়।
প্রমিতের বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। তা টের পেয়ে মোহসেনা বলল, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে হবে না। সমস্যাটা ধরো। জয় করো। এর আগে-পিছে কোনো ফর্মুলা নেই। এটা (a+b)²=a²+2ab+b² এর মতো ফর্মুলা।
বাব্বা! তুমি তো দেখছি মনের সব খবর জানো। দূর থেকে। মনের অলিগলি ঘুরে সব দেখে ফেলতে পারো!
হ্যাঁ। পারি। কারণ এগুলো সহজ ফর্মুলা। আরও জটিল ফর্মুলাও আছে। সেগুলোর জটও খুলে ফেলার বিষয়ে উচ্চতর কোর্সে পড়াশোনা শুরু করেছি।
আচ্ছা। আচ্ছা। পিচ্চিকালের ফ্রেন্ড আরও উঁচুতে উঠুক, চাই।
আমি তো তোমার ফ্রেন্ড ছিলাম না। আমি শত্রু ছিলাম তোমার চোখে।
তোমার চোখে আমি কী ছিলাম?
কিছুই না। ছবি দেখে দেখে ভেবেছিলাম একটা সন্ত্রাসী সাথী আছে আমার। তার নাম প্রমিত।
মাগো!
মাগো, ডাকার দরকার নেই। মাকে ডাকো। মায়ের কষ্ট দূর করো। তোমার বাবা নেই। তোমাকে নিয়ে আন্টির অনেক বড় আশা। সেটা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ো না।
তা না দিতে কী করতে হবে? এমনি এমনিতেই তো ধুলোয় মিশে যাচ্ছি।
সম্পর্কগুলো পরিচর্যা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হওয়ার নাটাই বোধ হয় আমার হাতে নেই।
আছে। আছে। তোমার হাতেই আছে। সেই ক্ষমতাটা হাতে নাও। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কোরো। আর ভালো কাজে হ্যাঁ বোলো।
লাইন কেটে গেল। অবাক হয়ে প্রমিত তাকিয়ে রইল সেটের দিকে। কিছুক্ষণ পর চোখ বুজে তাকানোর পর আচমকা চোখ খুলে দেখল স্কুলের গেটে চলে এসেছে ও। ভাড়া মিটিয়ে গেটে নেমে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখল ঘড়িতে এখন সকাল ৯.৫৫ মিনিট। এখনও পাঁচ মিনিট বাকি আছে দেখে দেয়ালে সাঁটানো তির মার্কিং দেখে দেখে ও হাজির হলো স্কুলের মিলনায়তনে। হলভর্তি দেখে বুকে চাপ খেলো ও। কোথায় খুঁজবে ও রোদ্দুরকে? ওরা কি পেছনের দরজার দিকে তাকাবে?
ধীরে ধীরে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে ও এগিয়ে যেতে লাগল ভেতরের দিকে। আকস্মিক লাফিয়ে উঠে রোদ্দুর ফিসফিস করে ডাক দিলো, বাপি!
আরাধ্য ডাকটা শুনে বুকে পানি এলো। একটা চেয়ার খালি আছে। ওই চেয়ারে রাখা আছে মিতুর ব্যাগ।
বকা দেওয়ার সুযোগ পেল না মিতু। রোদ্দুরও। মাইকে অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা হচ্ছে। ঘোষণার প্রতিটা কথার মধ্যে নিজেকে ছেড়ে দিল প্রমিত। ও খেয়াল করল রোদ্দুর তার ডান হাতে প্যাচিয়ে ধরেছে বাপির বাঁ বাহু।
চব্বিশ
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধান শিক্ষক। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তিনি বললেন, আজকের অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চে নির্ধারিত কোনো প্রধান অতিথি নেই। সেই আসনটা আমরা খালি রেখেছি। এখানে একদিন বসবে, আজকে এই হলে উপস্থিত ছোট ছোট শিশুদের প্রতিনিধি। নতুন যারা ভর্তি হয়েছে, তোমরাই একেকজন আজকের প্রধান অতিথি।
শিশুরা দাঁড়িয়ে গেল। মুহূর্মুহূ তালি দিতে লাগল।
কিছুক্ষণ থেমে থেকে তিনি আবার বললেন, এই তালির উৎসবটা তোমাদের প্রত্যেকের জন্য উপহার হিসেবে দিলাম।
আবার তালি শুরু হলো। তালি আর থামছেই না। শিশুরা চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যদিয়ে প্রকাশ করতে লাগল তাদের মনে জেগে ওঠা আনন্দ। রোদ্দুরও সবার মধ্যে রোদের ঝিলিক ছড়াতে লাগল।
মা-বাবাদের মনও ভরে গেল আনন্দে। সেই আনন্দে সমান তালে শরিক হতে পারছে না মিতু। প্রমিতও। কোথায় যেন আটকে আছে পিছু টান।
বাবাদের শ্রেষ্ঠ বাবা হতে হবে। তখন মারাও শ্রেষ্ঠ মা হয়ে যান। সন্তানের মাকে আদর যত্ন করেন যে বাবা, ভালোবাসেন সত্যিকার অর্থে, সেই বাবা শ্রেষ্ঠ বাবা বনে যান। শ্রেষ্ঠ বাবা-মা গড়ে তোলেন শ্রেষ্ঠ পরিবার। আমি চাই আমাদের স্কুলে ভর্তি হওয়া সব বাচ্চাদের পরিবার হবে শ্রেষ্ঠ পরিবার। আবার বললেন প্রধান শিক্ষক।
সবাই তালি দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে গেছে। রোদ্দুরের ঝিলিক কমে গেল। সে দাঁড়াতে পারল না। আনন্দের দোলায় কষ্ট জেগে উঠল তার মনে। আচমকা ওর চোখ বেয়ে অশ্রু নামতে শুরু করল। ওর বুক ভেঙে যেতে লাগল। ভেতরটা কেমন করতে লাগল, বুঝতে পারছে না। কান্না আসছে। হুহু কান্নার বেগ আসছে। তার মনে হলো চিৎকার করে কেঁদেই ফেলবে ও। বাবার বাঁ বাহুটা প্যাচিয়ে ধরে বসেছিল। এবার সে জোরে চেপে ধরেছে। মেয়ের বুক ভরা কান্নার প্রকাশ পেল বাবাকে খামছে ধরার মধ্য দিয়ে। মেয়ের কষ্ট বুঝতে অসুবিধা হলো না প্রমিতের। মিতুও তার ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েকে।
শিশুদের উদ্দেশে পরে বলব। প্রথমে শুনুন আজকের অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি, মা-বাবারা।
আবার তালি। শিশুরা আবার উল্লসিত হয়ে উঠল। তারা ভীতি নিয়ে এসেছিল। মুহূর্তে ফানুসের মতো উড়ে গেল তাদের স্কুল ভীতি। তারা হয়ে উঠল বিদ্যালয়-পরিবারের অংশীদার।
আপনার শিশু আপনার দখলে থাকা কোনো সম্পত্তি নয়। সে আলাদা একটা মানুষ। আপনার ক্রমোজমের এক্সটেনশন হলেও সে আলাদা সত্তা। তাকে তার মতো বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে।
চুপ হয়ে গেল হলঘর। প্রধান শিক্ষকের এ গভীর কথার অর্থ শিশুরা তেমন করে বুঝতে পারল না। তবে প্রথম অংশ আর শেষের
অংশ বেশ ভালো করেই বুঝেছে ওরা।
তার মন কী বলে, জানতে হবে। শুনতে হবে তার মনের কথা। বুঝতে হবে তার অন্তরের ডাক। তার বয়সের স্তরে নেমেই বুঝতে হবে তাকে।
এ কথাটা শুনে নড়ে বসল রোদ্দুর। ওর কষ্ট যেন কমে গেল মুহূর্তে। তারপর বাবার কানটা ধরে টেনে নিচের দিকে এনে ফিসফিস করে বলল, শুনেছো?
মাথা ঝাঁকিয়ে প্রমিত বলল, শুনেছি। তোমার মাম্মি শুনেছে কিনা জিজ্ঞেস করো। এ কথা রোদ্দুরের কানে ঢুকল না। প্রধান শিক্ষকের কথা ওর কচি মনকে চুম্বকের মতো টানতে লাগল।
প্রশংসা করতে হবে সন্তানের ভালো কাজের। হাসি মুখে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তার লক্ষ্য সে ঠিক করবে। তবে লক্ষ্য ঠিক। করার জন্য তাকে গাইড করবেন বড়রা। লক্ষ্য হতে হবে ছোট ছোট। সে সফল হবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী, তেমন বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। তার বিকাশটা ঘটে প্রকৃতির ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট নিয়মে। এজন্য ইউনিসেফ বলে, আপনার শিশুকে হ্যাঁ বলুন। তবে সে বাজে কাজ করলে তার প্রতি নজর দেওয়া যাবে না।
রোদ্দুর এবার বিষাদের খোলস থেকে আবার বেরোতে লাগল। আবার বাবার কান টেনে নিচে নামিয়ে বলল, বুঝেছো, বাপি! আমাকে হ্যাঁ বলতে হবে। না বলতে পারবে না। আমি যা বলি শুনতে হবে।
সন্তানকে বকাঝকা করা যাবে না। সমালোচনা করা যাবে না। কটু কথা বা শ্লেষমাখা কথা বলা একদম নিষেধ। সৎ থাকতে হবে তার সঙ্গে। ভুল হতে পারে আমাদের জীবনে। কেউ আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে নই। বাবা-মারা নিজেদের ভুল বা ব্যর্থতা সন্তানের সামনে লুকিয়ে রাখবেন না। সন্তানেরও জানা উচিত বাবা-মা ভুল করতে পারে। ব্যর্থ হতে পারে। এই জানা বিষয় ভবিষ্যতে যেকোনো বড় বিপদে সন্তানের ভেঙে পড়া রোধ করবে।
আবার থেমে গেল রোদ্দুরের উচ্ছ্বাস। একই সঙ্গে চুপসে গেল প্রমিত। মিতুও।
আমি কি কঠিন কথা বলছি? কী বলল তোমরা, কঠিন না সহজ?
একযোগে চিৎকার করে শিশুরা জানান দিল, সহজ!
সহজ!
এই যে শিশুর আনন্দ, এই মুহূর্তের সুখ, সব বুঝতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে অসুখীবোধ যেন তার মধ্যে আসন গেড়ে বসতে না পারে। আধিপত্যও যেন না বাড়াতে পারে। কষ্টের কথা শিশুকে প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে।
কোনো প্রশ্ন আছে অভিভাবকদের? ভালো ভালো কথা বলে এবার প্রশ্ন আহ্বান করলেন প্রধান শিক্ষক।
রোদ্দুর পুঁতোতে লাগল। বাপি প্রশ্ন করো। দাঁড়াও।
প্রমিত কী বলবে। বুঝতে না পেরে বসে রইল।
রোদ্দুর আবার বলল, আমাকে হ্যাঁ বলো। দাঁড়াও।
প্রমিত দাঁড়ানোর আগেই এক লোক দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, নিজেদের কষ্টের কথা কি সন্তানের সঙ্গে খেলামেলা আলাপ করা উচিত?
কী ধরনের কষ্ট? পাল্টা প্রশ্ন করলেন প্রধান শিক্ষক।
এই যেমন ধরুন মা-বাবারা ডিভোর্স বা সেপারেশনের কথা।
হ্যাঁ। আলাপ করা উচিত। তার জানা উচিত। তা সন্তানের কষ্টকর আবেগের প্রতি সহনশীলতা বাড়াবে। অশুভ কিছু ঘটে গেলে কষ্ট সে পাবে, তবে ভেঙে যাবে না তখন।
ডিভোর্স বা সেপারেশন শব্দ দুটো মাথায় বুলেট ছুঁড়ে দিয়েছে। কী বলবে, ঠিক করতে পারল না। তবুও দাঁড়িয়ে গেল প্রমিত। মেয়েকে হ্যাঁ বলতে হবে। হ্যাঁ বলার এটা উপযুক্ত সময়। উপযুক্ত সময়ে হ্যাঁ না বললে ওর আবদারের উত্তর না হয়ে যাবে। রোদ্দুরকে কিছুতেই না বলতে চায় না ও। হাই বলবে মনস্থির করে প্রশ্ন করল, সন্তান কোথায় বড় হওয়া ভালো, নানা-বাড়ি না দাদা-বাড়িতে?
আপনি বসুন। কঠিন প্রশ্ন করে ফেলেছেন আপনি। এর জবাব আমার কাছে নেই। যেকোনো অভিভাবক মতামত দিতে পারেন? কেউ দাঁড়াবেন?
কেউ দাঁড়াচ্ছে না। মিতু দেখল ওর বাপির প্রশ্ন রোদ্দুরকে বিমর্ষ করে ফেলেছে। ও নড়া-চড়াহীন স্তব্ধ হয়ে গেছে। দেখে চট করে দাঁড়িয়ে গেল সে।
আপনি বলবেন?
জি।
বলুন।
যে বাড়িতে সন্তান থাকতে চায়, সেখানে থেকেই সে বড় হওয়া উচিত। সন্তানের মতামত আর ইচ্ছাটাই এখানে বড়।
বাহ! বেশ বলেছেন। আমরা কি ওনার সঙ্গে একমত হতে পারি?
আওয়াজ উঠল, হ্যাঁ। জোরালো হয়নি আওয়াজ। শোরগোল ওঠেনি। দুর্বল হ্যাঁর সাড়া হলটাকেও যেন বিমর্ষ করে দিয়েছে। এমন। বিষয় এই আনন্দঘন পরিবেশে উঠে আসায় প্রধান শিক্ষকও বিব্রত হলেন। তারপরও তিনি আরও অনেকক্ষণ কথা বললেন। ভালো ভালো পরামর্শ, সদুপদেশ দিলেন।
রোদ্দুর তবু চুপ মেরে গেছে। এক হাতে ও ধরে আছে বাপির হাত। আরেক হাতে মায়ের বাহু। নিজের মতটা খুঁজতে লাগল। দুবাড়িতে থাকতে চায় না ও। মাকে তো চায়ই। বাবাকেও। তবে ইচ্ছা যেখানে বাবা-মা একসঙ্গে থাকবে সেখানেই সে থাকবে।