হ্যাঁ – ১

এক

সে বলেছে, সে নয়, তুমি দোষী। তুমি বলছো, তুমি নও, সে দোষী। দুটো বাক্য বলে চুপ করে মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন দুজনেরই শিক্ষক আলি আকবর স্যার। মিতুর সরল মুখে দোষের চিহ্ন নেই। ডাগর চোখের কালোমণিতে টলমল জলের ফোঁটাও নেই। নেই কাঁদো কাঁদো চেহারা কিংবা ক্রোধের কোনো চিহ্ন। নিষ্পাপ, নিরপরাধ মুখটা দেখে ভাবার কোনো সুযোগ নেই মিতুই অপরাধী। উদ্বেগের রেখাও অনুপস্থিত ওর কপালের ভাঁজে। প্রমিত যখন ঘটনাটা খুলে বলেছে তখন তাকেও অপরাধী মনে হয়নি। মিতুকেই দোষ দিয়ে গেছে একচেটিয়া। ঘটনা তো ঘটেছে একটা, কিংবা অসংখ্য ঘটনার খারাপ প্রতিক্রিয়া জমতে জমতে যখন সমস্যা পাহাড়সমান হয়েছে, টের পায়নি ওরা। তালি একহাতে বাজে না–এ প্রবাদটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মিতুর উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন করলেন, তোমার কোনো দোষ নেই! তুমি নিশ্চিত?

প্রমিতের কথা আগে শুনে আপনি বোধহয় একপেশে হয়ে গেছেন। তাই এই ধরনের প্রশ্ন করতে পারলেন! এবার বেশ গোসসা মনে কথাটা বলে ফেলল মিতু। নিজের দোষ তো ধরতেই পারল না, দোষ করেছে কিনা তা যাচাই না করে বরং শিক্ষকেরই দোষ ধরা শুরু করল ও।

আমি উঠি। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। মধ্যস্থতা করার আগেই আপনি নিজেকে দোষের পাল্লায় তুলে ফেলেছেন। পক্ষ নিয়ে ফেলেছেন।

শোনো, মিতু। ভালো করে শোনো। বুশ বলেছেন সাদ্দাম দোষী, সাদ্দাম বলেছেন বুশ দোষী। ভারত বলছে পাকিস্তান দোষী, পাকিস্তান বলছে ভারত দোষী। চীন বলছে আমেরিকা দোষী, আমেরিকা বলছে বিশ্ববাণিজ্য দখল করার জন্য চীন ক্রমাগত অপরাধ করে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে দেখবে, তোমাদের দুজনের কথা বাদ দাও, স্বামী বলছে স্ত্রী দোষী, স্ত্রী বলছে স্বামী। টিনএজ কন্যা বলছে মা দোষী, মা বলছে মেয়ে বিগড়ে গেছে, কথা শোনে না। পড়ে না। রেজাল্ট খারাপ করে মেয়ে রসাতলে যাচ্ছে, গোল্লায় যাচ্ছে। আর এসব কথা মাথায় রেখে আমি এখনও তোমাদের দুজনের কথা বিচার করিনি। মতামত দিইনি। কিছু কমন কথা বলার চেষ্টা করছি।

মনে হচ্ছে কমন কথার ফাঁকে ওর দোষ না দেখে আমার দোষ। দেখবেন। আপনার থেকে কিছুই আশা করতে ইচ্ছা করছে না আর। আমি উঠলাম।

পরিবেশটা খারাপ হয়ে গেল। আলি আকবর স্যার বিব্রতবোধ। করলেন। মানুষ তাকে সম্মান করে। বিপদে পড়লে সবাই পরামর্শ চাইতে আসেন তার কাছে। তিনি সাধারণত কোনো রায় দেন না। নিজেকে নিউট্রাল রাখার চেষ্টা করেন। কথার মাধ্যমে সবার সমস্যার জট খুলে বের করে আনার চেষ্টা করেন। ননজাজমেন্টাল কথা বলে থাকেন। এখন একটা প্রবাদ প্রসঙ্গ তুলে মিতুর মন বিগড়ে দিয়েছেন, বুঝতে পারলেন। তবু ভেঙে পড়লেন না। মিতু তাঁর কক্ষ ছাড়ার আগেই মরিয়া হয়ে বললেন, সেই-ই বুদ্ধিমান যে নিজেকে সমালোচনা করতে পারে। নিজের দোষ ধরতে পারে, তা সংশোধন করতে পারে।

আমার দোষ না ধরে যে দোষ করেছে তাকে ধরতে বলুন। তাকে সংশোধন হতে বলুন। আবারও সোজা কথায় বেঁকে যেতে লাগল মিতু। আবারও কথার পিঠের কথা নিজের ঘাড়ে চেপে নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে লাগল।

না, না। কেবল তোমাকে তোমার দোষ ধরার কথা বলছি না। প্রত্যেক মানুষের উদ্দেশেই কথাটা শোনালাম। এ প্রসঙ্গে দর্শন কী বলে, জানো?

আমার জানার দরকার নেই। প্রমিতকে বলুন। সে নিজেকে সংশোধন করুক। তাহলে সব সমাধান হয়ে যাবে। ধর্ম আর দর্শনের কথা শুনতে চাই না। মিতুর রাগ চক্রবৃদ্ধি হারে উঁচুতে উঠে যেতে লাগল, আলি আকবর স্যার খেয়াল করতে পারলেন না। বিশ্লেষণের ঘোরের মধ্যে থেকেই তিনি বলতে লাগলেন, দর্শন বলেছে নো দাইসেলফ। নিজেকে জানো। নিজেকে জানা মানে নিজে নিজেকে খুঁড়ে দেখা। অতলে নিজের কোনো ঘাটতি আছে কিনা, নিজের কী কী সামর্থ্য আছে তাও বোঝা। বুঝতে পারলে জীবন সুন্দর হয়। যুগলজীবন তো অবশ্যই সুন্দর হতে তখন বাধ্য। দুজনেই আগে নিজেদের চিনতে হবে। তারপর অন্যকে চেনা সহজ হয়। বোঝা সহজ হয়।

যুগলজীবন সুন্দর করার কথা শুনে রাগের স্কেলে উঁচু পারদ নিচে নেমে এলো। চলে যেতে গিয়েও ফিরে এলো মিতু। চুপচাপ বসে পড়ে ভাবল যুগলজীবন সুন্দর হোক, চায় ও। মনে-প্রাণে চায়। অথচ যুগলজীবন বর্তমানে অসুন্দর নয় কেবল, ফাটল তৈরি হয়ে গেছে সুন্দর বাঁধনের ইমারতে। সুযোগ পেয়ে আলি আকবর স্যার আবার বলতে লাগলেন, মনস্তত্ত্ব বলেছে সেলফ ইভ্যালুয়েশনের কথা। সেলফ ক্রিটিসিজমের কথা। পজিটিভ হওয়ার কথা। সব কথার মর্মকথা হচ্ছে নিজেকে চেনা, জানা, বোঝা আর নিজেদের জীবন সংসার, দেশটাকে সুন্দর করা।

আপনার লেকচারটা এখন ভালো লাগছে। আগে মনে হয়েছে প্রমিতের নৌকায় উঠে আপনি যেদিকে ঝড় সেদিকে পাল তুলে দিয়েছেন। আর আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন।

যাক। তোমার এ বুঝটার জন্য ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ দিলে সংসার টিকবে না। আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিন। না দিলে আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিব। ও যেমন আপনার প্রিয় ছাত্র। আমিও। নিরপেক্ষভাবে নিজে বুঝে আমাদের সমাধান দিন।

কথা শেষ করে উঠে গেছে মিতু। আলি আকবর স্যার মিতুর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছেন। একবার ফিরে স্যারের চোখের দিকে তাকাল ও। অতি প্রিয় স্যার নিশ্চয় সমস্যার সমাধান করে দিবেন। কিছুতেই ও সংসার ভাংতে চায় না। শেষবারের মতো মরিয়া হয়ে বলল, আমার একটা কন্যাশিশু আছে। সব বোঝে এখন। ভালো ভালো কথা বলতে শিখেছে। বাবার সঙ্গ চায়। প্রমিত যখন আমাকে গালাগাল করে, আমার সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করে তখন ভয়ে সে কুঁকড়ে যায়। ওর নরম মন কি ব্যথা পায় না? ও কি সুস্থ হয়ে বড় হতে পারবে? ওর বৈশিষ্ট্যে ভয় আর আতঙ্কের ছায়া বসে যাবে না? আপনিই বলুন। এমন চলতে থাকলে মেয়েকে নিয়ে আমার আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত না? কথাটা আপনার মাথায় দিয়ে গেলাম। ওকে সংশোধন হতে বলুন। শেষ সুযোগ দিচ্ছি। বলে দেবেন। প্রমিতকে।

স্যার একবার বলতে চাচ্ছিলেন, তুমি চিৎকার কোরো না, চেঁচামেচি আর গালাগালি কোরো না, এসব কথা না বলে থেমে গেলেন। তিনি বুঝেছেন বড় আস্থা নিয়ে ওরা আলাদা আলাদাভাবে দুজনের সমস্যার কথা বলে গেছে। প্রমিত সংসার ভাঙতে চায় না। সে-কথা জোর দিয়ে বলেছে। মিতু ভাঙার হুমকি দিয়েছে। সমস্যার সমাধা না হলে কী করবে তা স্পষ্ট করে বলে গেছে। শিক্ষক হিসেবে স্যারও চাচ্ছেন না ওদের সংসার ভেঙে যাক। তাহলে উপায়?

দুই

কখনও রাত করে বাড়ি ফেরে না প্রমিত। আজ দেরি হচ্ছে। এখন প্রায় এগারোটা। অস্থির হয়ে পড়লেন ওর মা। এদিকে বউমাও নাতনি রোদ্দুরকে নিয়ে চলে গেছে বাপের বাড়ি। বউয়ের সঙ্গে ছেলের বনিবনা হচ্ছে না। বিষয়টাও তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোনো কিছু না ভেবে ফোন করে বসলেন মিতুকে, প্রমিত কি তোমাদের আনতে গেছে, বউমা?

আপনার কী মনে হয়, আপনার ছেলে যেরকম ত্যাড়া, সেরকম গোঁয়ার, সে কি আসবে আমাকে নিতে? আসতে পারে?

বউমার কষ্টের রোষও থামিয়ে দিতে পারল না শাশুড়ির উদ্বেগ। বরং আবার প্রশ্ন করলেন, তাহলে সে যায়নি তোমাদের বাসায়?

প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মিতু তাকাল দেয়াল ঘড়ির দিকে। রাত এগারোটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। এখনও প্রমিত বাড়ি ফেরেনি বুঝতে পেরে গোপনে সেও শঙ্কিত হয়ে গেল। যত রাগ আর অভিমান, সব পানি হয়ে গেল। ক্রোধ চাপা পড়ে গেল। উৎকণ্ঠায় ডুবে গিয়ে প্রশ্ন করল, দুপুরের পর বাসায় ফেরেনি একবারও?

না, বউমা! ভেবেছিলাম তোমাদের বাসায় গেছে। তাই ভয় লাগেনি। এখন তো ভয় করছে।

ফোন করুন।

করেছিলাম। ওর ফোন অফ আছে।

শুনে আবারও রাগ বেড়ে গেল। উৎকণ্ঠার বদলায় ক্রুদ্ধ হয়ে বলে বসল, নিশ্চয় আমাকে সাজা দেওয়ার জন্য মোবাইল অফ রেখেছে!

তা কেন হবে, বউমা? বিপদ-আপদও তো হতে পারে।

বিপদ-আপদের কথা শুনে এবার সত্যি সত্যি শংঙ্কা উড়ে এসে জুড়ে বসল মনঘরে। অভিমান আর ক্রোধও উড়াল দিয়ে পালিয়ে গেল। মা ঠিকই বলেছেন। রাতে কখনও বাইরে থাকে না প্রমিত, বাইরে থাকলে সেট অফ রাখবে–কথাটা একদম ঠিক নয়। আবার আচমকা ওর মাথায় প্রশ্ন জেগে উঠল, আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কি এমনটা করল?

হ্যাঁ। এটাই তার উদ্দেশ। নিশ্চয় কূট চিন্তা নিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। ভাবনাটা শক্ত করে দিলো ওর মনের গিঁট। শাশুড়ির সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আবার লাইনও কেটে দিতে পারছে না। প্রমিতের ওপর ছলকে পড়া রাগ ওর মায়ের ওপর ঝাড়তে চাইল না। চুপ করে রইল।

বউমা, লাইনে আছো?

জি।

কী করব? ওর কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে কল করব?

করুন।

কারও তো নাম্বার জানা নেই। কার নম্বরে ফোন করব?

আপনার ছেলের কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই। সাধারণ বন্ধুও নেই। তার বন্ধু সে নিজেই। নিজের মধ্যেই ডুবে থাকে। নিজের কাজের ঘোরে থাকে। কাজই তার বন্ধু।

ঠাণ্ডা মাথায় কথাটা বললেও কথার পিঠে ধারালো শান আছে। বুঝলেন শাশুড়ি। কথার পিঠে আর কথা না বাড়িয়ে বললেন, রাখি। বউমা। সে তোমাকে কল করলে আমাকে জানিয়ো। তিনি বউমার ওপর রাগ করলেন না। জানেন কথাটা ভুল বলেনি সে। কাজ-পাগল ছেলেটা সত্যিকারের কাজ-পাগলই। এটা দোষের কিনা কে জানে। তবে বুঝেছেন ছেলে বউ-বাচ্চার প্রতি সময় দিতে পারে না। কিন্তু সে যা করে সংসারের উন্নতির জন্যই করে। বউ-বাচ্চাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার জন্যই করে। আজেবাজে আড্ডায় থাকে না। বাজে কাজে সময় খরচ করে না। বউমার মনে জেদ থাকা স্বাভাবিক। নিশ্চয় এ জেদ পানি হয়ে যাবে। নিশ্চয় ছেলের স্বভাব একসময় বুঝবে বউমা। নিশ্চয় সব ঠিক হয়ে যাবে। লাইন কেটে ভাবতে পেরে স্বস্তি পেলেও ছেলের জন্য দুশ্চিন্তার ঘোর থেকে বেরুতে পারলেন না। প্রমিতের ঘরে ঢুকে ওর কোনো নোটবুক আছে কিনা খুঁজতে লাগলেন। ডায়েরিও। টেবিলের উপর খুঁজতে গিয়ে একটা অফিস ফাইলও পেয়ে গেলেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন অফিসের ফাইলও বাসায় নিয়ে আসে ছেলে। এটা ঠিক নয়, জানেন তিনি। জানলেও বোঝেন কাজের বাড়তি চাপ সামাল দিতেই এমনটা করতে হয় ওকে। এ চাপ ওকে ক্ষতি করে তাও বুঝলেন। ফাইল ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এলো একটা চিরকুট। তাতে লেখা

কথা বলুন। পাশে নাম। একটা মোবাইল নাম্বার। এটা কেমন নাম, এক্সবুম। নিশ্চয় ছদ্মনাম। সাংকেতিক শব্দের আড়ালে নিশ্চয় ডুবে আছে আসল নাম। তবু ওটাতে কল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুঠোফোনে টুকে টাচস্ক্রিনে আলতো ছোঁয়া দিয়ে কল করে বসলেন। রিং হচ্ছে। সাড়া নেই অপর পাশে। কল এনগেজড সিগন্যাল ভেসে ওঠার পর থেমে গেলেন তিনি। আঙুলের কাজ থেমে থাকলেও আবার কল করার ইচ্ছা জেগে উঠল। থমকে আছে আঙুলের ডগা। মন থমকে নেই। সচল মনে ধাক্কা খেলেন। কল ব্যাক করেছে

এক্সবুম। সেটের ভয়েস লাউড করে টেবিলে রাখলেন। একটা মেয়ে কণ্ঠ, কী! আসব!

জবাব দিলেন না, সায়েরা আমিন, প্রমিতের মা। চুপ করেই রইলেন।

শুনলাম তোমার বউ তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে! কথাটা কি ঠিক?

দ্বিতীয় প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না সায়েরা আমিন।

কী! চুপ করে আছো কেন? তুমি বললে আসব। না বললে আসব না। জোর করার বিষয় না তো!

সায়েরা আমিনের মাথা ঘুরে উঠল। এত ভদ্র আর সজ্জন প্রমিত

এক্সবুম নামে কার সঙ্গে জড়িয়েছে? কোনো অসৎ মেয়ের ফাঁদে পড়েনি তো ও! মন খেপে উঠলেও খারাপ কিছু চিন্তা করতে পারলেন

তিনি। যুগ খারাপ। যুগের আবহ খারাপ জেনেও ছেলে খারাপ পথে গেছে? তাঁর মাথায় উদ্বেগের আগুন তুষের আগুনের মতো জ্বলে উঠল।

ফোনসেট অফ করার জন্য হাত বাড়ানোর মুহূর্তেই সেট তুলে নিলেন হাতে।

সঙ্গে সঙ্গে আবার কল এলো, এক্সবুম!

এবার কল রিসিভ করে প্রশ্ন করলেন, কে আপনি?

নারী কণ্ঠের প্রশ্ন শুনেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল লাইনটা।

কলার কে আবিষ্কারের চেয়েও বড় চিন্তা ঢুকে গেল মাথায়। ছেলে কি তাহলে

এক্সবুমকেও কল করছে না? সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে!

তিন

বউমার কল পেয়ে উদ্বিগ্ন সায়েরা আমিনের রাত জাগার ক্লান্তি ঘুচে গেল। ফোন রিসিভ করেই প্রশ্ন করলেন, খবর পেয়েছো, বউমা? প্রমিত কি তোমাদের বাসায় গেছে?

না, সে বাসায় ফিরেছে কিনা, জানার জন্য ফোন করেছি।

তো, কী করব এখন?

বুঝতে পারছি না।

তাহলে চলো থানায় গিয়ে খোঁজ নিই।

আপনি একা যাবেন?

না। একা কেন? দুজনেই চল।

আচ্ছা, আমি আসছি। আপনি রেডি থাকুন।

সায়েরা আমিন শান্তি পেলেন। উদ্বেগের মাঝেও মনে শান্তি এলো দেখে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে ভাবলেন ওদের সম্পর্কে বড়ো ফাটল নিশ্চয়ই তৈরি হয়নি। মান-অভিমানের চাপে দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। নিশ্চয় এ দূরত্ব ঘুচে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো

এক্সবুমর কথা। তৃতীয়-জনের কাছে ভিড়ছে কেন ছেলে? এ ধরনের ঘেঁষা কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। শাশুড়ি হয়েও বউমার দোষ না ধরে ছেলের দোষ ধরতে পারছেন দেখে নিজেও স্বস্তি পেলেন। বুঝে গেছেন এ মুহূর্তে বউমার জোরালো সাপোর্টের কোনো বিকল্প নেই। এ ভাবনার পেছনেও ছেলের স্বার্থ জড়িত–তাও চেতন মনে নাড়া দিল। ছেলেকে উদ্ধারে বউমার শান্ত মেজাজই যথেষ্ট। ভাবতে ভাবতে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। প্রস্তুতি থেমে গেল ডোর বেলের শব্দ পেয়ে। দ্রুত দরজা খুলে দেখলেন

উবার থেকে নামছে প্রমিত। এক অপরিচিত তরুণ তাকে গাড়ি থেকে নামাতে গিয়ে তাল হারিয়ে পড়ে গেলেন সড়কের পাশে। আরেকজন দরজার সামনে ডোর বেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

আপনি কি প্রমিত সাহেবের মা? পাশে দাঁড়ানো তরুণের প্রশ্ন শুনে উদ্বেগের ঘোরে থাকা অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে সায়েরা আমিন জবাব দিলেন, হ্যাঁ। ওর মা।

মহাখালি ব্রিজের বড় পিলারের পাশে পড়ে ছিলেন উনি। ভোরে আমরা যাচ্ছিলাম মহাখালি বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আমাদের গাড়ি ওই দিক দিয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্য ভালো উবারের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পিলারের কাছে গিয়ে। ওনার কাতর ডাক শুনে তুলে নিয়েছি। কিছুটা শক্ত আছেন দেখে হাসপাতালে না নিয়ে বাসার ঠিকানা বলতে পারায় বাসায়ই নিয়ে এলাম।

ও ভালো আছে তো!

এখন ভালো। জ্ঞান আছে। কথা বলতে পারছেন। তবে শরীরটা বেশ দুর্বল। মনে হয় মলম পার্টির কবলে পড়েছিলেন, অজ্ঞান ছিলেন। সারারাত।

মলম পার্টি?

হ্যাঁ। তাই মনে হলো আমাদের। চোখে মলম ঢেলে অজ্ঞান করার সুগন্ধি মাখা রুমাল দিয়ে ওরা নাকে চেপে ধরে সব ছিনিয়ে নেয়। মনে হয় তেমন কিছু ঘটেছে প্রমিত সাহেবের সঙ্গে।

কথা শুনে কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলেও হঠাৎ ছুট দিলেন ছেলের দিকে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এলেন। ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। দয়া করে ঘরে আসুন।

না। না। আমরা বসব না। আমাদের দেরি হয়ে গেল। ময়মনসিংহ যাব আমরা। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমরা।

নিজেদের যাত্রা ভেঙে আমার ছেলেকে উদ্ধার করে এনেছে তোমরা। অনেক আদর আর দোয়া থাকল তোমাদের প্রতি। প্রথমে আপনি করে বললেও পরে সন্তানতুল্য ভেবে তুমি করে সম্বোধন করায় ওরা মাতৃস্নেহ পেয়ে খুশি হয়ে গেল। তারপরেও বলল, আন্টি, আমাদের যেতে হবে।

সায়েরা আমিন পরম স্নেহে দুই তরুণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ছেলের কাছে এলেন। চোখে-মুখে পানি দেওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি লাগছে প্রমিতের। তারপরও কোনো কথা বলছে না ও। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

কী করবেন, কী বলবেন বুঝতে পারছেন না সায়েরা আমিন। একপলক তাকালেন ছেলের দিকে। কপালে হাত রাখলেন। কোনো প্রশ্ন নেই। মুখে কোনো শব্দ নেই। তবে স্বস্তি এসেছে তার মনে। সারা রাত উদ্বেগে কাটিয়েছেন, থানায় গিয়ে জিডি করার কথা ভেবেছেন। এখন ভাবছেন কী খাওয়াবেন ছেলেকে। হঠাৎ মনে হলো ছেলে সকালে গ্রিন টি পান করে। চায়ের পানি গরম করার জন্য কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

চার

উবারে চড়ে এসেছে মিতু। সঙ্গে কন্যা রোদ্দুরও আছে। নামে রোদ্দুর হলেও কন্যার মুখে জমে আছে মেঘ। মিতুর চোখেমুখে মেঘ নেই। আছে উৎকণ্ঠা। ঝড়। মা-মেয়ে মেঘ আর ঝড় নিয়ে ঘরে ঢুকে চমকে উঠল। রোদ্দুর এক লাফে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। মেয়ের আনন্দধ্বনিও মিতুর নতুন বোধটা টলাতে পারল না। ও ভেবে নিয়েছে শাশুড়ি মিথ্যা বলেছেন। কৌশলে ওকে আর রোদ্দুরকে বাসায় ফিরতে বাধ্য করেছেন। অথচ প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিল স্বামীর অবস্থা চেঞ্জ না হলে, ফিরবে না আর এ বাড়িতে। ওর বোধে জেগে ওঠা শাশুড়ির মিথ্যা ছলনা ক্ষুব্ধ করে তুলল ওকে। ক্ষোভ থেকে অনড় এক মনোভাব জেগে উঠল ওর মনে। শাশুড়িকে চা নিয়ে আসতে দেখেও কোনো কথা ফুটল না ওর মুখে।

চা হাতে এগিয়ে এসে শাশুড়ি দেখলেন মিতুকে। হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি এসে গেছে, বউমা?

দেখতেই তো পাচ্ছেন আমাকে।

রোদ্দুর আসেনি?

আপনার কী মনে হয়, রোদ্দুরকে আমি রেখে আসতে পারি?

না। তা নয়। কখনই রেখে আসবে না। জানি আমি।

তো! প্রশ্ন করলেন কেন?

বউমার কাট কাট কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন সায়েরা আমিন। ছেলের দুর্দশার কথা বলতে ভুলে গেলেন। ধীরে ধীরে ঢুকলেন ওদের শোবার ঘরে। খাটে শুয়ে আছে প্রমিত। কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, এখন কেমন লাগছে, বাবা?

রোদ্দুরকে দেখে ভালো লাগছে। রোদ্দুর বলল ওর মাও এসেছে। সে কোথায়, আম্মা?

ওকে তো দেখলাম ঘরের বাইরে দাঁড়ানো। বোধ হয় রেগে আছে এখনও। নিশ্চয় তোমার সব কথা শোনার পর সহজ হয়ে যাবে।

বলোনি? আমার কী হয়েছে জানে না সে?

না, বলিনি। বলার সময় পেলাম কোথায়? ওরা তো এইমাত্র এলো বাসায়।

শাশুড়ি ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে নেই বউমা। কোথায় গেল? চিন্তিত হয়ে খুঁজতে খুঁজতে বাসার বাইরে এলেন সায়েরা আমিন। বিস্ময় নিয়ে দেখলেন একটা সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে বসেছে সে। একবার চিৎকার করে ডেকে বললেন, প্রমিত ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিল। মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে। দুই তরুণ তাকে দিয়ে গেছে বাসায় কিছুক্ষণ আগে।

সিএনজি অটো শব্দ ছেড়ে পেছন থেকে সাদা ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে গেল সামনে। সায়েরা আমিনের কথা তার কানেই ঢুকল না। এই ফাঁকে ছুটে এসেছিল রোদ্দুর। মাকে চলে যেতে দেখে চিৎকার জুড়ে দিল। তারপর চোখের পানি মুছতে মুছতে বাবার বুকে এসে শুয়ে পড়ল। কান্না জড়ানো গলায় বলল, মাম্মি চলে গেছে! কথা শেষ না করে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে।

রোদ্দুরের কান্নায় বুক ভারী হয়ে গেল প্রমিতের। মেয়েকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে সেও কাঁদতে লাগল। দরজায় দাঁড়িয়ে সায়েরা আমিনও চোখের পানি মুছলেন নিঃশব্দে। হাউস গভর্নেন্স, বিণা এসে সায়েরা আমিনের উদ্দেশে বলছে, খালাম্মা মোবাইল লন হাতে। মিতু আফারে বেবাক বুঝাইয়া কন। নিশ্চয় আফা ভুল বুঝছে। ভাবছে ভাইজান বাসায় আছিল, আপনি তারে মিছা কথা কইছেন।

বিণার কথা শুনে বউমার চলে যাওয়ার বিষয়টা চমকে দিল শাশুড়িকে। এসেও চলে যাওয়ার এটাই প্রথম কারণ হতে পারে, বুঝতে পারলেন। আচমকা জেগে ওঠা ক্রোধের কারণে আগে-পিছে কিছু ভাবার সময় পায়নি বউমা। ওর প্রাণের টুকরো রোদ্দুরকেও নিতেও ভুলে গেছে। নিশ্চয় ভুল ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সে। ঘোরের মধ্য থেকে বেরুতে পারেনি। আর তাই কোনো প্রশ্ন না করে নিজে মনে মনে যা চিন্তা করেছে, তার জন্য এমন আচরণ করে ফেলেছে। এমন ভাবনা কষ্ট আর উদ্বেগ কমিয়ে দিল। তখনই তিনি কল করলেন মিতুকে।

মোবাইল সুইচ অফ। ঢুকছে না কল। কী ভয়াবহ ব্যাপার। আবার কল করলেন! বারবার। না বউমাকে ধরতে পারলেন না।

চোখ মুছতে মুছতে রোদ্দুর এলো দাদুভাইয়ের কাছে। প্রশ্ন করল, কল ধরেছে, মাম্মি?

না।

আমারে দাও, দাদু। আমি কল করি।

এখনো ভালো করে কল করতে পারে না ও। তবে মায়ের মোবাইল নম্বর মুখস্থ আছে। ফোনবুক থেকে নাম বের না করে, ডায়াল অপশনে গিয়ে ওর মায়ের মুখস্থ নম্বর টিপে ও কল করল। স্যরি মোবাইল সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না–এ কথার মানে জানে রোদ্দুর। আচমকা সে কাঁদতে লাগল আবার। ছুটে এসে আবার ওর বাপিকে জড়িয়ে ধরল।

শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছিল। উঠে বসে মাথা চক্কর খেয়ে শুয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার মাম্মি ফিরে আসবে। ভুল বুঝে চলে গেছে। ভুল কেটে গেলে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এখন গরম আছে। থাকুক। কিছুক্ষণ পর আমার টানে না হোক, তোমার টানে চলে আসবে।

বাপির কথা শুনে মেয়ের মন শান্ত হয়ে গেল, তা না। তবে ওর কান্না থেমে গেল। শুয়ে রইল বাপির পাশে। হালকা শীত-শীত লাগছে। তাই নিজের গায়ের চাদরটা তুলে দিল ওর গায়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *